সুগারু মিয়াকি
মিয়াগি যখন পর্যবেক্ষক হিসেবে আমার এপার্টমেন্টে এসেছিল, তার চাহনি দেখে খানিকটা অপ্রস্তুত বোধ করেছিলাম। তখন মনে হয়েছিল, এই মেয়ে না হয়ে মোটা, কুৎসিত, মধ্যবয়স্ক কোনো পুরুষকে পর্যবেক্ষক হিসেবে পেলেই বোধহয় হাঁফ ছেড়ে বাঁচতাম, নিজে কী করতে চাই সে ব্যাপারে আরও সৎ হতে পারতাম।
মিয়াগির পরিবর্তে যে পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব পালন করতে এসেছে, সে ঠিক ঐরকমই দেখতে। ছোটখাটো শরীর, মাথায় টাকের ছাপ পড়েছে, আর চেহারা একদম মাতালদের মতো। মুখে ধূসর রঙের মোচ আর তেলতেলে শরীর ছিল লোকটার। অস্বাভাবিক দ্রুত গতিতে সে চোখের পলক ফেলত, নাক দিয়ে ঘোঁত ঘোঁত করে শ্বাস নিত আর মোটা কন্ঠস্বরে কথা বলছিল মানুষটা; যেন তার গলায় একগাদা কফ জমা হয়ে রয়েছে।
“যে মেয়েটা ছিল, সে কোথায়?” সবার আগে এই প্রশ্নটাই করলাম তাকে। “ছুটিতে,” সোজাসাপটা জবাব দিল সে। “আমি ওর হয়ে আজকে আর কালকে দায়িত্ব পালন করব।”
নিজেকে স্থির রাখার চেষ্টা করলাম। আমার সৌভাগ্যই বলা চলে, এই পরিবর্তনটা স্থায়ী কোনো পরিবর্তন ছিল না। যদি দুইদিন অপেক্ষা করি, তবে মিয়াগি ফিরে আসবে।
“পর্যবেক্ষকদেরও তাহলে ছুটি দেয়া হয়,” আপনমনে আওড়ালাম আমি।
“পর্যবেক্ষকরা গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। তোমার মতো নই আমরা। আমাদের সময় পার হলে আমরা আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারব,” ব্যঙ্গ করে লোকটা বলল।
“শুনে খুব ভালো লাগছে। তাহলে দুদিন পরেই ওর ছুটি শেষ হবে আর ও ফিরে আসবে, তাই না?”
“তাই তো হবার কথা,” সে জবাব দিল।
চোখ ডলে ঘুম তাড়ানোর চেষ্টা করলাম। তারপর আমার এপার্টমেন্টের কোণে বসে থাকা মানুষটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা শুরু করলাম আমি। সে আমার ভেন্ডিং মেশিনের ছবিভর্তি ফটো অ্যালবামটা দেখতে ব্যস্ত ছিল।
“এটা আবার কী?” সে জিজ্ঞেস করল।
পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে বসলাম, “জীবনে কখনো ভেন্ডিং মেশিন দেখেননি?”
জিহ্বা দিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করার শব্দ করল সে। “আমার প্রশ্ন সেটা ছিল না। এইসব ছবি তোলার উদ্দেশ্যটা জানতে চাইছি আমি।”
“যারা আকাশ ভালোবাসে, তারা আকাশের ছবি তোলে। যারা ফুল ভালোবাসে, তারা ফুলের ছবি তুলে। যারা ট্রেনের ছবি ভালোবাসে, তারা ট্রেনের ছবি তোলে। আমার ভেন্ডিং মেশিন ভালো লাগে। সে কারণে ওগুলোর ছবি তুলি আমি।”
সে অনাগ্রহের ভঙ্গিতে অ্যালবামের আরও কয়েক পাতা ওল্টাল। তারপর “জঘন্য” বলে আমার দিকে অ্যালবামটা ছুঁড়ে মারল। পুরো ঘরটায় ওরিগামি পেপারে বানানো কাগজের সারস ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। সেসব দেখে বিরক্ত হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে।
“বাকি সময়টুকু তুমি এভাবে নষ্ট করছ? পুরোপুরি বোকামি হচ্ছে। এসব বাদে তোমার আর কিছু করার নেই?”
তার ভাবভঙ্গিতে অবশ্য আমি তেমন কিছু মনে করিনি। একদিক দিয়ে ভাবলে সে যে আমার সাথে সোজাসুজি রাখঢাক না রেখে কথা বলছে-এতে বরং আমার জন্য ভালোই হয়েছে। অন্তত হাঁটুজোড়া আঁকড়ে ধরে ঘরের এককোণে বসে থেকে আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার থেকে এভাবে রুক্ষ কথাবার্তা শোনা হাজারগুণে ভালো।
“তা হয়তো রয়েছে, কিন্তু এর থেকে আনন্দের কিছু করতে গেলে আমার আর সময় বাকি থাকবে না,” হাসিমুখে বললাম।
সে অবশ্য আরও কিছুক্ষণ আশেপাশের সবকিছু নিয়ে অনবরত অভিযোগ করে গেল। এই পর্যবেক্ষকটা বেশ মারমুখী মনে হচ্ছে, আমি ভাবলাম।
অবশ্য এরকম আক্রমণাত্মক হওয়ার কারণটা আমি দুপুরের খাবার পরপরই জানতে পেরেছিলাম। খেয়েদেয়ে আমি ফ্যানের নিচে শুয়ে গান শুনছিলাম তখন।
“অ্যাই, শোনো,” লোকটা আমাকে ডাকল। আমি না শোনার ভান করলাম। সে গলা খাকাড়ি দিয়ে আরও জোরে ডাকল আমাকে, “তুমি ওর সাথে কিছু করনি তো, তাই না?”
‘ওর’ সাথে, তার মানে মিয়াগির কথা বলছে মানুষটা। কিন্তু এভাবে ওর কথা বলছে কেন? তাই আমি একটু সময় অপেক্ষা করে মুখ খুললাম।
“মিয়াগির কথা বলছেন?”
“আর কার কথা বলতে যাব আমি?” ভ্রু কুচকে বিরক্তির দৃষ্টিতে সে আমার দিকে তাকাল, যেন আমি ‘মিয়াগি’ নামটা বলে ভুল করে ফেলেছি।
আচমকা মানুষটার প্রতি আমার শ্রদ্ধা বেড়ে গেল।
ওহ, তুমিও তাহলে আমারই মতো।
“এক মিনিট, আপনি কি ওর কাছের কেউ নাকি?”
“না, তা তো আমি বলিনি। আমরা তো একে অপরকে দেখতে পাই না,” সে জবাব দিল। আগের তুলনায় তুলনামূলক ভদ্রভাবেই জবাব দিল সে। “চিঠির মাধ্যমে দুই কি তিনবার ওর সাথে যোগাযোগ হয়েছে আমার। কিন্তু ও যখন তার সময় বিক্রি করতে এসেছিল, আমি তখন ডেস্কে ছিলাম। তাই ওর ইতিহাস আমার ভালোমতই জানা রয়েছে।”
“তখন কী মনে হয়েছিল আপনার?”
“ওর জন্য দুঃখ পেয়েছিলাম,” স্পষ্ট ভাষায় জবাব দিল মানুষটা। “অনেক অনেক দুর্ভাগ্য সইতে হয়েছে তাকে।”
একদম সোজাসাপটা সৎ প্রতিক্রিয়া ছিল সেটা।
“আয়ু বিক্রি করে দিয়ে আমি ওর সমানই টাকা পেয়েছি। আমার জন্য দুঃখবোধ হয় না?”
“মোটেও না। তুমি অতি শীঘ্রই মারা যাবে। তোমার কোনো মূল্যই নেই।”
“কথাটা ভুল বলেননি,” তার সাথে একমত হলাম।
“কিন্তু মেয়েটা এমন একটা জিনিস বিক্রি করেছিল, যা কোনোমতেই বিক্রি করা উচিত না। তখন তার বয়স ছিল মাত্র দশ। সে কী করতে যাচ্ছে, সে ব্যাপারে তার বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না। আহারে। দশ বছরের সেই বাচ্চাটাকে তোমার মতো নিহিলিস্টিক মানুষ, যারা কিনা বেঁচে থাকার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে, তাদের পর্যবেক্ষণ করতে হয়েছে মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। তুমি ওর কোনো ক্ষতি করনি তো? তোমার উত্তর থেকেই তোমার বাকি জীবন কীভাবে কাটবে, তা নির্ধারিত হয়ে যাবে।”
লোকটাকে আরও পছন্দ করে ফেললাম আমি।
“যতদূর মনে হয়, আমি ওর সাথে বেশ খারাপ আচরণই করেছি,” সত্যিটাই বললাম আমি। “বেশ বাজে বাজে কথা শুনিয়েছি তাকে, তাকে শারীরিকভাবে আঘাত করতে গিয়েও থেমে গিয়েছিলাম- সত্যি বলতে কী, একদিন আরেকটু হলেই তাকে ধর্ষণ করে বসতাম আমি।”
লোকটার মুখ রাগে বিবর্ণ হয়ে গেল, সে আমাকে মারার জন্য উঠে দাঁড়াচ্ছিল। মিয়াগির ফেলে যাওয়া নোটবুকটা তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে তাকে থামালাম।
“এটা কী?” নোটবুকটা সে হাতে নিল।
“আমার ধারণা, আমার সাথে ঘটা সবকিছুই ওখানে লেখা রয়েছে। মিয়াগি ভুলে এটা রেখে গিয়েছে। যাকে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে, তার তো ওটা পড়া উচিত না, ঠিক না?”
“পর্যবেক্ষণ জার্নাল?” সে পুনরাবৃত্তি করল শব্দটা। তারপর বুড়ো আঙ্গুলটা জিহ্বায় ঠেকিয়ে পাতা ওল্টানো শুরু করল।
“আপনার চাকরির ব্যাপারে তেমন কিছুই জানা নেই আমার, তবে ভাবভঙ্গিতে মনে হয় আপনারা নিয়মের ব্যাপারে ততটা কঠোর নন। তা সত্ত্বেও আমি চাই না এরকম কোনো ভুলের কারণে মিয়াগি শাস্তি পাক। তাই আপনাকে দিয়ে দিলাম নোটবুকটা।”
সে নোটবুকটা খুলে কয়েক পাতা ওল্টাল। ভেতরের লেখাগুলোয় দ্রুত চোখ বোলাল সে। দুমিনিটের মাথায় শেষ পাতায় পৌঁছে আপনমনে বলে উঠল, “আচ্ছা।”
ওখানে কী লেখা রয়েছে তা আমার জানা নেই। তবে এরপর থেকে মানুষটা আমার সাথে আর খারাপ ব্যবহার করেনি। বোধহয় ওখানে আমার ব্যাপারে বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ ভাষায় লিখেছিল। হঠাৎ করে আমার খুশি খুশি লাগতে লাগল।
.
যদি নিজের একটা নোটবুক কেনার চিন্তা মাথায় না আসত, তবে হয়তো আমি এই ঘটনাগুলো লিখে যেতে পারতাম না। মিয়াগির নোটবুকটা মধ্যবয়স্ক মানুষটার হাতে দেবার পর সিদ্ধান্ত নিলাম, আমারও একটা নোটবুক চাই। স্টেশনারি দোকানে গিয়ে একটা ই-৫ সাইজের সুবামে নোটবুক আর সস্তা একটা ফাউন্টেন পেন কিনে আনলাম। এখন সেটায় কী লিখব সেটাই ভাবছিলাম।
ভাবলাম, মিয়াগির সাথে আমি যা যা করতে পারিনি, আগামী দুদিন নতুন এই পর্যবেক্ষকের এর সাথে করা যাক। প্রথমে আত্মঘাতী কিছু করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু মিয়াগি ফেরার পর আমার ভেতরের অনুশোচনাটা খুব সহজেই টের পেয়ে যাবে। তাই মিয়াগিকে দেখতে দিতে চাই না, এমন সব কাজ করার সিদ্ধান্ত নিলাম আমি
যেদিন সিঁড়ি বেয়ে পুরোনো বিল্ডিংটার চতুর্থতলায় গিয়ে আমার আয়ু বিক্রি করে এসেছিলাম, সেদিন থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া সবকিছু নোটবুকে লিখলাম। প্রথম পৃষ্ঠায় আমি এলিমেন্টারি স্কুলে শেখা নীতি-নৈতিকতার বাণীগুলো লিখে ফেললাম। এরপর কী লিখব, তার জন্য খুব একটা চিন্তা করা লাগল না।
সবার আগে লিখলাম আয়ুর মূল্য সম্পর্কে আমার ধারণার কথা।
বড় হয়ে আমি গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ হব, ছোটবেলার এরকম চিন্তাভাবনার কথা লিখলাম।
হিমেনোর সাথে করা প্রতিজ্ঞার কথা লিখলাম
কীভাবে আয়ু বেচাকেনার এই জায়গার কথা সিডির দোকান আর বইয়ের দোকান থেকে জেনেছি সেটাও লিখলাম।
মিয়াগির সাথে প্রথমবার সাক্ষাতের কথা লিখে ফেললাম।
লেখাগুলো আপনাআপনি নিজে থেকেই যেন তৈরি হয়ে যাচ্ছিল। চুটিয়ে সিগারেট খেলাম (একটা খালি সোডা ক্যান অ্যাস্ট্রে হিসেবে ব্যবহার করেছি যাতে আমার লেখাতে সম্পূর্ণ মনোযোগটা দিতে পারি)। কলমে খসখস করে লেখার শব্দটা কানে মধুর লাগছিল। ঘরের ভেতর প্রচণ্ড গরম আর আর্দ্র বোধ হচ্ছিল। কপাল থেকে একফোঁটা ঘাম কাগজে পড়ে কয়েকটা শব্দ মুছে দিল।
“তুমি কী লিখছ?” মানুষটা আমায় জিজ্ঞেস করল।
“গত একমাস ধরে আমার সাথে যা যা ঘটেছে, তা লিখছি।”
“কেন? যাতে অন্য কেউ লেখাটা পড়তে পারে?”
“জানি না। আসলে কোনোকিছুতেই আমার আসে যায় না। লিখছি কারণ আমার মাথার ভেতর সবকিছুকে গোছাতে মন চাইছে। সবকিছু মাথায় নিয়ে জায়গামতো গুছিয়ে রাখছি।”
একটানা আমি লিখেই চললাম। লেখার ভাষা প্রাঞ্জলের ধারেকাছেও ছিল না। তবে এভাবে একটানা মন থেকে লিখে যেতে পারছি, ব্যাপারটা আমায় অবাক করছে।
দশটার পরে হঠাৎ করে শব্দ বের হওয়া বন্ধ হয়ে গেল। উপলব্ধি হলো, আজকে এর বেশি আমার পক্ষে লেখা সম্ভব না। ফাউন্টেন পেনটা টেবিলে রেখে আমি হাওয়া খেতে বাইরে গেলাম। মধ্যবয়ষ্ক মানুষটা বিরক্তির ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে অনুসরণ করল।
কোনোপ্রকার গন্তব্য ছাড়া রাতের গভীরে বের হয়েছি। দূর থেকে তাইকো ড্রাম বাজানোর শব্দ কানে এলো। বোধহয় কেউ সামনের উৎসবে বাজানোর জন্য অনুশীলন করছে।
“আচ্ছা, আপনি যেহেতু পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব পালন করছেন-তার মানে আপনিও আপনার জীবনের সময় বিক্রি করে দিয়েছেন?” ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে থাকা মানুষটাকে জিজ্ঞেস করলাম।
“যদি বলি হ্যাঁ, তবে তুমি কি আমায় করুণার চোখে দেখা শুরু করবে?” ঘোঁত করে উঠল সে।
“হ্যাঁ, আমি করব।”
আমার উত্তরে বেশ অবাক হলো সে। “আচ্ছা- ধন্যবাদ সেজন্য। কিন্তু সত্যিটা হলো, না আমি আমার আয়ু, সময় কিংবা স্বাস্থ্য কোনোটাই বিক্রি করিনি। এ কাজ করতে ভালো লাগে বলেই আমি কাজটা করি।”
“তার মানে আপনার পছন্দ একদমই ভালো না। এ কাজে কীভাবে আনন্দ খুঁজে পান আপনি?”
“আনন্দ না। কাজটাকে অন্যের কবর পরিদর্শন করার সাথে তুলনা করা যায়। আমিও তো একদিন মারা যাব। এজন্য অসংখ্য মানুষের মৃত্যুর আশেপাশে থাকছি, যাতে আমার সময় হয়ে এলে সেটার জন্য প্রস্তুত থাকতে পারি।”
“বুড়ো মানুষেরা এভাবে চিন্তাভাবনা করে।”
“আমি তো বুড়োই,” জবাব এলো।
এপার্টমেন্টে ফিরে গেলাম। গোসল সেরে এক ক্যান বিয়ার শেষ করে, দাঁত মেজে বিছানা সাজাচ্ছি, কিন্তু বাগড়া বাঁধালো পাশের এপার্টমেন্টের বাসিন্দারা। আজও তারা হইহুল্লোড় করছে। তাদের বারান্দার জানালা খোলা থাকায় টের পাচ্ছিলাম তিন কি চারজন মানুষ ভেতরে আড্ডা দিচ্ছে। সারাদিনই বোধহয় ঐ বাসায় মানুষ ভর্তি থাকে। এটাই ছিল আমার বাসার সাথে ওদের বাসার পার্থক্য। আমার বাসায় দুজন পর্যবেক্ষক বাদে আর কারো পদধূলিই পড়েনি।
ইয়ারপ্লাগ হিসেবে কানে হেডফোন লাগিয়ে, বাতি নিভিয়ে চোখ বন্ধ করলাম।
মনে হয় লেখালেখি করতে গিয়ে আমি আমার মস্তিষ্কের একটা অব্যবহৃত অংশ প্রচুর পরিমাণে ব্যবহার করেছি আজকে। তাই একটানা এগারঘণ্টা ঘুমালাম আমি। এর মধ্যে একবারো ঘুম ভাঙেনি আমার।
পরের দিনটাও নোটবুকে শব্দ ভরাতেই ব্যস্ত রইলাম। রেডিও চালু ছিল পাশেই, অবশ্য তাতে কোশিয়েন হাইস্কুল বেসবল টুর্নামেন্ট বাদে আর কোনো খবরই শোনালো না। অবশেষে সেদিন সন্ধ্যার মধ্যে এতদিন ধরে ঘটে যাওয়া সবকিছুকে লিপিবদ্ধ করতে সক্ষম হলাম।
কলমটা হাত থেকে ছেড়ে দিতেই টের পেলাম, আঙ্গুলগুলো থরথর করে কাঁপছিল। হাতের মাংসপেশিগুলো প্রচণ্ড যন্ত্রণায় চিৎকার করছিল। ঘাড় এতক্ষণ স্থির থাকতে থাকতে পাথরের মতো ভারি হয়ে গিয়েছিল। আর তীব্র মাথা ব্যথা করছিল আমার। কিন্তু কোনোকিছু শেষ করার যে আনন্দ, সেটা মন্দ ছিল না। আর স্মৃতিগুলোকে খাতায় লেখার পর সুখের অনুভূতিগুলোকে বারবার মনে করা আর খারাপ স্মৃতিগুলোকে মেনে নেয়া সহজ হয়ে গিয়েছিল আমার জন্য।
মেঝেতে পিঠ ঠেকিয়ে শুয়ে ছাদের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। ছাদে একটা কুৎসিত কালো দাগ দেখতে পাচ্ছি-কোথা থেকে দাগটা এল জানা নেই-আর কয়েকটা পেরেকের মাথা ছাদের এখানে-সেখানে বের হয়ে আছে। ঘরের এককোণে মাকড়সা জাল পেতেছে।
ঘর থেকে বের হলাম।
কাছের একটা মিডল স্কুলের মাঠে বেসবল খেলা চলছিল, সেটা দেখে কিছুক্ষণ সময় নষ্ট করলাম। তারপর স্থানীয় একটা সস্তা কেনাবেচার বাজার ঘুরে ঘুরে দেখলাম আমি। শেষমেশ একটা ডাইনিং হলে গিয়ে জঘন্য স্বাদের খাবার দিয়ে রাতের খাবারের পালা সেরে নিলাম।
মিয়াগি আগামীকালই ফিরে আসছে, মনে মনে ভাবলাম।
সিদ্ধান্ত নিলাম, আজকে তাড়াতাড়িই শুয়ে পড়ব। টেবিলে নোটবুকটা খোলা রেখেই চলে গিয়েছিলাম। সেটা বইয়ের তাকে গুছিয়ে রেখে বিছানা গোছাচ্ছি, এমন সময় মানুষটা মুখ খুলল।
“এই প্রশ্নটা আমি সকলকেই করে থাকি, তাই তোমাকেও করছি। তোমার আয়ু বিক্রি করে পাওয়া টাকাটা দিয়ে তুমি কী করেছ?”
“ওটা মিয়াগির জার্নালে লেখা নেই?”
“অতটা মনোযোগ দিয়ে পড়িনি।”
“আমি রাস্তায় গিয়ে আমার পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া সকলের হাতে একটা করে নোট ধরিয়ে দিয়েছিলাম,” আমি বললাম। “কিছু টাকা দৈনন্দিন কাজে ব্যয় করেছি অবশ্য। সবগুলো টাকা একজনকে দিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সে আমার জীবন থেকে সরে দাঁড়ানোয় টাকাগুলো দিয়ে আর কী করা যায়, মাথায় আসেনি। তাই অচেনা মানুষদের মধ্যে টাকাগুলো বিতরণ করে দিয়েছি।”
“প্রত্যেককে একটা করে নোট হাতে ধরিয়ে দিয়েছ?”
“হ্যাঁ। সবার হাতে হাতে একটা করে দশহাজার ইয়েনের নোট ধরিয়ে দিয়েছি।”
মানুষটা গলা ফাটিয়ে হাসতে শুরু করল।
“হাস্যকর একটা কাজ করেছি, তাই না?” আমি বললাম।
“না, সে কারণে হাসছি না আমি,” মানুষটা হাসতে হাসতেই বলল। “তাহলে তুমি টাকার বিনিময়ে নিজের জীবনটা বিক্রি করে দিয়েছ, আর সেই টাকা অচেনাদের মধ্যে বিলিয়েও দিয়েছ-তাও আবার কোনো কারণ ছাড়াই।
“মোটা দাগে বললে, হ্যাঁ তাই ঘটেছে,” জবাব দিলাম।
“একদম হদ্দ বোকা একটা মানুষ তুমি।”
“কথাটার সাথে একমত। টাকাটা ব্যবহার করার আরও সুন্দর কোনো পথ বেছে নেয়া যেত। ঐ টাকাটা দিয়ে আরও অনেক কিছু করতে পারতাম আমি।”
“না। সেটার জন্য আমি হাসছি না,” সে আবারো একই উত্তর দিল। কৌতূহলী হয়ে উঠলাম
কিছুক্ষণ পর সে প্রশ্ন করল আমাকে, “আচ্ছা, শোনো। তোমাকে ওরা প্রতিষ্ঠান থেকে বলে দিয়েছে যে, তোমার জীবনের মূল্য মাত্র তিনশো হাজার ইয়েন-আর তুমি সেটাই মেনে নিয়েছ, তাই না?”
প্রশ্নটা আমার ভেতরটা একদম কাঁপিয়ে দিল।
“কী বলতে চাইছেন?” জিজ্ঞেস করলাম আমি।
“যেটা ভাবছ ঠিক সেটাই বলতে চাইছি। যখন ওরা বলল তোমার জীবনের মূল্য ‘অমুক’, তুমি চুপচাপ সেটাই মেনে নিয়ে টাকাটা হাতে নিয়ে নিলে?”
“হ্যাঁ, তাই করেছি আমি। অবশ্য প্রথম প্রথম আমার কাছেও টাকার পরিমাণটা কম লেগেছিল।”
সে আবার হাসতে শুরু করল। নিজেকে সামলাতে না পেরে মেঝেতে একটা ঘুষি মেরে বসল সে।
“ঠিক আছে ঠিক আছে! শোন, আমি বেশি কিছু বলতে পারব না,” একহাত দিয়ে পেট ধরে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করল সে, “তবে আগামীকাল ও ফিরে এলে ওকেই না হয় জিজ্ঞেস কর। ওকে প্রশ্ন করবে, ‘আচ্ছা, আমার জীবনের মূল্য কি আসলেই তিনশো হাজার ইয়েন ছিল?”
লোকটাকে এ ব্যাপারে আরও প্রশ্ন করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তার মধ্যে উত্তর দেবার কোনো ইচ্ছে দেখলাম না।
তাই অন্ধকারের মধ্যে শুয়ে থেকে ছাদের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম আমি।
পুরোটা সময় মানুষটার বলা কথাটা মাথায় ঘুরতে থাকল।
“শুভ সকাল কুসুনোকি।”
জানালা দিয়ে আসা সূর্যের আলো আর মিয়াগির কন্ঠস্বরে ঘুম ভাঙল আমার।
ঐ যে, ঘরের কোণে বসে রয়েছে সে, মুখে বন্ধুত্বপূর্ণ এক হাসি। সে একটা মিথ্যাবাদী।
“কীভাবে আজকের দিনটা কাটাতে চাও?”
জবাবটা ঠোঁটে এসে গিয়েছিল প্রায়, কিন্তু সেখানেই থামিয়ে দিলাম।
সিদ্ধান্ত নিলাম, বোকা সেজেই থাকব আমি। মিয়াগির কাছ থেকে সত্য আদায় করতে গিয়ে ও যদি কষ্ট পায়? সে কাজটা আমি করতে পারব না।
“সাধারণত যেভাবে কাটাই, সেভাবেই কাটাব,” জবাব দিলাম।
“ভেন্ডিং মেশিন দর্শনের অভিযান,” হাসিখুশি চেহারায় মিয়াগি বলে উঠল।
.
নীল আকাশের নিচে গ্রামের প্যাঁচালো রাস্তা ধরে সামনে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। সামনের একটা রেস্ট-স্টপ পাওয়ায় বাইক থামিয়ে সেখান থেকে লবণ দিয়ে গ্রিল করা মাছ আর সফট-সার্ভ আইস্ক্রিম খেলাম। আবার যাত্রা শুরু হলো। একটা প্রায় জনমানবহীন, ব্যবসাশূন্য এলাকা চোখে পড়ল। অবাক ব্যাপার, এলাকায় অসংখ্য বাইসাইকেল সাজানো ছিল।
দেখতে দেখতে রাত নেমে এল।
একটা ছোট সাইজের বাঁধ এর পাশে বাইক পার্ক করে নিলাম। তারপর একটা সিঁড়ি ধরে নিচে নেমে একটা হাঁটাচলার পথে উঠলাম
“কোথায় যাচ্ছ তুমি?”
ঘাড় ঘুরালাম না। “যদি আমি তোমাকে বোকা বানিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন কোথাও নিয়ে যাই, তবে তুমি কী করবে?”
“তার মানে-তুমি কি আমাকে কোনো অপরূপ দৃশ্য দেখানোর জন্য কোথাও নিয়ে যাচ্ছ?”
“তুমি কথাটা অন্যভাবে নিলে,” বললাম আমি। কিন্তু মিয়াগি ঠিকই ধরতে পেরেছিল।
বনের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝরনাধারার ওপরের ছোট্ট ব্রিজ পার হচ্ছিলাম আমরা। ঠিক তখনই মিয়াগি বুঝতে পারল আমি কী করতে যাচ্ছি।
আশপাশের দৃশ্য দেখে মিয়াগি মোহগ্রস্ত হয়ে গিয়েছিল। “জানি না এতক্ষণ পর বলাটা ঠিক হচ্ছে কিনা, কিন্তু জোনাকি পোকারা রাতে আসলেই অনেক তীব্রভাবে জ্বলজ্বল করে, তাই না?”
হেসে ফেললাম। “সেজন্যই তো এর নাম ফায়ারফ্লাই (জোনাকি পোকা)। নাহলে মানুষ একে এই নামে ডাকবে কেন?” তবে কথাটার গূঢ় অর্থটা ধরতে পেরেছিলাম। লেকের ওপরের আকাশে থাকা জ্বলজ্বলে তারাগুলো দেখে আমারও ঠিক একই রকম বোধ হয়েছিল। তোমার জানা আছে যে, এসব জিনিস বাস্তবে রয়েছে। কিন্তু সেগুলোর সৌন্দর্য যখন মাত্রা ছাড়িয়ে যায়, এসব তথ্য কোনো কাজে লাগে না। নিজে না দেখা পর্যন্ত ব্যাপারটা তাই মোটেও উপলব্ধি করা সম্ভব না।
পথটা ধরে আমরা ধীরে ধীরে হাঁটতে থাকলাম। আর আমাদেরকে ঘিরে অগণিত সংখ্যক মিটমিট করে জ্বলা আলোর বিন্দু ঘুরে বেড়াতে লাগল। তবে এসময় কিন্তু সতর্ক থাকতে হবে তোমাকে, কারণ একদৃষ্টিতে আলোর বিন্দুগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকলে অনেকসময় নিজের ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যাওয়াটাও অস্বাভাবিক না।
“বোধহয় এই প্রথম আমি জোনাকি পোকা সামনাসামনি দেখতে পেলাম,” মিয়াগি বলল।
“কয়েকবছর ধরে এদের সংখ্যা অনেক কমে গিয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট কোনো স্থানে না গেলে তুমি এদের দেখা পাবে না আজকাল। এমনকি কদিন পর এখানেও তাদের দেখা মিলবে না।”
“তুমি কি এখানে প্রায়ই আসো কুসুনোকি?”
“না, গতবছরই প্রথম আসা হয়েছিল এখানে। গতকাল হঠাৎ মনে পড়ল এ জায়গাটার কথা।”
অবশেষে নির্দিষ্ট সময় পর জোনাকি পোকারা বিদায় নিল, আমরাও আমাদের ফেরার পথ ধরলাম।
“লেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য ধন্যবাদ হিসেবে এটাকে নেব নাকি?” মিয়াগি আমাকে জিজ্ঞেস করল।
“এখানে আসার সিদ্ধান্তটা আমারই ছিল, তাই এখানে আসা। এর বাইরে আর কোনো উদ্দেশ্য ছিল না আমার। তুমি চাইলে যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে ধরে নিতে পার।
“ঠিক আছে। আমি আমার ইচ্ছেমতোই ধরে নিলাম।”
“সেটা তো তোমার বলতে হবে না।”
অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে নিত্যদিনের কাজগুলো সেরে নিলাম : ছবিগুলোকে অ্যালবামে সাজানো, বিছানা গোছানো, মিয়াগি ‘শুভরাত্রি’ জানানো। বাতিটা নিভিয়ে দিচ্ছি, এমন সময় আমি আবার মুখ খুললাম।
“মিয়াগি।”
“বলো।”
“তুমি আমাকে মিথ্যা কেন বলেছিলে?”
সে উঠে বসে আমার দিকে তাকিয়ে কয়েকবার চোখের পলক ফেলল। “তোমার কথা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।”
“তাহলে একদম সোজাসুজিই বলি-আমার জীবনের মূল্য কি আসলেই তিনশো হাজার ইয়েন ছিল?”
বাইরে থেকে আসা চাঁদের আলোয় স্পষ্টভাবে তার চোখের পরিবর্তনটা টের পেলাম।
“হ্যাঁ,” সে বলল। এর জন্য অনেক দুঃখিত আমি, কিন্তু ওটাকে তোমার মেনে নিতেই হবে।”
“আমি গতরাত পর্যন্ত মেনেই নিয়েছিলাম।” তাকে বললাম।
মিয়াগি বুঝতে পারল, নিশ্চয়ই আমার বলা কথাগুলোর পেছনে নির্দিষ্ট কোনো কারণ রয়েছে। “আমার জায়গায় আসা পর্যবেক্ষক কি তোমাকে কিছু বলেছে?” দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে বলল।
“সে খালি ব্যাপারটা আরেকটু ঘেঁটে দেখতে বলেছে। কোনোরকম তথ্য অবশ্য সে আমাকে দেয়নি।”
“যে যাই বলুক, তিনশো হাজার ইয়েন হচ্ছে তিনশো হাজার ইয়েন। এর বাইরে জানার মতো আর কোনো তথ্য নেই।” উত্তর দিল সে। সোজা কথায় চিড়ে ভিজবে না, বুঝতে পারলাম।
“তুমি আমার সাথে মিথ্যা কথা বলছ’, এটা শোনার পর সবার আগে মনে হয়েছিল—তুমি বোধহয় আমার প্রাপ্য টাকাটা মেরে দিয়েছ।”
সে আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল।
“প্রথম দিকে আমি ভেবেছিলাম আমার জীবনের মূল্য ত্রিশ মিলিয়ন ইয়েন কিংবা তিন বিলিয়ন ইয়েন হবে। তুমি সে টাকাটা মেরে দিয়ে আমাকে ভুলভাল বুঝিয়েছ কিন্তু কথাটা মোটেও বিশ্বাস হলো না আমার। আমার সাথে প্রথমবার দেখা হবার মুহূর্ত থেকেই তুমি আমার সাথে মিথ্যা কথা বলে আসছ কোনোভাবেই মেনে নিতে পারলাম না আমি। তোমার হাসির আড়ালেও কোনো মিথ্যা লুকিয়ে আছে, ব্যাপারটা বিশ্বাস হলো না। ভাবলাম, আমার হিসেবে কোথাও ভুল হচ্ছে। তাই সারারাত ধরে ব্যাপারটা ভেবে ভেবে অবশেষে আমার ভুলটা ধরতে পেরেছি আমার প্রাথমিক চিন্তাভাবনাতেই ভুল ছিল।”
দশবছর আগে ক্লাসের শিক্ষিকা যে কথাটা আমাকে বলেছিলেন, সেটাই আবার কানে বেজে উঠল।
ওভাবে নিজের জীবনের মূল্য বের করার চেষ্টা কর না।
“আমার জীবনের প্রতিবছরের মূল্য সর্বনিম্ন দশ হাজার ইয়েন করে হবে-এটাই কেন ধরে নিয়েছিলাম আমি? কেন আমি ভেবেছিলাম মিলিয়ন কিংবা বিলিয়ন ইয়েনের বিনিময়ে মানুষের জীবন বিক্রি করে দেয়া সম্ভব? কারণ, নিজেকে খুব বেশি জ্ঞানী ভাবা শুরু করেছিলাম আমি। হয়তো ভেতরে ভেতরে এই ফালতু আশাটা আঁকড়ে ধরে রেখেছিলাম—’মানুষের জীবন তো পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান বস্তু’। আগে থেকে বিশ্বাস করে আসার কথাটার মধ্যে খুব বেশিই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে শুরু করেছিলাম আমি। একটু খোলা মন নিয়ে ভাবা উচিত ছিল আমার।”
জোরে একটা শ্বাস টেনে নিলাম। তারপর আবার কথা বলতে শুরু করলাম আমি, “এখন বলো-তুমি কেন একদম অচেনা একটা মানুষের হাতে তিনশো হাজার ইয়েন তুলে দিয়েছিলে?”
মিয়াগি “তুমি কী বোঝাতে চাইছ তা আমার বোধগম্য হচ্ছে না,” বলে আমার চোখ থেকে চোখ সরিয়ে অন্যদিকে তাকাল।
আমি উঠে গিয়ে মিয়াগির সামনে গিয়ে তার মতোই হাঁটুকে আলিঙ্গন করে বসে পড়লাম।
আমার এহেন কাণ্ডকীর্তি দেখে মিয়াগির মুখে একটু হলেও হাসি ফুটল। “যদি তুমি এখন জেনেও না জানার ভান কর, তাতে সমস্যা নেই আমার। শুধু এটুকু বলতে চাই : তোমাকে ধন্যবাদ।”
মিয়াগি মাথা নাড়ল। “কোনো সমস্যা নেই। আমি যদি সারাজীবন ধরেও এই চাকরি করতে থাকি, তারপরেও আমার ঋণ শোধ হবে না। মায়ের মতো আমিও ঋণ শোধ না করেই মারা যাব। আর যদি কোনোভাবে এ থেকে মুক্তি মেলে, তারপরের জীবনটা যে আনন্দে কাটবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাই এরকম কাজে টাকা ব্যয় করাটাই বরং ভালো।”
“তাহলে সত্যি করে বলো, আমার জীবনের আসল মূল্য কত ছিল?” জিজ্ঞেস করলাম আমি।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর মিয়াগি মুখ খুলল।
“ত্রিশ ইয়েন,” বিড়বিড় করে জবাব দিল সে।
“তিন মিনিট ফোনে কথা বললে যে খরচ হয়, আমার জীবনের মূল্যও তত,” হাসতে হাসতে বললাম আমি। “যাই হোক, তোমার দান করা এতগুলো টাকা ওভাবে খরচ করে ফেলার জন্য দুঃখিত।”
“তোমার দুঃখিতই হওয়া উচিত। আমি চেয়েছিলাম তুমি টাকাটা নিজের ওপর ব্যয় কর,” সে বলল। কথাটার মধ্যে রাগ ছিল না, বরং মোলায়েম একটা ভাব ছিল। “তবে স্বীকার করছি, তোমার তখনকার মনের অবস্থাটা আমি বুঝতে পেরেছিলাম। যে কারণে আমি তোমাকে টাকাটা দান করেছিলাম, আর যে কারণে তুমি সেই টাকা জনে জনে বিলিয়ে দিয়েছিলে—দুটাই কিন্তু এক। আমরা প্রচণ্ড নিঃসঙ্গ, দুঃখী আর আত্মঘাতী দুজন মানুষ। তাই এরকম অবস্থায় আমরা এ পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছিলাম-তবে এখন ভেবে দেখলে মনে হচ্ছে, তোমাকে ত্রিশ ইয়েনের কথাটা জানিয়ে দিলেই বোধহয় ভালো হতো। হয়তো তখন তুমি আয়ু বিক্রির ব্যাপারে হাল ছেড়ে দিতে। আর কিছু হোক না হোক, কটা দিন হয়তো একটু বেশি বাঁচতে পারতে। এ কাজে ব্যাঘাত ঘটানোর জন্য আমি অনেক অনেক দুঃখিত।”
কথাটা বলার সময় সে হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে তার পায়ের আঙুলগুলোর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল।
“হয়তো আমি জীবনে একবারের জন্য হলেও কাউকে স্বার্থহীনভাবে সাহায্য করতে চেয়েছিলাম। কিংবা আমার মতো পরিস্থিতির শিকার হওয়া দুর্ভাগা এক মানুষকে বাঁচাতে চেয়েছিলাম-যে কাজটা আমার জন্য কেউই করেনি, করতেও চায়নি। কিন্তু দিনশেষে ওটা আমার জোরাজুরিই ছিল, স্বার্থহীন কোনো কাজ ছিল না সেটা।”
“মোটেও না,” আমি প্রতিবাদ করলাম। “যদি তুমি তখন জানাতে, ‘আপনার জীবনের মূল্য ত্রিশ ইয়েন,’ আমি হয়তো তখনই নিজেকে ধ্বংস করে ফেলতাম। তিন মাস নয়, তখন তিনদিনের বেশি সময় আমি নিজের জন্য রাখতাম না। যদি তুমি মিথ্যে না বলতে, তাহলে আমাদের এই ভেন্ডিং মেশিনের ট্যুর সম্ভব হতো না, কাগজের সারস বানানো হতো না, তারার অপূর্ব সেই দৃশ্য কিংবা জোনাকির ঝাঁকের সেই অপরূপ দৃশ্যটাও আমার দ্বারা দেখা সম্ভব হতো না।”
“তোমার নিজেকে ধ্বংস করার কোনো কারণই আমি দেখছি না। ‘ত্ৰিশ ইয়েন’ সংখ্যাটা কোনো এক উচ্চপদস্থ কর্মচারীর ঠিক করে দেয়া,” মিয়াগি দাবি করল। “আমার কাছে তোমার জীবনের মূল্য এখন ত্রিশ মিলিয়ন কিংবা তিন বিলিয়ন ইয়েন।”
“খুব উদ্ভটভাবে আমাকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছ,” বললাম আমি।
“কথাটা সত্য বলেই বলছি।”
“তোমার ভালোমানুষি করে বলা কথাগুলোর কারণে নিজেকে আরও তুচ্ছ মনে হচ্ছে। আমি জানি তুমি একটা ভালো মানুষ। এসব বলে আমাকে সান্ত্বনা দেয়া লাগবে না তোমাকে।”
“চুপ কর। আমাকে থামতে বলবে না।”
“এভাবেও কেউ আমার সাথে কখনো কথা বলেনি।”
“আর আমি জোর করে ভালোমানুষ সাজছি না। আমার যেটা বলতে ইচ্ছে করছে, সেটাই বলছি। তুমি সেটাকে কী ভাবলে না ভাবলে, সেসব চিন্তা করার সময় আমার নেই।’
বলে মিয়াগি লজ্জা ঢাকতে মুখ হাঁটুর ভাঁজে লুকিয়ে ফেলল।
একটু পর আবার মুখ খুলল সে, “হ্যাঁ, আমি স্বীকার করছি, শুরুর দিকে আমিও ভেবেছিলাম তোমার মূল্য ত্রিশ ইয়েনের বেশি হবে না। ঐ তিনশো হাজার ইয়েন কেবল আমার স্বার্থের জন্যই তোমাকে দান করেছিলাম। চাইলে যে কাউকেই দিতে পারতাম আমি, তোমাকে কোনো নির্দিষ্ট কারণে বেছে নিই নি-কিন্তু যতই সময় যেতে লাগল, তোমার ব্যাপারে আমার ভুল ধারণাগুলো ভেঙে যেতে শুরু করল। ট্রেন স্টেশনের ঘটনার দিন তুমি আমার কথাবার্তাকে বেশ গুরুত্বের সাথে নিয়েছিলে। যখন আমি বলেছিলাম যে, আমি স্বেচ্ছায় এ চাকরিতে আসিনি-তুমি আমার দুঃখে দুঃখিত হয়েছিলে। সেদিন থেকে তুমি শুধু আমার পর্যবেক্ষণের বস্তু নয়, বরং আরও বড় কিছু একটাতে পরিণত হয়েছিলে। এটা কিন্তু বিশাল একটা সমস্যা, কিন্তু সমস্যা তো তখন কেবলমাত্র শুরু হয়েছে তোমার কাছে হয়তো ব্যাপারটা কিছুই মনে হবে না, তবে তুমি যখন জনসম্মুখে আমার সাথে কথা বলো, আমার প্রচণ্ড আনন্দ লাগে। তোমাকে কে কী ভাবছে, সেটারও ধার ধারো না তুমি। সারাটা জীবন আমি মানুষদের চোখে অদৃশ্য থেকে এসেছি। আমাকে সবাই অগ্রাহ্য করবে, এটাই তো আমার নিয়তি। কার সাথে আড্ডা দেয়া, রেস্তোরাঁয় গিয়ে খাওয়া-দাওয়া করা, একসাথে কেনাকাটা করা, শহরে ঘুরে বেড়ানো, নদীর পাড়ের পাশ দিয়ে হাত ধরে হেঁটে যাওয়া—এই ছোট, তুচ্ছ ব্যাপারগুলো আমার কাছে স্বপ্নের মতো ছিল। এতদিন ধরে আমি এই কাজে জড়িত রয়েছি অথচ কেউ আমাকে কখনো মানুষ বলেও গ্রাহ্য করেনি। কুসুনোকি, একমাত্র তুমিই আমাকে শুরু থেকেই মানুষ হিসেবে গণ্য করেছ, আচরণও সেভাবে করেছ। আমি যে সবসময় তোমার পাশে রয়েছি, এই অস্তিত্বটাকে স্বীকার করেছ তুমি।”
এর প্রত্যুত্তরে কী বলা যায়, বুঝে উঠতে পারলাম না। কেউ যে আমার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকতে পারে, সেটা আমার চিন্তারও বাইরে ছিল।
“তুমি যদি চাও-আমার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমি ঠিক সেভাবেই আচরণ করে যাব,” একটু খোঁচা মেরে বললাম।
কিন্তু মিয়াগি সেটাকে গুরুত্বের সাথেই নিল। মাথা নেড়ে বলল, “আমারো তাই মনে হয়। সেজন্যই তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি আমি।” দুঃখভরা দৃষ্টিতে সে আমার দিকে তাকাল। “অবশ্য যে মানুষটা খুব দ্রুত চলে যাবে, তার প্রেমে পড়ে কোনো লাভ নেই।”
বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ডটা লাফিয়ে উঠল। মিয়াগির মুখ থেকে কথাটা শোনার পর যেন বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলাম।
নিজেকে একটা গণ্ডগোলে ফ্রিজ হয়ে যাওয়া কম্পিউটার মনে হচ্ছিল। কিছুই বলতে পারছিলাম না আমি। এমনকি চোখের পলক ফেলাও দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছিল আমার জন্য।
“কুসুনোকি, আমি এতদিন ধরে তোমাকে অনেক মিথ্যা কথা বলে এসেছি,” মিয়াগির কণ্ঠস্বর আর্দ্র মনে হলো। “তোমার জীবনের মূল্য, হিমেনোর অতীত। এমনকি তুমি যদি কোনো গণ্ডগোল করতে যাও, তবে আমি চাইলেই তোমার জীবনটা শেষ করে দিতে পারব—সবই ছিল মিথ্যে। আমার থেকে একশো মিটারের বেশি দূরে চলে গেলে তুমি মারা যাবে-এটাও মিথ্যা ছিল। নিজেকে রক্ষা করার জন্যই আমি ওসব মিথ্যে কথাগুলো রটিয়েছিলাম। সব মিথ্যে। সব।”
“জানা ছিল না।”
“আর তোমার যদি এ নিয়ে কোনো ধরনের ক্ষোভ থাকে তবে তোমাকে একটা সুযোগ দিচ্ছি। তুমি আমার ওপর যা ইচ্ছে করতে পারবে।’
“যে কোনো কিছু?” জিজ্ঞেস করলাম।
“হ্যাঁ। তোমার যেটা মন চায় সেটা করতে পারবে।”
“তাহলে আমি সে সুযোগটা নিচ্ছি।”
বলে মিয়াগির হাতটা ধরে তাকে দাঁড়া করালাম। তারপর শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম তাকে।
জানি না কতক্ষণ এভাবে কেটে গিয়েছিল।
প্রত্যেকটা জিনিস আমি স্মৃতির কোটরে বন্দী করে রাখার চেষ্টা চালালাম। তার মোলায়েম চুল। নিখুঁত আকৃতির কান। সরু গলা। সুগঠিত কোমর আর পিঠ। বুকের খাঁজ। তার সুন্দর কোমর। পঞ্চইন্দ্রিয়কে কাজে লাগিয়ে তার প্রত্যেকটা বৈশিষ্ট্য মস্তিষ্কের ভেতর খোদাই করে রাখলাম আমি।
যাতে মুহূর্তের মধ্যে সেসবের কথা মনে করতে পারি। কোনোমতেও সেসব ভুলতে চাই না আমি।
“খুবই নির্দয় তুমি,” কান্নাভরা কণ্ঠে মিয়াগি বলল। “এখন তো তোমাকে ভোলা আমার জন্য অসম্ভব হয়ে পড়বে।”
“হ্যাঁ। আমি মরে গেলে তুমি অবশ্যই দুঃখী হবে কিন্তু,” বললাম আমি।
“যদি সেটা তোমার ইচ্ছে হয়ে থাকে, তবে আমিও নিজের মৃত্যু পর্যন্ত তোমাকে মনে রাখব।”
বলে মিয়াগি হাসল।
.
এই তুচ্ছ আর সংক্ষিপ্ত জীবনে অবশেষে আমি একটা উদ্দেশ্য খুঁজে পেয়েছি।
মিয়াগি যে কথাগুলো বলেছিল, তা আমার ওপর বিশাল প্রভাব ফেলেছিল।
আগামী দুইমাসের মধ্যে যেভাবেই হোক, তার ওপর চাপিয়ে দেয়া ঋণের বোঝা আমাকে পরিশোধ করতে হবে।
এটাই আমার পরিকল্পনা।
এমন একটা মানুষের পরিকল্পনা, যার জীবনের মূল্য ছিল ভেন্ডিং মেশিনের একটা সস্তা ড্রিংক থেকেও অনেক কম।
হয়তো এরকম পরিকল্পনাকেই মানুষ ‘আকাশকুসুম কল্পনা করা’ নাম দিয়েছে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন