উজিরকন্যের বুদ্ধি – নবনীতা দেবসেন

নবনীতা দেবসেন

এক দেশে এক রাজা ছিলেন।

তিনি তাঁর উজিরকে নিয়ে রোজ দরবারে বসেন। উজির খুব জ্ঞানী, তাই তিনি প্রধানমন্ত্রী—বসেন রাজার ডানদিকের আসনে।

দিব্যি চলছিল রাজ্যপাট, হঠাৎ রাজার মনে কী যেন হল!

 হঠাৎ কী কুক্ষণে

 রাজার হল মনে

 বুড়ো হয়ে উজির বাবুর

 বুদ্ধি গেছে কমে।

রাজা ঠিক করলেন উজিরমশাইয়ের বুদ্ধির পরীক্ষা নিতে হবে! রাজার যেমন ভাবা, তেমনি কাজ! তিনি উজিরকে ডেকে পাঠালেন নিজের গোপনঘরে। হঠাৎ কেন গোপনঘরে ডাক? উজিরের তো আগে থেকেই বুক ধুকপুক। কেবল খুব গোলমেলে পরামর্শের জন্যেই তো ওখানে ডাক পড়ে। আবার কী হল? শত্রুটত্রু আসছে নাকি দেশে? যুদ্ধুটুদ্ধু বাধাবে নাকি? উজির তো গিয়ে হাজির।

—”বলুন, রাজামশাই!”

কোনো ধানাই পানাই না করে রাজা বললেন, ”তোমার বুদ্ধির পরীক্ষা নেব। মন দিয়ে শোনো।”

উজির বললেন, ”শুনছি মহারাজা। বলুন।”

তখন রাজা বললেন, ”তোমাকে তিনটে প্রশ্ন দিচ্ছি। কাল সকালেই জবাব চাই। না পারলে তোমার মুণ্ডু চাই।”

প্রশ্ন শুনে উজির তো ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে বাড়ি গেলেন। প্রশ্নগুলোর উত্তর তাঁর জানা নেই।

বাবার মুখের চেহারা দেখে ব্যস্ত হয়ে তাঁর মেয়েটি এসে জিজ্ঞেস করল, ”বাবা, তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে?”

”না মা, শরীর খারাপ হয়নি। রাজা তিনটে প্রশ্ন দিয়েছেন তার উত্তর যদি কাল সকালেই আমি না দিতে পারি তাহলে আমার মুণ্ডু যাবে।”

মেয়ে বললে, ”সে কী কথা, বাবা? তুমি হলে রাজার প্রধানমন্ত্রী, রাজার ডানদিকেই তোমার আসন—তুমি তিনটে প্রশ্নের জবাব দিতে পারবে না, তা কখনও হতে পারে? বলো তো শুনি এমন কী প্রশ্ন? দেখি যদি আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি।”

এখন হয়েছে কী, মেয়েটা ধাঁধার উত্তর বের করতে খুব ভালোবাসত।

মন্ত্রী তখন বললেন, ”প্রশ্ন তিনটে এই—সবচেয়ে মূল্যবান পাথরটি কী? সবচেয়ে মধুর শব্দটি কী? ঈশ্বরের পরে আমাদের প্রাণদান করে কে?”

মেয়ে মন দিয়ে শুনল। শুনে বলল, ”বাবা, ধাঁধাগুলো কঠিন নয়। পাথরের মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান হচ্ছে জাঁতার পাথর। আমাদের রুটি দেয়। শব্দের মধ্যে সবচেয়ে মধুর হচ্ছে প্রার্থনার জন্যে ডাক, আজানের শব্দ। আর ঈশ্বরের পরে যা প্রাণদান করে, তা হল জল। জল ছাড়া প্রাণ বাঁচে না।”

মন্ত্রী পরদিন গিয়ে রাজাকে এই উত্তরগুলি দিলেন। রাজা খুশি হলেন, কিন্তু তাঁর উজিরকে পরীক্ষা করার ইচ্ছে এখানেই থেমে গেল না।

উজিরকে তিনি একদিন একটা সোনার থালা দিলেন। তাতে একটি সোনার মুরগি খোদাই করা আছে, এবং সঙ্গে তার সোনার ছানারা, সবাই মুক্তোর দানা খাচ্ছে। রাজা বললেন উজিরকে,—”এই সোনার মুরগিটার ওর ছানাসমেত কত দাম হতে পারে, আমাকে জানাও। যদি বলতে পারো, তাহলে আমার থালাটা তোমার। আর যদি বলতে না পারো, তাহলে তোমার মুণ্ডুটা আমার!”

শুনে তো উজিরের খুব মনখারাপ। এ আবার কেউ বলতে পারে নাকি? খোদাই করা সোনার মুরগির ছাপসমেত থালার কত দাম? এটা একটা প্রশ্ন হল? উজির বাড়ি ফিরে মন খারাপ করে শুয়ে পড়লেন। দেখে মেয়ে বললে, ”বাবা আমাকে বলো, কী হয়েছে?”

উজির তখন মনের কষ্টে মেয়েকে বললেন রাজার খামখেয়ালি প্রশ্নের কথা। উজিরের মেয়ে শুনে ঠোঁট কামড়ে বললে, ”বটে? এই প্রশ্ন? তাহলে তুমি এই উত্তরটা দিও তাঁকে।

 মহারাজ।

 সোনার মুরগির দাম যত হয়,

 উজিরের মগজের কাম যত হয়,

 খরা জমিতে এক পশলা বৃষ্টির দাম

 তার চেয়ে ঢের ঢের গুণ বেশি হয়।”

মন্ত্রী গিয়ে রাজাকে ছড়াটা শোনালেন। রাজা চুপ।

এবারেও মন্ত্রীর বুদ্ধির কাছে হার মেনে রাজা আবার একটা নতুন উপায় ঠাওরালেন যাতে উজিরকে ফাঁদে ফেলতে পারেন। তিনি এবারে করলেন কি, উজিরকে একটা ভেড়া দিয়ে বললেন, ”তুমি কি—এই ভেড়া থেকে আমাকে এক রাত্তিরের ডিনার খাওয়াতে পারবে, তারপর এই ভেড়া থেকেই আমার কিছু টাকা রোজগার হয় যাতে, সেই ব্যবস্থা করতে পারবে, তারপর কাল সকালে এই ভেড়াটা জ্যান্ত আমাকে আবার ফেরত দিতে পারবে?”

উজির এবারে ভেড়া—বগলে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি এলেন। রাজার খামখেয়ালে তিনি অতিষ্ঠ। এবারে আর রক্ষে নেই। মেয়েকে বললেন, ”মাগো, আর আমরা পারলুম না। এবার আমার মুণ্ডু যাবেই। তুমি সাবধানে থেকো।”

মেয়ে বললে, ”কিচ্ছু ভাবনা নেই বাবা। কেঁদো না তুমি। আমি সব ঠিকঠাক করে দিচ্ছি। এটা দুম্বা ভেড়া তো, আগে তুমি ওর মোটাসোটা লেজটা কেটে নিয়ে এসো দেখি। দুম্বা ভেড়ার লেজ খুব মাংসল হয়। আর লেজ বাদ দিলেও ভেড়ার প্রাণের কিছু ক্ষতি হয় না। লেজটাতে যে মাংস ছিল সেটা রান্না করে তুলে রাখল মেয়েটি। তারপরে ভেড়াটার সব লোম চেঁছে নিয়ে উল—ওয়ালাদের কাছে বিক্রি করতে পাঠাল। লোম বিক্রি করে দশ টাকা নিয়ে এল উজিরের লোকটি। পরের দিন সকালে উঠে একহাতে ভেড়ার মাংসের পাত্র, অন্য হাতে ভেড়ার দড়ি, আর পকেটে দশ টাকা নিয়ে রাজসভায় গেলেন।

”এই যে আপনার জ্যান্ত ভেড়া। এই যে দশ টাকা, আপনার ভেড়ার লোম থেকে রোজগার। আর হুজুর এই নিন আপনার ভেড়ার ডিনার।”—

হেসে ফেলে রাজা বললেন, ”নাঃ, আর তোমাকে আমি প্রশ্ন করব না মন্ত্রী—কেবল এই একটি প্রশ্ন ছাড়া। বলো দেখি কেমন করে তুমি আমার প্রশ্নগুলির উত্তর দিতে পারলে?”

শুনে মন্ত্রীর ভয় করল। সত্যি বলবেন? সত্যি শুনলে যদি রাজা আবার খেপে যান? কিন্তু উজির রাজার কাছে কখনও মিথ্যে বলেন না—তাই তিনি এবারেও সত্যি কথাই বললেন। গর্বে বুক ফুলিয়ে উজির বললেন, ”মহারাজ, আমার ঘরে আমারও একটি খুদে মন্ত্রী আছে। আমার মেয়ে। সে খুব ধাঁধার উত্তর দিতে ভালোবাসে। আপনার সব প্রশ্নের উত্তর সেই আমাকে বলে দিয়েছে।”

সেই না শুনে, রাজা আহ্লাদে সিংহাসন ছেড়ে লাফিয়ে উঠলেন। আকাশে দু’হাত ছুঁড়ে রাজামশাই বললেন ”এই তো পেয়েছি, অবিকল এমনি একটি মেয়েকেই তো আমি সারাজীবন ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছি, রানি করব বলে!”

উজির এখনও রাজার ডানদিকের আসনে বসে হাসিমুখে মন্ত্রীগিরি করেন। উপরন্তু তিনি এখন রাজার শ্বশুর। রানিমার বাবা!

 রাজার প্রশ্ন ফুরোলো।

 উজিরের প্রাণ জুরোলো।।

 রাজার ঘরে রানি এলেন।

 উজির রাজার শ্বশুর হলেন।।

 রাজার মন্ত্রী রাজার রানি।

 সব প্রশ্নের জবাব জানি।।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন