মড়াটা – বনফুল

ব্যাপারটার সূত্রপাত তর্ক থেকে। মেডিকেল কলেজের একটা মেসে থাকত জীবেন কানু আর অমল। তিনজনেই থার্ড ইয়ারে পড়ে। তখন শীতকাল। মড়া-কাটা চলছে। অ্যানাটমি হলের প্রত্যেক টেবিলেই তখন এক একটি করে মড়া শোয়ানো। মাথা মুখ গলা বুক হাত পা পেট কেটে কেটে ছিন্নভিন্ন করছে ছাত্রের দল।

জীবেন আর কানু এক ঘরে থাকে। আর অমল থাকে তেতলার উপর ছোট্ট একটা ঘরে, একা। সে ঘরটা খুব ছোট, তাই সিংগল-সিটেড।

জীবেনদের ঘরেই তর্কটা শুরু হয়েছিল।

কানু। আজ ভাই আমার মনটা বড় খারাপ হয়ে গেছে।

জীবেন। হঠাৎ? বউয়ের চিঠি আসেনি?

কানু। চিঠি এসেছে। মন খারাপ হয়েছে অন্য কারণে—

অমল। টাকা ফুরিয়ে গেছে বুঝি—

কানু। আরে না, না সে সব নয়। টাকা ফুরলেই বা কী! নীলমণি ধার দিতে কোনও দিন আপত্তি করবে না।

নীলমণি কলেজ-রেস্তোরাঁর মালিক। ছাত্ররা তার দোকানে ধারেই খাওয়াদাওয়া করে।

অমল। তাহলে মন খারাপ হবার কারণটা কী হল হঠাৎ!

কানু। আমাকে যে ‘বডি’ (body) দিয়েছে সেটা মেয়েছেলের। তার হাতে উলকি দিয়ে নাম লেখা আছে ‘পারুল’। ছেলেবেলায় আমাদের গাঁয়ে একটি মেয়ের সঙ্গে আমার ভাব ছিল। তার নামও পারুল। অনেক দিন তার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি। আজ ডিসেকশন করতে করতে কেবলই তার কথা মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, সে যেন পিছনে দাঁড়িয়ে আছে।

অমল হো হো করে হেসে উঠল।

অমল। ছি, ছি এত ভিতু তুই। ওর মুখ দেখে চিনতে পারলি না?

কানু। মুখ তো নেই। হেড নেক ডিসেকশন হয়ে গেছে যে—আমি পা-টা করছি, মহসীন পেটটা, গোবিন্দ হাতখানা। ওদের পার্টনার হচ্ছে কালী, যতীন আর মহাবীর। ওরাও বলছিল ওদের গা ছমছম করছে।

অমল। দুৎ! যত সব কুসংস্কারের ডিপো!

জীবেন। তোর কুসংস্কার নেই?

অমল। একদম না।

জীবেন। গরুর মাংস খেতে পারিস!

অমল। থিয়োরিটিকালি আপত্তি নেই। খাই না কারণ খেতে প্রবৃত্তি হয় না।

জীবেন। ওইটেই প্রচ্ছন্ন কুসংস্কার।

অমল। তা হতে পারে। কিন্তু কানুর মতো অমন দিনে দুপুরে গা-ছমছম করবে না।

জীবেন। রাত্রেও করবে না?

অমল। না, আমি ভূত বিশ্বাস করি না।

জীবেন। বিশ্বাস না করার মানে? অনাদিকাল থেকে পৃথিবীর সব দেশের সব সমাজের সব স্তরের লোক যা বিশ্বাস করে সেটা কি ভুয়ো হতে পারে? তোমার অবিশ্বাসের হেতু কী—

অমল। আমি নিজে কখনও দেখিনি—

জীবেন। তুমি নিজে কখনও সুইজারল্যাণ্ড বা আইসল্যাণ্ড দেখেছ? ওগুলো কি নেই? মাইক্রসকোপ আবিষ্কার হবার আগে কি কেউ ব্যাকটিরিয়া দেখেছিল, তা বলে কি ওগুলো ছিল না?

কানু। হয়তো একদিন কেউ ভূতোস্কোপ আবিষ্কার করবে তখন দেখা যাবে যে আমাদের চারদিকে ভূত কিলবিল করছে।

অমল। যত সব বাজে কথা।

কানু। আমার কিন্তু ভাই গা ছমছম করছিল—এটা বাজে কথা নয়।

জীবেন। আজ যে বডিটা এসেছে দেখেছিস? কালো মুসকো, ষণ্ডা চেহারা, দু’গাল ভরতি কাঁচা-পাকা দাড়ি, প্রকাণ্ড চোখ, দাঁতগুলো বেরিয়ে আছে মনে হচ্ছে যেন হাসছে, ওটাকে দেখে আমারও গা ছমছম করছিল। ওটাতে কাদের পার্টি পড়বে কে জানে। মনে হয় ওর গায়ে ছুরি বসালে ও লাফিয়ে উঠে কামড়ে দেবে—বাবা কী। চেহারা!

অমল। আমিও দেখেছি, আমার কিন্তু ভয় করেনি। মড়া মড়া, তাকে আবার ভয় কী?

জীবেন। রাত বারোটার সময় অন্ধকারে একা অ্যানাটমি হলে ঢুকে ওটার কপালে সিঁদুরের টিপ পরিয়ে দিয়ে আসতে পার?

অমল। অনায়াসে পারি।

জীবেন। কক্‌খনো পারবে না।

অমল। নিশ্চয় পারব—

জীবেন। আমি বাজি রাখতে পারি, পারবে না! দিনের আলোয় বসে ওরকম লম্বাই চওড়াই সবাই করতে পারে।

অমল। বেশ, রাখ বাজি, কত দেবে?

জীবেন। দশ টাকা।

অমল। বেশ।

জীবেন। আজ রাত্রি বারোটার পর আমরা তোমাকে মেস থেকে বার করে দেব। মুন্না ডোমকে দুটো টাকা দিলেই সে ‘অ্যানাটমি হল’ খুলে দেবে। তাকে বলে রাখব আমি। আমাকে সে খুব খাতির করে। তুমি কিন্তু কোনও আলো বা টর্চ নিয়ে যেতে পারবে না। অন্ধকারে হলের ভিতর ঢুকতে হবে। টেবিলটা কোথায় আছে তা আন্দাজ করে নিতে পারবে আশা করি। প্রোসেকটারের ঘরের সামনেই। রাজি তো?

অমল। রাজি।

সেদিন সন্ধ্যাবেলা জীবেনের মেসে থাকা হল না। তার বোনের বাড়ি থেকে নিমন্ত্রণ এল, রাত্রে সেখানে খাবার জন্য। ঠিক হল রাত্রি বারোটার পর কানুই অমলের সঙ্গে যাবে। কানু দূরে দাঁড়িয়ে থাকবে আর অমল ঢুকবে ‘অ্যানাটমি হলে।’

ঘড়িতে ‘অ্যালার্ম’ দিয়ে শুয়েছিল তারা বারোটার সময়। অ্যালার্ম বাজাতেই উঠে পড়ল দু’জনে। অমল সিঁদুর আর তেল আগেই গুলে রেখেছিল একটা শিশিতে। সেইটে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল দু’জনে। কানু দূরে দাঁড়িয়ে রইল। অমল চলে গেল অ্যানাটমি হলের দিকে। গিয়ে দেখল ‘অ্যানাটমি হল’-এ ঢোকবার কপাটটা খোলা রয়েছে। জীবেন আগেই সে ব্যবস্থা করে রেখেছিল। প্রথমে ঢুকেই কিছু দেখতে পেল না সে। সব অন্ধকার। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। খুট খুট করে শব্দ হল একটু। ভাবলে ইঁদুর সম্ভবতঃ। অন্ধকারে চোখটা অভ্যস্ত হওয়ার পর টেবিলগুলো আবছাভাবে চোখে পড়তে লাগল। প্রোসেকটারের ঘরের সামনের টেবিলটাও চোখে পড়ল তার। আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল। টেবিলটার কাছে এসে দাঁড়িয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত। তারপর ডান হাতের তর্জনী আঙুলটায় সিঁদুর মাখিয়ে মড়ার কপালে যেই সেটা লাগাতে যাবে অমনি অপ্রত্যাশিত কাণ্ড হয়ে গেল একটা। মড়াটা তাকে জাপটে ধরল। সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে উঠল অমল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আর একটা চিৎকারও শোনা গেল ভিন্ন কণ্ঠে। ছুটে গেল কানু আর মুন্না ডোম।

গিয়ে দেখল, অমল অজ্ঞান হয়ে আছে আর জীবেন রক্তে ভাসছে। মড়াটাকে টেবিল থেকে নামিয়ে দিয়ে জীবেনই শুয়েছিল টেবিলের উপর মুন্নার সঙ্গে সড় করে। আর অমলও সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল একটা ছুরি।

মুখে জলের ঝাপটা দিতেই অমলের জ্ঞান ফিরে এল। জীবেনকে ‘ইমারজেন্সি রুমে’ নিয়ে যাওয়া হল। কানু তার কাছে রইল। অমল যখন নিজের ঘরে ফিরল তখন দুটো বেজে গেছে। ঘরে ঢুকেই আবার চিৎকার করে উঠল অমল। সেই কালো ষণ্ডা মড়াটা তার বিছানার উপর বসে আছে। প্রকাণ্ড চোখ, মুখময় খোঁচা খোঁচা দাড়ি, দাঁতগুলো বেরিয়ে আছে। ভূত! ভূত ধীর ভাবে বলল—“তোমাদের খেলা তো শেষ হল, এইবার আমার একটা ব্যবস্থা কর। আমাকে নীচে মেজের উপর শুইয়ে রেখেছে। আমার বড্ড শীত করছে—” অমল কিন্তু তার কথাগুলো শুনতে পেল না, কারণ সে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল।

২৮.০৮.১৯৬০

লেখক পরিচিতি

বনফুল: আসল নাম বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়। ১৯ জুলাই ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে পূর্ণিয়া জেলার মণিহারীতে জন্ম। ১৯২৭ সালে ডাক্তারি পাশ করে ভাগলপুরে কর্মজীবন শুরু করেন। গ্রন্থতালিকায় কয়েকটি নাম: ডানা, স্থাবর, জঙ্গম, হাটেবাজারে, অগ্নীশ্বর। অণুগল্প রচনার পথিকৃৎ। ১৯৬০-এ আনন্দ পুরস্কার, ১৯৬২-তে রবীন্দ্র পুরস্কার। ১৯৭৬-এ পদ্মভূষণ। মৃত্যু: ৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯।

অধ্যায় ১ / ২৩

সকল অধ্যায়

১. মড়াটা – বনফুল
২. হাওয়া-বদল – অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত
৩. চাবি – আশাপূর্ণা দেবী
৪. কর্ণফুলির ডাক – সুবোধ ঘোষ
৫. সন্দেশ – জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী
৬. আলমারি – নরেন্দ্রনাথ মিত্র
৭. স্নায়ু – সন্তোষ কুমার ঘোষ
৮. খিল – বিমল কর
৯. বসবার ঘর – রমাপদ চৌধুরী
১০. ঠাট্টা – সমরেশ বসু
১১. একটা পিস্তল ও ডুমুর গাছ – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
১২. পাষাণভার – মতি নন্দী
১৩. অন্নপূর্ণা – শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়
১৪. শোণিতে সুমধুর সজ্জা – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
১৫. সাঁকো – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১৬. আমেরিকা – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
১৭. স্পেশাল অফিসার – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
১৮. সুটকেস – নবনীতা দেবসেন
১৯. ঝালমুড়ি – দিব্যেন্দু পালিত
২০. অবস্থান – বাণী বসু
২১. টাটকা বরফের মাছ – সমরেশ মজুমদার
২২. আমার এখন সময় নেই – সুচিত্রা ভট্টাচার্য
২৩. আমি আমার মতো নই – আবুল বাশার

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন