৩৩. প্রথমেই জেনে নেওয়া দরকার

সমরেশ মজুমদার

তেত্রিশ

‘প্রথমেই জেনে নেওয়া দরকার আমরা কী চাই। আমরা যারা এখানে রয়েছি তারা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে কাজ করেছি। মার্ক্সবাদের রীতিনীতি পদ্ধতিগুলোর সঙ্গে বিশেষ ভাবে পরিচিত। এ দেশের কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা ঔপনিবেশিক সংসদীয় কাঠামোয় নিজেদের মানানসই করে নিয়ে কয়েকটা রাজ্য সরকার গঠন করতে পারলেই ঊর্ধ্ববাহু হয়ে নৃত্য করবেন। আমরা মনে করি এই পথে সাধারণ মানুষের মুক্তি কখনওই আসতে পারে না। এ দেশের মানুষের কাছে ভোটের যে প্রলোভন রাখা হয় তার ব্যবহার আমরা জানি। গরিব মানুষগুলো নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলোর ভাঁওতাবাজির কাছে বারংবার ঠকে, ভোলে। কিন্তু প্রতিবাদ করার সাহস করে না। কমিউনিস্ট পার্টিও ঠিক এই পথে এদের ব্যবহার করতে চলেছে।’ এই অবধি বলে বক্তা একটু থামলেন।

ঘরে এখন পিন-ফেলা নৈঃশব্দ্য। অনিমেষ দেখল সবসমেত সাতজন এখন শ্রোতার ভূমিকায়। প্রত্যেকেই খুব গম্ভীর মুখে কথা শুনছে। সিঁথির এই বাড়িটায় আসতে ওরা খুব সতর্ক হয়েছিল। সুবাসদার সঙ্গে হরেকৃষ্ণ শেঠ লেনে নেমে অনেকটা হেঁটে এই বাড়িতে আসা। যিনি কথা বলছেন তাঁর নাম মহাদেব সেন। কমিউনিস্ট পার্টি থেকে বিতাড়িত যাঁরা হয়েছেন ইনি তাঁদের অন্যতম। এই ঘরে আর যাঁরা উপস্থিত তাঁদের সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির সরাসরি সম্পর্ক ছিল। সে অর্থে অনিমেষ একটু বাইরের লোক। বিশেষভাবে পছন্দ করা কিছু মানুষ এখানে সমবেত হয়েছেন। অনিমেষের উপস্থিতি সুবাসদার সুপারিশেই। এতক্ষণ বক্তা যে কথাগুলো বললেন সেগুলো প্রত্যেকেরই জানা। মহাদেববাবু বললেন, ‘আমার মনে হয় এইসব তত্ত্বের কথা আমরা সবাই জানি। আমি সোজাসুজি কথাগুলো বলছি এবার। যেহেতু এই নির্বাচন ব্যবস্থা, সামাজিক অসাম্য এবং রাজনৈতিক দালালিতে আমরা আর আস্থাবান নই তাই আজ ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে কিছু মানুষ নতুন চিন্তাভাবনা শুরু করেছেন। আমরা মনে করছি চিনের পথেই ভারতবর্ষের মুক্তি সম্ভব। চেয়ারম্যান মাও-এর কথায় আস্থা রেখেই বলছি বন্দুকের নলই শক্তির উৎস। বন্দুকের মাধ্যমেই বিপ্লব সাধিত হবে। আমাদের প্রথম পদক্ষেপ হবে সশস্ত্র কৃষক গেরিলাদল সংগঠিত করে গ্রামে গ্রামে অঞ্চলভিত্তিক ক্ষমতা দখল। একসঙ্গে সমস্ত ভারতবর্ষে বিপ্লব আনার মতো মানসিক এবং বাস্তব পরিস্থিতি এখনও তৈরি হয়নি। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অঞ্চলে ক্ষমতা দখল এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করলে তার অনুপ্রেরণা দাবানলের মতো আশেপাশের অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়বে। পরবর্তী পর্যায়ে এই কৃষক গেরিলাদল সশস্ত্র সংগ্রামের ছোট ছোট ঘাঁটিগুলোকে বিস্তৃত করে সারা দেশে জনযুদ্ধের স্রোত বইয়ে দেবেন। গড়ে তুলতে হবে গণফৌজ, যে গণফৌজ প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির মোকাবিলা করে তাদের উচ্ছেদ করবে।

‘আমরা জানি প্রতিরোধ আসবেই। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত কোনও শ্রেণি বিনা আপত্তিতে কখনওই আসন ছাড়েনি। ইতিহাস এই কথাই বলে। এই আপত্তির চেহারা হল সশস্ত্র বলপ্রয়োগ। আগেকার সব আইন, সব গণতন্ত্রের মুখোশ খুলে রেখে ওরা বেয়নেট নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে বিপ্লবীদের ওপর। একটা কথা জেনে রাখুন, প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বাঁচার এই লড়াইয়ে তাদের সঙ্গে শামিল হবে আজকের কমিউনিস্ট পার্টিগুলো। কারণ ইতিহাস বলছে যখনই কোনও কঠিন সমস্যা এসেছে ভারতবর্ষের পার্টিগুলো এমন সুবিধেজনক ভূমিকা নিয়েছে যেখানে তাদের অস্তিত্ব স্থির থাকে। আমাদের এইজন্যে প্রস্তুত থাকতে হবে।

‘আমাদের মূল লক্ষ্য শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বে শ্রমজীবী মানুষের সংগঠিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। অথবা সর্বহারার একনায়কতন্ত্র। অর্থাৎ এই ব্যবস্থায় শ্রেণি ক্রমাগত সংখ্যায় কমে না, উলটে বলা যেতে পারে বৃদ্ধি পায়। শ্রমিক শ্রেণি হল একমাত্র শ্রেণি যে অন্য শ্রেণির মানুষকে গ্রহণ করতে পারে।

‘তা হলে আমাদের প্রধান কর্তব্য হল গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরাও করতে হবে। আপাতত আমাদের এই সংগঠনকে ‘অল ইন্ডিয়া কো-অর্ডিনেশন কমিটি অফ কমিউনিস্ট রেভলিউশনরিজ’ নামে চিহ্নিত করা হয়েছে। মোটামুটি এই ব্যানারে আমরা কাজ শুরু করব। আমরা যারা এখানে উপস্থিত রয়েছি তাদের যদি কোনও প্রশ্ন থাকে তা হলে খোলাখুলি করতে পারেন।’

সুবাসদা বলল, ‘আমার প্রথম জিজ্ঞাস্য হচ্ছে, আমরা যারা এই বিপ্লবে অংশগ্রহণ করছি তাদের নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া কতটা পরিষ্কার তা জেনে নেওয়া দরকার। আমরা যা করতে চলেছি তার পরিণাম সম্পর্কে ওয়াকিবহাল তো? আমি খারাপ দিকটার কথা বলছি।’

মহাদেববাবু বললেন, ‘আমি তো তাই মনে করি।’ তারপর নিজের মনেই হাসলেন, ‘সুবাস, তোমার দোষ নেই, আমাদের চিন্তাভাবনা দীর্ঘকালের অভ্যেসে একই খাতে বয়ে চলেছে। কিন্তু এখন বোধহয় সেটাকে পালটাবার সময় এসেছে। যারা জলে ঝাঁপ দেবে তারা তো জানেই জলে ডুবে যাওয়াই সম্ভব। এ নিয়ে তর্কের কী প্রয়োজন? তুমি সতর্ক করছ যদি সে ভয় পায় তা হলে ঝাঁপ দেবে না, এইজন্যে? সে ক্ষেত্রে সারাদেশের মানুষ যদি ভয় পায় তা হলে কোনওদিন কোনও কাজ হবে না। সাঁতার শিখতে হলে তো জলে নামতেই হবে। তা হলে এই সতর্কীকরণ কেন? আর পারস্পরিক বোঝাপড়ার ব্যাপারটা মধ্যবিত্ত মানসিকতা থেকেই বললে। ওভাবে কোনও কাজ হবে না তা আমরা পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে জেনেছি। কাজে নেমে লক্ষ্য এক হলে মানুষের প্রয়োজন তাদের একটা বোঝাপড়ায় আসতে বাধ্য করে এবং সেটাই কাম্য।’

সুবাসদা এরকম কড়া অথচ পরিষ্কার জবাব পেয়ে আর কোনও কথা বললেন না। অনিমেষের একটা চিন্তা অনেকক্ষণ থেকে মাথায় পাক খাচ্ছিল। মহাদেববাবুর কথা শেষ হতেই সে জিজ্ঞাসা করল, ‘কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কার হাতে?’

‘কোনও ব্যক্তিবিশেষের হাতে নয়। তুমি কি লেটেস্ট ইস্তাহার পাওনি?’ মহাদেববাবু তাঁর ঝোলা থেকে হাতড়ে একটা কাগজ বের করে অনিমেষের দিকে এগিয়ে ধরলেন। অনিমেষ সেটাতে চোখ রাখল।

বর্তমান পরিস্থিতিতে কমিটি অফ কমিউনিস্ট রেভলিউশনরিজ কী করতে চায় তা বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা আছে। ইস্তাহারের বিষয়বস্তু নিয়ে গত দু’দিন তার সঙ্গে সুবাসদার যথেষ্ট আলোচনা হয়েছে। এমনকী গত রাতে কলেজ স্ট্রিটে মহাদেববাবুর সঙ্গে আলাপ হবার পর এ নিয়ে কথা বলেছে সে। মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টি থেকে বিতাড়িত কিংবা বেরিয়ে আসা নেতারাই চিনের অনুসরণে সারা ভারতবর্ষে একটি অগ্নিবিপ্লবের সূচনা করতে চান। এখন তা ছড়িয়ে থাকা কিছু সতেজ মানুষের চিন্তায় আছে মাত্র। মহাদেববাবু এখনও তার দিকে তাকিয়ে আছেন দেখে অনিমেষ বলল, ‘ঠিক আছে’।

‘এ ব্যাপারে কোনও প্রশ্ন নেই?’

‘না।’

‘আচ্ছা, এবার একটা খবর দিই। ঠিক এই মুহূর্তে কলকাতা শহর এবং বিভিন্ন জায়গায় আমাদের মতো ছোট ছোট দলে আলোচনা এবং বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হচ্ছে। সবসময় মনে রাখতে হবে আমরা একা নই। প্রদীপ জ্বালার আগে যেমন সলতে পাকানোর প্রয়োজন হয় তেমনি এখন আমাদের কাজ হচ্ছে বিপ্লবের জন্যে নিজেদের প্রস্তুত করা। আমাদের কয়েকটা বিষয়ে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে। প্রথমত, সরকার আমাদের পছন্দ করবে না তা বলাই বাহুল্য। তারা একে রাষ্ট্রদ্রোহী কাজ বলে চিহ্নিত করবেই এবং বিনা বিচারে জেলে পুরবে আমাদের। এই জিনিসটি আমাদের এড়াতে হবে। আমরা চেষ্টা করব কোনও অবস্থাতেই যেন পুলিশের হাতে না ধরা পড়ি। যতটা সম্ভব গোপন কাগজপত্র, যা আমাদের ভবিষ্যৎ কর্মসূচির সঙ্গে জড়িত আছে তা নিজের কাছে না-রাখাই ভাল। অবশ্য এ ক্ষেত্রে ওদের ছলনার অভাব হবে না। চেয়ারম্যানের যে-কোনও রচনা কিংবা রেডবুক কাছে থাকলেই ওরা সুযোগ পেয়ে যাবে। কোনওভাবে যদি ধরা পড়তেই হয় তা হলে মনে রাখতে হবে যে, কোনও অত্যাচারের সামনে দাঁড়িয়েও ঠোঁট খোলা চলবে না। পুলিশ প্রলোভন দেখাবেই এবং সেই ফাঁদে পড়ে সতীর্থদের নাম যে বিপ্লবী ফাঁস করে দেয় তার শাস্তি মৃত্যু। প্রত্যেক কমরেড যেন এই কথাটা মনে রাখেন।

‘দ্বিতীয়ত, আমাদের আশেপাশের রাজনীতি-অসচেতন মানুষকে চট করে এইসব কথা না-বলাই ভাল। তারা উত্তেজিত হবে, গ্রহণ করতে না-পারলে গুজব ছড়াবে এবং শেষে তাই বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।’

অনিমেষ প্রশ্ন করল, ‘কিন্তু জনসাধারণকে সঙ্গে না-পেলে কী করে বিপ্লব সম্ভব?’

‘অত্যন্ত বুদ্ধিমানের মতো প্রশ্ন। চেয়ারম্যান যখন পদযাত্রা শুরু করেছিলেন তখন সাধারণ মানুষকে ঘরে ঘরে গিয়ে বোঝাতে হয়নি। তারা বুঝেছিল এটা তাদের প্রয়োজন এবং তা বুঝেছিল বলেই তারা নিজেরাই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল।’ মহাদেববাবু উত্তর দিলেন।

‘ঠিক কথা। কিন্তু এ-দেশে তো কোনও বিদেশি শত্রু রাজত্ব করছে না কিংবা দেশি একনায়ক নেই। যারা সরকারে আছে তাদের নির্বাচন করেছে জনসাধারণই। এখানকার রাজনৈতিক দলগুলো মিটিং ডাকলে এখনও হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়। এই মানুষগুলো সঙ্গে পেতে হলে কি তাদের বোঝাতে হবে না?’ অনিমেষের প্রশ্নটা সরাসরি।

‘তুমি রেডবুক পড়েছ?’

‘হ্যাঁ।’

‘প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কীভাবে কাজ করতে হয় তার একটা ধারণা নিশ্চয়ই হয়েছে তোমার?’

‘হ্যাঁ। কিন্তু আমার মনে হয় সব থিয়োরি সর্বত্র খাটে না। এ-দেশের মানুষ, অন্ধ ধর্মবিশ্বাসী, ব্যক্তিপূজারি, এবং রাজনৈতিক দলগুলোর পাইয়ে দেবার টোপ খেতে অভ্যস্ত। এই খোলস ছেড়ে আচমকা এরা বেরিয়ে আসবে এমনটা ভাবা যেন আকাশকুসুম চিন্তা। তাই আমরা যা চাইছি তা কি এদের বোঝানো প্রথম কর্তব্য নয়? বিপ্লব তো জনসাধারণকে নিয়েই।’ অনিমেষ খুব ভেবেচিন্তে ধীরে ধীরে কথাগুলো বলল।

‘যুক্তিপূর্ণ কথা এবং এ-কথা কেউ অস্বীকার করবে না। কিন্তু কীভাবে জনসাধারণকে বিপ্লব-সচেতন করা যায় তা নিয়ে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব চিন্তা করছেন। আমরা নিশ্চয়ই জনসভা করে তাদের বোঝাতে পারি না কারণ সরকার তা হতে দেবেন না। তা ছাড়া জনসভায় বক্তৃতা মানুষের বুকের ভেতর কতটা পৌঁছায় সে বিষয়ে সন্দেহ আছে।’ মহাদেববাবু চিন্তান্বিত গলায় বললেন।

অনিমেষের বাঁ পাশের ভদ্রলোক বললেন, ‘আমার মনে হয় এখানে আমরা একটা বিষয় এড়িয়ে যাচ্ছি। এই শাসনব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন আনার জন্যে আমরা যে চেষ্টা করব তা তো কোনও ব্যক্তিবিশেষের জন্যে নয়। আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপ দেখে যদি জনসাধারণ সেটা বুঝতে পারে তা হলে মিটিং করে তাদের বোঝাতে যেতে হবে না। একটা সময় আসবে যখন তারা নিজেরাই সব মুখোশ খুলে আমাদের সঙ্গে যোগ দেবে।’

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ‘এত নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে কী করে?’

ভদ্রলোক বললেন, ‘খুবই সহজ। ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষ অত্যাচারিত, নিঃস্ব। পৃথিবীতে এখন দুটো জাত আছে। একদল ধনহীন অন্যদল ধনবান। এই দুই দলই কে তাদের বন্ধু এবং কে শত্রু তা চিনতে ভুল করে না। আজকের কৃষক শ্রমিক খুব সহজেই আমাদের বুঝতে পারবে। সমস্যা হবে মধ্যবিত্তদের নিয়ে। তারাই ঘোঁট পাকাবে। তবে ঝড় যখন সত্যিই উত্তাল হয় তখন একটা কলাগাছ কতক্ষণ মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে!’

অনিমেষ কিন্তু এতটা নিশ্চিন্ত হতে পারছিল না। তার মনে হচ্ছিল কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব অবশ্যই এদিকটা চিন্তা করবেন এবং জনসাধারণকে সচেতন করার দায়িত্ব নেবেন। ট্রামে বাসে রাস্তায় মানুষকে দেখেও মনে হয় না তারা বিপ্লব এলে যোগ দেবে। কেউ যখন ঝামেলায় জড়াতে চায় না তখন কী করে এত নিশ্চিত হওয়া যায়!

এইসময় মহাদেববাবু প্রস্তাব রাখলেন, ‘অনিমেষ, জানি না তুমি এতে সন্তুষ্ট হবে কিনা তবে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব একটা প্রস্তাব নিয়েছেন। তাঁরা প্রতিটি এলাকায় জনসাধারণকে জানাবার জন্যে দেওয়াল পোস্টার লেখার কথা বলেছেন। যে সমস্ত মানুষ এখনও মনস্থির করতে পারছেন না এইসব পোস্টার দেখে তাঁরা নিশ্চয়ই সক্রিয় হবেন। এটাকে পরোক্ষভাবে জনসচেতন করার চেষ্টা বলতে পারো।’

কথাটা এমনভাবে বলা যে অনিমেষ চমকে মুখ তুলছিল। কিন্তু মহাদেববাবুর গলায় কোনও জ্বালা ছিল না। কথা শেষ করে তিনি হাসছিলেন।

অনিমেষ বলল, ‘আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন না—।’

হাত নেড়ে ওকে থামিয়ে দিলেন মহাদেববাবু, ‘না না, না, তোমাকে এজন্যে ক্ষমা চাইতে হবে না। যৌবনের ধর্মই হল যাচিয়ে নেওয়া। তুমি ঠিক কাজই করেছ। তবে একজন গেরিলা সৈনিক হিসেবে কতগুলো নিয়ম পালন করতে হয়। অনেক কিছু চট করে মনের সঙ্গে না-মিললেও মনে রাখতে হবে বৃহত্তর স্বার্থের জন্যে তাই মান্য করা উচিত। নেতৃত্বকে প্রতি পায়ে অস্বীকার করা মানে বিপ্লবকে হত্যা করা। তুমি নিজেও একদিন এই সমস্যায় পড়বে। হয়তো তখন তোমাকেই খুব কঠোর ব্যবস্থা এ কারণে নিতে হতে পারে।’

সুবাসদা এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিলেন। হঠাৎ প্রশ্ন করলেন, ‘কিন্তু বিপ্লবের নেতৃত্ব কার হাতে থাকছে?’

‘জল যখন পাহাড় থেকে একবার নেমে পড়ে তখন সে কোনদিকে যাবে তা কি আগে থেকে অঙ্ক কষে বলা যায়?’ মহাদেবদা বললেন।

‘কিন্তু গরিব ভূমিহীন কৃষকেরা যদি নেতৃত্বে না-আসে তা হলে তো বিপ্লব মধ্যবিত্ত-ভিত্তিক হয়ে যাবে, তাই না?’

‘অবশ্যই। এবং তারা যে আসবে না তা আমরা জানছি কী করে?’ অনিমেষের পাশের ভদ্রলোক বললেন, ‘এটা তো তত্ত্বের কথা হল। যতদিন গরিব শ্রমিক কৃষক নেতৃত্বে না-আসছে মার্ক্সবাদী লেনিনবাদী যোদ্ধারা উপযুক্ত এবং আদর্শ সময় পেয়েও নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকবে?’

অনিমেষের এ-সময়ে লেনিনের কথা মনে পড়ে গেল। লেনিন তো শ্রমিক কিংবা ভূমিহীন কৃষকের পরিবারের সন্তান ছিলেন না। অনিমেষ হেসে বলল, ‘এই দেখুন, এখানে থিয়োরি আর জীবনের মধ্যে পার্থক্যটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। এই তত্ত্ব মানলে লেনিনের উচিত ছিল না রাশিয়ার বিপ্লবের নেতৃত্ব দেওয়া।’

পাশের ভদ্রলোক খুশি হলেন। অনিমেষকে বললেন, ‘ঠিক কথা বলেছেন। সেইসঙ্গে আপনার একটু আগের কথা যাতে আপনি ভারতবর্ষের মানুষের অন্ধতা এবং নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে বিপ্লবের ব্যাপারটায় সন্দেহ করেছিলেন তার বিরুদ্ধে একটা যুক্তি রাখছি। মার্ক্স বলেছেন, একমাত্র প্রচণ্ড ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাতেই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্ভব। এই ছবিটা কি বিপ্লবের আগের রাশিয়ার সঙ্গে মেলে?’

কথাবার্তা খুব জমে উঠলেও মহাদেববাবু বোধহয় আর বাড়াতে চাইলেন না। তিনি বললেন, ‘আমার মনে হয় কিছু থিয়োরি সামনে রেখে কাজ শুরু না-করলে আমাদের এগোনো সম্ভব নয়। কিন্তু সবসময় যে থিয়োরি আঁকড়ে থাকতে হবেই তারও কোনও মানে নেই। পরিবর্তিত অবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে আমাদের চলতে হবে। এ-ব্যাপারে কারও ভিন্নমত পোষণ করা নিশ্চয়ই উচিত নয়। আচ্ছা, এবারে কাজের কথায় আসা যাক। আমাদের মধ্যে ওয়াল-পোস্টার লেখার অভিজ্ঞতা কারও আছে?’

দু’জন ছেলে হাত তুলল।

মহাদেববাবু বললেন, ‘খুব ভাল হল। বাইরের কাউকে দিয়ে এখনই পোস্টার লেখানো উচিত হত না। তোমরা রং নিয়ে আজ রাত থেকেই লেগে পড়ো। দমদম স্টেশন থেকে চিড়িয়ামোড় আর ওদিকে সিঁথির মোড় পর্যন্ত দিন সাতেকের মধ্যে যতটা সম্ভব কভার করবে। মনে রাখতে হবে এমন সব দেওয়াল বেছে নেওয়া হবে যা সহজেই মানুষের চোখে পড়ে। ঘনঘন লেখার দরকার নেই, মোটামুটি জায়গাটা কভার করলেই চলবে। বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে?’

ছেলে দুটির একজন বলল, ‘সাতদিনে এতটা জায়গা, খুব বেশি মনে হচ্ছে না? দু’জনের পক্ষে কি সম্ভব?’

মহাদেববাবু বললেন, ‘আমরা চেষ্টা করব। তোমাদের সঙ্গে আমরাও থাকব।’

সুবাসদা বলল, ‘কী স্লোগান লেখা হবে বলে দিন মহাদেবদা।’

মহাদেববাবু ঝোলা থেকে একটা কাগজ বের করে বললেন, ‘কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এখন এই স্লোগানগুলো লেখা হবে। বুর্জোয়া সংবিধান নিপাত যাক, পার্লামেন্ট শুয়োরের খোঁয়াড়, রেডবুক— মার্ক্সবাদ লেনিনবাদের সংকলন, চিনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান, বন্দুকের নল শক্তির উৎস, মাও সে তুং সূর্যের চেয়ে বড় কারণ তাঁর চিন্তাধারা পৃথিবীর সর্বত্র আলো দেয়, সংশোধনবাদ নিপাত যাক, বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক। তোমরা এইগুলো কপি করে নাও।’ মহাদেববাবু কাগজটা ওদের দিকে বাড়িয়ে দিলেন। ওঁর পড়ার গুণে ঘরে একটা অন্যরকম আবহাওয়া তৈরি হয়েছিল।

সুবাসদা বলল, ‘মহাদেবদা, বর্তমান শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে আরও সরাসরি কিছু কথা থাকলে ভাল হত না?’

মহাদেববাবু বললেন, ‘এখন সাধারণ মানুষের মনে এই ব্যাপারটা একটু আলোড়ন তুলুক তাই কেন্দ্রীয় কমিটি চান। পরের স্টেজে ওগুলো আসবে।’

অনিমেষের পাশের ভদ্রলোক বললেন, ‘পুলিশ আমাদের লিখতে দেবে?’

মহাদেবদা বললেন, ‘না-দেওয়াই স্বাভাবিক। আমাদের তৈরি হয়ে যেতে হবে। দু’জন লিখবে দু’জন পাহারা দেবে। প্রথম দিকে শুধু পুলিশের কাছেই বাধা পাব কিন্তু পরবর্তীকালে কংগ্রেস এবং সি পি এম প্রতিরোধ করবেই। সেজন্যে সংগঠন শক্তি আরও জোরদার করতে হবে।’

আলোচনাসভা ভাঙলে সবাই এক এক করে বেরিয়ে যাচ্ছিল। আজ রাত বারোটার সময় দমদম স্টেশনের সামনে একটি ছেলে আসবে সরঞ্জাম নিয়ে। অনিমেষ আর সুবাসদা ওর সঙ্গী হবে। অন্য জন কাজ শুরু করবে সিঁথির মোড়ে। যে দু’জন তার সঙ্গে থাকবে তারা সময় জেনে চলে গেল। অনিমেষ বেরিয়ে আসছিল কিন্তু মহাদেববাবু তাকে আর একটু বসে যেতে বললেন। সুবাসদাকে বললেন, ‘তুমিও থাকো সুবাস।’ তারপর ঘর ফাঁকা হয়ে গেলে বললেন, ‘সুবাস, আজকের সভা সম্পর্কে তোমার মতামত কী?’

সুবাস বলল, ‘ভাল কাজ হয়েছে।’

‘কিন্তু অনিমেষ, তোমার কি দ্বিধা আছে?’

অনিমেষ মাথা নাড়ল, ‘না। আমি এখন বিশ্বাস করি এই পথেই দেশের মুক্তি সম্ভব। এ দেশে কমিউনিজম প্রতিষ্ঠা করতে গেলে বিপ্লব অবশ্যই প্রয়োজন। একথা ঠিক, বিদেশি শক্তি, কিংবা প্রচণ্ড ডিক্টেটরশিপ থাকলে কাজটা সহজ হত, আমরা সহজেই জনসাধারণকে সঙ্গে পেতাম কিন্তু এ ছাড়া কোনও উপায় নেই।’

মহাদেববাবু বললেন, ‘তোমায় একটা উলটো প্রশ্ন করি। কেন নেই?’

অনিমেষ বলল, ‘দেখুন, স্কুলে পড়ার সময় আমি কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। দেশপ্রেমের ব্যাপারটা আমাকেও স্পর্শ করেছিল। কিন্তু খুব অল্প দিনেই আমার মোহভঙ্গ হয়। কংগ্রেস একটা ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, এটা জানতে দেরি হয়নি। তারপরেই কমিউনিস্ট পার্টির দিকে আমি আকৃষ্ট হলাম। লেনিন, মার্ক্সের কথা এবং লেখা পড়ে বিশ্বাস করলাম এই হল একমাত্র পথ। কিন্তু এ দেশের কমিউনিস্ট পার্টির চেহারা যখন একটু একটু করে বুঝতে শুরু করলাম তখন অদ্ভুত বিষাদ এল। এদের কাজকর্মের সঙ্গে মার্ক্স কিংবা লেনিনের কোনও সম্পর্কই নেই। বুঝলাম সংসদীয় গণতন্ত্রের এই কাঠামোয় কমিউনিস্ট পার্টির এবং কংগ্রেসের মধ্যে পার্থক্যটা বেশি হতে পারে না। তখন মনে হত যদি একটা বিদেশি শক্তি আমাদের আক্রমণ করত, সব ভেঙে চুরমার করে দিত তা হলে তাদের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে আমরা যে শক্তি পেতাম তা থেকে নতুন ভারতবর্ষ গড়া যেত। বলতে গেলে আমি নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছিলাম। এমন সময় সুবাসদার মাধ্যমে এই কর্মসূচি জানতে পারলাম। ঠিক এইরকম রাস্তাই তো আমি খুঁজছিলাম। তাই দ্বিধা থাকবে কেন?’

মহাদেববাবু বললেন, ‘তুমি যে-কোনও মুহূর্তে নিজেকে উৎসর্গ করতে প্রস্তুত?’

‘অবশ্যই।’

‘তোমার বাড়িতে কে আছেন?’

প্রশ্নটা শুনে অনিমেষ মহাদেববাবুকে দেখল। বাড়ির কথা এখানে কেন? বোধহয় ওর চাহনি দেখেই মহাদেববাবু বিশদ হলেন, ‘আমি তোমার অ্যাটাচমেন্টের কথা জানতে চাইছি।’

‘আমার ঠাকুরদা, বাবা, মা এবং পিসিমা।’

‘ভাইবোন নেই?’

‘না।’

‘তুমি পরিবারের একমাত্র সন্তান, ওঁরা তো তোমার ওপর নির্ভর করবেন!’

‘আমি ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছি দাদু পিসিমা এবং বাবা-মা পরস্পরের ওপর নির্ভর করতেই অভ্যস্ত। আর আমার দাদুর কথা বলছি, এ-দেশের বর্তমান কাঠামো ভেঙে ফেলতে যদি বিপ্লবের ঢেউ আসে এবং আমি যদি সেই আয়োজনে থাকি তা হলে তিনি অখুশি হবেন না।’ অনিমেষ বলল।

‘বেশ। সমস্যা তা হলে আর কিছু রইল না।’ অনিমেষের হাত ধরলেন মহাদেববাবু, ‘তোমাকে যদি এই মুহূর্তে খুব বড় দায়িত্ব দেওয়া হয় তুমি নেবে?’

‘বলুন।’

‘গতকাল তোমার সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর কথাটা আমার মনে হয়েছে। আজ খোঁজখবর নিয়েছি, অবশ্য সুবাসও তোমার হয়ে বলেছে আমাকে। তোমার বাড়ি উত্তরবাংলায়। চা-বাগানের মানুষদের তুমি নিশ্চয়ই কিছুটা চেনো। আমাদের কর্মসূচির প্রথম পদক্ষেপ শহরের মানুষকে পরিস্থিতি-সচেতন করা এবং গ্রামে বা মফস্‌সলে শ্রমিক-কৃষক সংগঠিত করে এগিয়ে যাওয়া। আমি আজই এ নিয়ে কথা বলব, তুমি যদি রাজি থাকো তা হলে যে-কোনও মুহূর্তে তোমাকে ওখানে যেতে হতে পারে।’

‘আমি রাজি।’

‘খুশি হলাম।’

‘আজ রাত্রে দেখা হবে তা হলে।’

পৃথকভাবে ওরা বেরিয়ে এসে চিড়িয়ামোড়ে দেখা করতেই সুবাসদা বলল, ‘অনিমেষ, তুমি কি ভেবেচিন্তে সব কাজ করছ?’

প্রশ্নটায় একটু বিরক্ত হল অনিমেষ। প্রশ্নকর্তা যেহেতু সুবাসদা তাই সেটা প্রকাশ না-করে বলল, ‘এ-কথা কেন বলছেন?’

‘তোমার এম. এ. পরীক্ষা সামনেই।’

‘তাতে কী হয়েছে।’

‘এখনই কলকাতা ছাড়লে পরীক্ষা দিতে পারবে?’

অনিমেষ হাসল, ‘সুবাসদা, আমি যে বিষয় নিয়ে এম. এ. পড়ছি তার ডিগ্রি পাওয়া কিংবা না-পাওয়ার কোনও পার্থক্য নেই। তা ছাড়া আমরা যা করতে চলেছি তা সম্ভব হলে এ ধরনের ডিগ্রির কোনও প্রয়োজন হবে না। আর শুধু পরীক্ষা দেওয়ার কথা যদি বলেন তা হলে তো তা যে-কোনও মুহূর্তেই এসে দিয়ে যাওয়া যায়।’

‘তা হলে এতদিন এম. এ. পড়িছলে কেন?’

‘কিছু করতে হয় তাই। তা ছাড়া আমি এম. এ. পড়ছি এই ভাবনাটা অনেককেই নিশ্চিন্ত রাখত।’

‘তোমার আর কারও কাছে জবাবদিহি দেওয়ার নেই?’

প্রশ্নটা শুনেই অনিমেষের চোখের সামনে মাধবীলতার মুখ ভেসে উঠল। যে মেয়ে তার জন্যে এক কথায় ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে তার সঙ্গে কথা বলাটা জরুরি ছিল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মনে হল আজ যদি সে পিছিয়ে আসত তা হলে বাকি জীবনটা বেঁচে থাকার কোনও কারণ থাকত না। সে যাই করুক নিশ্চয় মাধবীলতা তাকে সমর্থন করবে। মাধবীলতা তার থেকে মোটেই ভিন্ন নয়। অনিমেষ উত্তর দিল, ‘সুবাসদা, সেটা দেওয়া হয়ে গেছে।’

সুবাসদা অবাক গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘কার কাছে?’

‘আমার নিজের কাছেই।’ অনিমেষ হাসছিল।

সুবাসদা জিজ্ঞাসা করল, ‘সিগারেট আছে অনিমেষ?’

অনিমেষ ঘাড় নাড়ল, না। তারপর চারপাশে চোখ ঘুরিয়ে সিগারেটের দোকান খুঁজতে লাগল। এখন নিশুতি রাত। স্টেশনের দিকে গেলে অবশ্যই দু’-একটা দোকান খোলা পাওয়া যাবে কিন্তু এ তল্লাটে কোথাও আলো জ্বলছে না। কাশীপুর ক্লাবের পাঁচিলের ওপর ছেলে দুটো কাজ করছে। এ দিকটায় লোকজনের ঘন বসতি নেই বলে কাজেরও সুবিধে। অনেকটা জায়গা নিয়ে লেখা হচ্ছে— ‘‘বন্দুকের নলই শক্তির উৎস।’’ লক্ষ করছিল অনিমেষ, ছেলেটার হাতের এক একটা টানে কী সহজে রেখাগুলো জ্যান্ত অক্ষর হয়ে যাচ্ছিল।

ঠিক বারোটার সময় ওরা মিলিত হয়েছিল। দমদম স্টেশনের চত্বরটা তখন বাজারের মতো সরগরম। সুবাসদা একটু ইতস্তত করছিল ওখানে কাজ শুরু করতে। প্রথমেই লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা উচিত হবে না। ওরা তাই একটু সরে এসে লেখা শুরু করেছে। ছেলে দুটোর হাত খুব ভাল, এরই মধ্যে দুটো লেখা হয়ে গেছে।

রঙের কৌটো মাটিতে রেখে ছেলে দুটোর একজন বলল, ‘বিড়ি খাবেন?’

সুবাসদা হাত বাড়াল, ‘বেশি থাকলে দাও।’

পকেট থেকে দুটো বিড়ি বার করে ওদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে ছেলেটি কাজে ফিরে গেল। সুবাসদা নিজেরটা ধরিয়ে অনিমেষের মুখের সামনে হাতের আড়ালে বাঁচানো আগুন এগিয়ে ধরল। অনিমেষ বিড়িতে টান দিতেই একটা কটু গন্ধ জিভে গলায় ছড়িয়ে পড়ল। শরীর গুলোচ্ছিল প্রথমে কিন্তু ক্রমশ ঠিক হয়ে এল। সুবাসদা বলেছিল, ‘বিড়িটা অভ্যেস করাই ভাল। প্রথম কথা পয়সা খরচ কম, আর সবচেয়ে উপকারী যেটা সেটা হল, ক্যান্সার হয় না।’

‘বিড়ি খেলে ক্যান্সার হয় না?’

‘শুনেছি সিগারেটের কাগজটার ধোঁয়াই সবচেয়ে ক্ষতিকর। বিড়িতে সেই ধোঁয়াটা নেই। বাংলাদেশের গ্রামের মানুষের ক’জনার ক্যান্সার হয়?’

বিড়ির টান এখন ভাল লাগছে। অনিমেষ ভাবছিল এবার থেকে বিড়িই খাবে। পয়সা সাশ্রয়ের চিন্তাটাই মাথায় ছিল। হঠাৎ মনে হল মাধবীলতার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে যদি সে বিড়ি খায় তা হলে কী প্রতিক্রিয়া হবে! সত্যি, আমরা কতগুলো ব্যাপার নিজেদের ইচ্ছেমতন সাজিয়ে নিই এবং তার ব্যতিক্রম হলেই আমাদের চোখে দৃষ্টিকটু লাগে। যেমন সিগারেট খাওয়ার বদলে বিড়িটার চল যদি শিক্ষিত মানুষের মধ্যেই স্বাভাবিক হত তা হলে সে প্রতিক্রিয়ার কথা ভাবত না।

সামনের রাস্তা দিয়ে এখন কদাচিৎই গাড়ি যাচ্ছে। নিস্তব্ধ এই রাত্তিরে দেওয়ালের গায়ে অক্ষরগুলো জন্ম নিচ্ছিল। বন্দুকের নলই শক্তির উৎস। লেখার ভঙ্গিতে একটা উদ্দাম বিদ্রোহের চেহারা আছে। বন্দুক শব্দটা দেখতে দেখতে অনিমেষের সামনে একটা ছবি ফুটে উঠল। কিউবার জঙ্গলে এগিয়ে যাওয়া বিপ্লবীসেনার হাতের বন্দুকের শেষ টোটা ফুরিয়ে যাওয়ার পরে মরিয়া হয়ে সে শত্রুকে আঘাত করছে লাঠির মতো ব্যবহার করে। বন্দুকের বারুদের অভাব বুকের বারুদ পূর্ণ করেছে। সেই দেখা ছবিটাই এখন চোখের সামনে ভাসল। বিপ্লবে বন্দুক অনিবার্য। অথচ সে কখনও বন্দুক স্পর্শ করেনি। অস্ত্র ব্যবহারে দক্ষতা না-থাকলে শিক্ষিত প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হতে চাওয়া বোকামি ছাড়া কিছু নয়। দেশের সৈন্যবিভাগ শুধু এই ব্যাপারেই দীর্ঘকাল ধরে শিক্ষা পেয়ে এসেছে। তাদের বিরুদ্ধে একদম আনাড়ি হাতে বন্দুক ধরলে কয়েক মুহূর্তেই বিপ্লবের স্বপ্ন আকাশকুসুম হয়ে যাবে। তা হলে?

প্রদীপ জ্বালার আগে তাই সলতে পাকানোটা শেখা দরকার। এই প্রস্তুতিটা কীভাবে হবে? নেতারা ব্যাপারটা নিয়ে নিশ্চয় চিন্তা করছেন। অস্ত্রশিক্ষা যখন একান্ত প্রয়োজন তখন তার শিক্ষকও দরকার। এ দেশে যাঁরা রাজনীতি করেন তাঁদের এই ব্যাপারে বিন্দুমাত্র অভিজ্ঞতা নেই। আর যাই হোক ধুতি সামলে রাইফেল ছোড়া যায় না। সে ক্ষেত্রে সামরিক শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষের সাহায্য দরকার হবে। সেটা কী করে সম্ভব! ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষ দূর থেকে গাদাবন্দুক দেখার অভিজ্ঞতা নিয়েই বেঁচে আছে।

পরের সমস্যা হল, শক্তির উৎস বন্দুক যদি হয় তা হলে সেটা পর্যাপ্ত পরিমাণে সংগ্রহ করা প্রয়োজন। আধুনিক সমরবিদ্যায় শিক্ষিত বাহিনীর সঙ্গে লড়তে গেলে আধুনিক অস্ত্রের প্রয়োজন। সেটা এ-দেশে সংগ্রহ করা অসম্ভব। তা হলে? বিপ্লবের প্রাথমিক প্রয়োজনগুলো যদি না-মেটানো যায়—। ক্রমশ অস্থির হয়ে পড়ল অনিমেষ। টান না-দেওয়ায় বিড়ি নিভে এসেছিল, বিরক্তিতে সেটাকে ছুড়ে ফেলল সে। সুবাসদা বোধহয় লক্ষ করেছিল ওর অন্যমনস্কতা, জিজ্ঞাসা করল, ‘কী হয়েছে?’

অনিমেষ সুবাসদার মুখের দিকে তাকাল। অনিয়মে মুখটা কালো হয়ে আছে। ঠোঁটে বিড়ির লাল আগুন জোনাকির মতো জ্বলছে। ওই আগুনটার দিকে তাকিয়ে অনিমেষের মনে হল সে নিশ্চয়ই খুব ভাবপ্রবণ। তা না-হলে একসঙ্গে কাজে নেমে সুবাসদা যা চিন্তা করে না তাই সে করছে কেন? কোনও কাজ করতে গেলে তার মাথায় হাজারটা সম্ভাব্য ভাবনা চলে আসে।

সুবাসদা তাকিয়ে আছে দেখে অনিমেষ বলল, ‘ভাবছিলাম এত বন্দুক পাওয়া যাবে?’ কথাটা সহজ করার জন্যে বলে ফেলে হাসল সে। সুবাসদা বুঝতে পারল না অর্থ, ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করল, ‘মানে’?

‘বিপ্লবের জন্যে কত বন্দুক দরকার হিসেব করেছেন?’ এবার শব্দ করে হাসল অনিমেষ। মনের ভেতর যে প্রশ্নটা এতক্ষণ পাক খাচ্ছিল সেটাকে এত সহজ ভঙ্গিতে বের করে দিতে পেরে স্বস্তি পেল সে। সুবাসদার মুখের রেখাগুলো সহজ হয়ে এল, ‘যদি প্রয়োজন হয় তা হলে ভারতবর্ষের প্রত্যেকটি মানুষ এক-একটি বন্দুকে রূপান্তরিত হবে।’

‘আমি আপনার সঙ্গে একমত। কিন্তু সরকারের সঙ্গে লড়তে গেলে অস্ত্র দরকার।’

‘ও নিয়ে চিন্তা কোরো না। প্রয়োজন তীব্র হলে কোনও কিছুই বাধা হয় না।’

ওদিকে ততক্ষণে লেখাটা শেষ হয়ে গেছে। ছেলে দুটো জিনিসপত্র গুটিয়ে একটু সরে এসে নিজেদের শিল্পকর্ম দেখছিল। সত্যি খুব সুন্দর হয়েছে লেখা। অনিমেষ মনে মনে তারিফ করল। বেশ তেজ আছে অক্ষরগুলোর মধ্যে। ওরা পরবর্তী জায়গার জন্যে এগিয়ে গেল। শেঠ লেনের মুখে একটা ভাল জায়গা বেছে নিয়ে ওরা কাজে লেগে গেল। কোথাও সামান্য শব্দ নেই। ‘পার্লামেন্ট শুয়োরের খোঁয়াড়’ লেখার আয়োজন চলল।

পাশের একটা রকে অনিমেষ বসেছিল। সুবাসদা রাস্তার উলটো দিকে জলবিয়োগ করে এসে দাঁড়াতেই গলি থেকে পাঁচ-ছ’জন লোক দৌড়ে এসে ওদের সামনে থমকে দাঁড়াল। লোকগুলো অনিমেষদের বোধহয় এখানে আশা করেনি। একটু থতমত হয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে ওরা দু’-তিনটে দলে ভাগ হয়ে ছুটে গেল এপাশ ওপাশ। ওরা চলে যাওয়ামাত্র দূরে কোথাও আওয়াজ উঠল। চিৎকার করছে কেউ এবং ক্রমশ শব্দটা বাড়তে লাগল। অনিমেষ চাপা গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘লোকগুলো কারা হতে পারে বলুন তো?’

‘বুঝতে পারছি না। ওয়াগন ব্রেকার কিংবা ডাকাত হতে পারে।’

‘কী করবেন?’

শব্দটা এগিয়ে আসছিল। যেন অনেক লোক কাউকে তাড়া করে আসছে। ছেলে দুটোর একজন বলল, ‘আমাদের আর এখানে থাকা উচিত হবে না।’

সুবাসদাও মাথা নাড়ল, ‘হ্যাঁ। জলদি পা চালাও।’

আঁকার জিনিসপত্র হাতে নিয়ে ওরা চিড়িয়ামোড়ের দিকে জোরে হাঁটতে লাগল। ওরা যখন রেডিয়ো গলির মুখে পৌঁছেছে ঠিক তখন সামনের রাস্তায় দুটো হেডলাইটকে ছুটে আসতে দেখল। অনিমেষ চাপা কণ্ঠস্বর শুনতে পেল, ‘লুকিয়ে পড়ো চটপট।’

সে কিছু বুঝে ওঠার আগেই জিপটা পাশে এসে দাঁড়াল শব্দ করে। দু’-তিনজন লোক লাফ দিয়ে নেমে চেঁচিয়ে উঠল, ‘হ্যান্ডস আপ!’

অনিমেষ সেই মুহূর্তেই আড়চোখে দেখতে পেল তার পাশে শুধু আঁকিয়ে ছেলে দুটোর একজন ভীতমুখে দাঁড়িয়ে আছে। সুবাসদা কথাটা বলেই কী করে যে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল কে জানে। লোকগুলোর নির্দেশ মান্য করার সময় ওদের হাতে চকচকে অস্ত্র নজরে পড়েছিল। একজন মোটামতো লোক জিপে বসেই জিজ্ঞাসা করল, ‘এত রাত্রে এখানে কী করছেন?’

দুটো হাত মাথার ওপরে, অনিমেষ বলল, ‘প্রয়োজন ছাড়া কেউ বের হয়?’

লোকটা অত্যন্ত বিরক্ত হল, ‘যা প্রশ্ন করেছি তার উত্তর দিন।’

‘কাজ ছিল।’

‘কী কাজ?’

‘লেখালেখি।’

‘লেখালেখি? রাত্তিরবেলায় রাস্তায় ঘুরে আপনারা পদ্য লিখেছন?’

‘পদ্যের আপনি কিছু বোঝেন?’

‘শাট আপ! আমাকে পদ্য বোঝানো হচ্ছে? নাম কী!’

‘অনিমেষ মিত্র।’

ততক্ষণে দু’জন পুলিশ ওকে সর্বাঙ্গে হাতিয়ে দেখেছে। ওর সঙ্গী ছেলেটিও বাদ পড়েনি কিন্তু তার হাত থেকে ওরা দুটো রং-মাখা তুলি উদ্ধার করে বীরদর্পে অফিসারটির দিকে এগিয়ে গেল। নাম শুনে অফিসারটি ঘাড় ঘুরিয়ে পাশের লোকটিকে কিছু জিজ্ঞাসা করে মাথা নাড়ল, তারপর তুলি দুটো দেখতে পেয়ে বলল, ‘কোন পার্টি?’

‘পার্টি ফার্টি নয়।’

‘পার্টি নয় তা হলে তুলি দিয়ে কী লেখা হচ্ছিল?’

‘লেখা হয়নি, লিখব বলে ভাবছিলাম।’

‘ভাবছিলেন? কী সেটা?’

‘কলকাতাকে আরও সুন্দর করে তুলুন, কলকাতা তিলোত্তমা হবেই, কলকাতার অন্য নাম ভালবাসা, এইসব।’

কথাটা শেষ হওয়ামাত্র হো-হো করে হাসতে লাগল অফিসার। পুলিশগুলোও দাঁত বের করল দেখাদেখি। হাসি শেষ করে অফিসার বলল, ‘হয় মাথা খারাপ নয় কবিটবি হবে। নামটাও যেন কাগজে দেখেছি মনে হচ্ছে।’

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ‘আমি হাত নামাতে পারি এবার?’

‘নামান। থাকা হয় কোথায়?’

এতক্ষণ একটা জেদের ঘোরে কথা বলছিল অনিমেষ। অফিসার ঠিকানা জিজ্ঞাসা করতেই সে থিতিয়ে গেল। ঠিকানা জানার পর এরা যদি তাকে সেখানে নিয়ে যেতে চায় তা হলে— না ভুল ঠিকানা বলা চলবে না।

ঠিক সেই সময় শেঠ লেন থেকে তিন-চারজন লোক খুব উত্তেজিত হয়ে বেরিয়ে পড়ল। তারা দমদম রোড দিয়ে এদিকেই আসছিল। অফিসার সেদিকে তাকিয়ে বলল, ‘এরা আবার কে?’

পুলিশের জিপ দেখে লোকগুলোর উৎসাহ যেন আরও বেড়ে গেল। পুলিশ পুলিশ বলে চিৎকার করে ওরা ছুটে আসতে কনস্টেবল তিনজন এগিয়ে গেল অনিমেষদের পাশ থেকে। লোকগুলো একই সঙ্গে হাউমাউ করে কথা বলছিল। অফিসারের ধমকে ওরা একটুও শান্ত হচ্ছিল না। অনিমেষ বুঝল একটু আগে মারাত্মক কিছু হয়ে গেছে শেঠ লেনের ভেতর। কয়েকটা লোক একটা বাড়ির দরজা ভেঙে ডাকাতি করেছে। বাধা দিতে গিয়ে বাড়ির একটি ছেলে খুন হয়েছে। ওরা যখন এইসব কথা পুলিশকে জানাচ্ছে তখন অনিমেষের পাশে দাঁড়িয়ে আঁকিয়ে ছেলেটি ফিসফিস করে বলল, ‘চলুন পালাই।’

অনিমেষ সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক হয়ে ওদের দিকে নজর বোলাল। অফিসারের সামনে নালিশ জানাতে আসা লোকগুলো দেওয়ালের মতো আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে। কনস্টেবলগুলো অনেকটা দূরত্বে মন দিয়ে কথা শুনছে। এখন যদি পালানো যায় তা হলে ধরা পড়ার সুযোগ কিছুটা কম। যদিও পালাবার রাস্তা একটাই, পেছনের রেডিয়ো গলি কিন্তু সেটা অনেকটা দূর অবধি সোজা দেখা যাচ্ছে এবং রাস্তার আলোগুলো খুব উজ্জ্বল। ওই গলি দিয়ে দৌড়ালে এরা অনেকক্ষণ দেখতে পাবে। ছোটার সময় যদি পা বিশ্বাসঘাতকতা করে তা হলে হয়ে গেল। কিন্তু সুবাসদারা কোথায় গেল? অনিমেষ কাঠেপিঠে লুকোবার জায়গা দেখতে পেল না। পাশের ছেলেটি আবার জিজ্ঞাসা করল, ‘কী করবেন?’

‘পালানো যাবে না।’

‘যাবে।’

চোখের ইঙ্গিত করে ছেলেটি আচম্বিতে দৌড় শুরু করল। অনিমেষ জায়গাটা লক্ষ করেনি। পেছনের নর্দমার পাশ দিয়ে সরু একটা পথ বাড়িগুলোর মধ্যে ঢুকে গেছে। রেডিয়ো গলি নয়, ছেলেটি ওই সরু পথের মধ্যে ছুটে গেল। এক পলকও নয়, অনিমেষ বুঝে নিল আর এখানে দাঁড়িয়ে থাকা নিরাপদ নয়। ওর সঙ্গীর ছুটে যাওয়ার জবাবদিহি তাকেই করতে হবে। নিজের অজান্তেই পা চালাল অনিমেষ। সে যখন নর্দমা পেরিয়ে সরু পথটার মুখে, ঠিক তখনই পুলিশগুলোর নজর পড়ল এদিকে। সঙ্গে সঙ্গে হইহই আওয়াজ উঠল। একটা থান ইট অনিমেষের শরীর ঘেঁষে তীব্র বেগে ছুটে দেওয়ালে লেগে টুকরো হল। চকিতে ঘাড় ঘুরিয়ে অনিমেষ দেখল কতগুলো শরীর তার দিকে ছুটে আসছে।

অন্ধকার গলির ভেতরে অনিমেষ ঢুকে পড়ল। একপাশে সরু নর্দমা অন্যদিকে সাঁচির বেড়ার ঘর। এদিকটা যাতায়াতের পথ নয়। অনিমেষ প্রাণপণে ছুটছিল। পায়ের তলায় ভাঙা ইট, রাজ্যের আবর্জনা, একটুও আলো চোখে পড়ছে না। সঙ্গী ছেলেটির কোনও অস্তিত্ব বোঝা যাচ্ছে না। রাস্তাটা কোথায় গিয়েছে এসব ভাববার কোনও অবকাশ নেই, অনিমেষ অন্ধের মতো ছুটছিল। দু’-তিনটে মোড় পেরিয়ে হঠাৎ সতর্ক হয়ে গেল সে। সামনে চকচক করছে জলকাদা। অর্থাৎ নর্দমাটা এখানে অনেকটা চওড়া হয়ে গিয়েছে এবং আর এগিয়ে যাওয়ার কোনও রাস্তা নেই। প্রায় খাঁচায় পড়া ইঁদুরের মতো অনিমেষ পেছন দিকে তাকাল। অস্পষ্ট কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে এবার। কনস্টেবলগুলো কি এই পথে ঢুকে পড়েছে? হঠাৎ আঁকিয়ে ছেলেটির ওপর মেজাজ গরম হয়ে গেল অনিমেষের। কী দরকার ছিল এভাবে পালানোর? অফিসারটি বেশ ভালই ব্যবহার করছিল, তা ছাড়া শেঠ লেনের লোকগুলোকে নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হত ভদ্রলোককে। ছেলেটা যদি এই পথেই আসে তা হলে যাবে কোথায়? অনিমেষ নর্দমাটা পার হবার চেষ্টা করল না। উলটোদিকে একটা তেতলা বাড়ির পেছন দিক। চিৎকার চেঁচামেচিতে দোতলার ঘরে আলো জ্বলে উঠেছে। এ পাশে সাঁচির বেড়ার ঘরগুলোর দিকে চকিতে নজর বোলাতে গিয়ে একটা ছোট ফাঁক চোখে পড়ল। কোনরকমে দ্বিধা না-করেই অনিমেষ সেই ফাঁক দিয়ে এগিয়ে গেল। বাঁশের কোনায় লেগে জামার হাতাটায় টান পড়তেই কেউ চিৎকার করল, ‘কে’?

জামাটাকে ছাড়িয়ে অনিমেষ দ্রুত এগোতেই একটা উঠোন দেখতে পেল। যে কে বলে ডেকেছিল তার সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না কিন্তু সবাই যদি জেগে ওঠে তা হলে আর দেখতে হবে না। ওপাশের পথটায় কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। পুলিশগুলো নিশ্চয়ই এতক্ষণে নর্দমাটার কাছে এসে গেছে। অনিমেষ চারপাশে খালি বারান্দা দেখতে পেল। তারপর দ্রুত পা চালাল বাইরে বেরুবার পথটার দিকে। গলিটা সরু, দু’পাশে বস্তিবাড়ি। বাঁ দিকের পথটা নিশ্চয়ই দমদম রোডে গিয়ে পড়েছে। ওদিকে এগোলে পুলিশের জিপের সামনে পড়তে হবে। কয়েক পা পেছনে এগোতে কাশির শব্দ কানে এল। অনিমেষ দেখল একটা দাওয়ার ওপর দ হয়ে বসে আছে কেউ, কাশিটা তারই গলা থেকে আসছে। অনিমেষের মনে হল লোকটা তাকে দেখেছে। কিন্তু দেখলে তো তার দিকে সরাসরি তাকাত। ওভাবে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে থাকবে কেন? অনিমেষ কী করবে বুঝতে না-পেরে আর এক পা এগোতেই লোকটি বলল, ‘খোকা এলি?’

সঙ্গে সঙ্গে শক্ত হয়ে গেল অনিমেষ. লোকটি কারও জন্যে অপেক্ষা করছে এত রাত্রে। কিন্তু তাকে এত কাছে দেখেও ভুল করছে কেন? গলার স্বরে বোঝা যায় বেশ বয়স হয়েছে, ‘ও খোকা, এলি নাকি?’

নিজের অজান্তেই অনিমেষ বলল, ‘হুঁ’।

‘রাত কত হল? এত দেরি করতে হয় বাপ, আমি যে ঘুমোতে পারি না।’ বৃদ্ধ খকখক করে কাশতে লাগল এবার। ঠিক এইসময় ও পাশের বস্তিতে কথাবার্তা শোনা গেল। পুলিশগুলো ওখানে ঢুকল কি না কে জানে!

‘ও খোকা যা ঘরে যা, ওপাশে আবার হইচই হয় কেন?’

বুড়োর গলায় উদ্বেগ ফুটে উঠল। জায়গাটায় দাঁড়ানো আর নিরাপদ নয়। অনিমেষ ইতস্তত করছিল। এতক্ষণে সে বুঝে গেছে বৃদ্ধ চোখে দেখতে পায় না। এত রাত্রেও ছেলের পথ চেয়ে জেগে বসে আছে। কোনও কিছু চিন্তা না-করে সে দাওয়ায় উঠে এল।

দরজাটা ভেজানো। বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে আর সাহস হচ্ছিল না। অথচ ভেতরে যেতেও কুণ্ঠা হচ্ছিল। কারণ ঘরের ভেতরে আর কে আছে সে জানে না। তাকে দেখে নির্ঘাত চিৎকার উঠবেই, এ-বাড়ির সমস্ত লোকই আর অন্ধ হতে পারে না। অতএব ভেতরে পা দেওয়া মানে স্বেচ্ছায় ধরা দেওয়া। কিন্তু পুলিশগুলো কি ওদেরই শেঠ লেনের হত্যাকারী বলে ঠাউরেছে? সঙ্গে সঙ্গে অনিমেষ ঠান্ডা হয়ে গেল।

অনিমেষ নিঃশব্দে বুড়োর দিকে এগিয়ে গেল। বুড়োকে সব কথা খুলে বললে কেমন হয়? বিনা কারণে পুলিশের রোষে পড়েছে জানলে যদি বুড়োর দয়া হয়। কিন্তু মুখ খোলার আগেই দরজায় শব্দ হল। অনিমেষ চকিতে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল দরজায় একটি রোগা শরীর দাঁড়িয়ে আছে। এত রোগা যে দেখলেও বিশ্বাস হয় না। আধো অন্ধকারেও সেই মুখচোখে বিস্ময় ফুটে উঠল। তারপরই চিৎকার করার জন্যে মুখ হাঁ হল। অনিমেষ সঙ্গে সঙ্গে দুটো হাত জড়ো করতেই শব্দটা বের হল না।

‘আমাকে বাঁচান।’ ফিসফিস করে উচ্চারণ করল অনিমেষ দরজার কাছে এগিয়ে গিয়ে। রক্তহীন শরীর, কোটরে ঢোকা চোখ, বয়স বোঝা মুশকিল। বৃদ্ধা ওকে খুঁটিয়ে দেখছিল এবার। গলার স্বরে যেটুকু আওয়াজ হয়েছে তাতেই বোধহয় বুড়োর খটকা লেগেছে। সঙ্গে সঙ্গে রেকর্ড বাজল, ‘কে, কে এল? খোকা এল না? অ খোকা!’

ও পাশের বস্তি এখন জেগে উঠেছে। পুলিশগুলো বোধহয় সবাইকে ডেকেডুকে কিছু বলছে। রাত বেশি বলেই বোধহয় মানুষের উৎসাহ কম। পুলিশ বস্তি থেকে বেরিয়ে সরু গলিটায় টর্চ ফেলতে লাগল। আর-একটু এগোলেই এই বারান্দাটা নজরে এসে যাবে।

‘আমাকে বাঁচান, আমি নির্দোষ!’ অনিমেষ আবার প্রার্থনা করল।

‘কে কথা বলে?’ বুড়োর গলায় সন্দেহ এবার।

‘খোকা।’ তীক্ষ্ম একটা কণ্ঠস্বর বাজল ওই রোগা শরীর থেকে।

‘অ খোকা! শুয়ে পড় বাবা, রাত ফুরিয়ে এল।’ তৃপ্তির গলা এবার।

টর্চের আলো এগিয়ে আসছে। অনিমেষ দেখল বৃদ্ধা দরজা থেকে সরে দাঁড়াল সামান্য। এবং প্রথম সুযোগেই সে ঘরের ভেতরে চলে এল। ঘর অন্ধকার। কিছুই দেখতে পাচ্ছে না সে, কারণ বৃদ্ধা এর মধ্যে দরজা ভেজিয়ে দিয়েছে এবং তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বরে জানতে চেয়েছে, ‘কে তুমি?’ গলার স্বর উচ্চগ্রামে নয় কিন্তু খুব জেদি এবং শীতল।

‘আমি রাজনীতি করি মা।’ শেষ শব্দটি উচ্চারণ করার আগে অনিমেষের একটুও মানসিক প্রস্তুতি ছিল না। তাই নিজের কানেই শব্দটা ঠেকল।

‘ভোটের লোক?’

‘না না। আমরা অন্য রাজনীতি করতে চাই।’

‘অ্যাই কে তুই?’ বাইরে হাঁক উঠল।

‘আমি নিবারণ দাস, আপনারা কে?’ বুড়োর গলা।

‘পুলিশ। এখানে বসে আছিস কেন?’

‘ঘুম আসে না বাবু। চোখে দেখি না ঘুমও আসে না।’

‘আর-একটি হেঁড়ে গলা বোধহয় জরিপ করেই বলল, ‘এ শালা অন্ধ।’

‘এদিকে কাউকে আসতে দেখেছিস।’

‘আমি তো চোখে দেখি না বাবু।’

‘ফালতু সময় নষ্ট করছিস। ফিরে চল।’

কয়েক মুহূর্ত বাদেই গলিটা নিস্তব্ধ হয়ে গেল। কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল অনিমেষ। এতক্ষণের উত্তেজনায় শরীর আর খাড়া থাকতে চাইছিল না। সে হাঁটু গেড়ে অন্ধকারে বসে পড়ল। সেই সময় বাইরে থেকে বুড়োর চাপা গলা ভেসে এল, ‘অ খোকার মা, খোকা আজ আবার কী করে এল, পুলিশ আসে কেন?’

‘ঘুমোও তো, চেঁচিয়ে পাড়া জাগিয়ো না।’ বৃদ্ধা ধমকে উঠল।

‘হ্যাঁ, এইবার ঘুম আসছে মনে হয়।’ বুড়ো বিড়বিড় করল।

সাদা কাপড়টাকে ঘরের এককোণে হেঁটে যেতে দেখল অনিমেষ। এই অন্ধকারেও সে ঘরের মধ্যে দারিদ্র্যের একটা গন্ধ টের পাচ্ছিল। কেমন একটা চিমসে হাওয়া পাক খাচ্ছে এখানে। এবং তখনই সে টের পেল এখানে শুধু ওরা দু’জনই নেই, আরও কয়েকটা নিশ্বাস পড়ছে মেঝেতে। ভাল করে দেখতে চেষ্টা করল অনিমেষ। হ্যাঁ, বৃদ্ধা যেদিকে গিয়ে বসেছে সেদিকের মেঝেতে তিনটে শিশু শুয়ে আছে।

‘তুমি চোর ডাকাত নও তো?’

‘আমাকে দেখে কি তাই মনে হয়?’

‘চেহারা দেখে আজকাল কিছু বোঝা যায় না।’

‘বিশ্বাস করুন, আমি কোনও অন্যায় করিনি। আমরা রাস্তায় পোস্টার লিখছিলাম এমন সময় পুলিশ তাড়া করল। আমাদের লেখাগুলো ওদের পছন্দ নয়।’

‘কী লেখা?’

‘আমরা এ-দেশের নিয়মগুলো ভাঙতে চাই। এইসব মন্ত্রী, নেতাদের সরিয়ে এমন একটা সরকার আনতে চাই যেখানে ধনী দরিদ্রের কোনও পার্থক্য থাকবে না।’

‘জানি না তুমি সত্যি বলছ কিনা, কিন্তু তোমাকে হুট করে এই ঘরে ঢুকতে দিলাম কেন জানো?’

‘আপনার দয়া।’

‘মোটেই না। বাইরের বুড়ো মানুষটা যদি ভুল বুঝেও নিশ্চিন্ত হয় তা হলে বাকি রাতটা একটু ঘুমুতে পারবে। উটকো লোককে এভাবে ঘরে ঢোকানো অন্যায় কিন্তু অন্ধ মানুষটার জন্যে-’ বৃদ্ধার গলা বুজে এল। সামান্য কান্নার আওয়াজ ঘরে পাক খেল। অনিমেষ অনেকক্ষণ কথা বলতে পারল না। নিজেকে সামলে নিয়ে বৃদ্ধা বলল, ‘ভোর হবার আগেই তুমি চলে যেয়ো। মানুষটার জাগবার আগেই।’

‘আচ্ছা।’

খানিকক্ষণ চুপচাপ। রাত ঘন হলে কতগুলো নিজস্ব শব্দ সৃষ্টি করে। সেগুলো মাঝে মাঝে কানে আসছিল। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে এখন। সুবাসদারা ধরা পড়ল কি না বোঝা যাচ্ছে না। যদি ধরা পড়ে তা হলে শেঠ লেনের ঘটনায় ফেঁসে যাওয়া বিচিত্র নয়। প্রথম রাতেই কী বিভ্রাট হল!

‘তোমার মা বাপ নেই?’ ঘরের কোণ থেকে গলা ভেসে এল।

‘কেন?’

‘রাত্তিরে বাড়ি ফিরছ না, তাদের চিন্তা হবে না?’

হঠাৎ অনিমেষের বুকের ভেতরটা ভারী হয়ে এল। সত্যি, এই কলকাতা শহরে তার জন্যে চিন্তা করার কেউ নেই। কথাটা মাথায় আসতেই বিদ্যুৎ ঝলকের মতো একটা মুখ মনের মধ্যে চলকে উঠল। যতক্ষণ সে অন্যায় করবে না ততক্ষণ সেই মুখ আমৃত্যু তাকে সমর্থন করে যাবে। অনিমেষ বলল, ‘চিন্তা তো হবেই। কিন্তু ভাল কাজ করতে গেলে তো ঘরে বসে থাকলে চলবে না।’

‘তুমি মদ খাও?’

‘না।’

‘বিয়ে করেছ?’

‘না।’

উত্তরটা শোনামাত্র একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল। সেই শব্দ এতদূরে বসেও যেন অনুভব করল অনিমেষ। বুড়োর গলায় খোকা ডাকটা এই মুহূর্তে তার কাছে জলের মতো স্পষ্ট। খুব নরম গলায় সে জিজ্ঞাসা করল, ‘এরা কে?’

‘আমার নাতি নাতনি।’

‘ওদের মা বাবা?’

‘মা চলে গেছে, বাপ মাতাল, অর্ধেক দিন বাড়ি ফেরে না। আমরা দু’জন এদের পাহারা দিই। ঝিয়ের কাজে আর ক’টা টাকা পাই!’ এবার নিশ্বাস ভীষণ ভারী।

তারপর সব চুপচাপ। অনিমেষ আর কথা খুঁজে পাচ্ছিল না। কখন ভোর হয় এই আশায় বসে থাকা ছাড়া এই মুহূর্তে অন্য কোনও চিন্তা নেই।

‘তোমরা কি লড়াই করে ভাল দিন আনবে, না আমাদের কাছে ভোট চাইতে আসবে?’ হঠাৎ বৃদ্ধা স্বাভাবিক গলায় কথা বলল।

‘আমরা ভোটে বিশ্বাস করি না।’

‘তা হলে?’

‘আমরা লড়াই করব।’

‘পারবে?’

‘পারতে হবেই।’

‘কী জানি বাবা।’

নিশ্বাসের শব্দ, আবার সব শান্ত। কিন্তু সেটা খুব সামান্য সময়ের জন্যেই। গলির ভেতর আওয়াজ উঠল। জড়ানো গলায় কেউ গান গাইছে। সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকারের মধ্যেই অনিমেষ দেখতে পেল বৃদ্ধা তড়াক করে উঠে দাঁড়ালেন। আর তারপরেই বাইরে বুড়োর কণ্ঠ বাজল, ‘কে এল? খোকা এলি? শুয়ে পড় বাপ।’

তিরের মতো বৃদ্ধা দরজা খুলে বেরিয়ে গেল বাইরে। তারপরেই হাউমাউ করে কান্না উঠল। পুরুষ কণ্ঠের আওয়াজ এবং সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধার গলা, ‘আঃ চুপ কর, পাড়ার লোক জাগবে, মদ খেয়ে কাঁদতে লজ্জা করে না, তুই না পুরুষ মানুষ!’

তারপরেই খোলা দরজা দিয়ে বৃদ্ধা একটা দড়ি পাকানো শরীরকে টেনে হিঁচড়ে ঘরে নিয়ে এল। লোকটাকে স্পষ্ট দেখা না-গেলেও বোঝা যাচ্ছিল আর দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি ওর নেই। এমনকী ঘরে যে অন্য কেউ দাঁড়িয়ে আছে সে খেয়াল করার ক্ষমতাও ওর নেই।

ছেলেকে বাচ্চাগুলোর পাশে ধীরে ধীরে শুইয়ে দিল বৃদ্ধা। শোওয়ামাত্র ফোঁস ফোঁস করে নিশ্বাস পড়তে লাগল তার।

অনিমেষ দাঁড়িয়ে ছিল, বৃদ্ধা এগিয়ে এসে বলল, ‘রাত শেষ হয়ে এসেছে, তুমি যাও।’

সেই সময়েই বুড়োর গলা বাজল, ‘ও খোকার মা, খোকা দু’বার এল কী করে, আগে কে এসেছিল?’

‘কেউ না। ঘুমোও তো।’ খিঁচিয়ে উঠল বৃদ্ধা।

‘কিন্তু আমি যে শুনলাম—।’

‘ভুল শুনেছ।’

অনিমেষ নিঃশব্দে বেরিয়ে এল বারান্দায়। বৃদ্ধা পেছনে পেছনে এসেছে। আকাশ ক্রমশ পরিষ্কার হচ্ছে। বারান্দার এক কোণে বুড়ো গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। বস্তির মানুষ জাগব জাগব করছে এইবার। অনিমেষ ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আপনার কাছে আমি ঋণী হলাম।’

বৃদ্ধা বলল, ‘কী কথার ছিরি! তাড়াতাড়ি এখান থেকে বেড়িয়ে পড়ো।’ বলে দ্রুত ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল।

এক মুহূর্ত অনিমেষ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর ভারতবর্ষের একটা ক্ষুদ্র শরীরকে ঘরের মধ্যে রেখে ভোর হয়ে আসা সময়ে সে বড় রাস্তার দিকে হাঁটতে লাগল।

সকল অধ্যায়

১. ১. শেষ বিকেলটা অন্ধকারে ভরে আসছিল
২. ২. হাঁটুর খানিকটা ওপরে
৩. ৩. দেবব্রতবাবু খুব কাজের মানুষ
৪. ৪. ব্যাপারটা যে এত দ্রুত চাউর হয়ে যাবে
৫. ৫. একতলার ক্যান্টিন রুমে
৬. ৬. তিনটের ক্লাসটা শেষ হলে
৭. ৭. অনিমেষ উঠে দাঁড়িয়েছিল
৮. ৮. পরমহংস চলে যাওয়ার পর
৯. ৯. প্রায় পাঁচ বছর অনিমেষ
১০. ১০. অন্যমনস্ক হয়ে আংটিটা ঘোড়াচ্ছিল
১১. ১১. ভুলু নামের ওই বিদঘুটে ছেলেটি
১২. ১২. হোস্টেলে কেমন একটা থমথমে ভাব
১৩. ১৩. য়ুনিভার্সিটিতে ঢোকার মুখে
১৪. ১৪. বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের নির্বাচন
১৫. ১৫. যুদ্ধ হয় একটার পর একটা
১৬. ১৬. এমন বিষধর সাপ আছে
১৭. ১৭. সন্ধ্যে নাগাদ সরিৎশেখর
১৮. ১৮. হোস্টেলে ফিরে এসে অনিমেষ দেখল
১৯. ১৯. সরিৎশেখরকে জানলার কাছে বসিয়ে
২০. ২০. জীবনে প্রথমবার থানায় এল অনিমেষ
২১. ২১. সরিৎশেখরের চিঠি এল
২২. ২২. খুব দ্রুত ঘটে যাচ্ছিল ঘটনাগুলো
২৩. ২৩. উপনির্বাচনটি নিয়ে উত্তরবাংলা
২৪. ২৪. কদমতলায় বাস থেকে নামতেই
২৫. ২৫. তিস্তার ওপর সুন্দর ব্রীজ
২৬. ২৬. অনিমেষের মুখের দিকে
২৭. ২৭. দাসপাড়ার উপনির্বাচনের কংগ্রেসপ্রার্থী
২৮. ২৮. কার্ডটা হাতে নিয়ে হতভম্ব
২৯. ২৯. দারোয়ানকে ম্যানেজ করে
৩০. ৩০. মাধবীলতা য়ুনিভার্সিটিতে আসেনি
৩১. ৩১. সবুজ ডোরাকাটা শাড়ি
৩২. ৩২. পয়লা তারিখে খুব ভোরে
৩৩. ৩৩. প্রথমেই জেনে নেওয়া দরকার
৩৪. ৩৪. খুব দ্রুত কাজ শুরু হয়ে গেল
৩৫. ৩৫. দক্ষিণেশ্বর স্টেশন থেকে ট্রেন
৩৬. ৩৬. বারীনকে ভাল লাগল অনিমেষের
৩৭. ৩৭. মাধবীলতাকে চিঠি
৩৮. ৩৮. খুব দ্রুত কাজ এগিয়ে যাচ্ছে
৩৯. ৩৯. সন্ধ্যে পার হয়ে গেছে
৪০. ৪০. খুব পাকা জুয়াড়ীও
৪১. ৪১. হাসিমারায় বসে কলকাতার খবর
৪২. ৪২. মহাদেবদার সঙ্গে রিকশায়
৪৩. ৪৩. জায়গাটা লালবাজার
৪৪. ৪৪. সেদিন যারা গা ঢাকা দিতে পেরেছিল
৪৫. ৪৫. জানলায় কোলকাতা ঠিকঠাক

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন