হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত
২
‘আমি প্রশ্নটি বিবেচনা করার প্রস্তাব করছি, যন্ত্র কি চিন্তা করতে পারে?’
চেশায়ারের এই ছোট্ট শহর উইমস্লোর প্রকৃতি এই মে-জুন মাসে বেশ মনোরম হয়ে ওঠে৷ ড্যাফোডিল, ব্লুবেল, ক্রোকাস আর নানা রঙের লিলি ফুলে ভরে আছে রাস্তার দুপাশ, অ্যাপার্টমেন্ট সংলগ্ন বাগিচাগুলো৷ বিয়ার পাবগুলোতে ভিড় উপচে পড়ে৷ ফেনা ওঠা বিয়ারের মাগ হাতে নিয়ে উল্লাসে মেতে ওঠে যুবক-যুবতিরা৷ যদিও সেই হুল্লোড়ের শব্দ এই ছোট্ট বাড়িটার দ্বিতলের নিভৃত শয়নকক্ষে এসে পৌঁছোয় না৷ ঠিক যেমন আর অন্য কোনো উল্লাস অনুভূতি স্পর্শ করে না এই কক্ষের নিঃসঙ্গ বাসিন্দাকে৷
সন্ধ্যা সাতটা বাজে৷ তবে বাইরের দিকে তাকালে তা বোঝা যাবে না৷ এখনও ঝলমল করছে আলো৷ এসময় এখানে অন্ধকার নামতে রাত আটটা বেজে যায়৷ জানলার সামনে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ অনেকটা যেন শূন্য দৃষ্টিতেই তাকিয়ে ছিলেন অ্যালান৷ টুকরো টুকরো নানা স্মৃতি তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠে পরমুহূর্তেই যেন অস্পষ্ট হয়ে হারিয়ে যাচ্ছিল৷ সিনেমার পর্দাতে কোনো জলে ভেজা ফিল্ম রোল চালিয়ে দেখলে যেমন দেখতে লাগে, ঠিক তেমনই সব দৃশ্যপট৷ কোথাও প্রচণ্ড উজ্জ্বল, কোথাও অস্পষ্ট, কোথাও আবার গাঢ় অন্ধকার৷ হ্যাঁ, এখন তাঁর জীবনকাহিনি তো ওই জলে ভেজা; ঘষা খাওয়া চলচ্চিত্র রিলের মতোই৷
‘আমি প্রশ্নটি বিবেচনা করার প্রস্তাব করছি, যন্ত্র কি চিন্তা করতে পারে?’—কথাটা শুনে ফিরে দাঁড়ালেন অ্যালান৷ ডাক্তার ঘরে ঢুকে প্রতিদিনের মতোই একই কথা বললেন অ্যালানের উদ্দেশে৷ এই কথা বা বাক্যবন্ধটা অবশ্য আসলে অ্যালানেরই৷ ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করার সময় অ্যালান যে গবেষণাপত্র পেশ করেছিলেন, তার প্রথম বাক্যটা ছিল এটাই—‘লেট আস কনসিডার দ্য কোশ্চেন, ক্যান মেশিন থিংক?’ এবং অ্যালানের বলা এই কথাটা অচিরেই ইংল্যান্ডের বিজ্ঞানীমহল ও তার বাইরেও শিক্ষিত ভদ্রসমাজে সংবাদ মাধ্যমের কল্যাণে পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা লাভ করে৷ কেউ কেউ আবার এই কথার অন্তর্নিহিত বক্তব্য না বুঝে বিদ্রুপাকারেও কথাটা ব্যবহার করে—যন্ত্র কি ভাবতে পারে! এই সরকারি চিকিৎসক ভদ্রলোক তাঁকে কোন অর্থে কথাগুলো বলেন, তা জানা নেই অ্যালানের৷ তবে প্রতি সপ্তাহে লোকটি যখন তাঁর সরকারি দায়িত্ব পালন করতে আসেন, তখন অনেকটা সম্ভাষণের মতো কথাগুলো বলেন অ্যালানকে৷
তাঁর কথা শুনে অ্যালান মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে প্রতিবারের মতো জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ, যন্ত্র অবশ্যই চিন্তা করতে পারে৷ এবং তা আমি প্রমাণ করেছি৷’
ডাক্তার আর এ প্রসঙ্গে গেলেন না৷ খাটের পাশে রাখা টেবিলের সামনে চেয়ার টেনে বসে তাঁর স্যাময় লেদারের পেটমোটা ব্যাগ থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস বার করে টেবিলের ওপর রাখতে লাগলেন৷ অ্যালান গিয়ে বিছানাতে বসলেন৷ একটা অ্যাম্পুলের ভিতর ইনজেকশনের সুচ ঢুকিয়ে ধীরে ধীরে ভিতরের তরলটাকে সিরিঞ্জের ভিতর টানতে থাকলেন ডাক্তার৷ ইস্ট্রোজেন হরমোন ইনজেকশন৷
ডাক্তারের হাতে ধরা সেই সিরিঞ্জটার দিকে তাকিয়ে অ্যালান বললেন, ‘এই ইনজেকশন নেওয়া ছাড়া অন্য কি কোনো উপায় নেই ডাক্তার? এ ইনজেকশন নেবার পর থেকেই দিন দিন কেমন যেন অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ছি আমি৷ যে-কোনো কাজ করার ইচ্ছা যেন আমার হারিয়ে যাচ্ছে৷ আর তার সঙ্গে শরীরের মাংসপেশিতে, অস্থির সংযোগস্থলে প্রচণ্ড যন্ত্রণা তো আছেই৷ আপনি হয়তো জানেন যে গণিতচর্চা, বিজ্ঞানচর্চার পাশাপাশি আমি একজন লম্বা দৌড়বিদ—ম্যারাথন রানার ছিলাম৷ পঞ্চাশ-ষাট কিলোমিটার একটানা অক্লেশে দৌড়ে যেতে পারতাম৷ আর সেই আমারই আজকাল ঘরের মধ্যে চলে ফিরে বেড়াতেও প্রচণ্ড কষ্ট হয়৷ এই ইনজেকশন ছাড়া কোনো উপায় কি নেই?’
ডাক্তার জবাব দিলেন, ‘ইনজেকশনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াতে এ ঘটনা ঘটা স্বাভাবিক৷ হয়তো আপনার এতে কষ্ট হচ্ছে৷ কিন্তু এই ইনজেকশনই আপনাকে সুস্থ স্বাভাবিক মানসিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনবে৷ আপাতত সেই অবস্থায় ফিরে আসার জন্য আপনাকে এ কষ্ট সহ্য করতে হবে৷ আর এটা সরকারি নির্দেশ৷ বিকল্প কোনো পথ যদি থেকেও থাকে, তবুও এ নির্দেশ আমাদের মেনে চলতেই হবে৷ তবে আপনি এ কদিনে চিকিৎসার ফলে কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠছেন কি না, আপনার শরীর চিকিৎসাতে সাড়া দিচ্ছে কি না সে ব্যাপারে একটা পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হতে পারে৷ সেইমতো আপনার চিকিৎসা প্রক্রিয়ার ব্যাপারে পরবর্তী সিদ্ধান্ত হবে৷’
অ্যালান আবারও তাঁকে প্রশ্ন করলেন, ‘আচ্ছা, আপনার কি মনে হয় আমি মানসিকভাবে অসুস্থ? তবে এই মানসিক অসুস্থতা নিয়ে আমি কীভাবে জটিল গাণিতিক ধাঁধা, গুপ্ত সংকেতের সমাধান করলাম? কীভাবে প্রথম প্রমাণ করলাম, ‘‘যন্ত্রও ভাবতে পারে?’’ কম্পিউটার প্রকৌশল ভাবনাতে কালজয়ী তত্ত্বের জন্ম দিলাম?’
ডাক্তার চেয়ার ছেড়ে উঠে অ্যালানের কাছে এগিয়ে এসে বললেন, ‘তা, নিশ্চয়ই করেছেন আপনি৷ কিন্তু যে ভাবনা সামাজিক ভাবনার সঙ্গে মেলে না, প্রকৃতির স্বাভাবিক ভাবনার সঙ্গে মেলে না, যদি কেউ সে ভাবনার বশবর্তী হন, তবে তিনি অন্য ক্ষেত্রে যতবড় পণ্ডিতই হন না কেন, তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ৷ তাঁর চিকিৎসা করা প্রয়োজন৷’
ডাক্তারের জবাব শুনে অ্যালান বুঝতে পারলেন, তাঁর ব্যাপারটা নিয়ে সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সঙ্গে সহমত পোষণ করেন এই ডাক্তার৷ তবুও একটু বিদ্রুপের স্বরেই অ্যালান তাঁকে বললেন, ‘আমার এই অসুস্থতা থেকে মুক্ত করতে আপনাদের সরকারের কত সময় লাগবে বলে মনে হয়?’
এ প্রশ্ন শুনে সতর্ক হয়ে গেলেন চিকিৎসক৷ তিনি সাধারণ সরকারি চিকিৎসক৷ সরকার বা সামরিক বিভাগের সর্বোচ্চ মহলের নির্দেশে অ্যালানের চিকিৎসা চলছে৷ তাঁরা কবে কী সিদ্ধান্ত নেবেন, তা তাঁর জানা নেই৷ এ প্রসঙ্গে বেফাঁস কিছু মন্তব্য করলে বিপদে পড়তে হতে পারে৷ বলা যায় না, এ ঘরের কোথাও হয়তো গোপন মাইক্রোফোন লাগানো আছে৷ আর তারের মাধ্যমে ডাক্তার আর অ্যালানের কথোপকথন হয়তো শুনতে পাচ্ছে ব্রিটেনের রাজনৈতিক বা সামরিক গুপ্তচর বিভাগ৷ হ্যাঁ, এমনটা তো হতেই পারে৷ সরকারের চোখে খুব গুরুত্বপূর্ণ মানুষ এই অ্যালান৷ লন্ডন থেকে দূরে সরিয়ে এনে এই চেশেয়ারে কড়া সরকারি নজরদারিতে চিকিৎসা করা হচ্ছে অ্যালানের৷ সরকারের অনুমতি ভিন্ন অ্যালানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারে না কেউ৷ কোনো কর্মোপলক্ষ্যে দৈবাৎ অ্যালান এ বাড়ির বাইরে বেরোলেও নাকি তাঁর ওপর সরকারের গুপ্তচরদের নজরদারি থাকে বলে শুনেছেন ডাক্তার৷ বলা যেতে পারে যে অ্যালান নামের এই বিখ্যাত গণিতজ্ঞ এখানে নজরবন্দি অবস্থাতেই আছেন৷
ডাক্তার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে যান্ত্রিক কণ্ঠে বললেন, ‘নিন, জামার হাতাটা এবার গোটান৷ ইনজেকশন দেব৷’
অ্যালান আর এরপর কোনো প্রশ্ন করে তাঁকে বিব্রত করলেন না৷ নিঃশব্দে জামার হাতাটা তুলে ফেললেন৷ ডাক্তার যখন নিডলটা তাঁর শরীরে প্রবেশ করালেন, তখন মৃদু যন্ত্রণাতে মুখটা একবার কুঁচকালেন অ্যালান৷ মুখে কোনো শব্দ করলেন না৷ ডাক্তার হরমোনটা ঢেলে দিলেন তাঁর শরীরে৷
তাঁর কাজ শেষ৷ টেবিলের কাছে গিয়ে জিনিসপত্রগুলো ব্যাগে ভরতে ভরতে হঠাৎ তাঁর চোখ গেল ফায়ারপ্লেসের মাথায় দেওয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে রাখা একটা দাবার বোর্ডের ওপর৷ জিনিসটা অবশ্য আগেও ওখানে টাঙানো থাকলেও এর আগে সেটা ঠিক খেয়াল করেননি ডাক্তার৷ শৌখিন জিনিসটার দিকে চোখ পড়তে তিনি বললেন, ‘বাঃ, চমৎকার জিনিস তো! হাতির দাঁতের মনে হচ্ছে?’
অ্যালান জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ, হাতির দাঁতের৷ ইন্ডিয়া থেকে আনা৷ ওদেশের লোকেরা ওকে ‘‘শতরঞ্জ’’ বলে৷’’
ব্যাগের মুখ বন্ধ করতে করতে ডাক্তার জানতে চাইলেন, ‘আপনি ইন্ডিয়াতে ছিলেন?’
অ্যালান হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ, অথবা না, এ প্রশ্নের উত্তরে দুটোই বলা যেতে পারে৷ আমার পিতা জুলিয়াস টিউরিং ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে ওদেশে কর্মরত ছিলেন৷ মা সারা টিউরিং-ও ওদেশেই কর্মরত ছিলেন৷ আমি মায়ের গর্ভে আসি ওদেশেই৷ কিন্তু মা আমাকে এ দেশের বুকেই জন্ম দেবার জন্য ও ভবিষ্যতে শিক্ষাদানের জন্য গর্ভাবস্থায় ইন্ডিয়া থেকে লন্ডনে চলে আসেন৷ ২৩ জুন, ১৯১২ সালে এখানেই আমার জন্ম হয়৷ মার সঙ্গেই ওই জিনিসটা এসেছিল৷ যেমন আমিও এসেছিলাম৷’
ব্যাগ গোছানো হয়ে গেছিল ডাক্তারের৷ তিনি হেসে বললেন, ‘আজ জুন মাসের প্রথম দিন৷ আপনার জন্মমাস৷ শুভেচ্ছা জানাই আপনাকে৷ দু-সপ্তাহ বাদে অর্থাৎ পনেরো তারিখে আবার আমি আসব৷’
তাঁর আসার তারিখটা জানিয়ে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন ডাক্তার৷
খাট ছেড়ে উঠে ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন অ্যালান৷ ভারী পর্দার আড়ালে তাঁর পরিচারক দাঁড়িয়ে ছিল অ্যালানকে কখন নৈশ আহার দেওয়া হবে তা জানার জন্য৷ অ্যালান তাকে জানিয়ে দিলেন রাতে তিনি আর খাবেন না৷ কারণ কিছুক্ষণের মধ্যেই হরমোন ইনজেকশনের আশু প্রতিক্রিয়া শুরু হবে প্রতিবারের মতো৷
প্রথমে মাথা ঘোরা, একটা ঝিমঝিম ভাব৷ কখনও বা হ্যালুসিনেশন৷ আর আগামী দু-দিন হয়তো গা-হাত-পার ব্যথায় ভালো করে চলাফেরাই করতে পারবেন না অ্যালান৷ ইনজেকশন নেবার পর প্রতিবারই এমন অবস্থার সম্মুখীন হতে হয় তাঁকে৷ কাজেই এখন শুয়ে পড়াই ভালো৷
অ্যালান সেইমতোই কাজ করলেন৷ পরিচারককে ফেরত পাঠিয়ে প্রথমে দরজা তারপর জানলা বন্ধ করে শুয়ে পড়লেন বিছানাতে৷ প্রত্যাশামতোই কিছুক্ষণের মধ্যে মাথা ঘুরতে শুরু করল তাঁর৷ ধীরে ধীরে একটা ঘোরের মধ্যে তলিয়ে যেতে লাগলেন তিনি৷ তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠল একটা ঘর৷ ভ্রমরের গুঞ্জনের মতো কথার শব্দ…
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন