চোখের বালি ১০

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

১০
বিহারী নিজে বসিয়া মহেন্দ্রকে দিয়া চিঠি লিখাইয়া লইল এবং সে চিঠি লইয়া পরদিনই রাজলক্ষ্মীকে আনিতে গেল। রাজলক্ষ্মী বুঝিলেন, এ চিঠি বিহারীই লিখাইয়াছে–কিন্তু তবু আর থাকিতে পারিলেন না। সঙ্গে বিনোদিনী আসিল।
গৃহিণী ফিরিয়া আসিয়া গৃহের যেরূপ দুরবস্থা দেখিলেন–সমস্ত অমার্জিত, মলিন, বিপর্যস্ত–তাহাতে বধূর প্রতি তাঁহার মন আরো যেন বক্র হইয়া উঠিল।
কিন্তু বধূর এ কী পরিবর্তন। সে যে ছায়ার মতো তাঁহার অনুসরণ করে। আদেশ না পাইলেও তাঁহার কর্মে সহায়তা করিতে অগ্রসর হয়। তিনি শশব্যস্ত হইয়া বলিয়া উঠেন, “রাখো, রাখো, ও তুমি নষ্ট করিয়া ফেলিবে। জান না যে-কাজ সে-কাজে কেন হাত দেওয়া।”
রাজলক্ষ্মী স্থির করিলেন, অন্নপূর্ণা চলিয়া যাওয়াতেই বধূর এত উন্নতি হইয়াছে। কিন্তু তিনি ভাবিলেন, “মহেন্দ্র মনে করিবে, খুড়ি যখন ছিল, তখন বধূকে লইয়া আমি বেশ নিষ্কণ্টকে সুখে ছিলাম–আর মা আসিতেই আমার বিরহদুঃখ আরম্ভ হইল। ইহাতে অন্নপূর্ণা যে তাহার হিতৈষী এবং মা যে তাহার সুখের অন্তরায়, ইহাই প্রমাণ হইবে। কাজ কী।”
আজকাল দিনের বেলা মহেন্দ্র ডাকিয়া পাঠাইলে, বধূ যাইতে ইতস্তত করিত–কিন্তু রাজলক্ষ্মী ভর্ৎসনা করিয়া বলিতেন, “মহিন ডাকিতেছে, সে বুঝি আর কানে তুলিতে নাই। বেশি আদর পাইলে শেষকালে এমনই ঘটিয়া থাকে। যাও, তোমার আর তরকারিতে হাত দিতে হইবে না।”
আবার সেই স্লেট-পেনসিল চারুপাঠ লইয়া মিথ্যা খেলা। ভালোবাসার অমূলক অভিযোগ লইয়া পরস্পরকে অপরাধী করা। উভয়ের মধ্যে কাহার প্রেমের ওজন বেশি, তাহা লইয়া বিনা-যুক্তিমূলে তুমুল তর্কবিতর্ক। বর্ষার দিনকে রাত্রি করা এবং জ্যোংস্না রাত্রিকে দিন করিয়া তোলা। শ্রান্তি এবং অবসাদকে গায়ের জোরে দূর করিয়া দেওয়া। পরস্পরকে এমনি করিয়া অভ্যাস করা যে, সঙ্গ যখন অসাড় চিত্তে আনন্দ দিতেছে না তখনো ক্ষণকালের জন্য মিলনপাশ হইতে মুক্তি ভয়াবহ মনে হয়–সম্ভোগসুখ ভসমাচ্ছন্ন, অথচ কর্মান্তরে যাইতেও পা ওঠে না। ভোগসুখের এই ভয়ংকর অভিশাপ যে, সুখ অধিক দিন থাকে না, কিন্তু বন্ধন দুশ্ছেদ্য হইয়া উঠে।
এমন সময় বিনোদিনী একদিন আসিয়া আশার গলা জড়াইয়া ধরিয়া কহিল, “ভাই, তোমার সৌভাগ্য চিরকাল অক্ষয় হোক, কিন্তু আমি দুঃখিনী বলিয়া কি আমার দিকে একবার তাকাইতে নাই।”
আত্মীয়গৃহে বাল্যকাল হইতে পরের মতো লালিত হইয়াছিল বলিয়া, লোকসাধারণের নিকট আশার একপ্রকার আন্তরিক কুণ্ঠিতভাব ছিল। ভয় হইত, পাছে কেহ প্রত্যাখ্যান করে। বিনোদিনী যখন তাহার জোড়া ভুরু ও তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, তাহার নিখুঁত মুখ ও নিটোল যৌবন লইয়া উপস্থিত লইল, তখন আশা অগ্রসর হইয়া তাহার পরিচয় লইতে সাহস করিল না।
আশা দেখিল, শাশুড়ি রাজলক্ষ্মীর নিকট বিনোদিনীর কোনোপ্রকার সংকোচ নাই। রাজলক্ষ্মীও যেন আশাকে বিশেষ করিয়া দেখাইয়া দেখাইয়া বিনোদিনীকে বহুমান দিতেছেন, সময়ে-অসময়ে আশাকে বিশেষ করিয়া শুনাইয়া শুনাইয়া বিনোদিনীর প্রশংসাবাক্যে উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিতেছেন। আশা দেখিল, বিনোদিনী সর্বপ্রকার গৃহকর্মে সুনিপুণ–প্রভুত্ব যেন তাহার পক্ষে নিতান্ত সহজ স্বভাবসিদ্ধ–দাসদাসীদিগকে কর্মে নিয়োগ করিতে, ভর্ৎসনা করিতে ও আদেশ করিতে সে লেশমাত্র কুণ্ঠিত নহে। এই সমস্ত দেখিয়া আশা বিনোদিনীর কাছে নিজেকে নিতান্ত ক্ষুদ্র মনে করিল।
সেই সর্বগুণশালিনী বিনোদিনী যখন অগ্রসর হইয়া আশার প্রণয় প্রার্থনা করিল, তখন সংকোচের বাধায় ঠেকিয়াই বালিকার আনন্দ আরো চার গুণ উছলিয়া পড়িল। জাদুকরের মায়াতরুর মতো তাহাদের প্রণয়বীজ একদিনেই অঙ্কুরিত পল্লবিত ও পুষ্পিত হইয়া উঠিল।
আশা কহিল, “এসো ভাই, তোমার সঙ্গে একটা কিছু পাতাই।”
বিনোদিনী হাসিয়া কহিল, “কী পাতাইবে।”
আশা গঙ্গাজল বকুলফুল প্রভৃতি অনেকগুলি ভালো ভালো জিনিসের নাম করিল।
বিনোদিনী কহিল, “ও-সব পুরানো হইয়া গেছে; আদরের নামের আর আদর নাই।”
আশা কহিল, “তোমার কোন্‌টা পছন্দ।”
বিনোদিনী হাসিয়া কহিল, “চোখের বালি।”
শ্রুতিমধুর নামের দিকেই আশার ঝোঁক ছিল, কিন্তু বিনোদিনীর পরামর্শে আদরের গালিটিই গ্রহণ করিল। বিনোদিনীর গলা ধরিয়া বলিল, “চোখের বালি।” বলিয়া হাসিয়া লুটাইয়া পড়িল।

সকল অধ্যায়

১. চোখের বালি ৩৮
২. চোখের বালি ৪০
৩. চোখের বালি ৪১
৪. চোখের বালি ৪২
৫. চোখের বালি ৪৩
৬. চোখের বালি ৪৪
৭. চোখের বালি ৪৫
৮. চোখের বালি ৪৬
৯. চোখের বালি ৪৭
১০. চোখের বালি ৪৮
১১. চোখের বালি ৪৯
১২. চোখের বালি ৫০
১৩. চোখের বালি ৫১
১৪. চোখের বালি ৫২
১৫. চোখের বালি ৫৫
১৬. চোখের বালি ০২
১৭. চোখের বালি ০৩
১৮. চোখের বালি ০৪
১৯. চোখের বালি ০৫
২০. চোখের বালি ০৬
২১. চোখের বালি ০৭
২২. চোখের বালি ০৮
২৩. চোখের বালি ০৯
২৪. চোখের বালি ১০
২৫. চোখের বালি ১১
২৬. চোখের বালি ১২
২৭. চোখের বালি ১৩
২৮. চোখের বালি ১৪
২৯. চোখের বালি ১৫
৩০. চোখের বালি ১৬
৩১. চোখের বালি ১৭
৩২. চোখের বালি ১৮
৩৩. চোখের বালি ১৯
৩৪. চোখের বালি ২০
৩৫. চোখের বালি ২১
৩৬. চোখের বালি ২২
৩৭. চোখের বালি ২৩
৩৮. চোখের বালি ২৪
৩৯. চোখের বালি ২৫
৪০. চোখের বালি ২৬
৪১. চোখের বালি ২৭
৪২. চোখের বালি ২৮
৪৩. চোখের বালি ২৯
৪৪. চোখের বালি ৩০
৪৫. চোখের বালি ৩১
৪৬. চোখের বালি ৩২
৪৭. চোখের বালি ৩৩
৪৮. চোখের বালি ৩৫
৪৯. চোখের বালি ৩৬
৫০. চোখের বালি ৩৭
৫১. চোখের বালি ৩৯

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন