অলিভার টুইস্ট – ১৭

চার্লস ডিকেন্স

সপ্তদশ পরিচ্ছেদ

টেস্‌ নদীর তীরে একটা মস্ত বড়ো বস্তি। লন্ডনের বেশির ভাগ বদমাইশদের আড্ডা সেখানে। কতকগুলো নোংরা সরু গলির গোলকধাঁধা পেরিয়ে সেখানে পৌঁছোতে হয়। গলিগুলোতে গরীবেরাই বাস করে থাকে পরিবার নিয়ে। গলিতে অনেকগুলো সস্তা মালপত্তরের দোকান। পথে বেকার শ্রমিকদের ভিড়। টেস্‌ নদীর একটা খাল আছে সেখানে। জোয়ারের সময় সেই খালটা জলে ভরে যায়। এ অঞ্চলের বাড়িগুলো সবই জিরজিরে আর পোড়ো। যাদের পুলিশের নজর এড়িয়ে লুকিয়ে থাকতে হয়, বা অভাবের জন্যে যারা অন্য জায়গায় যেতে পারে না, তারাই এরকম বাড়িগুলোতে বাস করছে। 

এই অঞ্চলেই বেশ একটা বড় বাড়ির দোতলায় একখানা ঘরে বিকেলবেলা বসে ছিলো—টোবি ক্র্যাকিট, টম্ চিটলিং, আর একটা পুরোনো ডাকাত—তার নাম ক্যাগ্‌স্।

চিটলিং জানালো যে, বেলা দুটোর সময় ফ্যাগিন্ ধরা পড়েছে পুলিশের হাতে, আর কোনোমতে ঘরের চিমনি বেয়ে সে আর চার্লি পালিয়ে এসেছে। বোল্টার একটা খালি চৌবাচ্চার ভেতর লুকিয়েছিলো, কিন্তু শেষে সে-ও ধরা পড়েছে। ‘ত্রিভঙ্গ’ সরাইখানার সকলকেই কয়েদ করা হয়েছে। 

ক্যাগস্‌ বললো যে, বোল্টার নিশ্চয়ই রাজসাক্ষী হবে। 

এমন সময় সাইকসের কুকুরটা হাঁপাতে হাঁপাতে ঘরের মধ্যে ঢুকে নেতিয়ে পড়লো। ওরা তাকে জল খেতে দিলো। 

সন্ধ্যা উতরে যেতেই একটা মোমবাতি জ্বেলে ওরা চুপ করে বসে আছে, এমন সময় সদর দরজায় ঘন-ঘন ধাক্কার শব্দ শোনা গেল। 

সেই শব্দে কুকুরটা কান খাড়া করে উঠলো। ক্র্যাকিট দরজা খুলে দিতেই যে লোকটা ঘরে ঢুকলো, তার মুখ-চোখ বসে গেছে—দাড়ি কামানো হয়নি বোধহয় তিন দিন…যেন সাইকসের প্রেত সে! 

দু-একটা কথার পর সাইক্‌স্ ক্র্যাকিটকে জিজ্ঞাসা করলো : “তুমিই তো এবাড়ির কর্তা…তুমি কি আমাকে এখানে থাকতে দেবে?” 

ক্র্যাকিট একটু ইতস্তত করে উত্তর দিলো : “তুমি নিরাপদ বোধ করলে এখানে থাকতে পারো।” 

আবার সদর দরজায় কড়া নড়ে উঠলো। এবার এলো চার্লি বে। ঘরে ঢুকে সাইকে দেখে দু’পা পিছিয়ে গিয়ে সে বলে উঠলো : “আগে থেকে আমাকে এ কথা কেন বলোনি, টোবি? আমাকে অন্য কোনো ঘরে বসতে দাও।” সাইকস্‌ তার দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো : “চার্লি! চার্লি! তুমি কি আমাকে চিনতে পারছো না?” 

চার্লি আরও পিছিয়ে গিয়ে বললো : “আমার কাছে এসো না তুমি… দানো না কোথাকার!” 

শুনেই মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে পড়লো সাইক্‌স্। 

চার্লি ডান হাত মুঠো করে চেঁচিয়ে বলতে লাগলো : “তোমরা সবাই জেনে রেখো…আমি ভয় করি নে ওকে…ওরা ধরতে এলে আমি ওকে ধরিয়ে দেবো। ওর সাহস থাকে তো আমাকে খুন করুক….আমি নিশ্চয়ই ওকে ধরিয়ে দেবো!” 

সাইক্‌স্ আর সইতে পারে না চার্লির মতো একটা ছোকরার বেপরোয়া বেইমানী। সে চার্লির দিকে হিংস্র আক্রোশে তাকাতেই চার্লি চেঁচাতে লাগলো : “আমাকে খুন করলে! কে আছো, বাঁচাও!” এই বলে সে হঠাৎ সাইকসের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে ঘুষি ও লাথি মেরে মাটিতে ফেলে দিলো। 

হঠাৎ চার্লির এই কাণ্ড দেখে ঘরের অন্য তিনজন হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো, আর ওরা দুজনে মাটির ওপর পড়ে ধস্তাধস্তি করতে লাগলো। সাইকসের কিল-চড় উপেক্ষা করে চার্লি সাহায্যের জন্যে চেঁচাতে শুরু করলো, কিন্তু সাইক্‌স্ তাকে হাঁটুর নিচে ফেলে তার গলা চেপে ধরলো। এই সময় ক্র্যাকিট সভয়ে জানালার দিকে আঙুল বাড়াতেই সকলে দেখলো, বাইরের গলিতে মশালের আলো দেখা যাচ্ছে—শোনা যাচ্ছে অনেক লোকের চেঁচামেচি আর পায়ের শব্দ। তাদের মধ্যে একজনকে দেখা গেল ঘোড়ার পিঠে। তিনি হচ্ছেন ডাক্তার লসবার্ন। কিছুক্ষণ বাদে বাড়ির সদর দরজায় জোর জোর যা পড়তে লাগলো, আর জনতার ভীষণ চেঁচামেচি শোনা গেল। 

গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো চার্লি : “হ্যাঁ হ্যাঁ, এখানেই আছে সেই খুনে লোকটা! দরজা ভেঙে ফ্যালো তোমরা!” 

সঙ্গে সঙ্গে নিচের দরজা-জানলায় আবার জোর ধাক্কা পড়তে লাগলো।

দাঁত খিঁচিয়ে সাইক্‌স্ বলে উঠলো : “এমন একটা ঘর খুলে দাও, যেখানে এই শয়তানের বাচ্চাটাকে আটকে রাখতে পারি!” 

চার্লিকে টেনে হিঁচড়ে একটা ঘরে আটকে রেখে, সাইক্‌স্ জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে জনতার উদ্দেশে বললো : “তোমাদের যা ক্ষমতা আছে করো—আমি ঠিক তোমাদের কলা দেখাবো।” 

একথা শুনে জনতা হৈ হৈ করে চেঁচিয়ে উঠলো। 

ঘোড়সওয়ার ডাক্তার লসবার্ন চেঁচিয়ে ঘোষণা করলেন : “যে একখানা ম‍ই এনে দিতে পারবে, তাকে বিশ গিনি পুরস্কার দেবো।” 

ঘোড়সওয়ারের কাছাকাছির লোকগুলো সেই ঘোষণা আওড়াতে লাগলো। কেউ কেউ মই নিয়ে আসার জন্যে চেঁচাতে লাগলো; কেউ কেউ মশাল-হাতে ছুটোছুটি শুরু করলো; আবার কেউ-বা পাগলের মতো বাড়ির দেওয়াল বেয়ে দোতলায় ওঠার চেষ্টা করতে লাগলো। 

সাইক্‌স্ একগোছা লম্বা দড়ি যোগাড় করে বাড়ির ছাদে গিয়ে উঠলো। আশেপাশের বাড়ির ছাদে ও বারান্দায় যে-সব উৎসুক নরনারী দাঁড়িয়ে ছিলো, তারা চেঁচিয়ে নিচের জনতাকে জানিয়ে দিলো যে, খুনে লোকটা ছাদে উঠেছে। এদিকে কার্নিশের ওপরে দাঁড়িয়ে সাইক্‌স্ নিচে তাকিয়ে দেখলো, খালে জল নেই, শুধু কাদা আর কাদা, অনেকটা খাদের মতো। 

অতো উঁচু থেকে কিভাবে লাফিয়ে খালে পড়বে তা ভাবতেই গা শিউরে উঠলো সাইকসের। তার চোখে-মুখে হতাশা দেখা গেল। 

জনতার মধ্যে ছিলেন মিঃ ব্রাউন্‌লো। তিনি এবার চেঁচিয়ে বলে উঠলেন : “যে ওই খুনেকে জ্যান্ত ধরতে পারবে, তাকে পঞ্চাশ পাউন্ড পুরস্কার দেবো।” 

জনতা গর্জে উঠে সাইকে ধরার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়লো! 

সাইক্‌স্ মরিয়া হয়ে ছাদের দরজা দিয়ে বাড়ির চিমনির মাথায় উঠে দাঁড়ালো। হাতে তার একটা লম্বা শক্ত দড়ি। নিচে থেকে চিমনির মাথায় সাইকে দেখে জনতা ভীষণ হৈ-হল্লা করতে লাগলো। সাইক্‌স্ ওদিকে নজর না দিয়ে দাঁত ও হাত দিয়ে অপূর্ব কৌশলে এক মুহূর্তের মধ্যে দড়ির একটা ফাঁস তৈরি করলো, আর সেই দড়ির একমাথা বাঁধলো চিমনির সঙ্গে। তার মতলব ছিলো, ফাঁসটার মধ্যে মাথা গলিয়ে সেটা ডান বগলের তলা দিয়ে নিজের শরীরটাকে ফাঁস দিয়ে ভালো করে বাঁধবে, যাতে চিমনির মাথা থেকে দড়ি ফেলে তা বেয়ে পেছনের খাদে নামার সময় কোনো অসুবিধা না হয়। খাদের মাটিতে পড়ার কিছু আগেই দড়িটাকে কেটে ফেলার জন্যে সে হাতে একটা ছুরি নিলো। ছুরিটা বাগিয়ে ধরে ফাঁসটার মধ্যে নিজের মাথা গলিয়ে দিতে যাবে, এমন সময় তাকে লক্ষ্য করে জনতা ভীষণ গর্জে উঠলো। 

খুব তাড়াতাড়ি সাইক্‌স্ ফাঁসের মধ্যে মাথা গলিয়ে দিলো, কিন্তু ফাঁসের দড়িটা ডান বগলের তলায় টেনে আনার আগেই হঠাৎ বিকারের ঘোরে সে চেঁচিয়ে উঠলো : “আবার সেই চোখ!”

তারপরই কাঁপতে-কাঁপতে পড়ে গেল সে চিমনির মাথা থেকে, আর ফাঁসটা বগলের তলায় না আটকে গলায় জড়িয়ে গেল। প্রায় পঁয়ত্রিশ ফুট নিচে ঝুলে পড়লো সাইক্‌স্ ফাঁসটা গলায় জড়িয়ে, আর তার প্রাণহীন দেহটা দড়িতে ঝুলতে লাগলো…ছুরিধরা হাতের মুঠোটা তখন শক্ত হয়ে গেছে। 

এই সময়ে সাইকসের কুকুরটা কোথা থেকে ছুটে এসে ঝুলন্ত দড়িটা তাক করে একটা লাফ দিলো, কিন্তু দড়ির নাগাল না পেয়ে একেবারে খাদের মধ্যে গিয়ে পড়লো, আর একটা পাথরে তার মাথা ছেঁচে গিয়ে ঘিলু বেরিয়ে পড়লো। 

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন