অধ্যায় ১২: সেপ্টেম্বর

মঈদুল হাসান

অধ্যায় ১২: সেপ্টেম্বর

প্রস্তাবিত ঐক্যফ্রন্টকে দুর্বল ‘উপদেষ্টা কমিটিতে’ পরিণত করার ক্ষেত্রে সর্বাধিক কার্যকর ভূমিকা ছিল খোন্দকার মোশতাকের। আওয়ামী লীগের ‘নিরঙ্কুশ অধিকারকে জলাঞ্জলি দিয়ে বহুদলীয় কমিটি গঠন করার ফলে আওয়ামী লীগের যে অংশ ক্ষুব্ধ হয়, তাদেরকে তাজউদ্দিনের বিরুদ্ধে পরিচালিত করার ক্ষেত্রেও মোশতাক সক্রিয় ছিলেন। অথচ নিজের নিউইয়র্ক যাওয়া যাতে সম্ভব হয়, এ জন্য সংশ্লিষ্ট বৈদেশিক মহলের জন্য তার বাহ্যিক ভূমিকা ছিল অন্য রকম। জাতীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠিত হওয়ার পাঁচদিন আগে, যখন এ বিষয়ে উধ্বতন প্রবাসী নেতৃত্ব গোপনীয়তা বজায়ের চেষ্টা করছিলেন, এমনকি ভারতীয় পত্রপত্রিকাও দৃশ্যত যখন এ বিষয়ের কোন হদিশ পায়নি, তখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেই লন্ডনের ‘গার্ডিয়ান পত্রিকার সংবাদদাতার কাছে ঘোষণা করেন যে, শীঘ্রই ‘ঐক্যবদ্ধ মুক্তিফ্রন্ট গঠিত হতে চলেছে এবং এর ফলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে রাশিয়ার সমর্থন লাভ সম্ভব হতে পারে। ৫ই সেপ্টেম্বরে পররাষ্ট্র সচিব মাহবুব আলম চাষীকে তিনি দিল্লী পাঠান মুখ্যত তার প্রত্যাশিত বিদেশ ভ্রমণ সম্পর্কে ভারতের সহায়তা লাভের উদ্দেশ্যে। পরবর্তীকালে প্রকাশিত এক তথ্য অনুসারে, যে দিন। ‘গার্ডিয়ান পত্রিকায় রাশিয়ার সমর্থনের সম্ভাবনা সম্পর্কে মোশতাকের আশাবাদ প্রকাশিত হয়, ঠিক সে দিনই অর্থাৎ ৪ঠা সেপ্টেম্বর ইসলামাবাদে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত যোসেফ ফারল্যান্ড প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে প্রস্তাব করেন, কোলকাতায় বাংলাদেশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে তারা জানিয়ে রাখতে চান যে, ইয়াহিয়া মোশতাকের সঙ্গে গোপনে আলোচনা শুরু করতে সম্মত হয়েছেন। ফারল্যান্ডের এই প্রস্তাবে ইয়াহিয়া রাজী হন। কিসিঞ্জারের স্মৃতিকথা প্রকাশের আগে অবধি এই ঘটনার কথা অবিদিত থাকলেও, এই ধরনের কর্মকাণ্ড যে ভিতরে ভিতরে চলছিল তা সেই সময়ের আর একটি সূত্র থেকে প্রকাশ পায়।

১৯৬০ সালে কঙ্গোয় পাশ্চাত্য রাজনৈতিক ও অর্থনেতিক স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক’ বাহিনীর আবরণকে যেভাবে ব্যবহার করেছিল, ১৯৭১ সালের জুলাই-আগস্টে অধিকৃত এলাকায় জাতিসংঘের ত্রাণ ও পুনর্বাসন সহায়তা কর্মসূচী অনেকটা তেমনিভাবে ব্যবহার করতে এবং সেই উদ্দেশ্যে USAID–কে উত্তরোত্তর মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করতে দেখা যায়। কাজেই আগস্টের শেষ দিকে এ বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের যথোচিত ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ প্রদান করা হয়। ৫ই সেপ্টেম্বরের বেতার ভাষণে তাজউদ্দিন স্পষ্ট সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যে সাহায্য দিয়েছে পাকিস্তানের মাধ্যমে তা দখলকৃত এলাকায় বিলি করার ব্যবস্থা সঙ্গত মনে করেছে জাতিসংঘ। বিগত ঘূর্ণিঝড়ের পরে রিলিফের জন্য যে সব হেলিকপ্টার, জলযান ও অন্যান্য যানবাহন এসেছিল, বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধেই পাকিস্তান সরকার নির্বিকারচিত্তে সে সব ব্যবহার করেছে। দুর্গত মানুষের জন্য নির্দিষ্ট বহু সামগ্রী দখলদার সৈন্যদের প্রয়োজনে ব্যবহৃত হচ্ছে। জাতিসংঘের সেবাদলে এখন একদল যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ এসেছেন উন্নত ধরনের যন্ত্রপাতি নিয়ে। এতে পাকিস্তান সৈন্যবাহিনীর রণকৌশলে সাহায্য হবে, তাতে সন্দেহ নেই। এই অবস্থায়, ত্রাণকার্যের মানবতাবাদী উদ্দেশ্য বিপর্যস্ত হবার ঘোরতর আশঙ্কা রয়েছে। জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল যদি পৃথিবীর এই অংশে বিশ্ব প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখতে চান তাহলে তাকে এমন ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে ত্রাণকার্যের নামে নিষ্ঠুর প্রহসন অনুষ্ঠিত না হয়।’

এই বেতার ভাষণের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের আন্ডার সেক্রেটারী জন আরউইন, ডেপুটি এ্যাসিস্টেন্ট সেক্রেটারী ভ্যান হোলেন এবং USAID-এর মরিস উইলিয়ামস্ ভারতের রাষ্ট্রদূত এল, কে, ঝার কাছে বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকায় ত্রাণ সহায়তার কাজে নিযুক্ত অফিসারদের নিরাপত্তা বিধানের অনুরোধ করেন। উত্তরে ঝা বলেন, যেহেতু ঐ এলাকার উপর ভারতের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই, সেহেতু ত্রাণকার্যে নিযুক্ত লোকজনদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রের উচিত বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এ বিষয়ে সরাসরি আলাপ করা। জন আরউইন তখন জানান, কোলকাতায় ‘যুক্তরাষ্ট্রের কনস্যুলেট সদস্যরা ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করছেন এবং তারা বাংলাদেশ প্রতিনিধি ও পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষের মধ্যে আলাপ-আলোচনার সম্ভাবনা অন্বেষণ করে দেখছেন। ১৫ই সেপ্টেম্বর ভারতের যুগ্ম সচিব এ. কে. রায় রাষ্ট্রদূত ঝা’র এই রিপোর্টের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাঁকে জানান, যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক প্রতিনিধিরা বাংলাদেশ পরিষদ সদস্যদের একাংশের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে তাদেরকে অখণ্ড পাকিস্তানের অধীনে একটা রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছাবার ব্যাপারে উৎসাহিত করে চলেছেন বলে তাঁর কাছেও সংবাদ রয়েছে। ২০শে সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট এ. কে. রায়কে জানান তার জানা মতে দু’জন জাতীয় পরিষদ সদস্য মার্কিন কনস্যুলেট জেনারেলের অফিসারদের সঙ্গে দেখা করেছেন।

দু’দিন আগে অর্থাৎ ১৮ই সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ পররাষ্ট্র সচিব মাহবুব আলম চাষীকে প্রেরিত এক সংক্ষিপ্ত নোটে রায় জানান কোলকাতায় মার্কিন কনস্যুলেট জেনারেলের অফিস অধিকৃত এলাকায় আন্তর্জাতিক ত্রাণ কর্মীদের নিরাপত্তা ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের সাথে যোগাযোগ করেছেন বলে ভারত সরকার অবগত হয়েছেন এবং তাদের মতে এ সংক্রান্ত তথ্যাদির বিনিময় সম্ভব হলে ভারত ও বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের সমন্বিত ভূমিকা ফলপ্রসূ হত। ২২শে সেপ্টেম্বরে লিখিত সংক্ষিপ্ততর জবাবে চাষী জানান, কোন ব্যাপারেই মার্কিন প্রতিনিধিদের সঙ্গে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের কখনো যোগাযোগ হয়নি। এই উত্তর পাঠাবার আগে বাংলাদেশ পররাষ্ট্র দফতরের মন্ত্রী, সচিব বা অন্য কেউই অন্তত প্রধানমন্ত্রীর কাছে এ বিষয়ে কোন পরামর্শ চাননি, এমনকি এহেন নাজুক বিষয়ে আশ্রয়দাতা সরকারের সঙ্গে নোট বিনিময় চলেছে তার উল্লেখ পর্যন্ত করেননি। আন্ডার সেক্রেটারী জন আরউইন পরিবেশিত তথ্যের পটভূমিতে মাহবুব আলমের এই প্রাঞ্জল অস্বীকৃতি ভারতের কেবল সন্দেহ বৃদ্ধিতেই সহায়ক হয়। ফলে তাঁদের গতিবিধি, যোগাযোগ ইত্যাদি ভারতীয় পর্যবেক্ষণের অধীন হয় এবং অচিরেই প্রতিষ্ঠিত হয়, খোন্দকার মোশতাক, মাহবুব আলম এবং তাঁর আরো তিন/চারজন সহযোগী মার্কিন প্রতিনিধিদের সঙ্গে অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে নিয়মিত সংযোগ রক্ষা করে চলেছেন।

খোন্দকার মোশতাকের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, তার শক্তি সামর্থ্যের আন্তর্জাতিক প্রেরণা, বিঘোষিত স্বাধীনতার প্রতি তাঁর আনুগত্যের মান প্রভৃতি বিষয় অজ্ঞাত ছিল না। কিন্তু কোন বিশেষ রাজনৈতিক পরিকল্পনা অথবা কোন নির্দিষ্ট কর্মসূচী বাস্তবায়নের জন্য তার এই আমেরিকা যাওয়ার ব্যগ্রতা তা প্রথম দিকে অস্পষ্ট ছিল। কেননা, আমেরিকায় পৌঁছে তিনি যদি পাকিস্তানের পক্ষে তাঁর আনুগত্য পরিবর্তন করতেন, তবে কিছু সময়ের জন্য আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমগুলির মনোযোগ আকর্ষণ করলেও অচিরেই তিনি যে ক্ষমতাহীন ব্যক্তি হিসাবে পরিত্যক্ত হতেন তা উপলব্ধি করার বুদ্ধিমত্তা তাঁর ছিল। এমনকি আমেরিকা পৌঁছানোর পর অবিভক্ত পাকিস্তানের অধীনে স্বায়ত্তশাসনের কোন আপোস ফর্মুলা নিয়ে তিনি যদি কোন নতুন ফ্রন্টও খুলতেন তবু স্বাধীনতা আন্দোলনের যে তাতে সমূহ ক্ষতি হত এমন নয়। অবশ্য সর্বজনগ্রাহ্য কোন রাজনৈতিক ব্যক্তি অথবা বিরাট ভাবাবেগ-সঞ্চারী নতুন কোন ইস্যুকে এই আপোস প্রস্তাবের সমর্থনে হাজির করা হলে তার ফলাফল কি দাঁড়াত বলা মুশকিল ছিল। এই শেষোক্ত আশঙ্কা থেকে সেপ্টেম্বরে খোন্দকার মোশতাক যখন আওয়ামী লীগের কোন কোন মহলে ‘হয় স্বাধীনতা, নয় শেখ মুজিবের মুক্তি, কিন্তু দুটোই এক সাথে অর্জন করা সম্ভব নয়’ বলে প্রচারণা শুরু করেন, তখন তার আমেরিকা সফরের একটি নতুন অর্থ খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়। ভারতে আসার পর থেকে জুলাই এবং সম্ভবত আগস্ট অবধি কোন সময়েই স্বাধীনতার বিকল্প হিসাবে শেখ মুজিবের মুক্তির প্রস্তাব খোন্দকার মোশতাক বা অন্য কারো কাছ থেকে পাওয়া যায়নি। আগস্ট সেপ্টেম্বরে মার্কিন প্রতিনিধিদের সাথে গোপন যোগাযোগের সময়ে মোশতাক স্বাধীনতা অথবা শেখ মুজিব এই নতুন প্রচারে অবতীর্ণ হওয়ায় তাঁর প্রস্তাবিত আমেরিকা সফর এক নিগুঢ় সম্ভাবনায় তাৎপর্যময় হয়ে ওঠে।

প্রায় চার সপ্তাহ মুলতবি থাকার পর ৭ই সেপ্টেম্বর লায়ালপুরে এক গোপন সামরিক আদালতে শেখ মুজিবের ‘বিচার’ পুনরায় শুরু হয়। ইতিপূর্বে এই তথাকথিত বিচার শুরু হওয়ার আগে ৫ই আগস্টে ইয়াহিয়া নিজে শেখ মুজিবকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতার জন্য শাস্তি প্রদানের অঙ্গীকার করায় এই ‘বিচারের রায় পূর্বনির্ধারিত বিষয় হিসাবেই পরিগণিত হয় এবং শেখ মুজিবের প্রাণরক্ষা নিয়ে সারা বিশ্বে উদ্বেগের সঞ্চার ঘটে। আওয়ামী লীগের সকল স্তরে এই প্রশ্ন ছিল নিদারুণ উৎকণ্ঠা ও ভাবাবেগের ইস্যু। কাজেই, স্বাধীনতা না বঙ্গবন্ধুর প্রাণরক্ষা-এই সুচতুর প্রচারণার মাধ্যমে স্বাধীনতার প্রতি আওয়ামী লীগের সমর্থনকে নতুন দ্বিধাদ্বন্দ্বের মুখে হাজির করে স্বায়ত্তশাসনভিত্তিক আপোস ফর্মুলাকে শেখ মুজিবের মুক্তির সঙ্গে জড়িত করে স্বাধীনতার বিরুদ্ধে এক নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই যদি মার্কিন কর্তৃপক্ষ মোশতাককে আমেরিকা নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করে থাকে, তবে বিস্মিত হবার কিছু ছিল না।

তাজউদ্দিন নিজেও আগস্টের প্রথমার্ধে-বিশেষত ১০ই আগস্টে জাতিসংঘের মহাসচিব উ থানটের উৎকণ্ঠিত বিবৃতির পর-শেখ মুজিবের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে সবিশেষ উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন। কিন্তু প্রকৃত ক্ষেত্রে ভারত-সোভিয়েট মৈত্রীচুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে মার্কিন সরকার পাকিস্তানের অখণ্ডতা বজায় রাখার জন্য যেভাবে ব্যস্ত হয়ে পড়েন এবং সমগ্র ঘটনাধারা নিয়ন্ত্রণে যেভাবে তাদের ভূমিকার সম্প্রসারণ ঘটতে থাকে, তার পরোক্ষ ফলস্বরূপ পাকিস্তানীদের সম্ভাব্য প্রতিহিংসা-হত্যার আশঙ্কা হ্রাস পায়। শেখ মুজিবের জীবনের নিরাপত্তা উন্নত করার উপযোগী একটি কার্যকর নীতি অন্বেষণকালে আমরা লক্ষ্য করি এই প্রশ্নে জনমত জোরদারের প্রচেষ্টার পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতা বৃদ্ধিই অধিকতর কার্যকর পন্থা। কেননা মুক্তিযুদ্ধের তীব্রতা বৃদ্ধির ফলে প্রবাসী নেতৃত্বের বিরুদ্ধেই প্রতিপক্ষের আক্রোশ কেন্দ্রীভূত হওয়া স্বাভাবিক; অন্তত আমেরিকানদের চোখে শেখ মুজিব ক্রমশই অধিকতর মধ্যপন্থী (moderate) হিসাবে পরিগণিত হয়ে উঠতে পারেন; এমনকি কোন এক পর্যায়ে উদ্ভূত সঙ্কট নিরসনে তাঁকে আমেরিকা একটি সংযোগসূত্র (linkage) হিসাবে বিবেচনা করতে আগ্রহান্বিত হতে পারে। শেখ মুজিবের জীবনের নিরাপত্তা বৃদ্ধির নামে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে মোশতাকের যুক্তি কার্যত সম্পূর্ণ বিপরীত ফল উৎপাদন করতে পারে বলে আমাদের আশঙ্কা জন্মে।

খোন্দকার মোশতাক ছাড়াও বিপদের আশঙ্কা ঐ সময় দেখা দেয় আরো কয়েকটি দিক থেকে। সেপ্টেম্বরে একদিকে তাজউদ্দিন যেমন মুক্তি সংগ্রামের মূল রণনৈতিক উপাদানগুলি একত্রিত করার দুরূহ কাজে, তথা, বাংলাদেশের অনুকূলে ভারত-সোভিয়েট সমঝোতার সম্প্রসারণ, দখলদার সৈন্যদের রণক্লান্ত করে তোলার জন্যে অনিয়মিত যুদ্ধের তীব্রতা বৃদ্ধি এবং চূড়ান্তপর্বে ভারত-বাংলাদেশ মিলিত অভিযান সম্ভব করে তোলার কাজে ব্যস্ত, তখন এই প্রচেষ্টাকে দলের ভিতর থেকে পর্যুদস্ত করার মত প্রচণ্ডতা নিয়েই আওয়ামী লীগের সকল উপদলীয় তৎপরতা, যেন এক অদৃশ্য শক্তির প্রভাবেই, একের পর এক আত্মপ্রকাশ করতে শুরু করে। খোন্দকার মোশতাক এবং শেখ মণির ‘মুজিব বাহিনী’ ছাড়াও ৯-নম্বর আঞ্চলিক প্রশাসনিক এলাকার (খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী ও অংশত ফরিদপুরের) ৪০ জন জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অনাস্থা ঘোষণা করেন। এই গ্রুপের নেতৃত্বে ছিলেন শেখ মণির নিকটাত্মীয় আবদুর রব সেরনিয়াবাত এবং শেখ আবদুল আজিজ। ৫ই সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গের বারাসাত ৯-নম্বর আঞ্চলিক কমিটি অফিসে তারা যে সমস্ত প্রস্তাব গ্রহণ করেন তন্মধ্যে জুলাই মাসে মন্ত্রিসভা কর্তৃক সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত ‘জোনাল কাউন্সিল অর্ডার’ (GA/810 (345), dated 27th July, 1971)-এর প্রত্যাহার, কেবলমাত্র আওয়ামী লীগ সদস্যদের সাহায্যে ‘জাতীয় মুক্তি পরিষদ গঠন, প্রত্যেক

প্রশাসনিক দফতর পরিচালনার জন্য পরিষদ সদস্যদের সমবায়ে ‘পার্লামেন্টারী কমিটি গঠন এবং ‘অন্তর্বর্তীকালীন শাসনতন্ত্র’ ঘোষণার দাবী জানানো হয় এবং প্রসঙ্গত উল্লেখ করা হয়, এপ্রিলে মন্ত্রিসভা গঠনকালে গুরুতর অনিয়ম করা হয়েছে। জোনাল প্রশাসনিক কাউন্সিল ছিল স্বাধীন সরকারের নির্মীয়মাণ প্রশাসনের অন্যতম মূল কাঠামো, কাজেই একে ভেঙ্গে ফেলার চেষ্টা কেবল অরাজকতা বৃদ্ধিতেই সহায়ক হত। তেমনি শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ সদস্যদের সমবায়ে ‘জাতীয় মুক্তি পরিষদ’ গঠনের দাবী ছিল মূলত বহুদলীয় মোর্চা গঠনের উদ্যোগকে বন্ধ করার জন্যেই, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের রণনৈতিক প্রয়োজন তথা আন্তর্জাতিক শক্তি সমাবেশের ক্ষেত্রে এই প্রস্তাব ছিল সম্পূর্ণ অর্থহীন। অন্য দাবীগুলি দৃশ্যত গণতান্ত্রিক; কিন্তু বাংলাদেশের যুদ্ধউপদ্রুত, নির্বাসিত অবস্থায় সেগুলি কতখানি উপযোগী ছিল, অনুমান করা কষ্টকর নয়।

তথাপি এই সব দাবীর ভিত্তিতে ১১ই সেপ্টেম্বরে জাতীয় পরিষদ সদস্য এনায়েত হোসেন খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উপরোক্ত গ্রুপের মুলতবি সভায় তাজউদ্দিনকে প্রধানমন্ত্রী ও দলের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে অবিলম্বে পদত্যাগে বাধ্য করার জন্য আওয়ামী লীগ হাইকমান্ডকে আহ্বান করা হয়। অপর এক প্রস্তাব অনুসারে এই গ্রুপ অন্যান্য আঞ্চলিক কমিটিকে এই অনাস্থা প্রস্তাবের পিছনে সংঘবদ্ধ করার জন্য প্রচারণা চালাবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। অক্টোবরে যখন তাদের সার্কুলার প্রচারিত হয়, তখন মোশতাক গ্রুপের সাথে তাদের লক্ষ্য ও বক্তব্যের অভিন্নতা স্পষ্টতর হয়। অবশ্য তার পূর্বেই তাদের মেলামেশা ও কাজকর্ম থেকে প্রতীয়মান হয় যে, খোন্দকার মোশতাক ও শেখ মণি উভয়ের স্বার্থই এই গ্রুপে প্রায় সমভাবে বিরাজমান। খোন্দকার মোশতাকের তুলনায় শেখ মণির রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষক, আকাঙ্ক্ষা ও বক্তব্য বহুলাংশে স্বতন্ত্র হলেও তাজউদ্দিনকে ক্ষমতাচ্যুত করার ক্ষেত্রে তাদের উদ্যোগ ও আয়োজন ছিল অভিন্ন। আশ্রয় প্রদানকারী রাষ্ট্রের শক্তিশালী নিরাপত্তা সংস্থার সর্ববিধ পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াও বিপুল সংখ্যক অনুগত সশস্ত্র তরুণের অধিনায়ক হিসাবে শেখ মণি ছিলেন তুলনামূলকভাবে প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী এবং সেই অর্থে সর্ববৃহৎ উপদলীয় বিপদের উৎস। একই সময়ে উপরোক্ত তিনটি গ্রুপ ছাড়াও কামরুজ্জামানের উদ্যোগে আওয়ামী লীগের ভিতরের ও বাইরের শক্তিকে নিয়ে এমন এক স্বতন্ত্র বিরোধিতার উদ্ভব ঘটতে থাকে, যা মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যের জন্য ছিল সমভাবেই অবাস্তব ও ক্ষতিকর।

সমস্ত অসম্পূর্ণতা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান রাজনৈতিক যন্ত্র। কাজেই সেই যন্ত্রকে বিভক্ত ও নিষ্ক্রিয় করে স্বাধীনতা সংগ্রামের সমূহ ক্ষতিসাধনের জন্য পাকিস্তানের প্রবল ক্ষমতাশালী পৃষ্ঠপোষকের পক্ষে এক অন্তর্ঘাতমূলক পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করা অস্বাভাবিক ছিল না। কিন্তু তখনকার দ্রুত পরিবর্তনশীল ঘটনা ও চরিত্র সমাবেশের মাঝে, নানা ধরনের স্বার্থ ও সম্পর্কের ভাঙ্গা-গড়ার ফলে এই সমস্ত উপদলীয় ধারার সঠিক শ্রেণীকরণ সর্বদা সম্ভব হত না। তা সত্ত্বেও এ কথা বুঝে উঠতে কষ্ট হয়নি, যে প্রবল ক্ষমতাসম্পন্ন। বহিঃশক্তি পাকিস্তানের স্বার্থ বজায় রাখার জন্য সর্ব উপায়ে তৎপর এবং যারা অন্তত একটি উপদলের সহায়তায় আওয়ামী লীগের একাংশকে স্বাধীনতার লক্ষ্য থেকে দূরে সরে নিয়ে যাওয়ার জন্য সচেষ্ট, সেই শক্তিই আওয়ামী লীগকে বিভক্ত ও নিষ্ক্রিয় করার সমূহ উপায় অবলম্বন করতে পারে। আওয়ামী লীগের উপদলীয় সংঘাতের প্রতিক্রিয়া মুক্তিযোদ্ধাদের উপর কি দাঁড়াবে এবং ফলত দেশের অভ্যন্তরে পাকিস্তান বাহিনীর অবস্থানকে দুর্বল করে দ্রুত সামরিক বিজয়ের ক্ষেত্র প্রস্তুত করার লক্ষ্য কতদূর ব্যাহত হবে, এই প্রশ্নই তখন মুখ্য হয়ে ওঠে।

ঠিক এই আশঙ্কার পটভূমিতে স্বাধীনতাযুদ্ধকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আপৎকালীন শক্তি হিসাবে ন্যাপ-সিপিবি-ছাত্র ইউনিয়ন থেকে মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুট করার একটি প্রস্তাবকে তাজউদ্দিন দ্রুত সিদ্ধান্তে পরিণত করেন। এই সব সংগঠনের কর্মীদের মুক্তিযুদ্ধে নিয়োগ করার ব্যাপারে তার নীতিগত সম্মতি বরাবরই ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের অবশিষ্ট নেতৃত্বের সম্মিলিত আপত্তির দরুণ-জাতীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠনের পরেও এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব হত কিনা বলা শক্ত। ইতিপূর্বে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ন্যাপ ও সিপিবির পক্ষ থেকে বাংলাদেশ সরকারের কাছে বিস্তর দেনদরবার করা হয়। এ ব্যাপারে ভারত সরকারের কাছে সিপিআই-এর প্রভাবশালী লবি বিশেষ করে ভারত-সোভিয়েট মৈত্রীচুক্তির পর বেশ সক্রিয় হয়ে ওঠে। ভারতীয় প্রশাসনের কেন্দ্রের বাম, অন্ততপক্ষে ডি. পি. ধর, যিনি ভারত-সোভিয়েট চুক্তির জন্য সর্বাধিক কৃতিত্বের অধিকারী, ইন্দিরা গান্ধীর আসন্ন মস্কো সফরের আগে ন্যাপ-সিপিবির কর্মীদের মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে রিক্রুট ও ট্রেনিং দানের জন্য বাংলাদেশ সরকারের সম্মতির অপেক্ষায় ছিলেন। অন্যদিকে আগস্টে মুজিব বাহিনী’র ক্রমবর্ধমান দৌরাত্ম প্রতিবিধানের জন্য ভারতীয় প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা কামনা করে তাজউদ্দিন যখন ব্যর্থ হয়েছিলেন, তারপর থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে রাজনৈতিক ভারসাম্য সৃষ্টির জন্য বামপন্থী কর্মীদের অন্তর্ভুক্ত করার এক প্রস্তাব তিনি সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করছিলেন। সেপ্টেম্বরে আওয়ামী লীগের উপদলীয় সংঘাতের সঙ্গে মার্কিন ইন্ধন যুক্ত হওয়ায় মুক্তিযুদ্ধ যখন ভিতর থেকে বিপন্ন হয়ে পড়ার উপক্রম হয়, তখন উপরোক্ত প্রস্তাবকে তাজউদ্দিন সিদ্ধান্তে রূপান্তরিত করতে আর বিলম্ব করেননি। দলের সংখ্যাগরিষ্ঠের কাছে অপ্রিয় এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার গুরুতর পরিণাম কি দাঁড়াতে পারে, তাজউদ্দিন সে সম্পর্কে পূর্ণরূপেই সচেতন ছিলেন।

সকল অধ্যায়

১. অধ্যায় ০১: ২৫ শে মার্চের প্রাক্কাল
২. অধ্যায় ০২: মার্চ-এপ্রিল
৩. অধ্যায় ০৩: এপ্রিল
৪. অধ্যায় ০৪: মে – জুন
৫. অধ্যায় ০৫: মে – জুন
৬. অধ্যায় ০৬: মে – জুন
৭. অধ্যায় ০৭: জুন – জুলাই
৮. অধ্যায় ০৮: জুলাই – নভেম্বর
৯. অধ্যায় ০৯: জুলাই – আগষ্ট
১০. অধ্যায় ১০: আগষ্ট
১১. অধ্যায় ১১: আগষ্ট – সেপ্টেম্বর
১২. অধ্যায় ১২: সেপ্টেম্বর
১৩. অধ্যায় ১৩: সেপ্টেম্বর – অক্টোবর
১৪. অধ্যায় ১৪: সেপ্টেম্বর – অক্টোবর
১৫. অধ্যায় ১৫: সেপ্টেম্বর – অক্টোবর
১৬. অধ্যায় ১৬: অক্টোবর
১৭. অধ্যায় ১৭: অক্টোবর
১৮. অধ্যায় ১৮: অক্টোবর – নভেম্বর
১৯. অধ্যায় ১৯: নভেম্বর
২০. অধ্যায় ২০: নভেম্বর – ডিসেম্বর
২১. অধ্যায় ২১: ডিসেম্বর
২২. অধ্যায় ২২: ডিসেম্বর – জানুয়ারি

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন