৩. গুপ্ত জেলখানায় বন্দি

নিক পিরোগ

অধ্যায় ১১

ভেবেছিলাম ঘুম থেকে উঠে দেখবো আমি কোন গুপ্ত জেলখানায় বন্দি, শেকল দিয়ে হাত-পা বেঁধে রাখা হয়েছে।

কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সিআইএ’কে কিছু সময়ের জন্যে হলেও ঘোল খাওয়াতে পেরেছি।

আমি বাবাকে বলেছি, তিনি যাতে ওদের দৃষ্টিসীমার মধ্যে থেকেই আমার এলাকা থেকে বের হয়ে যান গাড়ি নিয়ে। কারণ একবার যদি ওনাকে সিআইএ’র লোকগুলো হারিয়ে ফেলতো তখন আবার ফেরত চলে আসত তারা। আর এসে যদি দেখতো, একটা গাড়ি রাস্তার মাঝে এরকম তেরপল দিয়ে ঢাকা অবস্থায় পড়ে আছে তাহলে সন্দেহ জাগতো ওদের মনে। তারপর ভেতরে উঁকি দিলেই সকল গোমর ফাঁস হয়ে যেত।

অবশ্য যদি ওরা বাবাকে অনুসরণ করে দশমাইল দূরের একটা মোটেলে না-ও গিয়ে থাকে তবুও ওনাকে খুঁজে পেতে কোন সমস্যা হতো না ওদের। কারণ আমার ফোনটা এখন বাবার কাছে।

জিপিএস দিয়ে আলেক্সান্দ্রিয়ার সীমান্তবর্তি ঐ মোটেলের ঠিকানা বের করে ফেলতে বেশি বেগ পাওয়ার কথা নয়। এতক্ষনে মনে হয় বাইরে নজর রাখার ব্যবস্থাও করে ফেলেছে।

প্রথমে ভেবেছিলাম বাবার ফোনটা আমার নিজের কাছে রেখে দেব কিন্তু পরে মনে হলো, সিআইএর পক্ষে সবই সম্ভব। আমি যে বাবাকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করছি এটা বেরও করে ফেলতে পারে ওরা। তাই আর ঝুঁকি নেইনি।

আর বাবাও যে কতক্ষণ ওদের চোখে ধুলো দিয়ে থাকতে পারবেন বলা যায় না। অন্তত চব্বিশ ঘন্টা ওদেরকে ব্যস্ত রাখতে হতো ওনাকে। আর এক ঘন্টা পরে আমি এখান থেকে ষাট মাইল দূরে থাকব। তখন নিরাপদে ফেরত আসতে পারবেন তিনি।

ল্যাসি আর মারডক যে এখন কী করছে কে জানে। গত তেইশ ঘন্টায় ওদের ওপর নজর রাখার মতো কেউ ছিল না। মারডক তো ল্যাসি ওকে যা করতে বলবে সেটাই করবে। বাবার বাসাটা এখনো আস্ত আছে নাকি এটা দেখে আসার ইচ্ছে হলো। আর আস্ত থাকলেও সেটা যে স্বাভাবিক অবস্থায় নেই সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।

কিন্তু এখন ওদের দেখতে যাওয়ার সময় নেই আমার হাতে।

লাফ দিয়ে পেছনের সিট থেকে বের হয়ে নীল তেরপলটা সরিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়িটা নিয়ে আমার এলাকা থেকে বের হয়ে গেলাম।

ড্যাশবোর্ডে দেখাচ্ছে এখনও অর্ধেক গ্যাস আছে। অন্তত আমি যেখানে যেতে চাই তার জন্যে যথেষ্ট।

জিপিএসটা বের করে চালু করলাম। ওখানে দেখাচ্ছে, আমার গন্তব্যে পৌঁছাতে একঘন্টা সতের মিনিট লাগবে প্রায়।

হাইওয়েতে উঠেও বেশ জোরেই গাড়ি চালাতে লাগলাম। নির্ধারিত গতিসীমা থেকেও প্রায় পাঁচমাইল উপরে। এভাবে যেতে থাকলে আমার দুই দিন লেগে যাবে জায়গাটাতে পৌঁছাতে। তাই আজকে যতদূর সম্ভব এগিয়ে থাকতে চাই আমি। কারণ কালকে তাহলে ব্ল্যাক সাইটটার কাছে পৌঁছে বাবার দামি নাইকন ক্যামেরাটা দিয়ে ফটাফট কয়েকটা ছবি তুলে ফেলতে পিরবো। আর ছবিগুলো প্রেসিডেন্ট সুলিভানের মুখের সামনে ধরে ভেংচি কেটে বলতে পারবো, “বলেছিলাম না!”

চল্লিশ মাইল যাওয়ার পর জিপিএসটা নির্দেশ করলো ডানদিকে মোড় নিতে।

এখন সময় তিনটা পঁয়ত্রিশ।

পাশেই বিশাল একটা গ্যাস স্টেশন, হাইওয়ের সব ট্রাক থামে এখানে। চটপট বাথরুমে ঢুকে কাজ সেরে দুটো পানির বোতল আর কিছু খাবার নিয়ে নিলাম।

“কোথায় যাচ্ছেন?” ক্যাশের লোকটা জিজ্ঞেস করল।

আমার আগের লোকটাকেও এই একই প্রশ্ন করেছিল সে। আমি নিশ্চিত, আমার পেছনেরজনকেও এটা জিজ্ঞেস করনে।

“কিছু মাল নিয়ে ওহাইও যাচ্ছি।”

সে মাথা নেড়ে আমাকে আমার খুচরা টাকা ফেরত দিয়ে দিল।

স্টেশন থেকে বের হয়ে গাড়িতে গিয়ে উঠলাম। আধমাইল যাওয়ার পর ম্যাকলিন শহরে পৌঁছে গেলাম আমি। এখানেই সিআইএ’র হেডকোয়ার্টার ল্যাংলি অ্যাকাডেমি অবস্থিত।

বাবার মোটেল রুমের বাইরে যে দুই হারামজাদা নজর রাখছে ওরাও নিশ্চয়ই এখানেই প্রশিক্ষণ নিয়েছিল। এখানেই গুপ্তচরবৃত্তির যাবতীয় কৌশলের উপর ক্লাস করেছিল ওরা। আর শত্রুর সাথে মুখোমুখি সংঘাতের সময় কি করতে হবে সেটাও নিশ্চয়ই এখানেই শিখেছে। কিন্তু ওদের কি এই বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়নি, গাড়ির পেছনের হুডের ওপর যদি একটা একশ ষাট পাউন্ড ওজনের কুকুর বসে থাকে তাহলে কি করতে হবে?

.

বামদিকে একটা তীক্ষ্ণ বাঁক নিলাম কিছুক্ষণ পরে। এরপর একটা সোজা রাস্তা ধরে চলতে থাকলাম। একই সাথে ঐ স্টেশন থেকে কেনা খাবারগুলো কোনরকমে নাকেমুখে খুঁজতে থাকলাম আমি। বাইরে সুন্দর চাঁদের আলো। ভার্জিনিয়ার এই অংশটাতে সবুজের পরিমাণ একটু বেশিই মনে হয়। বেশ দেখাচ্ছে।

কল্পনা করলাম, আমার পাশের সিটে ইনগ্রিড বসে আছে। মাথাটা আমার কাঁধের ওপর রেখে বাইরের অপার সৌন্দর্য উপভোগ করছে সে।

এ মুহূর্তে ওর শূন্যতাটা অসহ্য লাগছে আমার কাছে।

ল্যাসি আর আমি ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পর থেকে ওর সাথে আর কথা হয়নি। ও কি হাতের কেসটা সমাধান করতে পেরেছে? নাকি আমাকে নিয়ে এ মুহূর্তে চিন্তিত? সে-ও কি বাইরের চাঁদটার সৌন্দর্য উপভোগ করছে? মনে হয় না। এতক্ষণে সে বোধহয় গভীর ঘুমে মগ্ন। হেনরি বিনস তার কল্পনাতেও নেই এ মুহূর্তে।

আমি প্রতিদিন একঘন্টা করেই হাতে পাই। তাই যেকোন একটা জিনিস নিয়ে পড়ে থাকা আমাকে মানায় না। কিন্তু ইনগ্রিডের সাথে পরিচয় হবার পর থেকে প্রায় সবকিছুতেই ওর ছায়া খুঁজে পাই আমি। মাথায় কেবল ওর চিন্তাই ঘুরপাক খায়।

কিন্তু আমার কথা তার কতটা মনে পড়ে ঘন্টায় একবার? নাকি পাঁচঘন্টায় একবার? সত্যি কথা বলতে কি, ওর জীবনে আমার মতো সময় নিয়ে কোন টানাপোড়েন নেই। তাই সে যদি দিনে চব্বিশবারও আমার কথা ভাবে তা-ও আমি ওকে নিয়ে যতটা ভাবি সেটার কাছাকাছি আসতে পারবে না।

বাবার ঘড়ির অ্যালার্মের শব্দটা আমাকে বাস্তবে ফিরিয়ে নিয়ে আসলো।

এখন আর লুকানোর জন্য ভালো কোন জায়গা বাছাবাছি করার সময় নেই। রাস্তার পাশেই গাড়িটা পার্ক করে লাইটগুলো সব নিভিয়ে দিলাম। পেছনের সিটে গিয়ে শুয়ে পড়লাম গুটিসুটি মেরে।

জিপিএসের দিকে চোখ গেল এ সময়।

আর ছয় মাইল।

.

বিকেলের দিকে একটা সবুজ রঙের টয়োটা প্রায়াস থেমে থাকা লিঙ্কন গাড়িটাকে অতিক্রম করে গেল। কিন্তু কিছুদূর গিয়ে আবার ফিরে আসল সেটা। গাড়ির চালক ভাবতে লাগলো, এত সুন্দর একটা গাড়ি এভাবে রাস্তার মাঝে ফেলে রেখেছে কে? কিছু হয়েছে নাকি? ইঞ্জিনের সমস্যা?

লিঙ্কনটার সামনে গাড়ি পার্ক করে সেটা থেকে এক লোক বের হয়ে আসলো। কোন মহিলা নয় কিন্তু। কারণ একজন মহিলা কখনোই এভাবে রাস্তার মাঝে গাড়ি থামিয়ে উঁকি ঝুঁকি দেবে না। অন্তত ঘটে যদি বুদ্ধি থেকে থাকে তো। প্রায়াসটা থেকে যে বের হলো তার বয়স হবে চল্লিশের মতো। উচ্চমধ্যবিত্ত। নিয়মিত চার্চে যান। গাড়ি নিয়ে একটু বের হয়েছেন ঘুরতে।

লিঙ্কনের সামনে গিয়ে চাকাগুলো আগে দেখলেন তিনি। ঠিকই আছে ওগুলো। এরপর ভেতরে উঁকি দিলেন। সামনের সিটে কিছু খাবারের ছেঁড়া প্যাকেট পড়ে আছে আর পেছনের সিটটাতে শুয়ে আছে এক যুবক।

এখানে যদি একজন সাধারণ লোক হতো তাহলে এতক্ষণে নিশ্চয়ই নিজের রাস্তা মাপতো। কিন্তু ইনি সাধারণ কেউ নন। যেকোন বিপদে পড়া মানুষকে যেচে গিয়ে সাহায্য করা তার স্বভাব। তিনি ভাবলেন, মানুষটা বোধহয় ভারি কোন কাজ করে এখন ক্লান্ত, তাই একটু বিশ্রাম নিচ্ছে। কিন্তু বিশ্রাম নেয়ার জন্যে পেছনের সিটে যেতে হবে কেন? সে কি রাত থেকে এখানে আছে নাকি? তাহলে তো হিসেবে একটু গন্ডগোল হয়ে গেল। কারণ এখন বাজছে বিকেল চারটা। যদি লোকটা গতরাত থেকে এখানে ঘুমিয়ে থাকে তাহলে এতক্ষণে তার উঠে পড়ার কথা।

প্রয়াসের লোকটা জানালায় একবার টোকা দিলেন। ভেতরের লোকটা ঠিক আছে নাকি জানতে হবে তো! কিন্তু কোন সাড়া পাওয়া গেল না। এবার আরেকটু জোরে টোকা দিলেন। না, কোন নড়াচড়া নেই।

ঠিক এই সময়ে নিজের মোবাইলটা হাতে তুলে নিলেন, আর দশ মিনিট পরে সেখানে শেরিফসাহেব এসে উপস্থিত হলেন। ব্যাপারটা তখন থেকেই একটু গোলমেলে হতে শুরু করলো।

শেরিফসাহেব চাবি ঢোকানোর জায়গাটা দিয়ে একটা পাইপ ঢুকিয়ে দিলেন। কিন্তু সেটা দেখার বিষয় নয়, দেখার বিষয় হলো পাইপ থেকে লাল রঙের জেলির মতো কী যেন বের হতে লাগলো।

এখন এই জায়গায় আমি, প্রয়াসের লোকটা আর শেরিফসাহেব। আমাকে ঘিরে আছে লাল রঙের জেলির মতো পদার্থগুলো।

এরপরে আরকজন লোক এসে জুটলো সেখানে, সাথে একজন মহিলা। কিছুক্ষণের মধ্যেই ছোটখাটো একটা ভিড় জমে গেল আমাকে ঘিরে। দুয়েকটা কুকুরও দেখা যাচ্ছে। এরপরেই সবাই একসাথে জেলিগুলো খাওয়া শুরু করলো। আমার থেকে আর মাত্র ছয় ফিট দূরে আছে ওরা সবাই। এভাবে চলতে থাকলে কিছুক্ষণের মধ্যে আমাকেও খেয়ে ফেলবে!

আর মাত্র দুই ফিট বাকি এমন সময় আমার ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম ভাঙার সাথে সাথে লাফিয়ে উঠে বসলাম, বাইরের দিকে তাকালাম, কেউ নেই। কি ভয়ানক স্বপ্ন ছিলরে বাবা!

অবশ্য প্রথম দিকের ঘটনাগুলো খুব স্বাভাবিকভাবেই ঘটতে পারতো। শেষের দিকে এসে একটু অবাস্তব হয়ে গিয়েছিল অবশ্য। কেউ গাড়ি থামিয়ে ভেতরে উঁকিও দিতে পারতো। রাস্তাটা অবশ্য একটু ভেতরের দিকে। তা সত্ত্বেও নিশ্চয়ই একশোর ওপরে গাড়ি অতিক্রম করেছে আমার গাড়িটার সামনে দিয়ে। ভাগ্য ভালো, কেউ দু-বার ভাবেনি এটা নিয়ে। নিজেদের চিন্তাতেই ডুবে ছিল ওরা। কতটা যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছে মানুষ!

গাড়ি থেকে বের হয়ে রাস্তার পাশেই এক নম্বর সেরে নিলাম, এরপর ড্রাইভিং সিটে চড়ে বসলাম। গাড়ি চালাতে চালাতেই বোতল থেকে অবশিষ্ট পানিটুকু খেয়ে নিলাম আমি। আর বাদবাকি খাবারগুলোও পেটে চালান করে দিতে লাগলাম সেই সাথে।

পাঁচমিনিটে পাঁচ মাইল গেলাম এ সময়।

তিনটা ছয়ের সময় জিপিএসটা আমাকে একবার ডানদিকে মোড় নেবার নির্দেশ দিলে একটা মাটির রাস্তা ধরে এগুতে লাগলাম।

চারপাশে একটার পর একটা পাহাড় অতিক্রম করতে লাগলাম। আরো কিছুদূর যাবার পর আবার বামে মোড় নিতে হলো। দুটো পাহাড় পার করার পর রাস্তাটা শেষ হলো অবশেষে। সামনে একটা গেট। ব্যক্তিগত সম্পত্তি।

বিনা অনুমতিতে প্রবেশ নিষেধ।

আমার মনে হয়, রাস্তার এই পর্যন্ত আসতে আসতে অন্তত একটা হলেও অ্যালার্ম বাজিয়ে দিয়েছি আমি। যেকোন মুহূর্তে হয়ত ট্রেনিংপ্রাপ্ত কমান্ডোরা ঝাঁপিয়ে পড়বে আমার উপর। নইলে একটা বুলেট এসে লাগবে আমার পায়ে। কিন্তু আমার একমাত্র আশা আমার মা। তিনি নিশ্চয়ই নিজের ছেলেকে একটা আত্মঘাতি মিশনে পাঠাবেন না!

বাবার নাইকন ক্যামেরা আর একটা টর্চলাইট নিয়ে বের হয়ে গেলাম।

দুই মিনিট পরে গেটটা পার হয়ে পাহাড়ি রাস্তা ধরে সামনে ছুটতে লাগলাম আমি।

এখন সময় তিনটা চৌদ্দ।

.

জিপিএসে দেখাচ্ছে, আমি আমার গন্তব্য থেকে আর মাত্র এক হাজার ফিট দূরে। রাস্তাটা কিন্তু শেষ হয়ে গেছে, আমার চারপাশে এখন জঙ্গল। এখানে যদি ব্ল্যাক সাইটটাতে পৌঁছানোর কোন রাস্তা থেকে থাকে তাহলে সেটা আমার চোখে পড়ছে না। ঘন গাছপালার মধ্যেই আরো পাঁচ কদম এগুলাম। পায়ের নিচে শুকনো ডালপালা মটমট করে ভাঙছে।

পেপারের আর্টিকেলটাতে পড়া ঐ দু-জন লোকের কথা মনে হলো। আব্দুল আল রাহমিন আর হাম্মাদ শেখ। ওদের দুজনকে এই রাস্তা দিয়ে টিয়ে নিয়ে গিয়ে জেলে পুরতে কতক্ষণ লেগেছিল? ইরাক থেকে ওদের চুপিসারে এখানে নিয়ে এসেছিল কিভাবে? কতজন লোক জড়িত ছিল এর সাথে? ছোট একটা দল নাকি বড়সড় কোন দল? যারা রাহমিন আর হাম্মাদকে আটক করেছিল তারাই কি নিয়ে এসেছে ওদের এই জঙ্গলে? নাকি অন্য কেউ?

তারা দু-জন কি জানতো, তাদের পরিণতি কি হতে যাচ্ছে? তাদের হয়তো আর কখনও দিনের আলো দেখার সৌভাগ্য হবে না।

আমি সামনে এগুলাম।

জিপিএসে দেখানো তীরচিহ্নটা ধরে সামনে যেতে লাগলাম খুব সাবধানে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জিপিএসে দেখানো জায়গাটার দুই ফিটের মধ্যে চলে এলাম আমি।

ইন্টারনেটে ব্ল্যাক সাইটগুলোর কিছু ছবি দেখেছি আমি। বেশ কয়েক ধরণের বাড়ির ছবি উঠেছিল। কতগুলো একদম ছোট আবার কতগুলো কারখানার মতো বড়। আর কিছু কিছু স্থাপনা দেখতে সরকারি অফিসের মতো।

কিন্তু এখানে কোন ব্ল্যাক সাইট চোখে পড়ছে না। গাছ ছাড়া আর কিছু নেই আশেপাশে।

মা কি তাহলে ভুল করলেন? এই জায়গাটার সন্ধান কোথায় পেয়েছিলেন তিনি?

ঘড়ির দিকে তাকালাম।

তিনটা বাইশ বাজে।

টর্চের আলো ফেলে আশেপাশে দেখতে লাগলাম কিন্তু লুকোনোর জন্য কোন বিল্ডিং কিংবা ঘর চোখে পড়ল না।

“বাল!”

শব্দটা এই রাতের বেলা আশেপাশে প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো, কিন্তু আমার আর ভয় লাগছে না। আশেপাশে কেউ নেই শোনার মতো। অন্তত কয়েকমাইলের মধ্যে।

তাহলে বাইরে প্রবেশ নিষেধ’ টাঙিয়ে রেখেছে কেন?

এই জঙ্গলটা কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি।

জিপিএসে যে জায়গাটা নির্দেশ করছে একদম সে জায়গায় ফিরে গেলাম। এবার একটু ভালোমতো লক্ষ করতে লাগলাম সবকিছু। এই দুই ফিট জায়গাটা আশেপাশের জায়গাগুলো থেকে কেমন যেন একটু সমান্তরাল। সেখান থেকে পাতাগুলো সরিয়ে দিয়ে হাটু মুড়ে বসে পড়লাম। এক ইঞ্চি পুরু ধুলোর আস্তরণ। হাত দিয়ে পরিস্কার করতে যেতেই শক্ত কিছু একটা হাতে লাগলো। হাঁপাতে হাঁপাতে টর্চটা হাতে নিয়ে নিচের দিকে তাক করলাম।

প্রাইউড।

আরো একমিনিট লাগলো চারফুটের প্লাইউডের টুকরোটা পুরোপুরি পরিস্কার করে ওপরে ওঠাতে। নিচে তামার একটা প্লেট। প্লেটটা দরজার মতো চওড়া আর প্রায় তিনফিট উঁচু। মস্ত বড় একটা প্যাডলক ওটাকে সিমেন্টের সাথে আটকে রেখেছে।

পেয়ে গেছি!

গলা থেকে বাবার ক্যামেরাটা হাতে নিয়ে ঝটপট কয়েকটা ছবি তুলে ফেললাম। কিন্তু এই প্লেটটার ছবি দিয়ে কিছু প্রমাণ করতে পারবো না। প্রেসিডেন্টসাহেব হেসেই উড়িয়ে দেবেন।

জোরে একটা লাথি মারলাম তালাটার উপরে। অবাক হয়ে দেখলাম, তালাটা ঘুরে গেল। ওটা ঘুরিয়ে দিলাম পুরোপুরি।

যে পরিমাণ ধুলো জমেছে তাতে মনে হচ্ছে না গত কয়েকমাসে এটা কেউ খুলেছে। ভেতরে যা-ই থাক না কেন সেটা নিশ্চয়ই খালি।

কিন্তু এটা যদি আসলেই একটা ব্ল্যাক সাইট হয়ে থাকে আর এটার অস্তিত্বের কথা ফাঁস হয়ে গিয়ে থাকে তাহলে সিআইএ যে এটা বন্ধ করে দেবে সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু একটা জিনিস বুঝলাম না, ওরা

এটার চিহ্ন পুরোপুরি মুছে দেয়নি কেন?

প্লেটটা তুলে ফেললাম।

ভেতরে একটা সিঁড়ি অন্ধকারের বুক চিড়ে নিচে নেমে গেছে।

ঘড়ির দিকে তাকালাম।

তিনটা আটাশ বাজে।

আরো দুটো ছবি তুলে নিয়ে নিচের দিকে নামতে লাগলাম আমি।

.

সিঁড়িতে বারোটা ধাপ।

নেমে হাতের টর্চটা দিয়ে চারপাশে আলো ফেলে দেখতে লাগলাম। পুরো জায়গাটা পুরু কংক্রিট দিয়ে তৈরি। আকারে বাবার বাসার বেজমেন্টটার তুলনায় তিনগুণ বড় হবে। কমসে কম একহাজার বর্গফিট তো হবেই।

কিন্তু বাবার জায়গাটা পুরোপুরি জিনিসপত্রে ঠাসা থাকলেও এই জায়গাটা বলতে গেলে খালিই। টর্চের আলোতে চারপাশে কেমন যেন একটা ভৌতিক আবহ সৃষ্টি হয়েছে। অদ্ভুত অদ্ভুত সব ছায়া। এক কোণায় রাখা তিনটা টেবিল আর পাঁচটা চেয়ার। সবগুলোই আবার ভাঁজ করে রাখা যায়। সেদিকে এগিয়ে গেলাম।

কল্পনা করলাম, আব্দুল এখানে বসে আছে, তার মুখটা চটের ব্যাগের ভেতর আর হাত-পাগুলো চেয়ারের সাথে বাঁধা। অন্য চেয়ারগুলোতে এমন লোকজন বসে আছে যাদের মাথায় কেবল একটা চিন্তাই ঘুরপাক খায় কিভাবে আরেকটা নাইন-ইলেভেনের হাত থেকে এ দেশকে রক্ষা করা যাবে। সেজন্যে তারা যেকোন কিছু করতে পারে।

কিছু ছবি তুলে আবার চক্কর মারা শুরু করলাম।

দূরে এক কোনায় একটা ছোট টেবিল রাখা আছে, আর ওটার পাশেই একটা ধাতব চৌবাচ্চা, যেটা বর্তমানে একপাশ করে রাখা হয়েছে। মেঝেতে পাঁচটা চটের ব্যাগও দেখা গেল।

এখানেই নিশ্চয়ই বন্দিদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতো।

কল্পনায় আবার আব্দুলের ছবি ভেসে উঠলো। তাকে চৌবাচ্চাটার ওপরে শুইয়ে রাখা হয়েছে। মাথাটা চটের ব্যাগ দিয়ে ঢাকা। পাশে থেকে একজন ক্রমাগত বরফ ঠান্ডাপানি ঢেলে যাচ্ছে আর আব্দুল ছটফট করছে নিঃশ্বাস নেয়ার জন্যে।

এখানকার তিনটা ছবি তুললাম। ঘড়ির দিকে তাকালাম একবার।

আমি এখানে নেমেছি নয় মিনিট হতে চলল।

টেবিলটার ঠিক উপরে দুটো চেইন ঝুলছে। সেগুলো আবার আঙটা দিয়ে আটফুট উপরের সিলিঙের সাথে লাগানো। একটা চেইনে নাড়া দিয়ে দেখলাম। ক্যাচকোচ আওয়াজ করে নড়ে উঠলো সেটা। পাশের চেইনটার সাথে বাড়ি খেয়ে এই বদ্ধ জায়গায় ধাতব প্রতিধ্বনির সৃষ্টি করল। এভাবে কাউকে ঝুলিয়ে রাখার অর্থ, আপনি নিশ্চিতভাবেই সে মানুষটাকে ঘৃণা করেন। তাছাড়া এই অমানুষিক কাজটা করা কোনভাবেই সম্ভব নয়। যেদিন টুইন টাওয়ারের ওপর প্লেনটা আছড়ে পড়েছিল সেদিনের কথা চিন্তা করলাম আবার। যারা ঘটনাটা ঘটিয়েছিল তাদের ওপর অবশ্যই ঘৃণা জন্মেছিল। এটাই স্বাভাবিক। সবারই ঘৃণা জন্মেছিল ওদের ওপর। ঐ সন্ত্রাসিরাও কিন্তু মারা গিয়েছিল ঘটনাটায়। আচ্ছা, ওরা যদি কোনভাবে বেঁচে যেত তাহলে কি ওদেরকে এরকম নির্মম অত্যাচারের দিকে ঠেলে দিতে পারতাম আমরা? যেখানে তাদের সাথে পশুর চেয়েও খারাপভাবে নিপীড়ন করা হবে?

জানা নেই আমার।

টর্চটা দিয়ে চৌবাচ্চার আশেপাশে আলো ফেলে দেখতে লাগলাম।

“কোন ড্রেইন নেই এখানে।”

চমকে উঠে ঘুরে তাকালাম। নিঃশ্বাস আটকে গেছে আমার।

টর্চটা ঘোরাতেই আমার দিকে এগিয়ে আসতে থাকা একটা লোকের ওপর আলো গিয়ে পড়ল।

“আমরা যখন এই জায়গাটা তৈরি করেছিলাম তখন ওরা বলেছিল, এখানে কোন পানির লাইন দেয়া সম্ভব নয়, তাই কোন ড্রেইনের ব্যবস্থাও নেই। বন্দিদের যখন রক্তপাত হতো ওটা মোছার জন্যেও কোন পানির ব্যবস্থা ছিল না। ওদের গায়েই রক্তগুলো শুকিয়ে যেত একসময়।”

“আপনি একজন অসুস্থ মানুষ,” আমি বললাম।

ডিরেক্টর লে’হাই কাঁধ তুললেন শুধু। যেভাবেই হোক আমাদের কথা বের করতে হতো।”

“আপনিই আমার মাকে খুন করেছেন।”

“ট্রিগারটা হয়ত আমি চাপ দেইনি, কিন্তু হ্যাঁ, আমি আপনার মাকে মারার নির্দেশ দিয়েছিলাম।”

“কে মেরেছে আমার মাকে?”

আবারও কাঁধ তুললেন তিনি, “যে কেউ হতে পারে। আমাদের তো এসবের জন্যে লোকের অভাব নেই।”

“গুপ্তঘাতক?”

“যে নামে ইচ্ছে ডাকতে পারেন আপনি।”

এই প্রথম খেয়াল করলাম, লে’হাইয়ের কোমরের কাছে জায়গাটা একটু ফুলে আছে। আশেপাশে তাকালাম। লোকটা একদম ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। সিঁড়িটা পেরোতে হলে ওকে পাশ কাটিয়ে যেতে হবে আমার।

ঝট করে ক্যামেরা বের করে ওর দুটো ছবি তুলে ফেললাম। ফোনটা থাকলে ওকে এই বলে ভয় দেখাতাম, এখনই ছবি আপলোড করে দেব। কিন্তু এত নিচে মোবাইলের নেটওয়ার্ক আছে কিনা সন্দেহ।

টর্চটা বন্ধ করে দিলাম। একটা অন্ধকারের চাদর ঘিরে ধরল আমাদের।

তিরিশ সেকেন্ড চুপচাপ কেটে গেল। আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম লে’হাই হয়ত নিজের টর্চটা জ্বালাবে।

কিন্তু সেরকম কিছু ঘটল না।

 ডানদিকে তিন কদম এগিয়ে গেলাম।

“চেইনগুলো লাগানোর কথা আপনার মার মাথা থেকে বেরিয়েছিল, হঠাৎ করে বলে উঠলেন লে’হাই।

শব্দ করে একটা ঢোক গিলোম।

“ঠিকই শুনেছেন। আপনার মা এই জায়গাটা তৈরি করতে সাহায্য করেছিলেন। এমনকি এটার নামকরণও করা হয়েছিল আপনার মা’র কথা চিন্তা করেই। মাদারস বাঙ্কার। অবশ্য এটুকু বললে কিছু বুঝবেন না আপনি। আরেকটু ইতিহাস বলতে হবে আমাকে। আপনি জানেন না বোধহয়, আপনার মার জন্মস্থান ছিল মেসিডোনিয়া। মাদার তেরেসা’র জন্মস্থানও কিন্তু ওখানেই। আপনার মা বন্দিদের সাথে খুব ভালো ব্যবহারই করতেন। অন্তত যতক্ষণ পর্যন্ত ওরা আমাদের সহযোগিতা করত আর কি। অবশ্য সহযোগিতা না করলে আবার অন্য রূপ বের হয়ে আসত তার। তখন ওদের একটা একটা করে নখ টেনে তুলতেন তিনি। একদিন কে যেন আপনার মাকে মাদার তেরেসা বলে ডাকলেন, ব্যস, ঐ নামই রয়ে যায়।”

আমি জানি, তিনি আমাকে ফসলাচ্ছেন যাতে আমি গড়গড় করে সব বলে দেই। তিনি প্রায় সফলও বলা যায়। আর একটু হলেই আমার বাধ ভেঙে যাবে। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে, “আমার মা এভাবে কাউকে নির্যাতন করতে পারেন না। তার পক্ষে এটা কোনভাবেই করা সম্ভব নয়। খুবই কোমল মনের মানুষ ছিলেন তিনি। কিন্তু নিজেকে সামলালাম। কারণ গত দু-সপ্তাহে একটা জিনিস ঠিকই শিখেছি আমি-মা সম্পর্কে খুব কম তথ্যই জানা আছে আমার।

“আপনার মা-ই আমাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। আসলে সবাই তার কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছে,” লে’হাই বললেন। তিনি এখনও মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন। প্রায় আমার বামদিকে।

আমি তাড়াতাড়ি বের হওয়ার রাস্তাটার দিকে তিনকদম এগুলাম।

“বন্দিদের পেট থেকে কিভাবে কথা বের করতে হবে এরজন্যে একটা বইও লিখেছিলেন আপনার মা। কথাটা কিন্তু সত্যি। বইয়ের নাম ‘দ্য পেইন গেইম। অবশ্য বইটার খুব কম সংখ্যক কপিই এ প্রেসিডেন্ট রেগানের আমলে বইটা নতুন রিক্রুট হওয়া কর্মিদের জন্যে পড়া বাধ্যতামূলক ছিল। আপনি কি জানেন, আপনার মা’কে হন্ডুরাসের সরকার এক কোটি ডলার দিয়েছিল যাতে তিনি তাদের অফিসারদের প্রশিক্ষণ দেন, কিভাবে বন্দিদের উপর অত্যাচার করে কথা বের করতে হয়? এক কোটি ডলার! আর আমি ১৯৮৬ সালের কথা বলছি। এতটা ভালো ছিলেন তিনি এসবে।”

ডিরেক্টরের গলার আওয়াজটাও বের হওয়ার রাস্তার দিকে এগিয়ে আসছে। তিনি জানেন, আমি কি করার তালে আছি।

আমি যদি জীবিত বের হতে চাই এখান থেকে তাহলে এখনই কিছু করতে হবে।

আমি চিন্তা করতে লাগলাম, লে’হাইয়ের মাথায় এখন কি ঘুরছে। তিনি নিশ্চয়ই ভাবছেন, আমি যেকোন মুহূর্তে দৌড় লাগাব। ওটার কথা আসলেও একবার চিন্তা করেছিলাম কিন্তু লে’হাইর আকার আমার প্রায় দ্বিগুণ আর ওনার কাছে একটা পিস্তলও আছে। নিঃসন্দেহে তিনি এটা জানেন এ মুহূর্তে তিনি সিঁড়ি থেকে কয় কদম দূরে আছেন। এমনও তো হতে পারে, তিনি প্রবেশপথটা তালা দিয়ে দিয়েছেন কিংবা প্রবেশপথের বাইরে সশস্ত্র সিআইএ এজেন্টরা আমার জন্যে বন্দুক হাতে অপেক্ষা করছে।

আমার একমাত্র উপায় হচ্ছে তার হাত থেকে বন্দুকটা কেড়ে নেয়া।

ক্যামেরাটা এ মুহূর্তে আমার কোন কাজে আসবে না। ওটা মাটিতে নামিয়ে রাখলাম। ভাঁজ করে রাখা যায় এমন টেবিল-চেয়ারগুলো থেকে আমি বেশি দূরে নেই। টর্চটা আমার কোমরে গুঁজে রেখে সামনের দিকে হাত বাড়িয়ে আস্তে আস্তে এগোতে লাগলাম আমি। দুই কদম সামনে গেলাম, পা একটা চেয়ারের সাথে লাগলে খুবই মৃদু আওয়াজ হলো। কিন্তু এই বদ্ধ জায়গার জন্যে সেটাই অনেক।

“আপনি ঐ কোনায় কি করছেন?” ডিরেক্টর চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলেন।

প্রবেশপথ থেকে তিনি পনেরফিট দূরে এ মুহূর্তে।

আমি চেয়ারটা তুলে নিয়ে আন্দাজে ছুঁড়ে মারলাম তার দিকে।

ওটা মেঝেতে আছড়ে পড়ল কোনকিছুকে আঘাত না করেই।

“নিজেকে সামলান, মি. বিনস।”

আমি আরেকটা চেয়ার তুলে নিয়ে ছুঁড়ে মারলাম। তারপর আরেকটা। এরপর ঘুরে চেইনগুলো যেদিকে আছে সেদিকে দৌড় দিলাম। কোমর থেকে টর্চটা বের করে শুধু একবার জ্বালিয়ে বুঝে নিলাম আমার অবস্থানটা, আর সে সুযোগে দেখে নিলাম আমার ছোঁড়া চেয়ারগুলোর কোন একটা লে’হাইকে আঘাত করেছে কিনা। একটাও লাগেনি তার গায়ে। ডিরেক্টর এখনও সটান দাঁড়িয়ে আছেন, হাতে তুলে নিয়েছেন পিস্তলটা।

টর্চ বন্ধ করে দিয়ে চেইন দুটো হাতে নিয়ে জোরে নাড়া দিলাম। ভয়ানক শব্দে ও-দুটো একটা আরেকটার সাথে বাড়ি খেতে লাগলো।

এই প্রতিধ্বনির সুযোগটা কাজে লাগালাম আমি। হাতড়ে হাতড়ে দেয়ালের কাছে চলে গেলাম। তারপর ওটা অনুসরণ করে একশ কদম সামনে এগুলাম। বের হওয়ার জায়গাটা আর অল্প একটু দূরেই।

বুকের ভেতরে হাতুড়ির বাড়ি পড়ছে যেন। শার্ট দিয়ে মুখ চেপে রেখেছি যাতে কোন আওয়াজ বের না হয়।

আমি জানি, লে’হাই আমার খুব কাছেই কোথাও আছে। বিশফিটেরও কম দূরে।

তিরিশ বছরের অভিজ্ঞতার পর এই সামান্য ঘটনায় তিনি হয়ত চিন্তিত নন। কিন্তু তার ভারি নিঃশ্বাসের আওয়াজ আমার কানে আসছে।

“সবকিছু কিন্তু এখনও ভালোয় ভালোয় মিটে যেতে পারে, মি. বিনস। আমরা দুজনেই এখান থেকে স্বাভাবিকভাবে হেঁটে বের হয়ে যেতে পারবো,” তিনি বললেন। “আপনাকে শুধু কয়েকটা কাগজে সই করতে হবে-আপনি কখনো এই জায়গার ব্যাপারে কারো সাথে কোন ধরণের আলাপ করবেন না। তাহলেই হয়ে যাবে।”

ফালতু কথা। আরেকবার জোরে নিঃশ্বাস নিলাম। যেকোন মুহূর্তে দৌড় দেব আমি।

এই সময় ঘড়ির অ্যালার্মটা বেজে উঠলো।

কিন্তু আমার কব্জিতে ঘড়িটা বাঁধা নেই এখন। ওটা আমি চেইনগুলো বাড়ি দেয়ার সময় নিচে খুলে রেখেছিলাম।

ডিরেক্টরের পায়ের আওয়াজ পেলাম। নিশ্চয়ই শব্দের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন।

আমিও তার পিছে পিছে যাওয়া শুরু করলাম। জ্বালিয়ে দিলাম টর্চটা।

তিনি ঘোরার চেষ্টা করলেন, কিন্তু দেরি হয়ে গেছে। টর্চটা দিয়ে তার ঘাড় বরাবর বসিয়ে দিলাম এক ঘা। তিনি সরে যাওয়ার চেষ্টা করলেন কিন্তু পুরোপুরি এড়াতে পারলেন না। বেশ জোরেসোরেই লাগলো আঘাতটা।

কিন্তু লে’হাই এরমধ্যেই একটা হাত দিয়ে আমাকে জোরে ধাক্কা দিলেন। আমি আর তাল সামলাতে পারলাম না, পড়ে গেলাম। হাটুটা কংক্রিটের সাথে যুকে গেল। ব্যথার একটা ঝলক ছড়িয়ে পড়ল সারা পায়ে। কিন্তু এখন এটা নিয়ে চিন্তা করার সময় নেই আমার। যে করেই হোক বন্দুকটা পেতে হবে। ওটা কি তার হাত থেকে পড়ে গেছে? কিন্তু মেঝেতে কিছু পড়ার শব্দ তো শুনিনি। আমার ইচ্ছে ছিল তার ডানহাতে জোরে একটা বাড়ি দেব যাতে করে বন্দুকটা ছিটকে যায়। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তার মাথায় বাড়ি দেয়ার কথা মনে হয়। উদ্দেশ্য, তাকে অজ্ঞান করা।

উঠে দাঁড়ালাম।

টর্চটা এখনও জ্বলছে। ওটার আলো ঠিকরে বের হচ্ছে আমার দশফিট ডানদিক থেকে। আর ওটার আলোতে কালো রঙের পিস্তলটা দেখা যাচ্ছে।

ওটা হাতে নেয়ার জন্যে ঝাঁপ দিলাম আমি। হাতলটা ধরতেই একটা বড় জুতো আমার আঙুলগুলোর উপর চেপে বসলো। আর আরেকটা নেমে আসতে লাগলো আমার মুখ বরাবর।

ঠিক এই সময়ে সব অন্ধকার হয়ে গেল।

*

অধ্যায় ১২

“হেনরি।”

আমি চোখ খুললাম।

“হেনরি।”

ডিরেক্টর আমার পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন। টর্চের আলো গিয়ে তার মুখের ওপর পড়ছে। তার মাথায় অল্প যে কয়টা চুল আছে সেগুলো রক্তে ভিজে একাকার।

“আপনি কি কাউকে এই জায়গাটা সম্পর্কে কিছু বলেছেন?”

“কাউকে কিছু বলিনি,” উত্তর দেয়ার সময় খেয়াল করলাম আমি একটা টেবিলের উপর শুয়ে আছি।

“আমাকে মিথ্যে বলবেন না। আপনার মা আপনাকে এই জায়গাটা সম্পর্কে জানিয়েছেন। আমার মাথার ওপরে একটা ভেজা কাপড় রাখা। “আর কে জানে, বলুন?”

“এই বালের জায়গাটা সম্পর্কে? শুধু আমিই,” বলার চেষ্টা করলাম কিন্তু তার আগেই কে যেন পানি ঢালা শুরু করলো আমার উপরে।

আপনার মনে হতে পারে, মুখের ওপর একটা ভেজা তোয়ালে থাকা অবস্থায় কেউ যদি পানি ঢালে তাহলে সেটা তেমন বড় কোন ব্যাপার নয়। কিন্তু আপনার ধারণা ভুল। ব্যাপারটা যথেষ্ট ভয়ানক। আপনার মনে হবে, আপনি পানিতে ডুবে যাচ্ছেন। নিঃশ্বাস নিতে পারবেন না।

পানি বন্ধ হয়ে গেলে কাপড়টাও সরিয়ে ফেলা হলো।

আমি হা-করে নিঃশ্বাস নেয়ার চেষ্টা করতে লাগলাম।

টর্চটা পেছনের দেয়ালের ওপর রাখা, ওখান থেকেই সেটা কোণাকুণিভাবে বাঙ্কারটাকে আলোকিত করে রেখেছে। আমি চোখ থেকে পানি ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করলাম। পরিস্কারভাবে কিছু দেখতে খুব কষ্ট হচ্ছে ।

আরেকবার আমার মুখটা কাপড় দিয়ে ঢেকে পানি ঢালা হলো।

আরেকটা ভয়ঙ্কর মিনিট।

“অন্য যে ব্ল্যাক সাইটটা আছে সেটার ব্যাপারে কাকে জানিয়েছেন?”

“অন্য ব্ল্যাক সাইট? আমি জানি না আপনি কোনটার কথা বলছেন,” আমি সত্যিই বললাম। আমি চাই না আবার আমার মুখের ওপরে ওভাবে। পানি ঢালা হোক। “শুধুমাত্র এটার ঠিকানাটাই মা আমাকে দিয়েছিলেন। দয়া করে বিশ্বাস করুন আমার কথা।”

“আপনি কি জানেন, শেষ যে বন্দিকে এখানে আপনার মা জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন সে কি বলছিল বারবার? দয়া করে বিশ্বাস করুন আমার কথা। বিশ্বাস করুন। “ ব্যাঙ্গাত্মক সুরে কথাটা বললেন তিনি। তার বয়স অবশ্য অনেক কম ছিল। মাত্র পনের। কিন্তু তার ভাই নয়জন লোককে মেরেছিল। আপনার মা এটা জানতেন, বাচ্চা ছেলেটা তার ভাইয়ের আস্তানাটা চিনতো। আর যেভাবেই হোক সেটা তার মুখ থেকে বের করতে চেয়েছিলেন তিনি।”

আমার ডানহাতটা ওপরে টেনে ঝুলানো হলো। বাম হাতটাও। আমার শরীরে পুরো একশ পঞ্চাশ পাউন্ড ওজন এখন কব্জিদুটোকে সইতে হচ্ছে। তীব্র ব্যথা ছড়িয়ে পড়ল নিমেষেই। পা-গুলো নিজে থেকেই ছুঁড়তে শুরু করলাম আমি।

“পাঁচদিন। পাঁচদিন ঐ ছোকরাকে এভাবে ঝুলিয়ে রাখার পরেও তার মুখ থেকে কোন কথা বের করা যায়নি। আমার মনে আছে, আমি আপনার মাকে বলেছিলাম, ছেলেটা হয়ত আসলেও কিছু জানে না। কিন্তু আপনার মা’র এক কথা তিনি কথা বের করবেনই। টেনে টেনে ছেলেটার নখগুলো তুলে ফেলা হয়। কারেন্ট ট্রিটমেন্টও দেয়া হয় কয়েকবার। ঘুমাতে দেয়া হয়নি তাকে। আরেকটা অভিনব পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয় তার উপর। এটার ব্যাপারে তো আপনি নিশ্চিতভাবেই অনেক জ্ঞান রাখেন। লম্বা ঘুম!”

“কি আজেবাজে বকছেন?” বললাম আমি।

“আপনার কি মনে হয় আপনার এই অবস্থা হলো কেন? কেন আপনি সারাদিনের মধ্যে কেবল একঘন্টাই জেগে থাকেন? আপনি নিশ্চয়ই আসলেও এটা ভাবেন না যে, এটা কোন অদ্ভুত অসুখ? না, এটাকে বলা হয় ‘ক্লাসিক্যাল কন্ডিশনিং’।”

“আপনি কি বলতে চাচ্ছেন, যখন আমি বাচ্চা ছিলাম তখন আমার মা ইচ্ছে করে আমার সাথে এমনটা করেছেন? আর এজন্যেই আমি একঘন্টা করে জাগি প্রতিদিন?”

জবাবে আমার পেট বরাবর একটা ঘুসি বসালেন তিনি। “আপনার ওপরেই প্রথম পদ্ধতিটা প্রয়োগ করেছিলেন তিনি।”

আমি বমি করে দিলাম। এটা কি ঘুসিটার কারণে হলো নাকি লে’হাই এ মুহূর্তে যে কথাগুলো বললেন সেটার প্রতিক্রিয়া, বুঝতে পারলাম না।

“যাই হোক, ঐ ছোকরাটার পেট থেকে কোন কথা বের করা যায়নি। এমনকি টানা একমাস কেবল একঘন্টা করে জেগে থাকার পরও সে তার আগের গল্পটাই বলে যাচ্ছিল বার বার। কিন্তু একসময় সে আর নিতে পারেনি এসব কিছু। মারা গেল। এর চারদিন পর আরেকজন বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে আসা হয় এখানে। সে জানতো বোমাগুলো কোথায় বানানো হচ্ছে। কিন্তু সে আরেকটা তথ্যও জানতো, ঐ মারা যাওয়া ছেলেটা আসলেই তার ভায়ের ব্যাপারে কিছু জানত না। কয়েক বছর ধরে তার সাথে কোন যোগাযোগ ছিল না ওর ভায়ের। আর এটাই সে মারা যাওয়ার আগপর্যন্ত বলে আসছিল।”

আর নিতে পারছি না আমি। মনে হচ্ছে আমার মাথাটাই বোমার মতোন বিস্ফোরিত হবে এখন।

“এই ঘটনার পর আপনার মা বদলে গেলেন।”

কথাটা শেষ হতে না হতেই আমার মুখ বরাবর আরেকটা ঘুসি বসালেন তিনি। এত জোরে যে, আমার মাথাটা একদিকে কাত হয়ে গেল। আর চোখের সামনে ভেসে উঠলো হাজারো তারার নকশা।

“আপনার মা বলছিলেন, তিনি ওবামার কাছে যাবেন, এই অবৈধ ব্ল্যাক সাইটগুলোর কথা বলে দেবেন সরকারকে। আর বলবেন, ঠিক ওবামার চোখের সামনেই অজ্ঞাতসারে একটা ব্ল্যাক সাইট গড়ে তোলা হয়েছে এই ভার্জিনিয়াতে। গত সাতবছর ধরে সিআইএ’র উচ্চপদস্থ কিছু কর্মকর্তা আর এজেন্ট দেশের বাইরে থেকে চরমপন্থি দলগুলোর কর্মিদেরকে এখানে পাচার করছে। সবার চোখে ধুলো দেয়ার জন্যে তাদের মৃত্যুর নাটক সাজানো হচ্ছে।”

আরেকটা ঘুসি খেলাম পেটে।

”কিন্তু এটা আমরা কিছুতেই হতে দিতাম না,” তিনি বলতেই থাকলেন। “আপনার মাও এটা জানতেন, তাই পালিয়ে গেলেন। কিন্তু আমাদের পক্ষে আর ঝুঁকি নেয়া সম্ভব হয়নি। তাই এ জায়গাটা বন্ধ করে দেয়া হয়। এরপর আমাদের আরো পনের মাস লাগে নতুন একটা ব্ল্যাক সাইট খুলে সেখানে সবকিছু স্থানান্তর করতে। ওটার নাম ভ্যাটিকান।”

“ভ্যাটিকান??” যেটুকু শক্তি অবশিষ্ট আছে সেটুকু দিয়ে এটাই বেরোল আমার মুখ দিয়ে।

তিনি মাথা নেড়ে সায় দিলেন।

“তার মানে আমার মাকে যদি সবাই মাদার তেরেসা বলে ডাকে তাহলে আপনাকে ডাকে-”

“পোপ!”

ইনগ্রিডের মেসেজটার কথা মনে পড়ে গেল।

নতুন একটা কেস পেয়েছি। একজন সিরিয়াল কিলারকে নিয়ে। নিজেকে পোপ বলে দাবি করে সে।

গত দু-সপ্তাহের ঘটনা মেলানোর চেষ্টা করলাম।

আমি এত বোকা কেন?

কিন্তু এখনও আশা আছে। যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ।

“আপনার এটা কেন মনে হলো, মা নতুন জায়গাটার ব্যাপারে জানেন?” জিজ্ঞেস করলাম তাকে।

“আমাদের দলের অন্য একজন সদস্য হয়ত তাকে জানিয়েছে এ কথা। আমার মনে হয়, আপনার মা তার সাথে যোগাযোগ করেছিলেন। আর সে তাকে বলে দিয়েছে ভ্যাটিকান নামের গোপন জেলখানার কথাটা। তার মুখ চিরদিনের বন্ধ করতে একটু দেরি হয়ে যায় আমাদের।”

“হয়ত মা এতদূর পৌঁছাতে পারেননি। আর পৌঁছালেও আমাকে এ ব্যাপারে কিছুই জানাননি তিনি।”

লে’হাই আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন।

“আপনাকে দেখে তো মনে হচ্ছে, সত্যি কথাই বলছেন।”

আমি মাথা নাড়লাম কেবল।

“শিট, আপনাকে আসলেও বলেননি তিনি!”

“কোথায় ওটা?” জিজ্ঞেস করলাম।

আমার দিকে আবারও হতাশ চোখে তাকিয়ে থাকলেন তিনি।

“আব্দুল রাহমিন কি সেখানেই আছে?”

“বাহ, বেশ খোঁজ-খবর নিয়েছেন দেখছি এ ব্যাপারে। কিন্তু শুনে কষ্ট পাবেন, আব্দুল বেশিদিন সহ্য করতে পারেনি।”

“মারা গেছে ও?”

“হ্যাঁ, মাথা নেড়ে জবাব দিলেন তিনি। কিন্তু ওর দশজন দোস্ত কিন্তু এখনও আমাদের কজায় আছে। ওদের কাছ থেকে আমরা যে তথ্য পেয়েছি তাতে করে অন্তত দশটা আল-কায়েদার প্রশিক্ষণ ক্যাম্প গুঁড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছি আমরা। আর মিনিয়াপোলিসের একটা বড়সড় বিস্ফোরণও ঠেকানো গেছে।”

“ভ্যাটিকানও এটার মতো মাটির নিচে অবস্থিত?”

আশেপাশে একবার তাকালেন তিনি। কোমর থেকে পিস্তলটা বের করে হাতে নিলেন। আমি মারা যাওয়ার আগে কি তিনি আমাকে নতুন ব্ল্যাক সাইটটার কথা জানাবেন?

“হ্যাঁ।”

তাকে দেখে মনে হচ্ছে, আমাকে জানাতেই চান। অন্তত কারো সাথে এ ব্যাপারে খোলাখুলি কথা বলতে চান।

“ওটাও কি এখানে, ভার্জিনিয়াতে?”

“না, ওটার দায়িত্ব পশ্চিম-পাশে আমাদের বন্ধুদের উপর।”

“পশ্চিম-ভার্জিনিয়া?” বেশ জোরেই বললাম।

মাথা নেড়ে সায় দিলেন লে’হাই।

আমি আশা করছি, যেকোন মুহূর্তে ওরা দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়বে। কিন্তু কেউ আসলো না। ওদের আরো তথ্য চাই।

আমি মাথা খাটালাম। মাটির নিচে, পশ্চিম-ভার্জিনিয়াতে।

“ওটা নিশ্চয়ই একটা পরিত্যক্ত কয়লাখনিতে, তাই না?”

তার মুখে একটা শয়তানি হাসি ফুটে উঠলো।

“পশ্চিম-ভার্জিনিয়ার ওয়ালটনের খনিটা কিনে নেই আমরা, এরপর কয়েদিদেরকে একটা ট্রাকে করে ওখানে নিয়ে যাই। কারো মনে বিন্দুমাত্র কোন সন্দেহ জাগেনি। আর কেউ যদি কিছু বুঝেও যায় তাহলে নিমেষের মধ্য ডিনামাইট দিয়ে ওটা ধ্বসিয়ে দিতে পারি আমরা।”

চেপে থাকা শ্বাসটা ছেড়ে দিলাম।

“আপনারা ভেতরে আসতে পারেন এখন,” আমি চিৎকার করে বললাম।

“কি উল্টাপাল্টা বলছেন?”

আমি মাথা নেড়ে বাঙ্কারের কোণার দিকে ইঙ্গিত করলাম। টর্চের মৃদু আলোতে খুব আবছাভাবে একটা ছোট ভিডিও ক্যামেরা দেখা যাচ্ছে। ভালো মতো খেয়াল না করলে কেউ বুঝবে না। আমার মাথায় যখন পানি ঢালা হচ্ছিল তখন কাপড়টার সরানোর এক ফাঁকে ওটা আমার চোখে পড়ে।

“তোর সব কথাবার্তা এতক্ষণ ভিডিও করা হচ্ছিল, গাধার বাচ্চা!”

তিন সেকেন্ড পরে অনেকগুলো পায়ের আওয়াজ ভেসে আসলো।

ওদের দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারছি, প্রোসডেন্টও আছেন ওদের মধ্যে। সেই সাথে ইনগ্রিডও।

রুমটা আলোতে ঝলকে উঠলো।

“পিস্তলটা ফেলে দিয়ে হাতদুটো উপরে তুলুন, কেউ একজন বলল।

লে’হাই চুপচাপ নির্দেশ পালন করলেন।

“হেনরি! এ কি অবস্থা হয়েছে তোমার?” ইনগ্রিড আমার কব্জিদুটো চেইনগুলো থেকে মুক্ত করে দিলো। আমি পড়ে গেলাম নিচে। “আমি আরো তাড়াতাড়ি আসতে চেয়েছিলাম কিন্তু ওরা আমাকে ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছিল না,” করুণ গলায় বলল সে, দু-গাল বেয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু ঝরছে। “দ্বিতীয় ব্ল্যাক সাইটটার অবস্থান না জানা পর্যন্ত কিছুই করতে দিচ্ছিল না ওরা।”

কেউ আমার হাত ধরে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করল। প্রেসিডেন্ট সুলিভান। “আমি অত্যন্ত দুঃখিত ব্যাপারটার জন্যে,” তিনি বললেন। “আমি চিন্তাও করিনি ব্যাপারটা এতদূর গড়াবে। আপনি আপনার দেশের জন্য অনেক বড় একটা কাজ করলেন আজকে। কখনও এটা ভুলবো না আমি।”

“কয়টা বাজে?” কোনমতে জিজ্ঞেস করলাম।

“তিনটা সাতান্ন,” আমার পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে উত্তর দিলো ইনগ্রিড।

একটা ঘোরের মধ্যে আছি আমি।

পেছনে ঘুরে দেখি তিনজন সশস্ত্র লোক লে’হাইর দিকে বন্দুক তাক করে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের উদ্দেশ্যে মাথা নাড়লাম।

এখনও ঘোর কাটছে না।

প্রেসিডেন্ট লে’হাইয়ের দিকে তাকালেন, “আপনাকে যখন সিআইএ’র ডিরেক্টর হিসেবে নিযুক্ত করেছিলাম তখন বলে দিয়েছিলাম এরকম বেআইনি কিছু করবেন না। আর এখানে ঠিক আমার চোখের সামনেই একটা ব্ল্যাক সাইট খুলে রেখেছেন আপনারা?”

“এই দেশকে বাঁচানোর জন্যে যে আমাদের কি করতে হয় এ ব্যাপারে আপনার কোন ধারণাই নেই,” লে’হাই ঝাঁঝের সাথে জবাব দিলেন। “আপনি কি জানেন, আমাদের কত ভয়ঙ্কর সব অপরাধিদের মোকাবেলা করতে হয়? আপনার কাজ তো শুধু অফিসে বসে কিছু কাগজে সই করা। আর এদিকে হাজারো নির্দোষ আমেরিকান মারা যায় আপনাদের এসব উল্টাপাল্টা সিদ্ধান্তের কারণে।”

ডিরেক্টর এসব ছাইপাঁশ বলতেই থাকলেন। কিন্তু আমি একদৃষ্টিতে ইনগ্রিডের দিকে তাকিয়ে আছি।

মা যেদিন আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন সেদিন যেরকম অনুভূতি হয়েছিল, ভেবেছিলাম, সারাজীবন হয়ত আর এরকম অনুভূতি হবে না।

খুব কাছের মানুষেরা বিশ্বাসঘাতকতা করলে এরকমই লাগে।

“তোমাকে শুয়ে পড়তে হবে এখন, হেনরি।”

কিন্তু ওর কথাটা আমার কানে ঢুকলো না। আমার মনে হচ্ছে, এ মুহূর্তে যদি আমাকে আবার ওরকম মুখে কাপড় বেঁধে পানিতে চুবানো হয় তবুও এতটা কষ্ট হবে না।

ঘুমে আমার চোখ বন্ধ হয়ে যাবার আগেই এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।

*

ধ্যায় ১৩

ফোনটা বাজছে।

“ও আবার ফোন করেছে,” ল্যাসিকে বললাম।

মিয়াও।

“না, ফোনটা ধরব না আমি।”

মিয়াও।

“ওর কথা অনেক মনে পড়ে তোর? পড়ুক।”

মিয়াও।

“আমারও অনেক মনে পড়ে? হ্যাঁ, পড়ে। কিন্তু ও যা করেছে আমার সাথে! মুখের উপর মিথ্যে কথা বলেছে। ওর জন্যেই ওভাবে চেইনের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছিল আমাকে।”

মিয়াও।

“আরে, আমার কব্জির কি অবস্থা হয়েছিল দেখিসনি তুই,” এই বলে হাতদুটো ওকে দেখালাম আমি। এখনও লাল হয়ে আছে। “আর ওর জন্যেই আমাকে ওয়াটারবোর্ডিংয়ের শিকার হতে হয়েছিল।” মুখ বেঁধে ওভাবে পানি ঢালাকে ওয়াটারবোর্ডিং বলে। পরে ইন্টারনেটে দেখেছি আমি। কথা বের করার একটা পুরনো পদ্ধতি এটা।

মিয়াও।

“ওটা কোন ব্যাপার না মানে? অবশ্যই এটা একটা বিরাট ব্যাপার। এদিকে আয় তোকে দেখাই কেমন লাগে।”

পালানোর আগেই ওকে ধরে বেসিনের কাছে নিয়ে গেলাম। কল ছেড়ে দিয়ে উল্টো করে ওকে তার নিচে ধরলাম আমি। এভাবে পাঁচ সেকেন্ড চুবিয়ে রাখার পর বের করলাম।

ব্যাটা হাসছে। মিয়াও।

“মজা পেয়েছিস?”

মিয়াও।

ও চাচ্ছে, আমি আবার ওকে পানিতে চুবাই।

পানি ছেড়ে আবার ওকে তার নিচে ধরলাম। আরো তিনবার আমাকে দিয়ে এটা করালো ল্যাসি। এরপর তোয়ালে দিয়ে ওকে মুছে দিলাম আমি। মাথায় একটা চুমু দিয়ে বললাম, “তুই অদ্ভুত।”

ফোনটা বেজে উঠলো। আবার।

আমার উপর ঐ নির্যাতনের আজ প্রায় এক সপ্তাহ হতে চলল। ইনগ্রিড আর প্রেসিডেন্ট দু-জনেই এরপর থেকে অনবরত আমাকে ফোন দিয়ে যাচ্ছে। ইনগ্রিড দু-বার এসেছিল, কিন্তু আমি তালা বদলে ফেলেছি। পুরনো চাবি দিয়ে লকটা আর খুলতে পারেনি ও।

কলিংবেল বেজে উঠলো।

খুড়িয়ে খুড়িয়ে দরজার কাছে গেলাম। আমার ডানহাটুতে এখনও প্রচন্ড ব্যথা।

“চলে যাও এখান থেকে।”

আবারো কলিংবেল বেজে উঠলো।

“যেতে বললাম না!”

তালায় চাবি ঢোকার শব্দ শুনলাম। সে আবার পুরনো চাবিটা দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করছে।

“কাজ করবে না ওটা।”

দুই সেকেন্ড পর দরজাটা খুলে গেল।

“কিভা-”

প্রেসিডেন্ট আর রেড দাঁড়িয়ে আছে। রেড একটা চাবিসদৃশ্য বস্তু পকেটে ঢোকাতে ঢোকাতে বলল, “দুঃখিত।”

“আপনি আমার ফোনের জবাব দিচ্ছিলেন না,” সুলিভান বললেন, তার পরনে আবার একটা জিন্স আর একটা রেডস্কিনসের জার্সি।

“আমি আপনার কোন কথা শুনতে চাই না।”

“যাই হোক, আমার কিছু কথা বলতেই হবে আপনাকে। এতে হয়ত আমি যা করেছি সেটা ক্ষমা করে দেয়া যাবে না কিন্তু অন্তত এটা বুঝতে পারবেন, কাজগুলো কেন করেছি আমি।”

ল্যাসি দৌড়ে গিয়ে প্রেসিডেন্টের পায়ে মুখ ঘষতে লাগলো।

আমি দৌড়ে গিয়ে ওকে থামালাম, “খবরদার!”

মিয়াও।

“কারণ ওনার কারণেই আমাকে ওয়াটারবোর্ডিংয়ের শিকার হতে হয়েছে।”

মিয়াও।

“না, তোর সাথে সেটা এখন করতে পারবেন না তিনি,” ওকে নামিয়ে রাখলাম নিচে। “চুপচাপ বিছানায় গিয়ে বসে থাক্।”

নির্দেশ পালন করল ও।

“আপনি আপনার বিড়ালের সাথে কথা বলেন?” ভ্রূ উঁচু করে জিজ্ঞেস করলেন প্রেসিডেন্ট।

এড়িয়ে গেলাম কথাটা। “আপনার হাতে আর পাঁচমিনিট আছে।” ফোনের দিকে তাকালাম।

তিনটা মোল বাজে।

প্রেসিডেন্ট একবার গলা খাঁকারি দিয়ে শুরু করলেন, “মনে আছে, আমি একবার পোকার খেলতে এখানে এসেছিলাম?”

আমি মাথা নাড়লাম।

“ওটার দু-দিন আগে রেড আপনার অজ্ঞাতসারেই এখানে একবার এসেছিল ওর ঐ বিশেষ চাবিটা ব্যবহার করে।”

“কেন?”

“নিরাপত্তার খাতিরে,” রেড বলে উঠলো এবার। “হাজার হোক, প্রেসিডেন্ট বলে কথা।”

“ঠিক।”

“প্রেসিডেন্ট যেখানেই যান না কেন, এটা আমাদের করতেই হয়। কিছু জিনিস খতিয়ে দেখতে হয় সামনাসামনি।”

“যেমন?”

“যেমন কোন আগ্নেয়াস্ত্র আছে কিনা, কিংবা নজরদারি করার মতো কিছু আছে কিনা, এসব।”

“কিন্তু আমার এখানে তো ওরকম কিছু নেই।”

“ভুল বললেন।”

“কি?”

“আপনার বাসায় আড়িপাতার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।”

“সেটা আমি জানি দু-সপ্তাহ আগে।”

“না,” প্রেসিডেন্ট বলে উঠলেন, “আমরা কয়েকমাস আগের কথা বলছি।”

“আপনারা নিশ্চিত?”

“হ্যাঁ,” রেড বলল, “কিন্তু ওগুলো সাধারণ কোন যন্ত্র ছিল না। একদম উঁচু পর্যায়ে যোগাযোগ ছাড়া কোনভাবেই ওগুলো হাতে পাওয়া সম্ভব নয়।”

“আচ্ছা।”

“আমরা ওগুলো নিয়ে পরীক্ষা করে দেখেছিলাম ওগুলো থেকে কোন তথ্য খুঁজে পাওয়া যায় কিনা। একজনের নাম বের হয়ে আসে এতে। বিশেষ একজনের নাম।”

“আমার মা,” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম।

“এলেনা জানেভ,” মাথা নেড়ে জবাব দিলেন তিনি। “আপনার ওপর নিয়মিত নজর রাখতেন তিনি।”

কথাটা শুনে একটু খুশিই হলাম আসলে।

“পরে আমরা জানতে পারি, সিআইএ আপনার মায়ের নামে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করেছে ছয় বছর আগেই।”

আমি মাথা নাড়লাম, “লে’হাইর কাজ এটা। উনিই মা’কে মেরেছেন।”

রেড আর প্রেসিডেন্ট পরস্পরের দিকে একবার তাকালেন কথাটা শুনে।

“আসলে ব্যাপারটা ওরকম নয়,” প্রেসিডেন্ট বললেন। “মানে?”

“ও কথায় আসছি একটু পরে,” জোর করে একবার শ্বাস নিলেন তিনি। “যাই হোক, খোঁজ নেওয়ার পর আমরা জানতে পারি আপনার মা’র আসল পরিচয়। রেড আরো খতিয়ে দেখে ব্যাপারটা। তখন ও অ্যাডভান্সড সার্ভেইলেন্স অ্যান্ড ট্র্যাকিংয়ের কাছে করা আপনার ইমেইলগুলো খুঁজে পায়।”

“আপনারা তাহলে জানতেন আমি আমার মাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি?”

“হ্যাঁ। আর আপনিই একমাত্র ব্যক্তি নন যে তার খোঁজে আছেন। এক বছর আগে প্রেসিডেন্ট ওবামা আমার কাছে এসেছিলেন। তিনি বললেন একদিন তার অফিসে কাজ করার সময় দরজার নিচ দিয়ে কে যেন একটা খাম ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে। একটা চিঠি ছিল ওটা। আপনার মা’র পক্ষ থেকে ছিল চিঠিটা। ওটাতে সিআইএ’র ব্ল্যাক সাইটগুলো সম্পর্কে যাবতিয় তথ্য ছিল। আর এটাও লেখা ছিল, আমাদের চোখের সামনেই একটা ব্ল্যাক সাইট আছে এই ভার্জিনিয়াতে। এটা যদি জনগণ জানতে পারতো তাহলে আমি জীবনেও আর প্রেসিডেন্ট হতে পারতাম না। আমেরিকার মাটিতে একটা টর্চার সেল? ডেমোক্রেটরা তো আমাকে সাথে সাথে লাথি মেরে তাড়িয়ে দিতো।”

“আপনি লে’হাইকে ধরলেন না কেন সাথে সাথে?”

“কারণ চিঠিতে আপনার মা আরো কয়েকটা ব্ল্যাক সাইটের কথা বলেছিলেন। আমি যদি তখন লে’হাইকে ধরতাম তাহলে কখনোই ওগুলোর খোঁজ পেতাম না।”

আমি কিছু না বলে মাথা নাড়লাম কেবল।

“তো, আপনার মা’র আসল পরিচয় খুঁজে বের করার পর আমাদের কিছু একটা করা জরুরি হয়ে পড়ে। ব্যাপারটা একরাতে ঠিক করা হয়নি। কয়েকমাস ধরে কাজ করতে হয়েছে। আমাকে কয়েকটা সংস্থার সাথে কাজ করে যেতে হয়েছে গোপনে। সিআইএ, হোমল্যান্ড সিকিউরিটি…”

“আর ইনগ্রিড,” আমি বললাম।

প্রেসিডেন্টের সাথে ইনগ্রিডের মিটিংটার কথা চিন্তা করলাম। ও মিথ্যে বলেছিল আমাকে ওটার ব্যাপারে। এমনকি প্রেসিডেন্টও মিথ্যে বলেছিলেন।

ইনগ্রিডের ব্যাপারটা এড়িয়ে গেলেন তিনি। “আমরা একটা লাশের ব্যবস্থা করি। যেটার দৈহিক গড়ন আপনার মা’র সাথে মিলে যায়। কিন্তু ঐ মহিলা মারা যায় ব্রেইন টিউমারে। রেডকে পরে তার মাথায় গুলি করার মতো অপ্রীতিকর কাজটা করতে হয়।”

আমি রেডের দিকে তাকালাম, সে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে এখন। চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে, কাজটা নিয়ে গর্বিত নয় বেচারা। ওকে দোষ। দিয়েও লাভ নেই।

“এরপর তার লাশ পটোম্যাক নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়। তখন থেকেই আসল খেলা শুরু। আমরা অপেক্ষা করতে থাকি কেবল। হোমল্যান্ডে আমাদের যে লোক ছিল তাকে দিয়ে চার নম্বর বিপদ সংকেত জারি করাই আপনার মায়ের উপর। আর আঙুলের ছাপ মিলে যাবার ব্যাপারটাও সাজানো ছিল। এএসটি কিন্তু আঙুলের ছাপ মিলে যাবার ব্যাপারটার খবর পাবার সাথে সাথে আপনাকে একটা ইমেইল পাঠিয়ে দেয়।”

“আর তখন থেকেই আমি আপনার হাতের পুতুল হয়ে যাই।”

“অনেকটা।”

“আমাজন ব্যবহার করার বুদ্ধিটা কার ছিল?”

প্রেসিডেন্ট ইশারায় রেডকে দেখালেন।

“কোন প্রকার সন্দেহের উদ্রেক না ঘটিয়ে তথ্য পাচার করার ভালো উপায় ছিল ওটা।”

“আর মেন ইন ব্ল্যাক?”

“ওটা আমার মাথা থেকে এসেছিল,” প্রেসিডেন্ট হেসে জবাব দিলেন।

ইচ্ছে করছে তার মুখ বরাবর একটা ঘুসি মেরে দেই।

“এরপর আপনারা ইনগ্রিডকে জড়ালেন এসবের সাথে, যাতে করে সে আমাকে সঠিক পথে যাওয়ার জন্যে একটু সাহায্য করে?”

ইনগ্রিডের পাঠানো মেসেজটার কথা মনে পড়ল : এখনই আবার মেন ইন ব্ল্যাক দেখতে বসে পড়ো না। আমি দেখিনি অবশ্য। কিন্তু রিভিউয়ে দেখেছি, খুবই জঘন্য মুভি নাকি ওটা।

সে যদি আমাকে মেসেজটা না পাঠাত তাহলে আমি আমাজনে রিভিউ’র ব্যাপারটা ধরতে পারতাম না কিছুতেই।

“আপনারা এটা কিভাবে বুঝেছিলেন, ইনগ্রিড হোমল্যান্ড সিকিউরিটিসের ঐ লোকটার কাছে ফোন দেবে।”

“আমরা জানতাম, আমাদের পরিকল্পনা যদি কাজে লাগে তাহলে এমনটাই হবে। আর হোমল্যান্ড সিকিউরিটিসের ঐ লোকটাও ইনগ্রিডকে চার নম্বর লাল রঙের বিপদ সংকেতটার কথা জানায়। এতে করে আমরা বুঝতে পারি, আমরা যে লোকের কাছে তথ্য পাঠাতে চাচ্ছিলাম সে সেটা পেয়ে গেছে।”

“কি মনে করে আপনি শহরের চাবিটার কথা বলেছিলেন?”

“আমার মাথায় তখন ওটা ছাড়া অন্যকিছু মাথায় আসছিল না।”

এরপর প্রেসিডেন্ট ইনগ্রিডের সাথে দেখা করে সবকিছু ঠিক করে নেন, যাতে করে তার বলা কথার সাথে সব কিছু মিলে যায়। এরপর ইনগ্রিড আমার সাথে আবার মিথ্যা কথা বলে।

“আপনি কিভাবে জানতেন, আমি আপনাদের দেয়া তথ্যগুলো অনুসরন করে এগিয়ে যাবো?”

“সত্যি বলতে, জানতাম না। কিন্তু আপনি তো সেটাই করেছেন।”

“আর রিভিউটার সাথে যে গ্লোবাল জিওলোজিস্ট আনলিমিটেডের যোগসূত্র খুঁজে পাবো আমি এটা কিভাবে বুঝেছিলেন?”

“অ্যাডভান্সড সার্ভেইলেন্স অ্যান্ড ট্র্যাকিংয়ের সাথে আপনার সংশ্লিষ্টতা। আপনার প্রথম দিকের একটা ইমেইলে আপনি বারবার জিজিইউ’র কথা উল্লেখ করেছিলেন,” এই বলে একটু থামলেন তিনি, “আপনাকে আগেই বলেছি, কয়েকমাস ধরে সব পরিকল্পনা করি আমরা।”

“ইনগ্রিডের ব্যাপারে সবকিছু খুলে বলুন আমাকে।”

“সে এসবে জড়াতে চায়নি কিন্তু আমি তাকে দেশের জন্যে এই কাজটা করতে বলি।”

কথাটা শোনার পরও আমার বুকের ভেতর জমে থাকা রাগ একটুও কমল না।

“সে একসপ্তাহ ধরে লে’হাইর উপর নজর রাখছিল।”

আমি এটা আগেই বুঝতে পেরেছি। লে’হাই যখন বলছিল, সবাই তাকে পোপ নামে ডাকে তখনই ব্যাপারটা ধরতে পারি আমি।

“আর আমার বাসায় যে দু-জন লোক আড়িপাতার ব্যবস্থা করেছিল?”

“ওরা লে’হাইয়ের লোক ছিল।”

“আর লে’হাইয়ের সাথে মিটিঙের ব্যাপারটা?”

“ওটার জন্যে আমি দুঃখিত। আমাকে বাধ্য হয়ে অভিনয় করতে হয়েছিল। যেমনটা আপনি করেছিলেন শেষদিকে।”

“আপনাকে তো আর পানিতে চুবানো হয়নি।”

“ওটার জন্যে আবারও ক্ষমা চাচ্ছি আপনার কাছে।”

“আপনারা ভিডিও ক্যামেরাগুলো কখন লাগিয়েছিলেন ওখানে?”

“ছয় সপ্তাহ আগে,” এই বলে রেডের দিকে তাকালেন তিনি।

“ওখানে গিয়ে তো মনে হচ্ছিল, কেউ আর ওটা ব্যবহার করে না। দারুণ কাজ দেখিয়েছেন আপনি,” আমি রেডকে বললাম।

“তিন ঘন্টা ধরে আমাকে গাছের মরা পাতা বিছাতে হয়েছে ওখানে।”

“একজন সত্যিকারের শিল্পীর মতো।”

জবাবে সে হাসলো কেবল। ওর প্রতি আমার কোন রাগ নেই।

“আপনারা জানলেন কিভাবে, ডিরেক্টরও ওখানে যাবেন?”

“তারা শুধু আপনার ঘরেই আড়িপাতার ব্যবস্থা করেনি।”

“আমার সাথে তো ফোনও ছিল না।”

তিনি মাথা ঝাঁকালেন জবাবে।

আমি আমার দিকে নির্দেশ করলাম। “আমার উপর? আমার উপর নজর রাখছিল ওরা? কিন্তু কিভাবে?”

“আপনার পায়ের তলায় ভালোমত খেয়াল করে দেখুন,” রেড বলল।

একটা চেয়ারে বসে মোজাটা খুলে পায়ের দিকে তাকালাম। গোড়ালিতে একটা স্বচ্ছ গোলাকার বস্তু লেগে আছে।

“এটা একটা ট্র্যাকিং ডিভাইস?”

“সবচেয়ে আধুনিক পদ্ধতি।”

আমি ওটা খুলে ডাস্টবিনে ফেলে দিলাম।

“তো, এখন কি হবে?”

“লে’হাইর বিচার সবার সামনে করা যাবে না, তাহলে জনগন সব জেনে যাবে।”

“তাকে ছেড়ে দেবেন?”

“তা নয় আসলে।”

“মানে?”

“ভ্যাটিকান।”

“ওটা ধ্বসে পড়েছে নিশ্চয়ই?”

তিনি মাথা নাড়লেন।

“আর লে’হাই সেখানে ছিল?”

তিনি আবারও মাথা নেড়ে সায় দিলেন।

“ওখানকার বন্দিদের কি হলো?”

“আমরা কোন ঝুঁকি নিতে চাইনি।”

“ওদেরকেও মেরে ফেললেন?”

“বাকি দুনিয়ার কাছে তারা আগে থেকেই মৃত ছিল।”

“আপনারা লে’হাইর চেয়ে কোন অংশেই কম নন।”

“লে’হাইর ব্যাপারে যাই বলুন না কেন, লোকটা কিন্তু কাজের ছিল। আমাদের সে দু-বার আক্রমনের হাত থেকে বাঁচায়। আর এটা নিশ্চয়ই ঐ ব্ল্যাক সাইটগুলোর কারণেই সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু কূটনীতির এই যুগে এসে আমাদের কিছু নিয়ম মেনে চলতেই হবে। যদি লোকজন এগুলোর কথা জানতে পারত তাহলে সিআইএ’কে রক্ষা করা সম্ভব হতো না। আর সিআইএ ছাড়া এই সন্ত্রাসবাদের যুগে আমরা অনেকটাই অচল।”

“আর আপনিও কখনো প্রেসিডেন্ট হতে পারতেন না।”

“সেটাও একটা কারণ বটে,” তার মার্কামারা হাসিটা দিয়ে বললেন প্রেসিডেন্ট।

“আর ইনগ্রিড?”

“আপনাকে একটা কথা জানিয়ে রাখি, ইনগ্রিডকে যখন দেশের জন্যে কাজটা করতে বলেছিলাম তখনও সে কিন্তু সাহায্য করার ব্যাপারে অস্বীকৃতি জানায়। বলে, ভালোবাসার মানুষের সাথে মিথ্যে কথা বলতে পারবে না সে।”

কথাটা শুনে দম বন্ধ হয়ে গেল আমার।

ভালোবাসার মানুষ?

“তার কাজটা করার একমাত্র কারণ ছিল, আমি তাকে বলেছিলাম, ও যদি কাজটা করে তাহলে আমি আপনাকে এই জিনিসটা দেব।”

প্রেসিডেন্ট তার পকেট থেকে একটা লাল রঙের খাম বের করে আমার হাতে তুলে দিলেন।

“এটা আপনার মা’র ফাইল।”

আমি আমার হাতের খামটার দিকে তাকালাম।

“খামটা খোলার আগেই আপনাকে সাবধান করে দিচ্ছি, ওখানে কিন্তু বেশ স্পর্শকাতর কিছু ব্যাপার বলা আছে। একবার দেখে ফেললে আর মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারবেন না ওগুলো।”

এই বলে প্রেসিডেন্ট আর রেড দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে গেলেন।

সিআইএ ডিরেক্টর আমাকে একসপ্তাহ আগে যে কথাগুলো বলেছিলেন সেটা মনে পড়ে গেল আপনার কি মনে হয় আপনার এই অবস্থা হলো কেন? কেন আপনি সারাদিনের মধ্যে কেবল একঘন্টাই জেগে থাকেন? আপনি নিশ্চয়ই এটা ভাবেন না, এটা কোন অদ্ভুত অসুখ? না, এটাকে বলা হয় ‘ক্লাসিক্যাল কন্ডিশনিং। আর আপনার ওপরই ওটা প্রথম প্রয়োগ করা হয়।”

শুধু এটাই নয়।

পটোম্যাক থেকে যে লাশটা উদ্ধার করা হয়েছে সেটা আমার মার ছিল না।

তার মানে তিনি এখনও জীবিত।

অধ্যায় ৩ / ৩

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন