স্বর্গকেনা

আশাপূর্ণা দেবী

এই ঝুরি—নামা বটগাছটা ওদের ভালবাসার সাক্ষী। ওদের অভিসারের কুঞ্জ। স্বর্ণ আর সর্বেশ্বরের।

ঝুরিগুলো এমন ঘেঁষ ঘেঁষ নেমেছে, দেখে মনে হয় বৃক্ষকাণ্ডটাকে ঘিরে ঝুরি পুঁতে পুঁতে কে যেন একটা বৃত্ত প্রাচীর রচনা করে রেখেছে। হয়তো রেখেছে, হয়তো অনন্তকালের প্রেমের দেবতাই অবসর কালের খেলায় মেতে এমন অভিনব একটি ঠাঁই গড়ে রেখেছেন ওদের জন্যে। নইলে সাহস ওদের হয় কি করে? হাত কয়েক দূরেই তো ভৈরবীকালীর মন্দিরে যাবার পথটা মাঠের মাঝখান দিয়ে সর্পিল রেখায় এগিয়ে গিয়েছে বহুজন পদতাড়নার চিহ্ন বহন করে। দৈনিক কম লোক তো যায় না ভৈরবীকালীর মন্দিরে! এমনিতে নিত্যযাত্রী বাদে শনি—মঙ্গলবারে তো আছেই বিশেষ পুজো। তাছাড়াও আছে সংক্রান্তি, অমাবস্যা, কৃষ্ণচতুর্দশী, এটা ওটা। সর্বোপরি আছে মানসিকের ভার। মানসিক করতে আর মানসিক শোধ দিতে দূর দূর গ্রাম থেকে লোকের আসা—যাওয়া।

মানুষ জ্ঞানে বিজ্ঞানে অনেক এগিয়ে যাচ্ছে আর বহুবিধ কুসংস্কারমুক্ত হচ্ছে বলে যে বিপদকালে দেবতার কাছে ধর্ণা দিতে আসবে না তা তো নয়!

আসবে। আসে। চিরকাল যেমন এসেছে, তেমনিই আসে। হয়তো বা সভ্যতার কল্যাণে দুর্গম পথ সুগম হয়ে যাওয়ার সুবিধেয় বেশিই আসে। স্যুটে বুটে নিখুঁত সাহেবও ঝকঝকে গাড়ির মধ্যে বুটটাকে ছেড়ে রেখে এসে কষ্টে হাঁটু গেড়ে বসে হাত বাড়িয়ে কালীতলার মাটি মাথায় মাখেন, আর পুজো—প্রণামীর সম্ভারে ঐশ্বর্যের পরিচয় ঘোষণা করে দীন—দুঃখী আর্তের ভঙ্গীতে নম্রমুখে নিয়ে যান কবচ—মাদুলী প্রসাদী—পুষ্প।

উপায় কি? মানুষ যেখানে চির—পরাস্ত, বিজ্ঞান যেখানে নিশ্চিত ভরসার বিদ্যুৎ—বাতি জ্বেলে দিতে পারে না, সেখানে ওই ভয়—ভয় অন্ধকারে গড়া জাগ্রত দেবতার পীঠ—মন্দিরের ধুম্রমলিন প্রদীপশিখাটুকুই তো আশ্রয়।

বহু বছরের, হয়তো বা যুগ—যুগান্তের, ধোঁয়ার সঞ্চয়ে পুষ্ট গাঢ় কালো মসৃণ দেয়ালের পৃষ্ঠপটে ওই ধূমোদ্গারী লালচে শিখাটা যেন মানুষের অসহায়তার হিসেব রেখে চলে।

ঘিয়ের প্রদীপের সেই একটি বিশেষ গন্ধ, সে যেন দেশের নাড়িতে নাড়িতে আছে ওতপ্রোত হয়ে জড়িয়ে। তাকে ভুলে থাকা যায়, নিভিয়ে ফেলা যায় না। বিপদে পড়লেই মনে পড়ে, ছুটে আসে। জাগ্রত দেবতার সেবাইত সেই ছুটে—আসা মানুষের সামনে প্রদীপটা উস্কে তুলে ধরে বলে, ‘নিন, ফুল হাতে নিয়ে সংকল্প করুন—’

তাই বীরপুরের অদূরেই রেলস্টেশন এসে গেলেও, এবং রেলস্টেশনের অনুষঙ্গ হিসেবে আধুনিক সভ্যতার বহুবিধ উপকরণ আর উপসর্গ এসে জুটলেও বীরপুরের ভৈরবীকালীর মন্দিরের পথ কদাচ নির্জন।

বরং আগের থেকে অনেক বেশী সশব্দ, গাড়ির গর্জনে। আগে প্রায় সকল যাত্রীই পায়ে হেঁটে আসত, কেউ কেউ গোযানে। এখন নানা যান। হাওয়াগাড়ি, রিক্সাগাড়ি, সাইকেলগাড়ি, গরুর গাড়িও। মোটর—বাইকের দর্শনও দুর্লভ নয়। বীরপুরের যে ছেলেরা রেলস্টেশন এগিয়ে আসার সুবিধেয় আর ‘মেসের ভাত’ খেয়ে চাকরি না করে ডেলি—প্যাসেঞ্জারী করছে, তাদের মুখে মুখে রটনা হয়ে দেবীমাহাত্ম্য শহরের স্নায়ুকে চঞ্চল করে তুলে বিস্তৃতি লাভ করেছে।

মন্দিরে লোক—সমাগম এখন অতএব কম তো নয়ই, বরং বেশি।

কিন্তু স্বর্ণ আর সর্বেশ্বর কি এখনকার? বীরপুরের যে মেয়েরা দল বেঁধে রেলে চড়ে তিন স্টেশন দূরে গিয়ে সিনেমা দেখে আসে, স্বর্ণ কি তাদের দলের? আর সর্বেশ্বর সেই ছেলেদের দলের? যে ছেলেরা হাওয়াই চপ্পল পরে, সেফটি রেজারে দাড়ি কামায়, আর সন্ধ্যাবেলায় পথে বেরোতে হলে টর্চ নিয়ে বেরোয়?

নাঃ। তা নয়। স্বর্ণ আর সর্বেশ্বর অনেক আগের।

ওরা যে আমলের, তখন বীরপুরের লোক তো কোন ছার, অনেক ‘পুরের’ লোকই রেলগাড়ির নামও শোনেনি। কলকাতাই অবাক বিস্ময়ে ওই অলৌকিক যন্ত্রযানটার দিকে তাকিয়ে ছড়া বাঁধতে বসেছে—

 ‘এসো কে বেড়াতে যাবে শীঘ্র কর আজ,

 ধরাতে পুষ্পক রথ এনেছে ইংরাজ!’

কিন্তু সেটুকুতে ভৈরবীকালীর বয়সের খুব একটা তারতম্য ঘটে না। ভৈরবীকালী স্মরণাতীত কাল থেকে এখানে বিরাজ করছেন বহুবিভূতির মহিমা নিয়ে। আগে নাকি এ মন্দির নিবিড় জঙ্গলে ঘেরা ছিল। নরবলি হত, এবং আরো অনেক কিছুই হত, আইনের দাপটে সে সব ক্রিয়াকলাপ বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু পুণ্যরক্তপুত সেই হাঁড়িকাঠটি আছে এখনো অনেক কিংবদন্তী বহন করে।

বহুপুরুষে সেবাইত পাঠক—বংশের সঙ্গেও ওই রকম একটি কিংবদন্তী জড়িত। সেটা হচ্ছে এই সর্বেশ্বর পাঠকের কোন এক পূর্বপুরুষ নাকি নিতান্ত বালক বয়সে ‘সর্বসুলক্ষণযুক্ত’ ব্রাহ্মণ—তনয় হিসেবে কোন একস্থান থেকে আনিত হয়েছিল ‘বলি’ হবার জন্যে।

এই উপলক্ষ্যে সমারোহে পূজার আয়োজন হয়েছিল। কিন্তু উৎসর্গীকৃত বালক যখন হাঁড়িকাঠের কাছাকাছি এবং ঢাকিঢুলিরা মহোৎসাহে বলির বাজনা শুরু করেছে, তখন তদানীন্তন সেবাইত সহসা পুজোর আসন থেকে ছুটে এসে হাঁ হাঁ করে উঠেছিলেন, ‘ওরে থামা, থামা, মা নিষেধ করছেন!’

মা নিষেধ করছেন!

এ কী অভাবিত আর অভূতপূর্ব কথা?

সমস্ত পরিবেশটার উপর যেন একটা বজ্রপাত হল। সেই আঘাতে উদ্দাম নৃত্যরত উন্মত্ত মানুষগুলো পাথর হয়ে গেল।

অমাবস্যা রাত্রির মধ্যভাগ, এতক্ষণ জ্বলন্ত মশালের লেলিহান শিখাগুলো এখানে ওখানে নেচে বেড়িয়ে জায়গাটাকে যেন ‘অগ্নিকাণ্ডে’র চেহারা করে তুলেছিল, হঠাৎ সমস্ত মশালগুলো এক একটা জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।

সেবাইত রুদ্র আদেশের সুরে বললেন, ‘এ বলি হবে না। এ পুজো বন্ধ করতে হবে। মা—র আদেশ!’

আবার নামল স্তব্ধতা।

রক্তাম্বরধারী সেবাইত সেই ছোট ছোট খিলেনে গাঁথা গর্ভমন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন কোন এক ভয়াবহ নায়কের মত, মশালের আলোগুলো বাতাসে কেঁপে কেঁপে তাঁকে আরো অনৈসর্গিক চেহারায় দাঁড় করাচ্ছে।

কিছুক্ষণ পরে অস্ফুট একটা গুঞ্জনধ্বনি উঠল। মায়ের নিষেধ, মায়ের আদেশ, কিন্তু সেটা এল কোন অলৌকিক পথ বেয়ে?

স্পষ্ট করে জিজ্ঞাসা করবার সাহস কারো হচ্ছে না, কিন্তু অসন্তোষের গুঞ্জন রোধ করতে পারছে না। এতবড় একটা সমারোহের আমোদ থেকে বঞ্চিত হবে তারা শুধু একটা ধরা—ছোঁয়াহীন নিষেধে?

একটুক্ষণ পরে ওই গুঞ্জনধ্বনির মাঝখান থেকে একটা ভাঙা আর কর্কশ গলার সাড়া উঠল, ‘আমার তবে এখন কী কোর্তব্য ঠাকুরমশাই?’

এ গলা কামারের।

তিনদিন ধরে যে ব্যক্তি তার খাঁড়াখানা পাথরে শান দিয়ে দিয়ে ধারালো করেছে। হ্যাঁ, কামার। ভৈরবীকালীর এই নিয়ম। বলি দেবে নিখুঁত নীরোগ কামারের ছেলে। এক কোপে কাটতে পারবার খ্যাতি আছে লোকটার, সেই অহঙ্কারে খাঁড়াখানা দু’হাতে মাথার উপর তুলে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আস্ফালন করছিল, সেই উল্লসিত উত্তেজনার ওপর কিনা ঠাকুরমশাই অকারণ এক কলসী জল ঢেলে দিল?

মা—র নিষেধ। ছেলের হাতের মোয়া!

এক পলকের মধ্যে চুপি চুপি মা কী নিষেধ দিয়ে বসলেন শুনি? নির্ঘাৎ বুড়োর ওই টুকটুকে ছেলেটার ওপর মায়া পড়ে গেছে। ছেলে তো নেই নিজের, শুধু গণ্ডাভর্তি মেয়ে।

কিন্তু এই কি সম্ভব? পাপের ভয় নেই? অকল্যাণের ভয় নেই?

মায়ের নামে উচ্ছুগু্য বলির জীবকে মায়া করে বাঁচালে ঝাড়ে—বংশে নির্মূল হবে না? আয় তবে তুই নিজে এসে হাঁড়িকাঠে মাথা দে!

ধেনো মদের মাহাত্ম্যে এরকম অনেক কথাই মাথার মধ্যে গজগজিয়ে ওঠে লোকটার, তবে কথা সে ওই একটাই বলে। কর্তব্যের নির্দেশ চায়।

তা ওর কথার সঙ্গে সঙ্গেই স্তব্ধ অরণ্যে ঝড় ওঠে। সকলের মুখ থেকে একটাই কথা ওঠে, ‘বেপারটা কি ঠাকুরমশাই?’

‘ব্যাপার?’ সেবাইত ঠাকুর একটা ধাতব গলায় বলেন, ‘ব্যাপার জানতে চাও? তবে এসো। মাকে দেখে যাও।’

এই রহস্যময় কথায় অনেকেই নিথর হয়ে যায়, তবু দু’চারজন এগিয়েও যায় গুটি গুটি। অজানিত কালের ধোঁয়ার সঞ্চয়ে মসৃণ কালো দেয়ালের গায়ে ছায়া ফেলে ধূমোদ্গারী লালচে আলোর শিখাটা তুলে ধরেন সেবাইত ঠাকুর। আর সঙ্গে সঙ্গে সেখানে একটা অস্ফুট আর্তনাদের ঢেউ বহে যায়।

দেবীর জিভ নেই।

সেই ভয়াবহ অথচ আশ্বাসবাহী, ভয়ঙ্কর অথচ সুন্দর, লেলিহান জিহ্বাখানি অন্তর্হিত। দুই ঠোঁটের মধ্যবর্তী শূন্য জায়গাটা যেন সর্বনাশের ইঙ্গিত নিয়ে স্থির হয়ে আছে।

‘ঠাকুরমশাই, এ কী!’

‘এ কেমন করে হল?’

‘মা জানেন!’ এই একটি মাত্র কথাই পাওয়া গেল ঠাকুরমশাইয়ের মুখ থেকে।

কিন্তু কখন হল?

কখন হল?

তা, সেটার একটা উত্তর আছে। ধ্যানে বসে হঠাৎ মন্ত্র ভুলে গেলেন ঠাকুরমশাই, সর্বাঙ্গ কাঁটা দিয়ে উঠল, দিশেহারা হয়ে উঠলেন তিনি, চোখ খুলে তাকালেন। সঙ্গে সঙ্গে—

তারপর কতদিন যেন অঙ্গহীন প্রতিমা অপূজিতা হয়ে পড়ে রইলেন, মন্দিরের আশেপাশে জঙ্গল বাড়তে লাগল, আর সেই অশুচি ছেলেটা বাড়তে লাগল এ—বাড়ি ও—বাড়ির দাক্ষিণ্যের খুদমুঠো খেয়ে। তারপর আবার সহসা একদিন দেবীর কপাল ফিরল, কপাল ফিরল কিশোর বালক অভিলাষ পাঠকের। গ্রামের জমিদার স্বপ্নাদেশ পেলেন, মৃত্তিকায় গড়া দেবীর সোনার জিভ গড়িয়ে দিতে, এবং সেই অশুচি ছেলেটাকেই অভিষেক করে পুরোহিত পদে বসাতে।

পূর্ব সেবাইত ঠাকুরমশাই তো তদবধি ঘরছাড়া হয়ে তীর্থে তীর্থে ঘুরছেন।

স্বপ্নাদেশের উপর কথা নেই, তার উপর আবার জমিদারের স্বপ্ন। তদবধি দেবীর সোনার জিভ, আর ওই পাঠক—বংশই সেবাইত। ঠাকুরমশাইয়ের ছোট মেয়েটার সঙ্গে মালাবদল ঘটিয়ে প্রাচীনে এবং নবীনে মিতালীর বন্ধন পাকা করে দিলেন জমিদারমশাই তীর্থ থেকে সেবাইতকে ফিরিয়ে এনে।

এই কিংবদন্তী।

পরবর্তী যুগের অবিশ্বাসীরা অবশ্য দেবীর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে মন্তব্য করে, ‘সব সেই বুড়ো বামনার কারসাজি! ছেলেটার ওপর মায়া পড়ে গিয়েছিল, জামাই করবার বাসনা জেগেছিল, তাই দেবীর জিভটি খসিয়ে নিয়ে—’

বিশ্বাসীরা বলে, ‘তাই কখনো সম্ভব? এতবড় ভয়ঙ্কর পাতক /করে পার পাবে? সঙ্গে সঙ্গে নিজের ভিজ খসে পড়বে না তার? মা কি সোজা মা?’

মা যে সোনা নয়, তা বেকায়দায় পড়লে সবাই স্বীকার করে। অতএব বেশি কথার চাষ হয় না। বলতে গিয়েও থেমে যায় লোকে। বরং বাইরের যাত্রী এলে মায়ের মাহাত্ম্য বোঝাতে ওই কিংবদন্তীটাই সাড়ম্বরে আর সালঙ্কারে শোনায়। সেটাই নিরাপদ, কে জানে বাবা ‘মা’—টি কখন কি অনিষ্ট ঘটিয়ে বসেন!

তবে যে যাই বলুক, কোন পক্ষের প্রতিবাদই জাগ্রতাদেবীর সোনার জিভ নড়ে না। কোথাকার যেন পাঠক—বংশকে এই বীরপুরের ভৈরবীকালীর সেবাইতরূপে প্রতিষ্ঠিত করতে মা একবারই সেই জিভ নেড়েছিলেন। মাটির জিভখানা নড়ার ফলে ভেঙেই পড়েছিল। বোধকরি নিজের ওপরও তেমন আস্থা ছিল না মা—র, ভেবেছিলেন অভিলাষ পাঠক নামক সেই বালকটাকে বাঁচানো আমার কড়ে আঙুলের কর্ম নয়, বড় একটা কিছু দাম দিতে হবে।

আর সেই কথাটা? যেটার কথাও কেউ কেউ তোলে। এত লোক থাকতে মা কালী জমিদারবাবুকেই বা স্বপ্ন দিতে গেলেন কেন? যে ব্যক্তি নাকি সেবাইত ঠাকুরের ‘এক গেলাসের ইয়ার’!

বাঃ, ওটা আবার একটা প্রশ্ন নাকি? স্বপ্ন দিলেন কি পূজুরীর বন্ধু বলে? তা নয়। স্বপ্ন দিলেন জমিদার বলেই। বিগ্রহ আর কুগ্রহ দুইয়েরই ভরসা ধনপতিদের ওপর। বিগ্রহও ওদের ওপর ভর করেন, কুগ্রহও ওদের ওপর ভর করেন, এতো জানা কথা।

যাক, কিংবদন্তী মুখে মুখে প্রচারিত হতে হতে অনেক পল্লবিত হয়, অতএব ওর সব কথা বিশ্বাস না করলেও এটা বিশ্বাস না করে উপায় নেই, কোথাকার সেই পাঠক—বংশই এতাবৎকালে দেবীপ্রদত্ত অধিকারে এখানে সম্মান আর সম্পত্তি ভোগদখল করে আসছে।

হালদারদের মেয়ে স্বর্ণর প্রাণেশ্বর সর্বেশ্বর সেই বংশেরই বংশধর, সেই কুলেরই কুলমণি। ভৈরবীকালীর দীনতম দাবিদার ওই হালদাররা। কোন পূর্বপুরুষের পুণ্যে বছরের মধ্যে একদিন মাত্র মা—র মন্দিরের উপসত্ব ভোগ করে হালদার—বংশ। ভাদ্র সংক্রান্তির উপসত্ব। নোটো হালদার সেদিন কোমরে গামছা বেঁধে আর খেঁটে মোটা একটা লাল টকটকে ছালতির ধুতি পরে, মন্দিরের দরজা পাহারা দেয়। নোটোর ডাক—হাঁকে বোধকরি ভৈরবীকালীরও হার্ট প্যালপিটেশন হয়।

কিন্তু উপায় কি নোটোর? কড়া পাহারা না দিলে? ওই মহাপুণ্য দিনের ভোগরাগ থেকেই তা নোটোর সংবৎসরের ভাত—কাপড়। ভাদ্র সংক্রান্তিটা যে মায়ের একটা বিশেষ পরবের দিন!

স্বর্ণ সেই নোটো হালদারের মেয়ে। তিন বছর বয়েস থেকে বাবার সঙ্গে মন্দিরে আসে, পাওনা—গণ্ডা আদায় মানেটা, কি, তা বুঝে ফেলতে।

সর্বেশ্বর ছোট থেকে মন্দিরে আসত বাপের সঙ্গে। বাপ শিবেশ্বর পাঠক বলত, ‘চল, এখন থেকেই তিথি নক্ষত্র নিরীক্ষণ করে দেখবি চল! দেখতে দেখতেই শিখে নিবি।’

সর্বেশ্বরের মা চন্দ্রাননী মুখঝামটা দিত, ‘ওরে আমার ছেলের সোহাগ! বলি এখন থেকে পূজোর রীতি—নীতি শিখে ওর হবেটা কি শুনি? কোমরে এখনো কাপড়খানা রাখতে শেখেনি ছেলে!’

‘শেখেনি, শিখবে।’ শিবেশ্বর পেশীবহুল মুখটা বাঁকিয়ে বলত, ‘আজন্ম একটা মানুষই ভুগবে না কি? রোগ হলে পর্যন্ত নিস্তার নেই আমার। ছোঁড়াটার গলায় সুতোটা তুলে দেওয়া পর্যন্ত আছি ধৈর্য্য ধরে। তারপর দিনে—অদিনে ওকেই করতে হবে।’

চন্দ্রাননী রেগে উঠে বলত, ‘তার মানে তুমি তখন সাপের পাঁচ পা দেখবে, রাজা কেষ্টচন্দর হবে, মায়ের পূজোর দায়টা ছেলের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে দিনরাত্তির সেই চুলোয় গিয়ে পড়ে থাকবে।’

বলা বাহুল্য প্রায়শঃই এরপর লেগে যেত ধুন্ধুমার। ‘চুলো’র উল্লেখটা যে বড় মর্মান্তিক উল্লেখ। মা—বাপের এই দাম্পত্য—লীলার দর্শক সর্বেশ্বর ছেলেবেলায় ভয় পেত, একবার মাকে এবং একবার বাবাকে থামাবার চেষ্টা করত, কিন্তু বড় হয়ে অন্য চাল ধরল। যেই দেখল বাড়িতে কাক—চিল উড়ছে, সেই এক ফাঁকে হাওয়া। সহজে আর বাড়ির ত্রিসীমানায় নয়। জানে, ভাত খাবার সময় এলেই মা ঠিক নিজের গরজে পাড়া তছনছ করে খুঁজে বার করবে তাকে।

এই সময় গিয়ে জুটত হালদার বাড়ি। স্বর্ণর মা—ও প্রশ্রয় দিত ছেলেটাকে, কারণ দস্যি মেয়েটার খেলার সঙ্গী বলতে বাড়িতে কেউ নেই, মাকে জ্বালিয়ে—পুড়িয়ে খায়, কাজ করতে দেয় না, সঙ্গী একটা জুটলে থাকে ভাল। অতএব সর্বেশ্বর এলেই সাগ্রহে বলে, ‘আয় বাবা, বোস বাবা। আগানে—বাগানে যেও না মানিক, বসে বসে খেলা কর।’

তা’ বসে বসে খেলাতেও দস্যি স্বর্ণ অরাজী নয়। রান্না—বান্না ঘর সংসার সাজানো খেলাটাও তার বিশেষ প্রিয়। মুদির দোকান সাজানো খেলাটাও চলে। অতএব কখনো স্বর্ণর গিন্নীপনার নীচে তাঁবেদার কর্তার ভূমিকা নিতে হয় সর্বেশ্বরকে, আবার কখনো ওজন দাঁড়ি হাতে দোকানদার সেজে ক্রেতাকে তোয়াজ করতে হয়। হ্যাঁ, কালটা সেকাল, বিক্রোতাই ক্রেতাকে তোয়াজ করছে দেখতে অভ্যস্ত ছিল তারা।

স্বর্ণর মাকে খুব ভাল লাগত সর্বেশ্বরের, বেশ কেমন লক্ষ্মীঠাকুরের মতন শান্ত নরম, তার মা—র মত রণচণ্ডী নয়।

বিশেষণটা অতিশয়োক্তি নয়, ভাত খাবার সময় ছেলেকে যখন খুঁজতে বেরতো চন্দ্রাননী, তখন নামের মাহাত্ম্য সম্পূর্ণ বিসর্জন দিয়ে রূদ্রাণী—রূপেই আবির্ভূত হত হালদারদের বাড়ি এবং ছেলের নড়াটা ধরে টানতে টানতে নিয়ে যেতে যেতে স্বর্ণর মাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলত, ‘লক্ষ্মীছাড়া ছেলের রাতদিন মেয়েমানুষের সঙ্গে মেয়েলী খেলা! হবে একটা মেনিমুখো! সমবইসী খেলুড়িদের সঙ্গে খেলা নেই, চব্বিশঘণ্টা একটা পুঁটকে মেয়ের সঙ্গে রান্নাবাড়ি খেলছে।’

সর্বেশ্বর অবশ্য সতেজে সে কথার প্রতিবাদ করত। বলত, ‘আমি কি রান্না করি? আমি তো হাটে যাই, গরু চরাই, খড় কাটি—’

চন্দ্রাননী আরও ছিটফিটিয়ে ওঠে ছেলের সেই প্রতিবাদে। ছেলের চুলের ঝুঁটিটা নেড়ে দিয়ে অথবা গালে একটা ঠোনা মেরে ঝঙ্কার দিয়ে বলে, ‘তাই করবি লক্ষ্মীছাড়া বামুনের ঘরের বাছুর, গরুই চরাবি, খড়ই কাটবি—’

পরদিন আবার এ বাড়িতে উদয় হলে, হয়তো স্বর্ণর মা সভয়ে বলত, ‘আবার তুমি স্বর্ণর সঙ্গে খেলতে এসেছ মানিক? মা রাগ করবে—’

সর্বেশ্বর প্রবল অগ্রাহ্যে সে সাবধানবাণী উড়িয়ে দিয়ে বলত, ‘করুকগে। মা তো সবতাতেই রাগ করে। অন্য ছেলেদের সঙ্গে খেলতে যাব না হাতী করব! হেরো, পটলা, বংশী মারে না বুঝি? আর হেরোর মা, বংশীর মা, পটলার মা, নাড়ু দেয়? ক্ষীরতক্তি দেয়?’

বলা বাহুল্য, তখন স্বর্ণর চাইতে স্বর্ণর মায়ের বদান্যতার আকর্ষণটাই বেশী ছিল সর্বেশ্বরের কাছে। ক্রমশঃ পালাবদল হল।

একটু বড় হতেই ঘরে বসে খেলার চাইতে বাগান—আগানটাকেই প্রাধান্য দিতে শুরু করল ওরা। এবং স্বর্ণই তাতে অগ্রণী। সর্বেশ্বর যদি বলত এই উঠোনেই খেলি না রে ‘কুমীর কুমীর’ কি ‘বাঘ শেয়াল’,স্বর্ণ ঝঙ্কার দিয়ে বলত, ‘পচা খেলা, ছাই কেলা, জন্মভোরই তো খেলছি ওই খেলা। বাগানে চল, বাগানে চল—’

স্বর্ণর জন্মভোরটা যদিও তখনো বছর সাতের বেশী নয়।

স্বর্ণর মা রণচণ্ডী হতে জানে না বটে, তবু রেগে বলত, ‘ গেছো মেয়ে! গেছো মেয়ে! ও বেটাছেলে, ও ঘরে বসে খেলতে চাইছে, উনি চললেন, গাছে উঠতে!’

স্বর্ণ বলত, ‘আহা রে, ভালমানুষ নাড়ুগোপাল, খেল তবে তুই বাড়ির উঠোনে, ওই খোকাটার সঙ্গে খেল, আমি চললাম।’

খোকা স্বর্ণর পরবর্তী। তারও পরে আছে একটা মেয়ে।

নোটো হালদারের বুড়ো বয়সের অবদান এসব। দু—দু—বার অকালে বৌ মরে যাওয়ার পর নোটোর এটি তৃতীয় পক্ষ। কিন্তু নোটোর দাপটে তৃতীয় পক্ষ একেবারে কেঁচো। স্বর্ণ পিতৃসদৃশ প্রবলা, তাই স্বর্ণকেও এঁটে উঠতে পারে না স্বর্ণর মা।

আর নোটোর এই বড় মেয়েটির প্রতি অগাধ প্রশ্রয়। স্বর্ণর জন্মকাল থেকেই না কি নোটোর আয়—উন্নতি বেশী। মা বকলেই অতএব স্বর্ণ বাবা বাড়ি ফিরলেই লাগিয়ে দেওয়া রূপ মহৎ উপায়টি অবলম্বন করে। আর নোটো রান্নাঘরের দরজায় এসে ডাক ছাড়ে, ‘আবার ওকে মুখ করেছ তুমি? আবার? নিষেধ করিনি তোমায়?’ স্বর উত্তরোত্তর চড়ে।

স্বর্ণ তখন দয়ার গলায় বলে, ‘থাক বাবা, আর বেশী বোকো না, গরীবের মেয়ে, মা নেই বাপ নেই, জন্মদুঃখী!’

স্বর্ণর মা তখন ভেউ ভেউ করে কাঁদে।

সর্বেশ্বর কখনো কখনো দুঃখিত চিত্তে বলে, ‘মা—র নামে লাগিয়ে দিস কেন নোটোকাকার কাছে? ছিঃ!’

স্বর্ণ বলে, ‘আহারে! ভারী দয়ালু এলেন! বলে না দিলে মা আমাকে খেলতে যেতে দেবে? ঠিক বলবে ঘরে বসে কাজ শেখ। পরের ঘরে যেতে হবে।’

সেটা অবশ্য সর্বেশ্বরের মনঃপুত নয়। অতএব তারা কেটে পড়ে, এবং বনে—বাদাড়ে ঘুরে বেড়ায়।

কিন্তু সেই অনাবিল সুখ ক’টা দিনের জন্যই বা পেয়েছে ওরা? স্বর্ণ আট বছরের কোঠা ছাড়াতে ছাড়াতেই পাড়ায় নিন্দের ‘টী টী’ পড়ে গেল। স্বর্ণর মা প্রতিবেশিনী মহিলাদের গঞ্জনা খেয়ে চোখের জলে বুক ভাসিয়ে স্বামীর দরবারে নালিশ করে মেয়েকে শাসিত করে ফেলল, ওদিকে শিবেশ্বর পাঠক ছেলের মাথায় খড়মের খুরো ঠুকে মাথাটায় গোটা কতক আলু গজিয়ে দিয়ে টোলে ভর্তি করে দিয়ে এল।

শিবেশ্বর পাঠকের মাসশ্বশুর হরিনাথ তর্করত্ন তখন ভাগ্যান্বেষণে বহরমপুর থেকে এই বীরপুরে এসে পড়ে একটি টোল খুলেছেন।

হরিনাথ তর্করত্ন বারো বছরের নাতিকে ব্রহ্মচর্য ও চরিত্ররক্ষা সম্পর্কে শিক্ষা দিতে দিতে পাকে—প্রকারে বুঝিয়ে দিতে থাকলেন বয়স্থা কুমারীর সঙ্গে একত্রে বিচরণ কত গর্হিত ও অশাস্ত্রীয়, আর শিবেশ্বর পাঠক ছেলেকে ‘দ্বিজত্বে’ উন্নীত করে ফেলার সুযোগে ভৈরবীকালীর একবেলার পূজোর ভার ছেলের উপর প্রায় পুরোপুরিই চাপিয়ে দিয়ে ‘চুলোয়’ বাসের মাত্রাটা বাড়িয়ে ফেলতে থাকলেন। চন্দ্রাননীর গলাবাজি কোন কাজে লাগছে এমন দেখা গেল না।

পুজোয় সর্বেশ্বরের বেজার নেই।

বরং সন্ধ্যা না হতেই সে দেবী—দর্শনে তৎপর হয়ে ওঠে।

হ্যাঁ, সন্ধ্যাপুজোটাই ছেলের উপর ঠেকিয়েছে শিবেশ্বর। কারণ, সন্ধ্যাপুজোটা সংক্ষিপ্ত। এ সময় বাইরের যাত্রী আসে না, মানসিক পড়ে না, অনুযোগ হয় না, লোক—সমাগমও সকালের তুলনায় অনেক কম। শুধু আরতি আর ভোগ উৎসর্গ।

ভোগটাও সংক্ষিপ্ত। ঘনদুধ কলা আর নারকেল—কোরা।

নারকেল—কোরাটি চাই—ই ঠাকুরের, এই বিধি। আইন—মাফিক প্রথায় এ—সব গোছগাছ পূজারীরই করে নেবার কথা, কিন্তু গোলগাল একটা নারকেলকে গুঁড়োয় পরিণত করে ফেলা সর্বেশ্বরের কর্ম নয়, ওটা তাই চন্দ্রাননীই করে দিয়ে পাথরবাটিতে ভরে কলাপাতা চাপা দিয়ে ছেলের হাতে দিয়ে দিচ্ছিল, কিন্তু বিধির নির্বন্ধে চন্দ্রাননী একবার বাপের বাড়াবাড়ি অসুখ শুনে বেলডাঙা চলে গেল ক’দিনের জন্যে। বলে গেল ‘হালদার খুড়িকে বলিস নারকেলটা কুরে দুধটা জ্বাল দিয়ে দেবে।’

হালদার বাড়িটা মন্দিরের আরো নিকটবর্তী, কাজেই অসুবিধে নেই কিছু। অসুবিধে ছিল না, সুবিধে ঘটল বিস্তর।

সর্বেশ্বর নারকেল কুরতে জানে না শুনে ন’ বছরের স্বর্ণ হেসে কুটি কুটি হল, এবং সদর্পে বলল, ‘ওটা গিয়ে আমিই কুরে দিয়ে আসব। যা দেখছি পিদ্দিমের সলতে পাকাতেও পারবে কি না সর্ব—দা সন্দ! ধুনো দিয়ে, পিদ্দিম সাজিয়ে, দুধটা আওটে, নারকেল কুরে দিয়ে আসব আমি এক দণ্ডে।’ সেই দণ্ডকালের সুবিধেটা কৌশলে আদায় করে নিল স্বর্ণ নিরীহ মা—টার কাছ থেকে। দেবী ভৈরবীর পাদপীঠে কোনরকম অশাস্ত্রীয় ঘটনা ঘটা সম্ভব, স্বর্ণর মা—র ধারণা নেই। সে শুধু মেয়েকে বলে দিল, ‘সর্ব—দা সর্ব—দা করে হি হি করবি না, বুঝলি? ঘাড় হেঁট করে আপন মনে কাজটুকু সেরে চলে আসবি। বড় হয়েছ, এখন পরপুরুষের দিকে চোখ তুলে তাকানো নিন্দের!’ স্বর্ণ অম্লানবদনে বলে, ‘তাকাতে আবার যাচ্ছে কে? মন্দিরে কুড়িটা—পঞ্চাশটা লোক বসে নেই। বলি মায়ের থানে যাব, আরুতিটা দেখব না? এমন মহাপাতুকী হতে বল হব।’

মা ভয়ে ভয়ে বলে, ‘আরুতি দেখতে তোকে দিব্যি দিইনি আমি। সোমত্ত মেয়ে পাঁচজনে পাঁচ কথা বলে, তাই সাবধান করা।’

স্বর্ণ গম্ভীরভাবে বলে, ‘পাঁচজনের পাঁচটা মুখ, পাঁচ কথা বলবে এ আর আশ্চর্যি কি? অত কানে নিলে চলে না।’

স্বর্ণর মা বলে, ‘বেথা হয়ে গেলে কানে নিতাম না। আইবুড়ো মেয়ে তাই ভয়। কোন কথা থেকে কোন কথা রটবে, বে দিতে বিপদ হবে এই ভয়।’

‘বিপদ হয়, মা ভৈরবীকালীর থানে নিয়ে বলি দিয়ে দিও, চুকে যাবে ল্যাঠা।’ বলে সুতির শাড়িখানা ছেড়ে মায়ের বিয়ের চেলিখানা গুছিয়ে গুছিয়ে পরে নিতে থাকে স্বর্ণ।

মা বলে, ‘ষাট ষাট, কি যে অকথা—কুকথা বলিস।’

‘বলাচ্ছ তাই বলতে হচ্ছে’। বলে হনহনিয়ে বাড়ির চৌকাঠ পার হয়ে যায় স্বর্ণ।

স্বর্ণর মা কোলের মেয়েটাকে তোষামোদ করে, ‘দিদির সঙ্গে যা না, আরুতি দেখগে।’ কিন্তু বছর চারেকের সেই মেয়েটা আরো অবাধ্য, মায়ের অনুরোধ কদাচ রাখে।

স্বর্ণকে পাহারা দেওয়া অতএব হয় না। কিন্তু ন’ বছরটাও যে নেহাত নিশ্চিন্তের বয়েস নয় সেটা স্বর্ণই প্রমাণ করে ছাড়ে। স্বর্ণ যেন দিব্যি গিন্নীদের মতন ভোগের ঘরের উনুনে কাঠ—কুটো জ্বেলে বড় পেতলের সরায় একসরা দুধ জাল দিয়ে ঘন করে, মুখে আঁচল জড়িয়ে নারকেলটি কুরে এগিয়ে দেয়, ধুনুচিতে আগুন ধরিয়ে মন্দিরে ধুম্রলোকের সৃষ্টি করে, তেমনিই আবার গিন্নীদের মত মুচকি হেসে বলে, ‘তোমার দিকে চাইতে মানা, বুঝলে সর্ব—দা?’

সর্বেশ্বর ভয়ে ভয়ে এদিক—ওদিক তাকিয়ে বলে, ‘কে মানা করল?’

‘মা।’

‘মা? তবু রক্ষে!’ হালদারকাকীকে তত ভয় নেই সর্বেশ্বরের। তাই সে—ও একটু হেসে বলে, ‘কি বলে মানা করল?’

‘বলল, পরপুরুষের দিকে চাইতে নেই।’

‘ওঃ!’ সর্বেশ্বর দেবীর চরণ থেকে বাসি ফুল—পাতা সরাতে সরাতে বলে, ‘বললি না কেন. পরপুরুষের দিকে চাইতে মানা, সে কথা মানব। সর্বেশ্বর পাঠকের দিকে ছাড়া আর কারুর দিকে তাকাব না।’

‘ইললি! মাকে ওই কথা বলি আমি।’

‘বললেই ভাল হয়।’ সর্বেশ্বর মনক্ষুণ্ণভাবে বলে, ‘মা ভৈরবী কালীকে নিত্য জানাচ্ছি, মা তো ওদের মনে সুবুদ্ধির উদয় দিচ্ছে না, কে তবে বলবে?’

‘চমৎকার! আমিই তবে বলিগে।’

‘আর না—বলাও তো বিপদ, চারিদিক থেকে সম্বন্ধ আসছে—’

‘একা তোমারই আসছে না, আমারও আসছে।’

‘তবে?’ সর্বেশ্বর বিবর্ণ মুখে বলে, ‘ তোরই বুদ্ধি বেশি স্বর্ণ, তুই একটা বুদ্ধি বার কর।’

স্বর্ণ বিরক্ত ভাবে বলে, ‘আমার ওপর ভরসা। তুমি না বেটাছেলে?’

‘এক্ষেত্রে বেটা ছেলে মেয়েছেলে দুই—ই সমান নিরুপায়। বাপ—মা ধরে বিয়ে দিলে করবটা কি?’

‘পালাতে পার।’ স্বর্ণ জ্বলন্ত স্বরে বলে, ‘রাতারাতি চম্পট দিতে পার।’

‘আমি নয় পালালাম, বলি তুই? তুই কি করবি? ফিরে এসে দেখব তোকে চিলে ছোঁ মেরে নিয়ে গেছে?’

‘ইস! নিয়ে গেলেই হল? বড় পুকুরের জল শুকিয়ে গেছে?’

‘তবে তো বড্ড বুদ্ধির কথাই হল’, সর্বেশ্বর বিরক্ত গলায় বলে, ‘আমি সন্নিসি হয়ে গেলাম, তুই ডুবে মরলি, ব্যস, হয়ে গেল পরম সুখ!’

বাইরে লোক চঞ্চল হয়ে ওঠে আরতির দেরি দেখে, ক্ষণে ক্ষণে উঁকি মারে, স্বর্ণ তখন গলা তুলে বলে, ‘হাত—পা যে তোমার চলছে না সর্ব—দা! একটু তড়ি—ঘড়ি কর। জ্যেঠামশাই কী সোন্দর একদণ্ডে আরুতি সারেন, তুমি তাঁর ছেলে হয়ে কী গো! আর বসে থাকতে পারব না, আমি তোমার ধুনোয় বাতাস দিতে। দেরি হলে মা মুখ করে।’

বাইরের লোকেরা বলে, ‘নোটো হালদারের মেয়েটা হচ্ছে বটে একখানা! বসানো বাপ! গলা কী! মেজাজ কী! যাদের ঘরে যাবে তাদের বুঝিয়ে দেবে ঠ্যালা।’

তবু ঠিক এই মুহূর্তে কেউ সন্দেহ করতে পারে না মায়ের ওই গর্ভমন্দিরের মধ্যে বসে ওরা এতক্ষণ প্রেমালাপ করছিল।

তা, প্রেমালাপ ছাড়া আর কি?

দুজনে একসঙ্গে মায়ের কাছে প্রার্থনা জানায়, ‘মাগো, দুজনের মা—বাপের কাছেই স্বপ্ন দাও—’স্বর্ণর সঙ্গে সর্বর বিয়ে দে! নচেৎ তোদের ভাল হবে না।’

আবার একসঙ্গে ফুল হাতে করে সংকল্প করে, ‘মা, বিয়ের পর জোড়ে এসে তোমায় একশো আট রক্তজবা দিয়ে পুজো করে যাব।’

বয়সের পক্ষে যথেষ্ট পাকামী বৈকি!

এ যুগের কাছে অবিশ্বাস্য রকমের পাকামী। কিন্তু পাঁচ বছর বয়েস থেকে যাকে বিয়ে আর বরের স্বপ্ন দেখানো হয়, আর পরের ঘরে যাবার তালিম দেওয়া হয়, তার পক্ষে এ পাকামী অপ্রত্যাশিত নয়।

সেই পাকামী বাড়াবার সুযোগটি দিয়ে গেছে চন্দ্রাননী।

বাড়তেই থাকে অতএব।

বাপের বাড়ি থেকে ফিরে এল চন্দ্রাননী। এসেই অবস্থাটা পর্য্যবেক্ষণ করল। বলা বাহুল্য বেশ প্রসন্ন হল না।

দুপুরবেলা হালদারবাড়ি গিয়ে স্বর্ণর মাকে বলল, ‘হ্যাঁরে নতুন বৌ, এ আবার কি বুদ্ধি তোর, মায়ের ঘরের যোগাড়ের ভার মেয়ের ওপর চাপিয়ে দিয়ে বসে আছিস! কাঁচা ছেলে, কী নাকি অপরাধ ঘটিয়ে বসে, তার ঠিক কি! হয়তো পা ঠেকে গেল, হয়তো চুল পড়ল। তোর ওপর ভার দিয়ে নিশ্চিন্দি হয়ে গেলাম আমি—’

স্বর্ণর মা পাঠকদিদির এই অমূলক আশঙ্কায় হেসে উঠে বলল, ‘ও দিদি, সে ভয় করো না। স্বন্ন আমার থেকে ঢের ওস্তাদ। ওর কাজকর্ম্ম দেখলে তাক লেগে যায়। কে বলবে একটা পাকা গিন্নীর কাজ নয়। ওতে তুমি নিশ্চিন্দি থেকো। বাপের ব্যামোয় খেটে খেটে হাড় কালি হয়ে এসেছ, দুদিন জিরেন খাও। মায়ের ঘরের যোগাড় স্বন্ন যেমন চালাচ্ছে চালাক।’

চন্দ্রাননী এই ন্যাকাচণ্ডীর কথায় জ্বলে না উঠে পারে না। ক্রুদ্ধ গলায় বলে, ‘চালাক বললেই তো আর চলতে দেব না আমি, আমার কাণ্ড—জ্ঞান আছে। বলি, ভোগের যোগাড়ের ছুতোয় তোমার ওই বয়েসওলা মেয়ে সন্ধ্যেভোর সর্বর কাছে ঘুর ঘুর করে, এটা দেশে ধর্মে ভাল? না নিশ্চিন্দির বস্তু?’

ইতিপূর্বেই যে মেয়েটাকে চন্দ্রাননী কাঁচা ছেলে বিশেষণে ভূষিত করেছে, সেটা আর খেয়াল থাকে না তার।

স্বর্ণর মা—র ঘাড়টা হেঁট হয়। বছর খানেক আগে থেকে সোমত্ত বয়েসের ছুতোয় সর্বর সঙ্গে খেলাধুলো করা বারণ হয়ে গেছে স্বর্ণর। সে তো স্বর্ণর মা—র অবিদিত নয়। পড়শীনীদের গঞ্জনায় নিজেই সে স্বামীর কাছে কেঁদে পড়ে মেয়ে শাসন করেছে।

কিন্তু এটা হল আলাদা কথা।

কাজটা মায়ের, আর জায়গাটা মহাপীঠস্থান, এখানে দুটো ছেলেমেয়ের একত্র উপস্থিতি যে দুষ্য হতে পারে, সেটা স্বর্ণর মা কনকের বুদ্ধির অগম্য।

যোগ—যাগের দিন, শনি—মঙ্গল, অমাবস্যা—সংক্রান্তির দিন যখন মায়ের মন্দির ভিড়ে ভেঙে পড়ে, চিঁড়ে—চ্যাপটা অবস্থা ঘটে মানুষের, তখন কি মেয়ে—পুরুষে বিভেদ থাকে? গায়ে গায়ে ঠেসাঠেসি। কই, তখন তো কেউ দৃশ্যকটুর কথা তোলে না? ধর্মস্থান পুণ্যস্থান, ও—কথা মনে আনাও তো পাপ।

সেই কথাই বলে কনক অস্ফুট গলায়, ‘মায়ের থান—’

‘থাম তুই নতুন বৌ! মায়ের থান বলে আগুন আগুনের কাজ করবে না?

হ্যাঁ, হতিস যদি আমাদের পালটি ঘর, এতে চোখবুজে থাকতাম। আর—’ বাকি কথা শেষ হবার আগেই সহসা বোকাসোকা কনক এক কাজ করে বসে। আচমকা চন্দ্রাননীর দুটো পা জড়িয়ে ধরে বলে ওঠে, ‘নাই বা হল পালটি ঘর, ভেন্নজাত তো নয়! ভাসুরঠাকুর ইচ্ছে করলে সবই হতে পারে দিদি! তুমি আমার স্বন্নকে পায়ে ঠাঁই দাও।’ কনক বোকা। চন্দ্রাননী বোকা নয়।

চন্দ্রাননী পা—টা ছাড়িয়ে নিয়ে কৃপাহাস্যে বলে, ‘এই এক বদ্ধ পাগল! একজাত হলেই হল? অসম্ভব কখনো সম্ভব করা যায়? এদের এই পাঠক বংশ হল জাত গোখরোর বংশ। আর হালদার হল হেলে—ঢোঁড়ার জাত।’

স্বয়ং নোটো হালদার যদি এখানে উপস্থিত থাকত, সন্দেহ নেই, বংশসর্পের এই শ্রেণী—বিভাগে ফাটাফাটি কাণ্ড করে ছাড়ত। ঈশ্বর কৃপায় নেই।

কনক নোটোর অনুপযুক্ত সহধর্মিণী, তাই সে ভয়ে কাঁটা হয়ে বলে, ‘রাগ করো না দিদি! উঁচু—নীচুর ভেদাভেদ সবই জানি, তবে শুনেছি নাকি শাস্তরে আছে ‘দুষ্কুলাদপি স্ত্রীরত্নং’, সেই ভরসায় বলছি ভাসুরঠাকুর যদি—’

চন্দ্রাননীর মুখে একটু দার্শনিক হাসি ফুটে ওঠে। চন্দ্রাননী আপসোসের মনটাকে কঠিন ভূমিতে স্থাপন করে বলে, ‘শাস্তরের কথা শাস্তরে আছে, মানুষের কথা মানুষে। এ—কথা তোর ভাসুরের কানে তুললে আমায় পাঁশপেড়ে কাটবে। নইলে তোর মেয়ে তো সোন্দর! বৌ করার অযুগ্যি নয়। সত্যি বলতে—’

শুধু সোন্দর বলে থেমে গেল চন্দ্রাননী, সে নিতান্তই পড়শীর মেয়ে বলে। নিজের মাসি—পিসির ঘরের মেয়ে হলে বলত ‘অতুল্য সুন্দরী, আর্মানীবিবির মতন ছাঁদ। হলে বৌয়ের মতন বৌ হবে।’

কিন্তু ওইটুকুই কি কম? যেটুকু বলে ফেলেছে চন্দ্রাননী? একটা অবোধ বালিকা—মনের কাছে ওইটুকুই পরম আশ্বাসবাহী।

স্বর্ণ ছাদে উঠেছিল শুকনো কাপড় তুলে আনতে, সিঁড়িতে নামতে নামতে শুনতে পেল ‘তোর মেয়ে তো সোন্দর, বৌ করার অযুগ্যি নয়।’

স্বর্ণর মনের সামনে হঠাৎ এক স্বর্গপুরীর বন্ধ দরজা খুলে গেল। মা ভৈরবীকালী তাহলে প্রার্থনা শুনেছেন। পাঠক—জ্যেঠিমা নিজে এসেছেন সম্বন্ধ নিয়ে। মা, মাগো, কালই তোমার পায়ে একশো আট জবা দেব মা!

স্বর্ণ আর নীচে নামতে পারল না। সেই কাচা কাপড়ের ডাঁই নিয়ে আবার পা টিপে টিপে উপরে উঠে গেল। নামলে হয়তো ভালই হত, পরবর্তী কথাগুলো শুনতে পেত, আকাশ—কুসুমের সুরভিত শ্বাসে স্পন্দিত হত না। কারণ চন্দ্রাননীর কথায় কনক আর একবার তার পা চেপে ধরে আকুল গলায় বলে বসে, ‘এটি তোমায় ঘটাতেই হবে দিদি, ছোটকাল থেকে দুটোতে বড় ভাব। যেন নাটক—নভেলের মতন ভালবাসা। চোখে চোখে চায় যেন শুভদৃষ্টি—’

বলা বাহুল্য, কথা সে শেষ করতে পায় না। চন্দ্রানীর মুহূর্তপূর্বের ঈষৎ দুর্বলতাটুকু মুহূর্তেই তিরোহিত হয়। চন্দ্রাননী যেন আগুনের দাহে ছিটফিটিয়ে ওঠে। ‘দুগগা দুগগা, তুই যে আমায় তাজ্জব বানিয়ে দিলি নতুন বৌ! বলি, ঘরে বসে বসে এইসব কুচ্ছিৎ কথা শিখলি কোথায়? তোর ওই পাড়া—মজানি মেয়ের কাছে নাকি? ছি ছি! গোল্লায় যা নতুন—বৌ, গোল্লায় যা। ও মাগো, ঘেন্না আমি রাখব কোথায়! যাচ্ছি লক্ষ্মীছাড়া ছোঁড়ার কাছে, চ্যালাকাঠ পিটিয়ে তার নাটক—নভেল বার করছি। দেখতে ভিজে বেড়াল, ভেতরে ভেতরে পিপুল পেকেছে। চললাম আমি, আর এই বলে গেলাম—তোমার মেয়ে যেন আর মায়ের ভোগের যোগাড়ে না যায়। আজ থেকে আমিই করব।’

দুমদুমিয়ে চলে যায় চন্দ্রাননী।

ছাদ থেকে দেখতে পায় স্বর্ণ সেই যাওয়াটা। স্বপ্নেও বুঝতে পারে না শেষ কী মনোভাব নিয়ে গেলেন পাঠক—জ্যেঠিমা। অনেকক্ষণ পরে পা টিপে টিপে নামে। ভয়ে ভয়েই নামে, কে জানে মা বকে উঠবে কিনা। বলবে কি ছাদে কি তুই ঘুমিয়ে পড়েছিলি স্বর্ণ?

কিন্তু মা কালীর দয়া, মা সে—সব কিছু বলল না। মা শুধু ঘর থেকে বলল, ‘তোকে মন্দিরে যেতে হবে না, ও বাড়ির জ্যেঠি এসে গেছেন। তোকে যেতে মানা করে গেছেন।’

স্বর্ণর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। স্বর্ণর বুকের ভিতরটা খালি হয়ে গেল। তবু স্বর্ণর চোখটা আহ্লাদেই উপচে উঠল।

জ্যেঠিমা বারণ করে গেছেন। তার মানে সম্বন্ধটা পাকা করে ফেলবার আগে ওদের দেখা—সাক্ষাতে নিষেধ করেছেন। মা ভৈরবীকালী, সেই কোন কালে যেন সর্বদার কোন ঠাকুদ্দাকে তুমি নাকি বলি থেকে রক্ষে করেছিলে, আজ আমাকে তাই করলে। কে জানে বাবার কখন কি মর্জি হত, দিত কোথাকার কাদের কাছে বলি। তাছাড়া আর কি, বিয়ে হওয়া মানেই তো এককোপে সাবাড়।

জ্যেঠিমার পায়েই একশো আট ফুল দিয়ে পুজো করতে ইচ্ছে করছে স্বর্ণর। সত্যি, মানুষটা দেখতেই রণচণ্ডী, ভেতরটা ভাল, মায়া—মমতা আছে। পূজুরী জ্যাঠা ওনার কথা ঠিক শুনবেন। দেখি তো জোড়হস্ত!

দশে এখনো পা দেয়নি স্বর্ণ, তবু দাম্পত্য—লীলার এসব লীলা সে বোঝে। দেখে দেখে আর শুনে শুনে সে হাড়হদ্দ।

তা, স্বর্ণর আপাতদর্শনটা ভুলও নয়।

শিবেশ্বর পাঠক চুলো নামক জায়গাটার নেশায় যতই আকৃষ্ট থাক, বাড়িতে গৃহিণীকে যমের তুল্য দেখে। সংসারে চন্দ্রাননীর গলাবাজির কাছে অহরহই তার নতি—স্বীকার। চেঁচামেচি করে চন্দ্রাননী পাছে শিবেশ্বরের চুলোর ঠিকানাটা পাড়া জানায়, তাই শিবেশ্বর আরো জোড়হস্ত।

কিন্তু চুলোটা?

সেটা পালিয়ে, লুকিয়ে। সন্ধ্যায় মায়ের ভোগারতির পালা চুকলেই কেটে পড়ত শিবেশ্বর, গভীর রাত্রের আগে আর বাড়ি ঢুকত না। কখনো কদাচ হয়তো একেবারে সকালেই। এখন ‘সন্ধ্যের’ সেই কর্তব্যের দায়টাও ঢুকেছে, কাজে কাজেই বিকেলবেলা থেকেই গা—ঢাকা। তারপর রাতদুপুরে বাড়ি ফিরে যথারীতি হাতে—পায়ে ধরা, নাক—কান মলা, মা কালীর দিব্যি গালা। এবং সেই পুরনো গল্পটাকে অন্য অন্য পোশাকে মঞ্চে আনা। এসব তো আছেই।

গল্পটা এই ধরণের—

মন্দিরের এলাকা থেকে বেরোবার সঙ্গে সঙ্গেই হঠাৎ কেমন দিকভুল হয়ে গেল, মনে হল কে যেন মন্তরপড়া দিয়ে কোথায় টেনে নিয়ে যাচ্ছে। পথ—ঘাট সব নতুন অচেনা, চলেছি তো চলেছি, তারপর এক মায়াবিনী পিশাচী খলখল করে হেসে উঠে বেঁধে নিয়ে কোথাকার এক বধ্যভূমিতে নিয়ে চলল। তখন কোনমতে সেই বাঁধন কেটে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটতে লাগলাম। কোনদিকে ছুটছি জানি না, কেন ছুটছি জানি না, শুধু জানি ছুটতে হবে। সেই ছুটতে ছুটতে হঠাৎ দেখি দরজা—সাজিয়ে—গুছিয়ে এই গল্পটাই চন্দ্রাননীর কাছে পেশ করতো শিবেশ্বর।

একটা অলৌকিক, একটা ডাইনির হাতছানি, একটা নিশিতে পাওয়া—পাওয়া ভাব থাকবেই।

প্রথম দু—একদিন ভয় পেয়েছিল চন্দ্রাননী, তারপরই থুড়তে শুরু করল বরকে। সেকালের সতীসাধ্বী পতিব্রতা বলে যে কিছু কসুর হল তা নয়। কিন্তু শিবেশ্বর তবু পালানোও ছাড়ে না, গল্প বলাও ছাড়ে না। ‘হ্যাঁ যাব, বেশ করব।’—এ কথা বলতে পারে না বলেই এত জ্বালা শিবেশ্বরের।

কিন্তু সংসার লীলার শিবেশ্বর বশংবদ।

চন্দ্রাননী তাই ঠিক করল ছোঁড়াটার বিয়ে দিয়ে তবে আর কাজ আমার। হালদারের মেয়ের সঙ্গে নভেল—নাটকের শুভদৃষ্টি ঘোচাচ্ছি বাছার। এখানে সে—ই কর্ত্রী, অতএব ঘটককে ডেকে পাঠানো তারই কাজ।

মেয়েটার রূপের জন্যে কদাচ কখনো মনে উদয় হয়েছে সত্যি, আহা, যদি আমাদের পালটি ঘর হত! কিন্তু বোকা কনক নিজের পায়ে নিজে কুড়ুল মেরেছে, নিজের মাথা নিজে খেয়েছে। সেই বেখাপ্পা কথাটা বলে বসেছে। চন্দ্রাননী অতএব ভাবতেই থাকে। ও মেয়ে ছোট থেকেই মোহিনী। ওকে সায়েস্তা করা আমার কর্ম নয়। তায় আবার এদেশেরই ঝিউড়ি মেয়ে! ছেলে তো আমার ওর সঙ্গে বে’ হলে ওই পাদপদ্যেই আত্মসমর্পণ করবেন।

তাছাড়া হবেই বা কি করে? বামন হলেই তো আর কুলিন হয় না? তা হলে তো ডানার গরবে আরশোলাও পাখী হত।

যদিও পাঠক—বংশকেও এই বীরপুরের কেউ খুব একটা উঁচু কুলিন ভাবে না। শুধু দেবী—মাহাত্ম্যে পাঠকদের সম্মান। তবু নিজেদেরকে ওরা খুবই উঁচু ভাবে। এবং দেশ—বিদেশ থেকে নিজেদের ‘মেল’ যোগাড় করে কাজ—কর্ম করে। কিন্তু তাতে তো কিছু এসে যায়নি। ইতিপূর্বে পাঠকদের কোন ছেলে—মেয়ে গ্রামের আর কোন ছেলে—মেয়ের দিকে শুভদৃষ্টির চোখে তাকিয়েছে এমন ইতিহাস জানা নেই বীরপুরে। অন্ততঃ এমন উদঘাটিত হয়নি সে ইতিহাস।

চন্দ্রাননী ঘটককে ডাকতে পাঠিয়ে মন্দিরে গেল।

এদিকে নিঃশঙ্ক হরিণী আনন্দে বিবশ হয়ে টুক করে একফাঁকে বাড়ি থেকে হাওয়া হয়ে যায় ‘মাকে’ কৃতজ্ঞতা জানাতে। আজ একাই, তারপর ওকে খবরটা জানিয়ে কোন এক ফাঁকে কাল যাবে জোড়ে।

কিন্তু আশ্চর্য ঘটনা, পথে বেরিয়েই দেখা।

স্বর্ণ এদিকে—ওদিক তাকিয়ে বলে, ‘মন্দিরে যাচ্ছ?’

‘না, এক্ষুনি কি? এখনো তো সূয্যিমামা রূপোরঙা। যাচ্ছি গদাইদের বাড়ি। তুই?’

স্বর্ণ একটু মুখ টিপে হেসে ভ্রূভঙ্গী করে বলে, ‘আমি যাচ্ছি ‘মায়ের’ কাছে।’

মায়ের কাছে যাবার নামে এই মুখটেপা হাসি ও ভ্রূভঙ্গিটা বেখাপ্পা। তা ছাড়া স্বর্ণর পরনে সেই লাল চেলিখানাও নেই, যে—খানায় স্বর্ণকে বিয়ের কনে ছাড়া আর কিছু মনে হয় না।

সর্বেশ্বর তাই বলে ওঠে, ‘এক্ষুনি মায়ের বাড়ি? আর এই বস্ত্ররে?’

স্বর্ণ আবার সেই যুবতী হাসিটুকু হেসে বলে, ‘মাকে পেন্নাম জানাতে যাব তার আবার বস্তরের বিচার। তবে দেখাই যখন হয়ে গেল, ভাবছি যুগলে পেন্নামটা আজই সেরে নেওয়া যেত। একেবারে সঙ্গে সঙ্গে!’

সর্বেশ্বরের গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। সর্বেশ্বরের চোখ ড্যাবা হয়ে ওঠে।

সর্বেশ্বর শিউরে বলে, ‘কি বললি?’

‘বলিনি কিছু’—স্বর্ণ টিপে টিপে ছাড়ে। ‘বলছি একটা সুখবর ছিল—’

সুখবর! সর্বেশ্বর নিজের বিশ্বাসে সুখবরটার মূর্তি কল্পনা করে।

নির্ঘাৎ মা—বাপের বাড়ি থেকে ফিরে স্বর্ণর ওই দেবী—সেবার কাজের সুখ্যাতি শুনে কাজটাতে ওকে বরাবরের জন্যেই বহাল রাখল।

অতএব নিত্যকার সেই দর্শন—সুখটা রইল।

সুখের দিন ফুরলো বলে—এই দুঃখেই তো মরছিল।

তাই সর্বেশ্বর আশান্বিত চিত্তে বলে, ‘সুখবর? মা বুঝি—’

‘হ্যাঁ, জ্যেঠাইমা গিয়েছিলেন আমাদের বাড়ি। মানে, মা ভৈরবীকালীর প্রেত্যক্ষ কৃপা। অথচ মাকে আমরা কালা বলে কত দুষেছি। সব বলছি, চল। অনেক কথা।’

স্বর্ণর ছোট বুকটা আহ্লাদে ওঠা—পড়া করতে থাকে, স্বর্ণর চোখ দুটো আবেশে প্রায় জল—ভরা হয়ে আসে।

সর্বেশ্বর অবাক হয়ে বলে, ‘যাব কোথায়?’

‘চল না তোর সেই বটঝুরি ঘরে। যেখানে লুকিয়ে বসে তামাক খেতে শিখেছিলি পাকামী করে।’

তা পাকামীই বটে। তবে সর্বেশ্বরের নয়, স্বর্ণরই।

সেই কতদিন যেন আগে ছেলেবেলায় স্বর্ণই একদিন জায়গাটা আবিষ্কার করে সর্বেশ্বরকে দেখিয়েছিল। বলেছিল, ‘তামাক খাবার এত বাসনা, খড়মপেটা খাবার ভয়ে তো পারিস না, চল তোকে একটা গুপ্ত কুঞ্জ চিনিয়ে দিই।’

স্বর্ণ তো চিরদিনই সর্বেশ্বরের সকল অকাজের গুরু। সকল অকাজের পরামর্শদাতা। তাই তামাক খাবার জায়গা খুঁজে দিয়েছিল।

তা ছাড়া মাঝে—সাঝে আচারটা আমসত্ত্বটা চুরি করে ওইখানে ডেকে নিয়ে যেত স্বর্ণ সর্বেশ্বরকে। ইদানীং বড় হয়ে পর্যন্ত কুঞ্জ পরিত্যক্ত ছিল। আজ গোপন সুখবরটা পরিবেশন করবার জন্যে মনে পড়ল স্বর্ণর।

আগের চেয়ে যেন আরো গভীর আর ঘন হয়ে গেছে ঝুরিগুলো। একটা ফাঁক দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়তেই যেন বাইরের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল ওরা। যেমন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় চিরকালের নরনারী একখানা বন্ধ—দরজা ঘরের আড়ালে ঢুকে গিয়ে।

কিন্তু ওরা কি সত্যিই নরনারী যে এই নিভৃতির সুযোগ নেবে? না, তা নিতে জানে না ওরা।

স্বর্ণ শুধু বলে, ‘দাঁড়িয়ে তোর সঙ্গে দুটো কথা বলব কি, পাপচক্ষু পৃথিবী হাঁ হাঁ করে মাকে দশকথা শোনাতে আসবে। যাক শুনলিতো ঘটনা? দেখলি মা ভৈরবীকালীর শক্তি! আমার মন নিচ্ছে নির্ঘাৎ জ্যেঠিমা বাপের বাড়িতে স্বপ্ন পেয়েছে।’

সর্বেশ্বর কিন্তু এতটা উৎসাহিত বোধ করে না। সর্বেশ্বর বিশ্বাস করে না। পাঠকে হালদারে যে কিছুতেই বন্ধন—সেতু রচনা করা যায় না, সে বোকা হলেও বোঝে, তাই অনেকবারের পর আরো একবার বলে, ‘আমার যেন কিছুতেই যেন প্রেত্যয় নিচ্ছে না। এও কি সম্ভব? এত সুমতি হবে মা—র? তুই কি শুনতে কি শুনেছিস।’

স্বর্ণ সতেজে বলে, ‘এতবার বললাম তবু সন্দ? কেন, মা ভৈরবীকালীর ওপর বিশ্বাস নেই? মা ইচ্ছা করলে হয়কে নয়, রাতকে দিন করতে পারেন না?’

‘তা পারেন বটে’, সর্বেশ্বর ভয়ে ভয়ে বলে, ‘কিন্তু মা কি সত্যিই সে ইচ্ছে করেছেন?’

‘বেশ করিসনি বিশ্বাস।’ বলে স্বর্ণ মুখ ফিরিয়ে দাঁড়ায়।

যদিও পড়ন্তবেলার ছায়ায় ওদের অবস্থান—স্থানটা এত বেশী অন্ধকার হয়ে গেছে যে ভাল করে দেখাই যাচ্ছে না, তবু বেচারী কিশোর সর্বেশ্বর এই পরিবেশের কোন সুযোগই নিতে পারে না, আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে থেকেই বলে, ‘বিশ্বাস করব না তা বলছি না, বলছি এত সুখ কি সইবে?’

‘সইবে না কেন?’ স্বর্ণ তীব্রস্বরে বলে, ‘কারুর সুখের ঘরে আগুন দিতে যাইনি আমরা যে সইবে না। এই বটবৃক্ষ সাক্ষী, আমরা—’

স্বর্ণ একটু ঢোঁক গেলে।

স্বর্ণ অতঃপর যথার্থই নাটক—নভেলের মত পাকা পাকা কথায় বলে, ‘আমরা ইহ—পরকালে পতি—পত্নী।’

স্বর্ণ নাটক—নভেল পড়েনি বলে স্বর্ণ এসব কথা শিখতে পারবে না তার কোন মানে নেই। স্বর্ণ কি গ্রামের যাত্রা—অপেরা দেখেনি? প্রেম প্রণয়, নাথ প্রাণেশ্বর, এসব শোনেনি? প্রণয়জনিত যন্ত্রণা, প্রণয়—প্রতিজ্ঞায় মৃত্যু—অনেক কিছুই স্বর্ণর জানা। তবে হ্যাঁ, স্বর্ণর বয়সের সব মেয়ের এত বোধশক্তি নেই। স্বর্ণর সেটা আছে। আর স্বর্ণর মুখস্থ করবার ক্ষমতাও আছে।

তাই স্বর্ণ অনায়াসে ইহ—পরকালের শপথবাক্যখানি উচ্চারণ করতে পারে।

কিন্তু সর্বেশ্বরের হয়ে যায়। সর্বেশ্বরের সর্বাঙ্গে কাঁটা দিয়ে উঠে।

সর্বেশ্বর এই অসমসাহসিকার একটা হাত ধরে ভ্যাবলাগলায় বলে ওঠে, ‘স্বর্ণ!’

পড়ন্তবেলা দ্রুত পড়তে থাকে, ভিতরটা আরো ঝাপসা হয়ে আসে, শুধু স্বর্ণর গলাটা ঝাপসা নয়। স্বর্ণ মাজা—ঘষা পরিষ্কার গলায় বলে, ‘মনে রাখিস, পাণিগ্রহণও হয়ে গেল।’

‘স্বর্ণ!’ সর্বেশ্বর আবেগের গলায় ডাকটা ডেকে ওঠে, কিন্তু কথা খুঁজে পায় না। তাই হঠাৎ বলে ওঠে, ‘স্বর্ণ, তাই যদি, তবে তুই এখনও আমায় ‘তুই’ ডাকছিস কেন?’

স্বর্ণ একটু চকিত হয়। স্বর্ণ অতঃপর অনুতাপের গলায় বলে, ‘তা বটে। আচ্ছা, আজ থেকে আর ‘তুই’ বলব না। এই পেন্নাম করে এতদিনের পাপের প্রাচিত্তিরটা করে নিই।’

বলে মুণ্ডু হেঁট করে সর্বেশ্বরের পায়ে একটা প্রণাম ঠুকে ফেলে স্বর্ণ।

ভ্যাবলা সর্বেশ্বর ভ্যাবলার মতই দাঁড়িয়ে থাকে। দ্বিতীয়বার পাণিগ্রহণের কথাটাও মনে পড়ে না তার। একটু পরে নিশ্বাস ফেলে বলে, ‘মাঝে মাঝে এখানটাতেই আসিস স্বর্ণ, নইলে আর দেখা হওয়ার আশা নেই।’

সেই থেকে ওই ওদের দেখা—সাক্ষতের জায়গা। চোর চোর খেলার মত ঝপ করে এক সময় ওর মধ্যে এসে লুকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়তো স্বর্ণ, এবং প্রায়শঃই দেখতে পায় সর্বেশ্বর তার মধ্যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মশার কামড় খাচ্ছে। এই চলছে বেশ কিছুকাল। স্বর্ণকে আসতে হয় অনেক কৌশলে, তাই দেরি হয়। স্বর্ণকে দেখলেই সর্বেশ্বরের অভিমান উথলে ওঠে। আজও উঠল। বলল, ‘পষ্ট বলিস না কেন তোর আর আসার সুবিধা হবে না। কাঁহাতক আর এমন যন্ত্রণা সহ্য হয়?’

স্বর্ণও ক্ষুব্ধ অভিমানের গলায় বলে, ‘আমারই যেন বড় সাধ যে তোমায় যন্ত্রণা খাওয়াই। মা কী খিটখিট করে আজকাল জান না তো? বিয়ে বিয়ে করে পায়ে বেড়ি পড়েছে আমার?’

‘বিয়ে তাহলে হয়ে যাচ্ছে তোর।’

স্বর্ণ তীব্র ঝঙ্কারের সঙ্গে বলে ওঠে, ‘তা’ তুমি যদি তোমার বিয়ে করা পরিবারকে আর কারুর হাতে তুলে দাও তো হবে। বলি পষ্টাপষ্টি বল এবার তোমার মাকে।’

সর্বেশ্বর করুণ গলায় বলে, ‘তার চেয়ে বল না কেন বাঘকে বলতে। সেদিন তুই কি শুনতে কি শুনলি, একটা অঘটন ঘটনা হল, তারপর তো দেখছি বিপরীত। মা তো তোদের নামে খড়্গহস্ত। ঘটকও তো যাচ্ছে আসছে। সহসা কেন যে তুই বললি মা তোর সঙ্গে আমার—’

সর্বেশ্বর চুপ করে যায়। কেন না চুপ করতে বাধ্য হয়।

স্বর্ণ সহসা গলায় আঁচলটা দিয়ে হাত জোড় করে রুদ্ধকণ্ঠে বলে ওঠে, ‘ঘাট হয়েছিল, অন্যায় হয়েছিল, আমার সঙ্গে তোমার বিয়েটা তোমার এত গলগ্রহ মনে হবে তা বুঝতে পারিনি। শুনলাম মা—র কাছে জ্যেঠিমা রব কাটছেন—’মেয়ে তোমার সোন্দর, বৌ করবার যুগ্যি।’ ভাবলাম, মা ভৈরবীকালী বুঝি মুখ তুলে চাইলেন।’ গলাটা প্রায় সবটাই বুজে আসে স্বর্ণর, শেষ কথাগুলো অস্পষ্ট শোনায়।

সর্বেশ্বর কাঁদো কাঁদো গলায় বলে, ‘আমি কি তাই বলছি—’

‘যা বলছ, তা বুঝেছি।’ স্বর্ণ গলা পরিষ্কার করে বলে, ‘মা—বাপ আমার গলায় চোপ দেবে, তুমি মুখে তালা—চাবি লাগিয়ে সঙের মতন তাই দেখবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, ব্যস! বেশ তাই হোক। তাহলে এই শেষ। আর আমি মাকে ভাঁড়িয়ে একশো মিছে কথা বলে ধেয়ে ধেয়ে এখানে এসে জুটতে পারব না তা বলে দিচ্ছি।’

‘স্বর্ণ তোর পায়ে পড়ি। দুদিনে পাঁচদিনে একবার না দেখা হলে প্রাণটা বড্ড খাঁ খাঁ করে।’

‘করুক। জন্মভোরই তো করবে।’

‘মা ভৈরবীকালী তাহলে আমাদের মুখ চাইলেন না!’ নিশ্বাস ফেলে সর্বেশ্বর।

কিন্তু স্বর্ণ এখন হিংস্র। দৃঢ় গলায় বলে, ‘চাইতেন, যদি তোমার তেমন প্রার্থনার জোর থাকত। তুমি আলগা আলগা বলেছ।’

‘স্বর্ণ, স্বর্ণ, এই কথা বললি তুই আমায়! রাতদিন মাকে জানাচ্ছি না ‘মা যেন আমায় বিয়ে দিয়ে না ফেলে।’

‘মা কালা!’

‘তা হলে উপায়?’

‘উপায় আবিষ্কার কর।’

‘আমি তো মাথামুণ্ডু কিছুই ভেবে পাচ্ছি না।’

‘বেশ, তবে এই শেষ। বুঝছি মরণই আমার গতি।’

স্বর্ণ আশ্রয়—কুঞ্জ ত্যাগ করে। রীতিমত বিক্রম সহকারেই করে।

কিন্তু বেচারী সর্বেশ্বর কি করবে? স্বর্ণর সামনে মনে হয় ঠিক আছে, কাউকে দিয়ে বলাব মাকে, হালদারদের ঘরেই বিয়ে দাও আমায়, পাঁচজনকে বল যে মা ভৈরবীকালী স্বপ্নাদেশ করেছেন। কিন্তু বাড়ি ফিরে চন্দ্রাননীর গোলালো আননখানি দেখলেই পেটের মধ্যে হাত—পা ঢুকে যায় তার।

তবু আজ মরি না মরতে আছি প্রতিজ্ঞা করে বাড়ি ফিরল সর্বেশ্বর।

চন্দাননী ছেলের জন্যে ঘরবার করছিল। কারণ ঘটক—ঠাকুর এক কন্যাদায়গ্রস্ত বাপকে সরাসরি ধরেই এনেছেন, তিনি পাত্রটিকে দেখে যাবার আকিঞ্চন করছেন।

অতিথি—সৎকারের ব্যাপার মিটেছে, সর্বেশ্বরের টোল থেকে ফেরার সময় বহুক্ষণ উত্তীর্ণ। শিবেশ্বর মায়ের দ্বিপ্রাহরিক ভোগরাগ সেরে বাড়ি ফিরে খুঁজতে বেরিয়েছেন ছেলেকে, ছেলের দর্শন নেই।

কখন চান করবে, কখন ভাত খাবে ছেলে! তাছাড়া লোকটা বসে রয়েছে, সেও একটা অস্বস্তি। ঘরবার করছে তাই চন্দ্রাননী।

যখন হতাশ ভদ্রলোক ঘটকের কাছে সন্দেহ প্রকাশ না করে পারেন না, ছেলে কী অবাধ্য দুর্বিনীত, এবং ঘটক যখন তার বিপরীতে বহু অকাট্য আশ্বাস দিতে থাকে, তখন অদূরে দেখা যায় শিবেশ্বর ছেলের কান ধরে নিয়ে আসছেন।

চন্দ্রাননী প্রমাদ গনে। এ দৃশ্য দেখলে কোন ভদ্রলোক মেয়ের বিয়ের জন্যে চেষ্টা করবে? ছেলে যে পাজী তা তো বুঝেই যাবে।

চন্দ্রাননী খিড়কির পথে বেরিয়ে পড়ে দ্রুত এগিয়ে বলে, ‘কান ছাড়ো।’

‘কান ছাড়ব?’ শিবেশ্বর ক্রুদ্ধ গর্জনে বলেন, ‘কান ছাড়ব? আজ তোমার ছেলের হাড় থেকে মাংস ছাড়াব। আমি হতভাগা গরু খোঁজা করে ছেলে খুঁজছ, আর বাবা আমার লভ করছেন।

‘চুপ, চুপ!’ চন্দ্রাননী তখনকার মত কথাটায় ধামা—চাপা দেয়।

শিবেশ্বর ঘুরে বড়রাস্তা দিয়ে বাড়ির সদরে ঢোকেন।

এবং যেমন ঘর্মাক্তকলেবর মূর্তি ছিল সেইভাবেই ভাবী শ্বশুরের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে হয় সর্বেশ্বরকে। কি ভাগ্যি তখনো শিবেশ্বরের হাতে সর্বেশ্বরের কানটা নেই।

নেই, কিন্তু প্রাণটা তো শিবেশ্বরেরই মুঠোয়।

পাত্র পছন্দ করিয়ে কথা পাকা করে ফেলেন শিবেশ্বর।

সর্বেশ্বর ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।

হ্যাঁ, তারপর শাস্তিটা ভালই হয় সর্বেশ্বরের। শিবেশ্বরের খড়মের গুলোর মর্মান্তিক আস্বাদ গ্রহণ করে সর্বেশ্বর দারুণ চিৎকারের সঙ্গে। চন্দ্রাননী শুদ্ধু সায় দেয়, আটকায় না।

আটকানো দূরস্থান, বরং ঘটনা শুনে রণমূর্তি নিয়ে চেঁচায়, ‘হ্যাঁ, দিয়ে দাও আরো দু—ঘা, জন্মের শোধ পাজীমো করা ঘুচুক। অ্যাঁ, বল কি তুমি, মায়ের মন্দিরে গিয়ে হাত—ধরাধরি! এই পুণ্যির বংশে এমন পাতুকী জন্মাল কী করে গো? কী কুলাঙ্গার পেটে ধরলাম আমি!…ওগো, আমার যে বিষ খেতে ইচ্ছে করছে গো!’

কিন্তু সবেরই বোধকরি মাত্রা থাকা দরকার।

শাসনের মাত্রা ছাড়ালেই সহ্যের মাত্রাও ছাড়ে। হঠাৎ এক বিপরীত ঘটনা ঘটে। প্রহার—জর্জরিত সর্বেশ্বর হঠাৎ এক সময় চেঁচিয়ে ওঠে, ‘হাত ধরেছি তো হয়েছে কি? মা কালীকে সাক্ষী রেখে ওকে বিয়ে করেছি আমি।’

হঠাৎ শিবেশ্বরের হাত থেকে খড়মটা খসে পড়ে, শিবেশ্বর স্খলিত স্বরে বলেন, ‘কী বললি? কী বললি? মাকে সাক্ষী রেখে বিয়ে করেছিস ওকে?’

চন্দ্রাননী ডুকরে কেঁদে ওঠে।

আর পরক্ষণেই শিবেশ্বর বাঘের মত ছেলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বলেন, ‘আয়, আজ তোকে খুন করে সেই রক্তে হাত ধুই।’

কিন্তু শুধুই কি সর্বেশ্বর খুন হচ্ছিল? স্বর্ণ হচ্ছিল না? স্বর্ণর বাপও কি ধরে ফেলেনি তার মেয়ে প্রেম করছে? আর সেই ধরে ফেলার কোন প্রতিক্রিয়া নেই?

ব্যাপারটা এই—

শিবেশ্বর যখন ভরদুপুরে চনচনে রোদে ছেলে খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন, নোটো হালদার তখন মন্দিরের পুকুরে ছিপ ফেলে মাছ ধরছিল।

হঠাৎ হুঙ্কার শুনতে পেল নোটো। চমকে ফিরে তাকিয়ে দেখল পিছনে শিবেশ্বর। তাঁর দু—হাতে দুটো কান। একটা কান শিবেশ্বরের নিজের ছেলের আর একটা কান নোটোর মেয়ের।

মানে!

মানে ব্যাখ্যা করবার সময় এখন নেই শিবেশ্বর পাঠকের, শুধু কুৎসিত একটা মুখভঙ্গী করে মেয়েটাকে নোটোর হাতে সমর্পণ করে বলে যান, ‘কেলেঙ্কারী কতদূর গড়িয়েছে আমি জানিনে নোটো! তবে তোকে এই বলে যাচ্ছি, সাত দিনের মধ্যে যদি মেয়ের বিয়ে না দিস, ভবিষ্যতে কী করে তুই মেয়ের বিয়ে দিস দেখব। এই সাতদিন সময় দিলাম।’

ছেলের কানটা করায়ত্তে রেখে হন হন করে চলে যান শিবেশ্বর।

আর বাঘা নোটো শেয়ালের মত ফ্যালফেলিয়ে তাকিয়ে থাকে সেই গমনপথের দিকে।

কিন্তু বাঘা নোটো হালদার কতক্ষণ আর শিয়ালের ভূমিকা অভিনয় করতে পারে? মেয়েটাকে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে স্রেফ তাকে দেয়ালের কাছে ঠেলে নিয়ে গিয়ে মাথাটা ঠুকতে লাগল দেয়ালে। ঝুনো নারকেল হলে অথবা পাকা বেল হলে চৌচির হত সন্দেহ নেই। কিন্তু আশ্চর্য শক্ত স্বর্ণর মাথাটা। হয়তো তার মেঘপ্রমাণ চুলের খোঁপাটাই তাকে চৌচির হওয়া থেকে রক্ষা করল। শুধু গোটাকতক জায়গায় আলুর মতন হয়ে উঠল।

স্বর্ণ নিথর। স্বর্ণ নিজেকে ছাড়িয়ে নেবারও চেষ্টা করে না, স্বর্ণ কেঁদে ওঠে না। নোটো যতই চাপা গর্জন করে, ‘বল হারামজাদি, কোথায় কি করছিলি?’ স্বর্ণ ততই যেন প্রস্তরত্বে পরিণত হয়। স্বর্ণ না তার বাপের বড় আদরের?

কনক যখন রান্নাঘর থেকে সাড়া পেয়ে ছুটে এসে চেঁচিয়ে ওঠে, ‘কী হয়েছে গো? কী সর্বনেশে কাণ্ড করছ!’—তখন স্বর্ণ ছাড়া পায়। নোটো হালদার মেয়েকে ছেড়ে এবার বৌয়ের মুণ্ডুটা ধরে।

‘মেয়ে গলায় বেঁধে দীঘিতে ডুবে মরগে যা লক্ষ্মীছাড়া মেয়েমানুষ! কাঁসি কাঁসি ভাত গিলতে পার আমার, আর মেয়ে সামলাতে পার না? মেয়ে রাস্তা—ঘাটে কেলেঙ্কারী করে বেড়ায়। আজ এক খাঁড়ায় দুজনকে কোপ দেব! মায়ের মন্দিরে হয়ে যাক দুটো নারী—বলি। অ্যাঁ, এমনি করে আমার গালে মুখে চুনকালি দিলি তোরা?…. এই শুনে রাখ স্বর্ণর মা, সাতদিনের মধ্যে মেয়ের বিয়ে দিতে হবে, হুকুম হয়ে গেছে। ঘাটের মড়া, বুড়ো তেজরবে, চারবরে, যা জোটে কপালে।’

ভাবা স্বাভাবিক—এরপর ক্ষুব্ধ অপমানাহত প্রহার—জর্জরিত সর্বেশ্বর ঘৃণায় অভিমানে গৃহত্যাগ করল, এবং নির‍্যাতিতা উৎপীড়িতা স্বর্ণ দীঘির জলের নীচে আশ্রয় নিল। প্রেমিক—প্রেমিকার বয়েস ষোল আর এগারো হলেও পক্বতাটা যখন অত বেশী! অতএব বাল্যপ্রেমের একটা জ্বলন্ত মহিমার ইতিহাস লেখা রইল বীরপুরের মাটিতে।

অথবা এও ভাবা চলে, ওরা না গেল পালিয়ে, না ডুবল জলে। সর্বেশ্বর গায়ের ব্যথা নিয়ে দিন দুই বিছানায় পড়ে থেকে রথারীতি আবার বেনিয়ানের উপর চাদর চাপিয়ে হেঁট মুণ্ডে টোলের দিকে রওনা দিল, এবং স্বর্ণ মাথার ব্যথা নিয়েই নিঃশব্দ গাম্ভীর্যে মায়ের রান্নার সাহায্য করতে লাগল। আর এরপর বাল্যপ্রেমের চিরন্তন রীতি অনুসারে যথাকালে দুজনের দু’জায়গায় বিয়ে হয়ে গেল। সর্বেশ্বর বিয়ে করতে যাবার সময় একটু কম আমোদ করল, আর স্বর্ণ শ্বশুরবাড়ি যাবার সময় একটু বেশি কাঁদল।

হয়ে গেল প্রেম—ব্রত উদযাপন।

কিন্তু না, এ—সবের কিছুই হতে পেল না। কারণ শিবেশ্বরের ওই কড়া আদেশের পরদিনই এই বীরপুর গ্রামে এমন ভয়ঙ্কর লোমহর্ষক এক কাণ্ড ঘটল, যাতে সবকিছু বজ্রাহতের মত স্তব্ধ হয়ে গেল।

যা ধারণাতীত, যা কল্পনাতীত, যা সমস্ত কিছু আশঙ্কার অতীত, তাই কিনা ঘটে বসে আছে? জাগ্রত দেবী কি এতদিন পরে আর একবার প্রমাণ করে ছাড়লেন তিনি কত জাগ্রত?

সমস্ত বীরপুর গ্রাম অজানিত কোন এক সর্বনাশের আশঙ্কায় থমথমিয়ে মন্দিরের ধারে কাছে জমায়েৎ হয়। সক্কালবেলাই যাদের উনুনে আগুন পড়েছিল, তাদের উনুন জ্বলে—পুড়ে নিভে যায়, যাদের উনুনে আগুন পড়েনি, তাদের উনুন ভয়াবহ শূন্যতার প্রতীকের মত বসে থাকে আয়োজনহীন রন্ধনশালায়!

বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলোকে শান্ত করতে কারো মা—ঠাকুমা গুচ্ছিরখানি মুড়ি—চিঁড়ে ঢেলে দিয়ে যায়, কারো মা—ঠাকুমা তাদের প্রতি দৃকপাত মাত্র না করে বেরিয়ে যায়। তারাও অতঃপর হেই হেই করতে করতে ওদের পশ্চাদ্ধাবন করে।

বীরপুরের বহু বাড়িতে আজ ছড়া ঝাঁট পড়ে না, গোয়ালের গরু ছাড়া হয় না। অথচ আজ সকাল সকাল কাজ সেরে নেওয়ার তাড়া ছিল।

আজ কৌশিকী অমাবস্যা, মায়ের বিশেষ উৎসব, বিশেষ ভোগরাগ। নিত্য সংসারের সাধারণ সুখ—দুঃখে অহরহই তো মায়ের কাছে মানত চলে, সে—সব পুজো এই সব বিশেষ বিশেষ দিনে পড়ে। তাই বিশেষ দিনে মহিলারা তৎপর হয়ে কাজ সেরে নেন, যাতে ভোগারতির সময় গিয়ে পৌঁছতে পারেন। অনেক গিন্নী অবশ্য নিত্য যান মন্দিরে, অনেকে আবার ন’মাসের ছ’মাসের যাত্রী। এঁরা বিশেষ দিনে ভোগ দেখতে চঞ্চল হন।

আজও হলেন। কিন্তু এ চাঞ্চল্য কি ভোগারতির সময় উপস্থিত হতে পারবার প্রস্তুতির চাঞ্চল্য? তা’ নয়। এ এক ভয়াবহ দৃশ্য দেখবার প্রস্তুতি—চাঞ্চল্য।

প্রথম দেখলেন অবশ্য শিবেশ্বরই।

কারণ তাঁকে আজ ভোরে উঠতে হয়েছে মঙ্গলারতির জন্যে। বিশেষ পুজোর দিনে, একটু বেশী ভোরে মঙ্গলারতির নিয়মটা এখনও বজায় রেখেছেন শিবেশ্বর। ইদানীং মাঝে মাঝে সর্বেশ্বরকে পাঠাচ্ছিলেন অবশ্য। ভোরবেলা ছেলেকে ঠেঙিয়ে তুলে অকারণ একটা আড়মোড়া ভেঙে বলছিলেন, ‘শরীরটে তেমন ভাল ঠেকছে না সর্বা, তুই একটু যা দিকি মুখ—হাত ধুয়ে।’

আজ কিন্তু সে আরামের উপায় ছিল না, আজ চন্দ্রাননী বলে দিয়েছে, ‘শেষ রাত্তিরে ছেলেটাকে টেনে তুলো না, গায়ের ব্যথায় নড়তে পারছে না হতভাগা।’

শিবেশ্বরকেই তাই ভোরবেলা ঘুমের খোঁয়াড়ি ভেঙে উঠে আসতে হয়েছিল। তা’ আরতিটা যে করেননি তা নয়, করেছিলেন। ঘুম ঘুম চোখে ঢং ঢং করে ঘণ্টা নেড়ে আরতির পর্ব সেরে ফেলেছিলেন, চামর ব্যজন কালে ব্যাপারটায় চোখ পড়ল।

চোখ পড়ল।

চোখটা বিস্ফারিত হতে থাকল।

চোখটা স্তব্ধ হয়ে পল্লব পড়া বন্ধ হয়ে গেল। হাতের চামরটা মাটিতে পড়ে গেল। তারপর দাঁড়ানো শিবেশ্বর নিজেও ‘মা’ বলে একটা ভয়ঙ্কর আর্তনাদ করে মাটিতে বসে পড়লেন।

প্রথম ঘটনা এই।

তারপর শিবেশ্বর ছুটে বেরিয়ে গেলেন বাবুদের বাড়ির উদ্দেশে।

এ হেন প্রভাতকালে জমিদারবাবুর ঘুম ভাঙানো প্রায় অবিশ্বাস্য ধৃষ্টতা, তবু তাই করতে হল শিবেশ্বরকে। এত বড় বিপদের বার্তা আর কাকে জানাতে যাবেন?

বাবু—’অ্যাঁ! বল কি পাঠক?’ বলে কাছা আঁটতে আঁটতে বেরিয়ে এলেন।

রাতবাস কাপড়ে মন্দিরে ঢুকলেন না, বাইরে থেকে উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করে বিফল হয়ে বাইরের চাতালে বসে পড়ে বললেন, ‘তুমি ঠিক দেখেছ পাঠক?’

হ্যাঁ, পাঠক ঠিক দেখেছেন বৈকি। অতবড় ভয়ঙ্কর দৃশ্য কি ভুল হয়?

বাবু স্খলিত বচনে বলেন ‘পাঠক, মায়ের পুজোয় কোন অনাচার ঘটেনি তো?’

পাঠকের মাথা থেকে পা পর্যন্ত একটা বিদ্যুৎ শিহরণ ঘটে। পুজোয় অনাচার! পুজোয় কিসের অনাচার? কেটে মটকা ছাড়া পরেন না কখনো পাঠক, হাত—মুখ না ধুয়ে মন্দিরে প্রবেশ করেন না।

শিবেশ্বরের কথা যোগাতে দেরি হয়।

আর কিছু নয়, সেই কালকের ব্যাপার! পুজোয় অনাচার নয়, মন্দিরে অনাচার। তারপর তিনিও স্খলিত স্বরে বলেন, ‘পুজোয় কোন অনাচার ঘটেনি—’

অর্থাৎ অশ্বত্থামা হত ইতি গজ!

বাবু মাথায় হাত দিয়ে বলেন ‘সে তো বুঝলাম, কিন্তু এখন উপায়?’

‘মা জানেন!’ বলেন শিবেশ্বর, কিন্তু মনে মনে উপায় ঠিক করতে থাকেন।

তবে এক্ষুনি হবে না, ভিড়ে ভেঙে পড়ছে মন্দির।

সক্কালবেলা বাবুর হঠাৎ মন্দিরে ছুটে আসার ব্যাপার থেকেই খবরটা চাউর হয়ে গেছে। আগুন আর দুঃসংবাদ বাতাসের আগে ছোটে। এ—চাল থেকে ও—চালে, এ—মুখ থেকে ও—মুখে। দণ্ডখানেকের মধ্যে বীরপুর গ্রামের কারো আর জানতে বাকি থাকল না বীরপুর গ্রামে বজ্রপাত ঘটেছে।

মা ভৈরবীকালী অঙ্গহীন হয়েছেন! দেবীর যে—টি অভয় হাত, সেই ঊর্ধ্বোত্থিত ডান হাতটির করতল খানি উধাও।

স্রেফ উধাও!

আশে—পাশে ফুল—পাতার মধ্যে, হোম—কুণ্ডে, কি পদতলের শতদল পদ্মের খাঁজে খাঁজে কোথাও নেই সেই ভগ্নখণ্ড। তার মানে হঠাৎ ভেঙে পড়ে যায়নি, মা নিজেই হরণ করেছেন। গুটিয়ে নিয়েছেন অভয় কর। যেমন অনেককাল আগে নিয়েছিলেন লেলিহান রসনা।

এবারেও যদি জিভ হত, হয়তো এত ভয় পেত না কেউ, কারণ এখন দেবী স্বর্ণজিহ্বা। অতএব ভাবা যেত সেই সোনাটুকুর লোভেই হয়তো চোরে—

না, চোরের অসাধ্য কাজ নেই, চোরের অসাধ্য পাপ নেই। জিভ হলে চোর ভেবে মাকে পঞ্চগব্যে শোধন করে নিয়ে আবার সোনার জিভ গড়িয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু এ যে ভয়ঙ্কর! এ যে সর্বনাশ!

কে বলতে পারে এখন সমগ্র গ্রামটায় মড়ক লাগবে কিনা! কে বলতে পারে বাজ পড়বে কিনা, আগুন লাগবে কিনা!

কেউ ভাবছে না মৃণ্ময়ী প্রতিমা পুরনো হয়ে গেছেন, জীর্ণ হয়ে গেছেন, একটা অংশ খসে যাওয়া বিচিত্র নয়। আর সে অংশ রাশীকৃত শুকনো জবার মালা আর বাসি ফুল—পাতার সঙ্গে হারিয়ে যাওয়াও বিচিত্র নয়।

ঝুড়িখানেক তো নির্মাল্য জমে প্রতিদিন। দুবেলা সরাতে হয়।

কে বলতে পারে গত রাত্রেই এ ঘটনা ঘটেছে, কিংবা আরো আগেই ঘটেছে। আধো—আলো আধো—ছায়া ঘরে ঘৃত—দীপের শিখাটা জ্বালিয়ে ধরা মাত্র সিঁদূর লেপা সোনার জিভখানাই চোখের সামনে চক চক করে ওঠে। তাই হয়তো এ ত্রুটি নজরে পড়েনি।

না, এ—কথাটা কেউ ভাবছে না, ভাবছে না দৈবাতের ঘটনা। সকলেই মা কালীকেই দায়ী করছে। মা কুপিত হয়েছেন, মা অভয় কর সরিয়ে নিয়েছেন।

কিন্তু কেন?

তা কে বলতে পারে? নির্ঘাৎ বীরপুরের উপর কারো অভিসম্পাত পড়েছে।

পাপ, অনাচার, অভিসম্পাত, এই সবই ভাবছে সবাই। কার পাপ, কার অনাচার, কার উপর অভিসম্পাত, এটা চট করে কেউ ভাবতে পারছে না। পারছে শুধু শিবেশ্বর পাঠক। তার গায়ের রোম থেকে থেকে খাড়া হয়ে উঠছে রাগের ধাক্কায়।

‘আজ আর তাহলে মায়ের পুজো হবে না ঠাকুরমশাই?’ কে একটি বৃদ্ধা প্রশ্ন করেন।

শিবেশ্বর হুঙ্কার দিয়ে ওঠেন, ‘না, হবে না। দেখছ না মা কুপিত হয়েছেন!’

‘তা মায়ের রোষ শান্তি করতে তো বেশি করে পুজো করাই দরকার বাবা!’

শিবেশ্বর তীব্রস্বরে বলেন, ‘তোমার কাছে পরামর্শ চাইতে গেছি আমি? পুজো এনেছ, রেখে যাও ওই দালানে। ব্যস, সরে পড়।’

বৃদ্ধা কাতর গলায় বলেন, ‘আজ কুশী অমাবস্যে, শ্যাঁকা—শাড়ি দিয়ে পুজো এনেছিলাম মা—র——’

‘এতো ভাল ঝামেলা হল’—শিবেশ্বর বলে ওঠেন, ‘বলছি রেখে যাও, মায়ের নিতে ইচ্ছে হয় নেবেন, নচেৎ নেবেন না।…’

তারপর বুকে হাত আড় করে বিজ বিজ করে বলতে থাকেন, ‘রোষ শান্তি! রোষ শান্তি! পাজী—নচ্ছার ছোঁড়াটাকে এই দালানে এনে মেপে সাত হাত নাকে খৎ দেওয়াব, আর হারামজাদি ছুঁড়িকে—

বাকি কথাটা আরো অস্পষ্ট হয়ে আসে।

বীরপুর গ্রামের এই আকস্মিক বিপৎপাতে গ্রামসুদ্ধ এসে ভেঙে পড়েছে, আসেনি খালি নোটো হালদার আর তার স্ত্রী—কন্যা।

আসার উপায় নেই বলেই হয়তো আসেনি নোটো। গতকাল সেই মারাত্মক চেঁচামেচির ফলে নোটোর মাথার শিরা প্রায় ছেঁড়বার উপক্রম হয়েছিল। আজ তাই নোটো মাথা তুলতে পারছে না। অতএব তার স্ত্রী মাথার কাছে বসে পাখা নাড়ছে, আর কন্যা চুপচাপ হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে আছে।

সকালবেলা রাখাল ছেলেটা গরু খুলতে এসে গরু না খুলেই খবরটা দিয়ে চলে গেছে, গরুগুলো চেঁচাচ্ছে, তাদের ভার নেবে এমন উৎসাহ কারো নেই। গরু এখন গৌণ।

কনক একবার উসখুস করেছিল, বলেছিল, ‘স্বর্ণ, পাখাটা একটু ধর তো, ছুটে গিয়ে একবার দেখে আসি’ নোটো এক ধমকে থামিয়ে দিয়েছিল। বলেছিল, ‘কেন, কী একখানা মহৎ দৃশ্য যে দেখতে যেতে হবে?’

কনক অস্ফুটে আর একবার বলেছিল, ‘সবাই যাচ্ছে—’

‘যাচ্ছে যাক! তোমার যাওয়া হবে না, ব্যস। মাথার যাতনায় ঘাড়ের শির ছিঁড়ে পড়ছে আমার, উনি যাবেন মজা দেখতে!’

কনক শিউরে দু—হাত জোড় করে বলে, ‘মজা! মজা দেখতে যেতে চাইছি!’

‘তা ছাড়া আবার কি?’ নোটো হালদার রগের শিরটা টিপে ধরে বলে, ‘মা কালীর হাত খসে পড়েছে, এ দৃশ্য দেখবার জন্যে এত ভীড়! মজা মজা, যাতে তাতে মজা পেলেই হল। উঃ! মাথাটার মধ্যে যেন কুকুরে চিবোচ্ছে—’

এই সময় ঘাড়গোঁজা স্বর্ণ হঠাৎ কথা বলে ওঠে। বলে, ‘ফাটল একজনের মাথা, যাতনা ধরল আর একজনের মাথায়। এত একরকম মজা!’

স্বর্ণর গলার শ্লেষ, না অভিমান?

নোটো কাল থেকে মেয়ের দিকে তাকাতে পারেনি। এখনো তাকাল না, শুধু উত্তর দিল। ক্ষুব্ধ অভিমানের গলায় দিল, ‘কার লাগা কোথায় লাগে, সে কথা এখন বুঝবি না। আগে বয়েস হোক, সন্তান হোক, বুঝবি।’

হয়তো বুঝেছে স্বর্ণ। তাই বাবার ঘরেই বসে আছে ঘাড় গুঁজে। কিন্তু উঠে গেলেও তো পারত! অন্ততঃ যখন শিবেশ্বর পাঠক বাড়িচড়াও হয়ে এসে যাচ্ছেতাই কোরে বকাবকি করল, তখন উঠে গেলে পারত।

তা গেল না। যেমন ঘাড় গুঁজে বসেছিল, তেমনি বসেই রইল। খানিকটা বেলায় শিবেশ্বর এলেন সাপের মত ফুঁসতে ফুঁসতে। বিনা ভূমিকায় বলে উঠলেন, ‘দেখ নোটো, ভাল চাস তো এই দণ্ডে তোর ওই শয়তানী মেয়েটাকে নিয়ে বীরপুর থেকে বেরিয়ে যা।’

অকস্মাৎ শিবেশ্বরকে দেখেই নোটো হালদার ধড়মড় করে উঠে বসেছিল। এখন এই আদেশে হাঁ করে তাকাল। আবার কী হল? গত কালই তো সাতদিনের মেয়াদে দণ্ডাদেশ হয়ে গেছে, সেই অবধি মেয়েটা ঘরের মধ্যে পড়ে আছে, নতুন কী ঘটল তবে?

হাঁ—করা নোটোর দিকে অগ্নিদৃষ্টি হেনে শিবু পাঠক আবার চাপা হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, ‘শুনতে পেয়েছিস? ঢুকেছে মাথায়?’

নোটো গম্ভীর ভাবে বলে, ‘না!

‘মাথায় ঢোকেনি? তা ঢুকবে কেন? এখনো রাজশয্যে ছেড়ে ওঠা হয়নি যে! তোর ওই পাপিষ্ঠি মেয়ের ওপর রোষযুক্ত হয়ে মা কী সর্বনেশে শোধ নিয়েছেন সেটা শুনিসনি তাহলে?’

নোটো এবার নিজমূর্তি ধরে। কড়া গলায় বলে ‘মেয়ের নামে যা ইচ্ছে তাই বোলো না বড় পূজুরী। হয়েছেটা কী তাই শুনি?

‘শুনবি? শুনতে তাহলে বাকি আছে তোর এখনো? শোন তবে’—শিবেশ্বর কণ্ঠস্বরে বজ্রস্বর আনেন, ‘মায়ের মন্দির কলুষিত হয়েছে। মা সেই কোপে রাগে দুঃখে আঙুল মটকেছেন, বুঝলি? অভিসম্পাত দিয়েছেন আঙুল মটকে, সে ধাক্কায় ডান হাতের চেটোখানা নিশ্চিহ্ন।’

হঠাৎ নোটো হালদার স্পর্ধিত ব্যঙ্গে হা হা করে হেসে ওঠে। ‘মা কালীও তাহলে আমাদের বিন্দুপিসির মত আঙুল মটকে শাপমন্যি দেন বড় পূজুরি?’

অন্য সময় শিবেশ্বরকে নোটো ‘শিবুদা বা পাঠকদা’ বলে, রাগের সময় বলে, ‘বড় পূজুরী।’ এখন সেই পালা।

‘হাসি! হাসছিস তুই? বড্ড বুকের পাটা দেখছি যে নোটো! এখনো বলছি নোটো, ভাল চাস তো মেয়ে নিয়ে গাঁ ছেড়ে বিদেয় হ’, নচেৎ সামলাতে পারবি না। মা—র অঙ্গক্ষয়ের কারণটা প্রকাশ হয়ে পড়লে গাঁ—সুদ্ধু লোক তোকে আস্ত রাখবে ভেবেছিস? তোর ওই কুলের ধ্বজা মেয়েকে তোকে হয় হাতে করে বিষ দিতে হবে, নয় গলায় পাথর বেঁধে দীঘিসই করতে হবে।’

‘বটে!’ আর ধৈর্য ধরতে পারে না নোটো। দাঁড়িয়ে উঠে বাঘের হুঙ্কারে বলে ওঠে, ‘মুখ সামলে কথা বল পাঠক, আর যদি আমার মেয়ের নাম মুখে আনবে, মা ভৈরবীকালীর থানে নিয়ে গিয়ে বলি দেব তোমায়!’

‘কী? কী বললি?’

‘যা বলেছি, ঠিকই বলেছি। কাল থেকে অনেক সহ্য করেছি, আর নয়। আমার ওই শিশু মেয়েটার নামে অনেক বলেছ তুমি—’

‘শিশু! শিশু!’ শিবেশ্বর যেন নেচে ওঠে। ‘ওই হাতী হোঁৎকা মেয়ে তোর শিশু? বয়সে বে দিলে এতদিন কোলে ছেলে ট্যাঁ ট্যাঁ করত। তোর ওই পাতকী মেয়ের অনাচারেই মা ভৈরবাকালী অভয় হাত গুটিয়েছেন—এই বলে দিলাম। মানে মানে ওকে যদি না সরাস, সবংশে ধ্বংস হবি নোটো। মায়ের মন্দিরে অনাচার কদাচার! মায়ের মন্দিরে বসে পেজোমি!’

নোটো আর চেঁচায় না। রূঢ় গলায় বলে, ‘অনাচার কদাচারের জ্বালায় যদি মা নিজের অঙ্গে নিজে আঘাত হানত পাঠক, তবে এতদিনে মা সর্বঅঙ্গ ভেঙে নাক কান বোঁচা করে বসে থাকত। বলি তুমি কী? তুমি নিজে? পদি কামারনীর কথা না জানে কে? বিশ বছর যাবৎ তুমি তার সঙ্গে বসবাস করছ, তার হাতে জল খাচ্ছ, পান খাচ্ছ, তামাক খাচ্ছ, তুমি পতিত হচ্ছ না?’

‘নোটো!’ শিবেশ্বর প্রায় নোটোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন, ‘মুখ সামলাবি তুই?’

নোটোও বিক্রম ছাড়ে না, কড়া গলায় বলে, ‘কেন সামলাব? হক কথা বৈ বানানো কথা বলিনি। তবু তো রেখে—ঢেকে বলেছি। আরো বলব? পদি কামারনীর ঘরে যে হাঁস—মুরগীর পাল ঘোরে, সেগুলো—’

শিবেশ্বর সহসা তীব্র একটা হুঙ্কারের সঙ্গে গলার পৈতেটা ছিঁড়ে নোটোর গায়ে ছুঁড়ে দিয়ে বলে, ‘এ—আস্পদ্দার প্রতিফল পাবি, পাবি, পাবি! ওই মেয়েকে বিষ গিলিয়ে মারতে তোকে হবে হবে হবে। চললাম আমি গা—সুদ্ধু সবাইকে জানাতে। তোর মেয়ের—’

নোটোর চোখদুটো রক্তবর্ণ হয়ে ওঠে, নোটোর মুখটা অগ্নিকুণ্ড হয়ে ওঠে। নোটো আর গুরু লঘু মানে না। ছেঁড়া পৈতেটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে হিংস্র গলায় বলে ওঠে, ‘সাপকে সাপের বিষ লাগে না পাঠক! পৈতে ছিঁড়ে নিজেই নিজের ক্ষেতি করলি। শুধু আমার মেয়ের কলঙ্ক রটাতে গেলে চলবে তোর? তার সঙ্গে তোর নিজের ঘরের কলঙ্ক ছড়াতে হবে না? কান তুই একজনের ধরিসনি সেটা বুঝি ভুলে যাচ্ছিস?’

শিবেশ্বর রাগে ঠক ঠক করে কাঁপে, মাটিতে দুম করে একটা পা ঠোকে, তারপর তীব্র কটু কঠোর গলায় বলে, ‘তোর ওই ন্যাকা শাস্তর রাখ নোটো, পুরুষ পরশ—পাথর, আড়াই পা বাড়ালেই শুদ্ধ, এ—কথা তুই ছাড়া আর সবাই জানে। আমি এই চললাম—মা যদি জাগ্রত হন, রাত্তিরের মধ্যে বজ্রাঘাতে সপুরী একগাড়ে যাবি তুই, যাবি, যাবি, যাবি।

দুঁদে নোটো হালদার আবার একবার তেমনি স্পর্ধিত ব্যঙ্গের হাসি হেসে ওঠে। থেমে থেমে হেসে হেসে বলে ‘জাগ্রত? মড়া আবার জাগ্রত হয় নাকি রে পাঠক? তোর মতন গেঁজেল কুচরিত্রের হাতের পুজো খেতে খেতে কোনজন্মে মরে ভূত হয়ে গেছে মা। তোর শাপ আর ফলবে না। তবে হ্যাঁ, কোথাও যদি কণিকামাত্তর পদার্থ এখনো টিঁকে থাকে মা—র, তাহলে তুই এই অন্যাই উৎপীড়নের ফল পাবি পাবি পাবি!’

‘আচ্ছা!’ শিবেশ্বর আর একবার মাটিতে পা ঠুকে বলেন, ‘আচ্ছা, আমিও শিবেশ্বর পাঠক। মা ভৈরবীকালীর অনুরক্ত ভক্ত, আমিও দেখব তোর এই অহঙ্কারের প্রতিফল পাস কি না। হাতে হাতে ফল পাবি নোটো, তে—রাত্তিরের মধ্যে মুখে রক্ত উঠে মরবি। তোর এই ভিটেয় ঘুঘু চরবে, তোর বেটাবেটি শেয়াল—কুকুরের মতন পথে পথে ঘুরবে, আর তোর ওই কুলের ধ্বজা মেয়ে’—শিবেশ্বর একটা দম নেন। ‘থাক, সেই পাপ কথা আর মুখ দিয়ে উচ্চারণ করলাম না, শুধু বলে গেলাম হবে হবে হবে। তিনসন্ধ্যে গায়ত্রী না করে জল খাই না আমি, আমার শাপ না লেগে যাবে কোথায়?’

হঠাৎ এক কাণ্ড ঘটে, স্বর্ণর মা কনক এতক্ষণ অবধি ধৈর্য ধরে পাশের ঘরে বসে ঠক ঠক করে কাঁপছিল। বোধকরি আর ধৈর্য ধরতে পারে না; হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠে শিবেশ্বরের পায়ের কাছে আছড়ে পড়ে।

কথা বলার উপায় নেই, মেয়েমানুষ! শুধু কান্নাতেই যা করতে পারে।

শিবেশ্বর চলে যাচ্ছিলেন, আবার এই এক নতুন মজায় দাঁড়িয়ে পড়েন। ভাবটা যেন, কেমন রে নোটো, তুই অপমান করছিস, তোর পরিবার এসে পায়ে আছড়াচ্ছে। দেখ, দেখ এখন।

নোটো অবশ্য তার পরিবারের এই খেলোমি বরদাস্ত করতে পারে না, তীব্র স্বরে বলে ওঠে, ‘স্বর্ণ, তোর মাকে উঠিয়ে নিয়ে ও ঘরে যা।’

স্বর্ণ? স্বর্ণ নামের মানুষটা যে এখানে বসে রয়েছে, সে খেয়াল এতক্ষণ যেন ছিল না দুটো গোঁয়ার পুরুষের। এখন হল। স্বর্ণ বাপের ডাকে উঠে দাঁড়াল, মাকে তুলল না, স্পষ্ট চোখে শিবেশ্বরের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বাবা হাতে করে দিতে পারবে না জ্যেঠামশাই, তুমিই বরং একবাটি বিষ গুলে পাঠিয়ে দিও, খেয়ে পাপের শান্তি করে দিয়ে যাব।’

মাকে না তুলেই ও—ঘরে চলে যায় স্বর্ণ।

বলা বাহুল্য, মেয়ের এই নির্লজ্জতায় কনকের কান্না থেমে যায়।

‘মেয়ে তোর শিশু, তাই না রে নোটো?’ তীব্র একটা ব্যঙ্গহাসি হেসে হন হন করে বেরিয়ে যান শিবেশ্বর। আর তন্মুহূর্তেই নোটো হালদারই যেন বিষাহতের মত বিছানায় ঢলে পড়ে শিথিল গলায় খিঁচিয়ে ওঠে, ‘আর নাটক করতে হবে না মাগী, জল দে এক গেলাস।’

আকস্মিকতার আঘাতটা ক্রমশঃ পুরনো হয়ে আসে, ভিড় পাতলা হতে থাকে মন্দিরের, সকলেরই ক্রমে নিত্য সংসারের কাজগুলো পিঠে ছাট মারতে থাকে। ফিরতে থাকে ঘরের দিকে।

চন্দ্রাননীও ঘরে ফেরে, অনেক বেলায়। শিবেশ্বর যখন মন্দির থেকে গনগন করে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন তখন একবার প্রশ্ন করেছিল, ‘এখন মন্দির ছেড়ে যাচ্ছ কোথায়?’

শিবেশ্বর বলেছিলেন, ‘পাপ তাড়াতে!’

চন্দ্রাননী কতকটা আঁচ করেছিল। সঙ্গে সঙ্গে যাবারও ইচ্ছে হয়েছিল, কিন্তু সাহস হয়নি। বাড়ির মধ্যে রণচণ্ডী হলেও বাইরে তেমন সাহস হয় না। তবে সন্দেহ নাস্তি গন্তব্যস্থলটা নোটোর বাড়ি। ….ঈশ্বর জানেন, হারামজাদি ছুঁড়িটা ভাল মানুষ সর্বটাকে ছলনার জালে ভুলিয়ে নিয়ে গিয়ে কি করেছে মায়ের মন্দিরে।

ছেলের জন্যে মনটা উথলে উঠল চন্দ্রাননীর। আহা, সকাল থেকে কিছু খেতে পায়নি বাছা!

বলতে ভুল হয়েছিল। শুধু সপরিবার নোটো হালদারই নয়, মন্দিরের কৌতুক দেখতে আরো একজন বাকি ছিল, সে হচ্ছে সর্বেশ্বর।

মার খাওয়ার প্রতিক্রিয়ায় সর্বাঙ্গে পাকা ফোড়ার ব্যথা জন্মেছে সর্বেশ্বরের। বাপ মন্দিরে গেল দেখে একটা নিশ্চিন্ত শান্তির নিশ্বাস ফেলে পাশ ফিরে আর এক পালা ঘুমের সাধনা করছিল, এবং সে সাধনায় সফলও হয়েছিল।

হঠাৎ আগুনের হলকার মতন ওই সংবাদটা কানে ঢুকল। দুধ দোয়ানী গয়লাপিসি তার চাঁচাছোলা গলায় চন্দ্রাননীর কাছে ব্যাপারটা বিবৃত করছে।

সর্বেশ্বর প্রথমটা যেন ভাল বুঝতে পারল না, কান খাড়া করে সর্বেন্দ্রিয় দিয়ে বোঝবার চেষ্টা করল, তারপর বুঝতে পারল।

মা ভৈরবীকালী ভয়ঙ্কর কোন অভিশাপে উদ্যত হয়ে নিজের অঙ্গে নিজে আঘাত হেনেছেন। সে আঘাত স্পর্শ করেছে মা—র ঊর্ধ্বোত্থিত অভয় করে।

বীরপুরে সর্বনাশ আসন্ন।

শুনতে শুনতে সর্বেশ্বরের সমস্ত শরীর হিম হয়ে এল। এবং যখন গয়লাপিসি বলে উঠল ‘জানিনে বৌদি, কার পাপে এই ঘটনা,—’তখন আর সন্দেহ থাকে না সর্বেশ্বরের কার পাপে।’

আর কেউ নয়, সর্বেশ্বর। আর কিছু নয় সেই হাত ধরা।

বটঝুরি কুঞ্জে যে পাপ সহ্য হয়ে গিয়েছিল, মায়ের মন্দিরে পুণ্যস্থানে তা হল না। পরনারীর হাত ধরা কি সোজা পাপ?

কিন্তু স্বর্ণ কি পরনারী? পরনারী মানে কী? অপরের বৌ, তাই না?

স্বর্ণ কার বৌ?

অনেকক্ষণ ভাবল, তারপর ভাবল কারুর বৌ না হোক, সর্বেশ্বরেরও তো নয়। অথচ সর্বেশ্বর তার হাত ধরেছে। শুধু কি হাতই ধরেছে? মায়ের প্রসাদী বড় একগাছা গাঁদার মালা পরিয়ে দেয়নি স্বর্ণর গলায়?

স্বর্ণ বলেছিল, আর একটা থাকলে আমার কাজটাও মিটত।

সর্বেশ্বর ভয়ে ভয়ে বলেছিল, থাক থাক।

তারপরই তো পিছন থেকে কৃতান্তের দরশন। মালাটা কি তখন স্বর্ণর গলায় ছিল? কে জানে।

তবে মন্দিরে পাপ ঘটেছিল। ওই সব লীলাখেলা মন্দিরের মধ্যে করা উচিত হয়নি তাদের। কিন্তু এত পাপ ঘটল তাতে যে, মা অঙ্গহীন হলেন?

সর্বেশ্বর আর ভাবতে পারে না। সর্বেশ্বর আচ্ছন্নের মত পড়ে থাকে। হয়তো বা দেহের ব্যথায় আর খালি পেটের যন্ত্রণায় ঘুমিয়ে পড়ে।

অনেকক্ষণ পরে ঘুম ভাঙে মা—বাপের কলরোলে, নোটো হালদারের বাড়ির কাহিনীটি সবিস্তারে বিবৃত করছেন শিবেশ্বর কটু কাটব্যের সঙ্গে। অবশ্য কামারনী ঘটিত অংশটুকু বাদে। বাকিটায় বরং আরো রঙ চড়াচ্ছেন।

সর্বেশ্বর শুনতে থাকে। সর্বেশ্বর মা ভৈরবীকালীর কাছে এই মুহূর্তে মৃত্যু প্রার্থনা করে। কিন্তু মৃত্যু হয় না। বাপের শেষ কথাটা শুনতে পায় সর্বেশ্বর। ‘নোটাকে আমি দেশছাড়া করব এ তুমি দেখে নিও।’

কিন্তু শিবু পাঠকের অহঙ্কার কি বজায় থাকে? নোটো হালদারকে দেশছাড়া করবার গৌরব তার ভাগে পড়ে? পড়ে না।

নোটো হালদার নিজেই দেশ ছাড়ে।

মানুষের দেওয়া শাস্তিকে কলা দেখিয়ে নোটো পৃথিবী থেকেই বিদায় নেয়। তা’ সেখানে শিবুর ভূমিকা আছে। শিবুর অভিশাপেই তো—

কে তবে বলবে কলির ব্রাহ্মণ শক্তিহীন?

ফলল তো শিবু পাঠকের অভিশাপ। মরল তো নোটো তিন রাত্তিরের মধ্যে।

লোকে অবিশ্যি বলল সন্ন্যাস রোগ, কিন্তু কনক তো জানল অভিসম্পাতের ফল। শিবেশ্বরও ভাবল সে—কথা। মহোৎসাহে একবার চন্দ্রাননীর কাছে, আর একবার পদি কামারনীর কাছে সে নিজের সেই মহিমা প্রচার করল, তবে বলতে বারণ করে দিল আর কাউকে। যতই তেজ করে বলে আসুক পুরুষ পরশপাথর, তবু নিজের ছেলের নামটা জড়িয়ে আর মন্দির কলুষের কলুষ—কাহিনী রটিয়ে বেড়াল না।

অবশ্য চন্দ্রাননী আর পদি কামারনীর কথা আলাদা। তা’ ওরা এ নিষেধের মান রাখল। কুন্তীর উপর রাগে যুধিষ্ঠিরের যে অভিশাপ সমগ্র নারীজাতির উপর বর্ষিত হয়েছিল, সে অভিশাপও এখানে খাটল না। দুটো মেয়েমানুষই পেটে কথা রাখল।

চন্দ্রাননী রাখল নিজের ছেলের দুর্নাম রটার ভয়ে, আর পদি রাখল শিবু পাঠক কখন এই গোলকের গোপন কথাটি তার কাছে ফাঁস করে গেল, এ প্রশ্নের উত্তর দেবার ভয়ে। …ঢাকে ঢোলে কাঠি, উলু দিতে মানা!

পদির বর ভূষণো কামার যে রাতে বাড়ি থাকে না, অথচ পদির ঘর থেকে তামাক খাওয়ার শব্দ ওঠে, কামারপাড়ার কে না জানে একথা? পদি কামারনীর আঁচতলায় ছাঁচতলায় ঠাকুরমশাইয়ের ছায়াই বা কে না দেখেছে? খড়ম দেখেছে, কালী—নামাঙ্কিত নামাবলীর কোণ উড়তে দেখেছে, রাত দুপুরে পদির রান্নাঘর থেকে হাঁসের ডিম ভাজার গন্ধও পেয়েছে অনেকেই। কার্যকারণ মিলিয়ে আড়ালে হাসাহাসি করে সবাই, তবে পষ্টাপষ্টি বলা—কওয়া নেই। অতএব পদিকে মুখে তালাচাবি দিয়ে রাখতে হয়। নইলে কম গল্প তো শোনে না ঠাকুরমশাইয়ের কাছে।

যাক ওসব ছেঁড়া কথা, নোটো হালদার? সন্ন্যাসরোগেই মারা গেল, এটাই জানল সকলে এবং স্তব্ধ আতঙ্কে প্রহর গুনতে লাগল সর্বনাশ এবার আবার কার ঘরে ঢোকে। মায়ের মন্দিরের দুর্ঘটনার পরই এ—ঘটনা সবাইকে প্রত্যক্ষ দেখিয়ে দিল আশঙ্কা অমূলক নয়।

যাবে, বীরপুর গ্রাম ধ্বংস হয়ে যাবে, এ তো দেখাই যাচ্ছে। ‘এক পয়সার’ ভাগীদার নোটো হালদারকে দিয়েই শুরু।

আর একজন অবশ্য অভিসম্পাতের কথা চাপল, বুক চাপড়ে বলে বেড়াল না। কারণ কে জানে কোন কথায় কোন কথা বেরোবে, কেঁচো খুঁড়তে সাপ উঠবে। কথা চাপল কনক।

বোকা হাবা কনকও মেয়ের অপবাদের ভয়ে চালাক হল। তবে সন্দেহ নেই, পেটের মেয়ের উপরও বিশ্বাস হারিয়েছে সে। হোক মোটে এগারো বছরের, তবুও—

এগারো বছর বয়সের পাকামীর নজীরও যে নেই তা তো নয়! এই তো নোটো হালদারের নিজেরই মাসতুতো ভায়ের বেটার বৌ।

দশবছরের কচি বাচ্চা বৌটা ‘রোগা—রোগা’ বলে কোবরেজ এল, বলে গেল, বৌয়ের অন্য কিছু রোগ নেই, সন্তান—সম্ভবা।

কলিতে সবই সম্ভব।

শিবু পাঠকের অভিযোগ সম্পূর্ণ সত্যি। সত্যি না হলে উপরোউপরি দু—দুটো এতবড় দুর্ঘটনা ঘটে?

মেয়ের দিকে তাই তাকাতেই পারে না কনক, ভয়ে লজ্জায় ধিক্কারে।

আর স্বর্ণ? স্বর্ণর কথা বোঝা যায় না। স্বর্ণ যেন একদিনে দশবছর পার করে ফেলেছে। স্বর্ণর জানা জগতের বাইরের একরাশ শব্দ স্বর্ণকে প্রথমে দিশেহারা করেছে, তারপর ভয়ঙ্কর এক ভয়ের অন্ধকার গর্তে নিক্ষেপ করেছে।

অনেক আবছা জ্ঞান, অজানা রহস্য, সেই অন্ধকার থেকে আস্তে আস্তে মাথা তুলে দাঁত খিঁচিয়ে তাকায়। স্বর্ণ স্তম্ভিত হয়ে যায়।

স্বর্ণ দুর্দান্ত, স্বর্ণ দুঃসাহসী, স্বর্ণ পাকাচোকা মেয়ে, কিন্তু স্বর্ণর সেই পাকাত্ব কি ওই রহস্যের বার্তা জানত?

স্বর্ণ তাই চুপ হয়ে গেছে, গুম হয়ে গেছে। বাপের এই আকস্মিক মৃত্যুও তাকে এলোমেলো করে ফেলতে পারেনি। অথচ পাঁচদিন আগে যদি নোটো হালদার মরত, নির্ঘাত বীরপুরের সবাই টের পেত স্বর্ণর বাপ মরেছে।

নোটো হালদারের ছেলে নাবালক, কনকই নমো নমো করে কাজ সারল। তারপর একদিন স্বর্ণর মামা এসে স্বর্ণদের কুড়িয়ে বাড়িয়ে নিয়ে কালনায় না কাটোয়ায় কোথায় যেন ফিরে গেল। এমন কি সামান্য জমি—জমা যা ছিল তাও বেচে দিয়ে গেল।

অর্থাৎ হালদারের চিহ্নটুকু পর্যন্ত মুছে গেল বীরপুর থেকে। সমাপ্তি ঘটে গেল স্বর্ণর আর সর্বেশ্বরের বাল্য—লীলার।…

যাবার সময় দেখাটাও হয় না।

কালের খাতায় আঁচড় পড়ে চলে, কাঁচা চুলে পাক ধরে, কাঁথায় শোওয়া শিশুগুলো ডাং—গুলি খেলে, গাছে চড়ে।

বীরপুরের সেই ভয়ঙ্করের চাঞ্চল্যকর ঘটনার পর আর কোন নতুন ঘটনা নেই। স্তিমিত হয়ে গেছে দেশটা। যেন নোটো হালদারকে ‘বলি’ নিয়েই মা’র রোষ শান্তি হয়ে গেছে। দেশটাও তাই ঘুমিয়ে পড়েছে। যোগে—যাগে মায়ের মন্দিরে যাত্রী আসে অবশ্য, আগের থেকে বেশী বৈ কম নয়, গাজনের বাদ্যিতেও গগন ফাটে। রটন্তী চতুর্দশীতে মেলা বসে, মানতি পুজো শোধের বহরে হাঁড়িকাঠ রক্তে স্নান করে। তবু দেশের নাড়ির সঙ্গে যেন ক্রমশঃই ভৈরবীকালীর যোগ কমে যাচ্ছে।

তার কারণ পূজুরীদের বোলবোলাওটা ঘুচেছে। নোটো হালদার বছরে একদিনের ভাগীদার ছিল, কিন্তু নোটোর ডাক—হাঁকে মন্দির সরগরম থাকত। শিবেশ্বর তো তারে বাড়া, এখন শিবেশ্বর বাতের ব্যথায় প্রায় উত্থানশক্তিরহিত, কাজ চালায় সর্বেশ্বর যো—সো করে, বাপের মত রমরমা নেই তার কাজের।

বলির সময় যে ‘মা মা’ করে গগনভেদী চিৎকার করতে হয়, একথা জানে না সর্বেশ্বর। তা ছাড়া ছোঁড়া যেন জন্মদুঃখী। দু—দুবার বিয়ে হল, দুটো বৌয়ের একটাও টিঁকল না। একটা ছেলে—মেয়েও রেখে গেল না কেউ স্মৃতিচিহ্ন স্বরূপ।

চন্দ্রাননী আবার মেয়ে দেখাদেখি করছে। তবে সর্বেশ্বর বাধা দিচ্ছে। বলছে, ‘আর কেন মা, বেশ তো আছি। দেখলে তো ভাগ্যে সইল না?’ তাই তেমন তোড়জোড় নেই। তা ছাড়া পাঠকদের সঙ্গে কুল মেলা ঘর জোটা বড় দুর্লভ।

সম্প্রতি কলকাতায় কালীঘাটের সেবাইত হালদারদের বাড়িতে একটা সম্বন্ধ চলছে, মেয়েটা দেখতে সুবিধের না হলেও অন্য সুবিধে বিস্তর। বাপের একমাত্র মেয়ে, ভাই নেই, কাজেই বাপের সম্পত্তির ষোল আনার মালিক। সে প্রায় রাজার ঐশ্বর্য্য।

মেয়ের রূপের অভাবেই তারা তেজবরে বরের সঙ্গে কথা চালাচ্ছে। রঙ মা কালী, একটা পা টেনে চলে।

সর্বেশ্বর আগে শোনেনি, যেদিন শুনল স্তম্ভিত হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, ‘হালদার! হালদারদের বাড়ি! তাহলে নোটোকাকা কোন অপরাধে মুখে রক্ত উঠে মরেছিলেন মা?’

চন্দ্রাননী প্রথমটা থতমত খেয়েছিল বৈকি। কারণ ঘটকের মুখে হালদার শব্দটা শোনামাত্রই তো অনেক স্মৃতিকথা, অনেক ইতিহাস উথলে উঠেছিল। তবে ভেবেছিল সর্ব অত খেয়াল করবে না। দশ বারো বছর আগের কথা কি আর মনে গেঁথে রেখে দিয়েছে সর্ব?

দেখল গেঁথে রেখে দিয়েছে। তবে প্রথমটা থতমত খেয়েই পরক্ষণে ধমকে ওঠে, ‘নোটোকাকা! নোটোকাকার কথা তুলছিস? তার মানে সেই লক্ষ্মীছাড়ী স্বর্ণর কথা এখনো মনে রেখেছিস? হায়া হল না তোর সর্ব, লজ্জা করল না সেই পাপিষ্ঠির বাপের নাম মুখে আনতে? যে মেয়ে কুলের কলঙ্ক, বংশের কলঙ্ক, বীরপুর গাঁয়ের কলঙ্ক!’

তা’ কথাটা মিথ্যে নয়। সর্বকে তাই মাথা হেঁট করতে হয়েছে।

কানাঘুসো নয়, লোকমুখে পাকা খবর এসেছে এখানে। স্বর্ণর গরীব মামা অতগুলো নতুন ‘হাঁ’ নিয়ে গিয়েও চেষ্টা—যত্ন করে ভাগ্নীটার বিয়ে দিয়েছিল। বলতে কি ভালই দিয়েছিল। রূপটা তো আছে? কিন্তু ওই রূপই কাল। সর্বনাশী মেয়ে ঘর—বর ছেড়ে কুলত্যাগ করে চলে গেছে।

ওই মেয়ে ঘাড়ে চাপতে আসছিল চন্দ্রাননীর। উঃ! ও মেয়ের হাড়ে মজ্জায় কুকাজের নেশা। উঃ কতজন্মের পুণ্যফল ছিল সর্বর যে ওই কুচরিত্র মেয়েটার সঙ্গে বিয়ে ঘটেনি। ঘটেনি, হালদারদের সঙ্গে তাদের করণকারণ হয় না বলেই না? তবে এখন?

এখন? চন্দ্রাননী বড় গলায় বলে, ‘কিসেয় আর ‘কিসেয় সোনায় আর সীসেয়! ওদের সঙ্গে এরা? এরা কতবড় উঁচু বংশ! কালীঘাটের কালীর পূজুরী। তাছাড়া অবস্থায় রাজা জমিদার বললেই হয়।’

ঘটকের অত্যুক্তির ফলে এই রকমই বলে চন্দ্রাননী।

সর্বেশ্বর আর কত বলবে? যা বলেছে তাই ঢের। বাল্যসখীর এই শোচনীয় পরিণামের খবরে সর্বেশ্বরই যেন লজ্জায় মরমে মরে গিয়েছিল। আর কিছু বলতে পারল না সর্বেশ্বর।

অনেক সময় স্বর্ণর মুখটা মনে করবার চেষ্টা করে সর্বেশ্বর। কিন্তু কেমন যেন ঝাপসা হয়ে যায়। ঠিক ঠিক রেখাগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে না। শুধু এক টুকরো রঙই মাঝে মাঝে চোখে ভেসে ওঠে। কখনো একটু হাতের অংশ, কখনো কপাল, কখনো চিবুক কণ্ঠা গলা। কখনো পায়ের পাতা, কাঁধের কোণ। এক টুকরো ফর্সা ধবধবে রঙ।… রেখাগুলো ধরা দেয় না কেন? খারাপ হয়ে গিয়ে, অসতী হয়ে গিয়ে স্বর্ণ কি সব রেখা হারিয়ে ফেলেছে?

চৈত্রমাস পড়ায় বিয়ের কথা স্থগিত আছে। গাজনের উৎসবের ধুম পড়েছে। সেই নিয়ে মন্দিরের কাজ বেড়েছে। সর্বেশ্বর তাই একটু ব্যস্ত।

আজ সংক্রান্তির আগের দিন, নীলপুজো। যাত্রী আসছে অসংখ্য, ডাবের পাহাড় পড়েছে নাট—মন্দিরের চাতালে, সর্বেশ্বর মন্দিরের মধ্যে। একজন সহকারী পাণ্ডা যাত্রীদের হাত থেকে পুজো নিচ্ছে আর মন্দিরে চালান দিচ্ছে। চালান দিচ্ছে আবার মুহূর্তে বার করে নিয়ে আসছে।

হঠাৎ একজনের প্রশ্নে থতমত খেল লোকটা। সুরেলা মেয়েলী গলায় একজন ব্যঙ্গহাসির সঙ্গে প্রশ্ন করল, ‘মা—র সামনে ধরছ আর কেড়ে নিচ্ছ পাণ্ডাঠাকুর, মাকে খেতে অবসর দিচ্ছ কই?’

গলাটা কার? এমন মাজা—ঘষা সুরেলা। সর্বেশ্বর চমকে বাইরে চোখ ফেলল। ঠেসাঠেসি ভিড়ের মধ্যে বুঝতে পারল না।

কত মেয়ে, কত পুরুষ, কত তরুণী, কত বৃদ্ধা! পাণ্ডার জবাবী গলাটা শুনতে পেল সর্বেশ্বর, ‘মা—র কি আর খেতে সময় লাগে দিদিমণি? মা হচ্ছেন ব্রহ্মাণ্ডভাণ্ডোদরী! লহমায় খান।’

‘হুঁ, তাই দেখছি। তা’ মায়ের একটা হাতের চেটো সোনার কেন? কেউ মানত করেছিল বুঝি, সোনা দিয়ে হাত বাঁধিয়ে দেবে মা—র?’

সর্বেশ্বর আর পাণ্ডার উত্তরের দিকে কান পাতে না। সর্বেশ্বরের খেয়াল থাকে না এই মুহূর্তে সে কি করেছিল।

সর্বেশ্বর মন্ত্রাহতের মত মন্দির থেকে বেরিয়ে আসে। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে অগণিত মুণ্ডের সারির মধ্যে চোখ ফেলে দেখতে চেষ্টা করে কোথা থেকে উঠে এল ওই সুর।

কিন্তু কি করে বোঝা যাবে? কত সুর, কত স্বর, কত রোল! অথচ উদভ্রান্ত হয়ে খুঁজে বেড়াবারই বা অবকাশ কোথায়? লোকের পর লোক আসছে, চিনি সন্দেশের ঠোঙা এগিয়ে ধরে তাড়া লাগাচ্ছে, ‘ঠাকুরমশাই আমারটা আগে।’

কাজের ধাক্কায় আবার সেই তিন সিঁড়ি নীচু অন্ধকার গর্ভগৃহের মধ্যে ঢুকে পড়তে হয় সর্বেশ্বরকে, কাজের স্রোতে হাবুডুবু খেতে হয়। চিনি সন্দেশের ঠোঙা মায়ের দিকে এগিয়ে দিতে হয়। অসংখ্য পাতা হাতের উপর চরণামৃত দিতে হয় রূপোর কুশী করে ঢেলে ঢেলে।

প্রণামীর পয়সা আনি দুয়ানি সিকি যে যেমন ইচ্ছে ছুঁড়ে দিচ্ছে মায়ের চরণ লক্ষ্য করে, সে সব হাতড়ে হাতড়ে জড় করতে হয়। আর একবার বেরিয়ে পড়ে দেখবার অবকাশ মেলে না সুরের উৎসটা কোথায়।

তবু সেই সুর সেই হাসি যেন অবিরাম ধ্বনিতে সর্বেশ্বরের মাথার মধ্যে রিমঝিম করে বাজতে থাকে, আর সারা শরীরে প্রবাহিত রক্তের মধ্যে ভয়ানক একটা আক্ষেপ ওঠে।

যে এই হাসি—কথায় আগুন ছড়িয়ে গেল, সে কেন মন্দিরের দরজায় এল না? অথবা এসেছিল, সর্বেশ্বর তাকিয়ে দেখেনি। দুটোতেই আক্ষেপ।

আজ আর দুপুরের পর ভিড় কমার কোন উপায় নেই, উত্তোরত্তর বেড়েই চলেছে। সন্ধ্যাপুজোর ভিড়ই বেশি। মন্দিরধারে ভৈরব শিবের ছোট্ট দরজায় খুনোখুনি কাণ্ড চলছে। বাড়তি পূজুরী দু’জনকে নেওয়া হয় এ—সব দিনে, আজও হয়েছে। বিকেলের দিকে একবার তাদেরই একজনের ওপর ভার ঠেকিয়ে মন্দিরের বাইরে বেরিয়ে এল গলদঘর্ম সর্বেশ্বর। ভেবেছিল মন্দিরের পুকুরেই একবার ডুব দিয়ে নেবে, কিন্তু সে দিকে পা বাড়াবার জো নেই। কোন দিকেই কি আছে? যাত্রীর ভিড়ে সর্বত্রই নরককুণ্ড। পুকুর পাড়ে ছেঁড়া শালপাতা আর ভাঙা মাটির ভাঁড়ের যা স্তূপ হয়েছে তা’ একত্রে জমালে পাহাড়। সর্বেশ্বর দ্রুত পায়ে বাড়ির দিকেই পা চালাল। একবার মাথায় দু’ ঘড়া জল আর গলায় একবাটি চিনির পানা ঢেলে নিতে পারলেই আবার সারারাত যুঝতে পারা যাবে।

নির্জন কোথাও নেই। মাঠের মাঝখানেই জায়গায় জায়গায় ঝুপড়ি বসেছে, ঝুরিনামা বটগাছটাকে ঘিরে বসেছে মেলার বাজার।

পাশ কাটিয়ে চলতে চলতে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়তে হল সর্বেশ্বরকে—সেই স্বর না? কাকে কি বলছে? তাকেই নাকি? কি বলছে যেন?

‘হনহনিয়ে চললে কোথায় গো ঠাকুরমশাই?’

সর্বেশ্বর সামনে পিছনে তাকাল, দেখতে পাচ্ছে না তো কে এই গলায় ডাক দিচ্ছে। স্বপ্ন, না মায়া, না মতিভ্রম?

সর্বেশ্বর নিজেকে ধিক্কার দিল। মাথায় ভূত চেপেছে তার, পেত্নীতে পেয়েছে। তাই মাঠের মাঝখানে অলৌকিক স্বর শুনছে। দ্রুত পা চালাল। পিছনে একটা হাসি শুনতে পাচ্ছে, বাচাল বাচাল হাসি।

বাড়ি ফিরে তোলা জল দু ঘড়া মাথায় ঢেলে, আর এক গেলাস জোলো চিনির শরবৎ খেয়ে ফের যখন ফিরল সর্বেশ্বর, তখনো বেলা আছে। চৈত্রের পড়ন্ত বেলায় অপরূপ আলো আর অনির্বচনীয় বাতাস দেহ—মন—চোখ সব জুড়িয়ে দিচ্ছে। স্নানস্নিগ্ধ সর্বেশ্বর ভূত পেত্নীর চিন্তা ত্যাগ করে সন্ধ্যে—পুজোর মোহড়া সামলানোর চিন্তা করতে করতে যাচ্ছিল।

বাবুদের বাড়ি থেকে বিরাট পুজো আসে আজ ভৈরব—শিবের তলায়, সেখানে মূল পূজারী না থাকলে মাঠাকরুণ রুষ্ট হন, ওদিকে মায়ের মন্দিরে—

হঠাৎ আবার শরীরের সমস্ত রক্ত নিশ্চল হয়ে গেল সর্বেশ্বরের। যে চিন্তা ত্যাগ করেছিল, সেটাই মূর্তি ধরে সামনে এসে দাঁড়াল। তীক্ষ্ন হাসি হেসে বলল, ‘ঠাকুরমশাই যে বড় ব্যস্ত দেখছি।’

কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে সর্বেশ্বর অস্ফুট গলায় উচ্চারণ করল, ‘স্বর্ণ!’

‘যাক, তবু চিনতে পারলে!’ স্বর্ণ একটু ভ্রু—ভঙ্গী করল, ‘তখন তো ডাক শুনে ভূতে তাড়া খাওয়ার মত ছুটলে।’

সর্বেশ্বর শুকনো গলায় বলে, ‘তা কেন, কাজের তাড়ায়। কবে এসেছ?’

‘কবে মানে? আজই তো।’

‘কাকীমা এসেছেন? কেমন যেন বেভুলের মত প্রশ্নটা করে বসে সর্বেশ্বর।

‘কাকীমা!’ স্বর্ণ ভুরুটা আরো কুঁচকে বলে ‘মা—র কথা বলছ? তুমি তাহলে সেই অবধি আমার কোন খবরই রাখনি আর?’

সর্বেশ্বর এবার ঈষৎ আত্মস্থ হয়। সর্বেশ্বর জোর দিয়ে বলে, ‘রাখব না কেন? সবই রেখেছি। কীর্তি কি কখনো চাপা থাকে?’

‘ও, তাও তো বটে।’ স্বর্ণ ব্যঙ্গের সুরে বলে, ‘তবে আর কাকীমার প্রশ্ন কেন?’

সর্বেশ্বর যে চট করে একটা উত্তর খুঁজে পায় এটা আশ্চয্যি। এটা তার ধাত নয়। তবু আজ হঠাৎ সঙ্গেসঙ্গেই বলে ওঠে, ‘সে প্রশ্ন করেছি তোমার সাহস দেখে। বীরপুরে এসে মুখ দেখাচ্ছ, বড় গলায় কথা কইছ, হাসছ, ভাবলাম সুপথে ফিরেছ।’

স্বর্ণর সেই গভীর কালো চোখ দুটোয় হঠাৎ যেন ধ্বকধ্বক করে দুডেলা আগুন জ্বলে ওঠে, আর আগুনের গলাতেই বলে ওঠে সে, ‘ওঃ, তাই বুঝি? তাই ভাবলে? এই মাত্তর পৃথিবীতে পড়লে? মেয়েমানুষ কুপথ থেকে সুপথে ফিরতে চাইলেই সুপথ তাকে সুড় সুড় করে পথ ছেড়ে দেয় কেমন?’

সর্বেশ্বর ঠাকুর—মন্দিরে থেকে থেকে দু—চারটে ধর্ম কথা শিখে ফেলেছে, তাই বলে, ‘অনুতাপের পথ সবাইয়ের জন্যেই খোলা।’

‘অনুতাপ! ওঃ!’ স্বর্ণ ধিক্কারের গলায় বলে, ‘কে বলেছে তোমায় আমি অনুতাপে দগ্ধ হচ্ছি? কিসের অনুতাপ? কুপথ তো আমি ইচ্ছে করে বেছে নিয়েছি জেনে বুঝে।’

‘জেনে বুঝে?’

‘তবে না তো কি?’

সর্বেশ্বর এবার নরম আর কাতর গলায় বলে, ‘ও—কথা বলে নিজের ওপর ঝাল ঝাড়ছ স্বর্ণ বুঝতে পারছি। স্বামী মাতাল গোঁয়ার অত্যাচারী হলে ক’টা মেয়েমানুষ—’

‘কে বললে আমার স্বামী মাতাল গোঁয়ার অত্যাচারী?’ স্বর্ণ দৃপ্তস্বরে বলে, ‘মামা যার সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিল আমার, সমাজ যাকে আমার স্বামী বলে পরিচয় দিয়েছে, সে লোক খুব মহৎ, খুব ভাল।’

সর্বেশ্বর স্খলিত বচনে বলে, ‘তবে?’

‘তবে?’ স্বর্ণ সাপিনীর মতন ফোঁস করে ওঠে, ‘তবে? বুঝতে পারনি তবেটা কি? সমাজ তাকে আমার স্বামী বলেছে বলেই সে আমার স্বামী? জগতে সত্যি অসত্যি নেই? পরপুরুষের ঘর করব আমি?’ হঠাৎ উল্টোমুখো ফিরে হনহন করে মাঠের মাঝখান দিয়ে এগিয়ে যায় স্বর্ণ সেই ঝুরি বটতলার দিকে।

ওইখানেই তাহলে আস্তানা নিয়েছে। কিন্তু কী সব বলে গেল স্বর্ণ? প্রহেলিকার মত লাগছে। পর পুরুষটা কে? নিজেই তো কুলত্যাগ করেছে। কার ঘর করছে তবে?

এতক্ষণে ভাবতে চেষ্টা করে সর্বেশ্বর স্বর্ণর বেশ—ভুষাটা কি ছিল। পরনে গেরুয়া না? উভোঝুঁটি করে বাঁধা রুক্ষু কেশের তাল, গলায় স্ফটিক না রুদ্রাক্ষের মালা কতকগুলো, হাতে দণ্ডী! হ্যাঁ, তাই! তখন চোখে পড়েনি, তখন শুধু স্বর্ণ নামের অবয়বটা সর্বেশ্বরের সমস্ত চৈতন্যকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল।

এই সাজ ছিল স্বর্ণর। কিন্তু এ কি শুধু গাজনের দণ্ডীর সাজ, না বরাবরের সাজ? স্বর্ণ কি তাহলে কুলত্যাগ করেছে পরম দেবতার উদ্দেশ্যে? লোকে সেই কুলত্যাগকে কুৎসিত চেহারা দিয়ে নিন্দে রটিয়েছে?

কিন্তু তা যদি হয়, স্বর্ণ নিজমুখে কেন বলল, ইচ্ছে করে কুপথ বেছে নিয়েছি।

হায় ভগবান, এমন দিনে আর এমন পরিস্থিতিতে দেখা হল স্বর্ণর সঙ্গে। কে জানে ক’দিন থাকবে!

কাল সংক্রান্তি, কাল তো বাণ—ফোঁড়াফুঁড়ি কাণ্ড। কাল কি আর পাওয়া যাবে ওকে? পরশুই হয়তো চলে যাবে।

কিন্তু এত দেশ থাকতে বীরপুরেই বা আসতে ইচ্ছে করল কেন স্বর্ণর গাজন—উৎসবের উদযাপন করতে?

মন্দিরের দিক থেকে তুমুল কলরোল আসছিল, বোঝা যাচ্ছে না, শুধুই মারপিট হচ্ছে, না খুনোখুনি হচ্ছে?

মারপিটটা হয়। বড় যোগ—যাগ মাত্রেই হয়, গাজনের সময় তো হয়ই। সেটা গা—সহা। খুনোখুনি না হলেই মঙ্গল। সর্বেশ্বর সমুদ্রতাড়িত ঝরা পাতার মত শব্দ—তরঙ্গে তাড়িত হয়ে এগিয়ে যায়।

এবং সমস্ত ঘৃণা, সমস্ত বিস্ময়, সমস্ত অস্বস্তি ছাপিয়ে মনের মধ্যে একটি কথা বাজতে থাকে—স্বর্ণ এসেছে। স্বর্ণ এসেছে।

কিন্তু কোথায় উঠেছে স্বর্ণ?

পরদিন জানা গেল কোথায় উঠেছে স্বর্ণ। ঘৃণায় লজ্জায় দীর্ণ—বিদীর্ণ হয়ে মাথা হেঁট করে ফিরে গেল সর্বেশ্বর, কোথায় উঠেছে স্বর্ণ সে—কথা টের পেয়ে।

মাঠের ও—প্রান্তে মেলার বাজারের শেষ সীমা বরাবর যে খারাপ মেয়েমানুষের একটা দল গাজনের সন্ন্যাসিনী হয়ে এসে আড্ডা গাড়ে, এবারেও সেই দলটা এসে আড্ডা গেড়েছে। স্বর্ণ আছে সেই দলে। তার মানে স্বর্ণ নাম—লেখানো খারাপ।

সর্বেশ্বরের মনে হল, পৃথিবী দ্বিধা হও। এ খবর শোনার পর তিলার্ধ আর বাঁচতে সাধ থাকে না সর্বেশ্বর পাঠকের। সেই স্বর্ণ! সেই চঞ্চল দুষ্টু ডাকাবুকো স্বর্ণ! তার এই পরিণতি! এই জন্যেই মা বলেছিল ও জন্মপাপী।

জন্মপাপী না হলে ভাল স্বামীর হাতে পড়ে—

হঠাৎ চোখদুটো জ্বালা করে আসে সর্বেশ্বরের।

সর্বেশ্বরই না বলেছিল, ইহজন্মে পরজন্মে আমরা পতি—পত্নী। এখন মা—বাপ হালদারদের মেয়ে ঘরে আনতে চাইছে। তখন যদি এ সুমতি হত, হয়তো স্বর্ণর এমন পরিণাম হত না। এই বীরপুরে মা ভৈরবীকালীর থানে পড়ে থাকতে পেলে কেমন সে জন্মপাপীর মূর্তি দেখাত, দেখতাম।

চেলির কাপড়ের কোণে চোখ মুছতে মুছতে তাড়াতাড়ি গিয়ে মায়ের মন্দিরে ঢোকে সর্বেশ্বর।

দুদিন মহাহুল্লোড়ের পর আজ সব নিথর—নিথর। গাজনের দল প্রায় সকলেই বিদায় হয়েছে। কেউ কেউ মেলাতলার আকর্ষণে রয়ে গেছে গেরুয়া বিসর্জন দেওয়ার পরেও।

স্বর্ণর দল যায়নি। আসার সময় দেখে এসেছে সর্বেশ্বর নদীর পাড় থেকে। ওদের ঝুপড়ি থেকে হাসি—হুল্লোড়, উনুনের ধোঁয়া, রান্নার সুবাস—অনেক কিছুই উঠছে। আজ খাওয়ার ঘটা। এতদিনের কৃচ্ছ্বসাধনের শোধ তুলবে সবাই।

আশ্চর্য, ওই খারাপ মেয়েগুলোর দলে স্বর্ণ আছে? হয়তো স্বর্ণও ওদের সঙ্গে বিড়ি খাচ্ছে, মুখে খড়ি মাখছে!

হঠাৎ বোধ করি অজ্ঞাতসারেই সর্বেশ্বর নিজের মাথায় গঙ্গাজল ছিটোয়। কেন তা জানে না। কিন্তু ছিটোনোর সঙ্গে সঙ্গে ছিটকে আসে সেই হাসি। ‘কী হল ঠাকুরমশাই, খামোকা মাথায় গঙ্গাজল ছিটোচ্ছ কেন? পরনারীর চিন্তা করছিলে বুঝি ভুলে ভুলে?’

সর্বেশ্বরের বুক কেঁপে ওঠে। সর্বেশ্বর একবার চারিদিকটা তাকিয়ে দেখে। মন্দিরের দিক এই সন্ধ্যাতেই প্রায় জনশূন্য। ব্রতীরা খাওয়া মাখায় ব্যস্ত, যাত্রীরা মেলার বাজারের কেনা—কাটায় ব্যস্ত। ভাঙা মেলা আরো ক’দিন থাকলেও মূল মেলা আগামী কাল অবধি। সারা বছর ধরে গ্রামের লোক এই মেলাটার প্রতীক্ষাতেই থাকে।

অতএব সহজে কেউ এদিকে আসছে না। তবু বুক কাঁপে সর্বেশ্বরের। স্বল্পালোকিত দালানের কোণে যে মানুষটা একটা থামে ঠেস দিয়ে বসে আছে, সে যেন একটা সর্বনাশের সম্ভাবনা নিয়ে এসে হাজির হয়েছে।

দেবীর যেদিন অঙ্গ—হানি ঘটেছিল, বীরপুরের সবাইয়ের প্রাণের মধ্যে এমনি সর্বনাশের ইশারা এসে পৌঁছেছিল। আর ওই দালানে ওই থামটার সামনেই।

সর্বেশ্বর ছটফটিয়ে উঠে এল। বলল, ‘অসময়ে এখানে কেন?’

‘মায়ের মন্দিরের আবার সময় অসময় কি?’ তেমনি নির্লিপ্ত ভাবে ঠেস দিয়ে বসে থেকে বলে স্বর্ণ।

‘বাঃ, সময় অসময় নেই? সবাই চলে গেল—’

স্বর্ণ তেমনি স্তিমিত গলায় বলে, ‘সবাইয়ের সঙ্গে আমার কি? স্বর্ণর চোখটা কি বোজা?

সর্বেশ্বর অসহায় সুরে বলে, ‘লোকে নিন্দে করতে পারে—’

ঝপ করে খাড়া হয়ে বসে স্বর্ণ। শিথিলতা ত্যাগ করে নিজস্ব ব্যঙ্গের গলায় বলে ওঠে, ‘নিন্দে? আমার আবার নিন্দে কি? বলে সমুদ্রে পেতেছি শয্যে, গোস্পদে কি ডর! খারাপ মেয়েমানুষের আবার কিছুতে নিন্দে হয় নাকি গো ঠাকুরমশাই?’

সর্বেশ্বরের অসহায়তা ঘোচে। সর্বেশ্বর তীব্রস্বরে বলে, ‘তা তোমার সে ভয় না থাকে, আমার তো আছে!’

‘মিথ্যে কথা!’ স্বর্ণ সহসা দাঁড়িয়ে ওঠে।

আর এতক্ষণে চোখ পড়ে সর্বেশ্বরের, স্বর্ণ ব্রতশেষে গৈরিক ত্যাগ করেনি। আধা—অন্ধকারে গেরুয়ার পরিমণ্ডলে স্বর্ণর মুখটা যেন জ্বলছে, আর দপদপ করছে চোখ দুটো। সেই চোখে যেন সর্বেশ্বরকে ভস্ম করে ফেলার আগুন।

‘মিথ্যে কথা ঠাকুর মশাই! তোমাদের আবার নিন্দের ভয়! কেন, ছোটবেলা থেকে এ শিক্ষা পাওনি পুরুষ পরশ—পাথর? তার গায়ে পাপ স্পর্শ করে না!’

সর্বেশ্বর গম্ভীর ভাবে বলে, ‘এ—কথা কে বলেছে তোমায়? পাপ হচ্ছে আগুন। আগুন কি মেয়ে পুরুষ বাছে?’

‘বাছে বৈকি!’ স্বর্ণ তেতো গলায় বলে, ‘বাছে না? জান না? দেখনি নীচু বামুনের ঘরের মেয়ে আনতে যাদের জাত যায়, নীচু জাতের ঘরে গিয়ে তাদের সঙ্গে থালায় খেতে, এক বিছানায় শুতে জাত যায় না? দেখনি কামারের উঠোন ডিঙিয়ে এসেই মায়ের মন্দিরে আসন করে ‘অপবিত্র পবিত্রো বা’ করে ভোগ নিবেদন করতে? পুরুষের আবার নিন্দে! হাসালে তুমি সর্বদা!’

হি হি করে আবার সেই বাচাল হাসি হাসতে থাকে স্বর্ণ।

সর্বেশ্বরের পা দুটো কাঁপতে থাকে। সর্বেশ্বর রুদ্ধ গলায় বলে, ‘গুরুজনের কথা নিয়ে তামাশা কোরো না স্বর্ণ!’

‘তামাশা করব কেন গো? হক কথাটা বলছি। তুমি ভয়ে কাঁটা হচ্ছ কিনা নিন্দে হবে ভেবে, তাই চৈতন্য করাচ্ছি।’

‘আমার চৈতন্যে দরকার নেই।’ সর্বেশ্বর বলে, ‘তুমি যাও!’

‘কেন, ভয় করছে?’

‘করছে স্বর্ণ, করছে। যাও তুমি।’

‘যাব কি গো!’ স্বর্ণ তেমনি হাসির সঙ্গে বলে, ‘নির্জনে আমায় দেখলে এখনো তোমার ভয় করে, এ কি কম আহ্লাদের কথা? খবর নিলাম, দু—দুবার মালাবদল করেছ, টেঁকেনি। ভাবতে ইচ্ছে করছে—গেছে তোমার কারসাজিতে। বিষ—টিষ দাওনি তো গো? মেয়েমানুষ অসুবিধে ঘটালে ও জিনিসটার ব্যাভার মন্দ নয়। ঝামেলা মেটে।’

সর্বেশ্বর বিচলিত গলায় বলে, ‘বাবা তোমার জন্যে বিষের ব্যবস্থা করেছিল, সে—কথা শুনেছিলাম স্বর্ণ, কিন্তু সে তো ভৈরবীকালীর কোপ—শান্তির জন্যে।’

‘ওঃ, তা বটে! বীরপুরের তা—বড় তা—বড় বীরেরা পার পেয়ে গেল, মায়ের কোপশান্তির জন্যে কোপ দিতে হল নিরীহ নিরপরাধ অবোধ বাচ্চা একটা মেয়ের ওপর!

সর্বেশ্বর ক্লান্ত সুরে বলে, ‘তোমার সঙ্গে আমিও পাপী, তাই বলি নিরপরাধ কি করে বলি? মায়ের মন্দিরে দাঁড়িয়ে হাত—ধরাধরি করেছি আমরা, ভালবাসার কথা কয়েছি, শুভদৃষ্টি করেছি—’

‘হি হি হি!’ স্বর্ণ হেসে উঠে বলে, ‘হায় হায়, এখনো দেখছি সেই বালকটাই আছ তুমি সর্বদা! দু—দুবার তো বিয়েও হয়েছিল, জগতের কিছুই শেখনি? মায়ের মন্দিরে কত কীর্তি ঘটছে—’

সর্বেশ্বর রুদ্ধস্বরে বলে, ‘কিন্তু দেখলে তো পষ্ট, মা কুপিত হয়ে—’

‘কী? রাগের চোটে আঙুল মটকে গাল দিতে গিয়ে আঙুলগুলো মটমটিয়ে ভাঙল মা?’ স্বর্ণ আরো হি হি করে হাসে, ‘বলিহারী বুদ্ধি সব! মা ভৈরবীকালীর হাতের চেটো কে ভেঙে দূর করে দিয়েছিল জান সর্বদা? এই স্বর্ণ পোড়ারমুখী।’

‘কী! কী! কী বললে?’ সর্বেশ্বর বসে পড়ে। মাথাটা দেয়ালে ঠেকিয়ে শুয়ে পড়াটা থেকে রক্ষা করে নিজেকে। আর্তচিৎকারে আবার বলে ওঠে, ‘স্বর্ণ!’

‘সর্বনাশ! তুমি যে একেবারে হাত—পা ছেড়ে দিলে গো! আশ্চয্যি যে এতগুলো মাথা দেশের, কারুর একটু সন্দেহও হয়নি?’

সর্বেশ্বর ঝিমোনো গলায় বলে, ‘সন্দেহের অতীত বস্তু, সন্দেহ হবে কেন? স্বর্ণ, আমার মন নিচ্ছে এ তোমার মিথ্যে অহঙ্কারের কথা।’

‘দেখ সর্বদা, স্বর্ণ পাপিষ্ঠী, কিন্তু স্বর্ণ মিথ্যুক নয়। মায়ের ওপর অভিমানে আক্রোশে ডান হাতখানা মুচড়ে ভেঙে দিতে গিয়েছিলাম। পেরে উঠলাম না, নাবালকের জোর বৈ তো নয়! শুধু আঙুল ক’টা সমেত ‘অভয় কর’ না কি মটকে ভেঙে এল।’

সর্বেশ্বর স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আশ্চর্য! ভয় করল না?’

‘ভয়? কই, মনে পড়ছে না তো। অবোধের রাগ আর কি! কাণ্ডজ্ঞানহারা! মা কালীর ওপর বড্ড ভরসা করেছিলাম, বাপের হাতে প্রহার খেয়ে সে ভরসার খেসারৎ দিতে হল। বললাম, ‘কিছুই যদি পারিস না তো দরকার কি অমন হাতে? দেব মুচড়ে ভেঙে।’

সর্বেশ্বরের গায়ে তখনো মুহুর্মুহু কাঁটা দিচ্ছিল। তবু উদাস গলায় বলে সে, ‘হাতে হাতে তার শাস্তিও পেলে। অবোধ বলে মা কি ছেড়ে দিলেন? তে—রাত্তিরের মধ্যে পিতৃহারা হলে!’

স্বর্ণ একটু ঘৃণার হাসি হেসে বলে, ‘পিতৃহারা আমি মায়ের শাস্তিতে হইনি সর্বদা, হয়েছি তোমার পিতৃদেবের মহিমায়। তেনার কটুকাটব্যের চোটে বাবার মাথার রক্ত টগবগিয়ে উঠল, ঘাড়ের শিরটা গেল ছিঁড়ে—’

বাচাল খারাপ স্বর্ণর গলাটা হঠাৎ বুজে আসে।

‘স্বর্ণ!’ সহসা আর এক সর্বেশ্বর মৃদু রুদ্ধ গলায় বলে, ‘মাঠের ভিড় তো ফুরিয়ে গেছে, আমাদের সেই জায়গাটায় একবার গিয়ে বসা যায় না? কত কথা জমে ছিল, কত কথা বলবার ছিল—’

‘সত্যিই কি ছিল ঠাকুরমশাই?’ স্বর্ণ বিদ্রুপের হাসি হেসে বলে, ‘না কি এখন সন্ধ্যেকালে, নির্জন স্থানে সুন্দুরী যুবতীর চোখের জল দেখে—’

‘স্বর্ণ খারাপ মেয়েমানুষের দলে মিশে তোমার কথাবার্তা বড় মন্দ হয়ে গেছে।’

‘হয়েছে? মন্দ হয়েছে?’ স্বর্ণ যেন আশান্বিত হয়ে ওঠে, ‘তাই তো চাই গো! মন্দ হবার জন্যেই তো শ্বশুরঘর ত্যাগ করে পথে ভেসেছি। নীচু ঘরের মেয়েকে ঘরে তুলতে তোমাদের আপত্তি, নীচ চরিত্রের মেয়েমানুষের ঘরে ঢুকতে তো আপত্তি নেই, তাই সেই সাধনায় সিদ্ধি হয়ে ফিরে এলাম গাঁয়ে। ভাবছি এবার বাগদীপাড়ায় একটা ঘর নেব। হ্যাঁ গো, আসবে তো সেখানে? তবে বড় আক্ষেপ, সতীন নেই, লড়াইয়ে জেতার সুখটা মিলবে না।’

‘স্বর্ণ, তোমার মাথাটার আর ঠিক নেই মনে হচ্ছে।’

‘মাথার ঠিক নেই? বল কি? এই মাথা নিয়ে কত কৌশল খেলছি, আর তুমি বলছ ঠিক নেই? গেরুয়ার ভেক নিয়ে, ওদের গুরু হয়ে দলকে দল জপিয়ে জপিয়ে গাজনের সন্নিসী করেছি, ভৈরবীকালীর মাহাত্ম্য প্রচার করে এই দিকে ভিড়িয়েছি।’

সর্বেশ্বর আস্তে বলে, ‘তার বিনিময়ে কী পেলে স্বর্ণ?’

‘পাইনি পাব। তোমায় পাব। সেই আশায় পড়েই তো এত কাণ্ড! তোমায় পাব, তোমায় নিয়ে সংসার করব, হাতে করে তোমার সেবা করব, এই সাধেই যে জ্বলে—পুড়ে মরছি। ভাগ্যদোষে মা—ঠাকুমার মতন করে সংসার করতে পেলাম না, ভাবছি পদী কামারনীর মত করেই করব।’

‘স্বর্ণ!’ সর্বেশ্বর পাঠক বলে ওঠে, ‘সে সংসারে আমার রুচি আসবেই এ—কথা ভাবছ কেন?

‘শোন কথা! রুচি আসবে না? ‘স্বর্ণ গালে হাত দিয়ে বলে, ‘পরিবার থাকতেই তোমাদের মোহান্ত—মহারাজদের দু—একটা করে সেবাদাসী লাগে, আর তোমার তো শূন্য ঘর।’

সর্বেশ্বর এবার দৃঢ়স্বরে বলে, ‘স্বর্ণ, তুমি যাও। তোমার কথাবার্তা বড় নীচ হয়ে গেছে, কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে আমার।’

স্বর্ণ হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে যায়। একবার যেন কেঁপে ওঠে। তারপর সহসা পিছন ফিরে দ্রুত পায়ে দালান থেকে নেমে চত্বর পার হয়ে অন্ধকারে মিশিয়ে যায়।

কিন্তু সর্বেশ্বর ঠাকুরও কেন দ্রুত পায়ে নেমে চত্বর পার হয়ে অন্ধকারে মিশিয়ে গেল? তার না ঘৃণা আসছিল, কষ্ট হচ্ছিল? সে না ধিক্কার দিচ্ছিল এক্ষুনি সামনের ওই মানুষটাকে নীচ হয়ে গেছে, মন্দ হয়ে গেছে বলে?

তবে ও অন্ধকারে মিলিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই সর্বেশ্বরও অন্ধকারে মিলিয়ে গিয়ে দৌড়ের বাজিতে জিতে ওকে ধরে ফেলে কাতর কণ্ঠে বলে উঠল, ‘স্বর্ণ!’

স্বর্ণ কিন্তু পিছু ফেরে না। দ্রুত পায়ে এগোতে এগোতে বলে, ‘ছিঃ ঠাকুর, মেলাতলার মেয়েমানুষের পেছন পেছন ছুটো না। লোকে নিন্দে করবে।’

‘স্বর্ণ!’ সর্বেশ্বর বলে ওঠে, ‘স্বর্ণ, আমায় মাপ কর, হঠাৎ কেমন রাগ চড়ে গেল, কি বলতে কি বললাম!’

স্বর্ণ এবার ফিরে দাঁড়ায়। বলে, ‘ঠিকই তো বলেছ।’

‘না না স্বর্ণ, সব ভুল বলেছি। তোকে দেখে অবধি’—সর্বেশ্বর গলাটা ঝেড়ে নিয়ে বলে, ‘তিলার্ধ স্বস্তি পাচ্ছি না।’

‘বেশ তো, চলে যাব কাল ওদের সঙ্গে, মিটে যাবে অস্বস্তি।’

‘স্বর্ণ, তোর যাওয়া হবে না।’

স্বর্ণ হেসে উঠে বলে, ‘তাহলে বাগদীপাড়ায় ঘর দেখি?’

আহত সর্বেশ্বর ক্ষুব্ধ গলায় বলে, ‘এতদিন পরে কি তুই আমায় ব্যঙ্গ করতেই এসেছিস স্বর্ণ?’

অন্ধকার মাঠে পাশাপাশি চলছে দুজনে, সাপখোপের ভয়ও লুপ্ত হয়ে গেছে যেন।

সর্বেশ্বরের কথার উত্তরে বলে স্বর্ণ, ‘বুঝতে পারছি না সর্বদা! হঠাৎ ভারি আশ্চয্যি লাগছে। মনে হচ্ছে, সত্যি কী করতে এলাম? অথচ—’

স্বর্ণ হাসির মত গলায় বলে, ‘অথচ এই এতগুলো বছর শুধু এই আসার স্বপ্নই দেখেছি। আসার দিনই গুনেছি। কী আশ্চয্যি বল তো? মামা বিয়ে দিল, ঘর ভাল, বর ভাল, সুখে—স্বচ্ছন্দে সংসার করব মিটে যাবে ল্যাঠা, তা নয়, হাবা বুদ্ধির বশে ভাবতে বসলাম, এ বিয়ে পাপ, এ বরের ঘর করা পরপুরুষের ঘর করার সামিল। মায়ের মন্দিরে দাঁড়িয়ে সেই যে শপথ, সেটাই আসল, সেই বিয়েই বিয়ে, সেই বরই বর। একেই বোধ করি বলে—সুখে থাকতে ভূতের কীল খাওয়া, তাই না? ঘরবসতের সময় এল, বেঁকে বসলাম, বললাম যাব না। মা গাল দিল, গলায় দড়ি দিতে উপদেশ দিল, দিতে পারলাম না। মনে ভাবছি, এ দেহ—মন—প্রাণ সবই তো তোমার, তোমাকে একবার না জানিয়ে মরি কি করে ছাই! তুমি যদি ভাব ‘কী বিশ্বাসঘাতক!’ দেখা হলে বলে মরব, ‘দেখ, বাধ্য হয়ে আত্মঘাতী হতে হচ্ছে আমায়, দোষ নিও না। ছেলেবুদ্ধির যা বহর, তাই আর কি! তখন তাই গলায় দড়ি না দিয়ে, পুকুরে ডুবে না মরে—শ্বশুরবাড়ি গেলাম। যাব না বলে তো ছাড়ান হল না। যে মা অত স্নেহময়ী ছিল, সেই মা তখন উঠতে বসতে গঞ্জনা করছে আমায়।…

শ্বশুরবাড়ি এসেই ওই দুশ্চিন্তা, বরের ঘরে যাই কেমন করে শেষ অবধি দুগগা বলে কথাটা বলে বসলাম তাকে।

সর্বেশ্বর অবাক হয়ে বলে, ‘কী বলে বসলে?’

ওই যে বললাম, ‘মনে কিছু করো না। তোমার সঙ্গে বসবাস আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। আগে অন্যত্র বিয়ে হয়েছে আমার।’

‘অ্যাঁ!’ সর্বেশ্বর শিউরে ওঠে। ‘এই কথা বললে স্বামীকে?’

‘স্বামী! মানে লোকচক্ষে স্বামী! তা সে যাই হোক, না বললে আত্মরক্ষেটা হবে কি করে?’ স্বর্ণ অনুচ্চ একটু হেসে ওঠে, ‘তখনকার যেমন মতি বুদ্ধি ছিল তেমন চিন্তা, এই আর কি!’

সর্বেশ্বর অস্ফুটে বলে, ‘শুনে কি বলল সে?’

‘শুনে? সে এক আশ্চর্য রহস্য! মনে ভেবেছিলাম শুনেই হয়তো লাথি—ঝ্যাঁটা মারবে, দূর করে তাড়িয়ে দেবে। ও মা, সে সবের কিছু না। শুধু বলল, ‘তোমার মাকে দেখে মনে হল না তো এতটা অসৎ কাজ করতে পারেন?’

আমি বললাম, ‘মা জানলে তো সৎ অসৎ? তারপর সব ঘটনা খুলে বললাম।’

সর্বেশ্বর আবার শিউরে ওঠে, ‘ভয় করল না?’

‘নাঃ, ভয় আবার কিসের? কথাতেই তো আছে মরার বাড়া গাল নেই! আমায় যদি মেরে ফেলে কি তাড়িয়ে দেয়, বেঁচে যাই। কিন্তু সে গুড়ে বালি। সব শুনে হেসে বলল, ‘ওঃ, তাই বল। খেলাঘরের বিয়ে? ছেলেবেলায় অমন বিয়ে—বিয়ে খেলা আমিও কত খেলেছি। ওতে দোষ নেই।’

যতই বোঝাই খেলাঘরের নয়, ততই হাসে লোকটা। আর বলে, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। মেয়েমানুষের তো সতীন থাকে, বেটাছেলেদেরও না হয় একটা থাকল—’

‘আশ্চর্য!’ সর্বেশ্বর অস্ফুটেই বলে, ‘আশ্চর্য লোক তো!’

‘তা আশ্চর্যই।’ স্বর্ণ একটু উদাস উদাস গলায় বলে, ‘অমনটি আর দেখলাম না। ছেড়ে চলে এসে তার জন্যেও মনের মধ্যে হু হু করে। মনে হয় দেবতুল্য লোকটা আমায় কী পাতকীই ভাবল! আসল কথা কী জানো, সংসারের আরো পাঁচজনের পথ যে যেতে পারবে, সে—ই সুখী, নচেৎ দুঃখের পসরা বইতেই হবে। আর পাঁচজনের মতন না হয়েই আমি হলাম জন্মদুঃখী। আমার মতন আর—’

সর্বেশ্বর ক্ষুণ্ণগলায় বলে, ‘আমিও কম দুঃখী নই স্বর্ণ!’

‘ওমা, সে কি!’ স্বর্ণ আবার ওর স্বভাবসিদ্ধ বাচাল হাসি হেসে বলে ওঠে, ‘তোমার আবার দুঃখু কি? কথায় বলে, অভাগ্যের ঘোড়া মরে, ভাগ্যবানের বৌ মরে। দু—দুবার ভাগ্যবান হয়েছ তুমি। অথচ সত্যি যদি বিষ খাইয়ে না মেরে থাক, ভাগ্যবান হতে একফোঁটা খাটতে হয়নি তোমায়। যা করবার ভগবানই করেছে। আবার তা যদি ভগবান না করত, এতদিনে দিব্যি বৌ—ছেলে ঘর—সংসার নিয়ে সুখে রাজ্যিপাট করতে! আমায় যে আগাগোড়াই নিজের ভার বইতে হচ্ছে। লোকটা যদি মারধোর করত, হয়তো ভাল হত, সন্দেহ করে যদি আমায় স্পর্শ না করত, বাঁচতাম। তা তো হল না, সে বলল কিনা খেলার বিয়েয় দোষ নেই, তুমি আমি জন্মে জন্মে এক। কি তবে করব বল না পালিয়ে? লুকিয়ে একটা ইঁটখোলার নৌকো চড়ে পলায়ন দিলাম।’

‘একা? একা পালালে?’

‘তা ছাড়া? কে আমার দুর্বুদ্ধির সঙ্গী হবে? ভেবেছিলাম যেমন করে হোক একবার বীরপুরের মাটিতে এসে পা দেব, তোমার সঙ্গে একবার দেখাটা করেই প্রাণ বিসর্জন দেব। কিন্তু সে সুযোগ কি সহজে এল! কত ঘাটে ঘুরতে হল, কত ঘাটের জল খেতে হল, সে এক মহাভারত। কাকে বলে জেলা, কাকে বলে গ্রাম, কিছুই জানি না, শুধু বীরপুর বললে বোঝেই না কেউ।…অনেক সমুদ্দুর পার হতে হতে, বয়েস হয়ে উঠল ভরা, মন গেল বদলে। প্রাণে সংসার—সাধ জাগতে লাগল। ভাবলাম, মরব কেন? পৃথিবীতে এত সাধ—আহ্লাদ, আর আমি নিজেকে সব থেকে বঞ্চিত করে আত্মঘাতী হব? কেন? আমি বাঁচব। তোমার কাছে এসে হাজির হব। যেমন করে হোক তোমার সঙ্গে মিলব। লোকে আমায় মন্দ ভাববে ভাবুক, আমি তো মনে—প্রাণে জানব আমি সতী, আমি খাঁটি!’

মাঠের পথ শেষ হয়ে এসেছে, এখন দুজনের দুই পথ। সর্বেশ্বরকে যেতে হবে বাড়িতে, স্বর্ণকে যেতে হবে সেই খারাপ মেয়েদের ঝুপড়িতে।

সর্বেশ্বর নিশ্বাস ফেলে বলে, ‘স্বর্ণ, গাঁয়ের বুকে তোমায় নিয়ে আমি বাস করব কী করে?’

স্বর্ণ তীক্ষ্নগলায় বলে, ‘কেন? যেমন করে তোমার বাবা কামারপাড়ায়—’

‘থাক স্বর্ণ, ওকথা থাক। এই বীরপুরের বুকে তোমায় নিয়ে সংসার করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তার চেয়ে চল আমরা পালাই।’

সহসা স্বর্ণ দাঁড়িয়ে পড়ে। গাঢ় গভীর গলায় বলে, ‘পারবে? বীরপুরের এই মোহন্তগিরীর রাজ্যিপাট ছেড়ে চলে যেতে পারবে?’

‘পারব স্বর্ণ!’

‘তবে এখনই চল না!’

‘এখন?’ সর্বেশ্বর বিচলিত গলায় বলে, ‘এখন কী করে হবে? চারিদিকে কত কর্মবন্ধন—’

‘স্বর্ণ হেসে ওঠে। বলে, ‘বন্ধন ছিঁড়তে হলে, চোখ—কান বুজে ছিঁড়তে হয় গো! উইল করে, ঘর—সংসার গুছিয়ে, দেনা—পাওনা মিটিয়ে বন্ধন ছেঁড়া যায় না। ও তোমার দ্বারা হবে না।’

সর্বেশ্বর অভিমানের গলায় বলে, ‘আমাকে তুমি এমন অধম ভাবছ স্বর্ণ? যতই হোক মা ভৈরবীকালীর মুখটাও তো চাইতে হবে। তাঁর সেবার একটা ব্যবস্থা না করে—’

‘হি—হি—হি’ স্বর্ণ যেন মুখে আঁচল গুঁজে হাসি রোধ করবার চেষ্টা করে। ওর কথার সুরে সেই চেষ্টার আভাস—’এই সেরেছে, কেন জানি না হঠাৎ বড্ড হাসি পাচ্ছে! ঘরে গিয়ে বরং একটু হাসি গে, কেমন? তুমি বাড়ি যাও।’

দ্রুতপায়ে কেরোসিনের কুপীর ধোঁয়া ওড়ানো লালচে আলোর ইশারাবাহী ঝুপড়িগুলোর দিকে এগিয়ে যায় স্বর্ণ। মিলিয়ে যায় কোথায় যেন।

মিলিয়ে তো যায়, কিন্তু বেচারা সর্বেশ্বরকে যে একেবারে দীর্ণ—বিদীর্ণ করে দিয়ে যায়।

সর্বেশ্বরের স্তিমিত শান্ত বিবর্ণ জীবনের ওপর হঠাৎ এ কী দুরন্ত ধাক্কা? এ কী চড়া রঙের বিদ্যুৎদীপ্তি? সর্বেশ্বর দিশেহারা হয়ে যায়। স্বর্ণকে তো প্রায় ভুলেই গিয়েছিল সে। স্বর্ণর দুর্মতির সংবাদে ঘৃণা করতে অভ্যাস করেছিল, ভাঁটা পড়ে গিয়েছিল স্বর্ণর চিন্তায়, হঠাৎ স্বর্ণ সেখানে একটা সর্বনাশা কুল—ভাঙা বন্যার বেশে এসে আছড়ে পড়ল।

স্বর্ণর বাচনভঙ্গী আর এক জগতের, স্বর্ণর দুঃসাহস আর এক জগতের, স্বর্ণর চিন্তাধারা আর এক জগতের। বীরপুরের মাটিতে মাটি হতে থাকা সর্বেশ্বর পাঠকের কাছে এ এক অদ্ভুত নতুন ভয়ঙ্করী আকর্ষণ।

সর্বেশ্বরের সমস্ত চৈতন্য ওর পিছু পিছু ছুটতে চাইছে। অথচ সর্বেশ্বর ওকে ঘৃণা করছে, ওকে অস্পৃশ্য ভাবছে, ওকে মহাপাতকী ভাবছে।

ভাবছে, আবার ভাবছে সত্যিই কি তাই সম্ভব? মা ভৈরবীকালীর হাত মুচড়ে ভাঙতে গিয়েছিল? অসম্ভব! মন্দ সঙ্গে মিশে মিশে মুখের তো আর এখন রাখ—ঢাক নেই ওর, মিথ্যে বাহাদুরী দেখাতে বলে নিল আমি ঠাকুরকে অঙ্গহীন করেছি।…সত্যি তাই করলে আর ওই রূপসী অঙ্গ নিয়ে ঘুরে বেড়াতে হত না? কিন্তু আশ্চর্য, কী নির্ভীক! ভয় বলে বস্তুটাই যেন নেই। লোকভয়, ধর্মভয়, সমাজভয়, এই নিয়েই তো মানুষ, এই নিয়েই জীবন কাটাচ্ছে! এই সর্বেশ্বরের জানিত জগৎ! ভয় করতে করতেই এত বড়টা হল সর্বেশ্বর।

হঠাৎ এই ভয়শূন্যতা তাকে যেমন ভয়ও পাওয়াচ্ছে, তেমনি একটা দুর্বার আকর্ষণেও টানছে।

মাঠের পথ পার হয়ে বাড়ির পথ ধরেছিল সর্বেশ্বর, ভুলে বাড়ি পার হয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। অজস্র প্রশ্ন ওর মাথাটাকে যেন মাছির মত ছেঁকে ধরছে।

আমাদের সেই ছেলেখেলার বিয়েটাকে স্বর্ণ তাহলে মনে—প্রাণে এত সত্যি বলে মেনে নিয়েছিল? কই, আমি কি—

কিন্তু যতই স্বর্ণ আজীবন ভজে থাকুক, যতই পরপুরুষ স্পর্শ না করুক, কুলত্যাগ যখন করেছে, অবশ্যই সমাজে পতিত, তাছাড়া খারাপ মেয়েমানুষের দলেই আছে। গেরুয়া পরলে আর কি হবে? কুসঙ্গ বলে কথা! এখন স্বর্ণ আমার আশ্রয়ে এসে থাকতে চাইলেই আশ্রয় দেব আমি? এদিকে বলছে সতী আছে, অথচ নষ্টচরিত্র মেয়ের পরিচয়ে থাকতে চায়। সত্যি সতী হলে মুখ দিয়ে বার করতে পারত একথা?

বলে যে আমার সেবা করার সাধ!

মা ভৈরবীকালীর বিষয়ে কথাটা যদি সত্যি হয়, ওর ওই পাপ হাতের সেবা আমি নেব?

প্রশ্নগুলো মাথাটাকে কামড় দিতে থাকে, কিছুতেই নামতে চায় না। হঠাৎ এক সময় খেয়াল হয় বাড়ি ছাড়িয়ে অনেক দূরে এসে পড়েছে।

কী আশ্চর্য, পাগল হয়ে গেল নাকি সে? একেই বোধহয় বলে মোহিনী মায়া! মায়ায় বিভ্রান্ত হয়ে—কে বলতে পারে স্বর্ণ ডাকিনী—মন্ত্র শিখে এসেছে কিনা!

দ্রুতপায়ে বাড়ি ফিরে আসে সর্বেশ্বর। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, কাল সকালবেলাই ওকে জানিয়ে দেবে, বীরপুর থেকে বিদায় হও তুমি। যে দলে মিশে এখানে এসেছ, সেই দলের সঙ্গেই বিদায় হও। তোমাতে আমার আর বিন্দুমাত্র রুচি নেই।

কিন্তু রাত্রের সেই প্রতিজ্ঞা কি সকালে রক্ষা করতে পারল সর্বেশ্বর? তবে কেন সকালের রোদে দেখা গেল, সর্বেশ্বর মন্দিরের পিছনের পুকুরধারে দাঁড়িয়ে কাতর বচনে বলছে, ‘দোহাই তোর স্বর্ণ, একবার আমাদের সেই জায়গাটায় চল। সেই আমাদের ছেলেবেলার ভালবাসার জায়গা। তুই চলে গিয়ে পর্যন্ত কতদিন আর ওদিকে তাকাতে পারিনি। ভেবেছি, যদি আবার কোনদিন আসিস তুই—’

হ্যাঁ, এই কথাই বলছিল সর্বেশ্বর। কথাটা পরনের পট্টবস্ত্রের সঙ্গে বেমানান হলেও বলছিল।

অথচ সর্বেশ্বর সকালবেলা বাড়ি থেকে বেরোবার সময়ও দৃঢ় সংকল্প করেছিল পুজো সেরে ফেরার সময় ওদের ওই মাঠের ধারে গিয়ে ডাক দিয়ে বলবে, ‘স্বর্ণ, তুমি যাদের সঙ্গে এসেছ তাদের সঙ্গেই বিদায় হও। তোমাকে আমার ঘৃণা হচ্ছে।’

কিন্তু মাঠের দিক পর্যন্ত কি যেতে হয়েছিল সর্বেশ্বরকে? হয়নি। মন্দিরের দরজায় এসেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়তে হয়েছিল তাকে। নাটমন্দিরে গান হচ্ছে। মৃদু মধুর গুঞ্জনধ্বনি। শ্যামসঙ্গীত না শ্যামাসঙ্গীত বোঝা যাচ্ছে না। সুরটা বুঝি কীর্তনেরই।

মুহূর্তে সর্বেশ্বরের সর্বাঙ্গ রোমাঞ্চিত হয়ে যায়, সর্বেশ্বর থামে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। গায়িকার চোখ বোজা, গালের উপর জলের ধারা। সদ্য ভিজে চুলগুলো ঘাড়ে পিঠে ছড়ানো, গেরুয়া শাড়িতে সকালের আলোর আভা।

এই ছবিকে সর্বেশ্বর বলবে, ‘তুমি দূর হও? তুমি বিদায় হও?’

সর্বেশ্বর গান শেষ হওয়ার অপেক্ষায় থাকে। শেষ হলেও দাঁড়িয়ে থাকে। কারণ গানের শেষেও স্বর্ণর চোখ বোজা।

অনেকটা পরে একটা নিশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ায় স্বর্ণ, আর সর্বেশ্বর ‘দূর হয়ে যাও’য়ের পরিবর্তে বলে, ‘স্বর্ণ! এমন অদ্ভুত গান গাইতে পার তুমি?’

স্বর্ণ বলেছিল, ‘চলে যাব, তাই শেষবারের মত মাকে নিশ্চিন্তে দেখতে এসেছিলাম। বেলায় ভীড় হয়ে যায়।’

সর্বেশ্বর বলেছিল ‘চলে যাবে? তাই আর কি? দেখি কেমন যেতে পার?’

‘শোন কথা, আমি সত্যি থাকতে এসেছি?’ স্বর্ণর চোখে জলের আভাস, মুখে হাসি। দলেরা পোঁটলা—পুঁটলি বাধছে, ভাবলাম এই তক্কে—’

‘স্বর্ণ, দলেরা যে যেখানে যাবে যাক, তোমার যাওয়া হবে না।’

স্বর্ণ একবার ওই পট্টবস্ত্রপরিহিত, তরুণ দেহকান্তির দিকে তাকিয়ে দেখে। পাঠক—বংশের চেহারা ব্রাহ্মণোচিত বটে। দীর্ঘ উন্নত চেহারা তীক্ষ্ন নাক, সুগঠিত চিবুক। শিবেশ্বরের গড়ন একটু স্থূল, সর্বেশ্বর একহারা। তাই লম্বা একটু বেশী দেখায়।

দেখলে মনে হয় বুদ্ধিমান পণ্ডিত।

তা, স্বর্ণকে দেখেও তো মনে হচ্ছে সন্ন্যাসিনী।

স্বর্ণ এখন আর বাচাল হাসি হেসে ওঠে না। স্বর্ণ বেশ গম্ভীর গলায় বলে ‘শুনে বাঁচলাম। তা থাকার জায়গা ঠিক হয়ে গেছে?’

‘থাকার জায়গা?’ সর্বেশ্বর থতমত খেয়ে বলে, ‘কার?’

‘ওমা! এ যে সপ্তকাণ্ড রামায়ণ শুনে সীতে কার পিতে। আমার দলেরা তো আজই তাঁবু গুটোচ্ছে, ওদের সঙ্গে যাওয়া বন্ধ হলে আশ্রয়টা দিনের আলোয় দেখে রাখতে হবে তো?

সর্বেশ্বর ব্যস্তভাবে বলে, ‘আচ্ছা, সে সব কথা হবে, দোহাই তোমার আমাদের সেই জায়গাটায় একবার চল। সেখানেই কথা হবে। এখানে এখুনি কে আসবে, হয়তো চিনে ফেলবে—’

‘চিনে!’ স্বর্ণ একটা উদাস নিশ্বাস ফেলে বলে, ‘কোথায়? এই তো এই তিনদিন মন্দিরে আসছি যাচ্ছি, কেউ তো চিনল না, তাকিয়েও দেখল না। বলল না, ‘ও মা, স্বর্ণ না?’

‘না বলেছে সেটাই তো মঙ্গল’, সর্বেশ্বর ব্যস্তভাবে বলে, ‘চিনলেই তো কেলেঙ্কারী হত!’

‘ও, তা বটে!’ স্বর্ণ মুচকি হেসে বলে, ‘কিন্তু ভাবছি তোমার যেমন কেলেঙ্কারীর ভয় দেখছি, বিপাকে পড়লে আমায় গঙ্গায় ঠেলে ফেলে দেবে না তো?’

‘স্বর্ণ, এমন নিষ্ঠুর কথা তোমার মুখেই সাজে। কিন্তু কথা রাখবে তো? চলে যাবে না?’

স্বর্ণ একটা বিচিত্র হাসি হেসে বলে, ‘চলে যাব বলে তো আসিনি, থাকব বলেই এসেছিলাম। কিন্তু সেই পালানোর পরামর্শটার কী হল গো?’

সর্বেশ্বর মৃদু গলায় বলে, ‘সে—কথা অনেক ভাবলাম। কিন্তু শেষ পরে ভেবে ভেবে দেখছি, চলে গেলে বৃদ্ধ মা—বাপকে কে দেখে, মায়ের পুজোর কি হয়? তাছাড়া জমি—জমা বিষয়—সম্পত্তি বাবা তো আজকাল দেখতেই পারে না। আমি উপযুক্ত ছেলে, আত্মসুখের জন্যে ওঁদের অকূলে ভাসিয়ে দিয়ে চলে যাব, সেটা কি ভাল হবে?’

স্বর্ণ সায় দিয়ে উৎসাহ সহকারে বলে, ‘পাগল, তাই কখনো হয়! আমি কি সত্যি বলছিলাম গো? পরিহাস করছিলাম বৈ তো নয়!’

সর্বেশ্বর নিশ্চিন্ত গলায় বলে, ‘আমিও তাই ভাবছিলাম। সজ্ঞানের কথার মতন তো লাগেনি কথাটা! সে যাক, একটা পরামর্শ দিচ্ছিলাম—’

স্বর্ণ মহোৎসাহের গলায় বলে ‘কী পরামর্শ গো?’

বলছিলাম, ‘অত চিন্তার কি আছে? পথ তো তুমি পরিষ্কার করেই রেখেছ। গেরুয়া নিয়েছ, রুদ্রাক্ষ পরেছ, পূরো ভৈরবী বেশ। মায়ের মন্দিরেই স্থিতি হও না! এমন তো কতই থেকে গেছে। মনে নেই তোমার সেই শঙ্করী ভৈরবীকে? সেই যে—’

স্বর্ণ কৌতুকোজ্জ্বল মুখে বলে, ‘খুব মনে আছে। পাঠকজ্যাঠার সঙ্গে মাঝে মাঝে লেগে যেত ধুন্ধুমার। ভাবও যত, আড়িও তত।’

সর্বেশ্বর অপ্রতিভ ভাবে বলে, ‘বাবার সঙ্গে লাগত পেসাদ পেসাদ করে। কিছুতেই যে তেনার মন উঠত না। পেটটি তো রাক্ষসের ছিল!’

‘ওঃ তবু ভাল।’ স্বর্ণ নিশ্চিন্ত সুরে বলে, ‘আমার আর তবে ভয় নেই, এক ছটাক চালের ভাত খাই। কিন্তু হ্যাঁ গো, গেরুয়া পরেই জীবন কাটাতে হবে? তাহলে আমার সংসার—সাধের কী হবে?’

সর্বেশ্বর আশ্বাসের স্বরে বলে, ‘সংসারে বাধা কি? পেসাদ খেয়েই দিন কাটাতে হবে তারও কোন মানে নেই। ওদিকের ওই যাত্রী ঘরগুলোর একটাতে ইচ্ছেমত রেঁধে—বেড়ে খেতে পার। শঙ্করী ভৈরবী একবার ঝগড়া করে পেসাদ ছেড়ে দিয়ে রেঁধে খেত, বেশ মনে আছে? বড়ি শুকোতে দিত, আচার বানাতো—’

‘সত্যি? তাই বুঝি? ‘স্বর্ণ যেন খুশিতে ফেটে পড়ে, ‘তবে আবার কি? বড়ি দিয়ে আচার বানিয়ে রেঁধে বেড়ে দিব্যি সংসার করতে পাব তাহলে! থাকার ঘরও পাব!’

সর্বেশ্বর মহোৎসাহে বলে, ‘তাইতো বলছি। অথচ নিত্য দুবেলা দেখা হবে। হরদমই হবে। বাবা তো চলৎশক্তিহীন, সর্বদাই আমি।

‘যাক, একটা ব্যবস্থা তাহলে হল।’ স্বর্ণ নিশ্চিন্তের গলায় বলে, ‘অথচ দেখ কত ভেবে মরছিলাম। কিন্তু ভাবছি—’

‘আবার কি ভাবছ?’

‘ভাবছি থাকতে থাকতে যদি কেউ চিনে ফেলে?’

‘এই কথা?’ সর্বেশ্বর ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেয়—’এই চিন্তা? তখন চিনল তো বয়েই গেল। সন্নিসীর সাজ নিয়েছ, আর ভয়টা কি? বলবে, অনুতাপে দগ্ধ হয়ে এই পথের পথিক হয়েছি।’

‘বাঃ রে! আজকাল অনেক ভাল ভাল ভাষা শিখেছ তো! তাহলে ওই কথাই রইল?’

সর্বেশ্বর বিগলিত গলায় বলে, ‘হ্যাঁ। তুমি যে এত সহজে রাজী হবে তা, ভাবিনি স্বর্ণ! তোমার পোঁটলা—পুঁটলি তাহলে ওদের থেকে আলাদা করে এখানে এনে রাখ। আমি বরং ঘরটা ধুইয়ে—’

‘থাক থাক, যা আছে তাই থাক। বৃথা কষ্ট করবে কেন? যাই তাহলে?’

‘যাই বলতে নেই।’

‘আচ্ছা আসি।’

‘হ্যাঁ, এখুনি এস। ওরা বিদেয় হলেই। তবে একটা আর্জি, দুপুরে সেই আমাদের বটঝুরির ওখানে যাওয়া চাই, বুঝলে তো? মন্দিরে তো দুদণ্ড মুখোমুখি বসা যাচ্ছে না, সর্বদা ভয়। কত কথা কইবার রয়েছে। আসবে?’

স্বর্ণ বিচিত্র হাসি হেসে বলে, ‘আসব।’

কিন্তু দুপুর গড়িয়ে যে বিকেল হয়ে আসে, কোথায় স্বর্ণ?

সর্বেশ্বর সেই বাল্যকালের মতই অপেক্ষা করে, মশার কামড় খায় আর ছটফটিয়ে মরে। স্বর্ণ কি তবে বেইমানী করল? স্বর্ণ ভোগা দিল? স্বর্ণ মিথ্যে স্তোক দিল?

মাঝে মাঝে ফাঁক দিয়ে দেখে সর্বেশ্বর, আর মাথাটা আবার ঢুকিয়ে নেয়।

আশ্চয্যি, সেই বদ মেয়েমানুষগুলো এত বন্ধু হল যে তাদের বিদায় না দিয়ে আর আসতে পারছেন না!

এগুলো বন্ধ করতেই হবে।

ভাবল সর্বেশ্বর। আর অনেকক্ষণ পরে বেলা যখন প্রায় পড়ে এসেছে, স্বর্ণ এসে দাঁড়াল। স্বর্ণর মুখে পড়ন্ত সূর্যের স্বর্ণাভা।

সহসা ভয়ানক একটা উন্মাদনা অনুভব করল সর্বেশ্বর। নীতি দুর্নীতি পাপ পুণ্য প্রবৃত্তি অপ্রবৃত্তি সব কিছু যেন ঝাপসা হয়ে গেল তার চেতনা থেকে। স্বর্ণকে হাত ধরে কাছে টেনে নিয়ে এই লোকলোচনের অন্তরালে একবার সাপটে ধরে দলিত মথিত করে ফেলবার বাসনা প্রবল হয়ে উঠল।

কেন নয়? স্বর্ণ তো তার বিয়ে—করা বৌ। এই দীর্ঘকাল ধরে তো স্বর্ণ সেই ধারণা নিয়েই কাটিয়ে এসেছে, এবং বহুচেষ্টায় বীরপুরে এসে হাজির হয়ে তার কাছে ধরা দিয়েছে। অতএব স্বর্ণকে উপভোগ করার মধ্যে কোন পাপ নেই। দেবতার জন্যে সাজানো নৈবেদ্য, দেবতা গ্রহণ করলেই তো নৈবেদ্যর সার্থকতা।

স্তিমিত সর্বেশ্বর পূজুরীর দৈনন্দিন জীবন ছিল ছকে বাঁধা, সেখানে উন্মাদনার কোন অবকাশ ছিল না। দু’ দুবার বিয়েই হয়েছে, বৌ দুটো তো ঘরবসতের আগেই খতম। একটা কলেরায়, একটা জ্বর—বিকারে। লোকমুখে বার্তা পেয়ে চন্দ্রাননী যখন পাড়া জানিয়ে চিৎকার করে কেঁদেছে, সর্বেশ্বর শুকনো মুখে অপরাধী ভাবে ঘুরেছে। আবার মা যখন হাঁড়ি—কুড়ি ফেলে নেয়ে ধুয়ে ছেলেকে ডাক দিয়ে বলেছে ‘স্বামীর ওপর অশৌচ লাগে না, তুই তোর রাজুপিসির কাছে মাছ—ভাত খেয়ে আয়,’ তখন গেছে সুড়সুড় করে। অবশ্য ব্যাপারটা যাতে শিবেশ্বর বা পাড়ার আর পাঁচজনের কানে না ওঠে, সে ব্যবস্থাও করেছে চন্দ্রাননী। সর্বেশ্বর তাতে সহযোগিতা করেছে। এই, একটুমাত্র বৈচিত্র্য তার জীবনে দুবার দেখা দিয়েছে। বৌ মরার জন্যে বৌয়ের অভাবজনিত যন্ত্রণা কই কখনো অনুভব করেছে বলে মনে পড়ে না। ঘরে একটা বৌ থাকলে মন্দ হয় না। মা—র সঙ্গে ঘোরে ফেরে, রাত্তিরে ঘোমটাটি দিয়ে মল বাজিয়ে ঘরে ঢোকে, রোমাঞ্চ আছে এমন ভাবনায়, কিন্তু সে ভাবনায় তীব্রতা ছিল না। আবেগ—ইচ্ছা—উন্মাদনা, এসবের স্বাদ জানা ছিল না সর্বেশ্বরের। হঠাৎ আজ তার চিরবুভুক্ষু দেহমন যেন উন্মাদ হয়ে উঠতে চাইল।

স্বর্ণর একটা হাত চেপে ধরে সংকীর্ণ একটা ফাঁক দিয়ে ভিতরে টেনে নিল সর্বেশ্বর, চাপা উত্তেজনায় বলে উঠল, ‘স্বর্ণ, নিজেই তুমি স্বীকার করেছ তুমি আমার বিয়ে—করা পরিবার।’

স্বর্ণ আস্তে কৌশলে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে মৃদু হেসে বলে, ‘তা তো করেইছি গো! তাই তো যাবার আগে একবার গলবস্তর হয়ে প্রণাম করে নিতে এলাম। না এসে মন মানল না।’

‘যাবার আগে!’ সর্বেশ্বরের ভঙ্গী শিথিল হয়ে যায়। সর্বেশ্বর শিথিল গলায় বলে, ‘যাবার আগে মানে?’

‘মানে গরুর গাড়িতে ওঠার আগে। ওরা সব মালপত্তর চাপিয়ে তিনখানা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে, আমি মাঠের ওপর দিয়ে আগে আগে এসে গেলাম। জানি তো অনেকক্ষণ অবধি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মশার কামড় খাচ্ছ।’

সর্বেশ্বর আশাভঙ্গের আঘাতে ছিটফিটিয়ে বলে ওঠে, ‘ওঃ সে জ্ঞান ছিল। কিন্তু যাবার কথাটা কি হল? ও—কথা তো ছিল না।’

‘শোন কথা,’ স্বর্ণ গোপন অভিসারের মর‍্যাদামাত্র না রেখে দিব্যি খোলা গলায় হেসে বলে ওঠে, ‘ঠাট্টা—তামাশার কথাটা সত্যি ভেবে বসে আছ তুমি? পূজুরিগিরি করে করে বুদ্ধি তোমার সেরেফ ভোঁতা হয়ে গেছে গো! যাকগে, পেন্নামটা সেরে নিই।’ ….আর সত্যিই গলায় আঁচল দিয়ে প্রণাম করে একটু থামে স্বর্ণ, তারপর বলে, ‘আর শোন, যার জন্যে এখানে আসা! এই বুড়ো বটের গোড়ায় গর্ত খুঁড়ে পুঁতে রেখে গিয়েছিলাম মায়ের সেই ভাঙা হাত। দিব্যি গেলেছিলাম, ‘মা, যদি কখনো দিন পাই, তোমার এই ভাঙা হাতকেই প্রতিষ্ঠা করে আমাদের এই সাক্ষীবটের নীচে তোমার জন্যে আলাদা একটা মন্দির বানাব।’

ছেলেবুদ্ধির গলায় দড়ি! ভেবেছিলাম, সব কিছু পোঁতা থাকলেই বুঝি চিরকাল থাকে। দিন পেলে তুলে নিয়ে ইচ্ছে বাসনা মেটানো যায়। ভাব মুখ্যুমী। আশায় ভর করে এসে খুঁড়ে দেখি—ওমা, কোথায় কি! পুঁতে রাখা জিনিস কোন ফাঁকে উইয়ে শেষ করে রেখেছে। আর কি করা যায় বল? চলি তাহলে—’

‘এইখানে পুঁতে রেখেছিলে!’ শিউরে উঠে সর্বেশ্বর। ‘ভাগ্যিস! মা নিজেই রক্ষে করেছেন।’ একটু আগেই না সর্বেশ্বর হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে এখানেই অসংযমী হয়ে বসছিল?

ঈষৎ উত্তেজিত গলায় বলে, ‘রেখেছিলেই যদি তো রাখবার আর জায়গা পাওনি? এইখানে পুঁতে রেখে গিয়েছিলে! আচ্ছা বোকা তো!’

‘ও বাবা, তা আবার বলতে! রামবোকা! ভেবেছিলাম এই বটবৃক্ষ আমাদের ভালবাসার আর তার দিব্যি দিলাসার সাক্ষীবট, এ রাখবে যত্ন করে। সেই ভরসায় এতদিন পরে কবেকার সেই পোঁতা জিনিস খুঁজতে এলাম। বলে গিয়েছিলাম কিনা, ‘হে বটবৃক্ষ তুমি যদি সত্যকালের বট হও, তবে রক্ষা কর এটি। আর আশীর্বাদ কর, যে হাতে আমি মা ভৈরবীকালীর হাত ভেঙেছি, সেই হাতেই যেন তাঁর নতুন মন্দির গড়ে দিতে পারি।’

সর্বেশ্বর বেকুবের মত বলে, ‘তা, তুমি যদি তেমন ইচ্ছে কর, এখনও করতে পার। মায়ের মন্দিরের একটু মাটি এনে এখানে গেড়ে ভিৎ পুজো করে’—কথা শেষ হতে পায় না। স্বর্ণ তাড়াতাড়ি সেই ঝুরির সারি সরিয়ে ভিতর কোটর থেকে বেরিয়ে এসে মুখে আঁচল দিয়ে বলে, ‘ও বাবা, আবার যে আমার সেই রকম হাসি পাচ্ছে গো! ভেতর থেকে হাসি ঠেলে উঠছে। ও আর আমার দ্বারা হবে না, আসল জিনিসটাই যখন উধাও, তখন আর একটু মাটি এনে—না বাবা, হল না। চললাম গো, ওঃ, হাসি রুখতে পাচ্ছি না।’

ছুট মারে স্বর্ণ মুখে আঁচলটা তেমনি চেপে ধরে।

দূরের দিকে তাকিয়ে দেখে সর্বেশ্বর মাঠের ওপার ঘুরে খান তিনেক গরুর গাড়ি আসছে ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দে মাল আর মানুষ বোঝাই দিয়ে। স্বর্ণ দ্রুত গিয়ে ওদের একটাকে ধরে ফেলে, একটু দাঁড় করিয়ে একটাতে উঠে পড়ে। গাড়িগুলো এগোতে থাকে মন্থর গতিতে। সর্বেশ্বর হাঁ করে তাকিয়ে থাকে সেদিকে। নতুন কোন দৃশ্য নেই, শুধু ধুলো উড়ছে পিছনের চাকা থেকে। তবু সেই দৃশ্যটাতেই এমন আচ্ছন্ন হয়ে থাকে সর্বেশ্বর, বহুক্ষণ পর্যন্ত যে চাকার সেই ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দটা কানে আসছে না, সেটা তার খেয়ালেই আসে না।

অনেকক্ষণ তেমনি মূঢ়ের মত তাকিয়ে থেকে, হঠাৎ নিজ মনেই সশব্দ মন্তব্য করে ওঠে সর্বেশ্বর, ‘দূর, মাথাটাই বিগড়ে গেছে, নইলে এত হাসে কেউ!’

তারপর হনহন করে এগিয়ে যায়।

অধ্যায় ২ / ২

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন