সুহাসিনী

পাঁচকড়ি দে

সুহাসিনী

প্রথম পরিচ্ছেদ – জহরত চুরি

১৮৮০ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে এক শনিবারে ক্ষুদ্র সহর শ্রীরামপুরে দুই কারণে মহা হৈ-চৈ পড়িয়া গেল। তখনকার একখানি সংবাদপত্রে যাহা লিখিত হইয়াছিল, তাহারই কিয়দংশ আমরা নিম্নে উদ্ধৃত করিতেছি,

“অদ্য আমরা এক অদ্ভুত চুরির সংবাদ পাঠকদিগকে দিতেছি। এ পর্যন্ত আমরা এরূপ অত্যাশ্চর্য ব্যাপার আর কখনও লিপিবদ্ধ করি নাই।

“গত শনিবার প্রাতে বিখ্যাত ধনী জনাৰ্দ্দন বসুর বাড়ির ভৃত্যগণ প্রাতে উঠিয়া দেখিল, বৈঠকখানা গৃহের জানালা ভাঙ্গিয়া কাহারা প্রবেশ করিয়াছে, তৎপরে পার্শ্ববর্ত্তী গৃহমধ্যে গিয়া সিন্দুক খুলিয়া সমস্ত অলঙ্কারাদি বহুমূল্যের হীরক মুক্তা জহরত সমস্তই চুরি করিয়া লইয়া গিয়াছে। আশ্চর্য্যের বিষয়, কেহ কিছুই জানিতে পারে নাই।

“পুলিস অনুসন্ধান আরম্ভ করিয়াছে—জনাৰ্দ্দন বসুর একমাত্র কন্যা, বহু টাকা পুরস্কার ঘোষণা করায় কলিকাতা হইতে কয়েকজন দক্ষ ডিটেকটিভ অনুসন্ধানে আসিয়াছেন। আশা করি, শীঘ্রই চোর ধরা পড়িবে।”

জনাৰ্দ্দন বসুর যে বহুমূল্যের জহরব্রতাদি ছিল, তাহা সকলেই জানিত। তাঁহার পিতা কমিসেরিয়েটের কাজ করিতেন। ভরতপুর যখন ইংরেজরা দখল করে, তখন ভরতপুরের রাজার প্রায় অনেক জহরত তাঁহার হস্তে পড়িয়াছিল, সুতরাং তাঁহার ঘরে যেরূপ জহরত ছিল, বাঙ্গালা দেশে আর কাহারই গৃহে সেরূপ ছিল না। সেই সকল বহুমূল্য জহরত চুরি গিয়াছে, সুতরাং ইহাতে যে শ্রীরামপুরের ন্যায় ক্ষুদ্র সহর চঞ্চল হইয়া উঠিবে, তাহাতে আর আশ্চর্য্যের কি!

কেবল ইহাই নহে—শ্রীরামপুরে আর একটা ঘটনা এই ঘটনার পরেই ঘটিল;নতুবা কতদিন যে ইহার আলোচনা চলিত, বলা যায় না। এই নূতন ঘটনা ঘটায় তখন সকলে ইহারই আলোচনায় নিযুক্ত হইয়া পড়িল।

এ সংবাদও সংবাদপত্রে প্রচারিত হইল। বড় ঘরের কোন কথাই গোপন থাকে না। সংবাদপত্রে এইরূপ লিখিত হইল,

“নরহরি বাবু শ্রীরামপুরের মধ্যে একজন খুব সম্ভ্রান্ত লোক—তাঁহার বহু কারবার—তাঁহার কন্যা ইন্দুবালা তাঁহার ভৃত্য গোপালের সহিত গৃহত্যাগ করিয়া গিয়াছে। এরূপ ব্যাপারে যে সকলেই একেবারে স্তম্ভিত হইবেন, তাহাতে আশ্চর্য্য কি! নরহরি বাবু ক্রোধে উন্মত্তপ্রায় হইয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন, যত টাকা লাগে, তিনি দিবেন;এই দুর্বৃত্ত ভৃত্যকে ধৃত করিয়া, তাহাকে সমুচিত দণ্ড না দিয়া তিনি নিরস্ত হইবেন না। সংবাদ পাওয়া গিয়াছে, তিনি এই কার্য্যে একজন সুদক্ষ ডিটেকটিভ নিযুক্ত করিয়াছেন।”

জনাৰ্দ্দন বাবুর জহরত চুরি ও নরহরি বাবুর কন্যার গৃহত্যাগ এই দুই ব্যাপার লইয়া পথে ঘাটে মাঠে কথোপকথন চলিতে লাগিল—কত লোক কত কথা বলিতে লাগিল—কত লোক কত অনুমান করিল, কিন্তু এই দুই ব্যাপারের কোন মীমাংসা করিতে পারিল না। নরহরি বাবুর কন্যা ইন্দুবালা বা তাঁহার ভৃত্য গোপালের কোন সন্ধান হইল না।

‘জনাৰ্দ্দন বসুর সুবৃহৎ সাত-মহল অট্টালিকা। তাহাতে তাঁহার একমাত্র কন্যা বৃদ্ধা পিসির সহিত বাস করেন। সুহাসিনী বৈধব্য পীড়িতা—আজ পাঁচ বৎসর হইল, তাঁহার স্বামী-বিয়োগ হইয়াছে; অতুল-ঐশ্বৰ্য্যশালিনী হইয়াও সুহাসিনীর জীবন ও জগৎ অন্ধকারময়; তবে এই বিপুল অন্ধকারের মধ্যে ক্ষুদ্র নক্ষত্রের মত তাঁহার একটিমাত্র সপ্তমবর্ষীয় পুত্র আছে। জনাৰ্দ্দন বাবুর একমাত্র সন্তান সুহাসিনীই তাঁহার পিতার সমস্ত সম্পত্তির অধিকারিণী হইয়াছেন। সুহাসিনীর বয়স এখন সাতাশ বৎসর হইবে। তাঁহার মাতুল ডাক্তার বরেন্দ্রনাথ তাঁহার সম্পত্তির তত্ত্বাবধারণ করেন।

চুরির দিবস সংবাদ পাইবামাত্রই পুলিস-ইনস্পেক্টর সদলে জনাৰ্দ্দন বসুর বাড়িতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। এই দারোগাটি অতি স্থূলকায়, অতি খর্ব্ব। এই দারোগা-পুঙ্গবের বুদ্ধিটিও তাঁহার শরীরের অনুরূপ।

বরেন্দ্রনাথ এই দারোগা মহাশয়ের প্রতীক্ষা করিতেছিলেন। তাঁহাকে সদলবলে দেখিয়া তিনি সমাদরে তাঁহাদিগকে গৃহমধ্যে আনিলেন, দারোগা মার্ত্তণ্ডকুমার বলিলেন, “বড়ই দুঃখের বিষয় – ডাক্তার বাবু, বড়ই দুঃখের বিষয়—তবে নিশ্চয়ই চোর ধরা পড়িবে—এত দামী জহরত কখনই তাহারা লুকাইয়া রাখিতে পারিবে না। আমাদের ডিটেকটিভদের চোখে ধুলি দেওয়া বড় কঠিন, ডাক্তার বাবু।—বড়ই কঠিন—এখন তাহার পর—কি বল শ্যামকান্ত, প্রথম আমাদের কি করা উচিত?”

অনুচর শ্যামকান্ত বলিল, “বোধ হয়, প্রথমে আমাদের—হ্যাঁ, তদন্ত আরম্ভ করা উচিত।” দারোগা বলিলেন, “নিশ্চয়—নিশ্চয়—তদন্ত আরম্ভ করা যাক—কি বলেন, ডাক্তার বাবু?” ডাক্তার বাবু বলিলেন, “যাহা ভাল বুঝেন, করুন। আমরা আর কি বলিব?”

“অবশ্য—অবশ্য—নিশ্চয়। শ্যামকান্ত!”

“আজ্ঞা করুন।”

“তবে তদন্ত আরম্ভ করা যাক?”

“আরম্ভ করুন।”

তখন দুইজন পুলিস-কৰ্ম্মচারী প্রত্যেক গৃহ, জানালা, চেয়ার, টেবিল, আসবাব প্রভৃতি বিশেষরূপে লক্ষ্য করিতে লাগিলেন। মধ্যে মধ্যে দারোগা বলিতেছিলেন, “শ্যামকান্ত, তদন্ত হইতেছে?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ।”

“কেমন হইতেছে?”

“খু—উ–ব।”

“তবে তদন্ত চলুক?”

“হ্যাঁ, চলুক।”

ডাক্তার বাবু ইঁহাদের কার্য্য-কলাপ দেখিয়া মনে মনে হাসিতেছিলেন। ভাবিলেন, “এই দুই অপদার্থ গদর্ভ, ইহারা কিছুই অনুসন্ধান করিতে পারিবে না; তবে কলিকাতায় মোহনলালকে সংবাদ দিয়াছি, তিনি নিশ্চয়ই শীঘ্র আসিয়া পড়িবেন, তখন যাহা হয়, করা যাইবে। এই দুই অপদার্থকে কোন কথা বলিয়া কোনই ফল নাই। এ চোর সাধারণ চোর নহে। তাহারা ক্লোরাফর্ম্ম দিয়া সকলকেই অজ্ঞান করিয়াছিল। সুহাসকে আর একটু বেশি ক্লোরাফর্ম্ম দিলে তাহার মৃত্যু হইবার সম্ভবনা ছিল। কি ভয়ানক!”

প্রায় একঘণ্টা ধরিয়া দারোগা ও শ্যামকান্ত বাড়ির সমস্ত গৃহ পর্যবেক্ষণ করিলেন; তৎপরে একে একে দাস-দাসীদিগকে ডাকিয়া তাহাদের জবানবন্দী লিখিতে আরম্ভ করিলেন।

তাহারা কেহই কিছু বলিতে পারিল না, তাহারা কেহই কিছু জানে না, সকলেই ক্লোরাফর্ম্মে অজ্ঞান ছিল; কিন্তু ক্লোরাফর্ম্মের কথাও তাহারা জানে না—সকলেই বলিল, “আমরা ঘুমাইয়াছিলাম, কিছু জানি না।”

অগত্যা তদন্ত শেষ করিয়া দারোগা ও শ্যামকান্ত গমনে উদ্যত হইলেন। ডাক্তার বরেন্দ্রনাথ জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি বুঝিলেন, মহাশয়?”

দারোগা শ্যামকান্তের দিকে চাহিয়া বলিলেন, “কি বল, শ্যামকান্ত? “

শ্যামকান্ত বলিল, “কি আর বলিব—তদন্ত হইল

“ডাক্তার বাবু আমাদের জিজ্ঞাসা করিতেছেন, কি বুঝিলাম।”

“বুঝিলাম—”

“হাঁ, গাধা।”

“এই—এই— চোর ঠিক ধরা পড়িবে।”

“নিশ্চয়।”

উভয়ে প্রস্থান করিলেন। বরেন্দ্রনাথ বিরক্ত হইয়া বলিলেন, “এমন মূর্খদেরও পয়সা দিয়া রাখিয়াছে।”

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – মোহনলাল

সেইদিন সন্ধ্যার সময়ে কলিকাতা হইতে সুদক্ষ গোয়েন্দা মোহানলাল শ্রীরামপুরে উপস্থিত হইলেন; কিন্তু তিনি সাধারণভাবে আসিলেন না। ডাক্তার বরেন্দ্রানাথ ও তাঁহার ভাগিনেয়ী সুহাসিনী উভয়েই তাঁহার অভূতপূর্ব আবির্ভাবে প্রথমে ভীত, তৎপরে বিস্মিত, অবশেষে না হাসিয়া থাকিতে পারিলেন না।

বাড়ির প্রাঙ্গণে একটা বড় আমগাছ ছিল, এই বৃক্ষের নিম্নে দাঁড়াইয়া বরেন্দ্রনাথ ও সুহাসিনী কথোপকথন করিতেছিলেন। মোহনলাল এখনও আসিলেন না বলিয়া বরেন্দ্রনাথ চিন্তিত হইয়া উঠিাছিলেন, মোহনলালের সহিত তাঁহার বিশেষ বন্ধুত্ব ছিল, তাহাই তিনি প্রাতেই তাঁহাকে টেলিগ্রাফ করিয়াছিলেন। তাঁহার দুই প্রহরেই আসিবার কথা, আর এখন রাত হইল।

সুহাসিনী বলিলেন, “মামা, কই আপনার সে ডিটেকটিভ আসিলেন না? “

“নিশ্চয়ই আসিবেন—বোধ হয়, কলিকাতায় এখন নাই—হয় ত অন্য কাজে কোথায় গিয়াছেন—তাঁহাকে প্রায়ই বাহিরে যাইতে হয়।”

“আসিলেই বাঁচি।”

“যখন এরূপ অবস্থা, তখন আমার এই মুহূর্ত্তেই উপস্থিত হওয়া কৰ্ত্তব্য।”

তাঁহাদের মস্তকের উপর হইতে কে এই কথা বলায় তাঁহারা উভয়েই চমকিত ও ভীত হইয়া সরিয়া দাঁড়াইলেন। তখন এক ব্যক্তি সেই বৃক্ষের ডাল হইতে লম্ফ দিয়া নিম্নে পড়িল।

বরেন্দ্রনাথ ক্রুদ্ধভাবে বলিলেন, “তুই কে? এখানে কেন?”

সেই ব্যক্তি ধীরে ধীরে বলিল, “হুজুরের হুকুমেই এখানে এই অধীনের আগমন।”

সুহাসিনী গৃহমধ্যে সরিয়া গেল। বরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “তুমি—তুমি— মোহনলাল—কতক্ষণ গাছের উপরে ছিলে হে?”

“অনেকক্ষণ—চিনিতে পারিয়াছ, ইহাই যথেষ্ট।”

“চেহারায় নহে—চিনিয়াছি গলার স্বরে।”

“চেহারাটা দরকার মত বদলাইতে হয়।”

“এভাবে আসিবার মানে কি?”

“ক্রমে সব শুনিবে—চেহারায় কি বুঝায়?”

“একজন কুলি মজুর।”

“তাহাই—কাল হইতে এ বাড়িতে মজুরের কাজেই লাগিব—মনে করিয়াছি, এখানকার লোক- জনে আমায় না দেখিতে পায়, আমি যেভাবে আসিয়াছি, সেই ভাবেই যাইব।”

“আর তোমার অনুসন্ধান কখন আরম্ভ করিবে?”

“আরম্ভ ত অনেকক্ষণ হইয়াছে।”

“কতদূর কি করিয়াছ, বল।”

“এইদিকে এস।”

এই বলিয়া মোহনলাল ডাক্তারের হাত ধরিয়া একটি প্রকোষ্ঠমধ্যে প্রবেশ করিয়া ভিতর হইতে দরজা বন্ধ করিয়া দিলেন। তৎপরে উভয়ে উপবিষ্ট হইলেন।

মোহনলাল বলিলেন, “এখন কি শুনিতে চাও?”

ডাক্তার জিজ্ঞাসিলেন, “কি অনুসন্ধান করিয়াছ?”

মোহনলাল বলিলেন, “তোমার টেলিগ্রাম পাইয়া দশটার গাড়িতে এখানে আসিয়াছি; সহরে এ সম্বন্ধে কে কি বলিতেছে, তাহা সবই শুনিয়া লইয়াছি; তাহার পর এই বাড়িটার চারিদিকটাও ভাল করিয়া দেখিয়াছি; চাকরদের সহিত আলাপ-পরিচয় করিয়া তাহাদের এ সম্বন্ধে কি বলিবার আছে, তাহাও জানিয়াছি। তাহাদের অলক্ষ্যে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করিয়া ঘরগুলিও সব দেখিয়াছি, তাহার পর আরও কিছু দেখিবার আশায় ঐ গাছে উঠিয়া বসিয়াছিলাম; তোমরা নিতান্ত আমার জন্য ব্যাকুল হইয়াছ, তাহাই সহসা আবির্ভাব হইতে হইল।”

“দেখিতেছি, তুমি ইহারই মধ্যে অনেক সন্ধান লইয়াছ।”

“কাৰ্য্যই ঐ—এখন ক্লোরাফর্ম্ম—”

“তাহাও জানিয়াছ?”

কেবল জানা নহে, এই শিশিটিও পাইয়াছি। এখন আমি যাহা অনুমান করিয়াছি, তাহা একে একে বলিতেছি। প্রথমে এই দস্যুগণ কাল রাত্রে প্রথম এ বাড়িতে প্রবেশ করে নাই, তাহারা পূৰ্ব্বে ও আসিয়াছিল। তাহার পর তাহারা প্রথমেই চোখে যে জানালা পড়িয়াছিল, তাহাই যে খুলিয়াছে তাহা নহে, তাহারা জানিত যে, এই জানালাটা সহজে খুলিতে পারা যাইবে। তাহারা এ বাড়ির ভিতর- বাহির উভয়দিকই খুব ভালরূপে জানিত।”

“এ সব কেবল অনুমান।”

“শুনে যাও—বৈঠকখানায় যে জিনিসপত্র তছনছ করিয়াছে, সে কেবল লোকের চক্ষে ধূলি দিবার জন্য, তাহারা জানিত যে, আসল জিনিস—জহরত সেখানে নাই। তাহারা আনাড়ী লোক নহে, আগে হইতে সমস্ত বন্দোবস্ত করিয়াছিল, সেই বন্দোবস্ত মত কাজ করিয়াছে—তাহাই তাহাদের কাজে কোন ব্যাঘাত ঘটে নাই। তাহারা নদী দিয়া আসিয়াছিল, তাহার পর বাড়ির খিড়কীর দরজা দিয়া বাড়িতে প্রবেশ করিয়াছিল। তাহারা খিড়কীর বাগানের ভিতর দিয়া বৈঠকখানায় আইসে; তাহারা জানিত, এই ঘরের পার্শ্বেই সিঁড়ি—সিঁড়ি দিয়া উঠিয়া গেলেই সুহাসিনী দেবীর ঘর। হয় ত তাঁহার গৃহের দ্বার খোলা ছিল, অথবা তাহারা দরজা খুলিবার যন্ত্র সঙ্গে আনিয়াছিল। তাঁহার ঘরের দরজা কি খোলা ছিল?’

“না, বন্ধ ছিল।”

“বন্ধ ছিল? ভাল, তাহারা কোন উপায়ে দরজা খুলিয়া গৃহমধ্যে গিয়াছিল, তাহার পর তাঁহাকে ক্লোরাফর্ম্ম দিয়া অজ্ঞান করিয়া অবাধে জহরতগুলি সংগ্রহ করিয়া পলাইয়াছে।”

ডাক্তার বিস্মিত হইয়া চাহিয়া রহিলেন, কোন কথা কহিলেন না।

মোহনলাল বলিলেন, “দেখিতেছি, মহাশয় আমার কথা বিশ্বাস করিতেছেন না, ক্রমে প্রমাণ দিতেছি। গঙ্গার ধারে আঘাটায় কাল যে একখানা নৌকা কেহ টানিয়া উপরে তুলিয়াছিল, আমি তাহার স্পষ্ট চিহ্ন দেখিয়াছি। পাছে নৌকাখানা এই আঘাটায় দেখিয়া কেহ সন্দেহ করে, তাহাই ইহারা এখানাকে উপরে তুলিয়া জঙ্গলের ভিতরে লুকাইয়া রাখিয়াছিল। এটা তাহাদের প্রথম নম্বর ভুল—এ সূত্র ইচ্ছা করিলে তাহারা অনায়াসে না রাখিতে পারিত।”

“তাহা হইলে এটা তাহাদের ভুল?”

“নিশ্চয়ই, তাহার পর এই বৈঠকখানার জানালা—তাহারা জানিত, এ ঘরে কেহ রাত্রে থাকে না, তাহাই অন্য জানালা না ভাঙ্গিয়া এইটাই ভাঙিয়াছিল। অজানা চোর হইলে এ জানালায় কখন আসিত না। তাহার পর তাহারা সুহাসিনী দেবীর প্রকৃতি ভাল রূপেই জানিত। তাহাই তাহারা তাঁহাকে অতি অল্প পরিমাণে ক্লোরাফর্ম্ম দিয়াছিল, তাঁহাকে একটু ঘুম পাড়ানই তাহাদের উদ্দেশ্য, তাঁহার জীবনাশ করা তাহাদের উদ্দেশ্য ছিল না, কি বল ডাক্তার? সুহাসিনী দেবীকে খুব ভালরূপে জানা না থাকিলে এরূপ কখনও ঘটিতে পারে না।”

“না, কথাটা ঠিক—অজানা লোক বা আনাড়ী লোক হইলে হয় ত অধিক ক্লোরাফর্ম্মই দিত।”

“তাহার পর দুইজন মাত্র দস্যু বাড়িতে প্রবেশ করিয়াছিল, একজন অপরের অপেক্ষা কিছু লম্বা, আমি জানালার পার্শ্বে উভয়েরই পায়ের দাগ লক্ষ্য করিয়াছি—লম্বা লোকের পা লম্বাই হইয়া থাকে—ডাক্তার, এক্ষণে এই পৰ্য্যন্ত, চল। আজ তোমার বাড়িতেই অধিষ্ঠান করিব।”

উভয়ে নিঃশব্দে সে বাড়ি পরিত্যাগ করিলেন। একজন দাসী ছুটিয়া আসিয়া বলিল, “মা ঠাকুরাণী ডাকিতেছেন।”

“ঘুরিয়া আসিতেছি,” বলিয়া বরেন্দ্রনাথ মোহনলালের সহিত প্রস্থান করিলেন।

তৃতীয় পরিচ্ছেদ – দুই বন্ধু

উভয়ে পথে আসিলে মোহনলাল বলিলেন, “আমাদের দুইজনের এক সঙ্গে যাওয়া ভাল নহে। তুমি অগ্রসর হও~~আমি পরে যাইতেছি।”

“কিন্তু —”

“ডাক্তার, ইহার মধ্যে কিন্তু-টিন্তু নাই, যাও, আমি পরে যাইতেছি—লুকাইয়া আমাকে বাড়ির ভিতরে লইও। বাড়িতে খানিকটা মোম আছে কি?”

“আছে, কেন?”

“কে আসিতেছে—শীঘ্র যাও।”

এই বলিয়া মোহনলাল পাশ কাটাইলেন। ডাক্তার বরেন্দ্রনাথ চিন্তিতমনে গৃহে ফিরিলেন। একঘণ্টা অতীত হইল, তবুও মোহনলালের দেখা নাই, বরেন্দ্রনাথ তাঁহার জন্য চিন্তিত হইলেন; এখনই আসিতেছি বলিয়া কোথায় গেলেন? তিনি মোহনলাল আসিতেছেন কি না দেখিবার জন্য বহিদ্বারে আসিলেন। বহুদূর পর্য্যন্ত পথের দুইদিক দেখিলেন, কোথায়ও তাঁহাকে দেখিতে পাইলেন না। তিনি ফিরিতেছিলেন, এই সময়ে কে পশ্চাৎ হইতে তাঁহার পৃষ্ঠে হস্তস্থাপন করিল। তিনি চমকিত হইয়া ফিরিয়া দেখিলেন, মোহনলাল!

মোহনলাল অতি ক্ষীণস্বরে বলিলেন, “কেহ নাই, একলা ত?”

“হাঁ, কোথায় ছিলে? কই, পথে ত তোমাকে আমি দেখিতে পাই নাই?”

‘তোমার বাড়িতেই ছিলাম।”

বিস্মিত হইয়া ডাক্তার বলিলেন, “কিরূপে প্রবেশ করিলে?”

“দরজা দিয়া—তুমি কাণা, দেখিতে পাও নাই—এইমাত্র।”

“সত্যকথা—এখন এস, সকাল থেকে উদরে কিছু পড়ে নাই?”

“তুমি মনে করিয়া দিলে, বাড়িতে ভাল আহার হয় নাই—তাড়াতাড়ি স্টেশনে আসিয়াছিলাম।” ‘এখনই খাবার আনিতে বলিতেছি।”

“তাড়াতাড়ি নাই।”

তবুও ডাক্তার উঠিলেন, দেখিয়া মোহনলাল বলিলেন, “তোমার কোন চাকর-বাকরকে এ ঘরে আসিতে দিও না, মুখোস খুলিতেছি।”

“না, আমি নিজেই আনিব।”

এই বলিয়া বরেন্দ্রনাথ প্রস্থান করিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে তিনি মোহনলালের জন্য নানাবিধ আহাৰ্য্য আনিলেন।

মোহনলাল বাক্যব্যয় না করিয়া নীরবে সে সমস্ত উদরস্থ করিলেন। তৎপরে হাতমুখ ধুইয়া বলিলেন, “এখন সুস্থ হইলাম, ডাক্তার, এইবার সেই খানিকটা মোম আবশ্যক।”

ডাক্তার মৃদুহাস্য করিয়া বলিলেন, “মোম লইয়া কি করিবে, তাহা জানিতে ব্যস্ত হইয়াছি।”

মোহনলাল উত্তর করিলেন না।

বরেন্দ্রনাথ খানিকটা মোম লইয়া আসিলেন; বলিলেন, “এই লও তোমার মোম—আর কি চাও?”

“এটা গলাইতে হইবে।”

“কিসে গলাইবে?”

“একটা বাটি দাও, তাহা হইলে এই আলোতেই গলাইয়া লইব।”

বরেন্দ্রনাথ একটা পিতলের বাটি আনিলেন। তখন বাটিতে মোম রাখিয়া মোহনলাল বাটি আলোর উপরে ধরিলেন। বলিলেন, “একটা ছাঁচ লইতে হইবে।”

তাহার পর তিনি পকেট হইতে ক্লোরাফর্ম্মের শিশিটি বাহির করিলেন; বলিলেন, “ডাক্তার, এ শিশিটি কিসের বলিয়া বোধ হয়?”

“কই দেখি।”

“ভাল করিয়া দেখ।”

ডাক্তার ভাল করিয়া শিশিটি দেখিয়া বলিলেন, “বোধ হয়, কোন এসেন্সের শিশি।”

“ঠিক কথা, এই এসেন্স প্রায় স্ত্রীলোকই ব্যবহার করে—নয় কি?”

“আমি এরূপ শিশি অন্যত্রেও দেখিয়াছি।”

“শীঘ্রই সব জানিতে পারিব।”

“আশ্চর্য্য হইতেছে, তাহারা এরূপ শিশি ফেলিয়া গিয়াছে।”

“ঠিক কথা, আমি ভাবিতেছিলাম, যখন দস্যুগণ সুহাসিনী দেবীর গৃহে প্রবেশ করে, তখন তাহাদের সঙ্গে একটা চোরা লণ্ঠন ছিল। ইহাদের একজন এই লণ্ঠন গৃহমধ্যে লইয়া যায়। তাহারা ক্লোরাফর্ম্মের বন্দোবস্ত আগেই করিয়া আনিয়াছিল; ভাবিয়াছিল, এইখানেই সুহাসিনীর ঘরের মধ্যে কোন কাপড় পাইবে, তাহাতেই মাখাইয়া তাঁহার নাকে ধরিবে; কিন্তু গৃহমধ্যে আসিয়া কোন কাপড় দেখিতে না পাইয়া নিজের রুমালেই মাখাইতে বাধ্য হয়।”

“তাহা হইলে এই চোরের পকেটে রুমাল ছিল?”

‘চোর হইলেই কি ছোট লোক হইতে হয়? ছোটলোক চোর ধরা সহজ, ভদ্রলোক চোর ধরাই বড় কঠিন; কারণ তাহারা লেখাপড়া জানে, তাহাদের বুদ্ধি আছে—তাহারা যখন চুরি, ডাকাতি, খুন করে, তখন অনেক ভাবিয়া করে, তাহাদের জন্যই ত আমাদের ডিটেকটিভগিরি চলিতেছে।”

“তাহা হইলে এই চোর একজন খুব ভদ্রলোক—এই পৰ্য্যন্ত বুঝিলাম।”

মোহনালাল বলিলেন, “হাঁ, এই ভদ্রচোর নিজের রুমালের খানিকটা ছিঁড়িয়া তাহাতেই ক্লোরাফর্ম্ম মাখাইয়া সুহাসিনীর নাকের উপরে ধরে; এই সময়ে তাহার সঙ্গী বাহির হইতে তাহাকে ব্যগ্রভাবে ডাকিতে থাকে, অবশ্যই বাহিরে একজন পাহারায় ছিল; তাহা হইলে কেহ উঠিয়াছে এই ভাবিয়া ভদ্রচোর সত্বর লণ্ঠনটা তুলিয়া লইয়া সে ঘর হইতে তাড়াতাড়ি বাহির হইয়া যায়, শিশিটা ও রুমালখানা লইয়া যাইতে সময় পায় নাই।”

“তাহা হইলে দুইজন ছিল?”

“হাঁ, দুইজন ছিল—এ সকল কাজ একা হয় না।”

“তুমি বলিতেছিলে তাহারা চালাক হইলেও অনেক ভুল করিয়াছে, কই ভুল ত কিছু দেখিতেছি না—সমস্ত জহরতগুলি লইয়া গিয়াছে।”

“তাহা ঠিক—এ সত্ত্বেও তাহারা ভুল করিয়াছে—তাহাদের কাজে অনেক ত্রুটি রাখিয়া গিয়াছে। তবে এ ব্যাপার সম্বন্ধে দুই-একটা বিষয় আমি আদৌ বুঝিতে পারি নাই। এখন সে সব কথা থাক, এখন আমি ছাঁচ সরাইয়া রাখিয়া একটু বিশ্রাম করিব। নিদ্রাটা মানুষের নিতান্ত আবশ্যক।”

ডাক্তার হাসিয়া বলিলেন, “শুনিয়াছি, ডিটেকটিভদিগের আহার নিদ্রা নাই।”

“সে কেবল উপন্যাসে। এখন নিদ্রা ও নাসিকা-গৰ্জ্জন।”

এই বলিয়া মোহনলাল চাদর মুড়ি দিয়া লম্বভাবে শয়ন করিলেন।

ডাক্তার বরেন্দ্রনাথ বহুক্ষণ নীরবে বসিয়া রহিলেন। তাঁহাকে দেখিলেই বেশ বুঝিতে পারা যায়, তিনি ঘোর চিন্তায় নিমগ্ন আছেন। অবশেষে তিনি উঠিয়া শয়ন করিলেন। তখন মোহনলালের নাসিকা-গৰ্জ্জন খুব চলিতেছে।

চতুর্থ পরিচ্ছেদ – চুরির তদন্ত

পরদিবস প্রাতে মোহনলাল সেইরূপ কুলী-মজুরের বেশে সুহাসিনীর বাড়ির দিকে চলিলেন। তিনি দেখিলেন, একটি প্রৌঢ় ভদ্রলোক সেই দিকে আসিতেছেন; তিনি তাঁহাকে দেখিয়া সুহাসিনীর বাড়ির দ্বার ছাড়িয়া আরও অগ্রসর হইলেন; তখন সেই ভদ্রলোক তাঁহার পার্শ্ব দিয়া চলিয়া গেলেন।

মোহনলাল তাঁহার দিকে দৃষ্টি রাখিলেন, তিনি এই লোককে এখানে দেখিয়া একটু বিস্মিত হইলেন, তবে বিস্ময় প্রকাশের লোক মোহনলাল ছিলেন না। তিনি মনে মনে বলিলেন, “তাহা হইলে ইনিও দেখিতেছি এ ব্যাপারে আছেন। ইঁহাকে ডাকিল কে? যিনিই ডাকুন—এবার মজাটা খুব হইবে।”

মোহনলাল দূরে গিয়া ফিরিয়া দেখিলেন, লোকটি সুহাসিনীর বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করিল।

এদিকে ভদ্রলোকটি বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করিয়া দাসীর দ্বারা সুহাসিনীকে এক পত্র পাঠাইয়া দিল। সুহাসিনী পত্র খুলিয়া দেখিলেন তাঁহার পিতার বিশেষ বন্ধু নীলরতন বাবু এই পত্র লিখিয়াছেন।

নীলরতন বাবু চুরির সংবাদ পাইয়া সুহাসিনীর সহিত দেখা করিতে আসিয়াছিলেন; তৎপরে যাহাতে চোর ধরা পড়ে ও জহরত পাওয়া যায়, তাহার জন্য বিশেষ চেষ্টা পাইবেন, বলিয়া গিয়াছিলেন।

তিনি সুহাসিনীকে লিখিয়াছেন;–

“তোমার নিকটে একজন বিশেষ সুদক্ষ গোয়েন্দা পাঠাইতেছি—ইনি পুলিসে কাজ করেন না। স্বতন্ত্র গোয়েন্দাগিরিই ইঁহার ব্যবসায়, বড় বিচক্ষণ লোক, ইঁহাকে চুরির অনুসন্ধানে নিযুক্ত করিও, ইনি নিশ্চয়ই চোর ধরিতে পারিবেন—ইঁহার নাম অবনীকান্ত দত্ত।”

দাসীকে দিয়া সুহাসিনী অবনীকান্তকে বলিলেন, “হাঁ, তাহা হইলে আপনি অনুসন্ধান করুন।” অবনীকান্ত বাহিরের ঘরে ছিলেন, দাসী দ্বারে—তাহার পশ্চাতে গৃহমধ্যে সুহাসিনী। অবনীকান্ত স্বর উচ্চে তুলিয়া বলিলেন, “আমি নীলরতন বাবুর নিকটে এ সম্বন্ধে সব শুনিয়াছি, এখন একবার অকুস্থানটি দেখিতে চাই।”

“বেশ, দেখিতে পারেন—দাসী আপনাকে সঙ্গে লইয়া যাইতেছে।”

দাসী অবনীকান্তকে লইয়া গেল। এই সময়ে একজন মালী আসিয়া বলিল, “মা ঠাকুরাণী, আমি আসিয়াছি।”

সুহাসিনী ভীত হইয়া সরিয়া দাঁড়াইলেন।

মালী বলিল, “ওরূপ করিলে সকলের সন্দেহ হইবে–সকল কাজ পণ্ড হইবে—আমাকে ঠিক আপনার মালীর মতই দেখিতে হইবে।’

সুহাসিনী বলিলেন, “কি করিতে বলেন?”

“কি মুস্কিল! আমি এখন আপনার চাকর—চাকর যে আমি, সেটা খুব মনে করিয়া রাখুন, কিছুতেই ইহা ভুলিবেন না—এখন আরও সাবধান হইতে হইবে—বিশেষতঃ অবনীকান্ত আসিয়াছে।”

সুহাসিনী একেবারে বিস্মিতা হইয়া গেলেন; বলিলেন, “আপনি ইঁহাকে চিনেন?”

“খুব।”

“লোক কেমন?”

“বেশ হুঁসিয়ার।”

“তাহা হইলে ইনিও কি আপনাকে চিনিতে পারিয়াছেন?”

“না, সেটা একটু শক্ত।”

“তাহা হইলে ইনিও কি অনুসন্ধান করিতে পারেন?”

“কে ইহাকে পাঠাইয়াছেন?”

“আমার একজন বিশেষ আত্মীয়।”

“কোন ভয় নাই, অনুসন্ধান করুক। এখন একটা কথা, আপনি এ চুরি সম্বন্ধে কাহাকে সন্দেহ করেন?”

“না, কাহাকেও না—আপনি এ কথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন কেন?”

“আমি ঠিক ও কথা জিজ্ঞাসা করি নাই—আমি জিজ্ঞাসা করিতেছিলাম, কে আপনার জহরত চুরি করিয়াছে, সে সম্বন্ধে কি আন্দাজ করেন?”

“আমি কিছুই আন্দাজ করি না।”

“গত শনিবার রাত্রে আপনার বাড়িতে চোর প্রবেশ করিয়াছিল, এ বিষয়ে আমার কোনই সন্দেহ নাই—এই চোরেরা যে আপনার জহরত চুরি করিয়াছে, তাহাতেও আমার কোন সন্দেহ নাই। তাহারা কে, তাহা আপনি অনুমান করিতে পারিতেছেন না—এ সকল বিষয়ে আমি এক রকম নিশ্চিন্ত হইয়াছি; কিন্তু আমি এক বিষয়ে নিশ্চিন্ত হইতে পারি নাই।”

“কোন্ বিষয়ে?”

‘কোথায় এই জহরত এখন আছে, তাহা আপনি জানেন, কি জানেন না?”

এই কথায় সুহাসিনীর মুখ লাল হইয়া গেল, তিনি ক্রুদ্ধ ও বিরক্ত স্বরে বলিলেন, “যদি আপনি এতই জানিয়াছেন, তখন এটাও জানিতে পারিবেন। নিশ্চয়ই এ বিষয়ে চেষ্টা করিবেন।”

“আমি ডিটেকটিভ, যতক্ষণ আপনার জহরতের জন্য আপনি চিন্তিত না হয়েন, যতক্ষণ এই চুরিতে আপনি দুঃখিত নহেন, ততক্ষণ এ সম্বন্ধে আমার কোনই কৌতুহল নাই—তবে আপনার জহরত চুরি গিয়াছে, আপনি পুলিসে সংবাদ দিয়াছেন, বরেন্দ্রবাবু আমাকে ডাকিয়া আনিয়াছেন, আমাকে এ সম্বন্ধে বিশেষ অনুসন্ধান করিতে হইবে।”

এই সময়ে নিকটে কাহার পদশব্দ শুনিতে পাওয়া গেল। মোহনলাল বলিলেন, “এখন এই পৰ্য্যন্ত—ভুলিবেন না, আমি আপনার চাকর।”

এই বলিয়া তিনি সরিয়া গেলেন। সুহাসিনীও অবনীকান্তকে দাসীর সহিত আসিতে দেখিয়া অন্য গৃহে প্রস্থান করিলেন।

অবনীকান্ত সমস্ত ঘর উত্তমরূপে দেখিয়া বাহিরে আসিলেন; দাসীকে বলিলেন, “দোয়াত, কলম, কাগজ দাও, আমি রিপোর্ট লিখিয়া তোমাদের কর্ত্রীঠাকুরাণীর নিকটে পাঠাইব—বাঙ্গালায় লিখিব।”

দাসী দোয়াত, কলম, কাগজ আনিয়া দিল। অবনীকান্ত রিপোর্ট লিখিতে বসিলেন।

তিনি গৃহের সমস্ত দাস-দাসীদিগকে প্রশ্ন-বর্ষণে প্লাবিত করিয়াছিলেন; কিন্তু তাহাতে যে অধিক কিছু জানিতে পারিয়াছিলেন, বলিয়া বোধ হয় না; কারণ, তাহারা কিছুই জানিত না।

তিনি ছদ্মবেশী মালীরূপী মোহনলালকেও ধরিয়াছিলেন; তাঁহার তীক্ষ্ণদৃষ্টি থাকা সত্ত্বেও তিনি মোহনলালকে চিনিতে পারেন নাই।

ছদ্মবেশী মোহনলালকে তিনি কঠোরকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিলেন, “বেটা, তুই কি জানিস্ রে?”

মোহনলাল বলিলেন, “হুজুর, আমি কেমন করিয়া জানিব?”

“তাহা আমি শুনিতে চাই না, শীঘ্র বল, বলিতেই হইবে।”

“হুজুর, আমি আজ কেবল কাজে লাগিয়াছি।”

“বেটা পাজি, এতক্ষণ বলিস নাই কেন?”

বিরক্ত হইয়া ছদ্মবেশী মালীকে গালিগালাজ দিয়া তিনি বাহিরে আসিয়া রিপোর্ট লিখিতে বসিলেন। প্রায় দুইঘণ্টা ধরিয়া ক্রমান্বয়ে দ্রুতবেগে অবনীকান্তের কলম চলিতে লাগিল, দিস্তা দিস্তা কাগজ লেখা হইয়া গেল। অবশেষে তিনি ডাকিলেন, “দাসি!”

দাসী আসিলে তিনি কাগজগুলি তাহার হাতে দিয়া বলিলেন, “যাও, তোমাদের কর্ত্রীঠাকুরাণীকে এই রিপোর্ট দাও, তাঁহাকে পড়িতে বল, আমি তাঁহার মতামত জানিবার জন্য এইখানে অপেক্ষা করিব।”

দাসী রিপোর্ট লইয়া প্রস্থান করিলে, অবনীকান্ত একটা তাকিয়ার উপরে পৃষ্ঠরক্ষা করিয়া দেহভার ন্যস্ত করিলেন—অবশ্যই গুরুতর পরিশ্রমের পর বিশ্রাম আবশ্যক।

পঞ্চম পরিচ্ছেদ – অবনীকান্তের মন্তব্য

অবনীবাবু লিখিয়াছেন,–

“আজ সকালে শ্রীরামপুরে পৌঁছিয়াছি, পদব্ৰজে সহর দেখিতে দেখিতে সুহাসিনী দেবীর বাড়িতে উপস্থিত হই। নীলরতন বাবু পত্র দিলে সুহাসিনী দেবী আমাকে অকুস্থান বিশেষ ভাল করিয়া দেখিবার জন্য অনুমতি দিলেন। আমি অনুসন্ধান আরম্ভ করিলাম।

“যে জানলা দিয়া দস্যুগণ গৃহপ্রবিষ্ট হইয়াছিল, তাহা দেখিলাম। গৃহমধ্য হইতে কোন দ্রব্যাদি সরাইয়া দেওয়ায় সূত্র নষ্ট হইয়াছে কি না, তাহা ঠিক বলিতে পারিতেছি না, তবে বৈঠকখানা ঘর হইতে দস্যুগণ কোন দ্রব্য চুরি করে নাই।

“দস্যুরা এই ঘর হইতে বাহির হইয়াই সম্মুখে সিঁড়ি দেখিতে পায়; কোন দিকে কেহ নাই দেখিয়া, তাহারা নিঃশব্দে উপরে উঠিতে থাকে। সিঁড়ির উপরেই সুহাসিনী দেবীর ঘর। তিনি বলিতেছেন যে, তিনি প্রত্যহ তাঁহার গৃহের দ্বার রুদ্ধ করিয়া শয়ন করেন, তবে আমার বিশ্বাস যে, চুরির দিন তিনি দরজা বন্ধ করিতে ভুলিয়া গিয়াছিলেন।

“যদি তাঁহার দরজা খোলা না থাকিত, তাহা হইলে দস্যুগণ নিশ্চয় প্রথমে অন্যান্য ঘর দেখিত—সম্ভবতঃ অন্য কোন গৃহের দরজা খোলা দেখিতে পাইত, তাহা হইলে দরজা ভাঙিয়া সুহাসিনী দেবীর গৃহে প্রবেশ করিবার চেষ্টা পাইত না। ইহাতে কাহারও-না-কাহারও জাগিয়া উঠিবার সম্ভাবনা ছিল।

“চুরি অতি নিঃশব্দে সংঘটিত হইয়াছিল। অন্য কোন দ্রব্যেই দস্যুগণ হাত দেয় নাই। ইহাতেই বোধ হইতেছে যে, দস্যুগণ প্রথমেই সুহাসিনী দেবীর গৃহের দ্বার খোলা দেখিয়া সেই গৃহমধ্যে প্রবেশ করিয়াছিল। প্রথমে একজন লোক গৃহমধ্যে প্রবেশ করিয়াছিল। তাহার পর সুবিধা দেখিয়া, সে তাহার সঙ্গীকে নিকটে আসিতে ইঙ্গিত করে, তাহার হাতে এক চোরা লণ্ঠন ছিল।

“একজন তখন নিঃশব্দে সুহাসিনী দেবীর শয্যার নিকটে আইসে, তখন সে অতি সাবধানে তাঁহার নাসিকার উপরে ক্লোরাফর্ম্মের রুমাল রাখিয়া দেয়, তাহাতেই সুহাসিনী দেবী জ্ঞানশূন্যা হয়েন।

“তাঁহাকে একবার ক্লোরাফর্ম্ম দেওয়া হইয়াছিল, তাহা আমার বোধ হয় না। সিন্দুক খুলিয়া জহরত লইতে অন্ততঃ অৰ্দ্ধঘণ্টা লাগিয়া ছিল। দস্যুগণের ইচ্ছা ছিল না যে, কোন রূপে সুহাসিনী দেবীর প্রাণহানি হয়, তাহাই অতি কম পরিমাণে তাঁহাকে ক্লোরাফর্ম্ম দেয়, তবে তিনি নড়িয়া- চড়িয়া উঠায় আবার ক্লোরাফর্ম্ম দিয়াছিল, এইরূপে বোধ হয়, দুই-তিনবার ক্লোরাফর্ম্ম দিয়াছিল। এইজন্যই তাহারা ক্লোরাফর্ম্মের শিশিটা ও রুমালের কিয়দংশ গৃহের এক কোণে রাখিয়াছিল। দুইজনে সিন্দুক হইতে জহরত লইতেছিল, এমন সময়ে বাহিরে কিসের শব্দ হইল। তখন তাহারা ভয়ে সত্বর গৃহ হইতে পলাইল। তাড়াতাড়ি পালাইবার সময়ে শিশি ও রুমালের কথা ভুলিয়া গিয়াছিল।

“দস্যুগণ বিশেষ কোন সূত্র রাখিয়া যায় নাই; তবে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই যে, তাহারা ব্যবসাদার চোর, দস্যুগিরিই তাহাদের ব্যবসায়; ইহার প্রমাণ তাহাদের কার্যপ্রণালী। যাহারা চিরকাল চুরি করিয়া না আসিতেছে, তাহারা কখনও এ ভাবে জহরত চুরি করিয়া পলাইতে পারিত না— বিশেষতঃ তাহারা সঙ্গে করিয়া নিশ্চয়ই অনেক যন্ত্র আনিয়াছিল, নতুবা এত নিঃশব্দে সিন্দুক খুলিতে পারিত না—যাহাদের চুরিই ব্যবসায়, তাহারা ব্যতীত অপরে এরূপ যন্ত্র সংগ্রহ করিতে পারে না।

“আমি যেরূপ প্রমাণ পাইলাম, তাহাতে বেশ বুঝিয়াছি, ইহা এই সহরের চোরের কাজ। তাহারা জহরত চুরি করিয়া নিশ্চয়ই কলিকাতায় লইয়া গিয়াছে, সেখানে ইহা বিক্রয়ের চেষ্টা করিবে। ইহাদের ধরিতে হইলে ইহাদের জন্য কলিকাতার দিকে দৃষ্টি রাখিতে হইবে।

“এই বাড়ির কোন চাকর তাহাদের সাহায্য করিয়াছে কি না জানিবার জন্য আমি বিশেষ অনুসন্ধান লইয়াছি, দাসদাসীদিগের সকলকেই নানা প্রশ্ন করিয়াছি, তাহাদের মধ্যে কেহ যে এই তস্করদিগকে সাহায্য করিয়াছে, এরূপ আমার বোধ হয় না।

“বাড়ির পশ্চিমে ময়দানে আমি দস্যুদিগের পদ-চিহ্ন দেখিতে পাইয়াছি। দুই-তিনজন লোক এই মাঠের উপর দিয়া অথচ পা টিপিয়া টিপিয়া গিয়াছে। স্পষ্ট জানা যাইতেছে, দস্যুগণ ওই মাঠ দিয়া বাড়ির পশ্চাতে আসিয়াছিল। বাড়ির প্রাচীর দেখিলেও ইহা স্পষ্ট জানিতে পারা যায়।

“খুব সম্ভব, দস্যুগণ তাহাদের কাজ শেষ করিয়া এই পথেই ফিরিয়া গিয়াছিল। বোধ হয়, তাহারা এখান দিয়া মাঠের পথে হাঁটিয়া বহুদূর গিয়া রেলে উঠিয়াছিল, তাহার পর কলিকাতায় রওনা হইয়াছিল। আরও আমার—”

এইখানে পাঠ বন্ধ করিয়া সুহাসিনী দেবী মৃদুহাস্যে দাসীর হাতে কাগজখানি দিয়া বলিলেন, “এখনই ফেরৎ দিয়া আইস।”

দাসী অবনীকান্তের হস্তে কাগজ ফিরাইয়া দিলে তিনি বলিলেন, “আপনাদের কর্ত্রীঠাকুরাণী রিপোর্ট পড়িয়া কি মত প্রকাশ করিলেন?”

“কিছুই না।”

“কিছুই না, অসম্ভব! সে কি? আমি তাঁহার মতামত শুনিতে চাই—আমি বৃথা পরিশ্রম করিব না।”

“তাঁহাকে কি বলিব?”

“বল যে, তিনি দ্বারের পার্শ্বে থাকিবেন, আমি তাঁহাকে দুই-চারিটি কথা জিজ্ঞাসা করিব।”

দাসী চলিয়া গেলে অবনীকান্ত বিরক্তভাবে বলিলেন, “কি আপদেই পড়িলাম! যত মূৰ্খ লইয়া কাজ—তাহাতে আবার স্ত্রীলোক!”

অবনীকান্ত মহাচিন্তায় পড়িয়া নানাবিধ মুখভঙ্গী করিতে লাগিলেন।

* * * *

কিয়ৎক্ষণ পরে দাসী আসিয়া বলিল, “তিনি বলিলেন, এ বিষয়ে তিনি মতামত কি বলিবেন; তিনি স্ত্রীলোক, তাঁহার কাজকর্ম্ম সমস্তই তাঁহার মাতুল মহাশয় দেখেন, আপনি তাঁহার সঙ্গে দেখা করিলেই সব কাজ হইবে।”

অবনীকান্ত অতি বিকট ভ্রুকূটি করিয়া বলিলেন, “কি মুস্কিল—ইহাতে কোন কাজই হয় না।”

এই সময়ে তথায় একটি যুবক প্রবেশ করিলেন। অবনীকান্তের দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিপাত করিয়া তিনি বলিলেন, “আপনি কে?”

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – সহযোগী

অবনীকান্তও যুবকের দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিপাত করিতেছিলেন। বলিলেন, “আমি ডিটেকটিভ অবনীকান্ত।”

যুবক মৃদুহাস্যে বলিলেন, “ও আপনিই অবনী বাবু? ভাল হইল।”

“কি ভাল হইল?”

“আপনি যে কাজে নিযুক্ত, আমিও সেই কাজে একটু নিযুক্ত হইয়া পড়িয়াছিলাম।”

“আপনিও তবে একজন ডিটেকটিভ?”

“না, আমি বাড়ির কর্ত্রীর সম্বন্ধে ভ্রাতা হই; সুতরাং তাঁহার হইয়া এ বিষয়ে একটু অনুসন্ধান লইতেছিলাম।”

“মহাশয়ের নাম?”

“সুরেন্দ্রনাথ বলিয়াই জানুন।”

“ভালই হইল; আপনার সহিত কথা চলিবে। আমি এ বিষয়ে অনুসন্ধান করিয়া এক রিপোর্ট লিখিয়াছি।”

“ওঃ! ইহার মধ্যে রিপোর্ট পর্য্যন্ত লেখা হইয়া গিয়াছে?”

“হাঁ, একবার পড়িয়া দেখুন না।”

সুরেন্দ্রনাথ অবনীকান্তের সুদীর্ঘ রিপোর্ট পড়িতে বাধ্য হইলেন, পড়া শেষ হইলে মৃদু হাসিয়া বলিলেন, “ভাল সময়েই আমি আসিয়া পড়িয়াছি—ভালই হইল, আপনার সহিত এ বিষয়ে আলোচনা চলিবে।”

“বলুন, আপনি এ সম্বন্ধে কি জানেন? সুহাসিনী দেবী এ অনুসন্ধানের ভার আমার উপরে দিয়াছেন। আমি আর এখানে বৃথা সময় নষ্ট করিতে ইচ্ছা করি না। কলিকাতায় গিয়া দস্যুদিগের সন্ধান লইতে হইবে। বলুন কিছু বলিবার থাকে, শীঘ্র শীঘ্র বলিয়া ফেলুন।”

সুরেন্দ্রনাথ বলিতে লাগিলেন, “আমি যাহা জানিয়াছি, তাহা শীঘ্র শীঘ্রই বলা হইবে। আমি ঘোড়ায় চড়িয়া বাহির হইয়াছিলাম, এখান হইতে অনেক দূর পর্য্যন্ত গিয়াছিলাম। অনেক লোকের সঙ্গে দেখা করিয়া অনেক কথা জিজ্ঞাসা করিয়াছি; জানিতে পারিলাম, ‘চুরির রাত্রে প্রায় দুইটার সময়ে বালি স্টেশনে দুইজন লোক রেলে উঠিয়াছিল; কিন্তু তাহাদের চেহারা ঠিক কিরূপ, তাহা আমি ঠিক জানিতে পারি নাই। রাত্রে অন্ধকার ছিল, স্টেশনমাস্টার ইহাদের ভাল করিয়া দেখিতে পান নাই। বোধ হয়, এই দুইজন লোকই এই চুরি শেষ করিয়া এইরূপে পলাইয়াছে।”

অবনীকান্ত পকেট হইতে নোটবই বাহির করিয়া সমস্ত বিষয় লিখিয়া লইতে লাগিলেন। তাহার পর গম্ভীরভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এই পৰ্য্যন্ত?”

“হাঁ, আপাতত এই পর্য্যন্ত—আর কিছু জানিতে পারি নাই।”

“ইহাতেই অনেক কাজ হইবে। এখন আমি বিদায় হইব।”

“তাহা হইলে আপনার এখানকার অনুসন্ধান শেষ হইল?”

“হাঁ উপস্থিত, তবে আমি আবার আপনার সঙ্গে দেখা করিব, অনেক কথাবার্তাও হইবে,” বলিয়া অবনীকান্ত বিদায় হইলেন। ক্ষণপরে সুরেন্দ্রনাথ উচ্চ হাস্য করিয়া উঠিলেন।

মোহনলাল ভৃত্যরূপে এতক্ষণ দ্বারের পার্শ্বে লুক্কায়িতভাবে দণ্ডায়মান ছিলেন, এইবার তিনি বাহির হইয়া আসিলেন।

সপ্তম পরিচ্ছেদ – ইন্দুবালা সম্বন্ধে

আমরা জহরতের ব্যাপার ত্যাগ করিয়া এক্ষণে ইন্দুবালার সম্বন্ধে দুই-এক কথা বলিব। ইন্দুর পিতা নরহরি বাবু বড়লোক—সম্ভ্রান্তলোক, তাহাই তাঁহার কন্যার অন্তর্দ্বানে এত হুলস্থূল পড়িয়াছে। নরহরি বাবুও কন্যার—বিশেষতঃ গোপালের বিশেষ অনুসন্ধান করিতেছে। তিনিও অবনীকান্তকে এই অনুসন্ধানে নিযুক্ত করিয়াছেন।

ইন্দুকে সুহাসিনী বড় ভালবাসিতেন। উভয় পরিবারে সদ্ভাব থাকায় প্রায়ই যাওয়া-আসা ছিল, এইজন্যই ইন্দুকে সুহাসিনী কনিষ্ঠা ভগিনীবোধে ভাল ‘সিতেন। তাহার প্রতি সুহাসিনীর এই স্নেহ- মমতা করিবার আরও একটি কারণ ছিল। ইন্দুবালার স্বামী দীনেন্দ্রকুমার অল্প বয়সেই পাগল হইয়া গিয়াছিল। তাহার কখন কখন জ্ঞান হইতে এইমাত্র—সে কাহারও সহিত বড় একটা কথা কহিত না, প্রায় বাড়িতে থাকিত না—প্রায়ই আহার করিত না, ছিন্ন মলিন বস্ত্র পরিয়া পথে পথে ঘুরিয়া বেড়াইত। যদি সে কখনও কোন কথা কহিত, তাহা হইলে সে কেবল সুহাসিনীর সহিত—যদি কখন আহার করিত, তাহা হইলে সে কেবল সুহাসিনীর বাড়িতে—সুহাসিনী কিছু দিলে।

তাহার স্ত্রীর কুকীর্তির বিষয় দীনেন্দ্রকুমার শুনিয়াছিল; কিন্তু কিছু বুঝিতে পারিয়াছিল কি না, সন্দেহ। সুহাসিনীও ভাবিয়াছিলেন যে, বোধ হয় দীনেন্দ্র ইন্দুর বিষয় কিছুই বুঝিতে পারে নাই; কিন্তু একদিন তিনি দেখিলেন, প্রকৃত তাহা নহে। দীনেন্দ্র কেবল যে ইহা বুঝিয়াছে, তাহা নহে, হৃদয়ে বড় বেদনা পাইয়াছে; কেবল তাহাই নহে, ইন্দুকে উদ্ধার করিয়া তাহাকে রক্ষা করিবার জন্য মনে মনে সংকল্প করিয়াছে, সঙ্গে সঙ্গে গোপালকে দণ্ড দিবেও স্থির করিয়াছে। সুহাসিনী ভাবিয়াছিলেন দীনেন্দ্ৰ কোন খবরই রাখে না—এখন দেখিলেন সে সকল সংবাদই রাখে।

একদিন দীনেন্দ্র আসিলে সুহাসিনী তাহাকে স্নান করাইয়া দিলেন, ছিন্নবস্ত্র ছাড়াইয়া পরিস্কার পরিচ্ছন্ন বস্ত্র পরাইয়া দিলেন, আহার করাইলেন। এ কার্য্য আর কেহ করিতে পারিত না—আর কেহ এ চেষ্টা করিলে দীনেন্দ্ৰ ভয়ানক দুৰ্দ্দান্ত হইয়া উঠিত।

আহারাদির পর দীনেন্দ্র নিজেই ইন্দুর কথা উত্থাপন করিল। তাহাতেই তাহার মনের ভাব সুহাসিনী কথায় কথায় জানিতে পারিয়াছিলেন। ইহাতে পরে যে একটা ভয়াবহ কাণ্ড ঘটিবে, তাহাও তিনি বুঝিতে পারিয়াছিলেন।

একদিন দ্বিপ্রহরের সময়ে দীনেন্দ্র সহসা অতি ব্যস্তভাবে সুহাসিনীর বাড়িতে আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহার চক্ষু সর্ব্বদাই লাল, এক্ষণে আরও লাল হইয়াছে, তাহার মুখও রক্তিমাভ—তাহার ভাব দেখিয়া সুহাসিনী ভীত হইলেন; বুঝিলেন, আজ দীনেন্দ্র কোন কারণে অতিশয় উত্তেজিত হইয়া উঠিয়াছে। সুহাসিনী তাহাকে যত্ন করিয়া বসাইয়া বলিলেন, “কি হইয়াছে?”

“আসিয়াছে।”

“আসিয়াছে—কে আসিয়াছে?”

‘তাহার খবর।”

“কাহার—ইন্দুবালার? কে খবর আনিল?”

“পত্র লিখিয়াছে, সে এই বাড়িতে আসিতে চায়।”

“তোমার শ্বশুর কি বলিতেছেন?”

“তিনি তাহাকে আনিতে চাহেন না।”

“তোমার এখন ইচ্ছা কি?”

“আসে আসুক।”

“আচ্ছা, তাহাকে তাঁহারা বাড়িতে না লয়েন, আমি তাহাকে আমার বাড়িতে লইব; কি বল, তোমার কোন আপত্তি নাই?”

দীনেন্দ্রকুমার এ কথায় অতিশয় সন্তুষ্ট হইল। মৃদুহাস্য করিল, তৎপরে নীরবে উঠিয়া গেল। লোক-লজ্জা ভয়ে নরহরি বাবু কন্যাকে বাড়িতে আনিতে ইচ্ছা করিলেন না; কিন্তু সুহাসিনী সমাজের ভয় করিলেন না, যদিই বা ইন্দু ভুল করিয়া থাকে, তাহাকে একেবারে পরিত্যাগ করা কৰ্ত্তব্য নহে। সুহাসিনী স্বয়ং নরহরি বাবুর বাড়িতে গিয়া অনেক বুঝাইলেন, অবশেষে তিনি নিজের বাড়িতে তাহাকে আনিতে চাহিলেন। যাহাই হউক, অবশেষে সুহাসিনীরই জয় হইল। পাপিষ্ঠা ইন্দুবালাকে গোপনে গৃহে আনা হইল।

ইন্দু গোপালের সঙ্গে গিয়াই তাহার চরিত্র বুঝিতে পারিয়াছিল, সেইদিন হইতে সে তাহার সহিত দেখা পর্য্যন্ত করে নাই, কলিকাতায় পৌঁছিয়াই তাহাকে বিদায় করিয়া সে তাহার এক আত্মীয়ার বাড়িতে গিয়া উঠিয়াছিল, সেইখানেই সে বাস করিতেছিল, সেইখান হইতেই বাড়িতে পত্র লিখিয়াছিল। কিন্তু গোপাল তাহার অনুসরণ করিতে ছাড়ে নাই। সে তাহার সন্ধানে শ্রীরামপুরে ফিরিল; কিন্তু তাহার দেখা পাইল না। তাহার দেখা পাইবার জন্য সে শ্রীরামপুরে তাহার পরিচিত একটি পতিতা স্ত্রীলোকের বাড়িতে লুকাইয়া থাকিল। তাহার হাতে কিছু পয়সা ছিল, তাহাতে যতদিন চলিল, সে মদ খাইয়া কাটাইতে লাগিল। যখন তাহার পয়সা ফুরাইয়া গেল, তখন সেই স্ত্রীলোকের উপরে অত্যন্ত অত্যাচার আরম্ভ করিল।

একদিন গোপাল তাহার নিকটে মদের পয়সা চাওয়ায় সেই স্ত্রীলোক দিতে অস্বীকার করে। গোপাল তখন তাহাকে নির্মমভাবে প্রহার করিতে আরম্ভ করিয়া দিল। তখন রাত্রি প্রায় আটটা, স্ত্রীলোকটি তাহার প্রহারে মর্মান্তিক চিৎকার করিতে লাগিল।

সহসা কে তাহার গৃহমধ্যে প্রবেশ করিয়া গোপালকে সবলে এক পদাঘাত করিল। গোপাল সেই একটিমাত্র পদাঘাতে ধরাশায়ী হইয়া পড়িল। তিনি ডাক্তার বরেন্দ্রনাথ।

বরেন্দ্রনাথ নত হইয়া স্ত্রীলোকটিকে বলিলেন, “তোমাকে কোন্ জায়গায় মারিয়াছে?”

সে কাতরভাবে বলিল, “আমায়—আমায় বড় লাগে নাই।”

এই সময় গোপাল টলিতে টলিতে উঠিতেছিল, সঙ্গে সঙ্গে কাপড়ের ভিতর হইতে একখানা ছোরা বাহির করিতেছিল। সে সোজা হইয়া দাঁড়াইবার পূর্ব্বেই বরেন্দ্রনাথ পদাঘাতে তাহাকে আবার দূরে নিক্ষেপ করিলেন।

এই সময়ে প্রতিবেশীরা এই গোলযোগ শুনিয়া তথায় আসিয়া উপস্থিত হইল। বরেন্দ্রনাথ তাহাদের বলিলেন, “আমি এই পথে যাইতেছিলাম, এই স্ত্রীলোকটির চিৎকার শুনিয়া এখানে আসিয়া দেখি যে, এ লোকটা ইহাকে অত্যন্ত নির্দয়ভাবে মারিতেছে, তাহাই ইহাকে একটু শিক্ষা দিয়াছি—ইহাকে তোমরা দেখ, আমি চলিলাম।”

এই সময়ে গোপাল আবার কষ্টে সোজা হইয়া দাঁড়াইয়াছিল, অনেক লোক দেখিয়া আর কিছু বলিল না—সত্বরপদে তথা হইতে পলাইল।

এদিকে এই পৰ্য্যন্ত।

অষ্টম পরিচ্ছেদ – প্রোথিত মৃতদেহ

ডাক্তার বরেন্দ্রনাথ কিছুই জানিতেন না; কিন্তু কয়েক দিন হইতে একজন লোক দিন-রাত্রি তাঁহার অনুসরণ করিতেছিল। আবার তাঁহার সেই অনুসরণকারীর আর একজন অনুসরণ করিতেছিল। ইহারা কে, তাহা তিনি কখন লক্ষ্য করেন নাই। তাঁহার মনে কখনও কোন সন্দেহের উদ্রেক হয় নাই। তবে কেহ কেহ লক্ষ্য করিয়াছিল, যে, গোপাল প্রায় ডাক্তারের বাড়ির চারিদিকে ঘুরিয়া বেড়ায়; তবে সে এখন এমন মাতাল হইয়া গিয়াছিল যে, কেহই তাহার সহিত কথা কহিত না। অতি অবনতি হইলে মানুষের যাহা হয়, তাহাই তাহার হইয়াছে। তাহাকে পথের কুকুরের ন্যায় ঘুরিয়া বেড়াইতে হইত, কেহ আর তাহার দিকে দৃপাত করিত না।

একদা মধ্যরাত্রে বরেন্দ্রনাথ গৃহে ফিরিয়া আসিলেন। ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত হইয়া তিনি শুইয়া পড়িলেন। একখানা বহি লইয়া দেখিতে লাগিলেন, বাহিরে তখন মহাদুর্যোগ—অবিশ্রান্ত বৃষ্টি হইতেছিল।

সহসা সবলে কে তাঁহার দ্বারে করাঘাত করিতে লাগিল। তিনি বৃষ্টির শব্দে প্রথমে সে শব্দ শুনিতে পান নাই; কিন্তু পরে শুনিতে পাইলেন, কে সবলে দ্বারে আঘাত করিয়া ডাকিতেছে, “বরেন—বরেন!”

তিনি গলার স্বরে বুঝিলেন, তাঁহার প্রতিবেশী উকিল মাধবলাল; তাঁহার বাড়ি, ডাক্তারের বাড়ির ঠিক সম্মুখে—রাস্তার অপর পার্শ্বে। ডাক্তার সত্বর উঠিয়া দরজা খুলিয়া দিতে গেলেন। এত রাত্রে মাধবলাল কেন তাঁহাকে ডাকিতেছেন, তাহা তিনি স্থির করিতে পারিলেন না।

দরজা খুলিলে মাধবলাল বলিলেন, “বরেন, তুমি কি বাপু একদম কালা হইয়াছ? তোমার কুকুর ডাকিয়া ডাকিয়া মরিল, শুনিতে পাইতেছ না? দেখ, তার কি হইয়াছে।”

“কেন, কি হইয়াছে?”

“এস দেখিবে—সে কি একটা টানিয়া বাহির করিয়াছে।”

ডাক্তার কোন কথা না বলিয়া উকিল মাধবলালের সহিত চলিলেন।

বরেন্দ্রনাথের বাড়ির সম্মুখে একটা ছোট বাগান ছিল—তাহার এক কোণে তাঁহার কুকুর ভয়ানক চিৎকার করিতেছে ও পা দিয়া মাটি সরাইতেছে। তাঁহারা উভয়ে সত্বর তথায় আসিলেন। আসিয়া দেখিলেন, তাঁহার কুকুর মাটি ও পাতার স্তূপের ভিতর হইতে একটা মানুষের পা টানিয়া বাহির করিতেছে; আর মৃতদেহের উপর হইতে সম্মুখের দুই পা দিয়া চারিদিকে মাটি বিক্ষেপ করিতেছে। বরেন্দ্রনাথ লম্ফ দিয়া গিয়া তাঁহার কুকুরের গলা ধরিয়া টানিয়া তাহাকে একদিকে লইয়া আসিলেন, তৎপরে মাধবলালের দিকে ফিরিয়া বলিলেন, “দাঁড়াও, এটাকে আগে বাঁধি।”

এই বলিয়া তিনি কুকুরটার গলা ধরিয়া টানিয়া বাড়িতে আনিলেন, তৎপরে তাহাকে বাঁধিয়া রাখিয়া ছুটিয়া আবার তথায় গেলেন।

মাধবলাল বলিলেন, “এ কি! এ কে–-এ কাহার পা?”

বরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “যাহারই হউক, দেখিতে হইতেছে—এস।”

“কি করিতে চাও?”

“মাটিগুলা সরাইতে হইবে। দাঁড়াও, আমি কোদাল আনিতেছি।”

“দুই-একজন লোক ডাকি।”

“না, এখন গোল করিবার আবশ্যক নাই,” বলিয়া বরেন্দ্রনাথ আবার বাড়ির দিকে ছুটিলেন। মাধবলাল সেই বীভৎস দৃশ্য হইতে চক্ষু ফিরাইয়া অন্যদিকে চাহিয়া রহিলেন।

তখনই বরেন্দ্রনাথ দুইখানা কোদাল লইয়া ছটিয়া আসিলেন; মাধবলালকে বলিলেন, “লও তুমি এইদিককার মাটি সরাও, আমি অন্যদিকটার সরাই—সাবধানে।”

দুইজনে কোদাল ধরিলেন, শীঘ্রই মাধবলাল মাটি অনেকটা সরাইয়া ফেলিলেন, তখন একখানা হাত, একখানা পা, পরে খানিকটা শরীর বাহির হইয়া পড়িল।

“এ যে এক ভয়ানক হত্যাকাণ্ড দেখিতেছি,” বলিয়া মাধবলাল সরিয়া দাঁড়াইলেন। ততক্ষণে বরেন্দ্রনাথ মাটি সরাইয়া একটা মনুষ্যের সম্পূর্ণ মৃতদেহ আবিষ্কার করিলেন, কেবল মুখখানা তখনও ঢাকা রহিয়াছে। তিনি উঠিয়া দাঁড়াইয়া পরিশ্রান্তভাবে হাঁপাইতে লাগিলেন।

মাধবলাল কম্পিতকণ্ঠে বলিলেন, “কে—এ?”

“দেখি, বলিয়া বরেন্দ্রনাথ মৃতদেহের মুখের মাটি সরাইতে আরম্ভ করিলেন। তিনি ডাক্তার- মৃতদেহ দেখিয়া তাঁহার তত ভয় হয় নাই; কিন্তু এ দৃশ্য দেখিয়া মাধবলালের হৃদকম্প উপস্থিত হইয়াছিল।

বরেন্দ্রনাথ ক্রমে মৃতদেহের মুখ হইতে মাটি সরাইয়া লইলেন, মুখ বাহির হইয়া পড়িল কিন্তু অন্ধকারে তাঁহারা সে মুখ ভাল দেখিতে পাইলেন না। এই সময়ে বিদ্যুৎ চমকিল। তাহাতে উভয়েই মৃতদেহের মুখ স্পষ্ট দেখিতে পাইলেন।

মাধবলাল বলিয়া উঠিলেন, “কি ভয়ানক—এ যে সেই লোকটা!”

“কে?”

“নরহরির সরকার—গোপাল।”

নবম পরিচ্ছেদ – বরেন্দ্রনাথ বিপন্ন

প্রকৃতই ইহা গোপালের মৃতদেহ! বরেন্দ্রনাথ ভাবিয়া পাইলেন না, তাঁহার বাড়ির বাগানের ভিতরে এই গোপালের মৃতদেহ কিরূপে আসিল। বরেন্দ্রনাথের মুখ সহসা শুকাইয়া গেল। মাধবলাল কিছুই বুঝিতে না পারিয়া বিস্মিতভাবে তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন। কিয়ৎক্ষণ উভয়েই নীরবে দণ্ডায়মান রহিলেন।

অবশেষে মাধবলাল বলিলেন, “এখন কি বল?”

বরেন্দ্রনাথ কম্পিতকণ্ঠে বলিলেন, “কি বলিব—প্রকৃতই লোকটাকে আমি চিনিতাম না, তবে নাম শুনিয়াছিলাম। একদিন ইহাকে কোথায় দেখি–”

মধ্যপথে বাধা দিয়া মাধবলাল অত্যন্ত ব্যগ্রভাবে বলিলেন, “এখন সে সব কথা থাক—এখন কি করা উচিত, তাহাই স্থির কর।”

বরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “পুলিসে খবর দিতে হইবে—ইহা ত আর লুকাইবার জিনিস নহে।” মাধবলাল বলিলেন, “তাহা ত নিশ্চয়, তবে এখান থেকে চল।”

সহসা বরেন্দ্রনাথ যেন সেইখানে প্রস্তরে পরিণত হইয়া গেলেন। তিনি চেষ্টা করিয়াও তাঁহার পা তুলিতে পারিতেছিলেন না।

মাধবলাল বলিলেন, “আর এখানে দাঁড়াইয়া কি হইবে, চল।”

বরেন্দ্রনাথ তখন আত্মসংযম করিয়া বলিলেন, “হাঁ, চল।”

উভয়ে তখন বাগান ছাড়িয়া গৃহে আসিলেন। বরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “তুমিই পুলিসে খবর দেও, আমার শরীর আজ নিতান্ত খারাপ।”

এই বলিয়া তিনি সত্বরপদে অন্য গৃহে প্রস্থান করিলেন। তাঁহার ভাবে বিস্মিত হইয়া মাধবলাল কিয়ৎক্ষণ তাঁহার দিকে চাহিয়া রহিলেন। তৎপরে তিনি নিজের বাড়িতে ফিরিলেন এবং সমস্ত বৃত্তান্ত লিখিয়া তাঁহার ভৃত্যকে দিয়া পত্র থানায় পাঠাইলেন।

সেই দুর্যোগের রাত্রে পুলিস বড় সাড়া দিল না। পরদিন প্রাতে আসিয়া লাস চালান দিল—সঙ্গে সঙ্গে অনুসন্ধানও আরম্ভ হইল।

* * * *

সন্ধ্যার সময়ে মাধবলাল, বরেন্দ্রনাথের বাড়িতে আসিলেন। বরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “এস— বসো।”

মাধবলাল বসিয়া বলিলেন, “এখন কেবল প্রতিবেশী বন্ধু বলিয়া আসিলাম; কিন্তু পরে উকিল হইয়া আসিতে হইবে, দেখিতেছি।”

বরেন্দ্রনাথ বিষাদিত হাসি হাসিয়া বলিলেন, “আমার উকিলের দরকার হইবে না।”

“এখন আমার ডাক্তারের দরকার নাই, তাহাই বলিয়া কি কাল আমার ডাক্তার দরকার হইতে পারে না?”

“তাহা হইলে তুমি বলিতে চাও যে, কাল আমার উকিলের দরকার হইবে?”

“বরেন, আমার ত তাহাই বোধ হয়।”

“ওঃ! তাহা হইলে পুলিসের অনুসন্ধানে এই প্রকাশ পাইবে যে, গোপালকে আমিই হত্যা করিয়াছি—আনুষঙ্গিক প্রমাণ, প্রথমে আমি একদিন গোপালকে পদাঘাত করিয়াছিলাম, তাহার সহিত আমার ঝগড়া ছিল, এই গেল এক নম্বর। তাহার পর দুই—গোপালের মৃতদেহ আমার বাগানের ভিতর পোতা ছিল। তাহার পর তিন নম্বর, আমার নামাঙ্কিত একখানা রুমালও মৃতদেহের সহিত পাওয়া গিয়াছে—এই ত মাধব?”

বরেন্দ্রনাথের অবিচলিত ভাব দেখিয়া মাধবলাল বিস্মিত হইলেন—তাঁহার দৃঢ়তা দেখিয়া সন্তুষ্ট হইলেন; বলিলেন, “তোমার হৃদয়ের বলের প্রশংসা করি, কিন্তু—”

বরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “তুমি বলিবে আমার বিরুদ্ধে গুরুতর প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে; কিন্তু কতদূর কি প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে, তাহা তুমিও জান না, আমিও জানি না।”

মাধবলাল বলিলেন, “এ কথা ঠিক—বিশেষ প্রমাণ আমি ত দেখি না, তবে পুলিস যাহা বলিতেছে, তাহাই বলিতেছি।”

বরেন্দ্রনাথ বিরক্ত হইয়া বলিলেন, “হাঁ, পুলিসে এমন অনেক কথাই বলে, দেখা যাক, কত দূরে গিয়া দাঁড়ায়, তাহার পর আমার কাছে আসিও—বন্ধুভাবে—উকিলভাবে নয়, তখন সকল কথা খুলিয়া বলিব।”

মাধবলাল -সেদিন চলিয়া গেলেন। বরেন্দ্রনাথও বেশ-বিন্যাস করিয়া বাহির হইলেন।

যখন এদিকে তাঁহাদের উভয়ে এইরূপ কথাবার্তা হইতেছিল, সেই সময়ে সুহাসিনীর বাড়ির উদ্যানে একজন মালী একটি বালকের সহিত মৃদুস্বরে কথা কহিতেছিল।

মালী বলিল, “তাহার পর?”

বালক বলিল, “তাহার পর আমি আপনার কথা মত সেই সব লোকের উপরে নজর রাখিয়াছি। সেই লোকটা মাতাল গোপাল—দিনের বেলায় বড় বাহির হয় না। রাত্রে বাহির হইয়া ডাক্তারের বাড়ির কাছে ঘুরিতে থাকে, আর তোমার অবনীকান্ত, সে তাহার পিছনে পিছনে যায়। কাল রাত্রেও ঐ রকম দুজনে যাইতেছিল; দেখিলাম, একটু আগে ডাক্তারও যাইতেছে; কিন্তু অবনীকান্ত কিছু দূরে গিয়া একদিকে চলিয়া গেল, আমি তোমার হুকুমমত তাহার পিছনে পিছনে চলিলাম।”

“খুব ভাল করিয়াছ।”

“তাহার পর অবনীকান্ত ফিরিয়া বাসায় আসিল—আমি অনেকক্ষণ সেইখানে দাঁড়াইয়া রহিলাম; দেখিলাম, অবনীকান্ত আর বাহির হইল না, তখন আমি বাড়িতে ফিরিলাম।”

“বেশ, তাহার পর?”

“তাহার পর আজ সকালে শুনিলাম, মাতাল গোপাল খুন হইয়াছে, তাহাকে ডাক্তারের বাগানে পাওয়া গিয়াছে। আমি যদি—” চুপ।

“কি যদি?”

“যদি গোপালের পিছনে থাকিতাম, তাহা হইলে তাহাকে কে খুন করিয়াছে, দেখিতে পাইতাম।”

“ও! সে বিষয়ে আমাদের কোন প্রয়োজন নাই—অবনীর উপরে নজর রাখিবে—এখন যাও।” বালক আর কিছু না বলিয়া তথা হইতে চলিয়া গেল। মালীও ঝোপের মধ্যে কোথায় অন্তর্হিত হইয়া গেল।

মালী—মোহনলাল। বালক তাঁহারই একজন অনুচর।

দশম পরিচ্ছেদ – খুনের অনুসন্ধান

পুলিস গোপালের মৃত্যুর অনুসন্ধান আরম্ভ করিয়াছে। ইনস্পেক্টর প্রথমেই মাধবলালের এজাহার লইলেন। মাধবলাল যেরূপে কুকুরের ডাক শুনিয়া বরেন্দ্রনাথকে ডাকিয়া তুলিয়াছিলেন, পরে তাঁহারা দুইজনে মিলিয়া কিরূপে মৃত্তিকা স্তূপ হইতে মৃতদেহ বাহির করিয়াছিলেন, সকলই একে একে বলিলেন। ইনস্পেক্টর সকল লিখিয়া লইয়া বরেন্দ্রনাথকে ডাকিলেন।

বরেন্দ্রনাথ বলিলেন, মাধব বাবু যাহা বলিলেন, তাহার অধিক তাঁহার কিছু বলিবার নাই। মৃতব্যক্তির বিষয় তিনি কিছুই জানেন না। একদিন লোকটা একটি স্ত্রীলোককে প্রহার করিতেছিল বলিয়া, তাহাকে পদাঘাতে দূরে ফেলিয়াছিলেন, আর একদিন তাঁহার পিছনে পিছনে আসায় ধাক্কা দিয়া তাড়াইয়া দিয়াছিলেন।

“আপনি কি কখনও তাহাকে শাসাইয়াছিলেন?”

“বোধ হয়, শেষবার আমি তাহাকে শাসাইয়া থাকিব—কি বলিয়াছিলাম মনে নাই। আমি পূর্ব্বেও তাহাকে আমার পিছনে পিছনে সর্ব্বদা আসিতে দেখিতাম।”

ইনস্পেক্টর একখানি রুমাল বাহির করিয়া বলিলেন, “এ রুমালখানি কি আপনার?”

ডাক্তার রুমালখানি হাতে লইয়া বলিলেন, “হাঁ, এ রুমাল আমার—আমার নাম ইহাতে লিখিত আছে।”

“তাহা হইলে এ রুমাল আপনার—আপনি সম্প্রতি রুমালখানি হারাইয়াছিলেন?”

“তাহা বলিতে পারি না।”

“কেহ কি এখানা চুরি করিয়াছিল বলিয়া বোধহয়?”

“জানি না।”

“তাহা হইলে আপনি কি বলিতে পারেন না, কিরূপে এই রুমাল গোপালের মৃতদেহে আসিল?”

“না, আমি জানি না।”

ইনস্পেক্টর একখানা ছোরা তুলিয়া লইয়া বলিলেন, “এই ছোরা আপনি কি পূর্ব্বে কখনও দেখিয়াছেন?”

“হাঁ, এই রকম একখানা ছোরা দেখিয়াছি।”

“এইরূপ ছোরা কি আপনার আছে?”

“হাঁ, আছে।”

“এ ছোরা কি অনেকেই ব্যবহার করে?”

“না, তবে ডাক্তারমাত্রেরই কাছে পাওয়া যায়।”

“একখানা ছাড়া এ রকম ছোরা কি আপনার অধিক আছে?’

“না, তাহা নাই।”

“তাহা হইলে বুঝিতে হইবে, এই রকম ছোরা একখানা আপনি হারাইয়াছেন।”

“না, আমার হারায় নাই।”

“আচ্ছা, এখন এই পৰ্য্যন্ত।”

তৎপরে এক ব্যক্তি আসিল, সে মৃত গোপালেরই মত একজন লোক, তাহা তাহাকে দেখিয়াই বুঝিতে পারা যায়। পুলিস ইহাকেও সংগ্রহ করিয়াছে।

লোকটা বলিল, “আমি একদিন গোপালের সঙ্গে রাত্রে ছিলাম, সে ডাক্তার বাবুর কাছে গেলে তিনি রাগিয়া উঠিয়া তাঁহাকে মারিতে আসিলেন।”

ইনস্পেক্টর জিজ্ঞাসিলেন, “ডাক্তার বাবু কি কিছু বলিয়াছিলেন?”

“হ্যাঁ।”

“কি বলিয়াছিলেন—বল।”

“তিনি বলিয়াছিলেন, ‘তুমি আমার জীবন অশান্তিময় করিয়াছ, ভাল চাও ত, এখান হইতে এখনই চলিয়া যাও, না হইলে—”

“না হইলে কি—কোন কথা গোপন করিও না।”

“না হইলে—তিনি বলিলেন, ‘তোমার মৃত্যু—তোমার মৃত্যু নিশ্চয়।”

“আর কিছু কি বলিয়াছিলেন?”

“না।”

“আচ্ছা, যাও।”

এই পৰ্য্যন্ত জবানবন্দী লইয়া ইনস্পেক্টর সেদিন প্রস্থান করিলেন।

* * * *

পরদিবস গোপালকে হত্যা করিবার অপরাধে ইনস্পেক্টর, ডাক্তার বরেন্দ্রনাথকে ধৃত করিয়া চালান দিলেন। সকলেই শুনিল, পুলিস ডাক্তারের বিরুদ্ধে আরও অনেক অমোঘ প্রমাণ সংগ্ৰহ করিয়াছে।

বলা বাহুল্য, এই ব্যাপারে চারিদিকে মহা হুলস্থূল পড়িয়া গেল। ডাক্তার বরেন্দ্রনাথকে সকলেই চিনিত, তিনি তথাকার একজন খুব সম্ভ্রান্ত লোক, তিনি খুন করিয়াছেন, ইহা কেহ সহজে বিশ্বাস করিতে চাহিল না।

তিনি ধৃত হইলে এই সংবাদ পাইবামাত্র সুরেন্দ্রনাথ ছুটিয়া মাধবলালের বাড়িতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। বলিলেন, “ইহারা কি সব শুনিয়াছে? ডাক্তারকে খুনি বলিয়া গ্রেপ্তার করিয়াছে কি বজ্জাতি! কেবল তাঁহার নিকট হইতে টাকা আদায় করিবার মৎলব। বেটারা কি ভয়ানক লোক!”

মাধবলাল বলিলেন, “স্থির হও, ইহাতে বরেন্দ্রের ক্ষতি ব্যতীত উপকার হইবে না।”

“চুপ করিয়া থাকি কিরূপে?”

“চুপ করিয়া থাকিতে হইবে না। তাঁহাকে ছাড়াইয়া আনিতে বিশেষ কষ্ট পাইতে হইরে— সুতরাং আমাদের সকলকেই এখন হইতে বিশেষ সাবধানে কাজ করিতে হইবে।”

“আপনি যাহা বলিতেছেন, তাহা ঠিক; কিন্তু ডাক্তারের উপরে যাহারা এরূপ দোষারোপ করিতে পারে, বলুন দেখি, তাহাদের কি বলিতে ইচ্ছা হয়। আপনাকে বরেন্দ্রবাবুর পক্ষ-সমর্থন করিতে হইবে।”

“তাহা ত করিবই—তবে তোমার সঙ্গে এ বিষয়ে পরামর্শ করিতে চাই, কিন্তু এখন নয়, অন্য সময়—তাহার পর বরেন্দ্রবাবুর সঙ্গে দেখা করিব।”

“তাঁহাকে জেলে লইয়া গিয়াছে—কি ভয়ানক!”

“খুনের মোকদ্দমা!”

“জামিনে কি খালাস দিতে পারিবেন?”

“খুনের মোকদ্দমায় জামিন নাই। এ সম্বন্ধে পরে কথাবার্তা কহিব।”

এই বলিয়া তিনি সুরেন্দ্রনাথকে বিদায় দিয়া কক্ষান্তরে প্রবেশ করিতেছিলেন, এই সময়ে তাঁহার পশ্চাৎ হইতে কে ডাকিল, “মাধবলাল বাবু!”

মাধবলাল চমকিত হইয়া ফিরিলেন। দেখিলেন, একটি প্রৌঢ় ভদ্রলোক। মাধবলাল বলিলেন, “আপনিই কি আমায় ডাকিলেন?”

ভদ্রলোকটি অতি সমাদরে তাঁহার হাত ধরিয়া বলিলেন, “হাঁ, আমার নাম বিপিনকৃষ্ণ—আমি ও উকিল। আপনার সঙ্গে বিশেষ কথা আছে—এখনই।”

“অন্য সময় হইলে কি ভাল হয় না?”

“না, এখনই—আমি ডাক্তার বরেন্দ্র বাবুর সম্বন্ধে কিছু বলিতে চাই।”

“তবে আসুন।”

একাদশ পরিচ্ছেদ – কারাকক্ষে

মাধবলাল তাঁহাকে ভিতরে আনিয়া একটি প্রকোষ্ঠে বসাইলেন।

প্রায় একঘণ্টা ধরিয়া উভয়ে মৃদুস্বরে কথা কহিলেন। অবশেষে বিপিনকৃষ্ণ বলিলেন, “তাহা হইলে এখন আপনি সকল বুঝিলেন?”

“হাঁ, আমি এখনই বরেন্দ্র বাবুর সহিত দেখা করিতে যাইতেছি—সুরেন্দ্র বাবুও আমার সঙ্গে যাইবে। যে কথাবার্তা হয়, তাহা আপনাকে আসিয়া জানাইব—এই ত?”

“হাঁ, ঠিক এই—তবে এখন আমি সুরেন্দ্র বাবুর সঙ্গে দেখা করিতে চাই না। আপনারা ফিরিয়া আসিলে দেখা করিব।”

মাধবলাল হাকিমের অনুমতি পাইয়া, সুরেন্দ্রনাথকে সঙ্গে লইয়া জেলে ডাক্তারের সহিত দেখা করিতে চলিলেন।

জেল-দারোগা অনুমতিপত্র পাইয়া যে গৃহে বরেন্দ্রনাথ ছিলেন, তথায় তাঁহাদিগকে রাখিয়া চলিয়া গেল।

মাধবলাল জানিতেন, এখানে বাজে কথায় সময় নষ্ট করা চলে না; তাহাই তিনি একেবারেই আসল কথা তুলিলেন; “বরেন আমিই তোমার মোকদ্দমা চালাইব, স্থির করিয়াছি; বুঝিতেছি এ সকল কিছুই নহে—পুলিসেরই কাণ্ড।”

ডাক্তার ম্লানহাস্যের সহিত বলিলেন, “মাধবলাল, তুমি যে বিপদে আমাকে ত্যাগ করিবে না, তাহা আমি জানি; কিন্তু কথা হইতেছে, আমার সাপক্ষে যাহা বলিবার তাহা তোমাকে নিজে গড়িতে হইবে, আমি গড়িতে পারিব না। তুমি এজাহার সব পড়িয়াছ।”

“থাক তোমার এজাহার, আমি তোমাকে দুই-একটা কথা জিজ্ঞাসা করিতে চাহি, তাহার পর সে সব দেখিয়া লইব।”

বরেন্দ্রনাথ কিয়ৎক্ষণ নীরবে রহিলেন; তৎপরে ধীরে ধীরে মাধবলালকে বলিলেন, “বন্ধু, তুমি কি যথার্থ বিশ্বাস কর, এ খুনে আমার কোন হাত নাই?”

“বিশ্বাস করি? নিশ্চয়ই তুমি নিৰ্দ্দোষ।”

“আর তুমি সুরেন?”

সুরেন্দ্রনাথ যেন আকাশ হইতে পড়িয়া কহিলেন, “না, না—কখনই ইহা সম্ভবপর নয়— আপনি কখনই খুন করিতে পারেন না।”

বরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “তোমাদের যে আমার উপরে এত বিশ্বাস আছে, তাহাতে যে আমি কি সন্তুষ্ট হইলাম, তাহা বলিতে পারি না; কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমার বিরুদ্ধে যে প্রমাণ সংগৃহীত হইয়াছে, তাহা আমি খণ্ডন করিতে পারিব না। আমার সাপক্ষে বলিবার কিছু নাই।”

সুরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “সহস্ৰ আছে—এই আপনার কোন শত্রু আপনাকে জব্দ করিবার জন্য আপনার রুমাল ও ছোরা চুরি করিয়াছিল, তাহারই এ সব কাজ। সেই শত্রুই যত অনিষ্টের মূল; এখন কথা হইতেছে—এই মহাগুপ্ত শত্রু কে?”

বরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “আমার শত্রু নাই।”

সুরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “তোমার মাথা খারাপ হইয়াছে।”

মাধবলাল কিয়ৎক্ষণ নীরব থাকিয়া বলিলেন, “বরেন, আমি তোমার পক্ষে উকিল হই, ইহাতে তোমার কোন আপত্তি আছে কি?”

বরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “কিছুমাত্র নহে, এ বিপদে তুমিই আমার একমাত্র ভরসা। তবে বলিয়াছি ত, আমি তোমাকে কোন সহায়তাই করিতে পারিব না।”

মাধবলাল বলিলেন, “ইহার অর্থ, তুমি ইচ্ছা করিয়াই আমায় এ বিষয়ে কোন সাহায্য করিবে না।”

বরেন্দ্রনাথ হতাশভাবে বলিলেন, “তুমি যাহা ভাবিতেছ, তাহা ঠিক নহে, প্রকৃতই আমাকে রক্ষা করিবার আমার কোন ক্ষমতাই নাই।”

“তাহাই বোধ হইতেছে—রুমালখানা কি যথার্থই তোমার?”

“হাঁ।”

“ছোরাখানা?”

“হাঁ, তবে তুমি আমার ঘর একবার দেখিতে পার।”

“পুলিসে তাহা দেখিয়াছে।”

“তাহা হইলে পুলিস আমার ঘরে আমার ছোরা পায় নাই?”

“না। একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, তোমার গৃহে কেহ কি যাইতে পারে?”

“ইচ্ছা করিলে সকলেই পারে।”

“সম্ভবতঃ কে গিয়াছিল?”

“তাহা আমি কেমন করিয়া বলিব?”

“এই যে ইহারা বলিতেছে যে, তুমি এই গোপালকে পূৰ্ব্বে, জানিতে, এ কথা কত দূর ঠিক?”

“যথার্থই আমি ইহাকে এখানেই দুই-একবার দেখা ব্যতীত কখনও দেখি নাই।”

“সে তোমাকে জানিত?”

“সম্ভব, আমাকে অনেক লোকেই চিনে।”

“তাহা হইলে আত্মরক্ষা করিবার জন্য কি তুমি কোন কথা বলিতেছ না?”

“আমার কিছুই বলিবার নাই।”

মাধবলাল বহুক্ষণ নীরবে বসিয়া রহিলেন। তৎপরে ধীরে ধীরে বলিলেন, “তাহা হইলে তোমার মোকদ্দমা এইরূপ দাঁড়াইতেছে যে, তোমার বাড়ির বাগানে একজনের মৃতদেহ পাওয়া গেল। একখানা ছোরা তাহার বুকে বিদ্ধ, তাহার সঙ্গে একখানা রুমাল। এই রুমালে তোমার নাম লেখা, আর এই ছোরাখানাও তোমার। ভাল, তাহার পর প্রমাণে জানা যাইতেছে যে, এই লোকটার সহিত তোমার বিবাদ ছিল, তুমি তাহাকে একদিন শাসাইয়াছিলে, এই লোকটা তোমার সম্বন্ধে কিছু জানিত, তোমার বাড়ির নিকটে ঘুরিত। একদিন রাত্রে সে তোমারই বাড়ির বাগানে হত হইল, তোমারই ছোরা তাহার দেহে—তোমারই বাগানে তাহার দেহ মাটিতে পুতিয়া রাখা হইল, কেমন নয় কি? এই সকল প্রমাণের বিরুদ্ধে তোমার কিছুই বলিবার নাই, এই ত? সুন্দর মোকদ্দমা—কেমন না?”

‘কেন মাধব, আমার পক্ষ সমর্থন করিতে গিয়া তুমি তোমার এত বড় যশঃ মানে জলাঞ্জলি দিবে। আমার ভাগ্যে যাহা আছে, তাহাই হউক।”

“সে বিষয়ে আমি পরে বিবেচনা করিব। উপস্থিত এই পর্য্যন্ত থাকিল। যখন তুমি আমার কোনই সাহায্য করিবে না, তখন আজ এই পর্য্যন্ত থাক। এস হে সুরেন!”

সুরেন্দ্রনাথ তখন বরেন্দ্রনাথকে অনেক অনুনয়-বিনয়, তর্ক-বিতর্ক করিলেন। মাধবলাল প্রতিবন্ধক দিয়া বলিলেন, “চলে এস সুরেন্দ্র; দেখি, আমি নিজের চেষ্টায় এই আত্মঘাতী মহামূর্খকে রক্ষা করিতে পারি কি না।”

তখন মাধবলাল বন্ধু বরেন্দ্রনাথের প্রতি মনে মনে অত্যন্ত চটিয়াছিলেন; সুতরাং বলা শেষ করিয়া মাধবলাল মহা ক্রোধভরে চলিয়া যাইতেছিলেন; কিন্তু বরেন্দ্রনাথ তখন বলিলেন, “দাঁড়াও, একটা কথা তোমায় বলিতে পারি। আমি লোকটার মৃতদেহ তত ভাল করিয়া দেখি নাই, তবুও যেটুকু দেখিয়াছি, তাহাতে আমার বোধ হয়, যে ছোরা তাহার বুকে পাওয়া গিয়াছে, সে ছোরায় তাহার মৃত্যু হয় নাই, ছোরাখানা দেখিলে বুঝিবে, ইহা হৃপিণ্ড পর্য্যন্ত যায় নাই, সুতরাং এ ছোরায় কিছুতেই তাহার মৃত্যু হইতে পারে না।”

মাধবলাল ফিরিয়া বলিলেন, “দেখিতেছি, তোমার একটু চৈতন্য দেখা দিয়াছে। কি আপদ! এ কথা এতক্ষণ বল নাই কেন? যাহা হউক, এখনও অনেক সময় আছে। যে ডাক্তার দেহ পরীক্ষা করিয়াছেন, আমি এ সম্বন্ধে তাঁহাকে বিশেষরূপে প্রশ্ন করিব—যাহা হউক, একটা কিছু পাওয়া গেল। এখন চলিলাম, কাল আবার দেখা করিব।”

এই বলিয়া মাধবলাল সুরেন্দ্রনাথের হাত ধরিয়া তাহাকে টানিতে টানিতে বাহিরে আনিয়া ফেলিলেন। সুরেন্দ্রনাথও আজ ভারি রাগিয়া গিয়াছে, বরেন্দ্রনাথের প্রতি অজস্র তীব্র মন্তব্য প্ৰকাশ করিতে লাগিল; আপন মনে বলিল, “জানিতাম, ডাক্তার হইলেই বুদ্ধিমান লোক হয়, এইজন্য তাহাকে ভক্তি, মান্য করিতাম—এখন দেখিতেছি, এমন পাগল দুনিয়ায় আর নাই—একেবারে বদ্ধ পাগল।”

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – ক্রোধের কারণ

সুরেন্দ্রকে সঙ্গে লইয়া মাধবলাল গৃহে ফিরিয়া দেখিলেন, উকিল বিপিনকৃষ্ণ তাঁহার অপেক্ষায় বসিয়া আছেন। তিনি মাধবলালকে দেখিয়া বলিলেন, “দেখা হইল?”

মাধবলাল বিরক্তভাবে বলিলেন, “হাঁ, হইল।”

“তাহার পর?”

“যাহা আপনি বলিয়াছিলেন, ঠিক তাহাই।

“তিনি আত্মরক্ষা করিতে চাহেন না?”

“না, ইহাই ত বুঝিলাম।”

বিপিনকৃষ্ণ, সুরেন্দ্রনাথের দিকে চাহিয়া বলিলেন, “সুরেন্দ্র বাবু বসুন, আমি আপনাকে একবার ভাল করিয়া দেখিতে চাই।”

সুরেন্দ্রনাথ তাঁহার অদ্ভুত কথায় বিস্মিত হইলেন; কিন্তু কোন কথা বলিলেন না, অধিকন্তু সেইখানে একখানা চেয়ার দখল করিয়া নীরবে বসিয়া রহিলেন।

বিপিনকৃষ্ণ বলিলেন, “এখন একেবারে কাজের কথা আরম্ভ হউক। সুরেন্দ্র বাবু, আমি ডাক্তার বরেন্দ্র বাবুকে রক্ষা করিতে আসিয়াছি, এ সব বিষয়ে আমার বিশেষ বহুদর্শিতা আছে। (মাধবলালের প্রতি) মাধব বাবু, আপনি অনুগ্রহ করিয়া কাগজ কলম লউন, আমাদের যাহা তাঁহার সাপক্ষে বলিবার আছে—লিখিয়া লউন।”

মাধবলাল বলিলেন, “আমাদের নহে—আপনার—”

“না হয় তাহাই হইল—আমার। এখন লিখুন।”

“বলুন, আমি প্রস্তুত আছি।”

“বরেন্দ্র বাবু জানেন, কে তাঁহার রুমাল চুরি করিয়াছিল—কে তাঁহার ছোরা চুরি করিয়াছিল?”

সুরেন্দ্রনাথ বিস্মিত হইয়া উভয়ের মুখের দিকে চাহিলেন। মাধবলাল কেবলমাত্র বলিলেন, “হাঁ।”

বিপিনকৃষ্ণ বলিতে লাগিলেন, “কোন কারণে তাঁহার রুমাল ও ছোরা চোরকে তিনি ঢাকিয়া রাখিতে চাহেন। কোনমতে তাহার নাম প্রকাশ করিতে ইচ্ছা করেন না। তাহার পর তাঁহার সন্দেহ আছে, যে ব্যক্তি ছোরা চুরি করিয়াছিল, নিজে সে-ই গোপালের বুকে ছোরা মারিয়াছে কি না।”

সুরেন্দ্রনাথ আরও বিস্ময়ের ভাব প্রকাশ করিলেন। বিপিনকৃষ্ণ বলিলেন, “বরেন্দ্র বাবুর বিরুদ্ধে একটা ষড়যন্ত্র হইতেছিল, আর আমার বিশ্বাস, তিনি ইহা জানিতেন।”

এই বলিয়া তিনি তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে সুরেন্দ্রনাথের মুখের দিকে চাহিলেন। সুরেন্দ্রনাথ ভয়ে বা লজ্জায় তাঁহার দিকে মুখ তুলিয়া চাহিতে পারিলেন না।

বিপিনকৃষ্ণ বলিলেন, “আমাদের প্রথমে চেষ্টা করিয়া জানিতে হইবে, বরেন্দ্র বাবু কাহাকে সন্দেহ করিতেছেন—আর কেন তিনি তাহার নাম বলিতেছেন না।”

মাধবলাল বলিলেন, “সহজ কাজ নহে।”

বিপিনকৃষ্ণ বলিলেন, “অধিক কঠিনও নহে। আমার বিশ্বাস আমাদের উপস্থিত বন্ধু সুরেন্দ্র বাবু এ বিষয়ে আমাদের সাহায্য করিতে পারেন।”

সুরেন্দ্রনাথ বলিয়া উঠিলেন, “আমি! আমি কি করিতে পারি। আপনি সম্পূর্ণ ভুল করিতেছেন—আমি কিছুই জানি না।”

বিপিনকৃষ্ণ মহা মুরুব্বীর ন্যায় গম্ভীরভাবে মাথা নাড়িয়া বলিলেন, “অধীর হইবেন না, সুরেন্দ্র বাবু অধীর হইবেন না, এ অধীর হইবার সময় নহে। আমরা তিন জন বরেন্দ্র বাবুকে রক্ষা করিবার জন্য এখানে সমবেত হইয়াছি। আপনি হয় ত জানেন না, আপনার একটা কথায় বরেন্দ্র বাবু রক্ষা পাইতে পারেন। আপনি আমার প্রশ্নের প্রকৃত উত্তর দিবেন, না প্রকৃত কথা জানিবার জন্য আমাদের ডিটেকটিভ নিযুক্ত করিতে হইবে?”

সুরেন্দ্রনাথ কিয়ৎক্ষণ নীরবে বসিয়া রহিলেন। তৎপরে বলিলেন, “আপনি কি জিজ্ঞাসা করিতে চাহেন, করুন। আমি সর্ব্বদাই ডাক্তার বাবুর যাহাতে উপকার হয়, তাহা করিতে প্রস্তুত আছি।”

বিপিনকৃষ্ণ জিজ্ঞাসিলেন, “হাঁ, এ কথা ভাল—প্রথম বরেন্দ্র বাবুর প্রতি কাহার রাগ, তাহা কি আপনি জানেন?”

“না, আমি কিছুই জানি না।”

“সুহাসিনীর জহরত কে লইয়াছে—তাহাও কি আপনি জানেন না, কাহাকে সন্দেহও করেন না?”

“না, আমি কিরূপে জানিব?”

“আপনি কি সুহাসিনীকে ভালবাসেন?”

“তিনি সম্বন্ধে আমার ভগিনী হয়েন।”

“আপনার সঙ্গে ডাক্তারের বিশেষ বন্ধুত্ব আছে?”

“হাঁ, তাহা সকলেই জানে।”

“আপনি সৰ্ব্বদাই ডাক্তারের গৃহে যাইতেন?

“সর্ব্বদা।”

“না। আপনি দীনেন্দ্রকুমারকে চেনেন?”

“যথার্থই চিনি।”

“তিনি পাগল?”

“হাঁ, একেবারে বদ্ধ পাগল।”

“তিনিও কি সর্ব্বদা ডাক্তারের বাড়ি যাইতেন?”

“কখনও কখনও।”

“যেদিন গোপাল খুন হয়, সেদিন গিয়াছিলেন?”

“হতে পারে, আমার তা ঠিক মনে নাই।”

বিপিনকৃষ্ণ বিরক্ত হইয়া বলিলেন, “আপনি এইরূপ বন্ধুকে রক্ষা করিতে চাহেন? দেখিতেছি, আপনি যাহা জানেন, বলিবেন না—অবশেষে আমাদেরই বলিতে হইবে। নরহরি বাবুর সহিত আপনার বিশেষ পরিচয় আছে, তাঁহার কন্যা ইন্দুকেও আপনি চিনেন?”

“চিনিব না কেন?”

“নরহরি বাবুর সহিত ডাক্তারের সদ্ভাব কেমন?”

“খুব ভাল।”

“না, আমার আর কিছু জিজ্ঞাস্য নাই,” বলিয়া বিপিনকৃষ্ণ উঠিয়া দাঁড়াইলেন। বলিলেন, “মাধব বাবু, আজ এই পর্য্যন্ত থাক, কাল আবার আপনার সঙ্গে দেখা করিয়া এ বিষয়ে আলোচনা করিব।” অনন্তর বিপিনকৃষ্ণ বিদায় হইলেন। তখন সুরেন্দ্রনাথ মহারুষ্ট হইয়া বলিলেন, “এ অসভ্য লোকটা কে?”

“ইনিও একজন উকিল।”

“কোথাকার উকিল?”

“কলিকাতার উকিল। ডাক্তারকে রক্ষা করিবার জন্য এখানে আসিয়াছেন।”

“এত মাথাব্যথা?”

“ঠিক বুঝিতে পারি নাই, জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম কে তাহাকে নিযুক্ত করিয়াছেন।”

“কই, বরেন্দ্র বাবু এ লোকটার কথা আমাদের কিছু বলিলেন না।”

“না, জিজ্ঞাসা করি নাই।”

“লোকটা মস্ত জুয়াচোর, তাহার কোন ভুল নাই—কি আশ্চর্য্য আপনি এ সকল লোককেও প্রশ্রয় দেন?”

“এমন বিপদের সময়ে কাহাকেও রাগাইতে নাই।”

“আপনার কাছে না হইতে পারে, আমি হইলে এ সকল লোককে বাড়িতে ঢুকিতে দিই না, লোকটা যে রকম ভাবে আমাকে প্রশ্ন করিতেছিল, তাহাতে যেন আমিই খুন করিয়াছি কি আস্পর্দ্ধা!”

“না, এ কথা তিনি বলেন নাই।”

“আর কি রকম করিয়া বলিতে হয়?”

“যাক, পরের কথায় আবশ্যক নাই, এখন সময় মত দেখা করিও, আমি একটু ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছি।”

অগত্যা সুরেন্দ্রনাথ বিদায় লইলেন। মাধবলাল উঠিয়া বাড়ির ভিতরে প্রস্থান করিলেন।

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ – উদ্বেগের কারণ

ডাক্তার খুনের দায়ে গ্রেপ্তার হওয়ায় জহরত চুরির কথা লোকে প্রায় ভুলিয়া গিয়াছিল। সুহাসিনীও তাঁহার অভিভাবক মাতুলের বিপদে তাঁহার বহুমূল্য জহরতের কথা ভুলিয়াছিলেন; কিন্তু দুই ব্যক্তি জহরতের কথা ভুলেন নাই—একজন মোহনলাল—অপর অবনীকান্ত।

মোহনলাল সুহাসিনীর বাড়িতে মালী হইয়া কাজ করিতেছিলেন, মধ্যে মধ্যে তিনি অন্তৰ্দ্ধান হইতেন। তাঁহার অন্তর্দ্ধানের অবস্থায় তাঁহাকে যদি সুহাসিনীর কোন প্রয়োজন হয়, তবে তাঁহার ঠিকানায় তাঁহাকে পত্র লিখিতে বলিয়াছিলেন।

মোহনলাল অন্তর্হিত হইয়াছেন, অনেক দিন তাঁহার কোন সংবাদ নাই, এদিকে অবনীকান্ত সুহাসিনীকে তাঁহার এক রিপোর্ট পাঠাইয়াছেন। তাহা এই;

“আপনার জহরত চুরির রীতিমত অনুসন্ধান চলিতেছে। প্রথমে আমি স্থির করিয়াছিলাম যে, সাধারণ দস্যুতে আপনার জহরত চুরি করিয়াছে, এখন অনেক নূতন প্রমাণ সংগৃহীত হওয়ায় আমাকে বাধ্য হইয়া মত পরিবর্ত্তন করিতে হইতেছে।

“যে দুই ব্যক্তি এখান হইতে গিয়া বালীতে রেলে উঠে, অনুসন্ধানে জানিলাম, তাহাদের সহিত এ চুরির কোন সম্বন্ধ নাই। চুরি আপনার ঘরের কোন লোকেই করিয়াছে, সত্যের অনুরোধে এ কথা প্রকাশ করিতে হইতেছে। অনুসন্ধানে সত্য প্রকাশ করাই আমাদের প্রধান কৰ্ত্তব্য।

“দুইটি উল্লেখযোগ্য প্রমাণ সংগৃহীত হইয়াছে, এক ছিন্ন রুমাল—দ্বিতীয়—ক্লোরাফর্ম্মের শিশি। অনুসন্ধানে অব্যর্থ প্রমাণ পাইয়াছি যে, রুমালখানি ডাক্তার বরেন্দ্রবাবুর, দ্বিতীয়তঃ ক্লোরাফর্ম্মের শিশিটিও তাঁহার, এ সকল প্রমাণ প্রয়োজনমত আপনার সম্মুখে উপস্থিত করিব।

“আরও একটা প্রমাণ— ক্লোেরাফর্ম্ম প্রয়োগ করিবার প্রথা, যে ব্যক্তি ক্লোরাফৰ্ম্ম দিয়াছিল, সে জানিত, কতটা ক্লোরাফর্ম্ম দিলে আপনার অনিষ্ট হইবে না, কেবল আপনি ঘুমাইয়া পড়িবেন মাত্র। ডাক্তার বরেন্দ্র বাবু ইহা জানিতেন, তিনি ডাক্তার—কয় ফোঁটা ক্লোরাফর্ম্ম দিতে হইবে, তাহা তিনি ভালই জানিতেন।

“এতদ্ব্যতীত চোর যে জানালা দিয়া গৃহে প্রবেশ করিয়াছিল, সেখানে তাহার পায়ের দাগ ছিল, সেই দাগ যে ডাক্তার বরেন্দ্র বাবুর, সে বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ। সুতরাং এ অবস্থায় আপনার জহরত কে চুরি করিয়াছে তাহা আপনাকে বোধ হয়, বিশেষ করিয়া খুলিয়া বলিতে হইবে না। ডাক্তার খুনি বলিয়া আপাততঃ ধৃত হইয়াছেন, এক্ষণে আমি যে প্রমাণ সংগ্রহ করিয়াছি, তাহা প্রকাশ করিলে তিনি নিশ্চয়ই আপনার জহরত বাহির করিয়া দিবেন।

“আপনার মতামত কি জানিবার জন্য বৈকালে আপনার বাড়িতে উপস্থিত হইব।

অবনীকান্ত।”

এই রিপোর্ট পাঠ করিয়া সুহাসিনীর হৃদয় ক্রোধে পূর্ণ হইয়া গেল, তিনি অত্যন্ত রুষ্টচিত্তে অবনীকান্তের আগমন প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন।

বৈকালে অবনী আসিয়া উপস্থিত হইলে তিনি দাসীকে দিয়া বলিলেন, “আপনি অবান্তর কথা বলিতেছেন—এ সব পাগলের কথা, আপনাকে আর আমার জহরতের অনুসন্ধান করিতে হইবে না। আপনি এখন অন্য কাজ করিতে পারেন।”

অবনীকান্ত বলিলেন, “এ বড় আশ্চৰ্য্য কথা! আপনি একটা অনুসন্ধানে নিযুক্ত করিলেন, যখন আমি তাহাতে কৃতকাৰ্য্য হইলাম—তখন আপনি বলিতেছেন, ‘আপনি এ অনুসন্ধান আর করিতে পাইবেন না,’ অনুসন্ধানের বাকি আর আছে কি?”

সুহাসিনী বলিলেন, “আপনার পারিশ্রমিক যাহা হইয়াছে, তাহা আপনি আমার ম্যানেজারকে বলিলে, তিনি এখনই আপনাকে তাহা দিবেন। এখন আপনি বিদায় হউন।”

অবনীকান্ত বলিলেন, “হাঁ, এ কথার উপরে কথা নাই। আপনি আমাকে নিযুক্ত করিয়াছিলেন, এখন আপনিই ছাড়িয়া দিতেছেন, ইহাতে আমার কি বলিবার থাকিতে পারে? তবে আমরা পরের জন্য পরিশ্রম করি বটে, কিন্তু সত্য অনুসন্ধানই আমাদের মূল উদ্দেশ্য। আমি এ সম্বন্ধে সত্য আবিষ্কার করিতে কৃতকার্য্য হইয়াছি, সুতরাং এ সত্য প্রকাশ না করিলে পাপীর প্রশ্রয় দেওয়া হয়, সমাজের প্রতি ঘোর অন্যায় করা হয়, আইন-বিগর্হিত কাজ করিতে হয়। এমন কি ইহার জন্য আমাকে আইনানুসারে দণ্ড পাইতে হয়। আমি যে সকল প্রমাণ পাইয়াছি, তাহা যদি পুলিসের নিকটে না প্রকাশ করি, তবে আইনানুসারে আমাকে দণ্ডিত হইতে হইবে।”

সুহাসিনী বলিলেন, “তাহা হইলে আমি আপনাকে এ অনুসন্ধানে নিযুক্ত না রাখিলেও আপনি নিজ হইতেই এ অনুসন্ধান করিবেন?”

“না, তাহা করিব না। আমি যে প্রমাণ সংগ্রহ করিয়াছি, তাহা পুলিসকে দিব, তাহারা যাহা ভাল বিবেচনা করে, তাহাই করিবে, আমাকে সাক্ষী করিলে আমি যাহা জানি, তাহা বলিব—এই পৰ্যন্ত।”

সুহাসিনী বুঝিলেন, এই লোককে নিযুক্ত করিয়া তিনি ভাল কাজ করেন নাই, এ ব্যক্তি ইচ্ছা করিয়াই বরেন্দ্রনাথের অনিষ্ট চেষ্টা করিতেছে। এই বিপদের সময়ে এই লোক তাঁহার আরও বিপদ ঘটাইবে—বরেন্দ্রনাথ যে খুন করিয়াছেন, তাহা সুহাসিনী এক মুহুর্ত্তের জন্যও বিশ্বাস করেন নাই, তিনি তাঁহার জহরত চুরি করিয়াছেন, এ কথা মনে করিলেও মহাপাপ। আজ এই মহা দুর্বৃত্ত অবনীকান্তের মুখ তিনি কিরূপে বন্ধ করিবেন? এ নিশ্চয়ই পুলিসে গিয়া সকল কথা বলিবে। এখন সময় লওয়াই একমাত্র উপায়। তিনি দাসীকে দিয়া বলাইলেন, “এরূপ গুরুতর বিষয়ের উত্তর আমি এখনই দিতে পারি না। আমি বিবেচনা করিয়া দেখি—তিন দিন আপনি এ কথা কাহারও কাছে প্রকাশ করিবেন না। তাহার পর আমার কাছে আসিলে, আমি বিবেচনা করিয়া যাহা স্থির করি, সেইদিনে বলিব।”

“বেশ, আমি সন্তুষ্ট হইলাম। তিন দিন পরে আবার দেখা করিব,” বলিয়া অবনীকান্ত বিদায় লইলেন। সুহাসিনী কি করিবেন, মনে মনে তাহা স্থির করিয়াছিলেন। মোহনলাল এখানে থাকিলে তিনি তাঁহারই শরণাপন্ন হইতেন, তিনি বুঝিয়াছিলেন যে, অবনীকান্তের মত মোহনলাল দুরাত্মা নহেন, তিনি হৃদয়বান্, বিশেষ ক্ষমতাপন্ন, তিনি অবনীর হাত হইতে তাঁহাকে ও ডাক্তারকে রক্ষা করিতে পারিবেন। তাহাই তিনি তাঁহাকে অনতিবিলম্বে নিম্নলিখিত পত্র লিখিলেন;–

“মহাশয়,

দুইদিনের মধ্যে আমার সহিত সাক্ষাৎ করিবেন; ডাক্তারের আরও বিপদ। অবনীকান্তের নিকটে আমি তিন দিন সময় লইয়াছি, বোধ হইতেছে, তিনি ডাক্তারের সর্ব্বনাশের চেষ্টা করিতেছেন। আমার বিশ্বাস হইয়াছে, ডাক্তারের কোন শত্রু এই অবনীকান্তের সাহায্যে তাঁহার সর্ব্বনাশের চেষ্টা পাইতেছে, তাহারাই তাঁহাকে খুনি বলিয়া গ্রেপ্তার করাইয়াছে—শীঘ্র আসিবেন, আপনার পরামর্শ না লইয়া কোন কাজই করিতে পারিতেছি না।”

পত্র পাঠাইয়া সুহাসিনী দুইদিন অত্যন্ত উদ্বিগ্নভাবে কাটাইলেন। তিনি তাঁহার মনের যন্ত্রণা কাহাকেও বলিতে পারেন না, তাঁহার হৃদয়ের উদ্বেগ, তাঁহাকে বাধ্য হইয়া নীরবেই সহ্য করিতে হইতেছে।

যদি মোহনলাল তাঁহার পত্র না পান, যদি মোহনলাল না আসেন, তাহা হইলে তিনি কি করিবেন, অবনীকান্তকে কি বলিবেন? তাঁহাকে বিদায় করিয়া দিলে তৎক্ষণাৎ গিয়া পুলিসে সংবাদ দিবেন। তাহা হইলে বিপদ আরও ঘনীভূত হইয়া উঠিবে। এখন সুহাসিনী উভয় সঙ্কটাপন্না।

সুহাসিনী ভাবিলেন, “টাকা লইয়া কি অবনীকান্ত নীরবে থাকিবেন? তিনি যত টাকা চাহেন, দিতে প্রস্তুত আছি, টাকা লইয়া আমি কি করিব? কিন্তু টাকা পাইয়া কি তিনি নিরস্ত হইবেন? নিশ্চয় অবনীক্বান্ত তাঁহার মাতুলের পরম শত্রু।”

দুইদিন উত্তীর্ণ হইয়া যায়, এই সময়ে একটা ভিক্ষুক বালক সুহাসিনীর দ্বারে ভিক্ষার জন্য আসিল। সুহাসিনীর লোকজন তাহাকে তাড়াইয়া দিতেছিল, কিন্তু সে বালক এমনই উচ্চৈঃস্বরে ক্রন্দন আরম্ভ করিয়া দিল যে, ব্যাপারটি কি দেখিবার জন্য সুহাসিনীকেও অগ্রসর হইতে হইল।

বালক তাঁহাকে দেখিবামাত্র “মা ঠাকুরুণ, এরা আমাকে মারছে, বলিয়া ছুটিয়া একেবারে উপরে তাঁহার কাছে আসিয়া পড়িল। নিমেষমধ্যে সুহাসিনীর হাতের মধ্যে একখানি চিঠি গুঁজিয়া দিয়া বালক মৃদুস্বরে বলিল, “মোহনলাল।”

সুহাসিনী তাঁহার লোকজনকে তিরস্কার করিয়া বিদায় দিয়া বালককে বলিলেন, “এস, আমি নিজে তোমাকে ভিক্ষা দিব।”

বালক তাঁহার সঙ্গে সঙ্গে চলিল। সুহাসিনী তাহাকে নিজ গৃহমধ্যে লইয়া গিয়া সেই পত্রখানি পড়িলেন। পত্রে মোহনলাল লিখিয়াছেন;—

“জহরত সম্বন্ধে যে কথা হয়, গোপন রাখুন; কিন্তু আর সমস্ত আমাকে খুলিয়া বলুন। অবনী আপনার বাড়ির উপরে বিশেষ দৃষ্টি রাখিয়াছে, সেইজন্য আপনার বাড়িতে আমার নিজের যাওয়া যুক্তিসঙ্গত বিবেচনা করিলাম না। ডাক্তারের জন্য কোন ভাবনা নাই—আমি তাঁহার শত্রুদিগকে নিজের হাতের মধ্যে আনিয়াছি। নিকটেই আছি, আবশ্যক হইলেই দেখা করিব। যত শীঘ্র পারেন, অবনীকে বিদায় করিয়া দিবেন। যদি কিছু বলিবার থাকে—এই ছোকরাকে দিয়া বলিয়া পাঠাইবেন—এই ছোকরা খুব বিশ্বাসী।”

পত্র পাইয়া সুহাসিনী অনেকটা আশ্বস্ত হইতে পারিলেন। বালককে বলিলেন, “তাঁহাকে তুমি বলিবে, তিনি যেরূপ বলিয়াছেন, আমি ঠিক সেইরূপ কাজ করিব। কালই অবনীকে আমি বিদায় করিয়া দিব।”

“তাঁহাকে বলিব—এখন আমি ভিখারী, আমার ভিক্ষা কই—না হইলে লোকে সন্দেহ করিবে যে!”

সুহাসিনী হাসিয়া বাক্স খুলিয়া বালকের হস্তে একটি টাকা দিলেন। সে বলিল, “বাহিরে দেখাতে হবে।”

“তুমিও কি একজন ছোটখাট ডিটেকটিভ না কি?”

“এই দু বৎসর মোহনলাল বাবুর কাছে আছি।”

“একটা কথা জিজ্ঞাসা করিব, তিনি কি এইখানেই আছেন?”

বালক হাসিল, ঘাড় নাড়িল, তৎপরে বলিল, “হাঁ, তিনি এখানে আছেন, কোথায় আছেন, আপনাকে এখন সে কথা বলিব না।”

“তাহা হইলে আমিও আর তোমাকে জিজ্ঞাসা করিতে চাহি না।”

বালক বিদায় হইল। সুহাসিনী জানালা দিয়া দেখিলেন, বালক তাঁহার লোকজনকে টাকাটা দেখাইয়া তাহাদের গালি দিতে দিতে উর্দ্ধশ্বাসে ছুটিয়াছে।

চতুৰ্দ্দশ পরিচ্ছেদ – অবসর

পর দিবস প্রাতেই অবনীকান্ত আসিয়া উপস্থিত। সুহাসিনীও তাঁহার প্রতীক্ষা করিতেছিলেন। দাসীকে মধ্যে রাখিয়া তাঁহাদের উভয়ের যে কথোপকথন হইল তাহাই আমরা লিখিতেছি,

সুহাসিনী বলিলেন, “আপনি আসিয়াছেন।”

অবনীকান্ত বলিলেন, “কথা ঠিক না থাকিলে আমাদের ব্যবসায় চলে না।”

সুহাসিনী বলিলেন, “তাহা হইলে আপনি এ জহরতের অনুসন্ধান এখনও ত্যাগ করেন নাই?”

“আপনার উদ্দেশ্য কি?”

“কাল আপনাকে বলিয়াছি।”

“আপনি বিবেচনা করিবেন, বলিয়াছিলেন।”

“হাঁ, বিবেচনা করিয়াছি।”

“সুরেন্দ্রবাবু বলেন, এ অনুসন্ধান ত্যাগ করা কিছুতেই উচিত নহে।”

“সুরেন্দ্র বাবু আমার অভিভাবক নহেন।”

“তবে আপনি আমাকে এ অনুসন্ধানে আর রাখিতে চাহেন না?”

“না, আপনার যাহা প্রাপ্য লইয়া যান।”

অবনীকান্ত পকেট হইতে একখণ্ড কাগজ বাহির করিয়া দাসীর হাতে দিয়া বলিলেন, “এই আমার পারিশ্রমিকের হিসাব।”

দাসী সেই কাগজখানা লইয়া ভিতরে সুহাসিনীর হাতে দিলে, সুহাসিনীর সেই কাগজখানার উপর তাড়াতাড়ি একবার চক্ষু বুলাইয়া ফিরাইয়া দিয়া বলিলেন, “যাও, ইহার টাকা এখনই দিতে বল। আমার জহরতের অনুসন্ধান এইখানে শেষ হইল।”

অবনীকান্ত বলিলেন, “প্রকৃতই ইহা কি আপনার উদ্দেশ্য?”

“হাঁ, আমি এ সম্বন্ধে আর কিছু করিতে ইচ্ছা করি না।”

অবনীকান্ত গমনে উদ্যত হইলে সুহাসিনী দাসীর দ্বারা জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনার কি এখনও ইচ্ছা যে, আপনি ডাক্তার বরেন্দ্র বাবুর বিরুদ্ধে পুলিসে প্রমাণ দিবেন?”

অবনীকান্ত মৃদুহাস্য করিয়া বলিলেন, “আপনার জহরত চোরের যে সন্ধান করিয়া দিতে পারিবে, আপনি তাহাকে অনেক টাকা পুরস্কার দিবেন বলিয়াছেন।”

“তাহা ঠিক নহে, যে চোর ধরিয়া দিতে পারিবে, তাহাকে দিব।”

“তবে একটা কথা হইতেছে, আপনি যেমন এখন অনুসন্ধান হইতে বিরত হইতেছেন, তেমনই কি পুরস্কার দানের সময় এইরূপ বিরত হইবেন, স্থির করিয়াছেন?”

“না, তাহা নহে।”

“তাহা হইলে যদি আপনার জহরত আর ঐ জহরত চোরকে ধরিয়া দিতে পারি, তাহা হইলে আপনি আমায় পুরস্কার ডবল করিয়া দিতে প্রস্তুত আছেন?”

“হাঁ, তাহা দিব; যদি আপনি আমার জহরত চোরকে ধরিয়া দিয়া তাহাকে বা তাহাদের দলকে জেলে দিতে পারেন, যদি আমি আমার জহরত ফেরৎ পাই, তাহা হইলে আমি যাহা পুরস্কার দিব বলিয়াছিলাম, তাহার ঠিক দ্বিগুণ দিব।”

“তাহা হইলে আমি যে প্রমাণ সংগ্রহ করিয়াছি, তাহা আমি উপস্থিত নিজ হস্তেই রাখিব। এখন বিদায় হইলাম।”

এই বলিয়া অবনীকান্ত বাহিরে আসিয়া, তাঁহার প্রাপ্য টাকা লইয়া সুহাসিনীর বাড়ি পরিত্যাগ করিলেন। পথে আসিয়া অবনীকান্ত বলিলেন, “দেখিতেছি, এই স্ত্রীলোকটি বড় যে-সে মেয়ে নহে। যাহা হউক, দেখা যাক কত দূর কি হয়—হয় এদিক থেকে, না হয় ওদিক থেকে।”

কিয়দ্দূর আসিলে একটা অন্ধ ভিক্ষুক তাঁহার দিকে কম্পিত হস্ত প্রসারিত করিয়া দিল। অবনীকান্ত তাহার হস্তে একটা পয়সা দিবার ভাণ করিয়া বলিল, “রামা, আছিস এখানে, পিছনে পিছনে আয়—কথা আছে—কেউ না টের পায়।”

* * * * *

অবনীকান্ত বাহির হইয়া গেলে সুরেন্দ্রনাথ সুহানিসীর সহিত দেখা করিতে আসিলেন। তাঁহাকে দেখিয়া সুহাসিনী বলিলেন, “তোমাকে আর ডাক্তারের জন্য ভাবিতে হইবে না, আমাদের অপেক্ষা তাঁহার ভাল সহায় জুটিয়াছে।”

“কে তিনি—জানিতে পারি না?”

“না, এখন বলিবার উপায় নাই, আমি অঙ্গীকার করিয়াছি—তবে—” (নীরব। )

“তবে কি?”

“একজন সুদক্ষ ডিটেকটিভ তাঁহাকে রক্ষা করিতেছেন—তাঁহার আর কোন ভয় নাই। তাঁহার নাম আমি এখন বলিতে পারিব না।”

“আশ্চর্য্যের বিষয়! ডাক্তারের অজ্ঞাত বন্ধুর অভাব নাই, একজন অপরিচিত উকিল আসিয়া মাধব বাবুকে তাঁহার মোকদ্দমার সাহায্য করিতেছেন।”

“কে তিনি।”

“কিছুই জানি না। নাম বিপিনকৃষ্ণ। বলেন, কলিকাতার উকিল।”

“ডাক্তারের সঙ্গে পূর্ব্বে তাঁহার আলাপ ছিল?”

“কেমন করিয়া বলিব? ডাক্তারের মুখে কখনও তাঁহার নাম ত শুনি নাই। আরও একটা আশ্চৰ্য্য কথা শুনিবে?”

“কি, বল শুনি।”

“তিনি আমায় লইয়া আগে কিছু টানাটানি করিলেন—সে জেরার ভঙ্গীমাই বা কি—লোকটা ভারি অসভ্য?”

“কেন, তোমাকে জেরা কেন?”

“কেমন করিয়া বলিব? রাগে আমার আপাদমস্তক জ্বলে গিয়াছিল, যেন আমার উপরেই তাঁহার সন্দেহ।”

“কিসের সন্দেহ?”

“আমিই যেন খুনী!”

“কি মুস্কিল! যাক, ডাক্তার খালাস হইবেন?”

“এখন ভগবানের হাত।”

“ভগবান ত আছেন।”

“অনেক সময়ে নাই বলিলেও হয়।”

“ও কথা মুখে আনিও না।”

পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ – বিচারালয়

ডাক্তার বরেন্দ্রনাথের বিচার আরম্ভ হইয়াছে। হুগলির দায়রায় তাঁহার বিচার হইতেছে।

সুহাসিনী প্রত্যহ সর্ব্বদা মোহনলালের প্রতীক্ষায় ব্যাকুলভাবে পথের দিকে চাহিয়া থাকেন, কিন্তু মোহনলালের দর্শন নাই।

মোহনলাল তাঁহাকে লিখিয়াছিলেন যে, তিনি যেরূপে হয় বরেন্দ্রনাথকে রক্ষা করিবেন; কিন্তু কই, তিনি কি করিতেছেন, বরেন্দ্রনাথের বিচার আরম্ভ হইল—এখন তাঁহার রক্ষা পাইবার উপায় কি?

এদিকে ইন্দু অত্যন্ত পীড়িতা হইয়া পড়িয়াছে; তাহার জীবনের কোন আশা নাই। দীনেন্দ্রকুমার আরও উন্মত্ত হইয়াছে। সুরেন্দ্রনাথও সুহাসিনীর সহিত আর দেখা করেন না, সুতরাং সুহাসিনী যে কাহারও সহিত পরামর্শ করিবেন, কাহাকে মনের কথা প্রকাশ করিয়া হৃদয়ের ভার লাঘব করিবেন, সে উপায়ও তাঁহার নাই। মোহনলাল আসিলে যাহা হয় হইত, তিনিও আসিলেন না।

এদিকে বরেন্দ্রনাথের বিচার আরম্ভ হইয়াছে। আদালতে লোকে-লোকারণ্য। একদিকে সরকারী উকিল, অন্যদিকে মাধবলাল। সুহাসিনী মাধবলালকে পুনঃপুনঃ অনুরোধ করিয়া পাঠাইয়াছিলেন, “কলিকাতা হইতে বড় বড় কৌন্সলী আনুন, যত টাকা লাগে, আমি দিব।” মাধবলাল বলিয়া পাঠাইয়াছিলেন, “কোন প্রয়োজন নাই।”

কিছুই বুঝিতে না পারিয়া সুহাসিনী এখন কি অবস্থায় ছিলেন, তাহা বলা বাহুল্যমাত্র।

এদিকে বরেন্দ্রনাথের বিচার আরম্ভ হইল। বরেন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে যে সকল প্রমাণ সংগৃহীত হইয়াছে, তাহা একে একে বিবৃত হইল। তৎপরে সাক্ষীর ডাক পড়িল।

মাধবলাল নীরবে বসিয়া রহিলেন। কোন সাক্ষীকেই তিনি জেরা করিলেন না।

কেবল মৃতদেহ পরীক্ষক সেই ডাক্তারকে তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি মৃতদেহের ক্ষত স্থান বিশেষরূপে পরীক্ষা করিয়াছেন কি?”

“বিশেষরূপে পরীক্ষা করাই আমাদের কর্তব্য।”

“সে কথা আমি জিজ্ঞাসা করিতেছি না, আপনি এই মৃতদেহ পরীক্ষা করিয়াছেন কি না?”

“নিশ্চয়ই করিয়াছি।”

“এই ছোরাতেই কি সে হত হইয়াছিল?”

“না, এ ছোরা ক্ষতস্থান হইতে ছোট ও সরু। ইহাপেক্ষা প্রশস্ত ও দীর্ঘ ছোরায় তাহার মৃত্যু হইয়াছিল।”

“তাহা হইলে এ ছোরায় গোপাল খুন হয় নাই?”

“না।”

“আমার আর কিছু জিজ্ঞাসা করিবার নাই,” বলিয়া মাধবলাল বসিলেন; তৎপরে অন্যান্য সাক্ষীর কাহাকেই তিনি জেরা করিলেন না।

সরকারী উকিল সকল সাক্ষী ডাকিয়া বলিলেন, “এই পর্য্যন্ত। আমার মাননীয় বন্ধু আসামীর পক্ষ হইতে কি বলিবেন, তাহা আমি জানি না, তবে যতদূর প্রমাণ দেওয়া হইল, আসামীই যে হতভাগ্য গোপালকে খুন করিয়াছে, তাহাতে আর কোন সন্দেহ থাকিতেছে না।”

মাধবলাল এইবার উঠিলেন; বলিলেন, “আমি অধিক কিছু বলিতে ইচ্ছা করি না, আমি কেবল একটিমাত্র সাক্ষী ডাকিব, আমার সাক্ষী দীনেন্দ্রকুমার।”

দীনেন্দ্রকুমার আসিয়া কাঠগড়ায় দাঁড়াইল। সকলে বিস্মিতভাবে তাহাকে দেখিতে লাগিল।

মাধবলাল বলিলেন, “সরকারী উকিল মহাশয় পাছে বলেন যে, এই সাক্ষীর মাথা খারাপ, এ উম্মাদ, তাহাই আমি প্রার্থনা করি, হাকিমের সম্মুখে ডাক্তার মহাশয় ইহাকে প্রথমে একবার পরীক্ষা করুন।”

বিচারপতি সরকারী উকিলের দিকে ফিরিয়া বলিলেন, “উহাতে আপনার কিছু আপত্তি আছে?”

“না, ইহাতে আমার কি আপত্তি হইতে পারে?”

ডাক্তার দীনেন্দ্রকে বহুক্ষণ পরীক্ষা করিয়া বলিলেন, “না, ইহার পূর্ব্বে যতই মাথা খারাপ থাকুক না কেন, এখন নাই, বেশ প্রকৃতিস্থ।”

মাধবলাল বলিলেন, “দীনেন্দ্র, কি হইয়াছে, সব হাকিমকে বল।”

দীনেন্দ্রকুমার বলিল, “যেদিন আমার স্ত্রী গোপালের সহিত যায়, সেইদিন হইতে গোপালকে খুন করিবার চেষ্টায় আমি ফিরিতেছিলাম; কিন্তু কোন সুবিধাই করিয়া উঠিতে পারি নাই। একদিন রাত্রে দেখিলাম, গোপাল মাতাল হইয়া ডাক্তারের বাড়ির দিকে যাইতেছে; আমি ছোরা হাতে তাহার অনুসরণ করিয়া চলিলাম। সে ডাক্তারের বাগানের বেড়ার উপরে ভর দিয়া ঝুঁকিয়া ডাক্তারের বাড়ির ভিতরের দিকে কি দেখিতে লাগিল, এই সময়ে আমি পশ্চাদ্দিক হইতে তাহার পৃষ্ঠে পুনঃপুনঃ তিনবার ছোরা মারিলাম, সে অস্পষ্ট শব্দ করিয়া পড়িয়া গেল। আমি তাহাকে টানিয়া ঝোপের ভিতরে রাখিয়া সুহাসিনীর বাড়ির দিকে ছুটিলাম; এ সংসারে কেবল তিনিই আমাকে ভালবাসিতেন। আমি তাঁহাকে সকল কথা বলিলে তিনি ব্যাপার কি হইয়াছে, তাঁহার মাতুল ডাক্তারকে সমস্ত বলিবার জন্য আমাকে লইয়া সেই দুর্যোগে ডাক্তার বাবুর বাড়ির দিকে ছুটিলেন। আমরা তাঁহার বাড়ির কাছে আসিয়া দেখিলাম, দুইটি লোক সেইখানে দাঁড়াইয়া আছে, তাহারা আমাদের দেখিতে পাইল না; কিন্তু আমি দেখিলাম, সুহাসিনীও তাহাদের দেখিল। আমরা এখন তাহাদের সম্মুখে গেলে ধরা পড়িব, এই বলিয়া সুহাসিনী আমার হাত ধরিয়া টানিতে টানিতে লইয়া তাঁহার নিজের বাড়িতে ফিরিয়া আসিলেন। যখন আমরা চলিয়া আসি, তখন ডাক্তার একবার তাঁহার জানালা খুলিয়াছিলেন; বোধ হয়, তিনি আমাকে বা সুহাসিনীকে দেখিয়া থাকিবেন। আমি এতদিন এ কথা বলি নাই; ভাবিয়াছিলাম, ডাক্তার আপনা হইতেই মুক্তি পাইবেন, সুহাসিনীও আমাকে এই কথা বলিয়াছিলেন। কিন্তু যখন দেখিলাম, ডাক্তার দোষী সাব্যস্ত হইলেন, তখন আর থাকিতে পারিলাম না, আমি আসিয়া সমস্ত বলিলাম। যাহা বলিতেছি, তাহা ভগবানের নামে শপথ করিয়া বলিতেছি, ইহার বিন্দুমাত্র মিথ্যা নহে। আমি আর অধিক দিন বাঁচিব না, আমার মুখ দিয়া রক্ত উঠিতেছে—দুরাত্মার উপযুক্ত দণ্ড দিয়াছি—আমি এখন মরিতে প্রস্তুত হইয়াছি, হুজুর আমাকে ফাঁসীর হুকুম—”  

কথাটা শেষ করিতে-না-করিতে দীনেন্দ্রের মুখ দিয়া ঝলকে ঝলকে রক্ত উঠিতে লাগিল। কয়েকজনে মিলিয়া তাহাকে ধরাধরি করিয়া বাহিরে লইয়া গেল।

ষোড়শ পরিচ্ছেদ – বিচারের ফল

সেইদিন সেই পৰ্য্যন্ত হইয়া মোকদ্দমা স্থগিত রহিল। আদালতে দীনেন্দ্রকুমারের মুখ দিয়া ঝলকে ঝলকে রক্ত নির্গত হওয়ায় বিচারপতি তখনই আদালত বন্ধ করিয়া উঠিয়া গেলেন। আরদালীরা জল দিয়া আদালত ধুইতে আরম্ভ করিল।

অদ্যকার এই ব্যাপারে সকলেই বিস্মিত হইয়া গিয়াছিল; সমস্ত হুগলী সহরে এই ব্যাপার লইয়া গৃহে গৃহে আলোচনা চলিতে লাগিল।

পর দিবসে আবার মোকদ্দমা আরম্ভ হইলে সরকারী উকিল বলিলেন, “দীনেন্দ্র যে খুন স্বীকার করিতেছে, তাহা অন্য সাক্ষীর দ্বারা সপ্রমাণ না হইলে, তাহার কথা গ্রাহ্য হইতে পারে না।”

মাধবলাল উঠিয়া বলিলেন, “অবশ্যই আমরা ইহার প্রমাণ দিব, আমার দ্বিতীয় সাক্ষী সুহাসিনী দেবী—তিনি ভদ্রমহিলা, পাল্কী হইতে সাক্ষ্য দিবেন।”

বিচারপতি বলিলেন, “অবশ্যই তাহাতে কাহারই আপত্তি নাই।

পাল্কীসহ সুহাসিনী আদালতে নীত হইলেন। দীনেন্দ্রকুমার যাহা বলিয়াছিল, তিনিও তাহাই বলিলেন।

সরকারী উকিল বলিলেন, “ইনি আসামীর আত্মীয়া, তাঁহার মোকদ্দমার সমস্ত ব্যয় দিতেছেন, ইনি যে আসামীকে নিৰ্দ্দোষ সপ্রমাণ করিতে চেষ্টা পাইবেন, তাহাতে আশ্চৰ্য্য কি?”

মাধবলাল বলিলেন, “আমাদের অন্য সাক্ষীও আছে—আমার তৃতীয় সাক্ষী মোহনলাল—বিখ্যাত ডিটেকটিভ।”

মোহনলালের নাম সকলেই শুনিয়াছিলেন, সকলেই বিস্মিত ও সকৌতূহলচিত্তে তাঁহার মুখের দিকে চাহিতে লাগিলেন।

মোহনলাল সাক্ষীর স্থানে গিয়া দাঁড়াইলেন। মাধবলাল বলিলেন, “আপনি এ মোকদ্দমায় অনেক অনুসন্ধান করিয়াছেন?”

মোহনলাল বলিলেন, “আমি প্রথমে এ মোকদ্দমার জন্য নিযুক্ত হই নাই—আমি সুহাসিনী দেবীর জহরত চুরি সম্বন্ধেই নিযুক্ত হইয়াছিলাম।”

মাধবলাল বলিলেন, “আচ্ছা, আপনি অনুসন্ধান সম্বন্ধে যাহা যাহা করিয়াছেন বা দেখিয়াছেন, সমস্ত জজ সাহেব ও জুরি মহোদয়দিগকে বলুন।”

মোহনলাল বলিলেন, “পূর্ব্বে ডাক্তার বরেন্দ্র বাবুর সহিত আমার পরিচয় ছিল, তিনিই চুরির সন্ধানের জন্য আমাকে আহ্বান করেন। আমি চুরির অনুসন্ধান করিতে করিতে জানিতে পারিলাম যে, ডাক্তারকে সরাইয়া সুহাসিনী দেবীর সমস্ত ধন-সম্পত্তি হস্তগত করিবার জন্য একটি লোক চেষ্টা পাইতেছে, সে আর একজন লোকের সাহায্য লইয়াছে। তাহারা যে সুহাসিনী দেবীর জহরত চুরি করিয়াছিল, সে বিষয়ে আমার বিশেষ সন্দেহ হইল।”

মাধবলাল বলিলেন, “ভাল, তাহার পর বলিয়া যান।”

মোহনলাল বলিলেন, “সুহাসিনী দেবীর জহরত যে চুরি করিয়াছিল, সে সুহাসিনী দেবীর প্রকৃতি খুব ভালরূপে জানিত, নতুবা অধিক ক্লোরাফর্ম্ম দিলে সুহাসিনী দেবীর মৃত্যু হইতে পারিত। এ কাজ দেখিলাম, কেবল দুইজনের দ্বারা হইতে পারে, এক ডাক্তার, অপর সুরেন্দ্রবাবু। আমি মালী বেহারার ছদ্মবেশে সুহাসিনী দেবীর বাড়িতে বাস করিতে লাগিলাম, সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার ও সুরেন্দ্রের উপরে বিশেষ দৃষ্টি রাখিতে লাগিলাম। বুঝিলাম, ডাক্তারের দ্বারা চুরি কখনই হয় নাই; অথচ সুরেন্দ্রের বিরুদ্ধেও বিশেষ কোন প্রমাণ পাইলাম না।

“এই সময়ে গোপাল খুন হইল। কেবল আমি যে একা চারিদিকে দৃষ্টি রাখিয়াছিলাম, তাহা নহে; আমার অন্য লোকও ছিল। দেখিলাম, অবনীকান্ত বলিয়া একটি লোকও সুরেন্দ্রের অনুরোধে এই চুরির তদন্তে নিযুক্ত হইল। ইহাকে আমি পূৰ্ব্ব হইতে জানিতাম, ইহার ন্যায় লোক এ সংসারে বড় একটা দেখা যায় না। টাকা পাইলে এ ব্যক্তি সকলই করিতে পারে।

“অবনীকান্ত চুরির অপরাধটা ডাক্তারের উপরে চাপাইতে চেষ্টা করিল, তখন বুঝিলাম সে ডাক্তারের সাপেক্ষ নহে—ডাক্তারের প্রতি তাহার এরূপ শত্রুতা করিবার উদ্দেশ্য কি? তখন আমি এই অনুসন্ধানেও নিযুক্ত হইলাম। বুঝিলাম, নিশ্চয়ই অপর কোন লোক তাহাকে নিযুক্ত করিয়াছে—অনুসন্ধানে জানিলাম, সে লোক অপর কেহ নহে— সুরেন্দ্রনাথ।

“তখন আমি সুরেন্দ্র ও অবনীর উপরে দিন রাত্রি চক্ষু রাখিলাম। ইহারাই মাতাল গোপালকে হস্তগত করিয়া প্রথমে ডাক্তারকে খুন করিতে চেষ্টা পায়, কিন্তু গোপাল মাতাল হইয়া ডাক্তারের বাড়ির কাছে ঘুরিত এইমাত্র, কখনও সাহস করিয়া তাঁহাকে আক্রমণ করিতে পারে নাই। তাহারাই তাহাকে মদের পয়সা দিত, সে কি করে বা না করে, দেখিবার জন্য তাহারাও দূরে থাকিয়া তাহার উপরে দৃষ্টি রাখিত। আমি আর আমার লোক ইহাদের সকলের উপরেই সর্ব্বদা দৃষ্টি রাখিতাম।

“একদিন রাত্রে সহসা দীনেন্দ্র গোপালকে ছোরা মারিয়া ছুটিয়া পলাইয়া গেল। গোপাল পড়িয়া গেল দেখিয়া সুরেন্দ্র ও অবনী ছুটিয়া তাহার নিকটস্থ হইল।

“আমিও অন্ধকারে তাহাদের নিকটে আসিলাম। দেখিলাম, গোপালের মৃতদেহের কাছে দাঁড়াইয়া উভয়ে মৃদুস্বরে কি পরামর্শ করিতেছে। তাহার পর সুরেন্দ্র ডাক্তারের বাড়ি প্রবেশ করিল, সে সর্ব্বদাই তাঁহার বাড়ি যাইত, সুতরাং কিরূপে বাড়িতে প্রবেশ করিতে হয়, তাহা সে ভালরূপেই জানিত।

“কিয়ৎক্ষণ পরে সে ফিরিল, তাহারা কি করে দেখিবার জন্য আমি অন্ধকারে লুকাইয়া তাহাদের আরও নিকটস্থ হইলাম। দেখিলাম, গোপালের ক্ষতস্থানে সুরেন্দ্র একখানা ছোরা বসাইল, তাহার হস্তে একখানা রুমাল জড়াইয়া দিল। তৎপরে উভয়ে সেই মৃতদেহটা টানিয়া বাগানের এককোণে যে একটা গর্ভ ছিল, তাহার ভিতরে ফেলিয়া মাটি ও পাতা চাপা দিয়া পলাইল।

“তখন আমি তাহাদের উদ্দেশ্য বুঝিলাম। যাহাতে ডাক্তার গোপালকে খুন করিয়াছেন বলিয়া ফাঁসী যান, সেই উদ্দেশ্যে এই দুই দুরাত্মা ডাক্তারের ছোরা ও রুমাল মৃতদেহের সঙ্গে রাখিয়া যায়। যে কোন উপায়ে ডাক্তারকে সরাইয়া দেওয়া তাহাদের উদ্দেশ্য।

“এই সময়ে ডাক্তার একবার জানালা খুলিয়াছিলেন, তিনি তখন সেখান হইতে সুহাসিনী আর দীনেন্দ্রকে দেখিতে পান। তাহার পর গোপালের মৃতদেহ দেখিয়াই বুঝিতে পারেন যে, দীনেন্দ্র প্রতিহিংসা সাধন করিতে গোপালকে খুন করিয়াছে; কিন্তু তিনি সুহাসিনীকে তাহার সঙ্গে দেখিয়া বিস্মিত হইলেন; কিছুই বুঝিতে পারিলেন না। পাছে এ কথা প্রকাশ করিলে সুহাসিনী বিপদে পড়ে, তাহার নাম এই ভয়াবহ ব্যাপারে জড়িত হয়, এই আশঙ্কা করিয়া তিনি কোন কথাই কাহাকে বলিতে পারিলেন না। বলিতে গেলে সুহাসিনী যে খুনের সময়ে দীনেন্দ্রের সঙ্গে ছিল, তাহা প্রকাশ হইয়া পড়ে, তাহাই তিনি আত্মপক্ষসমর্থনার্থ কোন কথাই বলিলেন না; বরং নিজে ফাঁসী যাইবে, তাহাও স্বীকার, কিরূপে সুহাসিনীকে বিপন্ন করিবেন?

“আমি বরেন্দ্র বাবুর সহিত কথা কহিয়া তাঁহার মনের ভাব বুঝিয়া লইলাম। দেখিলাম, তিনি ইচ্ছা করিয়া আত্মহত্যা করিতেছেন, তিনি কোন কথা বলুন, আর নাই বলুন, তাঁহাকে রক্ষা করিতেই হইবে, এই অভিপ্রায়ে আমি এই খুনের ব্যাপারে নিযুক্ত হইলাম।

“আমি বিপিনকৃষ্ণ উকিল সাজিয়া মাধবলাল বাবুর সহিত দেখা করিলাম, গোপনে তাঁহাকে সকল পরিচয় দিলাম। তৎপরে আমি অনুসন্ধানে যাহা যাহা জানিয়াছি, আর স্বচক্ষে যাহা দেখিয়াছি, সমস্তই তাঁহাকে বলিলাম। তখন কিরূপে ডাক্তার বরেন্দ্র বাবুকে রক্ষা করা যায়, সেজন্য প্রাণপণে চেষ্টা করিতে লাগিলাম। এখন বোধ হয়, কাহারই সন্দেহ নাই যে, গোপালকে দীনেন্দ্রই হত্যা করিয়াছেন। ডাক্তারকে ফাঁসী দিবার জন্য সুরেন্দ্র ও অবনী মৃতদেহের সঙ্গে ডাক্তারের ছোরা ও রুমাল রাখিয়া আসিয়াছিল। আর আমার কিছু বলিবার নাই।”

মাধবলাল উঠিয়া বলিলেন, “আর বোধ হয়, আমাকে অন্য সাক্ষী ডাকিতে হইবে না, আর বোধ হয়, আমাকে দীর্ঘ বক্তৃতা করিতে হইবে না। আমি আদালতের উপরে সম্পূর্ণ নির্ভর করিয়া আর কিছু বলিব না।”

বিচারপতি সরকারী উকিলকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, “আপনার আর কি বলিবার আছে?”

সরকারী উকিল উঠিয়া বলিলেন, “এ অবস্থায় আমার আর কিছুই বলিবার নাই। মাধব বাবু পূর্ব্বে আমাকে এ সকল কথা জানাইলে বোধ হয়, আদালতের এত সময় নষ্ট হইত না।”

বিচারপতি জুরিদিগকে বলিলেন, “আপনারা উভয়পক্ষের সাক্ষীর কথাই শুনিলেন, এ সম্বন্ধে আমার আর কিছু বলিবার ইচ্ছা নাই, আপনারা পরামর্শ করিয়া আপনাদের অভিমত প্রকাশ করুন।”

জুরিগণ পরামর্শের জন্য আর উঠিলেন না। সেইখানে বসিয়াই ক্ষণকাল পরস্পর দুই-একবার কি বলাবলি করিয়া তাঁহাদিগের মধ্যে একজন উঠিয়া দাঁড়াইলেন।

বিচারপতি তাঁহাকে জিজ্ঞাসিলেন, “আপনারা সকলে এক মত হইয়াছেন?”

তিনি বলিলেন, “হাঁ, হইয়াছি।”

“আপনাদের অভিমত কি বলুন।”

“আসামী নিদোষী।”

এ কথা শুনিয়া আদালতের মধ্যে একটা আনন্দগুঞ্জন উঠিল। চাপরাসীরা শান্তিরক্ষার জন্য ব্যস্ত হইল।

আদালত নিস্তব্ধ হইলে বিচারপতি বলিলেন, “ডাক্তার বরেন্দ্র বাবু, জুরিগণের সহিত এক মত হইয়া আমিও বলিতেছি যে, আপনি সম্পূর্ণ নিদোষী প্রমাণিত হইয়াছেন। আপনি বে-কসুর খালাস হইলেন।”

তৎক্ষণাৎ কনেষ্টবলগণ তাঁহার পার্শ্ব হইতে সরিয়া দাঁড়াইল, তিনি বিচারপতিকে সম্মতিবদনে সেলাম দিয়া কাটগড়া হইতে বাহির হইলেন।

তখন মাধবলাল ও মোহনলাল আসিয়া সাদরে তাঁহার হাত ধরিয়া আদালত হইতে বাহির হইয়া আসিলেন।

সপ্তদশ পরিচ্ছেদ – পাপের প্রায়শ্চিত্ত

ডাক্তার বরেন্দ্রনাথ খালাস হইলেন। দীনেন্দ্র হাজতে গিয়াছিল, বরেন্দ্র নাথ তাহার জন্য হৃদয়ে বড় বেদনা পাইলেন। তিনি মাধবলালকে বলিলেন, “চলুন, তাহাকে একবার দেখিয়া যাই, আহা, পাগল মানুষ—এ অবস্থায় সে খুন করিয়া বড় বেশী অপরাধ করে নাই। গোপালকে তাহার খুন করাই উচিত। চলুন যাই, তাহাকে জেলে একবার দেখিয়া যাই। বাড়িতে গেলেই সুহাসিনী তাহার কথা জিজ্ঞাসা করিবে, তাহাকে কি জবাব দিব?”

মাধবলাল বলিলেন, “চল, বাড়ি গিয়া ঠান্ডা হও, তাহার পর তাহার সঙ্গে দেখা করিও।” বরেন্দ্রনাথ কিছুতেই এ কথা শুনিলেন না; অগত্যা মাধবলাল তাঁহাকে লইয়া জেলের দিকে চলিলেন।

জেল-দারোগার সহিত তাঁহাদের সকলেরই বিশেষ পরিচয় ছিল, সুতরাং এ অবস্থায় তাঁহারা জানিতেন যে, দীনেন্দ্রের সহিত দেখা করিবার জন্য তাঁহাদের বিশেষ কষ্ট পাইতে হইবে না।

তাঁহারা জেল-দারোগার সহিত দেখা করিলে তিনি বলিলেন, “দীনেন্দ্রের মুখ দিয়া ক্রমাগত রক্ত উঠিতেছিল, তাহাকে হাঁসপাতালে রাখা হইয়াছে—ডাক্তার বাবু তাহার অবস্থা ভাল বলিতে পারিবেন। চলুন, ডাক্তার বাবুর কাছে যাই।”

ডাক্তার বাবু নিকটেই থাকিতেন। সকলে গিয়া তাঁহার সঙ্গে দেখা করিলে তিনি মুখ বিকৃত করিলেন; বলিলেন, “বাঁচিবে না, বাঁচিবার কোন সম্ভাবনা নাই, ফুসফুস ছিঁড়িয়া গিয়াছে। তাহার বিচার আর এ পৃথিবীতে হইতেছে না।”

বরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “আহা, তাহাই হউক—সে যে অবস্থায় খুন করিয়াছে, প্রকৃত মানুষমাত্রেই তাহা করিয়া থাকে।”

ডাক্তার বলিলেন, “একবার তাহাকে দেখিতে চাহেন না কি–বোধ হয়, সে আর আপনাদের চিনিতে পারিবে না।”

বরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “এখনও কতদিন বাঁচিয়া থাকিতে পারে, মনে করেন? তাহার কষ্ট লাঘবের জন্য যত টাকা লাগে, তাহা দিতে আমি প্রস্তুত আছি।”

ডাক্তার বিষণ্ণ হাসি হাসিয়া বলিলেন, “আজ রাত্রি কাটে কি না সন্দেহ, তাহার এ সংসারের সুখ দুঃখ ফুরাইয়া গিয়াছে।”

“একবার চলুন দেখি।”

“আসুন।”

সকলে ডাক্তারের সঙ্গে সঙ্গে গেলেন। হাসপাতালের একটি স্বতন্ত্র গৃহমধ্যে একখানা খাটের উপরে পরিষ্কার চাদরে সর্ব্বাঙ্গ আবৃত করিয়া দীনেন্দ্রকুমার মৃত্যুশয্যায় শায়িত আছে। সে খুনের আসামী, তাহাই তাহার দ্বারে নিয়মানুসারে একজন কনষ্টেবল পাহারায় আছে।

কনষ্টেবলকে লক্ষ্য করিয়া ডাক্তার বাবু মৃদুহাস্য করিয়া বলিলেন, “আর পলাইবে না, পলাইবার সময় গিয়াছে—বৃথা পাহারা।”

সকলে দীনেন্দ্রের নিকটবর্ত্তী হইলেন। দেখিলেন, চক্ষু মুদিত করিয়া দীনেন্দ্ৰ শুইয়া আছে। বরেন্দ্রনাথ বলিয়া উঠিলেন, “এ কি!”

মাধবলাল বলিলেন, “ঘুমাইতেছে।”

ডাক্তার সত্বর দীনেন্দ্রের মস্তকে হস্তস্থাপন করিলেন, তাহার বুকে হাত দিলেন, তৎপরে বলিলেন, “শেষ হইয়া গিয়াছে।”

“সে কি!” বলিয়া বরেন্দ্রনাথ দীনেন্দ্রের কপালে হাত দিলেন, তাহার বুকে হাত দিলেন, তৎপরে বলিলেন “এ যে দেখিতেছি, অনেকক্ষণ মৃত্যু হইয়াছে।”

ডাক্তার বাবু বলিলেন, “ঘণ্টাখানেক— আমি ভাবিয়াছিলাম, রাত্রে হইবে।”

বরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “ইহার দেহ যেন ডোমে স্পর্শ করে না, এখন বোধ হয়, ইহার দেহ আমরা লইয়া গিয়া সৎকার করিতে পারি।”

“ম্যাজিষ্ট্রেটের অনুমতি আবশ্যক।”

“বোধ হয়, প্রার্থনা করিলেই অনুমতি পাওয়া যাইবে।”

“নিশ্চয়ই—এ কেসে আর অঙ্গ-ব্যবচ্ছেদের আবশ্যক হইবে না।”

তাঁহারা অতি বিষণ্ণচিত্তে তথা হইতে বাহির হইলেন। গৃহে না ফিরিয়া ম্যাজিষ্ট্রেটের নিকটে আবেদন করিলেন। অনেক গোলযোগের পর তাঁহারা অনুমতি পাইলেন। তখন দীনেন্দ্রের সৎকারের বন্দোবস্তের জন্য তাঁহারা সত্বর গৃহের দিকে চলিলেন।

মাধবলাল অত্যন্ত ক্লান্ত হইয়াছিলেন, তিনি কিছুদূর এক সঙ্গে আসিয়া নিজের বাড়ির দিকে চলিয়া গেলেন।

সেই সময়ে পথে বরেন্দ্রনাথ একজন প্রতিবেশীর মুখে শুনিলেন, সেইদিন বেলা দশটার সময় অত্যন্ত রোগযন্ত্রণা ভোগ করিয়া পাপিষ্ঠা ইন্দুর মৃত্যু হইয়াছে। বরেন্দ্রনাথ সে প্রতিবেশীকে একটি কথাও জিজ্ঞাসা করিলেন না, অন্যদিকে মুখ ফিরিয়া একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিলেন। তখন তাঁহার সঙ্গে কেবল মোহনলাল ছিলেন, তিনি বলিলেন, “ডাক্তার, ইহাতে আক্ষেপের কিছুই নাই, কলঙ্কিত জীবন বহন করিয়া বাঁচিয়া থাকা অপেক্ষা মরণই মঙ্গল—আর পৃথিবীরও পাপের ভার লাঘব।”

ডাক্তার বরেন্দ্রনাথ গৃহে আসিয়া আরও এক ভয়াবহ দৃশ্য দেখিলেন। মোহনলাল তাঁহার সঙ্গেই ছিলেন। তাঁহারা আগেই শুনিয়াছিলেন যে, অবনীকান্ত ও সুরেন্দ্র মোকদ্দমায় তাঁহাদের কুকীর্তি সমস্ত প্রকাশ পাইয়াছে জানিতে পারিয়া, অন্তর্হিত হইয়াছিল। সঙ্গে সঙ্গে তাহাদের নামে ওয়ারেন্টও বাহির হইয়াছিল।

কিন্তু বরেন্দ্রনাথ নিজের বাড়ির দ্বারে আসিবামাত্র তাঁহার ভৃত্য বলিল, “সুরেন্দ্র বাবু প্রায় একঘণ্টা হইল, আপনার শোবার ঘরে গিয়া দরজা দিয়া রহিয়াছেন, কিছুতেই দরজা খুলিতেছেন না।”

ডাক্তার বিস্মিতভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কে?”

“সুরেন্দ্র বাবু।”

“সুরেন্দ্র বাবু এখানে?”

“হাঁ, ঘণ্টাখানেক হ’ল এসেছেন।”

“আমার ঘরে?”

“আজ্ঞে, আপনার ঘরে।”

মাধবলাল নিজের বাড়িতে গিয়াছিলেন। বরেন্দ্রনাথ ও মোহনলাল যে কক্ষমধ্যে সুরেন্দ্র ছিল, সেইদিকে ছুটিলেন। দেখিলেন, দ্বাররুদ্ধ, ঠেলিয়া দেখিলেন, ভিতর হইতে বন্ধ।

মোহনলাল বলিলেন, “আর দেখিতেছেন কি— দরজা ভাঙিয়া ফেলুন ও বোঝাই গিয়াছে “কি হইয়াছে?”

“হইবে আর কি পৃথিবীর আরও একটা পাপ কমিল—দরজাটা আগে ভাঙ্গুন।”

তখন তাঁহারা দুইজনে সবলে দ্বারে পৃষ্ঠ লাগাইয়া সবলে দরজা ঠেলিতে লাগিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে দরজা ভাঙ্গিয়া গেল—উভয়ে গৃহমধ্যে পড়িতে পড়িতে রহিয়া গেলেন। গৃহমধ্যে ঢুকিয়া তাঁহারা এক লোমহর্ষণ ব্যাপার দেখিয়া স্তম্ভিত হইলেন। গৃহের কড়িকাঠ সংলগ্ন লম্বমান রজ্জুতে সুরেন্দ্রের দেহ ঝুলিতেছে—তাহার চক্ষু কপালে উঠিয়াছে, জিহ্বার কিয়দংশ বাহির হইয়া পড়িয়াছে। সে গলায় দড়ি দিয়াছে।

বরেন্দ্রনাথ চিৎকার করিয়া ভৃত্যকে বলিলেন, “শীঘ্র কিছু লইয়া আয়, ইহার গলার দড়ি কাটিয়া নামাই।”

মোহনলাল বলিলেন, “বৃথা, দেখিতেছেন না, অনেকক্ষণ মরিয়াছে—যেমন আছে থাক, পুলিসে সংবাদ দেওয়া যাক, ইহাকে নামান পুলিসের কাজ। হতভাগ্য সুরেন্দ্র গলায় দড়ি লাগাইলেও অনেকখানি বুদ্ধি খরচ করিয়াছে। দেখিতেছি, আগে একখানা চেয়ার রাখিয়াছে, তাহার উপর বালিশ চাপাইয়া কড়িকাঠে দড়ি বাঁধিয়াছে; তাহার পর দড়ির ফাঁসটা নিজের গলায় লাগাইয়া পা দিয়া ঠেলিয়া পায়ের নীচ হইতে চেয়ার ও বালিশটা উল্টাইয়া ফেলিয়া দিয়াছে— লোকটার বুদ্ধি বেশ তীক্ষ্ণ ছিল—তবে ভাল বিষয়ে খরচ করিল না, ইহাই দুঃখ।”

“পাপের এইরূপ প্রায়শ্চিত্ত আর দেখা যায় না—এস,” বলিয়া বরেন্দ্রনাথ সে ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিলেন।

তখন তাঁহার ভৃত্য তাঁহার হস্তে একখানা পত্র দিয়া বলিল, “সুরেন্দ্র বাবু চিঠিখানা দিয়াছিলেন।”

“এতক্ষণ দিস নাই কেন?”

“ভুলিয়া গিয়াছিলাম।”

বরেন্দ্রনাথ সত্বর পত্রখানি খুলিয়া ফেলিলেন; দেখিলেন, সুরেন্দ্রের হাতের লেখা। সুরেন্দ্র লিখিয়াছে;–

“বরেন্দ্র বাবু,

“এ সময়ে সকল কথা বলিবার অবসর নাই—তোমরা সকলই জানিতে পারিয়াছ, যাহা হউক, ক্ষমা করিও, তোমার উপরে আমার কোন রাগ ছিল না, লোভই আমার কাল হইয়াছিল, লোভে ও অবনীর পরামর্শে সুহাসিনীর সর্ব্বস্ব লইতে মনস্থ করিয়াছিলাম। তুমি থাকিলে তাহার প্রতিবন্ধক হয়, এইজন্যই তোমাকে সরাইতে চেষ্টা পাইয়াছিলাম। যাহা হউক, শেষ সময়ে ক্ষমা করিও।

“সুহাসিনীর জহরত আমিই চুরি করিয়াছিলাম, আমার সঙ্গে অবনীও ছিল। আমি তোমার ঘর হইতেই ক্লোরাফর্ম্মের শিশি ও তোমারই রুমাল লইয়া গিয়াছিলাম। তোমার উপরে যাহাতে এ চুরির অপরাধ পড়ে, যাহাতে তুমি জেলে যাও, আমি তাহারই মৎলব করিয়াছিলাম। সমস্ত কাজ‍ই ঠিক করিয়া আনিয়াছিলাম। এই মোহনলাল মধ্যে না আসিলে আমাদের কাৰ্য্যে কেহই ব্যাঘাত দিতে পারিত না। দুঃখ রহিল, সেই মোহনলালকে উপযুক্ত দণ্ড দিয়া যাইতে পারিলাম না। জেলে যাইবার ছেলে সুরেন্দ্র নহে, তাহাই তোমার বিচারের সময় তোমারই ঘরে আসিয়া স্বহস্তে গলায় দড়ি দিয়া মরিলাম। আমার এই চিঠি থাকিল, আমি জানি, তুমি খালাস হইয়া সন্ধ্যার সময় ফিরিবে, সেই সময়ে আমাকে তোমার কড়িকাঠ হইতে ঝুলিতে দেখিবে, আর আমার এই পত্ৰও পাইবে।

“এখন সুহাসিনী—আমি জানি, সুহাসিনী আমাকে কখনও ক্ষমা করিবে না, তবুও হতভাগ্য মহাপাপী বলিয়া দয়া করিয়া আমাকে ক্ষমা করিতে বলিও। তাহার সমস্ত জহরত তাহারই বাড়ির পশ্চাতের বাগানের বড় আমগাছের নীচে পোতা আছে; চার-পাঁচ হাত মাটি খুঁড়িলেই জহরতের বাক্স পাওয়া যাইবে। এখন চলিলাম। পাপের দণ্ড হইল। আমার দৃষ্টান্ত দেখিয়া অপরে যদি শিক্ষা পায়, তাহা হইলে কতকটা আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত হইবে, ইতি।

সুরেন্দ্র।”

* * * * *

আর আমাদের কি বলিবার আছে? সেই পর্য্যন্ত অবনীকান্তকে আর কেহ সন্ধান পাইল না। সেই পৰ্য্যন্ত লোকটা একেবারে নিরুদ্দেশ।

সমাপ্ত।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন