২৬. ত্ৰিভুবন ঘড়ি দেখল

সমরেশ মজুমদার

ছাব্বিশ

ত্রিভুবন ঘড়ি দেখল। অপারেশন হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। পাশের বন্ধ দরজার ওপারে আকাশলাল এখন অনেকগুলো নল জড়িয়ে পুতুলের মতো স্থির। ওইরকম ব্যক্তিত্ববান মানুষটি জীবিত না মৃত তা ঠাওর করা যাবে না এই মুহূর্তেও। অপারেশনের পর বৃদ্ধ ডাক্তার নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তাঁকে পাশের ঘরে বিশ্রামের জন্যে রাখা হয়েছে। চব্বিশ ঘণ্টা না গেলে আকাশলাল সম্পর্কে কোনও কথা বলা সম্ভব নয় ভদ্রলোক জানিয়েছিলেন। চব্বিশ ঘণ্টা শেষ হতে এখনও ঢের দেরি।

আকাশলালকে এই বাড়িতে নিয়ে আসার পর থেকে একটিবারের জন্যেও কোথাও যায়নি ত্রিভুবন। সে এখানে বসেই জানতে পেরেছে ডেভিড সুড়ঙ্গে আটকে পড়েছে। তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। হেডকোয়ার্টার্সে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ভার্গিস তার ওপর অত্যাচার শুরু করেছে। ত্রিভুবন মনে করে ডেভিড অত্যাচার বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারবে না অথবা চাইবে না। ভয়টা এখানেই। হায়দার অবশ্য বলেছে তেমন কিছু ঘটবে না। ডেভিড যাতে মুখ না খোলে তার জন্যে হেডকোয়ার্টার্সের সোর্সগুলোকে কাজে লাগানো হচ্ছে তবু আশ্বস্ত হতে পারেনি ত্রিভুবন। তার কেবলই মনে হচ্ছে আদর্শের জন্যে যেসব মানুষ জীবন দিতে পারে ডেভিড তাদের দলে পড়ে না।

হায়দার তার ওপর দায়িত্ব দিয়ে বেরিয়ে গেছে কয়েক ঘণ্টা আগে। ত্রিভুবনের দুচোখ এখন টানছিল। এইভাবে টেনশনের মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জেগে থাকার ধকল সে আর সহ্য করতে পারছিল না। যদি আকাশলাল এখন এইভাবেই শুয়ে থাকে তাহলে একটু ঘুমিয়ে নিতে অসুবিধে কী! ভার্গিস যদি জানতে পারে আকাশলাল মারা যায়নি তাহলে সে আর এই বাড়ি থেকে কাউকে বেরিয়ে যেতে দেবে না। আকাশলাল অথবা নিজেকে বাঁচাবার কোনও পথ খোলা থাকবে না তখন। আত্মহত্যাই যদি করতে হয় একটু ঘুমিয়ে নিয়ে করাই ভাল। ত্রিভুবন দরজাটা খুলল।

ওষুধের গন্ধ এখনও ঘরের বাতাস ভারী করে রেখেছে। দেওয়ালের একপাশে খাটটাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আকাশলাল তার ওপর শুয়ে আছে। রক্ত এবং স্যালাইন চলছে। মুখ ফ্যাকাশে। চোখের পাতাও নড়ছে না। ওর পায়ের কাছে টুলে যে নার্সটি বসে ছিল সে ত্রিভুবনকে দেখে উঠে দাঁড়াল। মেয়েটি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত কিন্তু বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে কোনও হদিশ না দিয়ে। ইঙ্গিতে তাকে বসতে বলল ত্রিভুবন। তারপর আকাশলালের পাশে নিঃশব্দে গিয়ে দাঁড়াল। এই মানুষটার ডাকে অনেকের মতো ত্রিভুবন আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এই মানুষ না থাকলে সব কিছু ধুলোয় মিশে যাবে। চব্বিশটা ঘণ্টা যেন ভালয় ভালয় কাটে। ত্রিভুবন ধীরে ধীরে ঘরের অন্যপ্রান্তে গেল। লম্বা ইজিচেয়ারটিতে শরীর ছড়িয়ে দিল সে। সঙ্গে সঙ্গে সারা শরীরে একটা অদ্ভুত আরাম তিরতিরিয়ে উঠল। চোখ বন্ধ করল সে।

আরও কয়েক ঘণ্টা পরে হায়দারের মুখোমুখি বসে ছিল ত্রিভুবন। এখন তার শরীর বেশ ঝরঝরে। হায়দার দুহাতে মাথা ধরে আফসোসের শব্দ বের করল মুখ দিয়ে, ‘হাতে হাতকড়ি নিয়ে কেউ পুলিশের সামনে দিয়ে পালাতে চায়? কি করে এমন বোকামি করল ও আমি ভাবতে পারছি না।’

ত্রিভুবন ঠোঁট কামড়াল, ‘ও কি মুখ খুলেছিল?’

‘সম্ভবত নয়। ওর কাছ থেকে কিছু জানতে পারলে ভার্গিস এতক্ষণ চুপ করে বসে থাকত না।’

‘ওর মৃতদেহ কোথায়?’

‘পুলিশ মর্গে। ভার্গিস ঘোষণা করেছে ডেভিডের আত্মীয়স্বজন সৎকারের জন্যে মৃতদেহ নিয়ে যেতে পারে। মুশকিল হল ওর কোনও নিকট আত্মীয় নেই। ভার্গিসও সেটা জানে। সে হয়তো ভাবছে আমরাই কাজটা করতে এগিয়ে যাব। মূর্খ! হায়দা কাঁধ নাচাল।

‘তাহলে ডেভিডের শেষ কাজ কি করে হবে?’

‘আমরা ঝুঁকি নিতে পারি না।’

‘অন্য কাউকে পাঠাও।’

‘কাকে পাঠাব? যে-ই যাবে পুলিশ আমাদের সঙ্গে তাকে জড়িয়ে ফেলবে।’ বলতে বলতে হঠাৎ হায়দারের মনে পড়ে গেল কিছু। একটু ভাবল। তারপর বলল, ‘একটি ইন্ডিয়ান সাংবাদিক, মহিলা, খুব জ্বালাচ্ছে। সব ব্যাপারে তার খুব কৌতূহল। কারাফউ-এর মধ্যে কবরখানায় পৌঁছে গিয়েছিল। এখন ওকে কোনওমতে ওর টুরিস্টলজের ঘরে আটকে রাখা হয়েছে। ওই মেয়েটিকে রাজি করানো যেতে পারে।’

‘মেয়েটি কি ডেভিডকে চেনে?’

‘না। কিন্তু কৌতূহল বেশি বলে, দেখাই যাক না— ।’ হায়দার উঠে দাঁড়াল, ‘ডাক্তার কেমন আছে? চব্বিশ ঘণ্টা তো শেষ হয়ে গেল।’

‘ভদ্রলোকের নার্ভের ওপর প্রচণ্ড চাপ পড়েছিল। এখন একটু সুস্থ।’

‘চলো, কথা বলি।’

দরজায় শব্দ করে ভেতরে ঢুকতেই বৃদ্ধ মুখ ফেরালেন। টেবিলের ওপর ঝুঁকে কিছু লিখেছিলেন তিনি। হায়দার এগিয়ে যেতেই লেখাটা সরাবার চেষ্টা করলেন।

‘কি লিখছিলেন?’

‘এটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আপনাদের প্রয়োজনে লাগবে না।’

‘ডায়েরি নাকি? দেখতে পারি?’

বৃদ্ধ হাসলেন, ‘অদ্ভুত ব্যাপার। আপনাদের নেতার জীবন আমার ওপর ছেড়ে দিতে পরেছেন কিন্তু আমাকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। আমি যে কাজটা করেছি তা এই মহাদেশে কেউ করেনি অথবা করতে সাহস পায়নি। অপারেশনের সময় ঠিক কি কি করেছি তার বিস্তারিত বিবরণ লিখে রাখছিলাম। এর অনেক শব্দই চিকিৎসাবিজ্ঞান না জানা থাকলে বোধগম্য হবে না।’

হায়দার তবু খাতাটা দেখল। একটু চোখ বোলাল। ত্রিভুবনের ব্যাপারটা পছন্দ হচ্ছিল না। এই বৃদ্ধ ডাক্তারকে এখন সন্দেহ করা শুধু বোকামিই নয়, অভদ্রতা। খাতাটা ফিরিয়ে দিয়ে হায়দার জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনার পেশেন্টের অবস্থা কি রকম?’

‘স্বাভাবিক লক্ষণগুলো ফিরে আসছে। তবে— ।’ বৃদ্ধ চুপ করে গেলেন।

‘তবে কি?’

‘ওর ব্রেন কতখানি স্বাভাবিক থাকবে সে ব্যাপারে সন্দেহ থেকে গেছে আমার।’

‘বুঝতে পারলাম না।’

‘আমি ওর বুকে যে পাম্পিং স্টেশন বসিয়েছিলাম তার ক্ষমতা ছিল অত্যন্ত সীমিত। বড়জোর চব্বিশ ঘণ্টা ওটা কাজ করতে পারত। মানুষ স্বাভাবিক অবস্থায় যে অক্সিজেন শরীরে নেয় এবং যতখানি রক্তচলাচল দেহে করে তার অনেক কম পরিমাণ ওই স্টেশন থেকে আকাশলালের শরীর পেয়েছে। ওর কিডনি এবং লিভার এটা মেনে নিয়েছিল কিন্তু ব্রেন যদি না মানতে পারে তাহলে— ।’

‘এরকম হবার সম্ভাবনা আপনার আগে জানা ছিল না?’

‘ছিল। আমি ওঁকে বুঝিয়ে বলেছিলাম। উনি তবু আমাকে ঝুঁকি নিতে বললেন।’

‘ব্রেন অস্বাভাবিক হয়ে গেলে ওর কি হবে? আপনি কি মানসিক প্রতিবন্ধী হয়ে যেতে পারে বলে ভাবছেন? নাকি পাগলের মতো আচরণ করবে ও!’

‘মানসিক প্রতিবন্ধী হয়ে যাওয়াও অস্বাভাবিক নয়। ব্রেনে অক্সিজেন গিয়েছে কিন্তু যত পরিমাণে যাওয়া উচিত তার অনেক কম। এখন ও চোখের পাতা খুলছে, দেখবার চেষ্টা করছে কিন্তু ওষুধের জন্যে ঘুমিয়ে পড়ছে সঙ্গে সঙ্গে। আমাকে আর একটা দিন দেখতে হবে।’

‘আমরা চাই ও সুস্থ হয়ে উঠুক। সম্পূর্ণ সুস্থ।’ হায়দার বলল।

‘সেটা আমিও চাই। ও সুস্থ হলে আমি নোবেল পুরস্কার পেয়ে যেতে পারি।’ বৃদ্ধ হাসলেন।

‘তার মানে?’

‘চিকিৎসাবিজ্ঞানে এটা একটা বিস্ময়কর ব্যাপার। সমস্ত পৃথিবীতে হইহই পড়ে যাবে।’ বৃদ্ধের মুখ উদ্ভাসিত। হায়দার সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিচু গলায় বলল, ‘কিন্তু ডাক্তার, আপনি কি জানেন ভার্গিস এখন আপনাকেও খুঁজছে। হঠাৎ আপনি উধাও হয়ে গিয়েছেন। আপনি বিপ্লবী ছিলেন না, কিন্তু আমাদের সঙ্গে আপনার কোনও যোগাযোগ হয়েছে কি না তা সে খুঁজে বের করতে চাইবেই। আর এখান থেকে ফিরে গিয়ে আপনি যদি সারা পৃথিবীকে জানান কিভাবে পুলিশকে ধোঁকা দিয়ে আকাশলালের ওপর অপারেশন করেছেন তা হলে কি একটি দিনই জেলখানার বাইরে থাকতে পারবেন?’

বৃদ্ধ ডাক্তার ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকলেন। যেন এসব কথা তাঁর কাছে অবোধ্য ঠেকছে। হঠাৎ খুব দুর্বল গলায় বললেন, ‘আপনারা কি আমাকে সারাজীবন বন্দি করে রেখে দেবেন?’

হায়দারের মুখ এখন বেশ কঠোর। সে বলল, ‘আপনাকে আমরা বন্দি করে রাখিনি। আমাদের নিরাপত্তার জন্যেই আপনাকে বাইরে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। যে মুহূর্তে এর প্রয়োজন হবে না তখনই আপনি জানতে পারবেন।’

‘সেটা কবে? আপনার নেতা বলেছিল অপারেশনের পরেই আমাকে যেতে দেওয়া হবে।’

‘আপনি নিশ্চয়ই তাঁকে বলেননি এই ঘটনাটা গল্প করে পৃথিবীকে শোনাবেন।’ হায়দার ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ত্রিভুবনকে ইশারা করে। বৃদ্ধের জন্যে খারাপ লাগছিল ত্রিভুবনের। মানুষটা ভাল। নিজের কাজে ডুবে থাকেন সবসময়। কিন্তু হায়দার যা বলল সেটাও ঠিক। সে বাইরে বেরিয়ে এল।

হায়দার দাঁড়িয়ে ছিল। নিচু গলায় বলল, ‘বুড়োটাকে নিয়ে কি করা যায়?’

ত্রিভুবন বলল, ‘বুঝতে পারছি না।’

আকাশলাল চেয়েছে সে পৃথিবীর মানুষের কাছে মৃত বলে ঘোষিত হোক। এখন পর্যন্ত তুমি আমি ডাক্তাররা আর ওই নার্স ছাড়া একথা কেউ জানে না। ডেভিড জানত।’

‘হ্যাঁ, একজনের জানা নিয়ে আর কোনও ভয় নেই।’

ত্রিভুবনের কথা শুনে হায়দার ওর মুখের দিকে তাকাল।

ত্রিভুবন বলল, ‘তুমি ভুলে যাচ্ছ অপারেশনে এই বৃদ্ধ ডাক্তারকে আরও কয়েকজন সাহায্য করেছিল। মুখ খোলার হলে তারাও খুলতে পারে।’

‘হুঁ। কিন্তু আমরা তো তাদের সতর্ক করে দিয়েছি।’

‘সেই সতকর্তা ওদের কতদিন মনে থাকবে?’

‘থাকবে। নাহলে যাতে থাকে তার ব্যবস্থা করতে হবে আমাদের। কিন্তু এই বৃদ্ধকে আমি আর একটুও বিশ্বাস করতে পারছি না। এখনই নোবেল প্রাইজ পাওয়ার স্বপ্ন দেখছে। একমাত্র পথ ওকে সরিয়ে দেওয়া।’

মাথা নাড়ল ত্রিভূবন, এই সিদ্ধান্তটা আমরা যদি না নিই?’

‘কে নেবে?’

‘নেতার সুস্থ হওয়া পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করতে পারি।’

‘বেশ। আমি শুধু বলছি হাত থেকে তাস যেন না পড়ে যায়।’

অবস্থা এখন খুব খারাপ পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে। হেডকোয়ার্টার্সে ফিরে একটার পর একটা রিপোর্ট তৈরি করতে হয়েছিল ভার্গিসকে। আকাশলালের মৃত্যু, তার মৃতদেহ চুরি যাওয়া, ডেভিডের মত দাগী আসামিকে ধরেও মেরে ফেলা, বাবু বসন্তলালের বাংলোয় সাজেন্ট, চৌকিদার এবং ম্যাডামের ডাইভারের মৃত্যু—এসবই যে তার অপদার্থতার কারণে এ ব্যাপারে যেন বোর্ডের আর সন্দেহ নেই। আকাশলাল মরেছে ঠিকই, কিন্তু ডেভিডকে বাঁচিয়ে রাখতে পারলে বাকি সবগুলোকে ধরে রাজ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনা যেত এ ব্যাপারে ভার্গিস নিজেও নিশ্চিত। কিন্তু হঠাৎ কেন যে তিনি গুলি করতে গেলেন ভার্গিস এখনও বুঝতে পারছেন না। লোকটার হাতে হাতকড়া ছিল। ওই অবস্থায় বেশি দূর পালিয়ে যেতে ও কিছুতেই পারত না। তাছাড়া তিনি ওর পায়ে গুলি করতে পারতেন। ম্যাডামের উত্তেজিত আদেশ শোনামাত্র কেন যে তাঁর বোধবুদ্ধি লুপ্ত হল তা এখন আর ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। এখন নিজের চেয়ারে বসে ভার্গিসের কেবলই মনে হচ্ছিল ম্যাডাম অনেক বুদ্ধিমতী মেয়ে। আর এই মনে হওয়াটাই তাঁর কাছে আরও যন্ত্রণাদায়ক হয়ে উঠছে। ওই সার্জেন্ট এবং চৌকিদার ম্যাডামের ড্রাইভার ছাড়া কারও হাতে মারা পড়েনি। এমন হতে পারে ম্যাডাম সেখানে পৌঁছে ওই সার্জেন্টের সঙ্গে যখন কথা বলছিলেন তখন ড্রাইভার লোকটাকে গুলি করে। নিরীহ পাগলাটে চৌকিদারকে মেরে ফেলতে লোকটার কোনও অসুবিধে হয়নি। এবং এখন ভার্গিস নিঃসন্দেহ, ঝোপের আড়ালে ড্রাইভারকে লুকিয়ে থাকতে ম্যাডামই বলেছিলেন যাতে তিনি নাটক তৈরি করার সুবিধে পান। ড্রাইভারকে দিয়ে দুটো খুন করানোর পর আর ওকে বাঁচিয়ে রাখা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। ভার্গিসকে দিয়ে সেই কাজটা করালেন তিনি।

কিন্তু কেন? এতে ম্যাডামের কি লাভ হল? এই প্রশ্নটার উত্তর খুঁজে পাচ্ছিলেন না ভার্গিস। কিন্তু ওই মহিলার ওপর যে আর কোনওভাবে নির্ভর করা যেতে পারে না এটা বোঝার পর নিজেকে এই প্রথম অসহায় বলে মনে হচ্ছিল। বোর্ড অথবা মিনিস্টারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এই ভদ্রমহিলার মদত তাঁর সবচেয়ে প্রয়োজন, অথচ— । ম্যাডাম সম্পর্কে যে সন্দেহ মনে জাগছে তাও তো কাউকে বলা যাবে না। মিনিস্টারকে জানানোমাত্র ম্যাডাম তাঁর শত্রু হয়ে যাবেন। এক ঘণ্টার মধ্যেই তাঁকে চেয়ার ছেড়ে দিতে হবে।

এই সময় টেলিফোনটা বাজল। ভার্গিস অলস ভঙ্গিতে রিসিভার তুলে জানান দিলেন।

‘আমি কি পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে কথা বলছি?’ সুন্দর ইংরেজি উচ্চারণ, গলাটি মহিলার।

‘হ্যাঁ। আপনি কে বলছেন?’

‘আমি একজন রিপোর্টার। আমার নাম অনিকা। আকাশলালকে অ্যারেস্ট করার আগে আমাকে আপনি দেখেছিলেন। অবশ্য মনে রাখার কথা নয়।’

ভার্গিস মনে করতে পারলেন। মেয়েমানুষ এবং রিপোর্টার। এই দুটো থেকে তিনি অনেক দূরে থাকা পছন্দ করেন। গম্ভীর গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ব্যাপারটা কি?’

‘আপনার সঙ্গে কি দেখা করতে পারি?’

‘কেন? দেখা করার কি দরকার?’

‘ডেভিডের মৃতদেহ নিয়ে কথা বলতে চাই।’

‘ডেভিডের মৃতদেহ?’ ভার্গিস চমকে উঠলেন, ‘আপনি এ ব্যাপারে কথা বলার কে?’

‘আমি টেলিফোনে বলতে চাই না।’ অনীকা জবাব দিল, ‘এখনও শহরে কারফিউ চলছে। আপনার সাহায্য ছাড়া আমি টুরিস্টলজ থেকে বের হতে পারছি না।’

‘ওখানেই থাকুন।’ শব্দ করে রিসিভার নামিয়ে রাখলেন ভার্গিস। মেয়েটা পাগল নাকি? এই শহরে এসেছিল উৎসব সম্পর্কে রিপোর্ট করতে। ডেভিডের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক থাকার কথাই নয়। ভার্গিসের মনে হল তাঁকে ইন্টারভিউ করার একটা রাস্তা হিসেবে মেয়েটা ডেভিডের প্রসঙ্গ তুলেছে। ভেবেছে ওটা বললে তিনি খুব সহজে গলে যাবেন। অথচ বেচারা জানে না শুধু ওই একটা সংলাপের জন্যে তিনি ইচ্ছে করলে ওকে জেলে পচাতে পারেন। ইয়ার্কি! কিন্তু পরক্ষণেই তাঁর মনে হল সাহস করে যখন তাঁকে টেলিফোন করেছে তখন কিছু সত্যি থাকলেও থাকতে পারে। হয়তো ছাই ওডাতে ওড়াতে আগুন পাওয়া যেতে পারে। ভার্গিস টেলিফোন তুলে হুকুম দিলেন টুরিস্টলজ থেকে মহিলা রিপোর্টারকে তুলে আনতে।

মিনিট কুড়ি বাদে ভার্গিস নিজের টেবিলের ওপাশে অনীকাকে দেখছিলেন। খুব সুন্দরী নয় কিন্তু চটক আছে। পুরুষমানুষরা কিরকম মহিলার প্রতি আকর্ষণবোধ করে তা ভার্গিস ঠিক বোঝেন না। জীবনের এই দিকটা তাঁর অজানাই থেকে গেল।

‘ডেভিডের ব্যাপারে আপনি কি যেন বলবেন বলছিলেন?’ ভার্গিস সরাসরি প্রশ্ন করলেন।

‘আমি তো কিছু বলতে চাইনি।’ অনীকা সরল মুখে বলার চেষ্টা করল।

ভার্গিসের মুখ এবার বুলডগের মতো হয়ে গেল, ‘তাহলে ফোন করেছিলেন কেন?’

‘কিছুক্ষণ আগে একটি লোক এসে আমাকে বলল ডেভিডের কোনও আত্মীয়স্বজন নেই। ওর বন্ধুরা কেউ মৃতদেহ সৎকারের জন্যে নিতে আসবে না কারণ আপনি তাঁদের খুঁজছেন। আমি একজন বিদেশি সাংবাদিক, ডেভিডের সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই, আমি নিজে একটা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনের সদস্য, অতএব আপনার কাছে ওর মৃতদেহ সৎকারের জন্যে আবেদন করতে পারি। শুনে আমার মনে হল মানুষ হিসেবে আমার এটা কর্তব্য।’ অনীকা স্পষ্ট গলায় বলল।

‘কে বলেছে আপনাকে? কে পাঠিয়েছে?’ ভার্গিস গর্জে উঠলেন।

‘লোকটাকে তার নাম জিজ্ঞাসা করেছিলাম, বলতে রাজি হল না।’

‘এখনও সে টুরিস্টলজে আছে?’

‘না অনুরোধ করেই চলে গেল।’

‘মিস্‌। আপনি খুব বোকামি করছেন। কারফিউ-এর জন্যে যেখানে কেউ রাস্তায় বেরুতে পারছে না সেখানে আপনার কাছে একজন বেড়াতে এল এবং চলেও গেল? এর চেয়ে ভাল গল্প তৈরি করুন।’

অনীকা হাসল, ‘স্যার! কারফিউ-তে সাধারণ মানুষ পথে বের হয় না। কিন্তু যাদের প্রয়োজন তারা ঠিক বের হচ্ছে। আমার নিজের সেই অভিজ্ঞতা আছে।’

‘হুম! কিন্তু ডেভিডের মৃতদেহ তার আত্মীয় বা বন্ধু ছাড়া দেওয়া হবে না।’

‘তাহলে আপনাদের মর্গে ওর শরীর পচবে।’

‘এরকম অনেক শরীর ওখানে পচে। আপনি তাদের জন্যে কথা বলবেন?’ ভার্গিস নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন, ‘মিস, আপনি বিদেশি। কারফিউ থাকা সত্ত্বেও আপনাকে আমি সীমান্তের ওপারে পাঠিয়ে দিচ্ছি, নিজের দেশে ফিরে যান।’

‘কিন্তু আমি যদি নিজেকে ডেভিডের বন্ধু বলে দাবি করি?’

‘তাহলে আমি প্রশ্ন করব আপনার সঙ্গে কি ওর দলের লোকদের যোগাযোগ আছে?’

‘আমি সত্যি কথাই বলব, কাউকে চিনি না।’

‘বেশ, আপনাকে মিথ্যে কথা বলার অপরাধে আমি অ্যারেস্ট করছি।’

‘আমি কোনটে মিথ্যে বললাম?’

‘ওই যে গপ্পোটা, কেউ কারফিউ-এর মধ্যে এসে আপনাকে যেটা বলে গেল।’

‘আপনি জানেন কারফিউ-এর মধ্যে ইচ্ছে হলে বের হওয়া যায়। আমিই বেরিয়েছিলাম।’

‘আপনি? কোথায় গিয়েছিলেন?’

‘সাংবাদিক হিসেবে সেটা আপনাকে বলতে আমি বাধ্য নই।’

‘দেখুন, মহিলা বলেই আমি এখন পর্যন্ত আপনার সঙ্গে ভদ্র ব্যবহার করছি।’ ভার্গিস থমথমে মুখে অনীকার দিকে তাকালেন। অনীকা ভেবে পাচ্ছিল না কি করবে। পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে দেখা করার কোনও পরিকল্পনা তার ছিল না। কিন্তু হোটেলের সেই কর্মচারীটি তাকে ডেভিডের ব্যাপারে কিছু করার প্রস্তাব দিলে সে ভেবেছিল এটা একটা সুযোগ হতে পারে। লোকটার কাছে এসে এমন সব প্রশ্ন করবে যার উত্তর তার কাগজে হইচই ফেলে দেবে। অনীকা টেবিলে হাত রাখল, ‘অনেক ধন্যবাদ। আপনাকে খুলেই বলি, টুরিস্টলজ থেকে বেরিয়ে গলি দিয়ে হেঁটে আমি শেষ পর্যন্ত আপনাদের করবখানায় পৌঁছেছিলাম। রাস্তা পার হয়ে আমি সেখানে ঢুকতেও পেরেছিলাম।’

‘অত্যন্ত অন্যায় করেছেন।’ ভার্গিস কিছু একটার গন্ধ পেয়ে সোজা হয়ে বসলেন।

‘সাংবাদিক হিসেবে আমার কৌতূহল হওয়া স্বাভাবিক।’

‘আমাদের পুলিশ আপনাকে কিছু বলেনি?’

‘বোধহয় যাওয়ার সময় টের পায়নি কিন্তু ফেরার সময় তাড়া করেছিল, ধরতে পারেনি।’

‘আর এসব কথা আপনি আমাকে বলছেন?’

‘আপনাকে সত্যি কথা বলছি।’

‘কখন গিয়েছিলেন?’

‘করব দেবার আগে এবং কবর দেওয়ার পরে।’

‘কাকে কবর দেওয়ার কথা বলছেন?’

‘স্যার, আপনি জানেন।’

‘হুম। কি দেখলেন কবর দেওয়ার পর সেখানে গিয়ে?’

‘বেশিক্ষণ থাকতে পারিনি। আকাশলালের লোকজন আমাকে জোর করে সরিয়ে দিয়েছিল।’

‘ওর লোকজন ওখানে ছিল?’

‘সেই সময় ছিল।’

‘ভার্গিস একটা চুরুট বের করলেন, ‘হ্যাঁ, কি দেখলেন?’

‘একটা লোক কবরের কাছে মাটিতে কান পেতে কিছু শোনার চেষ্টা করছিল।’

‘লোকটা কে?’

‘আমি চিনি না।’

‘দেখলে চিনতে পারবেন?’

‘মনে হয় পারব।’

‘ব্যাস এইটুকু?’

‘হ্যাঁ।’

ভার্গিস ভেবে পাচ্ছিলেন না গল্পটা সত্যি কি না? মেয়েটাকে নিয়ে এখন কি করা উচিত। এই সময় অনীকা বলল, ‘আমার কাছে সমস্ত ব্যাপারটাই সাজানো মনে হচ্ছে।’

‘কোন ব্যাপারটা?’

‘এই আকাশলালের আত্মসমর্পণ এবং মৃত্যু।’

হো হো করে হেসে উঠলেন ভার্গিস। এমন হাসি হাসতে তাঁকে কখনওই দেখা যায়নি। হাসতে হাসতে বললেন, ‘দয়া করে বলবেন না সে কবর থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে।’

সকল অধ্যায়

১. ০১. দুরন্ত গতিতে লাল মারুতিটা ছুটে যাচ্ছিল
২. ০২. শহরের একপ্রান্তে বিশাল প্ৰাসাদ
৩. ০৩. এই পরিকল্পনায় ঝুঁকি আছে
৪. ০৪. উপোসি চাঁদের আলো
৫. ০৫. দূরত্বটা অনেকখানি
৬. ০৬. কোথাও কোনও শব্দ নেই
৭. ০৭. লোকটা মূর্খ
৮. ০৮. সেপাইরা গাড়িটাকে ঘিরে ফেলল
৯. ০৯. বাবু বসন্তলালের শরীর
১০. ১০. বেলা যত বাড়তে লাগল
১১. ১১. শহরের একেবারে পশ্চিমপ্রান্তে
১২. ১২. চেকপোস্টের আগে
১৩. ১৩. উৎসবে যোগ দিতে আসা মানুষ
১৪. ১৪. দুপুরের খাবার খারাপ ছিল না
১৫. ১৫. আকাশলাল হাসিমুখে মাথা নাড়ল
১৬. ১৬. সোম দেখছিল মেয়েটাকে
১৭. ১৭. বিছানায় শুয়ে থাকতে পারেনি ভার্গিস
১৮. ১৮. বৃদ্ধ ডাক্তারকে ঘরে নিয়ে আসা হল
১৯. ১৯. রিসিভারটা যেন কানের ওপর সেটে ছিল
২০. ২০. কথা বাতাসের আগে ছোটে
২১. ২১. কারফিউ-এর ভয়ে
২২. ২২. মেডিক্যাল রুমে ঢুকেছিলেন ভার্গিস
২৩. ২৩. টিভিতে তিনজনের বক্তব্য
২৪. ২৪. শহরের কয়েকটা রাস্তায়
২৫. ২৫. দুটো গাড়ি ছুটে যাচ্ছিল
২৬. ২৬. ত্ৰিভুবন ঘড়ি দেখল
২৭. ২৭. মুখের চেহারা এখন স্বাভাবিক
২৮. ২৮. চোখ বন্ধ করে নিঃশ্বাস নিল স্বজন
২৯. ২৯. ম্যাডামের অনুগত কর্মচারী
৩০. ৩০. ত্ৰিভুবনের ইঙ্গিত
৩১. ৩১. চোখ খুলল হায়দার
৩২. ৩২. ব্যান্ডেজটা মুখে জড়িয়ে
৩৩. ৩৩. ঝরনার ধারে পাহাড়ের গায়ে
৩৪. ৩৪. জীবনলাল মাথা নেড়ে বলেছিল
৩৫. ৩৫. তারপর আর কিছু জানা নেই

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন