৩৩. কতো টাকা চাই?

গোলাম মুরশিদ

কতো টাকা চাই?

লিও তলস্তয়ের একটি গল্প আছে, যার নাম: একজন মানুষের কতো জমি চাই? পেহম নামে একজন জমিহীন লোকের খুব লোভ ছিলো জমির জন্যে। ভাগ্যক্রমে একটু একটু করে খানিকটা জমি পেয়েও গেলো সে। কিন্তু তার আরও জমি চাই। শেষে অপরিচিত একটি এলাকায় গিয়ে সে অঞ্চলের মালিকদের খুশি করে অনেক জমি পাওয়ার অঙ্গীকার পেলো সে। এই মালিকদের মোড়ল পেহমকে বললেন, ঠিক আছে, তুমি সারা দিনে যতোটা জায়গা বেড় দিয়ে আসতে পারবে, সবটাই তোমার হবে। পরের দিন সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে যাত্রা শুরু করলো। সেই লোকটি–একটা টিলার মাথা থেকে। বেশ খানিকটা দূরে দূরে চিহ্ন দেওয়ার জন্যে সে সঙ্গে নিলো একটা কোদাল। অনেক লোভ তার। কখনো হেঁটে, কখনো দৌড়ে অনেক দূর পর্যন্ত চলে গেলো সে। দারুণ ক্লান্ত হয়ে সে দুপুরের পর রুটি খেলো। একটু শক্তি পেয়ে আবার চললো পুরো দমে। তারপর যখন মনে পড়লো, যেখান থেকে সে যাত্রা শুরু করেছিলো, সেখানে ফিরে যেতে না পারলে এ জায়গার একটুও তার হবে না, তখন ক্লান্ত দেহ নিয়ে সে আবার পেছনের দিকে ছুটতে আরম্ভ করলো। ওদিকে, সূর্য ধীরে ধীরে ঢলে পড়ছে দিগন্তের দিকে। লোকটিও প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে। তারপর সূর্যের শেষ রশ্মিটুকু যখন মিলিয়ে যাচ্ছে, ঠিক তখন সে ফিরে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়লো। যেখানে একটা টুপি রেখে সে যাত্রা শুরু করেছিলো ঠিক সেখানে। যে-এলাকা সে বেড় দিয়ে এসেছিলো, সেই বিত্তীর্ণ এলাকা তারই, একান্ত তারই হয়ে গেলো। ভৃত্যু এসে তাকে টেনে তুলতে চেষ্টা করলো। কিন্তু পারলো না। রক্ত বমি করে সে ত্যাগ করলো তার শেষ নিশ্বাস। কোদাল দিয়ে ভৃত্য তার জন্যে ছফুট লম্বা একটি কবর খুঁড়লো। সেই ছোট্টো জায়গাটুকুই কাজে লাগলো পেহমের।

সত্যি আমাদের দেশে চারদিকে মানুষ যেভাবে পাগলের মতো জমি কিনছে, সৎ-অসৎ উপায়ে মানুষের গলা কেটে; বিবেক বিসর্জন দিয়ে টাকা করছে, তাতে অনেক সময়ই আমার তলস্তয়ের এই গল্পটা মনে পড়ে। কতো জমি চাই আর! কতো টাকা চাই! দশ লাখ, বিশ লাখ, পঞ্চাশ লাখ! আর কতো চাই? ছেলেবেলায় বাবার মুখে একজনের কথা শুনেছিলাম যে, তিনি নাকি লা—খপতি। বাবার বলার মধ্যে সম্রামের চিহ্ন ছিলো, আর আমার চোখে ছিলো বিস্ময়ের দৃষ্টি। এখন লাখ টাকা খুব বেশি টাকা নয় বাংলাদেশে, ঠিকই। ধরলাম আগের লাখ টাকা এখন কোটি টাকা। এবং একজন এক কোটি টাকার কম হলে কিছুতেই নিরাপদ বোধ করতে পারছেন। না। ঠিক আছে; অতএব আমাদের উচ্চাশার সীমানা এক কোটিতে বেঁধে দিচ্ছি। না, তার চেয়েও বেশি।–দশ কোটিতে বাঁধছি।

কিন্তু বাস্তবে কী দেখতে পাচ্ছি? মানুষের কল্যাণের কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে ডাক্তার রোগীর গলা কাটছেন। অন্য ডাক্তারদের সঙ্গে সিন্ডিকেট করে সেই গলাকাটা রোগীদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা কামাই করছেন। বালি দিয়ে বাড়ি তৈরি করে ঠিকাদার কোটি কোটি টাকা সঞ্চয় করছেন। দলের হয়ে অন্যের গলা কাটছেন রাজনৈতিক টাউট–কেবল টাকার জন্যে। চাঁদাবাজ আর সন্ত্রাসী বিনা মূলধনে কেবল পেশী দেখিয়ে কামাই করছে অঢেল অর্থ। সরকারী কর্মকর্তারা বেতনের বদলে কাজ করছেন উপরির জন্যে। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে সবচেয়ে ভালো ফলাফল করে সেই প্রার্থী শুল্ক বিভাগে কাজ চান, নয়তো চান আয়কর বিভাগে। কারণ সেখানেই সবচেয়ে বেশি টাকা। জ্ঞান বিতরণের কথা ভুলে গিয়ে প্রাইভেট পড়িয়ে অন্য শিক্ষকদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তথাকথিত শিক্ষা-ব্যবসায়ী টাকা করছেন। সমাজসেবার উদ্দেশ্য নিয়ে নয়, স্রেফ টাকা করার লক্ষ্য নিয়ে রাজনীতিতে নামছেন অসংখ্য লোক। এবং, একবার ক্ষমতায় যেতে পারলে কাড়ি কাড়ি টাকা আনেন রাজনীতির সদর রাস্তা দিয়ে।

আমাদের একজন ফৌজী রাষ্ট্রপতিকে বলা হতো যে, এতো বড়ো পৃথিবীতে তাঁর নাকি মাত্র দুটি দুর্বলতা ছিলো–নারী আর অর্থ। দুটিই নাকি তিনি বেসুমার সংগ্ৰহ করেছিলেন। তবে তার নারীর সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও তিনি যে শত শত কোটি টাকা জমিয়েছিলেন–তা নিয়ে কোনো বিতর্ক ছিলো না। তখন তাকে আমার প্রায় পরম পূজনীয় এক অতিমানব বলে মনে হতো। কিন্তু এখন শুনতে পাচ্ছি যে, তিনি নাকি এখনকার দেশনায়ক/নায়িকাদের তুলনায় অপোগ— মাত্র। নাক টিপলে দুধ বের হয়।

এসব দেখে-শুনে সবাই এখন এক বাক্যে স্বীকার করেন যে, রাজনীতির মতো লাভজনক ব্যবসা আর নেই। এমন কি, আপনি যদি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হতে পারেন, তা হলেও আপনার কোটিপতি হওয়ার গ্যারান্টি থাকবে। সাংসদ হলে, কোটি-কোটিপতি। তার থেকেও বড়ো কোনো রাঘব বোয়াল হলে আপনি দেশটার একটা বড়ো অংশই গিলে খেতে পারবেন। এমন লাভজনক ব্যবসা হাতে রাখার জন্যে তাই ক্লিনিকে গিয়ে রাজনীতিকরা বিবেক ফেলে দিয়ে এবং নীতির মুড়িঘণ্ট ধুয়ে-মুছে-চেটে-পুটে খেয়ে সব কিছু করতে তৈরি থাকেন।

এই ব্যবসা করার জন্যে বেশি কিছু লাগেও না— প্রথমেই দরকার স্লোগান দেওয়ার লোক–যাদের ধরা যাক আমরা নাম দিলাম–পদাতিক সৈন্য। সহজেই তাদের ভাড়া করা যায়। যে টাকা দেবে, তার হয়ে এরা জিন্দাবাদ অথবা ধ্বংস হউক বলবে। তারপরে দরকার লাঠিয়ালদের সাজোয়া বাহিনী। তারপর খুনীদের কম্যান্ডো বাহিনী। তারপর সরকারী কর্মকর্তার আর্টিলারি। এই কর্মী বাহিনীর বেশির ভাগই জলের মতো (পানি বললাম না, কারণ তাঁরা নর্দমার দুৰ্গন্ধওয়ালা নোংরা জল–পান। করার উপযুক্ত নয়)। তাঁরা জলের মতো, কারণ যে-পাত্রে রাখিবেন, এই মাল সেই পাত্রের আকার ধারণ করবেন। যে-দল ক্ষমতায় আসুক সেই দলেরই ভাড়াটে সৈন্যের কাজ করিবেন। এসব বিল্ট-ইন ব্যবস্থা ছাড়া, দলের লোকেদের চাকরি দিয়ে আপনি প্রাইভেট আর্মিও গঠন করতে পারেন। লোকবল ছাড়া আপনার ব্যবস্থা করতে হবে প্রচারের জন্যে। এসবের ম্যানেজ করতে পারলে সামনের বার, ইনিশাল্লাহ, আপনি ক্ষমতায় আসতে পারবেন। এবং আসতে পারলে আপনার এতো টাকা হবে যে, আপনি নিজেই তার খেই হারিয়ে ফেলবেন। বোধ হয়, মরার সময়ে সন্তানদের সঠিক হিসেব দিয়ে যেতে পারবেন না।

কিন্তু কথা হচ্ছে, টাকা এলে সুখ-শান্তি আসবে কি? সরি! সেটার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারছেন না। আপনার পরিবার ভেঙে যেতে পারে। মানসিক শান্তি চলে যেতে পারে। দৈহিক পরিশ্রমে আপনি কাতর হতে পারেন। টেনশনে আপনার হার্ট অ্যাটাকিও হতে পারে। কিন্তু আপনার শত শত কোটি টাকা কেউ আটকাতে পারবে না।

কদিন আগে লন্ডনের এক রেস্টুরেন্টে বসে কবি এবং বাংলা সাহিত্যের একজন প্রধান নাট্যকার সৈয়দ শামসুল হককে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এতো টাকা দিয়ে এই কোটিকোটিপতিরা কী করবেন? এতো টাকা কোন কাজে লাগবে? তিনি সংক্ষেপে বললেন, ধর্মীয় অনুশাসন অনুযায়ী মরার পর গুপ্তস্থানের লোমগুলোও কামিয়ে নিতে হয়। অর্থাৎ ওগুলোও সঙ্গে যাবে না–টাকা তো নয়ই!

বলতে পারেন: আপনার আর কতো টাকা চাই?

(যুগান্তর, ২০০৬)

সকল অধ্যায়

১. ০১. দেবতার নারীবন্দনা
২. ০২. কারও পদতলে বেহেস্ত নয়
৩. ০৩. রোকেয়া : অবদান ও সীমানা
৪. ০৪. তসলিমার ভালোমন্দ
৫. ০৫. সুকুমারী থেকে সুচিত্রা
৬. ০৬. নারীবাদের সহি সবক
৭. ০৭. ধর্ম ও নারী
৮. ০৮. নর-বানর
৯. ০৯. আল্লাহ হাফেজ
১০. ১০. ঈশ্বরের ভাষাজ্ঞান
১১. ১১. শহীদের অপমৃত্যু
১২. ১২. ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত
১৩. ১৩. ধর্মীয় সাম্রাজ্যবাদ
১৪. ১৪. ধর্ম ও আধুনিকতা
১৫. ১৬. লক্ষ্য ও পন্থা
১৬. ১৭. আধুনিকতা
১৭. ১৮. রবীন্দ্রনাথ ও পূর্ববাংলার মুসলিম সমাজ
১৮. ১৯. কেন রবীন্দ্রনাথ?
১৯. ২০. রবীন্দ্ৰনাথ কি বেঁচে আছেন?
২০. ২১. শ্ৰেষ্ঠ বাঙালি : রবীন্দ্রনাথ বনাম শেখ মুজিব
২১. ২২. নজরুলের ধর্মমত ও অসাম্প্রদায়িকতা
২২. ২৩. শামসুর রাহমান: মুকুটহীন জাতীয় কবি
২৩. ২৪.  বাঙালির আদিখ্যেতা
২৪. ২৫.  ভবিষ্যতের বাংলা ভাষা-সাহিত্য
২৫. ২৬. আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস : গৌরব ও বাস্তব
২৬. ২৭. ভাষার চরিত্ৰহানি
২৭. ২৮. স্বাধীনতার লাভ লোকসান
২৮. ২৯. শাদা-কালো
২৯. ৩০. প্রেমের প্রাদুর্ভাব ও প্রতিকার
৩০. ৩১. পাশবিক ভাষা
৩১. ৩২. বিদ্যা ও বিশ্বাস
৩২. ৩৩. কতো টাকা চাই?
৩৩. ৩৪. মৃত্যুর পর শান্তি আছে?
৩৪. ৩৫. যে ঐ দেশেতে মরি
৩৫. ৩৬. গানের ভিতর দিয়ে

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন