পিশাচ কারখানা – সৈকত মুখোপাধ্যায়

সৈকত মুখোপাধ্যায়

পিশাচ কারখানা

এক

এমনিতে আমার গোপীমঠে ছুটি কাটাতে যাওয়ার কোনো কারণ ছিল না। একবছর আগেও যে জায়গার নাম-ই শুনিনি, সেখানে যাওয়ার ইচ্ছে হবেই বা কেন? কিন্তু টিটোর জন্যেই ওখানে যেতে হল।

টিটো হচ্ছে আমার এক্কেবারে সেই ছোটবেলার বন্ধু। ক্লাস-ওয়ান থেকে ওর সঙ্গে এক স্কুলে পড়াশোনা করেছি—টানা ক্লাস টুয়েলভ পর্যন্ত। তাছাড়া বরাহনগরে একই পাড়ায় আমাদের দুজনের বাড়ি।

ওর ওপরের পাটির সামনের যে-দাঁতটা আধখানা ভাঙা, সেটা আমাদের তিনতলার সিঁড়ি থেকে আছাড় খেয়েই ভেঙেছিল। তখন বোধহয় আমরা ক্লাস ফাইভে পড়ি। টিটো একদিন মাথার ওপরে একটা খোলা-ছাতা উঁচু করে ধরে, সিঁড়ির চাতাল থেকে নীচের দিকে পেল্লায় লাফ মেরে বসল। আমি তার আগে অনেকবার ওকে বোঝাবার চেষ্টা করেছিলাম, ‘শোন টিটো, ছাতা কখনো প্যারাশুটের কাজ করতে পারে না। যদি করত তাহলে আর এয়ারফোর্সের লোকেরা এত খরচা করে প্যারাশুট বানাত না।’ কিন্তু যতক্ষণ না ঠোঁট কেটে, দাঁত ভেঙে রক্তারক্তি হল, ততক্ষণ বোকাটা কিছুতেই সে কথা বিশ্বাস করল না।

এখন অবশ্য গোপীমঠ থানার ও.সি. তীর্থঙ্কর মিত্রকে বোকা-টোকা বললে পুলিশই আমাকে লাঠি নিয়ে তাড়া করবে। আমি সেসব কথা বলছিও না কাউকে। কিন্তু সত্যি কথাটা হচ্ছে, তীর্থঙ্কর অর্থাৎ টিটোই এখন মেদিনীপুর-উড়িষ্যার বর্ডারে এই গোপীমঠ থানার অফিসার-ইন-চার্জ, আর গতবছরে এখানে ট্রান্সফার হয়ে আসার পর থেকেই ও আমাকে ফোনে জ্বালিয়ে মারছে—‘চলে আয় নীল। ক’টা দিন ঘুরে যা। দেখবি, চারদিকে কি চমৎকার সিন-সিনারি। তুই ছবি তুলে শেষ করতে পারবি না।’

সেই প্রথম গোপীমঠের নাম শুনলাম।

নীল চ্যাটার্জিকে অবশ্য কেবলমাত্র সিন-সিনারির লোভ দেখিয়ে সুবিধে হতো না। কারণ, একজন ওয়াইল্ড-লাইফ ফোটোগ্রাফার হিসেবে বছরের মধ্যে আটমাস তাকে স্বর্গের মতন সব বন-জঙ্গল, পাহাড় আর নদীর তীরেই ঘুরে বেড়াতে হয়। তবু যে গোপীমঠে চলে এলাম তার কারণ ওই ছোটবেলার বন্ধুর ডাক। বনের ডাকের থেকে আমার কাছে সেটা কিছু কম জোরালো নয়। সত্যিই তো, বেচারা টিটো একা-একা এই পাণ্ডববর্জিত জায়গায় দিনের পর দিন পড়ে রয়েছে। আমরা যদি মাঝেমধ্যে ওকে একটু কম্পানি দিয়ে না যাই, সেটা কেমন দেখায়?

অবশ্য গতকাল এখানে পৌঁছিয়ে দেখলাম, জায়গাটা সত্যিই সুন্দর। টিটোর পাঠিয়ে দেওয়া জিপ আমাকে গিধনী স্টেশন থেকে পিক-আপ করে নিয়ে এসেছিল। গোপীমঠের দিকে যতই এগোচ্ছিলাম ততই দুপুর গড়িয়ে পড়ছিল বিকেলের দিকে আর পরিষ্কার করে মোছা শ্লেটের মতন কালো কুচকুচে পিচ-রাস্তার ওপরে লম্বা হচ্ছিল শালগাছের ছায়া। লোধাশুলির জঙ্গল ফুরোতেই হঠাৎ বড় গাছেদের জমায়েত শেষ হয়ে উঁচু-নীচু ঢেউখেলানো জমি শুরু হল। একটা বিরাট লম্বা ব্রিজের ওপর দিয়ে সুবর্ণরেখা নদী পার হতে হতে দেখলাম, ডুবন্ত সূর্যের আলোয় সুবর্ণরেখার বুক দিয়ে জল নয়, গলানো সোনা বয়ে চলেছে। এই বসন্তে নদীর তীরের গাছের নতুন পাতাগুলো ভেলভেটের মতন চকচকে। এখানে-ওখানে পলাশ আর মাদারের গাছে টকটকে লাল ফুল। আর এইসবের মধ্যে নদীর তীরে পাথরের ওপরে শুকোতে দেওয়া আদিবাসী মেয়েদের উজ্জ্বল লাল-নীল-হলদে-সবুজ শাড়িগুলোকেও মনে হচ্ছিল বনের লতাপাতা আর ফুলের মতনই প্রকৃতির কোনো সৃষ্টি।

টিটো যে আমাকে দেখে কি খুশি হল সে আর কী বলব। থানার সামনে জিপ দাঁড়ানো মাত্র ও চেম্বার থেকে বেরিয়ে এসে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরল। তারপর বলল, ‘এখানে আর দাঁড়াতে হবে না। চল, একেবারে আমার কোয়ার্টারেই চল। এই সৌমেন্দু! আমি বাড়ি চললাম। এখন থেকে যে ক’দিন নীল এখানে থাকবে, আমি এরকম ফাঁকিবাজির ডিউটিই করব।’

সৌমেন্দু মাইতি নামে হাসিখুশি কমবয়সি সেকেন্ড-অফিসারটি বস-কে স্যালুট ঠুকে বললেন, ‘সে আর বলতে হবে না স্যার। বন্ধুবান্ধব আমাদেরও আছে। আপনি নিশ্চিন্তে ফাঁকি মারুন।’

থানার ঠিক পেছনদিক থেকেই একটা সরু-রাস্তা সোজা পশ্চিমদিকে চলে গেছে। পায়ে হেঁটে সেই রাস্তা ধরে মিনিট পাঁচেক যেতেই রাস্তাটা একটা ভারি সুন্দর বাগানঘেরা বাংলোবাড়ির সামনে গিয়ে শেষ হয়ে গেল। বাড়িটার চুনকাম করা সাদা ধবধবে দেয়াল, মাথায় লাল টুকটুকে টালির ছাদ, দেয়ালের গায়ে সারসার কাচের জানলা আর পুরো বাংলোটাকে ঘিরে চওড়া বারান্দা। বাগানের কাঠের গেট খুলে টিটো আমাকে ডাকল, ‘আয় নীল! এই আমার কোয়ার্টার।’

বাগান পেরিয়ে, দু-ধাপ সিঁড়ি ভেঙে বারান্দায় উঠলাম। ভাবলাম, ঘরে ঢোকার আগে একটু চারপাশটা দেখে নিই। সামনে আর পাশে গোপীমঠ শহরের টুকরো-টাকরা দৃশ্য দেখতে দেখতে বাংলোর পেছনদিকে পৌঁছিয়েই চমকে উঠলাম। আগে বুঝতে পারিনি, এই বাড়িটাই শহরের শেষ বিন্দু। এর পরেই গভীর খাতের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে সুবর্ণরেখা নদী।

আসার পথে অনেকদূরে যে-নদীকে ফেলে এসেছিলাম, সেই নদীই যে আবার ঘুরে-ফিরে এই গোপীমঠ শহরের পাশে চলে আসবে, ভাবতে পারিনি।

ঘাড় ফিরিয়ে দেখলাম, টিটো মুচকি মুচকি হাসছে। পাজিটা নিশ্চয় এর আগেও অনেককে এইভাবে নদীর কথা কিচ্ছু না বলে চমকে দিয়েছে। আমি একটা বেতের চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে বললাম, ‘টিটো, যে ক’দিন এখানে থাকছি, আমি এই বারান্দা ছেড়ে নড়ছি না। সত্যি রে, অনেক বিখ্যাত জায়গায় ঘুরেছি। কিন্তু গোপীমঠ থানার বড়বাবুর কোয়ার্টারের মতন এত সুন্দর ভিউ-পয়েন্ট আর কোথাও দেখিনি।’

টিটোও আমার পাশে আরেকটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়ল। একটু বাদেই ওর সকল-কাজের-কাজি বাদলদা প্লেটভর্তি মোচার চপ আর সুগন্ধী দার্জিলিং চায়ের কাপ হাতে ধরিয়ে দিয়ে গেল।

চায়ে চুমুক দিতে দিতে দেখছিলাম, নদীর ওপাশেই হাতিবাড়ির গভীর জঙ্গল। জঙ্গলটাকে এত দূর থেকে বর্ষার মেঘের মতন দেখাচ্ছিল। টিটো বলল, ‘বুঝলি নীল, মাঝে মাঝে এই বন্ধুহীন শহরে খুব একা লাগে ঠিকই। কিন্তু যখন বউবাজার থানার গত তিন বছরের পোস্টিং-এর কথা মনে পড়ে, ওখানকার প্রতিদিনের মারপিট আর খুনজখমের কথা মনে পড়ে, তখন মনে হয় এই বেশ আছি। গোপীমঠ খুব শান্ত জায়গা। একটা বৈষ্ণব ট্র্যাডিশন আছে তো। এখানকার মানুষগুলো স্বভাবেই তাই শান্তিপ্রিয়। পুলিশের কাজ নেই বললেই চলে।’

আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম, ‘বৈষ্ণব ট্র্যাডিশনটা কীরকম?’

টিটো বলল, ‘গোপীমঠ নামটা শুনে আন্দাজ করতে পারছিস না? এখানে গোপীনাথ, মানে শ্রীকৃষ্ণের, বিশাল মন্দির আর আশ্রম রয়েছে।’

আমার বেশ অবাক লাগল। বললাম, ‘এই অখ্যাত জায়গায় বিশাল মন্দির!’

টিটো বলল, ‘আজকে অখ্যাত। কিন্তু যখন মানুষ পায়ে হেঁটে পুরীতে তীর্থ করতে যেত, তখন সেই রুটের ওপরে সবচেয়ে বড় গ্রাম ছিল এই গোপীমঠ। তখন অবশ্য জায়গাটার অন্য কী যেন একটা নাম ছিল। সে যাই হোক, পুরীর তীর্থযাত্রীরা অনেকেই যাতায়াতের পথে একটা করে রাত এখানে কাটাতেন। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন নদীয়ার বিশ্বম্ভর মিশ্রের ছেলে নিমাই।’

বললাম, ‘তাই নাকি?’

‘ইয়াপ বাডি। চৈতন্য মহাপ্রভু বেশ কয়েকবার এই গোপীমঠে পায়ের ধুলো দিয়েছেন; এখানকার এক সরাইখানায় রাত কাটিয়েছেন। আর যেখানে সেই সরাইখানা ছিল, সেই জায়গাতেই আঠেরোশো-পঞ্চাশ সালে মন্দির বানিয়ে দিয়েছিলেন এই অঞ্চলের তৎকালীন জমিদার রাধাগোবিন্দ পট্টনায়ক। তার মানে, মন্দিরের বয়সও হয়ে গেল দেড়শো বছরের ওপর।

‘ওই মন্দিরে সোনার তৈরি রাধাকৃষ্ণের মূর্তি ছাড়াও আরও একটা জিনিস রয়েছে। সেটাও অমূল্য। সেটাও জমিদার রাধাগোবিন্দ পট্টনায়কেরই দান।’

জিগ্যেস করলাম, ‘সেটা কী?’

টিটো উত্তর দিল, ‘চিন্তামণি।’

‘মানে, সেই যে খায় চিনি তাকে জোগায় চিন্তামণি, ওইরকমের কোনো কেস?’

‘অনেকটা সেইরকমই বটে। ইংরিজিতে যাকে বলে ফিলজফার্স স্টোন—হাতের মুঠোয় ধরে যা চাইবি তাই পাবি।’

বললাম, ‘অনেকটা গুপি বাঘার হাততালির মতন শোনাচ্ছে।’

‘ইয়ার্কি মারিস না। মোহন্তজি একদিন অনেকক্ষণ ধরে আমাকে চিন্তামণির ইতিহাস শুনিয়েছিলেন। চিন্তামণির গল্পের শুরুটা নাকি তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মে। ফিফথ সেঞ্চুরিতে দক্ষিণ তিব্বতের রাজা লা-টোরি-নিয়ানতসেনের রাজপ্রাসাদের ছাদে আকাশ থেকে একটা সোনার সিন্দুক খসে পড়েছিল। তার মধ্যে বৌদ্ধধর্মের পুঁথি ছিল। স্বয়ং বুদ্ধদেবের ব্যবহৃত ভিক্ষাপাত্র ছিল, সেই ভিক্ষাপাত্র আবার নিজেই সুন্দর সুরে বুদ্ধের বন্দনাগান গায়। আর ছিল এই চিন্তামণি।

‘এদিকে আবার দশম-শতাব্দীতে লেখা হিন্দু ধর্মশাস্ত্র যোগবাশিষ্ঠতেও চিন্তামণির কথা রয়েছে। সেখানে ন্যাচারালি সে মণির সঙ্গে বুদ্ধদেবের কোনো সম্পর্ক নেই। যোগবাশিষ্ঠতে ওই মণির মালিক বিষ্ণু। তিনি সমুদ্রের নাগরাজার কপাল থেকে মণি কেড়ে নিয়ে এসেছিলেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্রেও চিন্তামণিকে বলা হয়েছে সমুদ্রের ড্রাগন রাজার সম্পত্তি। অদ্ভুত মিল না?

‘আরও মিল আছে। দুই শাস্ত্রেই চিন্তামণিকে বলা হয়েছে অসাধারণ এক রত্ন। ওই পাথরের কাছে জ্ঞান, সম্পদ, রোগের আরোগ্য—যা চাইবি তাই পাবি। কিন্তু হ্যাঁ, সবাই ওই পাথর ধরে রাখতে পারে না। খারাপ লোকের হাতের ছোঁয়া লাগলে চিন্তামণি স্রেফ হাওয়ায় উবে যায়। বহু বছর বাদে আবার সে যাকে যোগ্য মনে করে, তার হাতে ফিরে আসে।’

খালি চায়ের কাপটা টেবিলে নামিয়ে রেখে বললাম, ‘ভালো গল্প। তুই দেখেছিস সেই চিন্তামণি?’

টিটো বলল, ‘একবারই মাত্র দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। কোনো রত্ন যে এত বিশাল আর এত সুন্দর হতে পারে তা আমার জানা ছিল না।’

‘ওটা কি মুক্তো?’

টিটো অবাক-দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। বলল, ‘কেমন করে বুঝলি?’

বললাম, ‘ওই সমুদ্রের সঙ্গে যোগাযোগের কথাটা শুনে মনে হল।’

টিটো বলল, ‘বুদ্ধিটা তোর বরাবরই শার্প। হ্যাঁ, চিন্তামণি আসলে একটা মুক্তো। এমন বিশাল আর এমন সুন্দর মুক্তো আমি চোখে দেখিনি তো বটেই, ছবিতেও কখনো দেখিনি। আমাকে এক মেঘলা দুপুরে তিনি মুক্তোটা দেখিয়েছিলেন। ঘরের আবছা আলোয় মুক্তোটার ভেতর থেকে যেন একটা হালকা নীল আলো ছড়িয়ে পড়ছিল। যদি ওর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ইতিহাসের কথা নাও ধরি, তবু শুধু একটা “জেম” হিসেবেই ওটার দাম বোধহয় কয়েক কোটি টাকা হবে।’

আমি বললাম, ‘মাত্র একবার দেখার সুযোগ পেয়েছিলিস বলছিস কেন? ওটা কি ব্যাঙ্কের লকারে রাখা থাকে?’

টিটো ঘাড় নাড়ল। বলল, ‘উঁহু। একটা মোটা সোনার হারের মাঝখানে মণিটা লকেটের মতন গাঁথা রয়েছে। সেই হার রয়েছে আবার মোহন্ত মহারাজের গলায়। এটাই ওই আশ্রমের দেড়শো বছরের পুরোনো প্রথা। যিনিই মোহন্ত হবেন, তাঁরই হৃদয় স্পর্শ করে থাকবে পবিত্র চিন্তামণি।’

‘বুঝলাম। তা, মোহন্ত মহারাজকে বললে তিনি একবার আমাকে মণিটা দেখতে দেবেন না?’

টিটো বলল, ‘নিশ্চয় দিতেন। আমাকে তিনি খুবই স্নেহ করেন। সেইজন্যে এর আগে আমি বলামাত্রই নিজের পোশাকের আড়ালে লুকিয়ে থাকা মণিটা আমাকে দেখিয়েছিলেন। কিন্তু গত তিনমাস ধরে তিনি খুবই অসুস্থ। শয্যাশায়ী বলতে যা বোঝায় তাই। বিছানা ছেড়ে উঠতেই পারছেন না। এই অবস্থায় তো আর তাঁকে বলা যায় না, একবার মণিটা দেখান।’

টিটোর কথা শুনে মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল। এত কাছাকাছি এসেও এমন ইতিহাস আর পুরাণের গন্ধমাখা একটা জিনিস দেখতে পাব না?

মনটাকে অন্যদিকে নিয়ে যাওয়ার জন্যেই ক্যামেরা-ব্যাগটা খুলে ফেললাম। আর কেউ না জানুক, আমি জানি, আমার সমস্ত মনখারাপ ক্যামেরার ভিউ-ফাইন্ডারের মধ্যে হারিয়ে যায়। লেন্সটা পরিষ্কার করতে করতে টিটোকে জিগ্যেস করলাম, ‘ন্যাচারাল বিউটি আর গোপীনাথের মন্দির ছাড়া তোর থানার এলাকায় দেখার মতন আর কী আছে?’

টিটো বলল, ‘আরেকটা জিনিস রয়েছে। সেটা অবশ্য মণি বা মন্দিরের তুলনায় অনেক নতুন। বয়স মাত্র পাঁচ বছর।’

‘কী সেটা?’

‘একটা পোলট্রি ফার্ম।’

‘মানে যেখানে মুরগি-টুরগির চাষ হয়?’

‘হ্যাঁ। মন্দির আর পোলট্রি পাশাপাশি। শুনেছি পূর্ব-ভারতে অত বড় মডার্ন পোলট্রি ফার্ম নাকি আর নেই। ওখানে গেলেও তুই ছবি তোলার সাবজেক্ট পাবি।’

আমি টিটোর চোখের সামনে ক্যামেরার লেন্সটাকে ধরে বললাম, ‘ওহে তীর্থঙ্কর মিত্র! তুমি কি জানো না, নীল চ্যাটার্জির ক্যামেরার এই লেন্সে রনথম্বোর-অরণ্যের বাঘের ছায়া পড়েছে। লাদাখের স্নো-লেপার্ডের ছায়া পড়েছে। পোলট্রির মুরগির ছবিই যদি তুলতে হয়, তাহলে তোমার মোবাইল ফোনের ক্যামেরাটাই কি ভালো ছিল না?’

‘উঁহু। টিটো হাসতে-হাসতে দু-দিকে ঘাড় নাড়ল। বলল, ‘যেমন ভাবছিস তেমন সাধারণ পোলট্রি ওটা নয়। ওখানেও মোরগ আছে ঠিকই, তবে তাদের এক-একটার সাইজ দেখলে ছাগলও দৌড়ে পালাবে। তাছাড়াও তিতির আছে, বটেরপাখি আছে, খরগোশ আছে। এমনকী টার্কি আর এমু পাখিরও চাষ হয় ওখানে। বিশাল ফ্রিজিং-প্ল্যান্ট রয়েছে। ওইসব পালিত পাখির মাংস অটোমেটিক-মেশিনে কেটেকুটে, ড্রেসটেস করে, কৌটোয় ভরে এক্সপোর্ট করা হয়। ওই বিশাল কর্মকাণ্ড তুই না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবি না।’

আমি ক্যামেরার বডিতে লেন্সটা বসাতে-বসাতে বললাম, ‘দেখব, দেখব। আমিষ এবং নিরামিষ দুটো দ্রষ্টব্যই দেখব। এখনো কদিন আছি তো।’

আমার কথা শুনে টিটো হো হো করে অনেকক্ষণ ধরে হাসল। তারপর কোনোরকমে হাসি থামিয়ে বলল, ‘এইভাবে তো ভাবিনি রে নীল। বৈষ্ণব মন্দির যদি নিরামিষ দ্রষ্টব্য হয়, পোলট্রি ফার্ম তাহলে ঘোর আমিষ। পারিস বটে তুই…সত্যি।’

আমি বললাম, ‘ইয়ার্কি নয়। এই যে মন্দিরের গায়েই পোলট্রি তৈরি করেছে, এতে মন্দিরের সাধুসন্ন্যাসীরা আপত্তি তোলেননি?’

টিটো বলল, ‘কীসের আপত্তি? শুনতে পাশাপাশি। আসলে দুটো প্রপার্টিই তো কয়েক একর বাগান দিয়ে ঘেরা। মাঝখানে বিস্তর ফাঁক। তার ওপরে জেলখানার মতন উঁচু পাঁচিল। কাজেই আঁশে নিরামিষে ছোঁয়াছুঁয়ির কোনো গল্পই নেই।’

টিটোর কথা শুনতে শুনতেই দেখলাম, নীলচে অন্ধকারে ঢাকা রিভার-বেড ধরে দারুণ উজ্জ্বল রঙের একটা বালি তোলার ট্রাক হেলতে দুলতে শহরের দিকে ফিরছে। এরকম রঙের কনট্রাস্ট চট করে পাওয়া যায় না। ক্যামেরাটা বাঁদিকে ঘুরিয়ে ওটার দিকেই ফোকাস করেছিলাম, কিন্তু ঠিক যখন শাটারে চাপ দিতে যাচ্ছি তখনই আমার পুরো লেন্সটাকে ঢেকে দিল একটা মুখ। এলমেলো চুল, বড় বড় চোখ, বোঁচা নাকের নীচে রোঁয়ারোঁয়া গোঁফের রেখা—বছর পনেরোর একটা ছেলে ক্যামেরার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি চট করে চোখ থেকে ক্যামেরা নামিয়ে নিলাম।

ছেলেটা বাঁদিকের বারান্দা থেকে মোড় ঘুরে আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে গিয়ে আমার ক্যামেরা আর নদীর মাঝখানে পড়ে গেছে। আর পড়ে গিয়ে খুব অপ্রস্তুত হয়েছে।

টিটো বোধহয় ওর অস্বস্তিটা বুঝতে পেরেই বেশ কর্ডিয়ালি ডাক দিল, ‘কী হল বিনুমাস্টার? দাঁড়িয়ে পড়লে কেন? এসো, এখানে এসে বসো। চপ খাও।’

বিনু নামের ছেলেটা সঙ্গে সঙ্গেই সহজ হয়ে উঠল। ‘থ্যাঙ্ক ইউ ওসি আঙ্কল’ বলে টিটোর ওপাশে একটা চেয়ারে বসল, কিন্তু চপের দিকে হাত বাড়ালো না।

‘কী হল? চপ খাবে না?’ জিগ্যেস করল টিটো।

আড়চোখে দেখলাম ছেলেটা মুখে কিছু না বলে ইশারায় আমার দিকে দেখাল। টিটো বলল, ‘ওহো, তাই তো! তোমার সঙ্গে নীলের আলাপ করিয়ে দিতে ভুলে গেছি। নীল, এ হল বিনু। ভালো নাম বিনায়ক মুখার্জি। আমাদের গোপীমঠের পোস্টমাস্টারমশাই বিভূতিবাবুর বড় ছেলে। ইন্দুভূষণ অ্যাকাডেমিতে ক্লাস টেনে পড়ে। সামনের বছর মাধ্যমিক দেবে। আর বিনু, নীলের নাড়িনক্ষত্র তো তুমি জানোই। বুঝলি নীল, ও তোর খুব বড় ফ্যান।’

আমি মুচকি হেসে বললাম, ‘তাই নাকি?’

টিটো বলল, ‘হ্যাঁ। আসলে বিনুও খুব নেচার-লাভার। সারাক্ষণ মাঠেঘাটে ঘুরে ঘুরে পাখি দেখছে, পোকামাকড় দেখছে। আবার ডায়েরিতে নোটও রাখে। বিভূতিবাবু ওকে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিনের গ্রাহক করে দিয়েছেন। ওই ম্যাগাজিনটায় তো তোর তোলা জন্তু-জানোয়ারের ছবি প্রায়ই বের হয়। সেইগুলো দেখেই ও তোর ফ্যান হয়ে গেছে।’

আমি বিনুর হাতটা আমার হাতের মুঠোয় ধরে ঝাঁকিয়ে দিয়ে বললাম, ‘ভেরি গুড। তোমার মতন বয়সে আমিও ঠিক ওইরকম মাঠেঘাটে টইটই করে বেড়াতাম। একটা টুনটুনিপাখি কেমন করে গাছের পাতা মুড়ে বাসা বানাচ্ছে সেটা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত দেখার জন্যে দিনের পর দিন একটা আধখোলা জানলার ফাঁকে মুখ রেখে বসে থাকতাম। গার্জিয়ানরা ভাবতেন পাগল। তুমি কি ছবিও তোলো?’

বিনু লজ্জা পেল। বলল, ‘ওই ইয়ে…মানে আমার তো ক্যামেরা নেই। এই মোবাইলটাতে টুকটাক…।’

আমি বললাম, ‘লজ্জা পাবার কী আছে? ছবি তোলার ব্যাপারে ক্যামেরা জিনিসটা সেকেন্ডারি। ক্যামেরার পেছনের চোখদুটোই আসল। দেখি, কী ছবি তুলেছ!’

বিনু চোখদুটো বড়-বড় করে বলল, ‘সত্যি দেখবেন? পরক্ষণেই চেয়ার থেকে সড়াৎ করে নেমে আমার পায়ের কাছে মেঝের ওপরে থেবড়ে বসে পড়ল। আমার হাঁটুর ওপরে ওর স্মার্টফোনটাকে ধরে, গ্যালারি থেকে একটার পর একটা ছবি স্ক্রল করতে শুরু করল।

আমি দেখলাম, ছেলেটার ছবি তোলার হাত সত্যিই ভালো। চেনা সব পাখি আর পোকামাকড়ের ছবিই তুলেছে, কিন্তু প্রত্যেকটা ছবির সঙ্গেই কিছুটা পরিবেশ যোগ করে দিয়েছে, যার ফলে ছবিগুলোকে আর বায়োলজি বইয়ের ইলাস্ট্রেশন বলে মনে হচ্ছে না। একটা লেডিবার্ড বিটলের ছবি যখন পেরিয়ে যাচ্ছে তখন আমি নিজেই ওর হাত চেপে ধরে বললাম, ‘আরে দাঁড়াও তো একটু। দেখতে দাও।’

একটা হলুদ রঙের পুঁটুশ ফুলের গোছা। সেই ফুলের পাপড়িতে বসে-থাকা লালের ওপরে কালো বুটিদার পোকাটাকে এত সুন্দর দেখতে লাগছিল যে, বলবার কথা নয়।

আমার ভালো লেগেছে দেখে বিনুর যতটা খুশি হওয়ার কথা ছিল ততটা যেন ও হল না। বুঝতে পারছিলাম, ও যেন কী একটা উদ্বেগে ভুগছে?

দেখলাম আমার আন্দাজ ঠিক। ও নিজেই বলল, ‘অনেকদিন আগে, মানে ধরুন তিনমাস আগে, একটা অদ্ভুত ঘটনা দেখেছিলাম। কাউকে বলিনি, কিন্তু ছবি তুলে রেখেছি। তখন থেকেই ভেবে রেখেছিলাম, আপনি একদিন না একদিন তো ওসি আঙ্কলের বাড়িতে বেড়াতে আসবেন। তখন আপনাকে দেখাব। আপনি ছবিগুলো দেখবেন?’

বললাম, ‘কেন দেখব না? দেখাও!’

আমার সম্মতি পেয়ে বিনু টাচ-স্ক্রিনের ওপর খুব দ্রুত আঙুল চালিয়ে, যে-ছবিটা দেখাতে চাইছিল, সেটাকে সামনে নিয়ে এল। তারপর মোবাইলটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, এখান থেকে দেখুন।

দেখলাম।

পরপর কয়েকটা ফ্রেমে একটা কুমোরেপোকার নানান ভঙ্গির ছবি। দেখবার জন্যে যতটা সময় লাগা উচিত ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি সময় নিয়েই দেখলাম। তারপর সেলফোনটা বিনুর হাতে ফেরত দিয়ে বললাম, ‘এটা ঠিক করোনি, বিনু।’

বিনু নিশ্চয় আমার এই রিঅ্যাকশন আশা করেনি। ওর বড়-বড় দুটো চোখের তারায় গভীর কষ্ট ফুটে উঠল। কিন্তু আমার তাতে মন গলল না। ঠিক করলাম, ছেলেটাকে এইমুহূর্তেই শিক্ষা দেওয়া দরকার।

বিনুর হাতে ওর মোবাইল ফোনটা গুঁজে দিয়ে বললাম, ‘তুমি এই বয়স থেকে সহজ রাস্তা ধরে নিয়েছ, তাই না? লোকজনকে চমকে দেবার জন্যে ফোটো-এডিটর দিয়ে ছবিকে যা নয় তাই করে তুলছ?’

টিটো অবাক হয়ে বলল, ‘কী হয়েছে রে নীল? বিনুকে এত বকছিস কেন? কীসের ছবি তুলেছে ও?’

আমি টিটোর কথায় পাত্তা না দিয়ে বিনুকেই বললাম, ‘তোমার এইসব মিথ্যে-ছবি যদি কোনো বাচ্চার হাতে পড়ে, সে তাহলে কী শিখবে বলো তো? সে তো ভাববে সত্যিই বোধহয় কুমোরেপোকা এইরকম বাসা বানায়।’

বিনু একবার শুধু বলবার চেষ্টা করল, ‘নীল আঙ্কল, বিশ্বাস করুন। আমি কিন্তু…।’

আমি হাত তুলে ওকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, ‘না। বিশ্বাস করব না। কারণ, প্রকৃতির রাজ্যে স্বেচ্ছাচার বলে কিছু নেই। বাবুইপাখি যতই ভালো বাসা বানাক, সে-বাসা সবসময় উল্টোনো কলসির মতনই দেখতে হবে। তাকে দিয়ে কিছুতেই কেউ একটা কাকের বাসার মতন বাসা বানাতে পারবে না।’

বিনু বলল, আমি জানি। সেইজন্যেই আমি পার্টিকুলারলি এই ছবিগুলো আপনাকে দেখাতে চাইছিলাম। শুধু বাসা নয়, এরপরে পোকাটার যা হয়েছিল শুনলে আপনি অবাক হয়ে যাবেন। পোকাটা জ্বলে পুড়ে গিয়েছিল।’

‘মানে?’

বিনুর মুখ উত্তেজনায় লাল হয়ে গিয়েছিল। ও গুছিয়ে কথা বলতে পারছিল না। কোনোরকমে আমতা আমতা করে বলল, আতসকাচের নীচে দেশলাই কাঠি ধরলে সেটা যেমন একটু বাদে হুশ করে জ্বলে ওঠে, সেইভাবে পোকাটা নিজে থেকেই জ্বলে উঠে ছাই হয়ে গিয়েছিল। আমি তখন এত অবাক হয়ে গিয়েছিলাম যে, সেই ছবি আর তুলে রাখতে পারিনি।’

আমি হাত তুলে ওকে থামিয়ে দিলাম। বললাম, ‘ব্যস ব্যস! অনেক হয়েছে। একটা মিথ্যেকে ঢাকবার জন্যে দশটা মিথ্যেকথা বোলো না বিনু। আমি আর তোমার ছবিতে ইন্টারেস্টেড নই।’

বিনু আর কোনো কথা বলল না। কিছুক্ষণ মুখ নীচু করে দাঁড়িয়ে থেকে তারপর আস্তে-আস্তে বাগানের রাস্তা পেরিয়ে চলে গেল। টিটো আবার আমাকে জিগ্যেস করল, ‘এই নীল! বিনু তোকে কীসের ছবি দেখাল? হঠাৎ অত রেগে গেলি কেন?’

আমি চেয়ারের পেছনে মাথাটা হেলিয়ে দিয়ে বললাম, ‘আর বলিস না। ছেলেটা একটা কুমোরেপোকার ছবি তুলেছে। পোকাটা মাটি দিয়ে বাসা বানাচ্ছে—সেই বাসা বানানোরই নানান স্টেজের ছবি।’

‘তো?’

‘প্রত্যেকটা বাসা নিখুঁত হার্ট শেপের। যেন বিদেশি চকোলেট কিম্বা দেশি পানপাতা। বিশ্বাস করা যায়? তুইই বল। তুই তো কুমোরেপোকার বাসা দেখেছিস। মিনিয়েচার কলসি ছাড়া কোনোদিন অন্য কিছু মনে হয়েছে কি? যত্তসব, ফোটোশপের বুজরুকি!’

মেজাজটা তেতো হয়ে গিয়েছিল বলেই বোধহয় সারাদিনের জার্নির ক্লান্তি এতক্ষণে আমাকে চেপে ধরল। বললাম, ‘টিটো, বাদলদাকে ডিনার লাগাতে বল। খাওয়াদাওয়া সেরে নিয়ে শুয়ে পড়ি। কাল বরং ভোর ভোর উঠে হাঁটতে যাব।’

দুই

‘নীল! এই নীল! ওঠ ওঠ। উঠে পড়। তুই যে বলেছিলিস ভোরবেলায় বেড়াতে বেরোবি। চল, রোদ চড়ে যাওয়ার আগে রিভারবেড ধরে একটু হেঁটে আসি।’

টিটোর ডাকাডাকিতে ঘুম ভেঙে গেল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম, সাড়ে পাঁচটা বাজে। বাইরে আলো ফুটে গেছে। এমনিতে আমি এরকম সময়ে ঘুম থেকে উঠে পড়ি। কিন্তু কাল রাতে ঘুম আসতে অনেক দেরি হয়েছিল। মনের ভেতরে একটা অপরাধবোধ কাজ করছিল। ভাবছিলাম, হাজার হোক, বিনু একটা ছোট ছেলে। তাকে অতগুলো কঠিন কথা শুনিয়ে কি ভালো কাজ করলাম?

ঘুমিয়ে পড়ার আগেই প্রতিজ্ঞা করে ফেলেছিলাম, বাকি যে ক’দিন এখানে থাকব, রোজ বিনুকে নিয়ে নেচার-টুরে বেরোব। ভালোবাসা দিয়েই ওর ভুলগুলো শোধরাতে হবে।

যাই হোক, টিটোর সঙ্গে এরপরে যেটা শুরু করলাম সেটাকেই নিশ্চয়ই বাংলায় ‘টিটো কোম্পানি’ বলে। কোনো উদ্দেশ্য নেই, গন্তব্য নেই। শুধু চারিদিকের অপূর্ব প্রকৃতির টানে বালির চর ধরে, বোল্ডার ডিঙিয়ে, সুবর্ণরেখার তিরতিরে জলের স্রোতে পা ভিজিয়ে হেঁটে যাওয়া।

যে রিভারবেডকে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় প্রাণহীন, একটু মনোযোগ দিয়ে দেখলে তারই বুকে কত অজস্র প্রাণের ফুটে ওঠা আর বড় হওয়া যে দেখা যায়।

একজায়গায় দেখলাম পাথরের খাঁজে লুকিয়ে আছে সূর্যশিশিরের ফুল। স্বপ্নের মতন গোলাপি ঝিরঝিরে পাপড়িগুলো দেখলে কে বলবে ওরা মাংসাশী।

বালির ওপর পড়ে আছে হট্টিটি পাখির ডিম। বাসা নেই, গর্ত নেই। খোলা জমির ওপরে পড়ে থাকা ডিমগুলোকে বাঁচায় শুধু ওদের খোলার ক্যামোফ্লেমিং কালার—চারিদিকের বালি আর নুড়ির রঙের সঙ্গে মেলানো ছোপ ছোপ বাদামি সাদা রং। এমনই সেই রঙের ম্যাজিক যে, দুহাত দূর থেকেও ডিম বলে চেনা মুশকিল।

জলের ধারে দৌড়োদৌড়ি করছিল একঝাঁক সোনাবাটান পাখি। শীত ফুরিয়ে বসন্ত এসে গেছে। ওদেরও চলে যাবার সময় হয়ে এল। তার আগে যতটা পারে শামুক, কাঁকড়া খেয়ে গায়ে চর্বি জড়ো করছে। সেই উত্তর সাইবেরিয়া পর্যন্ত উড়ে যেতে হবে তো। আমাদের আসতে দেখে একসঙ্গে রিনরিন শব্দ করে ওরা উড়ে গেল। কাস্তের মতন একটা বাঁক খেয়ে পুরো ঝাঁকটাই নামল আবার আধ-কিলোমিটার দূরে একটা জায়গায়। বালির ওপরে পোকামাকড়ের খোঁজে আবার মাথা নীচু করে দৌড়তে লাগল।

ক্যামেরা বার করে এইসব দৃশ্যের কয়েকটা স্ন্যাপ নিলাম। সকালের আলোয় খুব ভালো ছবি ওঠে, আর বিকেলে।

টিটোর বাংলো পেরিয়ে অনেকদূর চলে যাওয়ার পরে প্রথম মানুষের দেখা পেলাম। অবশ্য খুদেগুলোকে এখনো পুরোপুরি মানুষ বলা যায় না। আট থেকে বারো বছরের মধ্যে ছেলেমেয়েগুলোর বয়স; সবারই পরনে ছেঁড়া হাফপ্যান্ট কিম্বা ফ্রক। ফাঁকা আর পাথুরে জায়গা বলে গোপীমঠে এই এপ্রিলমাসেও ভোরের দিকে বেশ ঠান্ডা পড়েছে। তবু ওদের কারোরই গায়ে কোনো গরমজামা দেখলাম না।

ওরা জলের ধারে বালি ঘাঁটাঘাঁটি করে কী যেন খুঁজছিল? টিটোকে জিগ্যেস করলাম, ‘কী করছে রে ওরা? কাঁকড়া ধরছে নাকি?’

টিটো ঘাড় নেড়ে বলল, ‘উঁহু। সোনা খুঁজছে।’

শুনে যার পর নাই অবাক হলাম। একটু সামলে নিয়ে বললাম, ‘সোনা মানে? গোল্ড?’

টিটো উত্তর দিল, ‘ইয়েস অফকোর্স। গোল্ড-ডাস্ট টু বি প্রিসাইজ। জানিস না, সুবর্ণরেখার কিছু-কিছু জায়গায় বালির সঙ্গে সোনার কুঁচি মিশে থাকে? ওরা সেই সোনার কুঁচি খুঁজছে।’

বললাম, ‘সত্যিই সোনা খুঁজে পায় ওরা?’

টিটো বলল, ‘পায়। তবে সোনা বলতেই যেরকম লক্ষ-লক্ষ টাকার গল্প মাথায় আসে, সেরকম কিছু নয়। সারা মাসে ওরা যেটুকু সোনার কুচি পায়, টুরিস্টদের কাছে তার দাম বড়জোর একশো টাকা। তার জন্যেই বাচ্চাগুলো ভোরবেলায়, নদীর জল বেড়ে ওঠার আগেই, খোঁজাখুঁজি শুরু করে দেয়।’

বললাম, ‘চল তো, কাছে গিয়ে দেখে আসি।’

বাচ্চাগুলোর কাছাকাছি পৌঁছিয়ে আমিই ডাক দিলাম, ‘এই। কিছু পেলি?’

সবক’টা বাচ্চাই মাথার ওপরে হাত নেড়ে জানিয়ে দিল, কিছুই পায়নি। ওদের মধ্যে যে-মেয়েটা একটু দিদি গোছের, সে খোঁজাখুঁজি থামিয়ে আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে ফুঁ দিয়ে জমে যাওয়া হাতদুটোকে গরম করার চেষ্টা শুরু করল। টিটো ওকে বলল, ‘একদম কিছুই পাসনি? আমার এই বন্ধুটা কলকাতা থেকে এসেছে। ওকে দেখা না, তোরা কেমন ময়ূরের পালকের ডাঁটির মধ্যে সোনা জমিয়ে রাখিস।’

মেয়েটা বলল, ‘না কাকু, বিশ্বাস করো। একমাসের বেশি হল, বালির ভেতর থেকে সব সোনা হাওয়া হয়ে গিয়েছে। আর তার সঙ্গে শুরু হয়েছে পিঁপড়ের উৎপাত। আগে কখনো দেখিনি, এই এত বড় বড় হলুদ রঙের পিঁপড়ে। বালির নীচে থাকে। আমরা বালি ঘাঁটাঘাঁটি করতে গেলেই কামড়ে দেয়। কি জ্বলুনি, বাপ রে। দ্যাখো হাতদুটো কেমন ফুলিয়ে দিয়েছে।’

দেখলাম সত্যিই, বাচ্চা মেয়েটার হাতের তালুদুটো জায়গায় জায়গায় লাল হয়ে ফুলে রয়েছে।

মেয়েটা সেফটিপিন লাগানো হাওয়াই চটিদুটো পায়ে গলাতে-গলাতে বলল, ‘ধুউস, কাল থেকে লোকের বাড়িতে বাসন মাজতে যাব। সোনা খুঁজে ঘোড়ার ডিম হচ্ছে।’

মেয়েটার কথা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি সকালবেলায় ছোট ছেলেমেয়েদের স্কুলে যেতে হয়, পড়াশোনা করতে হয়। অথচ এই সুবর্ণরেখার ধারে বাচ্চাগুলো একদম অন্যরকম জীবন কাটাচ্ছে। টিটোরও বোধহয় খারাপ লাগছিল। তাই ও হঠাৎই বলে উঠল, ‘চল নীল, এবার রিভার বেড ছেড়ে উঠে পড়ি।’

বললাম, ‘কোথায় যাবি?’

টিটো বলল, ‘এখান থেকেই যদি নদীর ধারের রাস্তায় উঠে যাই তাহলে রাস্তার ঠিক উল্টোদিকেই মন্দির আর পোলট্রি-ফার্ম দুটোই পেয়ে যাব।’

আমি বললাম, ‘বেশ তো, তাই চল।’

হাতের ক্যামেরা ব্যাগে ঢুকিয়ে, ঢালু পাড় বেয়ে আমরা দুজনে ওপরে উঠতে শুরু করলাম। বেশ খাড়া পাড়। তার ওপরে রাবারের জুতো পরে বেরিয়েছিলাম বলে পা স্লিপ করছিল। কোনোরকমে গাছের চারা, পাথরের টুকরো এইসব পাকড়ে ধরে পড়ে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচছিলাম।

জীবজন্তুর খোঁজে বনে-জঙ্গলে ঘুরতে-ঘুরতে আমার একটা অদ্ভুত ক্ষমতা জন্মেছে। কোথাও সামান্য কোনো নড়াচড়াও চোখ এড়ায় না। হঠাৎই সেরকম একটা মুভমেন্ট চোখে পড়ল। তার সঙ্গে একটু আলোর ঝলকানি। পাড়টা ঢালু বলেই সেখানে রোদ ছিল না, আর রোদ ছিল না বলেই বোধহয় ঝলকানিটা বেশি করে চোখ টেনেছিল। যাই হোক, আমি যে অবস্থাতে ছিলাম, সেই অবস্থাতেই স্ট্যাচু হয়ে গেলাম। টিটো কিছু খেয়াল না করে একটানা ওপরে উঠে গেল। ওর পায়ে গ্রিপ-ওলা জুতো ছিল।

একহাতে একটা গাছের শেকড় আর অন্যহাতে একটা পাথরের টুকরো চেপে ধরে আমি আড়চোখে দেখলাম, আমার প্রায় পাঁচফুট দূর দিয়ে একসার হলুদ রঙের ডেয়ো-পিঁপড়ে লাইন করে হেঁটে চলেছে। দলটায় সব মিলিয়ে প্রায় তিরিশটা পিঁপড়ে। ওরা এক-এক করে ঢালের গায়ে বেরিয়ে-থাকা একটা সিমেন্টের নালির মধ্যে ঢুকে পড়ছে।

যদিও অমন অদ্ভুত রঙের ডেয়ো-পিঁপড়ে আগে কখনো দেখিনি, তবু দৃশ্যটার মধ্যে এত অবাক হবার মতন কিছুই থাকত না, যদি না প্রত্যেকটা পিঁপড়ের মুখে ধরা থাকত একটা করে সোনার কুচি।

হ্যাঁ, আমি নিশ্চিত, ওরা প্রত্যেকে সাঁড়াশির মতন শক্ত চোয়ালে যে জিনিসটা আঁকড়ে ধরে তুরতুর করে দৌড়চ্ছিল, সেই জিনিসটা সোনা ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। অন্য কোনো কিছুই সামান্য নড়াচড়ায় অমন ঝলমল করে ওঠে না।

আমি শেকড় থেকে হাত ছেড়ে দিয়ে, পাশের দিকে হামাগুড়ি দিয়ে ওই পাঁচফুট দূরত্ব পেরোবার চেষ্টা করলাম, যাতে ওই পিঁপড়েগুলোর কাছাকাছি পৌঁছতে পারি। কিন্তু তার আগেই পা পিছলে নেমে গেলাম প্রায় যেখান থেকে উঠতে শুরু করেছিলাম, সেইখানেই।

টিটো এতক্ষণ কিছুই খেয়াল করেনি। এবার আমার দুরবস্থা দেখে ও সাবধানে কিছুটা নেমে এসে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। আমি ওর হাত ধরে পাড়ে উঠে এলাম। তারপর কোমরে হাত দিয়ে, হতাশ হয়ে তাকিয়ে রইলাম ওই নালির মুখটার দিকে।

একটাও পিঁপড়ে আর বাইরে নেই। সবক’টাই ভেতরে ঢুকে পড়েছে।

টিটো আমার হতাশ ভঙ্গি দেখে বলল, ‘কী হল রে নীল?’

আমি ওকে যা দেখেছি সবটাই বললাম আর ও ন্যাচারালি আমার কথাগুলো হেসেই উড়িয়ে দিল। কিন্তু ওর হাসি পুরোপুরি থামার আগেই একটা কাণ্ড হল। আমরা খেয়াল করিনি, এক কুচি সোনা নালির বাইরে পড়েছিল। একটা ডেয়ো পিঁপড়ে হঠাৎই তীরগতিতে নালি থেকে বেরিয়ে এসে সেটাকে মুখে তুলে নিয়ে আবার গর্তের ভেতরে ঢুকে গেল আর তাই দেখে টিটোর মুখটাও আমারই মতন হা হয়ে গেল।

এবার ও কোমরে দু’হাত রেখে বলল, ‘এটা কী হল! কীরে নীল? এসব তো তোরই সাবজেক্ট। এক্সপ্লেন কর।’

আমি বললাম, ‘কোনো এক্সপ্লানেশন নেই। পৃথিবীর কোথাও কোনো পিঁপড়ের সোনার কুচি মুখে নিয়ে দৌড়বার কথা নয়, যেহেতু ওরা সোনা খায় না। সোনা দিয়ে বাসাও বানায় না।’

আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম, নিজের অজান্তেই কাল সন্ধেবেলায় জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা করে ফেলেছি। এখনি একবার বিনুর সঙ্গে দেখা করার দরকার। ওই কুমোরেপোকার বাসার ছবিগুলোর ব্যাপারে ও কী বলতে চেয়েছিল সেটা শোনা দরকার।

আমি টিটোকে বললাম, ‘টিটো। ওসব পোলট্রি মন্দির-টন্দির পরে দেখব। এখন একবার পোস্টমাস্টার বিভূতিবাবুর বাড়ি নিয়ে চল তো আমাকে। এক্ষুনি বিনুর সঙ্গে দেখা করব।’

টিটো এক মুহূর্তেই বুঝে নিল, আমার চিন্তা কোন পথে যাচ্ছে। ও আর কোনো কথা না বলে, আমাকে নিয়ে এ-গলি ও-গলির মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শহরের একটা অপেক্ষাকৃত নিরিবিলি পাড়ায় পৌঁছে গেল। সেখানে রাস্তার একপাশে ফাঁকা জমি; সবে এক দুটো বাড়ির ভিত গাঁথা হয়েছে। অন্যপাশে একটা স্কুলবাড়ির টানা পাঁচিল। টিটো বলল, ‘ওই মোড়টা ঘুরলেই বিভূতিবাবুর বাড়ি। খুব শিক্ষিত ভদ্রলোক। আমি মাঝে মাঝে শুধু গল্প করার জন্যেই তাঁর বাড়ি আসি। কিন্তু একি!’

টিটোর বিস্মিত হবার কারণ ছিল। নির্জন মাঠের মধ্যে একটা ছিমছাম নতুন একতলা বাড়ি। তার গেটের কাছে গোপীমঠ থানার জিপ দাঁড়িয়ে রয়েছে। বাড়িটার দরজার কাছে ইউনিফর্ম পরে যে পুলিশ অফিসার দাঁড়িয়ে রয়েছেন তাকেও আমি কাল বিকেলে গোপীমঠে পা দিয়েই দেখেছি। সৌমেন্দু মাইতি। টিটোর জুনিয়র অফিসার।

টিটো প্রায় দৌড়েই বাকি রাস্তাটুকু পেরিয়ে সৌমেন্দুবাবুর সামনে গিয়ে দাঁড়াল। পেছন-পেছন আমি। সৌমেন্দু মাইতি এই অসময়ে বস-কে সিভিল-ড্রেসে এখানে হাজির হতে দেখে খুবই অবাক হলেন। কিন্তু পুলিশি ট্রেনিং-এর ব্যাপারই আলাদা। কোনো প্রশ্ন না করে অ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়িয়ে খটাং করে স্যালুট ঠুকলেন।

টিটো উদ্বিগ্ন স্বরে প্রশ্ন করল, ‘কী হয়েছে সৌমেন্দু? এত সকালে তোমরা এখানে কেন?’

সৌমেন্দু মাইতিকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, তিনি খুব অস্বস্তির মধ্যে পড়েছেন। কোনোরকমে বললেন, ‘আসলে আপনাকে ডিস্টার্ব করতে চাইনি স্যার। কাল রাতেই বিভূতিবাবুর ছেলে বিনায়কের একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে।’

‘অ্যাকসিডেন্ট?’

‘ইয়ে…ঠিক অ্যাকসিডেন্ট নয় স্যার। আসলে বিনায়ককে কোনো মিসক্রিয়ান্ট সাঙ্ঘাতিকভাবে ইনজিওর করে পালিয়েছে।’

টিটো জিগ্যেস করল, ‘কখন? ঘটনাটা কখন ঘটেছে সৌমেন্দু?’

‘স্যার, কাল সন্ধেবেলাতেই। ওর কাকার বক্তব্য শুনে মনে হচ্ছে, ও তখন আপনার কোয়ার্টার থেকেই বেরিয়ে বাড়ি ফিরছিল।’

‘তারপর?’

‘রাত আটটা বেজে যাওয়ার পরেও বিনায়ক বাড়ি ফিরল না দেখে ওর বাবা-মা ওকে ফোন করেন। দেখেন ফোন সুইচড অফ। তখন বিভূতিবাবু বিনায়কের খোঁজে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন।

‘বেশিদূর যেতে হয়নি। রাস্তার বাঁকেই, ওই স্কুলের পাঁচিলের পাশে বিনায়ক উপুড় হয়ে পড়ে ছিল। টর্চের আলোয় ছেলের মাথা থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়তে দেখে বিভূতিবাবু চিৎকার করতে শুরু করেন। লোকজন জমে যায়। ওঁরা বিনায়ককে নিয়ে প্রথমে আশ্রমপাড়ার রিলায়েবল নার্সিং হোমে যান। সেখানকার ডাক্তারবাবু বলেন, কোনো বড় নার্সিং হোমে নিয়ে যেতে। তাই শুনে বিভূতিবাবু আর তাঁর স্ত্রী কাল রাতেই গাড়িভাড়া করে ছেলেকে নিয়ে খড়্গপুরে রওনা হয়ে গিয়েছেন। এই যে, ইনি হলেন বিভূতিবাবুর ভাই বিশ্বজিৎ মুখার্জি।’

বছর পঁয়ত্রিশের এক যুবক বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে হাতজোড় করে আমাদের নমস্কার জানালেন।

সৌমেন্দুবাবু বললেন, ‘এখন তিনিই বাড়ি আগলাচ্ছেন। থানাতেও কাল রাতে তিনিই রিপোর্ট করতে গিয়েছিলেন।’

টিটো বিশ্বজিৎবাবুকে প্রতিনমস্কার জানিয়ে জিগ্যেস করল, ‘বিনু এখন কেমন আছে সে ব্যাপারে কোনো খবর পেয়েছেন কি?’

বিশ্বজিৎবাবু গম্ভীরমুখে বললেন, ‘পেয়েছি। হি ইজ স্টিল আনকনশাস। চোটটা এতই জোরে ছিল যে স্কালে ফ্র্যাকচার হয়েছে। ওখানকার ফিজিশিয়ানরা বলেছেন, বাইরের চোট হয়তো সারিয়ে ফেলা যাবে। কিন্তু জ্ঞান না ফিরলে বোঝা যাবে না ব্রেনে কোনো পার্মানেন্ট ড্যামেজ হয়েছে কিনা। সিটি স্ক্যানে সবটা বোঝা যায় না।’

একটু থেমে তিনি বললেন, ‘ভাবা যায়? সামনে মাধ্যমিক পরীক্ষা। এত ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট ছিল আমার ভাইপোটা। তাঁর গলার স্বর কান্নায় বুজে এল।’

টিটো তাঁর কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘চিন্তা করবেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে।’

‘স্যার! বিনুকে যারা মেরেছে তাদের খুঁজে বার করুন। শাস্তি দিন। এইটুকুই অনুরোধ।’ বিশ্বজিৎবাবু বোধহয় চোখের জল লুকোতেই তাড়াতাড়ি বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়লেন।

টিটো সৌমেন্দুবাবুর দিকে তাকিয়ে কড়াগলায় বলল, ‘আমায় খবর দাওনি কেন?’

সৌমেন্দুবাবু থতমত খেয়ে বললেন, ‘স্যার, আমি ছুটির মধ্যে আপনাকে ডিস্টার্ব করতে চাইনি।’

‘তাই বলে একটা বাচ্চা ছেলে আমার কোয়ার্টার থেকে বেরিয়ে মরতে বসবে, আর সেই খবরও আমি পাব না? ঘটনার গুরুত্ব বোঝো না?’

‘স্যরি স্যার।’

‘বিনুর সেলফোন বন্ধ রয়েছে কেন? ফোনটা ওর কাছে পেয়েছ?’

‘না স্যার। সেটাই তো অবাক লাগছে। ফোনটা ওরা নিয়ে পালিয়েছে। একটা ছ-সাতহাজার টাকা দামের ফোনের জন্যে এইভাবে একটা বাচ্চাকে অ্যাটাক করবে?’

টিটো একবার আড়চোখে আমার দিকে তাকাল। তারপর সৌমেন্দুবাবুকে বলল, ‘হয়তো ওর ফোনে এমন কোনো কল বা ডাটা ছিল যেটা ওদের পক্ষে বিপজ্জনক। যাই হোক, সার্ভিস-প্রোভাইডারকে ফোনটার লোকেশন ট্রেস করতে বলো।’

‘বলেছি স্যার। ওরা এখনও পর্যন্ত কোনো সাকসেস পায়নি।’

আমি টিটো আর ওর সহকর্মীদের সব কথাই শুনছিলাম। সব দেখছিলাম। মনে হচ্ছিল আমার পায়ের তলার মাটি দুলছে। একটা কথা পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম—যে বদমাশগুলো বিনুকে মেরেছে, তারা শুধু ওর মোবাইলটা কেড়ে নেওয়ার জন্যেই ওকে মারেনি। যদি তাই হতো, তাহলে সে মারের ওজন হতো অনেক হালকা। ওরা বিনুকে খুন করতে চেয়েছিল।

তার মানে সেলফোনের মেমারিতে যে ফোটোগুলো ছিল, তার থেকেও মারাত্মক কোনো তথ্য ছিল বিনুর ব্রেনের মেমারিতে। বিনু খুব ভয়ঙ্কর একটা কিছু দেখে ফেলেছিল এবং সেটাই ও কাল সন্ধেবেলায় আমাকে বলতে গিয়েছিল। কিন্তু আমি ওকে সমস্ত কথা বলার সুযোগ দিইনি।

আজ একটু আগে নদীর চরে যে সন্দেহটা আমার মনের মধ্যে দানা বেঁধেছিল, সেটা যে একশোভাগ সত্যি, সেটা প্রমাণ হয়ে গেল। সেই সন্দেহটা হচ্ছে, বিনুর ছবিগুলোর মধ্যে কোনো এডিটিং-এর কারিকুরি ছিল না। সোনামুখী পিঁপড়ে যেমন সত্যি, তেমনই সত্যি কুমোরেপোকার বাসার জ্যামিতি।

আর এই অস্বাভাবিক পোকাগুলোর কথা কেউ প্রাণপণে লুকিয়ে রাখতে চাইছে।

সে কে?

তিন

টিটো একটু দূরে দাঁড়িয়ে সৌমেন্দুবাবু আর অন্য দুজন কনস্টেবলের সঙ্গে কী যেন আলোচনা করছিল। আমার কাছে ফিরে আসার পর আমি ওকে জিগ্যেস করলাম, ‘এখন কী করবি?’

টিটো খুব চিন্তিতমুখে উত্তর দিল, ‘সেটাই তো সমস্যা রে। কাল ঘটনাটার কথা জানার পরেই পুরো গোপীমঠ শহরটাকে নাকাবন্দি করে ফেললে ভালো হতো। তাহলে যারা বিনুকে মেরেছে, তারা আর শহর ছেড়ে পালাতে পারত না। কিন্তু সৌমেন্দু তো তা করেনি।

‘অবশ্য ওকেও দোষ দিতে পারছি না। তুই আর আমি বিনুর মোবাইল ফোনের ছবির কথা জানি বলে ব্যাপারটাকে অন্যচোখে দেখছি। কিন্তু সৌমেন্দুর দিক থেকে ভাবলে এটা তো খুব বড়সড় কোনো ক্রাইম নয়। নিতান্তই একটা ছিনতাই…পুলিশের খাতায় পেটি কেস।’

‘তাহলে?’

‘দ্যাখ, গোপীমঠ এমন কিছু বড় থানা নয়। এখানে দু-একটা ছিঁচকে চোর, দু-একটা নেশাখোর থাকে ঠিকই। কিন্তু এখানকার পার্মানেন্ট বাসিন্দাদের মধ্যে এরকম খুনি মনোবৃত্তির কেউ আছে বলে আমরা জানি না। তাহলে যে বা যারা কাজটা করেছে, সে বা তারা বাইরের লোক। তারা থাকবে কোথায়?

‘বাসস্ট্যান্ডের পাশে দুটো ছোট হোটেল আছে। সে-দুটো আমার লোকেরা অলরেডি চেক করেছে। এই মুহূর্তে যারা ওই দুটো হোটেলে রয়েছে তারা সকলেই নিয়মিত কাস্টমার। ব্যবসার কাজে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই এখানে আসে। তা বাদে পুরো গোপীমঠে আর দুটি মাত্র জায়গা আছে, যেখানে বাইরের দুষ্কৃতিরা গা ঢাকা দিয়ে থাকতে পারে। তোর কথায় একটা আমিষ, অন্যটা নিরামিষ। অর্থাৎ পোলট্রি ফার্ম এবং গোপীনাথের মন্দির।

‘মন্দিরে চারিদিক থেকে ভক্ত আসার বিরাম নেই। ওদের অতিথিশালাও তাই কখনো ফাঁকা থাকে না। তাদের মধ্যে কে সত্যিই ধার্মিক আর কে বকধার্মিক, কে বাছতে যাচ্ছে? আর পোলট্রিতেও একই ব্যবস্থা। প্রতিদিনই ব্যবসার কাজে দু-দশজন করে বাইরের লোক আসছে। তাদের মধ্যে যাদের ধর পশ্চিমবঙ্গের বাইরে বাড়ি, তারা কাজ না মেটা পর্যন্ত ওদের গেস্ট হাউসে থেকে যায়।

‘তাই ঠিক করেছি, দলবল নিয়ে এখনই ওই দুটো জায়গায় তল্লাশি চালাব। যাকে বলে ‘ম্যানহান্ট।’ তুইও আমাদের সঙ্গে চল।’

মনে মনে ভাবলাম, এসেছিলাম টুরিস্ট হিসেবে চারিদিক ঘুরে দেখার জন্যে। এখন সেই জায়গাগুলোই পুলিশ হিসেবে দেখব। কী আর করা যাবে? আগের বছরেও তো দীঘলবাড়ি গিয়েছিলাম স্রেফ হর্নবিল পাখির ছবি তুলতে। সেই স্বর্গের মতন বনভূমিতেও অমৃতপাতার খোঁজে খুনখারাপি শুরু হয়ে গেল। আমার কপালটাই বোধহয় এইরকম।

.

প্রথমে আমাদের নিয়ে থানার তিনটে গাড়ি ঢুকল গোপীনাথের মন্দিরে। কয়েকজন পুলিশের লোক জোরকদমে চলে গেলেন দোতলা অতিথিনিবাসের দিকে। তাঁরা অতিথিদের আইডেনটিটি চেক করবেন। আরেক দল সৌমেন্দুবাবুর নেতৃত্বে মন্দিরের পুরোহিত, সেবক ও অন্যান্য কর্মচারীদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে গেলেন। আমি আর টিটো মন্দিরের তিরিশ-ধাপ সিঁড়ি ভেঙে ঠাকুর দেখে আবার নীচে নেমে এলাম। টিটো বলল, ‘চল, মোহন্ত মহারাজের সঙ্গে একবার দেখা করা যায় কিনা দেখি।’

মন্দিরের উল্টোদিকেই একটা খুব সাজানো-গোছানো, এ.সি. মেশিন লাগানো দোতলা বাড়ি দেখে, আমি ওই বাড়িটার দিকেই পা বাড়িয়েছিলাম। কিন্তু টিটো পেছন থেকে আমার কনুই ধরে টান দিয়ে বলল, ‘ওদিকে কোথায় যাচ্ছিস?’

বললাম, ‘ওটা মোহন্ত মহারাজের বাড়ি নয়?’

‘আজ্ঞে না। ওখানে তাঁর জুনিয়র মহারাজেরা থাকেন। মোহন্ত মহারাজ নিজে অসম্ভব সাদামাটা জীবন যাপন করেন। তিনি থাকেন ওদিকে। চল, দেখলেই বুঝবি।’

টিটোর সঙ্গে মন্দিরের পেছন দিকে একটা একতলা বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। দেখে মনে হল একটাই ঘর। পেছনদিকে বাথরুম রান্নাঘর থাকতে পারে। সামনের ছোট বারান্দাটাতে বেশ কয়েকজন নারীপুরুষ বিষণ্ণমুখে বসেছিলেন। তাদের প্রায় সকলেরই পরনে সাদা কাপড়। কপালে চন্দনের রসকলি। গলায় তুলসীর মালা। অর্থাৎ ভক্ত। তাদের পাশ কাটিয়ে আমরা ভেজানো দরজার পাল্লায় আলতো টোকা মারলাম। ঘরের মধ্যে থেকে এক ভদ্রলোক প্রথমে পাল্লাদুটো অল্প ফাঁক করে উঁকি মারলেন। তারপর টিটোকে চিনতে পেরেই তাড়াতাড়ি দরজা হাট করে খুলে কৃতার্থ হাসি হেসে বললেন, ‘আসুন স্যার। ভেতরে আসুন।’

টিটো ফিসফিস করে বলল, ‘ইনি হলেন ননীগোপালবাবু। মোহন্ত মহারাজের সেবক বলতে পারিস। তাঁর ভালোমন্দের দিকে সারাক্ষণ নজর রাখেন।’

দরজাটা আবার ভেজিয়ে দিয়ে ননীবাবু আমাদের বসার জন্যে দুটো মোড়া এগিয়ে দিলেন। আমরা না বসে ঘরের অন্যদিকে পেতে রাখা নীচু খাটটার দিকে এগিয়ে গেলাম—যেটার ওপরে মোহন্তজি শুয়ে আছেন। আমি এই প্রথম তাঁকে দেখলাম। রোগা লম্বা ফরসা একজন মানুষ। কাঁচায়-পাকায় মেশানো চুল। বয়স ষাটের ঘরেই হবে। চোখদুটো বোজা।

ঘরে কেউ ঢুকেছে বুঝতে পেরেই বোধহয় অতিকষ্টে চোখদুটো একবার খুললেন। টানা টানা সুন্দর দুটো চোখ। টিটো তাঁর বিছানার পাশে হাঁটু মুড়ে বসে তাঁর ডানহাতটা নিজের হাতের মধ্যে ধরে বলল, ‘ঠাকুরমশাই! আমি তীর্থঙ্কর। আপনি কেমন আছেন?’

‘বড়…যন্ত্রণা।’ জড়ানো গলায় কথা দুটো যেন অনেক দূর থেকে ভেসে এল।

‘যন্ত্রণা? কোথায়?’

বিছানার ওপরে পেতে রাখা বাঁ-হাতটা আস্তে আস্তে উঠে গেল রগের কাছাকাছি… ‘এখানে।’

আমরা দুজনেই দেখলাম, মোহন্তজির বাঁদিকের ঝুলপির ঠিক নীচে একটুকরো অ্যাডহেসিভ টেপ লাগানো রয়েছে। ছোটখাটো কাটাছড়ায় যেমন লাগানো হয়। আমাদের পেছনেই ননীগোপালবাবু দাঁড়িয়ে ছিলেন। টিটো জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাতেই তিনি বলে উঠলেন, ‘কাল ডাক্তারবাবু তাঁর শরীরের কয়েকজায়গায় গোল-গোল আঠা মাখানো কী যেন সব লাগিয়ে ইসিজি না ইইজি কী যেন টেস্ট করছিলেন। তখনই কেটে গিয়েছিল নিশ্চয়। আমি দেখিনি, আমাকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছিলেন। যন্ত্রণা হওয়ার তো কথা নয়। কী জানি, ঘোরের মধ্যে কী বলছেন।’

টিটো আবার মোহন্তজির মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সেরে যাবে ঠাকুরমশাই। সব যন্ত্রণা সেরে যাবে। আপনি ঘুমোন।’

মোহন্তজি মনে হল সত্যিই আবার গভীর ঘুমের মধ্যে তলিয়ে গেলেন। তাই দেখে আমরা নীচু গলায় কথা বলতে শুরু করলাম।

টিটো ননীগোপালবাবুকে প্রশ্ন করল, ‘মোহন্তজি আজ কেমন আছেন, ননীবাবু?’

ননীবাবু দুদিকে ঘাড় নেড়ে বললেন, ‘ভালো নেই স্যার। ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে পড়ছেন। ডাক্তারবাবুর জন্যে অপেক্ষা করছি। তিনি রোজ এইসময়ে আসেন। তিনি এলে আরও ভালো বলতে পারবেন।’

ননীবাবুর কথা শেষ হওয়ার প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই দরজায় দুবার নক করে যিনি ঘরে ঢুকে এলেন, তিনি যে পেশায় ডাক্তার, গলায় ঝোলানো স্টেথোস্কোপ দেখে তা বুঝতে অসুবিধে হয় না। আমরা দুজনেই দাঁড়িয়ে উঠলাম।

ডাক্তারবাবু ছোটখাটো হাসিখুশি মানুষ। ষাটের কাছাকাছি বয়স হবে। টিটোর পুলিশি ইউনিফর্ম দেখে তিনি জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন। টিটো নিজের পরিচয় দিয়ে বলল, ‘মোহন্তজি কেমন আছেন দেখতে এসেছি। আমাকে তিনি খুবই স্নেহ করেন।’

ডাক্তারবাবু মোহন্তজির বুকে স্টেথো বসিয়ে, চোখের পাতা-টাতা টেনে কিছুক্ষণ দেখার পর কান থেকে নল খুলতে খুলতে একদম স্বাভাবিক গলায় উত্তর দিলেন, ‘ভালো দেখলাম না। দা এন্ড ইজ নিয়ার।’

টিটো আঁতকে উঠল। আমিও। মোহন্তজি হয়তো সম্পূর্ণ সচেতন নন। কিন্তু তিনি তো এখনো জীবিত। তাঁর বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে এইভাবে কথা বলাটা অমানুষিক কাণ্ড নয়?

টিটো বিরক্তমুখে ডাক্তারবাবুকে ঘরের অন্যদিকে ডেকে নিয়ে গিয়ে নীচুগলায় জিগ্যেস করল, ‘তাঁর কী হয়েছে বলুন তো। বয়স তো বেশি হয়নি। স্বাস্থ্যও এতদিন বেশ ভালোই ছিল।’

ডাক্তারবাবু খুব তাচ্ছিল্যভরে উত্তর দিলেন, ‘কিডনির রোগ। ইট ওয়জ ডিফিকাল্ট টু কিওর। গত তিন মাস ধরে সবরকমের চেষ্টাই তো করে দেখলাম। কিন্তু…।’ তিনি হাত ওল্টালেন। তারপর মেঝে থেকে অ্যাটাচিটা তুলে নিয়ে বললেন, ‘ননীবাবু, আমার দুদিনের ভিজিট বাকি পড়ে গেল কিন্তু।’

ননীবাবু হন্তদন্ত হয়ে বললেন, ‘পাঠিয়ে দিচ্ছি স্যার, এখনই পাঠিয়ে দিচ্ছি।’

ডাক্তারবাবুর পেছন পেছন আমি আর টিটোও ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। এতক্ষণ যে লোকগুলো মোহন্তজির খবরের আশায় দালানে বসেছিলেন, তারা ডাক্তারবাবুকে বেরোতে দেখেই হাতজোড় করে উঠে দাঁড়ালেন। তাদের মধ্যে একজন বয়স্কমানুষ ভারি বিনীতভাবে জিগ্যেস করলেন, ‘প্রভু কেমন আছেন, ডাক্তারবাবু?’

ডাক্তারবাবু বেশ হেঁকেই বললেন, ‘তোমাদের প্রভুজি আর বেশিক্ষণ নেই। তোমরা সমাধি-টমাধি কীসব যেন দাও—তার ব্যবস্থা শুরু করো।’

ডাক্তারবাবুর কথা শুনেই ভিড়ের মধ্যে থেকে কান্নার আওয়াজ উঠল। এই পরিবেশে ডাক্তারবাবুর কথাগুলো আমার কানে ভীষণই কর্কশ শোনালো। হয়তো তিনি সত্যিকথাই বললেন। কিন্তু আরেকটু নীচু গলায়, আরেকটু সহ্য করার মতন ভাষায় বলা যেত নাকি? টিটোরও দেখলাম চোয়ালদুটো কঠিন হয়ে উঠল। ও পেছন থেকে ডেকে বলল, ‘একবার শুনুন!’

‘বলুন।’ ডাক্তারবাবু যখন ঘুরে দাঁড়ালেন তখনও দেখলাম তাঁর মুখে মুচকি হাসিটা লেগে আছে, যদিও হাসির কারণটা কী হতে পারে তা কিছুতেই আমার মাথায় ঢুকছিল না। খুব সম্ভবত এটা তাঁর মুদ্রাদোষ। কিম্বা ঠোঁটের গড়নের জন্যেও এরকম মনে হতে পারে।

টিটো বলল, ‘আমি আপনাকে ঠিক রেকগনাইজ করতে পারলাম না। আপনার নাম কী? চেম্বার কোথায়?’

‘আমার নাম ডক্টর দেবব্রত সেন। আমাকে আপনি চেম্বারে খুঁজে পাবেন না, কারণ আমি পোলট্রি ফার্মের রেসিডেন্ট ফিজিসিয়ান। শুধু ওই ফার্মের লোকজনদের চিকিৎসা করাই আমার চাকরি। তবে যেহেতু এই আশ্রমের লোকেদের প্রতিবেশী বলেই মনে করি, তাই এরা ডাকলে না করতে পারি না। ভিজিট নিই অবশ্যই, কারণ ওটা আমার পেশা। আচ্ছা চলি, নমস্কার।’

ডানহাতে অ্যাটাচি-কেস থাকায় ডাক্তারবাবু বাঁ হাতটা কপালে অল্প একটু ছুঁইয়েই খুরখুর করে পাঁচিলের গায়ের একটা ছোট দরজা খুলে বেরিয়ে গেলেন।

টিটো ঘাড় ঘুরিয়ে ননীবাবুকে জিগ্যেস করল, ‘ডাক্তারবাবু ওদিকে কোথায় গেলেন?’

ননীবাবু উত্তর দিলেন, ‘ওদিকে পোলট্রির পাঁচিলের গায়েও একটা দরজা রয়েছে। তার ওপাশে ডাক্তারবাবুর কোয়ার্টার। তিনি এই পথেই যাতায়াত করেন।’

কথা বলতে-বলতেই হঠাৎ ননীগোপালবাবুর চোখে পড়ল মন্দিরের ভেতরের জমিতে এদিকে-ওদিকে খাঁকি পোশাক পরা লোকেদের ব্যস্তসমস্ত চলাফেরা দেখা যাচ্ছে। তিনি অবাক গলায় জিগ্যেস বললেন, ‘একী! মন্দিরে পুলিশ কেন স্যার?’

টিটো খুব সংক্ষেপে তাঁকে বিনুর ঘটনাটা বলল। আমরা যে এখানে কালপ্রিটদের খোঁজে এসেছি, সে কথাও লুকোল না। সব শুনে ননীবাবু বললেন, ‘এখন যারা অতিথিশালায় রয়েছেন, তারা সকলেই আমার পরিচিত। দীর্ঘদিনের ভক্ত সবাই। তাঁদের যাতে সম্মানহানি না হয় সেটা দেখবেন স্যার।’

‘দেখব।’ এই বলে টিটো আমাকে নিয়ে আশ্রমের গেটের দিকে রওনা দিল। কারণ আমরা ছাড়া টিমের বাকি সকলেই ইতিমধ্যেই সেখানে জড়ো হয়েছেন। সৌমেন্দুবাবু ডানহাতের বুড়ো আঙুলটা দুবার নেড়ে বুঝিয়ে দিলেন—ফল শূন্য।

গাড়িগুলো আশ্রমের গেটের বাইরেই পার্ক করে রেখে আমরা পায়ে হেঁটে রওনা দিলাম পোলট্রি ফার্মের গেটের দিকে। দুটো গেটের মধ্যে বড়জোর আড়াইশো মিটারের দূরত্ব। গাড়ি নেওয়ার দরকার পড়ে না।

.

পোলট্রি ফার্মে ঢোকার পর পুলিশ-টিমের সবাই, এমনকী টিটো পর্যন্ত, সার্চিংয়ের কাজে জড়িয়ে পড়ল। কাজটা সহজ ছিল না। প্রায় পাঁচ একর জায়গার ওপর বিশাল ফার্ম। তার মধ্যে কোথাও পালিত পশুপক্ষীর এনক্লোজার, কোথাও ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট, কোথাও গ্যারেজের সারি, আবার কোথাও গোডাউন। তাছাড়া গেস্ট হাউস আর স্থায়ী কর্মচারীদের থাকার বাড়িঘর তো রয়েছেই। এর মধ্যে যে-কোনো জায়গাতেই কালপ্রিটরা লুকিয়ে থাকতে পারে। তাই গেট দিয়ে ঢুকেই টিটোর দলের কুড়িজন লোক জাপানি পাখার মতন ছড়িয়ে পড়ল ফার্মের আনাচে-কানাচে। আমি দেখলাম, আমি একা হয়ে গেছি।

ভালোই হল। ব্যাগ থেকে ক্যামেরা বার করে হাঁটতে শুরু করলাম।

মোরামের রাস্তা ধরে, গাছের ছায়ায় ছায়ায় হেঁটে চলেছিলাম। জায়গাটায় অজস্র ফলের গাছ ছাড়াও ছিল নানাধরনের ঘাসের খেত, যে সমস্ত ঘাসের বীজ পাখিদের খাওয়ানো হয়। আর ছিল বড় বড় কয়েকটা পুকুর। সব মিলিয়ে ভারি শান্ত আর সুন্দর পরিবেশ।

একটু পরে-পরেই এক একটা পাখিদের তারের জালে ঘেরা এনক্লোজার চোখে পড়ছিল। তাদের কোনোটার মধ্যে ঘাড় উঁচিয়ে পায়চারি করছে বিদেশি মুরগির দল—টিটোর কথায়, যাদের দেখলে ছাগল পর্যন্ত দৌড়ে পালায়। কোনোটায় তিতিরপাখি, কোনোটায় ছোট ছোট বটেরপাখি দৌড়োদৌড়ি বেড়াচ্ছিল। শুধু পাখিই নয়। একটা এনক্লোজারের মধ্যে ছাই রঙের খরগোশও দেখলাম প্রায় একশোটা।

ফার্মের ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় তারের জালে ঘেরা বিরাট মাঠের মধ্যে লম্বা গলা দুলিয়ে প্রায় কুড়ি তিরিশটা এমুপাখি চরে বেড়াচ্ছিল। আমি আগে ছবির বইয়ের বাইরে এমুপাখি দেখিনি। এই প্রথম দেখলাম। ছবিও তুললাম বেশ কয়েকটা। তারপর হঠাৎই চোখে পড়ল কিছুটা দূরে পাঁচিলের গায়ে একটা বড় নাগলিঙ্গমের গাছে প্রচুর ফুল ফুটে আছে।

নাগলিঙ্গম আমার খুব প্রিয় ফুল। এদের গোলাপি পাপড়ির মাঝখানে পুংকেশর আর গর্ভকেশরগুলো এমনভাবে সাজানো থাকে যে, একটু কল্পনা করলে দিব্যি শিবলিঙ্গের মাথায় ফনা-মেলা সাপকে দেখা যায়। এই গাছটাকে কলকাতায় খুব বেশি দেখতে পাই না। রাজভবনের পেছনদিকের বাগানে কয়েকটা দেখেছি আর আর্মহার্স্ট স্ট্রিটের একটা পেট্রোল-পাম্পের সামনে একটা। তাই এই পোলট্রির বাগানে ফুলে ভরা গাছটাকে দেখে ভারি উৎসাহিত হয়ে ক্যামেরা বাগিয়ে এগিয়ে গেলাম। আর তখনই চোখে পড়ল গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ছোট একতলা বাড়িটা।

একদিকে কুড়ি ফুট উঁচু পাঁচিল আর অন্যদিকে বড় বড় গাছের জটলার মাঝখানে চৌকো বাড়িটা প্রায় হারিয়েই গিয়েছিল। এরকম ছায়াঢাকা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে বলেই সাদা বাড়িটার সারা গায়ে শ্যাওলার ছোপ ধরেছে। কার্নিশে শেকড় ঝুলিয়ে দিয়েছে বটের চারা। জানলা-দরজার পাল্লাগুলোতে কোনো এক কালে হয়তো সবুজ রং ছিল; এখন রং চটে গিয়ে কাঠ বেরিয়ে পড়েছে। সব মিলিয়ে পুরো বাড়িটাতেই কেমন যেন অসুস্থতার চিহ্ন।

অথচ বাড়িটা ফাঁকা নয়, মানুষ থাকে।

মানুষ যে থাকে তার প্রমাণ ছাদের এক কোনায় একটা ছোট অ্যান্টেনা, যেটা ক্রমাগত ঘুরে চলেছে।

বাড়িটা কেন যে আমাকে টানছিল ঠিক বুঝতে পারছিলাম না, কিন্তু টানছিল যে সেটা ঠিক। আমি পায়ে পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। কিছুটা কেমিক্যালের গন্ধ, কিছুটা বুনো লতাপাতার গন্ধ আর কিছুটা জানোয়ারের গায়ের গন্ধ—সব মেশালে যেরকম হবে, সেরকম একটা উগ্র গন্ধ দরজা ভেদ করে এসে আমার নাকে ধাক্কা মারল। মনে পড়ল স্কুলের বায়োলজি ল্যাবের কথা।

বাড়িতে ঢোকার দরজাটার গায়ে একটা শক্তপোক্ত ইয়েল-লক লাগানো ছিল। এই লক লাগানো থাকলে চাবি ছাড়া বাইরে থেকে দরজা খোলার আর কোনো উপায় থাকে না। ভেতর থেকে অবশ্য ছোট একটা ছিটকিনি ঘুরিয়েই দরজা খুলে ফেলা যায়, চাবি লাগে না।

আশা করি ভেতরে কেউ আছেন।

আমি দরজায় আলতো টোকা মারতেই খরখর করে একটা শব্দ ভেসে এল। মনে হল দরজার পাল্লার ওদিকের গা বেয়ে একটা বড়সড় জন্তু নীচ থেকে ওপর দিকে উঠে গেল। তারপরেই খুট করে ছিটকিনি ঘোরানোর শব্দ হল। আমি আরেকবার ধাক্কা দিতেই দরজাটা হাট হয়ে খুলে গেল আর পাল্লার ওপর থেকে নীচে মেঝেতে লাফিয়ে পড়ল একটা মাঝারি সাইজের গোসাপ।

আমাকে ঘরে ঢুকতে দেখে গোসাপটা দুলকি-চালে পেছোতে পেছোতে ঘরের এক কোনায় রাখা একটা কাঠের প্যাকিং-বাক্সের মধ্যে ঢুকে পড়ল আর ওখান থেকেই মাঝে মাঝে ঘাড় বাড়িয়ে আমার দিকে তাকাতে লাগল। ওর চোখে পরিষ্কার ভয় ফুটে উঠেছিল। ও আমার জন্যে দরজা খুলে দেয়নি। আর কাউকে আশা করছিল বেচারা।

তার মানে কুমোরেপোকা আর পিঁপড়ের সঙ্গে তৃতীয় আরেকটা প্রাণী যুক্ত হল যে নিয়ম ভেঙে যা করার নয় তাই করছে। এই গোসাপটা ছিটকিনি খুলতে জানে। কিন্তু কেমন করে জানল, সেটাই রহস্য। কারণ, ওর ব্রেন এত ছোট যে, ট্রেনিং দিয়ে এই কাজটা করিয়ে নেওয়া যায় না।

ঘরে ঢোকার পর ভালো করে চারদিকটা দেখলাম। বাইরে থেকে বোঝা যায় না যে, বাড়িটার ভেতরে এমন হলঘরের মতন বড় একটা ঘর থাকতে পারে। সমস্ত জানলা চেপে বন্ধ করা। কোনো বৈদ্যুতিক আলোও জ্বলছিল না। আলো বলতে শুধু খোলা দরজার ভেতর দিয়ে যেটুকু ঘরে ঢুকছে সেইটুকুই।

সেই অল্প আলোতেই দেখলাম, আমি যেন এক মিউজিয়ামের মধ্যে দাঁড়িয়ে রয়েছি। সবকটা দেয়াল জুড়ে কাঠের তাক। সেই তাকগুলোর ওপর সাজানো রয়েছে অজস্র পশু আর পাখির স্টাফড শরীর। তাছাড়াও নানান পশুপাখির হাড় আর করোটি। কাচের জারে ফর্মালিন দ্রবণে ডোবানো পোকামাকড় আর সরীসৃপের দেহ। একটা টেবিলের ওপরে রাসায়নিকের সারসার রঙিন বোতল, বুনসেন বার্নার, মাইক্রোস্কোপ। তাছাড়া নানান রকমের অচেনা যন্ত্রপাতিও রাখা ছিল।

এ ঘরের মালিক যে একজন বৈজ্ঞানিক তা বলে দিতে হয় না।

আমি যে দরজাটা দিয়ে ঘরে ঢুকেছিলাম, তার উল্টোদিকের দেয়ালে আরও একটা দরজা দেখতে পেলাম। সেই দরজাটা পেরিয়ে পৌঁছলাম অন্য একটা ঘরে। এই ঘরটা তুলনায় ভীষণই ফাঁকা। এক কোনায় একটা টেবিলের ওপরে খুব আধুনিক একটা কম্পিউটার আর অন্য দুয়েকটা অচেনা মেশিন নামানো রয়েছে। কম্পিউটারের স্ক্রিনটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম। নীল মনিটরের ওপরে ক্রমাগত ঘুরে চলেছে ঘড়ির সেকেন্ডের কাঁটার মতন সরু আর লম্বা একটা দাগ। অবশ্য ঘড়ির কাঁটার থেকে সেটা ঘুরছে অনেক দ্রুতবেগে। তাছাড়াও স্ক্রিনের এখানে ওখানে কতকগুলো বিন্দু নড়াচড়া করছে। জায়গা বদলাচ্ছে।

জিনিসটার সঙ্গে কীসের মিল আছে ভাবতে ভাবতেই মনে পড়ে গেল রাডার-স্ক্রিনের কথা। সন্দেহ নেই, এটা একটা রাডার স্ক্রিন। মনে পড়ে গেল এই বাড়ির ছাদের ওপরে ঘুরন্ত অ্যান্টেনাটার কথা। শুধু বুঝতে পারছিলাম না, এই রাডারে যে জিনিসগুলোকে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে, সেগুলো কী? এরোপ্লেন?

উঁহু। পৃথিবীর কোনো আকাশেই ওরকম এলোমেলোভাবে ঝাঁক বেঁধে এরোপ্লেন ওড়ে না। তাছাড়া সবকটাই তো আর ঝাঁক বেঁধে নেই। এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা একলা ফোঁটাগুলোই বা তাহলে কী হতে পারে?

দেখলাম রাডার স্ক্রিনের একদম কেন্দ্রবিন্দুর কাছে একজায়গায় চারটে বিন্দু স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হল এই ঘরের নিরীখে ওই চারটে ফোঁটাই সবচেয়ে কাছে রয়েছে। বাকি সবগুলোই অনেক দূরে দূরে।

এখানে আর কিছু দেখার নেই। কিন্তু এই ঘরটা থেকেও অন্য একটা ঘরে পৌঁছনো যায়। আমার তখন নিশ্চয় কাণ্ডজ্ঞান লোপ পেয়েছিল, কারণ আমি একবারের জন্যেও ভাবছিলাম না, ঘরের মালিক ফিরে এলে কী হবে। কম্পিউটারের ঘরটা পেরিয়ে পাশের ছোট ঘরটায় ঢুকে পড়লাম আর ঢুকেই দেখলাম এক অদ্ভুত দৃশ্য।

সারা বাড়ির মধ্যে এই একটা ঘরেই ছাদ থেকে একটা খোলা বাল্ব ঝুলছিল এবং ভাগ্যিস এই দিনের বেলাতেও সেটা জ্বালানো ছিল। নাহলে কিছুই দেখতে পেতাম না। যা দেখলাম সেরকম দৃশ্য কোনোদিন দেখব বলে দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি।

দেখলাম একটা বড় তারের খাঁচার মধ্যে চারটে বাঁদর শান্তভাবে বসে রয়েছে। সারা শরীরের মধ্যে তাদের হাতগুলোই শুধু নড়াচড়া করছে আর সেই হাতগুলো দিয়ে তারা যে কাজটা করছে সেটা বাঁদরদের করার কথা নয়। তারা ক্রমাগত হাত মুঠো করছে আর মুঠো খুলছে। পুরো মুঠোটা একসঙ্গে খুলছে না। প্রথমে একটা আঙুল তুলে ধরছে। তারপর দুটো। তারপর তিনটে…এইভাবে ওরা আসলে ক্রমিক সংখ্যা দেখিয়ে চলেছে। এক থেকে দশ পর্যন্ত। দশটা আঙুল খুলে গেলেই আবার দুটো হাতই মুঠো করে ফেলছে। তারপর আবার শুরু করছে—এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়…।

চারটে বাঁদর।

কম্পিউটারের মনিটারের কেন্দ্রের কাছে চারটে বিন্দু।

খোলা বাল্বের উজ্জ্বল আলোয় দেখা যাচ্ছে তাদের চারজনেরই বাঁদিকের রগে লাগানো রয়েছে একটুকরো করে অ্যাডহেসিভ টেপ।

আমার মাথার মধ্যে জমে থাকা কুয়াশাটা হঠাৎই দুলে উঠল। সরে যেতে শুরু করল, ঠিক যেভাবে বেলা বাড়লে কুয়াশা কাটতে শুরু করে। আমি খুব দ্রুত ঘরের পর ঘর পেরিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে ইয়েল লকটা টেনে দিলাম। মোক্ষম সময়েই বেরিয়ে এসেছিলাম বলতে হবে। কারণ, দরজাটা টেনে দিয়ে ঘুরে দাঁড়াতেই দেখতে পেলাম এক ভদ্রলোক এদিকেই আসছেন। চেনা লোক। ডানহাতে অ্যাটাচি, বেঁটেখাটো চেহারা। হাসিখুশি মুখ।

ডাক্তার দেবব্রত সেন।

ডাক্তার সেন আপনমনে কী যেন ভাবতে ভাবতে মাথা নীচু করে হেঁটে আসছিলেন। হঠাৎ দরজার কাছে আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। এতক্ষণের মধ্যে এই প্রথম ডাক্তারবাবুর ঠোঁট থেকে এক সেকেন্ডের জন্যে হাসিটা মুছে যেতে দেখলাম। শুধু তাই নয়, আমি যদি দেখতে ভুল না করি তাহলে ওই সময়টুকুর মধ্যে মধ্যে তাঁর চোখে যেটা খেলা করে গেল, সেটাকে কালো আগুন ছাড়া আর কিছু বলা যায় না।

পরক্ষণেই অবশ্য সামলে নিলেন। খুব স্বাভাবিক গলায় প্রশ্ন করলেন, ‘কী ব্যাপার? আপনি এখানে?’

আমার মাথায় একটা বদবুদ্ধি খেলে গেল। গলার ক্যামেরাটার দিকে আঙুল দেখিয়ে বললাম, ‘দেখছেনই তো, আমার একটু ফটোগ্রাফির শখ আছে। অ্যানিমাল ফটোগ্রাফি। তা ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ দেখলাম, একটা বাঁদর এই বাড়ির ছাদে বসে অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গি করছে। ওটাকেই ক্যামেরাবন্দি করবার জন্যে এসেছিলাম। কিন্তু ব্যাটা যে কোথায় লুকোল।’

ঠিক যা ভেবেছিলাম। আমার কথা শোনামাত্র ডাক্তার দেবব্রত সেনের মুখটা ছাইয়ের মতন ফ্যাকাসে হয়ে গেল। তিনি ‘এক্সকিউজ মি, পরে একসময় আসবেন, ভালো করে গল্প করব’, বলে পকেট থেকে চাবি বার করে দরজা খুলে ঘরে ঢুকে গেলেন। অবশ্য ভেতরে পা বাড়ানোর আগে দড়াম করে আমার মুখের ওপরে পাল্লাটা বন্ধ করে দিতে ভুললেন না।

চার

আরও প্রায় আধঘণ্টা এদিক-ওদিক ঘুরেও তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু দেখতে পেলাম না। একটু বাদে পোলট্রি-ফার্মের নানান বাড়ির ভেতর থেকে ছোট ছোট পুলিশ-টিমগুলো বেরিয়ে এসে গেটের কাছে জমায়েত হতে শুরু করল। আমাকে দেখতে পেয়েই সৌমেন্দুবাবু আবার আঙুলের ইশারায় লবডঙ্কা দেখালেন, অর্থাৎ ম্যান-হান্ট এবারেও সাকসেসফুল হয়নি। বিনুর আততায়ীকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। টিটোর ভাবভঙ্গি দেখে মনে হল এবার আমরা ফেরার পথ ধরব। যাকে বলে ‘বিটন রিট্রিট।’ হেরে পালানো।

আশ্রমের গেটের সামনে পৌঁছিয়ে গাড়িতে ওঠার ঠিক আগে আমি টিটোকে একটু পেছনে ডেকে নিয়ে বললাম, ‘টিটো, একবার মোহন্ত মহারাজের ঘরে যাবি?’

ও বলল, ‘কখন? কেন?’

‘এখনই। তুই যা হোক একটা বাহানা তৈরি কর। আর কেন-টার উত্তর পরে দিচ্ছি।’

টিটো কিছুক্ষণ আমার চোখে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর লোহার নাল লাগানো হিলের ওপর ভর দিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে কম্যান্ড দিল, ‘ট্রুপ, ডিসপার্স! সৌমেন্দু! তুমি একটা গাড়ি নিয়ে এখানেই অপেক্ষা করো। নীল বলছে মোহন্ত মহারাজের একটা পোর্ট্রেট তুলে রাখবে। আমি ওকে নিয়ে চট করে ঘুরে আসছি।’

এবার আমরা মন্দিরের পাশ কাটিয়ে সোজা মোহন্ত মহারাজের ছোট ঘরটার সামনে গিয়ে হাজির হলাম। একটু আগে যে-ঘরের বারান্দায় অত লোকের ভিড় ছিল, সেই বারান্দা এখন শুনশান। একজন লোক চোখ মুছতে মুছতে ফিরে আসছিলেন। তাকে দাঁড় করিয়ে জিগ্যেস করলাম, ‘কী ব্যাপার? সব গেল কোথায়?’ তিনি উত্তর দিলেন, ‘প্রভু মহারাজ লীলা শেষ করে চলে গেলেন তো। তাই ননীদাদা বললেন, ভিড় ফাঁকা করে দিতে।’

ভদ্রলোক নিজের রাস্তায় চলে গেলেন। আমি টিটোকে বললাম, ‘চল! এখনই মোহন্তের ঘরে ঢুকতে হবে।’

মোহন্ত মহারাজের ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। টিটো আওয়াজ ছাড়ল, ‘ননীগোপালবাবু দরজা খুলুন। আমি ও.সি. সাহেব।’

দরজা খুলে গেল। ননীগোপালবাবুর মুখটা কান্নায় থমথম করছিল। কোনোরকমে কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, ‘তিনি…তিনি চলে গেলেন।’

আমরা ছোট চৌকিটার দিকে তাকালাম। মোহন্ত মহারাজ যে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেছেন সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। চোখ বোজা। বুকের ওঠানামা বন্ধ। মুখের থেকে রক্ত সরে গেছে। তবু টিটো আস্তে আস্তে বিছানার পাশে হাঁটু গেঁড়ে বসে, তাঁর বাঁ-হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে, একবার পালসটা দেখে, আস্তে আস্তে হাতটা আবার বিছানার ওপরে নামিয়ে রাখল।

ঠিক সেই সময়েই একটা আশ্চর্য কাণ্ড ঘটল। বিছানার ওপরে পেতে রাখা মোহন্ত মহারাজের ডান হাতটা সটান ওপরে উঠে এল। খুলে গেল মৃতের দুটো চোখের পাতাও, যদিও চোখের মণিদুটো দেখলাম কাচের চোখের মতন স্থির। আর দেখলাম, যে-হাতের পাতা এতক্ষণ মুঠি করা ছিল, সেই মুঠিও খুলে গেছে। আমাদের মনে হল তিনি যেন হাত বাড়িয়ে অদৃশ্য কারোর হাতে অদৃশ্য কোনো জিনিস তুলে দিচ্ছেন।

টিটোর মতন ডাকাবুকো ছেলেও এই দৃশ্য দেখে তাড়াহুড়ো করে দু-তিন পা পেছিয়ে এল।

সব মিলিয়ে বোধহয় দশ-সেকেন্ডের মতন রইল এই অবস্থা। তারপরেই আবার মোহন্ত মহারাজের চোখের পাতা বন্ধ হয়ে গেল। হাত নেমে এল শরীরের পাশে। মুঠো বন্ধ হয়ে গেল।

টিটোর আর ওদিকে যাওয়ার মতন অবস্থা ছিল না। আমিই এবার এগিয়ে গিয়ে তাঁর পালস দেখলাম। নাকের নীচে হাত রেখে দেখলাম, নিশ্বাস পড়ছে কিনা। না। প্রাণের কোনো লক্ষণই তাঁর মধ্যে ফিরে আসেনি। তবু তিনি দশ-সেকেন্ডের জন্যে যে জীবনের লক্ষণ দেখিয়েছিলেন তাতেও ভুল নেই।

ননীগোপালবাবু ঘরের এক-কোনায় দাঁড়িয়ে দরদর করে ঘামছিলেন। টিটো তাঁকে জিগ্যেস করল, ‘এটা কী হল ননীগোপালবাবু?’

ননীগোপালবাবু কপালে বারবার জোড়হাত ঠেকিয়ে বললেন, ‘বুঝলেন না স্যার? বুঝতে পারলেন না? তিনি ইষ্টদেবকে শেষ পুজো দিয়ে গেলেন। আহা কি দেখলাম। জীবন ধন্য হয়ে গেল। আপনাদেরও অনেক পুণ্য স্যার…আপনাদেরও অনেক পুণ্য। আপনারাও ভক্তির মহিমা দেখলেন।’

টিটোর তখনো ঘোর কাটেনি। ভ্যাবলার মতন মুখ করে আমার পেছন-পেছন ঘরের বাইরে বেরিয়ে এল। বেরিয়ে এসে দেখলাম, ইতিমধ্যেই আশ্রমের আবাসিকরা মোহন্ত মহারাজের মৃত্যুর খবর পেয়ে ঘরের সামনে ভিড় করে দাঁড়িয়েছেন। তাদের মধ্যে ছোট-ছোট ছেলেরা রয়েছে, যারা এখানে থেকে পড়াশোনা করে। বাইরের ভক্তরা রয়েছেন। রয়েছেন নানান বয়সের সন্ন্যাসীরাও। সকলেরই মুখে শোকের ছায়া।

সাদা ধুতি, বাসন্তী রঙের উত্তরীয়, কপালে চন্দনের ফোঁটা আর গলায় তুলসীর মালা দেখে এই মঠের সন্ন্যাসীদের চিনতে পারা যাচ্ছিল। সেরকমই চারজন সন্ন্যাসী এগিয়ে এসে চাপাগলায় টিটোকে বললেন, ‘একটা অনুরোধ ছিল স্যার।’

টিটো দেখলাম ইতিমধ্যে নিজেকে অনেকটা সামলে নিয়েছে। স্বাভাবিক স্বরেই বলল, ‘বলুন।’

তাঁদের মধ্যে যিনি সবচেয়ে বয়স্ক, তিনি বললেন, অধমের নাম ‘কেদারনাথ বাচস্পতি। এনারা সবাই মিলে আমাকেই পরবর্তী মোহন্ত নির্বাচিত করেছেন। আমিও অরাজি নই। সবই তো প্রভুর কাজ। কিন্তু মোহন্তর সমস্যা হচ্ছে তাকে বৈষয়িক ব্যাপারেও মাথা ঘামাতে হয়। এই এখনই যেমন আমি চিন্তামণির নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা করছি।’

টিটো বলল, ‘কীরকম?’

কেদারনাথ বাচস্পতি বললেন, ‘জানেনই তো, চারঘণ্টার আগে মহারাজের ডেথ-সার্টিফিকেট ইস্যু করা যাবে না। সেরকমই নিয়ম। এই সময়ের মধ্যে আমরা কোনো ভক্তকে এদিকে আসতেও দিচ্ছি না। আগে ডক্টর সেন ডেথ-সার্টিফিকেট ইস্যু করুন। তারপরে যা-যা আচার-অনুষ্ঠান, নামগান, সমাধির প্রস্তুতি সব শুরু করা যাবে।’

টিটো বলল, ‘হ্যাঁ, সেটাই তো ঠিক। কিন্তু আমাকে কী করতে হবে বললেন না তো।’

কেদারনাথ বাচস্পতি বললেন, ‘মোহন্তজি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। কিন্তু তাঁর বুকের ওপরেই এখনো মহামূল্যবান চিন্তামণি বিরাজ করছেন। তাই এই ঘরের সিকিউরিটির জন্যে অন্তত দুজন আর্মড-গার্ডের ব্যবস্থা আপনাকে করে দিতে হবে স্যার।’

‘ঠিক আছে। এখনই করে দিচ্ছি।’ এই বলে টিটো ওর মোবাইলে সৌমেন্দুবাবুকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলে দিল। শুধু তাই নয়, নিজে দাঁড়িয়ে রইল, যতক্ষণ না থানা থেকে আর্মড গার্ড আসে।

ঠিক দাঁড়িয়ে নয়। টিটো, আমি আর চারজন সিনিয়র সন্ন্যাসী ঘরের ভেতরে গিয়েই বসলাম। আমি টিটোর কানে কানে বললাম, ‘এই টিটো! এখন একবার চিন্তামণি দেখা যায় নারে?’

‘নিশ্চয় যায়। ইনফ্যাক্ট, ঘরে তালা দেওয়ার আগে জিনিসটা ঠিকঠাক আছে কিনা সেটা দেখে নেওয়া দরকারও বটে।’

টিটো বলা মাত্রই কেদারনাথ বাচস্পতি প্রয়াত মোহন্তের গায়ের চাদর সরিয়ে, ভেতরের পিরানের বোতামগুলো খুলে দিলেন।

কী বলব! সঙ্গে সঙ্গেই ছায়ায় ঢাকা ঘরটা যেন স্নিগ্ধ এক আলোয় আলো হয়ে উঠল। দেখলাম প্রায় আমলকির সাইজের একটা মুক্তো মোহন্তজির বুকের ওপরে আলো ছড়াচ্ছে।

কেদারনাথবাবু কপালে হাত ঠেকিয়ে চিন্তামণির উদ্দেশে নমস্কার জানিয়ে আবার মোহন্তজির পোশাক-আশাক ঠিক করে দিলেন।

একটু বাদেই থানার জিপ এসে ঘরের সামনে দাঁড়াল আর সেই জিপ থেকে লাফিয়ে নামলেন দুজন আর্মড কনস্টেবল। টিটো আমাদের সামনেই ঘরের জানলাগুলো ভেতর থেকে ভালো করে বন্ধ করে বাইরে বেরিয়ে এল। কেদারনাথবাবু দরজার কড়ায় মস্ত বড় একটা তালা ঝুলিয়ে দিলেন। সেই তালার ওপরে টিটো আবার থানা থেকে নিয়ে আসা একটা তালা লাগিয়ে, নিজের চাবিটা পকেটে পুরে বলল, ‘ঠিক আছে। আমরা তাহলে এখন চলি কেদারবাবু? ডাক্তারবাবু যখন ডেথ সার্টিফিকেট দিতে আসবেন, তখন আমাকে ডাকবেন। আমি এসে তালা খুলে দেব।’

‘গোপীনাথ আপনাদের সবার মঙ্গল করুন।’ কেদারনাথবাবু আর অন্য সন্ন্যাসীরা আমাদের আবার নমস্কার জানালেন। আমরা আশ্রম ছেড়ে বাড়ির দিকে রওনা দিলাম।

যখন টিটোর কোয়ার্টারে ফিরলাম, তখন বেলা গড়িয়ে গেছে। ঘড়িতে দেখলাম আড়াইটে বাজে। স্নান-খাওয়া সেরে দুজনে বাংলোর পেছনের বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসলাম। আমি জিগ্যেস করলাম, ‘এবার কী করবি টিটো?’

‘কী ব্যাপারে?’

‘ওই যে, বিনুর ওপরে অ্যাটাকের ব্যাপারে। ওর হারানো মোবাইলের ব্যাপারে।’

টিটো ভুরু কুঁচকে বলল, ‘সেইটাই তো সারাক্ষণ ধরে ভেবে চলেছি রে, নীল। কিন্তু রাস্তা খুঁজে পাচ্ছি না। একটা কথা তোকে বলা হয়নি, বুঝলি। আজ যখন পোলট্রি-ফার্মে আমাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল, তখন একটা ফোন এসেছিল। ফোন করেছিলেন খড়্গপুরের নিবেদিতা নার্সিং হোমের নিউরোলজিস্ট ডাক্তার সুভদ্র ব্যানার্জি। তাঁর আন্ডারেই বিনু ভর্তি আছে। তিনি জানালেন, বিনু শারীরিকভাবে হান্ড্রেড পার্সেন্ট সুস্থ। কনসাসনেসও যে শিগগিরি ফিরে আসবে সেই লক্ষণও দেখা যাচ্ছে। এগুলো সবই গুড নিউজ।

‘তার সঙ্গেই তিনি একটা দামি কথা বললেন। বললেন কালপ্রিট, মানে যে বিনুর মাথায় বাড়িটা মেরেছিল, সেই লোকটা বেঁটে। এটা তিনি ইনজুরির ধরন দেখে বুঝতে পেরেছেন। বাড়িটা মারা হয়েছিল পেছনদিক থেকে, খুব ভারী কোনো অস্ত্র, মানে এই ধরুন লোহার মোটা রড জাতীয় কিছু দিয়ে। ওই ব্লো ঠিকঠাক মাথার মাঝখানে লাগলে বিনুর বেঁচে থাকবার কথা নয়। বেঁচে যে গেছে তার কারণ আঘাতটা লেগেছে মাথার একটু পেছনদিকে আর তার কারণ কালপ্রিট হাত বাড়িয়ে ওর ব্রহ্মতালুর নাগাল পায়নি। অর্থাৎ লোকটা বেঁটে।’

আমি বললাম, ‘টিটো, আমার মোবাইলে ডক্টর দেবব্রত সেনের একটা ছবি রয়েছে। তাঁকে বুঝতে না দিয়ে আজ দুপুরে তুলেছিলাম। এই ছবিটা তোদের হেডঅফিসে পাঠিয়ে একটু লোকটার সম্বন্ধে খোঁজখবর নিতে পারবি?’

টিটো সোজা হয়ে বসে বলল, ‘এ কি! আমি বেঁটে লোকের কথা বললাম বলেই তুই ডাক্তারবাবুকে সন্দেহ করতে শুরু করলি নাকি?’

আমি বললাম, ‘ধরে নে তাই। তবু তুই একটু চেষ্টা করে দেখ। কারণ আছে বলেই বলছি।’

‘বেশ। ছবিটা আমাকে হোয়াটসঅ্যাপ করে দে। সল্টলেকের পুলিশ ইনফর্মেশন বিউরোতে আমার ব্যাচমেট ফিরদৌস রয়েছে। যদি পুলিশের খাতায় ডাক্তারবাবুর নাম থাকে, তাহলে সেই ডিটেইলস আমার হাতে পৌঁছতে দেরি হবে না।’

আমি বাইরে বেড়াতে-টেড়াতে বেরোলে ফোনের নেট-কানেকশন অফ করে রাখি। ভার্চুয়াল-ওয়ার্ল্ড যেন চারপাশের সত্যিকারের পৃথিবীটাকে ভুলিয়ে না দেয়, সেইজন্যেই আর কি। এখন টিটোকে হোয়াটসঅ্যাপ করার জন্যে কলকাতা ছাড়ার আটচল্লিশ ঘণ্টা বাদে নেট অন করলাম। পাঠিয়েও দিলাম ছবিটা। ছবিটা সেন্ট হবার আগেই ঝিলমিল করে গত দুদিনে জমে থাকা নানারকমের মেসেজ আমার হোয়াটঅ্যাপের মেসেজ-বক্সে ঢুকতে শুরু করেছিল। দেখব না দেখব না করেও দু-একটায় চোখ বোলাতে গিয়ে দেখলাম, একটা অজানা নম্বর থেকে একটা ছবি আর টেক্সট এসেছে। ডাউনলোড করে চোখ বোলাতে শুরু করলাম।

নম্বরটা যে বিনুর ফোনের নম্বর সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। আর সেন্ট-টাইম যা দেখাচ্ছে তাতে বুঝলাম, মেসেজগুলো ও পাঠিয়েছিল গতকাল সন্ধেবেলায়, আমার কাছে বকুনি খাওয়ার পরেই। হয়তো রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতেই কী বোর্ডে কথাগুলো টাইপ করেছিল।

আগে টেক্সট-মেসেজে বিনু যা লিখেছিল সেটাই পড়লাম—

‘স্যার। আমি কিন্তু সত্যিই ফোটো এডিটিং করে কুমোরেপোকার বাসার শেপ বদলাইনি। সত্যিকথা বলছি, ওরকম কিছু করতে গেলে যে অ্যাপস লাগে তা আমার নেই। তবে ছবিগুলোকে ক্রপ করেছিলাম। সে তো করতেই হবে। না হলে বাসাটাকে বড় করে দেখাবো কী করে? এখন একটা আনক্রপড ছবি পাঠালাম। আমার মনে হয় ছবির লোকটার সঙ্গে কুমোরেপোকার অদ্ভুত বাসাটার কোনো সম্পর্ক রয়েছে।’

এইটুকুই বিনু লিখেছে। এরপরে ছিল একটা ছবি। এখানেও ফোর-ফ্রন্টে কুমোরেপোকার বাসা। পোকাটাও রয়েছে। কিন্তু ছবির মধ্যে একজন মানুষও রয়েছেন। সদ্য আলাপ হয়েছে তাঁর সঙ্গে। চিনতে তাই কোনো অসুবিধে হল না। ডক্টর দেবব্রত সেন। তাঁর সামনের দিকে বাড়িয়ে রাখা হাতদুটোয় একটা জয়স্টিক ধরা রয়েছে। যেরকম জয়স্টিক দিয়ে বাচ্চারা রিমোট কন্ট্রোলড গাড়িটাড়ি চালায়, সেইরকম।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমি কী-প্যাডে রিপ্লাই টাইপ করলাম—

‘তোমার কথা না শুনে ভুল করেছি, বিনায়কবাবু। যদি শুনতাম, তাহলে হয়তো গোপীমঠের মহান্ত মহারাজ আরও কিছুদিন বেঁচে থাকতেন। তুমি তাড়াতাড়ি সেরে ওঠো। তারপর তোমাকে আমি কচ্ছের রানে ফ্লেমিংগো পাখির কলোনি দেখাতে নিয়ে যাব। প্রমিস।’

তারপর রিপ্লাইটা না পাঠিয়ে ডিলিট করে দিলাম। জানি না বিনুর মোবাইল এখন কার কাছে রয়েছে। সে যদি কোনোভাবে ওর হোয়াটসঅ্যাপ অ্যাকাউন্টে ঢুকতে পারে তাহলে এই রিপ্লাই পড়ে আমার মাথাতেও ডান্ডা বসাবার একটা বিচ্ছিরি ইচ্ছে তার মনে জাগতেই পারে।

টিটো অন্যমনস্কভাবে নদীর দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবছিল। ওকে বিনুর মেসেজের ব্যাপারে কিছু বললাম না। আমি অপেক্ষায় বিশ্বাসী, কিন্তু টিটো চিরকালই ছাতা নিয়ে ঝাঁপানোর দলে।

.

সন্ধে ছ’টার সময় টিটোর মোবাইলে নতুন-মহান্ত কেদারনাথ বাচস্পতির বিনীত অনুরোধ ভেসে এল, ‘স্যার, চারঘণ্টা কেটে গেছে। ডক্টর সেন চলে এসেছেন। যদি এবার ঘরটা খুলে দেন।’

ইউনিফর্মের টুপিটা মাথায় ঠিক করে বসাতে বসাতে টিটো আমাকে বলল, ‘চল নীল। ঘুরে আসি।’

টিটো মোহন্ত মহারাজের ঘরের সামনে পৌঁছে প্রথমেই কড়া নজরে দেখে নিল আর্মড কনস্টেবল দুজন ঠিকঠাক ডিউটি দিচ্ছেন কিনা। দিচ্ছেন যে, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। আমি একটু এগিয়ে যেতেই তাঁদের মধ্যে একজন আমাকে বন্দুকের নল দেখিয়ে চলে যেতে ইশারা করলেন। টিটো হাত তুলে বলল, ‘ঠিক আছে সওদাগর। তিনি আমার বন্ধু।’

এরপর টিটো পকেট থেকে চাবি বার করে পুলিশী তালাটা খুলে একজন কনস্টেবলের জিম্মায় দিয়ে দিল। ওর দায়িত্ব শেষ।

সমস্ত সময়টাই আমাদের সঙ্গে সঙ্গে রইলেন সবচেয়ে সিনিয়র চারজন সাধু, যাদের মধ্যে একজন হচ্ছেন কেদারনাথ বাচস্পতি। আর ছিলেন ননীগোপালবাবু, মহান্তের সেবক। আরও একজন নির্বিকার মুখে একটু দূর থেকে সবকিছু লক্ষ করছিলেন। তিনি ডক্টর দেবব্রত সেন। কেদারনাথবাবু নিজের তালাটা খুলে ফেলার পরেই তিনি হাসতে হাসতে টিটোকে জিগ্যেস করলেন, ‘আমি কি তাহলে এবার প্রভুজিকে এগজামিন করতে পারি?’

এই পরিবেশে তাঁর মুখের ওই হাসিটা দেখে আমার কেমন যেন গা শিরশির করে উঠল। আমি মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। টিটো অবশ্য একইরকম নির্বিকার মুখে বলল, ‘হ্যাঁ, চলুন। সবাই মিলেই ভেতরে যাই।’

ডক্টর সেন দেখলাম ভারি চটপটে লোক। যন্ত্রের মতন সবক’টা ক্লিনিকাল এগজামিনেশন পরপর সেরে নিয়েই অ্যাটাচি খুলে নিজের রাইটিং-প্যাড বার করলেন। দ্রুত ডেথ-সার্টিফিকেট লিখে ননীবাবুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বললেন, ‘ননীবাবু! এটা নিয়ে কিন্তু তিনবারের ভিজিট বাকি রইল।’ যাবার আগে অবশ্য একবার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মুখের পার্মানেন্ট হাসিটাকেই আরেকটু চওড়া করলেন। আজ সকালেই যে আমাকে দেখেছিলেন, তারই স্বীকৃতি আর কী।

কেদারনাথবাবু টিটোকে ডাকলেন, ‘স্যার!’

‘বলুন।’

‘বলছিলাম কি, এই ঘরে তো আগামী কয়েকঘণ্টা বেশ ডামাডোল চলবে। শয়ে-শয়ে ভক্তরা আসবেন শেষ নমস্কার জানাতে। তাই আমরা আলোচনা করে স্থির করলাম, চিন্তামণিকে এই ঘর থেকে অফিসঘরের আয়রন-চেস্টের মধ্যে নিয়ে গিয়ে রাখব। এই যাবার পথটুকুতে যদি একটু আপনি এবং আপনার ওই দুজন অস্ত্রধারী আমাদের সঙ্গে থাকেন। কার মনে যে কী আছে তা তো বলা যায় না।’

টিটো বলল, ‘সে আর বলার কী আছে? চলুন, আমি আপনাদের প্রোটেকশন দিয়ে নতুন বাড়িতে পৌঁছে দিচ্ছি। এই সওদাগর! দরজার বাইরে দাঁড়াও। আর কেউ যেন এখন এই ঘরে না ঢোকে।

কেদারনাথবাবু আজ সকাল থেকে এই নিয়ে দ্বিতীয়বার শায়িত মহান্ত মহারাজের শরীরের চাদর সরিয়ে তাঁর পিরানের বোতাম খুললেন। তারপর বেশ কিছুক্ষণ ধরে মোহন্ত মহারাজের বুকের দিকে গোল গোল চোখ করে তাকিয়ে থেকে, তাঁর পায়ের কাছেই ধপ করে বসে পড়লেন। কেদারবাবুর ছাইয়ের মতন ফ্যাকাসে মুখটা দেখে মনে হচ্ছিল, তিনি আর বেশিক্ষণ বসে থাকতেও পারবেন না; এক্ষুনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবেন। আর তা যদি যান, তাহলে তাঁকে খুব একটা দোষও দিতে পারব না। আমার নিজের মাথাটাও কেমন যেন ঝিমঝিম করছিল। অন্য সকলের মতন আমিও পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম মোহন্ত মহারাজের গলায় সোনার চেনটা নেই।

বলাই বাহুল্য, সেই চেনের সঙ্গে গাঁথা কোটি টাকার চিন্তামণিও হাওয়া!

পাঁচ

সন্ধে সাতটার মধ্যেই মোহন্ত মহারাজের সৎকারের কাজ শেষ হয়ে গেল। আশ্রমের বিরাট বাগানের এক কোনে, ভূতপূর্ব মোহন্তদের সমাধিস্থলের একপাশে, তাঁকে সমাধিস্থ করা হল। আপাতত সেখানে রইল ফুলে ফুলে ঢাকা কাঁচা মাটির একটা স্তূপ। পরে নিশ্চয়ই জায়গাটা মার্বেল পাথরে বাঁধিয়ে দেওয়া হবে, যেভাবে আগের মোহন্তদের সমাধিস্থলও বাঁধিয়ে দেওয়া হয়েছে।

বাইরে থেকে দেখলে যে কারোর মনে হবে সবকিছুই সুষ্ঠুভাবে শেষ হল। মানুষ জন্মায়, মানুষ মারা যায়। পৃথিবী একইভাবে চলতে থাকে। এক মোহন্ত দেহ রেখেছেন, আরেক মোহন্ত তাঁর জায়গায় অভিষিক্ত হবেন। গোপীমঠের আশ্রমও আগের মতনই চলবে। ভোরবেলায় ছোট ছোট আশ্রমিক বালকরা নামগান গাইতে গাইতে মন্দির প্রদক্ষিণ করবে। তাদের ছোট ছোট হাতের চাপড়ে বেজে উঠবে ছোট ছোট মৃদঙ্গ, করতাল। মেয়েরা ফুল তুলবে, মালা গাঁথবে। দেড়শো-বছরের প্রাচীন মন্দিরে সোনার রাধাকৃষ্ণের নিত্যপূজা হবে। নিস্তব্ধ দুপুরে মন্দিরের ফাঁকা চাতালে বকবকুম করে আলোচাল খুঁটে খাবে পায়রা, চড়াই।

কিন্তু শুধু আমরা কয়েকজন জানি, এই সব শান্তির ছবির পেছনে এক ভীষণ অশান্তির মেঘ ঘনিয়ে উঠছে। অমূল্য চিন্তামণির খোঁজ না মিললে সেই মেঘ থেকে বিদ্যুৎ ছুটবে শিগগিরি। আগুন জ্বলবে গোপীমঠের মন্দিরে।

টিটোর মুখে দুশ্চিন্তার মেঘ আরও ঘন হয়ে উঠেছিল। একই অবস্থা হয়েছিল কেদারনাথ বাচস্পতি, মানে নতুন মোহন্তর। চিন্তামণির খোঁজ না পাওয়া গেলে এই দুজনকে কেউ ছাড়বে না, কারণ প্রয়াত মোহন্তের ঘরের দুটো তালার দুটো চাবি ওই দুজনের কাছেই ছিল। ওরা দুজনে ষড়যন্ত্র করে একসঙ্গে সেই দুটো তালা না খুললে বন্ধ ঘরের মধ্যে থেকে চিন্তামণির লকেট শুদ্ধ সোনার হার উধাও হবে কেমন করে?

ননীগোপালবাবু অবশ্য ইতিমধ্যেই অনেকবার বলবার চেষ্টা করেছিলেন, চিন্তামণি উধাও হয়েছে দৈবী কারণে। কেন, যোগবাশিষ্ঠতে কি বলা নেই যে পৃথিবীতে পাপ বাড়লে পবিত্র চিন্তামণি হারিয়ে যাবে। আবার উপযুক্ত সময়ে সেই মণি নিজের থেকেই ফিরে আসবে উপযুক্ত হাতে।

তিনি আমাকে আর টিটোকে সাক্ষী মেনেছিলেন। বলেছিলেন, ‘আপনারাই বলুন না স্যার, আজ দুপুরে কী দেখেছিলেন। মোহন্ত মহারাজ মৃত্যুর পরেও কেমন নিজের ডান হাতখানা তুলে ধরেছিলেন, বলুন না এনাদের। আমরা মূর্খ তাই বুঝতে পারিনি। তিনি আসলে তখন ভগবান বিষ্ণুকে বলছিলেন—ফিরিয়ে নাও তোমার কণ্ঠহার। বলুন না সে কথা এনাদের।’

ননীগোপালবাবু যখন ওইসব কথা বলছিলেন, তখন আমি আড়চোখে অন্য তিনজন সন্ন্যাসীর মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম। কিন্তু তাঁদের চোখের ভাষায় অলৌকিকে বিন্দুমাত্র বিশ্বাসের কোনো লক্ষণ খুঁজে পাইনি। বরং ভয়ঙ্কর অবিশ্বাস আর ঘৃণাই দেখতে পেয়েছিলাম। বুঝতে পারছিলাম, মোহন্ত মহারাজের পারলৌকিক কাজ শেষ হলে ওই তিনজন বয়োজ্যেষ্ঠ সন্ন্যাসীই সবার আগে কেদারনাথ আর ও.সি. সাহেবকে আক্রমণ করবেন। বলবেন, ওঁরা দুজনে মিলে চিন্তামণি সরিয়েছেন। আর টিটোর দিকে আঙুল তোলার অন্য একটা বড় কারণ তো রয়েইছে। যে দুজন আর্মড কনস্টেবল মোহন্ত মহারাজের ঘর সারাক্ষণ পাহারা দিচ্ছিলেন, তারা টিটোর অধস্তন কর্মী। তাদের কিছুক্ষণের জন্যে ওখান থেকে সরিয়ে দেওয়া টিটোর কাছে কিছুই নয়।

যদিও আমি জানি, সেসব কিছুই নয়। আমি সারাক্ষণ টিটোর সঙ্গেই ছিলাম।

টিটোর মুখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না। ও খুব ভালো করেই বুঝতে পারছিল যে, ওর কেরিয়ারে খুব পাকা রঙের কালি লাগতে চলেছে, এবং সেটাও একেবারেই বিনা দোষে। কিন্তু যে ব্যাপারটা ওকে সবচেয়ে বেশি যন্ত্রণা দিচ্ছিল সেটা হচ্ছে চিন্তামণির অন্তর্ধান রহস্য। ও কেবলই দু-হাতের মধ্যে মুখ গুঁজে আপনমনে বলে যাচ্ছিল, ‘এ কীভাবে সম্ভব বল তো নীল। কীভাবে বন্ধ ঘরের মধ্যে থেকে জিনিসটা উধাও হয়ে যেতে পারে? যখন এনকোয়ারি হবে তখন আমি কেমন করে কাউকে এ কথা বলব, যে কথা আমি নিজেই বিশ্বাস করি না।’

আমি টিটোকে দেখে কষ্ট পাচ্ছিলাম, কিন্তু ওকে বলতে পারছিলাম না যে, যাকে তুই অলৌকিক ভাবছিস তার মধ্যে অলৌকিকত্ব কিছু নেই রে টিটো। রয়েছে এক গভীর বদমাইশি।

আমি জানি, কুমোরেপোকাটা যখন বাসা বাঁধছিল, তখন জয়স্টিক হাতে নিয়ে যিনি পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি ডক্টর দেবব্রত সেন ছাড়া আর কেউ নন। জানি, ডক্টর দেবব্রত সেনের ঘরে একটা রাডার-মনিটর রয়েছে আর সেই মনিটরের স্ক্রিনে ছায়া ফেলছে পিঁপড়ে, কুমোরেপোকা, গোসাপ আর বাঁদর। অর্থাৎ নীচু থেকে শুরু করে উঁচু গোত্রের কিছু প্রাণী। পোকা আর পশুগুলো স্বাভাবিক নয়। তারা প্রত্যেকেই এমন কিছু কাজ করে যা প্রকৃতিবিরুদ্ধ।

আর আমি যেটা জানতাম না, কিন্তু আন্দাজ করেছিলাম, সেটা একটু আগেই সল্টলেক পুলিশ ইনফর্মেশন ব্যুরোর ইনস্পেক্টর ফিরদৌস চৌধুরীর কথায় কনফার্মড হয়েছে। তিনি টিটোকে মেল করে জানিয়েছেন, এই গোপীমঠে যিনি ডাক্তার দেবব্রত সেন বলে নিজের পরিচয় দিচ্ছেন, তাঁর আসল নাম ডক্টর বেদাংশু সিনহা। ডাক্তার নন, ডক্টরেট। চিকিৎসক নন, এক আমেরিকান ইউনিভার্সিটির প্রাক্তন গবেষক।

মাইক্রো-ফিজিক্সের সেই উজ্জ্বল ছাত্র, পরিণত বয়সে হঠাৎই মাইক্রো-বায়োলজির দিকে ঝুঁকে পড়েছিলেন। সচরাচর এমনটা দেখা যায় না, তবে ডক্টর বেদাংশু সিনহা মনে করেছিলেন, তিনি যা করতে চাইছেন তার জন্যে ওই দুটো বিষয়েই অধিকার থাকা দরকার—মাইক্রো-ফিজিক্স এবং মাইক্রো-বায়োলজি। প্রাণ এবং নিষ্প্রাণের দুই লিলিপুট-দুনিয়ায় দু’পা রেখে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন।

এই করতে গিয়েই বোধহয় তাঁর পা টলে গিয়েছিল। যে কাজ তিনি করতে চাইছিলেন, কোনো কারণে ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ তাতে সম্মতি দিতে নারাজ হন। তখন তিনি লুকিয়ে তাদের ল্যাবরেটরি ব্যবহার করেন। গবেষণার খরচ তোলার জন্যে ইউনিভার্সিটির ফান্ড নয়ছয় করেন এবং ল্যাবরেটরির বেশ কিছু দামি যন্ত্রপাতি কোথায় যে সরিয়ে ফেলেন, আজও কেউ তার হদিশ পায়নি।

এতেই শেষ নয়। সব শেষে তিনি একটা খুন করেন। হ্যাঁ, এমন একজন সহকর্মীকে বিষ খাইয়ে মারেন, যিনি তাঁর বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া এনকোয়ারি-কমিটির নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন।

এফ.বি.আই. তাঁকে গ্রেপ্তার করার ঠিক আগের মুহূর্তে ডক্টর বেদাংশু সিনহা আমেরিকা ছেড়ে পালিয়ে যান। এটা পাঁচবছর আগের কথা। তারপর তিনি যে কোথায় গা ঢাকা দেন, এতদিন কেউ তার হদিশ পায়নি। শেষ পর্যন্ত আমেরিকা এবং ভারত দু-দেশের তদন্তকারী অফিসারেরাই ধরে নিয়েছিলেন, উন্মাদ সেই বৈজ্ঞানিক বেঘোরে কোনো বনে-পাহাড়ে কিম্বা জলের স্রোতে প্রাণ হারিয়েছেন। তাঁর মৃতদেহটা হয়তো কোনো একদিন খুঁজে পাওয়া যাবে।

তিনি যে বহাল তবিয়তে গোপীমঠ নামে এক অখ্যাত জায়গায় চিকিৎসক সেজে বসে আছেন তা কে জানবে?

আমি যতক্ষণে টিটোর ল্যাপটপ থেকে মেলটা পড়লাম, তারমধ্যেই টিটো খুব দ্রুত ওর ফোন থেকে সৌমেন্দুবাবুকে কীসব যেন অর্ডার দিয়ে গেল। আমি পুরো মেসেজটা তিনবার আদ্যোপান্ত পড়ে ওর দিকে মুখ তুলে তাকালাম। টিটো বলল, ‘ক্রিমিনালটার পেছনে ওয়াচম্যান লাগিয়ে দিলাম। ও আর পালাতে পারবে না। আরকটা কথা। তুই লোকটাকে সন্দেহ করেছিলিস মানে তোর কাছে ডেফিনিট কোনো ইনফরমেশন আছে, যেটা আমি জানি না। সেটা কী?’

মুচকি হেসে বললাম, ‘আজি রজনীতে হয়নি সময়। মানে, এখনি তোকে এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারব না।’

‘তাহলে আমি নিজের মতন করে এগোই? লোকটাকে থানায় তুলে এনে থার্ড ডিগ্রি দিয়ে পেট থেকে কথা বার করি?’

আমি বললাম, ‘তুই এই থানার হর্তাকর্তা-বিধাতা। আমি বারণ করার কে? আর ডক্টর বেদাংশু সিনহা আজ হোক, কাল হোক, গরাদের মধ্যে ঢুকবেনই। দুদিন আগে যদি ঢোকাস তাতে এমনিতে কোনো ক্ষতি নেই। কিন্তু একটা প্রশ্নের উত্তর দে তো। তাঁর কাছে তুই কী জানতে চাইবি? যে ঘরের চাবি ছিল তোর কাছে, সেই ঘরের মধ্যে থেকে একটা জেম কেমন করে উধাও হল? ব্যাপারটা একটু বোকা-বোকা হয়ে যাবে না? পরে সামলাতে পারবি তো?’

টিটো অগ্নিদৃষ্টিতে আমার দিকে চাইল। কিন্তু আমি কী বলতে চাইছি সেটা বুঝতে পেরেই ও আবার দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেলল। আমি ওর পাশে দাঁড়িয়ে, কাঁধে হাত রেখে বললাম, ‘এত ভেঙে পড়িস না টিটো। শোন। চিন্তামণি কোথায় রয়েছে সেটা বোধহয় আমি জানি। কিন্তু সেটা তুই বা আমি এখনই নিজেদের হাতে নিয়ে আসতে পারব না। তার জন্যে আরও একটু সময় দরকার।’

‘কতটা সময়?’ দারুণ উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে উঠল টিটো।

আমি বললাম, ‘আজ রাতটুকু। কাল সকালের মধ্যে তুই একটা সাধারণ কুমোরেপোকা কেন হার্টশেপের বাসা বানায় তার উত্তর পেয়ে যাবি। বিনুর আক্রমণকারীকে পেয়ে যাবি। আর সবচেয়ে বড় কথা, হারানো চিন্তামণি আবার নিজের জায়গায় ফিরে আসবে। কাল সকালের মধ্যে।’

কথাগুলো আমি এতটাই জোরের সঙ্গে বললাম যে, টিটোর মুখ থেকে তক্ষুনি দুশ্চিন্তার মেঘ কেটে গেল। ও বলল, ‘তুই শুধু বল, তার জন্যে আমাকে কী করতে হবে।’

যা-যা করতে হবে সেই সবই ওকে বুঝিয়ে বলে দিলাম। এরপর শুধু অপেক্ষার পালা।

.

অপেক্ষাই করছিলাম—মন্দিরের বাগানে সেই সমাধিস্থলে।

দিনের বেলায় যে-জায়গা ফুলের মালায়, ধূপের গন্ধে, কীর্তনের সুরে শান্ত আর পবিত্র ছিল, এখন রাত দুটোর সময় সেই একই জায়গার চরিত্র যে কি অদ্ভুতভাবে বদলে গিয়েছে, দেখলে অবাক লাগে।

এখন চারিদিকে শুধু জমাট অন্ধকার। পাঁচিলের বাইরের একটা ল্যাম্পপোস্ট থেকে কিছুটা আলো ছিটকে এসে মোহন্ত মহারাজের কাঁচা মাটির কবরের ওপরে পড়েছিল। সেই আলোর ওপরেও নড়াচড়া করছিল অসংখ্য গুলঞ্চপাতার ছায়া। মনে হচ্ছিল কতগুলো কালো কালো সরীসৃপ যেন সমাধির ওপরে বুকে হেঁটে চলেফিরে বেড়াচ্ছে।

আমি আর টিটো একটা ঝোপালো জবাগাছের আড়ালে গুঁড়ি মেরে বসেছিলাম। এরকম শুধু আমরাই নই, প্রায় প্রত্যেকটা ঝোপের পেছনেই এক-দুজন করে পুলিশের লোক গা ঢাকা দিয়ে রয়েছে।

রাত আড়াইটের একটু পরে তিনি এলেন—ডাক্তার দেবব্রত সেন।

স্যরি। বলা উচিত, ডক্টর বেদাংশু সিনহা।

তাঁর চলাফেরার মধ্যে কোনো আড়ষ্টতা কিম্বা ভয়ের লক্ষণ দেখলাম না। এমনকী মনে হল, তাঁর ঠোঁটের কোনে সেই চিরস্থায়ী হাসিটাও যেন লেগে রয়েছে।

ডক্টর সিনহা যখন মোহন্ত মহারাজের সমাধির পাশে এসে দাঁড়ালেন, তখন আরও একটা জিনিস দেখলাম। দেখলাম, তিনি দু-হাতের মুঠোয় একটা জয়স্টিক ধরে রয়েছেন। যেহেতু আমি জানতাম, ওই জয়স্টিক কোনো শিশুর খেলনাকে রিমোট কন্ট্রোলে চালাবার যন্ত্র নয়, বরং ওই জয়স্টিক মৃত্যুকে চালনা করে, তাই আমার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল। আমি কিছুতেই সেই ভয়কে আটকাতে পারলাম না।

সমাধিস্থলকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা মহাকায় তেঁতুলগাছগুলোর কোনো একটার কোটরের ভেতর থেকে একটা প্যাঁচা হঠাৎই কি জানি কেন প্রবল চিৎকার শুরু করল। সেই চিৎকার যখন শেষ হল, তখন বুঝতে পারলাম, অন্য একটা শব্দ ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। এই শব্দটা মৃদু। গম্ভীর। অনেকটা হৃৎপিণ্ডের লাবডুবের মতন তালে তালে মাটির নীচ থেকে উঠে আসছে সেই শব্দ। ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে। ক্রমশ আমাদের পায়ের তলার মাটিতেও ছড়িয়ে পড়ছে সেই শব্দের অনুরণন।

টিটো অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকাল। আমি ঠোঁটে আঙুল রেখে ইশারায় ওকে চুপ করতে বললাম।

ডক্টর বেদাংশু সিনহার দিকে তাকালাম। অন্ধকারে ভালো বোঝা যাচ্ছিল না, কিন্তু মনে হল তিনি কবরের ঠিক পাশে দাঁড়িয়ে হাতের জয়স্টিকের বোতামগুলো খুব দ্রুত নাড়াচাড়া করছিলেন। কিছুক্ষণ পরেই তিনি উৎকট এক কৌতূহলে এমনভাবে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়লেন, যাতে মনে হল তিনি বোধহয় কবরের কাঁচামাটির গন্ধ শুঁকছেন।

শব্দটা হঠাৎই থেমে গেল। কবরের ভেতর থেকে উঠে এল একটা হাত। তারপর আরেকটা। মাটির পাড়ের ওপর দুহাতের চাপ দিয়ে এরপরে উঠে এল মোহন্ত মহারাজের শবদেহ। পুরোটা নয়, কোমর পর্যন্ত।

ডক্টর সিনহা তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেলেন সেই জীবন্ত মৃতদেহের দিকে। তারপর একটা ছোট ক্যানভাসের ব্যাগ বাড়িয়ে দিতেই সেই মৃতদেহ নিজের মুখ থেকে যে জিনিসটা বার করে বেদাংশু সিনহার ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল সেটা এই অন্ধকারের মধ্যেও চিনতে কোনো অসুবিধে হল না—চিন্তামণির মালা। অন্ধকারের মধ্যে একপলকের জন্যে স্নিগ্ধ নীল দ্যুতি ছড়িয়ে সেই আশ্চর্য মুক্তো হারিয়ে গেল ডক্টর সিনহার ব্যাগের মধ্যে। ডক্টর সিনহা ব্যাগটাকে ট্রাউজারের পকেটের মধ্যে ঢুকিয়ে আবার জয়স্টিক নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। মোহন্ত মহারাজের শবদেহ ধীরে ধীরে নরম মাটি ভেদ করে কবরের ভেতরে নামতে শুরু করল।

টিটো কোনো ভুল করল না। রাতের নৈঃশব্দ্য ভেদ করে ওর ঠোঁটের হুইশল বার বার বেজে উঠল। চারিদিক থেকে অন্তত দশজন অস্ত্রধারী পুলিশ ছুটে এসে ঘিরে ফেলল ডক্টর সিনহাকে। সার্চলাইটের আলোয় আলো হয়ে উঠল সমাধিস্থল। পুরোনো ইটের পাঁচিল, তেঁতুল গাছের গুঁড়ি, ছড়িয়ে থাকা ফুলের পাপড়ি আর পোড়া ধূপকাঠি—সবকিছুই পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল। আর এই সবকিছুর কেন্দ্রে কাচের মতন চোখ, মৃত্যুহিম মুখ আর কাদায় মাখামাখি শরীর নিয়ে বসেছিলেন মোহন্ত মহারাজ। ডক্টর সিনহার জয়স্টিকের আশ্চর্য কন্ট্রোলে তাঁর শরীর আবার অসাড় হয়ে গেছে—একজন মৃতমানুষের শরীর যেমন হওয়া উচিত।

অল্প কিছুক্ষণের জন্যে আমার মনে বোধহয় জয়ের আনন্দ জেগে উঠেছিল। জেগে উঠেছিল সাফল্যের অহঙ্কার। সেইটাই ভুল হয়েছিল। ডক্টর সিনহার মুখের অমানুষিক হাসিটার দিকে চোখ পড়তেই মনে পড়ল একটা বড় জিনিস ভুলে গেছি। ভুলে গেছি যে, বিনু বলেছিল ওর চোখের সামনেই কুমোরেপোকাটা জ্বলে গিয়েছিল, যেভাবে আতশকাচের নীচে ধরে থাকা দেশলাইকাঠি জ্বলে ওঠে। আমি চিৎকার করে উঠলাম—‘টিটো! জয়স্টিক!…তাঁর হাত থেকে জয়স্টিকটা কেড়ে নে!’

কিন্তু ততক্ষণে বড্ড দেরি হয়ে গেছে। আমাদের সবার চোখের সামনেই রংমশালের মতন রুপোলি আগুন ছড়িয়ে দাউদাউ করে জ্বলে উঠল মোহন্ত মহারাজের মৃতদেহ। কি বীভৎস সেই আগুনের আঁচ! আমরা সকলেই সেই আঁচ থেকে বাঁচতে পিছিয়ে দাঁড়ালাম। যখন সেই আগুন নিভলো, তখন মোহন্ত মহারাজের শবদেহের আর কোনো চিহ্ন নেই। ছাই ছড়িয়ে রয়েছে চতুর্দিকে।

.

এর পরে বলার মতন আর সামান্য কথাই বাকি থাকে।

নতুন মোহন্ত কেদারনাথ বাচস্পতির অভিষেক অনুষ্ঠানে তাঁর গলায় চিন্তামণির হার পরিয়ে দিয়ে আমার ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে একগাল হেসেছিলেন ননীগোপালবাবু।

পোলট্রি ফার্মের মালিক বিবেক অগস্থি কলকাতা থেকে সেদিনই ছুটে এসেছিলেন গোপীমঠে। তার সংস্থার ছায়ায় বিষাক্ত ছত্রাকের মতন যেভাবে ডক্টর বেদাংশু সিনহা বেড়ে উঠেছিলেন তা দেখে তিনি কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিলেন।

ডক্টর সিনহাকে আপাতত নিয়ে যাওয়া হয়েছে কলকাতায় লালবাজারে। পরে আন্তর্জাতিক আইনে তাঁর বিচার হবে। আমেরিকায় তাঁর নামে খুনের মামলা চলছে।

এরপরেও আরও কয়েকটা দিন আমাকে গোপীমঠে থেকে যেতে হয়েছিল। টিটো বলেছিল, এই চিন্তামণি রহস্যের পুরো রিপোর্টটা ওকে ডিকটেশন দিতে হবে। ও এখনো অনেক কিছুই বুঝতে পারছে না।

পুরোটা না হোক, মূল পয়েন্টগুলো আমি ধরিয়ে দিয়েছিলাম।

বলেছিলাম, যে-কোনো প্রাণীর শরীর একটা অসাধারণ যন্ত্র। প্রকৃতির নিজের হাতে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে গড়ে-ওঠা সেইসব দেহযন্ত্রের এফিশিয়েন্সির সঙ্গে আজও মানুষের তৈরি কোনো যন্ত্র পাল্লা দিতে পারে না। ডক্টর সিনহা সেই দেহযন্ত্রগুলোকে যন্ত্রের মতনই ব্যবহার করছিলেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ওই পিঁপড়ে, ওই কুমোরেপোকা, গোসাপ কিম্বা বাঁদর প্রত্যেককেই তিনি প্রথমে খুন করেছিলেন। তারপর মৃতদেহের মধ্যে তাঁর আবিষ্কৃত চীপস ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। তখন তিনি রাডার-কন্ট্রোলের মাধ্যমে ওই দেহযন্ত্রগুলোকে দিয়ে নিজের ইচ্ছেমতন কাজ করাতে পারতেন।

হাত পাকানোর সময়টাতে তিনি একদম সরল দেহযন্ত্র বেছে নিয়েছিলেন—পিঁপড়ে। সেই পরীক্ষা সফল হওয়ার পরে আরেকটু জটিলতার দিকে ঝুঁকেছিলেন—কুমোরেপোকা। সেই যন্ত্রচালিত মৃত-পতঙ্গকে তিনি বোধহয় মজা করেই হার্ট শেপের বাসা বানাতে শিখিয়েছিলেন, যেমন তার আগে পিঁপড়েকে শিখিয়েছিলেন সোনার কুচি কুড়িয়ে আনার কাজ।

এই নির্জন গোপীমঠে নদীর চরায় কয়েকটা পিঁপড়ের ঘোরাফেরার ওপরে যে কারোর নজর পড়তে পারে, সেটা তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি। এও ভাবেননি যে, কুমোরেপোকার আশ্চর্য বাসা কারোর চোখে পড়ে যাবে। কিন্তু তাঁর কপাল খারাপ, বিনায়ক মুখার্জি বলে এক প্রকৃতিপ্রেমী কিশোরের সামনে পড়ে গেল সেই কুমোরেপোকার উড়ন্ত মৃতদেহ। সেটাকে মৃতদেহ বলে চিনতে না পারলেও বিনু তার হার্টশেপের বাসা বানানোর ছবি তুলে রাখল এবং একইসঙ্গে সেইসব ছবির ফ্রেমে ধরা পড়ে গেলেন ডক্টর সিনহা নিজেও। বিনুর এই কীর্তি ডক্টর সিনহার চোখ এড়াল না। তিনি ঠিক করলেন বিনুকে খুন করে ওর মোবাইল লোপাট করে ফেলবেন।

মোবাইল ছিনতাই করলেন ঠিকই, তবে বিনু প্রাণে বেঁচে গেল। হ্যাঁ। তাঁর ঘর তল্লাশি করে পুলিশ বিনুর মোবাইল খুঁজে পেয়েছে।

তবে পিঁপড়ে, কুমোরেপোকা কিম্বা গোসাপ—এই সবই ছিল আসল নাটকের রিহার্সাল মাত্র। গোপীমঠের আশ্চর্য মুক্তোর খোঁজ কবে কীভাবে তিনি পেয়েছিলেন বলতে পারব না, তবে প্রথম থেকেই ডক্টর বেদাংশু সিনহার মূল লক্ষ্য ছিল ওই মুক্তো চুরি করা।

গবেষণা শেষ করতে এবং নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য মামলা লড়তে তাঁর নিশ্চয় অনেক টাকার প্রয়োজন ছিল। ওই একটা চিন্তামণিই তাঁকে সেই টাকা তুলে দিতে পারত। সেইজন্যেই তিনি মুক্তোটা হাতে পাওয়ার জন্যে অমন মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। তাছাড়া আমার ধারণা, ডক্টর সিনহা ছিলেন মানসিক রোগগ্রস্ত মানুষ। তাঁর ঠোঁটের কোণে লেপটে-থাকা হাসি দেখলে তাই মনে হয়। সাইকোপ্যাথ কিলার। খুন করতে যে তাঁর হাত কাঁপত না, সে তো বিনুর ওপরে আক্রমণের ধরন দেখলেই বোঝা যায়।

মহান্ত মহারাজকে খুন করার জন্যে তিনি অবশ্য অনেক আগে থেকেই আটঘাট বেঁধেছিলেন। পোলট্রি-ফার্মের মতন সংস্থাগুলোতে রেসিডেন্ট ফিজিসিয়ান হিসেবে যাদের রাখা হয় তাদের কাছ থেকে খুব বড় ডিগ্রি আশা করা হয় না। তাদের কাজের মধ্যেও খুব চ্যালেঞ্জিং কিছু থাকে না। অতএব ডক্টর সিনহা নাম এবং ডিগ্রি ভাঁড়িয়ে খুব সহজেই ওখানে ঢুকে পড়লেন। তিনি একসঙ্গে পেয়ে গেলেন প্রতিমাসে কিছু অর্থের যোগান, একটা নিরিবিলি কাজ করার জায়গা আর মোহন্ত মহারাজের চিকিৎসা করার সুযোগ।

চিকিৎসা? উঁহু। আমার ধারণা, ডক্টর সিনহা বেশ কয়েকমাস ধরে মোহন্ত মহারাজের শরীরে ওষুধের নামে আর্সেনিকের মতন কোনো বিষ ঢুকিয়ে চলেছিলেন। সেই অর্থে মোহন্ত মহারাজকেও তিনি খুনই করেছিলেন, যদিও মৃতদেহ পুড়ে যাওয়ার ফলে সেটা এখন প্রমাণ করা কঠিন।

বাঁদরগুলোর কানের নীচে যেমন অ্যাডহেসিভ টেপের টুকরো দেখেছিলাম, সেইরকম অ্যাডহেসিভ-টেপ মোহন্ত মহারাজের কানের নীচেও লাগানো ছিল। ওই জায়গা দিয়েই শরীরের ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন মাইক্রোচিপস। এবং এইভাবে মোহন্ত মহারাজকেও ডক্টর সিনহা তৈরি করে নিয়েছিলেন তাঁর কাজের জন্যে। বড় বিভৎস সেই কাজ। মৃত্যুর পরেও মোহন্ত মহারাজ ডক্টর সিনহার রিমোট কন্ট্রোলের নির্দেশে নিজের গলার চিন্তামণির হারটি মুখে পুরে ফেলেছিলেন।

এই জায়গাটা লিখবার সময় টিটো একবার অবিশ্বাসের চোখে আমার মুখের দিকে তাকিয়েছিল। আমি ওকে মনে করিয়ে দিয়েছিলাম, মোহন্তজির মৃত্যুর ঠিক পরের মুহূর্তটার কথা। নিতান্ত কাকতালীয়ভাবে আমি আর ও সেইসময়ে তাঁর মৃত্যুশয্যার পাশে হাজির হয়ে দেখেছিলাম, কেমন করে তাঁর একটা হাত ধীরে-ধীরে উপরে উঠে আবার নেমে এসেছিল। সন্দেহ নেই, সেই সময়ে ডক্টর সিনহা আসলে মোহন্তজির মৃতদেহের ওপরে তাঁর কন্ট্রোল চেক করছিলেন।

টিটো আমার কথা মেনে নিয়ে আবার কলম হাতে তুলে নিয়েছিল। আমি ওকে বলেছিলাম, একইভাবে ডক্টর বেদাংশু সিনহা রাত্রিবেলায় মোহন্তজিকে সমাধি থেকে উঠে আসতে নির্দেশ দিয়েছিলেন।

‘মোহন্তজি’, ‘মোহন্তজি’ বলছি ঠিকই। কিন্তু তিনি তো তখন একটা যন্ত্র ছাড়া কিছু নন। বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলা হয় ‘সাইবর্গ।’

বেদাংশু সিনহার জয়স্টিকের মোচড়ে কবর থেকে সেই সাইবর্গ ওপরে উঠে এসেছিল। মুখ থেকে চিন্তামণির হার বার করে তুলে দিয়েছিল ডক্টর সিনহার হাতে। তারপর আবার ডক্টর সিনহার নির্দেশ মেনে কবরের নীচে লুকিয়ে পড়তে যাচ্ছিল। আমরা না থাকলে ঢুকে যেতও নিশ্চয়। তারপর আর কয়েকদিন বাদেই সমাধির ওপরে মার্বেল পাথরের বেদী গেঁথে দেওয়া হতো। তার নীচে চিরকালের মতন হারিয়ে যেত চিন্তামণি অন্তর্ধান রহস্য।

টিটো কলমে ক্যাপ পরাতে-পরাতে বলল, ‘হারিয়ে যেত, যদি না তুই থাকতিস।’

আমি বললাম, ‘উঁহু, যদি না বিনু থাকত।’

কলকাতায় ফিরে যাবার দিনে টিটো নিজেই থানার জিপটা ড্রাইভ করে আমাকে স্টেশনে নিয়ে যাচ্ছিল। গিধনী নয়, ফিরব খড়্গপুর হয়ে, তাই লোধাশুলি থেকে বাঁক নিয়ে হাইওয়েতে উঠলাম।

স্টেশনে যাওয়ার আগে আমরা গেলাম খড়্গপুরের নিবেদিতা নার্সিং হোমে। তিনতলার একটা কেবিনে গলা পর্যন্ত সাদা চাদর ঢাকা দিয়ে শুয়েছিল বিনু। শুয়ে শুয়ে অ্যাসটেরিক্সের কমিক্স পড়ছিল। আমাকে আর টিটোকে ঘরে ঢুকতে দেখে ওর মুখ হাসিতে ভরে উঠল। বইটা নামিয়ে রেখে উঠে বসল। আমি বললাম, ‘কেমন আছ বিনু?’

‘একদম ঠিক আছি নীল আঙ্কল! কিন্তু ডাক্তারবাবু বলছেন এখনো আমাকে দুদিন অবজার্ভেশনে রাখবেন। কি মুশকিল বলুন তো। ওদিকে আমি যে কয়েকজনকে অবজার্ভেশনে রেখেছিলাম, তাদের কী হবে?’

টিটো অবাক হয়ে বলল, ‘কাদের কথা বলছিস রে?’

একটা ব্ল্যাক হেডেড অরিওল, মানে বেনেবউ পাখির ফ্যামিলি। আমাদের ছাদের একদম গায়ে একটা কদম গাছের ডালে কি সুন্দর দোলনার মতন বাসা বানিয়েছিল। যেদিন হাসপাতালে ভর্তি হলাম, মাত্র তার আগের দিনই ডিম ফুটে দুটো কুসি-কুসি বাচ্চা বেরিয়েছিল। সেগুলো কেমন আছে কে জানে।’

আমার চোখের কোনাটা কেমন যেন জ্বালা করে উঠল। বিনুর মাথার হালকা ব্যান্ডেজটাকে বাঁচিয়ে, ওর চুলগুলো ঘেঁটে দিয়ে ওকে সেই কথাটা বললাম, যেটা এর আগে হোয়াটসঅ্যাপে লিখেও আবার ডিলিট করে দিয়েছিলাম।

বললাম, ‘তুমি সেরে ওঠো বিনুবাবু। তোমার পরীক্ষা হয়ে যাক। তারপর তোমাকে আমি কচ্ছের রানে ফ্লেমিংগো পাখির কলোনি দেখাতে নিয়ে যাব। প্রমিস।’

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন