নীল দ্বীপের রাণী

রোমেনা আফাজ

নীল দ্বীপের রাণী – ৫১

ইরানীর চোখ দুটির দিকে তাকিয়ে বনহুর থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো। তার হস্তস্থিত ছোরাখানা নেমে এলো ধীরে ধীরে। দৃষ্টি সহসা ফিরিয়ে নিতে পারলো না বনহুর। কেমন যেন একটা অভিভূত ভাব তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে।

রহমান এবং বনহুরের অন্যান্য অনুচর যারা সেই স্থানে উপস্থিত ছিলো তারা বিস্মিত হলো, হঠাৎ সর্দারের মধ্যে তারা বিরাট একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করলো।

বনহুর যখন তন্দ্রাচ্ছন্নের মত ইরানীর চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলো, রহমান বলে উঠলো সর্দার।

 চমকে উঠলো যেন বনহুর, বললো–এ্যা—কিন্তু তার ছোরাসহ দক্ষিণ হাতখানা আর উদ্যত হলো না।

রহমান বলে উঠলো–সর্দার, একি করলেন? সময় যে উত্তীর্ণ হয়ে যাচ্ছে।

 বনহুর বলে উঠলো-রহমান, মনসুর ডাকুকে এবারের মতও আমি ক্ষমা করলাম।

একসঙ্গে বনহুরের কয়েকজন অনুচর বিস্ময়কর শব্দ করে উঠলো–সর্দার!

মনসুর ডাকুর মুক্তি নিয়ে বনহুরের আস্তানায় ভীষণ একটা সাড়া পড়ে গেলো। কেউ ভেবে পাচ্ছে না হটাৎ সর্দারের মধ্যে এ বিরাট পরিবর্তন এলো কি করে!

রহমান গভীরভাবে চিন্তিত হয়ে পড়েছে—- মনসুর ডাকুর মুক্তি—এ যেন একটা চরম ভয়ঙ্কর কাজ। কারণ মনসুরকে গ্রেপ্তার করার জন্য কয়েকদিন পূর্বে সর্দার যেভাবে ক্ষেপে উঠেছিলো সে এক স্মরণীয় ব্যাপার। সর্দার নিজে গিয়েছিলো কান্দাই পর্বতের সেই গোপন গুহার অভ্যন্তরে, মনসুর ডাকুর গোপন আড়ায়। সেখানে মনসুর ডাকুকে যুদ্ধে পরাজিত করে তাকে বন্দী করে এনেছিলো বনহুর নিজে। আর আজ তাকে এভাবে মুক্তি দিলো। বিষধর সাপকে কেউ কি জীবিত ছেড়ে দেয়?

রহমান আপন মনে বসে ভাবছিলো, সেই সময় নাসরিন এসে বসলো তার পাশে।

রহমান কিছু বলার পূর্বে বলে উঠলো নাসরিন তোমার কি হয়েছে বলোতো? আজ কদিন থেকে তোমাকে সব সময় ভাবাপন্ন দেখছি?

গম্ভীর মুখে বললো রহমান–একটা বিরাট ভুল করেছে আমাদের সর্দার।

বিস্ময়ভরা কন্ঠে বলে নাসরিন–ভুল!

হা।

ও, এবার বুঝেছি, সর্দার মনসুর ডাকে আবার মুক্তি দিয়েছে এই তো?

হাঁ, এ ভুল চরম ভুল। কারণ মনসুর ডাকু সর্দারকে হত্যা করার জন্য ভীষণভাবে উঠে পড়ে লেগে গেছে। কিভাবে তাকে বন্দী করবে বা নিহত করবে, সদা-সর্বদা এ নিয়ে নানারকম কৌশল অবলম্বন করে চলেছে সে।

নাসরিনের চোখেমুখে দুশ্চিন্তার ছাপ ফুটে উঠে। সেও অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়ে।

রহমান আর নাসরিনে এসব নিয়ে আলোচনা হচ্ছিলো, এমন সময় নূরী সেখানে উপস্থিত হলো। ব্যাপারটা সে এখনও শোনেনি, কারণ নূরী তার জাবেদকে নিয়ে সব সময় ব্যস্ত থাকে আজকাল। জাভেদ এখন হাসতে শিখেছে, দু’একটা কথা বলতে শিখেছে। জাভেদের চঞ্চলতা দিন দিন বেড়ে চলেছে ভীষণভাবে, তাই নূরীর ব্যস্ততাও বেড়েছে, কোনোদিকে খেয়াল নেবার সময় নেই তার।

রহমান আর নাসরিনের চিন্তার কারণ সম্বন্ধে নরী যখন সব জানতে পারলো তখন তার মুখখানাও গম্ভীর হলো। মনসুর ডাকুকে হত্যা করতে গিয়ে হঠাৎ বনহুরের মধ্যে পরিবর্তন এলো কেন, সেও ভেবে পেলো না।

এক সময় বনহুরকে নিভৃতে পেয়ে নূরী এসে বসলো তার পাশে, ওর চুলের ফাঁকে আংগুল বুলিয়ে দিতে দিতে বললো সে-হুঁর, একটা কথার সঠিক জবাব দেবে?

বনহুর সম্মুখের পাথুরে টেবিলে রাখা স্থূপাকার আংগুরের মধ্য হতে একটা থোকা তুলে নিয়ে মুখে পুরে বললো-কবে তোমার কথায় সঠিক জবাব দেইনি বলো?

আচ্ছা বলোতো, মনসুর ডাকুকে সেদিন কেন তুমি ক্ষমা করেছিলে?

পূর্বে যে কারণে করেছিলাম সেই কারণে।

এ তুমি কি করেছে হুর? যে তোমাকে হত্যার নেশায় উন্মাদ হয়ে উঠেছে, যে তোমাকে বিষদৃষ্টি নিয়ে দেখে যে তোমার রক্ত শুষে নেবার জন্য পাগল, তুমি তাকে হাতের মুঠায় পেয়েও হত্যা করোনি? তাকে আবার তুমি মুক্তি দিয়েছো?

 নূরীর কথায় বনহুরের মুখে কোনো পরিবর্তন আসে না, সে যেভাবে আংগুর চিবুচ্ছিলো সেইভাবে চিবুতে থাকে।

নূরী ব্যস্তকণ্ঠে বলে–কখনও তুমি হিংস্র পশুরাজ সিংহের চেয়েও ভয়ঙ্কর, কখনও তুমি মেষ শাবকের চেয়েও নিরীহ-তুমি কি বলোতো?

এবার বনহুর হাসে—আমি মানুষ।

মানুষ হলে অমন হয় না, তার মধ্যেও আছে মনুষ্যত্ব-বোধক প্রাণ। তোমার মধ্যে কিছু নেই-সব তোমার খামখেয়ালী–

শুধু আমি নই, পৃথিবীটাই খামখেয়ালী নূরী। দেখছে না এই পৃথিবীর কত রঙ? কেউ হাসে, কেউ কাঁদে, কেউ বা হাওয়ায় উড়ে বেড়ায় ফানুসের মত। খামখেয়ালী পৃথিবীর বুকে আমারও জন্ম হয়েছে, তাই আমিও খেয়ালী, বুঝলে? যা বলল জাভেদ কোথায়?

নূরী বুঝতে পারে, বনহুর মনসুর ডাকুর মুক্তির ব্যাপার নিয়ে কথা বাড়াতে চায় না, তাই সে জাভেদের কথা পেড়ে তাকে অন্যদিকে আকৃষ্ট করতে চেষ্টা করছে। নূরীও কথার মোড় ফেরায় বলে সে-জাভেদ দাইমার কোলে বসে খেলা করছে।

বনহুর আর একটা থোকা আংগুর হাতে তুলে মুখের কাছে ধরে বলে-কবে জাভেদ বড় হবে, ওকে আমি অস্ত্র শিক্ষা দেবো–

 তুমি বুঝি হাঁপিয়ে উঠছে ওকে অস্ত্রশিক্ষা দিতে না পেরে? :

হ বড় হাঁপিয়ে পড়েছি। সত্যি নূরী, সেদিনের কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে বাপুর কাছে যেদিন প্রথম অস্ত্র-শিক্ষা শুরু করলাম, সেদিন কি যে আনন্দ। বাপু আমার হাতে ছোট্ট একটা তরবারি দিয়ে বললো, এসো বনহুর, আমাকে তুমি পরাজিত করবে, এসো।

তুমি কি করলে?

আমি বাপুর হাত থেকে অস্ত্র নিয়ে রুখে দাঁড়ালাম, জানি না সেদিন কিসের যেন একটা উন্মাদনা আমাকে উন্মাদ করে তুললো। আমি বাপুকে আঘাতের পর আঘাত করে চললাম। বাপু হাসিমুখে আমার আঘাত তার তরবারি দ্বারা প্রতিরোধ করে চললো। বাপু আনন্দে আত্মহারা হয়ে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো, অস্ফুট কণ্ঠে বললো–সাবাস বেটা! সেই দিন থেকে আমার মধ্যে জেগে উঠলো একটা নতুন মানুষ।

নূরী মৃদু হেসে বললো–সেই হলো পাথুরে মানুষ দস্যু বনহুর!

তা যা খুশি তুমি তাই বলতে পারো নুরী। সেদিন আমার কচি মনে এক অসীম শক্তির উত্তর ঘটেছিলো যা আজও আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। নূরী, আমার উপর বাপুর ভরসা ছিলো একদিন বড় হবে, তার আশা পূর্ণ করবো—

সে আশা তুমি পূর্ণ করেছে হর, বাপুর সাধ তুমি পূর্ণ করেছে। আজ তুমি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ

— আমার আশা, আমার সাধ পূর্ণ করবে জাভেদ। ওকে মস্তবড় দস্যু করবো। যার প্রচণ্ড দাপটে পৃথিবীর সমস্ত অমানুষ প্রকম্পিত হয়ে উঠবে।

তোমার দাপটেই দেশবাসী অস্থির তদুপরি জাভেদ যদি দস্যু হয় তা হলে তো কথাই থাকবে না। তোমার ছেলে তোমার মত হবে আমি জানি।

সত্যি! সত্যি বলছো নূরী?

হা।

বনহুর নূরীকে টেনে নিলো কাছে।

 নূরী বনহুরের প্রশস্ত বুকে মাথা রাখলো।

 এমন সময় দাইমা জাভেদসহ হাজির হলো সেখানে।

জাভেদের অধস্কুট কণ্ঠস্বর শুনতে পায়—আ-ধ্ব-ব্বা—–

নূরী সরে দাঁড়ায় কনহুরের পাশ থেকে।

বনহুর দাইমা ও জাভেদের দিকে এগিয়ে আসে। হাত বাড়ায় সে জাভেদের দিকে-জাভেদ–এসো–এসো আলু–

জাভেদ দন্তবিহীন মুখে ফিক ফিক করে হেসে হাত বাড়ালো পিতার দিকে।

বনহুর দাইমার কোল থেকে ওকে নিয়ে বুকে চেপে ধরলো। চুমুর পর চুমু দিয়ে হাসতে লাগলো।

বনহুর যখন দাইমার কোল থেকে নূরকে নিয়ে আদর করছিলো তখন হঠাৎ তার কক্ষের সংকেতসূচক নীল-লাল বাগুলোর একটি বাল্ব জ্বলে উঠলো।

নূরী এবং বনহুরের সেদিকে খেয়াল ছিলো না।

দাইমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো সাংকেতিক আলোর বাল্বটা, ভাঙ্গা ভাঙ্গা অস্ফুট শব্দে বলে উঠলো সে-বনহুর দেখো—দেখো–বিপদ-সংকেত আলো জ্বলে উঠেছে—

 বনহুর আর নূরী একসঙ্গে তাকালো কক্ষের দক্ষিণ দিকে। সঙ্গে সঙ্গে বনহুর এবং নূরীর মুখ গম্ভীর হয়ে উঠলো।

বনহুর জাভেদকে নূরীর কোলে দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেলো কক্ষ থেকে।

সমস্ত আস্তানায় তখন বিপদ-সংকেত ধ্বনি হচ্ছে।

বনহুর কক্ষ থেকে বেরিয়ে দ্রুত এগিয়ে চলে ওয়্যারলেস কক্ষের দিকে।

 চারিদিক থেকে ছুটে আসে বনহুরের অনুচরগণ।

বনহুর ওয়্যারলেস মেশিনের সুইচ টিপে দিতেই জ্বলে উঠলো লাল আলোটা, ওয়্যারলেসে ভেসে এলো নারী কণ্ঠস্বর–বনহুর সাবধান হও, তোমার আস্তানার দিকে এগিয়ে চলেছে একদল নররক্ত পিপাসু নিগ্রো রাক্ষস—এরা যেমন ভয়ঙ্কর তেমনি সাংঘাতিক—এরা ঝাম জঙ্গল থেকে এসেছে–এদের সঙ্গে আছে মারাত্মক বিষাক্ত অস্ত্র–লড়াইয়ে কেউ জয়ী হতে পারবে না–

বনহুর ওয়্যারলেস বক্সে মুখ রেখে বললো–কে তুমি আমাকে সাবধান করে দিচ্ছো–

–আমি আশা–কিন্তু আমার সঙ্গে কথা বলার সময় নেই–যাও শীগগীর—ওদের জন্য কোন ব্যবস্থা অবলম্বন করো—

এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আশার কথা ভাবার সময় নেই বনহুরের কারণ আস্তানার বাইরে তার আস্তানারক্ষী অনুচরগণ বিপদ সংকেত শব্দ পাঠাচ্ছে। অত্যন্ত ভয়ঙ্কর বিপদ না দেখলে এ বিপদ সংকেত শব্দ করা হয় না।

বনহুর ওয়্যারলেস কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসতেই রহমান সহ অন্যান্য অনুচর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তার সম্মুখে এসে দাঁড়ালো সকলের চোখেমুখেই ভীষণ উত্তেজনার ছাপ ফুটে উঠেছে।

রহমান বললোসর্দার, আস্তানার উচ্চ কক্ষ হতে মালেক মিয়া জানালো, একদল জমকালো মানুষ মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আমাদের আস্তানার দিকে এগিয়ে আসছে–

হাঁ, ঐ রকম কথাই আশা আমাকে জানালো কিন্তু সে কোথা থেকে আমাকে এভাবে সাবধান করে দিলো বুঝতে পারলাম না। যা সে কথা এখন ভাবার সময় নেই, তোমরা এসোর ভুগর্ভ আস্তানার সর্বোচ্চ ক্ষুদে কক্ষে এসে ছিদ্রপথে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো বনহুর, খালি চোখে যতদূর দৃষ্টি যায় লক্ষ্য করে তেমন কিছু দেখা গেলো না। বাইনোকুলার চোখে লাগাতেই দেখতে পেলো অসংখ্য নিগ্রো অস্ত্র হাতে তীরবেগে এদিকে ছুটে আসছে। বনহুর বললো-রহমান, অগণিত জমকালো বেঁটে মানুষ এদিকে দ্রুত ছুটে আসছে–

সর্দার, ওরা কাদের লোক কি উদ্দেশ্যেই বা এদিকে আসছে?

 উদ্দেশ্য যে কিছু আছে সেটা ঠিক। কিন্তু এরা কাদের লোক আমিও ঠিক বুঝতে পারছি না। তবে যতদূর বুঝা যাচ্ছে ওরা কোনো দ্বীপবাসী জংলী নিগ্রো লোক।

সর্দার, ওরা অতি ভয়ঙ্কর।

হাঁ, অত্যন্ত ভয়ঙ্কর এরা তা ছাড়া আশা জানিয়েছে এদের হাতে নাকি রয়েছে মারাত্মক বিষাক্ত অস্ত্র। সম্মুখ যুদ্ধে এদের সাথে কেউ জয়ী হতে পারবে না। রহমান?

বলুন সর্দার।

ওরা আমাদের আস্তানার নিকটবর্তী হবার পূর্বেই ওদের গতিরোধ করতে হবে। রহমান, আমাদের আস্তানার চারপাশে যে বিরাট খাদ ঢাকা আছে মাটির স্তর দিয়ে, সেই খাদ উঘাটন করে দাও।

রহমান চলো ভূগর্ভ মেশিনকক্ষের দিকে।

রহমানকে সাহায্য করতে চললো আরও কয়েকজন অনুচর।

বনহুর বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে দেখছে, অসংখ্য নিগ্রো ছুটে আসছে তীরবেগে, সূর্যের আলোকে তাদের হাতের অস্ত্রগুলো ঝকমক করছে।

এখন নিগ্রোগুলো অতি নিকটে এসে পড়েছে।

বনহুর রহমানকে জানিয়ে দিলো এবার খাদের মেইন যন্ত্রের চাকা খুলে দিতে।

রহমান ভূগর্ভ মেশিনকক্ষ হতে শুনতে পাচ্ছে সর্দারের নির্দেশ। সেইমত সে কাজ করে চললো। নিগ্রোদল এগিয়ে আসতেই রহমান খাদের মুখ খুলে দিলো, সঙ্গে সঙ্গে অসংখ্য নিগ্রো খাদের মধ্যে সমাধি লাভ করলো।

মাত্র কয়েক মুহূর্ত প্রায় অর্ধেকের বেশি হিংস্র নিগ্রো পড়ে গেলো খাদের মধ্যে। বাকি যারা রইলো তারা ভীষণ ভয় পেয়ে পিছু হটে পালাতে লাগলো। সে এক অদ্ভুত ব্যাপার–বনহুরের মুখে ফুটে উঠলো হাসির রেখা।

 এক ভয়ঙ্কর বিপদ থেকে উদ্ধার পেলো বনহুরের অনুচরগণ। বনহুর আশাকে ধন্যবাদ না জানিয়ে পারলো না, কারণ সে-ই সর্বপ্রথম বিপদ-সংকেত জানিয়ে বনহুরের আস্তানা রক্ষীদের সাবধান করে দিয়েছিলো।

বনহুর এবার ভেবে চলে আশা কোথা থেকে তাকে এ সংকেত জানালো? তার উপকার করেই বা কি লাভ হচ্ছে আশার? কে সে নারী যে তাকেও ঘোলাটে করে তুলেছে। বনহুর আশার সন্ধানে রহমানকে নিযুক্ত করেছিলো কিন্তু সে হতাশ হয়েছে। বনহুর নিজেও আশাকে বহুভাবে অন্বেষণ করে ফিরেছে তবু তাকে আবিষ্কারে সক্ষম হয়নি আজও।

বনহুরের ললাটে একটা গভীর চিন্তারেখা ফুটে উঠে।

*

একদিন গভীর রাতে বনহুর ঝর্ণার পাশে এসে অশ্ব থেকে নেমে দাঁড়ালো। চারিদিক নিস্তব্ধ, শুধু ঝর্ণার জলধারার কল কল শব্দ ছাড়া আর কোনোকিছুই শোনা যাচ্ছে না।

বনহুর তাজকে একটা গাছের সঙ্গে বেঁধে এগিয়ে এলো ঝর্ণার পাশে। জোছনার আলোয় চারিদিক ঝলমল করছে। চাঁদের আলো ঝর্ণার জলে পড়ে অপূর্ব এক শোভা বিস্তার করেছে।

একটা পাথরের উপরে বসে পড়লো বনহুর।

 ঝর্ণার রূপালী জলধারার দিকে তাকিয়ে ছিলো বনহুর আনমনে। বহুদূরে সে গিয়েছিলো তার জম্বুর আস্তানায়। এখানে সে জম্বুর আস্তানার কথাগুলোই ভেবে চলেছে। সেখানে গিয়েছিলো বনহুর আশার খোঁজে। কারণ জম্বু আস্তানা থেকেই আশা ওয়্যারলেসে কয়েকবার তার সঙ্গে কথা বলেছে। বনহুর জম্বুর আস্তানার সর্দার কাসেম খাঁর কাছে গিয়ে জানতে চেয়েছিলো কে তাকে এখান থেকে সাবধানবাণী শুনিয়েছিলো নীলনদের সেই জাহাজে। তারপর আরও কয়েকবার জম্বু আস্তানা থেকে আশা কথা বলেছে। কাসেম খ তাকে যে অদ্ভুত বাণী শুনিয়েছে সত্যি তা বিস্ময়কর। একদিন কাসেম খা নাকি তার বিশ্রামকক্ষে আরাম করছিলো, অন্যান্য অনুচর সবাই বিশ্রাম করছে ঠিক সেই মুহূর্তে এক অদ্ভুত নারী মূর্তির আবির্ভাব ঘটলো। চমকে উঠলো সবাই, কারণ যেখানে কোনো পিপীলিকা প্রবেশে সক্ষম নয় সেখানে একটা জীবন্ত মানুষ কি করে প্রবেশ করলো। সবাই তখন অস্ত্র বিহীন অবস্থায় ছিলো কিন্তু সেই নারীমূর্তি হস্তে ভয়ঙ্কর দুটি আগ্নেয় অস্ত্র। কেউ কোনো কথা বলার পূর্বেই বলে উঠলো নারীমূর্তি—খবরদার, এক চুল নড়বে না বা কোনো অস্ত্র ধারণ করবে না। আমি তোমাদের মঙ্গল কামনা নিয়ে এসেছি। শুধু তোমাদের ওয়্যারলেসটা আমি ব্যবহার করব। কাসেম খাঁ তার অনুচরদের নীরব থাকার আদেশ দিয়েছিলো এবং সে নিজেও কোনো অস্ত্র ধারণ করেনি। কাসেম খাঁর মনে প্রশ্ন জেগেছিলো, কে এই নারী আর কিইবা তার উদ্দেশ্য? নারীমূর্তি ওয়্যারলেসে কথা বলা শেষ করে যেমন এসেছিলো তেমনি নীরবে বেরিয়ে গিয়েছিলো। প্রয়োজন হয়নি তার উপর কঠিন আচরণ প্রয়োগ করতে। এরপর আরও কয়েকবার সেই বিস্ময়কর নারীর আগমন ঘটেছিলো, কাসেম খার অনুমতি নিয়েই সে ওয়্যারলেস ব্যবহার করেছিলো। কাসেম খাও অনেক চেষ্টা করে সেই নারীমূর্তির চেহারা স্বচক্ষে দেখার সুযোগ করে উঠতে পারেনি। সেও জানে না কে সেই নারী–

হঠাৎ বনহুরের চিন্তাজাল বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, সে অনুভব করে কেউ তার পিছনে এসে, দাঁড়িয়েছে। বনহুর দ্রুত ফিরে তাকায়। এ যে সেই নারীমূর্তি যার সমস্ত দেহ কালো আবরণে আচ্ছাদিত। এমনকি হাতে কালো গ্লস পরা পায়ে বুট মাথায় মুকুটের মত কালো আবরণী তারই অংশ দ্বারা সমস্ত মুখমণ্ডল ঢাকা। শুধু ঠোঁট দুটো দেখা যাচ্ছে জোছনার আলোতে।

 বনহুর মুহূর্ত বিলম্ব না করে উঠে দাঁড়ালো, বিস্মিত দৃষ্টি নিয়ে তাকালো সেই অদ্ভুত নারীমূর্তির দিকে।

 নারীমূর্তি বলে উঠলো–জানি তুমি আমার কথাই ভাবছিলে। কে আমি জানতে তোমার বড় সখ হচ্ছে, না?

 বনহুর কোনো জবাব না দিয়ে কুঞ্চিত করে তাকালো।

নারীমূর্তি হেসে বললো–ভাবছো এই মুহূর্তে আমাকে তুমি আবিষ্কার করতে পারো। আমার রহস্যময় চেহারাটিকে তুমি উঘাটন করতে পারো কিন্তু আমি জানি, তুমি তা পারবে না।

এবার বনহুরের মুখমণ্ডল গম্ভীর হয়ে উঠলো, অধর দংশন করে বললো—পারবো না?

না, পারবে তুমি আমাকে আবিষ্কার করতে।

কে তুমি?

বলেছি তুমি আমাকে জানতে চেওনা।

না, তা হবে না। আজ আমি তোমার পরিচয় জানতে চাই। বনহুর নারীমূর্তিটিকে ধরে ফেলে খপ করে। সঙ্গে সঙ্গে একটা নকল হাত খুলে আসে বনহুরের হাতের মুঠায়। নারীমূর্তি যেন হাওয়ায় মিশে যায় মুহূর্তে। বনহুরের কানে ভেসে আসে একটা খট খট আওয়াজ। অশ্বপদ শব্দ সেটা, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বনহুর যেন থ’ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, এমনভাবে আজ পর্যন্ত কেউ তাকে ধোকা দিয়ে পালাতে পারেনি।

 বনহুর জোছনার আলোতে হাতখানা তুলে ধরলো চোখের সম্মুখে, গ্লাস পরা একটি রবারের হাত। বনহুর যখন হাতখানা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে তখন আর পায়ের কাছে খসে পড়লো একখানা ভাঁজ করা চিঠি। চিঠিখানা ঐ নকল হাতের মধ্যে ছিলো বুঝতে পারে বনহুর।

উবু হয়ে বনহুর চিঠিখানা তুলে নিলো, তারপর জোছনার আলোতে চোখের সামনে মেলে ধরলো। লেখাগুলো স্পষ্টই নজরে পড়লো বনহুরের, সে পড়তে লাগলো আপন মনে।

 বনহুর যতই তোমাকে দেখছি ততই আমি বিস্মিত হচ্ছি। তোমার মধ্যে আমি খুঁজে পাচ্ছি আমার স্বপ্নে গড়া সেই সম্রাটকে-যার জন্য আমার এই সাধনা তাকে।
— আশা

 চিঠিখানা পড়ে বনহুরের মুখে একটা হাসির রেখা ফুটে উঠলো, ভাঁজ করে চিঠিটা রাখলো সে প্যান্টের পকেটে। বসা আর হলো না, ঝর্ণার ধারে বসে ক্লান্তি দূর করবে ভেবেছিলো বনহুর- তা আর হলো না। তাজের পাশে এসে পিঠ চাপড়ে বললো–চল যাই।

আস্তানায় ফিরে তাজকে অনুচরদের হাতে দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো বনহুর। নূরী অপেক্ষায় বসে ছিলো বনহুরের বিশ্রামকক্ষে।

বনহুর কক্ষমধ্যে প্রবেশ করতেই নূরী উঠে দাঁড়ালো বললো ফিরতে এত দেরী হলো কেন

নূরীর কথার কোনো জবাব না দিয়ে বনহুর হাসিতে ভেঙ্গে পড়লো।

নূরী বিস্ময়ভরা চোখে তাকিয়ে রইলো বনহুরের মুখের দিকে। মনে তার নানারকম প্রশ্ন উঁকিঝুঁকি মারছে। বনহুর নূরীর মনোভাব বুঝতে পেরে পকেট থেকে আশার দেওয়া চিঠিখানা বের করে এগিয়ে দেয় নূরীর দিকে, বলে–পড়ে দেখো।

নূরীর মনে বিস্ময় তখনও কমেনি, সে বনহুরের হাত থেকে চিঠিখানা নিয়ে পড়ে গম্ভীর হয়ে পড়লো। ক্রুদ্ধকণ্ঠে বললো–হু, বুঝেছি।

কি বুঝেছো নূরী?

বলো আশা কে?

জানি না।

আরও একদিন আমি তোমার কাছে আশাকে জানতে চেয়ে বিমুখ হয়েছি। আশা সম্বন্ধে তুমি আমাকে জানাতে চাওনি।

 জানাতে চাইনি নয়, জানাতে অক্ষম হয়েছি। বিশ্বাস করো নূরী, আমি নিজেই আশাকে চিনি না।

যে নারী তোমাকে এতখানি—

 সে অপরাধ আমার নয়। আমাকে যদি কেউ ভালবাসে ভালবেসে ফেলে সে দোষ কার বলো? সত্যি বলছি আমি আশাকে চিনি না জানি না।

নুরী আর বনহুরের যখন কথা হচ্ছিলো তখন বনহুরের এক অনুচর এসে দাঁড়ালো দরজার বাইরে–সর্দার।

বনহুর বললো —-কে কাওসার?

 হ সর্দার।

এসো।

কাওসার ভিতরে প্রবেশ করলো, হাতে তার একটা নীল রংয়ের চিঠি। বনহুরকে কুর্ণিশ জানিয়ে চিঠিখানা এগিয়ে ধরলো–সর্দার, এ চিঠিখানা রায়হান বন্দর থেকে আমাদের গুপ্তচর পাঠিয়েছে।

গুপ্তচর জমশেদ আলী?

 হ সর্দার।

 বনহুর চিঠিখানা হাতে নিয়ে মেলে ধরলো চোখের সামনে।

নূরী ব্যাকুল আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে রইলো বনহুরের মুখের দিকে। চিঠিখানা পড়ে বনহুরের মুখোভাব ভীষণ গম্ভীর হয়ে পড়লো। অস্ফুট কণ্ঠে উচ্চারণ করলো–নীল দ্বীপের রাণী–

নূরীর চোখেমুখেও একরাশ বিস্ময় ছড়িয়ে পড়লো। অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো–কার চিঠি?

 বনহুর বললো-নীল দ্বীপের রাণীর চিঠি।

নীল দ্বীপের রাণী–কে সে?

আমার মনেও সেই প্রশ্ন জাগছে নূরী। নীলদ্বীপ সে তো নীলনদের ওপারে। সেই দ্বীপের রাণীর চিঠি।

কাওসার আর একখানা চিঠি বের করে বললো–সর্দার, এই চিঠিখানা জমশেদ আলী লিখেছে।

দাও। হাত বাড়ালো বনহুর কাওসারের দিকে।

কাওসার চিঠিখানা দিলো বনহুরের হাতে। বনহুর চিঠিখানা নিয়ে পড়তে লাগলো—-

সর্দার, নীলরংয়ের কাগজে লেখা নীলদ্বীপের রাণীর যে চিঠিখানা পাঠালাম ওটা আমি এক ভিখারীর ঝোলা থেকে পেয়েছি। যার ঝোলা থেকে ওটা পেয়েছি তাকে আমাদের রায়হান আস্তানায় বন্দী করে রেখেছি।
– জমশেদ

বনহুর আবার নীল রংয়ের চিঠিখানা মেলে ধরলো। নূরী বললো–পড়ো দেখি কি লিখা আছে। ওটাতে? বনহুর পড়লো-হিংশু, তোমার কথামত কাজ হচ্ছে না প্রতি সপ্তাহে আমার মন্দিরে একটি যুবক বলি দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তুমি জীবনলাভে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু প্রতিমাসে একটি যুবক বলি হচ্ছে। এবার আমি তোমাকে ক্ষমা করবো না।

বনহুর চিঠি পড়া শেষ করে বললো-নীল দ্বীপের রাণীর সখ তো মন্দ নয়। শিশু বা বালকের– রক্ত নয়, যুবকের রক্ত তার প্রয়োজন হাঃ হাঃ হাঃ কি সুন্দর কথা।

 বনহুরের হাসি দেখে মনে মনে শিউরে উঠলো নূরী, বললো—-আশ্চর্য যুবকের রক্ত দিয়ে নীলদ্বীপের রাণী কি করে?

আমিও তাই ভাবছি নূরী। কাওসার?

 বলুন সর্দার।

তুমি ফিরে যাও রায়হানে, জমশেদ আলীকে বলবে সেই ভিখারীকে যেন আটক রাখে। আমি কাল ভোরেই রায়হানের উদ্দেশ্যে রওনা দেবো।

আচ্ছা সর্দার। কুর্ণিশ জানিয়ে বেরিয়ে গেলো কাওসার।

নূরী বনহুরের জামার আস্তিন চেপে ধরলো–তুমি যাবে সেই নীল দ্বীপে?

 যেতে যে আমাকে হবেই নূরী।

এ তুমি কি বলছে হুর।

 আমি দেখতে চাই নীল দ্বীপের রাণী কে আর কেনই বা সে যুবকের রক্ত গ্রহণ করে চলেছে।

 আমি তোমাকে সেই রাক্ষুসীর দেশে যেতে দেবো না হুর। কিছুতেই না…

নূরী, জানো এর প্রতি আমার কতখানি দায়িত্ব রয়েছে? কত নিরীহ যুবককে বিনাদ্বিধায় ওখানে হত্যা করা হচ্ছে। আমার মনে হয়, এর পেছনে আছে গভীর কোনো রহস্য। নূরী, নীল দ্বীপের রাণীর এ রহস্য আমাকে উদঘাটন করতেই হবে।

কি জানি আমার মনে কেমন যেন আশঙ্কা হচ্ছে। বুকের মধ্যে টিপ টিপ করছে যেন।

দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই নূরী। বনহুর নূরীর চিবুকটা তুলে ধরলো উঁচু করে।

নূরীর চোখ দুটো ছল হয়ে উঠলো, কোনো কথা বলতে পারলো না।

নূরীর ইচ্ছা না থাকলেও পরদিন সে নিজ হাতে বনহুরকে সাজিয়ে দিলো। এগিয়ে দিলো সে আস্তানার বাইরে পর্যন্ত।

বনহুরের সঙ্গে চললো তার প্রধান সহচর রহমান।

*

সর্দার, এই সেই ভিখারী, যার কাছে পাওয়া গেছে নীল দ্বীপের রাণীর নীল চিঠি। কারাকক্ষে এক বন্দীকে দেখিয়ে বললো– জমশেদ আলী।

 বনহুর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বন্দীর আপাদমস্তক লক্ষ্য করে দেখতে লাগলো। ভালভাবে দেখে নিয়ে বললো বনহুর-বৃদ্ধ তোমার নাম?

 বৃদ্ধ তার ঘোলাটে চোখ দুটো তুলে ধরলো বনহুরের মুখে, তারপর বললো— আমার নাম হরিশ চন্দ্র। আর তোমার নাম?

বনহুর হেসে বললো– আমার নাম একটু পরেই জানতে পারবে। এবার বলো নীল দ্বীপের রাণী কে?

নীল দ্বীপের রাণী আমাদের রাণী, এই তার পরিচয়। হাঁ, তার চিঠি তোমার হস্তগত হয়েছে, কাজেই আমি……..

হ, কিছু গোপন করতে গেলে বুঝতেই পারছো তোমার শাস্তি হবে মৃত্যুদণ্ড।

আমাকে তোমরা হত্যা করবে?

হত্যা- সে স্বাভাবিক হত্যা নয়। সে হত্যা হবে এক ভীষণ অবস্থায়। তোমার দেহ থেকে প্রাণ বের হবার পূর্বে তোমার দেহ থেকে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছেটে বাদ দেওয়া হবে, মানে তোমার হাত পা-কান-নাক সব কেটে ফেলা হবে- সব শেষে বাদ দেওয়া হবে তোমার মাথাটা। বলল নীল দ্বীপের নীল রাণী কে?

পুনরায় বৃদ্ধ দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললো– বললাম তো সে আমাদের রাণী।

বনহুর পকেট থেকে নীল রংয়ের সেই চিঠিখানা বের করে বৃদ্ধের দিকে বাড়িয়ে ধরে বলে–

এ চিঠি তুমি পড়েছিলে?

হাঁ, ও চিঠি আমার কাছে লিখা হয়েছিলো, কাজেই আমি পড়েছি।

 বেশ, যেভাবে তুমি এ চিঠির কথা স্বীকার করলে সেই ভাবে সব কথা তুমি আমার কাছে স্বীকার করবে নচেৎ তোমার মৃত্যুর শাস্তি পূর্বেই অবগত হয়েছে হরিশচন্দ্র দেব।

দেব আমি নই, শুধু হরিশচন্দ্র বলেই ডাকবে। দেখো তুমি কে এবং কি তোমার নীতি জানি না, তবে এটুকু আমি বুঝতে পারছি, তুমি সাধারণ ব্যক্তি নও। তোমার চেহারা, তোমার কণ্ঠস্বর সত্য আমাকে অভিভূত করেছে। শুনবে, সত্যি তুমি আমার সব কথা শুনবে?

 হাঁ, তোমার কাছে আমি সব জানতে চাই কিন্তু কোনো একটা শব্দ মিথ্যা হলে পরিত্রাণ নেই আমার কাছে।

বৃদ্ধ বললো এবার–মৃত্যুভয়ে আমি ভীত নই, কারণ প্রতি সপ্তাহে আমাকে একটি করে যুবক সংগ্রহ করতে হবে নচেৎ আমাকে প্রাণ দিতে হবে। আমি এতে অক্ষম, কাজেই বুঝতে পারছে মৃত্যু আমার শিয়রে প্রতীক্ষা করছে। তাছাড়া আমি এখন শেষ ধাপে এসে পৌঁছেছি, মিথ্যা বলার আমার কোনোই প্রয়োজন নেই। হাঁ, একটা প্রশ্ন আমি তোমায় করবো, জবাব দেবে তো?

বনহুর বললো– দেব।

বৃদ্ধ বললো— তুমি কে প্রথমে আমার জানা দরকার।

 বনহুর তাকালো জমশেদ আর রহমানের দিকে।

 বনহুরের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো তারা।

 জমশেদ বললো- সর্দার, ওকে নিজ পরিচয় না দেওয়াই সমীচীন।

 রহমান ভ্রূকুঞ্চিত করে বললো— বৃদ্ধকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করা উচিত নয় সর্দার।

বৃদ্ধ হেসে উঠলো-একটা মৃত্যুপথের যাত্রীর কাছে তোমাদের এত দ্বিধা? আমি শপথ করছি……

 বনহুর বলে উঠলো– শপথের কোনো প্রয়োজন হবে না বৃদ্ধ, কারণ দস্যু বনহুরের হাত থেকে তুমি রেহাই পাবে না কোনদিন।

মুহূর্তে মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো বৃদ্ধের। উচ্ছ্বসিতভাবে বললো–জয় মা কালী, পেয়েছি, পেয়েছি মা তোর সেই সন্তানকে। পেয়েছি তার সন্ধান,….বৃদ্ধ বনহুরের পা থেকে মাথা অবধি তীক্ষ্ণ নজরে দেখতে লাগলো। সে যেন কোনো হারানো মানিকের সন্ধান পেয়েছে, এমনি ভাব ফুটে উঠলো তার মুখমণ্ডলে।

 রহমান এবং জমশেদ আলীর চোখেমুখেও বিস্ময় ফুটে উঠেছে। বৃদ্ধের আচরণ তাদের কাছে অদ্ভুত মনে হচ্ছে। বৃদ্ধ যেভাবে বনকে লক্ষ্য করছিলো তাতে আশ্চর্য না হয়ে পারা যায় না।

এবার বৃদ্ধ বলে উঠলো আমি তাহলে ঠিক যায়গায় এসে পৌঁছে গেছি! দস্যু বনহুরের আস্তানায়….হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ জয় মা কালী……জয় মা কালী……একটু থেমে বললো বৃদ্ধ বাবা বনহুর, আমি বহুদিন হতে তোমার সন্ধান করে ফিরছি, আজ ভগবান আমার বাসনা পূর্ণ করেছেন।

বৃদ্ধের কথাবার্তা এবং আচরণে বনহুরও কম অবাক হয়নি, সে নিশ্চুপ লক্ষ্য করছিলো তাকে। বৃদ্ধের বয়স কম নয়, প্রায় আশির কাছাকাছি হবে। সুদীর্ঘ দেহ, উজ্জ্বল গৌর দেহের রঙ, প্রশস্ত ললাটে চন্দনের তিলক, উন্নত নাসিকা। মুখে একমুখ শুভ্র দাড়ি। মাথায় শুভ্র কুঞ্চিত রাশিকৃত চুল। কাঁধে ছেঁড়া কাথার তৈরি ঝোলাটা এখনও ঝুলছে। বৃদ্ধ বললো এবার মুক্তি আমি চাই না। বনহুর, আমি চাই তুমি সেই রাক্ষসীর কবল থেকে রক্ষা করবে দেশের শত শত নিষ্পাপ নিরীহ যুবকদেরকে। হাঁ, আমি যা বলবো তাই করবে তো?

বললো বনহুর– যদি তোমার কথা মঙ্গলজনক হয় তবে করবো।

বৃদ্ধ জমশেদ আলী আর রহমানের দিকে তাকিয়ে বললো–এদের বাইরে যেতে আদেশ দাও, আমি তোমাকে সব কথা খুলে বলতে চাই।

বনহুর ইংগিত করলো।

জমশেদ আলী আর রহমান বেরিয়ে গেলো।

বৃদ্ধ বললো- বসো, আমার পাশে বসো তুমি।

বনহুর বসলো বুদ্ধের পাশে।

 বৃদ্ধ বলতে শুরু করলো-নীলনদের ওপারে আছে এক দ্বীপ, তার নাম নীল দ্বীপ।

হাঁ, সে দ্বীপের নাম আমি শুনেছি হরিশচন্দ্র। আমি জানতে চাই নীল দ্বীপের রাণীটি কে?

সে কথাই তোমাকে বলবো বৎস। নীলদ্বীপের নীল রাণী মহারাণী বা সম্রাজ্ঞী নয়, সে কাপালিক জয়দেবের কন্যা জয়া। এই নারী মাতৃস্থানীয়া হয়েও মাতা নয়, সে রাক্ষুসী…..থামলো বৃদ্ধ।

বনহুর আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে রইলো বৃদ্ধের মুখে।

বৃদ্ধ বলে চললো–কাপালিক জয়দেব নীল দ্বীপের বনাঞ্চলের একচ্ছত্র অধিপতি ছিলো। তার প্রতাপে নীলদ্বীপের মহারাজ হীরন্ময় সেনগুপ্তও ভীতভাবে রাজ্যে বাস করতেন। জয়দেবের ভীষণ আচরণে এ দ্বীপে শান্তি ছিলো না। দ্বীপবাসীরা সদা-সর্বদা প্রাণ ভয়ে পালিয়ে বেড়াতে। কারণ জয়দেব ছিলো রক্তপিপাসু কাপালিক। তার আখড়ায় ছিলো কালী মন্দির, প্রতি অমাবস্যায় এ মন্দিরে নরবলি হতো। এ নরবলির জন্য নব সংগ্রহের ভার ছিলো মহরাজ হীরন্ময় সেনগুপ্তের উপর। যেখান থেকে তোক একটি নর তাকে সগ্রহ করে দিতে হবে প্রতি অমাবস্যায়।

থামলো বৃদ্ধ ভিখারী তাপসী।

 বনহুর বিপুল উন্মাদনা নিয়ে বৃদ্ধের কথাগুলো শুনে যাচ্ছে! সে যেন কোনো এক কল্পনা জগতে চলে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। অদ্ভুত এক আলোড়ন সৃষ্টি হচ্ছে তার বুকের মধ্যে। বললো বনহুর তারপর?

মহারাজ হীরন্ময় যেন গুপ্ত প্রাণভয়ে এবং রাজ্যের মঙ্গল আশায় গোপনে প্রতি অমাবস্যায় একটি করে নর সগ্রহ করে চললেন। এ কারণে তাকে গোপনে বহু অর্থ ব্যয় করতে হতো। রাজার আদেশ কেউ অমান্য করতে সাহসী হতো না। তারা অর্থের লোভে ও মহারাজের আদেশে এ কাজে আত্ননিয়োগ করলো। কিন্তু কতদিন তারা এভাবে দেশের সর্বনাশ করবে—প্রতি মাসে একটি করে লোক তারা পাবেই বা কোথায়, তবু রাজ আদেশ তাদের পালন করতেই হবে। একদিন হীরনুয়ের রাজকর্মচারিগণ বিদ্রোহী হয়ে উঠলো, তারা সবাই বিমুখ হয়ে বসলো, এ জঘন্য কাজ তারা আর করতে পারবে না। লাখ লাখ টাকা দিয়েও মহারাজ তার কর্মচারীদের রাজি করাতে সক্ষম হলেন না।

বনহুরের মুখে এক দৃঢ়ভাব ফুটে উঠেছে। দু’চোখে তার রাজ্যের বিস্ময়! স্তব্ধ হয়ে শুনছে সে বৃদ্ধের কথাগুলো। বৃদ্ধ বলে যাচ্ছে–একদিন দুদিন তিন দিন করে তিনটি মাস কেটে গেলো। তিনটি অমাবস্যায় মহারাজ হীরন্ময় কাপালিক জয়দেবকে নরবলির জন্য কোনো নর দিতে পারলেন না। হীরন্ময় অহরহ দুশ্চিন্তায় মুষড়ে পড়লেন, তিনি জানতেন কাপালিক জয়দেব কত ভয়ঙ্কর। তাই সদা ভীতভাবে দিন কাটাতে লাগলেন। একদিন গভীর রাতে মহারাজের শয়নকক্ষে হাজির হলো সেই কাপালিক সন্ন্যাসীর বেশে। হীরায় কাপালিককে দেখে থরথর করে কাঁপতে শুরু করলেন, কারণ কাপালিক হন্তে ছিলো এক ভয়ঙ্কর মৃত্যু অস্ত্ৰ খৰ্গ। খর্গ দ্বারা সে বিনা দ্বিধায়। মহারাজকে দ্বিখণ্ডিত করে ফেলতে পারে। বললো কাপালিক–আমার কথা অমান্য করার সাহস কি করে তোমার হলো? সুখ নিদ্রায় অভিভূত রয়েছে, মনে আছে আমার কথা? হীরন্ময় কম্পিত কণ্ঠে করজোড়ে বললেন–আছে কিন্তু আমি অক্ষম সন্ন্যাসী বাবাজী! কারণ আর কোনো লোক আমি পাচ্ছি না যাকে আপনার জন্য দিতে পারি। কাপালিকের চক্ষু দিয়ে অগ্নি স্ফুলিঙ্গ নির্গত হতে থাকে। সেই মুহূর্তে কাপালিক মহারাজকে হত্যা করতে উদ্যত হলো, মহারাজ সম্মুখে মৃত্যুদূত দেখে শিউরে উঠলেন, কাপালিকের পা জড়িয়ে ধরে বললেন মহারাজ আবার–আমি কথা দিচ্ছি, যেমন করে পারি আপনার বলির জন্য প্রতি অমাবস্যায় একটি করে লোক সংগ্রহ করে দেবো। কাপালিক বজ্রকঠিন কণ্ঠে গর্জে উঠলো–প্রতি অমাবস্যায় নয়, প্রতি সপ্তাহে আমাকে একটি লোক দিতে হবে, যদি অক্ষম হও তবে তোমার মাথা দিতে হবে।

বনহুর বললো–তারপর?

মহারাজ হীরন্ময় চোখে অন্ধকার দেখলেন কিন্তু কোনো উপায় নেই, কাপালিকটির কবল থেকে উদ্ধারের পথ বন্ধ। মহারাজ তার কর্মচারীদের প্রচুর অর্থের লোভ দেখিয়ে এবং ভয় দেখিয়েও কোনো ফল হলো না। শেষ পর্যন্ত নিজ পুত্রকে বলির জন্য কাপালিক হস্তে তুলে দেয়াই স্থির করলেন হীরন্ময়। এ কথা বলতে গিয়ে বাষ্পরুদ্ধ হয়ে এলো বৃদ্ধ ভিখারীর গলা।

বনহুর লক্ষ্য করলো, বৃদ্ধের গণ্ড বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু ধারা। নিজকে অতি কষ্টে সংযত করে নিয়ে বললো বৃদ্ধ আবৗর-হীরন্ময় যেন নিজ পুত্রকে ফুসলিয়ে নিয়ে গেলেন সেই নীলদ্বীপের গহন জঙ্গলে। যুবক সমীর যেন গুপ্ত বুঝতে পারলো না পিতার মনোভাব, সেও বিনা দ্বিধায় পিতার সঙ্গে এসে হাজির হলো সেই ভয়ঙ্কর নররাক্ষস কাপালিক জয়দেবের কালী মন্দিরে…..থামলো বৃদ্ধ ভিখারী। তার মনে যে গভীর একটা বেদনা চাপ ধরে উঠছে স্পষ্ট বুঝা গেলো। একটু সুস্থির হয়ে নিয়ে বললো বৃদ্ধ-সমীর সেন সহ হীরন্ময় যখন মন্দিরে প্রবেশ করলেন তখন সমীর সেন পিতাকে জিজ্ঞেস করলো বাবা এখানে আমাকে কেনো নিয়ে এলে? হীরন্ময় পুত্রের প্রশ্নের কোনো জবাব দিতে পারলেন না। তিনি ভয়ঙ্কর এক মুহূর্তের জন্য প্রতীক্ষা করতে লাগলেন।

বলো, তারপর কি হলো? অধীর কণ্ঠে বললো বনহুর।

ভিখারীর চোখ দুটো করুণ হয়ে উঠলো, ব্যথাজড়িত বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বললো সে–হীরন্ময় যখন কাপালিকের আগমন প্রতীক্ষা করছে তখন যুবক সমীর সেন উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে, সে যেন বুঝতে পেরেছে তার পিতা তাকে কোনো অভিসন্ধি নিয়ে এখানে এনেছেন, তাকাতে লাগলো সে এদিক-সেদিক। ঠিক সেই মুহূর্তে কাপালিক তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে যুবরাজ সমীর সেনকে চারিপাশ থেকে ঘেরাও করে ফেললো। তখন সমীর বুঝতে পারলো কেন তার পিতা তাকে এখানে এনেছিলেন……

থামলো বৃদ্ধ ভিখারী, কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেছে তার।

বনহুর অধীর আগ্রহ নিয়ে শুনছে তার কথাগুলো। কারাকক্ষের নিস্তব্ধতা যেন জমাট বেঁধে উঠলো ক্ষণিকের জন্য।

বৃদ্ধ বলতে শুরু করলো–সমীরকে হাত-পা-মুখ বেঁধে কালীমার সম্মুখে নেওয়া হলো….না না, তারপর আর কিছু আমি জানি না…জানি না……

বনহুর এবার বৃদ্ধ ভিখারীর জামার আস্তিন চেপে ধরে ভীষণভাবে ঝাঁকুনি দিয়ে কঠিন কণ্ঠে বললো-বলো কে সেই মহারাজ হীরন্ময় যে নিজের প্রাণের বিনিময়ে যুবক পুত্রকে বিসর্জন দিতে পারে? কে সেই নিষ্ঠুর পিতা? কোথায় আছে সে বলো?

না না, ওকথা আমাকে জিজ্ঞেস করো না, সেই নিষ্ঠুর পাষণ্ড পিতার পরিচয় আমি জানি না। শুধু জানি, সে নীলদ্বীপের মহারাজ হীরন্ময়।

তোমাকে বলতেই হবে।

বলবো না, বলবো না আমি কোথায় আছে সে।

তুমি লুকোতে চেষ্টা করলে পারবে না বৃদ্ধ, আমি জানি তুমিই সেই নিষ্ঠুর পিতা হীরন্ময় সেনগুপ্ত……

আমি!

 হ তুমি।

বৎস, তুমি আমাকে হত্যা করো, আমি মহাপাপী, মহাপাতকী…

 হত্যা করার পূর্বে তোমাকে আমার প্রয়োজন আছে।

 আমাকে তোমার প্রয়োজন?

হাঁ, তোমার পুত্রহত্যার প্রতিশোধ তোমাকেই গ্রহণ করতে হবে। মহারাজ তুমি এত নিষ্ঠুর! যুবক পুত্রের আশা-আকাঙ্ক্ষা, তার ভবিষ্যৎ মুছে দিয়ে তুমি নিজে আজও পৃথিবীর বুকে বিচরণ করে ফিরছো? তোমার হৃদয় বলে কোনো জিনিস নেই মনে হচ্ছে।

 তিরস্কার করো, তুমি তিরস্কার করে আমাকে। নীল দ্বীপের মহারাজ আমি নই, আমি নীল দ্বীপের অভিশাপ। তাইতো আজ আমি রাজ্য ছেড়ে, পরিজন ত্যাগ করে ভিখারী হয়েছি। তা, এখনও বহু কথা তোমাকে বলা হয়নি–সব শোনো, তারপর তুমি আমাকে হত্যা করো। একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলো ভিখারীবেশী মহারাজ হীরন্ময় সেন গুপ্ত–চোখের সম্মুখে পুরে মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড দেখলাম…নিজেকে কিছুতেই স্থির রাখতে পারলাম না…আক্রমণ করলাম আমি কাপালিক জয়দেবকে…কিন্তু পারলাম না কিছু করতে— ওরা আমাকে ধরে ফেললো—- হত্যা করার জন্য খর্গ উদ্যত করলো…তখন আমি চোখে মৃত্যু বিভীষিকাময় অন্ধকার। দেখলাম…এই জীবন রক্ষার জন্য কত অসহায় প্রাণ তুই বিনষ্ট করেছিস তবু তোকে মরতে হলো? নিজের পুত্রকে তুই বিসর্জন দিলি–এই কি তার প্রতিদান? মন আমার বিদ্রোহী হয়ে উঠলো…ভাবলাম, না না, এভাবে মরবো না…প্রতিশোধ নিতে হবে…প্রতিশোধ…বৃদ্ধ মহারাজ হীরন্ময় সেনগুপ্তের মুখ কঠিন হয়ে উঠলো, অধর দংশন করতে লাগলেন তিনি।

 বনহুর বিস্ময় নিয়ে বৃদ্ধের মুখোভাবে মুহুর্মুহুঃ পরিবর্তন লক্ষ্য করছিলো। বৃদ্ধের হৃদয়ের অভূতপূর্ব অনুভূতি অনুভব করছিলো সে অন্তর দিয়ে।

বৃদ্ধ মহারাজ আবার বলতে লাগলেন–আমার মন বললো…এই শয়তান কাপালিক যদি তোকে হত্যা করে তাহলে প্রতিশোধ নেবার কেউ থাকবে না। সে দিনের পর দিন আরও শত শত নিষ্পাপ প্রাণ বধ করে চলবে। তা হয় না, তোকে বাঁচতে হবে, ওকে নিঃশেষ করতে হবে…আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এলো, আমি কাপালিক জয়দেবের পা জড়িয়ে ধরে বললাম, আমাকে মেরো না, আমি শপথ করছি তোমার বলির জন্য প্রতি মাসে একটি করে যুবক দেবো, যেমন আমার পুত্র সমীর সেনকে দিয়েছি…আমার সেই কথায় খুশিতে কাপালিক জয়দেবের চোখ নেচে উঠলো। আমাকে বললো সে, কালীমায়ের পা স্পর্শ করে শপথ কর নাহলে আমি তোকে ক্ষমা করবো না। আমি মা কালীর পা স্পর্শ করে শপথ করলাম-মুখে বললাম, প্রতি মাসে একটি করে যুবক তোমার বলিদানের জন্য দেবো, কিন্তু মনে মনে বললাম, মা আমাকে ক্ষমা করিস, আমি তোর পা স্পর্শ করে মিথ্যা কথা বললাম। আমি জয়দেবকে বলি দেবো তোর পায়ে…আমি ছাড়া পেলাম, তারপর থেকে জয়দেবকে হত্যা করার জন্য উন্মাদ হয়ে উঠলাম। একদিন সুযোগ এলো…জয়দেব তার মন্দিরে পূজা করে চলেছে, এমন সময় আমি হাজির হলাম সেই মন্দিরে। আড়ালে লুকিয়ে পড়লাম। আড়াল থেকে দেখলাম কাপালিক জয়দেব পূজা করছে, তার পাশেই পড়ে রয়েছে সূতীক্ষ্ণ ধার খর্গ। চোখ দুটো আমার জ্বলে উঠলো, একটা বিপুল খুনের নেশা আমাকে পেয়ে বসলো। আমি সুযোগ খুঁজতে লাগলাম। সুযোগ এলো, জয়দেব পূজা শেষ করে যেমন সে মাথাটা মাটিতে রেখে দেবীকে প্রণাম করতে গেলে অমনি আমি আড়াল থেকে বেরিয়ে খৰ্গটা তুলে নিলাম হাতে, মুহূর্ত বিলম্ব না করে খর্গের এক কোপে দ্বিখণ্ডিত করে ফেললাম কাপালিক জয়দেবের দেহ থেকে মাথাটা। উঃ! সে কি ভীষণ রক্তস্রোত। আমি আরষ্ট হয়ে গেলাম। ঠিক ঐ সময় সহসা এক ভয়ঙ্করী নারীমূর্তি আমার সম্মুখে এসে দাঁড়ালো…..

নারীমূর্তি বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বললো বনহুর।

হাঁ, সে এক প্রেমূর্তি যেন। আমার চুল বজ্রমুষ্ঠিতে চেপে ধরলো। সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন কাপালিক আমাকে ধরে ফেললো দৃঢ়হস্তে। নারীমূর্তিকে আমার চিনতে দেরী হলো না, সে জয়দেবের কন্যা যোগিনী নীলা। পিতার চেয়েও ভয়ঙ্করী এই যযাগিনী, রাক্ষুসীর মত তার কার্যকলাপ। এই যোগিনীকে নীলদ্বীপের রাণী বলে ওরা। আমি জয়দেবকে হত্যা করলাম বটে কিন্তু যোগিনী নীলার হাত থেকে নিস্তার পেলাম না। আমাকে সে অঙ্গীকার করালো সপ্তাহে একটি করে যুবক দিতে হবে বলির জন্য। প্রতিশ্রুতি দিয়ে জীবন রক্ষা পেলাম সেদিন, কিন্তু পরিত্রাণ পেলাম না, এক এক করে আমার চার পুত্রকে সপে দিতে হয়েছে সেই রাক্ষুসী যোগিনী নীলদ্বীপের রাণীর হাতে। পাঁচ পুত্রকে বিসর্জন দিয়ে আমি ভিখারী হয়েছি, দেশ ত্যাগ করেছি, রাজ্যের মায়া ত্যাগ করেছি, আত্নীয়-পরিজনকে ত্যাগ করেছি কিন্তু পরিত্রাণ পাইনি সেই নর-রাক্ষুসীর হাত থেকে……হাঁ, এবার আমি পরিত্রাণ পাবো। আমি জানি, একমাত্র দস্যু বনহুরই পারবে সেই নর রাক্ষুসীকে কাবু করতে। তাই-তাই আমি খুঁজে ফিরছিলাম তাকে। পেয়েছি, পেয়েছি আমি……মহারাজ হীরন্ময় উন্মাদের মত চেপে ধরলেন বনহুরের জামাটা-কথা দাও, তুমি সেই নর-রাক্ষুসী পিশাচিনী নীল দ্বীপের রাণীকে ধ্বংস করবে? বলল, বলো, কথা দাও আমাকে?

 বনহুর কিংকর্তব্যবিমূছের মত স্তব্ধ হয়ে গেছে, সে যেন কোনো রূপকথার কাহিনী শুনছিলো। এবার সম্বিৎ ফিরে আসে তার, হীরন্ময় সেনের মুখে দৃষ্টি সীমাবদ্ধ করে দৃঢ়কণ্ঠে বলে–কথা দিলাম, তোমার পাঁচ পুত্রের হত্যার প্রতিশোধ আমি নেবো।

 সত্যি, সত্যি বলছে যুবক?

 হাঁ, সত্যি বলছি।

কিন্তু তোমার যদি কোনো বিপদ হয়?

এক টুকরা হাসির রেখা ফুটে উঠলে বনহুরের ঠোঁটের কোণে, বললো সে— দস্যু বনহুর কোনো বিপদে পিছপা হয় না মহারাজ।

আমি তা জানি, আর জানি বলেই তো তোমাকে খুঁজে ফিরছিলাম। কত জায়গায় তোমার সন্ধানে ফিরেছি, যেখানেই শুনেছি তোমার নাম সেখানেই ছুটে গেছি কিন্তু কোথাও তোমার দেখা পাইনি। ভগবান আমার ডাক শুনেছিলেন, তাই আজ তোমাকে পেয়েছি,

বনহুর বুললো– মহারাজ, আপনাকে তুমি বলে সম্বোধন করার জন্য আমি লজ্জিত, মাফ করবেন।

না না, তুমি আমার সন্তানের মত। সন্তান পিতাকে তুমি বলেই সম্বোধন করে থাকে।

বেশ, আমাকে সন্তান বলেই মনে করবেন। এবার আপনি খেয়ে নিয়ে বিশ্রাম করুন, পরে আপনার সঙ্গে আমার নিভতে আলাপ আছে।

 বনহুর করতালি দিলোঁ, সঙ্গে সঙ্গে রহমান এবং জমশেদ আলী কারাকক্ষে প্রবেশ করলো।

বনহুর বললো–তাকে কারাকক্ষ থেকে বের করে নিয়ে যাও এবং ভাল খাবার দাও এবং বিশ্রামের ব্যবস্থা কর।

 বনহুরের আদেশমত বন্দী ভিখারীবেশী নীলদ্বীপের মহারাজ হীরন্ময় সেনকে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হলো। তার বিশ্রাম এবং ভক্ষণের সুব্যবস্থা করা হলো।

*

দস্যু বনহুর ভীল যুবকের বেশে সজ্জিত হয়ে মহারাজ হীরন্ময় সেনের সম্মুখে এসে দাঁড়ালো। তাকে হঠাৎ চিনে উঠতে না পেরে অবাক হলেন মহারাজ, বললেন–কে তুমি, কি চাও আমার কাছে?

বনহুর হেসে বললো–আমি বনহুর!

বনহুর! দস্যু বনহুর তুমি?

 হ মহারাজ। বলুন এখন আমাকে আপনার সঙ্গে নিতে কোনো অসুবিধা আছে?

না। কিন্তু……কিন্তু……

বলুন– কিন্তু কি?

সেই নর-রাক্ষুসী যোগিনী তোমাকে যদি সত্যিই হত্যা করে বসে? তাহলে আমার সব আশা ভরসা নষ্ট হয়ে যাবে। প্রতিশোধ আর কোনোদিনই

হাসলো বনহুর, সে হাসির মধ্যে ফুটে উঠে এক বৈচিত্র্যময় ভাবধারা। বললো সে–সেজন্য আপনার দুশ্চিন্তার কারণ নেই মহারাজ।

হীরন্ময় সেন গম্ভীর মুখে বসে রইলেন।

বনহুর বললো—আপনি প্রতিবারের মতই আমাকে নিয়ে উপস্থিত হবেন নীল দ্বীপে, তারপর সেই জয়দেবের কালী মন্দিরে। আমাকে তুলে দেবেন নীলা যোগিনীর হাতে……

এ সর্বনাশ আমি করতে পারবো না।

 নিজ পুত্রকে আপনি কি করে তবে তুলে দিয়েছেন সেই নর-শয়তান কাপালিকের হাতে?

তখন আমার জীবনের প্রতি ছিলো এক মহাশক্তিময় আকর্ষণ–আজ আর সে আকর্ষণ নেই, মৃত্যুভয়ে ভীত আর নই আমি। শুধু চাই প্রতিশোধ, জয়দেবকে আমি স্বহস্তে হত্যা করেছি, তার যোগিনী কন্যাকে এবার হত্যা করতে চাই। বনহুর, শুধু তাই নয়, ধ্বংস করতে চাই সেই নর রাক্ষুসী যোগিনী নীলদ্বীপের রাণীর আখড়া নীল জঙ্গল, সেই কালী মন্দির, তার দলবল,…..

আপনার বাসনা পূর্ণ হবে মহারাজ। আমি যা বলবো সেইভাবে কাজ করবেন।

*

রায়হান বন্দর থেকে ভিখারীবেশী মহারাজ হীরন্ময় সেন এবং ভীল যুবক-বেশী দস্যু বনহুর জাহাজে উঠে বসলো।

তিন দিন তিন রাত্রি চলার পর জাহাজটি নীলদ্বীপে এসে পৌঁছলো।

ভিখারীবেশী মহারাজের সঙ্গে বনহুর নেমে পড়লো নীলদ্বীপ বন্দরে।

নীলদ্বীপের নাম বনহুর শুনেছিলো, আজ সেই নীলদ্বীপে আগমন করে মনে মনে খুশি হলো সে। নীলদ্বীপ নীলই বটে, সুন্দর ছবির মত দ্বীপটা। সবুজ বনানী ঢাকা উঁচু-নীচু জায়গা, মাঝে মাঝে উচ্চ অট্টালিকা। প্রশস্ত রাজপথ, পথের দুপাশে নানারকম দোকানপাট। দ্বীপের পূর্বদিকে ঘন জঙ্গল, ওটাই হলো নীল দ্বীপের নীল জঙ্গল।

ভিখারীর সঙ্গে ভীল যুবক পথ চলছিলো।

ভিখারী আংগুল তুলে দেখালো–ঐ সেই নীল জঙ্গল। ওখানেই আছে নীল দ্বীপের রাণী নীলা।

ভীল যুবকের চোখ দুটো শুধু চকচক্ করে উঠলো, কোনো জবাব দিলো না সে।

পথ চলেছে ওরা দুজন।

বনহুরের মাথায় তখন একরাশ চিন্তা জট পাকাচ্ছিলো……কিভাবে সে কাজ শুরু করবে…প্রথমে কোনো এক স্থানে আশ্রয় নিতে হবে, তারপর গোপনে সন্ধান নিতে হবে সেই নর রাক্ষুসী যযাগিনীর। অতঃপর মহারাজ হীরন্ময়ের সঙ্গে প্রকাশ্য বলিদানের জন্য হাজির হতে হবে কাপালিক জয়দেবের সেই কালীমন্দিরে……।

পথ চলতে চলতে বড় হাঁপিয়ে পড়েছিলো মহারাজ হীরন্ময় সেন। বনহুর তাকে বললো– মহারাজ, চলুন ঐ গাছের নিচে বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করা যাক।

মহারাজ হীরন্ময় খুশি হয়ে বললেন–তাই চলো বাবা।

মহারাজ, এরপর থেকে আপনি আমাকে বৎস’ বলেই ডাকবেন—আর আমি আপনাকে ডাকবো ‘গুরুদেব বলে।

হাঁ, সেই ভাল।

উভয়ে এসে বসলো পথের ধারে একটা গাছের নিচে। শীতল ছায়ায় দেহের ক্লান্তি দূর হয়ে গেলো অল্পক্ষণে। ভীল যুবকবেশী দস্যু বনহুর বললো—পুরুদেব, এখন সর্বপ্রথম রাজ প্রাসাদেই আপনাকে যেতে হবে। কারণ সেখানে আপনাকে দুদিন অপেক্ষা করতে হবে, অমাবস্যার দুদিন বাকি আছে।

হ বৎস, তুমি ঠিকই বলেছে। অমাবস্যা রাতে সোজা তোমাকে নিয়ে হাজির হবো নীল জঙ্গলে।

গুরুদেব!

বলো?

রাজপ্রাসাদে আপনি নিজ পরিচয় গোপন রাখতে চেষ্টা করবেন। পারবেন কি সক্ষম হতে?

সকলের চোখে ধূলো দিয়ে নিজে অতিথি হিসেবে থাকতে পারবো কিন্তু একজনের কাছে পারবো না আত্নগোপন করতে, সে হলো আমার একমাত্র কন্যা বিজয়ার কাছে।

বিজয়া!

হাঁ, আমার পাঁচপুত্র এবং এক কন্যা ছিলো। পাঁচ পুত্রকে বিসর্জন দিয়েছি, শুধু একমাত্র কন্যা বিজয়া মা আমার রাজপ্রাসাদ আলো করে আছে। জানি না তার ভাগ্যে কি আছে! হীরন্ময় সেনের গণ্ড বেয়ে দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।

বনহুর কিছু বলতে যাচ্ছিলো, ঠিক ঐ মুহূর্তে তার সম্মুখে মাটিতে একটি তীরফলক এসে বিদ্ধ হলো। চমকে উঠলো বনহুর, তীরফলকটি হাতে তুলে নিতেই দেখতে পেলো তাতে বাধা রয়েছে একখানা ভাজ করা কাগজ। কাগজখানা দ্রুতহস্তে খুলে সর্বপ্রথম কাগজের নিচে তাকালো বনহুর, দেখলো লেখা আছে–আশা”। নীলদ্বীপে আশা এলো কি করে! বনহুরের মনে বিস্ময় জাগলো। এবার সে চিঠিখানা পড়লো

“বনহুর, অত্যন্ত সাবধানতার সঙ্গে কাজ করবে। তোমার উপর নির্ভর করছে নীলদ্বীপের ভবিষ্যৎ। আমি তোমার সঙ্গে আছি। “
— আশা

বনহুর যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে, আশা তাকে অনুসরণ করে নীলদ্বীপেও এসেছে! অস্ফুট কণ্ঠে সে। উচ্চারণ করলো–আশ্চর্য!

 এতক্ষণ হীরন্ময় সেন অবাক হয়ে বনহুরের হাতের চিঠিখানা লক্ষ্য করছিলেন এবং মনে মনে ভীত হয়ে উঠছিলেন, এবার বললেন তিনি–কার এ চিঠি বৎস?

বনহুর বললো—পড়ে দেখুন গুরুদেব?

চিঠিখানা দিলো বনহুর মহারাজ হীরন্ময় সেনের হাতে।

হীরন্ময় সেন চিঠিখানা পড়ে বললেন-আশা! কে এই আশা?

আমিও জানি না কে এই নারী যে আমাকে অনুসরণ করে নীলদ্বীপ পর্যন্ত এসেছে।

 হীরন্ময় বললেন-আশ্চর্য বটে!

বনহুর তখন গভীরভাবে ভেবে চলেছে……আশার উদ্দেশ্য কি? কেনই বা সে তাকে এমনভাবে অনুসরণ করে। কেনই বা তাকে রক্ষার জন্য এত তার আগ্রহ? আর কেনই বা সে নিজকে এভাবে গোপন করে রাখে……ভেবে কিছু স্থির করতে পারে না। উঠে পড়ে বনহুর আর হীরন্ময় সেন।

আবার তারা পথ চলতে শুরু করে।

নীলদ্বীপের সৌন্দর্য মুগ্ধ করে বনহুরকে।

বহুক্ষণ চলার পর রাজপ্রাসাদে উপস্থিত হয় তারা।

মহারাজ হীরন্ময় তার অংগুরী দেখাতেই প্রহরী পথ মুক্ত করে দেয়। হীরন্ময় প্রাসাদে প্রবেশ করেন, সঙ্গে তার ভীল যুবক-বেশী দস্যু বনহুর। অন্তঃপুরে প্রবেশ করার পূর্বে ভিখারীর পোশাক পরিবর্তন করে ফেলেন মহারাজ হীরন্ময়!

মহারাজ ফিরে এসেছেন শুনে ছুটে আসেন মহারাণী মাধবী দেবী এবং কন্যা বিজয়া।

মহারাজ প্রায় ছ’মাস পূর্বে প্রাসাদ ত্যাগ করেছিলেন, আজ তিনি ফিরে এসেছেন, এ যে পরম সৌভাগ্য। প্রাসাদে আনন্দের বান বয়ে যাওয়ার কথা কিন্তু কেউ খুশি হতে পারলেন না, কারণ মহারাজ শাপগ্রস্ত। তাঁর পাঁচ সন্তানকে বলি দান করেছেন তবু তিনি শাপমুক্ত হতে পারেননি, ভিখারীর বেশে তাকে দেশ হতে দেশান্তরে ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে, সংগ্রহ করতে হচ্ছে কাপালিক জয়দেবের মন্দিরের নরবলির জন্য নিষ্পাপ যুবকগণকে।

মহারাণী মাধবী দেবী এবং রাজকন্যা বিজয়া পিতার সঙ্গে এক ভীল যুবককে দেখে শিউরে উঠলো, না জানি কে এই যুবক।

মহারাণী এবং রাজকন্যা করুণার চোখে ভীল যুবকটিকে লক্ষ্য করতে লাগলো। মহারাজ বললো–রাজপ্রাসাদে এর থাকা এবং খাওয়ার ব্যবস্থা করে দাও।

মহারাজের কথামত ভীল যুবক-বেশী বনহুরকে রাজপ্রাসাদে থাকা এবং খাওয়ার ব্যবস্থা করা। হলো।

 মহারাজ হীরন্ময় সেন অন্তপুরে তার বিশ্রামকক্ষে প্রবেশ করতেই মহারাণী মাধবী দেবী স্বামীর সম্মুখে এসে অশ্রুভরা চোখে বললেন–একি করছো তুমি? নিজ পুত্রদের বিসর্জন দিয়েও তোমার সাধ মেটেনি? কি হবে রাজ্য নিয়ে, কি হবে আর এ তুচ্ছ জীবন বাঁচিয়ে? পারবে না তুমি আর কোনো নিষ্পাপ জীবন হত্যা করতে। ঐ ভীল যুবককে তুমি মুক্তি দাও।

 মহারাজ এবং মহারাণী যখন অন্তপুরে এই নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছিলো তখন বিজয়া এসে দাঁড়ায় ভীল যুবকের কক্ষে।

 চমকে উঠে ভীল যুবক, সে কেবলমাত্র তার শয্যায় শয়ন করতে যাচ্ছিলো, ফিরে তাকিয়ে সোজা হয়ে বললো–আপনি!

হাঁ, আমি রাজকন্যা বিজয়া। ভীল যুবক, তুমি জানো না তোমাকে এখানে কেন আনা হয়েছে?

 ভীল যুবকের দু’চোখে প্রশভরা দৃষ্টি ফুটে উঠে, ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায় সে বিজয়ার দিকে।

 বিজয়া কক্ষের দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে নিয়ে বলে—-শীগৃগীর তুমি এখান থেকে পালিয়ে যাও। একটি দিন তুমি এই নীলদ্বীপে থাকবে না।

ভীল যুবক বলে উঠলো—আমার কেউ নেই রাজকুমারী। আমি বড় অসহায়, আমাকে তাড়িয়ে দেবেন না।

বিজয়া সরে আসে আরও, বললো–ভীল যুবক, এই রাজপ্রাসাদ তোমার জন্য নিরাপদ নয়। তুমি যত শীঘ্র পারো পালিয়ে যাও।

কোথায় যাবো আপনিই বলে দিন রাজকুমারী?

রাজকুমারী বিজয়ার দু’চোখে করুণা ঝরে পড়ে, সেও চিন্তিত হয়ে পড়ে। সত্যি লোকটা বড় অসহায়, যাবেই বা কোথায়! বিজয়া নির্বাক দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকে ভীল যুবকের মুখের দিকে। ওর প্রশস্ত ললাটে কুঞ্চিত কেশ রাশি, কানে বালা, গভীর নীল দুটি চোখ। বিজয়ার কাছে বড় ভাল লাগে ওকে। বড় মায়া হয়, কিন্তু কি করে উদ্ধার করবে ওকে ভেবে পায় না। তার পিতা ওকে যে বলি দেয়ার জন্য এনেছেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলে বিজয়া তোমাকে আমি আমার গোপনকক্ষে লুকিয়ে রাখবো। তুমি নিরাপদে থাকবে সেখানে। অমাবস্যা রাত কেটে গেলে তুমি চলে যেও।

 ভীল যুবক বললো অমাবস্যা রাত কেটে গেলে আমি কোথায় যাবো? আপনার পিতা আমাকে একটা কাজ দেবেন বলে এনেছেন।

রাজকুমারী বেশ বিপদে পড়লো, ওকে যতই বুঝাতে চেষ্টা করে সে একেবারে কিছু বুঝতেই চায় না।

শেষ পর্যন্ত বিজয়া বিমুখ হয়ে ফিরে গেলো অন্তপুরে।

রাত্রির অন্ধকার তখন রাজপ্রাসাদে নববধূর মত ঘোমটা টেনে দিয়েছে। প্রাসাদের লোকজন সবাই নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। মহারাণী সন্ধ্যা প্রদীপ হাতে উঠানে তুলসী মঞ্চের পাশে দাঁড়িয়ে নীরবে অশ্রু বর্ষণ করে চলেছেন।

রাজকন্যা বিজয়া পিতার কক্ষে প্রবেশ করলো।

বিজয়া যখন রাজকক্ষে প্রবেশ করে পিতার পাশে এসে দাঁড়ালো তখন ভীল যুবক সকলের অলক্ষ্যে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে কান পাতলো। শুনতে পেলো সে বিজয়ার ব্যাকুল কণ্ঠ–বাবা, তুমি ঐ ভীল যুবকটিকে হত্যা করো না, ওকে তুমি কাপালিক কন্যা যোগিনী নীলার হাতে তুলে দিও না। বলো বাবা, বলো তুমি মানবে আমার কথা?

বৃদ্ধ মহারাজের কণ্ঠস্বর-মা, আমি যে নিরুপায়।

বাবা, ওকে তুমি মুক্তি দিয়ে আমাকে তুলে দাও যোগিনীর হাতে। আমাকে তুমি হত্যা করো বাবা, আমাকে তুমি হত্যা করো……

আমি কি নিয়ে বাঁচবো মা, তোকে হারিয়ে আমি কাকে নিয়ে বাঁচবো বল? সব হারিয়েছি, পাঁচ। পুত্রকে আমি দেবীর পায়ে বলি দিয়েছি…..না না, পারবো না আমি তোকে হারাতে।

 বাবা, আমিও তোমাকে দেবো না ঐ ভীল যুবকটিকে হত্যা করতে। নিষ্পাপ সুন্দর একটি জীবন-বাবা, তোমার পায়ে ধরি তুমি ওকে হত্যা করো না।

মা, আমি যে অভিশাপগ্রস্ত, আমাকে প্রতি অমাবস্যায় একটি করে যুবক সগ্রহ করে দিতেই হবে, নাহলে……

বল, নাহলে কি হবে?

সমস্ত রাজ্য ধ্বংস হবে, আমার অসংখ্য প্রজাদের প্রাণ বিনাশ হবে। আমাকেও ওরা হত্যা করবে…….।

বাবা!

হাঁ মা, সেই ভয়ঙ্কর নীলা তার পিতা জয়দেবের চেয়ে অনেক বেশি ভয়ঙ্কর। তার আয়ত্তে আছে সাতজন ভয়ঙ্কর নর-রাক্ষস কাপালিক, যাদের শক্তির কোনো তুলনা হয় না।

কক্ষের দিকে এগিয়ে আসছে কারও পদশব্দ। রাণী সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালা শেষ করে ফিরে আসছেন হয়তো। ভীল যুবক দ্রুত ফিরে গেলো তার নির্দিষ্ট কক্ষে।

কক্ষমধ্যে প্রবেশ করে চমকে উঠলো ভীল যুবক। সে দেখলো, তার বিছানায় একটি তীরবিদ্ধ হয়ে আছে। কক্ষের চারিদিকে তাকালো সে, একপাশে মোমদানিতে মোটা একটি মোম জ্বলছে। কক্ষশূন্য, একটা থমথমে নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে কক্ষের চারিদিকে। ভীল যুবক বিছানার দিকে এগিয়ে গেলো, তীরটি তুলে নিলো হাতে। দেখলো সে, তীর ফলকে গাথা আছে একটি ভাজ করা চিঠি। ভীল যুবক তীরফলক থেকে চিঠিখানা খুলে নিলো তারপর এগিয়ে গেলো মোমদানির দিকে। চিঠিখানা মেলে ধরতেই অবাক হলো সে, রাজ প্রাসাদেও এসেছে আশা! আশ্চর্য এই নারী। চিঠিখানা পড়তে লাগলো ভীল যুবক

 “বিজয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে বনহুর, সহজে তুমি মুক্তি পাবে না এখান থেকে কিন্তু তোমার সম্মুখে এক মহান কর্তব্য রয়েছে। জানি তুমি কর্তব্য পালনে কোনোদিনই বিমুখ নও। আমি তোমার মঙ্গল কামনা করি।
–আশা

ভীল যুবকের মুখে ফুটে উঠলো একটা হাসির রেখা, চিঠিখানা ভাঁজ করে পকেটে রেখে শয্যা গ্রহণ করলো। ভাবতে লাগলো আশার কথা…কে এই নারী যে তার পিছনে ছায়ার মত বিচরণ করে ফিরছে অথচ তাকে সে আজও আবিষ্কার করতে সক্ষম হলো না। সারাদিন হেঁটে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলো, বেশিক্ষণ কিছু ভাবতে পারে না, দুচোখ তার মুদে আসে, নিদ্রায় ঢলে পড়ে সে।

রাজপ্রাসাদ নিস্তব্ধ।

সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে।

বাইরে শোনা যায় প্রহরীর ভারী বুটের শব্দ খট খট খট।

আকাশে অসংখ্য তারার প্রদীপ জ্বলছে।

মহারাজ তার নিজ কক্ষে নিদ্রামগ্ন। বৃদ্ধ মানুষ, তারপর বহু হেঁটেছেন তিনি আজ।

হঠাৎ ভীল যুবকের ঘরের দরজা খুলে যায়, আপাদমস্তক কালো আবরণে ঢাকা এক নারীমূর্তি প্রবেশ করে সেই কক্ষে, এগিয়ে যায় শয্যায় শায়িত ভীল যুবকটির দিকে। নির্বাক দৃষ্টি মেলে সে তাকিয়ে থাকে নিদ্রিত ভীল যুবকের মুখে। বহুক্ষণ তাকিয়ে থাকে সে অপলক নয়নে যুবকের দিকে, অতঃপর লঘু হস্তে চাদরখানা টেনে দেয় তার দেহের উপর। আলগোছে একটা চিঠি রেখে দেয় সে ভীল যুবকের বালিশের পাশে।

যেমন এসেছিলো তেমনি বেরিয়ে যায় আলখেল্লা পরিহিতা নারীমূর্তি।

সহসা ঘুম ভেঙ্গে গেলো ভীল যুবকের, ধড়মড়িয়ে বিছানায় উঠে বসলো, কারণ তার ঘুমাবার। সময় নয় এটা। চোখ রগড়ে তাকালো মোমবাতিটার দিকে। মোমবাতি দেখে সে বুঝতে পারলো বহুক্ষণ ঘুমিয়েছে- মোমবাতি প্রায় শেষ হয়ে এসেছে।

শয্যা ত্যাগ করে নেমে দাঁড়ালো ভীল যুবক তার দৃষ্টি হঠাৎ চলে গেলো বিছানায় বালিশটার পাশে। একি! চিঠি কার? কেউ কি তবে এ কক্ষে প্রবেশ করেছিলো? দ্রুতহস্তে চিঠিখানা নিয়ে সরে এলো মোমবাতিটার পাশে, চিঠিতে মাত্র দু’লাইন লিখা

বনহুর, প্রাণভরে তোমাকে দেখলাম। এমন করে কোনোদিন তোমাকে দেখিনি। হাঁ, আমি তোমার পাশেই আছি, থাকবো চিরদিন।
— আশা

বনহুরের মুখ গম্ভীর হয়ে পড়লো, অধর দংশন করে আপন মনে বললো, একটা নারীর কাছে তার এরকম পরাজয়! পরাজয় নয়তো কি? যে নারী তার পাশে পাশে অহরহ ছায়ার মত ঘুরে বেড়াচ্ছে তাকে সে ধরতে পারে না, দেখতে পারে না– কে সে? কি তার পরিচয়? বনহুর পায়চারী করতে লাগলো। কিন্তু এখন আশার কথা ভাবার সময় নেই, অনেক কাজ তার বাকি রয়েছে, নীল দ্বীপের গভীর রহস্য নীল রাণীকে তার জানতে হবে।

 বনহুর রাজপ্রাসাদ থেকে বের হবার উপায় চিন্তা করতে লাগলো। বেরিয়ে এলো সে কক্ষ থেকে, অতি সন্তর্পণে এগিয়ে চললো প্রাসাদের পিছুন প্রাচীরের দিকে। সুউচ্চ প্রাচীর বলে এদিকে তেমন কোনো পাহারা নেই। বনহুর অতি সহজেই প্রাচীর টপকে বেরিয়ে এলো প্রাসাদের বাইরে। প্রাসাদের অদূরেই অশ্বশালা। বনহুর অশ্বশালায় প্রবেশ করে বেছে নিলো একটি বলিষ্ঠ সবলদেহী অশ্ব।

অশ্বপৃষ্ঠে চেপে বসলো বনহুর।

উল্কা বেগে অশ্ব ছুটতে শুরু করলো।

তারাভরা আকাশ।

আকাশে চাঁদ না থাকলেও তারার আলোতে পৃথিবীটা বেশ স্বচ্ছ মনে হচ্ছিলো। বনহুরের অশ্ব তীরবেগে ছুটে চললো নীল জঙ্গল অভিমুখে।

*

রাত ভোর হবার পূর্বেই ফিরে এলো বনহুর। অশ্বশালায় অশ্ব বেঁধে রেখে রাজপ্রাসাদের প্রাচীর টপকে অন্তপুরে প্রবেশ করলো সে, নিজ কক্ষে প্রবেশ করে চাদর টেনে শুয়ে পড়লো।

খুব ভোরে রাজকন্যা বিজয়া বাগানে ফুল তুলতে গিয়েছিলো। পিতার পূজার জন্য সে নিজ হাতে বাগান থেকে ফুল সগ্রহ করতো। ফুল নিয়ে ফেরার পথে হঠাৎ মনে পড়লো ভীল যুবকের কথা। ধীর পদক্ষেপে বিজয়া প্রবেশ করলো ভীল যুবকের কক্ষে।

কক্ষমধ্যে প্রবেশ করে থমকে দাঁড়ালো বিজয়া, মুক্ত জানালার পাশে শয্যায় গভীর নিদ্রায় মগ্ন ভীল যুবক। ভোরের উজ্জ্বল আলো এসে পড়েছে ভীল যুবকের মুখে।

 বিজয়া, সহসা দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে পারলো না, নিৰ্ণিমেশ নয়নে সে তাকিয়ে দেখতে লাগলো। ভেবে পায় না বিজয়া ভীল জাতির মধ্যেও এত সুন্দর হতে পারে। নিজের অজান্তে এক গুচ্ছ ফুল নিয়ে রাখলো ভীল যুবকের উপর তারপর লঘু পদক্ষেপে বেরিয়ে যাচ্ছিলো, হঠাৎ পাশের একটা পাত্রে পা লেগে শব্দ হয়।

ঘুম ভেঙ্গে যায় ভীল যুবকের, চমকে উঠে বসে দেখতে পায় রাজকুমারী বিজয়া কক্ষ থেকে দ্রুত বেরিয়ে যাচ্ছে। তার হাতের ফুলের জিতে অনেক ফুল। ভীল যুবক নিজের কোলের উপর কতকগুলো ফুল ছাড়িয়ে পড়ে থাকতে দেখে বিস্মিত হলো। বুঝতে পারলো ফুলগুলো রাজকন্যা বিজয়ার উপহার। ভীল যুবক ফুলগুলো হাতে নিয়ে নাকের কাছে তুলে ধরলো। অস্ফুট কণ্ঠে বললো সেহায় নারী, তোমরা ফুলের মতই সুন্দর আর কোমল আবার তোমরাই পাথরের চেয়েও শক্ত, নরকের চেয়েও ঘৃণ্য……।

এমন সময় রাজা কক্ষমধ্যে প্রবেশ করলেন।

দ্রুত শয্যা ত্যাগ করে উঠে দাঁড়ালো ভীল যুবক।

মহারাজ বললেন-বৎস, ঘুম হয়েছে তো?

হ গুরুদেব, সমস্ত রাত্রি আমি নিশ্চিন্ত মনে ঘুমিয়েছি।

আজ দিবাগত রাত্রি শেষ হলে কাল অমাবস্যা, জানি না বৎস তোমার ভাগ্যে কি আছে?

 আপনি চিন্তিত হবেন না গুরুদেব।

কি জানি বৎস, কেমন যেন দুর্বলতা বোধ করছি। মহারাণী এবং বিজয়া তোমাকে মুক্তি দেবার জন্য আমাকে ভীষণভাবে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছে।

আমি জানি তারা কত মহৎ, কত মহাপ্রাণা।

 কিন্তু কি করে তাদের আমি শান্ত করি বল।

সে ভার আমি গ্রহণ করলাম গুরুদেব।

বেশ, আমি তাহলে পূজার জন্য চললাম।

আচ্ছা।

মহারাজ বেরিয়ে গেলেন।

 ভীল যুবক মুক্ত জানালা দিয়ে তাকালো নীল আকাশের দিকে।

এমন সময় একটা দাসী এসে খাবার রেখে গেলো, যাবার সময় বললো-খাবারগুলো খেয়ে নাও। দেখো পেট পুরে খেয়ো।

ফিরে তাকালো ভীল যুবক, বৃদ্ধা দাসীর দরদভরা কথাগুলো তার কানে যেন সুধা বষণ করলো। মুক্ত জানালা থেকে ফিরে এলো খাবার টেবিলটার পাশে। আলগোছে ঢাকনা তুলতেই চমকে উঠালা, খাবার প্লেটের পাশে একটা ভাঁজ করা কাগজ। ভীল যুবক খাবার না খেয়ে চিঠিখানা তুলে নিলো হাতে, মেলে ধরতেই তার চোখ দুটো বিস্ময়ে-বিস্ফারিত হয়ে উঠলো

বৃদ্ধা দাসীর বেশে এসেছিলাম, ওমন করে নিশ্চুপ কি ভাবছিলে? কই, একটি কথাও তো বললে না? কিছু ভেবো না, সব সহজ হয়ে যাবে।
— আশা

ভীল যুবক-বেশী বনহুর চিঠিখানা পড়া শেষ করে তাকালো দরজার দিকে, যে পথে একটু আগে চলে গেছে সেই বৃদ্ধা দাসী। এত কাছে এসেছিলো আশা অথচ তাকে সে ধরতে পারলো না। কী সুচতুরা এই নারী। ভীল যুবক মুহূর্ত বিলম্ব না করে, খাবার না খেয়ে দ্রুত বেরিয়ে এলো, রাজ-অন্তপুরে এগিয়ে চললো।

মহারাজ ব্যস্ত হয়ে ভীল যুবকের কাছে এসে বললেন–কি হয়েছে বৎস?

ভীল যুবক বললো–এই মুহূর্তে আপনার প্রাসাদের সব দাস-দাসীদের আমার সম্মুখে হাজির করুন।

হঠাৎ এ কথা কেন বৎস? বললেন মহারাজ।

ভীল যুবক বললো- বিশেষ প্রয়োজন আছে।

বেশি প্রশ্ন না করে মহারাজ তৎক্ষণাৎ প্রাসাদের সকল দাসদাসীকে হাজির করার জন্য আদেশ দিলেন।

অল্পক্ষণে প্রাসাদের সবগুলো দাসদাসীকে হাজির করা হলো। সবাইকে ভীল যুবক নিজে পরীক্ষা করে দেখলো, কিন্তু এরা সবাই সত্যিকারের দাসী, বহুদিন থেকেই এরা রাজপ্রাসাদে কাজ করে চলেছে। সেই বৃদ্ধা দাসীকে আর খুঁজে পাওয়া গেলো না। বনহুর মনে মনে বেশ ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠলো। কিন্তু মুখোভাব ঠিক রেখে বললো—যা চেয়েছিলাম তা পেয়েছি মহারাজ, এবার এরা যেতে পারে।

মহারাজের নির্দেশে সবাই চলে গেলো।

ফিরে এলো ভীল যুবক নিজ কক্ষে।

প্রাতঃরাশ তার এখনও সমাধা হয়নি। কিছু পূর্বে বৃদ্ধা দাসী-বেশী আশার রেখে যাওয়া খাবার খেয়ে বসলো ভীল যুবক। বড় সুস্বাদু খাবারগুলো পেট পূর্ণ করে খেলো সে। খাওয়া প্রায় হয়ে এসেছে হঠাৎ তার নজর পড়লো দরজার পাশে একটু আড়ালে পড়ে আছে একটি পরচুলা আর কাপড়-চোপড়। ভীল যুবক এগিয়ে গিয়ে সেগুলো বের করে আনতেই বুঝতে পারলো, ঐ পরচুলা এবং পোশাকই বৃদ্ধা দাসী-বেশী আশার। ভীল যুবক স্তব্ধ হয়ে রইলো, বুঝতে পারলো, সে যখন দাস-দাসীদের পরীক্ষা করে দেখছিলোতখন তারই কক্ষে আশা পোশাক পরিবর্তন করে নিয়েছে, কিন্তু সে গেলো কোথায়?

*

আজ অমাবস্যা।

যোগিনী নীলা ভয়ঙ্করী রূপ ধারণ করেছে। নীল জঙ্গলের মন্দিরে আজ কাপালিকদের আড্ডা জমে উঠেছে। যোগিনী নীলার এলোকেশ ছড়িয়ে আছে তার সমস্ত পিঠে। কপালে রক্তের রেখা, গলায়-হাতে-বাজুতে রুদ্রাক্ষের মালা। কালীমূর্তির সম্মুখে ভীমাঙ্গিনীর মত বসে আছে, সামনে বিরাট অগ্নিকুণ্ড, পাশেই উচ্চ বেদীর উপর নরমুণ্ড রক্ষিত।

একজন কাপালিক মন্ত্র পাঠ করে চলেছে।

যোগিনী নীলার চোখ দুটো আগুনের গোলার মত জ্বলছে। সেকি ভীষণ ভয়ঙ্কর কঠিন এক নারীমূর্তি।

নীল জঙ্গল সেই মন্ত্র পাঠের সঙ্গে যেন দুলে দুলে উঠছে। জঙ্গলের পশু-পাখি সবাই আজ জঙ্গল ছেড়ে কোথায় পালিয়েছে কে জানে। থমথমে জমাট রাত, মাঝে মাঝে হিমেল হাওয়া। বইছে। গাছের পাতায় সা সা শব্দ হচ্ছে। গাছের ফাঁকে ফাঁকে আকাশের কিছু কিছু অংশ দৃষ্টিগোচর হয়, কিন্তু আজ আকাশে একটিও তারার চিহ্ন নেই।

অমাবস্যার রাত।

 যোগিনী নীলা প্রতীক্ষা করছে, তার বলি এখনও এসে পৌঁছায়নি। অন্যান্য কাপালিক সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। মহারাজ হীরন্ময় সেন এখন পর্যন্ত এলো না, বলির লগ্ন যে এসে পড়লো বলে।

ওদিকে রাজবাড়িতে তখন বিজয়া পিতার পা দু’খানা চেপে ধরে বলছে–বাবা, তুমি যাই করো, ঐ ভীল যুবককে যোগিনী নীলার কাছে নিয়ে যেও না। সর্বনাশী রাক্ষুসী ওকে হত্যা করে ফেলবে।

মা, কোনো উপায় নেই। যোগিনী নীলা ওকে না পেলে শুধু আমাকেই হত্যা করবে না, আমার অগণিত নিরীহ প্রজাদের ধ্বংস করে ফেলবে। সমস্ত নীলদ্বীপ শ্মশানে পরিণত হবে।

 মহারাণীও কন্যার সঙ্গে যোগ দিয়ে স্বামীর কাছে মিনতি জানাচ্ছেন–ওগো, তুমি ঐ অসহায় ভীল যুবকটিকে হত্যার জন্য নিয়ে যেও না। ওকে বড় মায়া লাগছে, বড় মায়া লাগছে, জানি না কি মোহশক্তি আছে ওর মধ্যে। ওর দিকে তাকিয়ে আমি ভুলে গেছি আমার হারানো পাঁচ সন্তানকে।

রাণী, আমি নিরুপায়। ওকে আজ নিয়ে যেতেই হবে সেই নীল জঙ্গলে। তোমরা বাধা দিও না আমাকে। বিলম্ব হয়ে যাচ্ছে। বলির সময় উত্তীর্ণ হলে কাঁপালিকা নীলা আমাকে ধ্বংস করে ফেলবে! না না, যেতে দাও, যেতে দাও রাণী…….

বিজয়া আর মহারাণী যখন মহারাজকে গমনে বাধা দিচ্ছিলো তখন ভীল যুবক এসে দাঁড়ায় সেখানে, হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলে–শুরুদেব আসুন, কোথায় যেতে হবে বলেছিলেন?

মহারাজ বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন–চলো বৎস, চলো।

মহারাণী ভীল যুবকসহ বেরিয়ে পড়লেন, কোনো বাধাই তাদের ক্ষান্ত করতে পারলো না।

এগিয়ে চলেছেন মহারাজ হীরন্ময় সেন এবং ভীল যুবক। জমাট অন্ধকার রাত, পথঘাট তেমন করে কিছুই দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না।

হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে মহারাজ বললেন–একটা কিছু শব্দ শোনা যাচ্ছে না?

 হ গুরুদেব, বললো ভীল যুবক।

কিসের শব্দ বলে তোমার মনে হয় বৎস?

অশ্বপদ শব্দ বলেই আমার ধারণা হচ্ছে। বহুদূর পথ দিয়ে কোনো অশ্বারোহী চলে গেলো।

 এত রাতে অশ্বারোহী, কে সে, আর কোথাই বা যাচ্ছে সে?

 মহারাজ, নিশ্চয়ই কোনো নিশাচর।

কিন্তু বৎস, আমার রাজ্যে প্রজাগণ কাপালিক জয়দেবের ভয়ে এমন ভীত যে, তারা সন্ধ্যার পর কেউ বাইরে বের হয় না বা বের হবার সাহস পায় না।

 মহারাজ, এমন জনও হয়তো আছে যে কাপালিক ভয়ে ভীত নয়। তারই অশ্বপদ শব্দ আমরা শুনতে পাচ্ছি। অশ্বপদ শব্দ জঙ্গলের দিকেই মিলিয়ে যাচ্ছে।

হাঁ, কেউ নীল জঙ্গল অভিমুখেই গমন করেছে বলে মনে হচ্ছে। বৎস, আমার কেমন যেন চিন্তা হচ্ছে।

চিন্তার কোনো কারণ নেই গুরুদেব! হয় জীবন রক্ষা পাবে নয় মৃত্যুকে আলিঙ্গন করবো……

না না, তাহলে আমার সবই যে ব্যর্থ হয়ে যাবে।

মহারাজ, ধৈর্যচ্যুত হবেন না। আজ রাত আপনার জীবনে এক মহা পরীক্ষার রাত। শুধু আজ রাতের উপর নির্ভর করছে আপনার নীল দ্বীপের ভবিষ্যৎ।

বনহুর, তুমিই আমার ভরসা!

মহারাজ, দয়াময় আল্লাহ আমাদের ভরসা। তিনি নিশ্চয়ই আমাদের মঙ্গল করবেন।

একসময় নীল জঙ্গলে পৌঁছে গেলেন মহারাজ আর ভীল যুবক। গহন জঙ্গলে অতি সন্তর্পণে এতে লাগলো তারা। মহারাজ একটি মশাল জ্বেলে নিয়েছিলেন, তারই আলোতে পথ দেখে চললেন।

মাঝে মাঝে হাঁপাচ্ছিলেন বৃদ্ধ মহারাজ হীরন্ময় সেন। কারণ এতটা পথ তাঁকে দ্রুতপায়ে আসতে হয়েছিলো।

বহুক্ষণ ধরে তাদের চলতে হয়েছে।

এক সময় একটা গুরুগম্ভীর কণ্ঠস্বর কানে এলো তাদের।

কাপালিক ঠাকুরের মন্ত্রপাঠের আওয়াজ এটা। বনভূমি যেন কেঁপে কেঁপে উঠছিলো সে শব্দে। মশালের আলোতে ভীল যুবক লক্ষ্য করছিলো, মহারাজের মুখমণ্ডল ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে, পা দু’খানা কাঁপছে তার।

ভীল যুবক বললো– মহারাজ, আপনি বেশি ভীত হয়ে পড়েছেন।

বৎস, এমনিভাবে আমি আমার পাঁচটি রত্নকে এই বনে নিয়ে এসেছিলাম, কাউকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারিনি। আজ জানি না ভাগ্যে কি আছে। তোমাকেও হারাবো কিনা কে জানে।

আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন মহারাজ। মৃত্যু একদিন হবেই, সেজন্য এত ভেবে বা উদ্বিগ্ন হয়ে কোনো লাভ নেই।

ক্রমেই মন্ত্রপাঠের শব্দ স্পষ্ট শোনা যেতে লাগলো। মহারাজের পা দু’খানা যেন ক্রমান্বয়ে শিথিল হয়ে আসছে। সমস্ত শরীর ঘেমে নেয়ে উঠছে যেন।

ভীল যুবক মহারাজকে ধরে ধরে নিয়ে চললো।

 দূরে বনের মধ্য হতে দেখা যাচ্ছে অগ্নিকুণ্ডের লেলিহান শিখা।

আরও কিছুটা অগ্রসর হতেই মন্দিরটা স্পষ্ট দৃষ্টিগোচর হতে লাগলো। মহারাজ ক্রমেই ভেঙ্গে পড়ছেন। একসময় মন্দিরের নিকটে পৌঁছে গেলো তারা।

দু’জন কাপালিক মন্দিরের দরজায় খর্গ হস্তে দণ্ডায়মান ছিলো, তারা মহারাজ হীরন্ময় সেনের সঙ্গে একটি ভীল যুবককে দেখে আনন্দসূচক শব্দ করে উঠলো, সঙ্গে সঙ্গে শংখধ্বনি করলো তারা।

তৎক্ষণাৎ মন্দিরের মধ্যে হতে বেরিয়ে এলো ভীষণকায় দু’জন কাপালিক। তাদের এক একজনকে এক একটি দৈত্যের মত মনে হচ্ছিলো। মাথায় জটাজুট, মুখে রাশিকৃত দাড়ি-গোঁফ। চোখগুলো যেন আগুনের গোলা।

কাপালিক দুজন এসে ভীল যুবকটিকে ধরে ফেললো দৃঢ় মুষ্ঠিতে। দরজায় দণ্ডায়মান। কাপালিকদ্বয় এসে ধরলো মহারাজ হীরন্ময়কে। একরকম টেনেই নিয়ে চললো তারা।

মন্দির মধ্যে প্রবেশ করতেই যোগিনী নীলা ক্রুদ্ধ সিংহীর ন্যায় গর্জন করে উঠলো–তোমার স্পর্ধা তো কম নয় মহারাজ, বলির লগ্ন উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। এত বিলম্ব হলো কেন?

মহারাজ হীরন্ময় সে করজোড়ে বললেন–বহুদূরের পথ, তাই আসতে বিলম্ব হয়েছে। ক্ষমা করো…..

ভয়ঙ্করী রূপ নিয়ে হেসে উঠলো যোগিনী নীলা হিঃ হিঃ হিঃ হিঃ হিঃ হিঃ……সে হাসি যেন থামতে চায় না। শয়তানী পিশাচিনীর হাসি। হাসি থামিয়ে বললো–এতদিন ক্ষমা করেছি কিন্তু আজ আর ক্ষমা নয়। আজ তোমাকেও মা কালীর চরণে বলি দেবো।

 হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন মহারাজ হীরন্ময় সেন, বললেন-তাই দাও, আমাকেও বলি দাও। আমি আর বাঁচতে চাই না।

যোগিনী বললো–হাঁ তাই হবে। প্রথমে মহারাজ পরে ঐ যুবকটিকে, কিন্তু বলির পূর্বে মা কালীর আরতি হবে।

সঙ্গে সঙ্গে একজন কাপালিক শঙ্খধ্বনি করলো।

মহারাজ এবং ভীল যুবক-বেশী বনহুর বিস্ময়ভরা চোখে দেখলো, মন্দিরের পিছন দরজা দিয়ে মন্দিরে প্রবেশ করলো অপ্সরীর মত একটি তরুণী। সমস্ত দেহে শুভ্র বসন, পায়ে নূপুর, গলায়

মাথায়-হাতে ফুলের মালা জড়ানো। মাথায় একটি পাতলা আবরণী, আবরণী দিয়ে তরুণীর মুখ ঢাকা। দু’হাতে তার দুটো ধূপ দানি। ধূপ দানি থেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে ধুম্ররাশি ছড়িয়ে পড়ছে। তরুণী মন্দিরে প্রবেশ করে কালী মূর্তির সম্মুখে নতজানু হয়ে মাথা নত করলো। তারপর নাচতে শুরু করলো সে। অগ্নিকুরে চারপাশে ঘুরে ঘুরে নেচে চললো তরুণী। অদ্ভুত সে নৃত্য, আরতির লগ্নে কাপালিকগণ মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে তরুণী নর্তকীকে নৃত্যে উৎসাহ যোগাতে লাগলো।

মহারাজ শিউরে উঠেছেন–তিনি জানেন, নৃত্য শেষে তাহদের বলি দেওয়া হবে।

বিস্মিত দৃষ্টি নিয়ে ভীল যুবক তাকিয়ে ছিলো, নর্তকীর মুখগুল দেখার জন্য তার মনে একটা বিপুল উৎসাহ জাগছিলো, কিন্তু দেখার কোনো উপায় ছিলো না, কারণ দু’জন বলিষ্ঠ কাপালিক তার দুটি বাহু বলিষ্ঠ হাতে মজবুত করে ধরেছিলো। মহারাজের অবস্থাও তাই, তাঁকেও দুজন ধরে ছিলো শক্ত হাতে।

 লেলিহান অগ্নিকুণ্ডের চারপাশে ঘুরেফিরে নর্তকী নৃত্য করে চলেছে। তার নূপুরের শব্দে মুখর হয়ে উঠেছে বনভূমি।

যোগিনী নীলার চোখ দুটো জ্বলছে যেন।

 নৃত্যের তালে ধূপদানিগুলো রেখে দেবীর চরণতল থেকে তুলে নিলো সুরাপাত্র। দক্ষিণ হস্তে সুরা পাত্র, বাম হস্তে সুরা-ভাণ্ড। ভাণ্ড থেকে সুরা ঢেলে এগিয়ে ধরতে লাগলো সে এক এক জন কাপালিকের দিকে।

কাপালিকগণ নর্তকীর হাত হতে সুরাপাত্র নিয়ে ঢক ঢক করে সুরা পান করে চললো।

 নর্তকী যোগিনী নীলার হাতেও একটা সুরাপাত্র তুলে দিলো।

প্রত্যেকটা কাপালিককে সুরা পান করালো নর্তকী, যোগিনী নীলাও সুরা পানে বিভোর হয়ে পড়লো। মাত্র কয়েক মুহূর্ত, কাপালিকগণ যে যেখানে ছিলো ঢলে পড়লো মন্দিরের মেঝেতে। যোগিনীর দেহটাও অগ্নিকুণ্ডের পাশে গড়িয়ে পড়লো।

নর্তকী দ্রুতহস্তে অগ্নিকুণ্ডের পাশ থেকে খৰ্গটা তুলে নিয়ে ছুঁড়ে দিলো ভীল যুবকের হাতে, সঙ্গে সঙ্গে বললো সে-মুহূর্ত বিলম্ব করো না, এদের প্রত্যেকের দেহ থেকে মাথাটা বিচ্ছিন্ন করে ফেলো…

 এবার বনহুর নিজ মূর্তি ধারণ করলো, খৰ্গ হাতে নিয়ে একটির পর একটি কাপালিকের দেহ থেকে মাথাটাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে লাগলো। যোগিনী নীলাকেও হত্যা করলো, তার মাথাটা গড়িয়ে পড়লো অগ্নিকুণ্ডের দিকে।

রক্তের স্রোত বয়ে চললো।

 সবাইকে হত্যা করে ফিরে দাঁড়ালো বনহুর।

মহারাজ হীরন্ময় সেন বিস্মিত হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, তার মুখে কোনো কথা নেই। তিনি যেন পাথরের মূর্তি বনে গেছেন। ভেবে পাচ্ছেন না কেমন করে কি হলো। এ সব কি স্বপ্ন না সত্য!

 বনহুর মহারাজের দিকে তাকাতেই মনে পড়লো নর্তকীর কথা কিন্তু কোথায় সে? বনহুর খেয়ালের উপর এতক্ষণ হত্যালীলা চালিয়ে চলেছিলো, ভাববার সময় ছিলো না কিছুকে সে নর্তকী, কোথা হতেই বা হঠাৎ এলো আর সূরা পানেই বা কাপালিকগণকে কিভাবে জ্ঞানশূন্য করে ফেললো। যখন বনহুর নর্তকীর অন্বেষণে ব্যস্ত হয়ে পড়লো তখন সে অদৃশ্য হয়েছে। বনহুর যা স্থির করে এখানে এসেছিলো, তা হয়নি। সে ভাবতেও পারেনি, এভাবে এত সহজে তার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে। সে স্থির করেছিলো, কাপালিকরা যখন তাকে কালীর চরণে বলি দিতে উদ্যত হবে, ঠিক সেই মুহূর্তে সে আত্নপ্রকাশ করবে এবং এক এক করে নীলা যোগিনী ও কাপালিকদেরকে শেষ করবে। অবশ্য মহারাজ হীরন্ময়ের কাছে সে গুনেছিলো, নীলা যোগিনীর মন্দিরে যে চারজন অসুরের মত শক্তিশালী কাপালিক আছে, তাদের ভয়ে নীলদ্বীপবাসী কম্পমান থাকতো এবং তাদের বিরোধিতা করার সাহস পেত না। কিন্তু মহারাজ হীরন্ময় শুধু বনহুকেই দেখেছিলেন, তার শক্তি প্রত্যক্ষ করেননি। বনহুর তার জীবনে ওরকম শক্তিশালী অনেক কাপালিককে শেষ করেছে। কিন্তু সেই শক্তি পরীক্ষার মুহূর্তটা আসেনি, কৌশলে নর্তকীটি কাজ সহজ করে দিয়েছে। বলতে গেলে বনহুরের করণীয় কাজ নর্তকীটি সমাধা করেছে। কিন্তু কে সেই নর্তকী? আর গেলোই বা কোথায়?

 মহারাজও খেয়াল করেননি নর্তকী তরুণীটি গেলো কোথায়! হঠাৎ মহারাজের দৃষ্টি পড়লো তার পায়ের কাছে, মেঝেতে পড়ে আছে একটি কাগজ। কাগজখানা তুলে নিয়ে তিনি বনহুরের দিকে এগিয়ে ধরে বললেন–দেখো দেখি বৎস, এটা কি?

 বনহুর কাগজখানা মেলে ধরলো দ্রুত চোখের সামনে। কাগজখানায় লেখা আছে

বিলম্ব করোনা বনহুর, মহারাজসহ শীঘ্র ফিরে যাও রাজপ্রাসাদে। আজ হতে মহারাজ শাপমুক্ত হলেন। আমিই নর্তকীর বেশে সুরার সঙ্গে বিষাক্ত ঔষধ মিশিয়ে দিয়েছিলাম। যোগিনী নীলার ধ্বংসই ছিলো আমার কামনা। তুমি আমার কামনা পূর্ণ করেছ।
–আশা

 বনহুর অস্ফুট কণ্ঠে বললো-মহারাজ, আশার বুদ্ধিবলে আজ আপনি শাপমুক্ত হলেন।

আশা! কে সেই আশা বলতে পারো বৎস?

আমিও জানি না কে সে!

নর্তকীর বেশে আমাদের সম্মুখে সে নৃত্য করেছে, এত কাছে ছিলো তবু আমরা তাকে চিনতে পারলাম না।

মহারাজ, এখন ভাবার সময় নেই, চলুন ফেরা যাক।

চলো বৎস, চলো? দাঁড়াও, একটু দেখে নেই–এই মন্দিরে মা কালীর চরণে আমার পাঁচ পাঁচটি পুত্রকে অর্পণ করেছি। আজ তুমি যদি ওদের হত্যা না করতে তাহলে……..

মহারাজ এবং বনহুর শুনতে পেলো সেই অশ্ব পদশব্দ। দূরে, অনেক দূরে সরে যাচ্ছে ক্রমান্বয়ে শব্দটা।

মহারাজ বললেন–পূর্বে যে অশ্বপদ শব্দ আমাদের কর্ণগোচর হয়েছিলো, এ সেই শব্দ না?

 হাঁ, সেই শব্দ! আশার অশ্বের খুরের শব্দ এটা।

*

নীল দ্বীপ আজ অভিশাপমুক্ত হয়েছে।

ঘরে ঘরে আনন্দ উৎসবে মেতে উঠেছে সবাই। রাজপ্রাসাদে মহা ধূমধাম চলেছে। যদিও রাজ প্রাসাদময় একটা গভীর শোকের ছায়া ঘনীভূত হয়ে উঠেছিলো, পাঁচ-পাঁচটি সন্তানকে হারিয়ে মহারাণীর মাথায় বজ্রাঘাত হয়েছিলো যেন। তিনি ভীল যুবক-বেশী বনহুরকে পেয়ে বুকে অসীম সান্ত্বনা খুঁজে পেয়েছেন। এক মুহূর্ত তিনি ওকে কাছছাড়া করতে চান না। মহারাজের কাছে তিনি চেয়ে নিয়েছেন ওকে।

মহারাজ জানেন এ যুবকের আসল পরিচয় তবু শোকাতুরা স্ত্রীকে প্রবোধ দেবার জন্য কতকটা বাধ্য হয়েই ভীল যুবকটিকে তিনি তার হাতে অর্পণ করেছেন।

আলোকমালায় সজ্জিত করা হয়েছে রাজপ্রাসাদ।

আজ কাঙ্গাল ভোজন করানো হবে। সমস্ত নীলদ্বীপের দীনহীন গরিব এসে জড়ো হচ্ছে। রাজবাড়ির প্রাঙ্গণে।

মহারাণী নিজ হস্তে কাঙ্গালদের দান করে চললেন। নিজ হাতে তিনি সবাইকে তৃপ্তির সঙ্গে ভোজন করালেন। কন্যা বিজয়া মাকে যথাসাধ্য সাহায্য করে চললো।

নীলদ্বীপে ফিরে এসেছে অনাবিল শক্তি আর আনন্দ।

উৎসব চলেছে।

মহারাণী ধরে বসলেন ভীল যুবক তিলককে তিনি নিজ পুত্র হিসেবে অভিষেক করে গ্রহণ করতে চান।

বিপদে পড়লেন মহারাজ হীরন্ময় সেন, তিনি বললেন–একি কথা বলছো রাণী? একটা ভীল। যুবককে তুমি অভিষেক করে পুত্র হিসেবে গ্রহণ করতে চাও, সে কেমন কথা?

মহারাণী অশ্রুসিক্ত নয়নে স্বামীকে বললেন–ভীল হলেও সে মানুষ। আমি ওর মধ্যে আমার হারানো সন্তানদের খুঁজে পেয়েছি। ও যেদিন আমাকে মা বলে প্রথম ডেকেছে, আমি ভুলে গেছি আমার সেই পাঁচ সন্তানকে…

 রাণী!

হ রাজা, আমি জানি না কেন ওকে আমার এত ভাল লেগেছে। ভীল যুবক হলেও ও মানুষ, আমার শরীরে যে রক্তের প্রবাহ ওর শরীরেও সেই রক্ত, কাজেই আমি ওকে ছেড়ে দেবো না আর…

মহারাজ আর মহারাণী মিলে যখন কথা হচ্ছিলো তখন আড়াল থেকে সব শুনে ফেলে বনহুর। নতুন একটা সমস্যা তাকে যেন অক্টোপাসের মত জড়িয়ে ফেলছে। বনহুরের মনেও জেগে উঠছে যেন একটি সন্তানসুলভ অনুভূতি। মহারাণীর কথাগুলো যেন তার বুকের মধ্যে একটির পর একটি গেঁথে যাচ্ছিলো। সন্তান হারিয়ে মায়ের সেকি ব্যথা, আজ বনহুর অন্তর দিয়ে অনুভব করলো।

 বনহুর ফিরে গেলে নিজের ঘরে, একটা মায়ার বন্ধনে সে যেন আটকে পড়েছে। কি করে সে এই বন্ধন ছিন্ন করে বিদায়, নেবে এই রাজপ্রাসাদ থেকে? মহারাজ যখন এসে বলবেন তাকে মহারাণীর ইচ্ছার কথা তখন সে কিরূপে অমত করে বসবে–না না, তা হয় না। পালাতে হবে সকলের অলক্ষ্যে। বনহুর দ্রুতহস্তে একখানা চিঠি লিখলো মহারাজকে। তারপর পা টিপে টিপে কক্ষের বাইরে বেরিয়ে এলো।

সঙ্গে সঙ্গে একটি কোমল কণ্ঠস্বর ভেসে এলো বনহুরের কানে—তিলক।

বনহুর নীলদ্বীপে এই নামেই পরিচিত ছিলো, রাজপ্রাসাদেও সবাই তাকে তিলক বলে ডাকতো।

বনহুর চোরের মত চুপি চুপি সরে পড়তে যাচ্ছিলো, পালানো আর হলো না, ফিরে তাকালো সে। দেখলো, অদূরে সখী পরিবেষ্টিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিজয়া, চোখেমুখে তার আনন্দোচ্ছ্বাস।’ বনহুরকে লক্ষ্য করে বললো বিজয়া-তিলক, এসো আমাদের সঙ্গে আনন্দ উৎসবে যোগ দেবে।

বনহুর কোনো জবাব না দিয়ে বাধ্য হলো রাজকন্যা বিজয়ার দিকে এগিয়ে আসতে।

 বিজয়া সখীদের লক্ষ্য করে বললো–এই সেই ভীল যুবক তিলক, যে আমাদের নীলদ্বীপের অভিশাপ মোচন করেছে।

এতক্ষণ বনহুর লক্ষ্য করেনি সখীদের হাতে এক একটি ফুলের মালা, রাজকন্যা বিজয়ার হাতেও সুন্দর একটি মালা রয়েছে।

এগিয়ে আসে বিজয়া, প্রথমে সে-ই বনহুরের গলায় মালা পরিয়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে বিজয়ার সখীরা এক এক করে মালা পরিয়ে দিলো বনহুরের গলায়।

স্তব্ধ বিস্ময়ে বনহুর তাকিয়ে আছে, কোনো কথা তার মুখ দিয়ে বের হচ্ছে না।

একটি তরুণী বিজয়াকে লক্ষ্য করে বললো–ওকে কিন্তু ভীল যুবক বলে মনে হচ্ছে না।

আর একজন বলে উঠলো–সত্যি বলেছিস, ভীলরাতো জংলী, তাদের গায়ের রং কালো ভূতের মত হয়।

অন্য একজন বললো—-একে বোরাজকুমার বলে মনে হচ্ছে।

বিজয়া হেসে বললো-রাজ কুমারই তো? জানিস না তোরা, মা ওকে আজ অভিষেক করে রাজকুমার হিসেবে গ্রহণ করবেন।

একসঙ্গে সখীরা আনন্দধ্বনি করে উঠলো।

 একজন বললো–বিজয়া, তুই বড় ভাগ্যবতী।

 বিজয়া মৃদু হেসে বললে–চল, ওদিকে আর সবাই হয়তো আমাদের খুঁজছে।

ওকে সঙ্গে নিবি না বিজয়া? বললো একজন।

 বিজয়া তাকালো বনহুরের মুখের দিকে।

একরাশ মালার মধ্যে বনহুরের সম্পূর্ণগলা এবং চিবুকটা ঢাকা পড়ে গিয়েছিলো যেন। প্রাসাদের উজ্জ্বল আলোতে তাকে অপূর্ব সুন্দর দেখাচ্ছিলো।

বিজয়ার সখীরা সবাই মুগ্ধ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে ছিলো ওর দিকে।

 বিজয়া হেসে বললো—এসো আমাদের সঙ্গে।

বনহুর পালাতে চেয়েছিলো কিন্তু আরও বেশি করে আটকে পড়লো, অগত্যা বিজয়াকে অনুসরণ করলো সে।

সখীরা সবাই ওকে ঘিরে নিয়ে চললো।

বনহুর মনে মনে বেশ আনন্দ অনুভব করতে লাগলো, একটা মজার সৃষ্টি হলো এবার-বনহুর কিন্তু নীরবে এগিয়ে চলেছে, এতক্ষণেও সে কোনো কথা বলেনি।

সখীরা নানারকম আলাপ-সালাপ করছিলো, হাসছিলো ওরা বিজয়ার বলাবলি

বনহুর চলতে চলতে শুনতে পায় একজন ফিস্ ফিস্ করে বললো–ওকে কিন্তু ছেড়ে দিবি না বিজয়া, জয় করতেই হবে তোর।

বিজয়া একটু হেসে বললো–আমি ওকে জয় করতে পারবো কিনা জানি না, ও কিন্তু আমাকে জয় করে নিয়েছে।

সত্যি?

হা।

বনহুর শুনলো সখীদের মধ্যে একটা হাসির হুল্লোড় উঠলো।

সবাই মিলে তখন বাগানের একটা সুন্দর নির্জন স্থানে এসে পৌঁছে গেছে। চারিদিকে নানারকম গাছপালা, মাঝখানে পানির হাউজ। হাউজের মধ্যে কতকগুলো পদ্মফুল ফুটে রয়েছে। দুটো রাজহংসী সাঁতার কাটছিলো সেই হাউজে।

হাউজের চারপাশে শ্বেত পাথরের তৈরি আসন।

সখী পরিবেষ্টিত হয়ে বিজয়া আর তিলক এসে দাঁড়ালো সে স্থানে। গাছে গাছে আলোকমালা এবং নানারকম ফুলের ঝাড় ঝুলছে। সমস্ত রাজপ্রাসাদ জুড়ে একটা সুন্দর সুমধুর বাজনার শব্দ ছড়িয়ে আছে। রাজপ্রাসাদের সুউচ্চ সিংহদ্বারে বসেছে বাদ্যকরগণ, তারা মিহি সুরে বাধ্য পরিবেশন করে চলেছে, তারই সুর ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে।

বনহুরকে ঘিরে ধরলো বিজয়ার সখীরা।

একজন এগিয়ে এসে বললো–বোবা নাকি, কথা বলছে না যে!

অন্য একজন বললো–হয়তো বোবই হবে।

আর একজন বললো–কিরে বিজয়া, সত্যি ও বোবা নাকি?

 বিজয়া হেসে বললো-আমিও ঠিক জানি না।

বলিস কিরে, এতদিন প্রাসাদে আছে অথচ লোকটা বোবা কিনা জানিস না? আয় ভাই, আমরা আজ ওকে পরীক্ষা করে দেখবো সত্যি বোবা কিনা। একজন সখী বিজয়ার অন্য সখীদের দিকে তাকিয়ে কথাটা বললো।

সখীরা সবাই যোগ দিলো ওর কথায়–ঠিক বলেছিস, এতক্ষণ যার মুখে একটা কথাও শুনতে পেলাম না, তাকে একবার পরীক্ষা করে দেখা উচিত।

বনহুর ওদের কথা শুনে মৃদু মৃদু হাসছিলো।

একজন তরুণী বললো ভাল যুবক, বলো দেখি আমার সখী বিজয়াকে তোমার কেমন লাগে?

বনহুর একটি ফুল মালা থেকে ছিঁড়ে নিয়ে দেখালো তাকে।

খিল খিল করে হেসে উঠলো তরুণী দল।

বিজয়া কিন্তু হাসলো না, সে অভিমানভরা মুখে তাকালো তিলকের দিকে।

একজন সখী বিজয়ার চিবুকে মৃদু নাড়া দিয়ে বললো—ফুলের মত তোমাকে ভাল লাগে ওর, দেখলে না ফুলটা দেখালো ও।

অন্য আর একজন সখী বললো–দাঁড়াও আমি ওকে কথা বলাবো।

সত্যি পারবি? বললো অপর একজন।

সখীটা বললো–নিশ্চয়ই পারবো। সে কথাটা বলে হাউজ থেকে পানি নিয়ে ছুঁড়ে দিতে লাগলো তিলকের গায়ে। তারপর হেসে বললো–এখনও কথা বলো নয়তে স্নান করিয়ে ছাড়বো।

তবু বনহুর নীরব, সে শুধু মৃদু মৃদু হাসছে।

একজন সখী বললো-আয়, আমরা সবাই মিলে ওকে হাউজে ঠেলে ফেলে দেই। নিশ্চয়ই তাহলে কথা বলবে।

 তরুণীদল খুশি হয়ে ছুটে গেলো, সবাই মিলে ধরে ফেললো তিলককে, কিন্তু একচুলও ওকে নড়াতে পারলো না। মেয়েরা হিমসিম খেয়ে গেলো। সকলের চোখ কপালে উঠলো, লজ্জায় কুঁকড়ে গেলো সবাই।

বিজয়ার দু’চোখে গর্বের ছায়া ফুটে উঠলো।

তরুণীরা যখন তিলককে একচুলও নড়াতে পারলো না, তখন তারা বিদায় গ্রহণ করলো।

সবাই যখন চলে গেলো এগিয়ে এলো বিজয়া বনহুরের পাশে। অতি নিকটে ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়িয়ে বললো–তিলক!

বলুন রাজকুমারী?

এতক্ষণ ওদের সঙ্গে কথা বললে না কেন?

 প্রয়োজন মনে করিনি।

ওরা মনে করলো সত্যি তুমি বোবা।

তাতে আমার কিছু মন্দ হবে না জানতাম।

 জানো ওরা তোমার কত প্রশংসা করলো?

 শুনেছি।

তুমি ভীল যুবক তবু তোমার চেহারা নাকি রাজপুত্রের মত।

সত্য যা তাই ওরা বলেছে!

সত্যি তিলক, তোমার চালচলন, কথাবার্তায় মনে হয় না তুমি ভীল জাতির ছেলে।

সেটা হয়তো আমার চেহারার দোষ। কারণ আমি চাই না আমাকে কেউ রাজকুমার বা রাজপুত্র বলুক। ভীল সন্তান আমি, আমাকে ভীল বললে বেশি খুশি হব।

তুমি কি নিজের ভাল চাওনা তিলক?

কে না নিজের ভাল চায়, আমিও আমার ভাল চাই রাজকুমারী।

কই, তোমার আচরণে মনে হয় না তুমি তোমার ভাল চাও। নীলদ্বীপের অভিশাপ মুক্ত করে তুমি নীলদ্বীপবাসীর যে উপকার করেছে, তার মূল্য হয় না। কই, তুমি তো তার কোনো প্রতিদান চাইলেনা মহারাজের কাছে?

আমার তো কিছুর প্রয়োজন নেই রাজকুমারী, কি চাইবো তার কাছে?

অর্থ, ঐশ্বর্য……

ওসবে আমার কোনো মোহ নেই।

তিলক!

হাঁ, আমি ভীল-সন্তান, অর্থ-ঐশ্বর্য দিয়ে আমি কি করবো? তাছাড়া আমি এসব রাখবোই বা কোথায়?

তিলক, তুমি এসব ছাড়াও যা চাইবে মহারাজ তাই দেবেন তোমাকে।

আমার চাইবার মত কিছুই তো দেখছি না।

কি বললে, তুমি রাজবাড়িতে চাইবার মত কিছুই দেখলে না?

না।

তিলক, তুমি যা চাইবে তাই পাবে। তুমি অসাধ্য সাধন করেছে। মহারাজ তোমার বাসনা অপূর্ণ রাখবেন না। বলো তুমি কি চাও?

বলেছি আমার কোনো মোহ নেই।

তিলক, আমার চোখের দিকে তাকাও দেখি।

 তিলক চোখ দুটি তুলে ধরলো বিজয়ার চোখের দিকে। দেখলো সে, বিজয়ার দৃষ্টিতে। আবেগময় ভাবের আকুলতা। ধীরে ধীরে দৃষ্টি নত করে নিলো তিলক।

বিজয়া ব্যাকুল কণ্ঠে বললো-তিলক, চাইবার মত তুমি কি কিছুই খুঁজে পাচ্ছো না?

এবার তিলক নীরব, বিজয়ার প্রশ্নের কোনো জবাব সে দিতে পারলো না চট করে, অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলো।

ঠিক ঐ মুহূর্তে মহারাজ স্বয়ং এসে উপস্থিত হলেন। বিজয়া আর তিলককে দেখে হাস্যোজ্জ্বল মুখে বললেন তিনি–তোমরা এখানে? তিলক, তোমাকে খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়েছি বৎস।

 বিজয়া বললো-বাবা, ওকে আমরা এখানে ধরে এনেছিলাম। আমার সখীরা একে বিজয়মাল্য পরিয়ে দিয়েছে।

 চমৎকার, চমৎকার……এবার মহারাণী তোমাকে নিজ পুত্র বলে অভিষেক করতে মনস্থ করেছে বস, তাই তোমার খোঁজে এখানে এসেছি। এসো বাবা, এসো। চল মা বিজয়া।

 বিজয়া বললো–চলো বাবা।

পিতা-পুত্রী এগিয়ে চললো।

ওদের পিছনে এগিয়ে চললো তিলক।

*

মহারাজ, আপনি আমার পরিচয় জানেন তবু আপনি এ অনুরোধ করছেন, আমি সেজন্য দুঃখিত। কথাগুলো বলে থামলো বনহুর।

মহারাজ ব্যাকুল কণ্ঠে বলে উঠলেন–বাবা, তুমি যদি অমত করো তবে রাণী আত্নহত্যা করবেন। তাকে বাঁচাতে পারবো না তিলক।

কিন্তু……

আর কোনো কিন্তু নয়, তোমাকে মত দিতেই হবে। আমি জানি, তুমি মহৎ, তুমি মহান। আমার ব্যথা তুমি অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করবে। রাণীকে বাঁচাতে হলে তোমাকে পুত্র হিসেবে তার পাশে এসে দাঁড়াতেই হবে। কথা দাও তিলক, তুমি রাজি আছো?

বনহুর চিত্রাপিতের ন্যায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

পুনরায় বলে উঠেন মহারাজ-চুপ করে থেকো না বাবা, কথা দাও।

বনহুর তখন ভেবে চলেছে…মহারাণী তাকে অভিষেক করে পুত্র বলে গ্রহণ করতে চান, চিরদিনের জন্য তাকে মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ করতে চান তিনি। কিন্তু কি করে তা সম্ভব হবে– তার মা আছেন, তিনি যদি জানতে পারেন কোনোদিন এ কথা? না না, তা হয় না, অভিষেক করে পুত্র হিসেবে সে আর একজনকে জননীরূপে গ্রহণ করতে পারে না। শুধু কি তাই, যখন অভিষেক হবে, মহারাণী তাকে পুত্র বলে গ্রহণ করবেন, তখন কি তিনি সহজে ছেড়ে দিতে চাইবেন তাকে? কঠিন হবে সে বন্ধন ছিন্ন করতে, কারণ তাকে পুত্র হিসেবে শপথ গ্রহণ করতে হবে।

 মহারাজ ব্যাকুলভাবে বললেন–আবার কি ভাবছো তিলক? তুমি যাই বলো, আমার সর্বনাশ তুমি করতে পারবে না। রাণী যদি না বাঁচেন তবে আমার রাজ্য শ্মশানে পরিণত হবে। আমার প্রজাগণ মাতৃহারা হবে। বলল, জবাব দাও, চুপ করে থেকো না।

বনহুর এবার কথা না বলে পারলো না, বললো—মহারাজ, আমার মায়ের অমতে আমি পারবো না কিছু করতে।

তোমার মা আছেন?

হা।

কোথায়, কোথায় আছেন তিনি?

কান্দাই শহরে।

 আমি যাবো, সেখানে যাবো, তোমার মায়ের মত নিয়ে আসবো। বনহুর, রাণীকে অনেক বুঝিয়েছিলাম, পুত্র হিসেবে গ্রহণ করার জন্য বহু রাজপুত্রের নাম আমি তার কাছে বলেছি কিন্তু তিনি কিছুই শুনতে রাজি নন। তার এক কথা, তিলককে পেয়ে আমি ভুলে গেছি আমার পাঁচ সন্তানকে। তিলকের মধ্যে বেঁচে আছে আমার স্বপন, প্রদীপ, চঞ্চল, পলাশ ও তপন। ভেবে দেখো বাবা, কতবড় একটা কর্তব্য আজ তোমার সম্মুখে উপস্থিত……

 বেশ, কথা দিলাম আমার মা যদি মত দেন তবে আমি রাজি আছি।

আমি তোমার মায়ের হাতে ধরে মত চেয়ে নেবো। মা হয়ে আর এক মায়ের ব্যথা নিশ্চয়ই তিনি বুঝবেন। যাবো, আমি যাবো সেইখানে, যেখানে আছেন তোমার মা, সেই ভাগ্যবতী জননী……

বনহুর কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইলো।

মহারাজ তখনকার মত বেরিয়ে গেলেন।

এ উৎসবে মহারাণীর সন্তান লাভ হলো না।

মহারাণী কেঁদে বুক ভাসাতে লাগলেন।

বিজয়ার মনে একটা অভিমান দানা বেঁধে উঠলো, তিলক তার মাকে উপেক্ষা করলো। একটা ভীল যুবকের এত স্পর্ধা। বিজয়া পিতার কাছে গেলো-বাবা, তিলক আমার মাকে উপেক্ষা করে অপমান করেছে। যত উপকারই সে করুক তবু সে ভীল, একটা জংলীর এত স্পর্ধা?

মা, তুই ওকে জানি না, তাই অমন কথা বলছি।

বাবা, আমি এ কয়দিনের মধ্যে ওকে বেশ করে জেনে নিয়েছি, আর জানতে চাই না। বাবা, তোমরা ওকে ভাল বাসলেও আমি ওকে…

থাক মা থাক, আমি সব জানি।

বাবা, আমি ওকে ক্ষমা করবো না। বেরিয়ে গেলো বিজয়া।

বনহুরের কক্ষের দিকে এগিয়ে বললো বিজয়া।

বনহুর তখন পকেটে কিছু খুজঁতে গিয়ে তার হাতে একটা ভাজকরা কাগজের টুকরা পেলো– অবাক হলো, এটা তার পকেটে এলো কি করে? বিজয়া এবং সখীদলের কবল থেকে ছাড়া পেয়ে সে এ কক্ষে চলে এসেছে, তারপর মহারাজের সঙ্গে কথাও হয়েছে এই কক্ষে। জামাটা তখন থেকে গায়েই আছে। তাড়াতাড়ি ভাজকরা কাগজখানা খুলে মেলে ধরলো সে চোখের সামনে–

বিজয়া আর তার সখীদের সঙ্গে মিলে আমিও তোমার গলায় জয়মাল্য পরিয়ে দেবার সৌভাগ্য অর্জন করলাম। এজন্য আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি।
– আশা

 বনহুর চিঠিখানা পড়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলো। বিজয়ার বান্ধবীদের দলে আশাও ছিলো! বনহুর প্রত্যেককে ঠিক মনে করতে পারছে না, কারণ অনেকগুলো মেয়ে ছিলো সেখানে।

বনহুর চিঠিখানা হাতে নিয়ে তন্ময় হয়ে ভাবছে, এমন সময় বিজয়া প্রবেশ করে সেই কক্ষে।

বনহুর দ্রুত চিঠিখানা পকেটে গুঁজে ফিরে তাকায়।

 বিজয়া গম্ভীর কণ্ঠে বলে–তিলক।

বলুন রাজকুমারী?

আমার মায়ের বাসনা পূর্ণ করতে তুমি রাজি হওনি কেন আমি জানতে চাই?

বনহুর হেসে বলে–আমি গরিব ভীল জাতির ছেলে, মহারাণীর ইচ্ছা পূর্ণ করার মত সাহস আমার হলো না রাজকুমারী।

সাহস হলো না, না তার কথা তুমি উপেক্ষা করেছো?

 মত না দেওয়াকে আপনি এখন যা মনে করেন তাই।

তিলক, তুমি কাপালিক কন্যা নীলা এবং কাপালিকগণকে হত্যা করে নীলদ্বীপবাসীদেরকে উদ্ধার করেছে, তাই বলে তুমি পারো না মহারাণীর বাসনাকে অবহেলা করতে। এজন্য তোমাকে শাস্তি পেতে হবে।

যে শাস্তি আমাকে দেবেন মাথা পেতে গ্রহণ করবো কিন্তু একটা কাজ আপনাকে করতে হবে।

 বলো কি কাজ?

আপনার যে সখীরা আমার গলায় মালা পরিয়ে দিয়েছিলো তাদের সবাইকে আমার সম্মুখে নিয়ে আসতে হবে।

কেন, তাদের কাউকে বুঝি পছন্দ হয়েছে তোমার?

পরে বলবো।

আজ নয়, কাল সবাইকে নিয়ে আসবো তোমার কাছে। কিন্তু……

 বলুন রাজকন্যা, কিন্তু কি?

 তিলক, আমাকে তোমার ভাল লাগে না বুঝি?

বামন হয়ে চাঁদ পাওয়ার আশা……রাজকুমারী ক্ষমা করুন, অমন দূরাশা আমি করতে পারি না।

তুমি নিজেকে এত নগণ্য, তুচ্ছ মনে করো কেন তিলক!

জানি না।

বলেছি-তুমি রাজকুমার হবে। কেউ জানে না তুমি ভীল সন্তান। কেন তুমি মিছেমিছি……বিজয়া বনহুরের কাছে ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ায়।

বনহুর একটু পিছিয়ে দাঁড়ায়।

 বিজয়া হঠাৎ সরে আসে, বনহুরের বুকে মাথা রেখে আবেগভরা কণ্ঠে বললো-তিলক, আমি তোমাকে আর কোনোদিন যেতে দেবো না।

বনহুর নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।

 বিজয়ার নিশ্বাসের উষ্ণতা বনহুরের জামা ভেদ করে তার বুকে লাগছে। মাথাটা এসে লেগেছে তার চিবুকের সঙ্গে। ওর চুলের মিষ্টি একটা গন্ধ প্রবেশ করছে বনহুরের নাকে। বিজয়ার মুষ্টিবদ্ধ হাতে তার জামার অংশ আটকে আছে।

বলে বিজয়া-তিলক, বলো, কথা দাও, আমাকে ছেড়ে যাবে না তুমি?

 বনহুর ক্রমান্বয়ে অভিভূত হয়ে পড়ছে, শিরায় শিরায় জাগছে একটা অনুভূতি। দক্ষিণ হাতখানা এসে বিজয়ার কাধ স্পর্শ করলো। পরক্ষণেই বনহুর সংযত হয়ে বললো-রাজকুমারী, পরে আপনাকে কথা দেবো। বিজয়ার মুষ্টিবদ্ধ হাতের মধ্য হতে নিজের জামার অংশ ছাড়িয়ে নিয়ে সরে দাঁড়ালো বনহুর।

বিজয়া বললো-কাল আবার দেখা হবে।

 বনহুর কোনো জবাব দিলো না।

বিজয়া চলে যেতেই বনহুর আয়নার সম্মুখে এসে দাঁড়ালো। নিজের চেহারাটাকে এত করে সে বদলে ফেলেছে তবু কেন তাকে যে দেখে সে এমন করে ভালবাসতে চায়। চুলগুলো এলোমেলো, কানে বালা, হাতে বালা, জামাটাও সামান্য ফতুয়া ধরনের। খালি পা, পরনে সামান্য ধূতি। ভীল যুবক ছাড়া তাকে কেউ দ্র বলতে পারে না, তবু তার প্রতি কেন এত মোহ…বনহুর নিজ চেহারার দিকে তাকিয়ে ছিলো তন্ময় হয়ে।

হঠাৎ একটা কণ্ঠস্বর ভেসে আসে তার কানে, কোমল নারীকণ্ঠ–যতই ছদ্মবেশ ধারণ করো, আত্নগোপন করতে পারবে না…পরক্ষণেই হাসির শব্দ, তারপর হাসি থেমে যায়, পুনিঃ সেই কণ্ঠ- বিজয়ার হৃদয় তুমি জয় করে নিয়েছে, তার সঙ্গে নিজেও জড়িয়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে……সাবধান, হারিয়ে যেও না যেন……

বনহুর বিস্ময়ভরা দৃষ্টি নিয়ে চারিদিকে তাকাতে লাগলো। দ্রুত এগিয়ে গেলো জানালার দিকে, সেখানেও কেউ নেই। দরজা খুলে ক্ষিপ্রতার সঙ্গে বেরিয়ে এলো বাইরে। এদিক সেদিক অনেক সন্ধান করেও কাউকে পেলো না বনহুর, নীরবে ফিরে এলো কক্ষমধ্যে। একণ্ঠস্বর কার? কে তাকে এভাবে লক্ষ্য করছিলো আর তাকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বললো? নিশ্চয়ই আশা। বনহুর আপন মনেই হাসলো।

ঐ মুহূর্তে পিছন বেলকুনিতে অদৃশ্য হলো একটি নারীমূর্তি।

মরিয়ম বেগম বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বললেন–নীলদ্বীপের মহারাজ এসেছেন আমার সঙ্গে দেখা করতে, বলিস্ কি?

বনহুর ছোট্ট বালকের মত মাথা দোলায়–হাঁ মা।

কেন রে, হঠাৎ নীলদ্বীপের মহারাজের আমার সঙ্গে কি প্রয়োজন?

তা আমি কেমন করে বলবো বলো? চলো না মা, দেখা করবে।

 কি জানি আমার যেন কেমন আশঙ্কা হচ্ছে।

মনিরা এতক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে শুনছিলো স্বামী এবং শাশুড়ীর কথাবার্তা, এবার বলে উঠলো–মামীমা, মিছেমিছি তোমার এত আশঙ্কা। নীল দ্বীপের মহারাজ অতি মহঞ্জন। আড়াল থেকে আমি তাকে দেখেছি, দেখে সেই রকমই মনে হলো।

বেশ, চল যাচ্ছি। মরিয়ম বেগম উঠে পড়লেন।

 বনহুর মাকে সঙ্গে নিয়ে হলঘরে ফিরে এলো।

বৃদ্ধ মহারাজ হীরন্ময় সেন মরিয়ম বেগমকে দেখে আসন ত্যাগ করে উঠে দাঁড়ালেন এবং সসম্মানে নমষ্কার করলেন।

মরিয়ম বেগম মহারাজকে অভ্যর্থনা জানিয়ে বসার জন্য অনুরোধ করলেন।

আসন গ্রহণ করলেন মহারাজ হীরন্ময় সেন।

 মরিয়ম বেগমও বসলেন।

সরকার সাহেবও এসেছিলেন, মরিয়ম বেগম তাকেও বসার জন্য বললেন।

সরকার সাহেব আসন গ্রহণ করলেন বটে কিন্তু তার মনে নানারকম প্রশ্ন উঁকি মারছিলো। হঠাৎ নীল দ্বীপের মহারাজের আগমন বিস্ময়কর বটে। তিনি উদ্বিগ্নভাবে অপেক্ষা করতে লাগলেন।

মরিয়ম বেগম কিছু বলবার পূর্বে বনহুর নিজে একপাশে আসন দখল করে চুপটি করে বসে পড়ে। মুখমণ্ডলে তার একটা সুস্পষ্ট চিন্তার ছাপ ফুটে উঠেছে। তার মা মহারাজ হীরন্ময়ের কথায় কি জবাব দেবেন কে জানে।

মহারাজই প্রথমে কথা বললেন—-আপনার মত ভাগ্যবতী জননীর সাক্ষাৎলাভে আমি ধন্য হলাম। যার গর্ভে এমন সন্তান, তিনি শুধু স্বার্থক জননী নন, বিশ্বনন্দিতা তিনি।

মরিয়ম বেগম একটু হেসে বললেন—সব খোদার ইচ্ছা।

দেখুন, আমি সেই নীল দ্বীপ থেকে কেন ছুটে এসেছি এবার সেই কথা বলতে চাই। কিন্তু তার পূর্বে আমাকে কয়েকটা কথা জানাতে হচ্ছে।

বলুন?

আপনকে ধৈর্য সহকারে শুনতে হবে আমার কথাগুলো।

শুনবো।

বলতে শুরু করলেন মহারাজ হীরন্ময় সেন, রায়হান বন্দরে বনহুরের অনুচর হস্তে ধরা পড়ার। পূর্বে নীল দ্বীপে যে অভিশাপ এসেছিলো, কিভাবে তার পাঁচ পুত্র এবং শত শত নিষ্পাপ প্রজাকে কাপালিক হস্তে তুলে দিতে হয়েছিলো সব বললেন, তারপর বললেন, সংসার ত্যাগ করে স্ত্রী-কন্যা আত্নীয়স্বজন ত্যাগ করে দেশত্যাগী হলাম। সমস্ত মায়া-মমতা বিসর্জন দিয়ে ভিখারী বেশে ঘুরতে লাগলাম দেশ হতে দেশান্তরে। একদিন তোক মুখে শুনলাম এক মহৎ, মহাপ্রাণ জনের কথা, সেই পারবে নীল দ্বীপকে কাপালিকের কবল হতে রক্ষা করতে। নতুন এক আলোকরশ্মি সন্ধান পেলাম, তারপর থেকে খুঁজে ফিরতে লাগলাম সেই মহাপ্রাণ শক্তিশালী ব্যক্তিকে। হাঁ, একদিন আমার ঝোলা থেকে একটি চিঠি বের হলো, আর সেই চিঠির সূত্র ধরে আমাকে পাকড়াও করে নিয়ে গেলো। তখনও আমি ভাবতে পারিনি, আমি যাকে খুঁজে মরছি এ তারই আশ্রয়। তারপর সবাই বললেন মহারাজ হীরন্ময় সেন……

মহারাজ হীরন্ময় সেনের কথা শুনতে গিয়ে মুহূর্তে মুহূর্তে শিউরে উঠছিলেন মরিয়ম বেগম। বিস্ময়ে আরস্ট হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। মুখে তার কোনো কথা সরছিলো না। চিত্রার্পিতের ন্যায় শুধু শুনে যাচ্ছিলেন।

 মহারাজ সব কথা শেষ করে বললেন–মহারাণী পাঁচপুত্রকে হারিয়ে উন্মাদিনীর মত হয়ে পড়েছিলেন। যেদিন তিনি তিলককে দেখলেন সেইদিন তিনি ওকে নিজ পুত্র বলে গ্রহণ করলেন। ওকে পেয়ে রাণী অনেকটা প্রকৃতিস্থ হয়েছেন, আপনি দয়া না করলে রাণীকে বাঁচানো সম্ভব হবে না। আপনি জননী, আর এক জননীর ব্যথা আপনি বুঝবেন।

না না, এ সব আপনি কি বলছেন, আমার একমাত্র সন্তান…

আপনি আমাকে বিমুখ করবেন না বোন।

 সব দিতে পারি কিন্তু….

 মা, তুমি মত দাও মা! বললো বনহুর।

না না, তা সম্ভব নয়, তোকে শপথ করে পুত্র হতে হবে।

 তাতে দোষ কি মা? আমার এক জননী ছিলো, এবার দুজন হবে।

আমাকে তুই হত্যা করে যেখানে খুশি চলে যা, আমি তবু সহ্য করবো কিন্তু জীবিত থেকে তোকে আর একজনের হাতে সঁপে দিতে পারবো না।

সরকার সাহেব এতক্ষণ নিশ্চুপ ছিলেন, এবার তিনি কথা না বলে পারলেন না। তিনি বললেন–বেগম সাহেবা, আপনি অবুঝ হচ্ছেন কেন? মত দিন, কারণ আপনার সন্তান আপনারই থাকবে।

আপনি চুপ করুন সরকার সাহেব, আমি পারবো না এ কাজে মত দিতে। কথাটা বলে অন্তপুরে চলে যান মরিয়ম বেগম।

মহারাজ বনহুরের হাত দু’খানা চেপে ধরে উচ্ছ্বসিতভাবে কেঁদে উঠলেন-বাবা, কোন মুখ নিয়ে আমি নীল দ্বীপে ফিরে যাবো? রাণীকে কথা দিয়ে এসেছি তোমার তিলকে আমি নিয়েই আসবো! বলো, বলো বাবা, কি উত্তর দেবো আমি তাঁকে গিয়ে?

বনহুর গম্ভীর হয়ে পড়েছে, মহারাজের কথায় কোনো জবাব সে দিতে পারলো না।

মহারাজের অশ্রু বৃদ্ধ সরকার সাহেবকে বিচলিত করে তুললো। বনহুরও অত্যন্ত ব্যথিত হলো, সে ভেবেছিলো তার মা নিশ্চয়ই অমত করবেন না। মহারাজের কথায় তার হৃদয় গলে যাবে।

 মরিয়ম বেগম অন্তপুরে প্রবেশ করলেন।

 মনিরা আড়ালে দাঁড়িয়ে সব শুনেছিলো, মরিয়ম বেগম ভিতরে আসতেই বলে উঠলো মামীমা, আপনি ঠিকই করেছেন, কোন সাহসে নীল দ্বীপের মহারাজ এসেছেন আপনার বুক থেকে সন্তান ছিনিয়ে নিতে?

হাঁ, আমি দেবো না, আমার সন্তানকে আমি দেবো না-না না, কিছুতেই না……

 বনহুর এসে দাঁড়ায় সেখানে, হেসে বলে-মা, তুমি স্থির হয়ে ভেবে দেখো। তাছাড়া আমি কি সত্যি সত্যি তোমার কোল থেকে চিরদিনের জন্য সরে যাবো? আমি কি পর হয়ে যাবো?

তা হয় না, তা হয় না মনির। আমার সন্তান আর এক জনের হবে, এ আমি ভাবতে পারি না

মা মা গো, তুমি মা হয়ে এর একটি মায়ের ব্যথা বুঝতে পারছো না? আমি যেমনটি ছিলাম ঠিক তেমনি থাকবো তোমার হয়ে!

মনিরা এতক্ষণ ফুলছিলো মনে মনে, এবার সে ক্রুদ্ধকণ্ঠে বলে–যা সম্ভব নয় তা নিয়ে কেন বাড়াবাড়ি করছে! মা মত দেবেন না কিছুতেই।

মনিরা, তুমিও অবুঝ হলে?

অবুঝ আমরা কেউ নই, তুমি যা খুশি তাই করবে সেটা সহ্য করবেন মামীমা?

 তুমিও যদি ব্যাপারটা ঠিকমত বুঝতে চেষ্টা না করো তাহলে আমি নিরুপায়।

মনিরা চলে যায় নিজের ঘরে।

 বনহুর মনিরার পিছু পিছু তার কক্ষে প্রবেশ করে।

মনিরা গম্ভীর হয়ে পড়েছে ভয়ানকভাবে!

বনহুর মৃদু হেসে মনিরা চিবুকটা তুলে ধরে বলে-মনিরা, তুমি তো জানো কেউ আমাকে আটকে রাখতে পারবে না। আমি তোমাদের ছেড়ে কোথাও থাকতে পারি? মনিরা, তুমিও কি বুঝতে পারছে না সেই মহিলার ব্যথা! পাঁচ-পাঁচটি সন্তানকে হারিয়ে তার কি অবস্থা হয়েছে……

কেন, তুমি ছাড়া এ পৃথিবীতে কি আর কেউ ছিলো না যাকে পুত্র বলে গ্রহণ করতে পারে?

বহু আছে কিন্তু তিনি কেন যে আমার প্রতি এত আকৃষ্ট হলেন বুঝতে পারছি না। হয়তো আমাকে তার এদের কারও মত মনে হয়েছে। মনিরা, তুমি নিজেও যদি এ অবস্থায় পড়তে, তবে কিছুতেই পারতে না তাকে বিমুখ করতে। এক অসহায় মায়ের সেই করুণ মুখ, সেই অশ্রুভরা চোখ……মনিরা, তুমি মাকে একবার বুঝাও, নিশ্চয়ই তিনি তোমার কথা শুনবেন। বনহুর মনিরার হাত দু’খানা মুঠায় চেপে ধরে।

 মনিরা পারে না আর শক্ত হয়ে থাকতে, বলে–তুমি ওখানে থেকে যাবে না তো?

অসম্ভব! তোমাদের ছেড়ে আমি নীলদ্বীপে চিরদিনের জন্য থেকে যাবো, এ কথা ভাবতে পারো? মা, তুমি নূর-তোমরাই যে আমার স্বপ্ন মনিরা……

সত্যি বলছো, আমাদের ভুলে যাবে না তো সেখানে গিয়ে?

না, কথা দিলাম অভিষেক হলেই চলে আসবো।

 যদি মহারাণী তোমাকে ছেড়ে না দেন?

পৃথিবীর কোনো শক্তিই আমাকে আটকে রাখতে পারে নি, পারবেও না কোনোদিন। তুমি তো জানো, তোমার স্বামীর কত কাজ। এক জায়গায় স্থির হয়ে থাকার মত সময় আছে তার? চলো, চলো মনিরা, মাকে বুঝিয়ে বলবে, চলো?

কি জানি কেন যেন আমার মনটাও বড় অস্থির লাগছে।

 সে তোমার মনের একটা খেয়াল।

না, খেয়াল নয়, খেয়াল নয়–বুকের মধ্যে আমার বড় কষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে তুমি আর ফিরে আসবে না।

হাসে বনহুর নারী মন এমনি হয়। মনিরা, আমাকে তুমি তাহলে বিশ্বাস করতে পারছো না?

তোমাকে বিশ্বাস না করলে আমি কাকে বিশ্বাস করবো বলো?

তবে চলো, মাকে বুঝিয়ে বলবে চলো। ব্যাকুল কণ্ঠে বললো বনহুর।

মনিরা পারলো না আর নিশুপ থাকতে।

বনহুর আর মনিরা যখন মায়ের কামরার দরজায় এসে দাঁড়ালো তখন শুনতে পেলো ভিতরে সরকার সাহেবের গলা, তিনি বলছেন–বেগম সাহেবা, আপনার সন্তান অবুঝ নয়, সে অতি বুদ্ধিমান। তাকে ধরে রাখে এমন শক্তি পৃথিবীতে নেই। আপনার ছেলে আবার ফিরে আসবে আপনার কাছে……।

আপনি আমাকে বৃথা বুঝাতে চেষ্টা করছেন সরকার সাহেব। নীলদ্বীপের মহারাণী আমার মনিরকে চিরদিনের জন্য আমার বুক থেকে ছিনিয়ে নেবার চেষ্টা করছে। আমি জানি, সব জানি। মরিয়ম বেগম বাষ্পরুদ্ধকণ্ঠে কথাগুলো বললেন।

বনহুর মনিরার কানে মুখ নিয়ে বললো-যাও মনিরা, এবার তুমি যাও! মাকে বুঝাতে চেষ্টা করো।

মা কিছুই বুঝবেন না।

তুমি পারবে মনিরা মাকে বুঝাতে, সে ভরসা আমার আছে।

বেশ, আমি যাচ্ছি।

 যাও, যাও মনিরা।

বনহুর দাঁড়িয়ে থাকে দরজার পাশে।

 মনিরা কক্ষমধ্যে প্রবেশ করে মামীমার পাশে এসে দাঁড়ায়।

সরকার সাহেব বেরিয়ে যান মাথা নত করে, কারণ তার সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।

সরকার সাহেব বেরিয়ে যেতেই মনিরা বলে উঠলো—মামীমা, কাউকে কোনোদিন বিমুখ করতে নেই। আপনার সন্তানকে কেউ যদি নিজের সন্তানরূপে ভালবাসতে চায় তাতে দোষ

মনিরা, তুইও আমাকে ভোলাতে এসেছিস?

ভোলাতে নয়, বুঝাতে। মামীমা, ও শিশু নয় যে কেউ ওকে চিরদিনের জন্য ধরে রাখবে। যখন খুশি চলে আসবে, শুধু আর একটি মাকে সে পুত্রের অধিকার দেবে।

তুইও ওকে ছেড়ে দিতে চাইছিস মনিরা?

মামীমা, তুমি তো জানো ওকে কেউ কোনোদিন আটকে রাখতে পারেনি–পারবেও না। সেই ভরসা নিয়েই আমি তোমাকে মত দিতে বলছি।

বেশ, তাই হোক,

মরিয়ম বেগমের কথা শেষ হয় না, বনহুর কক্ষমধ্যে প্রবেশ করে মায়ের কোলে মুখ গুঁজে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলে-মা, মাগো, আমি তোমার সন্তান, চিরদিন তোমারই থাকবো।

মরিয়ম বেগমের চোখ থেকে ফোট ফোঁটা অশ্রু ঝরে পড়তে থাকে বনহুরের মাথার উপর।

*

মহা ধুমধামের সঙ্গে অভিষেক-পর্ব শেষ হলো।

 তিলককে মহারাণী পুত্র হিসেবে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হলেন। তিনি নিজ হাতে নীলদ্বীপের দীন-দুঃখীদের মধ্যে প্রচুর অর্থ, খাদ্য, বস্ত্র দান করলেন অকাতরে। রাজপ্রাসাদের যেন আনন্দের বন্যা বয়ে চললো।

 মহারাণী নিজ হাতে তিলকের দেহে রাজকীয় পোশাক পরিয়ে দিলেন। বারবার ওকে দেখতে লাগলেন অপূরণীয় দৃষ্টি নিয়ে। একমুহূর্ত ওকে চোখের আড়াল করতে চান না তিনি।

বিজয়ার আনন্দ সবচেয়ে বেশি। তিলক চলে যাবার পর থেকে তার মনের খুশি চিরতরে অন্তর্ধান হয়েছিলো। সে ভেবেছিলো, যে চলে গেলো সে আর আসবে না।

তিলক ফিরে এসেছে, তার স্বপ্নের রাজকুমার ফিরে এসেছে-এ যে বিজয়ার পরম সৌভাগ্য। সে সখীদের নিয়ে আনন্দে মেতে উঠলো। হাসি-গান আর আনন্দে রাজপ্রাসাদ পূর্ণ হয়ে উঠেছে আজ।

মহারাজ এতদিনের তৃপ্তির নিশ্বাস ত্যাগ করলেন।

মহারাণীর প্রাণভরা স্নেহ-ভালবাসা বনহুরকে কম মুগ্ধ ও অভিভূত করলো না, সেও আত্নহারা হয়ে পড়লো যেন।

বিজয়া একসময় নিভৃতে বনহুরকে ধরে ফেললো–তিলক, জানতাম তুমি আসবে।

বনহুর চোখ তুলে তাকায়, তার মুখ দিয়ে ছোট্ট একটা শব্দ বের হলো–উ!

 তিলক, তুমি কত সুন্দর!

উ, কি বললেন রাজকুমারী?

কত সুন্দর তুমি!

আপনি এসব কি বলছেন রাজকুমারী?

আপনি নয়, তুমি বলবে এখন থেকে।

সর্বনাশ, তুমি বলবো আপনাকে? তা আমি পারবো না।

কেন পারবে না?

আপনি রাকন্যা আর আমি হলাম ভীল-সন্তান!

এখন তুমি আর ভীল সন্তান নও, তুমি রাজকুমার।

হেসে উঠলো বনহুর তার অভ্যাসমত হাঃ হাঃ হাঃ, হাঃ হাঃ হাঃ…..

বিজয়া বিস্ময়ভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইলো, এমন করে সে কোনোদিন কাউকে হাসতে দেখেনি। কি অদ্ভুত সে হাসি, প্রাসাদের পাথরগুলো যেন দুলে দুলে উঠছে সে হাসির শব্দে।

বনহুর হাসি থামিয়ে বললো-রাজকুমারী, আপনারা সভ্য সমাজের উচ্চস্তরের লোক, আর আমরা জংলী অসভ্য-যেমন মানুষ আর বানরে পার্থক্য তেমনি আপনাতে আর আমার মধ্যে প্রভেদ।

তিলক। এব তুমি কি বলছো?

 সত্যি যা তাইতো বলছি রাজকুমারী।

ওসব কোনো কথাই তোমার আমি শুনবো না। বিজয়া তিলকের কণ্ঠ বেষ্টন করে বললো আবার–তোমার গলায় মালা দিয়েছি তিলক, সে মালা তুমি আর আমাকে ফিরিয়ে দিতে পারো না।

বনহুর কোনো জবাব দিতে পারলো না।

 ততক্ষণে বিজয়ার অন্যান্য সখী এসে তাদের ঘিরে দাঁড়িয়েছে।

খিল খিল করে হেসে উঠে সবাই।

বনহুরের মনে একটা শিহরণ জাগে, এদের মধ্যেই হয়তো আছে সেই আশা, সেই অদ্ভুত মেয়েটি। কিন্তু কোনটা সেই আশা কে জানে।

বনহুর ওদের সবাইকে লক্ষ্য করছিলো নিপুণ দৃষ্টি নিয়ে।

 বিজয়া বলে উঠলো–ওদের দিকে তাকিয়ে কি দেখছো তিলক?

 হেসে বলে বনহুর–দেখছি এদের মধ্যে কে রাজকুমারীর প্রিয় বান্ধবী।

তাই নাকি? আচ্ছা, বলোতো এদের মধ্যে সবচেয়ে কে আমার প্রিয়?

সখীরা সবই সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়ালো।

বনহুর সবাইকে নিপুণভাবে দেখার সুযোগ পেলো, সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে লক্ষ্য করে বললো প্রত্যেকটা তরুণীকে, মুখমণ্ডল থেকে পা পর্যন্ত নিখুঁতভাবে লক্ষ্য করে দেখতে লাগলো। শুধু তাই নয়, চোখ দুটির দিকে তাকাতে লাগলো বনহুর স্থির দৃষ্টি নিয়ে। বনহুরের দৃষ্টির কাছে তরুণীরা যেন কুঁকড়ে গেলো লজ্জাবতী লতার মত।

সবাইকে দেখা শেষ করে সরে দাঁড়লো বনহুর।

বিজয়া বললো–বলল, কে আমার সবচেয়ে প্রিয়, বলো?

 বনহুর মাথা চুলকাতে লাগলো।

ঠিক সেই মুহূর্তে একটি তীর এসে গেঁথে গেলো বনহুরের পায়ের কাছে।

একসঙ্গে চমকে উঠলো সবাই।

 বিজয়া অস্ফুট কণ্ঠে বললো–কার এমন সাহস প্রাসাদের মধ্যে তীর নিক্ষেপ করলো!

বনহুর ততক্ষণে তীরফলকটা তুলে নিয়েছে হাতে। বিস্ময়ে বিস্ফারিত নয়নে দেখলো তীরটার সঙ্গে গাঁথা আছে একটি কাগজের টুকরা। দ্রুতহস্তে খুলে নিয়ে মেলে ধরলো, কাগজের টুকরায় লিখা আছে মাত্র কয়েকটা কথা–

–বনহুর, তোমার অন্বেষণ বৃথা। কারণ যাকে খুঁজছে সে নেই বিজয়ার সখীদের মধ্যে।”
–আশা

 নেই, নেই সে এদের মধ্যে। আপন মনেই বলে উঠে বনহুর।

 বিজয়া সরে আসে–কি বললে, এদের মধ্যে আমার প্রিয় বান্ধবী কেউ নেই?

বনহুর বললো–না, নেই।

তিলক, তুমি এতবড় মিথ্যা কথা বলতে পারলে? জানো এরা সবাই আমার প্রিয় বান্ধবী।

বনহুর যখন বিজয়ার কথার উত্তর দেবে ভাবছে তখন হঠাৎ তার দৃষ্টি চলে গেলো দূরে রাজপ্রাসাদের সম্মুখে রাস্তায়। কয়েকজন রাজকর্মচারী কয়েকজন বন্দীকে শিকলে আবদ্ধ করে টানতে টানতে কারাগার প্রাঙ্গণের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এ দৃশ্য লক্ষ্য করে বনহুরের কুঞ্চিত হয়ে উঠলো।

বিজয়া হেসে বললো—ওরা মুসলমান।

বনহুর গম্ভীর কণ্ঠে বললো–মুসলমান বলেই কি ওরা এই শাস্তি পাচ্ছে?

না, তা নয়।

তবে কি?

তুমি জানো না তিলক, নীল দ্বীপের চারপাশে যে বাঁধ তৈরি হচ্ছে, সেখানে বহু মুসলমান বাস করে। বাধ তৈরির ব্যাপারে তারা কাজ করছে। যারা বাঁধ তৈরি ব্যাপারে জায়গা ছেড়ে দিতে রাজি না হয় কিংবা সেখানে কাজ করতে রাজি না হয় তাদের ঐ ভাবে শাস্তি দেওয়া হয়, তারপর বন্দী করে রাখা হয়। কথাগুলো স্বচ্ছকণ্ঠে বললো বিজয়া। সে জানে না তিলক কি জাতি এবং সে কে, তাই কথা গুলো বলতে তার বাধলো না একটুও।

বনহুরের মুখমণ্ডলে একটা গভীর চিন্তার ছাপ ফুটে উঠলো।

বিজয়া বনহুরের মুখোভাব লক্ষ্য করে সখীদের চলে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিলো।

সখীরা সবাই চলে গেলো।

বিজয়া সরে এলো ঘনিষ্ঠ হয়ে বনহুরের পাশে, বললো হঠাৎ তোমার কি হলো তিলক?

বনহুর বললো–আমি জানতাম তোমার বাবা মহারাজ হীরন্ময় অতি মহঞ্জন, কিন্তু……

 বলল, থামলে কেন?

বলবো, সব বলবো তোমাকে বিজয়া।

তিলক!-তিলক, তুমি আমাকে তুমি বলেই বলবে আর নাম ধরে ডাকবে। সত্যি তোমার মুখে আমার নাম অপূর্ব শোনালো!

বিজয়ার কথাগুলো বনহুরের কানে পৌঁছলো কিনা কে জানে, তার মনের মধ্যে তখন আলোড়ন চলেছে। নীল দ্বীপে মুসলমানদের উপর এইরকম অকথ্য অত্যাচার চলেছে। কি ভয়ঙ্কর এক অবস্থার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে তারা। খোদা হয়তো এর একটা বিহিত ব্যবস্থার জন্যই তাকে নীল দ্বীপে আটকে রাখলো। কাপালিক হত্যার পরই যদি ফিরে যেতে সে কান্দাই, তাহলে সে এর বিন্দুমাত্র জানতো না।

বিজয়া বনহুরকে গম্ভীর হয়ে ভাবতে দেখে বললো–কি ভাবছো তিলক?

 ভাবছি নীল দ্বীপের চারপাশে যে বাঁধ তৈরি হচ্ছে সেটা একবার আমার দেখা দরকার।

ও এই কথা? এ নিয়ে ভাবতে হবে–আজই আমি পিতাকে বলে তোমার সেখানে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেবো।

খুশি হলাম তোমার কথা শুনে বিজয়া।

*

বনহুরের ইচ্ছা বিজয়ার মুখে শুনে মহারাজ হীরন্ময় খুশিই হলেন, তিনি মন্ত্রী পরশু সিংকে ডেকে জানালেন কথাটা।

পরশু সিং ছিলো যেমন দুর্দান্ত তেমনি নির্দয় ধরনের। বিশেষ করে নিরীহ মুসলমানদের প্রতি ছিলো তার অহেতুক একটা প্রতিহিংসামূলক মনোভাব। নীল দ্বীপে মুসলমান বাস করবে, এটা যেন তার সহ্যের বাইরে। পরশু সিং মহারাজ হীরন্ময়কে যা বুঝাতে তিনি তাই বুঝতেন।

নীল দ্বীপটিকে সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা করার জন্য নীলদ্বীপের চারপাশে সুউচ্চ বাঁধ তৈরি করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। কারণ প্রায়ই সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে নীলদ্বীপের প্রচুর ক্ষতি সাধিত হতো এবং বহু লোকজন মর্মান্তিকভাবে প্রাণ হারাতে। এই বাধ তৈরি করে নীলদ্বীপকে রক্ষা করাই মহারাজের উদ্দেশ্য। বাঁধ তৈরি শুরু হয়েছে এবং কাজ চলছে। বিরাট বিরাট পাথরের চাপ দিয়ে তৈরি হচ্ছে এই বাঁধ।

এই বাধ তৈরি সহজ কথা নয়, অত্যন্ত কষ্টকর।

 নীলদ্বীপের জনগণ এ বাঁধ তৈরি ব্যাপারে অক্ষম তাই মুসলমানদের প্রতি কঠিন জুলুম করা হয়েছে–এ বাঁধ তৈরি তাদের দ্বারাই সমাধা করতে হবে।

 নীল দ্বীপের উত্তর পূর্বদিকে বাস করতে কিছুসংখ্যক মুসলমান। এরা খুব ধনবান কিংবা শিক্ষিত ছিলো না। এরা অত্যন্ত সরল-সহজ-নিরীহ ছিলো। মহারাজ হীরন্ময়ের প্রধানমন্ত্রী পরশু সিং এদের উপর নির্দেশ দিলো– এ বাঁধ তারাই তৈরি করবে। কেউ যদি এ ব্যাপারে অমত করে বা অবহেলা করে তাকে কঠিন শাস্তি দেওয়া হবে এবং কারাগারে বন্দী করে রাখা হবে। কারাগারে নির্যাতন চালানো হবে তাদের উপর।

পরশু সিং-এর নিষ্ঠুর নির্যাতনের ভয়ে ভীত নিরীহ মুসলমান এই অসাধ্য সাধনে আত্ননিয়োগ করেছে। তারা অবিরত কাজ করে চলেছে। কাপালিকদের অত্যাচারে কিছুদিন বাঁধ তৈরির কাজ বন্ধ ছিলো। কাপালিক হত্যার পর আবার বাঁধ তৈরির কাজ পুরাদমে শুরু হয়েছে।

বনহুর মন্ত্রী পরশু সিং-এর সঙ্গে অশ্বপৃষ্ঠে হাজির হলো যেখানে বাঁধ তৈরির কাজ চলেছে। সমুদ্রের ধার ঘেঁষে বড় বড় পাথর দিয়ে দেয়ালের মত মজবুত করে বাঁধ তৈরি হচ্ছে। অগণিত মুসলমান যুবক-বৃদ্ধ অবিরত কাজ করে চলেছে। এক মুহূর্তের জন্য কারও বিশ্রামের উপায় নেই। তাদের পরিচালনা করে চলেছে মহারাজের কর্মচারিগণ। মহারাজ হীরন্ময় মহৎ উদার ব্যক্তি ছিলেন কিন্তু তার মন্ত্রী ছিলো অত্যন্ত শয়তান নির্দয় পাষণ্ড। কাজেই অন্যান্য কর্মচারী যারা মন্ত্রীর নির্দেশমত কাজ করতো তারাও ছিলো ঠিক মন্ত্রী পরশু সিং-এর মতই হৃদয়হীন নরাধম।

 বনহুর সেখানে পৌঁছতেই প্রথমে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো-একবৃদ্ধ মুসলমানকে ভীষণভাবে আঘাতের পর আঘাত করে চলেছে এক রাজকর্মচারী। এ দৃশ্য লক্ষ্য করতেই মুখমণ্ডল কঠিন হয়ে উঠলো বনহুরের।

পরশু সিং দীপ্তকণ্ঠে বললো—দেখুন তিলককুমার, আমার নির্দেশ কত কঠিন। কেউ কাজে অবহেলা করলে তাকে এইভাবে প্রহার করা হয়ে থাকে।

বনহুর অস্ফুট কণ্ঠে বললো—চমৎকার, এমন সুন্দর নির্দেশ মেনে চলা একান্ত কর্তব্য।

আসুন তিলক কুমার, ওদিকে দেখবেন আসুন।

 চলুন।

অশ্বপৃষ্ঠে অগ্রসর হলো পরশু সিং এবং বনহুর।

কিছুদূর অগ্রসর হতেই নজরে পড়লো কতকগুলো যুবক মাথায় এবং কাঁধে করে বড় বড় পাথর বহন করে নিয়ে চলেছে। পিছনে চাবুক হস্তে তাদের অনুসরণ করে চলেছে রাজকর্মচারিগণ। পাথর বয়ে নিয়ে যেতে যেতে গা বেয়ে এক একজনের ঘাম ঝরে পড়ছে, কারও বা মাথা বা হাতের কুনুয়ে কেটে গিয়ে রক্ত ঝরছে। হঠাৎ এক যুবক পাথরসহ হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলো অমনি এক রাজকর্মচারী পিশাচের মত চাবুক চালাতে শুরু করলো।

যুবকটি মাটিতে পড়ে রীতিমত হাঁপাচ্ছে।

 চাবুকের আঘাতে আঘাতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠলো সে, মুখ দিয়ে ফেনা বের হচ্ছে।

একদিকে প্রখর রৌদ্রের অগ্নিসম উত্তাপ, পিপাসায় যুবকের কণ্ঠনালী শুকিয়ে গেছে, ঝর ঝর করে ঘাম ঝরছে তার দেহ দিয়ে, তারপর এই নির্মম কষাঘাত-যুবকটা মুখ থুবড়ে পড়ে গেছে, নাকেমুখে বালি প্রবেশ করছে।

বনহুর অধর দংশন করছিলো, এ দৃশ্য তাকে ভীষণভাবে অস্থির করে তুলছিলো তবু নীরব রইলো সে অতি সর্তকভাবে।

পরশু সিং বললো–চলুন এবার তিলক কুমার, বাঁধ দেখবেন চলুন।

 পরশু সিং এর কণ্ঠস্বরে সম্বিত ফিরে আসে বনহুরের, বলে উঠে–চলুন মন্ত্রীবর।

*

সেদিনের সেই নির্মম দৃশ্যের কথা ভুলতে পারলো না বনহুর কিছুতেই। বাঁধ তৈরির ব্যাপারে মুসলমানদের প্রতি এই অন্যায় অত্যাচার তার ধমনির রক্ত উষ্ণ করে তুললো। এর প্রতিকার তাকে করতেই হবে। বনহুর নিজ ঘরে শুয়ে শুয়ে এ ব্যাপার নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে লাগলো। অসহায় নিরীহ কতকগুলো লোকের সেই জঘন্য পরিণতি ভাসতে লাগলো তার চোখের সামনে।

বনহুর ভাবছে তাদের কথা, ভাবছে কিভাবে তাদের রক্ষা করা যায়।

এমন সময় একটি ফুল এসে পড়লো তার বুকের উপর।

চমকে উঠে ফিরে তাকালো বনহুর।

দেখতে পেলো অদুরে দাঁড়িয়ে হাসছে বিজয়া!

 বনহুর ততক্ষণে ফুলটা হাতে তুলে নিয়ে বিছানায় উঠে বসেছে।

এগিয়ে আসে বিজয়া।

 বনহুর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে তাকায় বিজয়ার মুখের দিকে।

বিজয়া আজ বনহুরের দৃষ্টির মধ্যে একটা গম্ভীর ভাব লক্ষ্য করলো। অন্যান্য দিন হলে বনহুর হাসতো ওকে দেখতে পেয়ে আজ যেন নতুন একটা রূপ দেখতে পেলো সে ওর মধ্যে।

আরও সরে এলো বিজয়া বনহুরের দিকে।

 বনহুর তখন ফুলটা রেখে দিয়েছে বিছানার একপাশে।

বিজয়া বললো–তিলক, আজ তোমার কি হয়েছে?

বনহুর পুনরায় দৃষ্টি তুলে ধরলো বিজয়ার মুখে, গম্ভীর কণ্ঠে বললো-আজ নীল দ্বীপের আসল রূপ উদঘাটন হয়ে গেছে আমার চোখে।

তার মানে? বললো, বিজয়া।

 মানে বলার সময় আজ নয়, বলবো একদিন।

তিলক, তোমার কথাগুলো কেমন হেঁয়ালি পূর্ণ মনে হচ্ছে।

কি হয়েছে তোমার বলো তো?

কিছু হয়নি, তবে নীলদ্বীপটা আজ আমার কাছে নীল নরক বলে মনে হচ্ছে।

তিলক!

 হ রাজকুমারী।

জানো এ কথা বাবা শুনলে কত ব্যথা পাবেন?

সত্যি যা তা বলতে আমার বাধা নেই রাজকুমারী।

রাজকুমারী…রাজকুমারী, কেন বিজয়া বলে ডাকতে পারো না?

সে অধিকার আমার নেই।

কে বললো সে অধিকার তোমার নেই? তিলক, যেদিন আমি তোমাকে প্রথম দেখেছি সেদিন আমি……

থাক, আর শুনতে চাই না।

 তিলক।

হাঁ, ও কথাগুলো আমি বহু নারীর কণ্ঠে বহুবার শুনেছি, কাজেই নতুন করে আর শুনতে আমি রাজি নই। আমি জানি প্রথম দিন যখন তুমি আমার দিকে তাকিয়েছিলে তখনই বুঝতে পেরেছিলাম তোমার মনের কথা।

সত্যি?

হা।

তবে কেন তুমি এতদিনও আমাকে……

জানাইনি, তাই না?

হাঁ, কেন জানাওনি তোমার মনের কথা?

তুমি রাজকুমারী আর আমি…

বিজয়া বনহুরের মুখে হাতচাপা দিলো–থাক, আর বলতে হবে না। তিলক, এই নির্জন কক্ষে একা একা শুয়ে থাকতে তোমার কি খুব ভাল লাগছে?

খুব ভাল লাগে আমাকে একা থাকতে।

 তুমি এক অদ্ভুত মানুষ।

আমি অদ্ভুত মানুষ নই, বলো অদ্ভুত জীব।

খিল খিল করে হেসে উঠে বিজয়া, তারপর ফুলটা তুলে নিয়ে বনহুরের সম্মুখে ধরে-কেমন। লাগছে এটা?

খুব সুন্দর।

ফুলের চেয়েও বেশি সুন্দর তুমি তিলক!

 হাসে বনহুর।

বিজয়া বনহুরের হাত ধরে টেনে নিয়ে চলে–চলো বাগানে যাই।

জোছনার আলোতে ঝলমল করছে চারিদিক।

ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে বাগানের গাছগুলো।

অপূর্ব লাগছে জোছনার আলো ঝলমল রাত।

বনহুরের হাত ধরে বিজয়া এসে দাঁড়ালো জোছনা প্লবিত বাগানে।

মায়াময় রাত।

বিজয়ার হৃদয়ে আনন্দের অনুভূতি।

বলে বিজয়া-তিলক, কি সুন্দর রাত, তাই না?

অপূর্ব। বলে বনহুর।

বিজয়া বনহুরের হাত ধরে ওকে একটি আসনে বসিয়ে দেয়।

বনহুর বিজয়ার হাতের পুতুলের মত বসে পড়ে পাথরাসনে। বিজয়া ওর কণ্ঠে বাহু লগ্ন করে বলে-তিলক, ঐ চাঁদের মত তুমি সুন্দর! আমি হারিয়ে গেছি তোমার মধ্যে।

তারপর?

 তারপর তুমি আমার। কই, তুমি তো কিছু বলছে না?

আমি ভীল সন্তান, অমন করে বলার সাহস আমার নেই।

আমি তোমাকে সে অধিকার দিলাম। বলল, বলো তিলক। কিছু বলো তুমি! সত্যি সত্যি। তোমাকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে আমার হৃদয় ব্যথায় ভেঙ্গে পড়ে।

বনহুর নির্বাক হয়ে বিজয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

বলে বিজয়া-তুমি গান শুনতে ভালবাসো তিলক?

 গান শুনতে কে না ভালবাসে? তুমি গান জানো বিজয়া?

জানি, শুনবে?

 শুনবো।

 বিজয়া গান গায়।

বিজয়ার কণ্ঠস্বর অপূর্ব লাগে বনহুরের কানে। ধীরে ধীরে সে যেন আত্নহারা হয়ে যায়।

 বিজয়া গান গাওয়া শেষ করে বনহুরের বুকে মাথা রাখে।

বনহুর নিশ্চুপ বসে আছে, তার মন তখন বহুদুরে তার কান্দাই আস্তানায়। তার চোখে ভাসছে নূরীর ঢলঢল মুখখানা, ভাসছে মনিরার স্থির নির্মম পবিত্র দুটি চোখ।

বিজয়া বলে–কি ভাবছো তিলক?

এ্যা, কিছু না! চলো, রাত বেড়ে আসছে বিজয়া।

চলো।

 বিজয়া আর তিলক যখন বাগান থেকে বেরিয়ে আসছিলো তখন একটা হাসনাহেনা ঝাড়ের আড়ালে আত্নগোপন করে সরে দাঁড়ায় একটি অপূর্ব সুন্দরী যুবতী, তার দেহে পুরুষের ড্রেস, হাতে তীর-ধনু।

*

হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যায় বনহুরের, সে শুনতে পায় একটা নারীকণ্ঠ, কোথা থেকে শব্দটা ভেসে আসছে ঠিক বুঝতে পারে না সে। কান পেতে শুনে বনহুর।

…….ঘুমাবার সময় নয় বনহুর, আজ তুমি যাদের সেই নির্মম পরিণতি দেখে এসেছে তাদের জন্য, তোমাকে সংগ্রাম করতে হবে। পারবে না তুমি তাদের উদ্ধার করতে……।

বনহুর ততক্ষণে শয্যায় উঠে বসেছে, চারিদিকে ব্যাকুল আঁখি মেলে তাকাচ্ছে সে। তার কণ্ঠ দিয়ে বেরিয়ে আসে একটা অস্ফুট কণ্ঠস্বর-পারবো! পারবো……হাঁ, পারবো আমি।

…..তবে বিলম্ব করার সময় আর নেই, চলে যাও সেখানে, তাদের বাঁচাবার চেষ্টা করো……

কে, কে তুমি কথা বলছো?

 ……আমি আশা

আশা?

……হা। …

এসো আমার সম্মুখে।

….না। এখনও সময় আসেনি বনহুর..

তুমিই আমাকে মনসুর ডাকুর সেই অগ্নিকুণ্ড থেকে রক্ষা করেছিলে?

…হাঁ, এর জন্য আমি নিজেকে ধন্য মনে করি। …..

এরপর বনহুর আর কোনো কথা শুনতে পায় না। চারিদিকে একটা নিস্তব্ধতা বিরাজ করতে লাগলো।

বনহুর কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো, তারপর শয্যা ত্যাগ করে নেমে দাঁড়ালো মেঝেতে।

এগিয়ে গেলো বনহুর ওদিকের ড্রেসিং টেবিলের দিকে।

ড্রয়ার খুলে বের করলো একটি জমকালো ড্রেস। পরে নিলো সেই ড্রেস, তারপর আয়নার সম্মুখে দাঁড়ালো, এবার তাকে কেউ রাজকুমার তিলক বলে চিনতে পারবে না।

 ভোর হবার বেশি দেরী নেই। অন্ধকারে আত্মগোপন করে বনহুর অশ্বপৃষ্ঠে ছুটে চললো নীলদ্বীপের যে অংশে বাঁধ তৈরির কাজ চলছে সেখানে।

ভোর হবার পূর্ব হতেই এখানে কাজ শুরু হয়ে গেছে।

অগণিত মুসলমান যুবক-বৃদ্ধ কাজ করে চলেছে।

 মহারাজের অনুচরগণ কাজ পরিচালনায় নিয়োজিত রয়েছে।

এতটুকু শিথিলতা লক্ষ্য করেই চাবুক চালাচ্ছে তারা অসহায় নিরীহ মুসলমানদের উপর।

পৃথিবীর বুক থেকে রাতের অন্ধকার মুছে না যেতেই বাঁধ তৈরির কাজ শুরু হয়, আবার সন্ধ্যার অন্ধকার জমাট বেঁধে না উঠা পর্যন্ত কাজ চলতে থাকে।

নিপীড়িত মুসলমানগণ হাঁপিয়ে উঠেছে তবু তাদের বিরাম নেই, নেই পরিত্রাণ। যতক্ষণ দেহে প্রাণ আছে কাজ করতেই হবে। নীলদ্বীপে জনসংখ্যা অত্যন্ত বেশি, কিন্তু মুসলমান সংখ্যা কম। তবু মহারাজের গুণধর মন্ত্রী পরশু সিং-এর হুকুম, মুসলমানগণ দ্বারাই এ বাঁধ তৈরির কাজ সমাধা করতে হবে।

অন্যান্য দিনের মত আজও কাজ পুরাদমে শুরু হয়ে গেছে।

মুসলমান যুবক-বৃদ্ধ-নারী কেউ বাদ যায়নি। সবাই যে যেমন পারে পাথর বহন করে চলেছে।

বনহুর হঠাৎ এসে দাঁড়ালো তার অশ্ব নিয়ে। দেহে জমকালো ড্রেস, মাথার পাগড়ি দিয়ে মুখের নিচের অংশ ঢাকা। কোমরের বেল্টে রিভলভার, পাশেই খাপের মধ্যে ছোরা। অশ্বপৃষ্ঠে বসে সে তাকালো সম্মুখের দিকে। দেখলো, পূর্বদিনের সেই বৃদ্ধ আজও পাথর বহন করে চলেছে। সমস্ত রাত্রির ক্লান্তি এখনও জড়িয়ে আছে তার সমস্ত দেহ এবং মুখে। পাথর বহন করে নিয়ে যেতে অত্যন্ত কষ্ট হচ্ছে বৃদ্ধের তবু চলেছে সে মন্থর গতিতে, শিথিল দু’খানা পায়ের উপর দেহটা যেন দুলছে ওর।

হঠাৎ একটা হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলো লোকটা। পাথরে মুখ থুবড়ে পড়ায় ঠোঁট দুটো কেটে রক্ত গড়িয়ে পড়লো।

ঠিক সেই মুহূর্তে একজন রাজকর্মচারী দ্রুত এগিয়ে এলো চাবুক হস্তে। কোনোরকম দ্বিধা না করে চাবুক দিয়ে প্রচণ্ডভাবে আঘাত করলো তার পিঠে।

বৃদ্ধ আর্তনাদ করে উঠলো-উঃ!

সঙ্গে সঙ্গে পুনরায় চাবুক এসে পড়লো।

এরপর চাবুক উঁচু হতেই রাজকর্মচারীর হাতখানা চাবুক সহ আটকে গেলো শূন্যে। বিস্ময় নিয়ে ফিরে তাকালো রাজ কর্মচারী, চোখ দুটো তার স্থির হয়ে গেলো একেবারে। দেখলো, জমকালো পোশাক পরা একটি লোক চাবুকসহ তার ডান হাতখানা ধরে ফেলেছে। মুহূর্ত বিলম্ব হলো না, চাবুকখানা রাজকর্মচারীর হাত থেকে এক ঝটকায় কেড়ে নিলো বনহুর, তারপর প্রচণ্ডভাবে তার দেহে আঘাতের পর আঘাত করে চললো।

সেকি ভীষণ আঘাত।

রাজকর্মচারীর পরিধেয় বস্ত্র সে আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলো। দেহের চামড়া কেটে রক্ত গড়িয়ে পড়তে লাগলো। মুখ দিয়ে ফেনা নির্গত হতে লাগলো তার।

নিমিষে এই কাণ্ড ঘটে গেলো।

চারিদিক থেকে অন্যান্য রাজকর্মচারী ছুটে এলো, কিন্তু ততক্ষণে আহত রাজকর্মচারীর নাকেমুখে রক্ত বেরিয়ে আসছে গড় গড় করে। চাবুকের প্রচণ্ড আঘাতে তার হৃৎপিণ্ড ফেটে গিয়েছিলো, মুখ দিয়ে রক্তের ফিনকি ছুটলো, সঙ্গে সঙ্গে প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেলো।

ততক্ষণে বনহুর অশ্বপৃষ্ঠে চেপে বসেছে।

রাজকর্মচারিগণ শুধু দেখলো, একটা জমকালো পোসাক পরা লোক অশ্বপৃষ্ঠে উল্কাবেগে অদৃশ্য হয়ে গেলো। কেউ জানলো না বা বুঝলো না কে সেই লোকটি।

 পরদিন মন্ত্রিসভায় যখন এ ব্যাপার নিয়ে ভীষণ একটা আলোড়ন চলছিলো তিলক বসেছিলো মন্ত্রী পরশু সিং-এর পাশে।

বাঁধ নির্মাণ স্থানে যেসব রাজকর্মচারী পাহারারত ছিলো তারা এক-একজন এক-একরকম উক্তি প্রকাশ করতে লাগলো।

 এক রাজকর্মচারী এসে পরশু সিং-এর সম্মুখে দাঁড়ালো, চোখেমুখে তার ভীতির লক্ষণ, ভয় বিহ্বল কণ্ঠে বললো—মন্ত্রীবর, সে এক অতি ভয়ঙ্কর ব্যাপার। ভোর হয়ে গেছে, বাঁধ তৈরির কাজ চলেছে, এমন সময় হঠাৎ একজন কালো পোশাক পরা যমদূতের মত লোক অশ্বপৃষ্ঠে সেখানে আবির্ভূত হলো এবং আচমকা আমাদের লোকটার উপর হামলা চালালো……।

বাধ তৈরির ব্যাপারে মহারাজ হীরন্ময় সেন সমস্ত দায়িত্বভার মন্ত্রী পরশু সিং-এর উপর দিয়েছিলেন, তাই বাঁধ তৈরির ব্যাপারে যতকিছু সমস্যা নিয়ে আলোচনা চলতো মন্ত্রিসভায়। গতদিনের সেই ভয়ঙ্কর অবস্থা নিয়ে আজ মন্ত্রিসভা সরগরম হয়ে উঠেছে।

পরশু সিং গর্জন করে উঠলোতোমরা তখন কোথায় গিয়েছিলে? যতসব গর্দভের দল।

 আর একজন বললো-হুজুর, আমরা হতবাক হয়ে পড়েছিলাম। সেকি ভয়ঙ্কর শক্তিমান কালো মূর্তিটি….

চুপ করো, ঐ এক কথা–কেন, তোমাদের হাতে কি অস্ত্র ছিলো না?

 ছিলো হুজুর, কিন্তু……

এগুতে কেউ সাহস পাওনি, তাই না?

হা হুজুর।

এবার মন্ত্রী পরশু সিং আনমনা হয়ে গেলো, গভীর মনোযোগ সহকারে চিন্তা করে বললো লোকটাকে তোমরা কেউ চিনতে পারলে না?

একসঙ্গে রাজকর্মচারীরা বলে উঠলোনা, আমরা কেউ তাকে চিনতে পারিনি।

অন্য একজন রাজকর্মচারী বলে উঠলোমন্ত্রীবর, লোকটা যমদূতের মত যেমন দেখতে তার কাজও তেমনি, আমরা কেউ সেখানে এগুবার সাহস পাইনি।

হুঙ্কার ছাড়লো পরশু সিং-সাহস পাওনি! একটা লোককে মেরে ফেললো আর তোমরা দূরে দাঁড়িয়ে শুধু তামাশা দেখলে? যতসব মেষ শাবকের দল। আর একজনকে লক্ষ্য করে এবার বললো পরশু সিং-বলো কি করছিলে তোমরা তখন?

কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে এলো সেই রাজকর্মচারীটি, কম্পিত কণ্ঠে বললো—মন্ত্রীবর, সে লোকটা মানুষ না রাক্ষস ঠিক বুঝতে পারিনি আমরা। হঠাৎ কোথা হতে এলো, ভীষণভাবে আক্রমণ করলো আমাদের একজনকে, চাবুকের আঘাতে মেরেই ফেললো তাকে।

অন্য একজন বলে উঠলো-আমরা এগিয়ে আসার আগেই সেই ভীষণ ভয়ঙ্কর লোকটা ঘোড়ায় চেপে হাওয়ার বেগে কোথায় যে চলে গেলো, আর তাকে দেখতে পেলাম না……

এবার বললো তিলক–লোকটা নিশ্চয়ই যাদুকর হবে।

পরশু সিং বলে উঠলো ঠিক বলেছেন রাজকুমার তিলক সেন, নিশ্চয়ই সে কোনো যাদুকর হবে, নাহলে হঠাৎ আবির্ভূত হলো, আবার কোথায় হাওয়ায় মিশে গেলো-সত্যি বড় আশ্চর্য ঘটনা। আচ্ছা, আজ তোমরা যাও, ঠিকভাবে কাজ পরিচালনা করবে। আবার যদি হঠাৎ সেই যাদুকর হানা দেয়, তোমরা তাকে ছেড়ে দিও না, বুঝলে? পরশু সিং কথাগুলো তার অনুচরদের লক্ষ্য করে বললো।

অনুচরদের একজন বললোআচ্ছা হুজুর, আপনার আদেশমত কাজ করবো।

সেদিনের মত মন্ত্রিসভা ভংগ হলো।

তিলক উঠে দাঁড়ালো।

মন্ত্রী পরশু সিং সসম্মানে মাথা নত করে কুর্ণিশ জানালো।

তিলক একটু হেসে বিদায় গ্রহণ করলো।

ঘটনাটার খবর রাজপ্রাসাদেও এসে পৌঁছলো।

 মহারাজ যখন ব্যাপারটা শুনলেন নীরব রইলেন, তিনি কোনো ভাল বা মন্দ জবাব দিলেন না।

মহারাণী এবং রাজকন্যা বিজয়ার মুখেও একটা ভীতি ভাব ফুটে উঠলো। এই তো সামান্য কিছুদিন পূর্বে তারা ভয়ঙ্কর কাপালিকের কবল থেকে রক্ষা পেয়েছে, আবার না জানি কোন যাদুকরের আগমন ঘটলো কে জানে।

মহারাণী একসময় তিলকের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন—বাবা তিলক, তুমি কোনো সময় অসাকানে রাজপ্রাসাদের বাইরে যাবে না।

 তিলক বলেছিলো–কেন মহারাণী?

তুমি শোনোনি বাবা সেই ভয়ঙ্কর যাদুকরের কথা? হঠাৎ আবির্ভূত হয়ে আমাদের একজন রাজকর্মচারীকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে?

শুনেছি মহারাণী। কিন্তু আমি তো কারও অন্যায় করিনি যে আমাকে সেই যাদুকর হত্যা করবে?

রাজকর্মচারী সেও তো কোনো অন্যায় করেনি বাবা? সে তো কাজ পরিচালনা করছিলো।

অন্যায় না করলে কেই কাউকে হত্যা করে না মহারাণী। কারণ যাদুকর মানুষ, কাপালিক নয়।

বিজয়া এসে দাঁড়ায় সেখানে–যত কথাই বলে তিলক, তোমাকে রাতে বাইরে যেতে দেওয়া হবে না। অনেক সাধনা করে মা তোমাকে সন্তানরূপে পেয়েছেন।

হাসে তিলক।

পরদিন রাজকর্মচারিগণ কয়েকজন মুসলমান বন্দীকে হাত-পায়ে শিকল বেঁধে টেনে-হিঁচড়ে কারাগার অভিমুখে নিয়ে চলেছে, এমন সময় হঠাৎ পূর্ব দিনের সেই জমকালো পোশাক পরা লোক আচমকা, পথের মধ্যে আবির্ভূত হলো, মুহূর্ত বিলম্ব না করে ঝাঁপিয়ে পড়লো রাজকর্মচারীদের উপর। প্রচণ্ডভাবে আক্রমণ করলো জমকালো পোশাক পরা লোকটা, এক এক আঘাতে এক একজনকে ধরাশায়ী করতে লাগলো।

রাজকর্মচারীরা হাতে অস্ত্র থাকা সত্ত্বেও অস্ত্র ব্যবহার করার সুযোগ পেলো না, কে কোন দিকে প্রাণ নিয়ে পালালো, তার ঠিক নেই।

জমকালো পোশাক পরা লোকের মুষ্টাঘাতে এক-একজনের নাকমুখ থেতলে রক্ত গড়িয়ে পড়লো। কাউকে কাউকে গলা টিপে হত্যা করে ফেললো সে।

অল্পক্ষণেই বন্দীদের ছেড়ে রাজকর্মচারিগণ উধাও হলো।

 বন্দীরা মুক্তি পেয়ে খোদার কাছে হাজার হাজার শুকরিয়া আদায় করতে করতে ফিরে গেলো নিজ নিজ আবাসে।

জমকালো পোশাক পরা লোক অশ্বপৃষ্ঠে চেপে উধাও হলো।

 ঘটনাটা ছড়িয়ে পড়লো নীল দ্বীপের সর্বত্র।

রাজকর্মচারীরা ধূলা বালি আর রক্তমাখা দেহে মন্ত্রী পরশু সিং-এর সম্মুখে এসে সব কথা জানালো।

যখন রাজকর্মচারীরা মন্ত্রীবরের সম্মুখে এই ভয়ঙ্কর ঘটনার কথা বর্ণনা করে শোনাচ্ছিলো তখন তিলক হাজির হলো সেখানে।

মন্ত্রী পরশু সিং বললো-রাজকুমার, শুনুন, আজ আবার সেই দুর্দান্ত যমদূত হানা দিয়ে আমাদের রাজকর্মচারীদেরকে আহত এবং নিহত করে বন্দীদের সবাইকে ছিনিয়ে নিয়ে মুক্তি দিয়েছে।

দু’চোখে বিস্ময় নিয়ে বললো রাজকুমার তিলক সেন– আমি সেই সংবাদ শুনেই আসছি মন্ত্রীবর। কি ভয়ঙ্কর দুঃসাহসী সেই ব্যক্তি। নাঃ, কিছুতেই তাকে ক্ষমা করা উচিত নয়..

পরশু সিং বলে উঠলো-আমিও সেই কথা ভাবছি, কিন্তু কিভাবে তাকে শায়েস্তা করা যায়। লোকটা অত্যন্ত শক্তিশালী এবং দুর্দান্ত। আমাদের পঁচিশজনকে সে একাই কাবু করে উধাও হয়ে গেছে।

মন্ত্রীবর, আপনি কি তাকে দেখেছেন?

অমন অশুভ মুহূর্ত এখনও আমার ভাগ্যে আসেনি।

অশুভ নয় মন্ত্রীবর, শুভ মুহূর্ত বলুন…

তিলকের কথায় অবাক হয়ে তাকালো মন্ত্রী পরশু সিং।

হেসে বললো তিলক কারণ আপনার হাতে পড়লে সে যতবড় শক্তিশালী বীর পুরুষই হোক, নাকানি-চুবানি তাকে খেতেই হবে।

এবার পরশু সিং-এর মুখে হাসি ফুটলো, বললো সেঠিক বলেছেন রাজকুমার, সে কত দুর্দান্ত একবার আমার সম্মুখে এলে তাকে দেখে নেবো।

হঠাৎ অট্টহাসিতে ভেঙ্গে পড়ে তিলক।

মন্ত্রী পরশুর চোখে আবার বিস্ময় ফুটে উঠে, অবাক হয়ে তাকায় সে তিলকের মুখে।

তিলক হাসি বন্ধ করে বলে,–আপনার হাতে পড়লে তার নিস্তার নেই কিছুতেই। ঠিক বলেছি কিনা মন্ত্রীবর?

হাঁ, ঠিকই বলেছেন রাজকুমার।

পরশু সিং রাজকর্মচারীদের দিকে তাকিয়ে বললো-তোমরা যাও যতসব অক্ষম আর অপদার্থের দল! তোমরা যেভাবে কাজ চালাচ্ছিলে সেইভাবে কাজ চালাবে। আমি গিয়ে এবার বন্দীদের নিয়ে আসবো। দেখি কোন্ বেটা আমার সামনে আসে। যাও….

রাজকর্মচারিগণ? এক-একজনকে ভেজা শেয়ালের মত মনে হচ্ছিলো, তারা সবাই পিছু হটে বেরিয়ে গেলো সেখান থেকে।

পরশু সিং বললো–এবার আমি যাবো, দেখবো কে সে!

সেটাই ভাল হবে মন্ত্রীবর।

তিলক মন্ত্রী প্রাসাদ হতে ফিরে এলো রাজপ্রাসাদে।

বিজয়া বাগানের পাশেই চিন্তিত মুখে অপেক্ষা করছিলো, তিলককে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এলো-তিলক, একটা আশ্চর্য খবর শুনেছো?

কই না তো, আশ্চর্য খবর এমন কি?

আজ আবার জমকালো পোশাক পরা সেই ভয়ঙ্কর লোকটা পথের মধ্যে হানা দিয়ে আমাদের বন্দীদেরকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে।

এটা আবার এমন আশ্চর্য খবর কি? হয়তো আমাদের রাজকর্মচারিগণ অন্যায়ভাবে কতকগুলো লোককে বন্দী করে নিয়ে আসছিলো, তাই…

তা কি পারে! আমাদের রাজকর্মচারিগণ অহেতুক কাউকে বন্দী করে নিয়ে আসতে পারে না। যারা বাঁধ তৈরি করতে নারাজ হয় কিংবা বিদ্রোহী হয়ে উঠে তাদের বন্দী করে আনা হয়। যা ওসব কথা, তুমি যেন কখনও বাঁধ তৈরির ওদিকে যেও না?

উ হু, মোটেই না। সত্যি, সেই জমকালো পোশাক পরা লোকটির কথা শুনলে আমার গা শিউরে উঠে যেন।

তিলকের কথা শুনে হাসে বিজয়া– এই সাহস নিয়ে তুমি কাপালিক হত্যা করেছো তিলক?

তিলক চোখ দুটো গোলাকার করে বলে–কাপালিক হত্যা সে তো সামান্য ব্যাপার। এটা যে অদ্ভুত আর আশ্চর্য মানুষ। হাওয়ায় মিশে আসে, আবার হাওয়ায় মিশে যায়।

আমার কিন্তু বিশ্বাস হয় না একটুও। মানুষ কখনও হাওয়ায় মিশে আসতে পারে, আবার হাওয়ায় মিশে যেতে পারে? সব মিছে কথা, নিশ্চয়ই কোনো দুষ্ট দুঃসাহসী লোক হবে।

সর্বনাশ, তাহলে তো আরও ভয়।

 কেন?

দুষ্ট লোক সবচেয়ে বেশি ভয়ঙ্কর হয়, তারা যে কোনো অসাধ্য কাজ বিনা দ্বিধায় করতে

পারে……

আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলো তিলক, এমন সময় মহারাণী এসে পড়েন সেখানে।

 তিলক চলে যাচ্ছিলো।

মহারাণী বললেন–বাবা তিলক, যেও না, শোনো।

 তিলক থমকে দাঁড়ালো।

বিজয়া মায়ের পাশে ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ালো।

মহারাণী বললেন–তিলক, রাজ্যে নতুন একটা আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। একদিন নয়, পর পর দুদিন সেই জমকালো পোশাক পরা লোকের আবির্ভাব ঘটেছিলো। সে আবার রাজকর্মচারীদের নির্মমভাবে হত্যা করেছে।

আমি সব শুনেছি রাণীমা।

বাবা, আমার যত ভয় আর ভাবনা তোমাকে নিয়ে। হঠাৎ তোমার উপর তার দৃষ্টি না পড়ে।

 আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন রাণীমা, আমার উপর কোনোরূপ হামলা চালাতে সাহসী হবে না।

হাঁ বাবা, তাই আমিও চাই। তোমাকে হারালে আমি মরে যাবো তিলক।

 তিলক হেসে বললো–কেন, বিজয়া আছে। তাছাড়া চিরদিন কি নীল দ্বীপে আমার থাকা সম্ভব রাণীমা?

 না না, তোমাকে কিছুতেই আমি ছেড়ে দিতে পারি না। তুমি যে আমার নয়নের মণি, হৃদয়ের ধন। বিজয়া, ওর দিকে ভালভাবে খেয়াল রাখি মা।

সে তোমাকে বলতে হবে না মা, আমি সব সময় ওর প্রতি খেয়াল রাখবো।

মহারাণী চলে গেলেন।

তিলক মুখখানা কাচুমাচু করে বললো–বিজয়া, তোমরা দেখছি আমাকে একেবারে নিঃশ্বাস বন্ধ করে মেরে ফেলবার যোগাড় করেছে।

চুপ করো তিলক, মায়ের আদেশ অমান্য হবার নয়।

কি করতে হবে?

আজ থেকে বাইরে যাওয়া তোমার চলবে না।

সর্বনাশ, কেন?

ঐ তো মায়ের আদেশ।

মানে?

মানে তোমাকে সব সময় চোখে চোখে রাখতে হবে।

যেন না হারিয়ে যাই?

তা নয়।

মার ভয় সেই দুষ্ট ভয়ঙ্কর লোকটা যদি…..

 আমাকে হত্যা করে, এই তো?

হা।

সত্যি, আমারও বড় ভয় করছে, কিন্তু……

কিন্তু আবার কি?

সব সময় কি আর প্রাসাদে বন্দী হয়ে থাকা যায়?

সেকি, প্রাসাদে বন্দী থাকবে কেন? বাগান রয়েছে, ঝর্ণার ধার রয়েছে, দীঘি রয়েছে-যখন যেখানে খুশি বেড়াবে, শুধু প্রাসাদের বাইরে যেতে পারবে না।

 আর তুমি থাকবে আমার পাশে পাশে।

হাঁ, থাকবো।

 তাহলেই তো হয়েছে।

কেন, আমাকে তোমার পছন্দ হয় না?

 হয়, খুব হয়, তবে….

বলো?

তবে আমার মাঝে মাঝে একা থাকতে ইচ্ছা করে।

 আর আমার মনে কি হয় জানো?

কি?

সব সময় তোমাকে এমনি করে জড়িয়ে রাখি দুটি বাহু দিয়ে……বিজয়া তিলককে জড়িয়ে ধরে আলগোছে।

তিলক বলে উঠে–কেউ দেখে ফেলবে বিজয়া।

রাজকন্যা বিজয়ার সেজন্য ভয় পবার কিছু নেই, দেখলেই বা।

ঠিক ঐ মুহূর্তে একটি তীর এসে গেঁথে যায় মাটিতে তিলকের পায়ের কাছে।

বিজয়া হাত দুখানা মুক্ত করে নিয়ে বিস্ময়ভরা দৃষ্টি মেলে তীরখানার দিকে তাকালো।

তিলক তুলে নিলো তীরটা হাতে-আশ্চর্য, আজ তীরফলকে কোনো কাগজ গাঁথা নেই। তাকালো সে আনমনে সামনের দিকে, বুঝতে পারলো তিলক আশা তাকে বিজয়ার কবল থেকে রক্ষা করে নিলো। একটু হাসলো তিলক।

বিজয়া অবাক কণ্ঠে বললো—আচ্ছা তিলক, মাঝে মাঝে এভাবে কোথা থেকে তীর আসে কই, কোনো দিনতো তুমি আমাকে বললে না? আমি লক্ষ্য করেছি, তীরফলক এলেই তুমি কেমন যেন উদাসীন হয়ে পড়ো?

আমি নিজেও জানি না কোথা থেকে এ তীরফলক আসে আর কেই বা নিক্ষেপ করে। আমি বুঝতে না পেরে মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক হয়ে যাই। যাক সে কথা, চলো এবার যাওয়া যাক।

পা বাড়ালো তিলক আর বিজয়া প্রসাদের অভ্যন্তরের দিকে।

*

মরিয়ম বেগম সব সময় চিন্তিতভাবে দিন কাটাচ্ছেন। তার মনের মধ্যে সদা-সর্বদা ঐ একটি কথা উঁকিঝুঁকি মারছে, এতদিনেও তাঁর মনির এলো না কেন? নিশ্চয়ই কোনো শয়তানী তার সন্তানকে জোর করে আটকে রেখেছে। সব সময় পুত্রের কথা স্মরণ করে তিনি চোখের পানি ফেলতে লাগলেন।

মনিরা কোনোরূপ সান্ত্বনা দিতে পারলো না, কারণ সে নিজেই এ জন্য দায়ী। স্বামীকে নীল দ্বীপে পাঠিয়ে তারও কি কম দুশ্চিন্তা। কিন্তু কি করবে সে, একদিকে শাশুড়ীর বিষণ্ণ মুখ অন্য দিকে নূরের সাদা প্রশ্ন, তার আব্বু কবে আসবেন, কোথায় গেছেন, কেন গেছেন, এমনি নানা কথা।

মনিরা প্রতীক্ষা করতে থাকে রহমানের, রহমান এলে তার কাছে সংবাদ জানতে পারবে কিছু।

কান্দাই শহরে মনিরা যখন বনহুরের জন্য অস্থির চিত্ত নিয়ে দিন কাটাচ্ছে তখন কান্দাই জঙ্গলে বনহুরের প্রতীক্ষায় তার অনুচরগণ ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, বিশেষ করে নূরী বেশি চঞ্চল হয়ে পড়েছে, তার হুর আজও ফিরে আসছে না কেন নীল দ্বীপ হতে?

রহমান তাকে অনেক করে বুঝাতে লাগলো।

বিশেষ করে নূরী কচি জাভেদের দিকে বেখেয়ালী হয়ে পড়লো, তার চিন্তা হুরের জন্য। কেন সে আসছে না, অমঙ্গল কিছু ঘটেনি তো? হুর কোথাও গিয়ে বহুদিন কাটায় না, এবার কেন সে এতদিন নীরব রয়েছে কে জানে।

একদিন নূরী গভীর রাতে ঘুমন্ত জাভেদকে নাসরিনের শয্যায় শুইয়ে রেখে অশ্ব নিয়ে বেরিয়ে পড়লো, নীল দ্বীপ কোথায় সেই খোঁজে।

অশ্ব নিয়ে ছুটে চললো নূরী, ভুলে গেলো সে স্নেহের জাভেদের কথা। ভুলে গেলো সঙ্গী সাথীদের কথা। শুধু তার মনে এক চিন্তা-কোথায় সেই নীল দ্বীপ যেখানে তার বনহুর রয়েছে।

বন-জঙ্গল, পাহাড়-পর্বত সব ছেড়ে এগিয়ে চললো নূরী।

ক্ষুধা-পিপাসায় কাতর হয়ে পড়লো তবু সেদিকে খেয়াল নেই, চলেছে সে একমনে। কিন্তু কদিন না খেয়ে কাটানো যায়, অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়লো নূরী। ঝর্ণার পানি পান করে, কখনও বা বন থেকে ফল সংগ্রহ করে খেয়ে জীবন বাঁচাতে লাগলো।

কিন্তু নীল দ্বীপ কোথায় তা তো নূরী জানে না।

সে দিনরাত অশ্ব নিয়ে এগিয়ে চললো।

 ওদিকে নাসরিন সেদিন ঘুম থেকে জেগেই পাশে জাভেদকে দেখে আশ্চর্য হলো, এত রাতে জাভেদ কি করে তার শয্যায় এলো? দিনের বেলা হলে ভাবার কিছু ছিলো না, কারণ অনেক দিন নূরী জাভেদকে সখ করে নাসরিনের শয্যায় ওর পাশে শুইয়ে দিয়ে যেতো। নাসরিন স্বামীকে ডেকে বললো–দেখো দেখো, জাভেদ কি করে আমার বিছানায় এলো।

রহমান চোখ রগড়ে বললো–তাই তো, এত রাতে জাভেদ এখানে কেন?

 নাসরিন জাভেদকে কোলে নিয়ে নুরীর কক্ষের দিকে ছুটলো……কিন্তু কোথায় নূরী, শূন্য কক্ষ খাঁ খাঁ করছে।

সমস্ত আস্তানায় নূরীর সন্ধান চললো, কোথাও সে নেই। পরে অশ্বশালায় খোঁজ নিয়ে দেখা গেলো, একটি অশ্ব নেই। এবার সকলের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেলো, নূরী জাভেদকে নাসরিনের কাছে সঁপে দিয়ে উধাও হয়েছে।

 রহমান ভীষণভাবে চিন্তিত হয়ে পড়লো, নুরী সকলের অজান্তে গেলো কোথায়? নিশ্চয়ই সে সর্দারের খোঁজে গেছে পাবে সে সর্দারকে। নীল দ্বীপ সে বহুদূরে সমুদ্রের ওপারে, সেখানে নূরী যাবে কি করে?

 রহমান দরবারকক্ষে অনুচরদের ডেকে সবাইকে জানিয়ে দিলো, নূরী কাউকে কিছু না বলে কোথায় চলে গেছে, তারা সবাই যেন নূরীর সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে।

রহমান নিজেও নিশ্চুপ থাকতে পারলো না, সেও নূরীর খোঁজে বেরিয়ে পড়লো।

 নাসরিন জাভেদকে নিয়ে মেতে উঠলো। ওর নাওয়া-খাওয়া, দোলনায় দোলা দেওয়া, কোলে করে ঘুম পাড়ানো, এ সব নিয়ে সে ব্যস্ত। জাভেদ কচি শিশু, তাই সে মাকে তেমন করে বুঝতে শেখেনি, নাসরিনের আদর-যত্নে সে বিভোর হয়ে পড়লো।

অবশ্য প্রথম প্রথম মাকে না পেয়ে কাদাকাটা শুরু করেছিলো জাভেদ। কিন্তু বেশি সময় লাগেনি তাকে ভোলাতে নাসরিনের।

বনহুরের অনুচরগণ যে যেদিকে পারলো নূরীর সন্ধানে বেরিয়ে পড়লো।

রহমানও অশ্ব নিয়ে খোঁজ করে চললো বন-জঙ্গল সব জায়গায়। কদিন অবিরত খোঁজ করেও নূরীর কোনো সন্ধান পেলো না তারা। ফিরে এলো এক এক করে সবাই।

রহমানও ফিরে এলো হতাশ মন নিয়ে।

 নাসরিন জাভেদকে কোলে করে ছুটে গেলো স্বামীর পাশে, স্বামীর উস্কোখুস্কো ম্লান মুখ দেখে সে বুঝতে পারলো সব, তবু ব্যাকুল কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলো-নূরীকে পেলে না?

রহমান একটা আসনে বসে পড়ে বললো–না!

তবে জাভেদের কি হবে?

 তুমিই ওর ভার নাও নাসরিন, যতদিন নূরী ফিরে না আসে..

এদিকে যখন নূরীর সন্ধানে সবাই ব্যস্ত তখন নূরী সমুদ্রতীরে এসে পৌঁছে গেছে। অশ্ব ত্যাগ করে জাহাজে উঠে পড়ে অন্যান্য যাত্রীর সঙ্গে। সে অন্যান্যের কাছে জেনে নেয়, এ জাহাজখানা নীল দ্বীপ অভিমুখে যাচ্ছে।

রুক্ষ চুল। জামাকাপড় ছিঁড়ে গেছে, চোখমুখ বসে গেছে একেবারে। ঠিকমত খাওয়া নেই, নাওয়া নেই, ঘুমানো নেই, পাগলিনীর মত হয়ে পড়েছে।

জাহাজের যাত্রিগণ সবাই নিজকে নিয়ে ব্যস্ত, কেউ নূরীকে লক্ষ্য করলো না। নূরী জাহাজের ডেকে একপাশে জড়োসড়ো হয়ে বসে রইলো। তাকে যেমন করে হোক যেতেই হবে সেই নীল দ্বীপে, তার হুরকে খুঁজে বের করতেই হবে।

জাহাজ যখন মাঝসমুদ্রে তখন জাহাজের একজন খালাসীর চোখে পড়ে গেলো নূরী। সেই খালাসি খাবার রেখে ওদিকে গিয়েছিলো কিছু আনতে, সেই মুহূর্তে নূরী ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করতে না পেরে খালাসীর খাবারগুলো টেনে নিয়ে গোগ্রাসে খেতে শুরু করলো।

খালাসি এসে দেখে অবাক, কে এই নারী-পাগলিনী না কি! ওকে ধরে নিয়ে গেলো সে ক্যাপ্টেনের কাছে।

ক্যাপ্টেনও দেখে অবাক।

নূরীকে পাগলী মনে করে তারা বন্দী করে রাখলো, মনে করলো ছাড়া থাকলে নানা রকম। গণ্ডগোল করতে পারে।

*

প্রতিদিন এইভাবে অকস্মাৎ হানা দিয়ে দু’চারজন করে রাজকর্মচারী হত্যা চললো। কে সেই জমকালো পোশাক পরা ব্যক্তি—কেউ তাকে ধরতে পারে না, কেউ তার দেহে অস্ত্র নিক্ষেপ করার পূর্বেই দ্রুত অশ্ব নিয়ে উধাও হয়ে যায়।

নীলদ্বীপবাসী যখন এই ব্যক্তিকে নিয়ে ভীষণ একটা আতঙ্ক সৃষ্টি হলো তখন ও মহারাজ হীরন্ময় নিশূপ, তিনি এ ব্যাপরে কোনোরকম মতামত ব্যক্ত করেন না। আজকাল যেন বোবা বনে গেছেন তিনি।

বাঁধ নির্মাণ কাজ অগ্রসর হওয়া দূরের কথা, আরও ক্ষতি হতে লাগলো। রাজকর্মচারিগণ কেউ আর বাধ নির্মাণ স্থানে পাহারারত থাকতে রাজি নয়। বিদ্রোহ দেখা দিলো তাদের মধ্যে।

কিন্তু মুসলমানদের আনন্দ আর ধরে না। এ পর্যন্ত সেই কালো মূর্তি মুসলমানদের কাউকে হত্যা করেনি বা কারও উপর নির্যাতন চালায়নি!

সেদিন পরশু সিং মহারাজের দরবারে হাজির হয়ে জানালোমহারাজ, কাপালিকের কবল থেকে দেশবাসী রক্ষা পেলো বটে কিন্তু আর একটি ভয়ঙ্কর জীবের অত্যাচার শুরু হয়েছে। সে শুধু আমাদের লোককে হত্যা করে, মুসলমানদের কোনো ক্ষতি করে না।

বিস্ময়ভর কণ্ঠে বললেন মহারাজ-ভয়ঙ্কর জীব সে কেমন?

মহারাজ, জীবাট পশু বা জানোয়ার নয়—-মানুষ।

 এবার মহারাজ হেসে উঠলেন, ব্যঙ্গপূর্ণ সে হাসি।

পরশু সিং অবাক হলো, সে বলে উঠলো-মহারাজ, আপনি হাসছেন যে?

মহারাজ গম্ভীর হয়ে বললেন—হাসবো না তো কি কাদবো? পশু নয়, জানোয়ার নয়, একটি মানুষ আপনাদের এমনভাবে নাকানি-চুবানি খাওয়াচ্ছে, আর আপনার বীর পুরুষের দল শুধু হাবা গোবা হয়ে দেখেই যাচ্ছেন। যান, ওসব আমি শুনতে চাই না।

মহারাজ, সব দোষ মুসলমানদের।

না।

সেই ব্যক্তি মুসলমানের পক্ষ হয়ে আমাদের লোকজনদের এভাবে প্রহার এবং হত্যা করে। চলেছে। এখন রাজকর্মচারিগণ আর সেই স্থানে যেতে রাজি নয়। মহারাজ, বাধ তৈরির কাজ এবার বন্ধ হবার উপক্রম হয়েছে।

তাই হোক, বাঁধ তৈরির কাজ বন্ধ করে দিন।

মহারাজ, বলেন কি। বাধ তৈরির কাজ বন্ধ হয়ে গেলে সমস্ত নীলদ্বীপ যে ধ্বংস হয়ে যাবে।

তবে শুধু মুসলমান নয়, নীলদ্বীপবাসী সবাইকে বাধ তৈরির কাজে নিযুক্ত করুন, দেখবেন সব সমস্যা চুকে যাবে।

মহারাজের কথায় মন্ত্রী পরশু সিং খুশি হতে পারলো না, বরং মনে মনে সে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলো। মহরাজের কি ভীমরতি হয়েছে যে, এতগুলো মুসলমান দেশে থাকতে তাদের বসিয়ে রেখে হিন্দুদের দ্বারা বাধ তৈরির কঠিন কাজ করাবেন। বুড়ো হলে বুদ্ধিসুদ্ধি লোপ পায়, তাই মহারাজের মাথাও গুলিয়ে গেছে। মহারাজের মতামতের অপেক্ষা না করে পরশু সিং চলে গেলো সেখান থেকে। সোজা সে গিয়ে হাজির হলো রাজকুমার তিলকের কাছে।

তিলক তখন তার বিশ্রামকক্ষে বিশ্রাম করছিলো।

পরশু সিং এসে কুর্ণিশ জানালো তিলক কুমারকে।

তিলক অসময়ে তার কক্ষে মন্ত্রী পরশু সিংকে দেখে কিছুটা বিস্মিত হলেও মুখোভাবে প্রকাশ না করে বসার জন্য অনুমতি দিলো—বসুন মন্ত্রীবর।

পরশু সিং আসন গ্রহণ করলো, তারপর বললো-রাজকুমার, একটা পরামর্শের জন্য এলাম।

 তিলক শয্যায় অর্ধশায়িত অবস্থায় ছিলো, সোজা হয়ে বসে বললো–বলুন?

 মহারাজ বৃদ্ধ হয়েছেন, সঙ্গে সঙ্গে বুদ্ধিসুদ্ধি ও সব তার বুড়িয়ে গেছে।

 কি ব্যাপার মন্ত্রীবর?

ব্যাপার অত্যন্ত দুঃখজনক।

 বলুন?

মহারাজকে আমি সেই দুষ্কৃতিকারী সম্বন্ধে সব বলায় তিনি বললেন–মুসলমানদের প্রতি অন্যায় আচরণ না করে নীলদ্বীপের হিন্দুগণ দ্বারা বাঁধ তৈরির কাজ শুরু করে দিন। বলুন, তার মাথা ঠিক আছে কি?

তিলক বললো–হুঁ, তাইতো মনে হচ্ছে।

 কুমার, আপনি যদি আমার সঙ্গে থাকেন তবে আমি সব করতে পারি। কে সেই শয়তান জমকালো পোশাক পরিহিত ব্যক্তি, তাকেও আমি দেখে নেবব, আর……

বলুন, থামলেন কেন?

আর বাঁধ তৈরির কাজ চলবে এবং সে কাজ মুসলমানদের দিয়েই করাবো।

 মহারাজের হুকুম আপনি অমান্য করবেন মন্ত্রীবর? জানেন এটা চরম দোষণীয়?

তিলক, তুমি আজ রাজকুমার হয়েছে, কিন্তু আসলে তুমি ভীল-সন্তান। তোমার কথাবার্তা কিন্তু ভীল-সন্তানের মত নয়।

নয় বলেই তো মহারাণী আমাকে নিজ সন্তানরূপে গ্রহণ করেছেন। তাছাড়া মহারাজও আমাকে জেনেশুনেই কুমারের স্থানে বসার অনুমতি দিয়েছেন।

তিলক, মহারাজ বৃদ্ধ, তাঁর সমস্ত বুদ্ধি লোপ পেয়েছে। তিনি যা করবেন সেটাই যে রাজ্যের মঙ্গলজনক তা নাও হতে পারে, কাজেই…

কাজেই আপনি কি করতে চান মন্ত্রীবর?

আমি চাই মহারাজকে বন্দী করে…..

আপনি মহারাজকে বন্দী করতে চান?

হাঁ, তাকে পাগল বলে প্রজাদের মধ্যে প্রচার করতে হবে।

 চমৎকার বুদ্ধি।

হাঁ, বুদ্ধি আছে বলেই তো আজও টিকে আছি। তিলক, তুমি যদি চিরদিনের জন্য রাজকুমার হয়ে রাজপ্রাসাদে থাকতে চাও তাহলে আমার কাজে বাধা দিও না বা বাধা দিতে চেষ্টা করো না।

বরং আপনাকে সহায়তা করতে পারি, এই তো?

হাঁ, বুঝেছো দেখছি। তিলক, তুমি যা চাও তাই পাবে, রাজকন্যা বিজয়াকেও পাবে, শুধু আমাকে সহায়তা করবে। বুদ্ধিহীন রাজাকে আর রাজ-সিংহাসনে বসাতে চাই না।

তিলক একটু হেসে বললো–যা বলবেন তাই হবে।

বেশ, আমার কথামত কাজ করবে, কেমন?

হাঁ, করবো।

পরশু সিং চারিদিকে তাকিয়ে দেখে নিলো, তারপর বললো আবার–আগামী সপ্তাহের শেষ। দিন আমি মহারাজকে বন্দী করবো, তুমি আমাকে সাহায্য করবে।

নিশ্চয়ই করবো, কিন্তু….

কিন্তু কি, বলো তিলক?

আমাকে আপনি সর্বক্ষণ পাশে রাখবেন তো?

তুমিই আমার ডান হাত হলে তিলক। তোমাকে বাদ দিয়ে কোনো কাজ করবো না।

এ কথা যেন ভুলে যাবেন না মন্ত্রীবর।

না না, ভুলবো না, কিছুতেই না। পরশু সিং উঠে দাঁড়ালো। হঠাৎ কি মনে করে আবার বসে পড়লো সে, বললো—তিলক, আজ রাতে আমি নিজে যাবো সেই বাঁধ তৈরির স্থানে। যে বন্দীদের সেদিন ছিনিয়ে নিয়ে মুক্তি দেওয়া হয়েছিলো তাদের সবাইকে বেঁধে নিয়ে আসবো।

বললো তিলক-তারপর?

 তারপর বন্দী মুসলমানদের হাত-পা বেঁধে তাদের সবাইকে ছোরা বিদ্ধ করে হত্যা করবো।

 চমৎকার!

আরও চমৎকার আজ দেখে নেবো সেই দুর্দান্ত ব্যক্তিটিকে, দেখবো কত শক্তি আছে তার দেহে!

মন্ত্রীবর, আপনি সত্যি অসীম শক্তিবান। না জানি কি উপায়ে আপনি সেই ভয়ঙ্কর লোকটাকে কাবু করবেন?

জানো দেয়ালেরও কান আছে।

জানি কিন্তু…..

তবু জানতে চাও?

হা।

পরে বলবো, এখন নয়। কথাটা বলে বেরিয়ে গেলো। পরশু সিং।

 তিলক মৃদু হেসে শয্যা গ্রহণ করলো।

*

রাত গভীর।

মুসলমানদের বন্দী করে নিয়ে আসার জন্য পরশু সিং সজ্জিত হয়ে নিলো। অন্যান্য অনুচরকে সে যেভাবে শিখিয়ে রেখেছে তারা সেইভাবে তৈরি হয়ে নিয়েছে, মন্ত্রীবরের অপেক্ষায় আছে তারা।

 মন্ত্রীর পরশু সিং পোশাক পরে যেমন তার তরবারিটা তুলে নিতে যাবে, ঠিক সেই মুহূর্তে পিঠে ঠাণ্ডা এবং শক্ত কিছু অনুভব করলো এবং সঙ্গে সঙ্গে শুনতে পেলো একটা গম্ভীর কঠিন কণ্ঠস্বর-অস্ত্র স্পর্শ করো না।

পরশু সিং-এর হাতখানা অস্ত্র স্পর্শ করতে গিয়ে থেমে পড়লো, ফিরে তাকালো সে পিছন দিকে। চোখ দুটো তার বিস্ময়ে বিস্ফারিত হলো……জমকালো পোশাক পরিহিত সেই ব্যক্তি, যাকে দেখার সৌভাগ্য আজও তার হয়নি, শুধু শুনেছে তার বর্ণনা আর দেখেছে তার কার্যের নির্মম পরিণতি। শিউরে উঠলো পরশু সিং, মুখখানা দেখা না গেলেও চোখ দুটো সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হচ্ছে যেন ঐ দুটি চোখে।

 পরশু সিং একচুল নড়বার সাহস পেলো না।

জমকালো পোশাক পরা লোকটি পরশু সিং-এর পিঠে ছোরাখানা ঠিক রেখে পা দিয়ে আঘাত করে টেবিল থেকে তরবারিখানা দূরে ফেলে দিলো, তারপর বললো—জানো আমি কেন এসেছি?

তা আমি কেমন করে জানবো? ভয়কম্পিত কণ্ঠে বললো পরসিং।

জমকালো পোশাক পরিহিত ব্যক্তি বললো-তবে শোনো, তুমি যাদের বন্দী ব তাদের মুক্তি নিয়ে আমি এসেছি।

কে তুমি?

আমি তোমাদের অতি পরিচিত। একবার নয়, কয়েক বার আমি তোমাদের রাজকর্মচারীদের সঙ্গে সাক্ষাত করেছি…..এবার এসেছি তোমার সঙ্গে পরিচিত হতে।

কি চাও আমার কাছে?

তুমি কোনটা চাও তাই জানতে এসেছি–নীল দ্বীপের মুষ্টিময় মুসলমানদের রেহাই দেবে, না জীবন দেবো বলো? কোনটা তুমি চাও?

 পরশু সিং-এর চোখেমুখে ভয়, বিস্ময়, কম্পিত কণ্ঠে বললো–তুমি আমাকে হত্যা করতে চাও?

হ্যাঁ, কিন্তু আমার কথা যদি রাখো তবে তুমি জীবন ভিক্ষা পাবে। মুসলমানদের প্রতি কোনোরকম অত্যাচার তুমি করতে পারবে না।

বেশ, তাই হবে।

শপথ করলে তো?

হ্যাঁ, শপথ করলাম।

যাও, এবার অস্ত্র হাতে উঠিয়ে নাও।

পরশু সিং দ্রুত ঝুঁকে তরবারিধানা হাতে তুলে নিয়ে ফিরে তাকালো, বিস্ময়ের উপর বিস্ময় জাগলো তার দুচোখে..কই, কোথায় সেই জমকালো পোশাক পরা ব্যক্তি? লোকটা যেন হাওয়ায় মিশে গেছে।

পরশু সিং-এর সব উদ্দেশ্য পণ্ড হয়ে গেলো, রাগে-ক্ষোভে সে পায়চারী করতে লাগলো।

ওদিকে রাজকর্মচারীরা যারা তৈরি হয়ে মন্ত্রীবরের জন্য অপেক্ষা করছিলো তারা উদগ্রীব হয়ে উঠলো। সেনাপতি স্বয়ং এসে হাজির হলো মন্ত্রী পরশু সিং-এর কক্ষে।

পরশু সিং-এর মুখ কালো হয়ে উঠেছে, একটা ক্রোধ এবং প্রতিহিংসামূলক ভাব ফুটে উঠেছে। তার চোখেমুখে, অধর দংশন করছিলো সে বারবার। সেনাপতি আসতেই তার মনে সাহস দেখা দিলো। একটু পূর্বের শপথের কথা সম্পূর্ণ বিস্মৃত হলো সে। ভুলে গেলো সেই জমকালো পোশাক পরা লোকটির কথা, সোনাপতিসহ বেরিয়ে এলো সে যেখানে তার জন্য অপেক্ষা করছিলো তার অনুগত অনুচরগণ।

যেভাবে পূর্বে প্রস্তুতি নিয়েছিলো সেভাবেই কাজ করলে পরশু সিং। ভোর হবার পূর্বেই হানা দিয়ে মুসলমানদের বন্দী করে নিয়ে এলো রাজ-কারাগারে।

এবার পরশু সিং-এর আনন্দ আর ধরে না। কারণ কালো পোশাক পরিহিত ব্যক্তি তাকে কোনোরকম বাধা দেয়নি বা দেবার সাহস পায়নি।

পরশু সিং ইচ্ছামত শাস্তি দিতে লাগলো মুসলমান বন্দীদের। লৌহশিকলে আবদ্ধ করে এক একজনকে ঝুলিয়ে রাখা হলো বন্দীশালায়।

নানাভাবে এইসব বন্দীর উপর নির্যাতন চললো। মুসলমানদের অপরাধ, তারা বাধ তৈরির ব্যাপারে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলো। আরও অপরাধ, তারা জমকালো পোশাক পরা ব্যক্তির কোনো পরিচয় দেয়নি।

পরশু সিং-এর সন্দেহ সেই অদ্ভুত ব্যক্তি মুসলমানদেরই মধ্যের কোনো যুবক–যে মসাধ্য সাধন করে চলেছে, যে দুঃসাহসী পরপর কয়েকজন রাজকর্মচারীকে হত্যা করেছে।

পরশু সিং কারাগারে বন্দীদের দেহে অগ্নিদগ্ধ লৌহশলাকা প্রবেশ করিয়ে জিজ্ঞেস করতে লাগলো-বলো কে সেই ব্যক্তি যে আমাদের রাজকর্মচারীদেরকে বিনা দ্বিধায় হত্যা করে চলেছে, জবাব দাও?

নিরীহ মুসলমানগণ কেমন করে জবাব দেবে, তারা নিজেরাই জানে না কে সেই জমকালো পোশাক পরিহিত ব্যক্তি। আর্তকণ্ঠে বলে উঠে তারা–জানি না, আমরা জানি না।

 নরপিশাচের মত মুখোভাব বিকৃত করে পশু সিং বলে উঠে-জানো না? মিথ্যা কথা, সব মিথ্যা কথা, দাও অগ্নিদগ্ধ লৌহশলাকা প্রবেশ করিয়ে দাও ওদের দেহে।

সঙ্গে সঙ্গে অগ্নিদগ্ধ লৌহশলাকা প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হলো একজনের মাংস মধ্যে।

যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠলো বন্দী মুসলমান লোকটি।

সহসা পরশু সিং কাঁধে একটি বলিষ্ঠ হাতের ছোঁয়া অনুভব করে চমকে ফিরে তাকায়, মুহূর্তে ফ্যাকাশে হয়ে উঠে তার মুখমণ্ডল। সেই জমকালো পোশাক পরা ব্যক্তির অগ্নিচক্ষু দুটি তার হৃৎপিণ্ডকে যেন ছিদ্র করে দেয়।

জমকালো মূর্তির হস্তের সুতীক্ষ্ণধার ছোরাখানা তার পিঠে ঠেকে আছে আলগোছে। একটু নড়লেই সমূলে প্রবেশ করবে তার পিঠের মধ্যে।

জমকালো পোশাক পরিহিত ব্যক্তির দিকে তাকিয়ে সেই বন্দীশালার পাহারাদারগণ আরষ্ট হয়ে গেছে যেন, সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মত ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাচ্ছে।

 গম্ভীর কণ্ঠে বললো জমকালো পোশাক পরিহিত ব্যক্তি মন্ত্রীবর, তোমার শপথ রক্ষা করেছো না? জবাব দাও?

পরশু সিং ঢোঁক গিললো। তার সামান্য কয়েকজন সঙ্গী এখানে কারাকক্ষে রয়েছে, তারাও তেমন সাহসী বীর পুরুষ নয়। নিজকে অসহায় মনে হচ্ছে মন্ত্রীবরের। সে জানে, এ ব্যক্তি কত সাংঘাতিক, এই মুহূর্তে ওর হস্তস্থিত ছোরাখানা তার পৃষ্ঠদেশ ভেদ করে হৃৎপিণ্ডে পৌঁছতে পারে। জীবন্ত যমদূত যেন তার কাঁধে হাত রেখেছে। পরও সিং কোনো জবাব দিতে পারলো না।

হুঙ্কার দিয়ে উঠলো জমকালো পোশাক পরিহিত ব্যক্তি তোমার সব চক্রান্ত ফাঁস হয়ে গেছে মন্ত্রীবর। তুমি মুসলমানদের ধ্বংস করে নীলদ্বীপবাসিগণকে নিজের আয়ত্তে আনতে চাও। মহারাজকে পাগল সাব্যস্ত করে বন্দী করতে চাও। তারপর মহারাজকে হত্যা করে সিংহাসনে উপবেশন করতে চাও……

কে, কে তোমাকে এসব কথা বলেছে?

লুকোতে চাইলেই কথা চাপা থাকে না মন্ত্রীবর।

আমি তিলকের কাছে সব বলেছিলাম, নিশ্চয়ই তিলক সব তোমাকে বলেছে?

হাঁ, তিলককে তুমি আরও অনেক কিছু বলেছে। তাকে তার বংশ পরিচয়ের দুর্বলতায় কাবু করে নিজের বশে আনতে চেষ্টা করেছে। তাকে হাতের মুঠায় নিয়ে রাজ সিংহাসন দখল করার চেষ্টা চালাচ্ছো,

হা চালাচ্ছি, কারণ মহারাজ বৃদ্ধ, অক্ষম, তাই…..

সঙ্গে সঙ্গে মহারাজ হীরন্ময় সেন এবং কিছুসংখ্যক সৈন্য অস্ত্র এবং লৌহশিকল হস্তে কারাকক্ষে প্রবেশ করে।

পরশু সিং-এর মুখ কালো হয়ে উঠলো মুহূর্তে।

মহারাজ হীরন্ময় সেন বললো–বন্দী করো এই নরাধম মন্ত্রীবরকে আর ওর অনুগত দাসদের।

সঙ্গে সঙ্গে সৈনিকগণ রাজ আদেশ পালন করলো। পরশু সিং এবং তার অনুগত অনুচর যারা ঐ কারাকক্ষে ছিলো তাদের বন্দী করে ফেললো।

এবার জমকালো পোশাক পরিহিত ব্যক্তি নিজ মুখের কালো আবরণ উন্মোচন করে ফেললো।

বিস্ময়ে অস্ফুট ধ্বনি করে উঠলো পরশু সিং-তিলক।

হাঁ, আমিই তিলক।

পরশু সিং এবার বন্ধন অবস্থায় বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলে উঠলো–মহারাজ, এই সেই ব্যক্তি যে আমাদের অনেকগুলো রাজকর্মচারীকে হত্যা করেছে।

পরশু সিং-এর কথায় মহারাজের মুখেচোখে কিছুমাত্র পরিবর্তন দেখা দিলো না। তিনি স্বাভাবিক এবং গম্ভীর কণ্ঠে বললেন-আমি সব জানতাম।

আপনি সব জানতেন তবু তাকে….

হ মন্ত্রীবর, যে অপরাধী, তাকে শাস্তি দিলে আমি কোনোদিনই তার বিরুদ্ধাচরণ করবো না। তিলক অপরাধীর শাস্তি দিয়েছিলো মাত্র।

মহারাজ!

হাঁ, যেমন আপনার অপরাধের জন্য আপনি বন্দী হলেন এবং এরজন্য আপনাকে চরম শাস্তিও পেতে হবে।

পিছন ফিরে তাকাতেই মহারাজ অবাক হলেন, তাদের পিছনে দাঁড়িয়ে মহারাণী আর বিজয়া। তারা বিস্ময় দৃষ্টি নিয়ে তাকাচ্ছে জমকালো পোশাক পরা তিলকের দিকে।

[পরবর্তী বই নূরীর সন্ধানে]

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন