৩.০৫ ডাক্তার চট্টরাজ

প্রফুল্ল রায়

ডাক্তার চট্টরাজকে ভীষণ ক্লান্ত এবং বিধস্ত দেখাচ্ছিল। কপালে দানা দানা ঘাম জমেছে। আন্দাজ করা যায় তার ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেছে।

কেউ কিছু বলার আগেই রুদ্ধশ্বাসে জ্যোৎস্না জিগ্যেস করল, হ্যায় (সে) বাইচা আছে তো? কণ্ঠস্বরে তীব্র ব্যাকুলতা। পোর্টব্লেয়ারে আসার পর এই প্রশ্নটা যে সে কতবার করেছে।

ডাক্তার,চট্টরাজ উত্তর দিতে গিয়ে একটু থমকে গেলেন। তারপর যেন দ্বিধা কাটিয়ে উঠে বললেন, সেই রকমই আশা করছি।

জ্যোৎস্না বলল, ডাক্তারবাবু; আমারে হের (তার) কাছে লইয়া যান৷

এখন নিয়ে যাওয়া যাবে না।

দয়া করেন ডাক্তারবাবু, হেরে (তাকে) একবার খালি দেখুম। আপনের পায়ে ধরি

জ্যোৎস্না ডাক্তার চট্টরাজের পায়ের দিকে ঝুঁকতে যাচ্ছিল, বিব্রতভাবে তার হাতদুটো ধরে বললেন, না না, তুমি বোসো। অপারেশনের পর তোমার স্বামীকে ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়েছে। সে ঘুমোচ্ছে।

কিন্তু কে কার কথা শোনে। হাতজোড় করে সে সমানে বলে যেতে লাগল, মোহনবাঁশির কাছে তাকে নিয়ে যেতেই হবে।

শেখরনাথ আর বিনয় একদৃষ্টে ডাক্তার চট্টরাজকে লক্ষ করছিল। দুজনেরই মনে হচ্ছিল, অপারেশনটা হয়ে গেলেও কোথায় যেন সমস্যা রয়েছে। শেখরনাথ কী ভেবে জ্যোৎস্নাকে বুঝিয়েসুঝিয়ে বসতে বলে ডাক্তার চট্টরাজকে বললেন, চল, তোমার চেম্বারে যাওয়া যাক–

ডাক্তার চট্টরাজ খুব সম্ভব এটাই চাইছিলেন। ব্যস্তভাবে বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ চলুন–

চেম্বারে গিয়ে শেখরনাথ জিগ্যেস করলেন, তোমার মুখচোখ দেখে কেমন যেন লাগছে। অপারেশনটা কি সাকসেসফুল হয়নি?

নিশ্চয়ই হয়েছে। ডাক্তার চট্টরাজ চকিত হয়ে উঠলেন। তবে কেসটা তো ভীষণ ক্রিটিক্যাল। একটা প্রবলেম দেখা দিয়েছে। সেটা মোহনবাঁশির স্ত্রীর সামনে বলতে চাইনি।

কী প্রবলেম? শেখরনাথকে চিন্তিত দেখাল।

অনেক কষ্টে খুব সাবধানে আমরা তিরটা বার করতে পেরেছি। কিন্তু যে ভয়টা হচ্ছিল সেটা ঘটেছে।

কী সেটা?

ফুসফুস থেকে খানিকটা ব্লিডিং হয়েছে। এখনও হচ্ছে। আপনাকে আগেই বলেছিলাম, রক্ত বেরোনোটা ভালো নয়।

মুখটা থমথমে হয়ে গেল শেখরনাথের। কোনও প্রশ্ন না করে উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে রইলেন।

ডাক্তার চট্টরাজ বললেন, রক্ত বেরোনোর ফলে পেশেন্টের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে।

শেখরনাথ জিগ্যেস করলেন, ফ্যাটাল কিছু হয়ে যাবে না তো?

বাহাত্তর ঘণ্টা না গেলে সেটা বলা যাবে না। তবে অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছে, সেই সঙ্গে ব্লাডও। এখন দেখা যাক।

অনেকক্ষণ নীরবতা।

তারপর শেখরনাথ বললেন, র্জোৎস্না ভীষণ উতলা হয়ে আছে। ওকে নিয়ে গিয়ে কি একবার মোহনবাঁশিকে দেখিয়ে আনা যায়?

ডাক্তার চট্টরাজ বললেন, সেটা ঠিক হবে না। পেশেন্টের নাকে অক্সিজেনের নল, বেডের পাশে ব্লাড় আর অন্য সব ওষুধের বোতল ঝুলছে। এসব দেখলে মোহনবাঁশির স্ত্রী খুব নার্ভাস হয়ে পড়বে।

তবু– বাকিটা শেষ না করে থেমে গেলেন শেখরনাথ।

বেশ, আপনি যখন বলছেন তাই হবে। কিন্তু দূর থেকে দেখাব। এমন একটা দৃশ্য দেখলে কান্নাকাটি করবে, স্বামীকে আঁকড়ে ধরতে চাইবে। আপনাকে কিন্তু সেটা সামলাতে হবে।

ঠিক আছে।

এই সময় বিশ্বজিৎ চেম্বারে এসে ঢুকলেন।কিছুক্ষণ আগে কোর্টের হিয়ারিং শেষ হল। ড্রাইভারকে তাড়া দিয়ে দশ মিনিটের মধ্যে চলে এসেছি। অপারেশন কেমন হল? তিনি ডাক্তার চট্টরাজের দিকে তাকালেন।

ডাক্তার চট্টরাজ সব জানিয়ে দিলেন।

 খুবই চিন্তাগ্রস্ত দেখাল বিশ্বজিৎকে। বললেন, যেভাবে হোক, লোকটাকে বাঁচাতেই হবে, নইলে আন্দামানের রিহ্যাবিলিটেশনে এর বিরাট ধাক্কা এসে লাগবে।

ডাক্তার চট্টরাজ বললেন, আমার মনে আছে। আগেও অনেকবার বলেছেন। আমরা মোহনবাঁশির স্ত্রীকে নিয়ে পেশেন্টের কাছে যাচ্ছি। আপনি কি যাবেন?

নিশ্চয়ই।

চেম্বার থেকে বেরিয়ে জ্যোৎস্নাকে সঙ্গে নিয়ে শেখরনাথরা তেতলায় উঠতে লাগলেন। মোহনবাঁশির ছেলেমেয়েদের অবশ্য সঙ্গে নেওয়া হল না। তাদের বারবার বলা হল, দোতলার বেঞ্চে যেন বসে থাকে, অন্য কোথাও না যায়।

সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে শেখরনাথ জ্যোৎস্নাকে বোঝাতে লাগলেন, শরীরে ছুঁচ এবং নাকে নল ঢুকিয়ে মোহনবাঁশিকে নানারকম ওষুধ দেওয়া হচ্ছে। সেসব দেখে সে যেন ভয় না পায়, কান্নাকাটি না করে।

জ্যোৎস্না ঘাড় কাত করে জানাল–তেমন কিছুই করবে না।

অপারেশনের পর তেতলার সমুদ্রের দিকে কাঁচ দিয়ে ঘেরা একটা কেবিনে রাখা হয়েছে মোহনবাঁশিকে। সে চিত হয়ে শুয়ে আছে। চোখদুটো বোজা। বোঝা যায় সম্পূর্ণ বেহুশ। ডাক্তার চট্টরাজ যেমন বলেছিলেন ঠিক তেমনি নল টল, অক্সিজেন সিলিন্ডার ইত্যাদি দেখা যাচ্ছে।

দুই তরুণ ডাক্তার সুকুমার আর তাপস এবং একজন নার্স মোহনবাঁশির বেডের পাশে রয়েছে।

ডাক্তার চট্টরাজ বললেন, আপনাদের এতজনকে কিন্তু কেবিনের ভেতর নেওয়া যাবে না।

শেখরনাথ বললেন, যাওয়ার দরকার কী? এখান থেকেই ভালো দেখা যাচ্ছে।

ডাক্তার চট্টরাজ দাঁড়ালেন না। কেবিনে ঢুকে নিচু গলায় সুকুমার এবং তাপসের সঙ্গে কথা বলতে লাগলেন। নিশ্চয়ই রোগীর চিকিৎসা সম্পর্কে কোনও পরামর্শ দিচ্ছেন।

বিনয় জ্যোৎস্নার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ছিল। সে লক্ষ করল, জ্যোৎস্না পলকহীন বেডে শায়িত মোহনবাঁশিকে দেখছে। শেখরনাথ তাকে কাঁদতে বারণ করেছিলেন। সে শব্দ করে। কাঁদছে না ঠিকই, তবে চোখ জলে ভরে যাচ্ছে। ঠোঁট দুটো কাঁপছে থরথর করে।

শেখরনাথও জ্যোৎস্নার দিকে নজর রেখেছিলেন। চাপা, নরম গলায় বললেন, না না, চোখের জল ফেলো না। ডাক্তারবাবুরা চেষ্টার ত্রুটি করছেন না। চোখ মোছো–।

ধীরে ধীরে আঁচল তুলে চোখ মুছে ফেলল জ্যোৎস্না।

ডাক্তার চট্টরাজ কেবিন থেকে বেরিয়ে এলেন। বললেন, দেখানো হয়েছে। এবার আপনারা বাড়ি চলে যান কাকা। কাল আবার আসবেন।

শেখরনাথ বললেন, আচ্ছা

বিশ্বজিৎ জিগ্যেস করলেন, ওষুধ টোষুধ, ইঞ্জেকশন কিছু কিনে দিতে হবে?

ডাক্তার চট্টরাজ বললেন, আপাতত দরকার নেই। তেমন বুঝলে পরে জানাব।

এতক্ষণ নীরব ছিল। হঠাৎ ভাঙা ভাঙা, জড়ানো গলায় জ্যোৎস্না বলে উঠল, আমি বাড়িত যামু না।

সবাই অবাক। শেখরনাথ জিগ্যেস করলেন, যাবে না কেন?

 আমারে পোলামাইয়া লইয়া হের (তার) কাছে থাকতে দ্যান।

অর্থাৎ জ্যোৎস্না চাইছে তাদের মোহনবাঁশির কেবিনে থাকতে দেওয়া হোক। একবার যখন স্বামীকে দেখতে পেয়েছে তাকে চোখের আড়াল করতে চায় না।

ডাক্তার চট্টরাজ বললেন, বিরাট অপারেশন হয়েছে মোহনবাঁশির। এখনও জ্ঞান ফেরেনি। এই অবস্থায় এতজন তার কেবিনে থাকবে তাই হয় নাকি? হাসপাতালে এভাবে থাকার নিয়ম নেই।

জ্যোৎস্না শেখরনাথের দিকে তাকায়। আকুল স্বরে বলে, বাবা, আপনে আমার পোলামাইয়াগুলারে লইয়া যান। আমি হের (তার) ঘরের এক কিনারে চুপ কইরা বইয়া (বসে) থাকুম৷ কথা কমুনা,কাম না। আমারে দয়া করেন।

শেখরনাথ বললেন, ডাক্তারবাবু কী বলেছেন শুনলে তো। ওঁর পক্ষে হাসপাতালের নিয়ম ভাঙা সম্ভব নয়। চল জ্যোৎস্নার একটা হাত ধরে আস্তে আস্তে তেতলার ওয়ার্ড পেরিয়ে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি। বিনয় এবং বিশ্বজিৎ ওঁদের পাশাপাশি চলতে লাগলেন।

জ্যোৎস্না আর একটি কথাও বলল না। ঘাড় ঘুরিয়ে যতক্ষণ মোহনবাঁশির কেবিনটা চোখে পড়ে, দেখতে লাগল।

.

পরদিন সাড়ে নটায় আবার জ্যোৎস্নাদের নিয়ে হাসপাতালে এলেন শেখরনাথ। বিনয়ও এসেছে। উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের ব্যাপারে বিশ্বজিতের আজ পর পর বেশ কটা মিটিং আছে। তাছাড়া কিছুক্ষণের জন্য হলেও একবার কোর্টে যেতে হবে। তাই আজ আর তার পক্ষে হাসপাতালে আসা সম্ভব নয়। এবেলা তো বটেই, বিকেলের দিকেও আসতে পারবেন না।

কাল বাংলোয় ফেরার পর কিছু খেতে চায়নি জ্যোৎস্না। একরকম জোর করেই তাকে খাইয়েছেন শেখরনাথ আর বিশ্বজিৎ। শেখরনাথ বলেছেন, তুমি যদি না খেয়ে খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়, আমরা মুশকিলে পড়ে যাব। একদিকে মোহনবাঁশি, আরেকদিকে তুমি। তখন কাকে সামলাব? নিজেকে সুস্থ রাখতে হবে। খাও–খাও বলছি। প্রায় ধমকই দিয়ে উঠেছিলেন।

আজ হাসপাতালে এসে সামান্য সুখবর পাওয়া গেল। বাইরের প্যাসেজের বেঞ্চিতে জ্যোৎস্নাদের বসিয়ে শেখরনাথ আর বিনয় ডাক্তার চট্টরাজের চেম্বারে চলে গিয়েছিল।

ডাক্তার চট্টরাজ বললেন, ফুসফুসের ব্লিডিং অনেকটাই থামানো গেছে। তবে শ্বাসকষ্টটা একইরকম আছে। আপাতত আরও চব্বিশ ঘণ্টা অক্সিজেন চলবে। তারপর দেখা যাক।

শেখরনাথের মুখ দেখে মনে হল, মোহনবাঁশির ফুসফুসে। রক্তপাত কমে আসায় সামান্য হলেও তার মানসিক চাপ কেটেছে। উৎসুক সুরে জিগ্যেস করলেন, আউট অফ ডেঞ্জার বলা যায় কী?

এখনও পুরোপুরি নয়। আজ সারাদিন চেষ্টা চালিয়ে যাব। ব্লিডিংটা পুরোপুরি বন্ধ করাই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য। সেটা করতে পারলেই ফিফটি পারসেন্ট কাজ হয়ে যাবে। তখন বলতে পারব আশা আছে।

সন্ধের আগে হাসপাতাল থেকে যাচ্ছি না। অনেক আশা এ নিয়ে থাকব। জ্যোৎস্নাকে কি বলতে পারি মোহনবাঁশি একটু ভালো আছে? বুঝতেই পারছ কিরকম প্রচণ্ড উদ্বেগে কটাদিন তার কাটছে–

ডাক্তার চট্টরাজ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর দ্বিধার সুরে বললেন, আচ্ছা, বলবেন।

শেখরনাথ বললেন, এখন তাহলে আমরা উঠি। তুমি নিশ্চয়ই মোহনবাঁশিকে দেখতে যাবে?

হ্যাঁ।

সবাই চেম্বারের বাইরে বেরিয়ে এল। ডাক্তার চট্টরাজ সিঁড়ি ভেঙে তেতলায় চলে গেলেন। বিনয়কে সঙ্গে করে শেখরনাথ গেলেন জ্যোৎস্নাদের কাছে। লম্বা অলিন্দের একপাশে ছেলেমেয়েদের নিয়ে জড়সড় হয়ে বসে ছিল জ্যোৎস্না। সে নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ায়। দুচোখে অনন্ত প্রশ্ন।

শেখরনাথ হাত তুলে তাকে বললেন, দুশ্চিন্তা কোরো না। ডাক্তারবাবু বলেছেন মোহনর্বাশির বিপদ কেটে এসেছে। সে সুস্থ হয়ে উঠবে। তবে আরও কিছুদিন তাকে হাসপাতালে থাকতে হবে।

জ্যোৎস্নার দুচোখে উৎকণ্ঠা এবং আশা আলোআঁধারির মতো ফুটে উঠতে থাকে। ব্যগ্রভাবে সে বলে, ডাক্তারবাবু ভরসা দিছে তো বাবা? শেখরনাথের মুখে শোনার পরও যেন পুরোপুরি ভরসা পাচ্ছে না সে।

বিনয়ের দিকে আঙুল বাড়িয়ে শেখরনাথ বললেন, ও তো আমার সঙ্গেই ছিল। ডাক্তারবাবু কী বলেছেন, ওকেই জিগ্যেস করে দেখ।

জ্যোৎস্নার হঠাৎ খেয়াল হল শেখরনাথের মতো শুভাকাঙ্ক্ষী আপনজন এই আন্দামান দ্বীপে তাদের আর কেউ নেই। সে ডাক্তার চট্টরাজ সম্পর্কে যে প্রশ্নটা করেছে তার মধ্যে খানিকটা অবিশ্বাস রয়েছে। ওটা করা ঠিক হয়নি৷ শেখরনাথের পায়ের দিকে ঝুঁকে ব্যাকুলভাবে বলে, কেওরে (কারওকে) জিগাইতে অইব না। আমারে মাফ কইরা দ্যান। বোঝেনই তো বাবা, হার (তার অর্থাৎ মোহনবাঁশির) লইগা মনখান বড় উতলা। কী কইতে যে কী কইয়া ফালাই (ফেলি)! মাথা আমার ঠিক থাকে না।

ঠিক আছে, ঠিক আছে জ্যোৎস্নার দুহাত ধরে টেনে তুলে তাকে দাঁড় করিয়ে দিলেন শেখরনাথ। বললেন, তোমাদের তো মোহনবাঁশির কাছে এবেলা যেতে দেবে না। ওবেলা অবস্থা বুঝে দেখতে দিতে পারেন। এতটা সময় কী করবে?

বিহুলের মতো জ্যোৎস্না বলল, কী করুম!

এক কাজ কর, আমাদের সঙ্গে গাড়ি আছে। তুমি বিশ্বজিতের বাংলায় চলে যাও। সকালে কী চাট্টি খেয়ে এসেছ! দুপুরে পেট ভরে খেয়ে ওখানে বিশ্রাম কর। বিকেলে ফের গাড়ি গিয়ে তোমাদের হাসপাতালে নিয়ে আসবে।

কালও হাসপাতাল ছেড়ে যেতে রাজি হয়নি জ্যোৎস্না। আজও হল না। বলল, আমরা এখানেই থাকুম৷

জ্যোৎস্নার মনোভাবটা বোঝেন শেখরনাথ। স্বামীর সঙ্গে দেখা না হলে হাসপাতালে তার কাছাকাছি থাকা যাবে, এটুকুই তার সান্ত্বনা। তিনি আর জোর করলেন না। একটু কী ভেবে বললেন, তোমরা তাহলে এখানেই বসে থাকে। আমরা একটু ঘুরে আসি।

কহন (কখন) আইবেন?

দুপুরে। তোমাদের খাবার নিয়ে আসব।

 জ্যোৎস্না আর কোনও প্রশ্ন করল না।

 শেখরনাথ বিনয়কে বললেন, চল, নিচে নামা যাক—

 বিনয় বলল, কাকা, আপনি বলেছিলেন, সেলুলার জেলটা ভালো করে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাবেন। আজ আপনার কি অন্য কোনও কাজ আছে?

না, নেই। আজ তোমাকে যতটা পারি দেখাব। কিন্তু এই কুখ্যাত জেলখানার বিরাট ইতিহাস। কত বিপ্লবী কত খুনি দস্যু সারা ভারত থেকে এখানে দ্বীপান্তরের সাজা নিয়ে এসেছিল। সে কি একদিনে শোনানো যায়। চল, যতটা পারি–

.

নিচের বিশাল চত্বরে নেমে শেখরনাথ উলটো দিকের লম্বা তেতলা উইংটা দেখিয়ে বললেন, আজ ওখানে যাব। তার আগে চারপাশ দেখাই৷

মোহনবাঁশিকে নিয়ে জেফ্রি পয়েন্ট থেকে আসতেই হাসপাতালে বিনয়ের চোখে পড়েছিল ভূমিকম্পে এবং জাপানি বোমায় দুটো উইং ধংস হয়ে যাবার পর বাকি যে পাঁচটা মস্ত মস্ত উইং এখনও দাঁড়িয়ে আছে, হাসপাতালটা বাদ দিলে তার প্রতিটি তলায় সারি সারি কুঠুরি বা সেল। প্রতিটি সেলের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ব্রিটিশ আমলের কত যে বর্বর নির্যাতনের নীরব কাহিনি। এর কিছু কিছু বিবরণ নানা বইতে পড়েছে বিনয় কিন্তু একজন বিপ্লবী যিনি তার জীবনের অতি মূল্যবান অনেকগুলো বছর এই ভয়ংকর নরককুণ্ডে কাটিয়েছেন তার মুখে শোনাটা বিরল অভিজ্ঞতা। আন্দামানে এসে শেখরনাথের সঙ্গে দেখা হওয়াটাকে বিরাট সৌভাগ্য বলেই মনে হয় বিনয়ের।

শেখরনাথ বললেন, হাসপাতালের সামনে যে মস্ত চত্বরটায় আমরা দাঁড়িয়ে আছি, ইংরেজ রাজত্বে এখানে কী ছিল জানো?

বিনয় মাথা নাড়তে থাকে।–জানে না।

শেখরনাথ জানালেন, এই বিস্তৃত ফাঁকা জমিতে ছিল টিনের লম্বা লম্বা ছাউনির তলায় ঘানিঘর।

জেলখানায় ঘানিঘর! বিনয় বেশ অবাকই হল।

 হা হা, সারি সারি ঘানি বসানো হয়েছিল। ঘানি টানা দেখেছ কখনও?

দেশে থাকতে কলুদের বাড়িতে দেখেছি। বলদ দিয়ে টানানো হত।

আর এখানে টানানো হত কয়েদিদের দিয়ে। বলে একটু হাসলেন।

বিনয় জিগ্যেস করল, আপনার মতো বিপ্লবীদের দিয়েও?

শেখরনাথের হাসি সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ল।সবাইকে দিয়েই। কেউ বাদ নয়। আর বিপ্লবী বলে গুরুঠাকুর নাকি যে তাদের মাথায় করে রাখতে হবে? ইংরেজদের রাগ তো রেভোলিউশনারিদের ওপর সবচেয়ে বেশি। তারা সশস্ত্র বিপ্লব ঘটিয়ে ওদের তাড়িয়ে ইন্ডিয়া স্বাধীন করতে চায়।

বিনয় আন্দাজ করে নিল শেখরনাথকেও ঘানি ঘোরাতে হয়েছে। একজন মানুষ জীবনে যাঁর একমাত্র লক্ষ্য ছিল দেশের বন্ধনমুক্তি, যিনি চিরকুমার, নিজের সিদ্ধিতে পৌঁছতে যিনি সর্বস্ব ত্যাগ করেছেন তাকে প্রচণ্ড নিগ্রহ ভোগ করতে হয়েছে, ভাবতেও মন ভীষণ খারাপ হয়ে যায় তার।

শুনে খুব কষ্ট হল তো? আরে বাবা, প্রায় দুশো বছরের এত বড় একটা কলোনির অজস্র সম্পদ লুটপাট করে লন্ডনের জেল্লা যেখানে দিন দিন বাড়ানো হচ্ছে, সেখানে বাধা পড়লে ইংরেজ মুখ বুজে সহ্য করবে? ওই অত্যাচারটুকু রেভোলিউশনারিদের প্রাপ্য।

একটু চুপচাপ।

 তারপর শেখরনাথ বললেন, দিনে নারকেল থেকে তেল বার-২ করতে হত। পাক্কা পনেরো সের। পেটি অফিসার নিজের হাতে মেপে নিত।

উৎসুক সুরে বিনয় জানতে চাইল, পেটি অফিসার কাদের বলে? জেলের স্টাফ?

শেখরনাথ বুঝিয়ে দিলেন। কয়েদিদের মধ্যে যাদের কয়েক বছর জেল খাটা হয়ে গেছে, যারা জেলারের তাবেদার, ইংরেজদের নামে যারা কথায় কথায় সেলাম ঠোকে, তাদের ভেতর থেকে অন্য কয়েদিদের ওপর নজরদারি করার জন্য কয়েকজনকে বেছে নেওয়া হত। জেলের হর্তাকর্তারা এদের, দুভাগে ভাগ করে দিয়েছিল। একেবারে নিচের স্তরের। নজরদারদের বলা হত টিল্ডাল, তার ওপরে পেটি অফিসার। টিন্ডালদের মাইনে দেওয়া হত মাসে দুটাকা, পেটি অফিসাররা পেত সোয়া তিন কি সাড়ে তিন টাকা। তখনকার দিনে এই টাকাটা খুব কম নয়, বিশেষ করে কালাপানির সাজা খাটতে আসা কোনও কয়েদির পক্ষে।

এইভাবে কয়েদিদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করেছিল। টিন্ডাল আর পেটি অফিসাররা বেশিরভাগই হত পাঠান। মানুষ যে এমন নিষ্ঠুর এবং বর্বর হতে পারে ভাবা যায় না। নতুন পদমর্যাদা পেয়ে তারা সারা সেলুলার জেল দাপিয়ে বেড়াত। সারাক্ষণ তক্কে তক্কে থেকে সাধারণ কয়েদিদের খুঁত ধরতে চেষ্টা করত। ওদের শকুনের নজর, কিছু না কিছু একটা বার করে ফেলতই। তারপর নৃশংস নির্যাতন।

শেখরনাথ বললেন, সে টরচার তুমি কল্পনা করতে পারবে না বিনয়।

বিনয় রুদ্ধশ্বাসে শুনে যাচ্ছিল। জিগ্যেস করল, কী ধরনের টরচার?

সেলুলার জেলের ভেতর কয়েদিদের দিয়ে নানারকম পরিশ্রমের কাজ করানো হত। যেমন ধর ডিউটি ছিল সকাল সাড়ে আটটা থেকে সাড়ে বারোটা। তারপর দুপুরের খাওয়া দাওয়ার জন্য একঘণ্টা গ্যাপ। ফের দেড়টা থেকে সন্ধে অব্দি হাড়ভাঙা খাটুনি। কয়েদিদের কারওকে ঘানি টানতে হত, কারওকে নারকেল ছোবড়া পিটিয়ে সরু সরু তার বার করতে হত, কারওকে কাঠ চেরাই করতে হত। যার পনেরো সের নারকেল তেল বার করার কথা টিন্ডাল কি পেটি অফিসার ওজন করে যদি দেখত আধপোয়া বা তিনপোয়া কম হয়েছে তার দুদিন রাতের খানা বন্ধ। যাকে নারকেল ছোবড়া থেকে আড়াই সের। তার বার করতে হবে তার কম হলে সেই কয়েদিরও একই সাজা। পর পর তিনদিন যদি কম হয় তখন টিকটিকিতে চড়ানো হত।

টিকটিকি কাকে বলে?

 সামনের উইংটার পেছনে যে চত্বরটা রয়েছে সেখানে এখনও দুচারটি আছে। নিজের চোখে দেখলে বুঝতে পারবে। এসো আমার সঙ্গে

বিশাল তেতলা বিল্ডিংটার পাশ দিয়ে ওদিকে চলে এল দুজনে। এই এলাকাটা ভীষণ নির্জন। কোনও জনপ্রাণী চোখে পড়ছে না। এ ধারের মস্ত বিল্ডিংটা খাঁ খাঁ করছে। ইংরেজরা চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে সেলগুলোতে নতুন কয়েদি আর আসেনি। যদিও বা দুচারজন ছিল, স্বাধীনতার আগে আগেই খুব সম্ভব তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

চারিপাশ নিরেট এক শূন্যতা বিনয়কে যেন ঘিরে ধরতে থাকে।

এখানকার চত্বরটা হাসপাতালের চত্বরের মতো একই মাপের। তবে ওদিকটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। কিন্তু এখানে বড় বড় ঘাস আর আগাছা জন্মেছে প্রচুর। এক কোণে কটা বেজি বেশ গুছিয়ে ঘর সংসার পেতেছিল। হঠাৎ উটকো, অবাঞ্ছিত দুটো লোককে দেখে তুমুল হইচই বাধিয়ে ছোটাছুটি করতে করতে তাদের অসন্তোষ জানাতে থাকে।

চত্বরের এক কোণে বিনয়কে নিয়ে যেতে যেতে শেখরনাথ বললেন, এখানেও তেলের ঘানির জন্য বড় শেড ছিল। ইংরেজরা যাবার আগে ভেঙে দিয়ে গেছে। পরে এই নিয়ে হুলস্থূল বাধে তাই বহু কুকীর্তির চিহ্ন লোপাট করে দিয়েছে। কিন্তু তারপরও যা যা পাওয়া গেছে তাতে ভারতের মেনল্যান্ডের মানুষ শিউরে উঠেছে। সে যাক, এই যে ধারে

চত্বরের বাঁ প্রান্তে চারটে তেকোনা, ত্রিভুজের আকারের স্ট্যান্ড দাঁড় করানো রয়েছে। সামনের দিকে দুটো লোহার মজবুত পায়া, পেছন দিকে একটা। প্রায় সাত আট ফিটের মতো উঁচু। পায়াগুলোতে সমুদ্রের নোনা হাওয়ায় জং ধরে গেলেও এখনও বেশ শক্তপোক্তই আছে। সামনের অংশের প্রায় পুরোটা জুড়ে পুরু কাঠের পাটাতন আটকানো।

শেখরনাথ বললেন, এই হল টিকটিকি। এতে চড়িয়েই কয়েদিদের বেত মেরে শায়েস্তা করা হত।

অবাক বিস্ময়ে স্ট্যান্ডগুলো দেখতে লাগল বিনয়।

শেখরনাথ কীভাবে বেতের বাড়ি মারা হত বিশদভাবে তা বুঝিয়ে দিলেন। কয়েদিকে উলঙ্গ করে পাটাতনে তার বুকটা ঠেসে হাতদুটো পেছনের লোহার পায়ার সঙ্গে শক্ত করে বাঁধা হত, আর পা দুটো বাঁধা হত স্ট্যান্ডের দুই পায়ার সঙ্গে যাতে কয়েদি নড়াচড়া করতে না পারে।

কখনও কখনও টিন্ডাল বা পেটি অফিসাররা বেত মারার মহান কর্তব্যটি পালন করত। তাছাড়া জেলর এটি করার জন্য অন্য পুরনো, ঘাগি কয়েদিদেরও কাজে লাগাত। কেননা রোজ কম করে তিরিশ চল্লিশ জনকে বেতানো হত। দু-চারজনের পক্ষে তা সম্ভব নয়।

অপরাধের গুরুত্ব অনুযায়ী কারও বরাদ্দ দশ ঘা বেত, কারও পনেরো, কারও পঁচিশ। পঁচিশ অবধি পৌঁছবার আগেই বেশিরভাগ কয়েদি সেন্সলেস হয়ে যেত। তখন তার মাথায় জলটল দিয়ে ব্রান ফিরিয়ে পিঠে ওষুধ লাগিয়ে তার সেলে পাঠিয়ে দেওয়া হত। এইভাবেই সেলুলার জেলে বিভীষিকার রাজত্ব চালিয়ে যেত।

শেখরনাথ বলতে লাগলেন, অত্যাচারের এটা হল সামান্য নমুনা। পরে যখন ব্লকে ব্লকে ঘুরে তোমাকে কুঠুরিগুলো দেখাব তখন, আরও অনেক কিছু জানতে পারবে।

বিনয় কী বলতে যাচ্ছিল, বলা হল না, নিজেকে সামলে নিল।

শেখরনাথ তাকে লক্ষ করছিলেন। কপাল কুঁচকে মজার একটা ভঙ্গি করলেন। বললেন, কী বলতে চাও–আমাকে টিকটিকিতে চড়ানো হয়েছিল কি না, তাই তো?

বিনয় চুপ করে রইল।

শেখরনাথ বললেন, বার ছয়েক আমাকে তোলা হয়েছিল। সেলুলার জেলে আসব আর বেত খাব না, তাই কখনও হয়? বলে পেছন ফিরে পাঞ্জাবিটা উঁচুতে তুলে পিঠটা দেখিয়ে দিলেন। সারা পিঠ জুড়ে অগুনতি আড়াআড়ি কালো কালো দাগ। গভীর ক্ষত শুকিয়ে গেলে যেমন হয় সেইরকম।

স্বাধীনতা সংগ্রামীকে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে এসে কী অসহনীয় নির্যাতন সইতে হয়েছে তার একটি ঝলক দেখে শিউরে ওঠে বিনয়। এইসময় দূর থেকে কেউ ডেকে ওঠে, ভাইসাব, ভাইসাব।

সকল অধ্যায়

১. ১.১ বিনয় তাকিয়েই আছে
২. ১.২ সেসোস্ট্রেস বে পেরিয়ে
৩. ১.৩ ব্যারাকের মতো দালান
৪. ১.৪ এবারডিন বাজার
৫. ১.৫ মূল পোর্টের গা ঘেঁষে
৬. ১.৬ বিশাল চারটে ব্যারাক
৭. ২.০১ জেফ্রির পয়েন্টে অন্ধকার
৮. ২.০২ উদ্দাম জঙ্গলের ভেতর
৯. ২.০৩ বহু মানুষের হইচই
১০. ২.০৪ উদ্বাস্তুদের মধ্যে তুমুল আতঙ্ক
১১. ২.০৫ জমি বিলি হওয়ার কথা
১২. ২.০৬ বিশ্বজিৎ চলে যাবার পর
১৩. ২.০৭ ক্যাম্প অফিসের সামনে
১৪. ২.০৮ এসেছেন শেখরনাথ
১৫. ২.০৯ কলোনাইজেশন অ্যাসিস্ট্যান্ট পরিতোষ
১৬. ২.১০ বহু মানুষের চেঁচামেচি
১৭. ২.১১ মেয়েদের ব্যারাকের সামনে
১৮. ২.১২ আনন্দটা ক্ষণস্থায়ী
১৯. ৩.০১ সেলুলার জেলের বাইরে
২০. ৩.০২ এবারডিন মার্কেট
২১. ৩.০৩ উপসাগরের মুখোমুখি
২২. ৩.০৪ চোখে ঘুমের ঘোর
২৩. ৩.০৫ ডাক্তার চট্টরাজ
২৪. ৩.০৬ শেখরনাথ ঘুরে দাঁড়ালেন
২৫. ৩.০৭ আবার হাসপাতাল
২৬. ৩.০৮ মোহনবাঁশি খানিকটা সুস্থ
২৭. ৩.০৯ আবার এল বিনয়রা
২৮. ৩.১০ হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জ
২৯. ৪.০১ সেলুলার জেলের দিকে
৩০. ৪.০৫ কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল
৩১. ৪.১০ কলকাতা থেকে নতুন উদ্বাস্তু
৩২. ৪.১৫ শেখরনাথকে অমান্য করার ক্ষমতা
৩৩. ৪.২০ পেরিমিটার রোডের এধারে

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন