হর্ষবর্ধনের অক্কালাভ

শিবরাম চক্রবর্তী

অবশেষে সেই দিনটি এল। শেষের সেই শোকাবহ দিনটি ঘনিয়ে এল হর্ষবর্ধনের জীবনেও…

আমার সঙ্গে কথা কইতে কইতে হঠাৎ যেন তিনি ধুঁকতে লাগলেন। বললেন, বুকের ভেতরটা কেমন যেন করছে। কনকন করছে কেমন।’ বলতে বলতে শুয়ে পড়লেন সটান।

বুঝতে আর বাকি রইল না। রোজ সকালের দৈনিক খুলেই যে-খবরটা প্রথম নজরে পড়ে—তেমন খবর একটা না-একটা থাকেই রোজ—কালকের কাগজ খুলেও আরেকটা সেই রকমের দুঃসংবাদ দেখতে পাব টের পেলাম বেশ।

যে-খবরে আত্মীয়বিয়োগ নয়, আত্মবিয়োগের ব্যথা অনুভব করে থাকি—আমারও তো উচ্চ রক্তচাপজনিত হার্টের দোষ ওই— রোজই যে খবর পড়ে আমার বুক ধড়ফড় করে আর মনে হয় আমিই যেন মারা গেলাম আজ, আর আধঘণ্টা ধরে প্রায় আধমড়ার মতোই পড়ে থাকি বিছানায়—মনে হল তেমন ধারার একটা খবর যেন আমার চোখের ওপর ঘটতে চলেছে এখন।

ক-দিন ধরেই ভদ্রলোকের শরীর তেমন ভালো যাচ্ছিল না, বুকের বঁা-দিকটায় কেমন একটা ব্যথা বোধ করছিলেন— দেখাই দেখাই করে, কাজের চাপে পড়ে সময়াভাবে আর ডাক্তার দেখানো হয়ে উঠছিল না তাঁর… অবশেষে তিনি ডাক্তারের দেখা-শোনার একেবারেই বার হতে চলেছেন…মারাত্মক সেই করোনারি থ্রমবোসিস এসে তাঁর হৃদয়ের দ্বারদেশে দাঁড়িয়ে কড়া নেড়েছে এখন।

তাহলেও ডাক্তার ডাকতে হয়।

ছুটলাম ট্যাক্সি নিয়ে রাম ডাক্তারের কাছে। এই এলাকায় নামকরা ডাক্তার বলতে গেলে তিনিই একমাত্র।

গিয়ে ব্যাপারটা বলতেই রাম ডাক্তার গুম হয়ে গেলেন। কিছু না বলে দুম করে তাঁর বিখ্যাত ডাক্তারি ব্যাগের ভেতর থেকে একটা অ্যামপিউল বার করে নিজের ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জে ভরলেন।

ভয় পেয়ে আমি বলি—আজ্ঞে না, আমি নই। আমার কিছু হয়নি। কোনো অসুখ করেনি আমার। দোহাই, আমাকে যেন ইঞ্জেকশন দেবেন না। হর্ষবর্ধন বাবুর বুকেই… বলতে বলতে আমি সাত হাত পিছিয়ে গেলাম ভয় খেয়ে। রাম ডাক্তারের ওই এক ব্যারাম, অসুখের নাম করে কেউ সামনে এলে, কাছে পেলেই, ধরে তাকে এক ইঞ্জেকশন ঠুকে দেন।

তিনি আমার কথার কোনো জবাব না দিয়ে সিরিঞ্জ হাতে বিনা বাক্যব্যয়ে সেই ট্যাক্সিতে গিয়ে উঠলেন। সিরিঞ্জ হাতেই নামলেন ট্যাক্সির থেকে আমার হাতে তাঁর ডাক্তারি ব্যাগ গছিয়ে দিয়ে।

গিয়ে দেখি হর্ষবর্ধন বিছানায় লম্বমান। দেখেই বুঝলাম হয়ে গেছে। দেহরক্ষা করেছেন ভদ্রলোক।

সিরিঞ্জটা আমার হাতে দিয়ে—‘ধরুন, এটা ততক্ষণ’ বলে রাম ডাক্তার হর্ষবর্ধনের নাড়ি টিপে দেখলেন। তারপর স্টেথোসকোপ বসালেন বুকে। অবশেষে গম্ভীর মুখে জানালেন—‘সব শেষ।’

আমি ‘ফল ধর রে লক্ষ্মণের’ মতন তাঁর সিরিঞ্জ হাতে কম্পাউণ্ডারের দুর্লক্ষণের মতো দাঁড়িয়ে আছি তখনও।

‘দিন তো সিরিঞ্জটা—’ আমার দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন—‘ওষুধটা আর নষ্ট করব না। ওঁর নাম করে সিরিঞ্জে যখন ভরেছি তখন ইঞ্জেকশনটা বরবাদ না করে দিয়েই যাই বরং ওনাকে।’

বলে মড়ার উপরে খাঁড়ার ঘা মারার মতোই ইঞ্জেকশনটা স্বর্গত তাঁর বুকের ওপর ঠুকে দিয়ে ভিজিটের টাকাগুলো গুনে নিয়ে ব্যাগ হাতে ট্যাক্সিতে গিয়ে চাপলেন আবার।

হর্ষবর্ধনের বউ পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসলেন। আমি একখানা সাদা চাদর দিয়ে ঢেকে দিলাম শবদেহকে।

গোবর্ধন চোখের জল মুছে বলল—‘কান্না পরে। ভায়ের কাজ করি আগে। আমি নিউ মার্কেটে চললাম, ফুল নিয়ে আসি গে। তারপরে খাট সাজাতে হবে। আপনি যদি পারেন তো ইতিমধ্যে কীর্তনিয়াদের ডেকে নিয়ে আসুন—বন্ধুর কর্তব্য করুন।’

‘তার আগে চাই ডেথ সার্টিফিকেট।’ আমি জানাই—‘তা না হলে তো মড়া নিয়ে কেওড়াতলায় ঘেঁষতেই দেবে না। তাড়াহুড়োর মধ্যে ডাক্তারবাবু চলে গেছেন ভুলে— ডেথ সার্টিফিকেটটা না দিয়েই— সেটা লিখিয়ে আনি গে তাঁর কাছ থেকে। তার পরে ফেরার পথে তোমার সংকীর্তন পার্টির খবর নেব নাহয়।’

ডেথ সার্টিফিকেট পেলাম কিন্তু কেত্তুনেদের খোঁজ পাওয়া গেল না। তারা যে কোথায় থাকে, কোথায় যায় কেউ তা বলতে পারল না। শুধু এইটুকু জানা গেল যে আজকাল নাকি তাদের ঘোর চাহিদা। ঘৃত দুগ্ধপুষ্ট মনস্বী যত বড়োলোকদের মড়ক যেন লেগেই আছে চারধারে এখন।

ডেথ সার্টিফিকেট হাতে দরজাতে পা ঠেকাতেই চমকে উঠতে হল। বাড়িতে পা দিতেই যাঁর ক্রন্দন ধ্বনি কানে আসছিল তিনি আর্তনাদ করে উঠেছেন যেন অকস্মাৎ!

ঢুকে দেখলাম, হর্ষবর্ধনের স্ত্রীও নিষ্প্রাণ নিষ্পন্দ সটান!

‘সতীসাধ্বী সহমরণে গেলেন!’ বলে তাঁর পায়ে হাত ঠেকিয়ে নমস্কার করে নাকের গোড়ায় হাতটা ঠেকাতেই—ওমা! নিশ্বাস পড়ছে যে বেশ। অজ্ঞান হয়ে গেছেন মাত্র।

মুখে-চোখে জলের ঝাপটা দিতেই নড়েচড়ে উঠে বসলেন উনি।

‘হঠাৎ এমন করে চেঁচিয়ে উঠলেন যে! হয়েছিল কী?’ আমি জিজ্ঞেস করি।

তিনি ভীতিবিহ্বল নেত্রে বিগত হর্ষবর্ধনের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে বললেন— ‘মড়াটা নড়ছিল যেন মনে হল।’ বলে নিজের আশঙ্কাটা ব্যক্ত না করে পারলেন না—‘শনিবারের বারবেলায় গত হলেন, দানোয় পায়নি তো? ভূতপ্রেত কিছু হয়নি তো উনি’?

‘প্রেতযোনি প্রাপ্ত হয়েছেন কি না শুধোচ্ছেন? তা কী করে হয়? ওঁর মতন দানব্রত পুণ্যাত্মা লোক সটান স্বর্গে চলে গেছেন। উনি তো ভূত হবেন না—না কোনো ভূত ওঁর দেহে ভর করতে পারবে।’ বলে, মুখে সাহস দিই বটে কিন্তু সত্যি বলতে আমার বুক কেঁপে ওঠে—‘রাম নাম করুন, তাহলেই আর কোনো ভয় নেইকো।’

‘আমার শ্বশুর ঠাকুরের নাম যে, করি কী করে?’ তিনি বলেন—‘আপনি করুন বরঞ্চ।’

‘আমাকে আর করতে হবে না রাম নাম। আমার নামের মধ্যেই স্বয়ং রাম আছেন, তার ওপর আমার হাতে সাক্ষাৎ রাম ডাক্তারের সার্টিফিকেট—এই দেখুন—ভূত আমার কাছ ঘেঁষবে না।’

দেখতে দেখতে হর্ষবর্ধন নড়েচড়ে বসলেন বিছানার ওপর। খানিকক্ষণ যেন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন চারদিকে। তারপর নিজেকে চিমটি কেটে দেখলেন বার কয়েক—‘না:, বেঁচেই আছি বটে।’ বলে তারপর শুধোলেন আমাদের—‘শিবরামবাবু! আপনি অমন গোমড়ামুখে দাঁড়িয়ে কীসের জন্যে? গিন্নি, তোমার চোখে জল কেন গো?’

কারো কোনো বাক্যস্ফূর্তি না দেখে আপন মনেই যেন শুধালেন আবার—‘কী হয়েছিল আমার?’

প্রশ্নটা আমার উদ্দেশ্যে নিক্ষিপ্ত মনে করে আমি তাঁকে পালটা জিজ্ঞেস করলাম—‘আপনিই তো বলবেন আপনার কী হয়েছিল?’

‘কিছুই হয়নি।’ তিনি জানালেন তখন—‘একটা ভারি বিচ্ছিরি দুঃস্বপ্ন দেখছিলাম যেন। এইরকমটাই মনে হচ্ছে এখন।’

‘কিছুই হয়নি তাহলে। আপনি কিছু আর ভাববেন না। কর্তাকে গরম গরম এক কাপ কফি করে দিন তো।’ বললাম আমি শ্রীমতীকে।

উনি দু-কাপ কফি করে নিয়ে এলেন—আমার জন্যও এক কাপ ওইসঙ্গে।

কফির পেয়ালা নি:শেষ করে তিনি বললেন—‘আপনার হাতের কাগজটা কী দেখি তো।’

কাগজখানা হস্তগত করে নাড়াচাড়া করলেন খানিকক্ষণ, তারপর বললেন— ‘ডাক্তারদের প্রেসক্রিপশনের মাথামুন্ডু যদি বোঝা যায়। কম্পাউণ্ডাররাই বুঝতে পারে কেবল।’

ইতিমধ্যে গোবরা কয়েক তোড়া ফুল নিয়ে এসে হাজির।

‘এত ফুল কীসের জন্যে রে? ব্যাপার কী আজ?’ অবাক হয়ে শুধিয়েছেন তিনি।

‘আজ যে আপনাদের বিয়ের তারিখ তা একদম মনে নেই আপনার? সে-কারণে আমার কথায় গোবর্ধন ভায়া ফুল কিনে আনতে গিয়েছিল বাজারে। নতুন ফুলশয্যার দিন না আজ আপনার?’

‘বিয়ের তারিখ বুঝি আজ? তাই নাকি? একেবারেই মনে ছিল না আমার!’ বলে আপন মনেই যেন তিনি গজরান—‘মনেও থাকে না তারিখটা। রাখতেও চাইনে মনে করে। বিয়ের তারিখ তো নয়, আমার মৃত্যুর তারিখ। অপমৃত্যুর দিন আমার।’

আমি একবার বক্রকটাক্ষে শ্রীমতী হর্ষবর্ধিনীর দিকে তাকাই। তিনি কিছু বলেন না। তাঁর ভারিক্কি মুখ যেন আরও ভারী হয়ে উঠেছে দেখা যায়।

হর্ষবর্ধন রাম ডাক্তারের সার্টিফিকেটখানা গোবরার হাতে দিয়ে বললেন—‘যা তো গোবরা! রাম ডাক্তারের এই প্রেসক্রিপশনটা নিয়ে সামনের ডিসপেনসারির কম্পাউণ্ডারবাবুকে দে গিয়ে— যেন এই ওষুধটা চটপট বানিয়ে দেন দয়া করে।’

গোবর্ধন বেরিয়ে গেলে আমার দিকে ফিরলেন তিনি—‘ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখলাম মশাই। বলব স্বপ্নটা আপনাকে একসময়। আপনি গল্প লিখতে পারবেন তার থেকে। কিন্তু স্বপ্ন দেখে আমি তেমন অবাক হইনি মশাই—স্বপ্ন আমি প্রায়ই দেখি, ঘুমোলেই স্বপ্ন দেখতে হয়। কিন্তু এই অবেলায় হঠাৎ এমন ঘুমিয়ে পড়লাম কেন, এমন তো ঘুমোই না, তাই ভেবেই আমি অবাক হচ্ছি আরও।’

‘ঘুমের আবার বেলা-অবেলা আছে নাকি?’ ঘুমের তরফে সাফাই গাইতে হয় আমায়—‘সব সময়ই হচ্ছে ঘুমের সময়। সকাল, সন্ধ্যে, দুপুর, বিকেল। তার ওপর রাতের বেলা তো বটেই। যখন ইচ্ছে ঘুমোন। আমি তো সময় পেলেই একটুখানি ঘুমিয়ে নিই মশাই! অসময়েও ঘুমোই আবার। ঘুমোতে তো আর ট্যাক্সো লাগে না…’

বলতে বলতে গোবর্ধন একটা শিশি হাতে ফিরে এল—‘এই মিকচারটা বানিয়ে দিল কম্পাউণ্ডার। তিন ঘণ্টা বাদ বাদ খাবে। এক দাগ খেয়ে ফ্যালো চট করে এক্ষুনি।’

হর্ষবর্ধন এক দাগ গিলে যেন একটু চাঙ্গা বোধ করলেন—‘বা: বেড়ে ওষুধ দিয়েছে তো! খেতে না খেতেই বেশ সুস্থ বোধ করছি। থাক প্রেসক্রিপশনটা আমার কাছে।’ বলে গোবর্ধনের হাত থেকে সেই ডেথ সার্টিফিকেটখানা নিয়ে নিজের বালিশের তলায় গুঁজে রাখলেন তিনি—‘মনে হচ্ছে ওটা খেয়ে যেন নবজীবন লাভ করলাম। চালিয়ে যেতে হবে ওষুধটা। রাম ডাক্তারের দাবাই বাবা! ডাকলে সাড়া দেয়!’

‘আপনার এয়োতির জোরেই বেঁচে গেছেন উনি এ যাত্রা!’ কানে কানে ফিসফিস করে এই কথা বলে ওঁর বউয়ের হাসিমুখ দেখে আর ওঁকে বহাল তবিয়তে রেখে ওঁদের বাড়ি থেকে বিদায় নিলাম সেদিন।

দিন কয়েক বাদে হর্ষবর্ধন রাম ডাক্তারের বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, এমন সময় এক পশলা বৃষ্টি আসতেই তিনি বাড়ির দোরগোড়াটায় গিয়ে দাঁড়ালেন।

তারপর সেখানেও বৃষ্টির ছাঁট আসছে দেখে ভাবলেন, রাম ডাক্তারের ওষুধ খেয়ে এমন ভালো আছেন, তাঁর সঙ্গে একবার দেখা করে ধন্যবাদটা জানিয়ে যাই।

ভেবে যেই-না তাঁর চেম্বারে ঢোকা রাম ডাক্তার তো আঁ আঁ করে আঁতকে উঠেছেন তাঁকে দেখেই-না!

‘ডাক্তারবাবু! ডাক্তারবাবু! চিনতে পারছেন না আমায়? আমি শ্রীহর্ষবর্ধন।’ তাড়াতাড়ি তিনি বলেন—‘আপনার ওষুধ খেয়ে আমি ঢের ভালো আছি এখন। বুকের সেই ব্যথাটাও নেই আর। সেই কথাটাই বলতে এলাম আপনাকে।’

‘আমি তো কোনো ওষুধ দিয়ে আসিনি আপনাকে। শুধু একটা কোরামিন ইঞ্জেকশন দিয়েছিলাম কেবল… তবে কি, তারই রি-অ্যাকশনেই আপনি পুনর্জীবন…’

‘সেকী! আমাকে দেখে এই প্রেসক্রিপশনটা দিয়ে আসেননি আপনি?’ বাধা দিয়ে বললেন হর্ষবর্ধন ‘কাগজখানা সেই থেকে আমি বুকে করে রেখেছি যে। কখনো কাছ ছাড়া করিনে। আপনার এই প্রেসক্রিপশনের ওষুধ খেয়েই তো আমি নবজীবন লাভ করলাম মশাই।’

কাগজখানা তিনি বাড়িয়ে দিলেন রাম ডাক্তারের দিকে।

‘প্রেসক্রিপশন? দেখি—আঁ—এটা তো আপনার ডেথ সার্টিফিকেট—আমিই দিয়েছিলাম বটে।’

‘ডেথ সার্টিফিকেট? … আঁ…?’ এবার আঁতকাবার পালা হর্ষবর্ধনের। কাঁপতে কাঁপতে সামনের চেয়ারটায় বসে পড়লেন তিনি।

‘আমার ডেথ সার্টিফিকেট? তাই-ই বটে!’ খানিকটা সামলে নিয়ে তিনি বললেন তারপর—‘তাহলে ঠিকই হয়েছে। আমার সেই ভীষণ স্বপ্নটার মানে আমি বুঝতে পারছি এখন…এতক্ষণে বুঝলাম।’

‘আপনি কি তাহলে মারা যাননি না কি?’

‘না, মারা গিয়েছিলাম ঠিকই। ঠিকই ডেথ সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন আপনি…’

‘তাহলে কি এখন ভূত হয়ে…’ ভয় খেলেও তেমন ভয়াবহ কিছু নয় বিবেচনা করে ডাক্তার তত ঘাবড়ালেন না এবার— ‘দেখুন স্বর্গীয় হর্ষবর্ধনবাবু! আমার কোনো দোষ নেই। আমি আপনাকে মারিনি! সে-সুযোগ আমি পাইনি বলতে গেলে। আমি গিয়ে পৌঁছোবার আগেই আপনি খতম হয়েছিলেন…।’

‘না, না, আপনার কোনো দোষ দিচ্ছিনে। আমি মারা গেছলাম ঠিকই। আমার নিজগুণেই মরেছিলাম। আপনার ডেথ সার্টিফিকেটেও কোনো ভুল হয়নিকো। যমালয়েও নিয়ে গেছল আমায়। ঘটনাটা যা হয়েছিল বলি তাহলে আপনাকে। যমালয়ের ফেরতা বেঁচে ফিরে এলাম কী করে আবার—শুনলে আপনি অবাক হবেন।’

সন্দেহ একেবারে না গেলেও রাম ডাক্তার উৎকর্ণ হন।

‘যমদূতেরা নিয়ে গিয়ে যমরাজার দরবারে তো হাজির করল আমায়।’ —বলে যান অভূতপূর্ব হর্ষবর্ধন—‘দেখলাম, বিরাট সেরেস্তার সামনে সিংহাসনে বসে আছেন যমরাজ। সামনে দপ্তর নিয়ে বসে তাঁর চিত্রগুপ্ত—তিনিই যে চিত্রগুপ্ত, কেউ না বলে দিলেও, তাঁর দিকে তাকালেই তা মালুম হয়। যমদূতরা সব ইতস্তত খাড়া।

যমরাজ আমাকে দেখে গুপ্তমশাইকে ডেকে বললেন—‘দ্যাখো তো হে, এর পাপ-পুণ্যের হিসাবটা দ্যাখো তো একবার।’

খতিয়ান দেখে চিত্রগুপ্ত জানালেন—‘প্রভু! এর পুণ্যকর্মই বেশি দেখছি। তবে পাপও করেছে কিছু কিছু।’

‘কী পাপ?’

‘আজ্ঞে ভেজালের কারবার। ভারতখন্ডের বেশিরভাগ লোকই যা করছে আজকাল।’

‘কীসে ভেজাল দিত লোকটা?’

‘কাঠের ভেজাল।’

‘প্রভু! কাঠ কি কোনো খাবার জিনিস না ওষুধপত্তর, যে তাতে আমি ভেজাল দিতে যাব?’ প্রতিবাদ না করে পারলাম না আমি—‘কাঠ কি কেউ খায় কখনো? না, কাঠে কেউ ভেজাল দিতে যায়? কাঠের আবার ভেজাল হয় না কি?’

‘কিন্তু হয়েছে।’ চিত্রগুপ্ত বললেন—‘লোকটা দামি সেগুন কাঠ বলে বাজে বেগুণ কাঠের ভেজাল চালাত!’

‘আপনি অবাক করলেন গুপ্তমশাই!’ আমি বললাম তখন—‘পাট গাছ থেকে যেমন ধান হয়ে থাকে, সেইরকম কথাটাই বলছেন না আপনি? বেগুন গাছের থেকে কাঠ হয় নাকি আবার? পাট গাছের থেকে তবু পাটকাঠি মেলে, কিন্তু বেগুন গাছের থেকে কাঠ দূরে থাক একটা কাঠিও যে পাওয়া যায় না মশাই!’

‘বেগুণ মানে গুণহীন, নির্গুণ, বাজে।’ ব্যাখ্যা করে দিলেন চিত্রগুপ্ত। ‘দামি বলে বিলকুল বাজে কাঠ ছেড়েছ তুমি বাজারে।’

কথাটা মেনে নিতে হয় আমায়।—‘তা ছেড়েছি বটে প্রভু! কিন্তু দেখুন, শাস্ত্রেই বলেছে আমাদের—মহাজনো যেন গতঃ সঃ পন্থা। সদা মহাজনদের পথে চলিবে। আমিও সদা সিধে তাই চলেছি। মহা মহা ব্যক্তিরা— কে নয়? —নানাভাবে ভেজাল চালাচ্ছে এখন— বেপরোয়া চালিয়ে যাচ্ছে—তাই দেখে আমিও…’

যমরাজ বাধা দিলেন আমার কথায়—‘চিত্রগুপ্ত, এর জন্য কতদিন নরকবাসের দন্ড দেয়া যায় লোকটাকে?’

‘ধর্মরাজ! বিশ বছর তো বটেই। পাপের বিষ ক্ষয় হতে ওই বিশ বছরই যথেষ্ট— বিশে বিষক্ষয় হয়ে যাক…তবে এর স্বর্গবাসের সময়টাই ঢের বেশি আরও…।’

ধর্মরাজ তখন আমার দিকে তাকালেন—‘তুমি আগে স্বর্গভোগ করতে চাও, না নরকভোগটাই করবে আগে?’

‘যা আপনি মঞ্জুর করবেন।’ কৃতাঞ্জলিপুটে আমি বললাম। আমার কথার কোনো জবাব না দিয়ে যমরাজ নিজের হাতের নখগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন। দেখলাম, তাঁর হাতের নখগুলো বেড়েছে বেজায়— দেখবার মতোই হয়েছে সত্যি!

বললাম—‘অবিলম্বে আপনার নখ কাটার দরকার কর্তা। বড্ড বড়ো হয়েছে যথার্থই! যদি অনুমতি করেন আর একটা নরুন পাই, অভাবে ব্লেড, তাহলে আমিই কেটে দিতে পারি।’

‘নখ না, আমি নখদর্পণে তোমার কলকাতার পরিস্থিতিটা দেখছিলাম।’

‘আজ্ঞে, কলকাতায় আমার কোনো পরিস্থিতি নেই। আমার পেত্নীস্থিতি। আমার বাড়িতে যিনি আছেন কোনো ক্রমেই তাঁকে পরি বলা যায় না। পেতনি বললেই ঠিক হয়। এমন দজ্জাল। ঘ্যানঘেনে আর খ্যানখেনে কুঁদুলে বউ আর দুটি এমন দেখিনি। পেতনি নিয়েই হয়েছে আমার ঘর করা…।’

‘যদি তোমাকে বঁাচিয়ে আবার তোমার বাড়িতে ফিরিয়ে দেওয়া হয়?’

‘দোহাই হুজুর, তাহলে আমি মারা পড়ব। মারা যাব আবার আমি। অমন বউয়ের কাছে আমি ফিরে যেতে চাইনে, তার চেয়ে নরকেও যাব আমি বরং।’

‘দেখছিলাম তাই। তোমার ঘরের পরিস্থিতি এই, বাইরের পরিস্থিতি যা দেখছি কলকাতার তা আরও ভয়াবহ…রাস্তার খানাখন্দ, আর আঁস্তাকুড়ের গন্ধ, যত রাজ্যের জঞ্জাল। ট্রামে বাসে বাদুড়ঝোলা হয়ে যাচ্ছে মানুষ, রাস্তায় রাস্তায় শোভাযাত্রা, আপিসে আপিসে ঘেরাও, চালে কাঁকর, তেলে-ঘিয়ে ভেজাল, চিনিতে বালি, বালিতে গঙ্গামাটি, দুধে জল যেরকমটা দেখলাম আমার এই নখদর্পণে তাতে মনে হয় কলকাতাটাই এখন নরক হয়ে দাঁড়িয়েছে। কত বললে চিত্রগুপ্ত? বিশ বছরের নরকবাস না? তোমার আয়ু বিশ বছর বাড়িয়ে দেওয়া হল আরও। যাও, গিয়ে তোমার কলকাতা গুলজার করো গো।’

আর, তারপরই আমি বেঁচে উঠলাম তৎক্ষণাৎ। বলে হর্ষবর্ধন একটা সুদীর্ঘ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন।

সকল অধ্যায়

১. অঙ্ক সাহিত্যের যোগফল
২. অমূলক কাহিনি নয়
৩. অশ্বত্থামা হত ইতি
৪. আমার সম্পাদক শিকার
৫. ইতর বিশেষ
৬. ইংরিজি যার নাম
৭. একটি স্বর্ণঘটিত দুর্ঘটনা
৮. কালোবাজার
৯. রিক্সায় কোনো রিস্ক নেই!
১০. কল-স্বর
১১. গল্পের উপসংহার
১২. গোবর্ধনের কেরামতি
১৩. গুরুচন্ডালি
১৪. চটির সঙ্গে চটাচটি
১৫. আস্তে আস্তে ভাঙো
১৬. জবাই!
১৭. জোড়া ভরতের জীবনকাহিনি
১৮. ঠিক ঠিক পিকনিক
১৯. দুগ্ধপানের ইতিহাস
২০. নব্য উপকথা
২১. নিখরচায় জলযোগ
২২. পরোপকারের বিপদ
২৩. পাতালে বছর পাঁচেক
২৪. প্রেম এবং দাঁত
২৫. পুরস্কার-লাভ
২৬. প্রজাপতির নির্বন্ধ
২৭. ফিসটের ফিসটি
২৮. বিবেক যদি দেখা দেয়
২৯. ভ্যা-জাল!
৩০. হাতির সঙ্গে হাতাহাতি
৩১. মন্টুর মাস্টার
৩২. মাথা খাটানোর মুশকিল
৩৩. মূকং করোতি বাচালং
৩৪. আমার ভালুক শিকার
৩৫. ঘোড়ার সঙ্গে ঘোরাঘুরি
৩৬. শিবরামের ছেরাদ্দ!
৩৭. শ্রীকান্তের ভ্রমণকাহিনি
৩৮. শুঁড়ওয়ালা বাবা
৩৯. সাহিত্যিক সাক্ষাৎ
৪০. সত্যবাদিতার পুরস্কার!
৪১. বিহার মন্ত্রীর সান্ধ্য বিহার
৪২. স্বামী মানেই আসামি
৪৩. স্বামীসুখ
৪৪. স্বামী হওয়ার সুখ
৪৫. স্ত্রী-সুখ
৪৬. হাতি-মার্কা বরাত
৪৭. হোলির হায় হায়
৪৮. হর্ষবর্ধনের অক্কালাভ
৪৯. হর্ষবর্ধনের কিরিকেট
৫০. হর্ষবর্ধনের ‘দ্বিরাগমন’

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন