অপারেশন তেলআবিব-২ – ৪

আবুল আসাদ

কোড ডিসাইফার খুলে ভ্রু কুচকে উঠল সিনবেথ প্রধান ডেভিড ডোবিনের। কোড বুকটা ভালো করে নেড়ে চেড়ে দেখল পাতাগুলো কেমন আলগা আলগা। প্রতিটি পাতায় চাপ দিয়ে ফ্ল্যাট করার লক্ষণ স্পষ্ট। ডোবিন বিস্ময়ের সাথে লহ্ম্য করল, চাপের ফলে মাঝখানের কয়েকটা পাতার পেস্টিং আঠা পর্যন্ত আলগা হয়ে গেছে। স্পষ্টই বুঝা যায়, বইটি জোর করে মেলে রাখতে গিয়েই এমনটা ঘটেছে।

কপালটাও কুঞ্চিত হলো ডোবিনের।

পাশ থেকে আরও একটি বই টেনে নিল ডোবিন। বহুল পঠিত বই। কিন্তু পাতাগুলো অসম হয়নি। বিস্ময়টা ধীরে ধীরে সন্দেহের এক কুয়াশায় রূপ নিল।

ডোবিন ভূ-গর্ভস্থ সিকুরিটি রুম থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে নিজের কক্ষে চলে এল। বিশাল টেবিলের পাশে বিশাল চেয়ারটায় বসে ডোবিন ইন্টারকমে সহকারী আইজাককে বলল, তুমি একটু এস এখানে। এক মিনিটের মধ্যেই আইজাক এসে প্রবেশ করল ডোবিনের রুমে।

আইজাককে বসার জন্যে ইঙ্গিত করে ডোবিন বলল, এ কোড ডিসাইফারটা কে নিয়েছিল?

-স্মার্থা, দেশরক্ষা সচিব এরহান শালর্টকের মেয়ে।

-ও মনে পড়েছে। কয়দিন রেখেছিল বইটা?

-৭ দিন।

-স্মার্থা মেয়েটাতো ভালো।

বলে চোখ বুজল ডোবিন। মুহূর্তকয় পরে চোখ খুলল। ডিসাইফার আইজাকের হাতে দিয়ে বলল, ডিসাইফারের পাতায় যে ফিংগার প্রিন্টগুলো আছে তা নিয়ে আস এখুনি।

বইটি নিয়ে আচ্ছা বলে আইজাক বেরিয়ে গেল।

মিনিট পনর পরে আইজাক ডোবিনের ঘরে ফিরে এল ফিংগার প্রিন্ট নিয়ে।

ঘরে প্রবেশ করতেই ডোবিন বলল, কি পেলে আইজাক?

-স্যার ডসিয়ারের সবগুলো ফিংগার প্রিন্ট পরিচিত শুধু একটি ছাড়া।

-অপরিচিত ফিংগার প্রিন্ট কত জায়গায় পেয়েছ?

-যতগুলো পাতা দেখেছি, সবগুলোতেই আছে। আর …….

-আর কি?

ডোবিনের চোখে নতুন কৌতুহল।

-কয়েকটা পাতার আমি Ray একজমিনও করেছি।

-করেছ, কি পেয়েছ তাতে?

চেয়ারে সোজা হয়ে বসল ডোবিন। তার ধারাল চোখ আইজাকের চোখে।

-সাধারণ আলো থেকে একশ গুণ বেশী শক্তিশালী এক ধরনের Ray প্রতিফলন চিহ্ন পাওয়া গেছে ডসিয়ারের পাতায়।

একপোচ কালি যেন ছড়িয়ে পড়ল ডোবিনের গোটা মুখে। এক লহমায় তার বয়সটা ১০ বছর বেড়ে গেল। চোখের ধারাল দৃষ্টি যেন নিস্তেজ হয়ে গেল। কপালের ভাজগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠল।

সে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পায়চারি করতে লাগল। পায়চারি করতে করতে আইজাকের কাছে এসে অপরিচিত সেই ফিংগার প্রিন্টটি তার কাছ থেকে নিয়ে চোখের সামনে ধরল। দেখে স্বগতঃই উচ্চারণ করল, মহিলার ফিংগার প্রিন্ট। আইজাকের হাতে ফেরত দিয়ে ডোবিন বলল, স্মার্থা ছাড়া আর কারো হাতে গেছে এই ডসিয়ার?

‘না’ সূচক মাথা নাড়াল আইজাক।

-তাহলে অন্য কিছু চিন্তা করার আগে স্মার্থাকেই একবার জিজ্ঞেস করতে হয় আর কারো হাতে এই ডসিয়ার পড়েছিল কি না?

একটু থামল ডোবিন। তারপর বলল, আইজাক, যাও, ড্রাইভারকে গাড়ীতে উঠতে বল। আমি দেশরক্ষা সচিবের বাসায় যাব। টেলিফোনে ওর কাছ থেকে অনুমতি নিচ্ছি।

আইজাক বেরিয়ে গেল।

ডোবিন লাল টেলিফোনের রিসিভারটা তুলে নিল হাতে।

কোড ডিসাইফারটা এমিলিয়ার হাতেও গেছে এ কথা জেনে নিয়ে ডোবিন ছুটল এমিলিয়ার বাড়ীতে।

ডেভিড বেনগুরিয়ানের ছেলে ডেভিড সালেম সলোমন যুদ্ধে একটা পা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সেনাবাহিনী থেকে রিটায়ার করেছেন অনেক আগে। ডাকসাইটে একজন অফিসার ছিলেন তিনি সেনাবাহিনীর। এখন একজন শিল্পিপতি ব্যবসায়ী হিসেবে সকলের সম্মানের পাত্র তিনি। তাছাড়া ডেভিড বেনগুরিয়ানের ছেলে হিসেবেও তার একটা বিশেষ মর্যাদা আছে সবার কাছে।

ডোবিন সেনাবাহিনীতে ডেভিড সালেমের অনেক জুনিয়র ছিল। সালেমের ড্রয়িং রুমে বসে তার অপেক্ষা করছিল ডোবিন।

ডেভিড সালেম এসে ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করতেই উঠে দাঁড়িয়ে স্যালুট দিল ডোবিন। বলল, স্যার অসময়ে এসেছি, এমিলিয়ার সাথে একটু কথা বলতে চাই।

ডোবিনের মুখের দিকে তাকিয়ে সালেম বলল, বস ডোবিন। তোমাকে খুব উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছে।

-জি স্যার।

-ব্যাপার কি, কিছু ঘটেছে?

-আমাদের নতুন কোড ডিসাইফারটাও আমাদের হাতের বাইরে চলে গেছে বলে মনে হচ্ছে।

-হাতের বাইরে মানে শত্রুর হাতে? কপাল কুঞ্চিত হয়ে উঠল। ডেভিড সালেমের।

-শত্রুর হাতে গেছে কি না এটা এখনও স্পষ্ট নয়। এজন্যেই এমিলিয়ার সাথে এ ব্যাপারে কয়টা কথা বলতে চাই।

-এমিলিয়ার সাথে, এ ব্যাপারে?

বিস্ময় ঝরে পড়ল ডেভিড সালেমের কণ্ঠ থেকে।

-জি স্যার, কোড ডিসাইফারটা এমিলিয়ার হাতেও গিয়েছিল।

-ব্যাপারটা খুলে বলতো ডোবিন।

এবার কিছুটা উদ্বেগ ডেভিড সালেমের কন্ঠে।

সোফায় একটু নড়ে চড়ে বসে ডোবিন বলল, দেশরক্ষা সচিব এরহান শার্লটকের মেয়ে স্মার্থা মোসাদে ট্রেনিং নিচ্ছে। দেশরক্ষা সচিবের কথায় তাকে ৭ দিনের জন্যে কোড ডিসাইফারটা দিয়েছিলাম। ডিসাইফারটা ফেরত পাওয়ার পর আমরা চেক করতে গিয়ে দেখেছি, ডিসাইফারটার ফটো কপি করা হয়েছে। কার দ্বারা হয়েছে আমরা জানি না। যেহেতু কোড বইটা স্মার্থার কাছ থেকে এমিলিয়াও নিয়েছিল, তাই আমরা তাকেও কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই।

উদ্বেগ ফুটে উঠল ডেভিড সালেমের চোখেও। তিনি সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা ইউনিটেও দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। তিনি জানেন, ছোট্র ঐ কোড বইটার কত মূল্য। জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নই শুধু নয়, জাতির গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের জীবন ঐ কোড বইটা। ডেভিট সালেম বলল, তুমি সাংঘাতিক খবর শোনালে ডোবিন, শত্রুরা আমাদের কোডের কপি পেয়ে গেলে সর্বনাশ। এমিলিয়াকে আমি ডেকে দিচ্ছি।

বলে ডেভিড সালেম বেয়ারাকে নির্দেশ দিল এমিলিয়াকে ডেকে আনারজন্যে।

অল্পক্ষণ পরেই এমিলিয়া এসে ড্রইং রুমে প্রবেশ করল। লাল লম্বা স্কার্ট পরা, মাথায় রুমাল।

ডেভিড সালেম বলল, এস মা।

ডোবিন এমিলিয়ার দিকে মুখ তুলে হেসে বলল, বস মা, কেমন আছ?

-ভাল। আপনি কেমন আছেন, চাচাজান?

-আছি একরকম, খুব ভাল কি থাকতে পারছি।

এমিলিয়া সোফায় তার পিতার পাশে বসল।

মুহুর্ত কয়েক সবাই চুপচাপ।

নীরবতা ভাঙ্গল প্রথমে এমিলিয়ার পিতাই। বলল, তোমার চাচা ডোবিন তোমাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করবে এমি।

বলে ডোবিনের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার কথা শুরু কর ডোবিন।

এমিলিয়া চকিতে একবার পিতার দিকে তাকাল। একটা সন্দেহ, বিশেষ করে ডোবিনকে এভাবে দেখে, তার মনে ঝিলিক দিয়ে গেল। সেই সাথে একটা শংকাও দেখা দিল তার মনে। বোধ হয় চোখে মুখে তার একটা অস্বস্থির ছাপও ফুঠে উঠল।

কিন্তু তা মুহূর্তের জন্যই। ঘটনার কথা স্মরণ করতে গিয়ে তার হৃদয়ে ভেসে উঠল মাহমুদের মুখ। প্রশান্তিতে ভরে উঠল এমিলিয়ার বুকটা। ওঁর কাজে লাগতে পেরেছে এমিলিয়া এর চেয়ে বড় তৃপ্তি তার কাছে আর কিছু নেই।

ডেভিড সালেমের কথায় ডোবিন একটু নড়ে-চড়ে বসল। একটু সামনে ঝুকে বসে জিজ্ঞেস করল, মা এমিলিয়া তুমি তো স্মার্থার কাছ থেকে কোড ডিসাইফার নিয়েছিলে তাই না? এমিলিয়া শান্তভাবে জবাব দিল, জি, নিয়েছিলাম।

-এনে ক’দিন রেখেছিলে?

-বাসায় আনিনি?

-তাহলে?

-স্মার্থার বাসায়ই আমি ওটা দেখেছি। এমিলিয়ার জবাবে ডেভিড সালেমের চোখ দু’টি উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

ডেভিড আবার জিজ্ঞেস করল, তুমি কি গোটা বইটা পড়েছিলে?

-হাঁ গোটা বইটাই আমি দেখেছি।

ডোবিন একটু চুপ করে থাকল। তারপর মুখ তুলে তাকাল এমিলিয়ার দিকে। বলল, তুমি কি বইটার ফটো নিয়েছিলে? ডেভিড সালেমেরও স্থির দৃষ্টি এমিলিয়ার দিকে। তার চোখে কিঞ্চিত উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার ছাপ।

প্রশ্ন শুনে এমিলিয়ার মুখ একটু নীচু হলো। একটা বিমর্ষতার ছাপ ফুটে উঠল তার চোখে মুখে। বাইরে শান্ত দেখালেও বুকটা তার তোলপাড় করছিল। কি উত্তর দেবে সে? পিতা, দাদার মর্যাদার কথা সে জানে। নিজের জন্য তার কিছু ভয় নেই, কিন্তু তার এ স্বীকৃতিতে পিতার এবং দাদার মান মর্যাদা ধূলায় লুটিয়ে পড়বে, এই কথা তার কাছে খুব বড় হয়ে উঠল। তাহলে সে কি করবে? মিথ্যা কথা বলবে? জ্বলজ্যান্ত মিথ্যা কথা সে বলবে কেমন করে? তার প্রিয়তম মাহমুদের কথা তার মনে পড়ল। এ অবস্থায় সে কি করত? নিশ্চয়ই তার মত নীতি-নিষ্ঠ মানুষের মিথ্যা বলার প্রশ্নই উঠে না। যদি তাই হয় তাহলে তার এমিলিয়া জীবনের ভয়ে, বংশ মর্যাদার ভয়ে মিথ্যা কথা বলবে কি করে? এমিলিয়া মন শক্ত করল, সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল। মুখ না তুলেই ধীর কন্ঠে সে বলল, হাঁ আমি ফটো নিয়েছি?

-ফটো নিয়েছো?

ডেভিড সালেম এবং ডোবিন দু’জনের কণ্ঠই আঁৎকে উঠল।

ডেভিড সালেমের চোখে-মুখে একটা কালোছায়া নেমে এসেছে। সে বিস্ময়-বিষ্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছে এমিলিয়ার দিকে। যেন তার বিশ্বাস হতে চাইছে না, এমন কন্ঠে সে দ্রুত জিজ্ঞেস করল, সত্যিই বলছ, তুমি ফটো নিয়েছ?

মুখ না তুলেই এমিলিয়া বলল, জি, আব্বা।

ডেভিড সালেম আর কোন কথা জিজ্ঞেস করতে পারল না। যেন ব্যাপারটা বুঝতে এবং আত্মস্থ হতে তার সময় লাগছে।

এই ফাঁকে ডোবিন জিজ্ঞেস করল ফটোগুলো তোমার কাছে এখন আছে?

-না, নেই।

মুহূর্তে উত্তেজনায় মুখটি লাল হয়ে উঠল ডোবিনের। চঞ্চল হয়ে উঠল সালেমের চোখ-মুখও। এমিলিয়া কিন্তু মুখ তোলেনি। যেভাবে সে মুখ নীচু করে বসেছিল, সেভাবেই বসে থাকল।

ডোবিন আবার জিজ্ঞেস করল কোথায় ফটোগুলো? এবার মুখ তুলে স্পষ্ট কন্ঠে এমিলিয়া বলল, মাহমুদ নামের একজন ওগুলো নিয়ে গেছে?

-মাহমুদ! কে সে, কোথায় থাকে? প্রায় চিৎকার করে উঠল ডোবিনের কণ্ঠ।

আমি তার নাম জানি, কোথায় থাকে জানি না।

এবার ডেভিড সালেম জিজ্ঞাসা করল, কেমন করে, কোথায় তোমার সাথে পরিচয়?

উদ্বেগে যেন ভেঙ্গে পড়তে চাইল ডেভিড সালেমের কণ্ঠস্বর।

এমিলিয়া ধীরকন্ঠে জবাব দিল, একটা দুর্ঘটনার সময় উনি আমাকে রক্ষা করেছিলেন। সেই থেকে পরিচয়। কোথায় থাকেন তার কিছুই আমি জানি না।

ডোবিন ডেভিড সালেমের দিকে একটু চেয়ে এমিলিয়ার দিকে ফিরে আবার জিজ্ঞেস করল, মা এমিলিয়া, তুমি বুদ্ধিমতি, তুমি জান ঐ কোড ডিসাইফারটি শত্রুর হাতে পড়লে ইসরাইল রাষ্ট্রের কি সর্বনাশ হয়ে যাবে। আমরা চাই তার হাত থেকে এই মুহূর্তে ওটা উদ্ধার করি। তুমি তার ঠিকানা দিয়ে আমাদের সাহায্য কর।

চোখে-মুখে এমিলিয়ার একটা অসহায়ত্বের ভাব ফুটে উঠল। বলল, চাচাজান, আমি মিথ্যা কথা বলি না। বলছি, আমি তার ঠিকানা জানিনা।

ভাবছিল ডোবিন মুখ নীচু করে। কিছুপর মাথা তুলে বলল, তার সাথে যোগাযোগ হতো কোথায়, সেটা বলো।

-তার সাথে কোন যোগাযোগ আমি কখনও করিনি। স্পষ্ট কন্ঠে জবাব দিল এমিলিয়া।

মাথা নীচু করে ভাবছিল ডোবিন। কিছুক্ষণ পরে মুখ তুলে ডেভিড সালেমের দিকে চেয়ে বলল, স্যার আপনার সাথে একা কথা বলতে চাই।

ডেভিড সালেমের গোটা মুখমন্ডলটা বিধ্বস্ত, বিমূঢ় ও অসহায়ভাব সেখানে। সে এমিলিয়াকে বলল, মা তুমি একটু ভিতরে যাও।

এমিলিয়া চলে গেলে ডোবিন বলল, বলুন স্যার, এখন কি করণীয়?

-আমিও ভাবছি ডোবিন। কেমন করে এ সর্বনাশ হলো বুঝতে পারছিনা।

-আমার মনে হয় স্যার, এমিলিয়া শত্রু পক্ষের গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের জালে জড়িয়ে পড়েছে।

চমকে উঠল ডেভিড সালেম। বলল, তুমি কি এ রকমটাই মনে করছ?

-আমার কাছে এখনও কিছু স্পষ্ট নয় স্যার।

ডোবিন একটু থামল, একটু দ্বিধা করল। তারপর বলল, পরিস্থিতি যতদূর গড়িয়েছে তাতে এমিলিয়াকে একবার আমাদের অফিসে যাওয়া দরকার। সকলে যাতে মূতমাইন হতে পারে এ জন্যে সকলের সামনেই তার জিজ্ঞাসাবাদ হওয়া উচিত।

মনে মনে কেঁপে উঠল ডেভিড সালেম। তার অতি আদরের একমাত্র কন্যাকে যেতে হবে সিনবেথ অফিসে। এ যাওয়ার অর্থ সে বুঝে। বুকটা তার মোচড় দিয়ে উঠল। কিন্তু সেই সাথে মনে পড়ল রাষ্ট্রের কথা, ইসরাইলী জনগণের কথা, ইহুদী স্বার্থের কথা। আরো মনে হল, অন্যের ক্ষেত্রে হলে এ পরিস্থিতিতে সে কি করত! বড় অসহায় বোধ করল ডেভিড সালেম। পিতৃমন তার কোন যুক্তিই মানতে চায় না। কিন্তু তার পিতৃস্নেহের কি মূল্য! কে এর মূল্য দিবে! সে কি ডোবিনকে বাধা দিতে পারবে? তার পিতৃত্বের অধিকার দিয়ে রাষ্ট্রের অধিকারকে সে কেমন করে ঠেকিয়ে রাখবে! ডেভিড সালেম ডোবিনের দিকে চেয়ে ধীরে ধীরে বলল, এখনি নিয়ে যেতে চাও?

ডোবিনও ডেভিড সালেমের এই অবস্থার সামনে খুবই বিব্রত বোধ করছিল। বলল, তার আগে স্যার আপনারা এমিলিয়াকে একটু বুঝিয়ে দেখুন। মাহমুদের ঠিকানা জানালে ব্যাপারটা সহজ হয়ে যায়।

আবার কেপেঁ উঠল ডেভিড সালেমের মন। ডোবিনরা এ কঠিন পয়েন্টই ধরবে সে জানে। বলল, ঠিক আছে ডোবিন, তুমি আরেকটু বস।

বলে ডেভিড সালেম ভেতরে চলে গেল।

সালেম চলে গেলে ডোবিন টেলিফোন করল অফিসে। টেলিফোনের ওপার থেকে আইজ্যাক কথা বলে উঠল। ডোবিন বলল, আইজাক খবর খারাপ। পাখি আমাদের হাতছাড়া বলে মনে হচ্ছে। ঘটনার মূল এখন এমিলিয়া। তাকে নিয়ে আসছি।

বিস্মিত আইজাক ওপার থেকে কিছু বলতে চাইল। ডোবিন তাকে বাধা দিয়ে বলল, এখন আর কোন কথা নয়। আসি তারপর।

ডোবিন মাথা নীচু করে দাঁড়িয়েছিল গাড়ীর পাশে। এমিলিয়া শান্ত ও স্বাভাবিকভাবে হেটে গিয়ে গাড়ীতে উঠল। তার ইচ্ছা হচ্ছিল পিছন ফিরে একবার মাকে দেখে। কিন্তু সাহস পাচ্ছিল না। মায়ের মুখ সে সহ্য করতে পারবে না। হয়ত সে ভেঙ্গে পড়বে শেষ মুহূর্তে, আর লোকে বলবে আমি ভয়ে কেঁদেছি। তার মনে পড়ল পিতা-মাতার কান্নাজড়িত অনুরোধের কথা। আমি যেন মাহমুদের ঠিকানা বলে দিই, বলে দিয়ে নিজেকে রক্ষা করি, পিতা-মাতার মুখ রক্ষা করি। কিন্তু এ অনুরোধ এমিলিয়া রাখবে কি করে? সে তো আসলেই মাহমুদের ঠিকানা জানে না। এখানেই সবচেয়ে বেশী কষ্ট লাগছে এমিলিয়ার। পিতা-মাতা নিশ্চয়ই মনে করছেন আমি সব জানি, কিন্তু বলছি না। কিন্তু কেমন করে সে তাদের বুঝাবে যে, তাদের এমিলিয়া তাদের সাথে মিথ্যা কথা বলেনি।

ডোবিনের গাড়ী এমিলিয়াকে নিয়ে চলে গেল। এমিলিয়ার মা আইরিনা টলতে টলতে বাড়ীর ভেতরে প্রবেশ করল। চলে গেল শোবার ঘরে।

ওখানে এমিলিয়ার পিতা ডেভিড সালেম চেয়ারে বসে গালে হাত দিয়ে বাইরে তাকিয়েছিল। কাঁচের জানালা দিয়ে তার দু’টি চোখ কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল কে জানে।

আইরিনা তার গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে ডুকরে কেঁদে উঠল। তুমি কোন কিছু বললে না, কেন যেতে দিলে আমার এমিলিয়াকে? কেন কেন, কেন!

ডেভিড সালেম কিছুই বলল না। যেমন বসেছিল তেমনি বসে রইল। ঠিক বোবা মানুষের মত।

আইরিনা ডেভিড সালেমের গা থেকে গড়িয়ে পড়ে গেল মেঝেতে।

ডেভিড সালেম উঠে আইরিনাকে তুলে বলল, ধৈর্য ধর আইরিনা, ইহুদীরা আমরা ইসরাইলের স্বার্থকেই সবার ওপর স্থান দিয়েছি।

-মানি না এ কথা।

-মানতে হবে আইরিনা, ব্যক্তির জন্যে দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দেব কেমন করে?

-দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দেবার প্রশ্ন কেন, আমার এমিলিয়া নির্দোষ।

-তুমি বললেই তো সবাই একথা বলবে না আইরিনা!

-আমার এমিলিয়া যা জানে সত্য সত্যই সব বলেছে!

-সত্য বলেই তো আরো জড়িয়ে পড়েছে!

আইরিনা আবার ফুপিয়ে কেঁদে উঠল, না, আমি এসব কিছু বুঝি না। প্রধানমন্ত্রী তোমার পিতার লোক, তাকে তুমি বল, আমার এমিলিয়াকে ফিরিয়ে আন।

ডেভিড সালেম আইরিনাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, আমাকে এ অনুরোধ করো না, আমি এ কথা তাকে বলতে পারবো না।

এক ঝটকায় উঠে দাঁড়াল আইরিনা। চিৎকার করে বলল, তুমি এত নিষ্ঠুর। তুমি পিতা না? তুমি কি জান না, সিনবেথ কোন নরপশুদের আড্ডা?

বলে কান্না চাপতে চাপতে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল আইরিনা।

চেয়ারে ফিরে এল সালেম। আইরিনার শেষ কথাগুলো প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল তার অন্তরে, তুমি পিতা না? তুমি জান না, সিনবেথ কোন নরপশুদের আড্ডা?

অন্তরটা তারও হাহাকার করে উঠল। এমিলিয়ার অসহায় মুখটি ভেসে উঠল তার চোখে। দু’চোখ ফেটে তার নেমে এল অশ্রু, মাথাটা নুয়ে পড়ল টেবিলে। অবরুদ্ধ কান্নার বাঁধভাঙ্গা উচ্ছাসে কেঁপে উঠতে লাগল তার শরীর।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন