অধ্যায়-২ মিসরে যাবার আগে কেমন ছিল বনী ইসরাইল?

আব্দুল্লাহ ইবনে মাহমুদ

অধ্যায়-২ মিসরে যাবার আগে কেমন ছিল বনী ইসরাইল?

বনী ইসরাইল জাতিকে হযরত মূসা (আ) মিসর থেকে মুক্ত করে নিয়ে গিয়েছিলেন— এটা ইহুদী, খ্রিস্টান ও মুসলিম সকলেই বিশ্বাস করেন, কিন্তু মিসরে স্থান পাবার আগের ঘটনা কী?

হযরত ইব্রাহিম (আ)-এর এক পুত্র হযরত ইসমাইল (আ), আর আরেকজন ছিলেন হযরত ইসহাক (আ), যাকে ইংরেজিতে আইজ্যাক ডাকা হয়। ইহুদীদের বিশ্বাস, অর্থাৎ আদিপুস্তক (২৫) অনুযায়ী, হযরত ইসহাক (আ) এর বয়স যখন ৪০ বছর, তখন তিনি বিয়ে করেন রেবেকা নামের এক মেয়েকে।

তিনি জমজ পুত্রসন্তানের জন্ম দিলেন। একজনের নাম ‘ইসাও’ বা আরবে যাকে ‘ঈস’ বলে। আর অপরজন ছিলেন হযরত ইয়াকুব (আ) বা জ্যাকব।

তাঁদের ঘটনাগুলো বর্ণনা করবার ক্ষেত্রে আমরা ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত হযরত ইবনে কাসির (র) রচিত আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া (ইসলামের ইতিহাস: আদি-অন্ত) গ্রন্থকে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করছি। এছাড়াও, ইহুদীদের তৌরাতের আদিপুস্তক ও তাদের নীতিবাক্য ও তফসির গ্রন্থ মিদ্রাশও ব্যবহৃত হবে।

এক্ষেত্রে ইহুদী কিতাবগুলোতে কিছু অদ্ভুত কাহিনীর বর্ণনা রয়েছে, যা ইসলামি কিতাবগুলোতে পাওয়া যায় না। যেমন- বলা আছে, হযরত ইয়াকুব (আ) এর চেয়ে বড় সন্তান ঈসের প্রতি বাবা হযরত ইসহাক (আ) এর বেশি ভালোবাসা ছিল। কিন্তু রেবেকার একটি চালের কারণে হযরত ইয়াকুব (আ) বাবার আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে ওঠেন, কিন্তু ঈস হননি। এতে ঈস হযরত ইয়াকুবের (আ) প্ৰতি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। ফলে মায়ের পরামর্শে হযরত ইয়াকুব (আ) পালিয়ে যান, গন্তব্য ‘হারান’।

তবে এরপরের কাহিনীগুলো নিয়ে তেমন মতভেদ নেই। হযরত ইয়াকুব (আ) বীরশেবা থেকে বেরিয়ে হারান মরুর দিকে যাচ্ছিলেন। ঠিক যেমনটা আগের অধ্যায়ে বলা হয়েছিল। এখানে তিনি সন্ধ্যার পর ঘুমালে স্বপ্ন দেখেন যে, পৃথিবী থেকে একটি সিঁড়ি উপরে উঠে গেছে। সেখানে আল্লাহর ফেরেশতারা ওঠা-নামা করছে। স্বপ্নে আল্লাহ তাঁকে জানালেন, যেখানে হযরত ইয়াকুব (আ) শুয়ে আছেন, সেই ভূমি তিনি তাঁকে দেবেন, এবং তাঁর বংশধরকে। তাঁর বংশধরেরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে।

স্বপ্ন দেখে তিনি জেগে উঠলেন। এই সিঁড়ির স্বপ্ন ‘জ্যাকব’স ল্যাডার ড্রিম নামে পরিচিত। এ স্বপ্নের মাধ্যমে তিনি পবিত্র ভূমির প্রতিশ্রুতি পান। আর ইহুদী ও খ্রিস্টানরা হলো হযরত ইয়াকুব (আ) এর বংশধর।

‘লুজ’ নামের সেই জায়গার নাম তিনি ‘বেথেল’ (‘বাইতুল্লাহ’) রাখলেন। ইবনে কাসিরের ‘আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ গ্রন্থে আছে, তিনি ওয়াদা করলেন যে, ভবিষ্যতে তিনি যদি নিরাপদে পরিবারের কাছে ফেরত যেতে পারেন তবে শুকরিয়া স্বরূপ ঠিক এ জায়গায় আল্লাহর জন্য একটি ইবাদতখানা নির্মাণ করবেন। পাথরের উপর বিশেষ তেল দিয়ে তিনি জায়গাটা চিহ্নিত করেও রাখলেন।

এরপর হযরত ইয়াকুব (আ) আবার রওনা দিলেন। পূর্বদিকের এক অঞ্চলে এসে তিনি মানুষকে জিজ্ঞেস করলেন জায়গাটার নাম। তারা উত্তর দিল, এ জায়গার নাম ‘হারান’। অর্থাৎ তিনি ঠিক জায়গায় এসে পৌঁছিয়েছেন।

তখন ইয়াকুব (আ) জিজ্ঞেস করলেন, “আপনারা কি লাবানকে চেনেন?” আসলে তিনি তাঁর মামা লাবানের কাছেই এসেছিলেন, তাঁর মা তাঁকে বলেছিলেন সেভাবেই!

তারা বলল, “জ্বি, চিনি। তিনি ভালোই আছেন। ঐ যে দেখুন, তাঁর মেয়ে রাহেলা ভেড়ার পাল নিয়ে আসছেন।”

দেখা গেলো, রাহেলা (হিব্রু 1২, ইংরেজি Rachel) তাঁর বাবার ভেড়াগুলো নিয়ে সেখানে আসছেন; তাঁকে আসতে দেখে ইয়াকুব (আ) দ্রুত এগিয়ে কুয়ার মুখ থেকে পাথর সরিয়ে দিয়ে ভেড়াগুলোকে পানি খাওয়ালেন। এরপরই তিনি রাহেলাকে সব খুলে বললেন, যা যা হয়েছে।

রাহেলা দৌড়ে গিয়ে বাবা লাবানকে ডেকে আনলেন। লাবান এসে বরণ করলেন হযরত ইয়াকুব (আ)-কে, তাঁকে জড়িয়ে ধরে নিয়ে গেলেন বাড়িতে। মাসখানেক সেখানেই কাটালেন হযরত ইয়াকুব (আ)। সময়টায় লাবানের নানা কাজকর্ম করে দিতে লাগলেন তিনি।

তখন লাবান বললেন, “তুমি আমার আত্মীয় দেখে কি বিনা বেতনে খেটে যাবে? বলো, তোমাকে কী দিতে পারি?”

উত্তরে ইয়াকুব (আ) জানালেন, “আমি আপনার ছোট মেয়ে রাহেলার জন্য সাত বছর আপনার কাজ করব।” অর্থাৎ তিনি রাহেলাকে বিয়ে করতে চান। উল্লেখ্য, রাহেলার বড় বোন ছিলেন ‘লিয়া’ (হিব্রু 78২, ইংরেজি Leah)।

সাত বছর ইয়াকুব (আ) কাজ করবার পর তাঁর মামা লাবান একটি ভোজের আয়োজন করলেন। এবং ভোজ শেষে মেয়েকে নিয়ে এলেন ইয়াকুব (আ)-এর কাছে। কিন্তু কী আশ্চর্য, মেয়েটি রাহেলা ছিল না, ছিল লিয়া। ইয়াকুব (আ) অবাক হয়ে বললেন, “আপনি আমার সাথে এটা কেমন ব্যবহার করলেন? ঠকালেন আমাকে?”

লাবান জানালেন, “আমাদের দেশের নিয়মানুযায়ী বড় মেয়ের আগে ছোট মেয়ের বিয়ে দেয়া যায় না। তুমি এ বিয়েটা করে ফেলো। এরপর আরো সাত বছর আমার জন্য কাজ করবে পরে, তাহলে আমার অন্য মেয়েটিও আগামী সপ্তাহে হবে তোমার।”

হযরত ইয়াকুব (আ) মেনে নিলেন কথাটা। সেই সপ্তাহ শেষে রাহেলাও তাঁর স্ত্রী হলেন। তিনি আরো সাত বছর কাজ করলেন লাবানের অধীনে। ইব্রাহিমি শরীয়ত অনুযায়ী, দু’বোনকে বিয়ে করাতে সমস্যা ছিল না।

লিয়া সহজেই গর্ভবতী হলেও রাহেলা বহু দিন পর্যন্ত ছিলেন নিঃসন্তান। হযরত ইয়াকুব (আ) এর ১২ পুত্র হয়েছিল, এর মাঝে শেষ দুজন কেবল রাহেলার গর্ভে। তারা ছিলেন হযরত ইউসুফ (আ) (Joseph) এবং বেনইয়ামিন (Benjamin)। বেনইয়ামিনের জন্ম দিতে গিয়ে রাহেলা মারা যান।

তাঁর বাকি ১০ পুত্র ছিল রূবেন (Reuben ), শিমিয়োন (Simeon), লেবি (Levi), এহুদাহ (Judah), ইসাখার (Issachar ), সবুলুন (Zebulun), দান (Dan), নপ্তালি (Naphtali), গাদ (Gad) এবং আশের (Asher)। তাঁর একমাত্র কন্যা ছিলেন দিনাহ (Dinah)।

২০ বছর মামার ভেড়া চরাবার পর তিনি দেশে ফেরত যেতে চাইলেন। মামা সেই অনুমতি দিলেন। জমজ ভাই ঈসের সাথে সম্পর্ক ভালো করবার জন্য হযরত ইয়াকুব (আ) ইদোম দেশে লোক পাঠালেন। লোক পাঠাবার পর নিজেও একই রাস্তায় রওয়ানা দিলেন। পথিমধ্যে এক জায়গায় তাঁর দেখা হলো ফেরেশতাদের সাথে। ইয়াকুব (আ) এর দূতেরা ফিরে এসে জানালো, “আপনার ভাই ঈস তো ৪০০ লোক নিয়ে আপনার সাথে দেখা করতে আসছেন।” এ কথা শুনে ইয়াকুব (আ) ভাবলেন, ঈস বুঝি তাদের আক্রমণ করতে আসছেন। তিনি ঘাবড়ে গেলেন।

তিনি তখন তাঁর বিশাল দলটিকে দু’ভাগে ভাগ করলেন। ভাবলেন, একটা দলের সাথে ঈসের দেখা হলে যদি আক্রমণ করে, তবে অন্য দলটি পালিয়ে যেতে পারবে। এটা করবার পর তিনি তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে কাফেলা ওখানেই থামালেন। সিদ্ধান্ত নিলেন, ঈসের জন্য তিনি অনেক উপহার দেবেন- দুশো ছাগী, বিশটি ছাগল, দুশো ভেড়ী, বিশটি ভেড়া, ত্রিশটি দুধেল উটনী, চল্লিশটি গাভী, দশটি ষাঁড়, বিশটি গাধী ও দশটি গাধা। উপহারগুলো তিনি আগে আগে পাঠিয়ে দিলেন। কিন্তু তিনি রাতটা ওখানেই কাটালেন।

ঠিক এ জায়গায় এসে ইসরাইলি বর্ণনায় একটি ঘটনা উল্লেখ আছে। রাতেই যব্বোক নামের এক নদী পেরিয়ে অন্য পাড়ে স্ত্রী-সন্তানদের রেখে আসলেন ইয়াকুব (আ), সাথে আর যা কিছু আছে। তখন কোথা থেকে যেন এক লোক এলো এবং একা হযরত ইয়াকুব (আ) এর সাথে লড়াই শুরু করল। দুজনে ভোরের আলো ফোটা পর্যন্ত কুস্তি করলেন। লোকটি খেয়াল করলো, সে ইয়াকুব (আ)-কে হারাতে পারছে না। তখন সে সজোরে ইয়াকুব (আ) এর রানের জোড়ায় আঘাত করল, এতে তাঁর রানের হাড় সরে গেল। এরপর সে বলল,

“ভোর হয়ে আসছে, এবার আমাকে ছাড়ো। তোমার নাম কী?”

“আমার নাম ইয়াকুব।”

ইহুদী বর্ণনা (আদি পুস্তক ৩২:২৮) অনুযায়ী, এ পর্যায়ে লোকটি তাঁকে জানালো, এখন থেকে ইয়াকুব (আ) এর নাম হবে ইসরাইল। ইহুদী ও খ্রিস্টান মতবাদে এ শব্দের অর্থ ‘যিনি ঈশ্বরের সাথে যুদ্ধ করেন’, কিন্তু অর্থটি বেশ অসঙ্গতিপূর্ণ। সত্যি বলতে, হিব্রু ইসরাইল শব্দের আক্ষরিক অর্থ ‘আল্লাহর জয় হয়’ (El prevails), আর ভাবার্থ দাঁড়ায় ‘ঈশ্বরের পথে সংগ্রামে জড়িত কেউ। হিব্রু ভাষায় ‘ইসরাইল’ কথাটির উচ্চারণ অনেকটা এরকম- ‘য়িস্রাএল’ (২৪৭”)। এই নামটি ৩টি অংশে গঠিত। ‘য়ি’, ‘স্রা’ এবং ‘এল’। ‘য়ি’ একটি পূর্বপদ বা prefix, যা দ্বারা পুরুষবাচক শব্দ বোঝায়। ‘স্রা’ শব্দটি এসেছে সেমিটিক ধাতু ‘স্রাঈ’ থেকে, যার মানে হচ্ছে সংগ্রাম করা (strive/ struggle)। আর ‘এল’ শব্দটি ইলাহ বা আল্লাহকে বুঝিয়ে থাকে। অদ্ভুত ব্যাপার, বাইবেলের বুক অফ জেনেসিসে প্রাথমিকভাবে ইয়াকুব (আ) স্বয়ং ঈশ্বরের সাথে মল্লযুদ্ধ করেছিলেন এমন আপাত ধারণা দিলেও, পরবর্তীতে বাইবেলেই পুস্তকেই পরিষ্কার করে দেয়া হয়, “সে [ইয়াকুব] ঈশ্বরের দূতের সঙ্গে লড়াই করেছিল এবং জিতেছিল।” (হোশেয় ১২:৪)

ইয়াকুব (আ) লোকটির নাম জিজ্ঞেস করলেন। কিন্তু নাম না বলেই লোকটি উধাও হয়ে গেলো। তখন ইয়াকুব (আ) বুঝতে পারলেন, লোকটি ফেরেশতা ছিল। কিন্তু এই মল্লযুদ্ধের সাথে ইসরাইল নামের সম্পর্ক কী সে বিষয়ে ইসলামি ব্যাখ্যাগ্রন্থে কোনো বর্ণনা নেই। হযরত ইবনে কাসির (র) এ ঘটনা তাঁর কিতাবে উল্লেখ করেছেন, তবে ব্যাখ্যা করেননি।

ইহুদীরা এই ঘটনা স্মরণ করে কোনো প্রাণীর রানের জোড়ার উপরকার গোশত খায় না, এটা তাদের জন্য হারাম। এ ঘটনার পর হযরত ইয়াকুব (আ) খোঁড়া হয়ে যান।

তবে ইয়াকুব (আ) যে ভয়টা পাচ্ছিলেন, সেটি মিথ্যে ছিল। ঈস পরদিন যখন এলেন, তখন দু’ভাইয়ের মিলন সুখেরই ছিল। ঈস হযরত ইয়াকুব (আ) এর স্ত্রী-পুত্রদের দেখে খুশি হয়েছিলেন। ইয়াকুব (আ) এর শত অনুরোধে ঈস উপহারগুলো গ্রহণ করেন।

এরপর তিনি শাখীম এলাকার উরশালিম নামের এক গ্রামে পৌঁছান। সেখানে শাখীম ইবনে জামুরের এক টুকরো জমি তিনি ১০০ ভেড়ার বিনিময়ে কিনে নেন ও সেখানে তিনি একটি কোরবানগাহ নির্মাণ করেন। সেটির নাম তিনি রাখেন ‘এল ইলাহী ইসরাইল’ (ইসরাইলের মাবুদই আল্লাহ)। ইবনে কাসির (র) তাঁর আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া কিতাবে লেখেন, এ কোরবানগাহ নির্মাণের আদেশ আল্লাহ দিয়েছিলেন হযরত ইয়াকুব (আ)-কে। এটিই আজকের বাইতুল মুকাদ্দাস। এটা সে জায়গা ছিল যেখানে তিনি তেল দিয়ে চিহ্নিত করে রেখেছিলেন, এবং নিজে ওয়াদা করেছিলেন।

ইসরাইল (আ) ঠিকঠাক স্বদেশে ফিরে এসেছিলেন। তাঁর ১২ পুত্রের বংশ পরবর্তীতে ইসরাইলের ১২ গোত্র অর্থাৎ বনী ইসরাইল নামে পরিচিত হয়। আগেই বলা হয়েছে, তাঁর স্ত্রী রাহেলার সন্তান হচ্ছিল না, আল্লাহর কাছে অনেক প্রার্থনার পর তাঁর অসম্ভব ফুটফুটে পুত্র সন্তান হয়। তাঁর নাম রাখা হয় ‘ইউসুফ’।

এই সুপুরুষ হযরত ইউসুফ (আ) শেষ পর্যন্ত অধিষ্ঠিত হন মিসররাজের এক উজির হিসেবে! সে এক অসাধারণ কাহিনী! কিন্তু সেই কাহিনীর পাশেও আরেকটি ব্যাপার আমরা খেয়াল করব পরবর্তী পর্বে, আর সেটি হচ্ছে, যেহেতু হযরত ইউসুফ (আ) ধর্মীয় ইতিহাস অনুযায়ী প্রাচীন মিসরের প্রশাসনিক পদ পেয়েছিলেন, তাহলে কি প্রাচীন মিসরের হায়ারোগ্লিফিক হোক আর প্যাপিরাসের লেখনিই হোক— যেকোনো জায়গায় কি আমরা তাঁকে খুঁজে পাবো না মিশরের ইতিহাসের পাতায়? কারো সাথে কি খাপে খাপে মিলে যায় এ ঘটনাগুলো?

কিছু সাধারণ প্রশ্ন যেগুলো মাথায় আসতে পারে, সেগুলো প্রশ্নোত্তর আকারে তুলে ধরা যাক।

প্রশ্ন: ইসরাইলিদের সাথে পৌত্তলিক বা প্যাগানদের সম্পর্ক কী?

উত্তর: লাতিন শব্দ paganus থেকে প্যাগান শব্দ এসেছে। মূলত প্যাগান বলতে তাদেরকেই বোঝায় যারা বহু দেব-দেবীর পূজা করত বা করে। সেটা মূর্তিপূজা হতেও পারে, না-ও পারে। মূর্তিপূজা এর অন্তর্গত। বনী ইসরাইলিরা একেশ্বরবাদী ছিল। সত্যি বলতে, খ্রিস্টানদের থেকে ইহুদীদের সাথেই বরং ঐশ্বরিক ধারণায় মুসলিমদের বেশি মিল। ইসরায়েলিরা মরুভূমিতে যাযাবর সময় কাটাবার সময় অনেক সময়ই নানা প্যাগান সম্প্রদায়ের সংস্পর্শে এসেছে, পূজাও করেছে পথভ্রষ্ট হয়ে। বাইবেল ও কুরআনে সামেরির গোবাছুরের ঘটনা যেমন এসেছে, আবার দেবতা বা’আল এর কথাও এসেছে। এমনকি এ অধ্যায়ে উল্লেখিত যে লাবানের কথা বলা হলো, তিনি নিজেও প্যাগান বা পৌত্তলিক ছিলেন। ইহুদী কিতাবে এ ব্যাপারে বিবরণ পাওয়া যায়। দশাদেশ অবতরণের সময় এই ‘শিরক’ বা ‘ঈশ্বরের সাথে অংশীদার করা’-কে হারাম করা হয়েছিল।

প্রশ্নঃ কানান থেকে ইসমাইল (আ) কীভাবে এত দূর পথ পাড়ি দিয়ে মক্কায় এলেন, যিনি মুসলিম জাতির পিতা?

উত্তর: আসলে, হযরত ইব্রাহিম (আ) এসেছিলেন। হ্যাঁ, হযরত ইসমাইল (আ) এবং হাজেরাকে নিয়ে আসেন। উত্তরের খাতিরে আমরা কানান ( Canaan) বলতে হযরত ইব্রাহিম (আ) এর সমাধি যেখানে সেই হেব্রনকে ধরে নিই। তবে আমরা দেখতে পাই, হেব্রন থেকে মক্কার দূরত্ব ১,২২২ কিলোমিটার। অনেক দূর বটে, কিন্তু পার হওয়া যাবে না এমন নয়। আগেকার দিনেই এই দূরত্ব উটের পিঠে হরহামেশাই পার হওয়া হতো। ব্যবসার খাতিরে অনেক জায়গাতেই যাওয়া হতো। তাহলে হযরত ইব্রাহিম (আ) এর সময়ও একই জিনিস করা সম্ভবপর ছিল। অবশ্য, ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেছেন যে, ইব্রাহিম (আ) অলৌকিক দ্রুতগতিসম্পন্ন জীব বুরাকে করে প্রতি বছর মক্কায় হজ্ব করতেন। (আখবারুল মাক্কাহ’- আযরাকী, রেওয়ায়েত ৭৯)

প্রশ্নঃ হযরত ইসমাইল (আ) কি হযরত ইব্রাহিম (আ)-এর দাসী বা অপ্রধান স্ত্রীর সন্তান ছিলেন? ইহুদী ধর্মে অপ্রধান সন্তান কি উত্তরাধিকার হতে পারে?

উত্তর: ইহুদী তাফসিরগ্রন্থ মিদ্রাশ ঘেঁটে আমরা পাই, হাজেরা ছিলেন হযরত ইব্রাহিম (আ) এর দ্বিতীয় স্ত্রী। তিনি ছিলেন মিসরের রাজকুমারী, অর্থাৎ মিসররাজের কন্যা। ইহুদীদের মিদ্রাশ জানায়, হযরত ইব্রাহিম (আ) এর স্ত্রী সারার প্রতি মিসররাজ লোলুপ দৃষ্টি দেন, এবং কেড়ে নেন হযরত ইব্রাহিমের (আ) থেকে। কিন্তু সারার প্রার্থনা-পরবর্তী মুজেজা বা অলৌকিক কাণ্ডের ফলস্বরুপ সারা যখন মুক্তি পেয়ে যান সেটি হাজেরা জানতে পারেন। পরে হাজেরা মন্তব্য করেন, রাজকুমারী থাকার চাইতে সারার আবাসে দাসী হয়ে থাকাও শ্রেয়। কিন্তু যখন সারা গর্ভবতী হচ্ছিলেন না, তখন তিনি হযরত ইব্রাহিম (আ)-কে অনুরোধ করেন যেন তিনি হাজেরাকে বিয়ে করেন, এতে অন্তত সন্তান হতে পারে। হয়েছিল বটে। হযরত ইসমাইল (আ) জন্ম নেন হাজেরার গর্ভে। তাই অপ্রধান স্ত্রী বলবার অবকাশ এখানে থাকে না। তবে হ্যাঁ, ইহুদীরা বলে, হাজেরা যেহেতু আগে দাসী ছিল, তাই তার বুঝি মর্যাদা কম। কিন্তু স্ত্রী হয়ে যাওয়াতে সেই প্রশ্ন আর থাকছে না। উত্তরাধিকারও একই রকম। এছাড়া অন্য বর্ণনাতে আছে, হাজেরা ছিলেন সালিহ (আ) এর বংশধর এবং মাগ্রেবের রাজার কন্যা। ফারাও যুলার্শ তাঁকে পরাজিত করবার পর হাজেরা মিশরের রাজপ্রাসাদে দাসী হয়ে পড়েন। তবে তাঁর রাজকীয় রক্ত থাকায় তাঁকে দাসীদের প্রধান করা হয়। ফারাও যখন ইব্রাহিমের (আ) ধর্ম সত্য বলে মেনে নেন, তখন তিনি হাজেরাকে উপহার হিসেবে দেন সারাকে। সারা হাজেরার মালিকানা ইব্রাহিম (আ)-কে দিয়ে দেন। এছাড়া এমন বর্ণনাও আছে, হাজেরার পিতাই তাঁকে ইব্রাহিমের সাথে বিয়ে দেন।

সকল অধ্যায়

১. অধ্যায়-১ ইহুদী ধর্মের সূচনা
২. অধ্যায়-২ মিসরে যাবার আগে কেমন ছিল বনী ইসরাইল?
৩. অধ্যায়-৩ হযরত ইউসুফ (আ)- দাসবালক থেকে মিসরের উজির
৪. অধ্যায়-৪ ইউসুফ-জুলেখার কাহিনীর জানা-অজানা অধ্যায়
৫. অধ্যায়-৫ মসজিদুল আকসা আর বাইতুল মুকাদ্দাসের ইতিবৃত্ত
৬. অধ্যায়-৬ দাসবন্দী বনী ইসরাইল এবং হযরত মূসা (আ:) এর জন্ম
৭. অধ্যায়-৭ মিসরের রাজপ্রাসাদ থেকে সিনাই পর্বত
৮. অধ্যায়-৮ সিনাই পর্বত থেকে ফারাওয়ের রাজদরবার
৯. অধ্যায়-৯ মিসরে অভিশাপ
১০. অধ্যায়-১০ দ্বিখণ্ডিত লোহিত সাগর, এক্সোডাসের সূচনা
১১. অধ্যায়-১১ মরিস বুকাইলি আর ফিরাউনের সেই মমি
১২. অধ্যায়-১২ সিনাই পর্বতে ঐশ্বরিক সঙ্গ এবং তাওরাত লাভ
১৩. অধ্যায়-১৩ ইসরাইলের বাছুর পূজা এবং একজন সামেরির ইতিবৃত্ত
১৪. অধ্যায়-১৪ জীবন সায়াহ্নে দুই নবী
১৫. অধ্যায়-১৫ রাহাব ও দুই গুপ্তচরের কাহিনী
১৬. অধ্যায়-১৬ জেরিকোর পতন এবং স্যামসনের অলৌকিকতা
১৭. অধ্যায়-১৭ এক নতুন যুগের হাতছানি
১৮. অধ্যায়-১৮ বর্তমান আর ভবিষ্যৎ বাদশাহর দ্বৈরথ
১৯. অধ্যায়-১৯ তালুতের পতন, দাউদের (আ) আরোহণ
২০. অধ্যায়-২০ কিং ডেভিডের রাজত্বকাল
২১. অধ্যায়-২১ দিগ্বিজয়ী সুলাইমানের (আ) প্রতাপ
২২. অধ্যায়-২২ উইজডম অফ সলোমন : সুলাইমানের অলৌকিকতা
২৩. অধ্যায়-২৩ লেজেন্ডস অফ সলোমন
২৪. অধ্যায়-২৪ সলোমন ও শেবার রানী
২৫. অধ্যায়-২৫ ইসরাইলের পতনের শুরু : আহাব ও জেজেবেলের পরিণতি
২৬. অধ্যায়-২৬ বনী ইসরাইলের পারস্যে নির্বাসন
২৭. অধ্যায়-২৭ ইসরাইলের সেবায় হযরত উজাইর
২৮. অধ্যায়-২৮ জেরুজালেম ধ্বংসের ভবিষ্যৎবাণী
২৯. অধ্যায়-২৯ ব্যবিলনের অগ্নিপরীক্ষায় নবী দানিয়েল (আ)
৩০. অধ্যায়-৩০ নির্বাসন শেষে ইসরাইলে প্রত্যাবর্তন
৩১. অধ্যায়-৩১ রোমান শাসনে দমিত ইসরাইল
৩২. অধ্যায়-৩২ অতঃপর যীশু খ্রিস্ট
৩৩. অধ্যায়-৩৩ ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাত: কী, কেন এবং কীভাবে এর শুরু?
৩৪. অধ্যায়-৩৪ এক নজরে ইহুদী বিশ্বাসের ইতিবৃত্ত
৩৫. অধ্যায়-৩৫ হাতিবাহিনীর ইতিবৃত্ত ও কিছু অজানা দিক
৩৬. অধ্যায়-৩৬ জন্মকালীন অজানা কাহিনী
৩৭. অধ্যায়-৩৭ মরুর বুকে ধূসর শৈশব
৩৮. অধ্যায়-৩৮ ঐশীবাণীর পূর্বে যুবক জীবন শেষের কথা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন