শিকলি কাটা পাখি – ১

আশাপূর্ণা দেবী

‘আমি তোমায় ষ্টাম্পো পেপারে লিখে দিতে পারি রাখালদা, ওই ছোঁড়াটা ছেলে নয়।’

সুধো তার কথায় গুরুত্ব আরোপ করতে চৌকির ওপর একটা ঘুসি বসায়।

রাখাল কিন্তু আদৌ ওর কথায় গুরুত্ব দেয় না। কেউই দেয়না কোনদিনই, সবাই জানে সুধো একটা ‘বক্তার ছেলে’। ওর যে একটা ভব্যিযুক্ত আস্ত নাম আছে, সেটাও ভুলে গেছে সবাই, শুধু দলের খাতায় নামটা পুরো লেখা আছে, মাইনে নেবার সময় সেই নাম সই করে সুধো—শ্রীসুধাংশুমোহন ঘোষাল।

ব্যস ওই পর্যন্ত, বাকি সময় সে সুধো। তবে ঠিক অবহেলা নয়, অমনি একটা আলগাভাব আর কি। নচেৎ ছেলেটাকে ভালবাসে দলের সবাই।

অনেকেরই মধ্যে অনেক রেষারেষি আছে। কিন্তু সুধোর সঙ্গে কারুর সে সব কিছু নেই, সুধো অজাতশত্রু।

তার কারণ সুধো শুধু যে ছেলেটাই ভালো তা নয়, সুধোর রং কালো হলেও চেহারাখানি ভালো, কথাবার্তা আকর্ষণীয়। আর গানের গলাটি উত্তম।

তাছাড়া সে মুখে মুখে গান বাঁধতে ওস্তাদ।

সুধোর আর একটা মস্ত গুণ, সুধো ছুটি চায় না, বাড়ি যায় না।

দেশের বাড়িতে না কি মা বাপ আছে সুধোর, কিন্তু সে কথা তুললে সুধো অম্লান মুখে বলে, ‘তারা আমায় খরচের খাতায় লিখে রেখেছে। আবার যাওয়া আসা করে জঞ্জাল বাড়াই কেন?’

ওর দেশের কাছাকাছি থাকে এমন একজন চুপিচুপি জানিয়েছিল ওর মা নাকি সৎমা, আর দ্বিতীয়পক্ষে বিয়ে করে বাপ নাকি সৎ বাপের অধম হয়ে গেছে। সেই দুঃখেই ঘর ছেড়েছে সুধো।

কিন্তু সুধোর জীবন সম্পর্কে কেউ প্রশ্ন করলে সুধো বলে, ‘শুধু কি দুঃখেই ঘর ছাড়ে মানুষ? সুখে ছাড়ে না? এই যে ভগবানের রাজ্য খানা? এটা দেখবার সুখে ঘর ছাড়ে না?’

তা’ যে কারণেই হোক, সুধো ঘরছাড়া, আর ঘরছাড়াদের প্রতি মমতা মানুষের সহজাত, বিশেষ করে মনিবের।

রাখাল ওর মনিবও বটে বন্ধুও বটে।

দলের আর কেউ রাখাল দাসের সামনে এমন ফ্রী ভাবে কথা বলতে পারে না, যেমন সুধো পারে।

সে রাখালের সামনে ঘুসি মেরে বক্তব্য প্রতিষ্ঠিত করবার সাহস করতে পারে।

অতএব রাখালদাস তার কর্মচারীর এই দুর্বিনয়ে বিরক্ত হলো না, বরং হ্যা হ্যা করে হেসে বলে উঠলো, ‘ভালো কথাটাই বললি সুধো, বেড়ে! ‘ছোঁড়াটা’ ছেলে নয়। তবে কি? মেয়ে?’

‘আলবাৎ মেয়ে। বলেছি তো স্ট্যাম্পো কাগজে লিখে দিতে পারি।’

একথা দলের আর কারো কাছে বললে তারা যে কি রসালো পরিহাস উক্তি করে বসতো কে জানে, কিন্তু রাখাল সেদিক দিয়ে গেল না। রাখাল সভ্য ভব্য। রাখালের আভিজাত্য আছে। তাছাড়া সুধো যে শুধুই ‘রাখালদা’ বলে ডাকে তা নয়, রাখালও দাদার মতো মনোভাব পোষণ করে।

রাখাল তাই শুধু বললো, ‘অনুমানটা এমন অভ্রান্ত মনে হচ্ছে কেন সুধোচন্দর? বললো কে?’

‘বললো ওর চলন বলন চেহারা, গলার স্বর।’

‘অনেক বেটাছেলেরও ওরকম মেয়েলি স্বর হয় রে সুধো! বিধাতার সৃষ্টি এই মানুষ জাতটার হদিস পাওয়াই শক্ত। কতো মেয়েলি বেটাছেলে দেখলাম, কতো ছেলেলি মেয়ে মানুষ দেখলাম।’

‘আচ্ছা’ সুধো বলে, ‘এবারের দেখায় তফাৎ আছে কি নেই বুঝো।’

‘তা গলাটা কিন্তু ফাস্টক্লাশ মাইরী। গান বাঁধারও কায়দা আছে। আমার ধারণা ছিল আমার এই ‘বসন্তবাহার কবির লড়াই’ পার্টিতেই শুধু তোদের মতন কম বয়সীদের নিয়ে কাজ কারবার। ও ছোঁড়াকে মনে হলো তোর থেকেও অল্পবয়সী।’

‘ছোঁড়া নয় মেয়ে।’ সুধো গম্ভীরভাবে বলে, ‘চোখের দিকে ভালো করে তাকালেই বুঝতে পারবে।’

‘অমন বাহার করে কাজল পরলে এই রাখাল দাসের চোখেও বিদ্যুৎ ঝলসাবে সুধো! মেয়ে অমনি হলেই হলো? বাঘ ভালুকের খাঁচায় কেউ একটা হরিণ রাখে? অতোগুলো বাঘ ভালুক রয়েছে না দলে?’

‘নাম ভাঁড়িয়ে ছদ্মবেশে এসেছে নিশ্চয়?’

‘মাথায় ওই এক বৃথা চিন্তা ঢোকাসনি সুধো! ছদ্মবেশে এসেছে! বলি অতো—লোক রাতদিন সঙ্গে সঙ্গে থাকছে তারা ধরে ফেলতো না? আর তুই আসরে বসে দুটো গানের লড়ালড়ি দিয়ে ছদ্মবেশ ধরে ফেললি? আসলকথা তোর ভেতরে ভয় ঢুকেছে।’

‘ভয়? কিসের ভয়?’

‘হেরে যাবার ভয়। ছোঁড়াটা তো কাল তোকে প্রায় কাৎ করে এনেছিল।’

‘অতো সোজা নয় রাখালদা—’

‘তা’ তো নয়ই। শেষ অবধি অবিশ্যি জোর রাখতে পারলো না।’

সুধা হঠাৎ বলে ওঠে, ‘আচ্ছা রাখালদা, এই যে মল্লিকরা যারা পূজোয় আমাদের ডেকেছে, এদের আর কোনো শরীক টরীক আছে?’

‘কে জানে। কেন?’

‘না তাহলে আর একদিন বায়না পাওয়া যেতো।’

‘দূর পূজো ফুরলে আর কে বায়না দেবে?’

‘দেবে না কেন? কোজাগর পর্যন্ত ঘটা চলে। রাণাঘাটে গিয়ে কী হয়েছিল সেবার? আসতেই পাওয়া যায় না।’

‘এদের তো শুনেছি এই দুই শরীকের পালার পূজো। ভাগ করে দুদিন দুদিন। বড়কর্তার সপ্তুমি—অষ্টমী, ছোট গিন্নীর নউমী—দশুমী।’

‘কিন্তু রাখালদা, কালকের মতন ভীড় কি হবে? অষ্টমীর ভীড় আর নউমীর দিনের ভীড় এক নয় রাখালদা!’

‘তা নয়, তাছাড়া দুই শরীকের অবস্থাও তো এক নয় সুধো। একদিকে শুধু বিধবা নিঃসন্তান, অপরদিকে কর্তা, গিন্নি, ছেলে—মেয়ে চাঁদের হাট বাজার। ভোগের পেসাদেও তফাৎ হবে। তবুতো সমান করে দুজনে কবির লড়াই, যাত্রা পালা দিচ্ছে।’

‘তা দিচ্ছে। অহঙ্কারে খাটো হবে কেন?’

তা সত্যি। জমিদারী না থাকলেও জমিজমা আছে, এবং পালার পূজোও আছে। এই উজিরপুরে ওই একখানিই দুর্গা পূজো। ওই পালার পূজো।

প্রবল শরীক, জিতেন্দ্রভূষণ মল্লিকের দু’দিনের পূজোয় একদিন জনার্দন অপেরার যাত্রা ও একদিন ‘নীলমণি মান্না’ কবির লড়াইয়ের দলের লড়াই হয়ে গেছে। বাকি দুদিন দুর্বল শরীক মনোরমা মল্লিকের আহূত—এই বসন্তবাহারের কবির লড়াই! আর—

‘রামকৃষ্ণ অপেরার লীলা খেলা।’

‘এই ‘রামকৃষ্ণ’ কিন্তু অপেরা পার্টির কর্তার নামে নয়, সেই দক্ষিণেশ্বরের পাগলা ঠাকুরের ব্যাপার। তাঁর স্বপ্নাদেশেই নাকি এর পত্তন।’

সুধো ‘বসন্তবাহারের’ আসল বাহার।

একহাতে তালি বাজে না, তাই বসন্তবাহারে আর নীলমণি মান্নার দলে তালি বাজাবাজি।

আসর সেই মল্লিকদের ঠাকুর দালানের উঠোন।

উঠোনের মাঝখানের হাঁড়িকাঠটা বাদ দিয়ে আসর সাজানো হয়েছে। পাছে কারো পায়ে ঠেকে, তাই গোটাকতক বাখারির টুকরো এনে একটু বেড়া দেওয়া হয়েছে। তবে ভক্তজনের হাঁড়িকাঠের মাটি আহরণের ঠেলায় একদিনেই সে বেড়ার অনেকটা গেছে, আশা করা যাচ্ছে আজ বাকিটা যাবে।

যাক। নবমীর পাঁঠারা তো বেলা দশটার মধ্যেই খতম হয়ে গেছে। আর দরকার কী?

সুধো স্নানের আগে পুকুরপাড়ে বেশ যত্নের সঙ্গে পৈতে মাজছিল।

গুপী গামছা গায়ে জড়িয়ে এসে বসলো। বললো, ‘পৈতে শাদা বামুন গাধা! পৈতে মাজছিস কেন রে ভাগ্নে?’

গুপীকে সুধো কী সুবাদে কে জানে মামা বলে, তাই গুপী ভাগ্নে বলে।

সুধো বলে, ‘সুধো চিরকেলে গাধা মামা, নতুন করে আর কী হবে?’

‘আহা তুই আমাদের দলের সাধা গাধা। তবে মাঝে মাঝে ধোপার গাধার মতন কথা বলে বসিস। মনিবের কাছে কী বলেছিস রে? তাই নিয়ে হাসির হুল্লোড় পড়ে গেছে।’

রাখালদাসকে বেশীর ভাগ সবাই ‘মনিব’ বলেই সম্বোধন করে।

কী বলেছে সেটা বুঝতে দেরী হয় না সুধোর, তবু তাচ্ছিল্যের গলায় বলে! ‘কী বলেছি?’

‘যা বলেছিস মাইরী, বেশ মজার কথাই বলেছিস। তা’ ভাগ্নে ওই ছেলেটা মেয়েছেলে তা তোকে কে খবর দিয়ে গেল?’

সুধো গম্ভীরভাবে বলে, ‘ভগবানদত্ত চোখ দুটোই দিলো খবর।’

‘আরে হাবা, চোখ তো সবাইকেই দিয়েছে ভগবান। কেউ বুঝলো না, আর তুই বুঝে ফেললি?’

সুধো কথায় হারে না, গম্ভীরভাবে বলে, ‘সব চোখ যদি ‘চোখ’ হতো তা হলে তো ভাবনাই ছিল না মামা!’

‘সব চোখ চোখ নয়? তোর চোখটাই চোখ?’

সুধো অম্লান বদনে বলে, ‘তা’তে আর আশ্চর্য্য কী? গলা তো তোমাকেও দিয়েছে ভগবান, আর সুধাংশু ঘোষালকেও দিয়েছে, তবে একজনের গলায় ঢাক বাজে কেন, আর একজনের গলায় বাঁশী?’

গুপী কথাটা একটু অনুধাবন করে নিয়ে গম্ভীর হয়ে গিয়ে বলে, ‘হুঁ। অহমিকা হয়েছে। অহমিকা! হবে নাই বা কেন? মনিব যে মাথাটি খাচ্ছে। তোকে যেমন ‘লাই’ দেয় তেমন আর কাকে দেয় বল?’

সুধো দুষ্টু হাসি হেসে বলে, ‘দেবে না কেন? গুণ দেখে, তাই দেয়।’

তারপরই হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গিয়ে বলে, ‘তা বলে হঠাৎ যদি সুধোর গলায় ক্যানসার হয়, আর দেবে?’

‘দুর্গা। দুর্গা। ছোঁড়ার মুখে কিছু আটকায় না।’

বলে গুপী জলে নামে।

সুধোও নামে।

আর গুন গুন করে গায়, ‘আমি ডুব জলে নামিলাম সই তলিয়ে যাবার তরে।’

আগে সুধো নাইতে খেতে যখন তখন গলা ছেড়ে গান গাইতো, এখন গায় না। রাখাল বারণ করে দিয়েছে। বলে, ‘যখন তখন গলা ছাড়িসনে সুধো, সস্তা হয়ে যাবি।’

সুধো এখন গুনগুনোয়।

একসময় সেটা থেমেও যায়।

সুধো গান করতে করতে সন্ধ্যার আসরটার কল্পনায় বিভোর হয়।

বিকেল থেকেই আসরে ভীড় জমেছে। জায়গা দখলের আশায় মেয়ে মহল বেলা দুপুরেই রাতের রান্না সেরে নিয়ে কোলে কাঁখে দুধের বাচ্চাদের নিয়ে এসে বসে আছেন।

পুরুষদের দিকটা এখনো ফাঁকা। ওঁরা অতো হ্যাংলা নন, ওঁরা ধীরে ধীরে আসবেন।

বেশ কয়েকটা ‘পেট্রোম্যাক্স’ মজুৎ করা হয়েছে, আর উঠোন থেকে অনেকগুলো সিঁড়ি উঁচুতে ঠাকুর দালানের মধ্যে তখন থেকেই একটা জ্বেলে রাখা হয়েছে।

লড়াইকামী দুই দলের জায়গা রাখা হয়েছে দুদিকে, মধ্যবর্ত্তী খানিকটা অংশ ফাঁকা রাখা হয়েছে। বোধ করি রণক্ষেত্র হিসেবে।

বসন্তবাহারের দল আগে এসে বসলো।

গায়ক বাদক কর্তা।

হারমোনিয়াম বাজায় সন্তোষ, সে আবার একটু বাবু প্যাটার্ণের, তাই হারমোনিয়ামটা বয়ে এনে ধুপ করে বসিয়ে দিল দোয়ার জগন্নাথ। হারমোনিয়ামের হ্যাণ্ডেলে একটা জবার মালা জড়ানো।

মূলগায়েনের গলায় রজনীগন্ধার মালা।

এরপর মান্না কোম্পানীর দল এসে বসলো।

ওদের সাজ সরঞ্জাম দামী, পোষাক আশাক দামী, এবং তরুণ গায়েনের মুখটাতেও সেই দাম সম্পর্কে চেতনার ছাপ।

ওর নাম বটেশ্বর।

নামটা বেশ সৃষ্টিছাড়া তাতে সন্দেহ নাই। বিশেষ করে এমন একখানি সুকান্তি তরুণের অমন নাম!

শুনে পর্য্যন্ত লোকে বলাবলি করেছে নিশ্চয় বটেশ্বর শিবের দোর ধরা।

হয়তো তাই, তবে সাজসজ্জায় শিবের সরলতা বা শিবের অনাড়ম্বরতা নেই।

জরিপাড় কোঁচানো ধুতির ওপর চুড়িদার পাঞ্জাবী। পাঞ্জাবীর উপর আবার বেগুনী ভেলভেটের জহরকোট। সেই গাঢ় বেগুনী রঙের উপর অনেকগুলো মেডেল ঝকমক করছে।

চোখে সরু সুর্মা টানা, চুল কোঁকড়া কোঁকড়া ঘাড়ে ঝাঁপানো।

বটেশ্বরের হাত দুটি যেন মোম দিয়ে মাজা। তবে সত্যি ফর্সা কিনা বোঝবার জো নেই, এরাও আজকাল যাত্রা থিয়েটারের অ্যাক্টারদের মতো পেণ্ট করতে শিখেছে।

আজ মান্না কোম্পানীর অগ্রাধিকার সেই কথাই জানিয়ে মান্নাবাবু করজোড়ে সকলের কাছে নিবেদন করেন, বাবু ভদ্দরলোকেরা যেন দোষ ত্রুটি মার্জ্জনা করেন। তার দলের নবীন গায়েন বটেশ্বরের শিক্ষা থাকলেও, বয়স অল্প কাজেই—ইত্যাদি।

এরপর বটেশ্বর উঠে দাঁড়ালো।

প্রথমে তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর চরণ বন্দনা করা বিধি।

বটেশ্বর উঠে দাঁড়িয়ে কুর্ণিশের ভঙ্গীতে সভাস্থ সকলকে নমস্কার জানিয়ে দেবী দুর্গার দিকে মুখ ফিরিয়ে কিছুক্ষণ বিড়বিড় করে হাঁটুগেড়ে বসে প্রণাম করে নেয়।

তারপর যেন ঘুম ভেঙে লাফিয়ে ওঠার মতো আসরের মাঝখানে সরে এসে বাঁশীর মতো সরুগলায় শুরু করে—

তেত্রিশ কোটি দেবদেবী—

সবার চরণ সেবি,

 বটেশ্বর মাগে বরাভয়,

সকলে প্রসন্ন মনে

আশীসো গে অভাজনে

 এই রণে যেন হয় জয়।

সরু বাঁশীর সুর আস্তে আস্তে চড়তে থাকে, বটেশ্বর দু’লাইনে তেত্রিশ কোটী সেরে নিয়ে দুর্গামণ্ডপের দিকে ফিরে সুর করে গান গায়।

জয় জয় জগন্মাতা দেবী ভগবতী—

অভাগারে দেহ মা গো

 এ চরণে মতি।

রণক্ষেত্রে দাঁড়ায়েছে অবোধ সন্তান,

কণ্ঠে সরস্বতী দিয়ে

 রাখো তার মান।

কলের পুতুলের মতো চারিদিক মুখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গাইতে থাকে বটেশ্বর—

মরালবাহিনী সুশুভ্রবরণী

 বাগদেবী বীণাপাণি,

 ও রাঙা চরণে নিয়েছি স্মরণ

আর কারে নাহি জানি।

ভীড়ের মধ্যে থেকে কে একটা ঠেঁটা—ছেলে টুক করে বলে ওঠে। ‘তেত্রিশকোটীর সবাইকেই তো জানো গুরু।’

বটেশ্বরের কান এড়াল না, বটেশ্বর শুধু ওই ভীড়ের মধ্যে একবার দৃষ্টিপাত করলো, কিন্তু অচঞ্চল গলাতেই বন্দনা শেষ করলো—

তব কৃপা পেলে

জিনি অবহেলে

 শত্রুরে সম্মুখ রণে

কৃত্তিবাস আদি—

সবারে সম্বোধি—

 দীন বটেশ্বর ভনে।

ভীড়ের মধ্যেই সেই ইয়ার গলাটা আবার বলে উঠলো, ‘ভনিতা ছেড়ে এবার লাগো প্রভু—’

ভীড়ের মধ্যে থেকেই একটা গোলমাল উঠলো, ‘কে? কে রে অসভ্যতা করছে? আসর থেকে বার করে দাও, কান ধরে বার করে দাও। জুতো মেরে বার করে দাও।’ অসভ্যতা নিবারণের জন্য বেশ খানিকটা অসভ্যতার পালা অভিনয় হয়ে গেল।

বটেশ্বর কিন্তু অচঞ্চল।

বটেশ্বরের কোঁকড়া চুলে ঘেরা মুখে যেন দিব্য জ্যোতি, যেন বরাভয়ের আশ্বাস।

বটেশ্বর এবার ভাবে গদগদ বন্দনা গান বন্ধ করে সুউচ্চ বাঁশীর সুরকে মাঝারি পর্দায় নামিয়ে এনে গেয়ে ওঠে—

‘মরি আহারে!

শরৎকালে দেখিলাম ‘বসন্ত বাহারে।’

এখন বলুন দেখি সুধাংশুদা—

 আপনার নামের মানে কী?

আয়না ধরে দেখুন দাদা,

 মনে হচ্ছে—পান্তাভাতে ঘী।’

‘সুধাংশুদা’ সম্বোধনেই আসরে একটা হাসির গুঞ্জন শোনা গিয়েছিল, শেষের লাইনটায় হাস্যরোল উঠলো।

কারণ সুধাংশু দেখতে সুঠাম সুশ্রী হলেও রং কালো।

তাছাড়া তার বুকেও মেডেলের মালা আছে বটে, কিন্তু সাজ সজ্জায় অতো জৌলুস নেই। সুধাংশু পেণ্টও করে না।

এরপর আর সুধাংশু চুপ করে বসে থাকতে পারে না।

হুঙ্কার দিয়ে লাফিয়ে উঠে গলা ছাড়ে সুধাংশু—

‘বটা তুই—

 কাজল এঁকে চোখ করেছিস,

পেণ্টো করে রং

তোর চাল চলনে উঠছে ফুটে

 মেয়ে—ছেলের ঢং

রূপ দেখিয়ে আসর মাতায়—

 সুধো, এমন বান্দা নয়,

গুণের লড়াই হোক রে বটা—

 দেখি কাহার জয়।’

সঙ্গে সঙ্গে বটেশ্বরের মুখে খই ফোটে,

 ‘গুণের বড়াই দেখাতে চাও

 ওহে গুণমণি—

 বল দেখি গণেশবাবুর

 মামা কেন শনি?’

শনি কী সুবাদে গণেশের মামা, কবির লড়াইয়ে এটা একটা কঠিন প্রশ্ন নয়, কিন্তু হঠাৎ সুধো যেন স্মৃতি শক্তি হারিয়ে ফেলে।

সুধো ওই প্রচলিত গল্পটা ভুলে যায়।

এক সেকেণ্ড, দু সেকেণ্ড, দশ সেকেণ্ড। বিশ, ত্রিশ—

এইটুকুই যথেষ্ট।

শ্রোতাদের মধ্যে গুঞ্জন ধ্বনি ওঠে, ‘পারছে না পারছে না।’

রাখালদাসের মুখ শুকিয়ে আসে।

কী আশ্চর্য এই সামান্য কথাটার উত্তর দিতে পারছে না সুধো?

রাখাল দাসের মনে পড়ে যায় সুধোর কথাটা—’ওই বটেশ্বর? ও ছোঁড়া ছেলে নয়।’

ওই, ওই এক উৎকট ধারণা মাথায় ঢুকেই ছোঁড়া বেসামাল হয়ে গেছে।

এখন কী হবে?

আর একটা মিনিট পর্য্যন্ত—

তার পরই তো হাত তালি পড়বে।

ছিঃ ছিঃ হাত তালি!

কিন্তু ততক্ষণে সামলে নিয়েছে সুধো।

ওই প্রচলিত গল্পটা মনে না পড়লেও সুধো অন্য জাল বিস্তার করেছে—

‘স্বর্গভূমে কে কার বাবা,

 কে কার পিসেমশাই—

হিসেবটা তার ঠিক আছে তোর—

 ওরে আমার বটাই?

মা দুগ্গার মাসতুতো বোন

 তাঁর দিদিমার নাতি

তিনি শনি, মায়ের মামার

 বংশে দিতে বাতি।

বুঝলি এখন?

 শনি কেন গণপতির মামা?

না বুঝিস তো

 সেলাম ঠুকে কবির লড়াই থামা।’

রাখাল দাসের বুঝতে বাকি থাকে না সুধো হেরে যেতে যেতে একটা চালাকি খেলে ডুবো নৌকোটা ভাসিয়ে তুলেছে। মান্না কোম্পানীও রাগে গরগরালো, কিন্তু শ্রোতার দল চট করে ধরতে পারেনা। তারা তখন ‘মাসতুতো বোনের দিদিমার নাতি’র ধাঁধাঁয় ঘুরছে।

বটেশ্বর এই কুটিল চক্রান্তের একটা উচিত মতো উত্তর দেবার চেষ্টা ভাঁজছিল এই সময় হঠাৎ ড্যাডাং ড্যাডাং রবে ভোগারতির বাজনা বেজে উঠলো।

এটি মল্লিক বাড়ির বিশেষ প্রথা।

সন্ধ্যা আরতির পর যথারীতি বৈকালীর ভোগরাগ সমাধা হলেও রাত বারোটায় একটি বিশেষ ভোগ হয়, ‘ক্ষীরভোগ।’ এ আরতি তার।

এঁদের পূর্বতন কর্তা বলতেন, ‘ছেলে—পুলে যেমন ঘুমের আগে দুধ খেয়ে শোয়, আমার মা বেটি তেমনি ক্ষীর খায়।’

ঢাক ঢোলের শব্দে কিছুক্ষণ লড়াই বন্ধ থাকলো।

ইত্যবসরে রাখাল চুপি চুপি বললো, ‘সুধো তোর হলো কী? আরটু হলে যে ফেঁসে যাচ্ছিলি? যাই হোক খুব একখানা ম্যানেজ করে নিয়েছিস। আজ মা দুগগা তোর সহায়, কিন্তু এবার তুই একখানা মোক্ষম চাপান দে সুধো যাতে ও ছোঁড়া কাৎ হয়ে যায়।’

সুধো তৎক্ষণাৎ রাখালের কথার প্রুফ কারেকশান করে দেয় ‘ছোঁড়া নয়, ছুঁড়ি।’

এরপর জমে উঠলো লড়াইয়ের উন্মাদনা। গালমন্দ, ব্যক্তিগত আক্রমণ। যারা লড়ছে, তাদের থেকে অনেক বেশী উত্তেজিত শ্রোতারা।

রাত প্রায় ভোর হয়ে আসে।

সুধো শেষ লড়া লড়ে ‘জবাব’ দেয়!

অধ্যায় ১ / ১১

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন