সমাজে স্ত্রী-পুরুষের প্রেমের প্রভাব

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

স্ত্রী-পুরুষগত প্রেমের ন্যায় প্রবল শক্তি আর কিছু আছে কি না সন্দেহ। এই শক্তি ষোলো আনা মাত্রায় সমাজের কাজে লাগাইলে মানবসভ্যতা অনেকটা বল পায়। এই শক্তি হইতে বঞ্চিত করিলে সমাজের একটি প্রধান বল অপহরণ করা হয়। দাবাহীন শতরঞ্চ খেলার মতো হয়। য়ুরোপীয় সমাজে এই শক্তি সম্পূর্ণ প্রয়োগ করা হইয়াছে। তাহাদের স্ত্রী-পুরুষপ্রেম ব্যক্তিবিশেষে বন্ধ নহে, সমস্ত সমাজের মধ্যে সঞ্চারিত। স্ত্রী-সাধারণের প্রতি পুরুষসাধারণ এবং পুরুষসাধারণের প্রতি স্ত্রীসাধারণের আকর্ষণে সমস্ত সমাজ গতিপ্রাপ্ত হইতেছে। স্ত্রী-প্রকৃতি এবং পুরুষ-প্রকৃতি উভয়ে আপনাকে পরিপূর্ণ মাত্রায় বিকশিত করিবার চেষ্টা করিতেছে। প্রেমের প্রভাবেই মানব সমগ্রভাবে পরিস্ফুট হইয়া উঠে। স্বাভাবিক নিয়মে পুষ্প ও ফল যেমন সমগ্রভাবে সূর্যের উত্তাপ গ্রহণ করে, তেমনি প্রেমে মানব-প্রকৃতির মধ্যে সর্বত্র সমভাবে উত্তাপ সঞ্চারিত করিয়া দেয়, তাহার চূড়ান্ত সুমিষ্টতা ও সৌরভ তাহার আদ্যোপান্তে পরিণত হইয়া উঠে। অনুশাসন ও সংহিতা ধোঁয়া দিয়া পাকানোর মতো তাহাতে এককালে সর্বাঙ্গীণ পরিণতি হয় না। তাহাতে কোথাও রঙ ধরে কোথাও ধরে না, তাহাতে আঁঠি পর্যন্ত পাকিয়া উঠে না। প্রেমে আমাদের অন্তঃকরণ সজীব হইয়া উঠিয়া বাহিরের সজীব শক্তিকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করিতে পারে– প্রেমের অভাবে অন্তঃকরণ অসাড় থাকে, কেবল বাহিরের শক্তি তাহার উপরে বলপ্রয়োগ করিয়া যতটুকু করিয়া তোলে। অতএব সংহিতা অনুশাসন মুমূর্ষু সমাজের প্রতি সেঁকতাপের ন্যায় প্রয়োগ করা যাইতে পারে। সজীব সমাজের আপাদমস্তকে উক্ত কৃত্রিম তাপ অবিশ্রাম প্রয়োগ করিলে তাহার স্বাভাবিক তেজ হ্রাস হয়। য়ুরোপীয় সমাজে স্ত্রী-পুরুষপ্রেম স্বাভাবিক ব্যাপ্ত সূর্যতাপের ন্যায় সমাজের সর্বাঙ্গে পত্র, পুষ্প, ফল বীর্য ও সৌন্দর্য সমগ্রভাবে উদ্ভিন্ন করিয়া তুলিতেছে। স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা বায়ুর ন্যায় অদৃশ্যভাবে সর্বত্র প্রবাহিত হইতেছে। কেবল যন্ত্রের ন্যায় জড়চালনা নহে জীবনের বিচিত্র গতিহিল্লোল রক্ষিত হইতেছে।

কিন্তু এই জীবন পদার্থটা অত্যন্ত দুরায়ত্ত। তাহাকে কাটাছাঁটা নিয়মের মধ্যে আনা যায় না। তাহার সহস্রমুখী নিয়ম সহজে ধরা দেয় না। অতএব যাহারা সমাজকে একটা স্বকপোলকল্পিত নিয়মের মধ্যে বাঁধিতে চাহে এই জীবন পদার্থটা তাহাদের অত্যন্ত বিঘ্নের কারণ হয়। ইহার গলায় ফাঁস লাগাইয়া ইহাকে আধমারা করিয়া তবে তাহাদের উদ্দেশ্য সফল হয়। ইহার নিজের একটা জটিল নিয়ম আছে কিন্তু সেটাকে কায়দা করিয়া আপন মতের স্বপক্ষে খাটাইয়া লওয়া অত্যন্ত দুরূহ। অতএব প্রকৃতিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করিয়া যাঁহারা উন্নতির একটা ভারি সহজ উপায় বাহির করিতে চান, তাঁহারা এই উপদ্রবটাকে সর্বাগ্রে নিকাশ করিতে ইচ্ছা করেন। স্ত্রী-পুরুষপ্রেম ভারতবর্ষীয় সমাজের মৃত্যুবৎ শান্তির পক্ষে অত্যন্ত ব্যাঘাতজনক, তাহাতে সমাজে একটা জীবনপূর্ণ চাঞ্চল্য সর্বদা সঞ্চরণ করিতে থাকে; এই চাঞ্চল্য সম্পূর্ণ দমন করিয়া সমাজকে নিতান্ত ভালোমানুষ করিয়া তোলাই আমাদের উদ্দেশ্য ছিল। স্ত্রীলোকদিগকে প্রাচীররুদ্ধ করিয়া রাখা সেই উদ্দেশ্য সফলতার অন্যতম কারণ হইয়াছে। অনেক বিপদ অনেক অশান্তির হাত এড়ানো গিয়াছে, সেইসঙ্গে অনেকখানি জীবন একরকম চুকাইয়া দেওয়া গেছে। আমরা সকল সভ্যসমাজ অপেক্ষা বেশি ঠাণ্ডা হইয়াছি, তাহার কারণ আমাদের নাড়ি নাই বলিলেই হয়।

আমাদের দেশে পরিবার আছে, কিন্তু সমাজ নাই তাহার এক প্রধান কারণ স্ত্রীলোকেরা পরিবারের মধ্যে বদ্ধ, সমাজের মধ্যে ব্যাপ্ত নহে। স্ত্রীলোকের প্রভাব কেবলমাত্র পরিবারের পরিধির মধ্যেই পর্যাপ্ত। পরিবারের বাহিরে আর মানব সমাজ নাই, কেবল পুরুষ সমাজ আছে। কেবল পুরুষে পুরুষ গড়িতে পারে না। এমন-কি পুরুষ প্রকৃতি গড়িয়া তুলিতে স্ত্রীলোকেরই বিশেষ আবশ্যক। কারণ, স্ত্রীলোকেই চাহে, পুরুষ পরিপূর্ণ রূপে পুরুষ হউক। পুরুষের উন্নত আদর্শ স্ত্রীলোকের হৃদয়েই বিরাজ করিতে পারে। স্ত্রীলোকের জন্যই পুরুষদিগকে বিশেষরূপে পুরুষ হওয়া আবশ্যক।

কেহ বলিতে পারেন পরিবারের মধ্যে স্ত্রীলোকের প্রভাব আবদ্ধ থাকাতে পরিবারের সুখ ও উন্নতি বৃদ্ধি হইয়াছে। সে সম্বন্ধে দুই-একটা কথা বলা যাইতে পারে। প্রত্যেক লোকের সাধারণ শিক্ষা ও বিশেষ কাজ আছে। প্রথমে মানুষ হওয়া আবশ্যক, তাহার পরে কেরানি হওয়া বা জজ হওয়া বা আর কিছু হওয়া। সমস্ত জীবন কেবলমাত্র বিশেষ আবশ্যকের জন্য প্রস্তুত হইতে গেলে কখনো মনুষ্যত্ব লাভ করা যায় না। চাষা আজন্মকাল প্রধানত কৃষি ব্যবসায়ের জন্যই উপযোগী হইয়াছে, এইজন্য সে কেবল চাষা। ব্যবসায়ীদের প্রতি সাধারণ ঘৃণার ভাব কতকটা এই কারণবশত। তাহারা বিশেষ কাজের যন্ত্র হইয়া পড়ে, মানুষ হইতে পায় না। স্ত্রীলোকের সম্বন্ধেও এই নিয়ম খাটে। আমাদের স্ত্রীলোকেরা অতি বাল্যকাল হইতে কেবলমাত্র পরিবারের সেবা করিবার জন্য বিশেষরূপে প্রস্তুত হইতে থাকে। আত্মোৎকর্ষ সাধনের জন্য পৃথিবীতে যে-সকল উপায় আছে তাহা হইতে বঞ্চিত হইয়া তাহারা পরিপূর্ণতা লাভ করিতে পারে না। তাহারা সম্পূর্ণ স্ত্রীলোক হইতে পারে না, তাহারা কেবলমাত্র গার্হস্থ্যের উপাদান সামগ্রী হইয়া উঠে। অবশ্য পরিবারের কাজ করিতে গেলে স্নেহ, প্রেম প্রভৃতি অনেকগুলি উচ্চ মানব প্রবৃত্তির চর্চা স্বভাবতই হইয়া থাকে, এইজন্য আমাদের দেশের স্ত্রীলোক আমাদের দেশের পুরুষ সাধারণের অপেক্ষা অনেক ভালো, তথাপি ইহা নিশ্চয় স্ত্রীলোকের সর্বাঙ্গীণ উন্নতির পথ আমাদের দেশে সম্পূর্ণ রুদ্ধ। আমাদের দেশের স্ত্রীলোকেরা কেবলমাত্র গৃহিণী, তাহা ব্যতীত আর কিছুই নহে। তাহাদের সহিত কেবল আমাদের সুবিধার যোগ, শিক্ষিত পুরুষের অধিকাংশই তাহাদের নিকট রহস্য। অর্থাৎ মানবের উন্নতি ব্যাপারে তাহারা সামান্য দাসীর কার্য করে মাত্র। সুতরাং স্বভাবতই তাহাদের আত্মসম্ভ্রম থাকে না এবং সমাজের নিকট হইতে যথোচিত সম্মান প্রাপ্ত হয় না– দীনভাবে নিতান্ত আচ্ছন্ন, সংকুচিত, জড়ীভূত হইয়া থাকে, তাহাদের সমগ্র মধুর মহৎ স্ত্রীপ্রকৃতি বিকশিত হইয়া উঠিতে পারে না।

চাষা কেবলমাত্র চাষা থাকিয়াই চাষের কাজ একরকম চালাইয়া দিতে পারে, কিন্তু স্ত্রীলোক কেবলমাত্র গৃহিণী হইয়া গৃহকার্য যথোচিত সম্পন্ন করিতে পারে না। কারণ ইহা কেবলমাত্র জড়প্রকৃতির সহিত কারবার নহে। সন্তান পালন কেবলমাত্র স্তনদান নহে, স্বামীর সঙ্গিনী হওয়া কেবল স্বামীর ভাতের মাছি তাড়ানো, পা ধুইবার জল জোগানো নহে। এ-সকল কাজের জন্য প্রথমত সাধারণ শিক্ষা আবশ্যক, মানুষ হওয়া আবশ্যক।

আমাদের জাতি কেবল পরিবারের সমষ্টি, কিন্তু জাতি নহে এবং প্রকৃত প্রস্তাবে সমাজ নহে। স্ত্রী-পুরুষের যোগে এই সমাজ স্থাপিত এবং স্ত্রী-পুরুষের আকর্ষণে ইহা গতিপ্রাপ্ত হইতে পারে। আমরা কেবল অসম্পূর্ণ পুরুষ, স্ত্রীলোকেরা কেবল আমাদের ঘরের কাজ অসম্পূর্ণরূপে করে মাত্র।

২৪। ১১। ১৮৮৮, পারিবারিক স্মৃতিলিপি পুস্তক

সকল অধ্যায়

১. নব্যবঙ্গের আন্দোলন
২. রমাবাইয়ের বক্তৃতা-উপলক্ষে
৩. হিন্দুবিবাহ
৪. প্রাচ্য সমাজ
৫. আহার সম্বন্ধে চন্দ্রনাথবাবুর মত
৬. কর্মের উমেদার
৭. আদিম আর্য-নিবাস
৮. আদিম সম্বল
৯. কর্তব্যনীতি
১০. বিদেশীয় অতিথি এবং দেশীয় আতিথ্য
১১. ব্যাধি ও প্রতিকার
১২. আলোচনা
১৩. স্মৃতিরক্ষা
১৪. মুসলমান মহিলা
১৫. আচারের অত্যাচার
১৬. সমুদ্রযাত্রা
১৭. বিলাসের ফাঁস
১৮. কোট বা চাপকান
১৯. নকলের নাকাল
২০. প্রাচ্য ও প্রতীচ্য
২১. অযোগ্য ভক্তি
২২. পূর্ব ও পশ্চিম
২৩. বাঙালির আশা ও নৈরাশ্য
২৪. ইংরাজদিগের আদব-কায়দা
২৫. নিন্দা-তত্ত্ব
২৬. পারিবারিক দাসত্ব
২৭. জুতা-ব্যবস্থা
২৮. চীনে মরণের ব্যবসায়
২৯. নিমন্ত্রণ-সভা
৩০. চেঁচিয়ে বলা
৩১. জিহ্বা আস্ফালন
৩২. জিজ্ঞাসা ও উত্তর
৩৩. সমাজ সংস্কার ও কুসংস্কার
৩৪. ন্যাশনল ফন্ড
৩৫. টৌন্‌হলের তামাশা
৩৬. অকাল কুষ্মাণ্ড
৩৭. হাতে কলমে
৩৮. একটি পুরাতন কথা
৩৯. কৈফিয়ত
৪০. দুর্ভিক্ষ
৪১. লাঠির উপর লাঠি
৪২. সত্য
৪৩. আপনি বড়ো
৪৪. হিন্দুদিগের জাতীয় চরিত্র ও স্বাধীনতা
৪৫. স্ত্রী ও পুরুষের প্রেমে বিশেষত্ব
৪৬. আমাদের সভ্যতায়
৪৭. সমাজে স্ত্রী-পুরুষের প্রেমের প্রভাব
৪৮. আমাদের প্রাচীন কাব্যে ও সমাজে
৪৯. CHIVALRY

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন