অন্তর্যামী – ২৪

ইসমাইল আরমান

চব্বিশ

শব্দটা অ্যালির কানেও গেছে। টিফানির ওপর থেকে মনোযোগ টুটে গেল ওর। পাঁই করে ঘুরে দাঁড়াল। ফ্যাল ফ্যাল করে প্রথমে দরজা, তারপর রানার দিকে তাকাল।

ঝুঁকে মেঝেতে রাখা পিস্তলটা তুলে নিল রানা। পা টিপে টিপে দরজার দিকে এগিয়ে গেল, থামল দশ ফুট দূরে। অ্যালিও এল ওর সঙ্গে।

দরজার পাল্লার তলায় ছোট্ট একটা ফাঁক, সেখানে চোখ ফেলল রানা। সিঁড়ির আবছা আলো ঢুকছে ওখান দিয়ে, তবে পুরোপুরি নয়। বাধা পাচ্ছে দু’জায়গায়। দুটো পা রয়েছে ওখানে… মানুষের পা। কেউ দাঁড়িয়ে আছে ওপাশে। সিঁড়ি ধরে ওপরে যাচ্ছে না, নিচেও নামছে না। দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ।

আধ সেকেণ্ডেরও কম সময়ের ভেতরে সমস্ত সম্ভাবনা যাচাই করল রানা, নিয়ে ফেলল সিদ্ধান্ত। না, কোনও ঝুঁকি নেয়া চলে না। মনে মনে কথা বলল অ্যালির সঙ্গে।

পেছনের বেডরুমে চলে যাও। ব্যালকনির দরজাটা খোলো। আমি তোমার পেছনে থাকছি।

দ্বিধা করল না অ্যালি। ঘুরে অদৃশ্য হয়ে গেল ছায়ার মাঝে। কয়েক সেকেণ্ড অপেক্ষা করে ওকে অনুসরণ করল রানা, তবে পিছনে হেঁটে। হাতের সিগ-সাওয়ার তাক করে রেখেছে সামনের দরজার দিকে। বেডরুমের দরজায় পৌঁছুতেই শুনতে পেল স্লাইডিং ডোর খুলে যাবার আওয়াজ। ধাতব মেঝেতে পায়ের শব্দও শুনল—ব্যালকনিতে বেরিয়ে গেছে অ্যালি।

পিছাতে পিছাতে স্লাইডিং ডোরের কাছে পৌঁছুল রানা, এখনও উল্টো, ঘোরেনি। বেডরুমের খোলা দরজা, আর প্যাসেজ পেরিয়ে সামনের দরজাটা দেখতে পাচ্ছে পরিষ্কার। দরজার তলায় পায়ের ছায়াদুটো রয়েছে এখনও। ব্যালকনিতে সবে পা দিয়েছে, এমন সময় নড়ে উঠল দরজার হাতল। আঁতকে ওঠার মত একটা আওয়াজ করল অ্যালি।

ঘুরে রেলিঙের ওপর দিয়ে নিচে তাকাল রানা। দশ ফুট নিচে মাটি। গলিটা আগেই দেখে নিয়েছে, এস্কেপ রুট হিসেবে চমৎকার—ছায়ায় ঢাকা, কোনও ধরনের বাধা নেই, এক দৌড়ে রাস্তা পর্যন্ত পৌঁছুনো যাবে।

‘এসো,’ রেলিঙের ওপর পা তুলতে তুলতে বলল রানা। ‘লাফ দিতে হবে আমাদেরকে।’

‘হাত-পা ভাঙব তো!’ অ্যালির গলায় শঙ্কা।

‘না, ভাঙবে না। কারণ আমি আগে নামছি। এরপর তুমি লাফ দেবে। নিচ থেকে আমি তোমাকে ধরব।’

রেলিঙের ওপর বসে দু’পা ঝুলিয়ে দিল রানা। পিস্তলটা ইতিমধ্যে গুঁজে নিয়েছে ওয়েস্টব্যাণ্ডে। রেলিঙের ওপর দু’হাতের ধাক্কায় আলতো এক ঝাঁপ দিল বাতাসে। মাটিতে পা ঠেকতেই হাঁটু ভাঁজ করে বসে পড়ল, পরক্ষণে স্প্রিঙের মত লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল। উঁচু জায়গা থেকে লাফ দেবার কায়দা এটাই।

সোজা হয়ে অ্যালিকে ইশারা দিল ও। রানাকে অনুকরণ করে ইতিমধ্যে রেলিঙে বসে পড়েছে মেয়েটা। ঝাঁপ দিতে যাবে, এমন সময় বিচ্ছিরি একটা আওয়াজ ভেসে এল অ্যাপার্টমেন্টের দরজা থেকে। কেউ লাথি দিচ্ছে পাল্লায়। কেঁপে উঠল অ্যালি, ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে গেল নিচে।

তবে তৈরি ছিল রানা। দু’হাতে লুফে নিল ওকে। সাবধানে নামাল মাটিতে।

‘ওরা এসে গেছে!’ ভয়ার্ত গলায় বলল অ্যালি।

‘জানি,’ বলল রানা শান্ত গলায়। ‘দৌড়াও।’

ছুটতে শুরু করল দু’জনে। রানার এক হাতে পিস্তল, অন্য হাতে ধরে রেখেছে অ্যালির হাত। গলি পেরিয়ে রাস্তায় পৌঁছুবার চেষ্টা করছে। কয়েক সেকেণ্ডের মাথায় মড়মড়ানি শোনা গেল, অ্যাপার্টমেন্টের দরজা ভেঙে ফেলেছে অচেনা হানাদার। সেই শব্দ ছাপিয়ে আরেকটা শব্দ শোনা গেল খুব কাছ থেকে।

শটগান লোড করার আওয়াজ… ভেসে এসেছে দশ ফুট সামনে, গলির গাঢ় ছায়ার ভেতর থেকে।

থমকে দাঁড়াল রানা, অ্যালির হাত টেনে ধরল।

পরমুহূর্তে চোখ ধাঁধিয়ে গেল আলোয়। শটগানের ওপরে লাগানো ফ্ল্যাশলাইট জ্বলে উঠেছে। একটা নারীকণ্ঠ শোনা গেল তার পেছন থেকে। ‘একচুল নড়বে না! আমার দিকে পিস্তল ওঠালেই গুলি করব তোমাকে।’

গলা শুনেই বুঝল রানা, ধাপ্পা দিচ্ছে না। তারপরেও ঝুঁকি নেবে কি না ভাবল। সমস্যা হলো, অ্যালি একেবারে ওর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। শটগানে যদি বাকশট ভরা থাকে, গুলি করলে ও-ও আহত হবে। অগত্যা আদেশটা না মেনে গতি নেই।

একটু অপেক্ষা করল নারীকণ্ঠ। তারপর বলল, ‘পিস্তলের ম্যাগাজিন খোলো… সাবধানে! চেম্বারের বুলেটটাও বের করবে। এরপর অস্ত্রটা ফেলে দেবে মাটিতে।’

পেছনে ধুপ করে একটা আওয়াজ হলো। অ্যাপার্টমেন্টের ব্যালকনি থেকে কেউ একজন লাফ দিয়ে নেমেছে নিচে।

‘দাঁড়িয়ে আছ কেন?’ সামনে থেকে ভেসে এল ধমক। নিঃশব্দে সিগ-সাওয়ারের ম্যাগাজিন খুলল রানা, চেম্বার খালি করল। অস্ত্রটা ছুঁড়ে দিল সামনে। পায়ের শব্দ শুনল। পেছন থেকে এগিয়ে এসেছে দ্বিতীয় শত্রু। শটগানের লাইন অভ ফায়ার এড়িয়ে একটু পাশে গিয়ে পজিশন নিয়েছে।

ঝনঝন করে কিছু একটা আছড়ে পড়ল সামনে। একজোড়া হ্যাণ্ডকাফ। চকচক করছে আলোয়।

‘উল্টো ঘোরো,’ হুকুম এল। ‘হাঁটু গেড়ে বসো। এরপর হাতদুটো পেছনে নিয়ে পরে ফেলো হ্যাণ্ডকাফ।

ঘুরল রানা। পালন করল হুকুম। ক্লিক জাতীয় শব্দ তুলে দু’কবজিতে আটকে গেল হ্যাণ্ডকাফ।

এবার এগিয়ে এল দ্বিতীয়জন, ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় তাকে দেখতে পেল রানা। আরেকটা মেয়ে। পরনে গাঢ় পোশাক।

হঠাৎ উদয় হওয়া দুই নারীর দিকে পালা করে তাকাচ্ছে অ্যালি। ওর চেহারায় বিস্ময়।

‘তোমরা কারা?’ জিজ্ঞেস করল ও। ‘আমি তোমাদের কারোরই চিন্তা শুনতে পাচ্ছি না কেন?’

‘না পাওয়ারই কথা, ডিয়ার,’ হাসিমুখে বলল দ্বিতীয় নারী।

কাছে এসে রানাকে ধাক্কা দিল সে, উপুড় করে ফেলল মাটিতে। পিঠে চড়ে বসল। পিন-গাঁথা প্রজাপতির মত দশা হলো রানার, নড়তে পারছে না। প্লাস্টিক ছেঁড়ার একটা আওয়াজ শুনতে পেল, প্যাকেট থেকে বের করা হচ্ছে কী যেন।

‘কী করছ তুমি ওকে নিয়ে?’ আতঙ্কিত গলায় জানতে চাইল অ্যালি।

‘শান্ত হও,’ ওকে বলল দ্বিতীয় নারী।

কিন্তু শান্ত হলো না অ্যালি। চেঁচিয়ে উঠল, ‘কী করছ তুমি?’

আরও কিছু বলতে চাইছিল, কিন্তু চাপা পড়ে গেল গলা। প্রথম মেয়েটি এগিয়ে এসে ওর মুখ চেপে ধরেছে।

এক মুহূর্ত পরেই ঘাড়ে সুঁইয়ের গুঁতো অনুভব করল রানা—ইঞ্জেকশন দেয়া হচ্ছে ওকে। প্লাঞ্জারে চাপ দিতেই উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ল চামড়ার তলায়।

‘থামো!’ কোনোমতে মুখ ছাড়িয়ে চেঁচাল অ্যালি। ‘ঈশ্বরের দোহাই, থামাও এসব!’

রানাকে ছেড়ে উঠে দাঁড়াল দ্বিতীয় নারী। অ্যালির সঙ্গে ধস্তাধস্তিতে পেরে উঠছে না প্রথমজন, সাহায্য করল তাকে। কষ্টেসৃষ্টে ‘চিৎ হলো রানা, কিন্তু দেখতে পেল না ওদেরকে। চোখের ওপর ধূসর একটা পর্দা নেমে আসছে যেন। সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে উত্তাপ। দেহের তলা থেকে মাটি যেন সরে গেল, উন্মুক্ত হলো অতল এক গহ্বর। সেখানে পড়ে গেল ও। হারিয়ে গেল সব শব্দ, নেমে এল নিশ্ছিদ্র অন্ধকার।

সকল অধ্যায়

১. অন্তর্যামী – ১
২. অন্তর্যামী – ২
৩. অন্তর্যামী – ৩
৪. অন্তর্যামী – ৪
৫. অন্তর্যামী – ৫
৬. অন্তর্যামী – ৬
৭. অন্তর্যামী – ৭
৮. অন্তর্যামী – ৮
৯. অন্তর্যামী – ৯
১০. অন্তর্যামী – ১০
১১. অন্তর্যামী – ১১
১২. অন্তর্যামী – ১২
১৩. অন্তর্যামী – ১৩
১৪. অন্তর্যামী – ১৪
১৫. অন্তর্যামী – ১৫
১৬. অন্তর্যামী – ১৬
১৭. অন্তর্যামী – ১৭
১৮. অন্তর্যামী – ১৮
১৯. অন্তর্যামী – ১৯
২০. অন্তর্যামী – ২০
২১. অন্তর্যামী – ২১
২২. অন্তর্যামী – ২২
২৩. অন্তর্যামী – ২৩
২৪. অন্তর্যামী – ২৪
২৫. অন্তর্যামী – ২৫
২৬. অন্তর্যামী – ২৬
২৭. অন্তর্যামী – ২৭
২৮. অন্তর্যামী – ২৮
২৯. অন্তর্যামী – ২৯
৩০. অন্তর্যামী – ৩০
৩১. অন্তর্যামী – ৩১
৩২. অন্তর্যামী – ৩২
৩৩. অন্তর্যামী – ৩৩
৩৪. অন্তর্যামী – ৩৪
৩৫. অন্তর্যামী – ৩৫
৩৬. অন্তর্যামী – ৩৬
৩৭. অন্তর্যামী – ৩৭
৩৮. অন্তর্যামী – ৩৮

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন