মুহম্মদ জাফর ইকবাল
ছোটাচ্চু দাদি (কিংবা নানিকে) বলল, “বুঝলে মা, এই ডিটেকটিভের কাজ মনে হয় ছেড়ে দিতে হবে।”
দাদি একটা উপন্যাস পড়ছিলেন, বই থেকে মুখ না তুলেই জিজ্ঞেস করলেন, “কেন?”
আশেপাশে যে কয়জন বাচ্চাকাচ্চা ছিল তারা এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, “কেন ছোটাচ্চু? কেন কেন?”
ছোটাচ্চু নাক-মুখ কুঁচকে বলল, “ডিটেকটিভের কাজ মানেই হচ্ছে ক্রাইম সলভ করা। আর ক্রাইম করে কারা? চোর, ডাকাত, বদমাইশ, অসৎ মানুষেরা। এদের পেছনে ঘুরতে কি ভালো লাগে?”
শান্ত বলল, “কী বলছো ছোটাচ্চু! চোর, ডাকাত, বদমাইশ মানুষেরাই তো ইন্টারেস্টিং। ভালো মানুষেরা হচ্ছে বোরিং! ঘুরতেই যদি হয় তাহলে ইন্টারেস্টিং মানুষদের পেছনেই ঘোরা উচিত।”
ছোটাচ্চু বলল, “এক-দুই দিন ঠিক আছে, কিন্তু যদি প্রত্যেকদিনই চোর- ডাকাতের পেছনে সময় কাটাতে হয় তাহলে ঠিক নাই।”
টুম্পা বলল, “ছোটাচ্চু, আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে।”
“কী আইডিয়া?”
“তুমি তোমার আল্টিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সিটা আমাদের দিয়ে দাও। আমরা সেটা চালাব। তুমি অন্য কিছু করো।”
সব বাচ্চারা মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ। তোমার তাহলে চোর, ডাকাত, বদমাইশদের পেছনে ঘুরতে হবে না।”
ছোটাচ্চু কিছুক্ষণ বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর জিজ্ঞেস করল, “আমি তাহলে কী করব?”
শান্ত বলল, “কোচিং সেন্টার দিতে পারো। কোচিং সেন্টারে অনেক টাকা। মেডিক্যাল আর ইঞ্জিনিয়ারিং ভর্তি কোচিংয়ে সবচেয়ে বেশি টাকা। কয়েকজন ধান্দাবাজকে নিয়ে নাও। তারাই তোমার জন্য সব করে দেবে। তুমি খালি বসে বসে টাকা গুনবে।”
আর একজন বলল, “না, না, না—কোচিং সেন্টার থেকে ভালো হচ্ছে টিভি চ্যানেল। নিজের টিভি চ্যানেল থাকলে ঈদের সময় তুমি সেখানে গান গাইতে পারবে।”
একজন মাথা নাড়ল, “সেইটা ঠিক। ছোটাচ্চুকে তা না হলে অন্য কোনো চ্যানেল গান গাইতে দিবে না।”
শান্ত বলল, “বাজে কথা বলবি না। টিভি চ্যানেল দিতে অনেক টাকা লাগে। কম টাকা দিয়ে যেটা করা যায় সেটা হচ্ছে ক্যাফে। খালি কয়েকটা চেয়ার-টেবিল আর ফ্রি ওয়াইফাই।”
একজন জিজ্ঞেস করল, “আর কফি বানাবে কে?”
“কফি আবার বানাতে হয় নাকি! ময়লা, কালা, তিতা গরম পানি হচ্ছে কফি।”
টুনি সবাইকে থামাল, ছোটাচ্চুর দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি হঠাৎ করে ডিটেকটিভ কাজ নিয়ে বিরক্ত হচ্ছ কেন?”
দাদিও তার বইয়ের পৃষ্ঠা ভাঁজ করে বইটা বন্ধ করে জিজ্ঞেস করলেন, “হ্যাঁ, তোর ডিটেকটিভ কাজে সমস্যা হচ্ছে?”
ছোটাচ্চু বলল, “না মা সমস্যা না। কাজের অভাব নাই কিন্তু মাঝে মাঝে এমন কেস আসে যে একেবারে মেজাজ গরম হয়ে যায়।”
দাদি জিজ্ঞেস করল, “কী কেস আসছে?”
“যেমন ধরো আজকে একজন ডাক্তার এসেছে। বড়ো হাসপাতালে কনসালট্যান্সি করে। রীতিমতো বড়ো ডাক্তার, রোগী দেখে শেষ করতে পারে না। সে আমার কাছে কেন এসেছে জানো?”
“কেন?”
“সেই ডাক্তার রোগীকে টেস্ট করতে দিয়েছে, রোগী টেস্ট রিপোর্টগুলো নিয়ে এসেছে, সেগুলো দেখে রোগীর চিকিৎসা করেছে, কিন্তু পরে কি দেখেছে জানো?”
“কী দেখেছে?”
“অনেক রিপোর্ট ভুয়া।”
“ভুয়া?”
“হ্যাঁ।”
“ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে ধরেছে?”
ছোটাচ্চু মাথা নাড়ল, বলল, “না, না, না—এটা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ব্যাপার না। ডায়াগনস্টিক সেন্টার তো সবসময় ভুল টেস্টের রিপোর্ট দেয়— সেইটা তো সবাই মেনেই নিয়েছে! এইটা অন্য জিনিস।”
টুনি জিজ্ঞেস করল, “অন্য জিনিস মানে কী?
“এটা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের রিপোর্ট না। ডায়াগনস্টিক সেন্টারের রিপোর্টের মতো করে কাগজে প্রিন্ট করে দিয়ে দিয়েছে।”
“তার মানে ডায়াগনস্টিক সেন্টার জানে না তাদের নামে কেউ একজন রিপোর্ট তৈরি করে দিচ্ছে?”
“হ্যাঁ।”
“বানানো রিপোর্ট?”
“হ্যাঁ।”
“সেই রিপোর্ট দেখে ডাক্তার ওষুধপত্র দিচ্ছে?”
“হ্যাঁ।”
শান্ত জিজ্ঞেস করল, “ভুলভাল চিকিৎসা করে রোগী মারা যাচ্ছে?”
ছোটাচ্চু বলল, “না রোগী মারা যায় নাই এখনও। ডাক্তার সে রকম কিছু বলে নাই।”
দাদি হতাশ হয়ে মাথা নাড়লেন, বললেন, “বুঝলি, এই অপরাধের কোনো মাফ নাই। যখন রোগীর চিকিৎসা নিয়ে কেউ চুরিচামারি করে তখন তার কোনো মাফ নাই।”
ছোটাচ্চু মাথা নাড়ল, “ঠিকই বলেছো মা। এই ডিটেকটিভগিরি করার জন্য এ রকম ক্রিমিনালদের খুঁজে বের করতে হয়।”
দাদি আবার তার বই খুলে পড়তে শুরু করার আগে বললেন, “এই রকম ক্রিমিনালদের ধরে পুলিশে দে। সমাজের উপকার হবে।”
“সেই জন্যই এখনও টিকে আছি মা। মাঝে মাঝেই ত্যক্তবিরক্ত হয়ে যাই।”
টুম্পা বলল, “যখন একেবারে আসল ত্যক্তবিরক্ত হবে তখন আমাদেরকে দিয়ে দিবে। আমরা সব ম্যানেজ করে দিব।”
ছোটাচ্চু কিছু না বলে একটা লম্বা শ্বাস ফেলল, তারপর উপর দিকে তাকিয়ে চিন্তা করতে লাগল। টুনি কিছুক্ষণ ছোটাচ্চুকে লক্ষ করল, তারপর তার পাশে গিয়ে বসল। নিচু গলায় বলল, “ছোটাচ্চু, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”
“কর।”
“তুমি বলেছো রোগীরা যে রিপোর্ট নিয়ে আসছে তার অনেক রিপোর্ট ভুয়া। তার মানে সবগুলো ভুয়া না?”
ছোটাচ্চু কিছুক্ষণ টুনির দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, “হ্যাঁ, তুই ঠিকই বলেছিস। সবগুলো ভুয়া না, কিছু কিছু ভুয়া।”
টুনি জিজ্ঞেস করল, “তোমার ডাক্তার সাহেব কি বলেছে কোন রিপোর্টগুলো সত্যি আর কোনগুলো ভুয়া?”
ছোটাচ্চু মাথা নাড়ল, বলল, “না সেটা বলে নাই।”
“তুমি জিজ্ঞেস করো নাই?”
“আমি কেন জিজ্ঞেস করব? আমি ডাক্তারি টেস্টের কী বুঝি?”
টুনি বলল, “না, মানে দরকারি টেস্ট আর বেদরকারি টেস্ট বলে কথা আছে তো। সেই জন্য ভুয়া টেস্টগুলি বেদরকারি কি না জানতে চাচ্ছিলাম।”
ছোটাচ্চু ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “তুই কী বলতে চাইছিস?”
টুনি বলল, “আমি কিছু বলতে চাইছি না, শুধু জানতে চাইছি।” “কী জানতে চাইছিস?”
“মানে যে টেস্টগুলোর দরকার নাই সেগুলোর জন্য ভুয়া কাগজ দিয়েছে কি না।”
ছোটাচ্চু একটু রেগে উঠল, বলল, “রোগী বুঝবে কেমন করে কোনটা দরকারি কোনটা বেদরকারি?
টুনি ছোটাচ্চুর রাগটা ঠান্ডা করার জন্য চুপচাপ বসে রইল। ছোটাচ্চু গজগজ করে বলল, “আর একজন বড়ো ডাক্তার বেদরকারি টেস্ট করতে দেবে কেন? এটা কী রকম কথা?”
টুনি মিনমিন করে বলল, “পত্রিকায় দেখেছিলাম তো, তাই বললাম।”
ছোটাচ্চু বলল, “আলতুফালতু পত্রিকা পড়বি না। ঠিক আছে?”
টুনি ঘাড় নেড়ে মেনে নিল। যখন মনে হলো ছোটাচ্চুর মেজাজটা একটু ঠান্ডা হয়েছে তখন আবার জিজ্ঞেস করল, “ছোটাচ্চু আমার একটা লাস্ট কোশ্চেন?”
“কী কোশ্চেন?”
“তোমার ডাক্তার কেমন করে বুঝল যে কিছু কিছু রিপোর্ট ভুয়া?”
“কী আশ্চর্য! একজন ডাক্তার একটা ভুয়া রিপোর্ট দেখলে বুঝবে না সেটা ভুয়া?”
“কেমন করে বুঝবে? এইটাও তো অন্য রিপোর্টের মতো দেখতে হুবহু একরকম!”
ছোটাচ্চু এবারে একটু থতমত খেয়ে গেল। বলল, “ডাক্তারদের নিশ্চয়ই বোঝার উপায় আছে।”
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ আছে। পত্রিকায় লিখেছিল, সেটাই জানতে চাচ্ছি।”
ছোটাচ্চু ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “পত্রিকায় কী লিখেছিল?”
“লিখেছিল, ডাক্তাররা নাকি ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে কমিশন পায়। যত বেশি টেস্ট করতে দিবে তত বেশি ইনকাম।
“তাই লিখেছে?”
“হ্যাঁ। সেই জন্য তোমার ডাক্তার যখন দেখেছে তার ইনকাম কমে গেছে তখন বুঝতে পেরেছে কিছু একটা সমস্যা। আমার তাই মনে হয়!”
ছোটাচ্চু আবার রেগে উঠল, বলল, “তোদের চিন্তাভাবনাই খারাপ। আলতুফালতু পত্রিকার আউলফাউল খবর পড়িস আর সবাইকে সন্দেহ করিস। একজন সম্মানী ডাক্তার নিয়ে একটা বাজে কথা বলে ফেললি!”
টুনি বলল, “আমি বলি নাই এ রকম হয়েছে, বলেছি এ রকম তো হতেও পারে! পত্রিকায় পুরো সপ্তাহ রিপোর্টিং করেছে। সব ডাক্তার খারাপ তা না— অনেক ডাক্তার এ রকম।”
ছোটাচ্চু হতাশভাবে মাথা নেড়ে উঠে গেল।
.
দুই দিন পর টুনি ছোটাচ্চুকে জিজ্ঞেস করল, “তোমার কি ভুয়া টেস্ট রিপোর্টের কেসটা সল্ভ হয়েছে?”
ছোটাচ্চু মাথা নাড়ল, বলল, “এত তাড়াতাড়ি কেমন করে শেষ হবে। এখনও কাজ চলছে।”
“কীভাবে বের করবে ছোটাচ্চু?”
“যেসব রোগী ভুয়া রিপোর্ট দিয়েছে তাদের খোঁজ করে বের করে ইন্টারভিউ নেব।”
“এখনও ইন্টারভিউ নাও নাই?”
“না। রিপোর্টে খালি রোগের নাম আর বয়স লেখা থাকে, সেটাই হচ্ছে মুশকিল।”
টুনি বলল, “ঠিকানা থাকলেও লাভ হতো না ছোটাচ্চু।”
“কেন?”
“কারণ, একজন রোগীর অসুখবিসুখের খবর গোপনীয়। তুমি যদি এটা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করো তোমার বিরুদ্ধে মামলা করে দিবে।”
ছোটাচ্চু মাথা চুলকাল, বলল, “তুই ঠিকই বলেছিস!”
টুনি বলল, “তোমার ডাক্তার যে মেডিক্যাল টেস্ট রিপোর্টগুলো তোমাকে দেখতে দিয়েছে, সেটাও মনে হয় বেআইনি। রোগী যদি জানে ডাক্তারের বিরুদ্ধে মামলা করে দিতে পারে।”
পাশেই দাঁড়িয়ে শান্ত টুনি আর ছোটাচ্চুর কথা শুনছিল। সে এবারে হাতে কিল দিয়ে বলল, “গুড আইডিয়া।”
ছোটাচ্চু জিজ্ঞেস করল, “কী গুড আইডিয়া?”
“মামলা।
“মানে?”
“আমরা ডাক্তার সাহেবকে মামলার ভয় দেখাই—”
“কেন তুই ডাক্তার সাহেবকে মামলার ভয় দেখাবি?”
“একটু হালকা ব্ল্যাকমেইলিং—”
ছোটাচ্চু দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “ভাগ এখান থেকে। এই বয়সে ব্ল্যাকমেইলিং করা শিখে গেছে!”
শান্ত মুখে একটা ফিচলে হাসি ধরে রেখে সরে গেল। ছোটাচ্চু চিন্তিত মুখে নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছিল, টুনি তার পিছু পিছু যেতে যেতে বলল, “ছোটাচ্চু, তোমাকে একটা কথা বলি?”
ছোটাচ্চু দাঁড়িয়ে গেল, বলল, “বল।”
“তুমি সবচেয়ে সোজা কাজটা করছো না কেন?”
“সবচেয়ে সোজা কাজ কী?”
“একজনকে রোগী হিসেবে ওই ডাক্তারের কাছে পাঠাও, যখন রোগী ডাক্তারের প্রেসক্রিপশান নিয়ে আসবে তখন ওই ভুয়া টেস্ট রিপোর্টের মানুষটা হয়তো নিজেই তার কাছে আসবে—তখন তাকে ধরে ফেলবে।”
ছোটাচ্চু হতাশভাবে মাথা নেড়ে বলল, “তোর কি ধারণা ওই লোক ডাক্তারের চেম্বারের সামনে নিজের বুকে একটা সাইনবোর্ড লাগিয়ে বসে আছে? সাইনবোর্ডে লিখে রেখেছে, আমি ভুয়া টেস্ট রিপোর্ট সাপ্লাই দেই?”
টুনি বলল, “না, তা আমি বলছি না। কিন্তু নিজের রোগী হলে তোমার গোপনীয়তা নিয়ে কোনো ঝামেলা হবে না, এটা হবে স্টিং অপারেশান।”
“দেখ টুনি ডিটেকটিভ কাজ হচ্ছে পরিশ্রমের কাজ। সব তথ্য একত্র করে সেটা বিশ্লেষণ করা, গভীর মনোযোগ দিয়ে সেটা সিনথেসিস করা, তারপর সেখান থেকে একটা প্যাটার্ন খুঁজে বের করা, তারপর সেই প্যাটার্ন থেকে একটা হাইপোথিসিস দাঁড়া করিয়ে অগ্রসর হওয়া।”
টুনি বলল, “বুঝেছি ছোটাচ্চু। কিন্তু ডাক্তারের কাছে রোগী সেজে যাওয়া এত সোজা—চেষ্টা করতে তো ক্ষতি নাই।”
ছোটাচ্চু এবারে রাগতে শুরু করে, মুখ খিঁচিয়ে বলে, “তোর ধারণা একজন রোগী সেজে যাবে আর গিয়ে দেখবে সেই মানুষটা একটা মাইক নিয়ে বসে চিৎকার করে বলছে, আসো আসো, আমার কাছে আসো। আমি ভুয়া টেস্ট রিপোর্ট বানিয়ে দেবো।”
টুনি হাল ছেড়ে দেওয়ার আগে শেষবার চেষ্টা করল, বলল, “ছোটাচ্চু, তোমাকে কিছু করতে হবে না, তুমি শুধু ডাক্তারের নাম বলো, কোথায় বসে বলো, আর—” টুনি কথা বলা বন্ধ করে মুখ কাঁচুমাচু করে ছোটাচ্চুর দিকে তাকাল।
ছোটাচ্চু মুখ শক্ত করে বলল, “আর কী?”
“ডাক্তারের ভিজিটের টাকা দাও, তাহলে আমি একজনকে রোগী সাজিয়ে নিয়ে যাব, তারপর কী হয় তোমাকে রিপোর্ট করব।”
“কাকে রোগী সাজিয়ে নিবি?”
“দাদিকে নিতে পারি। দাদিকে বললেই একটু বকাবকি করে মনে হয় রাজি
হয়ে যাবে। ভিজিটের টাকাটাও মনে হয় দিয়ে দিবে।”
“না, না, না—খবরদার মা’কে এসব জায়গায় টানাটানি করবি না।”
টুনি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “ঠিক আছে, তাহলে ফারিহাপু! ফারিহাপুর এই রকম স্টিং অপারেশানে অনেক উৎসাহ। মনে নাই—”
ছোটাচ্চু এবারে হুংকার দিলো, “খবরদার! ফারিহাকে এর মাঝে ঢুকাবি না। ছোটোখাটো একটা কাজ করে সারাক্ষণ আমাকে খোঁটা দেয়।”
টুনি বলল, “না মানে ফারিহাপুকে রাজি করালে আমার আর ডাক্তারের ভিজিট নিয়ে চিন্তা করতে হতো না।”
“ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমি তোকে ডাক্তারের নাম আর ভিজিট দিয়ে দেবো। অন্য কাউকে নিয়ে যা—আমার এজেন্সি থেকে একজন দিতে পারতাম কিন্তু সবাই এত ব্যস্ত যে এ রকম ফালতু কাজ করার সময় নাই।”
টুনি দাঁত বের করে হেসে বলল, “তুমি কোনো চিন্তা কোরো না। আমি ঝুমু খালাকে নিয়ে যাব। এই রকম কাজে ঝুমু খালা হচ্ছে সুপারডুপার।”
ছোটাচ্চুকে অবশ্য ঝুমু খালার নাম শুনে খুব উৎসাহী হতে দেখা গেল না, কিন্তু শেষ পর্যন্ত একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে মেনে নিল।
.
কাজেই দুই দিন পর একটা বড়ো হাসপাতালে ডাক্তারের চেম্বারের সামনে ঝুমু খালা আর টুনিকে বসে থাকতে দেখা গেল। চেম্বারের কাছাকাছি একটা ডেস্ক, সেখানে দুইজন মহিলা বসে আছে। কাগজপত্র দেখে একটু পরপর রোগীদের নাম ডাকছে এবং রোগীরা চেম্বারে ঢুকে যাচ্ছে। দশ-পনেরো মিনিট পর রোগীরা চকচকে ফোল্ডারে প্রেসক্রিপশান নিয়ে বের হয়ে আসছে।
টুনিদের সময় ছিল সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা, এখন সাতটার উপরে বাজে— সেটা নিয়ে টুনির কোনো সমস্যা নেই। তারা এসেছেই সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে, কাজেই সময় বেশি লাগলে তাদের জন্য ভালো। এখন পর্যন্ত তারা সন্দেহজনক কিছু দেখতে পায় নাই। ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হওয়ার পর রোগী আর আত্মীয়স্বজন মাঝে মাঝে চেম্বারের সামনে যে ডেস্ক আছে সেখানে বসে থাকা মহিলা দুজনের সাথে কথা বলে। মনে হয় পরের অ্যাপয়েন্টমেন্ট ঠিক করে নেয়। মাঝে মাঝে ডাক্তারের সাদা এপ্রোন পরা কমবয়সি একজন মেয়ে সেখানে কথা বলে—এই মেয়েটিও নিশ্চয়ই হাসপাতালের একজন, কারণ মাঝে মাঝেই সে ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকে যায়। কাজেই এখন পর্যন্ত ভুয়া টেস্ট রিপোর্ট দেওয়ার মতো সন্দেহজনক কাউকেই দেখতে পাচ্ছে না। অবশ্য টুনি খুব বেশি অবাক হলো না। ভুয়া মেডিক্যাল রিপোর্ট দেওয়ার মতো এ রকম বিপজ্জনক কাজ নিশ্চয়ই ডাক্তারের চেম্বারের সামনে করার সাহস পাবে না। চেম্বার থেকে বের হয়ে রাস্তায় নামার পর তাদের দেখা পাওয়া যেতে পারে।
শেষ পর্যন্ত ঝুমু খালার ডাক পড়ল। টুনিও ঝুমু খালার সাথে ভেতরে যাবে। দুজন উঠে দাঁড়াল, টুনি ঝুমু খালার হাত ধরে ফিসফিস করে বলল, “ঝুমু খালা, মনে আছে তো?”
ঝুমু খালা বলল, “মনে থাকবে না কেন! পেট জ্বলা বুক জ্বলা রোগ।”
“হ্যাঁ। এই ডাক্তার হচ্ছে গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিস্ট—তার মানে পরিপাকতন্ত্র—”
ঝুমু খালা টুনিকে ধমক দিলো, “এখন চুপ করো। আমার ওপর ছাইড়া দাও।” বলে ডাক্তারের চেম্বারের দরজা ধাক্কা দিয়ে ঢুকে গেল। টুনি পিছু পিছু গেল।
ছোটো একটা রুম। এক পাশে একটা উঁচু টেবিল, বালিশ-বিছানা পাতা আছে। রোগীকে এখানে শোয়ানো হয়। ডেস্কের সামনে দুইটা চেয়ার। পেছনে ডাক্তার সাহেব বসে আছেন। নাকের উপর চশমা, নাকের নিচে বড়ো গোঁফ এবং মাথায় টাক।
ডাক্তার সাহেব ভুরু কুঁচকে তাকালেন, বললেন, “বসেন।”
ঝুমু খালা বসে টুনিকে বলল, “তুই বস এখানে।”
টুনিও বসল।
ঝুমু খালা বলল, “ডাক্তার সাহেব কী কয় মন দিয়া শুনবি।”
টুনি মাথা নাড়ল। ঝুমু খালার মাথায় বুদ্ধি আছে। ডাক্তারের কাছে বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে আসার একটা অজুহাত তৈরি করে ফেলল।
ডাক্তার সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, “কী সমস্যা?”
ঝুমু খালা বলল, “সমস্যা কি একটা? সমস্যা একশটা। পেটে বেদনা, বুক জ্বলা। কিছু খাইলেই পেটে গ্যাস। খালি চুকা ঢেকুর ওঠে। যখন হিক্কি ওঠে তখন থামে না। রাত্রে ঘুমাইতে পারি না। এসিডিটির ট্যাবলেট মুড়িমুড়কির মতো খাই, তখন মাঝে মাঝে একটু বুক জ্বলা কমে—”
ডাক্তার সাহেব মাথা নাড়লেন, বললেন, “না, না—এটা হচ্ছে আমাদের দেশের সমস্যা। রোগীরা নিজে নিজের চিকিৎসা করে—এভাবে যখন-তখন ওষুধ খাওয়া ঠিক না।”
“সে জন্যই তো আপনার কাছে আসছি। কী করমু কন।”
“আপনাকে একটু চেক করতে হবে। বেডে শুয়ে পড়েন।”
ঝুমু খালা মুখ কালো করে বলল, “ডাক্তার সাহেব, আমার আবার কেতকুতি বেশি। পেটে হাত দিলেই কেতকুতি লাগে—”
“সেটা দেখা যাবে।”
ঝুমু খালা তখন বেডে শুয়ে পড়ল। ডাক্তার ব্লাড প্রেশার নিলেন। ঝুমু খালা সেটা সহ্য করল, কিন্তু যে-ই তার পেটে চাপ দিয়ে দেখার চেষ্টা করল, ঝুমু খালা গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে হাত-পা ছুড়ে এমনভাবে হি হি করে হাসতে শুরু করল যে, ডাক্তার রীতিমতো ভয় পেয়ে পেছনে সরে এলেন।
ঝুমু খালা অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বলল, “আপনি কী দেখবার চান বলেন, আমি নিজেই হাত দিয়ে দেখে আপনারে বলি।”
ডাক্তার সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, “যদি আপনি নিজে হাত দিয়ে বলতে পারতেন তাহলে তো আপনি ডাক্তার হয়ে যেতে পারতেন, আমার কাছে আসতে হতো না।”
“সেটা কথা সত্যি। ঠিক আছে আবার চেষ্টা করেন। ডাক্তার সাহেব কেতকুতি দিয়েন না।”
“আমি কেন কাতুকুতু দিব?”
এবারে ডাক্তার সাহেব সাবধানে পেট চেপে দেখে মাথা নেড়ে নিজের চেয়ারে বসলেন। ঝুমু খালাকে আরও কয়েকটা প্রশ্ন করলেন। ঝুমু খালা বানিয়ে বানিয়ে উত্তর দিলো—উত্তরগুলোর মাঝে নিশ্চয় কোনো মিল নেই, কারণ ডাক্তার সাহেব কয়েকবার তার টাক মাথা চুলকালেন।
শেষ পর্যন্ত ডাক্তার সাহেব তার প্যাড টেনে এনে প্রেসক্রিপশান লিখতে শুরু করলেন। টুনি মাথা উঁচু করে দেখল অনেকগুলো টেস্ট করতে দিয়ে নিচে কয়েকটা ওষুধের নাম লিখে প্রেসক্রিপশানটা ঝুমু খালার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, “এই টেস্টগুলো করে সামনের সপ্তাহে আবার দেখা করেন। আর নিচে কয়েকটা ওষুধ লিখে দিলাম, রাতে খাওয়ার আগে খাবেন। ঠিক আছে? আর একটা কথা—”
“কী কথা?”
“আজেবাজে জায়গায় টেস্ট করাবেন না। বাইরে কাউন্টার থেকে ভালো কয়েকটা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের নাম নিয়ে যাবেন।”
ঝুমু খালা মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়াল, তখন টুনি তার হাত ধরে টান দিয়ে ফিসফিস করে বলল, “ফি।”
“ও আচ্ছা।” ঝুমু খালা আবার বসে পড়ল, বলল, “ডাক্তার সাহেব, আপনার ভিজিট কয় টাকা?”
খুবই চাঁছাছোলা প্রশ্ন। ইচ্ছা করলে প্রশ্নটা আরও নরমভাবে করা যেত। ডাক্তার সাহেবও চাঁছাছোলাভাবে বললেন, “আটশ টাকা।”
ঝুমু খালা রীতিমতো আঁতকে উঠল, “আ-আ-আটশ টাকা!”
ডাক্তার সাহেব ঝুমু খালার কথা শুনে একটু অবাক হলেন এবং মনে হয় একটু অপমানিত বোধ করলেন। বললেন, “হ্যাঁ।”
“আটশ টাকা তো অনেক বেশি ডাক্তার সাহেব। একটু কম নেন। চারশ টাকা দেই?”
ডাক্তার সাহেব অবাক হয়ে ঝুমু খালার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, “আপনি এসব কী বলছেন? খোঁজ নিয়ে আসেন নাই?”
“খোঁজ নিয়েই তো আসলাম, কিন্তু সব জায়গায় তো দরদাম করলে কম রাখে। সেদিন একটা শাড়ি কিনলাম, দুই হাজার চাইছে, বিক্রি করছে সাতশ টাকায়।”
ডাক্তার সাহেবের মুখ লাল হতে শুরু করেছে। চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, “এটা শাড়ির দোকান না। এইটা ডাক্তারের চেম্বার।”
টুনি তখন ঝুমু খালার হাত ধরে বলল, “ঝুমু খালা, ডাক্তার সাহেবের ভিজিট দিয়ে দাও। প্লিজ।”
ঝুমু খালা টুনির হাত সরিয়ে খুবই বিরক্ত হয়ে একটা ব্যাগ খুলে বেশ কিছু খুচরা টাকা মিলিয়ে আটশ টাকা বের করে ডাক্তারের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, “নেন।” ডাক্তার সাহেব টাকাটা নিয়ে তার ড্রয়ারে রাখলেন। তখন ঝুমু খালা বলল, “একটা রসিদ দিবেন না?”
ডাক্তার সাহেব চোখ বড়ো বড়ো করে বললেন, “রসিদ?”
ঝুমু খালা বলল, “জে, আমার হাজব্যান্ড কইছে রসিদ না নিয়া যেন কোনোদিন টাকা না দেই।”
ডাক্তার সাহেব চশমার ফাঁক দিয়ে কয়েক সেকেন্ড ঝুমু খালার দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর বললেন, “বাইরে কাউন্টার আছে সেখানে বলেন, তারা রিসিট দিয়ে দেবে।”
ঝুমু খালা উঠে দাঁড়িয়ে ডাক্তার সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল, “থ্যাঙ্কু ডাক্তার সাহেব।” তারপর টুনির দিকে তাকিয়ে বলল, “বুঝলি ঝুমু, রসিদ দিলে সেইটা হচ্ছে হোয়াইট মানি, হালাল রুজি। আর রসিদ না দিলে সেইটা বেলেক মানি, হারাম রুজি।”
যদিও কথাটা টুনিকে বলা হয়েছে কিন্তু হোয়াইট ও ব্ল্যাক মানির পার্থক্যটা ডাক্তার সাহেবও শুনলেন। শুনে তার লাল মুখটা এবারে রীতিমতো কালো হয়ে উঠল।
ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হয়ে ঝুমু খালা ফিসফিস করে বলল, “কী রকম অ্যাক্টিং করলাম?”
“একটু বেশি হয়ে গেছে ঝুমু খালা।”
“কম হওয়া থেকে বেশি হওয়া ভালো।”
“চলো যাই এখন।”
“খাড়াও, রিসিটটা নিয়া নিই।”
ঝুমু খালা যখন রিসিট নিচ্ছে তখন সাদা এপ্রোন পরা কমবয়সি মেয়েটা এসে টুনির হাত থেকে ফোল্ডারটা নিয়ে একনজর দেখে ফেরত দিয়ে ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকে গেল। মেয়েটা মনে হয় এই ডাক্তার সাহেবের নার্স।
কাউন্টার থেকে একটা রিসিট প্রিন্ট করে দিয়ে রিসিটের সাথে কয়েকটা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কার্ড স্ট্যাপল করে ঝুমু খালার হাতে দিয়ে বলল, “এই ডায়াগনস্টিক সেন্টার ছাড়া অন্য জায়গায় টেস্ট করাবেন না। আজকাল রাস্তার মোড়ে মোড়ে ডায়াগনস্টিক সেন্টার—কিন্তু কোনোটা ভালো না।”
ঝুমু খালা বলল, “ঠিক আছে।”
তারপর দুইজন ওয়েটিং রুম থেকে বের হয়ে যেতে থাকে। তারা মাত্র কয়েক পা গিয়েছে তখন হঠাৎ পেছন থেকে একটা মেয়ের গলার স্বর শুনল, “এই যে শুনেন—”
টুনি ঘুরে তাকিয়ে দেখল সাদা এপ্রোন পরা মেয়েটা তাদের দিকে হেঁটে আসছে। মেয়েটা কাছে এসে ঝুমু খালাকে বলল, “ডাক্তার সাহেব আপনাকে অনেকগুলো টেস্ট করতে দিয়েছেন, তাই না?”
ঝুমু খালা মাথা নাড়ল।
মেয়েটা বলল, “এখানে কেউ আসলেই তাকে সবসময় অনেকগুলো টেস্ট করতে দেয়। এটাই নিয়ম।”
টুনি অবাক হয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইল। মেয়েটা মুখে একটা বাঁকা হাসির ভান করে বলল, “বেশিরভাগ টেস্টের কোনো দরকার নাই।”
ঝুমু খালা জিজ্ঞেস করল, “দরকার নাই?”
“না।”
“আপনি কেমন করে জানেন? আপনি কি ডাক্তার?”
“না, আমি এখনও ডাক্তার হই নাই। সামনের বছর পাস করলে হয়ে যাব। কিন্তু আমি জানি। কমনসেন্স। যাই হোক, ডাক্তার সাহেব যে টেস্ট করতে দিয়েছেন সেগুলি করতে অনেক টাকা লাগবে। আমি আপনাদের কিছু টাকা বাঁচিয়ে দেই?”
ঝুমু খালা টুনির দিকে তাকাল। টুনিও ঝুমু খালার দিকে তাকাল। দুইজনেই একসাথে হেসে উঠল। এপ্রোন পরা মেয়েটা ভুরু কুঁচকে বলল, “কী হলো? হাসো কেন?”
টুনি বলল, “আপু, তুমি আমাদের বেদরকারি টেস্টগুলোর জন্য ভুয়া রিপোর্ট তৈরি করে দিবে। তাই না?”
মেয়েটা আমতা আমতা করে বলল, “হ্যাঁ। কিন্তু তোমরা কেমন করে বুঝলে?”
টুনি বলল, “আপু! আমরা দুইজন স্টিং অপারেশান করে তোমাকে ধরতে এসেছি।”
“আ-আ-আমাকে ধরতে এসেছো?”
“হ্যাঁ।” টুনি ঝুমু খালাকে দেখিয়ে বলল, “আসলে ঝুমু খালার কোনো অসুখ হয় নাই। আমরা এমনি এসেছি।”
“তোমরা কারা?”
“ডাক্তার সাহেব তোমাকে ধরার জন্য একজন ডিটেকটিভ লাগিয়েছেন। আমরা সেই ডিটেকটিভ এজেন্সি থেকে এসেছি।”
মেয়েটা ভালো করে টুনিকে দেখল, তারপর বলল, “এটা কী রকম ডিটেকটিভ? তোমার মতো বাচ্চা মেয়েকে অ্যাসাইনমেন্টে পাঠায়?
টুনি বলল, “আসলে আমার ছোটো চাচা হচ্ছে ডিটেকটিভ। মাঝে মাঝে আমরা তার কাজ করে দেই।”
মেয়েটা বলল, “ও।”
টুনি বলল, “আপু, তোমাকে একটা জিনিস জিজ্ঞেস করি?” “করো।”
“তুমি কেন এটা করো? কোনোদিন ঝামেলায় পড়বে না?”
মেয়েটা হাসল, বলল, “আমি তো ঝামেলায় পড়তেই চাই। তাহলে একটা
হইচই হবে, পত্রিকায় নিউজ হবে—সবাই জানবে, কিন্তু এখনও ঝামেলায় পড়তে পারি নাই। চেষ্টা করে যাচ্ছি।”
টুনি বলল, “আপু!”
“কী?”
“তোমার মতোন ইন্টারেস্টিং মানুষ আমি জন্মেও দেখি নাই। এই ডাক্তার সাহেবের ওপর তোমার এত রাগ কেন?”
“কারণ, এই ডাক্তার সাহেব কত টাকা কামাই করে তুমি চিন্তাও করতে পারবে না।”
“এই জন্য রাগ?”
“না। আরও একটা কারণ আছে।”
“কী কারণ? বলবে আপু।”
মেয়েটি একটা নিঃশ্বাস ফেলল, তারপর বলল, “এই ডাক্তার সাহেব হচ্ছে আমার আব্বু।”
টুনি হাঁ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল, তারপর হি হি করে হাসতে শুরু করল। কিছুতেই হাসি থামাতে পারে না।
মেয়েটা কিছুক্ষণ টুনির দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, “এটা আসলে হাসির ব্যাপার না। এইটা হচ্ছে দুঃখের ব্যাপার। আমি বুঝি না আমার আব্বুর এত লোভ কেন! লোভ থেকে খারাপ কিছু নাই। বুঝলে মেয়ে—”
“আমার নাম টুনি।”
“বুঝলে টুনি, আমি যখন ডাক্তার হব তখন আমি রোগী থেকে পাঁচ টাকা ফি নিব। খোদার কসম। মরে গেলেও ভুয়া টেস্ট করতে দিব না। আরও বড়ো হলে কি করব জানো?”
“কী করবে?”
“আমার মতো যারা আছে তাদের নিয়ে একটা সত্যিকার হাসপাতাল দিব। সেই হাসপাতালে চিকিৎসা হবে, গবেষণা হবে—”
টুনি অবাক হয়ে দেখল মেয়েটার চোখের কোনায় পানি চিকচিক করছে। সে মেয়েটার হাত ধরে বলল, “আপু—”
“বলো।”
“আমি তোমার হাসপাতালে চাকরি করব আপু।”
মেয়েটা টুনির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “ঠিক আছে টুনি। চলে এসো।”
.
ছোটাচ্চু জিজ্ঞেস করল, “টুনি তোদের স্টিং অপারেশান কেমন হয়েছে?”
টুনি দাঁত বের করে হাসল, বলল, “সাকসেসফুল।”
ছোটাচ্চু অবাক হয়ে বলল, “সত্যি?”
“হ্যাঁ। আমার কথা বিশ্বাস না হলে ঝুমু খালাকে জিজ্ঞেস করো।”
ছোটাচ্চু বলল, “ঠিক আছে তোর কথাই বিশ্বাস করলাম। কে সেই মানুষ?”
“বলা যাবে না ছোটাচ্চু।”
“কী বললি?”
“বলেছি, মানুষটার পরিচয় দেওয়া যাবে না।”
“মানে?”
টুনি চোখ নাচিয়ে বলল, “এই মানুষটা কে সেটা গোপন থাকা ভালো।”
“কেন?” ছোটাচ্চু রেগে উঠতে চেয়েছিল কিন্তু টুনির কথা শুনে এত অবাক হলো যে, ঠিকমতো রেগে উঠতে পারল না।
টুনি বলল, “কারণ মানুষটার পরিচয় জানাজানি হয়ে গেলে এই অসাধারণ প্রজেক্টটা বন্ধ হয়ে যেতে পারে।”
“কী বললি?”
“তা ছাড়া মানুষটার পরিচয় জানাজানি হয়ে গেলে তোমার ডাক্তার সাহেবের ঝামেলা হয়ে যেতে পারে।”
“কী বললি? কী বললি তুই?” ছোটাচ্চু শেষ পর্যন্ত রেগে উঠতে পারল। “ঠিকই বলেছি। তাই না ঝুমু খালা?”
ঝুমু খালা মাথা নাড়ল। বলল, “একেবারে সত্যি কথা।” ছোটাচ্চু অবাক হয়ে দুইজনের দিকে তাকিয়ে রইল।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন