কলম সরদার

লীলা মজুমদার

আমার ছোট ঠাকুরদা একদিন বললেন, ভূতফুত কিছু না। কেন যে পাঁচির মা রাতে ছাদে গিয়ে কালো কুকুরকে অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখে ভয় পেল এ আমি ভেবে পেলাম না। ভূত আবার কী?

বুঝলি, গত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় বোমার ভয়ে কলকাতা শহর ভোঁ-ভোঁ। রাতে পাড়ার মধ্যেও থমথম করে। বাড়িতে থাকলে বাইরে যেতে ভয় করে, বাইরে থাকলে অন্ধকারে খালি বাড়িতে ঢুকতে ভয় করে। ভয়টা শুধু জাপানি বোমার ভয় নয়। চুরি-ডাকাতি, নিখোঁজ হওয়া, সব রকম। ভয় ছিল লোকের। খানিকটা সত্যি, খানিকটা মন-গড়া।

সে একদিন গেছে। পাছে শত্রুদের বোমারু আলো দেখতে পেলে ঠিক জায়গাটিতে বোমা ফেলে, তাই আলো দেখানো বারণ ছিল। আলো দেখালে পুলিশে ধরত। সবার জানালা-দরজা বন্ধ, মোটা কালো পরদা দিয়ে ঘেরা, আলোর চারদিকে কালো কাগজের ঘেরাটোপ। শুধু বাতির তলায় একটুখানি আলো পড়ে, বাকি সব অন্ধকার। পড়াশুনো কাজকর্ম সকলের মাথায় উঠেছিল। রাত আটটার পর বাইরে বেরুতে হলে পারমিট দরকার হত।

তবে আমার কথা আলাদা। আমি নতুন পুলিসে ঢুকেছি, আমাদের সুদ্ধ মিলিটারি বানিয়ে দিয়েছে। জানিস্ নিশ্চয়, যারা নতুন পুলিসে চাকরি নেয়, তাদের দিয়েই সবচেয়ে বিপজ্জনক কাজ করানো হয়। কারণ দক্ষ দুঁদে লোক মরে গেলে বেশি ক্ষতি হয়।

সে যাই হোক, আমার উপর চব্বিশ ঘণ্টা কালীঘাটে খানা-তল্লাসীর ডিউটি পড়ল। কুখ্যাত চোর-গুণ্ডা কলম সরদারকে খুঁজে বের করতে হবে। মেলা সোনাদানা নিয়ে সে ফেরারী হয়েছে, অথচ পুলিসের খবর যে সে শহরের মধ্যেই কোথাও গা ঢাকা দিয়েছে। সম্ভবত কালীঘাটে কি খিদিরপুরে, কি চেতলায়। এমনিতেই কলমের পিছু নেওয়া মানে প্রাণটি হাতে নিয়ে বেরুনো। তার উপর খাঁ-খাঁ খালি, কালীঘাট মানেই ভূতের হাট। সত্যি কথা বলতে কী আমি খুব সাহসীও ছিলাম না তখন। সঙ্গে একটা লোক পর্যন্ত দেয়নি আপিস থেকে।

সুখের বিষয় কলমের মোটা বেঁটে কদমছাঁট চুলওয়ালা চেহারা দূর থেকেও চেনা যেত, সাবধান হওয়া যেত, বামাল ধরতে পারলে এখুনি প্রমোশন, নচেৎ— এই অবধি— বলে আমাদের বড়সায়েব আমার দিকে একবার তাকিয়ে এক দাঁত কিড়িমিড়ি করলেন। আমি জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বললাম— হ্যাঁ স্যার, ধরে আনছি স্যার। বড়সায়েব আমাকে তিন দিন সময় দিলেন।

আসলে কালীঘাটে তদন্ত করতে আমার খুব বেশি আপত্তি ছিল না। ঐখানে খালের ধারে আমার বন্ধু জগার বাড়ি। বাড়ির বাকি সবাই ঘাটশীলায় ছিল; শুধু জগা আর তার রাঁধুনে বামুন শঙ্কর, যার রান্না একবার খেলে আর ভোলা যায় না। ঠিক করলাম ওদের বাড়িটাকেই তদন্তের হেডকোয়ার্টারস্ করতে হবে। কলমকে সঙ্গে না নিয়ে আর আপিসমুখো হওয়া নয়।

পথের আলোয় ঘেরাটোপ দেওয়া, কিছুই দেখা যায় না। প্রায় অনেকটা আন্দাজে তদন্ত চলল। তবে কলম নিজেও নিশ্চয় ভারি নিরাপদ মনে করে খানিকটা অসাবধান হয়ে পড়েছিল। তাছাড়া আমিও একরকম অদৃশ্যভাবেই চলাফেরা করতাম। আগাগোড়া কালো পোশাক, পায়ে কালো রবারের জুতো, মাথায় তখন কালো কুচকুচে চুলও ছিল। জুতোর জন্যে প্রায় নিঃশব্দে চলি। রাত হয়তো একটা হবে, রাস্তার মিটমিটে আলোয় চমকে দেখি আমার হাত পাঁচেক সামনে যে হনহনিয়ে চলেছে সে যে কলম সরদার, সে বিষয়ে কোনো ভুল হতে পারে না।

সামনেই প্রকাণ্ড পুরোনো বট-অশ্বত্থে ছাওয়া আমলা-বাড়ি। পঞ্চাশ-ষাট বছর সেখানে কাউকে বাস করতে দেখা যায়নি। জগা বলে— বাড়িটার বড় বদনাম, দিনের বেলাতেও কেউ সেখানে যায় না। কলম দেখলাম স্বচ্ছন্দে তার ফটকের মধ্যে ঢুকে পড়ল। বলা বাহুল্য আমিও ঢুকলাম। ঘাস-গজানো খানিকটা কাঁকরের পথ, তারপরেই নড়বড়ে গাড়িবারান্দা দেওয়া বিশাল বাড়ি। সেদিকে তাকালে গা শিরশির করে।

মধুমালতীর ছায়ায় দাঁড়িয়ে দেখলাম, কলম পকেট থেকে একটা পেন্সিল টর্চ আর লম্বা চাবি বের করে, সদর দরজাটা খুলে ফেলল। তারপর কোনোদিকে না তাকিয়ে ঢুকে পড়ল, দরজাটা আধ-ভেজানো রইল। বেজায় ঘাবড়িয়ে গেলাম। টর্চ জ্বাললেই ও দেখতে পাবে। না জ্বেলেই বা যাই কী করে, এদিকে হাত-পা তো পেটের মধ্যে সেঁদিয়েছে। ইতস্তত করছি, এমন সময় কাঁধের কাছ থেকে কে যেন বলল, “কী মুস্কিল, এটা কি থামবার সময় হল? সঙ্গে সঙ্গে ঢুকে পড়তে হয়, নইলে কোথায় গিয়ে গা-ঢাকা দেবে আর ধরতে পারবে না। তারপর বড়সায়েব যখন—”

আঁৎকে উঠলাম, ব্যাটা এত কথা জানল কী করে? নিশ্চয় স্টোফানো সাহেব আমাকে অবিশ্বাস করে আমার উপর চোখ রাখার জন্যে গুপ্ত-গোয়েন্দা লাগিয়েছে। যত না রাগ হল, তার চেয়ে বেশি নিশ্চিন্ত হলাম। যাক, ভূতের বাড়িতে তাহলে একা ঢুকতে হবে না! সে বললে, “আবার কী হল? চল, চল, এক মিনিটও নষ্ট করার নয়। আমার পিছন পিছন এসো।”

একরকম বাধ্য হয়েই ঢুকে পড়লাম। ভীষণ অন্ধকার। কলম নিজেকে নিরাপদ ভেবে বেশ দুমদাম শব্দ করে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। তিনতলায় তার টর্চের আলো দেখতে পেলাম। লোকটা বলল, “এই রে ছাদের নিচের চোরা-কুঠরিতে সেঁদিয়েছে। তা যাক। সিঁড়িটা না তুললেই হল।” ঠুক করে একটা দরজা বন্ধ হবার শব্দ, তারপর চুপচাপ, ঘুটঘুটে অন্ধকার।

লোকটা বলল, “তোমার সঙ্গে আলো নেই?” এবার নিশ্চিন্তে টর্চ জ্বাললাম। যতটা সম্ভব ভালো করে গুপ্তগোয়েন্দাকে দেখে নিলাম। কালো তাল ঢ্যাঙা, কপালের মাঝখানে তিলকের মতো কাটা দাগ; পরনে পরিষ্কার সাদা ফতুয়া, ধুতি, গলায় পৈতে, পায়ে বিদ্যাসাগরী চটি। বাড়িময় তিন ইঞ্চি পুরো ধুলো জমেছে, তাই লোকটার চটির শব্দ পর্যন্ত শোনা গেল না।

ধুলোর নীচে মনে হল মার্বেল পাথরের সিঁড়ি। নিঃশব্দে তিনতলায় উঠলাম। লোকটা আমাকে হলঘরের পাশে একটা ছোট ঘরে নিয়ে গিয়ে ছাদের কড়িকাঠে ঠেকানো লম্বা একটা কাঠের মই দেখিয়ে দিল। ছাদটা প্রায় পঁচিশ ফুট উঁচুতে হবে।

লোকটা বলল, “মইয়ের মাথায় ওই চোরা-কুঠরি। ভালো করে দেখ ওইখানে গোল ঢাকনির মতো দরজা ছাড়া আর পথ নেই। তবে ঘুলঘুলি দিয়ে হাওয়া ঢোকে, দম আটকেও মরে যাবে না। চটপট সিঁড়ি বেয়ে ওঠ দিকিনি। কড়িকাঠের আড়ালে হুড়কো আছে। ওটি টেনে দিলেই খাঁচা বন্ধ। তারপর থানা থেকে লোকজন বন্দুক এনে ধরে ফেললেই হল।”

আমি বললাম, “বড্ড উঁচু যে। ইয়ে আপনার সব চেনা জানা, আপনি উঠলেই ভালো হত না?” লোকটা মুখ চেপে হাসতে লাগল। “কী যে বল! আমি উঠব ওই সিঁড়ি বেয়ে, তবেই হয়েছে! নাও, নাও, উঠে পড়, শেষটা বড় বেশি দেরি হয়ে যাবে।”

সত্যিই উঠলাম, হুড়কোও টানলাম, সঙ্গে সঙ্গে দড়াম করে চোরা দরজার উপর ভারী কিছু পড়ল। ভয় পেলাম, “ভাঙবে না তো?”

“আরে না, না, লোহার তৈরি। এবার নেমে এসে সিঁড়িটা নিয়ে নিচে চল। পঁচিশ ফুট উঁচুতে থাকুন বাছাধন।”

মই কাঁধে তার সঙ্গে একতলায় এসে সিঁড়ির পিছনে মই রাখলাম। তারপর সদর দরজা দিয়ে বাইরের আবছা অন্ধকারে এলাম। লোকটাও বেরিয়ে এসে, দরজাটাকে ঠেলে ভেজিয়ে দিল। তারপর বলল, “চল থানার দিকে এগুনো যাক।”

আমি বললাম, “আচ্ছা স্যার, চোরা-কুঠরির কথা জানলেন কী করে? এখানে আরও এসেছেন নাকি?” সে খুব হাসল। “আসিনি আবার! হাজারবার এসেছি। তোমার সাহায্য ছাড়া ব্যাটাকে ধরতে পারছিলাম না। এবার বুঝুক ঠেলা।”

“কিছু মনে করবেন না স্যার, আপনিও কি পুলিসের গুপ্ত গোয়েন্দা?”

সে বেজায় রেগে গেল। “গুপ্ত-গোয়েন্দা? আরে ছো ছো। আমি সর্বদা পুলিস-ফুলিস এড়িয়ে চলি। ফুলিস বললাম বলে আবার চটে যেও না যেন। তুমি কিন্তু বেশ চালাক?”

একটু খুসি না হয়ে পারলাম না। “তবে কি কলম আপনার জিনিসই সরিয়েছে নাকি? নাকি আপনি প্রাইভেট ডিটেকটিভ?”

ততক্ষণে থানায় পৌঁছে গেছি আমরা। লোকটি বলল, “মোটেই না। ব্যাটাচ্ছেলে কাগজ না কলম সে খবরও রাখি না, আর লোকে যদি নিজেদের জিনিস নিজেরা রক্ষা করতে না পারে, তাহলে নিলে আমার কোনোই আপত্তি নেই। কিন্তু আমাদের বোষ্টম-বাড়িতে দু’বেলা মটন চপ আর পাঁঠার ঘুগনি সাঁটাবে, এ আমার সহ্যের বাইরে।”

এই বলে লোকটা আমার চোখের সামনে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল; থানার ক্ষীণ আলোয় স্পষ্ট দেখলাম। আমিও ঝুপ করে মূৰ্ছা গেলাম। পরে শুনলাম বামাল কলম গ্রেপ্তার।

জিজ্ঞাসা করলাম, “কী করে ধরলেন? আমি তো কিছু না বলেই অজ্ঞান হয়ে গেছিলাম।” থানার ও-সি বললেন, “কেন, আপনাকে পড়ে যেতে দেখে কে একজন লম্বা কালো ভদ্রলোক অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে সব কথা বললেন। আমাদের লোকও তখুনি বেরিয়ে গেল। বেশ মজার ভদ্রলোক, আপনার যথেষ্ট যত্ন হচ্ছে না বলে খুব রাগ দেখালেন। বললেন, ‘ষাট বছর আগে হলে এরকম অযত্ন হত না।’ ওই বলে হনহন করে বেরিয়ে গেলেন, আর কাউকে দেখতে পেলাম না।”

দরজার কাছ থেকে থানার বুড়ো চৌকিদার বলে উঠল, ‘দেখবেন কাকে স্যার? ও কি দেখার মানুষ? পঞ্চাশ-ষাট বছর ধরে ভূতের বাড়ি আগলাচ্ছে, ও কি যে-সে নাকি? কপালে একটা কাটার দাগ ছিল তো?”

আমি বললাম, “ছিল, ছিল!” বলে আবার প্রায় মূৰ্ছা যাচ্ছিলাম। এমন সময় আমার খাবার এল।

সকল অধ্যায়

১. পেনেটিতে
২. আহিরিটোলার বাড়ি
৩. অহিদিদির বন্ধুরা
৪. ভুতুড়ে গল্প
৫. খাগায় নমঃ
৬. লক্ষ্মী
৭. কাঠপুতলি
৮. সত্যি নয়
৯. যুগান্তর
১০. ফ্যান্টাস্টিক
১১. পাশের বাড়ি
১২. দামুকাকার বিপত্তি
১৩. চোর
১৪. বাপের ভিটে
১৫. স্পাই
১৬. নটরাজ
১৭. দজ্জাল বৌ
১৮. কলম সরদার
১৯. কর্তাদাদার কেরদানি
২০. আকাশ পিদ্দিম
২১. ছায়া
২২. চেতলায়
২৩. পিলখানা
২৪. রাত্রে
২৫. গোলাবাড়ির সার্কিট হাউস
২৬. অশরীরী
২৭. ট্যাঁপার অভিজ্ঞতা
২৮. ভয়
২৯. তেপান্তরের পারের বাড়ি
৩০. সন্ধ্যা হল
৩১. লাল টিনের ছাদের বাড়ি
৩২. সোহম
৩৩. আলোছায়া
৩৪. সোনালি-রূপালি
৩৫. পাঠশালা
৩৬. নাথু
৩৭. শেল্টার
৩৮. মোটেল
৩৯. তোজো
৪০. ভ—ভূত!
৪১. ভাগ্যদেবী ব্রাঞ্চ হোটেল
৪২. হরু হরকরার একগুঁয়েমি

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন