মগরাজ – ২২

রবিন জামান খান

অধ্যায় বাইশ – বর্তমান সময়

আগ্রাবাদ, চট্টগ্রাম

মোবাইলের ভাইব্রেশনের শব্দে মাঝ দুপুরের গাঢ় ঘুমটা আচমকাই ভেঙে গেল শারিয়ারের। ব্যাপার কী! এইসময়ে কে করল করতে পারে ওকে! মোবাইলটা হাতে তুলে নেবার পর দেখতে পেল আননোন নম্বর থেকে কল এসেছে। কিন্তু নম্বরের ধরন দেখে সে বুঝতে পারল এটা অফিসিয়াল নম্বর।

কলটা রিসিভ করবে কি না ভাবতে ভাবতে কলটা কেটে গেল। রিসিভ করেই বা লাভ কী। কেস তো শেষ। আবারও চাদর মুড়ি দিয়ে ওর মনে পড়ে গেল আজ সকালের ঘটনা। বলা যায়, ওর জীবনের সবচেয়ে লজ্জাজনক সকাল।

***

পাশা স্যারের সঙ্গে কথা বলার পর মেয়েটা যখন জানাল ওকে এই কেসটা থেকে ডিসচার্জ করা হয়েছে তখন শারিয়ার কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই মেয়েটা একটা আঙুল তোলে ওর উদ্দেশে।

‘আপনাকে ডিসচার্জ করা হচ্ছে ঠিকই, তবে,’ বলে সে নিজের একটা হাত তুলল। ‘আপনি চট্টগ্রাম ত্যাগ করার আগে আমাদের পুরো টিমের সামনে আপনার এবং আপনাদের পুরো ঘটনার ডিটেইল ব্রিফিং দেবেন, সঙ্গে লিখিত রিপোর্ট জমা দিয়ে আপনি চট্টগ্রাম ছাড়বেন। একই নিদের্শনা আপনার জন্যও, মিস্টার ভুবন। তবে আপনাকে ডিসচার্জ করা হচ্ছে না। বরং আপনি আমার টিমের সঙ্গে কাজ করবেন। দুজনেই বুঝতে পেরেছেন আমার বক্তব্য?’

দুজনেই মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। ‘আমার একটা অনুরোধ আছে। আমরা দুজনার কেউই অসলে এই মুহূর্তে ব্রিফ করার মতো অবস্থায় নেই কাজেই…’

‘আমি তো আগেই বলেছি আপনারা পিবিআইয়ের বাংলোতে চলে যান। সেখানে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে পোশাক বদলে খাওয়াদাওয়া করে বিশ্রাম নেন। দুপুরের পর আপনাদের সঙ্গে বসব আমি ও আমার টিম,’ বলে সে পেছন ফিরে ঘুরে গেল নিজের টিমের দিকে। তাদের বিভিন্ন নির্দেশনা দিতে শুরু করল। শারিয়ারের দিকে তাকিয়ে ভুবন হাতের ইশারা করল ওঠার জন্য। শারিয়ার নিজের ব্যাকপ্যাকটা নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে হাঁটা ধরল। পুলিশের একজন ওর ফাস্টপ্যাকটা সেই গাড়ি থেকে এনে পৌঁছে দিয়েছিল এখানে।

বাইরে বেরিয়ে আসতেই সকালের রোদ ঝাপ্পি মারল দুজনার চোখে। ‘বস, রোদটা উঠছে দেখছেন আজকে?’ শারিয়ার কিছু না বলে মাথা নাড়ল স্রেফ। ‘তুমি ও কি গেস্ট হাউসে যাবে?’ শারিয়ার জানতে চাইল।

‘না, বস আমি বাড়ি যাব। আমি তো পরিবারসহ এখানেই থাকি। যদিও আমার বাসা এখন খালি। তবে আমার কোনো সমস্যা নেই। আপনি ঠিক আছেন তো? বরং আপনি চাইলে বাংলোতে না গিয়ে আমার সঙ্গে আসতে পারেন,’ বলে সে মনোযোগ দিয়ে পরখ করতে লাগল শারিয়ারকে। শারিয়ার মাথা নাড়ল।

‘বস, মনের ওপরে চাপ নিয়েন না,’ বলে সে শারিয়ারের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। ‘মনের ওপরে চাপ নিলেও প্রবলেম, আর প্রবলেম হইলেই সমস্যা,’ বলে সে হেসে উঠল। শারিয়ারও হেসে উঠল তার সঙ্গে সঙ্গে। ‘এই যে মজার কথাডা কইলাম এইটা কিন্তু আপনেরে খুশি কইরা আরেকটা দামি বিড়ি খাওয়ার জন্য, বলে সে আবারও হেসে উঠল।

শারিয়ার ওর ব্যাকপ্যাকটা সাবধানে সামলে নিয়ে শতছিন্ন ব্লেজারের পকেট থেকে আরেকটা সিগারেট বের করে নিজে একটা ধরিয়ে আরেকটা এগিয়ে দিল ভুবনকে।

‘কিন্তু বস, একটা কথা, কাইল রাতে আসলে হইলোডা কী?’ বলে সে সিগারেটে টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলে উঠল। ‘ওই যে জিপ আসছে, মনে অয় ওইটাই আমারে বাসায় নামায়া আপনেরে গেস্ট হাউসে পৌঁছায়া দিব।’

জিপটা কাছে আসতেই দুজনেই চড়ে বসল ওটাতে। ‘শোন ভুবন, আমি যতটুকু বুঝতে পেরেছি এই কেসে যা বলা হচ্ছে বা যা দেখা যাচ্ছে এর বাইরেও আরো অনেক ব্যাপার আছে। কিছুই না বুঝে হুট করে এসে কেসের ভেতরে ঢুকে বোকার মতো ঝামেলায় সেঁধিয়ে গেছি। যাকগে,’ বলে নিজের এটা হাত বাড়াল শারিয়ার। ‘এখন এসব ভেবে আর লাভ কী? তোমরা সামলাও এসব,’ বলে সে হেসে উঠল। ‘তবে আমার কিছু অবজারভেশন আছে যেগুলো আমি বিফ্রিংয়ে সময় বলার চেষ্টা করব। যদি আমার কথা শোনা হয় আরকি। এরমধ্যে ফ্রেশ হয়ে খেয়েদেয়ে রেস্ট নিয়ে আরেকটু ঠান্ডা মাথায় চিন্তাও করা যাবে।’

ভুবন নেমে যেতেই ওকে একটু পর পিবিআইয়ে গেস্ট হাউসে নামিয়ে দিয়ে গেল জিপ। যাওয়ার আগে ড্রাইভার শারিয়ারকে তার নাম আর নম্বর জানিয়ে গেল। দুপুরের পর ওকে নিয়ে যাওয়ার কথা। ফোন দিলেও সে চলে আসবে এটাও জানিয়ে গেল।

সুন্দর খোলামেলা জায়গাতে খুবই চমৎকার একটা বাংলোমতো বাড়িতে গেস্ট হাউসটা। সামনের দৃশ্য দেখার মতো, সেই সঙ্গে থাকার আয়োজনও চমৎকার। শারিয়ার ভেতরে যেতেই একজন মেসেঞ্জার এসে ওকে ভেতরে সিঙ্গেল বেডের একটা কামরাতে ওকে নিয়ে গেল লোকটা। সেখানে ফ্রেশ হয়ে খেয়েদেয়ে লম্বা একটা ঘুম দেয় শারিয়ার। না ঘুমানো পর্যন্ত মাথা কাজ করছিল না। তারপর হঠাৎই ঘুমটা ভেঙে গেল এই মোবাইল ভাইব্রেশনের শব্দে।

***

কলটা কেটে যেতেই শারিয়ার আবারও চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিন্তু লাভ হলো না। কারণ মোবাইলটা আবারও ভাইব্রেট করতে শুরু করল। শারিয়ার অনুমান করল এই কল কেটে দিলে কিংবা রিসিভ না করলে বাজতেই থাকবে। তাই আর দেরি না করে আবারও মোবাইলটা তুলে নিয়ে নিজেকে যতটা সম্ভব সামলে নিয়ে পরিষ্কার গলায় বলার চেষ্টা করল, ‘হ্যালো।’

‘ঘটনা নাকি উলটো ঘটে গেছে? নায়ক নাকি ভিলেনের হাতে মার খেয়ে কুপোকাত হয়ে গেছে এবার?’ আদি অকৃত্রিম দরাজ একটা গলা বলে উঠল। সেকেন্ডের জন্য শারিয়ার বুঝতে পারল না কে কথা বলছে। যখন বুঝতে পারল খুশিতে মনটা আনচান করে উঠল ওর। কিন্তু সেটা গলায় ফুটে উঠতে না দিয়ে সে গম্ভীর গলায় বলল, ‘হ্যাঁ, মার কে খেয়েছে আর কাকে কার কাছ থেকে, আর কে কাকে উদ্ধার করেছে মাঝরাস্তা থেকে সেটা এখন সবাই জানে, শারিয়ার এটুকু বলতেই ফোনের অপর প্রান্ত থেকে হাসির শব্দ শোনা গেল। ‘শোন, বেশি কথা বলিস না। হাতি যখন কাদায় পড়ে পাশের বাসার আন্টিও তখন লাথি মারে,’ এবার আর শান্ত থাকল না, ওপর প্রান্ত থেকে জোরে হেসে ওঠার আওয়াজ পাওয়া গেল। শারিয়ার আবারও কিছু বলার আগেই ওপাশ থেকে মানুষটা কথা বলে উঠল, ‘বিদেশ থেকে ট্রেনিং নিয়ে এসে এভাবে কুপোকাত হয়ে গেলি বন্ধু? তাও আবার মেয়ে মানুষের কাছে! এটা একটা কথা হলো! তোর মতো তেজি মানুষ এভাবে একটা মেয়েমানুষের কাছে ঝাড়ি খাবে, আমি কোনদিন ভাবতেও পারিনি। ছি ছি এভাবে আমার মানসম্মান না ডোবালে কি তোর আর চলছিল না ব্যাটা, পিবিআইয়ের আরেক স্পেশাল অফিসার শারিয়ারের বন্ধু তানভীর মালিকের গলায় কৃত্রিম আনন্দ।

শারিয়ার আর তানভীরের বন্ধুত্বের শুরুটা খুব বেশি আগে নয়। বড়োজোড় ছয় কিংবা সাত মাস হতে পারে। শারিয়ার পিবিআইয়ের দক্ষ ফিল্ড এজেন্ট আর তানভীর ছিল পিবিআইয়ের একজন ডেস্ক অ্যানালিস্ট। কোনো এক অদ্ভুত কারণে আজ থেকে সাত মাস আগে যখন পিবিআই থেকে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড আর জার্মান পুলিশের একটা স্পেশাল ট্রেনিংয়ে পাঠানোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তখন পিবিআইয়ের ক্রিমিনাল অ্যানালিসিস উইংয়ের প্রধান হাবিব আনোয়ার পাশা এই দুজনকেই নির্ধারিত করে ইউরোপে ট্রেনিংয়ে যাওয়ার জন্য। তানভীরের সঙ্গে শারিয়ারের সখ্যতার শুরুটা সেই ট্রেনিং থেকেই। তবে ওদের বন্ধুত্বের শুরুটা খুব একটা ভালোভাবে হয়নি। দুই জগতের দুই মানুষ, দুই ধরনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড। এমনকি দুজনেই কাজের আলাদা ক্ষেত্র থেকে এসেছে। ফলে শুরু ওদের দুজনার জন্য পরস্পরকে মানিয়ে নেয়াটা অসম্ভব মনে হচ্ছিল কিন্তু পরবর্তীতে দুজনেই যখন বন্ধু হিসেবে পরস্পরকে আবিষ্কার করতে শুরু করল, তখন থেকে বন্ধুত্বটা এমনভাবে গভীর হতে শুরু করে যা দুজনকেই নিয়ে যায় অন্য এক ভুবনে। বড়ো হওয়ার পর মানুষের বন্ধুত্ব গাঢ় হয় না এই ধারণাকে সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণ করে দুজনেই হয়ে ওঠে পরস্পরের সবচেয়ে কাছের বন্ধু। যদিও ওদের ট্রেনিংয়ের একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে দুজনে আলাদা গ্রুপে পড়ে যায়। শারিয়ার নিজের ট্রেনিং পুরোটা শেষ করে আসতে পারলেও তানভীরের পক্ষে সেটা সম্ভব হয়নি। বিশেষ একটা মিশনের কারণে পাশা স্যারের নির্দেশে ট্রেনিংয়ের একেবারে শেষ পর্যায়ে সে চলে আসে বাংলাদেশে। ওদিকে শারিয়ার পুরো ট্রেনিং শেষ করে এসেছে। কিন্তু এরপরে দুজনার ভেতরে কোনো যোগাযোগ হয়নি।

তানভীরের টিপ্পনি হজম করে নিয়ে শারিয়ার বলে উঠল, ‘আমার আলাপ বাদ দে। যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। তোর কথা বল। আগে বল তোর শরীর এখন কেমন?’

অপারেশন ব্ল্যাক বুদ্ধার শেষ পর্যায়ে তানভীর গুলি খেয়ে সাংঘাতিক আহত হয়েছিল। সে-ব্যাপারেই শারিয়ার জানতে চাইছে ওর শরীর এখন কেমন। ‘আমি এখন বেটার। শরীর সেরে উঠছে। জানিসই তো শরীরের ক্ষত সবসময়ই মনের ক্ষতের চেয়ে দ্রুত শুকায়,’ বলে তানভীর মৃদু হেসে উঠল। শুষ্ক হাসিই বলে দেয় ফিল্ড লেভেলে অপারেশন ভালোভাবে সম্পন্ন করতে পারলেও নিজের প্রথম মিশনে তাকে কী পরিমাণ মানসিক যাতনার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে।

শারিয়ারও তাকে প্রায় একই ধরনের শুষ্ক হাসি ফিরিয়ে দিয়ে বলে উঠল, ‘ওয়েলকাম টু দা ওয়ার্ল্ড অব ক্যাওস,’ বলে সে যোগ করল। ‘প্রথমবারের মিশনে তুই নাকি জাদু দেখিয়েছিস। মৌসুমি আপা থেকে শুরু করে এমনকি পাশা স্যার পর্যন্ত তোর প্রশংসায় পঞ্চমুখ।’

‘আসলে বিয়ষয়টা উলটো, বন্ধু।’ ওপার থেকে তানভীর খুব তরল গলায় বলে উঠল। ‘শোন, পুরো মিশনে আমি কিছুই ঠিকঠাক করতে পারিনি। বলতে গেলে আমি একের পর এক সবই গুবলেট পাকিয়ে ফেলেছি। দু-একটা জায়গায় হয়তো আমার অ্যানালিটিক্যাল স্কিলের কারণে কিছু ব্যাপার আমি ধরতে পেরেছি, বাকি সাফল্যের ক্রেডিট আসলে পুরোটাই আমার টিমের আর ভাগ্যের। বুঝতে পেরেছিস?’

‘দোস্ত একটা কথা বলি, শারিয়ার শোয়া থেকে উঠে বসল। ‘তুই আদর্শ ফিল্ড এজেন্ট হবি একদিন। তোর কথার ধরনেই আমি বুঝতে পারছি,’ বলে জোরে হেসে . উঠল ও। ফিল্ড লেভেলের কাজ এভাবেই হয়। সিনেমায় আর উপন্যাসে যেমন দেখায় নায়ক সব ঠিকঠাক সমাধান করছে বাস্তবে তা হয় না। এখানে আসলে..

‘শারিয়ার, তোকে কয়েকটা কথা বলার জন্য ফোন করেছি আমি,’ ফোনের ওপর থেকে তানভীরের গলা বেশ সিরিয়াস হয়ে গেছে। যদিও আমি জানি আমার পরামর্শ কোনো অবস্থাতেই তোর মতো একজন দক্ষ ফিল্ড এজেন্টের দরকার নেই। তবুও যদি বন্ধু মনে করিস, সেই জায়গা থেকে দু-একটা কথা আমি বলতে চাই।’

শারিয়ার হেসে উঠল। ‘পাশা স্যার নতুন একটা টিম নাকি গঠন করছে। গুজব শুনলাম উনি নাকি তোকে ওটার প্রধান বানাতে যাচ্ছেন। তার মানে তুই খুব শীঘ্রই আমার বস হবি। তাই বলে এখনি বসগিরি ফলাতে শুরু করে দিলি? শালা, ফর্মালিটি বাদ দিয়ে কী বলবি বল,’ শারিয়ার বিছানার পাশ থেকে ডানহিলের প্যাকেটটা তুলে নিয়ে একটা সিগারেট বের করে মুখে লাগাল।

‘ধন্যবাদ বন্ধু,’ ওপাশ থেকে তানভীরের গলায় স্বস্তি। ‘শোন, তুই তো বহু বছর ধরে ফিল্ডে কাজ করছিস, আমি আমার প্রথম মিশনেই একটা ব্যাপার বুঝতে পেরেছি, ফিল্ড লেভেলের কাজে কখনোই সবকিছু ঠিকঠাক হয় না। আমরা কেউই ইয়ান ফ্লেমিয়ের জেমস বন্ড না যে খুব স্মুথলি প্রত্যেকটা মিশন সম্পন্ন করব। বেলা শেষে এসবই আসলে লেগে থাকার ব্যাপার, মাথা গরম না করার ব্যাপার এবং, বলে তানভীর একটু থামল। ‘সবচেয়ে বড়ো কথা হলো নিজের ইগোকে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যাপার। শারিয়ার, আমাদের সবারই ইগো আছে, তবে আমরা যদি আমাদের ইগোকে নিজেদের অস্তিত্বের চেয়ে বড়ো হতে দিই সেটা ভালো কোনো ব্যাপার না। আমাদের কারো ইগোই আমাদের চেয়ে বড়ো না। আমি কী বলতে চাইছি তুই কি বুঝতে পারছিস?’

শারিয়ার নীরবে সিগারেট টেনে যাচ্ছে। মনে মনে সে তানভীরের কথাগুলোর সঙ্গে একমত পোষণ করে। কিন্তু মুখে সেটা বলতে পারবে না। ‘শোন, তোর কেসটার ব্যাপারে আমি মৌসুমি আপার কাছ থেকে সব শুনেছি। তুই হয়তো কেসটাকে যেভাবে দেখছিস ব্যাপারটা আমার সেরকম মনে হচ্ছে না। ভুল তো তুই করেছিস। কিন্তু তুই হয়তো ভাবছিস পাশা স্যার একটা ভুলের জন্য তোকে এতটুকু ছাড় দিল না। ব্যাপারটা আসলে এরকম নয়। তুই ট্রেনিং শেষ করে এসে রিপোর্ট করিসনি। তোকে স্যারের উদ্ধার করতে হয়েছে জেল থেকে। এটাতে সে কষ্ট পেয়েছে। তবুও তোকে মিশনে পাঠিয়েছে এবং সেখানে গিয়ে তুই ভুল করেছিস, ভুল করার পর মাতব্বরি করেছিস, অফিসারের সঙ্গে গোয়ার্তুমি করেছিস। বল আমি ভুল বলছি?’

‘তুই আমাকে কী করতে বলিস তানভীর?’ শারিয়ারের গলা থমথমে।

‘আমি তোকে স্রেফ নিজের ইগোটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে বলছি, আর কিছু না।’

দুজনেই চুপ। ‘তারমানে তুই কি আমাকে মিশনে ফিরতে বলছিস?’ শারিয়ারের গলায় অবিশ্বাস। ‘আমি নিজের সম্মান হারিয়ে কাজ করব না তানভীর। তুই আমাকে চিনিস।’

‘আমি তোকে চিনি বলেই বলছি। তুই যেটাকে সম্মান হারানো বলছিস আমি সেটাকে বলছি নিজেকে প্রমাণ করা। তোর কি ধারণা পিবিআইয়ের চট্টগ্রাম ব্যুরোর লোকজনের কাছে তোর কিংবা আমাদের হেড অফিসের সম্মান বলে এই মুহূর্তে আদৌ কিছু আছে?’

শারিয়ার চুপ। তানভীর বলে চলেছে। ‘তার চেয়ে একটা বড়ো কথা কী জানিস। এটা আমার বিশ্বাস। তুই যদি এই কেসটা ছেড়ে ঢাকা চলে যাস আমার ধারণা ওরা কেসটা সলভ করতে পারবে না।’

‘এই কথা বলিস না। ওই তালুকদার না ফালুকদার ওর আস্ফালন দেখলে এই কথা বলতি না তুই,’ রাগে ঝামটে উঠল শারিয়ার।

‘শোন, মাতব্বরি দেখানোর সুযোগ পেলে তুইও তো দেখাস, দেখাস না? আর তোর ওপরে মাতব্বরি করার পেছনে ওই মেয়েটার কারণ আছে। পরে সেটা বলব। আমি তোকে স্রেফ একটা কথাই বলতে চাই। নিজের কারণেই হোক আর যে কারণেই হোক তুই তো কেসটার কিছুটা ভেতরে ঢুকেছিলি। তুই তো কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছিস কেসটা। এই কেসের ঘটনাগুলো কারো কাছেই এখনো পরিষ্কার না। যদি ধরে নেই আমরা একটা থ্রিলার উপন্যাসের ভেতরে তবে, এই কেসটাতে আসলে এখনো কী ঘটছে পাঠকের কাছে একেবারেই পরিষ্কার না। বলতে পারিস এখন পর্যন্ত স্রেফ গল্পের ভিত রচনা করা হয়েছে, গল্পটা বলা হয়নি। যে তোর আগে ময়দানে ছিল সে কিছুটা জানে, ফরেনসিক টিম কিছুটা জানে, তুই কিছুটা জানিস। তোরা যদি সবাই মিলে সবার সঙ্গে নিজের আইডিয়াগুলো শেয়ার করে টুকরোগুলোকে জোড়া না লাগাস তবে এই কেস সলভ হবে না। সবচেয়ে বড়ো কথা আমরা এখনো জানি না আমাদের শত্রু কারা। তারা কী চায়, তবে এটা তো বুঝতে পেরেছি আমাদের শত্রু অনেক বেশি শক্তিশালী। তা না হলে ওরা এতটা ডেসপারেটলি আক্রমণ চালাত না। প্লিজ বন্ধু, তুই কেসটা ছাড়িস না।’

‘কিন্তু আমাকে তো কেস থেকে ডিসচার্জড করে দেওয়া হয়েছে।’

‘আমি মৌসুমি আপার সঙ্গে কথা বলেছি। আমি প্রয়োজনে পাশা স্যারের সঙ্গেও কথা বলব। লাগলে আমি চট্টগ্রাম ব্যুরো বা তালুকদারের সঙ্গে কথা বলব। তুই তো ওদের ব্রিফিংয়ে যাবি। আমি বলি তুই কেসের ফিল্ড অফিসার হিসেবে না থাকলেও কেসের যে-টিম সেই টিমের পার্ট হিসেবে কাজ কর,’ ওপার থেকে তানভীরের গলায় অনুনয়ের সুর। ‘আমি জানি এটা তোর জন্য সম্মানের নয়। কিন্তু বন্ধু ভেবে দেখ, তুই যদি এখন কেসটা থেকে সরে আসিস এবং শেষ পর্যন্ত কেসটা ব্যর্থ হয় এবং দেখা যায় এটা বিরাট কোনো ষড়যন্ত্রের অংশ ছিল, যেমনটা পাশা স্যার ভাবছেন তবে সারাজীবনে তুই নিজেকে ক্ষমা করতে পারবি, বল?’

‘ঠিক আছে,’ অনেকক্ষণ চুপ থেকে শারিয়ার বলে উঠল, ‘শুধু তোর জন্য। বল আমাকে কী করতে হবে?’

ওপাশে তানভীর স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লে শারিয়ার পরিষ্কার শুনতে পেল। ‘ওদের ব্রিফিং শুরু হবে আড়াইটা থেকে, মানে লাঞ্চের পর থেকে। তোর হাতে এখনো কয়েক ঘণ্টা সময় আছে। তুই পুরো কেসটা নিয়ে আবারও বস। পেপার ওয়ার্কের সঙ্গে তোর কাল রাতের অভিজ্ঞতা মিলিয়ে দেখ। তারপর ব্রিফ করে আমার মনে হয় তুই কেসটাতে আলাদা একটা অ্যাঙ্গেল দিতে পারবি। একটা বিশেষ জায়গা থেকে শুরু করতে পারবি। আমি হাসপাতালে বসে পুরো কেস ফাইলটা দেখেছি। একটা জায়গাতে এখনো কেউ টাচ করেনি। কিংবা করা হয়ে ওঠেনি কেসটাতে।’

‘কোনটা সেটা?’

‘স্পট থেকে।’

‘মানে?’ শারিয়ার বুঝতে পারেনি তানভীরের কথা।

মানে হলো যেখানে অ্যাক্সিডেন্টটা হয়েছে। দেখ কেসটা শুরু হওয়ার পর থেকে সবাই লোকটার পরিচয়, তার ক্রিমিনাল রেকর্ড, এই লোকের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সব সংস্থার সংযোগ এসব অনেক ব্যাপার নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করছে। কেসটা শুরু হওয়ার আগেই এতটা ছড়িয়ে গেছে যে ইটস আ কমপ্লিট মেস। কিন্তু লোকটা নিজে এবং যেখানে অ্যাক্সিডেন্টটা হয়েছে সেটা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়নি। তুই তোর টিমকে ওখান থেকে শুরু করতে বল।’

‘ওই বেটি তালুকদার আমার কথা শুনবে ক্যান? সে যে মাতব্বর, শারিয়ার টিপ্পনি কাটল।

‘শারিয়ার, তুই মাঝে মাঝে বেশি কথা বলিস। শোন, আমি যা বলেছি তোকে সেখান থেকেই কাজটা করতে হবে তা কিন্তু না। এটা স্রেফ আমার সাজেশন। তুই নিজে ঘেঁটে দেখ। বললাম তো আরো কয়েক ঘণ্টা সময় আছে, তুই নিজে আমার চেয়ে অনেক বেশি এক্সপার্ট ও অভিজ্ঞ একজন এজেন্ট। কাজেই তুই ভেবে দেখ। আর যদি আমার পয়েন্টটা ঠিক হয় কিংবা তুই নিজে কিছু বের করতে পারিস তবে সেটাও ওদের সঙ্গে শেয়ার কর। আমি যা বলছি সেটা হলো, তুই নিজে সবসময় লিড দিয়ে এসেছিস ঠিক আছে। এখানে যেহেতু একটা ব্যাপার ঘটে গেছে তাই সেটাকে ভুলে গিয়ে তুই টিমের পার্ট হিসেবে কাজ কর। আমার অনুরোধ, তোর এখানে লক্ষ্য হবে কেসটাকে সলভ করা, অন্য কিছু না। তুই কি রাখবি আমার অনুরোধ?’

‘হইছে, বহুত প্যাঁচাল পাড়ছোস, শালা টোস্ট, শারিয়ার প্রায় ধমকে উঠল তানভীরকে। ‘এখন ফোন রাখ। আমি কাজে নামব,’ ওর কথা শুনে ওপাশ থেকে হেসে উঠল তানভীর। ‘আর শোন, তোর জন্য আমি এই বালের কেসে টিকে যাচ্ছি। ঢাকায় এলে ট্রিট দিবি, আর ওই বেটি তালুকদার যত মাতব্বরি দেখাবে আমার ওপরে তোর ট্রিটের আয়তন তত বাড়বে, মনে রাখিস,’ বলে সে হাসতে হাসতেই কল কেটে দিল।

কলটা কেটে দিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল সে ফোনের দিকে। তানভীর যা বলেছে ভুল বলেনি। কিন্তু সেটাকে শুদ্ধ প্রমাণ করতে গেলে অনেক কিছু হারাতে হবে। এমন সময় ওর ট্রেনিংয়ের একজন ইন্সট্রাকটরের কথা মনে পড়ে গেল। লোকটা ট্রেনিংয়ের সময় বলেছিল ফিল্ডে কাজ করার সময় নিজের শারীরিক শক্তি, বুদ্ধি, নিজের ইমোশন সবকিছুকে অনেকটা তরল স্রোতের মতো প্রবাহিত হতে দেওয়া উচিত। যে যত ভালোভাবে এই স্রোতটাকে প্রবাহিত হতে দিতে পারে এবং সঠিক নির্দেশনায় প্রবাহিত হতে দিতে পারে সে তত ভালো এজেন্ট হতে পারে। শারিয়ারের মনে হলো ও এতক্ষণ পর্যন্ত নিজের বুদ্ধি-শক্তি সবকিছুকে বাদ দিয়ে স্রেফ নিজের ইগো দিয়ে সব বোঝার চেষ্টা করছিল। এখন সময় এসেছে কাজে নামার এবং সময় এসেছে সত্যিকারের অ্যানালিটিক্যাল স্কিলকে কাজে লাগিয়ে মাঠে নামার। ‘ঠিক আছে, যাহা ভবিতব্য তাহাই কর্তব্য,’ আনমনেই বলে উঠল ও।

টেবিলের ওপরে রাখা সমস্ত কেস ফাইলগুলোকে নিয়ে এলো ও মেঝের ওপরে। তারপর সবগুলোকে ফাইল আর ফোল্ডারের ভেতর থেকে বের করে একে একে ক্রমান্বয় অনুসারে সারি দিয়ে সাজাল সেগুলোকে। তারপর একটা সিগারেট ধরিয়ে ওগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। সিগারেটটা শেষ করে ওটাকে অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিয়ে প্রথম কাগজের গুচ্ছটা টেনে নিল ও নিজের দিকে। একে একে পড়ে যেতে লাগল ফাইলগুলো। সেই সঙ্গে নোট নেওয়া চলল নিজের ডিউটি প্যাডে।

পরবর্তী দুঘণ্টা সে ডুবে রইল ফাইলের ভেতরে। সব ফাইল একে একে পড়ে, সেই সঙ্গে সব নোট মিলিয়ে, গতরাতের টুকরো টুকরো অভিজ্ঞতাগুলোকে একসঙ্গে করে এখন পর্যন্ত এলোমেলো কেসটার একটা চেহারা দাড় করানোর চেষ্টা করল ও। নির্দিষ্ট পয়েন্টগুলো নোট করে নিয়ে খানিকটা স্বস্তির সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। এবার কেসটা একটা চেহারা পেতে শুরু করেছে ওর কাছে। আর তানভীর যা বলেছিল সেটা পুরোপুরি ঠিক না হলেও কেসটাকে নির্দিষ্ট একটা দিকে ধাবিত করার মতো উপকরণ জড়ো করতে পেরেছে সে গত দু-ঘণ্টার চেষ্টায়।

খুশি মনে মেঝে থেকে কাগজগুলো তুলে নিয়ে টেবিলে সাজিয়ে রাখল। অফিস থেকে দেওয়া ফাস্ট প্যাকটা থেকে নতুন এক সেট কাপড় বের করে এনে বিছানার ওপরে রেখে বাথরুম গিয়ে শেভ-গোসল সেরে ফিরে এসে কড়কড়ে নতুন পোশাক পরে নিল ও। টাইটেনিয়ামের বুটের সঙ্গে ম্যাচ করা গ্যাবার্ডিন প্যান্ট। তার ওপরে গায়ে প্রথমে চড়াল বুলেট প্রুফ ভেস্টটা। তার ওপরে কালো শার্ট, কালো শার্টের ওপরে হোলস্টরটা পরলেও পিস্তল আর বুলেটগুলো বের করে রেখে দিল টেবিলের ওপরে।

পিস্তলটা তুলে নিয়ে এই প্রথমবারের মতো ভালোভাবে পরখ করল সে। জিনিসটার ডিজাইন পুরনো আমলের হলেও একেবারে আধুনিক একটা ভার্সন। পিস্তলটার বাঁট কিং কোবরার মতোই। কালো রঙের বাঁটে একটা গোখরা সাপের মাথা খোদাই করা। জিনিসটা দেখে ছোটোবেলায় টিভিতে দেখা ওর প্রিয় অ্যাকশন স্টার সিলভেস্টার স্ট্যালোনের কোবরা সিনেমার কথা মনে পড়ে গেল। লাইট ওয়েট কার্বনের তৈরি বডিটা একেবারে চকচকে। পুথু দিয়ে জিনিসটা পরিষ্কার করে বুলেট ভরে নিল ও। তারপর ওটার সঙ্গে মেশিনপার্ট আর লেজার অ্যাটাচ করে রেখে দিল হোলস্টারে। যে কেউ চাইলে ওটাকে দিয়ে সিঙ্গেল শটও চালাতে পারবে কিংবা কনভার্ট করে মেশিনের মতোও চালাতে পারবে। পিস্তলটা হোলস্টারে রেখে কালো শার্টের ওপরে কালো ব্লেজার পরে নিল ও। হাতে ঘড়ি চাপিয়ে চুল ব্যাকব্রাশ করে ঠোঁটের দুপাশ দিয়ে নেমে আসা চোখা গোঁফে হাত বোলাল একবার। ফাস্ট প্যাক থেকে ছোটো ছুরিটা বের করে পকেটে রেখে দিল ও।

নিজেকে আয়নায় দেখে নিয়ে খুশি হয়ে উঠল। আবারও গোঁফে হাত বোলাতে বোলাতে মনে মনে ভাবল, এবার ও মাঠে নামার জন্যে সম্পূর্ণ প্রস্তুত।

সকল অধ্যায়

১. মগরাজ – পূর্বকথা
২. মগরাজ – ১
৩. মগরাজ – ২
৪. মগরাজ – ৩
৫. মগরাজ – ৪
৬. মগরাজ – ৫
৭. মগরাজ – ৬
৮. মগরাজ – ৭
৯. মগরাজ – ৮
১০. মগরাজ – ৯
১১. মগরাজ – ১০
১২. মগরাজ – ১১
১৩. মগরাজ – ১২
১৪. মগরাজ – ১৩
১৫. মগরাজ – ১৪
১৬. মগরাজ – ১৫
১৭. মগরাজ – ১৬
১৮. মগরাজ – ১৭
১৯. মগরাজ – ১৮
২০. মগরাজ – ১৯
২১. মগরাজ – ২০
২২. মগরাজ – ২১
২৩. মগরাজ – ২২
২৪. মগরাজ – ২৩
২৫. মগরাজ – ২৪
২৬. মগরাজ – ২৫
২৭. মগরাজ – ২৬
২৮. মগরাজ – ২৭
২৯. মগরাজ – ২৮
৩০. মগরাজ – ২৯
৩১. মগরাজ – ৩০
৩২. মগরাজ – ৩১
৩৩. মগরাজ – ৩২
৩৪. মগরাজ – ৩৩
৩৫. মগরাজ – ৩৪
৩৬. মগরাজ – ৩৫
৩৭. মগরাজ – ৩৬
৩৮. মগরাজ – ৩৭
৩৯. মগরাজ – ৩৮
৪০. মগরাজ – ৩৯
৪১. মগরাজ – ৪০
৪২. মগরাজ – ৪১
৪৩. মগরাজ – ৪২
৪৪. মগরাজ – ৪৩
৪৫. মগরাজ – ৪৪
৪৬. মগরাজ – ৪৫
৪৭. মগরাজ – শেষ কথা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন