বীরাঙ্গনা, পরাক্রমে ভীমা-সমা

হেমেন্দ্রকুমার রায়

রণরঙ্গে বীরাঙ্গনা সাজিল কৌতুকে;—
উথলিল চারিদিকে দুন্দুভির ধ্বনি;
বাহিরিল বামাদল বীরমদে মাতি,
উলঙ্গিয়া অসিরাশি, কার্মুক টংকারি,
আস্ফালি ফলকপুঞ্জে।

 —মাইকেল মধুসূদন

.

এক

দেশে দেশে রণরঙ্গিণী রমণীর কাহিনি শোনা যায়,—কেবল কল্পিত গল্পে নয়, সত্যিকার ইতিহাসেও। চলতি কথায় এমন মেয়েকে বলা হয় ‘রায়বাঘিনী’।

ভারতের রানী লক্ষ্মীবাঈ, রানী দুর্গাবতী, চাঁদ সুলতানা, ইংল্যান্ডের রোডিসিয়া ও ফ্রান্সের জোয়ান অব আর্ক প্রভৃতি রণরঙ্গিণী বীরনারীর কথা কে না শুনেছে?

কথিত হয়, সেকালের কাপ্পাডোসিয়ার বীরাঙ্গনারা বাস করত নারীরাজ্যে—যেখানে পুরুষের প্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ! পুরুষদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে কোনওদিনই তারা পিছপাও হয়নি। আধুনিক নিউগিনিতেও এমন দেশের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। মাঝে মাঝে তারা আবার বাইরে হানা দিয়ে পুরুষ দেখলেই বন্দি করে নিয়ে যায়। একালের স্পেন, রুশিয়া ও চিন প্রভৃতি দেশে হাজার হাজার নারী-যোদ্ধার দেখা পাওয়া যায়। এবং এই অতি-আধুনিক যুগেও তিব্বতে শ্রীমতী রিপিয়েডোর্জেস প্রায় এক হাজার রণমুখো নারী-যোদ্ধা নিয়ে কমিউনিস্ট চিনের বিরুদ্ধে প্রবল বিক্রমে যুদ্ধে নিযুক্ত আছেন।

কিন্তু আর এক শ্রেণির বীরনারীদের কথা নিয়ে বড় বড় ঐতিহাসিকরা মাথা ঘামান না এবং তার কারণ বোধ হয় তাঁরা হচ্ছেন কালো আফ্রিকার কাজলা মেয়ে।

এঁদের প্রধানার নাম নান্সিকা। আজ এঁরই রক্তাক্ত কাহিনি বর্ণনা করব। কিন্তু তার আগে গুটিকয় গোড়ার কথা বলতে হবে।

প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে জনৈক পাশ্চাত্য লেখক The Rising Tide of colour নামক পুস্তকে সভয়ে এই মর্মে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন : ‘শ্বেতাঙ্গরা এখনও আন্দাজ করতে পারছে না, অশ্বেত জাতিরা (পীত, তাম্র ও কৃষ্ণ বর্ণের) ক্রমেই অধিকতর শক্তিশালী হয়ে শ্বেতাঙ্গদের নাগালের বাইরে চলে যাবে। অবিলম্বে তাঁদের সাবধান না হলে চলবে না।’

তারপর গত এক যুগের মধ্যেই তাঁর ভবিষ্যদবাণী সফল হয়েছে—গৌরাঙ্গরা সাবধান হয়েও পীতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গদের ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি।

প্রায় সমগ্র এশিয়া থেকেই তাম্র ও পীত বর্ণের প্রভাবে শ্বেতবর্ণ বিলুপ্তপ্রায় হয়েছে এবং তারপর বেঁকে দাঁড়িয়েছে এতকালের পশ্চাৎপদ আফ্রিকাও। একে একে শ্বেতাঙ্গদের বেড়ি ভেঙে স্বাধীন হয়েছে মিশর, সুদান, মরক্কো, ঘানা ও কঙ্গো প্রভৃতি আরও কয়েকটি প্রদেশ এবং আরও কোনও কোনও দেশ প্রস্তুত হয়ে আছে স্বাধীনতা অর্জনের জন্যে কিংবা ইতিমধ্যেই স্বায়ত্তশাসনের অধিকার লাভ করেছে।

সদ্য-স্বাধীন ঘানার প্রতিবেশী ডাহোমি। পশ্চিম আফ্রিকার টোগোল্যান্ড ও নাইজিরিয়ার মধ্যবর্তী আটলান্টিক সাগর-বিধৌত তটপ্রদেশে আটত্রিশ হাজার বর্গমাইল জায়গা জুড়ে ডাহোমির অবস্থান। তার লোকসংখ্যা প্রায় দশ লক্ষ। গত শতাব্দীর শেষভাগে ফরাসি দস্যুরা হানা দিয়ে ডাহোমির স্বাধীনতা হরণ করেছিল, কিন্তু সম্প্রতি কর্তার চেয়ার ছেড়ে আবার তাদের দর্শকের গ্যালারিতে সরে দাঁড়াতে হয়েছে।

দুই

স্বাধীন ডাহোমির সব চেয়ে বড় বিশেষত্ব ছিল, সেখানে দেশরক্ষা করত পুরুষরা নয়, নারীরা! সাধারণভাবে বলা যায়, ডাহোমির রাজাদের ফৌজে সৈনিকের ব্রত পালন করত সশস্ত্র নারীরা।

আগেই বলা হয়েছে, নারী-ফৌজ কিছু নতুন ব্যাপার নয়। এই শ্রেণির রণচণ্ডী নারীদের নাম দেওয়া হয়েছে ‘অ্যাম্যাজন’। স্প্যানিয়ার্ডরা দক্ষিণ আমেরিকা আক্রমণ করতে গিয়ে বিভিন্ন নারী বাহিনীর কাছে বারংবার বাধা পেয়েছিল। তাই তারা সেই দেশের ও সেখানকার প্রধান নদীর নাম দিয়েছিল যথাক্রমে ‘অ্যাম্যাজোনিয়া’ এবং ‘অ্যাম্যাজন’। পৃথিবীতে অ্যাম্যাজন আজও বিখ্যাত নদীগুলির মধ্যে তৃতীয় স্থান অধিকার করে আছে—তার দৈর্ঘ্য চার হাজার পাঁচশো এক মাইল।

তবে অন্যান্য দেশে পুরুষদের সঙ্গেই নারীরা যুদ্ধে যোগদান করেছে। কিন্তু ডাহোমির প্রধান যুদ্ধক্ষেত্রে পুরুষের ছায়াও দেখা যায়নি, সেখানে শত্রুদের সঙ্গে শক্তিপরীক্ষা করেছে কেবল রণরঙ্গিণীরা। সেখানে অ্যাম্যাজনদের নাম হচ্ছে ‘আহোসি’। সারা পশ্চিম আফ্রিকায় সকলেই আহোসিদের ভয় করে সত্যসত্যই রায়বাঘিনীর মতো।

সপ্তদশ শতাব্দীতে ভারতে যখন মোগল সাম্রাজ্যের গৌরবের যুগ, তখনই ডাহোমির নারী সেনাদল গঠিত হয়। প্রথমে রাজা আগাদগা বিদ্রোহীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে সৈন্যসংখ্যা বাড়াবার জন্যে ফৌজে পুরুষদের সঙ্গে নারীদেরও সাহায্য গ্রহণ করেন। দেখা যায়, বীরত্বে ও রণনিপুণতায় নারীরা হচ্ছেন অসামান্য। তখন আইন হল, ডাহোমির প্রত্যেক আইবুড়ো মেয়েকে পনেরো বছর বয়স হলেই ফৌজে যোগ দিতে হবে। বরাবর চলে আসছে সেই নিয়মই।

আন্দাজ ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে রাজা গেজো সিংহাসন পেয়ে সুদীর্ঘ চল্লিশ বৎসর কাল রাজ্য চালনা করেন। তাঁর আগেও ডাহোমির মেয়ে-সেপাইরা অস্ত্র ধরে শত্রুনিধন করত বটে, কিন্তু তাদের মধ্যে কোনও শৃঙ্খলা ছিল না। রাজা গেজোই সর্বপ্রথমে নারী-বাহিনীকে সুব্যবস্থিত ও অধিকতর শক্তিশালী করে তোলেন এবং তাদের সাহায্যে পার্শ্ববর্তী দেশের পর দেশ জয় করে নিজের পতাকার তলায় আনেন।

সৈনিকবৃত্তি গ্রহণ করবার পর কুমারীদের কঠোর শিক্ষাদীক্ষার ভিতর দিয়ে প্রস্তুত হতে হত—একটু এদিক-ওদিক হলেই ছিল প্রাণদণ্ডের আশঙ্কা। কিছুকাল সৈনিকজীবন যাপন করবার পরই তারা কেবল তরবারি, তির-ধনুক, বল্লম, বন্দুক ও বেওনেট চালনাতেই সুপটু হয়ে উঠত না, উপরন্তু নিয়মিত ব্যায়ামে তাদের দেহও হয়ে উঠত দস্তুরমতো বলিষ্ঠ ও পেশীবদ্ধ। একবার এই রণরঙ্গিণীদের বিশজন অরণ্যে গিয়ে এক মিনিটের মধ্যে বধ করেছিল সাত-সাতটা হাতি। সেই থেকে নারী-বাহিনীর একটি বিশেষ দল ‘মাতঙ্গ-মর্দিনীর দল’ নামে বিখ্যাত হয়ে আছে।

তিন

ব্যাপারটা একবার ভালো করে তলিয়ে বুঝবার চেষ্টা করুন।

একটিমাত্র ক্রুদ্ধ হাতির সামনে গিয়ে দাঁড়াতে ভয় পায় দলে ভারী পুরুষ-শিকারিরাও। কিন্তু বনচর হাতির পালের সামনে গিয়ে ‘যুদ্ধং দেহি’ বলে আস্ফালন করতে গেলে যে কতখানি বুকের পাটার দরকার সেটা অনুমান করতে গেলেও হৃৎকম্প হয়!

পাশ্চাত্য শিকারিদের হাতে থাকে অধিকতর শক্তিশালী আধুনিক বন্দুক এবং যার খোলনলচের ভিতরে থাকে বিশেষভাবে প্রস্তুত হাতিমারা বুলেট। কিন্তু দলবল নিয়ে তার সাহায্যেও হাতি মারতে গিয়ে কতবার কত লোককে যে মরণদশায় পড়তে হয়েছে, গুনে তা বলা যায় না।

মেয়ে-সেপাইরা তেমন বন্দুক চোখেও দেখেনি, এবং সেই বিশজনের প্রত্যেকেরই হাতে যে বন্দুক—অর্থাৎ খেলো বন্দুক ছিল, তাও নয়; অনেকের হাতে ছিল খালি সেকেলে তির-ধনুক ও বল্লম-তরবারি। হাতির পালে কত হাতি ছিল তা প্রকাশ পায়নি, তবে বিশজন মেয়ে যখন মিনিটখানেকের মধ্যে সাত-সাতটা হাতি মেরে ধরাশায়ী করতে পেরেছিল, তখন হস্তীযুথ যে মস্তবড় ছিল সেটুকু বুঝতে দেরি হয় না।

কিন্তু এখানে সপ্তহস্তীবধের চেয়ে আজব কথা হচ্ছে সেই দুর্ধর্ষ বীরাঙ্গনাদের প্রচণ্ড সাহসের কথা। এমন কাহিনি আর কোনওদিন শোনা যায়নি।

ডাহোমির রাজা বিপুল বিস্ময়ে বীরাঙ্গনাদের সাদর অভ্যর্থনা করে বললেন, ‘আজ থেকে তোমাদের উপাধি হবে ‘মাতঙ্গমর্দিনী’!’

তারপর সেই বিশজন মাতঙ্গমর্দিনী নিয়ে গড়া দলে ভরতি করা হতে লাগল নারী-বাহিনীর সেরা সেরা বীরাঙ্গনাকে। যুদ্ধের সময়ে খুব ভেবেচিন্তে কখনও-সখনও ব্যবহার করা হত সেই রায়বাঘিনীর দলকে,—কারণ তাদের প্রাণকে মনে করা হত মহামূল্যবান।

কিন্তু তাদের উপরেও নারীবাহিনীর আর একটা দল ছিল। কেবল সর্বশ্রেষ্ঠ ও সবচেয়ে দক্ষ মেয়ে-সেপাইদের নিয়ে সেই দল গঠিত হত। তাদের প্রত্যেকের আকার হত বলিষ্ঠ ও লম্বাচওড়া এবং কষ্ট সহ্য করবার ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। তাদের প্রধান অস্ত্র বেওনেট বা কিরিচ। তাদের পরনে থাকত নীল ও সাদা রঙের জমির ডোরাকাটা আর হাতকাটা জামা এবং হাঁটু পর্যন্ত ঝুলে পড়া ঘাগরা।

ওই প্রথম ও দ্বিতীয় দলের অর্থাৎ কিরিচধারিণী ও মাতঙ্গমর্দিনীদের পরেও মেয়ে-ফৌজে ছিল আরও দুই দলের পদাতিক সেপাই।

এক, বন্দুকধারিণী দল। এদের গড়নপিটন পাতলা ও দেহ ছিপছিপে। খণ্ডযুদ্ধের সময়ে যখন এই দলকে লেলিয়ে দেওয়া হত, তখন দলের অনেকেই মারা পড়লেও কেউ তা নিয়ে মাথা ঘামাত না।

আর এক, ধনুকধারিণীর দল। এই দলের মেয়েরা ছিল ফৌজের মধ্যে সবচেয়ে অল্পবয়সি ও দেখতে রূপসি। হাতাহাতি লড়বার জন্যে তারা ছোরা সঙ্গে রাখত।

এই শেষোক্ত দুই দলের সৈনিকরা অন্যান্য জামা-কাপড়ের বদলে কোমরে পরত কেবল কৌপীন এবং অন্যান্য অলংকারের বদলে বাম হাতে রাখত খালি হাতির দাঁতের বালা।

আড়াই শত বৎসরের সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতার ফলে মেয়ে-সেপাইরা রণকৌশলের হাড়হদ্দ বিশেষ ভাবেই রপ্ত করে ফেলেছিল। তাদের প্রধান একটি ফিকির ছিল, অতর্কিতে শত্রুদের আক্রমণ।

মেয়ে-ফৌজে সৈন্যসংখ্যা ছিল আট হাজার এবং এই নারীবাহিনীর পরিচালিকা ছিল, নান্সিকা।

কবি মাইকেল মধুসূদনের ভাষায় নান্সিকা হচ্ছে—

‘বীরাঙ্গনা, পরাক্রমে ভীমা-সমা!’

হ্যাঁ, যুদ্ধক্ষেত্রে যেমন অপূর্ব তার গুণপনা, তেমনি ভয়াল তার বীরপনা। প্রকাশ, তার সঙ্গে হাতাহাতি সংঘর্ষে প্রাণদান করতে হয়েছে পাঁচশত শত্রু-যোদ্ধাকে! অমোঘ তার অস্ত্রধারণের শক্তি এবং অভ্রান্ত তার সৈন্যচালনার দক্ষতা!

যে পুরুষ-কবি সর্বপ্রথমে নারীকে অবলা বলে বর্ণনা করেছিলেন, নান্সিকাকে স্বচক্ষে দেখলে তিনি সভয়ে মত পরিবর্তন করতে বাধ্য হতেন। প্রত্যেক অঙ্গভঙ্গে নান্সিকার দেহতটে যখন উচ্ছ্বসিত হতে থাকত বলিষ্ঠ যৌবনের ভরাট জোয়ার, তখন তার দুই চক্ষে ঠিকরে উঠে বীর্যবত্তার তীব্র বিদ্যুৎ, শত্রুর চিত্তে জাগিয়ে তুলত আসন্ন অশনিপাতের আশঙ্কা!

এই নান্সিকার সঙ্গে ইউরোপ থেকে আগত ফরাসি দস্যুদের ভীষণ শত্রুতার সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে।

কারণটা খুলে বলা দরকার।

বরাবরই দেখা গিয়েছে ইউরোপীয় দস্যুরা প্রথমে সওদাগরের বা পরিব্রাজকের বা ধর্মপ্রচারকের ছদ্মবেশ ধারণ করে এশিয়া ও আফ্রিকার দেশে দেশে গিয়ে অতি নিরীহের মতো ধরনা দিয়েছে, তারপর সময় বুঝে ধীরে ধীরে নানা অছিলায় গোপনে শক্তিসঞ্চয় করে হঠাৎ একদিন নিজমূর্তি ধরে রক্তধারায় মাটি ভাসিয়ে এবং দিকে দিকে মৃত্যু ছড়িয়ে সর্বগ্রাস করে বসেছে।

শ্বেতাঙ্গরা এই ভাবে ভারতবর্ষে এসে শিকড় গেড়ে বসেছিল। আফ্রিকাতেও তারা গোড়ার দিকে সেই চালই চালে এবং অন্ধিসন্ধি বুঝে নেয়। কিন্তু ভারতের তুলনায় আফ্রিকা ছিল প্রায় অরক্ষিত, কারণ আগ্নেয়াস্ত্রকে কতক্ষণ ও কতটুকু বাধা দিতে পারে তরবারি, বল্লম ও তিরধনু! দেখতে দেখতে নানাদেশী শ্বেতাঙ্গরা আফ্রিকার উপরে ক্ষুধিত রাক্ষসের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে তার নানা অংশ ছিনিয়ে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিলে।

পশ্চিম আফ্রিকার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল ফরাসি দস্যুরা। ছলে-বলে-কৌশলে অনেকখানি জায়গা দখল করে নিয়ে অবশেষে তাদের শনির দৃষ্টি নিক্ষেপ করল ডাহোমির উপরে।

ডাহোমি তখনও স্বাধীন। তার সিংহাসনে আসীন রাজা গেলেল।

বেয়ল হচ্ছেন ফরাসিদের এক পদস্থ কর্মচারী। একদিন তিনি এলেন রাজা গেলেলের কাছে—মুখে তাঁর শান্তিদূতের মুখোশ।

রাজা তাঁকে অভ্যর্থনা করলেন হাসিমুখে। বলা বাহুল্য, বেয়লের মুখে মিষ্টি মিষ্টি বুলির অভাব হল না। সরল রাজা ভুলে গেলেন কথার ছলে।

নান্সিকা ছিল নারী-বাহিনীর অন্যতম পরিচালিকা। অতিশয় বুদ্ধিমতী বলে তার সুনাম ছিল যথেষ্ট। সে দেখনহাসি বেয়লের মিষ্ট কথায় তুষ্ট হল না—ফন্দিবাজ ফরাসিদের স্বরূপ চিনে ফেলেছিল তার অন্তর্ভেদী দৃষ্টি। বেয়লের ফন্দি ব্যর্থ করবার জন্যে নান্সিকা নানা ভাবে চেষ্টা করতে লাগল।

কিন্তু সে কিছুই করতে পারলে না—ক্রমে ক্রমে রাজা হয়ে পড়লেন বেয়লের হাতের কলের পুতুলের মতো। বেয়ল যা বলেন, রাজা তাইতেই সায় দেন।

নান্সিকা তখন দেশের শত্রুকে বধ করবার জন্যে গোপন চক্রান্তে প্রবৃত্ত হল।

খবরটা রাজার কানে উঠল। খাপ্পা হয়ে বললেন, ‘আমার বন্ধুর বিরুদ্ধে চক্রান্ত! বন্দি করো নান্সিকাকে! লাগাও পিঠে সপাসপ কোড়ার বাড়ি! বেয়ল যতদিন আমার রাজধানীতে থাকবেন, ততদিন তাকে কারাগার থেকে মুক্তি দিও না।’

তাই হল। বেত্রদণ্ডের পরে নান্সিকা হল বন্দিনী।

তারপরেই কিন্তু নান্সিকা রাজার মনে যে সন্দেহের ঘুম ভাঙিয়ে দিয়ে গেল, ক্রমে তা হল নির্জলা সত্যে পরিণত। একটু একটু করে রাজার চোখ ফুটতে লাগল বটে, কিন্তু তিনি কোনও-কিছু করবার আগেই নিজের কাজ ফতে করে বেয়ল বিদায় নিয়ে ফিরে গেলেন।

নান্সিকা আবার কারাগারের বাইরে এসে দাঁড়াল।

তারপর কোথাও কিছু নেই, হঠাৎ একদিন হৃৎপীড়ায় আক্রান্ত হয়ে রাজা পড়লেন মৃত্যুমুখে।

প্রজারা হাহাকার করতে লাগল—হায়, হায়, এ যে বিনামেঘে বজ্রাঘাত।

নান্সিকা সুযোগ বুঝে দিকে দিকে রটিয়ে দিলে—’এ হচ্ছে দেশের শত্রু ফরাসিদের কারসাজি। এমন ভাবে মানুষ মারা পড়ে না। দুষ্ট বেয়লের বশীকরণ-মন্ত্রে বশ হয়েই রাজা মারা পড়েছে—কুহকী ফরাসিদের দেশ থেকে এখনি তাড়াও।’

অরণ্যরাজ্য ডাহোমির নিরক্ষর সব প্রজা—রাজনীতি, কূটনীতি প্রভৃতি অতশত কিছুই বোঝে না, নান্সিকার কথাই তারা ধ্রুবসত্য বলে মেনে নিলে। ফরাসিদের উপরে সকলে খড়গহস্ত হয়ে উঠল।

নূতন রাজা হয়ে ডাহোমির সিংহাসনে বসলেন বেহানজিন। নান্সিকা ছিল তাঁর প্রিয়পাত্রী। তিনি বললেন, ‘নান্সিকা! আজ থেকে তুমি হলে আমার সমস্ত নারী-বাহিনীর অধিনায়িকা। যাও, শত্রুজয় করে ফিরে এস।’

চার

১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দ।

কোটোনৌ হচ্ছে ফরাসিদের দ্বারা অধিকৃত একটি দুর্গ-নগর। সেই নগরে থানা দিয়ে বসেছেন ডাহোমির শাসনকর্তারূপে নির্বাচিত জিন বেয়ল।

ডাহোমির নূতন অধিপতি বেহানজিন ক্রুদ্ধস্বরে বললেন, ‘আমাদের স্বর্গীয় রাজাকে—আমার পূর্বপুরুষকে ফরাসি কুক্কুর বেয়ল কুহকমন্ত্রে বধ করেছে! প্রতিশোধ, আমি প্রতিশোধ চাই!’

রায়ে রায় দিয়ে নান্সিকা তীব্রস্বরে বললে, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ মহারাজ, প্রতিশোধ! প্রতিশোধ নিতে গেলে প্রথমেই করতে হবে বেয়লের মুণ্ডপাত! তারপর আমাদের স্বদেশ থেকে দূর করে খেদিয়ে দিতে হবে ফরাসি দস্যুদের!’

রাজা বললেন, ‘উত্তম। যা ভালো বোঝো তাই করো। তোমার সুবুদ্ধির উপর আমার বিশ্বাস আছে।’

হাতজোড় করে নান্সিকা বললে, ‘প্রভু, যদি আমার উপরে ভূতপূর্ব মহারাজের এই বিশ্বাস থাকত, তাহলে ব্যাপারটা আজ এতদূর পর্যন্ত গড়াত না।’

রাজা বললেন, ‘ও কথা এখন যেতে দাও নান্সিকা! অতীতের ভুল আর শোধরাবার উপায় নেই। বর্তমান সমস্যার সমাধান করো। তোমার অধীনে তো নারী-সেনাদল প্রস্তুত হয়ে আছে—’মাতঙ্গিনীযূথ যথা মত্ত মধু-কালে’! সেই আহোসিদের নিয়ে বেরিয়ে পড় গৌরবপূর্ণ জয়যাত্রায়!’

নান্সিকা বললে, ‘যথা আজ্ঞা মহারাজ! এই আমি আপনার আদেশ পালন করতে চললুম!’

সেই অসিকার্মুকধারিণী বলিষ্ঠযৌবনা বীরাঙ্গনা বীরদর্পে পৃথিবীর উপরে সজোরে পদক্ষেপ করতে করতে মনে মনে বললে, ‘কেবল দেশের জন্যে নয় মহারাজ, কেবল আপনার জন্যেও নয়—সেই সঙ্গে নিজের জন্যেও আজ আমি প্রতিহিংসাব্রত উদ্যাপন করতে যাব! সেদিনকার অপমান কি আমি জীবনে ভুলতে পারব? আমি ডাহোমির সেনানায়িকা নান্সিকা, সকলের সামনে আমার হাতে বেড়ি, পায়ে বেড়ি আর পিঠে কোড়ার বাড়ির পর কোড়ার বাড়ি! শয়তান বেয়ল আর দেশের শত্রু ফরাসি দস্যুরা, ওরাই দায়ী এর জন্যে! ওদের যমালয়ে পাঠাতে না পারলে জীবন থাকতে আমার শান্তি নেই!’

ডিমি-ডিমি-ডিমি-ডিমি বাজতে লাগল কাড়া-নাকাড়া, আকাশের দিকে হাত বাড়িয়ে উড়তে লাগল বর্ণরঞ্জিত পতাকার পর পতাকা, দিকে দিকে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে লাগল নাগরিকদের হুংকৃত কণ্ঠের ঘন ঘন জয়োল্লাস এবং নারী-সেনাদের তালে তালে দর্পিত পাদপ্রহারে থর-থর কম্পিত পৃথিবী যেন আর্তনাদ করতে লাগল সশব্দে!

ফৌজের পুরোভাগ থেকে মাথার উপরে শূন্যে শাণিত বিদ্যুদচিকন তরবারি আস্ফালন করতে করতে নান্সিকা উচ্চ, দৃপ্ত স্বরে বার বার বলে চলল—’আগে চল, আগে চল আগে চল! শত্রুসংহার করতে হবে, শত্রুসংহার! তোমার শত্রু, আমার শত্রু, রাজার শত্রু, দেশের শত্রু! হয় মারব, নয় মরব, হার স্বীকার করব না! আগে চল, শত্রুসংহার কর—মার আর মর।’

লামা জলাভূমি—হঠাৎ দেখলে মনে হয় দূরবিস্তৃত বিশাল হ্রদ বুকে তার নীলিমা মাখিয়ে দেয় আকাশের প্রতিচ্ছায়া।

তারই পার্শ্ববর্তী গ্রাম থেকে নান্সিকার রক্তলোচনা বিভীষণা সঙ্গিনীরা বন্দি করে আনলে একদল ফরাসিকে।

রাজা বেহানজিনের উৎসাহের সীমা রইল না। লামা হ্রদের তটে দাঁড়িয়েই তিনি প্রকাশ্যভাবে পররাজ্যলোভী ফরাসিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা করলেন।

ইউরোপে যখন এই খবর গিয়ে পৌঁছোল তখন সকলের ওষ্ঠাধরে ফুটে উঠল ব্যঙ্গহাসির রেখা। কোথায় কোটি কোটি মানুষের বৃহৎ বাসভূমি, সভ্যতায় শীর্ষস্থানীয় ও শক্তিসামর্থ্যের জন্যে সুপ্রসিদ্ধ ফ্রান্স, আর কোথায় অসভ্য কৃষ্ণাঙ্গের জন্মভূমি আফ্রিকার অজানা এক প্রান্তে অবস্থিত মাত্র দশ লক্ষ প্রায়নগ্ন বর্বর মনুষ্যের বন্য স্বদেশ—ক্ষুদ্রাদপি ক্ষুদ্র ডাহোমি! পর্বতের পদতলে নগণ্য নুড়ি, মত্তহস্তীর চলনপথে তুচ্ছ উই, বনস্পতির ছায়ার তলায় ক্ষুদ্র তৃণ। অ্যাঁ! হাউই বলে কিনা—’তারকার মুখে আমি দিয়ে আসি ছাই!’ শ্বেতাঙ্গ সেনাপতির একটিমাত্র ইঙ্গিতে লক্ষ লক্ষ সৈনিক ঝড়ের বেগে ছুটে গিয়ে কেবল পায়ের বুটজুতোর চাপেই ডাহোমিকে এখনই সমতল পৃথিবীর সঙ্গে মিলিয়ে দিয়ে আসতে পারে!

সুতরাং ফ্রান্সের টনক নড়ল না।

কিন্তু নান্সিকার যুক্তি হচ্ছে, ছোট্ট বিছাকে ঘাঁটালে সেও পাগলা হাতিকে কামড়ে দিতে ইতস্তত করে না এবং ধুমসো হাতি তখন বিষের জ্বালায় ছটফটিয়ে দৌড় মারতে বাধ্য হয়! অতএব—আগে চল, আগে চল! হয় শত্রুবধ, নয় মৃত্যু! অতএব—থামল না ডিমি-ডিমি দামামা-ধ্বনি, আনত হল না দর্পিত ধ্বজপতাকা, স্তব্ধ হল না ক্ষুদ্র ডাহোমির রুদ্র জয়নাদ!

শূন্যে ঝকঝকে তরবারি তুলে, মাথার উপরে শাণিত বল্লম উঁচিয়ে শরাসনে তীক্ষ্ণমুখ বাণযোজন করে সেই মূর্তিমতী চামুণ্ডাবাহিনী বনে বনে খুঁজে বেড়াতে লাগল কোথায় আত্মগোপন করে আছে ফরাসি দস্যুদল!

বনে-মাঠে যখন-তখন যেখানে-সেখানে খণ্ডযুদ্ধের পর খণ্ডযুদ্ধ। ফরাসি পুরুষপুঙ্গবরা অবলা নারীদের দেখে প্রথমে গ্রাহ্যের মধ্যেই আনতে চায় না, কিন্তু তারপরেই মারাত্মক অস্ত্রাঘাতে এক-মুহূর্তের অবহেলার ফলে চিরনিদ্রায় অভিভূত হয়ে পড়ে!

তারপর ডেনহাম হ্রদের ধারে সাদায়-কালোয়—সাদা-চামড়া পুরুষ এবং কালো-চামড়া মেয়ের মধ্যে হাতাহাতি হানাহানি হল বারবার। বন্দুকগর্জন, কোদণ্ডটংকার, তরবারির ঝনঝনানি, নরনারীর মিলিত কণ্ঠের ভৈরব তর্জন, আহতদের করুণ কাতরানি এবং মরণোন্মুখের অন্তিম চিৎকার কান্তার-প্রান্তর ও আকাশ-বাতাসকে যেন সচকিত করে তুললে!

ফরাসিদের সেনাধ্যক্ষরা স্তম্ভিত! গ্রিক পুরাণ-কাহিনিতে তাঁরা পড়েছেন কি শুনেছেন যে, স্মরণাতীত কাল পূর্বে কোনও এক সময়ে নাকি রণরঙ্গিণী নারী-বাহিনীর সঙ্গে গ্রিক বীরপুরুষদের তুমুল সংগ্রাম করতে হয়েছিল এবং গ্রিসের পার্থেনন দেবমন্দিরের শিলাপটের উপরে সেই পৌরাণিক যুদ্ধে নিযুক্ত নর-নারীর উৎকীর্ণ মূর্তিচিত্র অনেকে স্বচেক্ষ দর্শনও করেছেন।

সে তো কবির কাল্পনিক কাহিনি মাত্র, আর সেই রণরঙ্গিণী নারীরাও শ্বেতাঙ্গিনী!

কিন্তু এই আসন্ন বিংশ শতাব্দীর মুখে বর্বর আফ্রিকায়—যেখানে কালো কালো ভূতের মতো পুরুষগুলো শ্বেতাঙ্গদের দূরে দেখলেও ভেড়ার পালের মতো ভয়ে ছুটে পালায় কিংবা কাছে এলে গোলামের মতো জুতোর তলায় লুটিয়ে পড়ে, সেখানকার অর্ধোলঙ্গ কৃষ্ণাঙ্গিনীরা কিনা শ্বেতপুরুষের মুণ্ডচ্ছেদ করবার জন্যে দূর থেকে হুংকার তুলে খাঁড়া নিয়ে ধেয়ে আসে!

এই কল্পনাতীত দৃশ্যের কথা ভেবে শ্বেতাঙ্গ যোদ্ধারা বিপুল বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়েন, কিন্তু তৎক্ষণাৎ তাঁদের চাঙ্গা করে তুলে অদূরে জাগে শত শত কামিনীকণ্ঠে খলখল অট্টহাস্যরোল এবং তারও উপরে গলা তুলে উদ্দীপিত স্বরে সচিৎকারে কে বলে ওঠে—’আগে চল, আগে চল! শত্রু মার, শত্রু মার!’ তারপর চোখের পলক পড়তে না পড়তে জঙ্গলের অন্তরাল থেকে সহসা বেরিয়ে হন্যে হয়ে অস্ত্র আস্ফালন করতে করতে ছুটে আসে সারি সারি বীরনারীর দল! পর মুহূর্তেই ধুন্ধুমার, হুহুংকার ধনুষ্টংকার ও তরবারির ঝনৎকার!

কুসুমকোমলা বলে কথিত রমণীদের এমন সংহার-মূর্তি ফরাসিরা আর কখনও দেখেনি!

কিন্তু ফরাসিরা মার খেয়ে মার হজম করতে বাধ্য হল তখনকার মতো।

সেই দুর্দমনীয় নারী-বাহিনী পিছু হটতে জানে না, বীরবিক্রমে এগিয়ে আসে আর এগিয়ে আসে!

বীরাঙ্গনারা মারতে মারতে ছুটে চলে, মরতে মরতে মারণ-অস্ত্র চালায়! মৃত্যুভয় ভুলে যারা রক্তস্নান করে এবং হাসতে হাসতে প্রাণ-কাড়াকাড়ি খেলায় মাতে, কে লড়াই করবে তাদের সঙ্গে?

এই অদ্ভুত সংবাদ সাগর পার হয়ে পৌঁছোল গিয়ে ফ্রান্সের বড় কর্তার কাছে। তাঁরাও প্রথমটা হতবাক হয়ে গেলেন মহাবিস্ময়ে!

সকলে দারুণ মর্মপীড়ায় কাহিল হয়ে পড়লেন। একদল অরণ্যচারিণী নগণ্য কৃষ্ণাঙ্গীর প্রতাপে কীর্তিমান ফ্রান্সের শ্বেত পুরুষত্ব নস্যাৎ হয়ে যাচ্ছে, এ কথা শুনলে ইউরোপের অন্যান্য দেশ টিটকিরি দিতে ও হাসাহাসি করতে বাকি রাখবে না!

অবিলম্বে এর একটা বিহিত করা চাই।

উপরওয়ালাদের হুকুমে তখনই তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল। তার কয়েক মাস পরে যথাসময়ে ডাহোমির দিকে পাঠানো হল দলে দলে নতুন সৈন্য, বড় বড় কামান এবং ভারে ভারে রসদ।

প্রধান সেনাপতি হয়ে গেলেন জেনারেল সিবাস্টিয়ান টেরিলন। তিনি আড্ডা গেড়ে বসলেন দুর্গ-নগরী কোটোনৌয়ের উপকণ্ঠে।

পাঁচ

১৮৯০ খ্রিস্টাব্দ। দুর্গ-নগরী কোটোনৌ।

তার চতুর্দিকে ধূ-ধূ-ধূ তেপান্তর। এবং তেপান্তরের পর দুরধিগম্য কান্তার—বাহির থেকে তার ভিতরে প্রবেশ করা এবং ভিতর থেকে তার বাহিরে বেরিয়ে আসা দুইই সমান কষ্টসাধ্য।

কিন্তু বনচর জীবেরা বনের গোপন পথ জানে। রণরঙ্গিণী রমণীরা হচ্ছে বনরাজ্যের অন্তঃপুরচারিণী—অবহেলায় এড়িয়ে চলতে জানে যে-কোনও আরণ্য বাধাবন্ধ।

দুর্গের অদূরেই মাঠের উপরে পড়েছে সৈনিকদের ছাউনি। সেখানে এক তাঁবুর ভিতরে বসে ফরাসিদের দ্বারা প্রেরিত শাসনকর্তা আমাদের পূর্বপরিচিত বেয়ল, জেনারেল টেরিলন ও আরও দুইজন পদস্থ সেনানী মদ্যপান করতে করতে আলোচনায় নিযুক্ত ছিলেন।

টেরিলনের চেহারা যেন তালপাতার সেপাই! মেজাজ তাঁর এমনই কঠিন যে ভাঙলেও মচকাতে চায় না। ফৌজের সৈনিকদের কাছে তিনি ছিলেন চোখের বালির মতো দুঃসহ। তিনি তাচ্ছিল্যভরা কণ্ঠে বলছিলেন, ‘আরে ছোঃ। অস্ত্র ধরলে কী হবে, ওরা তো স্ত্রীলোক—তুচ্ছ স্ত্রীলোক ছাড়া আর কিছুই নয়!’

বেয়ল নারী-যোদ্ধাদের কেরামত হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন,—বললেন, ‘কিন্তু তারা বিভীষণা, সাংঘাতিক!’

—’তাহলে আমার সঙ্গে আরও দ্বিগুণ সৈন্য পাঠানো হল না কেন?’

এইবার আলোচনায় যোগ দিলেন কাপ্তেন আউডার্ড, এতক্ষণ তিনি একমনে বসে বসে চুমুকের পর চুমুকে খালি করছিলেন মদের গেলাসের পর গেলাস। অধার্মিক ও কর্কশ প্রকৃতির লোক। খুনোখুনির সুযোগ পেলেই খুশি। লম্বাচওড়া রোমশ দৈত্যের মতো চেহারা। তিনি বড়াই করে বললেন, ‘জেনারেল, কী হবে আরও সৈন্যে? স্ত্রীলোকগুলোকে শিক্ষা দেওয়ার জন্যে আমি প্রস্তুত! আর যাই-ই হোক, পুরুষের মতো তারাও তো মরতে বাধ্য?’

চেয়ারের পিছনদিকে হেলে পড়ে বেয়ল ঘোঁৎ-ঘোঁৎ করে উঠলেন। বললেন, ‘আউডার্ড, তুমি সাহসী বটে। কিন্তু তুমি তো কখনও রায়বাঘিনীদের সঙ্গে লড়াই করনি! দেখো, কালই তুমি তাদের হাতে পঞ্চত্বলাভ করবে। জেনারেল, তোমাকেও তারা মারবে। আর মুসেট, তুমিও বাঁচবে না!’

শেষোক্ত ব্যক্তি হচ্ছেন লেফটেনান্ট চার্লস মুসেট। তিনি হাঁ-না কিছুই না বলে ব্রান্ডির গেলাসে চুমুক দিতে লাগলেন মৌনমুখে। বোধ হয় এসব কথা তাঁর মনে হচ্ছিল বাজে বকবকানি!

নিজের শেষ গেলাসটা খালি করে উঠে দাঁড়ালেন জেনারেল! তারপর টলতে টলতে তাঁবুর এককোণে গিয়ে বিছানার উপরে ধপাস করে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে বললেন, ‘এখন থ্রো কর এ-সব কথা। রাত হয়েছে, আমি শ্রান্ত।’

কিন্তু বেয়লের মুখে বন্ধ হল না কথার তোড়। তিনি বললেন, ‘ঘুমনো হচ্ছে বোকামি। আহোসিরা আক্রমণ করবে দুপুর রাত থেকে সূর্যোদয়ের মধ্যেই।’

আউডার্ড ব্যঙ্গভরে বললে, ‘কিন্তু তাদের আদর করবার জন্যে আমরা তো তৈরি হয়েই আছি! কী বল হে মুসেট, তাই কিনা?’ বলেই তাঁকে এক গুঁতো মারলেন।

কিন্তু গুঁতো খেয়েও মুসেটের রা ফুটল না। নেশাটা বোধ করি বড়ই জমে উঠেছিল।

উত্তেজিত কণ্ঠে ক্ষিপ্তের মতো বেয়ল বললেন, ‘শোনো, শোনো, তোমরা বুঝতে পারছ না কেন? রায়বাঘিনীরা দিনের খটখটে আলোয় লড়াই করে না। সূর্যোদয়ের পূর্ব-মুহূর্তেই তারা করে আক্রমণ।’

কেবা শোনে কার কথা। ‘নির্বোধ! মূর্খ!’ বলে বেয়ল হতাশ হয়ে গজরাতে গজরাতে ফিরে গেলেন নিজের তাঁবুতে।

কিন্তু তখনও পর্যন্ত তিনিও জানতেন না যে, ডাহোমির রাজা বেহানজিন সেই দিনই—অর্থাৎ মার্চ মাসের চার তারিখেই—ফরাসিদের সঙ্গে তুমুল যুদ্ধের পর কোটোনৌ দুর্গ-নগরী অধিকার বা অবরোধ করবার আদেশ দিয়েছেন!

ছয়

নিজের বস্ত্রাবাসে প্রবেশ করে বেয়ল ক্রুদ্ধস্বরে আবার বললেন, ‘নির্বোধ মূর্খের দল!’

খানিকক্ষণ বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করেও ঘুম এল না। হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন, রাত সাড়ে চারটা।

শয্যায় উঠে বসে নিজের দুটো রিভলভারের কলকবজা ঠিক আছে কিনা পরীক্ষা করে দেখলেন! চোখ তুলে লক্ষ করলেন দেওয়ালে যথাস্থানেই ঝুলছে শক্তিশালী বন্দুকটা—আট-আটটা টোটায় ভরা।

নিজের মনে-মনেই বললেন, ‘হয়তো আউডার্ডের মত ভ্রান্ত নয়।—প্রস্তুত হয়ে থাকো, আহোসিদের কাছে আসতে দাও, তারপর বন্দুক ছুড়ে ভূমিসাৎ করো! একমাত্র আশার কথা এই যে বেশির ভাগ রায়বাঘিনীর হাতেই বন্দুক নেই। ধনুক, বর্শা, তরবারি,—বন্দুকের সামনে ও-সব তো খোকাখুকির খেলনা ছাড়া আর কিছুই নয়! তবে মুশকিলের কথাও আছে। রায়বাঘিনীরা দলে ভারী!’

ধ্রুম, ধ্রুম, ধ্রুম ধ্রুম। আচম্বিতে বন্দুকের পর বন্দুকের গর্জন!

একলাফে শয্যা ছেড়ে বেয়ল বলে উঠলেন, ‘তারা আসছে, তারা আসছে, তারা আসছে!’

তাড়াতাড়ি পটমণ্ডপের বাইরে বেরিয়ে পড়ে বেয়ল মুখ তুলে দেখলেন, পূর্ব-নাট্যশালায় মহিমময়ী উষার শ্বেতপদ্মের মতো শুভ্র আলোর পাপড়ি ফুটে উঠছে ধীরে ধীরে।

বেয়ল বললেন, ‘জানি, আমি জানি! এই তো আহোসিদের আক্রমণের মাহেন্দ্রক্ষণ!’

বন্দুকের গুড়ুম-গুড়ুম শব্দে জেনারেল টেরিলনেরও ঘুম ভেঙে গেল সচমকে। তিনি তাড়াতাড়ি উঠে একটা বাঁশিতে জোরে ফুঁ দিয়ে করলেন উচ্চ সংকেতধ্বনি!

তৎক্ষণাৎ কোথা থেকে বেজে উঠল রণতূর্য। সঙ্গে সঙ্গে কামানগুলোর মুখে মুখে জাগল আরক্ত আলোকচমক ও গুরু গুরু বাজের ধমক। আউডার্ড ও মুসেট ছুটে যথাস্থানে গিয়ে দাঁড়ালেন—অন্যান্য সৈনিকরাও শ্রেণিবদ্ধ হয়ে দখল করলে নিজের নিজের জায়গা।

খ্যাঁক খ্যাঁক করে ক্রুদ্ধস্বরে টেরিলন বলে উঠলেন, ‘পাজী জানোয়ারের দল! আমাকে জুতো পরবারও সময় দিলে না!’

অধিকাংশ রণরঙ্গিনীরই সম্বল বল্লম ও তিরধনু বটে, তবে অনেকের হাতে বন্দুকও ছিল। ঝাঁকে ঝাঁকে বাণের সঙ্গে গরমাগরম বুলেটও ছুটোছুটি করতে লাগল ঘৃণিত ইউরোপীয়দের শ্বেত অঙ্গ ছিদ্রময় করবার জন্যে।

কাটা গাছের গুঁড়ি ও বালিভরা থলের আড়ালে আত্মগোপন করে বেয়লও বন্দুক তুলে বুলেট-বৃষ্টি করতে লাগলেন।

এক জায়গায় সুযোগ পেয়ে একদল রায়বাঘিনী ফরাসি ফৌজের মাঝখানে ঢুকে পড়বার চেষ্টা করলে, ফরাসিদের প্রচণ্ড অগ্নি-বৃষ্টিকে তারা একটুও আমলে আনলে না।

ব্যাপার ক্রমেই ঘোরালো হয়ে উঠল। বার্তাবহ ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে এসে নতুন বিপদের খবর জানালে।

টেরিলন চিৎকার করে বললেন, ‘হা ভগবান! আহোসিরা আমাদের একটা কামান কেড়ে নিয়েছে! আমাদের একজন সৈনিকেরও মাথা কাটা গিয়েছে!’

বেয়ল বললেন, ‘নিশ্চয়ই ঘুমোচ্ছিল। যেমন কর্ম তেমনি ফল!’

তেড়ে এল এক ঝাঁক চোখা চোখা বাণ, চটপট সেখান থেকে চম্পট দিলেন টেরিলন! বেয়ল যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করলেন।

রায়বাঘিনীদের আর একটা দল ধেয়ে এল—ফরাসিদের কামানগুলো করলে প্রচণ্ড অগ্নিবৃষ্টি।

হতাহত হয়ে একটা দল ভেঙে যায়—কিন্তু তুরন্ত তেড়ে আসে নতুন আর একটা দলের শত শত বীরাঙ্গনা! তাদের মরণভয় নেই—তারা মরতে মরতেও মারতে চাইবে!

দৌড়োতে দৌড়োতে মুসেট ডাকলেন, ‘গভর্নর বেয়ল! গভর্নর—’ কথা আর শেষ হল না—শোনা গেল ধনুকের টংকার শব্দ এবং সঙ্গে সঙ্গে তরুণ মুসেটের দেহ পপাত ধরণীতল! একটা বাণ তাঁর কণ্ঠে এবং আর একটা বাণ বিদ্ধ হয়েছে তাঁর চক্ষে!

জন ছয় নারী-যোদ্ধা খনখনে গলায় চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতে বল্লম উঁচিয়ে ফরাসি ব্যুহের ভিতরে ঝাঁপিয়ে পড়ল মরিয়ার মতো।

বেয়ল বন্দুকের কুঁদোর চোটে একজনের মাথা চুরমার করে দিলেন, গুলি করে মেরে ফেললেন আর একজনকে এবং তৃতীয় তরুণীকে ধরাশায়ী করলেন বেওনেটের খোঁচায়। চতুর্থ ও পঞ্চম জন মারা পড়ল অন্যান্য সৈনিকের কবলে। ষষ্ঠজনও পালিয়ে যেতে যেতে মরণাহত হয়ে মাটির উপরে আছড়ে পড়ল।

আপাতত এই পর্যন্ত।

বেহানজিনের দ্বারা প্রেরিত প্রথম দলের আক্রমণ ব্যর্থ।

বেয়ল বললেন, ‘হে ভগবান, আবার যদি আক্রমণ হয় তাহলে আমাদের আর রক্ষা নেই!’ মাথার ঘাম মুছতে মুছতে ভীরু চোখ বুলোতে লাগলেন এদিকে-ওদিকে। শিবিরের উপরে বারুদের ধোঁয়া জমে আছে মেঘের মতো।

একটা সিগারেট ধরিয়ে বেয়ল চারদিকে আর একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন। মাঠ ছেয়ে আছে নারী-সৈনিকদের শত-শত আড়ষ্ট মৃতদেহে। ফরাসি সৈনিকদের দেহও দেখা যাচ্ছে এখানে-ওখানে। সেই মর্মন্তুদ রক্তরঞ্জিত দৃশ্যের উপর থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে তিনি মনে মনে বললেন,—আহোসিরা যে খেলাঘরের সেপাই নয়, আশা করি টেরিলন এতক্ষণে তা দস্তুরমতো সমঝে নিয়েছে!

হ্যাঁ, সে সম্বন্ধে সন্দেহ নেই। যে কামানটা আহোসিরা কেড়ে নিয়েছিল, সেটা আবার দখল করবার জন্যে টেরিলন পাঠিয়েছিলেন চল্লিশ জন ফরাসি সৈনিক। কামানটা পুনরধিকার করে তারা ফিরে এসেছে বটে, কিন্তু পিছনে মাঠের উপরে রেখে এসেছে আঠারো জন সঙ্গীর মৃতদেহ।

টেরিলন ও আউডার্ড এতক্ষণ পরে বেয়লের পাশে এসে দাঁড়ালেন।

বেয়ল বললেন, ‘এইবারে সমগ্র নারী-বাহিনী আমাদের আক্রমণ করতে আসবে। এই দ্বিতীয় আক্রমণ ঠেকাতে না পারলেই সর্বনাশ!’

টেরিলন বললেন, ‘আমাদের কামানগুলো প্রস্তুত হয়েই আছে। দ্বিতীয় দলের সৈন্যসংখ্যা কত হতে পারে?’

‘অন্তত তিন হাজার।’

‘কিন্তু কামানের বিরুদ্ধে ধনুকের তির কী করতে পারে?’

বেয়ল বললেন, ‘ও প্রশ্নের উত্তরে মুসেট কী বলে শোনো না!’

টেরিলন বললেন, ‘মুসেটের মৃত্যু নিয়ে কি তুমি কৌতুক করতে চাও?’

বেয়ল জবাব দেবার সময় পেলেন না। কারণ দূর থেকে রক্ষীর উচ্চকণ্ঠে ভয়াল ধ্বনি জাগল—’আহোসিরা আসছে! আহোসিরা আসছে!’

সাত

বেয়ল বললেন, ‘এবারে ওরা সহজে ছাড়বে না, মরণ-কামড় দেবার চেষ্টা করবে!’

আবার শুরু হয়ে গেল কামান-বন্দুকের বজ্র-হুংকার! কিন্তু নারী-ফৌজের অগ্রগতি বন্ধ হল না—সারির পর সারি বন্যা-তরঙ্গের পর তরঙ্গের মতো আছড়ে আছড়ে পড়তে লাগল ফরাসি-ব্যুহের উপরে। ফরাসিদের অগ্নিবৃষ্টির তোড়ে হতাহত শত্রুরা যেখানে-সেখানে পঙক্তির মধ্যে ফাঁক সৃষ্টি করে, সেখানেই নতুন নতুন রণরঙ্গিণী আবির্ভূত হয়ে ফাঁক ভরিয়ে তোলে। নিক্ষিপ্ত বল্লম ও তিরের আঘাতেও ফরাসি সৈনিকরা রক্তাক্ত পৃথিবীর উপরে লুটিয়ে পড়ে। শত শত সঙ্গিনীর মৃত্যুও আহোসিদের সেই ভয়াবহ অগ্রগতি রুদ্ধ করতে পারলে না—তাদের কাছে মৃত্যু যেন ধর্তব্যের মধ্যেই গণ্য নয়! যত লোক মরে, তত যেন বাড়ে বীরবালাদের মরণানন্দ!

বেয়ল হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, ‘ওরা উন্মাদিনী, ওরা হার মানতে জানে না!’

আচম্বিতে জেনারেল টেরিলন মাটির উপরে আছাড় খেয়ে পড়লেন, তীক্ষ্ণ বাণে বিদ্ধ হয়েছে তাঁর ঊরুদেশ। একহাতে বাণটাকে ক্ষতস্থান থেকে টেনে বার করতে করতে নিজের ধূমায়িত রিভলভার তুলে তিনি সমানে গুলি চালাতে লাগলেন।

সামনেকার অংশের খানিকটা বিচ্ছিন্ন করতে পেরে বীরাঙ্গনারা ব্যূহের গভীরতম অংশে ঢুকে পড়বার জন্যে আক্রমণের পর আক্রমণ চালাতে লাগল। যত আক্রমণ ব্যর্থ হয়, তত তাদের জেদ বেড়ে ওঠে—যেন হাজার জন প্রাণ দিলেও তারা আক্রমণ করতে ছাড়বে না। কিন্তু অসম্ভব সম্ভব হল না, ফরাসি কামানগুলো অজস্র অগ্নিময় গোলা নিক্ষেপ করে তাদের ঠেকিয়ে রাখলে শেষ পর্যন্ত। অসংখ্য নারী-সৈনিকের মৃতদেহ স্তূপীকৃত হয়ে উঠল রণক্ষেত্রে।

তারপর আচম্বিতে! দূর থেকে রাজা বেহানজিনের রণশিঙা বেজে উঠে আজকের মতো যুদ্ধে সমাপ্তিঘোষণা করলে। একমুহূর্তে, একসঙ্গে প্রত্যেক নারী-সৈনিক ফিরে দাঁড়িয়ে রণক্ষেত্র থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল দুঃস্বপ্নের মতো।

রাজার আদেশ অমোঘ!

বেয়ল বললেন, ‘রাজার হুকুম না পেলে ওরা এখনও আমাদের ছাড়ত না।’

তিরটা উপড়ে ফেলে ক্ষতস্থানে ‘ব্যান্ডেজ’ বাঁধতে বাঁধতে টেরিলন বললেন, ‘তবু ওরা আমাদের কখনওই হারাতে পারত না।’

বেয়ল মুখে মত জাহির করলেন না, কিন্তু মনে মনে বললেন, উদ্ধত! নির্বুদ্ধির ঢেঁকি!

রক্তগঙ্গা বয়ে-যাওয়া মৃত্যুভীষণ রণক্ষেত্রের দিকে তিনি দৃষ্টিপাত করলেন। আন্দাজি হিসাবে তাঁর মনে হল ওখানে পড়ে আছে অন্তত একহাজার বীরাঙ্গনার শবদেহ।

তিনি পা চালাতে চালাতে বললেন, ‘টেরিলন, খানিকটা মদ না হলে আমার আর চলবে না। আমি নিজের তাঁবুতে যাচ্ছি।’

টেরিলন বললেন, ‘আমিও শীঘ্রই তোমার কাছে গিয়ে বিজয়োৎসবে যোগদান করব।’

আট

নিজের পটগৃহে বসে বেয়ল লোকমুখে ফরাসিপক্ষের হতাহতের খবরাখবর নিলেন।

ফরাসিদের পঁচাত্তর জন সৈনিক মৃত্যুমুখে পড়েছে। আহতদের সংখ্যা আরও অনেক বেশি। মৃতদের মধ্যে ছিলেন বাক্যবাগীশ কাপ্তেন আউডার্ডও। প্রত্যাবর্তনের সময়ে বীরাঙ্গনাদের একটা অব্যর্থ বাণ এ-জীবনের মতো তাঁর মুখর মুখ মৌন করে দিয়ে গেছে!

আচমকা তাঁবুর একটা ছায়াময় প্রান্ত থেকে গর্জিত কণ্ঠস্বরে শোনা গেল—’ওরে ফরাসি শূকর, আজ আর আমার হাত থেকে তোর নিস্তার নেই।’

সবিস্ময়ে বেয়ল কয়েক পদ পিছিয়ে গেলেন। তাঁর দৃষ্টির সামনে এসে দাঁড়াল ক্রোধভীষণা, দীপ্তনয়না নান্সিকা স্বয়ং। ধনুকে যোজন করেছে সে এক শাণিত তির। একান্ত অভাবিত দৃশ্য।

বেয়ল লাফ মেরে একটা রিভলভার হস্তগত করলেন, কিন্তু সেটা ব্যবহার করবার আগেই নান্সিকার নিক্ষিপ্ত তির এসে তাঁর স্কন্ধদেশ বিদীর্ণ করলে, মাটির উপরে পড়ে গেল রিভলভারটা।

হিংস্র জন্তুর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে নান্সিকা ক্ষিপ্রহস্তে চকচকে ছোরা তুলে তাঁকে আঘাত করতে গেল, কিন্তু বিদ্যুৎবেগে পাশ কাটিয়ে বেয়ল সে চোট সামলে নিয়ে একলাফে গিয়ে পড়লেন নান্সিকার উপরে—ধাক্কার চোটে তার হাত থেকে ছোরাখানা মাটির উপরে পড়ে গেল ঝনঝন শব্দে। পরমুহূর্তে গৃহতলে গড়াগড়ি দিতে লাগলেন দুজনেই—নীচে বেয়ল, উপরে নান্সিকা।

হাঁটু দিয়ে নান্সিকা এত জোরে বেয়লের তলপেটে আঘাত করলে যে তিনি মূর্ছিত হয়ে পড়তে পড়তে কোনওরকমে নিজেকে সামলে নিলেন।

তারপর চোখের নিমেষে মাটির উপর থেকে একরাশ ধুলো তুলে নিয়ে তিনি ছুড়ে মারলেন নান্সিকার চোখে। মুহূর্তের জন্যে নান্সিকা অন্ধ!

সেই অবসরে শত্রুর হাত ছাড়িয়ে বেয়ল টপ করে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের তরবারিখানা টেনে নিলেন, কিন্তু ততক্ষণে নান্সিকাও চকিতে আবার তাঁর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে তরবারিসুদ্ধ হাত সজোরে চেপে ধরলে। এবং কী আশ্চর্য শক্তির অধিকারিণী এই বীরনারী, তার প্রবল হাতের চাপে বেয়লের শিথিল মুষ্টি থেকে খসে পড়ল তরবারিখানা।

নান্সিকা যেই হেঁট হয়ে তরবারি কুড়িয়ে নিতে গেল, বেয়ল দিলেন তাকে এক প্রচণ্ড ঠেলা। পরমুহূর্তেই নিজের কোমরবন্ধ থেকে বার করে ফেললেন দ্বিতীয় একটা রিভলভার।

চরম আঘাত হানবার জন্যে নান্সিকা তরবারি খুলে তেড়ে এল তিরবেগে।

বেয়লের রিভলভার গর্জন করলে একবার, দুবার।

নান্সিকার দেহ হল ভূতলশায়ী।

বাহির থেকে ফরাসি সৈনিকরা তিরবেগে তাঁবুর ভিতরে প্রবেশ করল—সকলের পিছনে পিছনে টেরিলন।

হাঁপাতে হাঁপাতে ম্লান হাসি হেসে বেয়ল বললেন, ‘আজ আমি মূর্তিমতী মৃত্যুর কবলে গিয়ে পড়েছিলুম।’ তারপর বিবশ হয়ে বসে পড়লেন।

অবশিষ্ট

রণাঙ্গনে বীরাঙ্গনাদের সেই-ই হচ্ছে শেষ রণরঙ্গ।

তার সাত সপ্তাহ পরে রাজা বেহানজিন নারী-সেনাদের ভাঙা দল আর পুরুষ সৈনিকদের নিয়ে আর একবার বাধা দিতে অগ্রসর হন, কিন্তু শোচনীয়রূপে হেরে যান। তারপর কিছুকাল বন-বাদাড়ে পালিয়ে পালিয়ে বেড়িয়ে অবশেষে বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করলেন। এবং ফৌজ ও অস্ত্রশস্ত্র ছেড়ে মেয়েরাও আবার অন্তঃপুরে ফিরে গিয়ে হেঁসেলে ঢুকে হাতা-খুন্তি নাড়তে লেগে গেল।

আজ কিন্তু চাকা আবার ঘুরে গিয়েছে।

আটান্ন বৎসর আগে, ডাহোমির স্বাধীনতা রক্ষা করতে গিয়ে দেশের শত্রুর হাতে প্রাণ দিয়েছিল বীরবালিকা নান্সিকা।

কিন্তু আজ আর ডাহোমি পরাধীন নয়। যুগধর্মের গতি বুঝে ফরাসিরা আজ প্রভুর উচ্চাসন ছেড়ে নেমে দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছে। ডাহোমির বাসিন্দারা আজ স্বাধীন।

শান্তিলাভ করেছে নান্সিকার আত্মা।

সকল অধ্যায়

১. ভারতের দ্বিতীয় প্রভাত
২. পঞ্চনদের তীরে
৩. মহাভারতের শেষ মহাবীর
৪. ভগবানের চাবুক
৫. আলেকজান্ডার দি গ্রেট
৬. দিগবিজয়ী নেপোলিয়ন
৭. রক্ত বাদল ঝরে
৮. হন্তারক নরদানব
৯. সিরাজের বিজয় অভিযান
১০. মহাভারতের মহারথ
১১. রক্ত পাথারের সাঁতারু
১২. তিন সম্রাটের ত্র্যহস্পর্শযোগ
১৩. সাতহাজারের আত্মদান
১৪. আলেকজান্ডারের পলায়ন
১৫. ওষ্ঠাধরে রাজদণ্ড
১৬. মরা মানিক আর জ্যান্ত মানিক
১৭. মুসলমানের জহরব্রত
১৮. সূর্য দেবী, পর্মল দেবী
১৯. মারাঠার লিওনিডাস
২০. ভারতের একমাত্র সুলতানা
২১. ব্যাঘ্রভূমির বঙ্গবীর
২২. উপন্যাসের চেয়ে আশ্চর্য
২৩. মরণ বিজয়ীর দল
২৪. ছত্রপতির ছত্রভঙ্গ
২৫. জগন্নাথদেবের গুপ্তকথা
২৬. নতুন বাংলার প্রথম কবি
২৭. শিবদাস ভাদুড়ি
২৮. ইতিহাসের রক্তাক্ত প্রান্তরে (মিসিং)
২৯. বীরাঙ্গনা, পরাক্রমে ভীমা-সমা
৩০. বর্গি এল দেশে
৩১. হে ইতিহাস গল্প বলো (মিসিং)
৩২. প্রথম বাঙালি সম্রাট
৩৩. অনামা বীরাঙ্গনা
৩৪. ইতিহাসের রক্তাক্ত দৃশ্য
৩৫. ছত্রপতির অ্যাডভেঞ্চার
৩৬. বাংলাদেশের বোম্বেটেরাজ

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন