বরযাত্রী

বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়

ত্রিলোচনের বিবাহ। বরযাত্রীদের মধ্যে রাজেন, কে. গুপ্ত. গোরাচাঁদ আর ঘোঁৎনা আসিয়া হাজির হইয়াছে, গণশার অপেক্ষা; সে আসিলেই এদিককার দলটা পূর্ণ হয়। ত্রিলোচন সাজগোজের মধ্যে এর পূর্বেও আসিয়া কয়েকবার খোঁজ লইয়া গিয়াছে, আবার তর্জনীর ডগায় একটু স্নো লইয়া মুখ বাঁকাইয়া দক্ষিণ গালটা নির্মমভাবে ঘষিতে ঘষিতে আসিয়া হাজির হইল; প্রশ্ন করিল, “এল র‍্যা?”

ঘোঁৎনা বলিল, “ওর মামা ওকে যে রকম আগলে বসে আছে দেখলাম—”  

এমন সময় হালদারদের বাড়ির পাশের গলিটায় সাইকেলের ঘণ্টির আওয়াজ হইল, এবং গণশা সবেগে নিষ্ক্রান্ত হইয়া এবং সবেগেই দলটির মাঝখানে প্রবেশ করিয়া ব্ৰেক চাপিয়া নামিয়া পড়িল। জবাবদিহি হিসাবে বলিল “গ-গ্ গণশাকে আটকায় সে এখনও মা- ম্মায়ের পেটে।”

ছোকরা একটু তোতলা; রাগিলে কিংবা উৎসাহিত হইলে এক-একটা অক্ষর প্রায়ই দ্বিত্ব প্রাপ্ত হয়। ডান দিকের ভ্রূটায় একটা হেঁচকা টান দিয়া সামলাইয়া লয়।

রাজেন বলিল, “তোর কিন্তু না গেলেই ভাল হত গণশা। এতদিন হাঁটাহাঁটি করে সাহেব যদি বা ইন্টারভিউয়ের জন্যে আজ ডাকলে, বরযাত্রী যাওয়ার লোভে”

ঘোঁৎনা বলিল, “তাতে আবার আজকাল চাকরির যা বাজার!

গণশা বলিল, “তিলুর বিয়েতে আমি যাব না! এর পর আমার নি-ন্নিজের বিয়েতে বলবি, গ-গ্-গণশা, তোর গিয়ে কাজ নেই, তুই চা-চ্চাকরির খোঁজ করগে।”

গণেশের কথাটা বলিবার হক আছে। সে ত্রিলোচনকে তাস খেলিতে শিখাইয়াছে, সিগারেট খাইতে শিখাইয়াছে, চলন্ত ট্রামে উঠা-নামা করিতে শিখাইয়াছে এবং নিয়মিতভাবে বায়স্কোপের সিরিয়াল-অসিরিয়ালে লইয়া গিয়া পৃথিবীর যত সিনেমা-জ্যোতিষ্কদের নাম মুখস্থ করাইয়া তাহাকে সকল দিক দিয়া লায়েক করিয়া তুলিয়াছে।

শুধু তাহাই নহে। আপাতত এ কয়েকদিন ধরিয়া দাম্পত্যনীতিতে জোর তালিম দিতেছে সে-ই, এবং বিশেষ করিয়া দাম্পত্য-রাজ্য করায়ত্ত করিবার পূর্বে বাসর-দুর্গটি কি করিয়া অতিক্রম করিতে হইবে, তাহার কৌশল-কানুনও অধিগত করা হইতেছে ওই গণশারই নিকট।

ত্রিলোচন কৃতজ্ঞচিত্তে বলিল, “না না, এসে ভালই করেছিস। বউদি আবার বাসরঘরের যা ভয় লাগিয়ে দিয়েছে, ভাবছি আর গলা শুকিয়ে যাচ্ছে, আর জল খাচ্ছি। যার সঙ্গে বিয়ে, সে একলাটি থাকলেই দিব্যিটি হত। কার কথার যে কি উত্তর দোব, কার কানমলা সামলাব, কে গোঁফজোড়াটা নেড়ে দেবে, তার ওপর আবার গানের ফরমাশ আছে, কারুর হেঁয়ালি আছে—”

কে. গুপ্ত ত্রিলোচনের পাশাপাশি তাহাদের ফুটবল-টীমে ব্যাক খেলে। বলিল, “তা বটে; পাঁচটা ফরওয়ার্ডকে সামলাতেই হিমসিম খেয়ে যেতে হয়—”

ত্রিলোচন বলিল, “ছ’জনে মিলে, আর এ একলা। গোঁফজোড়াটা নয় ফেলে দোব গণশা? যতটা হালকা হয়। বিয়ে হয়ে গেলে আবার না হয় তখন—”

গোরাচাঁদ বলিল, “তাহলে তো নাক কান কেটে, মাথা মুড়িয়ে বাসরঘরে ঢুকতে হয়।”

গণশা বলিল, “বরং ক-ক্কন্ধকাটা হয়ে ঢুকলে তো আরও ভাল হয়। দেখবে, বরের গ-গ্ গলারই বালাই নেই, গাইতে বলা মিছে।”

ত্রিলোচন চিন্তিতভাবে বলিল, “তোদের তামাশা বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু আমার এদিকে যে কি হচ্ছে তা—। আবার তার ওপর সকাল সকাল লগ্ন পড়ে গেছে কপালগুণে।”

কে. গুপ্ত বলিল, “খুব স্টেডি থাকবেন মশাই, নার্ভাস হলেই প্রেস করে ধরবে। একটা বেশ বড় দেখে নিতবর সঙ্গে নিলে—”

গণশা একটু রাগিয়া উঠিল; বলিল, “বা-ব্বাড়ির দারোয়ান কি গা-গ্-গাড়ির সহিসকে তো আর নিতবর করবে না মশাই; সে সব আপনাদের ছা-চ্ছাতুর দেশে চলে।”

বেহারের ছেলে। সুদূর ছাপরার এক মহকুমার স্কুল হইতে পাস করিয়া কলকাতার কলেজে পড়িতে আসিয়াছে, বাংলার ছেলেদের সঙ্গে এখনও কথায় পারিয়া উঠে না। কে গুপ্ত চুপ করিয়া গেল।

ঘোঁৎনা বলিল, “বাসরঘরের ভয়ে যদি বিয়ে ছাড়তে হয় তো কলিশানের ভয়ে গাড়ি চড়াও ছাড়তে হয়।”

গোরাচাঁদের কথাবার্তায় প্রায়ই একটু আহার্যের গন্ধ থাকা নিয়ম; বলিল, “তা হলে কাঁটার ভয়ে মাছ খাওয়া ছাড়তে হয়।”

কবি রাজেন বলিল, “কন্টকের ভয়ে গোলাপফুল ছাড়তে হয়।

গণশা সাইকেলটা রাখিতে গিয়াছিল, আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “বরযাত্রীদের মালা এসেছে?”

ত্রিলোচন বলিল, “সে সব ঠিক আছে—মালা, গোলাপজল, এসেন্স, আর—আমি যাই, দেখিগে, সবাই একটু মিষ্টিমুখ করে যাবি তো?”

গোরাচাঁদ বলিল, “হ্যাঁ, যা, শীগগির যা। কি কি আছে র‍্যা?”

ত্রিলোচনকে ফিরাইয়া ঘোঁৎনা বলিল, “আর শোন, ওদিকে কে কে যাচ্ছে বল তা, বেশি ভেজাল বাড়লে আবার ফূর্তি জমবে না।”

ত্রিলোচন বাঁ হাতে আঙুলের পর্ব গুনিতে গুনিতে বলিল, “বাবা এক, মেসো দুই, সেজপিসে, সহায়রামবাবু, এই হল চার, আর, আর—”

বাংলা দেশ সম্বন্ধে অনভিজ্ঞ কে, গুপ্ত ভয়ে ভয়ে মনে করাইয়া দিল, “একজন পুরুত যাবে না?”

ত্রিলোচন গুনিল, “পুরুত পাঁচ, দীনে নাপতে ছয়। পুরুত মশাই নিজে যেতে পারবেন না, তাঁর কাকা ন্যায়রত্ন মশাই যাবেন।”

গোরাচাঁদ একটু অস্বস্তির সহিত বলিল, “এই ছজনেও মিষ্টিমুখ করবে তো?”

ঘোঁৎনা বলিল, “পুরুত ঠাকুরের কাকা? সে বুড়ো তো রাতকানা, আবার কালাও তার ওপর; কার সঙ্গে বিয়ে দিতে কার সঙ্গে দিয়ে দেবে!”

ত্রিলোচন বলিল, “তাকে দীনে সামলাবে।”

রাজেন বলিল, “একা দীনে ব্যাটা কজনকে সামলাবে? ওদিকে সহায়রাম চাটুজ্জের যাওয়া মানেই বোতলের শ্রাদ্ধ।”

ত্রিলোচন বলিল, “সহায়রামবাবু আর সেজপিসে রাত্তিরেই চলে আসবে; কাল তাদের আপিসের মেল-ডে কিনা, ছুটি পেলে না। আর বোতল? দু পাঁট সাফ হয়ে গেছে, দু ডজন চপ কাটলেট—”

গোরাচাঁদ বিরক্ত হইয়া বলিল, “কেন মিছিমিছি তিলুকে আটকাচ্ছিস সবাই? সাজগোজে দেরি হয়ে যাবে, ভাল করে একটু সাজতে হবে তো? কথায় বলে বরসজ্জা। ওই সঙ্গে কিছু চপ কাটলেট সরিয়ে ফেল্গে তিলোচন, ট্রেনে কাজ দেবে।”

উপর হইতে ছোটবোন ডাকিল, “দাদা, গল্প করছ, জামাকাপড় পরতে হবে না? বউদি চন্দন-টন্দন নিয়ে বসে আছেন যে!”

গোরাচাঁদই উত্তর দিল, “তোদের সব তাড়াতাড়ি!” ত্রিলোচনের গেঞ্জিতে একটা টান দিয়া বলিল, “আগে গিয়ে কি যেন মিষ্টিমুখের কথা বলছিলি, দেখে শুনে দিগে। তাড়াতাড়িতে ভুলে গেলে তোর মার মনে আবার শুভদিনে একটা খটকা থেকে যাবে। ও সাজগোজের জন্যে ভাবিস নি, আজকাল আবার মেলা সাজগোজ করাটা ফ্যাশান নয়, না রে গণশা?”

গণশা বলিল, “তা বইকি, আজকাল যত—”

ত্রিলোচন পা বাড়াইল। গণশা হঠাৎ সামলাইয়া লইয়া বলিল, “মা-ম্‌মালা, গোলাপজল, এসেন্স পাঠিয়ে দিগে, আর আমার জন্যে একটা সিল্কের রুমাল আর ভা-ভাল শাল পারিস তো, পা-প্পালিয়ে এসেছি কিনা; আর দেখ—”

ত্রিলোচন দরজার নিকট ফিরিয়া দাঁড়াইতে গণশা বাঁ হাতটা তুলিয়া সিগারেটের টিন আঁটে এই পরিমাণ একটা অর্ধচন্দ্রাকৃতি মুদ্রা সৃজন করিয়া বলিল, ‘বা-ব্বাগাবি একটা।”

উত্তরে ত্রিলোচন বাঁ হাতের তর্জনী আর মধ্যমা আঙুল দুইটা তুলিয়া ধরিয়া হাসিয়া সংক্ষেপে বলিল, “সে হয়ে গেছে—এই।”

গণশা বিরক্ত হইয়া গোরাচাঁদের দিকে চাহিয়া বলিল, “বে-বেচ্চারা বিয়ের সময় একটু সাজগোজ করবে না তো ওর দিদিমাকে গঙ্গাযাত্রা করাবার সময় করবে? খ্যাটের গন্ধ পেলে তোর জ্ঞান তাকে না গোরে। আমায় আবার সা-সাক্ষী মানতে কে বলেছিল র‍্যা? একটু অন্য-মনস্ক হয়েছিলাম, অমনই—না রে গণশা?”

যেখানে বিবাহ সে গ্রামটার মূল নাম গোকুলপুর; পরে ‘কালসিটে গোকুলপুরে’ দাঁড়ায়। কবে নাকি গ্রামের লোকেরা এক মাতাল গোরার দলকে উত্তম-মধ্যম দিয়া এই সামরিক খেতাবটা অর্জন করে। মুখে মুখে ক্ষয়প্রাপ্ত হইয়া এখন শুধু ‘কালসিটে’তে দাঁড়াইয়াছে।

বরযাত্রীর দলও প্রায় গোরার মতই শত্রুস্থানীয়, তাই গ্রামে কোনো বরযাত্রী আসিলেই ছেলে-ছোকরারা সুযোগমত কানে তুলিয়া দেয়, “এ যার নাম কালসিটে মশাই, একটু সমঝে চলতে হবে!”

গ্রামটা ডায়মন্ডহারবারের কাছাকাছি, স্টেশন হইতে মাইল তিন-চার দূরে।

বাড়িটা নিবিড় জঙ্গলে ঢাকা। গ্রামের সব বাড়িই এই রকম। যেখানে জঙ্গল নাই, সেখানে খানা-ডোবা; দুই-একটা মাঝারি-সাইজের পুকুরও আছে, সব জলে টইটম্বুর! জলটা ঘাটের কাছে একটু দেখা যায়, তাহার পরই ঘন সতেজ পানার কার্পেট।

সদর আর অন্দর আলাদা আলাদা, রশি দুয়েকের তফাত হইবে। উৎসব উপলক্ষে সদর-বাড়ির সামনে একটি ছোট শামিয়ানা পড়িয়াছে। শামিয়ানার চারিদিকে খুঁটিতে কাচের পাত্রে মোমবাতির নিষ্প্রভ আলো, মাঝখানে একটি তীব্রজ্যোতি গ্যাসের আলো—বকমধ্যে- হংস-যথা শোভা পাইতেছে। অন্দর বাহির মিলিয়া আরও গোটাকতক গ্যাসের আলো।

শামিয়ানার মধ্যে বরের আসর। বর বিষণ্নমুখে বসিয়া আছে এবং দূরে পাড়ার কোনো মেয়ের দল বাড়ির মধ্যে যাইতেছে দেখিলেই বাসরঘর স্মরণ করিয়া অস্ফুটস্বরে বলিতেছে, “বাপ রে, দফা সারলে আজ!”

তাহাকে ঘেরিয়া তাহার বন্ধুবর্গ। সবচেয়ে কাছে গণশা, একটা মখমলের বালিশ বুকে চাপিয়া ত্রিলোচনের দিকে ঝুঁকিয়া বসিয়া আছে। মাঝে মাঝে ত্রিলোচনও মুখটা বাড়াইয়া আনিতেছে, এবং একটু কথাবার্তা হইতেছে।

একটু দূরে কর্তারা। বলা বাহুল্য, সকলেই অপ্রকৃতিস্থ—কম-বেশি করিয়া। সহায়রামবাবু কন্যাযাত্রীদের কয়েকজনের সঙ্গে বেশ জমাইয়া লইয়াছেন। তাঁহার বক্তব্য তিনি কত শত জায়গায় বরযাত্রী গিয়াছেন, কিন্তু এমন ভদ্র কন্যাপক্ষ কোথাও দেখেন নাই। নানা রকম উদাহরণ দিয়া অশেষ প্রকারে কথাটা সাব্যস্ত করিবার চেষ্টা করিতেছেন; কিন্তু মুশকিল, তাহারা কোনো রকমেই কথাটা মানিয়া লইতে প্রস্তুত নয়। তাহাদের মধ্যেও সব অল্পবিস্তর নেশা করিয়াছে এবং ধরিয়া বসিয়াছে তাহারা অতি দীনহীন ইতর; বরপক্ষীয়েরাই বরং অতিশয় ভদ্র ও সম্মানার্হ, এ গ্রামে এ রকম বরযাত্রী আসে নাই।

কথাটা অমায়িক মৃদু হাস্যে, হাতজোড় প্রভৃতি বিনয়োচিত প্রথায় আরম্ভ হইয়াছিল; ক্রমেই কিন্তু সে ভাবটা তিরোহিত হইয়া যাইতে লাগিল, এবং একটা জেদাজেদির সঙ্গে সবার মুখ গম্ভীর হইয়া আসিতে লাগিল। ত্রিলোচনের পিসে একটু উষ্ণ হইয়া জড়িতস্বরে বলিলেন, “কেমনতর লোক আপনারা মশাই? একটা ভদ্রলোক সেই থেকে বলছে, আপনাদের মত ভদ্রলোক দেখি নি, তা কোনোমতেই মানবেন না? ভারি জ্বালা তো!”

ওদিককার একজন তাঁহারই মত ভারি আওয়াজে উত্তর করিল, “আর আমাদের কথাটা বুঝি কিছু নয় তা হলে মশাই? আমরা এতগুলো ভদ্রলোক মিথ্যেবাদী হলাম?”

ত্রিলোচনের পিসের পোষকতা পাইয়া সহায়রামবাবুর আত্মসম্মান ক্ষুব্ধ হইয়া উঠিল। রাগিয়া গলা চড়াইয়া বলিলেন, “কটা ভদ্রলোক আছে আপনাদের মধ্যে গুনে দিন তো দেখি, চিনতে পারছি না। ভদ্রলোকের মান রাখতে জানেন না, আবার ভদ্রলোক বলে পরিচয় দিতে যান।”

বোধ হয় বলিয়া দিতে হইবে না যে, তাঁহার উচ্চারণ আরও বেশি গাঢ় এবং অস্পষ্ট।

 পিছন হইতে একটা ছোকরা শাসাইল, “এটা কালসিটে মশাই, মনে থাকে যেন!”

একটা বাড়াবাড়ি রকম কিছু হইতে যাইতেছিল, কন্যাবাড়ির লোকেরা এবং কয়েকজন বয়স্থ লোক আসিয়া তাড়াতাড়ি থামাইয়া দিল। সহায়রামবাবু আর ত্রিলোচনের পিসেকে ধরিয়া সদর-বাড়ির ঘরে উঠাইয়া লইয়া গেল, এবং ওদিককার কয়েকজনকেও সরাইয়া আসরের নিদারুণ ভদ্রাভদ্র-সমস্যাটা কতক হালকা করিল।

রাজেন তাহার নিজের লেখা কবিতা বিলি করিতে যাইতেছিল। ঘোঁৎনা তাড়াতাড়ি উঠিয়া তাহাকে বসাইয়া দিল, কানের কাছে মুখ দিয়া বলিল, “এই, সব ক্ষেপে রয়েছে, আর ঘাঁটাস নি। যারা পড়তে জানে না, ভাববে, ঠাট্টা করছে।”

রাজেন ক্ষুণ্নমনে বলিল, “তাহলে এগুলো কি হবে? এত কষ্ট করে লিখলাম, ছাপালাম, কেউ পড়বে না?”

গোরাচাঁদ আশ্বাস দিল, “ভাবিস নি, আমি কাল শেয়ালদার মোড়ে বিলি করিয়ে দোব’খন। আজকাল একটা ছোঁড়া জ্যাঠার সন্ন্যাসীপ্রদত্ত দদ্রুভৈরবের হ্যান্ডবিল বিলোয় কিনা, সঙ্গে একখানা করে তোর হর্ষোচ্ছ্বাসও দিয়ে দেবে।”

রাজেন কোনো উত্তর দিল না, নাক মুখ কুঞ্চিত করিয়া পদ্যের বাণ্ডিলটা হাতের মধ্যে ঘুরাইতে লাগিল।

ত্রিলোচন ভীতভাবে গণশার দিকে মুখটা সরাইয়া গিয়া বলিল, “দেখলি তো পিসে আর সহায়রামবাবুর কাণ্ডটা? ওদের আর কি? ওরা দুজনেই তো এই গাড়িতে লম্বা দেবে, সব ঝোঁকটা গিয়ে পড়বে আমার ওপর। ভাবটা বুঝছিস তো? ব্যাটারা বাড়িতে মেয়েদের সব খবর দিতে গেল, আসরের শোধ বাসরে তুলবে।—আঃ, গোলমালে আবার গানের অন্তরাটা দিলে ভুলিয়ে। তারপর কি র‍্যা গণশা, মুহা পঙ্কজ সোঙরি সোঙরি? একটু মাথাটা সরিয়ে আন, সুর করেই বল।”

গণশা মখমলের বালিশের উপর তর্জনীর টোকা দিতে দিতে ত্রিলোচনের মুখের উপর ভাব-ব্যাকুল চোখ দুইটা তুলিয়া গুন গুন করিয়া গাহিতে লাগিল—”

“মুহা পঙ্কজ সোঙরি সোঙরি
চিত মোর ব্যা—ব্যা-ব্যা …

রাজেন সরিয়া আসিয়া ধীর ধীরে মাথা নাড়িতেছিল, এই গাঁটের মাথায় নিজের গলাটা জুড়িয়া দিল—”

“ব্যাকুল হোয়,
নয়না নিদ জানত নেহি,
মানত নেহি…”

গণশা গাহিতেছিল—”

“জা-জ্জা-জ্জানত নে-ন্নে”

রাজেনের হাতটা টিপিয়া বলিল, “তুই থাম, এগিয়ে যাচ্ছিস তা-ত্তাড়াহুড়ো করে।” রাজেন এই রকম চারিদিকেই থামা খাইয়া নেহাত অপ্রসন্নভাবে মুখটা ঘুরাইয়া রহিল। মনে মনে ভাবিল, এমন জানিলে কখনই আসিত না। গণশার ব্যবহারে তাহার দুঃখটা বিশেষ করিয়া এইজন্য যে, গানটি তাহার স্বরচিত, যদিও গণশার সুর দেওয়া। রাজেন ‘বাসর-তাণ্ডব’ নাম দিয়া ঝালোয়ার প্রদেশের রাজপুত কাহিনী অবলম্বন করিয়া একটা নাটক লিখিতেছে। ঝালোয়ার সামন্ত সুব্বা সিং বাসরঘরে. রাজপুত-বীরাঙ্গনা-পরিবৃত হইয়া অবগুণ্ঠনবতী বধূ মীরাবাঈয়ের উদ্দেশ্যে তন্ময় হইয়া গানটি গাহিতেছেন, এমন সময় খবর পাওয়া গেল, দুর্গপাদদেশে মুঘল-সৈন্য।

এই সময় ত্রিলোচনের বিবাহের হাঙ্গামা আসিয়া পড়ায় নাটকটা আর অগ্রসর হয় নাই। রাজেন স্থির করিয়াছিল, রাজপুতদের জিতাইবে; কিন্তু গণশার দুর্ব্যবহারে মেজাজটা অত্যন্ত তিক্ত হইয়া যাওয়ায় মনে মনে ভাবিতেছে, গণেশশঙ্কর নাম দিয়া একটা তোতলা দাগাবাজ ব্রাহ্মণকে দাঁড় করাইয়া রাজপুত—বাহিনীকে মুঘলের হস্তে বিধ্বস্ত করাইয়া দিবে। গোরাচাঁদ কে, গুপ্তকে বলিতেছিল, “লুচি ভাজার গন্ধ বেরুচ্ছে, কি রকম খাওয়াবে কে জানে!”

এমন সময় ত্রিলোচনের পিতা ডাক দিলেন, “বাবা গোরাচাঁদ, শুনে যাও একটা কথা।”

গোরাচাঁদ কাছে গিয়া বসিল। ত্রিলোচনের পিতার চোখ দুইটি একটু রক্তাভ, বেশ অনায়াসেই যে চাহিয়া আছেন এমন বোধ হয় না। গোরাচাঁদের কাঁধের উপর কোমলভাবে স্পর্শ করিয়া প্রশ্ন করিলেন, “বাবা, আমার ত্রিলোচন আর তোমরা কি আলাদা?”

গোরাচাঁদ এ প্রশ্নের কোনো সঙ্গত কারণ খুঁজিয়া পাইল না; কিন্তু প্রশ্নকর্তার অবস্থা দেখিয়া সহজে অব্যাহতি পাইবার আশায় উত্তর করিল, “আজ্ঞে না, আমরা সবাই আপনার ছেলের মতন, কিছু তফাত নেই তো। তিলুকে নিজের ভাই জেনেই তো এসেছি সব!”

“তা হলে একটা কথা,—কেউ তোমরা এখানে অন্নস্পর্শ করো না আজ। গোরাচাঁদ একেবারে স্তম্ভিত হইয়া গেল। এ আবার কি ফ্যাসাদ!

একটু চুপ করিয়া থাকিবার পর তাহার একটা সম্ভাবনার কথা মনে হইল; বলিল, “আজ্ঞে, আমরাও যা, তিলোচনও তাই; কিন্তু ওর আজকে বিয়ে বলে কিছু খেতে নেই, আর আমরা তো শুধু বরযাত্রী হয়ে এসেছি কিনা—”

সেজন্য নয়। এদের আক্কেলটার কথা ভাবছি, আমাদের কি অপমানটা করলে, দেখলে না? আমি যৎপরোনাস্তি রেগেছি গোরাচাঁদ; এই আমি আর তোমাদের মেসো বসে আছি, বর তুলে নিয়ে যাক তো আমাদের সামনে থেকে!”

গোরাচাঁদ ভীত হইয়া বলিল, “আজ্ঞে, সেটা কি ভাল হবে? খেতে বারণ করেন সে কিছু শক্ত কথা নয়। কিন্তু এরা যে রকম অবুঝ আর বেয়াক্কেল লোক দেখছি, বর না উঠতে দিলে একটা হাঙ্গাম

“ওরে এই দিক পানে, অন্দরে নিয়ে যা, ওই দিক দিয়ে ঘুরে যা।”

কয়েকটা ভারী দই-ক্ষীরের তিজেল বাঁকে লইয়া, একবার এদিক একবার ওদিক করিতেছে। গোরাচাঁদ সতৃষ্ণনয়নে দেখিয়া লইয়া বলিল, “কি যে বলছিলাম? হ্যাঁ, বর না উঠতে দিলে একটা হাঙ্গাম—এমন কি, না খেলেও একটা রীতিমত হাঙ্গাম করতে পারে। তাই বলছিলাম—”

ত্রিলোচনের পিতা গণশাকে ডাক দিতে যাইতেছিলেন। গোরাচাঁদ ত্রস্তভাবে বলিল, “আমি দিচ্ছি ডেকে, আপনি কষ্ট করতে যাবেন কেন? হ্যাঁ, ও বরং চালাক আছে, যা বলে—”  

ভিতরে গিয়া গণশাকে বলিল, “তিলুর বাবা ডাকছেন রে।” একটু চাপা গলায় তাড়া-তাড়ি টিপিয়া দিল, “দেখিস, যেন মেলা আত্মীয়তা করতে যাস নি; তা হলে আমার মতন বেকায়দায় ফেলে খাওয়া বন্ধ করবে, ভয়ানক খাপ্পা হয়েছে ওদের ওপর।”

এই সময় কন্যাকর্তা গলায় গামছা দিয়া করজোড়ে বরের আসরের কাছে আসিয়া দাঁড়াইলেন। সাধারণভাবে সভাস্থ সকলকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন, “এইবার বরকে নিয়ে যাবার—। কই, বেয়াই-মশাই কোথায়? এই যে—”

কাছে গিয়া বলিলেন, “তা হলে দাদা, অনুমতি দিন এইবার।”

গোরাচাঁদ, গণশা, ত্রিলোচন, সকলেই রুদ্ধশ্বাসে একটা বিষম দুর্ঘটনার অপেক্ষা করিতে লাগিল। ত্রিলোচনের পিতা একটু চুপ করিয়া রহিলেন, তাহার পর ধীরে-সুস্থে উঠিয়া কন্যা-কর্তাকে বুকে জড়াইয়া গদগদ কণ্ঠে বলিলেন, “তিলু তো তোমারই ছেলে ভাই, আজ যদি—ওফ!” গলাটা অশ্রুরুদ্ধ হইয়া পড়ায় আর বলিতে পারিলেন না।

যাইবার সময় ত্রিলোচন বন্ধুদের দিকে একটা বিপন্ন অসহায় ভাবের দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া গেল। কে. গুপ্ত একটু কাছে ছিল, সাহস দিয়া বলিল, “যান, ভগবান আছেন।”

বর চলিয়া গেলে গোরাচাঁদ তাড়াতাড়ি ত্রিলোচনের পিতার নিকট গেল; ডাকিল, “জ্যাঠামশাই!”

ত্রিলোচনের পিতা শোকাচ্ছন্নভাবে মাথাটা হাতের তেলোয় ধরিয়া বসিয়া ছিলেন, মুখ’ তুলিয়া গাঢ়স্বরে বলিলেন, “কে গোরাচাঁদ? গোরা রে, আজ যদি বাবা বেঁচে থাকত- ওফ!”

গোরাচাঁদ বলিল, “আজ্ঞে হাঁ। বলছিলাম, আর তবে না-খাওয়ার হাঙ্গামাটাও করে কাজ নেই, কি বলেন? যখন মিটেই গেল—”

.

বর চলিয়া গেলে কন্যাপক্ষের একজন আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “বরযাত্রীদের মধ্যে কারা এই গাড়িতে ফিরে যাবেন যেন?”

ঘোঁৎনা বলিল, “হ্যাঁ, সহায়রামবাবু আর বরের পিসেমশাই, তাঁরা ওই ঘরে রয়েছেন।”

প্রশ্নকর্তা বলিল, “দুজন তা হলে? বলেন তো আপনাদের সবারই জায়গা করে দিই। কজন আছেন সব মিলিয়ে?”

গোরাচাঁদ তাড়াতাড়ি সামনে আগাইয়া বলিল, “হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চয়। আছি, আমি এক, ঘোঁৎনা দুই—”

গণশা নীচু গলায় ধমক দিয়া বলিল, “খা-খ্—খালি খাই খাই, স্ত্রী-আচার দেখবি নি? রাজুকে খোঁ-খ্-খোঁজ নিতে পাঠালাম কী করতে?—আজ্ঞে না, আমরা একটু ফূর্তিটুর্তি করি, খাওয়া তো রোজই—”

“হ্যাঁ হ্যাঁ, সেই ঠিক, একটু আমোদ-আহ্লাদ গান বাজনা করুন।—কই হে, এঁদের ডেকে নাও না তোমরা। শিবপুর থেকে এসেছেন, গান-বাজনার দেশ; বলে, গাইয়ে বাজিয়ে শূর, তিনে শিবপুর।”

সভার একদিকে গান-বাজনা হইতেছিল। এক চুড়িদার-পাঞ্জাবি-পরা ছোকরা শীর্ণ কাঁধের উপর কেশভারাক্রান্ত মাথাটা প্রচণ্ড বেগে নাড়িয়া নাড়িয়া গান গাহিতেছে, সাত- আটটি সমবয়সী মন্দিরা বাজাইয়া, শিস দিয়া, হাততালি দিয়া, তুড়ি বাজাইয়া তাহাকে উৎসাহিত করিতেছে। আশপাশের আর সকলে সমস্ত দলটির মৃত্যুকামনা করিতেছে।

ভদ্রলোকের কথায় একজন বলিল, “আমরা তো তাই চাই।—আপনারা দয়া করে—”

গণশা সবার মুখপাত্র হইয়া বলিল, “মা-ম্মাপ করবেন; আমাদের মধ্যে কেউ গা-গ্ গাইতে বাজাতে জানে না।”

ওদিককার একজন বলিল, “সে কথা শুনব কেন মশাই? সাদা কথাতেই আপনার অমন গিটকিরি বেরুচ্ছে, গাইতে বসলে—”  

অপর এক ছোকরা জুড়িয়া দিল, “গিটকিরি ছাড়া তো কিছু বেরুবেই না।”

গণশা একটা রাগারাগি গণ্ডগোল করিতে যাইতেছিল, রাজেন আসিয়া ধীরে ধীরে তাহার কাঁধে হাত দিয়া চাপা গলায় বলিল, “হাড় কখানির মায়া রাখ?”

গণশা ফিরিয়া বলিল, “কেন, কি হয়েছে?”

“তা হলে স্ত্রী-আচার দেখবার নাম করো না। যা করে বেঁচে এসেছি, আমিই জানি। বাইরে দাঁড়িয়ে যাব কি না-যাব ভাবছি, একটা কেলে রোগা ছোঁড়া এসে বললে, ভেতরে চলুন না, বাইরে কষ্ট করছেন কেন? সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি, হঠাৎ কোথা থেকে এসে কাঁধের ওপর হাত দিয়ে—কে মশাই আপনি?—ফিরে দেখি, ইয়া লাস, আমার পায়ের গোছ তার হাতের কব্জি। পরে একজনের কাছে খবর নিয়ে জানলাম, কনের কাকা, নাম জগুদা। থতমত খেয়ে বললাম, বরযাত্রী—স্ত্রী-আচার দেখছি।

“শুনে সুখী হলাম। একলা যে?”

“বললাম, তারা আসব আসব করছে।”

“শুনে সুখী হলাম, তাঁদের ডেকে নিয়ে আসুন। একটিতে আমার হাতের সুখ হবে না। কালসিটেতে এসে স্ত্রী-আচার দেখবে? মাতলামির আর জায়গা পাও নি?”

“আমি তো ভয়ে কেঁচোটি হয়ে সুড়সুড় করে বেরিয়ে এলাম। দেখি, সেই সে-কোণে হারামজাদা ছোঁড়াটা দাঁড়িয়ে মুচকে মুচকে হাসছে। যদি কখনও শিবপুরে পাই ব্যাটাকে—”

গান-বাজনার কথা লইয়া গণশার রাগটা চড়িয়াই ছিল, আরও ক্ষিপ্ত হইয়া বলিল, “ইডিয়েট! ভী-ভ্-ভীরু কোথাকার! বি-ব্বিয়ে দেখতে এসে যদি স্ত্রী-আচারই দেখলাম না তো—। চল সবাই, দে-দ্দেখি কে কি করে।”

দৃপ্তভাবে পা ফেলিয়া অগ্রণী হইল, আর সবাই সাহস এবং উৎসাহের অনুপাতে আগু-পিছু হইয়া চলিল। রাজেন শুধু ভীরু অপবাদটা দূর করিবার জন্য গণশার পাশে রহিল। সদর ছাড়াইয়া একটু দূরে যাইতেই তাঁহার সঙ্গে দেখা। গায়ে একটা সোয়েটার মাত্র, সবল পেশীগুলা জাগিয়া আছে। একটা গামছা কাঁধে ফেলিয়া এদিকেই আসিতেছিলেন, রাজেন দূর হইতে চিনাইয়া দিল অবশ্য চিনাইয়া না দিলেও কোনো ভুল হইত না।

কাছে আসিয়া রাজেনকে লক্ষ্য করিয়া একটা খসখসে গম্ভীর আওয়াজে বলিলেন, “এই যে, সবাইকে ডেকে এনেছেন!”

রাজেনের মুখটা ফ্যাকাশে হইয়া গেল, আমতা-আমতা করিয়া বলিল, “আজ্ঞে না, মানে হচ্ছে, এরাই সব বললে—”

ঘোঁৎনা আগাইয়া আসিয়া বলিল, “গোরাচাঁদ বললে, বরং খেয়ে নিলে হত; আমি বললাম, তা হলে কনের কাকাকে গিয়ে বললেই হবে, তিনিই সব করছেন কম্মাচ্ছেন—”

রাজেন বলিল, “আমি বললাম, আর জগুদা লোকও বড় ভাল।”

গণশা বলিল, “লো-ল্লোক ভাল শুনে আমি বললাম, চ-চ্চল্ তা হলে আম্মো যাই, জগুদাদার সঙ্গে একটু আলাপ-পরিচয়ও হবে। সে-সে একটা মস্ত সৌভাগ্য কিনা।”

ভদ্রলোক বলিলেন, “বেশ বেশ; কিন্তু দু-একটা জিনিস এখনও বাকি আছে। যদি ক্ষিদে পেয়ে তাকে তো গোরাচাঁদবাবু না হয়—”

ঘোঁৎনা বলিল, “সেই খুব ভালো কথা গোরাচাঁদ, তুই তা হলে—। কোথায় গেল গোরাচাঁদ?”

শুরুতেই যেই ঘোঁৎনা ‘গোরাচাঁদ বললে’ বলিয়া আরম্ভ করিয়াছিল, গোরাচাঁদ বহির্মুখী একটি ছোট্ট দলে ভিড়িয়া বেমালুম সরিয়া পড়িয়াছিল, তাহাকে পাওয়া গেল না। ভদ্রলোক চলিয়া গেলে কেহ আর কোনো কথা কহিল না। শুধু কে. গুপ্ত একটু ছাপরেয়ে ইডিয়ম মিশ্রিত করিয়া বলিল, “খুব হট্টাকট্টা জোয়ান, গ্র্যান্ড ফুল ব্যাক হয়, গোষ্ঠ পালের জোড়া।”

আরও ঘণ্টা দুয়েক কাটিল। দলটা খানিকক্ষণ স্রোতের কুটাকাঠির মত এদিক সেদিক করিয়া কাটাইল। দুই-একজন সহায়রামবাবুদের সঙ্গে চলিয়া যাইতেও চাহিল; বাকি সবাই তাহাদের আটকাইয়া রাখিল।

খাওয়া-দাওয়ার পর সবাই আবার আসরে আসিয়া জুটিল। ভাঙা আসর, এখানে সেখানে এক-আধজন শুইয়া গড়াইয়া আছে। আশেপাশেও লোক বিরল, আলোও বেশির ভাগ নির্বাপিত। গোরাচাঁদ একটা বালিশের উপর কাত হইয়া বলিল, “খাইয়েছে মন্দ নয়, তবে একটু একটেরেয় পড়ে গিয়েছিলাম, এই যা।”

খানিকক্ষণ খাওয়ার আলোচনাই চলিল।

গোরাচাঁদ আবার বলিল, “রাজু, তোর পদ্যটা পড় তো একটু, শুনি। গোড়াটায় বেশ লিখেছিস—”

“আজকে সখা দিল-পেয়ালায় ফূর্তি সরাব উছলে ওঠে—”

ঘোঁৎনা বিরক্তভাবে বলিল, “আরে দ্যুৎ, উছলে ওঠে! তিলুর বিয়েটা জমতেই পেলে না, পদে পদে বাধা; এ যেন—।—গণশা কোথায়? দেখছি না যে?”

রাজেন বলিল, “তাই তো!”

শুইয়া বসিয়াই সকলে চারিদিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করিল।

কে. গুপ্ত হঠাৎ ঘোঁৎনার কাঁধটা নিজের কাছে টানিয়া বলিল, “দেখুন তো গণেশবাবুর মতই না?”

ঘোঁৎনা বলিল, “তাই তো বোধ হচ্ছে, অন্ধকারে ওখানে কি করছে ছোঁড়া?”

সদর-বাড়ির বাঁ দিক দিয়া একটা রাস্তা স্টেশনের দিকে গিয়াছে এবং তাহারই একটা সরু ফ্যাকড়া ঘন বন, জঙ্গল, রাবিশ প্রভৃতির মধ্য দিয়া অন্দর-বাড়ির পিছন দিকে হারাইয়া গিয়াছে। সেই রাস্তাতেই একটা বিচালির গাদার আড়ালে গণশাকে দেখা গেল, অতি সন্তর্পণে চারিদিকে সতর্ক দৃষ্টি নিক্ষেপ করিতে করিতে আসিতেছে। বিচালির গাদাটা পার হইয়া বেশ সহজ ভাব ধারণ করিল। দলের মধ্যে আসিয়া সকলের উৎসুক প্রশ্ন নিবারণ করিয়া চাপা গলায় বলিল, “চুপ।”

বলিয়া নিজেও একটু চুপ করিয়া রহিল। ঘোঁৎনা তাহার কাপড় হইতে একটা চোরকাঁটা ছাড়াইয়া লইয়া প্রশ্ন করিল, “কোথায় গিয়েছিলি রে গণশা?”

গণশা মুখটা একটু নীচু করিল, সবাই ঘেঁষিয়া আসিলে বলিল, “তি—ত্তিলুর বাসরঘর দেখে এলাম।”

“সে কি!”

“দ্যুৎ, মিছে কথা!”

“মাইরি?”—বলিতে বলিতে সবাই আরও ঘেঁষিয়া আসিল। কে. গুপ্ত বলিল, “ত্রিলোচনবাবু আছেন তো?—কান-টান—জামায় রক্ত- টক্ত—”

“আপনার ত্রিলোচন এখন সহস্রলোচন ইন্দ্র হয়ে বসে আছে মশাই, চা-চ্চারিদিকে অপ্সরী, কিন্নরী, ঠানদিদি –”

রাজেন কল্পনায় চিত্রটা আঁকিয়া লইয়া বলিল, “উঃ, যেতে হবে মাইরি!”

গণশা জানাইয়া দিল, অভিযানটা বেজায় শক্ত। সরু রাস্তাটা একটু গিয়া আর নাই। তাহার পর দূরের গান-বাজনা আর মাঝে মাঝে হাসির শব্দ লক্ষ্য করিয়া, ঘন আগাছার মধ্য দিয়া ছাই, গোবর, ভাঙা ইট, সুরকির গাদা প্রভৃতির উপর দিয়া বাড়ির পিছন দিকে পৌঁছিতে হইবে। সে আরও মারাত্মক জায়গা, চাপ জঙ্গল, ঘুটঘুটে অন্ধকার। দুইটা ঘর পার হইয়া বাসরঘরটা। খড়খড়ি-দেওয়া পাশাপাশি দুইটা জানালা, শীতের জন্য বন্ধ। একটার জোড়ের কাছটা একটু ফাঁক হইয়া গিয়াছে, আর অন্যটাতে একটা খড়খড়ির নীচের দিকে একটা ছোট্ট ফালি উড়িয়া গিয়াছে। “ভ-ব্লগবানের দয়া।”—বলিয়া বিবরণ শেষ করিয়া প্রশ্ন করিল, “বো-বোঝ; চাও যেতে কেউ?”

ঘোঁৎনা বলিল, “আলবত যাব, এর আর বোঝাবুঝি কি আছে?”

কে. গুপ্ত বলিল, “সাপখোপ—”

ঘোঁৎনা ধমক দিয়া বলিল, “রাত্তিরে ওই নাম করছেন? আচ্ছা কাঠ-গোঁয়ার তো!” কে. গুপ্ত ধাঁধায় পড়িয়া চুপ করিয়া গেল।

গণশা বলিল, “তবে হ্যাঁ, জঙ্গলের ওদিকে খানিকটা ফাঁকা মা-ম্মাঠ আছে; যদি তাড়া করে তো—”

গোরাচাঁদ প্রশ্ন করিল, “কি দেখলি জানলার ফাঁক দিয়ে গণশা? এক ঘর বুঝি খুব সুন্—”

রাজেন বাধা দিল, “থাক, বর্ণনা করলে আবার বাসি হয়ে যাবে।”

“সে করাও যায় না।”—বলিয়া গণশা সকলের উৎসুক কল্পনাকে একেবারে চরমে উদ্দীপিত করিয়া তুলিল।

.

দুইটা জানলার মধ্যে হাত চারেকের জায়গা। একটা রাজেন আর গণশা, অপরটা ঘোঁৎনা আর.কে. গুপ্ত দখল করিল।

পথে গোরাচাঁদের পা দুইটা হাঁটু পর্যন্ত একটা গোবর গাদায় ডুবিয়া গিয়াছিল। গণশার কানের কাছে ফিসফিস করিয়া বলিল, “ওরে গণশা, বড্ড কুটকুট করছে; উঃ, কি করি বল তো?”

গণশার মন তখন অন্য রাজ্যে। একটি ষোড়শী আসিয়া কনের মুখের ঘোমটা তুলিয়া ত্রিলোচনকে বলিতেছে, “এই দেখ ভাই। আহা, বেচারী, এইজন্যে মনমরা হয়ে ছিল গো! দেখ দিকিন কেমন!”

গোরাচাঁদ গণশার কাঁধটা একটু টিপিয়া বলিল, “শুনছিস? গেলাম, গেলাম মাইরি, গোবরটা নিশ্চয় পচা ছিল।”

গণশা ছিদ্রপথে দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া অন্যমনস্কভাবে প্রশ্ন করিল, “কি করে জানলি?”

গোরাচাঁদ খিঁচাইয়া বলিল, “কি করে জানলি! ভয়ানক কুটকুট করছে যে পা দুটা!”

গণশা চোখ দুইটা ছিদ্রপথে আরও ভালো করিয়া বসাইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কেন?”

গোরাচাঁদ নিরাশ হইয়া অপর জানালায় চলিয়া গেল, ঘোঁৎনার জামার খুঁটে একটা টান দিয়া বলিল, “ঘোঁতু, পচা গোবরের কোনো রকম ওষুধ—”

“না, হয় না; ফেলে দে।”—বলিয়া ঘোঁৎনা তাড়াতাড়ি আবার দৃষ্টিটা গবাক্ষবদ্ধ করিল।

ষোড়শী ঢলঢলে চোখ দুইটি তখন বরের মুখের উপর রাখিয়া আবদারের সুরে বলিতেছে, “হ্যাঁ ভাই বর, অমন চাঁদপানা মুখ একখানা দেখিয়া দিলাম, মজুরি হিসেবেও একখানা গান—”

একটি কিশোরী বলিল, “হ্যালা সরীদি, জানিস না, দয়া করলে কি আকে রস দেয়? কানে মোচড় না দিলে কি গান বেরোয়?”

ঘোনা কে. গুপ্তকে টিপিয়া ধীরে ধীরে বলিল, “দেখলেন, ওইটুকু মেয়ে অবলীলাক্রমে বিদ্যাসুন্দর আউড়ে দিলে!”

কে. গুপ্ত প্রশ্ন করিল, “সে আবার কি?”

ঘোঁৎনা মুখ ঘুরাইয়া লইয়া মনে মনে বলিল, “তোমার মুণ্ডু, ছাতুখোর!

ওদিকে রাজেন গণশাকে প্রশ্নে প্রশ্নে বোঝাই করিতেছিল, “পোষ মাসে বিয়ে হয় না, না রে গণশা? ধর্, যদি তেমন তেমন জরুরি হয়? আচ্ছা, মাঘ মাসে? মাঘ মাসের গোড়ায় দিন-টিন আছে কি না খোঁজ রাখিস?”

ঘরের ভিতর কানমলার অনেকগুলি সমর্থনকারিণী জুটিয়া গেল। ত্রিলোচন ভয়ে ভয়ে হাত বাড়াইয়া বলিল, “থামুন; আমি গাইব, তবে কথা হচ্ছে, গানের অন্তরাটা হারিয়ে যাচ্ছে, বাংলা নয় কিনা। যদি একবার ভেতরের বারান্দায় গণশাকে ডাকিয়ে পাঠান তো—”

গণশা তাড়াতাড়ি মুখটা সরাইয়া লইয়া অতিরিক্ত উৎকণ্ঠার সহিত ফিসফিস করিয়া বলিল, “কি সর্বনাশ বল দিকিন! ইডিয়ট! এক্ষুনি ওদিকে ডাক পড়বে, এখন কি করা—”

রাজেন দেখিতেই ছিল; হাতটা একবার ‘না’র ভঙ্গিতে নাড়িয়া গণশাকে টানিয়া লইল। গণশা শেষের দিকটা শুনিতে পাইল, “আমরা গণশা কি ঢ্যাপসা এদের ডাকতে যাই আর কি!”

গোরাচাঁদ, গণশা আর রাজেনের মাঝখানে মুখটা গুঁজিয়া দিয়াছিল। হঠাৎ পায়ের চিড়বিড়ানিটা বাড়িয়া যাওয়ায় এক রকম নাচিতে নাচিতেই সরিয়া আসিল। সঙ্গে সঙ্গে গণশাকে টানিয়া লইয়া চুলকাইতে চুলকাইতে বলিল, “আবার চাগিয়েছে রে, গেলাম মাইরি!”

“তুই সব মাটি করলি; আয় তো এদিকটায় ফাঁকায় একটু সরে। সেই মেয়েটা এতক্ষণ বোধ হয়—”

পাশেই হঠাৎ দুয়ার খোলার আওয়াজ হইল, এবং সঙ্গে সঙ্গে একরাশ এঁটো পাতা, খুরি, গেলাস দুইজনের মাথায় কাঁধে পিঠে সজোরে আছড়াইয়া পড়িল। তাহার পর তাহাদের ফিরিবার সঙ্গে সঙ্গেই, “ওগো বাবা গো ডাকাত!”—বলিয়া স্ত্রীকণ্ঠে একটা চিৎকার, ঝনাৎ করিয়া দুয়ার বন্ধ, সশব্দে পতন, গোঙানি, বিভিন্ন কণ্ঠে হাঁকাহাঁকি, বিভিন্ন দিকে ছুটোছুটি, সবগুলা যেন এক মুহূর্তে সংঘটিত হইয়া বাড়িটাকে তোলপাড় করিয়া তুলিল।

দলটার যে যেখানে ছিল, একটু হতভম্ব হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। ভাবিবার সময় নাই, শুদ্ধ জীবধর্মের প্রেরণায় কাজ। কোনো রকমে বাঁচিতে হইবে, যেমন করিয়াই হোক না কেন।

কে. গুপ্ত যেদিক হইতে আসিয়াছিল, সোজা সেই দিকে ঘুরিয়া ছুট দিল; সদরের দিকে নয়, একেবারে সোজা।

“ওই পালায়, পেছু নাও!”

“উত্তর দিকে ছুটেছে!”

ঘোঁৎনা পলাইবার উপক্রম করিয়া ঘুরিতেই একটা গাছে ধাক্কা লাগিল। বোধ হয় পেঁপেগাছ, খুব মোটা।

ওদিকে কে হাঁকিল, “না, বন্দুক না নিয়ে বেরিও না; খবরদার টোটা ভরে বেরুবে।” ঘোঁৎনা তরতর করিয়া পেঁপেগাছটার উপর উঠিয়া পড়িল। একটু উপরে উঠিয়াই টের পাইল, কতকগুলো ডাল বাহির হইয়া একটা ঝোপ; আপাতত সেখানটায় একটু থামিল।

গণশা গোরাচাদের কোমরের র‍্যাপারটা টানিয়া বলিল, “সা-স্সামনেই ফাঁকা মাঠটা, শি-শিগগির নেমে পড়।”

রাজেন বলিল, “তার চেয়ে চেঁচিয়ে বল, আমরা বরযাত্রী।”

“তুই আলাপ ক-কগে, মুখ্যু!”—বলিয়া গণশা গোরাচাঁদকে এক রকম টানিতে টানিতেই পা বাড়াইল।

পাশেই বাসরঘরে একটু যেন ধস্তাধস্তি হইতেছে। একজন বয়স্থার গলার আওয়াজ— “ওরে, না না, জানালা খুলিস নি, ওদের হাতে বন্দুক থাকে, ওরে অ নীহার! কি নির্ভয় মেয়ে সব আজকালকার!”

জানালাটা টানা-হিঁচড়ানির মধ্যে খুলিয়া গেল। রাজেন এক রকম লাফ দিয়াই গণশা- গোরাচাঁদকে ধরিয়া ফেলিল। তাহার পরেই পাতলা আগাছার মধ্য দিয়া ছুট। হাত-কয়েক পরে জমিটা সামনে একটু নামিয়া গিয়াছে, তাহার পরেই ফাঁকা। তিনজনে ঢালটুকু একরকম লাফ দিয়াই কাটাইল; পরক্ষণেই ঝপাং ঝপাং ঝপাং করিয়া তিনটা শব্দ।

“ওরে, পুকুরে পড়েছে।—খিড়কির পুকুরে, তিনটে।”

খিড়কির দরজা খুলিয়া গেল।

“লালঠেনে হবে না, গ্যাস-লাইটটা নিয়ে আয়।”

“একটা টর্চ হলে হত—বরযাত্রীদের কাছে বেশ বড় গোছের আছে একটা, চেয়ে নিয়ে আয়; তারা ঘুমোচ্ছে বোধ হয়, জাগিয়ে দে!”

তিনজনে প্রাণপণে সাঁতার কাটিতে লাগিল। রাজেন চাপাস্বরে বলিল, “এই তোর মাঠ? কি ভীষণ পানা রে বাবা! উফ্!”

গণশা বলিল, “ঘা-ঘ ঘাস ভেবেছিলাম! ডুব-সাঁতার কাট।”

সমস্ত পাড়ায় সাড়া পড়িয়া গিয়াছে। বেটাছেলের গলার আওয়াজ ক্রমেই বেশি শোনা যাইতেছে। নানা রকম প্রশ্ন, উত্তর, হুকুম।

“এই পুকুরে?”

“হ্যাঁ, ঘিরে ফেল। লাঠি সড়কি যাই হোক, সবাই এক-একটা হাতে রেখ, ভয়ঙ্কর লাশ এক-একটা!”

“রঘো বাগদীকে খবর দেওয়া হয়েছে?”—এটা যেন জগুদার স্বর।

এক কোণ হইতে গগনবিদারক আওয়াজ আসিল, “এজ্ঞে এই যে মুই রামদা নিয়ে রয়েছি। নেমে পড়ব?”

এপার হইতে উত্তর হইল, “না, ঘিরে ফেল চারিদিক থেকে। ওরে, কুকুর দুটোকে খুলে দে!”

“দেখতে পাচ্ছ কেউ?”

রঘো বলিল, “যেন তিনটে মাথা ওদিকপানে!”

গণশা ডুব দিল।

“দুটো!”

রাজেন ও গোরাচাঁদ ডুব দিল।

“গোঁত্তা দিয়েছে সব!”

“নজর রাখিস!”

রাজেন মুখ তুলিয়া প্রশ্ন করিল, “কতক্ষণ ডুবে থাকা যায়?”

গোরাচাঁদ প্রতিপ্রশ্ন করিল, “কতক্ষণ ভেসে থাকা যায়? আমার পেটে জায়গাই ছিল না, তার ওপর জল—”

রাজেন বলিল, “পানার জল। উঃ, কি কামড়ায় র‍্যা?”

গণশা বলিল, “মা-ম্মাছ—বোধ হয় পো-পোষা মাছ।” রাজেন বলিল, “উঃ, পোষাই বটে ওদের, ছিঁড়ে ফেললে!”

গোরাচাঁদ বলিল, “আবার পচা গোবরের চার পেয়েছে কিনা।”

যে টর্চ আনিতে গিয়াছিল, খিড়কির নিকট হইতে চেঁচাইয়া বলিল, “বরযাত্রীরা তো নেই জগুদা, দুজন খালি মদ খেয়ে নাক ডাকাচ্ছে। ডাকাত পড়েছে বলতে বললে—পড়ে থাক, উঠিও না।”

পুকুরের একদিক হইতে জগুদার কর্কশ আওয়াজ হইল, “আপনারা তা হলে কোন্ দিকে আছেন মশাই? একবার টর্চটা বের করুন না?”

অপর একজন বলিল, “তারা আবার এই সময় কোথায় গেল? পরের ছেলে- ভাবনার কথা তো!”

গোরাচাঁদ হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিল, “এই গণশা, এই তালে জানিয়ে দে আমরা এখানে, কোনো ভাবনা নেই—”

রাজেন বলিল, “আর টর্চটা ভিজে গেছে।”

গণশা বোধ হয় জানাইতে যাইতেছিল, কিন্তু ঠিক এই সময় পাশে একটা ঢিল আসিয়া পড়ায়, সে সঙ্গে সঙ্গে জলের মধ্যে ডুবিয়া পড়িল।

“ওই যে, ওইখানটায় একটা ঘায়েল হয়েছে!”

সঙ্গে সঙ্গে আরও কয়েকটা ছোট বড় ঢিল আসিয়া আশেপাশে পড়িল। একটা বন্দুকের আওয়াজও হইল।

আর দেরি করা চলে না। গোরাচাঁদ হাঁপাইতে হাঁপাইতে চেঁচাইয়া চলিল, “ঢিল ছুঁড়বেন না আপনারা!”

রাজেন বলিল, “বন্দুকও ছুঁড়বেন না!”

একজন কথাগুলা বাঁকাইয়া বলিল, “বটে বটে, কি ছুঁড়তে তা হলে হুকুম হয়?” একজন ইয়ার-গোছের ছোকরা ও-কিনারা হইতে বলিল, “ফুল ছুঁড়ন, চন্দনে ডুবিয়ে।”

গোরাচাঁদ দম লইয়া বলিল, “আমরা বরযাত্রীর দল।”

চারিদিক একটু নিস্তব্ধ হইয়া গেল, আধ মিনিটটাক মাত্র। তাহার পর সকলের বুদ্ধি ফিরিয়া আসিল। ওপারে কে একজন বলিল, “রসিক আছে তো?”

পেঁপেগাছ হইতে ঘোঁৎনা এই তালে বলিতে যাইতেছিল, “আমিও একজন আছি এখানে—কিন্তু অবিশ্বাসের বহর দেখিয়া আর বলা হইল না।

পাশের কিনারা হইতে উত্তর আসিল, “ওই যে শুনেছে বরযাত্রীদের পাওয়া যাচ্ছে না—ওরে আমার চালাক রে!”

তিনজনে এই দিকেই অগ্রসর হইতেছিল; পায়ে মাটি ঠেকিল। রাজেন বলিল, দিব্যি করে বলছি, আমরা বরযাত্রী, উঠলেই টের পাবেন। থু থু, কি পানা রে বাবা!”

গণশা লম্বা ডুব দেওয়াতে অতিরিক্ত হাঁপাইতেছিল। রাজেন বলিল, “রঘু বাগদী এদিকে নেই তো?”

আবার সেই উৎকট বক্রোক্তি, “বটে বটে, ওরে, রঘুকে ডাক!”

তিনজন আবার ঝপাঝপ করিয়া জলে পড়িল। তখন জগুদার কণ্ঠের আওয়াজ হইল, “আচ্ছা, উঠে আয়, কিন্তু এক এক করে। রঘু, তুই একটু ওদিকেই থাক, তোয়ের থাকবি কিন্তু।”

রাজেন প্রথমে উঠিল। হাত পা এক রকম অবশ হইয়া গিয়াছে, সর্বাঙ্গে পাঁক, পানা, কুটা-কাঠি। ঠকঠক করিয়া কাঁপুনি। কোমরে জড়ানো র‍্যাপারের পরতে একটা বড় চাঁদামাছ লণ্ঠনের আলোয় চকচক করিতেছে। বুকটা হাপরের মতো উঠানামা করিতেছে; কোনো রকমে দুইটা কথা ধাক্কা দিয়া বাহির করিল, “এই দেখুন।”

পূর্বপরিচিত সেই কালো লম্বা ছেলেটা বলিল, “বাঃ, কি চমৎকার!”

আর একজন বলিল, “চোখ জুড়িয়ে গেল!”

গোরাচাঁদ উঠিয়া আসিল। রাজেনেরই মত, অধিকন্তু কাপড়টা খুলিয়া গিয়াছে, নীচে আন্ডারওয়্যার। রাজেন হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিল, “এ গোরা।”

সেই ফাজিল ছেলেটা বস্ত্রের সংক্ষিপ্ততা লক্ষ্য করিয়া বলিল, “হাইল্যান্ডার গোরা বলুন!”

গণশা ফিরিয়াই আবার ডুব দেওয়ায় পিছনে পড়িয়া গিয়াছিল; অর্ধমৃত অবস্থায় উঠিয়া আসিল। গোরাচাঁদেরই অনুরূপ, বাড়তির মধ্যে মাথায় একটা ছোট্ট কচুরিপানার চূড়া।

সেই ছেলেটা পিছন হইতে সম্ভ্রমের স্বরে বলিল, “কম্যান্ডার-ইন-চীফ! “ “উঠেছে! উঠেছে ওই দিকে!”—শব্দ করিতে করিতে চারিদিকের লোক আসিয়া ভিড় করিয়া দাঁড়াইল।

একজন বলিল, “কি বলছে? এরাও বরযাত্রী? দড়ি নিয়ে এস।”

অন্য একজন বলিল, “বরযাত্রীরা নেই কিনা, ধরা পড়ে তাদের জায়গা দখল করে নিচ্ছে।”

সেই দুষ্টুবুদ্ধি ছোকরাটা সামনে আসিয়া বলিল, “আরে তাদের যে আমি ইস্টিশানের দিকে যেতে দেখলাম। আর তাদের দেখলেই জগুদা তক্ষুনি চিনে ফেলত, না জগুদা?”—বলিয়া একটা অর্থপূর্ণ দৃষ্টিনিক্ষেপ করিল।

“দেখতেও হত না, গলা শুনেই চিনতাম।”—বলিয়া একবার তাহার দিকে কেমন একভাবে চাহিয়া, হঠাৎ নিজের গলাটা পরিষ্কার করিবার দরকার পড়ায় জগুদা সরিয়া গেল।

কন্যাকর্তা বৃদ্ধগোছের। ছেলেটার দিকে পিটপিট করিয়া চাহিয়া বলিলেন, “তুই যেতে দেখলি তাদের? তা হবে; কয়েকজন চলে যাবে বলে তখন গোঁও ধরেছিল; আর তারা ছিল ছ-সাতজন।”

গোরাচাঁদ বলিল, “পাঁচজন ছিলাম।”

জগুদা ফিরিয়া আসিয়া বলিল, “আর তাদের মধ্যে একজন তোতলা ছিল, সবচেয়ে হারামজাদা।”

গণশা তাড়াতাড়ি দম লইয়া বলিল, “এই যে ম-ম্মশাই, আম্মো রয়েছি; বে- ব্লেজার—”

“মা-ম্মাইরি! অমনই তো-ত্তোতলা সেজে গেলে!”

কন্যাকর্তা বলিলেন, “অত তোতলা তো ছিল না!”

দুই-তিনজন ধূর্তামি করিয়া বলিয়া গেল, “একজন বোবা ছিল।”

“একজন খোনা ছিল।”

“একটা খোঁড়া ছিল।”

“তা এখনও হতে পারে।”

কন্যাকর্তা প্রশ্ন করিলেন, “বরযাত্রী তো, ওদিকে কি করছিলে সব?”

তিনজনে পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করিতে লাগিল। রাজেন গণশাকে একটু ঠেলিয়া বলিল, “বল না রে।”

গণশা মুখটা খিঁচাইয়া বিরক্তভাবে কহিল, “আরে ধুৎ, আমার কথা বে-ব্বেশি আটকে যাচ্ছে, বি-বিশ্বাস করবে না।”

গোরাচাঁদ কহিল, “রাজেন বললে—দিব্যি খাওয়ালে ভদ্দরলোকেরা; চল, তিলোচন বোধ হয় এতক্ষণ বাসরে গান ধরেছে, বাড়ির পেছন দিব্যি নিরিবিলিতে—”

রাজেন যোগাইয়া দিল, “পুকুরধারটিতে বসে—”

“দিব্যি নিরিবিলিতে পুকুরধারটিতে বসে একটু—”

গণশা থাকিতে পারিল না, বলিল, “আমি ব-বললাম, থাক, দ-দ্দরকার কি? মে- স্মেয়েছেলেরা রয়েছেন—”

গোরাচাঁদ গণশার দিকে একটা তির্যক দৃষ্টি হানিল; একটু উপস্থিতবুদ্ধি খরচ করিয়া বলিল, “আমি বললাম, মেয়েছেলেরা গান ধরলেই উঠে পড়ব, তাঁরা তো আমাদেরই বোনের তুল্যি।”

রাজেন বলিল, “মার পেটের বোনের—”

কন্যাকর্তা গর্জন করিয়া উঠিলেন, “সব ধাপ্পাবাজি! মার পেটের বোনের! কেউ গেল থানায়? রঘু!”

রঘু বাগদী পিছনেই দাঁড়াইয়া ছিল। বলিল, “এজ্ঞে, এই যে আছি মুই। আপনাদেরও যেমন হয়েছে কত্তা, ওই সব কথা পেত্তয় করেন! আয়েস করে গান শোনবার কি লন্দনকানন রে! সব একেলে শৌখিন ডাকাত, দেখছেন না? পুলিসে খবর না দিলে চলবে না।”

রঘুর উপস্থিতিতে এবং কথাবার্তায় সবাই আরও ঘাবড়াইয়া গেল। রাজেন বলিল, “আচ্ছা পুলিস ডাকবার আগে আমাদের কর্তাদের কাছে নিয়ে চলুন না একবার, তাঁরা তো ভুল করবেন না।”

গোরাচাঁদ বলিল, “না হয় বরের কাছে—”

কর্তা শাসাইয়া উঠিলেন, “খবরদার বরের কাছে যেন না নিয়ে যাওয়া হয়।”

পিছন হইতে একজন বৃদ্ধগোছের লোক বলিলেন, “আর দেখ, বর-কনে যেন ঘর থেকে না বেরোয়! কোথায় কে ঘাপটি মেরে আছে, কত রকম বিপদ হতে পারে—দুর্গা দুর্গা!”

জগুদা বলিল, “আচ্ছা, বরকর্তার কাছেই নিয়ে চল সবাইকে। রঘু, পাশে পাশে থাকিস।”

তিনজনেই নিজের নিজের মূর্তির দিকে চাহিয়া বলিল, “তাহলে একখানা করে শুকনো কাপড় আর জামা—”

সমস্ত দলটাতে একটা চেঁচামেচি-গোছের পড়িয়া গেল।

“মাইরি?”

“ওঁদের জামাই সাজিয়ে নিয়ে যেতে হবে!”

“একটা চৌঘড়ি নিয়ে এস।”

‘যেমন ভাবে পুকুর থেকে উঠেছিলে সেই রকম ভাবেই যেতে হবে; তাতে যদি চেনে তবেই—”

সেই দুষ্টুবুদ্ধি ছেলেটা বলিল, “দময়ন্তী নলকে অমন অবস্থাতেও কি করে চিনেছিলেন? বরং যে পানাগুলো খসে গেছে, আবার চাপিয়ে দাও।”

অগত্যা সেই অবস্থাতেই অগ্রসর হইতে হইল। দলটা রঙ-বেরঙের মন্তব্য প্রকাশ করিতে করিতে আগে-পিছে চলিল।

সদর-বাড়িতে মাঝখানের ঘরটিতে কর্তা ও বরের মেসো এক জায়গায় মড়ার মত পড়িয়া। এক কোণে পুরুতঠাকুর তাঁহার বধিরতার কল্যাণে গাঢ় নিদ্রায় অচৈতন্য। বাহিরের বারান্দায় দীনে নাপতে কাজকর্ম সারিয়া কর্তাদের বোতল-ঝাড়া একটু প্রসাদবিন্দু পাইয়াছিল, তাহাতেই তাহার ষোল আনা ফলপ্রাপ্তি হইয়াছে।

দলটা বারান্দায় আসিয়া উপস্থিত হইল। জগুদা “বেয়াই মশাই” বলিয়া বরকর্তাকে জাগাইতে যাইতেছিল, সেই ছেলেটা হঠাৎ সামনে আসিয়া বলিল, “দাঁড়ান, ওরাই আগে দেখাক, কে বরের বাবা, কে বরের মামা, কে বরের বোনাই, কে বরের—”

তিনজনে কটমট করিয়া তাহার পানে চাহিল। গোরাচাঁদ বলিল, “কেন, ওই তো বরের বাপ

গণশা টীকা করিল, “ভ-ভক্ততারণবাবু।”

“ওই বরের মেসো অনন্তবাবু, ওই পুরুত মশাই—কালা, রাতকানা। বাইরে দীনে নাপতে।”

ছেলেটা দমিবার পাত্র নয়, চোখ বড় বড় করিয়া বলিল, “সব খোঁজ নিয়েছে রে!” একজন বলিল, “বোধ হয় শিবপুর থেকে ধাওয়া করেছে!”

অনেক ডাকাডাকি এবং পরে ঠেলাঠেলির পর ভবতারণবাবু “উ” করিয়া এক শব্দ করিলেন। দুই-তিনজন চিৎকার করিয়া প্রশ্ন করিল, “দেখুন তো, এরা কি আপনাদের বয়যাত্রী?”

অনেকবার প্রশ্ন করায়, অনেক কষ্টে কর্তা রক্তাভ চক্ষু দুইটি চাড়া দিয়া অল্প একটু উন্মীলিত করিলেন; আরও অনেক চেষ্টার পর প্রশ্নটার একটু মর্মগ্রহণ করিয়া অস্পষ্টস্বরে বলিলেন, “কে বাবা, লন্দি-ভিরিঙ্গি, থিলোচনের বরযাত্র এশ্চো? এক শিল্‌ম্, চড়াও তো বাবা।”

তিনজনেই এক রকম আর্তস্বরেই চিৎকার করিয়া বলিল, “জ্যাঠামশাই, আমরা গোরাচাঁদ, রাজেন, গণেশ—”

“গজানন, শিঃ, তুই শেঙ্কালে বাপের বিয়ে দেখত্তেলি?”—বলিয়া অবশ অঙ্গুলি দিয়া সবাইকে সরিয়া যাইতে ইশারা করিয়া পাশ ফিরিয়া শুইলেন। বৃথা পরিশ্রম ভাবিয়া তাঁহাকে আর কেহ জাগাইতে চাহিল না।

বরের মেসো অনন্তবাবুর একটুও সাড়া পাওয়া গেল না। গোরাচাঁদ নিরাশভাবে বলিল, “হা ভগবান!”

পুরোহিত মহাশয়কে তোলা হইল। কথাটা তাঁহাকে শুনাইতে এবং ভালো করিয়া বুঝাইতে সবিশেষ বেগ পাইতে হইল। তিনি বলিলেন, “ডাকাতরা বলছে, বরযাত্রী? তা আমি তো রাত্রে দেখতে পাই না বাবা, প্রাতঃকাল পর্যন্ত তাদের বসিয়া রাখ না হয়।”

গোরাচাঁদ অগ্রসর হইয়া পদধূলি লইয়া বলিল, “ন্যায়রত্ন মশাই, আমি গোরাচাঁদ।”

“গোরাচাঁদ? এস দাদা, আজকের দিনে আর কি আশীর্বাদ করব? শীঘ্র একটি বিবাহ হোক, কন্দৰ্পকান্তি হও–”

সেই সর্বঘটের ছেলেটা একটু কাছে ঘেঁষিয়া চেঁচাইয়া বলিল, “কন্দৰ্পকান্তি আশীর্বাদের আগেই হয়ে বসে আছে!”

পাশ থেকে কে একজন বলিল, “মানস সরোবরে চান করে!”

ন্যায়রত্ন মহাশয় ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ তা বইকি, তোমরা সুপুরুষ তো আছই। তা গোরা রে, এঁরা কি বলছেন, ডাকাতরা নাকি বলছে—তারা বরযাত্রী? কি অনাসৃষ্টি! চিনে দাও তো দাদা।”

রাজেন বলিল, “এরা বলছে—এঁরা বলছেন, বরযাত্রীরা ডাকাত।”

ন্যায়রত্ন মহাশয় একটু ধাঁধায় পড়িয়া ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া বলিলেন, “ঠিক অর্থ গ্রহণ হচ্ছে না, ডাকাতরা বরযাত্রী, না বরযাত্রীরা ডাকাত?”

দলের একজন ডান হাতটা উল্টাইয়া পাল্টাইয়া বলিল, “সামলাও ন্যায়ের ধাক্কা এখন, তৈলাধার পাত্র, না পাত্রাধার তৈল? ডাকাতরা বরযাত্রী, না বরযাত্রীরা ডাকাত?”

গণশা মরীয়া হইয়া হাতজোড় করিয়া বলিল, “ম-ম্মশাই, আমি পারলে সো-সোজা করেই বলতাম, কি-ক্কিন্তু সত্যিই তোতলা; দয়া করে একবার বর তি-ত্তিলুর কাছে নিয়ে চলুন, তারপর পু-প্রুলিসে দিয়ে দেবেন না হয়। উঃ, শী-শ্ শীতে কালিয়ে গেলাম!”

বলা বাহুল্য, কথাবার্তার ভঙ্গিতে অনেকের সন্দেহটা মিটিয়াই আসিতেছিল, বিশেষ করিয়া বয়স্থদের মধ্যে। তাঁহাদের মধ্যে একজন বলিলেন, “তাই নিয়ে চল না হয়, রঘুকে এগিয়ে দাও।”

কর্তা বলিলেন, “জগু, বাড়ির মেয়েদের তা হলে বলগে।”

দলটি তিনজনকে ঘিরিয়া উঠানে আসিয়া দাঁড়াইল। ঠানদিদি আর মেয়েরা বরের চারিদিকে ব্যূহ সৃষ্টি করিয়া বাহির হইতে পাওয়া খবরের টুকরাটাকরাগুলা লইয়া নিজের নিজের কল্পনাশক্তির পরিচর্চা করিতেছিল। কর্তা চেঁচাইয়া বলিলেন, “একবার বরকে বাইরে পাঠিয়ে দাও।”

“ওমা, কি অমুঙ্গলে কথা, কি হবে!—কোনোমতেই না।”—বলিয়া সবাই ব্যূহটা আরও সুদৃঢ় করিয়া ঘেরিয়া ফেলিল। কন্যাকর্তাকে নিজেকেই ভিতরে যাইতে হইল।

এমন সময় একটা কাণ্ড হইল। ঘোঁৎনা পুকুরের দিকটা খালি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খুব সন্তর্পণে পেঁপেগাছ হইতে নামিয়া চুপিসাড়ে সদর-বাড়িতে দলটির পিছনে আসিয়া দাঁড়াইয়া ছিল। সেখানকার কথাবার্তায় আত্মপ্রকাশের উৎসাহ না পাইয়া খুব সাবধানে বাড়ির মধ্যেও আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিল। ত্রিলোচনের দ্বারা সনাক্ত হইবার সুযোগটা হারানো কোনোমতেই সমীচীন হইবে না ভাবিয়া, “কি হয়েছে র‍্যা গণশা? এত গোলমাল কিসের?”—বলিতে বলিতে ভিড় ঠেলিয়া আসিয়া সামনে দাঁড়াইল, এবং সঙ্গে সঙ্গে- “অ্যাঁ, তোদের এ কি দশা!” বলিয়া হাত-চোখ-কাঁধের ভঙ্গী সহকারে একখানি নিখুঁত অভিনয় করিল।

তিনজনই বলিয়া উঠিল, “ঘোঁৎনা রে! কোথায় ছিলি? দেখ না, এ ভদ্দরলোকেরা কোনোমতেই—”

ঘোঁৎনা গাছের উপর হইতে পুকুরপাড়ের সব কথাই শুনিয়াছিল, বলিল, “তোরা যখন আমার বারণ না শুনে পুকুরের দিকে গান শুনতে গেলি—”

মুরব্বীয়ানায় গোরাচাঁদের গা জ্বলিয়া উঠিল। গণশা বুঝিতে পারিয়া তাহাকে টিপিয়া থামাইল।

“আমি ভাবলাম, দুত্তোর, একটু বেড়িয়ে আসা যাক। খানিকটা দূরে গেছি, এদিকে একটা সোরগোল। তাড়াতাড়ি ফিরলাম। একে অজানা জায়গা, তায় রাত্তির, খানিকটা এদিক, খানিকটা ওদিক করে শেষে পথ ভুলে—”

“একটা পেঁপেগাছে উঠে পড়লাম।”

সবাই এই শেষের বক্তা সেই ফাজিল ছোকরাটির পানে চাহিল। তাহার ঠিক মোক্ষম জায়গাটিতে আসিয়া দাঁড়াইবার কেমন একটা গূঢ় শক্তি আছে, ইতিমধ্যে কখন ঘোঁৎনার পাশটিতে আসিয়া জুটিয়া গিয়াছে। সে নিজের টিপ্পনীর পর আর কিছু না বলিয়া ঘোঁৎনার চারিদিকে লোকদের সরাইয়া দিয়া ঘোঁৎনাকে একটু সামনে আগাইয়া দিল। সকলেই দেখিল, তার পিছনে, কোমরে জড়ানো র‍্যাপারের সঙ্গে বাঁধা দুইটা ডাঁটাসুদ্ধ পেঁপের পাতা, একটা শুকনো, একটা পাকা—মাঝারি সাইজের। গাছে থাকিতে কখন আটকাইয়া কাপড়ের সঙ্গে বাঁধা পড়িয়া গিয়াছে, ঘোঁৎনার সাড় হয় নাই।

“দোসরা ধাপ্পাবাজ!—লাগাও চাঁটি!”—একটা গোলমাল উঠিতেছিল, এমন সময় শ্বশুরের সঙ্গে ত্রিলোচন আসিয়া রকে দাঁড়াইল।

“সত্যিই যে তোরাই দেখছি! আমি বলি, বুঝি ডাকাতই পড়ল। তা জলে ঝাঁপ দেওয়ার কুবুদ্ধি হল কেন? আর কে. গুপ্ত কোথায়? গোরা, তোর দাড়িতে কি ঝুলছে, মুখ তোল তো?”

দাড়িতে বোধ হয় একটা পানার শিকড় ঝুলিতেছিল, কিন্তু মুখ তুলিবার তখন আর গোরাচাঁদের অবস্থা ছিল না—গোরাচাঁদেরও নয়, গণশারও নয়, রাজেনেরও নয়, ঘোঁৎনারও নয়।

সন্দেহ সম্পূর্ণ কাটিয়া যাওয়ামাত্র একটা রব পড়িয়া গেল—”

“ওরে, শুকনো কাপড় নিয়ে আয় তিনখানা। “ “কাপড় জামা র‍্যাপার—শিগগির!”

“চা করতে বলে দে, দেরি না হয়।”

“আহা, ভদ্দরলোকের ছেলে, বাসরঘর দেখবার ইচ্ছে হয়েছিল তো—”

সেই ছেলেটা বলিল, “স্পষ্ট করে বললেই হত জগুদাকে।”

“ওরে, নিয়ে এলি কাপড়? দেরি কেন?”

.

কাপড় আসিল দুই দিক হইতে। বাসরঘরের ভিতর হইতে লইয়া আসিল একটি কিশোরী। চারিখানি বেশ চওড়াপেড়ে শাড়ি, চারটি সায়া, চারটি ব্লাউজ। একটু মিষ্টি ধারালো হাসি হাসিয়া বলিল, “বাসরঘরে ওঁদের চারজনকে ডাকছেন।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন