শৈবাল মিত্ৰ
শ্রীচৈতন্যকে নিয়ে একটি উপন্যাসের প্রাথমিক খসড়া তৈরি করেছিলাম। আমার পরিকল্পিত সেই উপন্যাসটি সম্প্রতি ‘মাতৃশক্তি’তে ধারাবাহিক প্রকাশের ইচ্ছে জানান, পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলী। পুরনো খসড়াটি কিছুটা মেজে ঘষে দাঁড় করাতে গিয়ে টের পেলাম, কাজটা যত সহজ ভেবেছিলাম, তা নয়। শ্রীচৈতন্যকে নিয়ে পাঁচশ বছর ধরে যত বই লেখা হয়েছে, তার সংখ্যা রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে লেখা গ্রন্থের চেয়ে বেশি। চৈতন্য নিজে কোনও ধর্মগ্রন্থ না লিখলেও তাঁর রচনা হিসেবে প্রচলিত ‘শিক্ষাষ্টক’ নামে যে আটটি শ্লোক প্রচলিত আছে, তা প্রধানত নীতিশিক্ষামূলক। সংস্কৃতে লেখা সেই আটটি শ্লোক নির্ভর করে যে বৈষ্ণবতত্ত্ব আর বৈষ্ণবীয় ভাবজগৎ গড়ে ওঠেনি, তা অনায়াসে বলা যায়। তাহলে কোন প্রেরণায় গড়ে উঠেছিল বৈষ্ণব ভাবান্দোলন?
‘শ্রী চৈতন্যভাগবৎ’ কাব্যের লেখক, বৃন্দাবন দাস জানিয়েছেন চৈতন্যপ্রচারিত ধর্মের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল, ‘আপনি আচরি গোরা সভারে শিখায়।’ সভারে অর্থাৎ মানুষকে শিক্ষা দেওয়ার ব্রত নিয়েছিলেন তিনি। কী ছিল তাঁর শিক্ষার বিষয়? মাত্র আটটি শ্লোক লিখে যে শিক্ষা তিনি দিতে চেয়েছিলেন, তার চেয়ে বড় ছিল তাঁর ব্যক্তিজীবনের আচরণ। তাঁর ব্যক্তিগত জীবনাচরণ ঘিরে রক্তমাংসের মানুষের চেহারা পেয়েছিল ‘শিক্ষাষ্টক’। সাতচল্লিশ বছরের কিছু বেশি বেঁচেছিলেন তিনি। নবদ্বীপে বাস করেছেন তেইশ বছর, বাকি চব্বিশ বছর, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কাটিয়েছেন শ্রীক্ষেত্র পুরীতে। পুরী ছেড়ে দু’বছরের জন্যে দক্ষিণ আর উত্তর ভারত পরিভ্রমণে গিয়েছিলেন। তারপর পুরী থেকে আর নড়েননি।
নবদ্বীপে থাকার সময়ে খুব বেশি ছ’সাত বছর সংসার, সমাজ, জনজীবনে জড়িয়ে পড়ার এবং নিজের মতাদর্শ প্রচারের সুযোগ পেয়েছিলেন চৈতন্য। তখনও তিনি চৈতন্য হননি। ‘নিমাই’ আর ‘গোরা’ এ দুটো ছিল তাঁর পোশাকি নাম। স্মার্ত আর নৈয়ায়িকদের দুর্গ নবদ্বীপ, তখন দেশের অগ্রগণ্য শিক্ষাকেন্দ্র, জ্ঞানচর্চার পীঠস্থান। স্মার্ত, নৈয়ায়িকদের ক্ষুরধার পাণ্ডিত্যের সঙ্গে ছিল প্রবল আত্মাভিমান। ভিন্ন মতাবলম্বীদের তাঁরা শূদ্র আর অস্পৃশ্য ছাড়া কিছু ভাবতেন না। ট্যা ফোঁ করার উপায় ছিলনা অন্ত্যজদের। দরকার মতো কঠোর হাতে তাদের শায়েস্তা করা হতো। হৃদয়হীন ব্রাহ্মণ্যবাদের পুরোধা স্মার্ত, নৈয়ায়িকদের তাই ‘লিবারাল’ ব্রাহ্মণ আর স্বচ্ছল অব্রাহ্মণদের বড় অংশ ‘পাষণ্ডী’ ভাবত। ঘরে খিল এঁটে ভক্তিবাদীরা মাঝরাতে জয়দেবের গীতগোবিন্দ, বিদ্যাপতি চণ্ডীদাসে পদাবলী, প্রেমের গান গাইত। সুর আর সঙ্গীতের স্রোতে মাঝরাতের নিস্তব্ধ পৃথিবী যেমন ভেসে যেত, তেমনি গানের আবেগে চোখের জলে ভিজে উঠত গায়কদের দু’চোখ, গাল, চিবুক ভক্তিবাদীরা কপাট এঁটে গান বাজনা করলেও শাস্ত্রবিরোধী সেই অনাচারের বিবরণ যথাসময়ে পাষণ্ডীদের কানে পৌঁছে যেত। অনাচার দমনে তারা কোমর বেঁধে নেমে পড়ত। শাস্ত্রবিরোধী গান গাওয়ার অপরাধে কড়া শাস্তি দেওয়া হতো গায়কদের। ধোপা-নাপিত বন্ধ করে তাদের ‘এক ঘরে’ করার সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গে পাড়া ছাড়ার ব্যবস্থা করা হতো। ঘরে আগুন লাগানোর ঘটনা কম ঘটেনি। গান গাওয়ার ওপরে বলা যায়, এক ধরনের নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছিল। শহরের বাইরে নবশাক, শূদ্র, অন্ত্যজরা মনসার ভাসান, মঙ্গলকাব্যের গানে মেতে থাকলেও নগরের পণ্ডিতসমাজ, তা গ্রাহ্য করত না। বলা যায়, অবজ্ঞা করার সঙ্গে ইতরজনের এই ধর্মীয় ক্রিয়াকলাপকে দূর থেকে তারা প্রশ্রয় দিত। নবদ্বীপের কোণঠাসা, অবরুদ্ধ নাগরিকদের একাংশ এই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পেতে এমন এক ত্রাতার অপেক্ষা করছিল, যিনি ঈশ্বরের মতো ক্ষমতাবান, প্রেমিক, সাধক, আপনজন, ঈশ্বরের অবতার হওয়াও অসম্ভব নয়, তাঁর আবির্ভাব। স্মার্ত, নৈয়ায়িক সম্প্রদায়বহির্ভূত নবদ্বীপের উদারপন্থী ব্রাহ্মণ্যবাদীরা, এই চিন্তন নিয়ে সুদিনের প্রতীক্ষা করছিল। আজগুবি প্রার্থনা নিয়ে তাদের দিন গোণার কারণ ছিল। গৌড়ের নবাব সুলতান হুসেন শাহের কোনও এক জ্যোতিষী রাশিচক্র গণনা করে জেনেছিল, সুলতানি শাসন উচ্ছেদ করতে এমন এক হিন্দু মহাপুরুষের জন্ম হয়েছে, যিনি মথুরার অত্যাচারী রাজা কংসের নিধনকারী কৃষ্ণ, যিনি স্বয়ং ঈশ্বর। হুসেন শাহের পতনের কারণ হতে পারেন, সেই মহাপুরুষ।
জ্যোতিষীর ভবিষ্যৎবাণী সুলতান হুসেন শাহকে সন্ত্রস্ত করে থাকলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার মধ্যে থেকেও ক্ষমতাসীনরা জ্যোতিষশাস্ত্র মেনে সব কাজ করে থাকেন। হুসেন শাহও করতেন। সম্ভবত একটু বেশিরকম মেনে চলতেন জ্যোতিষী নির্দেশ। খুনখারাবির মধ্যে দিয়ে গৌড়ে পাঠান শাসকদের যখন ক্রমাগত বদল ঘটছিল, সুলতান রুকনুদ্দিন, বরবক শাহের মৃত্যুর পরে তাঁর ছেলে শামসুদ্দীন ইউসুফ শাহ এবং তাঁর পরে, তাঁর ছেলে সিকন্দার শাহ্ সিংহাসনে বসার পর থেকে প্রায় পনেরো বছর ধরে ক্ষমতার হাত বদল হতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত গৌড়ের শাসক পদে অধিষ্ঠিত হল হুসেন শাহ। চৈতন্য তখন পাঁচ, ছ’বছরের ছেলে। হুসেন শাহ যে সুশাসক ছিলেন এ বিষয়ে অধিকাংশ ঐতিহাসিক একমত। ‘চৈতন্যভাগবৎ’ রচয়িতা বৃন্দাবন দাসও হুসেন শাহের যথেষ্ট প্ৰশংসা করেছেন। তবুও ইতিহাসের মধ্যে এমন কিছু উপকরণ থাকে, যা আপাত বিচারে গল্পকথা মনে হলেও পুরো উড়িয়ে দেওয়া যায় না। হুসেন শাহের উত্থানের আগে, পরে, এরকম কিছু ঘটনা ইতিহাসের উপকরণ হিসেবে মেনে নিতে অসুবিধে হয় না। চৈতন্যের জন্মের আগে থেকে সিংহাসন নিয়ে সুলতানি উত্তরাধিকারের সঙ্গে হাযশি রাজপ্রহরীদের যে খুনোখুনি শুরু হয়, ক্ষমতা কেনাবেচার সেই চক্রে হুসেন শাহ ঢুকে পড়েছিলেন। তার আগে তিনি ছিলেন গৌড়ের প্রশাসক সুবুদ্ধি রায়ের কর্মচারী। সুবুদ্ধি রায়ের আরোপিত দীঘি বানানোর কাজে অবহেলা করার জন্যে হুসেন শাহকে শাস্তি দিয়েছিলেন সুবুদ্ধি রায়। সুবুদ্ধি রাযের চাবুকের দাগ হুসেন শাহের পিঠে তিনি সুলতান হওয়ার পরেও থেকে গিয়েছিল। হুসেন শাহ যে খুব একটা প্রতিহিংসাপরায়ণ ছিলেন, এমন নয়। সুলতান হওয়ার পরে গৃহশান্তি বজায় রাখতে সুবুদ্ধি রায়ের পদোন্নতি ঘটানোর সঙ্গে তাঁর মুখে বদনার জল ঢেলে তাঁর ধর্মনাশ ঘটান হুসেন শাহ। প্রায়শ্চিত্ত করতে গৌড় ছেড়ে সুবুদ্ধি রায় কাশীধামে যাওয়ার আগে সহকর্মীদের কাছে এমন কিছু মন্তব্য করে থাকতে পারেন, যা সুলতানের কানে যায় এবং তিনি কিছুটা ভয় পান। সম্ভবত দুষ্কৃতির বিনাশে যুগে যুগে ভগবানের আবির্ভাব এবং কংসের কারাগারে কৃষ্ণের ভূমিষ্ট হওয়ার পৌরাণিক কাহিনী হুসেন শাহের অজানা ছিলনা। লাঞ্ছিত সুবুদ্ধি রায়ও হয়তো হুসেন শাহের বিনাশ সাধন করতে ঈশ্বরের আবির্ভাব যে অনিবার্য, এমন অভিমত গৌড় ছাড়ার আগে পরিচিত মহলে করে থাকতে পারেন। পুরাকাহিনীকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছিল সুলতানের জ্যোতিষীর গণনা। ফলে সুলতানের সম্ভাব্য ঘাতককে খুঁজে বার করতে রাজশক্তি নেমে পড়েছিল। কাল্পনিক হন্তার গুপ্তচরবাহিনী শুরু করে দিয়েছিল ঘোরাঘুরি। শিক্ষা-দীক্ষার মহাপীঠ নবদ্বীপে তাদের পৌঁছে যাওয়া আশ্চর্য নয়। নবদ্বীপের ভক্তিবাদী ব্রাহ্মণ্য গোষ্ঠীর মানুষের সঙ্গে আরও নানা স্তরের মানুষ, নবশাক, শূদ্র, অন্ত্যজ সম্প্রদায়ের কাছেও পৌঁছে গিয়েছিল হুসেন শাহের গোপন ভয়ের খবর। সেই খবরের প্রেক্ষাপটে আরও আশাব্যঞ্জক যে বার্তা প্ৰচ্ছন্ন ছিল, তা হল, সৎ মানুষের পরিত্রাণে দুষ্কৃতির বিনাশে যুগে যুগে যে ভগবান পৃথিবীতে আবির্ভূত হন, তিনিও মর্ত্যভূমিতে, সম্ভবত গৌড়ের কোনও জনপদে বেড়ে উঠছেন। ফলে, শ্রীনিবাস, অদ্বৈত আচার্য প্রমুখ ভক্তের বাড়িতে প্রেমনাম সঙ্কীর্তন আরও জোরদার হতে থাকল। প্রেমিক মানুষটার দেখা পেতে, প্রাণের প্রদীপ জ্বেলে প্রতীক্ষায় থাকা ভাবাকুল ভক্তদের আর্তি আগের চেয়ে বেশি তীব্র হলো। নীল আকাশ অথবা মহাসমুদ্র কোথা থেকে তিনি আত্মপ্রকাশ করবেন, না জেনেও ভেতরের রুদ্ধ সঙ্গীতের প্রবাহ মুক্ত করে দেওয়ার তাগিদে গৃহলালিত নানা বৈষ্ণব আখড়ায় নাচ গানে তারা উত্তরোত্তর মেতে উঠল।
ইতিহাসের এই রঙ্গমঞ্চের কোনও খবর না রেখেই বালক নিমাই, যার এক নাম গোরা, বিশ্বম্ভর, বড়ো হচ্ছিল মা-বাবার সংসারে। তাকে আগলে রেখেছিল তার দাদা, বিশ্বরূপ। বিশ্বরূপের জন্মের আগে, তার আট দিদি শচী-জগন্নাথের আট কন্যা-সন্তানের কেউ বাঁচেনি। ছোটভাই গোরাকে নিয়ে বিশ্বরূপের মায়া-মমতা যে তাই একটু বেশি ছিল, বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশ্বরূপকে নিমাই কী চোখে দেখত, তা জানার উপায় না থাকলেও দাদার সন্ন্যাস নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার ঘটনা শিশু নিমাই-এর মনে গভীর ছাপ ফেলেছিল, তা অনায়াসে বলা যেতে পারে। সন্ন্যাসী হওয়ার বীজ, নিমাই-এর মনে হয়তো তখনই রোপিত হয়। ভারতীয় হিন্দু তরুণের চিন্তাতে সন্ন্যাস নেওয়ার প্রবণতা, এ যুগের ভাষায় ‘ক্রেজ’, প্রাচীন কাল থেকে ছিল, আজ পর্যন্ত কিছুটা থেকে গেছে। জনসাধারণের চোখে নিজেকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে ‘সন্ন্যাস’ নেওয়া ছিল প্রধান উপায়। গয়ায়, মৃত বাবা, জগন্নাথ মিশ্র এবং প্রয়াত স্ত্রী লক্ষ্মীদেবীর পিণ্ডদান সেরে ঈশ্বরপুরীর কাছ থেকে দশাক্ষর গোপাল মন্ত্রে দীক্ষা নিয়ে নবদ্বীপে ফিরে এলেও অল্প দিনে নিমাই টের পেলেন যে শুধু দীক্ষিত হয়ে বেশিদূর এগোনো যাবে না। সাধারণ মানুষের আস্থাভাজন হতে সন্ন্যাস নেওয়া জরুরি। ২৩ বছর ১১ মাস ৬ দিন বয়সে কাটোয়ায় কেশব ভারতীর কাছে তিনি সন্ন্যাস গ্রহণ করলেন। তাঁর আচমকা সন্ন্যাসী হয়ে যাওয়ার কার্যকারণ স্পষ্ট জানা না গেলেও অনুমান করা যায়, চব্বিশ বছর বয়স পর্যন্ত যেভাবে তিনি জীবনযাপন করেছেন, শাস্ত্রীয় নিষেধাজ্ঞা না মেনে সমাজের সব স্তরের মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করেছেন, এমন কি অন্ত্যজ, নবশাকদের ঘরে অন্নজল খেতে দ্বিধা করেননি, তা ব্রাহ্মণ্যবাদীদের শুধু যে অনুমোদন পায়নি, তাই নয়, বরং তুমুল বিরোধিতার মুখোমুখি হয়েছিল। খুন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল তাঁর। প্রকাশ্যে সঙ্কীর্তন করার অধিকারের দাবিতে কাজিবিরোধী আন্দোলনে, কয়েক বছর আগে যারা তাঁর সঙ্গী ছিল, তাদেরও অনেকে পছন্দ করছিল না শূদ্র, অন্ত্যজদের সঙ্গে তাঁর ওঠা-বসা। বিশেষ করে নবদ্বীপে আগন্তুক, আলাভোলা স্বভাবের অবধূত, নিত্যানন্দের যাবতীয় কাজকর্মের দায় এসে চাপছিল নিমাই-এর ওপর। নবদ্বীপে আসার অল্পদিনের মধ্যে নিমাই-এর ছায়াসঙ্গী হয়ে উঠেছিলেন নিত্যানন্দ। নিত্যানন্দ থেকে হয়ে গিয়েছিলেন নিতাই। অল্প চেনারা ভাবতে শুরু করেছিল—নিমাই, নিতাই দুই ভাই। নিত্যানন্দের মধ্যে শচীদেবী যেন ফিরে পেলেন সন্ন্যাস নিয়ে ঘর ছেড়ে চলে যাওয়া বড় ছেলে বিশ্বরূপকে। নিতাইকে পাশে পেয়ে নিমাই-এর প্রভাবের পরিধি বিস্তৃত হওয়ার সঙ্গে গভীরতর হতে থাকল তাঁর জনসংযোগ। মাটি থেকে তিনি উঠে আসতে শুনলেন গানের সুর আর ভাব। সাধারণ মানুষ যে ইতিহাসের প্রকৃত শক্তি, নাচ-গানের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে, সেই যুগে, নিজের মতো করে তিনি আগেই বুঝেছিলেন। জনশক্তির সেই প্রবল জোয়ারকে ‘চোয়াড়’ অধ্যুষিত রাঢ় ও গৌড়বাংলাতে সংগঠিত করে তিনি নতুন এক জাতি গড়ার চিন্তা, সম্ভবত নিজের অজান্তে শুরু করেছিলেন। ‘জননী, জন্মভূমি’র অনুধ্যান, ভারতীয় জীবনে হাজার বছরের বেশি পুরনো (ভবভূতির ‘উত্তররাম চরিতে’’জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী’ শ্লোকটি আছে) হলেও পাশ্চাত্য ‘নেশন’ স্টেট ধারণা চৈতন্যর যুগে সম্ভবত অপ্রচলিত ছিল। হয়তো অন্য চেহারায় ছিল। নিজে ‘বাঙাল’ হয়েও শ্রীহট্টর ‘বাঙাল’দের নিয়ে নিমাই যে হাসাহাসি করত, চৈতন্যজীবনীকাররা তা জানিয়ে গেছেন। শুধু কি বাঙালদের উচ্চারণের হাস্যকরতাতে থেমে গিয়েছিল চৈতন্যের কৌতুক? সম্ভবত তা নয়। চর্যাপদের সময় থেকে, আনুমানিক চৈতন্যের জন্মের সাত আটশো বছর আগে থেকে বাংলা ভাষার সঙ্গে যে বাঙালি জাতি গড়ে উঠছিল, চৈতন্যের সময় পর্যন্ত তার কাঠামো ছিল নড়বড়ে, আহার-বিহার, চাল-চলন, সংস্কৃতি—সবটাই ছিল গোষ্ঠীবদ্ধ, সম্প্রদায়মুখী, কখনও কিছুটা ভদ্র, কিছুক্ষেত্রে চরম ইতর। ‘চুয়াড়’ নরগোষ্ঠী অধ্যুষিত রাঢ় বাংলার মানুষের আচরণ যে কত রুক্ষ, ইতর ছিল তার প্রমাণ অভদ্র মানুষকে আজও ‘চোয়াড়ে’ বলা হয়। ‘ব্রাবৈকা’ সংস্কৃতির (ব্রাহ্মণ, বৈদ্য, কায়স্থ মিলে ব্রাবৈকা) সেটা নির্মাণপর্ব, পুরোপুরি তখনও গড়ে ওঠেনি। ম্লেচ্ছ আর যবনদের ছায়া মাড়ানো পাপ, আবার ‘ব্রাবৈকা’ সমাজের মধ্যে নিজস্ব শিষ্টাচার, সংস্কৃতি, অনেকটাই গড়ে উঠেছে। সঙ্কীর্তনের মোড়কে ব্রাবৈকা সংস্কৃতির চৌহদ্দিতে শূদ্র, নবশাক, অন্ত্যজ, যবনদের টেনে আনতে চেয়েছিলেন চৈতন্য। যুগোপযোগী বাঙালি জাতির আদি কাঠামো গড়তে চেয়েছিলেন। বাঙালির চরিত্রে, আচরণে আক্ষরিকভাবে যুক্ত করেছিলেন ‘শ্রী’। নামের আগের শ্রী, শ্রীমতী লাগানো তাঁরই প্রবর্তন। উত্তর মধ্য ভারতে নিত্যস্মরণীয় যে দুটো নাম শুধুই ‘রাম’ আর ‘কৃষ্ণ’ চৈতন্যের সংস্পর্শে তাঁরা হলেন ‘শ্রীরাম’, ‘শ্রীকৃষ্ণ’, ‘রাধা’ হলেন ‘শ্রীমতী’ রাধা, তাঁর সখীরা ‘শ্রীমতী’ ললিতা, ‘শ্রীমতী’ বিশাখা। স্বয়ং চৈতন্য হলেন শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য’, ‘শ্ৰী’চৈতন্য। তাঁর অনুগামীদের সকলের নামের আগে বসল ‘শ্রী’ শেষে অর্থাৎ ‘সারনেম’ থাকল ‘দাস’। দাস মানে ‘চাকর’, ‘ভৃত্য’ নয়, দাস অর্থে এখানে সেবক। সেবক অর্থে যে সখা, বন্ধু, ভাই, সন্তান এমনকি প্রেমিকও, তা বোঝা যায়- জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস, বলরামদাস প্রমুখের লেখা পদাবলী কবিতা পড়ে। প্রেমের গান, বন্ধুত্বের গান, অনুরাগ, অভিমান, ভালোবাসা, বিরহ, স্নেহ, আর মানবিক সম্পর্ক নিয়ে লেখা যত গান, সব একাকার হয়ে গেল। গানের ঝর্নাতলা খুলে দিলেন শ্রীচৈতন্য। বাঙালিকে ভদ্র, বিনয়ী, মর্যাদামণ্ডিত জাতি হিসেবে গড়ে ওঠার প্রেরণা দিলেন। বলা যায়, বাংলার প্রথম নবজাগরণ, আদি, অকৃত্রিম বাঙালির নবজাগরণের তিনি স্রষ্টা, তিনি-ই প্রধান, প্রথম ঋত্বিক। তিনি হোতা, তিনিই আহুতি। আরও চারশো বছর পরে, উনিশ শতকী নবজাগরণের উল্লেখ্য যাবতীয় নেতা, প্রবক্তা, রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মধুসূদন দত্ত, রামকৃষ্ণ পরমহংস, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ বরেণ্যদের প্রভাবের যোগফলের চেয়ে বহুগুণ বেশি, বাঙালি জাতি নির্মাণে যোগ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন শ্রীচৈতন্য। তাঁর কর্ষিত নবজাগৃতির মাটিতে এক পশলা অকাল বর্ষণের মতো ঊনিশ শতকে যে নবজাগরণ ঘটেছিল, তা মাটির ওপরের স্তরকে যৎসামান্য ভেজালেও ভূস্তরের গভীরে ঢুকতে পারেনি। বাংলা, উড়িষ্যা, আসাম, দক্ষিণ ভারতের নানা প্রত্যন্ত গ্রামে তাঁর সমন্বয়বাদী মানবিক যে মতাদর্শ পৌঁছে গিয়েছিল, পরে কয়েকশো বছরে তা নানা উপধর্মে ভাগ হয়ে গেলেও বৃন্দাবনের বৈষ্ণবসমাজ, গৌড়ের বৈষ্ণবসমাজ থেকে শুরু করে, আউল-বাউল, ফকির, সাহেব-ধনী, কর্তাভজা, সহজিয়া, কোনও সম্প্রদায় শ্রীচৈতন্যকে ভোলেনি। শ্রীচৈতন্যের আখর জুড়ে অর্থাৎ গৌরাঙ্গ ভজনা, গৌরচন্দ্রিকা গেয়ে শুরু হয় তাদের সঙ্গীত। চোয়াড়ে বাঙালি সম্প্রদায়কে তিনি সমুদ্র চিনিয়েছেন, (নীলাচল), নীল আকাশ, মেঘ, সবুজ দিগন্তরেখা, ফুলফল, পশুপাখি, সৌন্দর্যের উৎসবিন্দুগুলো দেখিয়ে, সৌন্দর্য-সচেতন কেেছন। মাত্র সাতচল্লিশ বছরের জীবনে নবদ্বীপে চব্বিশ আর পুরীতে তেইশ বছর কাটিয়ে, কোনও ধর্মগ্রন্থ না লিখে পাঁচশো বছরের বেশি, অনুগামীদের কাছে যিনি নিত্যস্মরণীয় হয়ে আছেন, যাঁকে নিয়ে আলাপ আলোচনা, গ্রন্থপ্রকাশ সমানে ঘটে চলেছে এবং ধর্ম, সমাজ, রাজনীতি (ইসকন থেকে মণ্ডল কমিশন), সব জায়গাতে নিয়মিত লম্বা হচ্ছে যাঁর ছায়া, সেই মানুষটি (ঈশ্বর বা দেবতা নন), কোন মাপের মানুষ ছিলেন, কী চেয়েছিলেন তিনি, তাঁর জীবনকথা, তাঁকে নিয়ে তৈরি কল্পকাহিনী, কিংবদন্তী, সব জুড়ে জুড়ে আমার উপন্যাস, ‘গোরা’। মাতৃশক্তিতে যা ধারাবাহিক প্রকাশ পেতে চলেছে। বলে রাখা ভালো, ‘গোরা’ নামে রবীন্দ্রনাথের এক বিখ্যাত উপন্যাস থাকলেও এবং উপন্যাসের নায়কের নাম ‘গোরা’ হলেও, গোরার জন্মের যে বিবরণ রবীন্দ্রনাথ শুনিয়েছেন, সেই বিবরণের আড়ালে আরও এক বিবরণ থাকতে পারে। কলকাতার এক বিখ্যাত আইনজীবীর ছেলে, চব্বিশ বছরের গোরা, শহরের এক ‘নাইট ক্লাবে’ ভোর রাত পর্যন্ত হল্লা করে, বাড়ি ফিরে নেশায় খোঁয়াড়িতে দেখল, এই একুশ শতকেও গোরার নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ, সেখানে পাঁচশো বছর আগেও গোরার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের গোরা এবং সেও আছে, মহাসময় মিশে রয়েছে মুহূর্তে।
এতবড় কাজ, পারব কি শেষ করতে? আপনারা শক্তি জোগান আমাকে।
.
লেখক, গোরা ও গ্রন্থপঞ্জী প্রসঙ্গে
শৈবাল মিত্রের প্রয়াণের পর পাণ্ডুলিপি থেকে গ্রন্থের অধিকাংশ অংশের পাঠোদ্ধার এবং অতিদ্রুতার সঙ্গে গ্রন্থপ্রকাশের কারণে ‘গোরা’র প্রথম সংস্করণে গ্রন্থপঞ্জী সংকলিত হতে পারেনি; যদিও এ ধরণের ইতিহাসনির্ভর উপন্যাসে গ্রন্থপঞ্জী জরুরি-ই নয় কেবল, অনিবার্য বলা যায়। লেখক গ্রন্থপঞ্জীর আকারে সাজিয়ে না গেলেও প্রতিটি সহায়ক গ্রন্থের নাম এবং তার লেখকের নাম তাঁর পাণ্ডুলিপির ডাইরিতে লিখে গেছেন। কোথাও এই গ্ৰন্থ নামগুলি রয়েছে সারিবদ্ধ ভাবে, কোথাও বা বিক্ষিপ্ত, অবিন্যস্ত ভাবে রয়েছে একটি বা কয়েকটি গ্রন্থনাম। এবার সেসব গুছিয়ে দেওয়া হল গ্রন্থপঞ্জীতে।
‘গোরা’ প্রকাশিত হবার পর পাঠক মহলে নানা প্রশ্ন উঠেছে; কাগজে চিঠি ও আলোচনা প্রকাশিত হয়েছে; কেউ বা শৈবাল মিত্রের বাড়িতেও এসেছেন নানা জিজ্ঞাসা নিয়ে। সেসব প্রশ্নের কথা মনে রেখে এবারের সংস্করণে কিছু প্রাসঙ্গিক তথ্য ও তথ্যসংশ্লিষ্ট আলোচনা লিপিবদ্ধ হল।
‘গোরা’ উপন্যাসটি শৈবাল মিত্র রচনা করেছেন প্রায় ৫০০ বছর আগের বাংলাদেশের এক উত্তাল সময়ের প্রেক্ষাপটে। সেই ইতিহাসের বহু উপাদান আজ অবলুপ্ত। চৈতন্যজীবনীগ্রন্থগুলিতে যা আছে তাতে অনেক ক্ষেত্রেই অতিকথন ও অতিরঞ্জন রয়েছে; রয়েছে ভক্তির ভাবোদয়। চৈতন্যের অন্তর্ধান আজও রহস্যাবৃত। তবু একদিন বাংলাদেশে ‘চৈতন্যচন্দ্রোদয়’ হয়েছিল— একথা আজ ঐতিহাসিক সত্যই নয় কেবল; জীবনসত্য। সে-ই আলো আজও আমাদের চৈতন্যে নিয়ত বিম্বিত ও বিকিরিত। শৈবাল মিত্রকে অনুপ্রেরিত করেছে এই আলোর বিম্বন ও বিকিরণ।
‘গোরা’ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে পাঠক ও সমালোচক মহলে এই প্রশ্ন বারেবারে উচ্চারিত হয়েছে যে মার্ক্সীয় দর্শনে বিশ্বাসী শৈবাল কিভাবে চৈতন্যের ভক্তিভাবে আপ্লুত হলেন; আকণ্ঠ নিমজ্জিত হলেন? আসলে শৈবালের আমৃত্যু অন্বিষ্ট ছিল মানুষ, জীবন আর জীবন সম্পৃক্ত মানুষের ইতিহাসের অবিরত বিবর্তন। তাঁর সমস্ত লেখায় প্রতিফলিত হয়েছে দর্শনের এই সারাৎসার; দৃষ্টির এই তীব্রতা ও তীক্ষ্ণতা। অতএব ‘গোরা’ তাঁর সাহিত্যধারায় অভিনব হলেও অর্বাচীন নয়, নয় অনিকেত।
ভক্তির আড়ম্বর, ঐতিহাসিক তথ্যের অভাব আর রহস্যে অবগুণ্ঠন থেকে গোরা-কে বের করে আনতে চেয়েছেন শৈবাল। পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকের বাংলার পটভূমি ও পরিবেশের মধ্যে যে-গোরার জন্ম ও উত্থান; তার বিকাশ ও বিচরণ সে সম্পর্কে নিয়ত সচেতন থেকেও গোরাকে মানুষ হিসাবেই আমাদের মাঝখানে আনতে চেয়েছেন লেখক। দীর্ঘ ১০ বছর তিনি বাংলার ইতিহাস নিয়ে নিয়ত পড়াশোনা করেছেন; সরেজমিনে বুঝতে চেয়েছেন গোরার পদসঞ্চারের ও পদচারণার ধারাবাহিকতাকে। ঘরে বসে কেবল বই পড়ে রচিত হয়নি এই মহাকাব্যোপম উপন্যাসটি; শান্তিপুর থেকে নবদ্বীপ, নদীয়া থেকে নীলাচল; বারানসী থেকে কন্যাকুমারী, গয়া থেকে বৃন্দাবন- যখন যেখানে প্রয়োজন পড়েছে অসুস্থতাকে অনায়াসে অগ্রাহ্য করেছেন তিনি। ইতিহাসের কুহেলিকাকে সরিয়ে সরিয়ে খুঁজে আনতে চেয়েছেন একজন মানুষকে যিনি সাধারণ থেকে হয়ে উঠেছেন অসাধারণেরও অসাধারণ।
পাঠকের প্রতি অশেষ আস্থা ছিল শৈবাল মিত্রর। সে-ই আস্থা যে অভ্রান্ত তা বোঝা গেল প্রথম প্রকাশের তিনমাসের মধ্যেই প্রকাশিত হচ্ছে ‘গোরা’র দ্বিতীয় সংস্করণ। এ কোনো পুরস্কার পাওয়া বই নয় এখন-ও, যে উষ্ণ সুখাদ্যের মত বিকিয়েছে সঙ্গে সঙ্গে। পাঠক ভালোবেসে পড়েছে এ বই। জীবনের যে নানা দিকের ছবি নানা বর্ণে লেখক এঁকেছেন, যে নির্লিপ্ত অবস্থানে থেকে আধুনিক গোরাকে ঊনবিংশ শতকের গোরার সমালোচনায় নিবদ্ধ করেছেন এবং মধ্যযুগের গোরার উন্মেষ ও উদয়ের কাহিনি শুনিয়েছেন—তাতে অভিভূত হয়েছে পাঠক। এ যুগের গোরা, রবীন্দ্রনাথের গোরা আর মধ্যযুগের গোরা— ত্রিস্তরের এক বিন্যাসে উপস্থাপিত এ উপন্যাসের ধারাবাহিক কাহিনি বা সিরিয়াল।
কেন এই বিন্যাস নিয়েছেন লেখক এ উপন্যাসে? নিজের দায় এড়ালেন কি তিনি সিরিয়ালের ধারায় আখ্যান বুনে? এ প্রশ্ন তুলতেই পারে কোনো সচেতন পাঠক। কিন্তু পাঠকের সচেতনতাই তখন তাকে পৌঁছে দেয় উপন্যাস শৈলীর এক চমকপ্রদ বিন্দুতে। মনে রাখতে হয়, এ উপন্যাসের নায়ক কোনো প্রতীক চরিত্র নয়; সে স্বয়ং চৈতন্য। চৈতন্যের আবির্ভাবের পরিমণ্ডল, চৈতন্যের জন্ম, চৈতন্যের উত্থান, সেই উত্থানের আলোড়ন এবং চৈতন্যের অন্তর্ধান—এসব প্রত্যেকটি ঘটনাকে লেখক সযত্নে এঁকেছেন এবং এই অঙ্কনের প্রতিটি টানে ও বর্ণবিচ্ছুরণে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন মানুষ চৈতন্যকে। ফলে চৈতন্যের জন্মের কাহিনিকে প্রথাগত অলৌকিক মহিমায় মণ্ডিত করেই নিজের দায় এড়িয়ে যাননি লেখক; তিনি এই অলৌকিকতাকেও লৌকিক বুনট দিয়েছেন বিশ্বরূপের পুঁথি রচনার মধ্য দিয়ে —বুরহানউদ্দিনের দরগায় প্রবল ঝড়ের রাতে যা ঘটেছিল, সেই ঝঞ্ঝায় শচীর মাতৃহৃদয়ের বিহ্বলতা, বিশ্বরূপের মঙ্গল কামনায় মায়ের নিজের বিপন্নতার অসীম আর্তি এবং সন্তান লাভের অলৌকিক আনন্দমুহূর্তের এক শাশ্বত লৌকিক বেদনা— নিঃসংশয়ে এ উপন্যাসের এক আকর্ষনীয় অংশ।
শৈবাল মিত্র একালের ঔপন্যাসিক। তাঁর উপন্যাসে তিনি রচনা করতে চান একালের দৃষ্টিতে সেকালকে। তিনি পেতে চান রক্তমাংসের চৈতন্যকে। সে কাজ তিনি করেছেন নিরলস পরিশ্রমে এবং নিজের ঔপন্যাসিক স্বকল্পিত বিভাকে ব্যবহার করে। শচী গর্ভবতী হলেন মাজারে—এ পরমতম দান ঈশ্বরের; মধ্যযুগের নারীর এই বিশ্বাসের ফলেই তাঁর মধ্যে কোনো বিকার আসেনি, গোরার জন্ম দিব্যমহিমার পবিত্রতায় মগ্ন করেছে তাঁকে। কিন্তু জগন্নাথকে? বিশ্বরূপের পুঁথিতে প্রতিফলিত সেদিনের যে শিশুমন তার সঙ্গে নিজের মনের সংশয় বিরাগ ও বিতৃষ্ণাকে মিলিয়ে প্রতি মুহূর্তে যেভাবে অস্তিত্বের ঘোরতর সংকটে আবর্তিত হয়েছে জগন্নাথ, শৈবাল তা রূপায়িত করেছেন নিরঙ্কুশ। জগন্নাথ শচীকে অভিযুক্ত করতে পারেনি; কারণ স্বামীর মত নিয়েই মাজারে ত্রিরাত্রি বাস করেছিল শচী। গোরার জন্ম মেনে নিতে পারেনি জগন্নাথ; অকাল মৃত্যুই মুক্তি দিয়েছে তাকে।
জন্মে নয়, কর্মেই মানুষের পরিচয়, নিজের জন্ম থেকে ও জীবন থেকেই গোরা পেল এ শিক্ষা; আধুনিক গোরাদের যা অনুপ্রেরণা যোগাবে নিরবধি। রবীন্দ্রনাথের গোরা আইরিশ সন্তান কিন্তু লালিত সংস্কারাচ্ছন্ন পিতা কৃষ্ণদয়ালের পরিবারে। পালিকা মাতা আনন্দময়রী উদারতার আলো তার মধ্যে এসে পড়েছে অনেক পরে—তখন সে দেশকালের সীমাকে অতিক্রম করে গেছে অনাবিল। রবীন্দ্রনাথের গোরা তাত্ত্বিক থেকে প্রায় হঠাৎ-ই হয়ে পড়ল বিশ্বপথিক। কিন্তু মধ্যযুগের গোরা শুরু থেকেই গুরুচণ্ডালী। তার টান অনেক বেশি অনুভব করে একালের গোরা। সিরিয়ালের গল্পের বিন্যাসের ত্রিস্তরে শৈবাল মিত্র এভাবেই সংযুক্ত করেছেন মধ্যযুগের গোরাকে; প্রাসঙ্গিক করেছেন মধ্যযুগের গোরাকে।
ঔপন্যাসিক সাধনার ধন যে জীবন তাকে প্রতিটি শব্দে বিন্যস্ত করতে চেয়েছেন লেখক তাঁর ‘গোরা’য়। তত্ত্ব ও তথ্যকে মন্থন করে, রহস্যের বাতাবরণকে সরিয়ে দিয়ে শৈবাল সৃষ্টি করেছেন তিলোত্তম গোরাকে। তাই গোরার অন্তর্ধান রহস্যও এ উপন্যাসে বিতর্কে আবৃত হয়ে পড়েনি কোনো ভাবেই, অনন্তকালের ধারায় তা বিস্তার লাভ করেছে সীমাহীন :
খোলা জানলা দিয়ে নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে ত্রিদিবনাথ দেখল, পাঁচশো বছর আগের গোরার সঙ্গে কাল থেকে কালান্তরে হেঁটে চলেছে আরো অনেক গোরা, গোরার মিছিল।
—সুদীপ কুমার চক্রবর্তী
.
গ্রন্থপঞ্জী
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন