১৬-২১. একটু পেছনে ফিরি

হুমায়ূন আহমেদ

একটু পেছনে ফিরি।

১৯৬৫ সন। আমি পড়ি ঢাকা কলেজে। এখনকার ছেলেপুলেরা বলে ‘ইন্টার’। সেই ইন্টারের ছাত্র। থাকি হোস্টেলে। প্রচুর স্বাধীনতা। সেই স্বাধীনতা ভোগ করার উপায় নেই। কারণ আমার মামাও হোস্টেলে একই রুমে আমার সঙ্গে থাকেন। তিনি সিরিয়াস ধরনের ছাত্র। কোনো ক্লাস মিস করেন না। সন্ধ্যার পর পরই বই নিয়ে বসেন।

আমার ক্লাস করতে ভালো লাগে না। পাঠ্যবই পড়তে ভালো লাগে না। হোস্টেলের খাবার ভালো লাগে না। ঢাকায় থাকতে ভালো লাগে না।

ক্লাস করা প্রায় ছেড়েই দিলাম। আমার মামা তা টের পেলেন না। কারণ তিনি অন্য সেকশানের ছাত্র। ক্লাসে যাওয়া ছেড়ে দেয়ার শুরুটা বেশ মজার। বাংলার একজন শিক্ষক, নাম আজিজুর রহমান। তিনি ক্লাস নিতে এসে বললেন, অনেক ছেলেই ক্লাসে আসে শুধুমাত্র পার্সেন্টেজের জন্যে। তাদেরকে জানাচ্ছি, তারা ক্লাসে না এলেও চলবে। আমি সবাইকে পার্সেন্টেজ দেই।

আমি উঠে দাঁড়ালাম। স্যার বললেন, কিছু বলবে?

আমি বললাম, জি-না স্যার। আমি চলে যাব।

স্যার বিস্ময়ের সঙ্গে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমি গটগট করে বের হয়ে এলাম। পরে জানলাম আজিজুর রহমানই বিখ্যাত ঔপন্যাসিক শওকত ওসমান। তাঁর সঙ্গে বেয়াদবি করেছি ভেবে মন খারাপ হলো এবং ঠিক করলাম অন্যক্লাস না করলেও আমি তার ক্লাসগুলি করব।

শওকত ওসমান স্যারের ক্লাস করতে গিয়ে হতাশই হয়েছি। মূল বিষয় নিয়ে তিনি অল্পই কথা বলতেন যেমন, একদিন পুরো ক্লাসে বললেন তিনি একটা পেইন্টিং কিনেছেন সে-গল্প। একজন শিক্ষকের কণ্ঠস্বর স্পষ্ট হওয়া বাঞ্ছনীয়। স্যারের কথা জড়িয়ে যেত। এবং আমার সবসময় মনে হতো তিনি সময়। কাটানোর জন্যেই কথা বলছেন।

আমাদের আরেকজন বাংলার শিক্ষক ছিলেন। মোটা, বেঁটে। তাঁর নাম মনে পড়ছে না। তিনি ক্লাসে ঢুকেই নানান ধরনের জোকারি করতেন। অঙ্গভঙ্গি করতেন। বিচিত্র শব্দ করতেন। ছাত্ররা খুবই মজা পেত। ক্লাস শেষ হবার পর বলতেন, একটা ঘন্টা আনন্দ করে পার করেছ এটাই লাভ। জগতে আনন্দই সত্য।

স্যারের গোপাল ভাঁড়ের মতো আচরণ আমার অসহ্য লাগত। একজন শিক্ষক ক্লাসে ছাত্র পড়াবেন। তাদের হাসানোর দায়িত্ব নেবেন না।

একদিন স্যার বললেন, কারো কোনো প্রশ্ন আছে?

আমি উঠে দাঁড়ালাম। স্যার বললেন, কী জানতে চাও হে খোকা?

খোকা ডাকায় ক্লাসে হো হো হাসি শুরু হলো। হাসির শব্দ থামার পর আমি বললাম, স্যার, ইলেকট্রন নিউক্লিয়াসের চারদিকে ঘোরে। নিউক্লিয়াস কি স্থির হয়ে থাকে? না-কি সেও ঘোরে?

স্যার কিছুক্ষণ হতভম্ব অবস্থায় কাটালেন। তারপর বললেন, বাংলা ক্লাসে তুমি সায়েন্স নিয়ে এসেছ কেন? বাংলা বিষয়ে কোনো প্রশ্ন থাকলে কর।

 আমি তৎক্ষণাৎ বললাম, স্যার, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শাশুড়ির নাম জানতে চাচ্ছিলাম।

স্যার একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমিও তাকিয়ে আছি। ছাত্ররা হো হো হাসতে শুরু করেছে।

আমি মোটেই বেয়াদব ছাত্র না। বরং একটু বেশিরকমই বিনয়ী। কিন্তু শিক্ষকদের ফাঁকিবাজিটা কখনোই নিতে পারতাম না।

ঢাকা কলেজে ভালো শিক্ষক কি ছিলেন না?

অনেক ছিলেন। সিরাজুল হক নামের একজন অংকের শিক্ষক ছিলেন, তিনি পড়াতেন কোঅর্ডিনেট জিওমেট্রি! ওরকম শিক্ষক পাওয়া ভাগের ব্যাপার।

প্রফেসর নোমান পড়াতেন ইংরেজি কবিতা। কী সুন্দর কণ্ঠ! কী চমৎকার পড়ানোর ভঙ্গি!

শিক্ষকদের কথা থাকুক, তাঁদের ছাত্রের কথা বলি। ছাত্র ক্লাস ফাঁকি দিয়ে কী করত? হন্টন করত।

হ্যাঁ, আমার প্রধান কাজ ছিল ঢাকা শহর চষে বেড়ানো। মাঝে মাঝে বলাকা সিনেমাহলে ম্যাটিনি শোতে ইংরেজি ছবি দেখা। দেশের প্রধান তখন ফিল্ড মার্শাল আয়ুব খান। ছাত্রদের প্রতি তার অনেক মমতা (!), ছাত্ররা যেন অর্ধেক টাকায় ছবি দেখতে পারে সেই ব্যবস্থা তিনি করেছেন। ছাত্রদের জন্যে সিনেমাহলে টিকিটের দাম অর্ধেক। ছাত্রদের সস্তায় সিনেমা দেখানোর জন্যে এই রাষ্ট্রপ্রধানের এত আগ্রহের কারণ কী কে জানে!

ঢাকার পথেঘাটে হাঁটতে হাঁটতে একবার এক ম্যাজিশিয়ানের দেখা পেলাম। বেশির ভাগ সময়ই ম্যাজিশিয়ানরা ম্যাজিক দেখাবার পর ওষুধ বিক্রি করে। এই ম্যাজিশিয়ান সেরকম না। তিনি ম্যাজিকের কৌশল টাকার বিনিময়ে শিখিয়ে দেন। কেউ যদি সেই আইটেম কিনতে চায় তাও তিনি বিক্রি করেন। আমি তার ম্যাজিক দেখে মুগ্ধ। চারটা তাশ নিয়েছেন। চার বিবি। ফুঁ দেয়া মাত্র বিবিদের ছবি মুছে গেল। হয়ে গেল চারটা টেক্কা।

এই ম্যাজিকটার দাম পাঁচ টাকা। আমি পাঁচ টাকা দিয়ে ম্যাজিকটা কিনলাম। ম্যাজিশিয়ান আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে কৌশল ব্যাখ্যা করলেন এবং চারটা তাশ আমাকে দিয়ে দিলেন।

ম্যাজিকের কৌশল শেখার পর সবারই ধাক্কার মতো লাগে। মন খারাপ হয়ে যায়। কৌশল এত সহজ! আমি মুগ্ধ হলাম। মানুষকে এত সহজে বিভ্রান্ত করা যায়।

এরপর থেকে আমার কাজ হয়ে দাঁড়াল ম্যাজিশিয়ান ভদ্রলোককে খুঁজে বের করা। ঘণ্টার পর ঘন্টা তার ম্যাজিক দেখা এবং অতি সস্তায় কিছু ম্যাজিক তার কাছ থেকে কেনা। কারণ টাকা নেই। নাশতা খাবার জন্য যে টাকা বাবা পাঠান, তার একটা বড় অংশই এখন চলে যাচ্ছে ম্যাজিকের কৌশল কেনায়। সারাক্ষণ মনে হয় যদি প্রচুর টাকা থাকত, তাহলে এই লোকটার সব ম্যাজিক আমি কিনে নিতাম।

ম্যাজিশিয়ানের সঙ্গে আমার কিছুটা খাতিরও হলো। ভদ্রলোকের নাম মনে নেই, তবে তার ওস্তাদের নাম মনে আছে। ওস্তাদের নাম যদু বাবু। ম্যাজিশিয়ান কথায় কথায় যদু বাবুর প্রসঙ্গ আনতেন। যেমন—

আমার ওস্তাদ যদু বাবু বলতেন যারা ম্যাজিকের জিনিসপত্র দিয়ে ম্যাজিক দেখায়, তারা ম্যাজিশিয়ান সমাজের কলঙ্ক। হাতের কাছে যা আছে তা দিয়ে যারা খেলা দেখায় তারাই খেলোয়াড়।

আমি ম্যাজিশিয়ানকে একদিন বললাম, পামিং শিখতে চাই। কতদিন লাগবে?

তিনি বিড়ি ধরাতে ধরতে বললেন, কমের পক্ষে কুড়ি বছর। প্রথম দশ বছর পয়সা হাতে নিয়ে ঘুরতে হবে।

হাতে নিয়ে ঘুরলেই হবে, আর কিছু না?

না। দশ বছরে পয়সা হাতরে চিনবে, হাত পয়সারে চিনবে। দুইজনের ভিতর মহব্বত হবে।

আমি কয়েন হাতে নিয়ে ঘুরতে শুরু করলাম। সবসময় হাতে কয়েন। কখনো একটা। কখনো দুটা।

ম্যাজিশিয়ান ভদ্রলোক থাকেন চানখাঁর পুলে। মাঝে মধ্যে তার ছাপড়ায় বেড়াতে যাই। তিনি আমাকে দেখে খুশিও হন না, বিরক্তও হন না। মন ভালো থাকলে এক-আধটা ম্যাজিক দেখান। একদিনের কথা। উনার মেজাজ খুব ভালো। আমাকে দেখেই বললেন, এখান থেকে যে-কোনো একটা তাশ নাও।

আমি নিলাম হার্টসের দুই।

ম্যাজিশিয়ান হাই তুলতে তুলতে বললেন, পানির গ্লাসের ভিতর তাকিয়ে দেখ কিছু দেখা যায় কি-না।

আমি অবাক হয়ে দেখি, পানির গ্লাসে হার্টসের দুই-এর ছায়া। আমি মন্ত্রমুগ্ধ। ম্যাজিশিয়ান বললেন, আমি শিষ্য নেই না। শিষ্য নিলে তোমারে নিতাম। তবে যদি পার আমাকে তিনশ’ টাকা দিও। এমন একটা ম্যাজিক তোমাকে শিখায়ে দিব বাকি জীবন করে খেতে পারবে।

তিনশ’ টাকা তখন অনেক টাকা। হোস্টেলের ফুড চার্জ মাসে চল্লিশ টাকা। ষাট টাকায় আমার মাস চলে। সেখানে কোথায় পাব তিনশ’ টাকা?

একসময় ছয় মাসের স্কলারশিপের টাকা একসঙ্গে পেলাম। প্রায় একহাজার টাকা। সেখান থেকে তিনশ’ টাকা নিয়ে গেলাম ম্যাজিশিয়ানের কাছে। তিনি তিনশ’ টাকা রেখে পরের মাসের প্রথম সপ্তাহে যেতে বললেন। আমি গেলাম এবং শুনলাম ম্যাজিশিয়ান ছাপড়া ছেড়ে চলে গেছেন। কোথায় গেছেন কেউ জানে না।

পাঠকের ধারণা হতে পারে এই ঘটনার পর আমি ম্যাজিকচর্চা ছেড়ে দিয়েছি। তা কিন্তু হয় নি। পামিং শেখা চালিয়ে গেছি। ম্যাজিকের বইপত্র জোগাড় করেছি। যে যা জানে তার কাছেই শেখার চেষ্টা করেছি।

যে মানুষটি এই ব্যাপারে আমাকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছেন, তার নাম জুয়েল আইচ। তাঁর কল্যাণেই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় যাদু সংস্থা—-International Brotherhood of Magicians-এর আমি সদস্য। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমি কি ম্যাজিক দেখাই?

উত্তর হলো, না।

আমি ম্যাজিকটা করি সম্পূর্ণই আমার নিজের জন্যে। হঠাৎ হঠাৎ শাওনকে একটা কৌশল দেখাই। সে মুগ্ধ হবার অভিনয় করে। এতেই আমি খুশি।

বলপয়েন্টে ম্যাজিকের অংশটা বিস্তারিত লেখার কারণটা বলি? আমার লেখালেখিতে Magician-এর চরিত্র অনেকবার উঠে এসেছে। পাঠকদের কি মনে আছে এইসব দিনরাত্রি-র আনিসের কথা? যে চিলেকোঠায় থাকতো। ম্যাজিক দেখাতে।

আমি বাস করি ম্যাজিকের জগতে। ছোট্ট নিষাদ যখন হাসে, সেই হাসিতে ম্যাজিক। তার মা যখন গান করে, তাতেও ম্যাজিক। আমি যখন একটি চরিত্র সৃষ্টি করি, সেখানেও ম্যাজিক।

আমার সেই মহান ম্যাজিশিয়ানের স্বরূপ জানতে ইচ্ছা করে, যিনি আমাদের সবাইকেই অন্তহীন ম্যাজিকে ডুবিয়ে রেখেছেন।

১৭.

স্যার, আপনি কি ভূত বিশ্বাস করেন?

না।

তাহলে এত ভূতের গল্প কেন লিখেছেন?

তোমাদের ভয় দেখানোর জন্যে। মানুষ নিরাপদ জায়গায় বসে ভয় পেতে ভালোবাসে।

স্যার, ভূত কখনো দেখেছেন?

তুমি দেখেছ?

জি। ঘটনা বলব?

বলো।

আমি তখন ইউনিভার্সিটিতে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। সামারের ছুটিতে বাড়ি যাচ্ছি। বর্ষাকাল। বৃষ্টি পড়ছে না, তবে আকাশে ঘন মেঘ। যে-কোনো সময় বর্ষণ শুরু হবে। সন্ধ্যার পর পর আমি নৌকায় কাওরাইদ পৌঁছলাম। কিছুটা রাস্তা হেঁটে যেতে হবে। গোরস্থানের পাশ দিয়ে রাস্তা। লোক চলাচল নেই বললেই হয়…

.

শুরু হয়ে গেল ভূতের গল্প। আমি এখন পর্যন্ত এমন কাউকে পাই নি যার ঝুলিতে কোনো ভৌতিক অভিজ্ঞতা নেই। নাস্তিকরা এই বিষয়ে অনেক এগিয়ে। তারা ভূত বিশ্বাস করে না, কিন্তু তাদের ভৌতিক অভিজ্ঞতা সবচেয়ে বেশি। এমন একজন হলেন অভিনেতা এবং আবৃত্তিকার জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়।

জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় কঠিন নাস্তিক। তিনি ঈশ্বর, ভগবান, ভূতপ্রেত কিছুই বিশ্বাস করেন না। এক সন্ধ্যায় নুহাশ পল্লীতে একটা ঘটনা ঘটল। তিনি দেখলেন এবং ভীত গলায় বললেন, আমি ভগবানকে বিশ্বাস করি না, কিন্তু নুহাশ পল্লীর ভূত বিশ্বাস করি।

ঘটনাটা বলি।

নুহাশ পল্লীতে কী একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে। সন্ধ্যা পার হয়েছে। অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে আলোকসজ্জা। হাজারখানিক মোমবাতি চারিদিকে জ্বালানো হয়েছে। বারবিকিউয়ের প্রস্তুতি চলছে। সুইমিং পুলের চারপাশে সবাই জটলা করছে। ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে গল্প চলছে। মেয়েরা পুরুষদের গল্প পছন্দ করলেও এ ধরনের অনুষ্ঠানে তারা আলাদা হয়ে যায়। মেয়েরা মেয়েরা গল্প করে। অনেকের ধারণা তাদের গল্পের বিষয়—শাড়ি, গয়না। তা কিন্তু না। মূল বিষয় কাজের বুয়া সমস্যা।

পার্টি জমে উঠেছে। হঠাৎ মেয়েদের মধ্যে কেউ বিস্মিত গলায় আঙুল উঁচিয়ে বলল, এটা কী?

আমরা সবাই তাকালাম। সুইমিং পুলের পেছনে জবা গাছের ঝাড়। ঘন জঙ্গলের মতো হয়ে আছে। সেই ঘন জংলায় একটি মেয়েমানুষের মূর্তি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মূর্তিটি মনে হচ্ছে আলোর তৈরি। সে দাঁড়ানো থেকে বসছে, আবার উঠে দাঁড়াচ্ছে।

সবাই হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছি। নুহাশ পল্লীর একজন কর্মচারী কে? কে? বলে জংলার দিকে ছুটে যেতেই ছায়ামূর্তি সবার চোখের সামনে মিলিয়ে গেল।

পার্টি ভেঙে গেল। সবাই ঘরে চলে এলাম। যে মেয়েটি প্রথম ছায়ামূর্তি দেখেছে সে অসুস্থ হয়ে পড়ল। তার মাথায় পানি ঢালা হতে লাগল।

প্রায় চল্লিশজন অতিথির সবাই স্বীকার করলেন, তার ব্যাখ্যার অতীত একটি ঘটনা দেখলেন। এদের মধ্যে ঔপন্যাসিক মঈনুল আহসান সাবেরও ছিলেন। যদিও তিনি ঢাকায় এসে এই বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলেন। তার ধারণা নুহাশ পল্লীর লোকজন ছাদ থেকে নানান ধরনের আলো ফেলে এই ছায়ামূর্তি তৈরি করেছে।

তার ধারণা সত্যি নয়। নুহাশ পল্লীর বাংলোতে ছাদে ওঠার কোনো ব্যবস্থা নেই। ব্যবস্থা থাকলেও আমাদের হাতে এমন কোনো যন্ত্রপাতি নেই যা দিয়ে এমন স্পষ্ট ছায়ামূর্তি (যা উঠবোস করে) তৈরি করা যায়। স্পিলবার্গের কাছে থাকলেও থাকতে পারে।

প্রিয় পাঠক! আমি আপনাকে ভূতে বিশ্বাস করাতে চাচ্ছি না। শুধু বলতে চাচ্ছি, জগতে কিছু ব্যাখ্যার অতীত ঘটনা ঘটে। ঘটনা ঘটে বলেই জগতটাকে ‘Interesting’ মনে হয়।

আমি আমার এক জীবনে (ষাট বছরে) অনেক ব্যাখ্যার অতীত ঘটনার মুখোমুখি হয়েছি। একটি বলি।

১৯৭১ সন। এপ্রিল মাস। আমরা পিরোজপুরে আছি। মিলিটারি তখনো পিরোজপুরে আসে নি। ভয়ে-আতঙ্কে সবাই অস্থির। এক ভোরবেলার ঘটনা। সব ভাইবোনরা মা’কে ঘিরে আছি। কারণ তিনি না-কি রাতে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছেন। স্বপ্নটা বলছেন।

 “আমি স্বপ্নে দেখলাম এই বাড়িটাই। তোরা এখন যেমন আমাকে ঘিরে বসে আছিস—স্বপ্নেও সেরকম আমাকে ঘিরে বসা। হঠাৎ সেখানে নয় দশ বছরের একটা মেয়ে ঢুকে বলল, আমার নাম লতিফা। আপনি কি আমাকে চিনেছেন?”

আমার মা স্বপ্নের এই অংশটি বলে শেষ করতেই নয়-দশ বছরের একটি মেয়ে চুকল। স্পষ্ট গলায় বলল, “আমার নাম লতিফা। আপনি কি আমাকে চিনেছেন? আমরা বাগেরহাট থেকে মিলিটারির ভয়ে পালিয়ে এসেছি। এখন আপনাদের সঙ্গে থাকব।…”

এই ঘটনার ব্যাখ্যা কি সত্যিই আছে?

আমার বিরুদ্ধে প্রচুর অভিযোগের একটি হচ্ছে, আমি ভূত নামক অর্থহীন বিষয় নিয়ে প্রচুর গল্প লিখি। এবং পাঠককে বাধ্য করি ভূতে বিশ্বাস করাতে। তারা শেষ পর্যন্ত ভূতে বিশ্বাস করে এবং মহাসমস্যায় পড়ে।

বাংলা সাহিত্যের একটা বড় অংশ জুড়েই যে ভূত আছে তা কি পাঠকরা। জানেন? বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে ভূত বিশ্বাস করতেন। পরকালে বিশ্বাস করতেন। ভূত বিষয়ে তার অসাধারণ সব গল্প আছে। তার একটি উপন্যাস দেবযান পরকাল নিয়ে লেখা। বিভূতিভূষণের মৃত্যুও কিন্তু যথেষ্টই রহস্যময়। তিনি তখন থাকেন ঘাটশিলায়। এক সন্ধ্যায় বেড়াতে বের হয়েছেন—হঠাৎ দেখেন একদল শবযাত্রী খাঁটিয়াতে করে শবদেহ নিয়ে যাচ্ছে। তারা বিভূতিভূষণকে দেখে খাঁটিয়া নামালো। তিনি খাঁটিয়ার কাছে গিয়ে দেখেন, শবদেহ আর কারোর না। তার নিজের। তিনি নিজের মৃতদেহ দেখে ছুটে বাড়িতে এসেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন। সে অসুস্থতাতেই তাঁর মৃত্যু।

বাংলা সাহিত্যের আরেক দিকপাল লেখকের নাম বনফুল (বলাইচাঁদ মুখাপাধ্যায়)। তিনি ভূত-প্রেত মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন। প্রচলিত আছে তার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বললেই একজন ঘোর নাস্তিকও আস্তিক হয়ে ফিরত।

অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত আমার প্রিয় লেখকদের একজন (প্রথম কদম ফুল,..)। তিনি শুধু যে ভূত বিশ্বাস করতেন তা-না, নিয়মিত ভূত-প্রেতের সঙ্গে কথাবার্তাও বলতেন।

‘রবীন্দ্রনাথের প্রেতচর্চা’ নামের একটা বই পড়ে জেনেছি পরকাল বিষয়ে তাঁর আগ্রহের কথা। পরকাল, জন্মান্তর, ভূত-প্রেত বিষয়ে তাঁর চিন্তার সার কথা তিনি লিখেছেন এই কয়েকটি লাইনে—

“চিরকাল এইসব রহস্য আছে নীরব
রুদ্ধ ওষ্ঠাধর।
জন্মান্তের নবপ্রাতে, সে হয়তো আপনাতে
পেয়েছে উত্তর।”

.

কয়েকদিন আগে আমার স্ত্রী শাওনের একটি ভৌতিক অভিজ্ঞতা হয়েছে। তার ওপর ভিত্তি করে একটা গল্প লেখা শুরু করেছি, নাম–”কে?” আমার সব অতিপ্রাকৃত গল্পে ‘Personal experience’-এর কিছু ব্যাপার থাকে। অন্যের অভিজ্ঞতা যে ধার করি না তাও না।

বলপয়েন্ট লিখতে গিয়ে মনে হচ্ছে ছোট্ট ভুল অতীতে করেছি। আমার লেখা প্রতিটি অতিপ্রাকৃত গল্পের ভূমিকা থাকা বাঞ্ছনীয় ছিল। গল্পটা কেন লিখলাম। শানে নজুলটা কী। এখন থেকে তাই করব।

যাই হোক, শাওনের ভৌতিক অভিজ্ঞতার গল্পটি করি। জাদুকর জুয়েল আইচ এই অভিজ্ঞতার লৌকিক ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে চেষ্টা করেছেন। আমি তার ব্যাখার সঙ্গে একমত নই। কারণ শাওনের ভৌতিক অভিজ্ঞতার সঙ্গে আমিও কিছুটা যুক্ত।

স্থান নুহাশ পল্লী। রাত দুটা। ঈদের নাটকের শুটিং (এনায়েত আলীর ছাগল) এইমাত্র শেষ হয়েছে। আমরা ঘুমুতে এসেছি। আলো থাকলে আমার ঘুম আসে না। বাতি নেভানো। আলো ছাড়া পুত্র নিষাদ ঘুমুতে পারে না। করিডোরের বাতি জ্বালানো। দরজা অর্ধেক খোলা। খোলা দরজায় যথেষ্টই আলো আসছে। সারাদিনের পরিশ্রমে বিছানায় যাওয়া মাত্রই তিনজনই গভীর ঘুমে। এই সময় শীওন একটা দুঃস্বপ্ন দেখল। দুঃস্বপ্নে কে যেন তার গা ঘেঁসে শুয়ে আছে। আমি তাকে বলছি–এই, তোমার পাশে এটা কী? শাওন জেগে উঠল। শাওনের স্বভাব। হচ্ছে, রাতে যে-কোনো কারণে ঘুম ভাঙলেই আমাকে ডাকবে। আমার কাঁচা ঘুম। ভাঙার যন্ত্রণা সে আমলেই নেবে না। সে যথারীতি আমাকে ডেকে তুলল। বলল, ভয় পেয়েছি। পানি খাব। তার হাতের কাছেই পানির বোতল। সেই বোতল। আমাকে তুলে দিতে হলো। পানি খেয়ে আবার ঘুমুতে গেল। আবার ঘুম ভাঙল। এবার দুঃস্বপ্ন দেখে না। তার কাছে মনে হলো, কে যেন তার পিঠে হাত রেখেছে। সে ধড়মড় করে উঠে বসে দেখল—খাটের পাশে হাঁটু গেড়ে একজন বসে আছে। চাঁদরে তার গা ডাকা। তার মুখ দেখা যাচ্ছে না, কারণ করিডোরের বাতি নিভানো। শাওন বিকট চিৎকার শুরু করল, এটা কী? এটা কী?

তার চিৎকারে আমার ঘুম ভাঙল। পুত্র নিষাদ জেগে উঠে কান্না শুরু করল। শাওন চিৎকার করেই যাচ্ছে, এটা কী? এটা কী?

হাঁটু গেড়ে যে বসে ছিল সে উঠে দাঁড়াল। শান্ত ভঙ্গিতে শোবার ঘর থেকে করিডোরে গেল। ততক্ষণে আমার সংবিত খানিকটা ফিরেছে। শাওন যেদিকে আঙুল দেখাচ্ছে আমি সেদিকে তাকালাম। আমার চোখে চশমা নেই, আমি স্পষ্ট কিছু দেখছি না। তারপরেও মূর্তিকে দেখলাম। সে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে করিডোরের শেষপ্রান্তের দরজা বন্ধ করল। আমার কাছে মনে হলো নারী মূর্তি।

এর মধ্যে ঘরের বাতি জ্বালানো হয়েছে। আমি দৌড়ে গিয়ে করিডোরের দরজা খুলেছি। কোথাও কেউ নেই।

জুয়েল আইচ বললেন, ভূত-প্রেত কিছু হতেই পারে না। যে ঘরে ঢুকেছে সে মানুষ। কারণ করিডোরের বাতি আগে জ্বালানো ছিল। যে ঘরে ঢুকেছে সে নিজের পরিচয় গোপন রাখার জন্যে বাতি নিভিয়ে ঢুকেছে।

যুক্তি আমার কাছে গ্রহণযোগ্য না। কারণ সে ঘরে ঢুকে হাঁটু গেড়ে পিঠে হাত রেখে বসে থাকবে কেন? আমাদের সম্মিলিত বিকট চিঙ্কারেও তার কোনো বিকার হবে না কেন? দৌড়ে পালিয়ে না গিয়ে সে কেন অতি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হেঁটে বের হবে?

নুহাশ পল্লীতে আমি যখন রাত্রি যাপন করি, তখন দু’জন সিকিউরিটি গার্ড সারারাত জেগে বাড়ি পাহারা দেয়। কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে কারো আমার শোবার ঘরে ঢোকার প্রশ্নই আসে না।

ঘটনা যা ঘটেছে তা দিয়েই চমৎকার একটা ভূতের গল্প লেখা যায়। বাড়তি আমি যা যোগ করব বলে ভেবে রেখেছি তা হলো, পরদিন দেখা গেল শাওনের পিঠে মানুষের হাতের ছাপের মতো কালো ছাপ। সেই ছাপে পাঁচটা আঙুলের জায়গায় ছয়টা আঙুল।

ভৌতিক গল্পের উপকরণ আমি সবসময় হাতের কাছেই পাই। গ্রামের বাড়িতে মন্তাজ মিয়া নামের একটি নয়-দশ বছরের বালকের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। বালকটি মারা গিয়েছিল। তাকে কবর দেয়া হয়েছিল। চব্বিশ ঘণ্টা পর কবর খুঁড়ে তাকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। তেমন কোনো রদবদল ছাড়াই বালকটির সঙ্গে আমার কথাবার্তা যা হয়েছিল তা নিয়ে একটি গল্প লিখি। পাঠকদের জন্যে গল্পটা দিয়ে দিলাম।

ছায়াসঙ্গী

প্রতিবছর শীতের ছুটির সময় ভাবি কিছুদিন গ্রামে কাটিয়ে আসব। দলবল নিয়ে যাব—হৈচৈ করা যাবে। আমার বাচ্চারা কখনো গ্রাম দেখে নি, তারা খুশি হবে। পুকুরে ঝাপাঝাপি করতে পারবে। শাপলা ফুল শুধু যে মতিঝিলের সামনেই ফোটে না, অন্যান্য জায়গাতেও ফোটে তাও স্বচক্ষে দেখবে।

আমার বেশির ভাগ পরিকল্পনাই শেষ পর্যন্ত কাজে লাগাতে পারি না। এটা কেমন করে জানি লেগে গেল। একদিন সত্যি সত্যি রওনা হলাম।

আমাদের গ্রামটাকে অজপাড়াগাঁ বললেও সম্মান দেখানো হয়। যোগাযোগ ব্যবস্থার এমন সুন্দর সময়েও সেখানে পৌঁছতে হয় গরুর গাড়িতে। বর্ষার সময়। নৌকা, তবে মাঝখানে একটা হাওড় পড়ে বলে সেই যাত্রী অগস্ত্যযাত্রার মতো।

অনেকদিন পর গ্রামে গিয়ে ভালো লাগল। দেখলাম আমার বাচ্চাদের আনন্দ বর্ধনের সব ব্যবস্থাই নেয়া হয়েছে। কোত্থেকে যেন একটা হাড় জিরজিরে বেতো ঘোড়া জোগাড় করা হয়েছে। এই ঘোড়া নড়াচড়া করে না, এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে। খুব বেশি বিরক্ত হলে দীর্ঘনিঃশ্বাসের মতো একটা শব্দ করে এবং লেজটা নাড়ে। বাচ্চারা এত বড় একটা জীবন্ত খেলনা পেয়ে মহাখুশি, দু’তিনজন একসঙ্গে ঘোড়ার পিঠে বসে থাকে।

তাদের অসংখ্য বন্ধুবান্ধবও জুটে গেল। যেখানেই যায় তাদের সঙ্গে গোটা পঞ্চাশেক ছেলেপুলে থাকে। আমার বাচ্চারা যা করে তাতেই তারা চমৎকৃত হয়। আমার বাচ্চারা তাদের বিপুল জনপ্রিয়তায় অভিভূত। তারা তাদের যাবতীয় প্রতিভা দেখাতে শুরু করল—কেউ কবিতা বলছে, কেউ গান, কেউ ছড়া।

আমি একগাদা বই সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলাম। আমার পরিকল্পনা পুরোপুরি বিশ্রাম নেয়। শুয়ে-বসে বই পড়া, খুব বেশি ইচ্ছা করলে খাতা-কলম নিয়ে বসা। একটা উপন্যাস অর্ধেকের মতো লিখেছিলাম, বাকিটা কিছুতেই লিখতে ইচ্ছা করছিল না। পাণ্ডুলিপি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি, নতুন পরিবেশে যদি লিখতে ইচ্ছা করে।

প্রথম কিছুদিন বই বা লেখা কোনোটাই নিয়ে বসা গেল না। সারাক্ষণই লোকজন আসছে। তারা অত্যন্ত গম্ভীর গলায় নানা জটিল বিষয় নিয়ে আলোচনায় উৎসাহী। এসেই বলবে–দেশের অবস্থা কী কন দেহি ছোড মিয়া! বড়ই চিন্তাযুক্ত আছি। দেশের হইলডা কী? কী দেশ ছিল আর কী হইল!

দিন চার-পাঁচেকের পর সবাই বুঝে গেল দেশ সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। গল্পগুজবও তেমন করতে পারি না। তারা আমাকে রেহাই দিল আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। গ্রামের নতুন পরিবেশের কারণেই হোক বা অন্য কোনো কারণেই হোক, আমি লেখালেখির প্রবল আগ্রহ বোধ করলাম। অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপি নিয়ে বসলাম, সারাদিন লেখালেখি কাটাকুটি করি। সন্ধ্যায় স্ত্রীকে সঙ্গে করে বেড়াতে বের হই। চমৎকার লাগে। প্রায় রাতেই একজন দু’জন করে ‘গাতক’ আসে। এরা জ্যোস্নাভেজা উঠোনে বসে চমৎকার গান ধরে —

ও মনা
এই কথাটা না জানলে প্রাণে বাঁচতাম না।
না না আমি প্রাণে বাঁচতাম না।

সময়টা বড় চমৎকার কাটতে লাগল। লেখার ব্যাপারে আগ্রহ বাড়তেই লাগল। সারাদিনই লিখি।

এক দুপুরের কথা। একমনে লিখছি। জানালার ওপাশে খুট করে শব্দ হলো। তাকিয়ে দেখি খালি গায়ে রোগামতো দশ-এগারো বছরের একটা ছেলে গভীর আগ্রহে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওকে আগেও দেখেছি। জানালার ওপাশ থেকে গভীর কৌতূহলে সে আমাকে দেখে। চোখে চোখ পড়লেই পালিয়ে যায়। আজ পালাল না।

আমি বললাম, কী রে?

 সে মাথাটা চট করে নামিয়ে ফেলল।

আমি বললাম, চলে গেলি নাকি?

ও আড়াল থেকে বলল, না।

নাম কী রে তোর?

মন্তাজ মিয়া।

আয়, ভেতরে আয়।

না।

আর কোনো কথাবার্তা হলো না। আমি লেখায় ডুবে গেলাম। ঘুঘু ডাকা শ্রান্ত দুপরে লেখালেখির আনন্দই অন্যরকম। মন্তাজ মিয়ার কথা ভুলে গেলাম।

পরদিন আবার একই ব্যাপার। জানালার ওপাশে মন্তাজ মিয়া বড় বড় কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে আছে। আমি বললাম, কী ব্যাপার মন্তাজ মিয়া? আয় ভেতরে।

সে ভেতরে ঢুকল।

আমি বললাম, থাকিস কোথায়?

উত্তরে পোকা খাওয়া দাঁত বের করে হাসল।

স্কুলে যাস না?

আবার হাসি। আমি খাতা থেকে একটা সাদা কাগজ ছিঁড়ে তার হাতে দিলাম। সে তার এই বিরল সৌভাগ্যে অভিভূত হয়ে গেল। কী করবে বুঝতে পারছে না। কাগজটার গন্ধ শুকল। গালের ওপর খানিকক্ষণ চেপে ধরে রেখে উল্কার বেগে বেরিয়ে গেল।

রাতে খেতে খেতে আমার ছোট চাচা বললেন, মন্তাজ হারামজাদা তোমার কাছে নাকি আসে? আসলে একটা চড় দিয়ে বিদায় করবে।

কেন?

বিরাট চোর। যা-ই দেখে তুলে নিয়ে যায়। ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে দিবে না। দুইদিন পরপর মার খায়। তাতেও হুঁশ হয় না। তোমার এখানে এসে করে কী?

কিছু করে না।

চুরির সন্ধানে আছে। কে জানে এর মধ্যে হয়তো তোমার কলম-টলম নিয়ে নিয়েছে।

না, কিছু নেয় নি।

ভালো করে খুঁজে-টুজে দেখ। কিছুই বলা যায় না। ঐ ছেলের ঘটনা আছে।

কী ঘটনা।

আছে অনেক ঘটনা। বলব একসময়।

পরদিন সকালে যথারীতি লেখালিখি শুরু করেছি। হৈচৈ শুনে বের হয়ে এলাম। অবাক হয়ে দেখি, মন্তাজ মিয়াকে তিনচারজন চ্যাংদোলা করে নিয়ে এসেছে। ছেলেটা ফেঁপাচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে প্রচণ্ড মার খেয়েছে। ঠোঁট ফেটে রক্ত পড়ছে। একদিকে গাল ফুলে আছে।

আমি বললাম, কী ব্যাপার?

শাস্তিদাতাদের একজন বলল, দেখেন তো কলমটা আপনের কি-না। মন্তাজ হারামজাদার হাতে ছিল।

দেখলাম কলমটা আমারই। চার-পাঁচ টাকা দামের বলপয়েন্ট। এমন কোনো মহার্ঘ বস্তু নয়। আমার কাছে চাইলেই দিয়ে দিতাম। চুরি করার প্রয়োজন ছিল না। মনটা একটু খারাপই হলো। বাচ্চাবয়সে ছেলেটা এমন চুরি শিখল কেন? বড় হয়ে এ করবে কী?

ভাইসাব, কলমটা আপনার?

হ্যাঁ। তবে আমি এটা ওকে দিয়ে দিয়েছি। ছেড়ে দিন। বাচ্চাছেলে, এত মারধর করেছেন কেন? মারধর করার আগে আমাকে জিজ্ঞেস করে নেবেন না?

শাস্তিদাতা নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, এই মাইরে ওর কিছু হয় না। এইডা এর কাছে পানিভাত। মাইর না খাইলে এর ভাত হজম হয় না।

মন্তাজ মিয়া বিস্মিত চোখে আমাকে দেখছে। তাকে দেখেই মনে হলো, সে তার ক্ষুদ্র জীবনে এই প্রথম একজনকে দেখছে যে চুরি করার পরও তাকে চোর। বলে নি। মন্তাজ মিয়া নিঃশব্দে বাকি দিনটা জানালার ওপাশে বসে রইল। অন্যদিন তার সঙ্গে দু’একটা কথাবার্তা বলি। আজ একটা কথাও বলা হলো না। মেজাজ খারাপ হয়েছিল। এই বয়সে একটা ছেলে চুরি শিখবে কেন?

মন্তাজ মিয়ার যে একটা বিশেষ ঘটনা আছে তা জানলাম আমার ছোট চাচির কাছে। চুরির ঘটনারও দুদিন পর। গ্রামের মানুষদের এই একটা অদ্ভুত ব্যাপার। কোন্ ঘটনা যে গুরুত্বপূর্ণ, কোটা তুচ্ছ তা এরা বুঝতে পারে না। মন্তাজ মিয়ার জীবনের এত বড় একটা ব্যাপার কেউ আমাকে এতদিন বলে নি, অথচ তুচ্ছ সব বিষয় অনেকবার করে শোনা হয়ে গেছে।

মন্তাজ মিয়ার ঘটনাটা এই—

তিন বছর আগে কার্তিক মাসের মাঝামাঝি মন্তাজ মিয়া দুপুরে প্রবল জ্বর নিয়ে বাড়ি ফেরে। সেই জ্বরের প্রকোপ এতই বেশি যে শেষ পর্যন্ত মন্তাজ মিয়ার হতদরিদ্র বাবা একজন ডাক্তারও নিয়ে এলেন। ডাক্তার আনার কিছুক্ষণের মধ্যেই মন্তাজ মিয়া মারা গেল। গ্রামে জন্ম এবং মৃত্যু দুটোই বেশ স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করা হয়। মন্তাজ মিয়ার মা কিছুক্ষণ চিৎকার করে কাদল। তার বাবাও খানিকক্ষণ ‘আমার পুত কই গেল রে!’ বলে চেঁচিয়ে স্বাভাবিক হয়ে গেল। বেঁচে থাকার প্রবল সংগ্রামে তাদের লেগে থাকতে হয়। পুত্রশোকে কাতর হলে চলে না।

মরা মানুষ যত তাড়াতাড়ি কবর দিয়ে দেয়া হয় ততই নাকি সোয়াব এবং কবর দিতে হয় দিনের আলো থাকতে থাকতে। কাজেই জুম্মাঘরের পাশে বাদ আসর মন্তাজ মিয়ার কবর হয়ে গেল। সবকিছুই খুব স্বাভাবিকভাবে।

অস্বাভাবিক ব্যাপারটা শুরু হলো দুপুররাতের পর। যখন মন্তাজ মিয়ার বড় বোন রহিমা কলমাকান্দী থেকে উপস্থিত হলো। কলমাকান্দা এখান থেকে একুশ মাইল। এই দীর্ঘ পথ একটি গর্ভবতী মহিলা পায়ে হেঁটে চলে এল এবং বাড়িতে পা দিয়েই চেঁচিয়ে বলল, তোমরা করছ কী? মন্তাজ বাইচ্যা আছে। কবর খুঁইড়া তারে বাইর কর। দিরং করবা না।

বলাই বাহুল্য, কেউ তাকে পাত্তা দিল না। শোকে-দুঃখে মানুষের মাথা খারাপ হয়ে যায়। কবর দিয়ে দেয়ার পর নিকট আত্মীয়স্বজনরা সবসময় বলে—‘ও মরে নাই।’ কিন্তু মন্তাজ মিয়ার বোন রহিমা এই ব্যাপারটা নিয়ে এতই হৈচৈ শুরু করল যে, সবাই বাধ্য হলো মৌলানা সাহেবকে ডেকে আনতে।

 রহিমা মৌলানা সাহেবের পায়ে গিয়ে পড়ল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, মন্তাজ বাইচ্যা আছে—আপনে এরে বাঁচান। আপনে না বললে কবর খুঁড়ত না। আপনে রাজি না হওয়া পর্যন্ত আমি পাও ছাড়তাম না। মৌলানা সাহেব অনেক চেষ্টা করেও রহিমাকে ঝেড়ে ফেলতে পারলেন না। রহিমা বজ্র আঁটুনিতে পা ধরে বসে রইল।

মৌলানা সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, বাইচ্যা আছে বুঝলা ক্যামনে?

রহিমা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, আমি জানি।

গ্রামের মৌলানারা অতি কঠিন হৃদয়ের হয় বলে আমাদের একটা ধারণী আছে। এই ধারণা সত্যি নয়। মৌলানা সাহেব বললেন, প্রয়োজনে কবর দ্বিতীয়বার খোঁড়া জায়েজ আছে। এই মেয়ের মনের শান্তির জন্যে এটা করা যায়। হাদিস শরীফে আছে…

কবর খোঁড়া হলো।

 ভয়াবহ দৃশ্য!

মন্তাজ মিয়া কবরের গায়ে হেলান দিয়ে বসে আছে। পিটপিট করে তাকাচ্ছে। হঠাৎ চোখে প্রবল আলো পড়ায় চোখ মেলতে পারছে না। কাফনের কাপড়ের একখণ্ড লুঙ্গির মতো পেঁচিয়ে পরা। অন্য দুটি খণ্ড সুন্দর করে ভাঁজ করা।

অসংখ্য মানুষ জমা হয়ে আছে। এই অবিশ্বাস্য দৃশ্য দেখে কারো মুখে। কোনো কথা সরল না। মৌলানা সাহেব বললেন, কী রে মন্তাজ?

মন্তাজ মৃদুস্বরে বলল, পানির পিয়াস লাগছে।

মৌলানা সাহেব হাত বাড়িয়ে তাকে কবর থেকে তুললেন।

এই হচ্ছে মন্তাজ মিয়ার গল্প। আমি আমার এই জীবনে অদ্ভুত গল্প অনেক শুনেছি। এরকম কখনো শুনি নি।

ছোট চাচাকে বললাম, মন্তাজ তারপর কিছু বলে নি? অন্ধকার কবরে জ্ঞান ফিরবার পর কী কী দেখল না-দেখল এইসব?

ছোট চাচা বললেন, না। কিছু কয় না। হারামজাদা বিরাট বজ্জাত।

জিজ্ঞেস করেন নি কিছু?

কত জনে কত জিজ্ঞেস করছে। এক সাংবাদিকও আসছিল। ছবি তুলল। কত কথা জিজ্ঞেস করল–একটা শব্দ করে না। হারামজাদা বদের হাড়ি।

আমি বললাম, কবর থেকে ফিরে এসেছে–লোকজন তাকে ভয়-টয় পেত না?  

প্রথম প্রথম পাইত। তারপর আর না। আল্লাতালার কুদরত। আল্লাতালার কেরামতি আমরা সামান্য মানুষ কী বুঝব কও?

তা তো বটেই। আপনারা তার বোন রহিমাকে জিজ্ঞেস করেন নি সে কী করে বুঝতে পারল মন্তাজ বেঁচে আছে?

জিজ্ঞেস করার কিছু নাই। এইটাও তোমার আল্লার কুদরত। উনার কেরামতি।

ধর্মকর্ম করুক বা না করুক, গ্রামের মানুষদের আল্লাহতায়ালার কুদরত এবং কেরামতির ওপর অসীম ভক্তি। গ্রামের মানুষদের চরিত্রে চমৎকার সব দিক আছে। অতি তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে এরা প্রচুর মাতামাতি করে, আবার অনেক বড় বড় ঘটনা হজম করে। দার্শনিকের মতো গলায় বলে, আল্লার কুদরত।

আমি ছোট চাচাকে বললাম, রহিমাকে একটু খবর দিয়ে আনানো যায় না?

ছোট চাচা বিস্মিত হয়ে বললেন, কেন?

কথা বলতাম।

খবর দেওয়ার দরকার নাই। এম্নেই আসব।

এম্নিতেই আসবে কেন?

ছোট চাচা বললেন, তুমি পুলাপনি নিয়া আসছ। চাইরদিকে খবর গেছে। এই গ্রামের যত মেয়ের বিয়া হইছে সব অখন নাইওর আসব। এইটাই নিয়ম।

আমি অবাক হলাম। সত্যি সত্যি এটাই নাকি নিয়ম। গ্রামের কোনো বিশিষ্ট মানুষ আসা উপলক্ষে গ্রামের সব মেয়ে নাইওর আসবে। বাপের দেশে আসার এটা তাদের একটা সুযোগ। এই সুযোগ তারা নষ্ট করবে না।

আমি আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কেউ কি এসেছে?

আসব না মানে? গেরামের একটা নিয়মশৃখলা আছে না?

আমি ছোট চাচাকে বললাম, আমাদের উপলক্ষে যেসব মেয়ে নাইওর আসবে তাদের প্রত্যেককে যেন একটা করে দামি শাড়ি উপহার হিসেবে দেয়া হয়। একদিন খুব যত্ন করে দাওয়াত খাওয়ানো হয়।

ছোট চাচা এটা পছন্দ করলেন না, তবে তার রাজি না হয়েও কোনো উপায় ছিল না। আমাদের জমিজমা তিনি দীর্ঘদিন ধরে ভোগদখল করছেন।

গ্রামের নিয়মমতো একসময় রহিমাও এল। সঙ্গে চারটি ছোট ছোট ছেলেমেয়ে। হতদরিদ্র অবস্থা। স্বামীর বাড়ি থেকে সে আমার জন্যে দু’টা ডালিম নিয়ে এসেছে।

আমার স্ত্রী তাকে খুব যত্ন করে খাওয়াল। খাওয়ার শেষে তাকে শাড়িটি দেয়া হলো। মেয়েটি অভিভূত হয়ে গেল। একরকম একটা উপহার বোধহয় তার কল্পনাতেও ছিল না। তার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগল। আমি তাকে আমার ঘরে ডেকে নিলাম। কোমল গলায় বললাম, কেমন আছ রহিমা?

রহিমা ফিসফিস করে বলল, ভালো আছি ভাইজান।

 শাড়ি পছন্দ হয়েছে?

পছন্দ হইব না! কী কন ভাইজান? অত দামি জিনিস কি আমরা কোনোদিন চউক্ষে দেখছি?

তোমার ভাইয়ের ব্যাপারটা জানতে চাচ্ছিলাম। তুমি কী করে বুঝলে ভাই বেঁচে আছে?

রহিমা অনেকটা চুপ করে থেকে বলল, কী কইরা বুঝলাম আমি নিজেও জানি ভাইজান। মৃত্যুর খবর শুইন্যা দৌড়াইতে দৌড়াইতে আসছি। বাড়ির উঠানে পাও দিতেই মনে হইল মন্তাজ বাঁইচ্যা আছে।

কী জন্যে মনে হলো?

জানি না ভাইজান! মনে হইল।

এই রকম কি তোমার আগেও হয়েছে? মানে কোনো ঘটনা আগে থেকেই কি তুমি বলতে পার?

জি-না।

মন্তাজ তোমাকে কিছু বলে নি? জ্ঞান ফিরলে সে কী দেখল বা তার কী মনে হলো?

জি-না।

জিজ্ঞেস কর নি?

করছি। হারামজাদা কথা কয় না।

রহিমা আরো খানিকক্ষণ বসে পান-টান খেয়ে চলে গেল।

আমার টানা লেখালেখিতে ছেদ পড়ল। কিছুতেই আর লিখতে পারি না। সবসময় মনে হয়, বাচ্চা একটি ছেলে কবরের বিকট অন্ধকারে জেগে উঠে কী ভাবল? কী সে দেখল। তখন তার মনের অনুভূতি কেমন ছিল?

মন্তাজ মিয়াকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করে, আবার মনে হয়—জিজ্ঞেস করাটা ঠিক হবে না। সবসময় মনে হয় বাচ্চা একটি ছেলেকে ভয়স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়াটা অন্যায় কাজ। এই ছেলে নিশ্চয়ই প্রাণপণে এটা ভুলতে চেষ্টা করছে। ভুলতে চেষ্টা করছে বলেই কাউকে কিছু বলতে চায় না। তবু একদিন কৌতূহলের হাতে পরাজিত হলাম।

.

দুপুরবেলা।

গল্পের বই নিয়ে বসেছি। পাড়াগাঁর ঝিম ধরা দুপুর। একটু যেন ঘুমঘুম আসছে। জানালার বাইরে খুট করে শব্দ হলো। তাকিয়ে দেখি মন্তাজ। আমি বললাম, কী খবর মন্তাজ?

ভালো।

বোন আছে না চলে গেছে?

গেছে গা।

আয় ভেতরে আয়।

মন্তাজ ভেতরে চলে এল। আমার সঙ্গে তার ব্যবহার এখন বেশ স্বাভাবিক। প্রায়ই খানিকটা গল্পগুজব হয়। মনে হয় আমাকে সে খানিকটা পছন্দ করে। এইসব ছেলেরা ভালোবাসার খুব কাঙাল হয়। অল্পকিছু মিষ্টি কথা, সামান্য একটু আদর—এতেই তারা অভিভূত হয়ে যায়। এইক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে বলে আমার ধারণা।

মন্তাজ এসে খাটের একপ্রান্তে বসল। আড়ে আড়ে আমাকে দেখতে লাগল। আমি বললাম, তোর সঙ্গে কয়েকটা কথা বলি, কেমন?

আইচ্ছা।

ঠিকমতো জবাব দিবি তো?

হ।

আচ্ছা মন্তাজ, কবরে তুই জেগে উঠেছিলি, মনে আছে?

আছে।

যখন জেগে উঠলি তখন ভয় পেয়েছিলি?

না।

কেন?

মন্তাজ চুপ করে রইল। আমার দিক থেকে অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে নিল। আমি বললাম, কী দেখলি—চারদিকে অন্ধকার?

হ।

কেমন অন্ধকার?

মন্তাজ এবারো জবাব দিল না। মনে হচ্ছে সে বিরক্ত হচ্ছে।

আমি বললাম, কবর তো খুব অন্ধকার। তবু ভয় লাগল না?

মন্তাজ নিচুস্বরে বলল, আরেকজন আমার সাথে আছিল, সেইজন্যে ভয় লাগে নাই।

আমি চমকে উঠে বললাম, আরেকজন ছিল মানে? আরেকজন কে ছিল?

 চিনি না। আন্ধাইরে কিচ্ছু দেখা যায় না।

ছেলে না মেয়ে?

জানি না।

 সে কী করল?

আমারে আদর করল। আর কইল, কোনো ভয় নাই।

কীভাবে আদর করল?

মনে নাই।

কী কী কথা সে বলল?

মজার মজার কথা—খালি হাসি আসে।

বলতে বলতে মন্তাজ মিয়া ফিক করে হেসে ফেলল।

আমি বললাম, কী রকম মজার কথা? দু’একটা বল তো শুনি?

মনে নাই।

কিছুই মনে নাই? সে কে—এটা কি বলেছে?

জি-না।

ভালো করে ভেবেটেবে বল তো কোনোকিছু কি মনে পড়ে?

উনার গায়ে শ্যাওলার মতো গন্ধ ছিল।

আর কিছু?

মন্তাজ মিয়া চুপ করে রইল।

আমি বললাম, ভালো করে ভেবে-টেবে বল তো। কিছুই মনে নেই?

মন্তাজ মিয়া অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, একটা কথা মনে আসছে।

সেটা কী?

বলতাম না। কথাডাঃ গোপন।

বলবি না কেন?

মন্তাজ জবাব দিল না।

আমি আবার বললাম–বল মন্তাজ, আমার খুব শুনতে ইচ্ছা করছে।

মন্তাজ উঠে চলে গেল।

.

এই তার সঙ্গে আমার শেষ দেখা। বাকি যে কদিন গ্রামে ছিলাম সে কোনোদিন আমার কাছে আসে নি। লোক পাঠিয়ে খবর দিয়েছি, তবু আসে নি। কয়েকবার নিজেই গেলাম। দূর থেকে দেখতে পেয়ে সে পালিয়ে গেল। আমি আর চেষ্টা করলাম না।

কিছু রহস্য সে তার নিজের কাছে রাখতে চায়। রাখুক। এটা তার অধিকার। এই অধিকার অনেক কষ্টে সে অর্জন করেছে। শ্যাওলা-গন্ধী সেই ছায়াসঙ্গীর কথা আমরা যদি কিছু নাও জানি তাতেও কিছু যাবে আসবে না।

১৮.

আমার জোছনাপ্রীতির বিষয়টা এখন অনেকেই জানেন। কেনইবা জানবেন না! জয়ঢাক পিটিয়ে সবাইকে জানিয়েছি। গান লিখেছি—

ও কারিগর দয়ার সাগর ওগো দয়াময়
চান্নিপসর রাইতে যেন আমার মরণ হয়।

 শিল্পী এস আই টুটুল এই গানটির সুরকার। সে নানান অনুষ্ঠানে গানটা করে এবং গলা কাঁপিয়ে আবেগ জর্জরিত ভাষণ দেয়—

আমার স্যার, হমায়ুন আহমেদ, একদিন ডেকে বললেন, টুটুল, চান্নিপসর রাতে আমার মৃত্যু হবে। তখন তুমি এই গানটি আমার মৃতদেহের পাশে বসে গাইবে।

আমি যুক্তিবাদী মানুষ হিসেবে জানি মৃত মানুষ গানবাজনা শুনতে পারে না। সেখানে আমার শবদেহের পাশে টুটুলকে এই গান কেন করতে বলেছি বুঝতে পারছি না। সেই পরিস্থিতিতে টুটুল যদি গিটার বাজিয়ে গানে টান দেয়, তার ফল শুভ হবে বলেও তো মনে হচ্ছে না। মৃত্যুশোকে কাতর শাওন অবশ্যই টুটুলের গলা চেপে ধরবে।

যাই হোক, জোছনা নিয়ে আমার অনেক বাড়াবাড়ি আছে। একসময় নুহাশপল্লীতে প্রতি পূর্ণিমায় জোছনা উৎসব হতো। এখন কিন্তু হয় না। অপূর্ব জোছনা রাতেও দরজা বন্ধ করে আমি ঝিম ধরে থাকি। শাওন খুবই বিস্মিত হয়। সে বলে, আকাশে এত বড় একটা চাঁদ উঠেছে, চল ছাদে যাই। আমি বলি, না।

না কেন?

ইচ্ছা করছে না।

সাম্প্রতিককালে আমি ‘ইচ্ছা করছে না’ ব্যাধিতে আক্রান্ত। চমৎকার সব ঘটনা চারপাশে ঘটছে। সেইসব ঘটনার সঙ্গে যুক্ত হতে ইচ্ছা করে না।

লেখক মাত্রই জীবনে কয়েক দফা ইচ্ছা করে না ব্যাধিতে আক্রান্ত হন। এই ব্যাধি চিকিৎসার অতীত। একটা পর্যায়ে ব্যাধি ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। তখন লেখকের লিখতে ইচ্ছা করে না। তখন অনেকেই আত্মহননের পথ বেছে নেন।

উদাহরণ—

আর্নেস্ট হেমিংওয়ে
মায়াকোভস্কি
কাওয়াবা

লেখালেখি একধরনের থেরাপি। ব্যক্তিগত হতাশা, দুঃখবোধ থেকে বের হয়ে আসার পথ। আমি এই থেরাপি গ্রহণ করে নিজের মনকে সুস্থ রাখার চেষ্টা করি। গ্রাহাম গ্রীনের লেখা থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি—

Writing is a form of therapy; sometimes I wonder how all those who do not write, compose or paint can manage to escape the madness, the melancolia, the panic fear which is inherent in a human situation.

জোছনাপ্রীতি আমার এখনো আছে, প্রবলভাবেই আছে। তবে সাময়িকভাবে নিজেকে শামুকের মতো গুটিয়ে নিয়েছি। বাস করছি আপন অমাবস্যায়। কোনো এক চান্নিপসর রাতে আবারো বের হয়ে আসব। নুহাশ পল্লীতে চন্দ্রউৎসব হবে।

এখন চান্নিপসর আমার মাথায় কী করে ঢুকল সেই গল্প করি। দৈনিক বাংলায় লেখাটা প্রথম ছাপা হয়েছিল। তারিখ মনে নেই।

চান্নিপসর রাইত

আলাউদ্দিন নামে আমার নানাজানের একজন কমলা ছিল। তাকে ডাকা হতো আলাদ্দি। কামলাশ্রেণীর লোকদের পুরো নামে ডাকার চল ছিল না। পুরো নাম ভদ্রলোকদের জন্যে। এদের আবার নাম কী? একটা কিছু ডাকলেই হলো। ‘আলাদ্দি’ যে ডাকা হচ্ছে এই-ই যথেষ্ট।

আলাউদ্দিনের গায়ের রঙ ছিল কুচকুচে কালো। এমন ঘন কৃষ্ণবর্ণ সচরাচর দেখা যায় না। মাথাভর্তি ছিল বাবরি চুল। তার চুলের যত্ন ছিল দেখার মতো। জবজবে করে তেল মেখে মাথাটাকে সে চকচকে রাখত। আমাকে সে একবার কানে কানে বলল, বুঝলা ভাইগ্না ব্যাটা, মানুষের পরিচয় হইল চুলে। যার চুল ঠিক তার সব ঠিক।

কামলাদের মধ্যে আলাউদ্দিন ছিল মহা ফাঁকিবাজ। কোনো কাজে তাকে পাওয়া যেত না। শীতের সময় গ্রামে যাত্রা বা গানের দল আসত, তখন সে অবধারিতভাবে গানের দলের সঙ্গে চলে যেত। মাসখানিক তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যেত না। অথচ শীতের মরশুম হচ্ছে আসল কাজের সময়। এমন ফাঁকিবাজকে কেউ জেনে-শুনে কামলী নেবে না। নানাজান নিতেন, কারণ তার। উপায় ছিল না। আলাউদ্দিন বৈশাখ মাসের শুরুতে পরিষ্কার জামাকাপড় পরে। চোখে সুরমা দিয়ে উপস্থিত হতো। নানাজানের পা ছুঁয়ে সালাম করে তৃপ্ত গলায় বলত, মামুজী, দাখিল হইলাম।

নানাজান চেঁচিয়ে বলতেন, যা হারামজাদা, ভাগ।

আলাউদ্দিন উদাস গলায় বলত, ভাইগ্যা যামু কই? আল্লাপাক কি আমার যাওনের জায়গা রাখছে? রাখে নাই। তার উপরে একটা নয়ন নাই। নয়ন দুইটা ঠিক থাকলে হাঁটা দিতাম। অফমান আর সহ্য হয় না।

এর ওপর কথা চলে না। তাকে আবারো এক বছরের জন্যে রাখা হতো। বারবার সাবধান করে দেয়া হতো যেন গানের দলের সঙ্গে পালিয়ে না যায়। সে আল্লার নামে, পাক কোরানের নামে, নবীজীর নামে কসম কাটত আর যাবে না।

মামুজী, আর যদি যাই তাইলে আপনের গু খাই।

সবই কথার কথা। গানের দলের সঙ্গে তার গৃহত্যাগ ছিল নিয়তির মতো। ফেরানোর উপায় নেই। নানাজান তা ভালোমতোই জানতেন। বড় সংসারে অকর্মা কিছু লোক থাকেই। এদের উপদ্রব সহ্য করতেই হয়।

আলাউদ্দিনের সঙ্গে আমার পরিচয় নানার বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে। আমরা থাকতাম শহরে। বাবা ছুটিছাটায় আমাদের নানার বাড়ি নিয়ে যেতেন। আমরা অল্প কিছুদিন থাকতাম। এই সময়টা সে আমাদের সঙ্গে ছায়ার মতো লেগে থাকত। রাতে গল্প শোনাত। সবই তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার গল্প। তার চেয়েও যা মজার তী হলো, তার প্রতিটি গল্পের শুরু চান্নিপসর রাইতে।

বুঝলা ভাইগ্না ব্যাটা, সেইটা ছেল চান্নিপসর রাইত। আহারে কী চান্নি। আসমান যেন ফাইট্যা টুকরা টুকরা হইয়া গেছে। শইলের লোম দেহা যায় এমুন চান্দের তেজ।

সাধারণত ভূত-প্রেতের গল্পে অমাবস্যার রাত থাকে। গল্পের পরিবেশ সৃষ্টির জন্যে অন্ধকার রাতের দরকার হয়। কিন্তু আলাউদ্দিনের ভূতগুলিও বের হয় চান্নিপসর রাতে। যখন সে বাঘের গল্প বলে, তখন দেখা যায় তার বাঘও চান্নিপসর রাতে পানি খেতে বের হয়।

ছোটবেলায় আমার ধারণা হয়েছিল, এটা তার মুদ্রাদোষ। গল্পে পরিবেশ তৈরির এই একটি কৌশলই সে জানে। দুর্বল গল্পকারের মতো একই টেকনিক সে বারবার ব্যবহার করে।  

একটু যখন বয়স হলো তখন বুঝলাম চাঁদনিপসর রাত আলাউদ্দিনের অত্যন্ত প্রিয়। প্রিয় বলেই এই প্রসঙ্গে সে বারবার ফিরে আসে। সবকিছুই সে বিচার করতে চায় চান্নিপসর রাতের আলোকে। একটা উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করি। নানাজানদের গ্রামের স্কুলের সাহায্যের জন্য একটা গানের আসর হলো। কেন্দুয়া থেকে দু’জন বিখ্যাত বয়াতী আনা হলো। হ্যাজাক লাইট-টাইট জ্বালিয়ে বিরাট ব্যাপার। গান হলো খুব সুন্দর। সবাই মুগ্ধ। শুধু আলাউদ্দিন দুঃখিত গলায় জনে জনে বলে বেড়াতে লাগল, হ্যাজাক বাত্তি দিয়া কি আর গান হয়? এই গান হওয়া উচিত ছিল চান্নিপসর রাইতে। বিরাট বেকুবি হইছে।

সৌন্দর্য আবিষ্কার ও উপলব্ধির জন্যে উন্নত চেতনার প্রয়োজন। তাহলে কি ধরে নিতে হবে আমাদের আলাউদ্দিন উন্নত চেতনার অধিকারী ছিল? যে সৌন্দর্যের উপাসক সে সবকিছুতেই সৌন্দর্য খুঁজে পায়। আলাউদ্দিন তো তা পায় নি। তার সৌন্দর্যবোধ চান্নিপসর রাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। এমন তো হবার কথা না। মনোবিজ্ঞানীরা হয়তো আলাউদ্দিনের জোছনা-প্রীতির অন্য ব্যাখ্যা দেবেন। তারা বলবেন, এই লোকের অন্ধকার-ভীতি আছে। চাঁদের আলোর জন্যে তার এই আকুলতার পেছনে আছে তার আঁধার-ভীতি, Dark Fobia. যে যাই বলুন, আমাকে জোছনা দেখাতে শিখিয়েছে আলাউদ্দিন। রূপ শুধু দেখলেই হয় না, তীব্র অনুভূতি নিয়ে দেখতে হয়। এই পরম সত্য আমি জানতে পারি মহামূর্খ বলে পরিচিত বোকাসোকা একজন মানুষের কাছে। আমার মনে আছে, সে আমাকে এক জোছনা রাতে নৌকা করে বড় গাঙে নিয়ে গেল। যাবার পথে ফিসফিস করে বলল, চান্নিপসর দেখন লাগে পানির উফরে, বুঝলা ভাইগ্নী ব্যাটা। পানির উফরে চান্নির খেলাই অন্যরকম।

সেবার নদীর ওপর চাঁদের ছায়া দেখে তেমন অভিভূত হই নি, বরং নৌকা ডুবে যাবে কি-না এই ভয়েই অস্থির হয়েছিলাম। কারণ নৌকা ছিল ফুটো, গলগল করে তলা দিয়ে পানি ঢুকছিল। ভীত গলায় আমি বললাম, পানি ঢুকছে মামা।

আরে থও ফালাইয়া পানি, চান্নি কেমন হেইডা কও।

খুব সুন্দর।

খাইয়া ফেলতে মনে লয় না কও দেহি?

জোছনা খেয়ে ফেলার তেমন কোনো ইচ্ছা হচ্ছিল না, তবু তাকে খুশি করার জন্যে বললাম, হ্যাঁ। আলাউদ্দিন মহাখুশি হয়ে বলল, আও, তাইলে চান্নিপসর। খাই। বলেই সে আকাশের দিকে তাকিয়ে চাঁদের আলো খাওয়ার ভঙ্গি করতে লাগল। সে এক বিচিত্র দৃশ্য। আমি আমার একটি উপন্যাসে (অচিনপুর) এই দৃশ্য ব্যবহার করেছি। উপন্যাসের একটি চরিত্র নবু মামা জোছনা খেত।

আলাউদ্দিন যে একজন বিচিত্র মানুষ ছিল তা তার আশেপাশের কেউ ধরতে পারে নি। সে পরিচিত ছিল অকর্মা বেকুব হিসেবে। তার জোছনা-প্রীতিও অন্যকেউ লক্ষ করেছে বলে মনে হয় না। তার ব্যাপারে সবাই আগ্রহী হলো যখন সে এক শীতে গানের দলের সঙ্গে চলে গেল, এবং ফিরে এল এক রূপবতী তরুণীকে নিয়ে। তরুণীর নাম দুলারী। তার রূপ চোখ-ঝলসানো রূপ।

নানাজী গম্ভীর গলায় বললেন, এই মেয়ে কে?

আলাউদ্দিন মাথা চুলকে বলল, বিবাহ করেছি মামুজী। বয়স হইছে। সংসারধর্ম করা লাগে। নবীজী সবেরে সংসারধর্ম করতে বলছেন।

সেইটা বুঝলাম। কিন্তু এই মেয়ে কে?

হেইটা মামুজী এক বিরাট ইতিহাস।

ইতিহাসটা শুনি।

ইতিহাস শুনে নানাজান গম্ভীর হয়ে গেলেন। শুকনো গলায় বললেন, এরে নিয়া বিদায় হ! আমার বাড়িতে জায়গা নাই।  

আলাউদ্দিন স্টেশনের কাছে ছাপড়া ঘর তুলে বাস করতে লাগল। ট্রেনের টাইমে স্টেশনে চলে আসে, কুলিগিরি করে। ছোটখাটো চুরিতেও সে অভ্যস্ত হয়ে পড়ল। থানাওয়ালারা প্রায়ই তাকে ধরে নিয়ে যায়। তার বৌ নানাজানের কাছে ছুটে আসে। নানাজান বিরক্তমুখে তাকে ছাড়িয়ে আনতে যান। নিজের মনে গজগজ করেন, এই যন্ত্রণা আর সহ্য হয় না।

নানাজানকে যন্ত্রণা বেশিদিন সহ্য করতে হলো না। আলাউদ্দিনের বৌ এক শীতে এসেছিল, আরেক শীতের আগেই মারা গেল। আলাউদ্দিন স্ত্রীর লাশ কবরে নামিয়ে নানাজানকে এসে কদমবুসি করে ক্ষীণগলায় বলল, দাখিল হইলাম মামুজী।

বছর পাঁচেক পরের কথা। আমার দেশের বাইরে যাওয়া ঠিক হয়েছে। আমি সবার কাছ থেকে বিদায় নেবার জন্যে নানার বাড়ি দিয়ে দেখি, আলাউদ্দিনের অবস্থা খুব খারাপ। শরীর ভেঙে পড়েছে। মাথাও সম্ভবত খানিকটা খারাপ হয়েছে। দিনরাত উঠোনে বসে পাটের দড়ি পাকায়। দড়ির সঙ্গে বিড়বিড় করে কথা বলে। খুবই উচ্চশ্রেণীর দার্শনিক কথাবার্তা। তার একটি চোখ আগেই নষ্ট ছিল। দ্বিতীয়টিতেও ছানি পড়েছে। কিছু দেখে বলে মনে হয় না। চোখে না। দেখলেও সে চান্নিপসর সম্পর্কে এখনো খুব সজাগ। এক সন্ধ্যায় হাসিমুখে আমাকে বলল, ও ভাইগ্না ব্যাটা, আইজ যে পুরা চান্নি হেই খিয়াল আছে? চান্নি দেখতে যাবা না? যত পার দেইখ্যা লও। এই জিনিস বেহেশতেও পাইবা না।

সেই আমার আলাউদ্দিনের সঙ্গে শেষ চাঁদনি দেখতে যাওয়া। সে আমাকে মাইল তিনেক হটিয়ে একটা বিলের কাছে নিয়ে এল। বিলের ওপর চানি নাকি অপূর্ব জিনিস। আমাদের চান্নি দেখা হলো না। আকাশ ছিল ঘন মেঘে ঢাকা। মেঘ কাটল না। একসময় টুপটুপ করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। আলাউদ্দিন দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলল, চান্নি আমরার ভাগ্যে নাই। ভাগ্য খুব বড় ব্যাপার ভাইগ্না ব্যাটা। ভাগ্যে না থাকলে হয় না।

আমরা ভিজতে ভিজতে ফিরছি। আলাউদ্দিন নিচুস্বরে কথা বলে যাচ্ছে, ভাগ্যবান মানুষ এই জীবনে একজন দেখছি। তোমার মামির কথা বলতেছি। নাম ছিল দুলারী। তার মরণ হইলে চান্নিপসর রাইতে। কী চান্নি যে নামল ভাইগ্না! না দেখলে বিশ্বাস করবা না। শইল্যের সব লোম দেহা যায় এমন পসর। চান্নিপসরে মরণ তো সহজে হয় না। বেশির ভাগ মানুষ মরে দিনে। বাকিগুলো মরে অমাবস্যায়। তোমার মামির মতো দুই-একজন ভাগ্যবতী মরে চান্নিপসরে। জানি না আল্লাপাক আমার কপালে কী রাখছে। চান্নিপসরে মরণের বড় ইচ্ছা।

আলাউদ্দিনের মৃত্যুর খবর আমি পাই আমেরিকায়। তার মরণ চাঁদনিপসরে হয়েছিল কি-না তা চিঠিতে লেখা ছিল না, থাকার কথাও নয়। কার কী যায় আসে তার মৃত্যুতে?

রাত দশটার দিকে হঠাৎ করেই গাড়ি নিয়ে বের হলাম। পেছনের সিটে বড় মেয়ে নোভাকে শুইয়ে দিয়েছি। গাড়ি চলছে উল্কার বেগে। নোভা অবাক হয়ে বলল, আমরা যাচ্ছি কোথায়?

আমি হাসতে হাসতে বললাম, মন্টানার দিকে। মন্টানার জঙ্গলে জোছনা দেখব। সে যে কী সুন্দর দৃশ্য তুমি না দেখলে বিশ্বাস করবে না।

গাড়ির ক্যাসেট চালু করে দিয়েছি। গান হচ্ছে—‘আজ জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে’। আমার কেন জানি মনে হলো, আলাউদ্দিন আমার কাছেই আছে। গাড়ির পেছনের সিটে আমার বড়মেয়ের পাশে গুটিসুটি মেরে বসে আছে। গভীর আগ্রহ ও আনন্দ নিয়ে সে আমার কাণ্ডকারখানা লক্ষ করছে।

১৯.

জোছনাপ্রীতির কথা লিখলাম। বর্ষাপ্রীতি বদি থাকে কেন?

তখন পড়ি ক্লাস এইটে। চিটাগাং কলেজিয়েট স্কুল। বাংলা স্যার বললেন, রচনা লিখে আন। প্রিয় ঋতু। চার-পাঁচটা কোটেশন যেন থাকে। প্রতিটা বানান ভুলের জন্যে পাঁচবার কানে ধরে উঠবোস। ডিকশনারি সামনে নিয়ে রচনা লিখবি।

আমরা রচনা লিখে জবাব দিলাম। স্যার আমার রচনা পড়ে রাগী গলায় বললেন, কী লিখেছিস ছাগলের মতো! বর্ষা প্রিয় ঋতু? লিখবি ঋতুরাজ বসন্ত। তাহলে না নাম্বার পাবি। ফুলের সৌরভ, পাখির কুজন। বর্ষায় ফুল ফুটে না। পাখিও ডাকে না।

আমি বললাম, স্যার, বর্ষাই আমার প্রিয়।

তোর প্রিয় তোর মধ্যে থাক। নাম্বার বেশি পেতে হবে না?

বলপয়েন্টে নাম্বার বেশি পাওয়ার বিষয় নেই, কাজেই বর্ষাই সই।

বর্ষা যাপনের জন্যে আমি নুহাশপল্লীতে বেশ বড় ঘর বানিয়েছি। ঘরের নাম ‘বৃষ্টি বিলাস’। ঘরের ছাদ টিনের। সেখানে বৃষ্টি পড়ে অদ্ভুত শব্দে হয়। বৃষ্টির শব্দের কাছে ভৈরবী বা বেহাগ রাগ দাঁড়াতেই পারে না। ১৯৭১-এর পর বাংলাদেশে পাকিস্তানি যারা সবাই পাকিস্তান চলে গেলেন। ঢাকা বেতারের একজন সেতারবাদক গেলেন না। কারণ হিসেবে বললেন, পাকিস্তানে এরকম করে বৃষ্টি হয় না। বৃষ্টির শব্দ না শুনলে আমি বাঁচব না। সেতারবাদকের নাম আমার মনে ছিল। এখন কিছুতেই মনে করতে পারছি না।

বৃষ্টি নিয়ে আমার মজার কিছু স্মৃতি আছে। যেমন, এক আষাঢ় মাসে আমি রওনা হলাম কক্সবাজার। ঝুম বৃষ্টিতে সমুদ্রের পানিতে গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে বসে থাকব। দেখব কেমন লাগে।

তুমুল বর্ষণ হচ্ছে। আমি গলাপানিতে বসে আছি। ঢেউ এসে মাথার ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। আমার কাছে মনে হচ্ছে এমন আনন্দময় অভিজ্ঞতা বহুদিন হয় নি। পাঠকদের কাছে কিছুটা অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, আমি সাগরে নেমেছিলাম সকাল দশটায়। উঠে আসি সন্ধ্যা মেলাবার পর। দুপুরের লাঞ্চ ছিল একটা ডাবের পানি এবং শাঁস।

দ্বিতীয় অভিজ্ঞতা তেমন সুখকর না। আমার পুত্র নুহাশের বয়স তখন চার মাস। আমি থাকি শহীদুল্লাহ হলে। নামল তুমুল বৃষ্টি। নুহাশের মা বাসায় নেই। ছেলেকে বৃষ্টির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার এই সুযোগ। আমি তাকে নিয়ে ছাদে চলে এলাম। পিতা-পুত্রের ওপর ধারাবর্ষণ হচ্ছে। পুত্র খুবই মজা হচ্ছে। হলের ছাত্ররাও মজা পাচ্ছে।

আমার মজা স্থায়ী হয় নি, কারণ ঠান্ডা লেগে নুহাশের নিউমোনিয়া হয়ে গেল। ডাক্তার-হাসপাতাল ছোটাছুটি। পুত্রের মাতার অবর্ষণ।

বর্ষাযাপন নিয়ে পত্র-পত্রিকায় বেশ কিছু লেখা লিখেছি। পত্রিকায় প্রকাশিত লেখা যক্ষের ধনের মতো সঞ্চয় করে রাখার অভ্যাস আমার নেই বলে লেখাগুলি হারিয়ে গেছে। এর মধ্যে একটা লেখা ছিল আমেরিকায় বর্ষাযাপনের অভিজ্ঞতা। মন্টানার বনভূমিতে প্রবল বৃষ্টির গল্প।

বাংলার প্রিয় কবি জীবনান্দ দাশের মধ্যে বর্ষা নিয়ে মাতামাতি দেখি না। তিনি হেমন্ত এবং কুয়াশা নিয়েই স্বস্তি বোধ করেছেন। উচ্ছ্বাস প্রকাশ পেয়েছে রবীন্দ্রনাথের মধ্যে। বর্ষার পুরো অভিজ্ঞতা তিনি নিয়ে এসেছেন একটি কবিতায়, কবিতার নাম ‘বর্ষা যাপন’।

বাড়িছে বৃষ্টির বেগ থেকে থেকে ডাকে মেঘ
ঝিল্লীরব পৃথিবী ব্যাপিয়া
এমন ঘন ঘোর নিশি দিবসে জাগরণে মিশি
না জানি কেমন করে হিয়া

বৃষ্টিকে রবীন্দ্রনাথের মতো আপন করে কেউ অনুভব করেছেন বলে আমি মনে করি না। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বৃষ্টির সম্পর্ক নিয়ে আমি ছোট্ট একটা লেখা লিখেছিলাম। লেখাটি কোথায় প্রকাশিত হয়েছিল এখন মনে করতে পারছি না। পাঠকদের জন্যে লেখাটি আবারো দিয়ে দিলাম। বিচিত্র কারণে এই লেখাটি বেশ কিছু ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। (ইংরেজি অনুবাদ কী একটা সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছে।)

বর্ষা যাপন

কয়েক বছর আগের কথা। ঢাকা শহরের এক কমুনিটি সেন্টারে বিয়ে খেতে গিয়েছি। চমৎকার ব্যবস্থা। অতিথির সংখ্যা কম। প্রচুর আয়োজন। থালা বাসনগুলি পরিচ্ছন্ন। যারা পোলাও খাবেন না, তাদের জন্যে সরু চালের ভাতের ব্যবস্থা। নিমন্ত্রিতদের মধ্যে দেখলাম বেশকিছু বিদেশী মানুষও আছেন। তাঁরা বিয়ের অনুষ্ঠান দেখতে আগ্রহী। দেখার মতো কোনো অনুষ্ঠান নেই বলে কন্যা কর্তা খানিকটা বিব্রত। এটা শুধুমাত্র খাওয়ার অনুষ্ঠান তা বলতে বোধহয় কন্যা কর্তার খারাপ লাগছে। বিদেশীরা যতবারই জানতে চাচ্ছে, মূল অনুষ্ঠান কখন শুরু হবে? ততবারই তাদের বলা হচ্ছে, হবে হবে।

কোণার দিকের একটা ফাঁকা টেবিলে খেতে বসেছি। আমার পাশের চেয়ারে এক বিদেশী ভদ্রলোক এসে বসলেন। আমার কিছুটা মেজাজ খারাপ হলো। মেজাজ খারাপ হবার প্রধান কারণ—ইনি সঙ্গে করে কাটা চামচ নিয়ে এসেছেন। এঁদের এই আদিখ্যেতা সহ্য করা মুশকিল। কাঁটা চামচ নিশ্চয়ই এখানে আছে। সঙ্গে করে নিয়ে আসার প্রয়োজন ছিল না। আমি আগেও লক্ষ করেছি, যারা কাঁটা চামচ দিয়ে খায় তারা হাতে যারা খায় তাদের বর্বর গণ্য করে। যেন সভ্য জাতির একমাত্র লোগো হলো কাঁটা চামচ। পাশের বিদেশী তাঁর পরিচয় দিলেন। নাম পল অরসন। নিবাস নিউমেক্সিকোর লেক সিটি। কোনো এক এনজিও-র সঙ্গে যুক্ত আছেন। বাংলাদেশে এসেছেন অল্পদিন হলো। এখনো ঢাকার বাইরে যান। নি। বিমানের টিকিট পাওয়া গেলে সামনের সপ্তাহে কক্সবাজার যাবেন।

কিছু জিজ্ঞেস না করলে অভদ্রতা হয় বলেই বললাম, বাংলাদেশ কেমন লাগছে?

পল অরসন চোখ বড় বড় করে বলল, Oh, wonderful!

এদের মুখে Oh, wonderful শুনে আহ্লাদিত হবার কিছু নেই। এরা এমন বলেই থাকে। এরা যখন এদেশে আসে, তখন তাদের বলে দেয়া হয়, নরকের মতো একটা জায়গায় যাচ্ছ। প্রচণ্ড গরম। মশা-মাছি। কলেরা-ডায়রিয়া। মানুষগুলিও খারাপ। বেশির ভাগই চোর। যারা চোর না তারা ঘুসখোর। এরা প্রোগ্রাম করা অবস্থায় আসে, সেই প্রোগ্রাম ঠিক রেখেই বিদেয় হয়। মাঝখানে Oh wonderful জাতীয় কিছু ফাঁকা বুলি আওড়ায়।

আমি পল অরসনের দিকে তাকিয়ে শুকনো গলায় বললাম, তুমি যে ওয়ান্ডারফুল বললে, গুনে খুশি হলাম। বাংলাদেশের কোন জিনিসটা তোমার কাছে ওয়ান্ডারফুল মনে হয়েছে?

পল বলল, তোমাদের বর্ষা।

আমি হকচকিয়ে গেলাম। এ বলে কী! আমি আগ্রহ নিয়ে পলের দিকে তাকালাম। পল বলল, বৃষ্টি যে এত সুন্দর হতে পারে এদেশে আসার আগে আমি বুঝতে পারি নি। বৃষ্টি মনে হয় তোমাদের দেশের জন্যেই তৈরি করা হয়েছে। তুমি শুনলে অবাক হবে, আমি একবার প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে রিকশার হুড ফেলে মতিঝিল থেকে গুলশানে গিয়েছি। আমার রিকশাওয়ালা ভেবেছে, আমি পাগল।

আমি পলের দিকে ঝুঁকে এসে বললাম, তোমার কথা শুনে খুব ভালো লাগল। অনেক বিদেশীর অনেক সুন্দর কথা আমি শুনেছি, কিন্তু তোমার মতো সুন্দর কথা আমাকে এর আগে কেউ বলে নি। এত চমৎকার একটি কথা বলার জন্যে তোমার অপরাধ ক্ষমা করা হলো।

পল অবাক হয়ে বলল, আমি কী অপরাধ করেছি?

পকেট থেকে কাঁটা চামচ বের করে অপরাধ করেছ।

পল হো-হো করে হেসে ফেলল। বিদেশীরা এমন প্রাণখোলা হাসি হাসে না বলেই আমার ধারণা। পল অরসনের আরো কিছু ব্যাপার আমার পছন্দ হলো। যেমন, খাওয়া শেষ হওয়ামাত্র পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে বলল, নাও, সিগারেট নাও।

বিদেশীরা এখন সিগারেট ছেড়ে দিয়েছে। তারা সিগারেট তৈরি করে গরিব দেশগুলিতে পাঠায়। নিজেরা খায় না। ভাবটা এরকম—অন্যরা মরুক, আমরা বেঁচে থাকব। তারপরেও কেউ কেউ খায়। তবে তারা কখনো অন্যদের সাধে না।

আমি পলের প্যাকেট থেকে সিগারেট নিলাম। পানের ডালা সাজানো ছিল। পল নিতান্ত পরিচিত ভঙ্গিতে পান মুখে দিয়ে চুন খুঁজতে লাগল। এধরনের সাহেবদের সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করা যায়। বর্ষা নিয়েই কথা বলা যেতে পারে। তাছাড়া গরম পড়েছে প্রচণ্ড। এই গরমে বৃষ্টির কথা ভাবতেও ভালো লাগে। আমি বললাম, পল, তোমার বর্ষা কখন ভালো লাগল।

পল অরসন অবিকল বৃদ্ধা মহিলাদের মতো পানের পিক ফেলে হাসিমুখে বলল, সে একটা ইন্টরেস্টিং ব্যাপার। লন্ডন এয়ারপোর্ট থেকে ঢাকা এসে পৌঁছেছি দুপুরে। প্লেন থেকে নেমেই দেখি প্রচণ্ড রোদ, প্রচণ্ড গরম। কিছুক্ষণের মধ্যেই গা বেয়ে ঘাম পড়তে লাগল। আমি ভাবলাম, সর্বনাশ হয়েছে! এই দেশে থাকব কী করে? বনানীতে আমার জন্যে বাসা ঠিক করে রাখা হয়েছিল। সেখানে এয়ারকুলার আছে বলে আমাকে চিঠি লিখে জানানো হয়েছে। আমি ভাবছি, কোনোমতে বাসায় পৌঁছে এয়ারকুলার ছেড়ে চুপচাপ বসে থাকব। ঘরে কোনো চৌবাচ্চা থাকলে সেখানেও গলা ডুবিয়ে বসে থাকা যায়?

বাসায় পৌঁছে দেখি, এয়ারকুলার নষ্ট। সারাই করার জন্যে ওয়ার্কশপে দেয়া হয়েছে। মেজাজ কী যে খারাপ হলো বলার না। ছটফট করতে লাগলাম। এক ফোঁটা বাতাস নেই। ফ্যান ছেড়ে দিয়েছি, ফ্যানের বাতাসও গরম।

বিকেলে এক মিরাকল ঘটে গেল। দেখি, আকাশে মেঘ জমেছে। ঘন কালো মেঘ। আমার বাবুর্চি ইয়াছিন দাঁত বের করে বলল, কালবোশেখী কামিং স্যার। ব্যাপার কিছুই বুঝলাম না। মনে হলো, আনন্দজনক কিছু ঘটতে যাচ্ছে। হঠাৎ ঝপ করে গরম কমে গেল। হিমশীতল হাওয়া বইতে লাগল। শরীর জুড়িয়ে গেল। তারপর নামল বৃষ্টি। প্রচণ্ড বর্ষণ, সেই সঙ্গে ঝড়ো হাওয়া। বাবুর্চি ইয়াছিন ছুটে এসে বলল, স্যার, শিল পড়তাছে, শিল। বলেই ছাদের দিকে ছুটে গেল। আমিও গেলাম পেছনে পেছনে। ছাদে উঠে দেখি, চারদিকে মহা আনন্দময় পরিবেশ। আশেপাশের বাড়ির ছেলেমেয়েরা ছোটাছুটি করে শিল কুড়াচ্ছে। আমি এবং আমার বাবুর্চি আমরা দুজনে মিলে এক ব্যাগ শিল কুড়িয়ে ফেললাম। আমি ইয়াছিনকে বললাম, এখন আমরা এগুলি দিয়ে কী করব?

ইয়াছিন দাঁত বের করে বলল, ফেলে দিব।

আমার ছেলেবেলার কথা মনে পড়ল। প্রথম তুষারপাতের সময় আমরা তুষারের ভেতর ছোটাছুটি করতাম। তুষারের বল বানিয়ে একে অন্যের গায়ে ছুঁড়ে দিতাম। এখানেও তাই হচ্ছে। সবাই বৃষ্টির পানিতে ভিজে প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে।

আমি পলকে থামিয়ে দিয়ে বললাম,

এসো কর স্নান নবধারা জলে
এসো নীপবনে ছায়াবীথি তলে।

পল বলল, তুমি কী বললে?

রবীন্দ্রনাথের গানের দুটি লাইন বললাম। তিনি সবাইকে আহ্বান করছেন—বর্ষার প্রথম জলে স্নান করার জন্যে।

বলো কী? তিনি সবাইকে বৃষ্টির পানিতে ভিজতে বলেছেন?

হ্যাঁ।

তিনি আর কী বলেছেন?

আরো অনেক কিছুই বলেছেন। তাঁর কাব্যের একটি বড় অংশ জুড়েই আছে বর্ষা।

বলো কী?

শুধু তাঁর না, এদেশে যত কবি জন্মেছেন তাঁদের সবার কাব্যের বড় একটা অংশ জুড়ে আছে বর্ষা।

পল খুব আগ্রহ নিয়ে বলল, বর্ষা নিয়ে এ পর্যন্ত লেখা সবচেয়ে সুন্দর কবিতাটি আমাকে বলো তো, প্লিজ।

আমি তৎক্ষণাৎ বললাম,

বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদেয় এল বান।

এই এক লাইন?

 হ্যাঁ, এক লাইন।

এর ইংরেজি কী?

এর ইংরেজি হয় না।

ইংরেজি হবে না কেন?

আক্ষরিক অনুবাদ হয়। তবে তার থেকে কিছুই বোঝা যায় না। আক্ষরিক অনুবাদ হচ্ছে—Patter patter rain drops, flood in the river.

পল বিস্মিত হয়ে বলল, আমার কাছে তো মনে হচ্ছে খুবই সাধারণ একটা লাইন।

সাধারণ তো বটেই। তবে অন্যরকম সাধারণ। এই একটি লাইন শুনলেই আমাদের মনে তীব্র আনন্দ এবং তীব্র ব্যথাবোধ হয়। কেন হয় তা আমরা নিজেরাও ঠিক জানি না।

পল হা করে তাকিয়ে রইল। একসময় বলল, বর্ষা সম্পর্কে এরকম মজার আর কিছু আছে?

আমি হাসিমুখে বললাম, বর্ষার প্রথম মেঘের ডাকের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেশের কিছু মাছের মাথা খারাপের মতো হয়ে যায়। তারা পানি ছেড়ে শুকনায় উঠে আসে।

আশা করি তুমি আমার লেগ পুলিং করছে না।

না, লেগ পুলিং করছি না। আমাদের দেশে এরকম ফুল আছে যা শুধু বর্ষাকালেই ফোটে। অদ্ভুত ফুল। পৃথিবীর আর কোনো ফুলের সঙ্গে এর মিল নেই। দেখতে সোনালি একটা টেনিস বলের মতো। যতদিন বর্ষা থাকবে ততদিন এই ফুল থাকবে। বর্ষা শেষ, ফুলও শেষ।

ফুলের নাম কী?

কদম।

আমি বললাম, এই ফুল সম্পর্কে একটা মজার ব্যাপার হলো বর্ষার প্রথম কদম ফুল যদি কোনো প্রেমিক তার প্রেমিকাকে দেয়, তাহলে তাদের সম্পর্ক হয় বিষাদমাখা। কাজেই এই ফুল কেউ কাউকে দেয় না।

এটা কি একটা মিথ?

হ্যাঁ, মিথ বলতে পারো।

পল তার নোটবই বের করে কদম ফুলের নাম লিখে নিল। আমি সেখানে রবীন্দ্রনাথের গানের চারটি চরণও লিখে দিলাম।

তুমি যদি দেখা না দাও
করো আমায় হেলা
 কেমন করে কাটে আমার
এমন বাদল বেলা।

(If thou showest me not thy face,
If thou leavest me wholly aside,
I know not how i am to pass
These long rainy hours.)

পল অরসনের সঙ্গে আর আমার দেখা হয় নি। তবে ঘোর বর্ষার সময় আমি যখন রাস্তায় থাকি তখন খুব আগ্রহ নিয়ে চারদিকে তাকাই, যদি রিকশার হুড় ফেলা অবস্থায় ভিজতে ভিজতে কোনো সাহেবকে যেতে দেখা যায়।

২০.

কিছুদিন আগে ষাট বছর পূর্ণ করলাম। এটা কোনো সুসংবাদ না, ভয়াবহ দুঃসংবাদ। দিন শেষ হয়ে আসছে। মহাযাত্রার সময় আগত। ট্রেনের চাকার শব্দ কানে আসছে।

কিছু কিছু দুঃসংবাদকে সুসংবাদ ভেবে পালন করার রেয়াজ আমাদের আছে। ৫০তম জন্মদিন, ৬০তম জন্মদিন পালন সেরকম ব্যাপার। শুনলাম জন্মদিন পালনে বিরাট প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। সারাদিনব্যাপী হুমায়ূন মেলা, জলসা, চলচ্চিত্র প্রদর্শনী এইসব। আমি একটা ব্যাপারে খুশি, উৎসব হাতছাড়া হয়ে যায় নি। হাতছাড়া হবার উপক্রম হয়েছিল। ঘটনাটা বলি। 

মাসুদ আখন্দ নামে এক যুবক থাকে সুইডেনে। সে নাকি তার জীবনের চরম দুঃসময়ে আমার বই পড়ে বেঁচে থাকার সাহস, প্রেরণা এবং আনন্দ পেয়েছিল। জীবনের একটা পর্যায়ে এসে সেই বইপড়া ঋণ শোধ করার তাগিদ বোধ করল। সবকিছু ছেড়ে ছুঁড়ে চলে এল ঢাকায়। বাকি জীবন নাকি সে গুরুর (হুমায়ুন আহমেদ) সেবা করে কাটিয়ে দেবে। অতি বৃদ্ধ বয়সে যখন একা একা বাথরুমে যাবার মতো শক্তি থাকবে না, তখন সে আমাকে কোলে করে বাথরুমে নিয়ে যাবে। বাথরুম থেকে নিয়ে আসবে।

আমার ষাটতম জন্মদিন নিয়ে সে বিরাট লাফ-ঝাঁপ শুরু করল। এর সঙ্গে মিটিং তার সঙ্গে মিটিং। তার পরিকল্পনাও ভয়াবহ। ঐ দিন বাংলাদেশের সমস্ত হিমুদের চাকায় ডাকা হবে। তারা সারাদিন একটী স্টেডিয়ামে র‍্যালি করবে। তাদের নাম রেজিস্ট্রেশন হবে। তাদের জন্যে হবে কনসার্ট। হিমু কনসার্ট। সব শেষে আমি হিমুদের উদ্দেশে ভাষণ দেব।

আল্লাহপাকের আমার ওপর বিশেষ করুণা আছেই বলেই ঘটনা শেষ পর্যন্ত স্টেডিয়ামে গেল না। পাবলিক লাইব্রেরি চত্বরে সীমাবদ্ধ রইল।

আমার মা ভোরবেলায় ষাটটা বেলুন উড়িয়ে পুত্রের শুভ জন্মদিন ঘোষণা করলেন। ছোট্ট একটা ভাষণও তিনি দিলেন। ভাষণের সারমর্ম তার ছেলেকে ঘিরে যে এত আনন্দ উল্লাস হবে তা তিনি সবই জানতেন। ইত্যাদি।

সন্ধ্যার পর মূল অনুষ্ঠান। আমি গম্ভীর মুখ করে স্টেজে বসে আছি। ইমদাদুল হক মিলন মাইকে বলে যাচ্ছে—

এখন অমুক এসেছেন, লেখককে ফুলের তোড়া উপহার দিলেন।

এখন এসেছেন অমুক। তিনি লেখককে…

কয়েকটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের ব্যাপার ছিল। বইগুলির প্রকাশকরা মোড়ক উন্মোচনের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ লোক খুঁজছিলেন। গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের একটি তালিকাও প্রস্তুত হয়েছিল। আমি প্রকাশকদের বললাম, আমার কাছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লোকজন হচ্ছে আমার পরিবারের লোকজন। বইয়ের মোড়ক উন্মোচন তারাই করবে।

আমার কনিষ্ঠপুত্র নিষাদ (বয়স এক বছর নয় মাস) একটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করে গম্ভীর হয়ে গেল। বইয়ের কভারে তার বাবার ছবি দেখে মহানন্দে বলতে লাগল—এইটা বাবা!

বড় পুত্র নুহাশ একটি বইয়ের মোড়ক খুলল।

স্ত্রী শাওন একটি। আমি একটি পরিবারের অতি ঘনিষ্ঠ আর কেউ নেই। অথচ একটি বইয়ের মোড়ক তখনো খোলা হয় নি। আমি মিলনকে ডাকলাম। একজন লেখক সবসময়ই আরেকজন লেখকের অতি ঘনিষ্ঠজন। পরিবারের সদস্য না হয়েও সদস্য।

শুরু হলো বক্তৃতামালা। আমি বক্তৃতাগুলি আগ্রহ নিয়ে শুনছি, কারণ আজ যারা বক্তৃতা দিচ্ছেন তারাই আমার মৃত্যুর পরের শোকসভায় বক্তৃতা দেবেন। তারা আজ যা বলছেন, মৃত্যুর পরের সভায় তাই বলবেন। নতুন কিছু না।

বক্তাদের মধ্যে রাশিয়ান ছেলে পাভেলের বক্তৃতা শুনে আনন্দ পেলাম। দর্শকরাও তুমুল হাততালি দিল। পাভেল আমার একটি উপন্যাস (সবাই গেছে বনে) রুশ ভাষায় অনুবাদ করেছে। সে বক্তৃতা দিল বাংলায়।

আমার জন্যে বড় ধরনের বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। হঠাৎ ইমদাদুল হক মিলন ঘোষণা করলেন, হুমায়ূন আহমেদের বড় ছেলে নুহাশ হুমায়ূন তার বাবার সম্পর্কে কিছু বলবে। নুহাশ হুমায়ূন তার বাবার একটি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেছে। বইটির নাম ফিহা সমীকরণ।

দর্শকদের মতো আমিও আগ্রহ নিয়ে ছেলের দিকে তাকালাম। সে বলল, অনেকেই এই অনুষ্ঠানে আমার বাবার নাম ভুল উচ্চারণ করেছেন। আমার তা মোটেই ভালো লাগে নি। তাঁর নামের শুদ্ধ উচ্চারণ হওয়া উচিত। তাঁর নাম হুমায়ূন আহমেদ। আহাম্মেদ না। আহমদ না।

পিতার নামের শুদ্ধ উচ্চারণে তার আগ্রহ দেখে মজা লাগল। তারপরেই সে যা বলল তা শুনে দর্শকরা কিছুক্ষণ হতভম্ব সময় কাটালো। তারপরই তুমুল তালি।

সে বলল, আমার বাবা যখন খুব অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ছিলেন তখন তার পাশে আমি উপস্থিত থাকতে পারি নি। তিনি যখন চার-পাঁচটা বিয়ে করেন তখনো আমি ছিলাম অনুপস্থিত। আজ এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পেরে ভালো লাগছে।

আমার মাথার ভেতর সব কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে গেল। ছেলে এইসব কী বলছে? আমি দ্বিতীয় বিয়ে করেছি। চার-পাঁচটা করি নি। আজকের অনুষ্ঠানে দ্বিতীয় বিয়ে টেনে আনাও অশোভন। সে সেখানে চার-পাঁচটা বিয়ে কোথায় পেল?

অনুষ্ঠান চলছে। গানবাজনা হচ্ছে। আমি ছেলের পাশে চুপচাপ বসে আছি। একবার ভাবলাম জিজ্ঞেস করি—বাবা! চার-পাঁচটা বিয়ের ব্যাপারটা কী? তারপরই মনে হলো কী হবে জিজ্ঞেস করে।

এখন আমার ইচ্ছা করছে দ্বিতীয় বিয়ের কিছু খণ্ডচিত্র লিখে ফেলি। অন্য কেউ জানতে চাক না-চাক নিষাদ একসময় জানতে চাইবে।

তখন আমার খুব দুঃসময়। মানসিক বিপর্যয়। শাওনকে তার বাসা থেকে বের করে দিয়েছে। তার থাকার জায়গা নেই। আমাকে আমার আত্মীয়স্বজনরা পরিত্যাগ করেছে। বন্ধুবান্ধবও পরিত্যাগ করেছে। আমি শাওনকে ডেকে বললাম, আমি দ্বিতীয়বার বিয়ে করছি, কিন্তু তোমার এটা প্রথম বিয়ে। অন্য মেয়েরা যেভাবে বিয়ে করে তুমি সেইভাবেই কর। টাকা দিচ্ছি, যাও একটা বিয়ের শাড়ি কিনে আন।

সে বলল, একা একা বিয়ের শাড়ি কিনে আনব?

আমি বললাম, হ্যাঁ। রবীন্দ্রনাথ তোমার জীবনের এই ঘটনার কথা মনে করেই লিখেছেন—‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে।’

সে খুবই অল্প টাকায় একটা শাড়ি কিনে আনল। তারপর পার্লারে গেল সাজতে। আমার খুব মায়া লাগল। আজ বেচারির বিয়ে। কেউ তার পাশে নেই? একজন আত্মীয়! বা একজন বন্ধু!

আমি অন্যদিন পত্রিকার সম্পাদক মাজহারের স্ত্রীকে টেলিফোন করে বললাম, স্বর্ণা! একটা মেয়ে বিয়ে করছে। কেউ তার পাশে নেই। একা একা পার্লারে বসে আছে। তোমরা সবাই আমাকে ত্যাগ করেছ আমি জানি। আজকের দিনে মেয়েটার পাশে দাঁড়াও।

স্বর্ণা বলল, আমি এক্ষুনি যাচ্ছি।

শাওন-পুত্র নিষাদ একদিন বড় হবে। সে অবশ্যই ভালোবেসে অতি রূপবতী কোনো তরুণীকে বিয়ে করবে। প্রকৃতির অমোঘ বিধানে সেই বিয়েতে আমি উপস্থিত থাকব না। তবে আমি চাই খুব ধুমধাম করে সেই বিয়ে হোক। যেন ছেলের বিয়ের আনন্দ দেখে শাওন তার নিজের আয়োজনহীন নিঃসঙ্গ বিয়ের স্মৃতি পুরোপুরি ভুলে যায়।

২১.

হাতে কোনো বই এলে আমি সবার আগে বইটির পেছনের ফ্ল্যাপে কী লেখা তা পড়ি। সেখানে লেখকের গম্ভীর মুখের একটা ছবি থাকে। তার জন্মবৃত্তান্ত এবং লেখালেখির ইতিহাস থাকে। বেশির ভাগ সময় লেখক নিজেই এই লেখাটা লেখেন বলে তিনি নিজের সম্পর্কে কী ভাবেন তা জানা যায়। একজন লেখক নিজের সম্পর্ক লিখছেন—

তাঁর লেখায় মানবজীবনের শত বঞ্চনা ভৈরবী রাগিনীর মতো মৃঞ্ছিত হয়েছে। তিনি লাঞ্ছিত নিপীড়িতের মহান আলেখ্যকার। তার দশটি অসাধারণ গল্পের সংকলন দশ পথিকের পাঁচালি (প্রথম মুদ্রণ শেষ হয়েছে, দ্বিতীয় মুদ্রণের কাজ চলছে।) ইংরেজি অনুবাদ করছেন শেখ নজরুল ইসলাম এম এ (ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য)। গল্পগ্রন্থের ইংরেজি নাম Ten Lost Soules Story.

লেখক পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে জ্যেষ্ঠ। তার ছোটভাই বাংলাদেশ সরকারের একজন কীর্তিমান নির্ভীক ম্যাজিস্ট্রেট। এক বোন ইতিহাসের প্রভাষক। ভাগ্নিজামাই ছদরুল হোসেন বিশিষ্ট আইনজীবী এবং সমাজসেবক।

পাঠক, আবার ভাবছেন না তো আমি এদের নিয়ে তামাশা করছি! তামাশা করার প্রশ্নই আসে না। আমার অনেক বইয়ের ফ্ল্যাপের লেখা আমি নিজে লিখেছি। এখনো লিখছি। নিজেকে পণ্যের আকারে প্রকাশ করার কিছু মজা অবশ্যই আছে।

সবকিছু বদলায়। ফ্ল্যাপের লেখাও বদলায়। শুরুর দিকে মোট কয়টি বই লিখেছি এইসব তথ্য থাকত। কিছু পুরস্কার পাবার পর পুরস্কার তালিকা চলে এল। কিছুদিন পর লেখা হতে লাগল–তিনি টিভিতে ধারাবাহিক নাটক লেখেন। এইসব দিনরাত্রি’, ‘অয়ময়’, ‘বহুব্রীহি তার লেখা নাটক। এরপর চলে এল ছবি। তিনি ছবি বানান। সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির নাম ‘আগুনের পরশমণি’।

ছবির বিষয়ে কিছুই জানি না। ক্যামেরা জানি না। শট কী বুঝি না। ‘ইন’ ‘আউট’ নামক জটিলতা জানি না, তারপরেও কেন ছবি বানাতে গেলাম? ছবি বানানোর গল্প নামের একটি বইয়ে আমি তা ব্যাখ্যা করেছি। বই থেকে এই অংশ পুনর্মুদ্রিত করছি, কারণ বলপয়েন্টে এই লেখা থাকা দরকার—

.

আমার প্রথম দেখা ছবির নাম ‘বহুত দিন হোয়ে’। খুব যে আনন্দময় অভিজ্ঞতা তা না। আমার শিশুজীবনের খানিকটা গ্লানি ছবির সঙ্গে জড়িয়ে আছে। বড় মামার সঙ্গে ছবি দেখতে গিয়েছি। মামা নিতান্তই অনাগ্রহের সঙ্গে আমাকে নিচ্ছেন। তার ধারণা বাতি নেভার সঙ্গে সঙ্গে আমি কাঁদতে শুরু করব। মাঝখান থেকে তাঁর ছবি। দেখা হবে না। আমি যে কাঁদব না তা মামাকে নানাভাবে বুঝানোর চেষ্টা করছি। মামা বুঝছেন না।

কাঁদলে কিন্তু আছাড় দিয়ে ভুড়ি গালিয়ে ফেলব।

কাঁদব না মামা।

 পিসাব পায়খানা যা করার করে নাও। ছবি শুরু হবে আর বলবে পিসাব তা হবে না।

আচ্ছা।

কোলে বসে থাকবে, নড়াচড়া করবে না। নড়লে চড় খাবে।

নড়ব না।

এতসব প্রতিজ্ঞার পরেও মামা বিমর্ষ মুখে আমাকে নিয়ে রওনা হলেন। সিলেটের ‘রঙমহল’ সিনেমায় ছবি দেখতে গেলাম। গেটে দুটা সিংহের মূর্তি। দেখেই গা ছমছম করে। মনে হয় গেটের ওপাশে না জানি কত রহস্য।

মামা টিকিট কিনলেন। সেসময় লাইন-টাইনের কোনো ব্যাপার ছিল না। মনে হয় এখনো নেই। ধস্তাধস্তি করে টিকিট কাটতে হতো। টিকিট হাতে ফিরে। আসা আর যুদ্ধ জয় করে ফিরে আসা কাছাকাছি ছিল। বাচ্চাদের কোনো টিকিট লাগত না। তারা কোলে বসে দেখতো কিংবা চেয়ারের হাতলে বসে দেখতে।

ছবি শুরু হতে দেরি আছে। মামা চা কিনলেন। আমার জন্যে দু’পয়সার বাদাম এবং চানাজা কেনা হলো। মামা বললেন, এখন না। ছবি শুরু হলে খাবে। আমি ছবি শুরুর জন্যে গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। চারদিকে লোকজন, হৈচৈ কোলাহলে নেশার মতো লাগছে। বুক ধক্ ধক্ করছে না জানি কী দেখব। ছবি শুরুর প্রথম ঘণ্টা পড়ল। সেই ঘণ্টাও অন্যরকম। বেজেই যাচ্ছে, থামছে না। লোকজন হলে ঢুকতে শুরু করেছে মামা ঢুকলেন না। আমাকে নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেলেন। গম্ভীর গলায় বললেন, পিসাব কর। ছবি শুরু হবে, আর বলবে পিসাব—তাহলে কান ছিঁড়ে ফেলব। (প্রিয় পাঠক, মামা অন্যকিছু ছেঁড়ার কথা বলেছিলেন। সুরুচির কারণে তা উল্লেখ করছি না।)

অনেক চেষ্টা করেও পিসাব হলো না। এদিকে দ্বিতীয় ঘণ্টা পড়ে গেছে। মামা বিরক্ত মুখে বললেন, চল যাই।

আমাকে বসিয়ে দেয়া হলো চেয়ারের হাতলে। হল অন্ধকার হয়ে গেল। ছবি শুরু হলো। বিরাট পর্দায় বড় বড় মুখ। শব্দ হচ্ছে, গান হচ্ছে, তলোয়ারের যুদ্ধ হচ্ছে। কী হচ্ছে আমি কিছুই বুঝছি না। তবে মজাদার কিছু যে হচ্ছে সেটা বুঝতে পারছি। বড়মামা একেকবার হাসতে হাসতে ভেঙে পড়ে যাচ্ছেন। তার সঙ্গে সঙ্গে হলের সব লোকও হাসছে। আমি বললাম, মামী, কী হচ্ছে?

মামা বললেন, চুপ। কথা বললে থাবড়া খাবি।

আমি খানিকক্ষণ চুপ থেকে বললাম, মামা, পিসাব করব।

মামা করুণ ও হতাশ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। আমি তার দৃষ্টি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে একটু পর পর বলতে লাগলাম, মামা, আমি পিসাব করব। মামা, আমি পিসাব করব। সম্ভবত তখন ছবির কোনো গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছিল। মামা পর্দা থেকে চোখ না সরিয়ে বললেন, নিচে নেমে পিসাব করে ফেল। কিছু হবে না।

 আমি তৎক্ষণাৎ মাতুল আজ্ঞা পালন করলাম। সামনের সিটের ভদ্রলোক মাথা ঘুরিয়ে মামার দিকে তাকিয়ে বিস্মিত গলায় বললেন, এই ছেলে তো প্রস্রাব করছে! আমার পা ভিজিয়ে ফেলেছে।

মামা বললেন, ছেলেমানুষ প্রস্রাব তো করবেই। আপনার ঘরে ছেলেপুলে নেই? পা তুলে বসুন না।

সেই সময়ের মানুষদের সহনশীলতা অনেক বেশি ছিল। ভদ্রলোক আর কিছুই বললেন না। পা তুলে মনের আনন্দে ছবি দেখতে লাগলেন।

আমার প্রথম ছবি দেখার অভিজ্ঞতা খুব সুখকর না হলেও খারাপও ছিল না। অন্ধকার হল, পর্দায় ছবির নড়াচড়া আমার ভালোই লাগল। ইন্টারভ্যালের সময় বাদাম এবং কাঠি লজেন্স খাওয়ার একটা ব্যাপারও আছে। বাসা থেকে রিকশায় করে হলে যাওয়া এবং ফেরার মধ্যেও আনন্দ আছে, রিকশায় চড়ার আনন্দ। কাজেই ছবি দেখার কোনো নড়াচড়া পেলেই আমি এমন কান্নাকাটি, হৈচৈ শুরু করে দেই যে আমাকে না নেয়া ছাড়া কোনো পথ থাকে না।

সিলেটে আমাদের বাসায় মেহমান লেগেই থাকতো। শাহজালাল সাহেবের দরগা জিয়ারতের মেহমান। তারা প্রথম দিন শাহজালাল সাহেবের দরগায় যেতেন (আমি সঙ্গে আছি, দরগীর গেটে হালুয়া কেনা হবে। যার স্বাদ ও গন্ধ বেহেশতি হালুয়ার কাছাকাছি)। শাহজালাল সাহেবের মাজার জিয়ারতের পর আসে শাহ পরাণ সাহেবের মাজার জিয়ারতের প্রশ্ন। অধিকাংশ মেহমান সেই মাজার এড়িয়ে যান। গরম মাজার, ভুল ত্রুটি হলে মুশকিল। মাজারপর্ব শেষ হবার পর মেহমানদের ছবি দেখার আগ্রহ জেগে ওঠে। সিলেটে শহরে তখন দুটি ছবিঘর। দুই ছবিঘরে দু’রাত ছবি দেখা হয়। আমি তখনো সঙ্গে আছি।

সবচেয়ে মজা হতো মার সঙ্গে ছবি দেখতে গেলে। পুরনো শাড়ি দিয়ে রিকশা পেঁচানো হতো। বোরকা পরা মায়েরা রিকশার ঘেরাটোপে ঢুকে যেতেন। আমরা বাচ্চারা পর্দার বাইরে। এক-একজন মহিলার সঙ্গে চার-পাঁচটা করে শিশু। দুটি সন্তানই যথেষ্ট এই থিয়োরি তখনো চালু হয় নি। সেসময় দুটি সন্তান যথেষ্ট নয় বলে বিবেচনা করা হতো।

সিনেমা হলে মহিলাদের বসার জায়গা আলাদা। কালো পর্দা দিয়ে ছেলেদের কাছ থেকে আলাদা করা। ছবি শুরু হবার পর পর্দা সরানো হবে। তার আগে নয়। মহিলাদের অংশে খাণ্ডারনী টাইপের একজন আয়া থাকে। তার কাজ হলো, ছবি শুরু হবার পর সামনের কোনো পুরুষমানুষ পেছনদিকে তাকাচ্ছে কিনা সেদিকে লক্ষ রাখী। কেউ তাকালেই বিকট চিৎকার—ঐ কী দেখস? চউখ গালাইয়া দিমু। ঘরে মা ভইন নাই?

পর্দায় উত্তম-সুচিত্রার রোমান্টিক সংলাপ হচ্ছে আর এদিকে চলছে শিশুদের চেঁ ঊ্যা। মায়েদের তাতে ছবি উপভোগ করতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। এই শিশুকে সামলাচ্ছেন, এই সুচিত্রার কষ্টে চোখের পানি ফেলছেন। সাধে কি আর বলে, মেয়েরা সর্বংসহা।

সেবছরই শীতের শুরুতে হঠাৎ বাসায় সাজ সাজ রব পড়ে গেল। দেয়ালের ছবি সব নামিয়ে ফেলা হতে লাগল। বাসায় যে ফরসি হুঁকা আছে তা ঘষেমেজে পরিষ্কার করা হতে লাগল। দেশ থেকে দাদাজান আসবেন। আমি খুব উল্লসিত বোধ করলাম না। কারণ দাদাজান নিতান্তই গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। ইবাদত বন্দেগি নিয়ে থাকেন। মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন বলেই বোধহয় আমাদের সবসময় পড়া ধরেন। সন্ধ্যাবেলা নামাজ শেষ করেই বলবেন, কই বই নিয়ে সবাই আস দেখি। পড়া না পারলে তার মুখ স্কুলের স্যারদের মতোই গম্ভীর হয়ে যায়। এরকম মানুষকে ভালো লাগার কোনো কারণ নেই। গল্প যে তিনি একেবারেই বলতেন না তা না, বলতেন, তবে বেশির ভাগই শিক্ষামূলক গল্প। ‘ঈশপ’ টাইপ। সব গল্পের শেষে কিছু উপদেশ।  

এক রাতের কথা, দাদাজানের সম্ভবত মাথাব্যথা? আমাদের পড়তে বসতে হলো না। বাতি নিভিয়ে তিনি শুয়ে রইলেন। আমাকে ডেকে বললেন, দেখি একটা গল্প বল তো।

আমি তৎক্ষণাৎ গল্প শুরু করলাম। সদ্য দেখা সিনেমার গল্প। কোনো কিছুই বাদ দিলাম না। সুচিত্রা-উত্তমের প্রেমের বিশদ বর্ণনা দিলাম। দাদা শুয়ে ছিলেন, এই অংশে উঠে বসলেন। তার মুখ হা হয়ে গেল। আমার ধারণা হলো, তিনি গল্প খুব পছন্দ করছেন। গল্প শেষ করে উৎসাহের সঙ্গে বললাম, আরেকটা বলব। দাদাজান?

তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, না, তোর মাকে ডাক।

মা এসে সামনে দাঁড়ালেন। দাদাজান একটা দীর্ঘ বক্তৃতা দিলেন। বক্তৃতায় অনেক কঠিন কঠিন তৎসম শব্দ ব্যবহার করা হলো। বক্তৃতার সামারি এন্ড সাবসটেন্স হচ্ছে—বাবা-মা’র প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য সন্তান সভাবে পালন। সেই কর্তব্যে গুরুতর অবহেলা হচ্ছে। ছেলে সিনেমা দেখে বেড়াচ্ছে। গান বাজনা, নাটক-নভেল, সিনেমা সবই আত্মার জন্যে ক্ষতিকর। এই ছেলের ভয়ঙ্কর ক্ষতি ইতিমধ্যে হয়ে গেছে। আর যেন না হয় সেই চেষ্টা করতে হবে। বউমা, তোমাদের সবার জন্যে সিনেমা নিষিদ্ধ। কারণ তোমাদের দেখেই তোমাদের ছেলেমেয়েরা শিখবে। যাই হোক, আমি খাস দিলে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করছি যেন সিনেমা নামক ব্যাধির হাত থেকে তোমরা দূরে থাকতে পার।

দাদাজানের প্রার্থনার কারণেই কিনা কে জানে তিনি সিলেট থাকতে থাকতেই বাবা বদলি হয়ে গেলেন দিনাজপুরের জগদ্দল নামের এক জঙ্গলে। সিনেমা টিনেমা সব ধুয়ে মুছে গেল। তবে তাতে আমার তেমন ক্ষতি হলো না। জগদ্দলের অপূর্ব বনভূমি আমার শিশুচিত্ত দখল করে নিল।

দাদাজানের প্রার্থনার জোর আট বছরের মাথায় কমে গেল বলে আমার ধারণা। কারণ আট বছরের মাথায় আবার সিনেমা ব্যাধি আমাকে গ্রাস করল। তখন মেট্রিক পাশ করে ঢাকায় পড়তে এসেছি। হোস্টেলে থাকি। বাবা-মা থাকেন। বগুড়ায়। পূর্ণ স্বাধীনতা। বড় হয়ে গেছি এরকম একটা ভাবও মনে আছে। আচার-আচরণে বড় হওয়াটা দেখাতে হবে। কাজেই দল বেঁধে সিনেমা দেখা। হাতের কাছে বলাকা সিনেমাহল। একটু এগুলেই গুলিস্তান। একই বিল্ডিং-এ নাজ—ভদ্রলোকের ছবিঘর। হোস্টেল সুপারের চোখ এড়িয়ে সেকেন্ড শো ছবি দেখার আনন্দও অন্যরকম। সেই সময় প্রচুর আজেবাজে ছবি দেখেছি। লাস্যময়ী নীলুর ‘খাইবার পাস’, সাপখোপের ছবি ‘নাচে নাগিন বাজে বীণ’, ‘আগ কা দরিয়া’, ‘ইনসানিয়াৎ’ (পাকিস্তানি ছবি। বম্বের ছবি না। তখন ভারতের ছবি আসত না। দেশীয় ছবি প্রটেকশন দেবার জন্যে ভারতের ছবি আনা বন্ধ ছিল)। বলাকা সিনেমাহলে নতুন ছবি রিলিজ হয়েছে আর আমি দেখি নি এমন কখনো হয় নি। এমনও হয়েছে একই দিনে দু’টা ছবি দেখেছি, দুপুর দেড়টায় ইংরেজি ছবি, তিনটায় ম্যাটিনিতে উর্দু ছবি। আমাদের সময় ছবি দেখতে টাকা লাগত কম। আইয়ুব খান সাহেব ব্যবস্থা করেছিলেন ছাত্র সিনেমা দেখবে হাফ টিকিটে। আইডি কার্ড দেখালেই অর্ধেক দামে স্টুডেন্ট টিকিট। ছাত্রদের সিনেমা দেখানোর জন্য আইয়ুব খান সাহেব এত ব্যস্ত ছিলেন কেন কে জানে। ক্রমাগত ছবি দেখে বেড়ালেও মনের গভীরে সবসময় মনে হতো—আমি যা করছি তা ঠিক না। ভুল করছি। নিজের ভেতর চাপা অপরাধবোধ কাজ করত। অবচেতন মনে হয়তো দাদাজানের বক্তৃতা খেলা করত। এই সময় একটা মজার ঘটনা ঘটল।

সুলতানা ম্যাডাম তখন আমাদের বাংলা পড়াতেন। ম্যাডাম সদ্য ঢাকা। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করেছেন। ঝলমলে তরুণী। তখনো বিয়ে করেন নি। ছেলেদের কলেজে পড়াতে এসেছেন বলে খানিকটা ব্ৰিত। তবে চমৎকার পড়ান। আমরা ক্লাসে কোনো ফাজলামি করলে আহত চোখে তাকিয়ে থাকেন। চোখের দৃষ্টিতে বলতে চেষ্টা করেন, আমি তোমাদের এত পছন্দ করি, আর তোমরা এমন দুষ্টামি কর? আমাদের বড় মায়া লাগে। একদিন তিনি ক্লাসে এসে বললেন, আজ আমার মনটা খুব খারাপ। গতকাল একটা সিনেমা দেখে খুব কেঁদেছি। মন থেকে ছবির গল্পটা কিছুতেই তাড়াতে পারছি না। সম্ভব হলে তোমরা ছবিটা দেখে। ছবির নাম ‘রোমান হলিডে।

সেই রাতেই আমরা দল বেঁধে ‘রোমান হলিডে’ দেখতে গেলাম। আমার জীবনে প্রথম দেখা ভালো ছবি। সামান্য একটা ছবি যে মানুষের হৃদয়-মন দ্রবীভূত করতে পারে, বুকের ভেতর হাহাকার তৈরি করতে পারে আমার ধারণীর ভেতর তা ছিল না। সত্যিকার অর্থে সেদিনই ছবির প্রতি পুরোপুরি আকৃষ্ট হলাম। আরম্ভ হলো বেছে বেছে ছবি দেখার পর্ব! একটা ভালো বই যেমন কয়েকবার পড়া। হয়, একটা ভালো ছবিও অনেকবার করে দেখতে শুরু করলাম। সবচেয়ে বেশি কোন ছবিটি দেখেছি? সম্ভবত ‘দি ক্রেইন আর ফ্লাইয়িং’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কাহিনী। মেয়েটির প্রেমিকা যুদ্ধে গিয়েছে। মেয়েটি জীবনের মোহের কাছে পরাজিত হয়ে অন্য একজনকে বিয়ে করেছে। যুদ্ধ শেষ হয়েছে। ট্রেনে করে ফিরছে সৈনিকরা, মেয়েটি ফুল হাতে এসেছে স্টেশনে। কতজন ফিরেছে, শুধু ফেরে নি সেই ছেলেটি একসময় মেয়েটি হাতের ফুল, যারা ফিরেছে তাদের হাতেই একটা একটা করে দিতে শুরু করল। তার চোখভর্তি জল। হঠাৎ সে মাথা তুলে আকাশের দিকে তাকাল। আকাশে ঝক ঝক বক পাখি। শীত শেষ হয়েছে বলে তারা ফিরে আসছে নিজবাসভূমে। আহা কী দৃশ্য!

আজ আমি মনে করতে পারছি না অসাধারণ সব ছবি দেখতে দেখতে কখনো মনের কোণে উঁকি মেরেছে কি-না—আহা, এরকম একটা ছবি যদি বানাতে পারতাম! অপূর্ব সব উপন্যাস পড়ার সময় এ ধরনের অনুভূতি আমার সবসময়। হয়। পথের পাঁচালী যতবার পড়ি ততবারই মনে হয়, আহা, এরকম একটা উপন্যাস যদি লিখতে পারতাম! ছবির ক্ষেত্রে এরকম না হবারই কথা। ছবি অনেক দূরের জগৎ, অসম্ভবের জগৎ, তারপরেও হতে পারে। মানুষের অবচেতন মন অসম্ভবের জগৎ নিয়ে কাজ করে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষের দিকে এসে অসম্ভবের জগতের এক যুবকের সঙ্গে পরিচয় হলো, তার নাম আনিস সাবেত। পদার্থবিদ্যার তুখোড় ছাত্র, কিন্তু তার ভালোবাসা বস্তুজগতের জন্যে নয়। তার ভালোবাসা অন্য এক জগতের জন্যে। সেই জগৎ ধরাছোঁয়ার বাইরের জগৎ, আলো ও আঁধারের রহস্যময় জগৎ।

এক জোছনা রাতে রাস্তায় হাঁটছি। তিনি হঠাৎ বললেন, ফিল্মে জোছনা কীভাবে তৈরি করা হয় জানো?

আমি মাথা নাড়লাম জানি না। জানার কোনো প্রয়োজনও কখনো মনে করি নি। তিনি দেখি দীর্ঘ এক বক্তৃতা শুরু করলেন। জোছনার বক্তৃতা শেষ হবার পর। শুরু হলো জোনাকি পোকার বক্তৃত। সত্যজিৎ রায় কীভাবে জোনাকি পোকার আলো পর্দায় নিয়ে এসেছেন সেই গল্প। চার-পাঁচটা টর্চ লাইট নিয়ে কয়েকজন বসেছে। টর্চ লাইটগুলির মুখে কাপড় বাধা। তারা টর্চ জ্বালাচ্ছে আর নেভাচ্ছে।

আমি বললাম, ফিজিক্স ছেড়ে এখন কি এইসব পড়ছেন?

তিনি বললেন, হ্যাঁ। আমি ঠিক করেছি ছবি বানানোকেই আমি পেশা হিসেবে নেব।

এই বিষয়ে তো আপনি কিছুই জানেন না।

কুবরিকও কিছু জানতেন না।

কুবরিক কে?

স্ট্যানলি কুবরিক একজন ফিল্ম মেকার, সত্যজিৎ রায় যার একটা ছবি কুড়িবার দেখেছিলেন।

আপনি তার কোনো ছবি দেখেছেন?

একটাই দেখেছি ‘স্পেস অডিসি ২০০১’। অসাধারণ ছবি।

আমি হাসতে হাসতে বললাম, আপনি তাহলে স্ট্যানলি কুবরিক হতে যাচ্ছেন?

আনিস ভাই বিরক্ত মুখে বললেন, আমাকে নিয়ে রসিকতা করবে না। আমি যা বলছি তা করব। অসাধারণ সব ছবি বানাব। এই দেশের মানুষ মুগ্ধ হয়ে আমার ছবি দেখবে।

ছবি বানাতে প্রচুর টাকা লাগে। আপনি টাকা পাবেন কোথায়?

যেখান থেকেই পাই, তোমার কাছে ধার করার জন্যে যাব না।

আপনি রাগ করছেন কেন?

আমি তোমাকে আমার একটা স্বপ্নের কথা বলছি, তুমি হেলাফেলা করে শুনছ, সেইজন্যেই রাগ করছি। মানুষের স্বপ্ন নিয়ে হেলাফেলা করতে নেই।

আর করব না, সরি।

আমার স্বপ্ন কি তোমার কাছে হাস্যকর মনে হচ্ছে?

আমি বললাম, না, মোটেই হাস্যকর মনে হচ্ছে না।

আনিস ভাইকে না বললেও আমার কাছে পুরো ব্যাপারটাই ছেলেমানুষি বলে মনে হচ্ছিল।

আনিস ভাই তার ব্যক্তিগত স্বপ্নের সঙ্গে আমাকে যুক্ত করতে চাইলেন। ছবি প্রসঙ্গে যে-কোনো বই পান নিয়ে আসেন। নিজে পড়েন। আমাকে পড়তে দেন। আমি না পড়েই বলি, পড়েছি। অসাধারণ বই।

ছবি দেখতে ভালো লাগে, ছবির শুকনো থিয়োরি পড়তে ভালো লাগবে কেন? আমার লাভের মধ্যে লাভ এই হলো আমি অনেকগুলি নাম শিখলাম। ‘আইজেনস্টাইন’, ‘বেটেলশিপ পটেমকিন’, ‘অক্টোবর’, ‘গদার’, ‘ফেলিনি’, ‘বাইসাইকেল থিফ’… আমার এই অল্প বিদ্যা পরবর্তী সময়ে খুব কাজে এসেছে। অনেক আঁতেলকে ভড়কে দিতে পেরেছি। আঁতেলদের দৌড়ও ঐ নাম পর্যন্ত বলেই ব্যাপার ধরতে পারেন নি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষ করার পর আনিস ভাইয়ের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল। আমি ময়মনসিংহের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারারের চাকরি নিয়ে ময়মনসিংহ চলে এলাম। কাজকর্ম নেই বললেই হয়। সপ্তাহে দুটা মাত্র ক্লাস। দুপুরের পর কিছু করার নেই। ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরে খানিকক্ষণ হটি, রাতে গল্প লেখার চেষ্টা করি। থাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের গেস্ট হাউসে। গেস্ট হাউস বেশির ভাগ সময় থাকে খালি। গেস্ট বলতে আমি একা। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চারদিক থেকে বিচিত্র সব ভৌতিক শব্দ হতে থাকে। ভয়ে জেগে বসে থাকি। সে এক ভয়াবহ অবস্থা। এই সময় আনিস ভাই মোটা এক খাতী হাতে ময়মনসিংহে উপস্থিত হলেন। তিনি একটি চিত্রনাট্য লিখে ফেলেছেন। মোটা খাতায় সেই চিত্রনাট্য। জনাব আহমেদ ছফার লেখা ওংকার উপন্যাসের চিত্রনাট্য। আমাকে শোনাবেন। আমি বললাম, কতদিন থাকবেন?

চিত্রনাট্য পড়তে যতদিন লাগে ততদিন থাকব।

চিত্রনাট্য পড়তে তার দীর্ঘদিন লাগল। একসঙ্গে তাকে বেশি পড়তে দেই না। দু’এক পাতা পড়া হতেই বলি, বন্ধ করুন। চট করে শেষ করলে হবে না। ধীরে সুস্থে এগুতে হবে। আবার গোড়া থেকে পড়ুন।

আমার ভয়, পড়া শেষ হলেই তিনি চলে যাবেন, আমি আবার একলা হয়ে যাব। একসময় চিত্রনাট্য পড়া শেষ হলো। আমাকে স্বীকার করতে হলে, অসাধারণ কাজ হয়েছে। আনিস ভাই টাকায় যাবার প্রস্তুতি নিলেন।

রাতের ট্রেনে ঢাকা যাবেন। আমি স্টেশনে তাঁকে উঠিয়ে দিতে যাব। ট্রেন রাত দশটায়, আনিস ভাই সন্ধ্যা থেকেই মনমরা। কী একটা বলতে গিয়েও বলছেন না। শুধু বললেন, খুব একটা জরুরি কথা আছে, এখন বলব না। ট্রেন ছাড়ার আগে আগে বলব।

জরুরি কথা কী হতে পারে আমি কিছুই ভেবে পাচ্ছি না। দুঃশ্চিন্তা বোধ করছি। আনিস ভাই ট্রেন ছাড়ার আগে আগে জানালা দিয়ে মুখ বের করে বললেন, হুমায়ুন, আমি দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছি। কানাডায় যাচ্ছি ইমিগ্রেশন নিয়ে। তোমার সঙ্গে আর দেখা হবে না।

আমি অবাক হয়ে বললাম, কেন যাচ্ছেন?

আনিস ভাই সেই কেন’র জবাব দিলেন না। আমি বললাম, কবে যাচ্ছেন?

পরশু যাব। দেশের শেষ ক’টা দিন তোমার সঙ্গে কাটিয়ে গেলাম।

আমরা ছবি বানাব না?

আনিস ভাই জবাব দিতে পারলেন না, ট্রেন ছেড়ে দিল। আমি খুব অভিমানী। তার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখলাম না। যে দেশ নিয়ে তাঁর এত। স্বপ্ন সেই দেশ ছেড়ে কী করে তিনি চলে যান? পিএইচডি করতে আমেরিকা গিয়েছি। হাতের কাছে কানাডা, ইচ্ছে করলেই ভার কাছে যেতে পারি। গেলাম না। আমার অভিমান ভালোবাসার মতোই তীব্র।

তার সঙ্গে দেখা হলো দশ বছর পর। এক দুপুরে হঠাৎ আমার শহীদুল্লাহ হলের বাসায় এসে উপস্থিত। সমস্ত রাগ, অভিমান ভুলে ভাঁকে জড়িয়ে ধরলাম। কত গল্প। গল্প ফুরাতেই চায় না। একসময় ছবি বানানোর প্রসঙ্গ এসে পড়ল। তিনি জানালেন, একটা শর্ট ফিল্ম বানিয়ে হাত পাকিয়েছেন। ছবিটি জার্মান ফিলা ফ্যাস্টিভেলে ‘অনারেবল মেনসান’ পেয়েছে। রবীন্দ্রনাথের মন মোর মেঘের সঙ্গী গানের চিত্ররূপ দিয়েও একটা ছবি বানিয়েছেন ১৬ মিলিমিটারে। ছবি বানানোর টাকা এখন তার হয়েছে। দেশে এসে ছবি বানাবেন। অসুস্থ মাকে দেখতে এক সপ্তাহের জন্যে দেশে এসেছিলেন, এক সপ্তাহ কাটিয়ে কানাডা ফিরে গেলেন।

আবার যোগাযোগ নষ্ট হয়ে গেল। চিঠি লিখি, উত্তর আসে না। একটা টেলিফোন নাম্বার দিয়ে গিয়েছিলেন, টেলিফোন করলে নো রিপ্লাই আসে।

বছরখানিক পরের কথা। এক গভীর রাতে টেলিফোনের শব্দে জেগে উঠে রিসিভার হাতে নিতেই আনিস ভাইয়ের গলা শুনলাম। রাত তিনটায় ঘুম ভাঙানোর জন্যে তিনি দুঃখ প্রকাশ করলেন। তারপর হঠাৎ আমাকে হতভম্ব করে দিয়ে বললেন, হুমায়ুন, আমার ক্যানসার হয়েছে, থ্রোট ক্যানসার। আমি মারা যাচ্ছি। এখন টেলিফোন করছি হাসপাতাল থেকে। মাঝে মাঝে তোমাকে টেলিফোন করে বিরক্ত করব, তুমি কিছু মনে করো না। মৃত্যুর আগে প্রিয় কণ্ঠস্বর শুনতে ইচ্ছে করে।

তিনি হাসপাতালের বেড থেকে টেলিফোন করতেন। তিনিই কথা বলতেন। আমি শুনতাম। তাঁর গলার স্বর নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। বেশির ভাগ কথা বোঝা যেত না। কথা বলতে ভর কষ্ট হতো। তারপরেও অনবরত কথা বলতেন, পুরনো সব স্মৃতির গল্প। তাঁর স্বপ্নের গল্প। সব গল্পই একসময় ছবি বানানোতে এসে থামত। আহা, কী অবসেশানই না তাঁর ছিল ছবি নিয়ে।

মানুষের মৃত্যু হয়, কিন্তু তাদের স্বপ্ন মরে না। আনিস ভাই মারা গেলেন, তাঁর স্বপ্ন কিন্তু বেঁচে রইল। কোনো এক অদ্ভুত উপায়ে সেই স্বপ্ন ঢুকে গেল আমার মধ্যে। এক ভোরবেলায় আমার মেজো মেয়ে শীলাকে ঘুম থেকে তুলে বললাম, মা, আমি একটা ছবি বানাব। ছবির নাম ‘আগুনের পরশমণি’। তুমি সেখানে অপলা চরিত্রে অভিনয় করবে।

অধ্যায় ৪ / ৪

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন