অভিরাম

সত্যজিৎ রায়

‘তোমার নাম কী?’

‘অভিরাম সাউ, বাবু।’

‘তোমার বাড়ি কোথায়?’

‘উলুইপুর গাঁয়ে বাবু। উড়িষ্যা।’

‘বাড়িতে আছে কে?’

‘আমার দাদা আছে, বৌদি আছে, দুই ভাই-পো আছে।’

‘তোমার বাড়ি যেতে হয় না?’

‘কালে ভদ্রে বাবু। আমি ত সংসার করিনি। ধানজমি আছে কিছু, দাদাই দেখে।’

‘তুমি বাড়ি গেলে বদলি দিয়ে যাবে ত?’

‘নিশ্চয়ই। তবে সে দরকার আমার হবে না বাবু। হলে, বদলি দিয়ে যাব নিশ্চয়ই।’

‘বদলির কথা কেন উঠল সেটা বলছি তোমায়, আমার সন্ধেবেলা একা থাকতে ভয় হয়। আমার ভূতের ভয় আছে। আমি রান্নার লোক যাকে পেয়েছি, সে ঠিকে; সন্ধেবেলা রেঁধে দিয়ে চলে যাবে। তখন আমার কাছে আরেকজন লোক থাকা চাই।’

‘সে নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না বাবু, ও হয়ে যাবে। আমার নিজের মনে কোনও ভূতের ভয় নেই।’

‘ঠিক আছে, অভিরাম।’

লোকটিকে বেশ ভালোই লাগল শঙ্করবাবুর। চল্লিশের কাছাকাছি বয়স, বেশ হাসি খুশি, চালাক চতুর চেহারা। স্টেটব্যাঙ্কের কর্মচারী শঙ্করবাবু এই সাত দিন হল বদলি হয়ে পশ্চিম বাংলা আর উড়িষ্যার বর্ডারে এই ছোট শহর কাঞ্চনতলায় এসেছেন। নিজে একা মানুষ। দুখানা ঘর সমেত একতলা একটি ছোট বাড়ি পেয়েছেন। তাতে তার চলে যাবে। তবে বাড়ির পরিবেশ নিরিবিলি, তাই একজন চাকর সব সময় থাকা দরকার। শঙ্করবাবুর ভূতের ভয়টা একটা খাঁটি ভয়। অনেক বছর ধরে অনেক চেষ্টা করেও সেটা কাটিয়ে উঠতে পারেননি।

অভিরামকে শঙ্করবাবুর দিনে দিনে বেশি ভালো লাগতে লাগল। এমনি কাজ ত ভাল করেই, খাটতেও পারে। আর সন্ধেবেলা সে সত্যি করে শঙ্করবাবুকে সঙ্গ দেয়।

আরেকটা জিনিস শঙ্করবাবুকে অবাক করে, সেটা হল অভিরামের গল্পের স্টক। সে বলে যে সব গল্প সে ছেলেবেলায় তার দিদিমার মুখে শুনেছে। উড়িষ্যার অফুরন্ত রূপকথা আর উপকথা। অভিরাম ভূতের গল্প বলার মন্ত্রণাও শঙ্করবাবুকে দিয়েছে। কিন্তু শঙ্করবাবু তাতে আমল দেননি।

‘আমি কিন্তু অনেক ভূতের গল্প জানি বাবু’, অভিরাম বলল।

‘তা হোক, ও জিনিসটা তুমি বাদ দাও।’

‘তা বেশ বাবু, তাই হোক। তবে যদি কোনওদিন মনে হয় ভূতের ভয় কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন ত আমায় বলবেন, তখন আমি আপনাকে ভূতের গল্প শোনাব। দেখবেন কেমন মজাদার গল্প।’

‘তুমি নিজে ভূত মান, অভিরাম?’

‘আমার আর মানা না মানার কী আছে বাবু। ভূত থাকলে আছে, না থাকলে নেই, ব্যস্‌ ফুরিয়ে গেল। তবে হ্যাঁ, ভূত মানেই যে খারাপ লোক হবে এটা আমি মানি না। ভালো ভূত হলে ক্ষেতি কী?’

কথা আর বেশি আগাল না।

এই ঘটনার তিন মাস পরে এক বর্ষাকালের সকালে অভিরাম শঙ্করবাবুর কাছে এসে বলল, ‘বাবু, দাদার কাছ থেকে চিঠি পেয়েছি। বেশি বর্ষা হবার ফলে আমাদের ফসলের খুব ক্ষেতি হয়েছে। দাদা একা সামলাতে পারছেন না। আমাকে তিন চারদিনের জন্য যেতে দিতে পারবেন বাবু?’

শঙ্করবাবু এই অবস্থায় না করতে পারলেন না। ‘কিন্তু তুমি যে যাবে, লোক দিয়ে যাবে ত?’

‘নিশ্চয়ই। খুব ভালো লোক দেব। তবে সে বোধ হয় আমার মতো কথা বলতে পারবে না।’

‘তা হোক। সন্ধেবেলাটা আমাকে একটু সঙ্গ দিতে পারলেই হল।’

‘তা খুব পারবে। আপনি যতক্ষণ না শুতে যাবেন ততক্ষণ ও আপনার কাছে থাকবে।’

অভিরাম চলে গেল। তিন দিন পরে শঙ্করবাবু এক পোস্টকার্ড পেলেন তার ভৃত্যের কাছ থেকে। খবর ভালো নয়। আরও তিন দিন লাগবে সামাল দিতে, তারপর অভিরাম ফিরবে। শঙ্করবাবু কী আর করেন! এদিকে বদলি চাকরটিকে তার বিশেষ পছন্দ নয়। মুখটা যেন বড় বেশি গোমড়া। যদিও কাজ করে ভালোই।

পরদিন সকালে রেডিওতে খবর শুনে শঙ্করবাবু স্তম্ভিত। তার চাকরের গাঁ এবং তার চারপাশে বেশ অনেকখানি এলাকা জুড়ে প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টির ফলে হাজার হাজার লোক মারা গেছে, এবং আরও অনেক বেশি লোক গৃহহীন।

শঙ্করবাবু মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। এ অবস্থায় কী করা উচিত তা তিনি স্থির করতে পারলেন না। চিঠি লিখে লাভ নেই। অভিরামও যে লিখবে এমন কোনও ভরসা নেই।

অভিরামের বদলি নিতাইও এ ব্যাপারে কিছু সাহায্য করতে পারল না। রাত দশটা পর্যন্ত বাবুকে সঙ্গ দিয়ে নিতাই উঠে পড়ল।

শঙ্করবাবু একা তাঁর শোবার ঘরে প্রবেশ করলেন। বিছানায় শুয়ে বুঝলেন যে, তাঁর ঘুম আসার সম্ভাবনা কম। অভিরামের অভাব তিনি তীব্রভাবে অনুভব করছেন।

ক্রমে রাত নিঝুম হয়ে এল। একটানা ঝিঁঝি ডেকে চলেছে। এবার তার সঙ্গে শেয়ালের ডাক যোগ হল, কেয়া হুয়া, কেয়া হুয়া, কেয়া হুয়া!

হয়া আবার কেয়া, শঙ্করবাবুর মাথার উপর আকাশ ভেঙে পড়েছে। ভূতের ভয়ে এর মধ্যেই তার শিরদাঁড়া দিয়ে ঢেউ খেলে যাচ্ছে।

ওটা কি?

পায়ের শব্দ না?

শঙ্করবাবু বুঝলেন, তাঁর গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।

‘বাবু!’

সেকী! এযে অভিরামের গলা!

‘অভিরাম নাকি?’ চাপা গলায় প্রশ্ন করলেন শঙ্করবাবু।

‘হাঁ বাবু! আমি এসেছি, ফিরে এসেছি!’

‘আমার ধড়ে প্রাণ এল অভিরাম, দাঁড়া, দরজা খুলি।’

‘না বাবু খুলবেননি।’

‘মানে?’

‘খুলে কিছু দেখতে পাবেননি।’

‘সেকী!’

‘আমি অভিরাম বাবু, কিন্তু আসল অভিরাম নই। আমি অভিরামের ভূত। আমায় বন্যায় টেনে নিয়ে গেছে, আমি আর বেঁচে নেই।’

কোনও উত্তর নেই শঙ্করবাবুর দিক থেকে।

‘কী বাবু? শুনলেন আমার কথা?’

তবু কোনও উত্তর নেই।

‘বাবু!’ আবার ডাক এল বাইরের অন্ধকার থেকে।

এবার কথা এল বাড়ির ভিতর থেকে।

‘তোকে কীভাবে দেখতে পাব?’

‘শুধু একটা ব্যাপার হলে পাবেন।’

‘কী?’

‘আপনিও যদি ভূত হন।’

‘তা সে আর তোকে বলছি কী! তুই ভূত হয়েছিস শুনেই ত আমার আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হয়ে গেছে।

আমার দেহ ওই পড়ে আছে খাটের উপর, দৃষ্টি ঘরের ছাতের উপর, দেহে প্রাণ নেই।’

‘তবে চলে আসুন বাবু!’

‘এই এলুম বলে। আমাকে গল্প শোনাতে পারবি, ভূতের গল্প? কারণ, এখন আর ভয় নেই। বাকি মরণটা গল্প শুনে কাটিয়ে দেব, কী বলিস?’

‘যা বলেছেন বাবু, যা বলেছেন!’

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন