দাম্পত্য ও অধিকার

“এ জগতে যত ফুটিয়াছে ফুল, ফলিয়াছে যত ফল,

নারী দিল তাহে রূপ-রস-মধু-গন্ধ সুনির্মল।

কোনো কালে একা হয়নি কো জয়ী পুরুষের তরবারী,

প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে বিজয়-লক্ষ্মী নারী।”

নারী পুরুষের অর্ধাঙ্গিনী, সমাজের সচল জোড়া চাকার অন্যতম। পরিবারের ভিত্তি ও শিক্ষার প্রথম স্কুল এই নারী। প্রত্যেক মহান পুরুষের পশ্চাতে কোন না কোন নারী লুক্কায়িত থাকে অথবা পুরুষের মহত্বের পিছনে এই নারীর হাত অবশ্যই থাকে।

দাম্পত্য জীবনে স্বামী-স্ত্রী উভয়েই উভয়ের মুখাপেক্ষী। প্রত্যেকের স্ব-স্ব অধিকার রয়েছে অপরের উপর। ইসলামে এই হল ভারসাম্যমূলক পারস্পরিক সহায়তাভিত্তিক প্রেম-প্রীতির সুন্দরতম জীবন ব্যবস্থা।

মানুষ হিসাবে সমান অধিকার সকলের। কিন্তু তাহলেও সমাজে সুশৃঙ্খলার জন্য নেতা ও মান্যব্যক্তির বিশেষ প্রয়োজন। নচেৎ সবাই ‘মোড়ল’ হলে শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় থাকে না। নারী-পুরুষের ভূমিকা সমান হলেও নারীর উপর পুরুষের কর্তৃত্ব রয়েছে। নারী জাতিকে অপেক্ষাকৃত দুর্বলরূপে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর ঘোষণাঃ-

هُنَّ لِبَاسٌ لَّكُمْ وَأَنْتُمْ لِبَاسٌ لَّهُنَّ

অর্থাৎ, “তারা তোমাদের পোশাক এবং তোমরা তাদের পোশাক।”[1]

﴿وَلَهُنَّ مِثْلُ الَّذِي عَلَيْهِنَّ بِالْمَعْرُوفِ وَلِلرِّجَالِ عَلَيْهِنَّ دَرَجَةٌ﴾

“নারীদের তেমনি ন্যায়সংগত অধিকার আছে, যেমন আছে তাদের উপর পুরুষদের। কিন্তু নারীদের উপর পুরুষদের কিছু মর্যাদা আছে।”[2]

﴿الرِّجَالُ قَوَّامُونَ عَلَى النِّسَاءِ بِمَا فَضَّلَ اللهُ بَعْضَهُمْ عَلَى بَعْضٍ وَبِمَا أَنْفَقُوا مِنْ أَمْوَالِهِمْ﴾

“পুরুষ নারীর কর্তা। কারণ আল্লাহ তাদের এককে অপরের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন এবং এ শ্রেষ্ঠত্ব এজন্য যে, পুরুষ (তাদের জন্য) ধন ব্যয় করে থাকে।”[3]

সুতরাং নারী পুরুষদের নেত্রী হতে পারে না। নেতার অর্ধাঙ্গিনী, রানী বা রাজমাতা হয়েই তো নারীর বিরাট গর্ব।

‘অতএব জাগো জাগো গো ভগিনী,

হও বীরজায়া বীর-প্রসবিনী।’

ইবাদতেও স্বামী স্ত্রীর ইমাম। স্বামী অশিক্ষিত এবং স্ত্রী পাকা হাফেয-ক্বারী হলেও ইমামতি স্বামীই করবে।[4] পরন্তু স্ত্রী স্বামীর পশ্চাতে দাঁড়িয়ে (জামাআত করে) নামাজ পড়বে।[5]

স্বামীর উপর স্ত্রীর অনস্বীকার্য অধিকারঃ-

স্বামীর উপর স্ত্রীর বহু অধিকার আছে, যা পালন করা স্বামীর পক্ষে ওয়াজেব। সেই সমস্ত অধিকার নিম্নরূপঃ-

১. আর্থিক অধিকারঃ-

ক. স্বামী বিবাহ-বন্ধনের সময় বা পূর্বে যে মোহর স্ত্রীকে প্রদান করবে বলে অঙ্গীকার করেছে তা পূর্ণভাবে আদায় করা এবং তা হতে স্ত্রীকে বঞ্চিতা করার জন্য কোন প্রকার টাল-বাহানা না করা। মহান আল্লাহ বলেন,

﴿فَآتُوهُنَّ أُجُورَهُنَّ فَرِيضَةً﴾

“সুতরাং তাদেরকে তাদের ফরয মোহর অর্পণ কর।”[6]

খ. আর্থিক অবস্থানুযায়ী স্ত্রীর ভরণ-পোষণ করা। নিজে যা খাবে তাকে খাওয়াবে এবং যা পরিধান করবে ঠিক সেই সমমানের লেবাস তাকেও পরিধান করাবে।[7] অবশ্য নেকীর নিয়তে এই ব্যয়িত অর্থ স্বামীর জন্য সদকার সমতুল্য হবে।[8] অন্যান্য সকল ব্যয়ের চেয়ে স্ত্রীর পশ্চাতে ব্যয়ের নেকীই অধিক।[9] এমন কি তাকে এক গ্লাস পানি পান করালেও তাতে নেকী লাভ হয় স্বামীর।[10]

২. ব্যবহারিক অধিকারঃ-

ক. স্ত্রীর সাথে সদ্ভাবে বাস করা ওয়াজেব। দুই-একটি গুণ অপছন্দ হলেও সদাচার ও সদ্ব্যবহার বন্ধ করা মোটেই উচিৎ নয়। মহান আল্লাহ বলেন,

﴿وَعَاشِرُوهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ فَإِنْ كَرِهْتُمُوهُنَّ فَعَسَى أَنْ تَكْرَهُوا شَيْئاً وَيَجْعَلَ اللهُ فِيهِ خَيْراً كَثِيراً﴾

“আর তাদের সাথে সদ্ভাবে জীবন-যাপন কর। তোমরা যদি তাদেরকে ঘৃণা কর, তবে এমনও হতে পারে যে, তোমরা যা ঘৃণা করছ, আল্লাহ তার মধ্যেই প্রভূত কল্যাণ নিহিত রেখেছেন।”[11]

সুতরাং সদ্ভাব ফুটিয়ে তুলতে স্বামী সর্বদা নিজের প্রেমকে স্ত্রীর মনের সিংহাসনে আসীন করে রাখবে। তাকে সুন্দর প্রেমময় নামে ডাকবে, সে যা চায় তাই তাকে সাধ্যমত প্রদান করবে। হৃদয়ের বিনিময়ে হৃদয় এবং শক্তি নয় বরং ভক্তি দ্বারাই সাথীর মন জয় করা কর্তব্য।

স্ত্রীর মন পেতে হলে আগে প্রেম দিতে হবে। ‘একটি পাখীকে ধরতে হলে তাকে ভয় দেখানো চলে না। তাকে আদর ক’রে, ভালোবাসা দিয়ে কাছে আনতে হয়। অতঃপর একদিন সে আপনিই পোষ মেনে নেয়। কারণ, স্নেহ ও ভালোবাসা বড়ই পবিত্র জিনিস।’

স্ত্রীর নিকট তার মাতৃলয়ের প্রশংসা করবে। সময় মত তাকে সেখানে নিয়ে যাবে বা যেতে-আসতে দেবে।

কোন কারণে স্ত্রী রেগে গেলে ধৈর্য ধরবে। মুর্খামি করলে সহ্য করে নেবে। যেহেতু পুরুষ অপেক্ষা নারীর আবেগ ও প্রতিক্রিয়া-প্রবণতা অধিক এবং পুরুষের চেয়ে নারীর ধৈর্য বহুলাংশে কম। সুতরাং দয়া করেই হোক অথবা ভালোবাসার খাতিরেই হোক তার ভুল ক্ষমা করবে। ‘যত ভুল হবে ফুল ভালোবাসাতে।’ তার ছোটখাট ত্রুটির প্রতি ভ্রূক্ষেপ করবে না। অনিচ্ছাকৃত ভুলের উপর তাকে চোখ রাঙাবে না। অন্যায় করলে অবশ্য শাসন করার অধিকার তার আছে। তবে-

‘শাসন করা তারই সাজে সোহাগ করে যে,

ত্রুটির উপর প্রীতির সাথে সহন ধরে সে।’

তাছাড়া ভুল হওয়া মানুষের প্রকৃতিগত স্বভাব। ভুল-ত্রুটি দিয়ে সকলেরই জীবন গড়া। কিন্তু সেই ভুলকে প্রাধান্য দিয়ে বাকী জীবনে অশান্তি ডেকে আনার কোন যুক্তি নেই।

প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন,

اسْتَوْصُوا بِالنِّسَاءِ فَإِنَّ الْمَرْأَةَ خُلِقَتْ مِنْ ضِلَعٍ وَإِنَّ أَعْوَجَ شَيْءٍ فِي الضِّلَعِ أَعْلَاهُ فَإِنْ ذَهَبْتَ تُقِيمُهُ كَسَرْتَهُ وَإِنْ تَرَكْتَهُ لَمْ يَزَلْ أَعْوَجَ فَاسْتَوْصُوا بِالنِّسَاءِ.

“তোমরা নারীদের জন্য হিতাকাঙ্ক্ষী হও। কারণ, নারী জাতি বঙ্কিম পঞ্জরাস্থি হতে সৃষ্ট। আর তার উপরের অংশ বেশী বঙ্কিম (সুতরাং তাদের প্রকৃতিই বঙ্কিম ও টেরা।) অতএব তুমি সোজা করতে গেলে হয়তো তা ভেঙ্গেই ফেলবে। আর নিজের অবস্থায় উপেক্ষা করলে বাঁকা থেকেই যাবে। অতএব তাদের জন্য মঙ্গলকামী হও।”[12]

সুতরাং স্ত্রীর নিকট থেকে যত বড় আদর্শের ব্যবহারই আশা করা যাক না কেন, তার মধ্যে কিছু না কিছু টেরামি থাকবেই। সম্পূর্ণভাবে স্বামীর মনে অঙ্কিত সরল পথে সে চলতে চাইবে না। সোজা করে চালাতে গেলে হাড় ভাঙ্গার মত ভেঙ্গে যাবে; অর্থাৎ মন ভেঙ্গে দাম্পত্য ভেঙে (তালাক হয়ে) যাবে।[13]

প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন,

لاَ يَفْرَكْ مُؤْمِنٌ مُؤْمِنَةً إِنْ كَرِهَ مِنْهَا خُلُقًا رَضِىَ مِنْهَا آخَرَ.

“কোন মু’মিন পুরুষ যেন কোন মু’মিন স্ত্রীকে ঘৃণা না বাসে। কারণ সে তার একটা গুণ অপছন্দ করলেও অপর আর একটা গুণে মুগ্ধ হবে।”[14]

সুতরাং পূর্ণিমার সুদর্শন চন্দ্রিমারও কলঙ্ক আছে। সুদর্শন সৌরভময় গোলাপের সহিতও কণ্টক আছে। গুণবতীর মধ্যেও কিছু ত্রুটি থেকে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়।

কথিত আছে যে, একদা এক ব্যক্তি তার ঠোঁটকাটা স্ত্রীর অভিযোগ নিয়ে হযরত উমারের নিকট উপস্থিত হয়ে বাড়ির দরজায় তাঁকে ডাক দিয়ে অপেক্ষা করতেই শুনতে পেল হযরত ওমরের স্ত্রীও তাঁর সাথে কথা-কাটাকাটি করছেন এবং তিনি নীরব থেকে যাচ্ছেন। লোকটি আর কোন কথা না বলে প্রস্থান করতে করতে মনে মনে বলতে লাগল, ‘আমীরুল মু’মিনীনের যদি এই অবস্থা হয় অথচ তিনি খলীফা, কত কড়া মানুষ, তাহলে আমার আর কি হতে পারে?’ হযরত উমার দরজায় এসে লোকটিকে যেতে দেখে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার প্রয়োজন না বলেই তুমি চলে যাচ্ছ কেন?’ লোকটি বলল, ‘যার জন্য এসেছিলাম তার জবাব আমি পেয়ে গেছি হুজুর! আমার স্ত্রী আমার সাথে লম্বা জিভে কথা বলে। তারই অভিযোগ নিয়ে আপনার কাছে এসেছিলাম। কিন্তু দেখছি আপনারও আমার মতই অবস্থা?’ উমার বললেন, ‘আমি সহ্য করে নিই ভাই! কারণ, আমার উপর তার অনেক অধিকার আছে; সে আমার খানা পাক করে, রুটি তৈরী করে, কাপড় ধুয়ে দেয়, আমার সন্তানকে স্তনদুগ্ধ পান করিয়ে লালন-পালন করে, আমার হৃদয়ে শান্তি আনে, ইত্যাদি। তাই একটু সহ্য করে নিই।’ লোকটি বলল, ‘আমীরুল মু’মিনীন! আমার স্ত্রীও তো অনুরূপ।’ উমার বললেন, ‘তবে সহ্য করে নাও গে ভাই! সে তো সামান্যক্ষণই রাগান্বিতা থাকে।’

সুতরাং সুন্দর সৌরভময় গোলাপ তুলে তার সুঘ্রাণ নিতে হলে দু-একটা কাঁটা হাতে-গায়ে ফুঁড়বে বৈ কি? কাঁটার জন্য কেউ কি প্রস্ফুটিত গোলাপকে ঘৃণা করে? নারী গোলাপের মত সুন্দর ও কোমল বলেই কাঁটার ন্যায় কথা দ্বারা নিজেকে রক্ষা করতে চায়।[15]

পক্ষান্তরে রাগের মাথায় একজন পুরুষকে ক্ষান্ত করতে হলে তার বিবেক-বুদ্ধির খেই ধরে, একজন নারীকে ক্ষান্ত করতে হলে তার হৃদয় ও আবেগের খেই ধরে এবং সমাজকে ক্ষান্ত করতে হলে তার প্রকৃতিকে জাগ্রত করে সফল হওয়া যায়। তাছাড়া ‘স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া করে কোন লাভও নেই; আঘাত করলেও কষ্ট, আর আঘাত পেলেও কষ্ট।’

স্ত্রী কোন ভাল কথা বললে উপেক্ষার কানে না শুনে খেয়ালের সাথে শোনা, কোন উত্তম রায়-পরামর্শ দিলে তা সাদরে গ্রহণ করাও সদ্ভাবে বাস করার শামিল।

যেমন, তার সাথে হাসি-তামাসা করা, সব সময় পৌরুষ মেজাজ না রেখে কোন কোন সময় তার সাথে বৈধ খেলা করা, শরীরচর্চা বা ব্যায়ামাদি করা ইত্যাদিও স্বামীর কর্তব্য। প্রিয় নবী (সাঃ) স্ত্রী আয়েশার সাথে দৌড় প্রতিযোগিতা করে একবার হেরেছিলেন ও পরে আর একবারে তিনি জিতেছিলেন।[16]

তদনুরূপ স্ত্রীকে কোন বৈধ খেলা দেখতে সুযোগ দেওয়াও দূষণীয় নয়।[17] তবে এসব কিছু হবে একান্ত নির্জনে, পর্দা-সীমার ভিতরে।

স্ত্রী ভালো খাবার তৈরী করলে, সাজগোজ করলে বা কোন ভালো কাজ করলে তার প্রশংসা করবে স্বামী। এমনকি স্ত্রীর হৃদয়কে লুটে নেওয়ার জন্য ইসলাম মিথ্যা বলাকেও বৈধ করেছে।[18] তবে যে মিথ্যা তার অধিকার হরণ করে ও তাকে ধোঁকা দেয়, সে মিথ্যা নয়।

সদ্ভাবে বাস করতে চাইলে স্বামী স্ত্রীর গৃহস্থালি কর্মেও সহায়তা করবে। এতে স্ত্রীর মন স্বামীর প্রতি শ্রদ্ধা ও প্রেমে আরো পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে। প্রিয় নবী (সাঃ); যিনি দুজাহানের বাদশাহ তিনিও সংসারের কাজ করতেন। স্ত্রীদের সহায়তা করতেন, অতঃপর নামাযের সময় হলেই মসজিদের দিকে রওনা হতেন।[19]

তিনি অন্যান্য মানুষের মত একজন মানুষ ছিলেন; স্বহস্তে কাপড় পরিষ্কার করতেন, দুধ দোয়াতেন এবং নিজের খিদমত নিজেই করতেন।[20]

স্বামী যেমন স্ত্রীকে সুন্দরী দেখতে পছন্দ করে তেমনি স্ত্রীও স্বামীকে সুন্দর ও সুসজ্জিত দেখতে ভালোবাসে। এটাই হল মানুষের প্রকৃতি। সুতরাং স্বামীরও উচিৎ, স্ত্রীকে খোশ করার জন্য সাজগোজ করা। যাতে তারও নজর অন্য পুরুষের (স্বামীর কোন পরিচ্ছন্ন আত্মীয়ের) প্রতি আকৃষ্ট না হয়। ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘আমি আমার স্ত্রীর জন্য সাজসজ্জা করি, যেমন সে আমার জন্য সাজসজ্জা করে।’ আর আল্লাহ তাআ’লা বলেন,

﴿وَلَهُنَّ مِثْلُ الَّذِي عَلَيْهِنَّ بِالْمَعْرُوفِ﴾

“নারীদের তেমনি ন্যায়সঙ্গত অধিকার আছে, যেমন তাদের উপর আছে পুরুষদের–।”[21]

বলাই বাহুল্য যে, এই অবহেলার ফলেই বহু আধুনিকা স্বামী ত্যাগ করে অথবা অন্যাসক্তা হয়ে পড়ে।

খলীফা উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর নিকট একটি লোক উষ্কখুষ্ক ও লেলাখেপা বেশে উপস্থিত হল। সঙ্গে ছিল তার স্ত্রী। স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করে তার নিকট থেকে বিবাহ বিচ্ছেদ প্রার্থনা করল। দূরদর্শী খলীফা সব কিছু বুঝতে পারলেন। তিনি তার স্বামীকে পরিচ্ছন্নতা গ্রহণ করার উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দিলেন। অতঃপর সে তার চুল, নখ ইত্যাদি কেটে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে ফিরে এলে তিনি তাকে তার স্ত্রীর নিকট যেতে আদেশ করলেন। স্ত্রী পরপুরুষ ভেবে তাকে দেখে সরে যাচ্ছিল। পরক্ষণে তাকে চিনতে পেরে তালাকের আবেদন প্রত্যাহার করে নিল!

এ ঘটনার পর খলীফা উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ‘তোমরা তোমাদের স্ত্রীর জন্য সাজসজ্জা কর। আল্লাহর কসম! তোমরা যেমন তোমাদের স্ত্রীগণের সাজসজ্জা পছন্দ কর; অনুরূপ তারাও তোমাদের সাজসজ্জা পছন্দ করে।[22]

স্ত্রীর এঁটো খাওয়া অনেক স্বামীর নিকট অপছন্দনীয়। কিন্তু শরীয়তে তা স্বীকৃত। রসূল (সাঃ) পান-পাত্রের ঠিক সেই স্থানে মুখ রেখে পানি পান করতেন, যে স্থানে হযরত আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা মুখ লাগিয়ে পূর্বে পান করতেন। যে হাড় থেকে হযরত আয়েশা গোশ্ত ছাড়িয়ে খেতেন, সেই হাড় নিয়েই ঠিক সেই জায়গাতেই মুখ রেখে আল্লাহর নবী (সাঃ) গোশ্ত ছাড়িয়ে খেতেন।[23] তাছাড়া স্ত্রীর রসনা ও ওষ্ঠাধর চোষণের ইঙ্গিতও শরীয়তে বর্তমান।[24]

এমন প্রেমের প্রতিমার এঁটো এবং চুম্বন তারাই খেতে চায়না, যারা একান্ত প্রেমহীন নীরস পুরুষ অথবা যাদের স্ত্রী অপরিচ্ছন্ন ও নোংরা থাকে তারা অথবা যাদের নিকট কেবল লৈঙ্গিক যৌনসম্ভোগই মূল তৃপ্তি।

স্ত্রীকে বিভিন্ন উপলক্ষে (যেমন ঈদ, কুরবানী প্রভৃতিতে) ছোটখাট উপহার দেওয়াও সদ্ভাবে বাস করার পর্যায়ভুক্ত। এতেও স্ত্রীর হৃদয় চিরবন্দী হয় স্বামীর হৃদয় জেলে।

মোট কথা স্ত্রীর সাথে বাস তো প্রেমিকার সাথে বাস। সর্বতোভাবে তাকে খোশ রাখা মানুষের প্রকৃতিগত স্বভাব। প্রেমিককে কষ্ট দেওয়া কোন মুসলিম, কোন মানুষের, বরং কোন পশুরও কাজ নয়।

প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন,

خَيْرُكُمْ خَيْرُكُمْ لأَهْلِهِ وَأَنَا خَيْرُكُمْ لأَهْلِى.

“তোমাদের মধ্যে উত্তম ব্যক্তি সেই, যে তার স্ত্রীর নিকট উত্তম। আর আমি নিজ স্ত্রীর নিকট তোমাদের সর্বোত্তম ব্যক্তি।”[25]

أَكْمَلُ الْمُؤْمِنِينَ إِيمَانًا أَحْسَنُهُمْ خُلُقًا وَخِيَارُهُمْ خِيَارُهُمْ لِنِسَائِهِمْ.

“সবার চেয়ে পূর্ণ ঈমানদার ব্যক্তি সে, যার চরিত্র সবার চেয়ে সুন্দর এবং ওদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উত্তম ব্যক্তি সেই, যে তার স্ত্রীর নিকট উত্তম।”(আহমদ)

وَاسْتَوْصُوا بِالنِّسَاءِ خَيْرًا فَإِنَّمَا هُنَّ عَوَانٍ عِنْدَكُمْ.

“সাবধান! তোমরা নারী (স্ত্রী)দের জন্য মঙ্গলকামী হও। যেহেতু তারা তো তোমাদের হাতে বন্দিনী।”[26]

اتَّقُوا اللَّهَ فِى النِّسَاءِ فَإِنَّكُمْ أَخَذْتُمُوهُنَّ بِأَمَانَةِ اللَّهِ وَاسْتَحْلَلْتُمْ فُرُوجَهُنَّ بِكَلِمَةِ اللَّهِ.

“তাদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর। যেহেতু তাদেরকে তোমরা আল্লাহর অঙ্গীকারে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে বরণ করেছ এবং আল্লাহর বাণীর মাধ্যমে তাদের লজ্জাস্থান হালাল করে নিয়েছ।”[27]

অবশ্যই স্ত্রীর যথার্থ মর্যাদা ও অধিকার প্রদান করার নাম ‘আঁচল ধরা’ বা ‘বউ পাগলামি’ নয়।

খ. স্বামীর উপর স্ত্রীর অন্যতম অধিকার এই যে, বিপদ আপদ থেকে স্বামী তাকে রক্ষা করবে। স্ত্রীকে রক্ষা করতে গিয়ে যদি স্বামী শত্রুর হাতে মারা পরে, তবে সে শহীদের দর্জা পায়।[28]

অনুরূপ স্ত্রীকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করাও তার এক বড় দায়িত্ব। তাকে দ্বীন, আকীদা, পবিত্রতা, ইবাদত, হারাম, হালাল, অধিকার ও ব্যবহার প্রভৃতি শিক্ষা দিয়ে সৎকাজ করতে আদেশ ও অসৎকাজে বাধা দিয়ে আল্লাহর আযাব থেকে রেহাই দেবে।

মহান আল্লাহ বলেন,

﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قُوا أَنْفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَاراً وَقُودُهَا النَّاسُ وَالْحِجَارَةُ﴾

“হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং নিজ পরিবারকে জাহান্নাম থেকে বাঁচাও; যার ইন্ধন মানুষ ও পাথর –।”[29]

গ. স্ত্রীর ধর্ম, দেহ, যৌবন ও মর্যাদায় ঈর্ষাবান হওয়া এবং এ সবে কোন প্রকার কলঙ্ক লাগতে না দেওয়া স্বামীর উপর তার এক অধিকার। সুতরাং স্ত্রী এক উত্তম সংরক্ষণীয় ও হিফাজতের জিনিস। লোকের মুখে-মুখে, পরপুরুষদের চোখে-চোখে ও যুবকদের মনে-মনে বিচরণ করতে না দেওয়া; যাকে দেখা দেওয়া তার স্ত্রীর পক্ষে হারাম তাকে সাধারণ অনুমতি দিয়ে বাড়ি আসতে-যেতে না দেওয়া সুপুরুষের কর্ম।

আর এর নাম রক্ষণশীলতা বা গোঁড়ামী নয়। বরং এটা হল সুপুরুষের রুচিশীলতা ও পবিত্রতা। নারী-স্বাধীনতার নামে যারা এই বল্গাহীনতা ও নগ্নতাকে ‘প্রগতি’ মনে ক’রে আল্লাহ-ভক্তদের ‘গোঁড়া’ বলে থাকে, শরীয়ত তাদেরকেই ‘ভেঁড়া’ বলে আখ্যায়ন করে। আর ‘ভেঁড়া’ বা স্ত্রী-কন্যার ব্যাপারে ঈর্ষাহীন পুরুষ জান্নাতে যাবে না।[30]

নিজের ইচ্ছামত এ ঘর-ও ঘর, এ পাড়া-ও পাড়া, এ মার্কেট সে মার্কেট যেতে স্বামী তার স্ত্রীকে বাধা দেবে। কোন প্রকার নোংরামী, অশ্লীলতা, গান-বাজনা, সিনেমা-থিয়েটারে নিজে যাবে না, স্ত্রীকেও যেতে দেবে না। নোংরা টেলিভিশন ও ভিডিও বাড়িতে রাখবে না। রেডিওতে গান-বাজনা শুনতে দেবে না। পর্যাপ্ত কারণ বিনা এবং আপোসের চুক্তি ও সম্মতি ছাড়া চার মাসের অধিক স্ত্রী ছেড়ে বাইরে থাকবে না। যেহেতু পুরুষের যৌনপ্রবৃত্তি যেমন, ঠিক তেমনি নারীরও। পুরুষের যেমন নারীদেহ সংসর্গলাভে পরমতৃপ্তি, অনুরূপ নারীও পুরুষের সংসর্গ পেয়ে চরম তৃপ্তি উপভোগ করে থাকে। অতএব প্রেমে অনাবিলতা বজায় রাখতে নারীকে হিফাযত করা পুরুষের জন্য ফরয এবং তা এক সুরুচিপূর্ণ কর্ম। পানি বা শরবতে সামান্য একটা পোকা বা মাছি পড়লে তা পান করতে কারো রুচি হয় না; আর নিজ স্ত্রীর সৌন্দর্য ও প্রেমে অপরের কাম বা কুদৃষ্টি, মন্তব্যের মুখ ও কামনার মন পড়লে তাতে কি করে রুচি হয় সুপুরুষের? সুতরাং যে পুরুষের অনুরূপ সুরুচি নেই সে কাপুরুষ বৈ কি?

হিজরী ২৮৬ সনে ‘রাই’এর কাযীর নিকট এক মহিলা মুকাদ্দামা দায়ের করল। তার অভিভাবকের সাথে মিলে স্বামীর বিরুদ্ধে সে তার মোহরানা বাবদ ৫০০ দিরহাম আদায় না দেওয়ার অভিযোগ করল। কাযী সাক্ষী তলব করলে সাক্ষী উপস্থিত করা হল। কিন্তু সাক্ষিদাতারা মহিলাটিকে চেনার জন্য তার চেহারা দেখাতে অনুরোধ জানালো। এ খবর স্বামীর কানে গেলে কাযীর সামনে বলল, ‘আমি স্বীকার করছি যে, ৫০০ দিরহাম আমার স্ত্রীর পাওনা। আমি যথাসময়ে তাকে তা আদায় করে দেব। সাক্ষীর দরকার নেই। ও যেন চেহারা না খোলে!’

এ খবর স্ত্রীর নিকট গেলে সেও আল্লাহ অতঃপর কাযীকে সাক্ষী রেখে বলল, ‘আমিও আমার স্বামীর নিকট থেকে প্রাপ্য উক্ত মোহরানার দাবী প্রত্যাহার করে নিচ্ছি এবং দুনিয়া ও আখেরাতের জন্য ওকে ক্ষমা করে দিচ্ছি!’

এ শুধু এ জন্য যে, পর্দার মান ও মূল্য আছে নারীর কাছে, আর স্বামীর আছে যথাযথ ঈর্ষা। তাই চেহারা খুলে বেআবরু করতে সকলেই নারাজ। এটাই তো সুরুচিপূর্ণ মুসলিম দম্পতির পরিচয়।

একটি সত্য কথা এই যে, মহিলা ঈর্ষাবান পুরুষকে অপছন্দ করে। কিন্তু যে তার ব্যাপারে ঈর্ষাবান নয়, তাকে সে আরো বেশী অপছন্দ করে।

স্ত্রীকে খামাখা সন্দেহ করাও স্বামীর উচিৎ নয়। বৈধ কর্মে, চিকিৎসার জন্য বা অন্যান্য জরুরী কাজের জন্য পর্দার সাথে যেতে না দিয়ে তাকে অর্গলবদ্ধ করে রাখাই হল অতিরঞ্জন ও গোঁড়ামী। তাছাড়া এমন অবরোধ প্রথায় ইসলামের কোন সমর্থন নেই।

পক্ষান্তরে স্ত্রীকে সন্দেহ করলে দাম্পত্য জীবন তিক্ত হয়ে উঠে। কারণ দাম্পত্য সুখের জন্য জরুরী; স্বামী-স্ত্রীর উভয়ের আমানতদারী, হিতৈষিতা, সত্যবাদিতা, অন্তরঙ্গতা, অনাবিল প্রেম, বিশ্বস্ততা, নম্রতা, সুস্মিত ব্যবহার ও বাক্যালাপ, একে অপরের গুণ স্বীকার। আর সন্দেহ এসব কিছুকে ধবংস করে ফেলে। কারণ সন্দেহ এমন জিনিস যার সূক্ষ্ণতম শিকড় একবার মনের মাটিতে সঞ্চালিত হয়ে গেলে তাকে যতক্ষণ পর্যন্ত না টেনে-ছিঁড়ে ফেলা হয়, ততক্ষণ সে প্রবল প্রতাপে রাজত্ব করতে থাকে এবং সম্প্রীতি ও সুখের কথা ভাবতেই দেয় না।

এই সন্দেহের ফলশ্রুতিতেই বহু হতভাগা স্বামী তাদের স্ত্রীদেরকে ভাতের চাল পর্যন্ত তালাবদ্ধ রেখে রান্নার সময় মেপে রাঁধতে দেয়! বলাই বাহুল্য যে, কথায় কথায় এবং কাজে কাজে স্ত্রীকে সন্দেহ করলে সে স্বামীর সংসার নিশ্চয় এক প্রকার জাহান্নাম।

পরিশেষে, মহান আল্লাহর এই বাণী প্রত্যেক স্বামীর মনে রাখা উচিৎ; তিনি বলেন,

[يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّ مِنْ أَزْوَاجِكُمْ وَأَوْلادِكُمْ عَدُوّاً لَكُمْ فَاحْذَرُوهُمْ وَإِنْ تَعْفُوا وَتَصْفَحُوا وَتَغْفِرُوا فَإِنَّ اللهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ]

“হে মুমিনগণ! নিশ্চয় তোমাদের স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততির মধ্যে কেউ কেউ তোমাদের (পার্থিব ও পারলৌকিক বিষয়ের) শত্রু। অতএব তাদের ব্যাপারে তোমরা সতর্ক থেকো। অবশ্য (দ্বীনী বিষয়ে অন্যায় থেকে তওবা করলে ও পার্থিব বিষয়ক অন্যায়ে) তোমরা যদি ওদেরকে মার্জনা কর, ওদের দোষ-ত্রুটি উপেক্ষা কর এবং ওদেরকে ক্ষমা করে দাও তাহলে জেনে রাখ যে, আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।”[31]

ফুটনোট

[1] (সূরা আল-বাক্বারা (২) : ১৮৭)

[2] (সূরা আল-বাক্বারা (২) : ২২৮)

[3] (সূরা আন-নিসা (৪) : ৩৪)

[4] (মাজাল্লাতুল বহুসিল ইসলামিয়্যাহ ১/৩৮২)

[5] (জামিউ আহকামিন নিসা, ১/৪১৬)

[6] (সূরা আন-নিসা (৪) : ২৪)

[7] (আবু দাঊদ, তিরমিযী, ইনাঃ, আল মারআতুল মুসলিমাহ, ওয়াহ্বী সুলাইমান আল-আলবানী ১৪৭পৃঃ)

[8] (বুখারী, মুসলিম, মিশকাতুল মাসাবীহ১৯৩০নং)

[9] (মুসলিম, মিশকাতুল মাসাবীহ ১৯৩১নং)

[10] (আস-সিলসিলাতুস সহীহাহ ২৭৩৬নং, ইরওয়াউল গালীল ৮৯৯ নং)

[11] (সূরা আন-নিসা (৪) : ১৯)

[12] (বুখারী, মুসলিম, মিশকাতুল মাসাবীহ ৩২৩৮নং)

[13] (মুসলিম, মিশকাতুল মাসাবীহ ৩২৩৯নং)

[14] (মুসলিম, মিশকাতুল মাসাবীহ ৩২৪০নং)

[15] (হুক্বূক্বুল মারআতিল মুসলিমাহ, কওসর আল-মীনাবী ৫২ পৃঃ)

[16] (মুসনাদে আহমদ, আল মারআতুল মুসলিমাহ, ওয়াহ্বী সুলাইমান আল-আলবানী ১৫০পৃঃ)

[17] (বুখারী, নাসাঈ, আদাবুয যিফাফ ২৭৫পৃঃ)

[18] (বুখারী, মুসলিম, আস-সিলসিলাতুস সহীহাহ ৫৪৫নং)

[19] (বুখারী, তিরমিযী, আদাবুয যিফাফ ২৯০পৃঃ)

[20] (আস-সিলসিলাতুস সহীহাহ ৬৭০নং, আদাবুয যিফাফ ২৯১পৃঃ)

[21] (সূরা আল-বাক্বারাহ (২) : ২২৮)

[22] (তুহফাতুল আরূস, ১০৩-১০৪পৃঃ)

[23] (মুসলিম, মুসনাদে আহমদ, প্রভৃতি, আদাবুয যিফাফ ২৭৭পৃঃ)

[24] (বুখারী ৫০৮০নং, আস-সিলসিলাতুস সহীহাহ ৬২৩নং)

[25] (ত্বাহাবী, হাকেম, দাঃ, আদাবুয যিফাফ ২৬৯পৃঃ)

[26] (তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, আদাবুয যিফাফ ২৭০পৃঃ)

[27] (মুসলিম)

[28] (তিরমিযী, আবু দাঊদ, নাসাঈ, মিশকাতুল মাসাবীহ ৩৫২৯নং)

[29] (সূরা আত্তাহরীম (৬৬) : ৬)

[30] (নাসাঈ, দাঃ, আল মারআতুল মুসলিমাহ, ওয়াহ্বী সুলাইমান আল-আলবানী ১৫৫পৃঃ)

[31] (সূরা তাগাবুন (৬৪) : ১৪ আয়াত)

স্ত্রীর উপর স্বামীরও অনস্বীকার্য অধিকার রয়েছেঃ-

প্রথম অধিকার হল বৈধ কর্মে ও আদেশে স্বামীর আনুগত্য। স্বামী সংসারের দায়িত্বশীল ব্যক্তি। সংসার ও দাম্পত্য বিষয়ে তার আনুগত্য স্ত্রীর জন্য জরুরী। যেমন কোন স্কুল-কলেজের প্রধান শিক্ষক, অফিসের ম্যানেজার বা ডিরেক্টর প্রভৃতির আনুগত্য অন্যান্য সকলকে করতে হয়।

স্ত্রী সাধারণতঃ স্বামীর চেয়ে বয়সে ছোট হয়। মাতৃলয়ে মা-বাপের (বৈধ বিষয়ে) আদেশ যেমন মেনে চলতে ছেলে-মেয়ে বাধ্য, তেমনি শ্বশুরালয়ে স্বামীর আদেশ ও নির্দেশ মেনে চলাও স্ত্রীর প্রকৃতিগত আচরণ। তাছাড়া ধর্মেও রয়েছে স্বামীর জন্য অতিরিক্ত মর্যাদা। অতএব প্রেম, সম্প্রীতি ও শৃঙ্খলতা বজায় রাখতে বড়কে নেতা মানতেই হয়। প্রত্যেক কোম্পানী ও উদ্যোগে পার্থিব এই নিয়মই অনুসরণীয়। অতএব স্বামী-স্ত্রীর ক্ষেত্রে তা নারী-পরাধীনতা হবে কেন। তবে অন্যায় ও অবৈধ বিষয়ে অবশ্যই স্বামীর আনুগত্য অবৈধ। কারণ যাদেরকে আল্লাহ কর্তৃত্ব দিয়েছেন তাদেরকে অবৈধ ও অন্যায় কর্তৃত্ব দেননি। কেউই তার কর্তৃত্ব ও পদকে অবৈধভাবে ব্যবহার করতে পারে না। তাছাড়া কর্তা হওয়ার অর্থ কেবলমাত্র শাসন চালানোই নয়; বরং দায়িত্বশীলতার বোঝা সুষ্ঠুভাবে বহন করাও কর্তার মহান কর্তব্য।

যে নারী স্বামীর একান্ত অনুগতা ও পতিব্রতা সে নারীর বড় মর্যাদা রয়েছে ইসলামে। প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন,

إِذَا صَلَّتِ الْمَرْأَةُ خَمْسَهَا، وَصَامَتْ شَهْرَهَا، وَحَصَّنَتْ فَرْجَهَا، وَأَطَاعَتْ بَعْلَهَا، دَخَلَتْ مِنْ أَيِّ أَبْوَابِ الْجَنَّةِ شَاءَتْ.

“রমণী তার পাঁচ ওয়াক্তের নামায পড়লে, রমযানের রোযা পালন করলে, ইজ্জতের হিফাযত করলে ও স্বামীর তাবেদারী করলে জান্নাতের যে কোন দরজা দিয়ে ইচ্ছামত প্রবেশ করতে পারবে।[1]

خَيْرُ النِّساءِ الَّتِي تَسُرُّهُ إذا نَظَرَ وَتُطِيعُهُ إذا أمَرَ ولا تُخالِفُهُ في نَفْسِها ولا مالِها بِما يَكْرَهُ.

“শ্রেষ্ঠ রমণী সেই, যার প্রতি তার স্বামী দৃকপাত করলে সে তাকে খোশ করে দেয়, কোন আদেশ করলে তা পালন করে এবং তার জীবন ও সম্পদে স্বামীর অপছন্দনীয় বিরুদ্ধাচরণ করে না।”[2]

স্ত্রীর নিকট স্বামীর মর্যাদা বিরাট। এই মর্যাদার কথা ইসলাম নিজে ঘোষণা করেছে। প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন, “স্ত্রীর জন্য স্বামী তার জান্নাত অথবা জাহান্নাম।”[3]

لَوْ كُنْتُ آمِرًا أَحَدًا أَنْ يَسْجُدَ لِأَحَدٍ لَأَمَرْتُ الْمَرْأَةَ أَنْ تَسْجُدَ لِزَوْجِهَا.

“যদি আমি কাউকে কারো জন্য সিজদা করতে আদেশ করতাম, তাহলে নারীকে আদেশ করতাম, সে যেন তার স্বামীকে সিজদা করে।”[4]

مِن حَقِّ الزَّوجِ عَلَى زَوجَتِهِ إن سَالَ دَماً وَقَيحاً وَصَديداً فَلَحَسَتهُ بِلِسَانِهَا مَا أَدَّتْ حَقَّهُ.

“স্ত্রীর কাছে স্বামীর এমন অধিকার আছে যে, স্ত্রী যদি স্বামীর দেহের ঘা চেঁটেও থাকে তবুও সে তার যথার্থ হক আদায় করতে পারবে না।”[5]

…فَإِنَّ الْمَرْأَةَ لَوْ تَعْلَمُ مَا حَقُّ زَوْجِهَا ، لَمْ تَزَلْ قَائِمَةً مَا حَضَرَ غَدَاؤُهُ وَعَشَاؤُهُ.

“মহিলা যদি নিজ স্বামীর হক (যথার্থরূপে) জানতো, তাহলে তার দুপুর অথবা রাতের খাবার খেয়ে শেষ না করা পর্যন্ত সে (তার পাশে) দাঁড়িয়ে থাকতো।”[6]

…فَوَالَّذِى نَفْسِى بِيَدِهِ لاَ تُؤَدِّى الْمَرْأَةُ حَقَّ رَبِّهَا عَزَّ وَجَلَّ حَتَّى تُؤَدِّىَ حَقَّ زَوْجِهَا كُلِّهِ حَتَّى إِنْ لَوْ سَأَلَهَا نَفْسَهَا وَهِىَ عَلَى قَتَبٍ أَعْطَتْهُ أَوْ قَالَ لَمْ تَمْنَعْهُ.

“তাঁর শপথ যাঁর হাতে মুহাম্মাদের প্রাণ আছে! নারী তার প্রতিপালকের হক ততক্ষণ পর্যন্ত আদায় করতে পারে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না সে তার স্বামীর হক আদায় করেছে। সওয়ারীর পিঠে থাকলেও যদি স্বামী তার মিলন চায় তবে সে বাধা দিতে পারবে না।”[7]

اثْنَانِ لا تُجَاوِزُ صَلاتُهُمَا رُءُوسَهُمَا : عَبْدٌ آبِقٌ مِنْ مَوَالِيهِ حَتَّى يَرْجِعَ إِلَيْهِمْ ، وَامْرَأَةٌ عَصَتْ زَوْجَهَا حَتَّى تَرْجِعَ.

“দুই ব্যক্তির নামায তাদের মাথা অতিক্রম করে না (কবুল হয় না) ; সেই ক্রীতদাস যে তার প্রভুর নিকট থেকে পলায়ন করেছে, সে তার নিকট ফিরে না আসা পর্যন্ত এবং যে স্ত্রী তার স্বামীর অবাধ্যাচরণ করেছে, সে তার বাধ্য না হওয়া পর্যন্ত (নামায কবুল হয় না।)”[8]

ثَلاَثَةٌ لاَ يُقبَلُ منهُم صَلاَةٌ وَلاَ تَصعُدُ إلَى السَّمَاءِ وَلاَ تَجَاوزُ رُءُوسُهُم : رَجُلٌ أَمَّ قَوماً وَهُم لَه كَارِهُونَ ، وَرَجُلٌ صَلَّى عَلَى جَنَازَةٍ وَلَمْ يُؤمَر ، وَامرَأَةُ دَعَاهَا زَوجُهَا من اللَّيلِ فَأَبَتْ عَلَيه.

“তিন ব্যক্তির নামায কবুল হয় না, আকাশের দিকে উঠে না; মাথার উপরে যায় না; এমন ইমাম যার ইমামতি (অধিকাংশ) লোকে অপছন্দ করে, বিনা আদেশে যে কারো জানাযা পড়ায় এবং রাত্রে সঙ্গমের উদ্দেশ্যে স্বামী ডাকলে যে স্ত্রী তাতে অসম্মত হয়।[9]

إِذَا دَعَا الرَّجُلُ امْرَأَتَهُ إِلَى فِرَاشِهِ فَأَبَتْ أَنْ تَجِيءَ لَعَنَتْهَا الْمَلَائِكَةُ حَتَّى تُصْبِحَ.

“স্বামী যখন তার স্ত্রীকে নিজ বিছানার দিকে (সঙ্গম করতে) আহ্ববান করে তখন যদি স্ত্রী না আসে, অতঃপর সে তার উপর রাগান্বিত অবস্থায় রাত্রি কাটায়, তবে সকাল পর্যন্ত ফিরিশ্তাবর্গ তার উপর অভিশাপ করতে থাকেন।” অন্য এক বর্ণনায় “যতক্ষণ পর্যন্ত না স্বামী তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে, ততক্ষণ পর্যন্ত ফিরিশ্তা তার উপর অভিশাপ করতে থাকেন।”[10]

স্বামীর আনুগত্য স্ত্রীর জন্য আল্লাহ ও তদীয় রসূলের আনুগত্য। সুতরাং স্বামীকে সন্তুষ্ট করলে আল্লাহ সন্তুষ্ট হন। বলাই বাহুল্য যে, অধিকাংশ তালাক ও দ্বিতীয় বিবাহের কারণ হল স্বামীর আহ্বানে স্ত্রীর যথাসময়ে সাড়া না দেওয়া। উক্ত অধিকার পালনেই স্বামী-স্ত্রীর বন্ধন মজবুত ও মধুর হয়ে গড়ে উঠে, নচেৎ না।

২. স্বামীর মান-মর্যাদা ও চাহিদার খেয়াল রাখা স্ত্রীর জন্য জরুরী। স্বামী বাইরে থেকে এসে যেন অপ্রীতিকর কিছু দেখতে, শুনতে, শুঁকতে বা অনুভব করতে না পারে। পুরুষ বাইরে কর্মব্যস্ততায় জ্বলে-পুড়ে বাড়িতে এসে যদি স্ত্রীর স্মিতমুখ ও দেহ-সংসারের পারিপাট্য না পেল, তাহলে তার আর সুখ কোথায়? সংসারে তার মত দুর্ভাগা ব্যক্তি আর কেউ নেই, যাকে বাইরে মেহনতে জ্বলে এসে বাড়িতে স্ত্রীর তাপেও জ্বলতে হয়।

সে নারী কত আদর্শ পতিভক্ত, যে তার স্বামীকে মিলন দিয়ে খুশী ও সন্তুষ্ট করার জন্য কারো মৃত্যুতেও শোক প্রকাশ করে না। অতি ধৈর্য ও সহনশীলতার সাথে এমনটি করা অনুপম পতিভক্তির পরিচয়। পরন্তু এরূপ করার পশ্চাতে প্রভূত কল্যাণের আশা করা যায়। যেমন ঘটেছিল উম্মে সুলাইম রুমাইসা (বিবি রমিসা) ও তাঁর স্বামী আবু তালহা রাযিয়াল্লাহু আনহু এর সাংসারিক জীবনে। তাঁদের একমাত্র সন্তান ব্যাধিগ্রস্ত ছিল। আবু তালহা প্রায় সময় নবী (সাঃ) এর নিকট কাটাতেন। এক দিন সন্ধ্যায় তিনি তাঁর নিকট গেলেন। এদিকে বাড়িতে তাঁর ছেলে মারা গেল। উম্মে সুলাইম সকলকে নিষেধ করলেন, যাতে আবু তালহার নিকট খবর না যায়। তিনি ছেলেটিকে ঘরের এক কোণে ঢেকে রেখে দিলেন। অতঃপর স্বামী আবু তালহা রসূল (সাঃ) এর নিকট থেকে বাড়ি ফিরলে বললেন, ‘আমার বেটা কেমন আছে?’ রুমাইসা বললেন, ‘যখন থেকে ও পীড়িত তখন থেকে যে কষ্ট পাচ্ছিল তার চেয়ে এখন খুব শান্ত। আর আশা করি সে আরাম লাভ করেছে!’

অতঃপর পতিপ্রাণা স্ত্রী স্বামী এবং তাঁর সাথে আসা আরো অন্যান্য মেহমানদের জন্য রাত্রের খাবার পেশ করলেন। সকলে খেয়ে উঠে গেল। আবু তালহা উঠে নিজের বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লেন। (স্ত্রীর কথায় ভাবলেন, ছেলে আরাম পেয়ে ঘুমাচ্ছে।) ওদিকে পতিব্রতা রুমাইসা সব কাজ সেরে উত্তমরূপে সাজ-সজ্জা করলেন, সুগন্ধি মাখলেন। অতঃপর স্বামীর বিছানায় এলেন। স্বামী স্ত্রীর নিকট থেকে সৌন্দর্য, সৌরভ এবং নির্জনতা পেলে উভয়ের মধ্যে যা ঘটে তা তাদের স্বামী-স্ত্রীর মাঝে (মিলন) ঘটল। তারপর রাত্রির শেষ দিকে রুমাইসা স্বামীকে বললেন, ‘হে আবু তালহা! যদি কেউ কাউকে কোন জিনিস ধার স্বরূপ ব্যবহার করতে দেয়, অতঃপর সেই জিনিসের মালিক যদি তা ফেরৎ নেয় তবে ব্যবহারকারীর কি বাধা দেওয়া বা কিছু বলার থাকতে পারে?’ আবু তালহা বললেন, ‘অবশ্যই না।’ স্ত্রী বললেন, ‘তাহলে শুনুন, আল্লাহ আয্‌যা অজাল্ল আপনাকে যে ছেলে ধার দিয়েছিলেন তা ফেরৎ নিয়েছেন। অতএব আপনি ধৈর্য ধরে নেকীর আশা করুন!’

এ কথায় স্বামী রেগে উঠলেন; বললেন, ‘এতক্ষণ পর্যন্ত কিছু না বলে চুপ থেকে, এত কিছু হওয়ার পর তুমি আমাকে আমার ছেলে মরার খবর দিচ্ছ?!’ অতঃপর তিনি ‘ইন্না লিল্লাহি—-’ পড়লেন ও আল্লাহর প্রশংসা করলেন। তারপর আল্লাহর রসূল (সাঃ) এর নিকট ঘটনা খুলে বললে তিনি তাঁকে বললেন, “তোমাদের উভয়ের ঐ গত রাত্রে আল্লাহ বর্কত দান করুন।” সুতরাং ঐ রাত্রেই রুমাইসা তাঁর গর্ভে আবার একটি সন্তান ধারণ করেন।[11]

৩. স্বামীর দ্বীন ও ইজ্জতের খেয়াল করা ওয়াজেব। বেপর্দা, টোঁ-টোঁ কোম্পানী হয়ে, পাড়াকুঁদুলী হয়ে, দরজা, জানালা বা ছাদ হতে উঁকি ঝুঁকি মেরে, স্বামীর অবর্তমানে কোন বেগানার সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করে অথবা কোথাও গেয়ে-এসে নিজের তথা স্বামীর বদনাম করা এবং আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করা মোটেই বৈধ নয়। স্বামী-গৃহে হিফাযতের সাথে থেকে তার মন মতো চলা এক আমানত। এই আমানতের খেয়ানত স্বামীর অবর্তমানে করলে নিশ্চয়ই সে সাধ্বী নারী নয়।

মহান আল্লাহ বলেন,

﴿فَالصَّالِحَاتُ قَانِتَاتٌ حَافِظَاتٌ لِلْغَيْبِ بِمَا حَفِظَ اللهُ﴾

“সুতরাং সাধ্বী নারীরা অনুগতা এবং পুরুষের অনুপস্থিতিতে লোকচক্ষুর অন্তরালে নিজেদের ইজ্জত রক্ষাকারিণী। আল্লাহর হিফাযতে তারা তা হিফাযত করে।”[12]

স্বামীর নিকট স্বামীর ভয়ে বা তাকে প্রদর্শন করে পর্দাবিবি বা হিফাযতকারিণী সেজে তার অবর্তমানে গোপনে আল্লাহকে ভয় না ক’রে কুটুমবাড়ি, বিয়েবাড়ি প্রভৃতি গিয়ে অথবা শ্বশুরবাড়িতে পর্দানশীন সেজে এবং বাপের বাড়িতে বেপর্দা হয়ে নিজের মন ও খেয়াল-খুশীর তাবেদারী ক’রে থাকলে সে নারী নিশ্চয় বড় ধোঁকাবাজ। প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন,

ثَلَاثَةٌ لَا تَسْأَلْ عَنْهُمْ رَجُلٌ فَارَقَ الْجَمَاعَةَ وَعَصَى إِمَامَهُ وَمَاتَ عَاصِيًا وَأَمَةٌ أَوْ عَبْدٌ أَبَقَ فَمَاتَ وَامْرَأَةٌ غَابَ عَنْهَا زَوْجُهَا قَدْ كَفَاهَا مُؤْنَةَ الدُّنْيَا فَتَبَرَّجَتْ بَعْدَهُ فَلَا تَسْأَلْ عَنْهُمْ.

“তিন ব্যক্তি সম্পর্কে কোন প্রশ্নই করো না; যে জামাআত ত্যাগ করে ইমামের অবাধ্য হয়ে মারা যায়, যে ক্রীতদাস বা দাসী প্রভু থেকে পলায়ন করে মারা যায়, এবং সেই নারী যার স্বামী অনুপস্থিত থাকলে– তার সাংসারিক সমস্ত প্রয়োজনীয় জিনিস বন্দোবস্ত করে দেওয়া সত্ত্বেও– তার অনুপস্থিতিতে বেপর্দায় বাইরে যায়।”[13]

শ্রেষ্ঠা রমণী তো সেই যে কোন পরপুরুষকে নিজের মুখ দেখায় না এবং বেগানার মুখ নিজেও দেখে না। স্বামী বাড়িতে না থাকলে গান-বাজনা শুনে নয়; বরং কুরআন ও দ্বীনী বই-পুস্তক পড়ে নিজের মনকে ফ্রী করে। কারণ গান শুনে মন আরো খারাপ হয়। স্বামীকে কাছে পেতে ইচ্ছা হয়। যৌন ক্ষুধা বেড়ে উঠে। তাইতো সলফগণ বলেন, ‘গান হল ব্যভিচারের মন্ত্র।’[14] পক্ষান্তরে-

﴿الَّذِينَ آمَنُوا وَتَطْمَئِنُّ قُلُوبُهُمْ بِذِكْرِ اللهِ﴾

“আল্লাহর যিকরেই মুমিনদের চিত্ত প্রশান্ত হয়।”[15]

৪. স্বামীর বৈয়াক্তিক ও সামাজিক জীবনের প্রতিও বিশেষ খেয়াল রাখা স্ত্রীর কর্তব্য। সুতরাং তার ব্যক্তিগত কাজ-কারবার, পড়াশুনা প্রভৃতিতে ডিস্টার্ব করা বা বাধা দেওয়া হিতাকাঙ্ক্ষিনী স্ত্রীর অভ্যাস হতে পারে না। স্বামীর নিকট এমন বিষয়, বস্তু বা বিলাস-সামগ্রী স্ত্রী চাইবে না, যার ফলে সে বাধ্য হয়ে অবৈধ অর্থোপার্জনের পথ অবলম্বন করে ফেলে। হারাম উপার্জন ও অসৎ ব্যবসায় মোটেই তার সহায়তা করবে না। সাধ্বী স্ত্রী তো সেই; যে তার স্বামীকে ব্যবসায় বের হলে এই বলে সলফের স্ত্রীর মত অসিয়ত করে, “আল্লাহকে ভয় করবেন, হারাম উপার্জন থেকে দূরে থাকবেন। কারণ, আমরা না খেয়ে ক্ষুধায় ধৈর্য ধরতে পারব; কিন্তু জাহান্নামে ধৈর্য ধরতে পারব না!”[16]

“–পতি যদি হয় অন্ধ হে সতী বেঁধোনা নয়নে আবরণ,

অন্ধ পতিরে আঁখি দেয় যেন তোমার সত্য আচরণ।”

৫. স্বামীর ঘর সংসার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং সাজিয়ে গুছিয়ে পরিপাটি করে রাখা স্ত্রীর কর্তব্য। স্বামীর যাবতীয় খিদমত করা, ছেলে-মেয়েদেরকে পরিষ্কার ও সভ্য করে রাখাও তার দায়িত্ব। সর্বকাজ নিজের হাতে করাই উত্তম। এতে তার স্বাস্থ্য ভালো এবং দেহে স্ফূর্তি থাকবে। একান্ত চাপ ও প্রয়োজন না হলে দাসী ব্যবহার আলসে মেয়ের কাজ। সাহাবী মহিলাগণ স্বহস্তে ক্ষেতেরও কাজ করতেন। একদা হযরত ফাতেমা রাযিয়াল্লাহু আনহা কাজের চাপের এবং নিজের মেহনত ও কষ্টের কথা আব্বার নিকট উল্লেখ ক’রে কোন খাদেম চাইলে প্রিয় নবী (সাঃ) তাঁকে স্বহস্তে কর্ম সম্পাদন করতে নির্দেশ দিলেন এবং অলসতা কাটিয়ে উঠার ঔষধও বলে দিলেন; বললেন, “যখন তোমরা শয়ন করবে তখন ৩৪ বার ‘আল্লা-হু আকবার’ ৩৩ বার ‘সুবহা-নাল্লা-হ’ এবং ৩৩ বার ‘আলহামদু লিল্লা-হ’ পড়বে। এটা তোমাদের জন্য খাদেম থেকেও উত্তম হবে!”[17]

তাই তো একজন বাদশাহর কন্যা হয়েও তিনি স্বহস্তে চাকি ঘুরিয়ে আটা পিষতেন। তাঁর হাতে ফোস্কা পড়ে যেত, তবুও আব্বার কথামত কোন দাস-দাসী ব্যবহার না করেই সংসার করেছেন।

“আত্মাহারা না হইয়া সৌভাগ্য সোহাগে

পরন্তু যে করে কাম স্বকরে যতনে,

পরিজন প্রীতি হেতু প্রেম অনুরাগে

আদর্শ রমণী সেই যথার্থ ভূবনে।”

পক্ষান্তরে দাস-দাসী ব্যবহারে বিপত্তি আছে। এদের মাধ্যমে ঘরের রহস্য বাইরে যায়, বাড়ির কোন সদস্যের সাথে অবৈধ প্রণয় গড়ে উঠতে পারে। তাদের ব্যবহার, চরিত্র, বিশ্বাস প্রভৃতি শিশুদের মনে প্রভাব বিস্তার করে ইত্যাদি। বিলাসের আতিশয্যে নিজের স্বামী ও সন্তানের সেবাযত্ন ত্যাগ করে সব কিছু দাস-দাসীর উপর নির্ভর করলে সংসারে ইচ্ছাসুখ মিলে না।

“বিলাসিনী যে রমণী গৃহস্থালি কার্য

সম্পাদন আপন ভাবিয়া না করে,

হউক তাহার পতি রাজ-অধিরাজ

অধমা সে নারী এ সংসার ভিতরে।”

৬. স্বামী তার স্ত্রীকে মন-প্রাণ দিয়ে ভালোবেসে থাকে। যথাসাধ্য উত্তম আহার-বসনের ব্যবস্থা করে থাকে। তবুও ত্রুটি স্বাভাবিক। কিন্তু সামান্য ত্রুটি দেখে সমস্ত উপকার, উপহার ও প্রীতি-ভালোবাসাকে ভুলে যাওয়া নারীর সহজাত প্রকৃতি। কিছু শিক্ষা বা শাসনের কথা বললে মনে করে, স্বামী তাকে কোনদিন ভালোবাসে না। স্বামীর অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তার মনে নিদারুণ ব্যথা দিয়ে থাকে। এটি এমন একটি কর্ম যার জন্যও মেয়েরা পুরুষদের চেয়ে অধিক সংখ্যায় জাহান্নামবাসিনী হবে।[18]

প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন,

لاَ يَنْظُرُ اللَّهُ إِلَى امْرَأَةٍ لاَ تَشْكُرُ لِزَوْجِهَا وَهِىَ لاَ تَسْتَغْنِى عَنْهُ.

“আল্লাহ সেই রমণীর দিকে তাকিয়েও দেখেন না (দেখবেন না) যে তার স্বামীর কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে না, অথচ সে স্বামীর মুখাপেক্ষিনী।[19]

আসলেই ‘মেয়ে লোকের এমনি স্বভাব, হাজার দিলেও যায় না অভাব।’ সে দেখে না যে, তার স্বামী তার জন্য কত কি করছে। সে শুধু তাই দেখে, যা তার জন্য করা হয় না।

৭. স্ত্রী হয় সংসারের রানী। স্বামীর ধন-সম্পদ সর্বসংসার হয় তার রাজত্ব এবং স্বামীর আমানতও। তাই তার যথার্থ হিফাযত করা এবং যথাস্থানে সঠিকভাবে তা ব্যয় করা স্ত্রীর কর্তব্য। অন্যায়ভাবে গোপনে ব্যয় করা, তার বিনা অনুমতিতে দান করা বা আত্মীয়-স্বজনকে উপঢৌকন দেওয়া আমানতের খেয়ানত। এমন স্ত্রী পুণ্যময়ী নয়; বরং খেয়ানত-কারিণী। অবশ্য স্বামী ব্যয়কুণ্ঠ কৃপণ হলে এবং স্ত্রী ও সন্তানের জন্য যথার্থ খরচাদি না দিলে, স্ত্রী গোপনে শুধু ততটুকুই নিতে পারবে যতটুকু নিলে তার ও তার সন্তানের প্রয়োজন মিটানোর জন্য যথেষ্ট হবে। এর বেশী নিলে অবৈধ মাল নেওয়া হবে।[20]

অবশ্য স্বামী দানশীল হলে এবং দানের জন্য সাধারণ অনুমতি থাকলে স্ত্রী যদি তার অনুপস্থিতিতে দান করে, তাহলে উভয়েই সমান সওয়াবের অধিকারী হবে।[21]

৮. স্বামীর বিনা অনুমতিতে বাইরে, মার্কেট, বিয়েবাড়ি, মড়াবাড়ি ইত্যাদি না যাওয়া পতিভক্তির পরিচয়। এমনকি মসজিদে (ইমামের পশ্চাতে মহিলা জামাআতে) নামায পড়তে গেলেও স্বামীর অনুমতি চাই।[22] এই পরাধীনতায় আছে মুক্তির পরম স্বাদ। মাতৃক্রোড় উপেক্ষা করে ঝড়-বৃষ্টি, শীত-গ্রীষ্মে যেমন শিশু নিজেকে বিপদে ফেলে, তা-এর কোল ছেড়ে ডিম যেমন ঘোলা হয়ে যায়, ঠিক তেমনি নারীও স্বামীর এই স্নেহ-সীমাকে উল্লংঘন করে নিজের দ্বীন ও দুনিয়া নষ্ট করে।

রুচিতে যা রুচে তাই যদি খাওয়া পরা, বলা, চলা হয় এবং রুচিতে যা বাধে তাই যদি না খাওয়া, না পরা, না বলা, না চলা হয়, তাহলে নৈতিকতাই বা কি? মানবিকতাই বা কি? তাও মানুষের রুচির ব্যাপার নয় কি? তাহলে থাকল আর কি? বন্ধন, শৃঙ্খল ও সীমাবদ্ধতা ছাড়া কি কোন নৈতিকতা, কোন শান্তি ও সুখ আছে?

পক্ষান্তরে ইসলামী নৈতিকতা ও গন্ডী-সীমার ভিতরে থেকেও নারী কর্ম, চাকুরী ও উপার্জন করতে পারে। যেখানে দ্বীনের কোন বাধা নেই, নারীত্ব ও সতীত্বের কোন আঁচড় নেই, সেখানে স্বামীরও কোন বাধা থাকতে পারে না। মহিলা কেবল মহিলা কর্মক্ষেত্রে, শিশু ও মহিলা শিক্ষাঙ্গনে অফিস বা শিক্ষকতার কাজ, বাড়িতে বসে শিশু ও মহিলা পোষাকের দর্জিকাজ অথবা কোন হাতের শিল্পকাজ বা ম্যাকানিকেল কাজ দিব্যি করতে পারে; যাতে পরপুরুষের সাথে কোন সংস্রবই নেই। অন্যথা পর পুরুষের পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে অবাধভাবে মিলেমিশে কর্ম করা নারী স্বাধীনতা নয়, বরং নারীর হীনতা এবং স্বামীর দ্বীনতা।[23]

অবশ্য যারা স্বামীর পরম সুখ ও ভালোবাসা পেয়ে ধন্য হয়েছে তারা কোন দিন ঐ সকল চাকুরী মরীচিকার পশ্চাতে ছুটে না। যেখানে জলভ্রম প্রদর্শন করে নারীকে পুরুষদের কর্মক্ষেত্রে আকর্ষণ করে এনে তারা নারীকেই জলখাবার বানিয়ে থাকে। ঘরের ও বাইরের উভয় কাজ উভয়কেই করতে হলে সুখ কোথায়? এই অবস্থায় সন্তান-সন্ততির লালন পালন ও তরবিয়ত কোত্থেকে কেমন করে হবে?

বলাই বাহুল্য যে, ধর্ম ও নৈতিকতাকে কবর দিয়ে উচ্চ শিক্ষিতা হয়ে, প্রতিষ্ঠিতা হয়ে, চাকুরী করে মোটা টাকা উপার্জন করে, স্বামীর তোয়াক্কা না করে, পার্থিব সুখ লুটা ভোগবাদী, বস্তুবাদী এবং পরকালে অবিশ্বাসিনীদের লক্ষ্য। পক্ষান্তরে ধর্ম ও নীতি-নৈতিকতা বজায় রেখে পার্থিব বিষয়াদি পরকালে বিশ্বাসিনী মুসলিম নারীর উপলক্ষ্য মাত্র। মুসলমানের মূল লক্ষ্য হল পরকাল। মুসলিম দু’দিনের সুখস্বপ্নে সন্তুষ্ট নয়। সে চায় চিরস্থায়ী উপভোগ্য অনন্ত সুখ।

এ জন্যই প্রিয় নবী (সাঃ) দুআ করতেন,

(وَلاَ تَجْعَل الدُّنْيَا أَكْبَرَ هَمِّنَا وَلاَ مَبْلَغَ عِلْمِنَا)

অর্থাৎ, দুনিয়াকে আমাদের বৃহত্তম চিন্তার বিষয় এবং আমাদের জ্ঞানের শেষ সীমা (মূল লক্ষ্য) করে দিও না।[24]

৯. স্বামীর অনুমতি না হলে তার উপস্থিতিতে স্ত্রী নফল রোযা রাখতে পারে না। যেহেতু তার সাংসারিক কর্মে বা যৌন-সুখে বাধা পড়লে আল্লাহ সে রোযায় রাযী নন।[25]

১০. কোন বিষয়ে স্বামী রাগান্বিত হলে স্ত্রী বিনীতা হয়ে নীরব থাকবে। নচেৎ ইঁটের বদলে পাটকেল ছুঁড়লে আগুনে পেট্রল পড়বে। যে সোহাগ করে, তার শাসন করার অধিকার আছে। আর এ শাসন স্ত্রী ঘাড় পেতে মেনে নিতে বাধ্য হবে। ভুল হলে ক্ষমা চাইবে। যেহেতু স্বামী বয়সে ও মর্যাদায় বড়। ক্ষমা প্রার্থনায় অপমান নয়; বরং মানুষের মান বর্ধমান হয়; ইহকালে এবং পরকালেও। তাছাড়া অহংকার ও ঔদ্ধত্যের সাথে ‘বেশ করেছি, অত পারি না’ ইত্যাদি বলে অনমনীয়তা প্রকাশ সতী নারীর ধর্ম নয়। সুতরাং স্বামীর রাগের আগুনকে অহংকার ও ঔদ্ধত্যের পেট্রল দ্বারা নয় বরং বিনয়ের পানি দ্বারা নির্বাপিত করা উচিৎ।

প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন,

وَنسَاؤُكُم من أَهْل الجَنَّة الوَدُود العَؤودُ عَلَى زَوجهَا الَّتي إذَا غَضِبَ جَاءت حَتَّى تَضَعَ يَدَهَا في يَده ثُمَّ تَقُولُ : لاَ أَذُوقُ غَمضاً حَتى تَرضَى.

“তোমাদের স্ত্রীরাও জান্নাতী হবে; যে স্ত্রী অধিক প্রণয়িণী, সন্তানদাত্রী, বার-বার ভুল করে বার-বার স্বামীর নিকট আত্মসমর্পণকারিণী, যার স্বামী রাগ করলে সে তার নিকট এসে তার হাতে হাত রেখে বলে, আপনি রাজি (ঠান্ডা) না হওয়া পর্যন্ত আমি ঘুমাবই না।”[26]

নারী হয়ে একজন পুরুষের মন জয় করতে না পারা বড় আশ্চর্যের ব্যাপার! “তুফানে হাল ধরতে নারে সেইবা কেমন নেয়ে, আর মরদের মন যোগাতে নারে সেই বা কেমন মেয়ে?!”

খেয়াল রাখার বিষয় যে, স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বিচ্ছেদ ঘটাতে শয়তান বড় তৎপর। সমুদ্রের উপর নিজ সিংহাসন পেতে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে তার ‘স্পেশাল ফোর্স’ পাঠিয়ে দেয়। সবচেয়ে যে বড় ফিৎনা সৃষ্টি করতে পারে সেই হয় তার অধিক নৈকট্যপ্রাপ্ত। কে কি করেছে তার হিসাব নেয় ইবলীস। প্রত্যেকে এসে বলে, ‘আমি অমুক করেছি, আমি অমুক করেছি। (চুরি, ব্যভিচার, হত্যা প্রভৃতি সংঘটন করেছি)। কিন্তু ইবলীস বলে, ‘কিছুই করনি তুমি!’ অতঃপর যখন একজন বলে ‘আমি স্বামী-স্ত্রীর মাঝে রাগারাগি সৃষ্টি করে উভয়ের মাঝে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে ছেড়েছি’ তখন শয়তান উঠে এসে তাকে আলিঙ্গন করে বলে, ‘হ্যাঁ, তুমিই কাজের ব্যাটা কাজ করেছ![27] সুতরাং রাগের সময় শয়তানকে সহায়তা ও খোশ করা অবশ্যই কোন মুসলিম দম্পতির কাজ নয়।

১১. পতিপ্রাণা নারীর সদা চিন্তা স্বামীর মনোসুখ, তার পরম আনন্দ ও খুশী। যেহেতু তার আনন্দেই স্ত্রীর পরমানন্দ। স্বামীর আনন্দ না হলে নিজের আনন্দ কল্পনাই করতে পারে না স্ত্রী। বাইরে থেকে রোদে-গরমে এলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার সামনে পানি পেশ করা, হাওয়া করে দেওয়া ইত্যাদি সতীর ধর্ম। তাছাড়া স্বামী সালাম দিয়ে যখন বাড়ি প্রবেশ করে, তখন উত্তর দিয়ে হাসিমাখা ওষ্ঠাধরের স্পর্শ উপহার যদি উভয়ে বিনিময় করে, তবে এর মত দাম্পত্য সুখ আর আছে কোথায়?

“সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে

রমণী সুন্দর হয় সতীত্ব রক্ষণে।”

এমনিতেই স্ত্রী স্বামীর জন্য হয়ে থাকবে ফুটন্ত গোলাপ। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায়, অঙ্গসজ্জা এবং বেশভূষায় স্বামীর চক্ষুশীতল করবে। সৌন্দর্য ও সৌরভে ভরা গোলাপের দিকে একবার তাকিয়ে যেমন মন-প্রাণ আকৃষ্যমাণ হয়, ঠিক তেমনি হবে স্বামীর মন তার স্ত্রীকে দেখে। স্বামী-স্ত্রীর এ পরম সুখ থাকলে, কোন নারী সংগঠন বা নারী-স্বাধীনতা ও নারী-মুক্তির আন্দোলনের প্রয়োজনই নেই।

নারী-পুরুষের মধুর সহাবস্থান ও মধুর মিলনে পরম সুখ, এই শান্তিই পরম শান্তি। কিন্তু এমন স্বর্গীয় সংসার আছে কয়টা?

“কোথায় গেলে তারে পাই?

যার লাগি এ বিশাল বিশ্বে নাই মোর কোন শান্তি নাই।”

বলাই বাহুল্য যে, যে স্বামী তার স্ত্রীর প্রগাঢ় ভালোবাসা পায়, বিপদে সান্ত্বনা, কষ্টে সেবাযত্ন, যৌবনে পরম মিলন পায়, রাগ-অনুরাগ বা অভিমান করলে যাকে তার স্ত্রী মানিয়ে নেয় এমন স্বামীর মত সৌভাগ্যবান স্বামী আর কে হতে পারে? পিতা-মাতার দুআ ও স্ত্রীর প্রেমেই তো রয়েছে স্বামীর প্রকৃত পৌরুষ। এমন নারী না হলে পুরুষের জীবন বৃথা।

“প্রেমের প্রতিমা স্নেহের সাগর

করুণা-নির্ঝর দয়ার নদী,

হত মরুময় সব চরাচর

জগতে নারী না থাকিত যদি।”

স্বামীকে সন্তুষ্ট ও রাজী করবার জন্য ইসলাম এক প্রকার মিথ্যা বলাকেও স্ত্রীর জন্য বৈধ করেছে। স্ত্রীর মনে যতটুকু পরিমাণ স্বামীর ভালোবাসা বর্তমান, স্বামীকে অধিক খুশী করার জন্য তার দ্বিগুণ ভালোবাসা মুখে প্রকাশ করা, বরং স্বামীর কোন কুস্বভাবের কারণে ভালোবাসায় আবিলতা এলেও তা গোপন করে স্বামীকে যদি তার প্রাণঢালা ভালোবাসার কথা মিথ্যা ক’রে ব’লে জানায় তাহলে তা দোষের নয়। তবে তার কর্ম যেন এ কথার অসত্যতা প্রমাণ না করে।

খুব কমসংখ্যক পরিবারই এমন আছে যাদের দাম্পত্য অনাবিল প্রেমের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। নচেৎ অধিকাংশ সংসারই তাসের ঘর। প্রায় সব সংসারের গাড়িই চলে টানে, নচেৎ ঠেলায়। বেশীর ভাগ দাম্পত্যই সন্তান, ইসলাম অথবা সামাজিক, নৈতিক নতুবা কোন অন্য চাপের ফলে টিঁকে থাকতে বাধ্য হয়। সুতরাং এ ক্ষেত্রে যদি স্বামী-স্ত্রী উভয়ে উভয়কে মোটেই ভালো না বাসলেও যদি ‘খুব ভালোবাসি’ বলে এক অপরকে রাজী করে সংসার টিকিয়ে রাখতে চায়, তবে তা মিথ্যা নয়।[28]

তবে হ্যাঁ, এ মিথ্যা যেন অন্য উদ্দেশ্যে, ধোঁকা প্রদান বা অধিকার নষ্ট করার উদ্দেশ্যে স্বামীকে বলা না হয়। নচেৎ সে মিথ্যা প্রমাণিত হলে সামান্য প্রেমেরও শীশমহলটুকু ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে।

১২. স্বামীর সংসারে তার পিতামাতা ও বোনদের সাথে সদ্ব্যবহার করা স্ত্রীর অন্যতম কর্তব্য। স্বামীর মা-বাপ ও বোনকে নিজের মা-বাপ ও বোন ধারণা করে সংসারের প্রত্যেক কাজ তাদের পরামর্শ নিয়ে করা, যথাসাধ্য তাদের খিদমত করা এবং তাদের (বৈধ) আদেশ-নিষেধ মেনে চলা পুণ্যময়ী সাধ্বী নারীর কর্তব্য।

১৩. নিজের এবং অনুরূপ স্বামীর সন্তান-সন্ততির লালন-পালন, তরবিয়ত ও শিক্ষা দেওয়া স্ত্রীর শিরোধার্য কর্তব্য। এর জন্য তাকে ধৈর্য, স্থৈর্য, করুণা ও স্নেহের পথ অবলম্বন করা একান্ত উচিৎ। বিশেষ করে স্বামীর সামনে সন্তানের উপর রাগ না ঝাড়া, গালিমন্দ, বদ্দুআ ও মারধর না করা স্ত্রীর আদবের পরিচয়। তাছাড়া বদ্দুআ করা হারাম। আর তা কবুল হলে নিজের ছেলেরই ক্ষতি।[29]

স্ত্রীর উচিৎ, সন্তান-সন্ততিকে পবিত্রতা, পরিচ্ছন্নতা, সচ্চরিত্রতা, বীরত্ব, সংযমশীলতা, বিষয়-বিতৃষ্ণা, দ্বীন-প্রেম, ন্যায়-নিষ্ঠা, আল্লাহ-ভীরুতা, প্রভৃতি মহৎগুণের উপর প্রতিপালিত ও প্রতিষ্ঠিত করা। কারণ,

মায়ের হাতেই গড়বে মানুষ মা যদি সে সত্য হয়,

মা-ই তো এ জাহানে প্রকৃত বিশ্ববিদ্যালয়।

এই মা-ই তো পরমা, সত্তমা। এই মায়ের পদতলেই জান্নাতের আশা করা যায়। এই মা তার সন্তানকে এমন মানুষ করে তুলবে; যাতে তারা বাঁচবে ইসলাম নিয়ে ও ইসলামের জন্য এবং মরবে তো তারই পথে। যাদের মাধ্যমে সমাজে সাধিত হবে প্রভূত কল্যাণ। এরা হবে তারাই, যাদেরকে নিয়ে রসূল (সাঃ) কিয়ামতে গর্ব করবেন।

ফুটনোট

[1] (ত্বাবারানী, ইবনে হিববান, সহীহ, মুসনাদে আহমদ, প্রভৃতি, মিশকাতুল মাসাবীহ ৩২৫৪নং)

[2] (আস-সিলসিলাতুস সহীহাহ ১৮৩৮নং)

[3] (ইবনে আবী শাইবাহ, নাসাঈ, তাবারানী, হাকেম, প্রভৃতি, আদাবুয যিফাফ ২৮৫পৃঃ)

[4] (তিরমিযী, মিশকাতুল মাসাবীহ ৩২৫৫নং)

[5] (হাকেম, ইবনে হিববান, ইবনে আবী শাইবাহ, সহীহুল জামে ৩১৪৮ নং)

[6] (ত্বাবারানী, সহীহ আল-জা-মিউস সাগীর অযিয়াদাতুহ ৫২৫৯নং)

[7] (ইবনে মাজাহ, মুসনাদে আহমদ, ইবনে হিববান, আদাবুয যিফাফ ২৮৪পৃঃ)

[8] (ত্বাবারানী, হাকেম, আস-সিলসিলাতুস সহীহাহ ২৮৮নং)

[9] (আস-সিলসিলাতুস সহীহাহ ৬৫০নং)

[10] (বুখারী, মুসলিম, আবু দাঊদ, মুসনাদে আহমদ, প্রভৃতি, আদাবুয যিফাফ ২৮৩পৃঃ)

[11] (ত্বায়ালিসী ২০৫৬, বাইহাকী ৪/৬৫-৬৬, ইবনে হিববান ৭২৫নং, মুসনাদে আহমদ ৩/১০৫-১০৬ প্রভৃতি। দেখুন, আহকামুল জানায়েয ২৪-২৬ পৃঃ)

[12] (সূরা আন-নিসা (৪) : ৩৪)

[13] (আস-সিলসিলাতুস সহীহাহ ৫৪২নং)

[14] (তামবীহাতুল মু’মিনাত ১৬২পৃঃ)

[15] (সূরা আর র‘দ (১৩) : ২৮)

[16] (আল মারআতুল মুসলিমাহ, ওয়াহ্বী সুলাইমান আল-আলবানী ১৬৯পৃঃ, সিফাতুল মু’মিনাতিস সা-দিক্বাহ, নাওয়াল বিন্ত্ আব্দুল্লাহ ৫০-৫১পৃঃ)

[17] (মুসলিম ২৭২৭নং)

[18] (বুখারী, মুসলিম, মিশকাতুল মাসাবীহ ১৯ নং)

[19] (নাসাঈ, আস-সিলসিলাতুস সহীহাহ ২৮৯নং)

[20] (ইরওয়াউল গালীল ২৬৪৬নং,ফাতাওয়াল মারআহ ৯২পৃঃ)

[21] (বুখারী, মুসলিম, আবু দাঊদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, প্রভৃতি, সহীহ আত্তারগীব অত্তারহীব, আল্লামা আলবানী ৯২৬-৯৩০নং)

[22] (জামিউ আহকামিন নিসা, ১/২৭৫-২৭৬)

[23] (ফাতাওয়াল মারআহ ১০৩পৃঃ, তামবীহাতুল মু’মিনাত ১৩১-১৩৩পৃঃ)

[24] (তিরমিযী ৩৪৯৭নং)

[25] (বুখারী, মুসলিম, সহীহ আত্তারগীব অত্তারহীব ৯২৭নং)

[26] (আস-সিলসিলাতুস সহীহাহ ২৮৭ নং)

[27] (মুসলিম ২৮১৩নং)

[28] (ফিকহুস সুন্নাহ ২/১৮৫)

[29] (আবু দাঊদ, আল মারআতুল মুসলিমাহ ১৭৬পৃঃ)

স্বামী-স্ত্রীর যৌথ অধিকারঃ-

১. ব্যবহারিক অধিকারঃ

পরস্পর পরস্পরকে ক্ষমার নজরে দেখবে। ভুল হওয়া মানুষের সহজাত প্রকৃতি। মানুষ যে কাজ করে সে কাজেই নিজেকে অনেক সময় ভ্রান্ত রূপে পায়। কিন্তু তখন নিজেকে তো শাস্তি দেওয়া যায় না। বড়জোর আক্ষেপ করা যায়। সুতরাং স্বামী-স্ত্রী যদি উভয়ের দুই মন এবং দুই অর্ধাঙ্গ মিলে এক দেহের মত নিজেদেরকে মনে করতে পারে তবেই ‘যত ভুল হবে ফুল ভালোবাসাতে।’

অনুরূপ একে অপরকে খুশী করবে, আল্লাহর আনুগত্যের উপদেশ দেবে, সংসারের যৌথ দায়িত্ব পালন করবে, কেউ কাউকে কারো সামনে লজ্জিত করবে না, কারো রহস্য ও গুপ্ত ত্রুটি প্রকাশ করবে না। কেউ কারো গুপ্ত দোষের কথা নিজের আত্মীয়দের নিকট ফাঁস করবে না।

২. বৈষয়িক অধিকারঃ-

এতে স্বামীর পিতা স্ত্রীর জন্য এবং স্ত্রীর মাতা স্বামীর জন্য আপন পিতা-মাতার ন্যায় হয়ে যায়। এর ফলে আপোসে বিবাহ হারাম হয়। স্বামী-স্ত্রী একে অপরের ওয়ারেস হয়।

সর্বশেষ ও প্রধান অধিকার হল উভয়ের ইচ্ছা ও খুশীমত একে অপরের দেহ ব্যবহার ও (বৈধভাবে) চির যৌনতৃপ্তি আস্বাদন।

পুরুষের ভাগ্যে সাধারণতঃ তিন প্রকার স্ত্রী জোটেঃ-

১. কারো ভাগ্যে জোটে প্রভু! ফলে সে স্ত্রীর নিকট স্ত্রৈণ হয়। নিহাতই বিবির গোলাম হয়ে তার আঁচল ধরে সংসার করে। বিবি যেমন বলে ঠিক তেমনি চলে। দাড়িকে ‘ছিঃ’ করলে চট্ ক’রে গাল তেল পারা করে। সিনেমায় যাওয়ার বায়না ধরলে শতখুশী হয়ে স্ত্রীর পশ্চাতে পশ্চাতে চলে। দ্বীন শিখতে, লেখাপড়া করতে বাধা দিলে তাই মানে। মা-বাপকে দেখতে মানা করলে তাই শোনে। ঘরে থাকে সে, আর বাজার করে বিবি। মাছ ধরে সে, ভাগ করে বিবি! আল্লাহর অবাধ্যাচরণ করেও বিবির বাধ্য থেকে সুখানুভব করে। কোন বিষয়ে স্ত্রীকে শাসন করার কথা কল্পনাই করা যায় না, উল্টে সেই স্বামীকে দস্তুরমত শাসিয়ে থাকে; এমন মেয়ে কোকিলবধূ হয়, এমনকি নিজেরও যত্ন নেয় না সে।

এমন স্ত্রী স্বামীকে যা বলে স্বামী তা ধ্রুব সত্য বলে মেনে তাকে ফিরিশ্তার মত বিশ্বাস করে এবং যার বিরুদ্ধে বলে তাকে পাকা দুশমন মনে করে। স্বামীর সুস্থ বিবেককে একেবারে হজম করে ফেলে। কোন ভুল হলে কথায় এবং কখনও দৈহিক আঘাতও দিয়ে থাকে স্বামীকে! অথচ এমন গোবেচারী মুসলিম হলে সেই কষ্ট দেখে তার বেহেশ্তী স্ত্রী (হুর)গণ ঐ স্ত্রীকে অভিশাপ দিয়ে বলতে থাকে ‘ওকে কষ্ট দিস্ না, আল্লাহ তোকে ধবংস করুক! ও তো তোর নিকট ক’দিনকার মেহমানমাত্র। অদূর ভবিষ্যতে তোকে ছেড়ে ও আমাদের কাছে এসে যাবে।”[1]

এমন সংসারে শান্তি কোথায়? কথায় বলে, ‘রাজার দোষে রাজ্য নষ্ট প্রজা কষ্ট পায়, আর নারীর দোষে সংসার নষ্ট শান্তি চলে যায়।’

২. কারো ভাগ্যে স্ত্রী হয় নিহাতই চরণের দাসী। ফুটবলের মত যে দিকেই লাথি খায়, সে দিকে গড়িয়ে যায়। কত নির্যাতন সহ্য করে দাসীর মতই। স্বামী ছাড়া স্বামীর মা-বোনও তাকে কষ্ট দিয়ে থাকে। ‘তোমার জন্য দাসী আনতে চললাম মা’ কথাকে বাস্তবায়ন করে স্বামী। সময়ে খেতে পায় না কাজের চাপে, সুন্দর পরতে পায় না কথার চোটে। অথচ স্ত্রীর উপর কর্তৃত্ব থাকলেও অবৈধ কর্তৃত্ব নেই। এর জন্যও জবাবদিহি করতে হবে স্বামীকে।

৩. তৃতীয় প্রকার স্ত্রী স্বামীর জন্য অপেক্ষাকৃত বয়োকনিষ্ঠ বন্ধু। এমন স্ত্রীর নিকট স্বামী শ্রদ্ধা ও সমীহ পায়, ভক্তি ও ভালোবাসা পায়, পরামর্শ ও সদুপদেশ পায়। এই হল সেই আদর্শ স্ত্রী, যার জন্য হাদীস শরীফে বলা হয়েছে “জগতের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ সম্পদ।”[2]

প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন,

أَربَعٌ منَ السَّعَادَة : المرأَةُ الصَّالحَةُ وَالمسكَنُ الوَاسعُ وَالجَارُ الصَّالِحُ وَالمَركَبُ الهَنيءُ، وَأَربَعٌ منَ الشَّقَاوَة : الجارُ السُّوء وَالمرأَةُ السُّوء وَالمسكَنُ الضَّيِّقُ وَالمركَبُ السُّوء.

“পুরুষের জন্য সুখ ও সৌভাগ্যের বিষয় হল চারটি; সাধ্বী নারী, প্রশস্ত বাড়ি, সৎ প্রতিবেশী এবং সচল সওয়ারী (গাড়ি)। আর দুখ ও দুর্ভাগ্যের বিষয়ও চারটি; অসৎ প্রতিবেশী, অসতী স্ত্রী, অচল সওয়ারী (গাড়ি) এবং সংকীর্ণ বাড়ি।[3]

“সৌভাগ্যের স্ত্রী সেই; যাকে দেখে স্বামী মুগ্ধ হয়। সংসার ছেড়ে বাইরে গেলে স্ত্রী ও তার সম্পদের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকে। আর দুর্ভাগার স্ত্রী হল সেই; যাকে দেখে স্বামীর মন তিক্ত হয়, যে স্বামীর উপর জিভ লম্বা করে (লানতান করে) এবং সংসার ছেড়ে বাইরে গেলে ঐ স্ত্রী ও তার সম্পদের ব্যাপারে সে নিশ্চিন্ত হতে পারে না।”[4]

সত্যিই তো ‘ছ্যাঁদা ঘটি চোরা গাই, চোর পড়শী, ধূর্ত ভাই। মূর্খ ছেলে, স্ত্রী নষ্ট, এ কয়টি বড় কষ্ট।’

উপযুক্ত স্ত্রীর ব্যবহার সকল অধিকারের ঊর্ধে। দাবীর বাইরে অতিরিক্ত তার দান। স্বামীর জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে তার কোন দ্বিধা নেই। তার মনে-প্রাণে শুধু এই ধারণাই থাকেঃ-

“পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি

এ জীবন মন সকলি দাও,

তার মত সুখ কোথাও কি আছে?

আপনার কথা ভুলিয়া যাও।”

এই তো পতিব্রতা সতী। ‘পতি সেবায় থাকে মতি, তবেই তাকে বলি সতী।’ স্বামীর খিদমত হয় তার ব্রত। এমন স্ত্রীই হয় বড় ধৈর্যশীল। যে হালে স্বামীর সাথে থাকে সেই হালেই আল্লাহর শুক্‌র ও প্রশংসা করে। স্বামী সুশ্রী না হলেও নিজ ভাগ ও ভাগ্য নিয়ে সন্তুষ্ট হয়। ধৈর্যের ফল বড় মিঠা। ধৈর্য ও সবর এক অমূল্য সম্পদ। যদ্দ্বারা ধনী না হলেও ধনীর মত জীবন-যাপন করা যায়। সবর ও শুক্‌রের ফলে উভয় জগতে রত্নলাভ হয়।

সবর ৩ প্রকার; আল্লাহর ফরযকৃত কর্মসমূহের উপর সবর ও ধৈর্যধারণ; তা নষ্ট না করা। তাঁর নিষিদ্ধ হারামের উপর ধৈর্যাবলম্বন; তাতে লিপ্ত না হওয়া। আর তাঁর লিখিত তকদীরের উপর ধৈর্যধারণ; তাতেই সন্তুষ্ট থাকা এবং তার উপর ক্ষুব্ধ না হওয়া। যার মধ্যে এই তিন প্রকার সবরই বিদ্যমান সে ফকীর হলেও রাজা। গরীবী হাল হলেও সবর ও শুক্‌রের বলে তার মন থাকে সবল।

এ স্ত্রীর মনে কোন অভিযোগ নেই। কারণ, যেমন স্বামী, যেমন শ্বশুর-শাশুড়ী ও যেমন শ্বশুরবাড়ি সে পেয়েছে তা তার ভাগ্যের জিনিস।

উত্‌বী বলেন, “একদা বসরার এক রাস্তায় পথ চলছিলাম। পথিমধ্যে দেখলাম, এক অপূর্বা সুন্দরী একজন কুশ্রী বৃদ্ধের সাথে উপহাস ও হাসাহাসির সাথে কথা বলতে বলতে পথ চলছে। আমি যুবতীর নিকটবর্তী এসে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ঐ লোকটি তোমার কে?’ বলল, ‘আমার স্বামী।’ আমি অবাক হয়ে তাকে বললাম, ‘তোমার এত সুন্দর রূপ-যৌবন থাকা সত্ত্বেও ঐ কুশ্রী বৃদ্ধকে নিয়ে কি করে সংসার কর?! এটা সত্যই আশ্চর্যজনক ব্যাপার!!’

কিন্তু মহিলাটি আমাকে উত্তর করল, ‘তাতে কি আছে? সম্ভবতঃ উনি আমার মত সুন্দরী পেয়ে আল্লাহর শুক্‌র আদায় করছেন। আর আমি উনার মত কুশ্রী পেয়েও সবর করে আছি। আর শুক্‌রকারী এবং সবরকারী উভয়ে জান্নাতবাসী হবে! আল্লাহ আমার ভাগ্যে যা জুটিয়েছেন তা পেয়ে সন্তুষ্ট হওয়া উচিৎ নয় কি?!’

এই জবাবে আমি হতবাক হলাম। অতঃপর কিছু না বলে প্রস্থান করলাম।”

এমন জবাব সত্যিই এক মু’মিন নারীর। পক্ষান্তরে কারো স্ত্রীকে অনুরূপ প্রলোভন, কুমন্ত্রণা ও ফুস্‌মন্তর দিয়ে তার সংসার নষ্ট করা অবশ্যই কোন মানুষের কাজ নয়; তার পশ্চাতে থাকে শয়তান। পরন্তু প্রিয় নবী (সাঃ) বলেন,

لَيْسَ مِنَّا مَنْ خَبَّبَ امْرَأَةً عَلَى زَوْجِهَا أَوْ عَبْدًا عَلَى سَيِّدِهِ.

“যে ব্যক্তি কারো স্ত্রী অথবা ক্রীতদাসকে তার (স্বামী বা প্রভুর বিরুদ্ধে) প্ররোচিত করে সে আমাদের দলভুক্ত নয়।”[5]

অবশ্য যে দম্পতি তকদীরে পূর্ণ ঈমান রাখে তারা কোন দিন বিচলিত হয় না।

এমন দম্পতি মু’মিন দম্পতি। এমন চরিত্রবাণ আদর্শ দম্পতির লক্ষণ; লজ্জাশীল হয়, অপরকে কোন প্রকার ব্যথা দেয় না। শান্তি ও শৃঙ্খলতাকামী হয়। পরোপকারী ও হিতাকাঙ্ক্ষী হয়। সত্যবাদী, মিতভাষী, মিষ্টভাষী, ধৈর্যশীল, কৃতজ্ঞ, অল্পে তুষ্ট, সহনশীল, অঙ্গীকার পালনকারী, আমানতদার, সংযমী, জিতেন্দ্রিয়, ভদ্র, শিষ্টাচারী, বিনয়ী, স্মিতমুখো হয়।

কাউকে লানতান বা অভিশাপ করে না, শীতল মেজাজী হয়। কাউকে গালাগালি করে না, কারো চুগলী, লাগান-ভাজান, কারো গীবত, পরচর্চা, পরনিন্দা করে না। অধীর হয় না। হিংসুটে, বখীল, পরশ্রীকাতর হয় না। যে আল্লাহর জন্য সব কিছুকে পছন্দ করে ও ভালোবাসে, তাঁরই জন্য সকল কিছুকে ঘৃণা করে ও মন্দ বাসে। তাঁরই সন্তুষ্টলাভের উদ্দেশ্যে সন্তুষ্ট ও রাগান্বিত হয়।

উমার বিন খাত্তাব রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘নারী তিন প্রকার; প্রথম প্রকার নারী; যারা হয় সরলমতী, সতী এবং আত্মসমর্পণকারিণী, অর্থের ব্যাপারে স্বামীকে সাহায্য করে, স্বামীর অর্থের অপচয় ঘটতে দেয় না। দ্বিতীয় প্রকার নারী সন্তানের আধার। আর তৃতীয় প্রকার নারী হল সংকীর্ণ বেড়ি; আল্লাহ যে বান্দার জন্য ইচ্ছা তার গর্দানে তা লটকিয়ে দেন।’[6]

এই ধরনের স্ত্রীরা হল স্বামীর গলার গাব। এরা কেবল ‘হাম করে খায় আর ধুম করে শোয়।’ এদের না আখেরাতের চিন্তা থাকে, আর না-ই দুনিয়ার কোন চিন্তা!

এক প্রকার স্ত্রী আছে; যারা স্বামীর আদেশ-পালনে গড়িমসি, কুঁড়েমি ও গয়ংগচ্ছ করে। বরং তার সে হুকুম তা’মীল না করতে বাহানা খোঁজে। কখনো বা নাক সিঁটকে উপেক্ষাও করে বসে। দ্বিতীয় প্রকার স্ত্রী; যারা আদেশ শোনামাত্র নিমেষে পালন করে। কোন প্রকারের ওজর পেশ বা গড়িমসি করে না, তারা হুকুমে হাজির হয়। কিন্তু আর এক প্রকার স্বামী-প্রাণা স্ত্রী আছে; যারা হুকুমের আশা করে না। হুকুমের পূর্বে স্বামীর প্রয়োজন অনুমান করে পূর্ণ করে রাখে।

অনুরূপ স্বামীও তিন প্রকার। শেষোক্তের দম্পতির যে স্বর্গীয় সুখ জগতেই উপভোগ হয় তা কল্পনাতীত!

ফুটনোট

[1] (তিরমিযী, ইমা, প্রভৃতি,আযি ২৮৪পৃঃ)

[2] (সহীহ আল-জা-মিউস সাগীর অযিয়াদাতুহ ৩৪১৩নং)

[3] (আস-সিলসিলাতুস সহীহাহ ২৮২নং)

[4] (ঐ ১০৪৭নং)

[5] (আবু দাঊদ, নাসাঈ, তুহফাতুল আরূস, ১৪৬-১৪৭পৃঃ)

[6] (আল ইকদুল ফারীদ ৬/১১২)

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন