০৯. মানুষের চরিত্র

হুমায়ূন আহমেদ

মানুষের চরিত্রের একটা অংশ উদ্ভিদের মত।

উদ্ভিদ যেমন মাটিতে শিকড় ছেড়ে দেয়, মানুষও তাই করে। কিছু দিন কোথাও থাকা মানে সেখানে শিকড় বসিয়ে দেয়া। মাটি যদি চেনা হয়। আর নরম হয় তাহলেতো কথাই নেই।

দশদিন মার কাছে ছিলাম। এই দশদিনে শিকড় গজিয়ে গেল। সেখান থেকে উঠে আসা মানে শিকড় ছেড়ে উঠে আসা। কি তীব্ৰ কষ্ট। পুরুষরা এই কষ্টের স্বরূপ জানে না। এই কষ্ট আরো অনেক কষ্টের মত একান্তই মেয়েদের কষ্ট।

আমি এসেছি। একা। অস্তুর আমাকে নিয়ে আসার কথা ছিল। সে হঠাৎ জ্বরে পড়ায় তাকে রেখে এসেছি। বাবা তার একজন চেনা লোককে বলে দিয়েছিলেন। তিনিও ঢাকায় আসছেন। তাঁর উপর দায়িত্ব আমার দিকে লক্ষ্য রাখা। ভদ্রলোক শুধু যে লক্ষ্য রাখলেন। তাই না। একেবারে আমাদের বাসার দরজায় নামিয়ে দিলেন। আমি বললাম, চাচা আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। এখন আপনি চলে যান।

উনি বললেন, মা তুমি দরজা খুলে ভেতরে ঢোক তারপর যাব। কড়া নাড়তেই নোমান এসে দরজা খুলে দিল। সে অপ্ৰসন্ন মুখে ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে রইল।

আমি ভদ্রতা করে বললাম, আপনি কি ভেতরে এসে বসবেন? চা খেয়ে যাবেন?

তিনি বললেন, না। আমি পরশুদিন নেত্রকোেনা চলে যাব। তোমার বাবাকে বলব তুমি ঠিক মত পৌঁছেছ।

জ্বি আচ্ছা।

নোমান আমার সুটকেস, ব্যাগ ভেতরে এনে রাখছে। তার মুখ এমন অন্ধকার হয়ে আছে কেন কিছু বুঝতে পারছি না। আমি বললাম, তুমি ভাল ছিলে?

সে বলল, হ্যাঁ।

সাত দিনের জায়গায় দশদিন থেকে এলাম। রাগ করানিতো? তারা কিছুতেই ছাড়বে না। অতিথিপুর থেকে আমার ছোটখালা এসেছিলেন উনি আবার একদিনের জন্যে অতিথপুর নিয়ে গেলেন।

মদিনা। মদিনাকে আনলে না?

ও আসল না। ওর না-কি এখানে থাকতে ভাল লাগে না।

ভাল লাগালাগির কি আছে? থাকবে বেতন পাবে।

তুমি এমন রেগে আছ কেন?

রেগে আছি কোথায়?

চোখ মুখ শক্ত করে আছ। জুর-টির নাতো— দেখি কাছে আসতো?

ও কাছে এল না। ভুরু কুচকে তাকিয়ে রইল। আমি বললাম, চা খেতে ইচ্ছা! হচ্ছে। চুলার কাছে যেতে ভাল লাগছে না। ফ্লাস্কে করে একটু চা এনে দেবে?

সে কিছু না বলে ফ্লাঙ্ক হাতে বের হয়ে গেল। আমার কাছে সব কেমন যেন অন্য রকম মনে হতে লাগল। ঘরের সাজ-সজ্জাও পাল্টানো। খাটটা জানালার কাছ থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। জানালার কাছে এখন দুটা বেতের চেয়ার।

ড্রেসিং টেবিলটার জন্যে ঢাকনি বানানো হয়েছে। কোন জানালার আগে পর্দা ছিল না। পর্দার প্রয়োজনও ছিল না। বাইরে থেকে কিছু দেখা যেত না। এখন দেখি সব কয়টা জানালায় বেগুনি রঙের পর্দা। এমন কি বাথরুমের জানালায় পর্দা ঝুলছে।

সবচে যেটা আশ্চর্যের ব্যাপার মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে। ও ফ্যান কিনেছে। শুধু ফ্যান না ওয়ার্ড ড্রোবের উপর একটা ক্যাসেট প্লেয়ার।

নোমান চা নিয়ে ফিরে এলো। চায়ের সঙ্গে গরম জিলিপী। আমি দেখলাম তার মুখের কঠিন ভাবটা আর নেই। সে চায়ের কাপে চা ঢালতে ঢালতে বলল, আগে চা খাও। চা খেয়ে তারপর জিলাপী খ্যাও। আগে জিলাপী খেলে চায়ের স্বাদ পাবে না। তোমার স্বাস্থ্য ভাল হয়েছে। নবনী। বাপের বাড়িতে খুব আরামে ছিলে, তাই না?

হুঁ। তুমি কি কষ্টে ছিলে?

কষ্ট মানে–দোজখের ভেতর ছিলাম। সফিক আর অহনার মধ্যে এমন ঝামেলা বেঁধে গেল। স্যুটিং ফুটিং কিছুই হয় নাই।

তুমি মিটমাটের চেষ্টা চালাচ্ছ না?

চালাচ্ছি। কাজ হবে কি-না বুঝতে পারছি না। সফিক এখন আমাকেও ঠিক বিশ্বাস করে না। অবশ্যি বিশ্বাস না করার কারণ আছে। অহনা করল কি সফিকের সঙ্গে ঝগড়া করে রাত দুপুরে আমার এখানে এসে উপস্থিত। আমার বাসায় না-কি লুকিয়ে থাকবে। লুকিয়ে থাকার জন্যে এইটাই না-কি আদর্শ জায়গা। সফিক সব জায়গায় খুঁজবে এইখানে খুঁজবে না।

তুমি রাজি হলে?

রাজি না হয়ে উপায় আছে? আহনাকে তুমি এখনো চিনলে না।

কদিন ছিল?

দু রাত ছিল। দু রাতের জন্যে পর্দা দিতে হয়েছে। ফ্যান লাগাতে হয়েছে। রাতে গান না শুনলে তার ঘুম আসে না। শেষে একটা ক্যাসেট প্লেয়ার কিনে আনতে হল। অহনা টাকা দিল। এতটুকু একটা জিনিস দাম নিয়েছে ন হাজার টাকা। গান শুনবে নবনী?

শুনব।

নোমান খুশি মনে ক্যাসেট চালু করে দিল। নিচু গলায় গান হতে লাগল—

আমি কেবলই স্বপন
করেছি বপন বাতাসে
তাই আকাশ কুসুম
করিনু চয়ন হতাশে।।

নবনী!

কি?

অহনার সঙ্গে থেকে থেকে আমারো বিশ্ৰী অভ্যাস হয়ে গেছে। রাতে গান না শুনলে ঘুম আসে না। এসব বড়লোকী অভ্যাস কি আর আমাদের মত গরিবের পোষায়?

অহনা যে তোমার এখানে ছিলেন সফিক সাহেব টের পান নি?

পাগল কোত্থেকে টের পাবে? সফিক চলে পাতায় পাতায় অহনা চলে শীরায় শীরায়। তবে দু রাত ছিল বলে রক্ষা। এরচে বেশি থাকলে ধরা পড়ে যেত। থার্ড নাইটে রাত একটার সময় সফিক এসে উপস্থিত। অহনার একটা খোঁজ না-কি পাওয়া গেছে আমাকে নিয়ে যাবে। আমি মনে মনে বলি আল্লাহ রক্ষা করেছে।

এখন উনি কোথায় আছেন?

জানি না কোথায়। আমি জানি না, সফিকও জানে না। তবে সফিকের বোধহয় ধারণা হয়েছে আমি জানি তার কাছে লুকাচ্ছি।

রাতের খাবার জন্যে ভাত রাঁধতে বসেছি নোমান পাশে এসে বসল। নরম গলায় বলল, জানি করে এসেছ এখন চুলার কাছে বসতে হবে না। চল বাইরে কোথাও যাই খেয়ে আসি। চাইনিজ খাবার আমার অসহ্য লাগে– তবু চল যাই।

আমরা বাইরে খেতে গেলাম। ও খাবারের মেনু অনেকক্ষণ চোখের সামনে ধরে রেখে বলল, শালার দাম কি রেখেছে। খেয়ে না খেয়ে দাম। একবাটি সুপ তার দাম একশ কুড়ি টাকা। পানি ছাড়া এর মধ্যে আর কি আছে। নবনী চল এক কাজ করি এক বাটি সুদৃপ খেয়ে চলে যাই। টাকা পয়সা এখন খুব সাবধানে খরচ করতে হবে। আমার ধারণা সফিক আমার চাকরি নট করে দেবে। গেট আউট করে দেবে।

নোমান চিন্তিত মুখে সু্যুপ খাচ্ছে। আমার খুব মায়া লাগছে। আহা বেচারা। শুধু স্যুপে কি তার পেট ভরবে?

নবনী!

কি?

অচেনা একটা লোককে নিয়ে বাসায় এসেছিলে রাগে আমার গা জ্বলে গেছে। ঐ দিন অফিসে এক লোক এসে উপস্থিত। তোমাদের ওদিকে বাড়ি। তোমাদের সবাইকে চেনে। আমি যত্ন করে বসায়েছি—চা খাইয়েছি তারপর ব্যাটা বলে কি নবনীর প্রথম পক্ষের সন্তানটি কি আপনার সঙ্গে থাকে?

তুমি কি বললে?

আমিতো। হতভম্ব। সফিক আমার সঙ্গে ছিল সে বলল, হ্যাঁ ওর সঙ্গেই থাকে। কেন দেখা করতে চান? শুধু যে এই একজন তা না। আগেও আরেকজন এসেছে আমাকে পায় নাই অফিসের লোকজনের সঙ্গে গল্প করে গেছে বিশ্ৰী সব কথাবার্তা।

আমি চুপ করে আছি। নোমান বলল, স্যুপ খেয়ে ক্ষিধে আরো বেড়ে গেল। একি যন্ত্রণা বল দেখি। একটা ফ্রায়েড চিকেন নিয়ে নিই?

না।

নবনী তুমি আগের চেয়ে আরো সুন্দর হয়েছ। এত সুন্দরী বৌ পাশে নিয়ে হাঁটাহাটি করতে অস্বস্তি লাগে। লোকে এমন ভাবে তাকাচ্ছে যেন আমি তোমাদের বাড়ির দারোয়ান। তুমি বাইরে বেরুবার সময় সাজগোজ একেবারেই করবে না।

আচ্ছা যাও করব না।

এত ভাল লাগছে তোমাকে দেখে।

আমি বললাম, আমাকে দেখে এত ভাল লাগছে তাহলে আজ আমাকে দেখে মুখটা এমন কাল করে ফেলেছিলে কেন?

মন মেজাজ অসম্ভব খারাপ। সফিক চাকরি থেকে ছাড়িয়ে দিলে খাব কি? একা থাকলে অসুবিধা ছিল না। এখন আমরা দুজন।

আমি চাপা গলায় বললাম, বাড়তেও পারে। কিছুদিন পর হয়ত দেখা যাবে তিনজন।

নোমান বলল, হ্যাঁ তাতো হবেই। চাকরি চলে গেলেতো ভিক্ষা করা ছাড়া উপায় থাকবে না।

ভিক্ষা করতে হলে করব। এই দেশে ভিক্ষা করা এমন অন্যায় কিছু না। সবাই ভিক্ষা করছে। আমরাও না হয় করব। তুমি এখন আরাম করে খাওতো। শুধু শুধু চিকেন খাবে কি করে কিছু ভাত নাও।

নোমান হাসি মুখে বলল, যা থাকে কপালে চল খাই। খাওয়া দাওয়ার পর আইসক্রিীম খাব। আইসক্রীম খেতে ইচ্ছা করছে। যাহা বাহান্ন তাহা তিপ্তান্ন খরচ হচ্ছে যখন হোক।

 

রাতে দুজন ঘুমাতে গেছি। নোমান গান দিয়ে দিয়েছে। আমি বললাম, গান থাক। এসো তোমাকে দারুন আরেকটা খবর দেই।

কি খবর?

দিচ্ছি। এত তাড়া কিসের? তুমি আগে আমাকে একটু আদর কর। তারপর খবর শুনবে। আচ্ছা আমি যে কিছুদিন পাগল ছিলাম তা-কি তুমি জান?

জানব না কেন। জানি।

কে বলেছে?

অহনা বলেছে।

উনি কি ভাবে জানেন?

অহনা সব জানে। তোমার সঙ্গে যখন বিয়ে ঠিক হল তখনি সব খোঁজ খবর করেছে। তারপর বলেছে— মেয়েটা বেশ কিছুদিন মাথা খারাপ অবস্থায় ছিল। এখন সুস্থ, তুমি বিয়ে করতে পার, ভাল মেয়ে। বেশ ভাল।

আমি কঠিন গলায় বললাম, তিনি অনুমতি দিলেন। তারপর তুমি বিয়ে করলে?

নোমান জবাব দিল না। আমি ওর গায়ে হাত দিয়ে দেখি সে ঘুমিয়ে পড়েছে। তৃপ্তির ঘুম।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন