০৫. রহস্যময়ী শিখা

প্রভাবতী দেবী সরস্বতী

রহস্যময়ী শিখা

এক – মাহেশের রথ

গ্রাণ্ড ট্যাঙ্ক রোড ধরে কলকাতার দিকে আসছিল শিখার মোটরখানা।

ঐ দিন সকালেই তাকে যেতে হয়েছিল চন্দননগরে। না যেয়ে সে পারেনি। হাতে শত কাজ থাকলেও সহপাঠিনী বন্ধুর অনুরোধ সে এড়াতে পারেনি। সুজিতার সঙ্গে শিখার বন্ধুত্বটা ছিল খুবই প্রগাঢ়। তাই তার আশীর্ব্বাদের দিনে শিখা উপস্থিত না থেকে পারেনি।

আশীর্ব্বাদ হয়ে গেলে শিখা যখন বাড়ী ফিরে যেতে চাইলো তখন সুজিতার বাবা—মা তাকে ধরে পড়লেন। কিছুতেই ছাড়তে চান না তাঁরা শিখাকে। সুজিতাও মুখ ভারী করে, শিখা চলে যাবে শুনে।

শিখা তখন অনেক করে জানায় যে কাজের চাপের জন্য এখানে থাকা তার পক্ষে অসম্ভব। তবে, সে কথা দিয়ে যায় যে, বিয়ের দিন বিকেলে নিশ্চয় সে আসবে এবং বিয়ের রাতটা এখানে থেকে যাবে সে।

এইভাবে কথা দেবার পর সে ছাড়া পায় বন্ধুর কাছ থেকে। সুজিতাদের মোটরে করেই সে তখন কলকাতায় ফেরে। ড্রাইভ করছিল সুজিতার বাবার ড্রাইভার গোবিন্দ।

সেদিন ছিল রথ।

ফেরবার পথে মাহেশ। রথে এখানে ভীষণ ভিড় হয়, মেলা বসে। রথ আর মেলা দেখতে প্রায় বিশ—পঁচিশ হাজার লোক জমে। মাহেশের রথের মেলায় ভিড়ের কথা শিখা লোকের মুখেই শুনে এসেছে। কিন্তু কি রকম ভিড়, সে সম্বন্ধে তার কোন ধারণাই ছিল না। মাহেশে পৌঁছে শিখা দেখে, অমন চওড়া রাস্তা…গ্রাণ্ড ট্র্যাঙ্ক রোড…তার দু—ধারে সার—সার দোকান বসেছে…ক’মাইল জুড়ে। মেলা দেখবার ভিড় আর রথ দেখবার ভিড়, দুয়ে মিলে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে যে, গাড়ী—চলাচল পর্য্যন্ত বন্ধ হয়ে গেছে। রথের জন্য গাড়ী চলা বন্ধ হয়, শিখা তা জানতো না।

লোকজনের মুখে শোনা গেল, মন্দির থেকে বিগ্রহ বেরিয়েছে—রথ চলতে সুরু হয়েছে।

বাধ্য হয়ে মোটর থামাতে হলো।

রথ মাসির বাড়ী পৌঁছাবার পর রাস্তা মুক্ত হবে—তখন আবার গাড়ী চলাচল সুরু হবে।

পথের মাঝে এ কি বিপত্তি!

বিরক্ত হয় শিখা—ভ্রূ কুঞ্চিত করে।

ড্রাইভার গোবিন্দকে শিখা জিজ্ঞাসা করে, ”এই গ্রাণ্ড ট্যাঙ্ক রোড ছাড়া কলকাতায় যাবার আর কোন রাস্তা নেই, গোবিন্দ?”

গোবিন্দর মুখে একটু অপ্রতিভ হাসি! সে বলে, ”তা থাকবে না কেন? তবে অনেক ঘুর হবে—তাছাড়া এ ভিড়ের কতক সেখানেও কি নেই? তার ওপর সেটা গলি পথ, কোথাও যদি আটকায়? সে—পথে কখনো যাইনি। তাই বলছিলুম, একেবারে সামনে এসে যখন পড়েছি দিদিমণি—রথে মহাপ্রভুর দর্শন…মানুন আর নাই মানুন, একবার দেখতে ক্ষতি কি? আপনার দয়ায় যদি একটিবার আমি দর্শন পাই—দেশ ছেড়ে এসেছি, রথে মহাপ্রভুর দর্শন কতকাল হয়নি!”

উৎকলবাসী গোবিন্দ সবিনয়ে হাত দুখানা কচলায়—শিখার দিকে তাকিয়ে থাকে উদগ্রীব ভাবে।

একটু হাসে শিখা। বাধ্য হয়েই তাকে রাজী হতে হয়। ভিড়ে যখন পথ পাওয়া যাবে না—ঘুরে অজানা অলি—গলি—পথে যেতে কতক্ষণ সময় লাগবে, কে জানে! তার চেয়ে এখানে রথারূঢ় জগন্নাথ—মূর্ত্তি দেখে না হয় কিছু পুণ্য—সঞ্চয় করা যাক।

অদৃষ্টে এমন ক্ষণ আবার আসবে কিনা সন্দেহ। কলকাতায় আসা অবধি সে মাহেশের বিখ্যাত রথযাত্রার কথা শুনে আসছে। বঙ্কিমচন্দ্রের রাধারাণী উপন্যাসেও মাহেশের রথের মেলার কথা পড়েছে সে, কতবার আসবে ভেবেছে, নানা কারণে আসা ঘটেনি।

হঠাৎ জনতার ভিড়টা যেন উদ্বেল হয়ে উঠলো। মহাসাগরের দিগন্তব্যাপী জলরাশি যেমন বাত্যা বিক্ষুব্ধ হয়ে অশান্ত আবেগে আবর্ত্তিত হয়ে ওঠে, জনসমুদ্রও সেই রকম উদ্বেগাকুল হয়ে উঠলো হঠাৎ। জনতার ভিতর থেকে বহুকণ্ঠের ধ্বনি শোনা গেল—”রথ আসছে…রথ আসছে…।”

হুড়মুড় করে ছুটে আসতে থাকে অশান্ত জনতা। ড্রাইভার গোবিন্দ আগলায় শিখাকে, বলে—”উঠে পড়ুন দিদিমণি, তাড়াতাড়ি গাড়ীর মধ্যে ঢুকে যান। এক্ষুণি ভিড় ভেঙ্গে পড়বে, ছড়িয়ে পড়বে চারিদিকে, সামলানো যাবে না—একেবারে চিড়ে—চ্যাপটা করে দেবে!”

গোবিন্দর কথা শেষ হবার আগেই ভিড়ের চাপ এসে পড়ে। অগণিত মানুষের ধাক্কার চাপে ছিটকে যায় শিখা গোবিন্দর কাছ থেকে। অপরিচিত পথ—ঘাট—এই লোকারণ্যে সে কোথা থেকে কোথায় এসে পড়েছে, কিছুই বুঝতে পারে না—শুধু বুঝতে পারে, ধাক্কা খেতে খেতে চলেছে সে।

তারপর কি হলো, কোথায় এসে পড়লো, শিখা তার কিছুই বুঝতে পারল না! অকস্মাৎ মনে হয়, কে যেন তার গলা টিপে ধরেছে! তারপর কতক্ষণ বাদে মনে হয়, সে যেন একখানা গাড়ীতে করে কোথাও চলেছে!

জড়িত—কণ্ঠে একবার সে ডাকে—”গোবিন্দ!”

তারপর আর কিছু জানে না।

দুই – বন্দিনী

কতক্ষণ পরে কে জানে—এক সময় শিখার জ্ঞান হলো।

চোখ মেলে চেয়ে দেখে, একটা ঘরে বিছানায় শুয়ে আছে সে। অদূরে টেবিলের ধারে একটি চেয়ারে বসে একজন লোক একখানা বই পড়ছে। তার মাথায় হিন্দুস্থানী টুপি!

শিখা উঠে বসতেই লোক তাকায় তার দিকে। তারপর সে এগিয়ে আসে শিখার কাছে। এসে খুশী গলায় বলে—”বাঁচলুম! আপনার জ্ঞান হয়েছে দেখছি!”

লোকটা তাহলে হিন্দুস্থানী নয়—বাঙ্গালী!

এরপর লোকাট ঘণ্টা বাজাল। বাজাতে একজন লোক দরজার পরদা সরিয়ে ঘরের মধ্যে এসে দাঁড়াল। টুপি মাথায় লোকটি তখন তাকে বলল—”এক কাপ গরম দুধ আনো।”

হুকুম শুনে আগন্তুক চলে যায় এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই বড় এক কাপ গরম দুধ নিয়ে এসে সসম্ভ্রমে শিখার পাশে দাঁড়ায়।

টুপি পরা লোকটি শিখাকে বললে, ”দুধটা খেয়ে নিন। তারপর কথা হবে।”

”কিন্তু আমি কোথায়, আগে সে কথাটা—”

বাধা দিয়ে দৃঢ়কণ্ঠে লোকটি বলে—”কিন্তু আমি আগেই বলেছি, আগে দুধ খান, তারপর কথাবার্ত্তা হবে।”

শিখা আর দ্বিরুক্তি করতে পারে না, এক—চুমুকে গরম দুধটুকু পান করে। অত্যন্ত ক্ষুধা পেয়েছিল, দুধটা খেয়ে মনে হলো দেহে যেন অনেকটা বল এলো।

নিজের চেয়ারখানা তার সামনে সরিয়ে এনে লোকটি বলে—”কিছু মনে করবেন না মিস্ রায়, অনিচ্ছা সত্ত্বেও আপনাকে এখানে নিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছি আমরা। আপনি বোধ হয় মনে করতে পারবেন—দিন—পনেরো আগে মোহনচাঁদের একখানা চিঠি আপনি পেয়েছিলেন?”

”মোহনচাঁদ!”

বিস্মিত চোখে শিখা তাকায় লোকটির পানে। তারপর ধীরে ধীরে মনে পড়ে সব কথা। কয়েকদিন আগে মোহনচাঁদ নাম সই করা একখানা চিঠি সে পেয়েছিল। তার আরও মনে পড়ে যে ঐ চিঠির মাথায় আঁকা ছিল একটা ত্রিশূল চিহ্ন।

সে চিঠি ডাকে আসেনি! একদিন সন্ধ্যার পর বাড়ী ফিরে সে নিজের ঘরের জানালার নীচে সেই চিঠিখানা পড়ে থাকতে দেখেছিল।

ঐ চিঠি পাবার মাত্র ক’দিন আগে মিঃ দৌলতরামের কাছ থেকে তার পেয়ে সে এলাহাবাদ গিয়েছিল। দৌলতরামের কন্যা রুবি ছিল তার সহপাঠিনী। আই—এ পাশ করে রুবি তার বাপের কাছে চলে যায় এলাহাবাদে—সেইখানে সে বি—এ পড়ছে।

মিঃ দৌলতরামের কাছ থেকে তার আসবার পরদিন রুবির কাছ থেকেও একখানা চিঠি সে পেয়েছিল। রুবি লিখেছিল—চিঠি পেয়েই শিখা যেন এলাহাবাদে চলে আসে। বড় বিপদ। শিখার সাহায্য বিশেষ দরকার।

টেলিগ্রাম পেয়েই শিখা চলে গিয়েছিল; কিন্তু রুবির পিতা মিঃ দৌলতরামের সঙ্গে তার দেখা হয়নি। রুবির কাছেই সে জানতে পেরেছিল তাদের বিপদের কথা।

সে এক গল্প—যেন চমকপ্রদ উপন্যাসের কাহিনী!

বাড়ীতে মাকে বিশেষভাবে বলে আসা হয়নি, তাই পরের দিনই শিখাকে ফিরতে হয়েছিল। রুবির কাজ সে গ্রহণ করেছে। তাকে বলে এসেছে—সাত দিন পরে সে আবার এলাহাবাদে আসবে এবং দু—চার দিন থেকে সাধ্যমত ব্যবস্থা করবে।

বাড়ীতে ফেরবার পরের দিনই সে মোহনচাঁদের চিঠি পায়। তাতে শুধু লেখা ছিল—দৌলতরামের কাজের ভার সে যেন গ্রহণ না করে। বিশেষ ভাবে তাকে সাবধান করা হচ্ছে,—এ নিষেধ না শুনলে তাকে বিপদে পড়তে হবে। মোহনচাঁদ চান না, কুমারী অগ্নিশিখা পরের ব্যাপারে জড়িয়ে পড়ে। সে যেন সতর্ক হয়।

চিঠিখানা পড়ে শিখা হেসেছিল।

মোহনচাঁদের পরিচয় সে বেশী জানে না; সামান্যই শুনেছে রুবির মুখে!

রুবির ভাই জয়নারায়ণ আর মোহনচাঁদ লণ্ডনে এক বোর্ডিংয়ে ছিলেন। দুজনের মধ্যে খুব বন্ধুত্ব ছিল। দুজনে ব্যারিষ্টারী পড়তে গিয়েছিলেন। আগে থেকেই মোহনচাঁদের পরিচয় রুবি জানতো—ছেলেবেলা থেকেই অত্যন্ত দুরন্ত, দুর্দ্ধর্ষ, কোন রকমে বি—এ পাশ করে বিলাতে যান এবং সেখানে গিয়ে বিশেষভাবে জড়িয়ে পড়েন দুর্দ্দান্ত দস্যু আর্থার মুরের দলের সঙ্গে।

ব্যারিষ্টারী পাশ করে জয়নারায়ণ দেশে ফিরে আসেন; কিন্তু প্র্যাকটিস করবার সুযোগ তিনি পেলেন না। অত্যন্ত লাজুক প্রকৃতির মানুষ। তাই ব্যারিষ্টারী না করে তিনি ব্যবসা নিয়ে পড়েছেন। ব্যবসার ব্যাপারে তিনি এখন দিল্লীতে আছেন।

মোহনচাঁদের দেশে ফেরবার কথা কেউ জানতে পারে না। হঠাৎ কাগজে—পত্রে জানা গেল—যুক্তপ্রদেশে এক দস্যুদলের আবির্ভাব হয়েছে; তাদের অত্যাচারে যুক্তপ্রদেশের ধনীরা ব্যতিব্যস্ত এবং সেই সঙ্গে পুলিশও বিপর্য্যস্ত হয়ে উঠেছে।

এদের পাণ্ডা মোহনচাঁদ।

অদ্ভুত শক্তি এই লোকটির! আশ্চর্য্য প্রতিভা! কিভাবে কোথায় কখন সে আত্মপ্রকাশ করে, কেউ তা জানতে পারে না। কিছুকাল আগে পাটনার উপকণ্ঠে এক ধনাঢ্য ভূস্বামীর কুলদেবতা সীতারামজী বিগ্রহের বহুমূল্য হীরক—অলঙ্কার চুরি যায়। ঐ তদন্তের ভার পড়ে মিঃ দৌলতরামের উপর। সেই ব্যাপারে উঠে—পড়ে লেগেছেন তিনি।

পুত্রকে পত্র দিয়ে দৌলতরাম সতর্ক করেছেন—হাজার হাজার টাকা নিয়ে তার কারবার। দস্যু মোহনচাঁদ যে ভাবে প্রথমে ত্রিশূলাঙ্কিত চিঠি দিয়ে, পরে সদলে ছলে—বলে—কৌশলে অর্থ সংগ্রহ করছে, তাতে দৌলতরাম তাঁর ছেলের জন্য রীতিমত শঙ্কিত হয়ে উঠেছেন।

সম্প্রতি রুবির জন্য জয়নারায়ণ একছড়া মহামূল্য মুক্তার মালা নিয়ে এসেছিলেন। সে মুক্তার মালা বাড়ীতে এনে রাত্রে না দিয়ে পরের দিন সকালে তাকে দেবেন ঠিক করে নিজের ড্রয়ারে রেখেছিলেন; সকালে মালা বার করতে গিয়ে তিনি আকাশ থেকে পড়লেন। ড্রয়ার যেমন চাবিবন্ধ তেমনই আছে—ড্রয়ারের মধ্যে মুক্তার মালা নেই!

বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা।

দুর্দ্দান্ত পুলিশ অফিসার দৌলতরাম—যাঁর কাজ দুর্দ্ধর্ষ অপরাধীকে গ্রেপ্তার এবং তার শায়েস্তার ব্যবস্থা করা—দেশে—বিদেশে যাঁর খ্যাতি, তাঁরই সতর্ক প্রহরী—বেষ্টিত ঘরে এমন চুরি!

এই জন্যই রুবি তার পুরাতন বন্ধু শিখাকে ডেকেছিল। যদি শিখাকে দিয়ে কোন কাজ পাওয়া যায়! শিখা এসেছিল এবং দৌলতরাম ও রুবির বিশেষ অনুরোধে, হাতে অনেক কাজ থাকা সত্ত্বেও এ কাজের ভার নিতে বাধ্য হয়েছিল।

মোহনচাঁদের নাম বলতেই এইসব কথা মনে পড়ে যায় শিখার।

তিন – মুক্তির সর্ত্ত

লোকটির মুখের দিকে শিখা তাকায়—মোহনচাঁদের চিঠির সঙ্গে এর কি সম্পর্ক থাকতে পারে? সে ভাবে।

তারপর শিখা বলল—”জিজ্ঞাসা করতে পারি আমি কোথায় আছি? আর কি করেই বা এখানে এসেছি? তাছাড়া আপনিই বা কে? আপনার নাম?”

লোকটি একটু হাসল, বললে—”একসঙ্গে অতগুলো প্রশ্ন করলে জবাব দেওয়া মুস্কিল মিস্ রায়। একে একে বলছি। আপনি শ্রীরামপুরের পথে ভিড়ের চাপে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন। আমাদের লোকজন আপনাকে সেই ভিড় থেকে অতি কষ্টে উদ্ধার করে আমার এখানে এনে পৌঁছে দিয়েছে। আপনি কোথায় আছেন, সে কথা এখন জানবার প্রয়োজন নেই। আপনি আগে সুস্থ হন, তারপর জানবেন।”

শিখা বিরক্ত হয়ে বলে—”সুস্থ যে আমি যথেষ্ট হয়েছি, আমি নিজেই তা বেশ বুঝতে পারছি! আমার নাম যখন জেনেছেন—তখন সবই জানেন। আমি যদি বাড়ী যাই তাতে আপনার আপত্তি আছে?”

একটু কুণ্ঠিত কণ্ঠে গৃহস্বামী বললে—”দেখুন, আমি হুকুমের চাকর, মনিবের হুকুম পালন করে যাই—এইমাত্র! আপনাকে যে কোন রকমে অন্ততঃ কিছুদিনের মত সরিয়ে রাখার হুকুম আমরা পেয়েছি। আজ ক’দিন থেকেই আপনার পিছনে আমাদের লোক ঘুরছিল, কিন্তু সুযোগ—সুবিধা আমরা পাইনি। পেয়েছি আজ বিকেলে। আপনি যখন ভিড়ের চাপে পড়ে গেলেন, তখন ওদের পক্ষে আপনাকে সরানো কঠিন হ’ল না।”

কথাটা শেষ করে শিখার মুখের উপর দু’চোখের দৃষ্টি সে নিবদ্ধ করল।

শিখা বললে—”ধরুন, আমি যদি মোটর থেকে না নামতুম, তাহলে আপনারা কি করতেন?”

লোকটি হেসে বলল—”হয়তো একটা অ্যাকসিডেণ্ট ঘটাতে হতো! নাহয় যেদিন আপনি আপনার চাকরটাকে সঙ্গে নিয়ে এলাহাবাদ যেতেন—তখন ট্রেন থেকে যে—কোন রকমে আপনাকে সরিয়ে ফেলা হতো।”

সক্রোধে অধর দংশন করে শিখা বলে—”পারতেন?”

লোকটি শান্ত কণ্ঠে বলে—”মোহনচাঁদের অসাধ্য কোন কাজ নেই মিস্ রায়!”

নির্ব্বাকদৃষ্টিতে শিখা কিছুক্ষণ তার পানে তাকিয়ে তারপর বলে—”কিন্তু আপনি দেখছি বাঙ্গালী—আপনি মোহনচাঁদের দলে গেলেন কি করে?”

লোকটি বললে—”আমি বাঙ্গালী সত্য। আমার নাম মুরারি সরকার। কিন্তু বাংলাদেশে আমি থাকিনে। ছেলেবেলা থেকে আগ্রায় মানুষ হয়েছি, সে হিসাবে বাংলা আমার কাছে অপরিচিত দেশ। মোহনচাঁদের দলে কেবল আমি নই…বিহার, গুজরাট, আসাম, বোম্বে প্রভৃতি প্রত্যেক রাজ্যের লোকই তার দলে আছে মিস্ রায়।”

শিখা জিজ্ঞাসা করে—”কিন্তু আমাকে এ—ভাবে আটক করে রাখার কোন কারণ আমি কিছু বুঝছিনে মুরারিবাবু? ব্যাপার হলো আপনাদের এলাহাবাদে—কলকাতা থেকে অনেক দূরে! তারপর ঘটনা ঘটল পুলিশ—অফিসার মিঃ দৌলতরামের বাড়ী। এ অবস্থায় আমায় নিয়ে টানাটানি করবার কারণ তো বুঝছিনে। আমার মত সামান্য একটি বাঙালী মেয়েকে মোহনচাঁদের এত ভয়?”

গম্ভীর মুখে মুরারি বলল—”নিজের ক্ষমতা অনেকেই বোঝে না মিস্ রায়, কিংবা বুঝলেও তা প্রকাশ করতে চায় না। আপনাকে মোহনচাঁদ খুব চেনেন, আর চেনেন বলেই তিনি চান না, এ নোংরা ব্যাপারে আপনি হাত দেন।”

—”নোংরা ব্যাপার!” শিখা সবিস্ময়ে বলে ওঠে।

মুরারি সরকার বলে—”নোংরা বৈ কি! ভয়ানক নোংরা। যার জিনিষ, সে নিয়ে গেছে, অথচ তার নাম হল চোর! ঐ মুক্তার মালা ছিল মোহনচাঁদের মায়ের। সে—মালা মোহনচাঁদ পান তাঁর মায়ের কাছ থেকে। মা মারা গেছেন। সে—মালা হারিয়ে যায়; তারপর জয়নারায়ণ কোনরকমে ঐ মালা হস্তগত করে এতকাল লুকিয়ে রেখেছিলেন। ভেবেছিলেন অনেকদিনকার ব্যাপার, আর দস্যু মোহনচাঁদ এ—মালার সম্বন্ধে কোন উচ্চ—বাচ্য করবেন না। সংশয়হীন হয়েই তিনি এ মালা নিয়ে বাড়ী এসেছিলেন। কিন্তু সে মালা সেই রাত্রেই আবার চুরি গেল! কথায় আছে—চোরের উপর বাটপাড়ি, এও অনেকটা তাই।”

ব্যাপারটা কেমন যেন হেঁয়ালির মত। শিখা কোন সূত্র পায় না। শিখা বলে—”বুঝলুম, ব্যাপারটা ভীষণ নোংরা। আপনাদের মোহনচাঁদ কোন রকমে জেনেছেন, আমি রুবির তার পেয়ে এলাহাবাদে গিয়েছিলাম আর তার কথায় যতটুকু পারি, সাহায্য করতেও রাজী হয়েছি। ধরুন আমি যদি সাহায্য না করি, যদি এলাহাবাদে না যাই, তা হলে তো আমায় মুক্তি দেবেন?”

—”হ্যাঁ। তবে এ—কথা আপনাকে লিখে দিতে হবে।”

—”লিখে?” ভ্রূ কুঞ্চিত করে শিখা বলে—”কি লিখে দিতে হবে?”

মুরারির দু’চোখের দৃষ্টি শিখার মুখে নিবদ্ধ। সে বলে—”একখানা দলিল!”

তাচ্ছিল্যভরে শিখা বলে—”সে—দলিলের কোন দাম আছে? ধরুন, এ—রকম দলিল লিখে দিয়ে সে দলিল যদি আমি না মানি, তাহলে তো আপনারা কোর্টে গিয়ে নালিশ করতে পারবেন না, কনট্রাক্টের চুক্তিভঙ্গ হয়েছে বলে!”

মৃদু হেসে মুরারি বলে—”তা অবশ্য পারবো না। তবে কিছু একটা সর্ত্ত না হলে আপনাকে ছাড়ব কি করে? তা ছাড়া দলিল লিখে দিলেও আমাদের লোকেরা আপনার উপর সব সময় নজর রাখবে।”

এই পর্য্যন্ত বলে মুরারি সরকার চুপ করল; তারপর বলল—”আমাদের ডাকাত বা আর যা—ই বলে জানুন না কেন, আমাদের কতকগুলো নিয়ম—কানুন আছে। সেই নিয়ম—কানুন মেনে আমাদের কাজ করতে হয়! দলিল লিখে দিয়ে মুক্তি পেয়ে চলে যাবার পর আপনি যদি সে দলিল না মানেন, তাহলে তার ফল সাংঘাতিক হতে পারে, মিস্ রায়। মানে, বেইমানীর জন্য আপনার প্রাণদণ্ড পর্য্যন্ত হতে পারে! মোহনচাঁদের বিচার কঠিন হলেও নিখুঁত। তার বিচারে কখনো ভুল হয় নি—হবেও না কোনদিন।”

এ—কথা শুনে শিখার মুখ বিবর্ণ হয়।

কিন্তু তখনি নিজেকে সামলে নিয়ে সে বলে—”বুঝেছি, আপনাদের মোহনচাঁদের বিচার যেমন নির্ভুল তেমনি কঠিন। তাই ভাবছি, তাহলে অনর্থক পরের দায় ঘাড়ে নিয়ে কেন বিপদ ডেকে আনি! যেখানে দৌলতরামের মত জবরদস্ত পুলিশ—অফিসার এ—তদন্তের ভার নিয়েছেন, সেখানে আমার মত একজন মেয়ে না গেলেও কোন ক্ষতি নেই। বেশ, আমি লেখাপড়া করে দেব। আপনি আপনাদের মোহনচাঁদকে এ কথা জানান। তিনি কি বলেন, তাঁর মত নিন। মোটের উপর আমি কাল সকালেই বাড়ী যেতে চাই।”

মুরারি গম্ভীর ভাবে মাথা নাড়ে, বলে—”ক্ষেপেছেন! আমাদের কর্ত্তা এখন আছেন দিল্লীতে। সেখানে খবর যাবে—জবাব আসবে, তবে বলতে পারব আপনাকে ছাড়া হবে কি হবে না। দু—তিন দিন দেরী তো হবেই। তবে কথা দিচ্ছি, এ দু—তিন দিন এখানে আপনার কোন কষ্ট হবে না। এত বড় বাড়ী—ইচ্ছামত বেড়ান। পাশের ঘরে লাইব্রেরীতে অনেক বই আছে, পড়ুন। মোটের উপর পালাতে পারবেন না। তাছাড়া পালাবার চেষ্টা করলেও সুবিধা হবে না। চারদিকে আমাদের লোক পাহারায় আছে। আচ্ছা আমি তাহলে কর্ত্তাকে তার করতে যাচ্ছি। আপনার চা, খাবার, ভাত যথানিয়মে ঠিক সময়ে রামজী এসে দিয়ে যাবে। ভয়—ভাবনা করবেন না, নিয়মমত খাবেন, বলে যাচ্ছি।”

উঠে দাঁড়ায় মুরারি।

—”হ্যাঁ, আপনার বাড়ীতে যদি খবর দিতে চান, একখানা কাগজে লিখে দিন। আর কোন কথা নয়—শুধু লিখবেন, বিশেষ কাজে আপনাকে এক—জায়গায় আটকে থাকতে হয়েছে, দু—তিন দিন পরে বাড়ী ফিরবেন। না লিখে দিলে ওঁরা হয়তো আবার পুলিশে খবর দেবেন। অনর্থক পুলিশ বেচারাদের হয়রান করে লাভ নেই তো! বাড়ীতে আপনার মা আছেন, আপনার খবর না পেলে তিনি হয়তো কেঁদে—কেটে একাকার করবেন, যতীনবাবুকে খবর দেবেন!”

শিখা তখন একখানা কাগজে তাড়াতাড়ি দু—লাইন লিখে দেয়—বিশেষ কাজে সে আটকে পড়েছে, দু—তিন দিনের মধ্যেই বাড়ী ফিরবে।

কাগজখানা ভাঁজ করে পকেটে ফেলে প্রসন্ন মুখে মুরারি বলে—”লক্ষ্মী মেয়ের মত কাজ করেছেন মিস্ রায়। যাই হোক, যতক্ষণ আমি আছি, আপনাকে ব্যস্ত হতে হবে না।”

সে ঘর থেকে চলে যায়।

চার – বন্ধ আঁখি

ঠিক সময়ে চা আসে, ভাত আসে! যে—লোকটা এসে দিয়ে যায়, সে কথা বলে না, খাওয়া শেষ হলে নিঃশব্দে খাবার পাত্রগুলি নিয়ে চলে যায়।

কোথায় শিখাকে রাখা হয়েছে, শিখা তা জানে না।

মস্ত বড় বাড়ী। এককালে ছিল বেশ জমকের, এখন জীর্ণ দশা। সামনের দিককার কতকগুলো ঘর ভেঙ্গে পড়েছে আর কয়েকখানা পড়ি পড়ি অবস্থা। যে কোন মুহূর্ত্তে ভেঙ্গে পড়তে পারে!

উপরে ওঠবার সিঁড়িটাও ভেঙ্গে পড়েছে।—সিঁড়িটা আস্ত থাকলে উপরে ওঠবার চেষ্টা করা যেত। এদিককার ক’খানি ঘর ভাল আছে, কিন্তু কোন ঘরের জানালা দিয়ে বাইরের দিকে দেখা যায় না। মনে হয়, বহু পূর্ব্বকালে এ—দিকটা ছিল কোন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির অন্দর—মহল। অন্দর—মহলের সঙ্গে বাইরের কোন সম্পর্ক ছিল না। ওপাশের প্রকাণ্ড উঠানটা জানালা দিয়ে চোখে পড়ে, আর ওদিকে আবার অট্টালিকা—শ্রেণী আর ভাঙ্গা—চোরা ইটের স্তূপ।

অস্থিরপদে বাড়ীর মধ্যে ঘুরে বেড়ায় শিখা। জনপ্রাণীর দেখা মেলে না। কথা বলবে, এমন লোক নেই। এ অবস্থায় বেশীদিন থাকলে নিশ্চয় সে পাগল হয়ে যাবে!

সেদিন উঠানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সে ইতস্ততঃ তাকিয়ে দেখছে, এমন সময় উপরের একখানা ঘর হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ল। ইটগুলো ছড়িয়ে পায়ের কাছে এসে পড়েছিল। সন্ত্রস্তে শিখা ছুটে আসে।

অপঘাত মৃত্যু! আর দু—হাত এগিয়ে দাঁড়ালে কি যে হতো, ঠিক নেই! এই জনশূন্য বাড়ীতে অপঘাতে মরলে কেউ দেখতে নেই! এক ফোঁটা জলও কেউ দিতে আসবে না—এ কথা ঠিক! এখানে বুক—ফাটা চীৎকার করলেও কারও কানে পৌঁছোবে না।

উদ্দেশ্যহীনভাবে লাইব্রেরী ঘরে যায় শিখা।

আলমারি—ঠাসা বই। দু—একখানা নিয়ে নাড়াচাড়া করে সে, পড়বার চেষ্টা করে—কিন্তু মন বসে না!

রাত্রের দিকে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়। বারান্দায় চার—পাঁচ জন লোক বিছানা পেতে শোয়। এরা এখানে পাহারা দেয়। দিনের বেলা এদের টিকি দেখা যায় না, বাইরের দিকে থাকে। সন্ধ্যা হলে ভিতরে আসে। প্রথম দিনই তারা জানিয়ে দিয়েছিল—”কোন ভয় নেই মাইজী, আমরা এই বারান্দায় শুয়ে আছি, আপনি নিশ্চিন্তে ঘুমান।”

শিখা কিন্তু নিশ্চিন্ত হতে পারে না। নিজের উপরে রাগ হয় তার। কি দরকার ছিল মোটর থেকে নামবার? মোটরে বসে থাকলে এত সহজে তাকে ধরে এনে আটক করা এদের পক্ষে সম্ভব হতো না!

তৃতীয় দিন সন্ধ্যার পর এসে পৌঁছালো মুরারি সরকার।

দূর থেকে তার মোটা গলার হাঁক শোনা গেল—”রাম সিং, পীতাম্বর, রহিম—সব ঠিক আছে? মাইজী আচ্ছা আছে?”

”জী—হাঁ।”

উত্তরটাও শোনা যায়।

মুরারি সরকার নিশ্চয় কোন খবর এনেছে! উৎসুক হয়ে ওঠে শিখা, হাতের বইখানা বন্ধ করে উঠে দাঁড়ায়।

”মিস্ রায়, জেগে আছেন?”

রুদ্ধ দরজায় করাঘাত করে মুরারি।

”জেগে আছি। আসুন।”

শিখা দরজা খুলে দিতে মুরারি সরকার এসে একখানা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে।

”খবর কি, মুরারিবাবু? আপনাদের কর্ত্তার হুকুম পেলেন?”

মুরারি গম্ভীর মুখে বলল—”হ্যাঁ, পেয়েছি, আপনাকে ছেড়ে দেওয়ার কথা বলেছেন।”

”ছেড়ে দেওয়ার হুকুম হয়েছে!”

উৎফুল্ল হয়ে ওঠে শিখা।

”কিন্তু আমাদের একটা সর্ত্ত আছে। তাতে আপনাকে রাজী হতে হবে—তবে খালাস পাবেন।”

শিখার দু—চোখে উদ্বেগ—চকিতের জন্য। বলে—”অর্থাৎ কিছু লিখে পড়ে দিতে হবে তো?”

মুরারি সরকার বলে—”হ্যাঁ; লিখে দিতে হবে, আপনি আমাদের পিছনে আর লাগবেন না! তবে লেখাপড়া বুঝছেন তো—তার কোন দাম নেই। কারণ, এ নিয়ে আইন—আদালত চলবে না। কিন্তু আমাদের কর্ত্তার কথাই আইন, তাঁর কাজ হলো দণ্ড দেওয়া। এটুকু জেনে রাখবেন, আমাদের কর্ত্তা অন্যায় কোনদিন করেন না। অন্যায় যে করে, তাকে তিনি সাজা দেন। যারা সাধু, তাদের তিনি বন্ধু—রক্ষা করেন।”

”সাধুকে রক্ষা করেন” কথাটা শুনে হাসি পায় শিখার। কিন্তু সে সতর্ক হয়ে যায়। এখানে হাসলেই বিপদ। মুরারি হয়তো রেগে উঠবে!

মুরারি বলে চলে—”আপনার ওপর তাঁর এতটুকু বিদ্বেষ নেই। এ—শাস্তি আপনাকে পেতে হতো না, যদি আপনি এলাহাবাদে না যেতেন, আর দৌলতরামের কাজে সহায়তা করবার প্রতিশ্রুতি না দিতেন! যাক, ওদিকে আর যাবেন না, এইটুকু কর্ত্তার অনুরোধ। আপনাকে ছেড়ে দেওয়ার হুকুম হয়েছে। এখনই আপনাকে আপনার বাড়ীতে পৌঁছে দেব। আপনি প্রস্তুত হন।”

শিখা বলে—”আমি প্রস্তুত হয়েই আছি মুরারিবাবু, এখনই যেতে রাজী। তাহলে আর দেরী না করে কাগজ—কলম নিয়ে আসুন। আমি লিখে দিচ্ছি।”

কাগজ আর ফাউণ্টেনপেন মুরারির সঙ্গেই ছিল, তাই সে আর কালবিলম্ব না করে শিখার সামনে এগিয়ে দেয়। শিখাও বিনাবাক্যব্যয়ে লিখে দেয় ”সে মোহনচাঁদের বিরুদ্ধে যাবে না।”

লেখা হয়ে গেলে কাগজখানা ভাঁজ করে পকেটে রেখে শিখাকে নিয়ে ঘরের বাইরে আসে মুরারি। বাইরে এসে ঘরে তালাবন্ধ করতে করতে সে বলে—”কিছু মনে করবেন না মিস্ রায়, আপনাকে এখান থেকে চোখ বেঁধে নিয়ে যাব। গাড়ীতে উঠেও চোখ খুলতে পাবেন না—এটাও আমাদের একটা সর্ত্ত। আশা করি আপনি এ সর্ত্ত মানবেন!”

চোখ বাঁধতে ইতস্ততঃ করে শিখা।

কিন্তু শেষে রাজী হতে হয়। তার মনে হয় পাছে দুর্ব্বৃত্তদের এই গোপন আড্ডার নির্দ্দেশ দিয়ে পরে সে পুলিশকে নিয়ে এসে সার্চ করে, এই ভয়েই এরা তার চোখ বাঁধতে চায়!

রাজী হওয়া ছাড়া উপায় নেই—সর্ত্ত না মানলে মুক্তি মিলবে না।

মুরারি বেশ ভালো করে চোখ বেঁধে দেয় শিখার, তারপর তার হাত ধরে এগিয়ে চলে।

অন্ধের মত মুরারির হাত ধরে তার নির্দ্দেশে উঁচু—নীচু জায়গা ঠিক করে চলতে থাকে শিখা। অনেকটা জায়গা ঘুরে—এ—গলি ও—গলি করে একখানা মোটরের সামনে ওরা আসে।

মুরারি সাবধান করে—”দেখবেন, চোখের বাঁধন যেন আলগা না হয়, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে আপনাকে আবার ফিরে যেতে হবে। মুক্তির কোন উপায়ই তখন আর আমি করতে পারব না। নিজে আমি বাঙ্গালী আর আপনিও বাঙ্গালী—মেয়ে, তাই আপনার দায়িত্ব আমি নিজে নিয়েছি। জানি, আপনি বিশ্বাসঘাতকতা করবেন না।”

ম্লান মুখে হাসে শিখা, বলে—”না, বিশ্বাসঘাতকতা করব না মুরারিবাবু, বাঙ্গালী—মেয়ের কথা আপনি বিশ্বাস করতে পারেন।”

শিখার মুখে এই কথা শুনে খুশী হয় মুরারি। সে তখন তার হাত ধরে গাড়ীতে তুলে দিয়ে নিজে কিছুটা ব্যবধান রেখে তার পাশে বসে পড়ে। ওরা উঠে বসতেই চলতে থাকে মোটরখানা।

পাঁচ – গুলির চোট

যতীনবাবু এসে উপস্থিত হন। তাঁর হাতে কতকগুলো কাগজপত্র।

”সাংঘাতিক ব্যাপার, মিস্ রায়! এলাহাবাদ থেকে মিঃ দৌলতরাম কলকাতায় আসছিলেন, পথে শ্রীরামপুরের ওখানে খুন হতে হতে বেঁচে গেছেন। ভয়ানক জখম হয়েছেন।”

অবাক হয়ে শিখা বলে—”তাই নাকি?”

যতীনবাবু বলেন—”এলাহাবাদে দুর্ব্বৃত্তদলের অত্যাচারে বিপর্য্যস্ত হয়ে তিনি বদলি হতে চেয়েছিলেন। বদলির আগে ক’দিনের ছুটি মঞ্জুর করিয়ে মেয়েকে নিয়ে কলকাতায় আসছিলেন—হঠাৎ পথে এই বিপদ!”

শিখা তৎপর হয়ে ওঠে। ”কে, রুবি এসেছে বুঝি? কোথায় আছে সে? কোন আত্মীয়ের বাড়ী? না, কোন হোটেলে উঠেছে?”

যতীনবাবু বললেন—”মিঃ দৌলতরামকে পুলিশ—হাসপাতালে রাখা হয়েছে। সেখানে কার্ড না দেখিয়ে অর্থাৎ বিনা—হুকুমে কেউ তাঁর কাছে যেতে পারবে না। তাঁর মেয়ে রুবি কোথায় আছেন, সে—খবর আমি পাইনি। পরে জেনে আপনাকে খবর দেব। এই কাগজপত্রগুলো ট্রেনের কামরায় পড়ে ছিল, আপনাকে দেখাবার জন্য এনেছি—দেখুন।”

শিখা দেখল—একখানা বাড়ীর নক্সা; আর ক’খানা কাগজে সাঙ্কেতিক ভাষায় কি সব লেখা। একখানা কাগজে ইংরাজীতে লেখা—”আমরা কিছুটা নিরাপদে আছি। তবে বানরটা বড় জ্বালাতন করছে, তাকে সরিয়ে ফেলাই উচিত মনে হয়।”

বানর অর্থে আসল বানর নয়, কোন মানুষ বোঝাচ্ছে, শিখা তা বেশ বোঝে। বললে—”এই সাঙ্কেতিক চিঠি আর কাগজপত্রগুলো এখনকার মত আমার কাছে থাক যতীনবাবু, এগুলো আমি মুন্সীসাহেবকে দিয়ে পড়িয়ে নেব। উনি এ রকম বহু সাঙ্কেতিক ভাষা বোঝেন। ‘ইন দি মিন টাইম’ আপনি রুবির খোঁজ নিয়ে আমাকে যদি শীঘ্র জানান, তাহলে—”

যতীনবাবু বললেন—”কিন্তু আমার মনে হয় মিস্ রায়, আপনি নিজে না গেলেই ভালো হয়। রুবি নিজে যদি আসেন, তাতে কোন কথা হবে না। এই ক’দিন আগে আপনার মুখেই যে—কাহিনী শুনেছি—যে—বিপদে আপনাকে পড়তে হয়েছিল, পাছে সেই রকম আবার কোন—”

বাধা দেয় শিখা। গম্ভীর মুখে সে বলে—”কিন্তু একটা অনিশ্চিত বিপদের ভয়ে চুপচাপ নিশ্চেষ্ট হয়ে ঘরে বসে থাকা যায় না যতীনবাবু। রুবি আমার বন্ধু—তার বিপদে আমি যদি না যাই, বা সামর্থ্য থাকতেও যদি তাকে না দেখি,—না, সে আমি পারব না, যতীনবাবু।”

যতীনবাবু মাথা চুলকোন, স্পষ্ট করে কোন কথা বলতে পারেন না। কেবল বলেন—”কিন্তু এতে বিপদ ঘটতে পারে!”

শিখা বিস্মিত কণ্ঠে বলে—”কেন? বিপদ ঘটতে পারে কেন?”

যতীনবাবু বললেন—”যারা মিঃ দৌলতরামের মত বাঘা পুলিশ অফিসারকে মারবার মতলব করেছিল, তাদের দৃষ্টি যে রুবির উপর নেই—তা মনে করবেন না। আপনি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলেই তারা বুঝবে, আপনি নিশ্চয় তাদের কাজ নিয়েছেন। সম্প্রতি আপনি ওদের কাছে যে চুক্তিনামা লিখে খালাস পেয়েছেন, সে—সর্ত্ত মিথ্যা বলে ওরা জানবে, আর তার ফলে আবার আপনাকে যেমন করে হোক বিপদে ফেলতে পারে, আমি সেই কথা বলছি। আমার কথা আপনি একটু ভেবে দেখবেন, এই আমার অনুরোধ।”

যতীনবাবু বিদায় নিলেন।

শিখা ভাবছিল, সত্যই রুবির কাছে তার এখন যাওয়া সঙ্গত হবে কিনা? সে বেশ বুঝতে পারে যে মোহনচাঁদের লোকেরা তার উপরে গোপনে নজর রেখেছে, সুতরাং সে যদি রুবির সঙ্গে দেখা করতে যায় তাহলে সে কথা মোহনচাঁদের অগোচর থাকবে না।

যাই হোক, মুন্সী সাহেবের সঙ্গে আগে দেখা করা দরকার। তিনি থাকেন পার্ক সার্কাসে। ফোন নম্বরটা দেখে সে ফোন করে। কিন্তু ফোনে জবাব পায়, মুন্সী—সাহেব অসুস্থ, সে জন্য তিনি কোথাও যাতায়াত করতে পারেন না। সন্ধ্যার দিকে শিখাকে যেতে বলেন।

তাই তো—ভারি মুস্কিল হলো!

অগত্যা শিখাকেই যেতে হবে। এই সাঙ্কেতিক লেখাগুলোর মর্ম্মোদ্ধার করতে হবে। কে জানে, হয়তো কিছু সূত্র মিললেও মিলতে পারে।

সন্ধ্যার কিছু আগে রতনকে দিয়ে একখানা ট্যাক্সি ডাকায় শিখা। তারপর মাকে বলে রতনকে নিয়ে সে ট্যাক্সিতে উঠে বসে।

ট্যাক্সি চলে।

বেলা তখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। গড়ের মাঠে কি একটা মিটিং হচ্ছে, মনুমেণ্টের কাছে অসংখ্য লোক জমেছে, লাউড—স্পীকারে লেকচার শোনা যাচ্ছে।

পথে আলো জ্বলতে সুরু হয়।

গড়ের মাঠ ছাড়িয়ে যেতেই শিখা বিস্ময়ে চেঁচিয়ে ওঠে—”এই রোখো রোখো—”

বিস্মিত চোখে সে তাকিয়ে দেখে, পথের পাশে দাঁড়িয়ে রুবি! মুখখানা দেখে মনে হয়, যেন কার সন্ধান করছে সে! যেন অত্যন্ত অসহায়!

ট্যাক্সি থামলে শিখা দ্রুত দরজা খুলে নেমে রুবির দিকে এগিয়ে যায়।

”রুবি! তুমি এখানে! কি ব্যাপার?”

”রুবি ফিরে তাকায়, বিস্মিত কণ্ঠে বলে—”শিখা!”

শিখা উত্তর দেয়—”হ্যাঁ, শিখাই। কিন্তু তুমি সন্ধ্যাবেলা এই অন্ধকারে পথের ধারে একা দাঁড়িয়ে। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না! ব্যাপার কি বলো?”

ক্লান্ত কণ্ঠে রুবি বলে—”সে খুব আশ্চর্য্য ব্যাপার শিখা—একেবারে অদ্ভুত! তুমি তো জান, আমি কলকাতার সব জায়গা চিনিনে; হোষ্টেলে থাকলেও হোষ্টেলের বাইরে বড় চলাফেরা করিনি, আমার বাবা পছন্দ করতেন না এসব।”

শিখা বললে—”জানি। কিন্তু তুমি এখানে এ—রকম ভাবে? তাই জিজ্ঞাসা করছি।”

রুবি উত্তর দিলে—”তুমি শুনেছ কি না জানি না, কাল এখানে…মানে, কলকাতায় আসবার সময় আমি আর বাবা ট্রেনের কামরায়…আমাদের উপর কি ভয়ানক জুলুম আর অত্যাচার হয়! বাবা…”

বলতে বলতে রুবি হঠাৎ থেমে যায়। অদূরে পাতলা—অন্ধকারে কি যেন সে লক্ষ্য করে, তারপর ভয়ার্ত্ত—কণ্ঠে বলে—”তোমার গাড়ী আছে শিখা? এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে চল, গাড়ীতে চল! আমার এক মাসির বাড়ী টালিগঞ্জে—রিজেণ্ট পার্কে, সেখানে আমার যাবার কথা…কিন্তু তোমার জন্য শুধু এখানে…আমায় সেখানে পৌঁছে দিতে পার যদি, আমার ভারি উপকার হয়। আমাকে দেখে আশ্চর্য্য হচ্ছ বুঝতে পারছি। গাড়ীতে চল। পথে যেতে যেতে সব কথা তোমাকে বলব। চল।”

শিখা বুঝতে পারে, কোন কারণে সে ভয় পেয়েছে। সে বলল—”এস। এই আমার ট্যাক্সি!”

রতন কাছে দাঁড়িয়ে ছিল, সে গাড়ীর দরজা খুলে দিল। শিখা উঠেছে, রুবি উঠতে যাবে, এমন সময় হঠাৎ ‘গুড়ুম’ করে শব্দ! সঙ্গে সঙ্গে আর্ত্ত চীৎকার করে রুবি মাটিতে পড়ে যায়। রতন সচকিতে সরে যায় মোটরের ও—পাশে। তার ভয় হলো তাকেও বুঝি গুলি করবে লোকটা!

ত্রস্তে শিখা নেমে পড়ে গাড়ী থেকে।

অন্ধকার ছড়িয়ে পড়েছে দিকে দিকে। গড়ের মাঠের এদিকটায় বিচ্ছিন্ন ভাবে দূরে দূরে আলো জ্বলছে—সে—আলোয় অন্ধকার দূর হয়নি, পাতলা হয়েছে মাত্র। দেখা গেল, দূরে ক’জন লোক ছুটে পালাচ্ছে—রিভলভারের শব্দ শুনে এদিক—ওদিক থেকে লোকজন ছুটে আসছে। যে লোকগুলো পালাচ্ছিল, তারা ভিড়ের মাঝে মিলিয়ে গেল!

এসে পড়ে কর্ম্মতৎপর পুলিশ আর পথের বহু লোক।

রুবি তখন মূর্চ্ছিত হয়ে পড়েছে। গুলি বিঁধেছে তার বাঁ—কাঁধে। শিখা সে—জায়গাটা চেপে ধরেছে, রক্তে তার হাত ভিজে উঠেছে!

তাড়াতাড়ি মূর্চ্ছিতা রুবিকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হলো।

তাকে ডাক্তারদের তত্ত্বাবধানে দিয়ে বিমর্ষ মুখে রতনকে নিয়ে শিখা আসে বউবাজার থানায়।

যতীন্দ্রনাথ তখন সবে অফিসের চেয়ার ছেড়ে উঠেছেন, শরীর বিশেষ ভালো নয়, সেজন্য তিনি বাড়ী যাবেন।

এমন সময় শিখাকে আসতে দেখে তিনি আশ্চর্য্য হয়ে যান—”আবার কি হলো মিস্ রায়? এমন ব্যস্ত হয়ে আসবার মানে?”

ক্লান্ত ভাবে একখানা চেয়ারে বসে পড়ে শিখা। বলে—”রুবিকে ওরা গুলি করেছে যতীনবাবু। তাকে মেডিকেল কলেজে দিয়ে এলুম।”

”রুবিকে গুলি!”

যতীন্দ্রনাথ আকাশ থেকে পড়েন—”তাকে আপনি পেলেন কোথায়? কোথায় কারা গুলি করলে?”

শিখা উত্তর দেয়—”পার্ক সার্কাসে যাবার পথে গড়ের মাঠের ধারে রুবিকে দেখে আমি গাড়ী থেকে নেমে তার সঙ্গে কথা বলছিলুম। তাকে গাড়ীতে তুলে নেবার সময় কে তাকে গুলি করে! কে—কিছু বুঝতে পারিনি। চারদিকে সোরগোল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো, ক’টা লোক ছুটে পালালো! পথের লোকজনের সাহায্যে রুবিকে গাড়ীতে তুলে তাকে হসপিটালে পৌঁছে দিয়েই আপনার কাছে এসেছি। আপনাকে এখনি একবার যেতে হবে।”

যতীন্দ্রনাথ মুহূর্ত্ত কয়েক নীরব থাকেন। তারপর বলেন—”আমি আজই সকালে আপনাকে বলেছি মিস্ রায়, আপনি রুবির সঙ্গে দেখা করবেন না! তাতে কেবল আপনার নয়—তাঁরও ক্ষতি হবার আশঙ্কা ষোল আনা। দুজনকেই নানা বিপদে পড়তে হবে! রুবি সেখানে যে—কোন কারণেই দাঁড়িয়ে থাকুন, আপনার সোজা চলে যাওয়া উচিত ছিল।”

শিখার ট্যাক্সিকে বিদায় দিয়ে তিনি রতন আর শিখাকে নিয়ে নিজের জিপে উঠলেন। জিপ চলল মেডিকেল কলেজে।

যতীন্দ্রনাথ বললে—”আমার মনে হয় এ গুলি রুবিকে লক্ষ্য করে ছোড়া হয়নি! যে ছুড়েছে অন্ধকারে দূর থেকে সে ঠিক বুঝতে পারেনি, আপনি আগে ট্যাক্সিতে উঠেছেন! সে বা তারা মনে করেছিল, আগে রুবিকে তুলে দিয়ে তারপর আপনি উঠছেন! যাই হোক, গুলির চোট যদি সাংঘাতিক না হয়ে থাকে, তবেই সব খবর জানা যাবে।”

ছয় – মোহনচাঁদ

খিদিরপুরে গঙ্গার ধারে বস্তী—অঞ্চল। সার—সার টালি—খোলার ঘর। মধ্যে মধ্যে টিনের বাড়ীও আছে। একতলা—দোতলা বাড়ীই অধিকাংশ…তেতলা বাড়ীও আছে অনেকগুলো।

এমনই একটা তেতলা বাড়ীর দোতলার এক বড় ঘরে জমেছে পনের—কুড়িজন লোক।

কাঠের মেঝেয় লম্বা মাদুর বিছানো, দেয়ালের দিক ঘেঁষে একটা গদির উপর চাদর বিছানো, তার উপর বসে যে—লোকটি দামী সিগার টানছে, তার পোষাক—পরিচ্ছদ বনেদী রকমের।

ঘরে নীল আলো জ্বলছে—আবছা হলেও প্রত্যেককে স্পষ্ট দেখা যায়।

ফরাসের উপর যে লোকটি বসে, সে এই দলের দলপতি বা সর্দ্দার। এরই নাম মোহনচাঁদ—দুর্দ্দান্ত দস্যু মোহনচাঁদ। আজই সে এসে পৌঁছেছে এখানে। বাংলাদেশের কলকাতার দলের ক’জনও এসে পৌঁছেছে! কিন্তু মুরারি সরকার এখনও এসে পৌঁছায়নি—তার উপর এখানকার কাজের ভার অর্পণ করা আছে।

মোহনচাঁদের দলে সব দেশের আর সব জাতির লোকই আছে! সকলেরই সমান অধিকার। বাংলাদেশের ভার বাঙালী মুরারি সরকারের উপর। জন্মাবধি বাংলায় না থাকলেও সে বাঙালী—সেই জন্যই বাংলাদেশে সে যে—কোনো কাজ করতে পারবে—পারা তার উচিত অন্ততঃ, এই ধারণাতেই মোহনচাঁদ মুরারির ওপর বাংলাদেশের ভার দিয়েছে।

রাত হয়ে যাচ্ছে—মুরারি সরকারের আসবার কথা সন্ধ্যার সময়। এত দেরী কেন?

বিরাটী গ্রাম কলকাতা থেকে এমন কিছু বেশী দূরে নয়। মোটর খারাপ হলে ট্রেন আছে, বাস আছে—কতটুকু সময় লাগে?

হাতের ঘড়ির পানে মোহনচাঁদ তাকায়, আটটা প্রায় বাজে।

হয়তো কোনো ফ্যাসাদে পড়েছে!

পুলিশের সতর্ক দৃষ্টি সর্ব্বদা দলের সকলের উপর। যে কোন মুহূর্ত্তে বিপদ ঘটা বিচিত্র নয়! বিশেষ এই খিদিরপুর অঞ্চলটা—এই বস্তীগুলোর উপর পুলিশের শ্যেন দৃষ্টি সব সময় বেশ প্রখর হয়ে আছে। এ—সব অঞ্চলে চুরি—জুয়াচুরি, জাল—জালিয়াতি, ডাকাতি, খুন—নিত্যকার ঘটনা।

অধীর হয়ে ওঠে মোহনচাঁদ।

দিল্লী থেকে ট্রেনে সে আজ এসে পৌঁছেছে। ছদ্মবেশী মোহনচাঁদকে পুলিশ ধরতে পারেনি, এতটুকু সন্দেহও করতে পারেনি।

দিল্লীতে সম্প্রতি একটা ব্যাঙ্ক লুঠ হয়ে গেছে। দিনের বেলায় প্রকাশ্যে এ—রকম ডাকাতি কেউ কোনদিন দেখেনি। চারজন মাত্র লোক এক লাখ বিশ হাজার টাকা হস্তগত করে রিভলভারে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে ব্যাঙ্ক থেকে বেরিয়ে জিপে উঠে পালিয়ে যায়। ব্যাঙ্কের লোকজন তাদের ধরবার চেষ্টা করেছিল—কিন্তু পারে নি। ডাকাতদের গুলিতে ক’জন সাংঘাতিক জখম হয় এবং দুজন দারোয়ান মারা যায়। পুলিশের চোখের সামনে দিয়ে বিদ্যুৎবেগে জিপখানা অন্তর্হিত হয়ে যায়। চৌমাথায় গিয়ে অসংখ্য লরি, জিপ আর প্রাইভেট মোটরের সঙ্গে মিশে কোন দিকে উধাও হয় তা কেউ বুঝতে পারে না—অবশ্য চারদিকেই পুলিশের জিপ আর মোটরবাইক ছুটেছিল—কিন্তু সে জিপ ধরা পড়েনি।

এই ব্যাপারের পরেই দিল্লী পুলিশ তৎপর হয়ে ওঠে। তারা বুঝতে পারে যে মোহনচাঁদ দিল্লীতে এসেছে। এ—কাজ যে তার এবং তার অসীম—সাহসী অনুচরদের দ্বারা হয়েছে, তাতে দিল্লী—পুলিশের অণুমাত্র সন্দেহ থাকে না। আজ ক’দিন ধরে দিল্লী—পুলিশ চারদিকে ওৎ পেতে আছে, তার ফাঁকে মোহনচাঁদ খাঁটি ইউরোপীয়ানের বেশে দিল্লী থেকে কখন চলে এসেছে কলকাতায়—তারা জানতেও পারেনি!

ঠিক আটটার সময় এসে পৌঁছুলো মুরারি।

বিদ্রূপের সুরে মোহনচাঁদ বললে—”বাঙ্গালী চিরদিনই সময় সম্বন্ধে বেহুঁশিয়ার রয়ে গেল, সরকার। পাংচুয়ালিটি আর কোনদিনই শিখল না!”

মুরারি বিনীত ভাবে অভিবাদন করে ফরাসের একপ্রান্তে বসলো। ক্লান্ত কণ্ঠে বললে—”কিন্তু আমার দোষ নেই স্যর, পুলিশ যা আরম্ভ করেছে—”

মোহনচাঁদের মুখ গম্ভীর হয়ে ওঠে। সে বলে—”কি রকম?”

মুরারি উত্তর দেয়—”মনে হয়, আমাকে তারা সন্দেহ করেছে! পুলিশের ইনফরমারী করলেও তারা আমাকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না যেন!”

মুরারি কোন রকমে ক্যালকাটা—পুলিশে ইনফরমারের কাজ যোগাড় করে নিয়েছে। বউবাজার থানার সঙ্গেই তার কাজ।

মুরারির মুখে শোনা যায়—আজ ক’দিন থেকে ও. সি. যতীন্দ্রনাথ তার উপর কড়া নজর রাখছেন। সেদিন হঠাৎ একখানা চিঠি দিয়ে তাকে মিস্ রায়ের কাছে যেতে আদেশ দেন। মূরারি বাধ্য হয়ে বেরোয়, কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার অছিলায় নিজে না গিয়ে একজন কনষ্টেবলকে সে শিখার কাছে পাঠায়।

বিনা সন্দেহে যতীন্দ্রনাথ তাকে শিখার কাছে পাঠাননি নিশ্চয়! শিখার কাছে তিনি সব কথা নিশ্চয় শুনেছেন। তিনি খোঁজ নিচ্ছেন তাই! তার উপর এই দৌলতরামের ঘটনা কলকাতার পুলিশ—মহলে চাঞ্চল্য জাগিয়ে তুলেছে কম নয়।

মোহনচাঁদ হেসে বলে—”লোকটা বেঁচে গেল, এইটেই সবচেয়ে আশ্চর্য্যের কথা! এই দুর্দ্দান্ত বদমায়েস লোকটা—ও কি মানুষ? মানুষের খোলশে জানোয়ার! তা যাই হোক হাসপাতালের চার্জ্জে আছে কে?”

একটি লোক উঠে দাঁড়াল, সসম্ভ্রমে সেলাম দিয়ে অবনত মস্তকে বললে—”জনাব, আমি।”

ভ্রূকুঞ্চিত করে মোহনচাঁদ তার পানে তাকাল, বললে—”বটে! তোমায় তো এর আগে দেখিনি। নতুন এসেছ বোধ হয়? নাম?”

লোকটি আবার সেলাম দেয়, বলে—”করিমবক্স জনাব।”

মুরারি তার পরিচয় দেয়—”ময়মনসিংয়ের করিমবক্স স্যর, ডাক—সাইটে নাম। এই চল্লিশ বছর বয়সের মধ্যে অন্ততঃ ষাটটা খুন করেছে আর রাহাজানি, লুঠপাট, চুরি, ডাকাতির তো সংখ্যাই নেই।”

বাধা দেয় করিমবক্স, বলে—”চুরি কথাটা বলো না সরকার সাহেব। কমিরবক্স মরদ—বাচ্চা—ছুঁচো মেরে সে হাত গন্ধ করে না। আমরা মারি তো হাতী—লুঠি তো ভাণ্ডার!”

ভ্রম সংশোধন করে নেয় মুরারি। বলে—”ঠিক, ঠিক, সাচ্চা বাত বলেছ! আমি ভুল করেছিলাম। যাই হোক, খাঁ সাহেব কাজের লোক। তাই করিমবক্স সাহেবকে আমি দলে নিয়েছি।”

এরপর চলে পরিচয়ের পালা।

—”এই যে বেঁটে লোকটিকে দেখছেন স্যর”, মুরারি পরিচয় দিতে থাকে, ”ইনি হচ্ছে মধ্য—ভারতের নাম—করা লোক বিশ্বনাথজী। আপনি এঁর নাম শুনেছেন! এঁর জুড়ি আর কোথাও নেই।—আর, ইনি হচ্ছেন আমাদের তিনকড়ি চক্রবর্ত্তী, দিন গেলে আমাদের কারখানায় হাজার হাজার নোট তৈরী করছেন। আর এই রাধাকৃষ্ণণ—সে—সব নোট বাইরে বেমালুম চালান করছেন।”

মোহনচাঁদের মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, বাংলাদেশে মুরারি বেশ বিরাট গোষ্ঠী গড়ে তুলেছে দেখে। এরা সবাই মোহনচাঁদের নাম জানে, চোখে তাকে কেউ দেখেনি! ছদ্মবেশী মোহনচাঁদকে তারা দেখে—যার মুখে ফ্রেঞ্চ—কাট দাড়ি, দীর্ঘ গুম্ফ, পরণে ইউরোপীয়ান পোষাক! আসল চেহারা কি—রকম, এরা জানে না।

খুশী—মনে মোহনচাঁদ বলে—”চমৎকার কাজ করছ মুরারি। এর জন্যে আমি তোমায় রীতিমত খুশী করব। তারপর সেই মেয়েটি—সেই অগ্নিশিখা রায়—তাকে ছেড়ে দিয়েছ, শুনলাম। তাকে বলেছ, আমার হুকুম নিয়েছ! ছি ছি, আমি তো তাকে ছেড়ে দেবার হুকুম দিইনি মুরারি।”

মুরারির মুখ পাংশু হয়ে যায়, অসহায়ভাবে সে মাটির পানে তাকায়। তারপর ক্ষীণ কণ্ঠে বলে—”আজ্ঞে, আপনার নাম করেই আমি তাকে ছেড়ে দিয়েছি স্যর! মেয়েটা একেবারেই ছেলেমানুষ।”

”থামো!”

ধমক দেয় মোহনচাঁদ। বলে—”ছেলেমানুষ সে মোটেই নয়, সে যে কি ভয়ানক মেয়ে, তা তুমি জান না সরকার। তাকে ছেড়ে দিয়ে অত্যন্ত বোকার মত কাজ করেছ তুমি। ওর জন্যই পুলিশ তোমায় নিজেদের লোক জেনেও সন্দেহ করছে! হয়তো ধুরন্ধর অফিসার যতীন্দ্রনাথ এতদিন তোমায় গ্রেপ্তার করত—করছে না, আরো ভালো রকম প্রমাণ পাবার আশায়। হয়তো তোমার পিছনে চর লাগিয়েছে, তুমি কোথায় যাও, কি কর, এই সব খবর নিতে নিতে কোন রকমে আমাদের ঘাঁটির খোঁজ পেলেই তোমার কোমরে দড়ি আর হাতে হাতকড়া লাগাবে, জেনে রেখো।”

মুরারি একান্ত অসহায় ভাবে তাকায়—তার দু—চোখে করুণ দৃষ্টি।

অর্দ্ধদগ্ধ সিগারটা এক কোণে ছুড়ে ফেলে মোহনচাঁদ বলে—”হ্যাঁ, রুবিকে আটক করেছ শুনলাম। তাকে কোথায় রেখেছ?”

মুরারি বললে—”উপস্থিত এই বাড়ীতেই রেখেছি। রাণী ওর মাসির লোক বলে হাসপাতাল থেকে নিয়ে এসেছে—কেউ সন্দেহ করেনি।”

মোহনচাঁদ বললে—”আমি একবার দেখতে চাই।”

”আসুন।”

মুরারি উঠে দাঁড়ায়, বলে—”এখানে রাণীর জিম্মাতেই সে আছে,—রাণী তাকে দু’দিনে ঠিক করে দেবে। আপনি আসুন, দেখবেন।”

সাত – ইঙ্গিত

ঘরে আলো থাকলেও সিঁড়িতে আলো ছিল না। কাঠের সিঁড়ি সোজা তেতলায় উঠে গেছে। টর্চের আলো ফেলে তড়তড় করে মোহনচাঁদ উপরে উঠে যায়, মুরারি সন্তর্পণে উঠতে থাকে। একবার পা সরে গেলে নিচেয় পড়ে হাত—পা ভাঙ্গা…….এমন কি মৃত্যু পর্য্যন্ত হতে পারে।

তেতলায় একখানি মাত্র ছোট ঘর। একদিকে একটি জানালা, আর একটি দরজা। সে দরজাও বাইরের দিক থেকে বন্ধ। দরজার সামনে বারান্দায় একখানি খাটিয়ায় বসে মুরারির বর্ণিত রাণী কি করছিল।

মোহনচাঁদকে দেখে সে ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াল, তারপর আভূমি প্রণত হ’ল।

মৃদু হেসে মোহনচাঁদ বলল—”তারপর, খবর ভালো রাণী? এখানে কোন কষ্ট হচ্ছে না তো?”

রাণী করযোড়ে উত্তর দেয়—”না মহারাজ, কেবল দেশ ছেড়ে আসা—সেই কষ্ট খুব বেশী করে লাগছে। একবার যদি যেতে পারতাম, বাড়ীতে কিছু জিনিষপত্র টাকা—কড়ি লুকানো আছে, সেগুলো আনা যেত।”

মোহনচাঁদ শান্ত কণ্ঠে বলল—”দেশে যাওয়া মানে, ফাঁসির দড়ি গলায় পরা! তুমি খুনী আসামী! এক রাত্রে দুজন কনষ্টেবলকে গুলিতে কাবার করেছ। ক’বছরেও জেন, পুলিশ তোমায় ভোলেনি। তোমার নামে দু—হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা আছে—যে তোমায় ধরিয়ে দিতে পারবে, সে পাবে। মনে কর একদিনের কথা—যেদিন আমার পা জড়িয়ে ধরেছিলে—সেদিন আমি তোমায় আশ্রয় দিয়েছিলাম, তোমাকে বিহার থেকে এখানে পাঠিয়েছিলাম। পুলিশ এখনও তোমার সন্ধান করছে—কাজেই বাংলাদেশে এই সহর কলকাতায় তুমি নিরাপদে আছ, জেন।”

রাণী আবার অভিবাদন করে।

মুরারি ইঙ্গিতে সে দরজার তালা খোলে।

মেঝেয় একখানা কম্বলের উপর দৌলতরামের আদরিণী কন্যা বিলাস—লালিতা রুবি মৃতের মত পড়ে আছে।

এ অবস্থায় মানুষের চোখে ঘুম আসে না। রুবিও চোখ বুজে পড়ে আছে, ঘুমোয়নি। তাই রাণী দরজা খুলে ঘরে ঢোকবার সঙ্গে সঙ্গে সে সভয়ে উঠে বসে।

আজ চারদিন সে এখানে এসেছে,—প্রথম দিন জলস্পর্শ করেনি; দ্বিতীয় দিনে রাণীর তাড়নায় বাধ্য হয়ে আহার্য্য গ্রহণ করেছে; কিন্তু সে অতি সামান্য—বাঁচবার জন্য যেটুকু প্রয়োজন, কেবল সেইটুকু মাত্র।

রাণী আলো জ্বালে—একটা লণ্ঠন।

এ সময় রাণীর আগমন অশুভ সূচনা! রুবি কোন কথা জিজ্ঞাসা করে না, রাণীর দিকে শুধু চেয়ে থাকে নির্ব্বাক দৃষ্টিতে।

রাণী বলে—”সর্দ্দারজী এসেছেন। তিনি একবার তোমায় দেখতে চান, হয়তো কিছু কথা বলতে চান তোমার সঙ্গে। তাঁকে আসতে বলছি।”

উঠে দাঁড়ায় রুবি। তার বুকের ভিতরটা ঢিপ ঢিপ করে ওঠে।

দস্যু—সর্দ্দার মোহনচাঁদের নাম সে জানে। পিতার উপর এই দস্যুর কি ভয়ানক আক্রোশ…পেলে বোধ হয় হাতে মাথা কাটে! মোহনচাঁদের জুলুমের জন্যই পিতা আজ হাসপাতালে আর সে এই বিজন—পুরীতে বন্দিনী হয়ে আছে। কিছুদিন আগে জয়নারায়ণের কাছে এক ত্রিশূলাঙ্কিত পত্র যায়। পত্রে লেখা ছিল—জয়নারায়ণ প্রভূত অর্থ উপার্জ্জন করেছেন,—ভারতের দরিদ্র—নারায়ণের সেবায় মোহনচাঁদ তার পুরাতন বন্ধুর কাছে মাত্র পঞ্চাশ হাজার টাকা প্রার্থনা করে। সে প্রমাণ দেবে—এ টাকা নিজের বিলাস—ব্যসনে ব্যয় করবে না; পাঞ্জাব প্রদেশের দরিদ্র জনসাধারণ খেতে পাচ্ছে না, তাদের জন্য সে এ টাকা প্রার্থনা করছে—এ টাকা সে তাদের দান করবে।

সাতদিনের মধ্যে টাকা পৌঁছে দেবার কথা। না দিলে জয়নারায়ণের মৃত্যু কেউ রোধ করতে পারবে না।

এই পত্রের কথা জানতে পেরে দৌলতরাম এলাহাবাদ থেকে দিল্লী যান এবং ঠিক তার পরের দিন জয়নারায়ণ ব্যাঙ্কে অনেক কিছু ধনরত্ন জমা দিয়ে প্লেনে চড়ে লণ্ডন যাত্রা করেন।

এরপরই পত্র আসে দৌলতরামের নামে। তাঁকে জানানো হয়, তিনি তাঁর পুত্রকে বিদেশে পাঠালেও তার জীবন নিরাপদ নয়! মোহনচাঁদ প্রার্থনা করল রুবিকে…জানাল, যে—কোন রকমে হোক এক—মাসের মধ্যে রুবিকে সে নিয়ে আসবে।

ভয় পান দৌলতরাম। রুবিকে নিয়ে তিনি দিল্লীতে গেলেন, সেখানে চাঁদনী—চকের মত জনবহুল স্থানে রুবি একদিন আক্রান্ত হয়। এরপর রুবির জিদে তিনি কলকাতায় শিখার কাছে রুবিকে নিয়ে আসছিলেন—পথে ট্রেনের কামরায় ঐ বিপদ!

শিখার সন্ধান রুবি করেছিল—ডেপুটি—কমিশনার তাকে নিজের বাড়ীতে নিয়ে রেখেছিলেন। যেদিন রুবির উপর আক্রমণ হয়, সেদিন পুলিশের গাড়ীতে করে সে এসেছিল হাসপাতালে দৌলতরামকে দেখতে—হাসপাতালে এক কনষ্টেবল তাকে একখানা চিঠি দেয়। তাতে লেখা ছিল—শিখা মনুমেণ্টের কাছে রুবির জন্য অপেক্ষা করছে—বিশেষ দরকার, রুবি যেন শীঘ্র গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করে।

রুবি চিঠি পেয়ে এক মিনিট দেরী করেনি, দুজন পুলিশ—কনষ্টেবলের সঙ্গে তাদের মোটরে নির্ভয়ে ময়দানে এসে নামে। একজন কনষ্টেবল তাকে নিয়ে শিখার কাছে যাচ্ছিল—তারপর সে যে কোথায় উধাও হলো, রুবি জানে না।

শিখার দেখা সে পেল বটে, কিন্তু তার গাড়ীতে উঠবার মুখেই সে গুলি খেয়ে অজ্ঞান হয়ে গেল। তারপর হাসপাতাল থেকে কৌশলে নিয়ে এসে তাকে আটক করেছে এরা।

কলকাতা শহরের রাস্তাঘাট সে ভাল চেনে না। তাছাড়া তাকে ঘর থেকে বাইরেও যেতে দেওয়া হয় না কোন সময়। কারো সঙ্গে তার দেখা হয় না। রাণী ছাড়া আর কেউ কাছে আসে না।

মোহনচাঁদ দরজার সামনে দাঁড়াল। তাকে দেখেই রুবি অত্যন্ত সঙ্কুচিত হয়ে এক কোণে সরে বসে।

মোহনচাঁদ স্নিগ্ধ কণ্ঠে বলে—”তোমার কোন ভয় নেই। এখানে তোমার থাকবার কোন অসুবিধা হবে না। তুমি নিশ্চয় জান, মোহনচাঁদ এ পর্য্যন্ত মেয়েদের উপর কোন পীড়ন বা অত্যাচার করেনি, আর কোনদিন তা করবেও না।”

রুবি কতকটা ভরসা পায়।

এতক্ষণে সে মোহনচাঁদের মুখের পানে তাকাতে পারে। লণ্ঠনের স্তিমিত আলো মোহনচাঁদের সুগৌর মুখে পড়েছে, স্পষ্ট দেখা গেলেও আবছা খানিকটা দেখা যায়।

রুবির মুখে বিদ্রূপ—হাসির রেখা ফুটে উঠল। সে বলল—”জখম করে আটকে রেখে তারপর ভাল—মন্দর প্রশ্ন উপন্যাসের মত শোনায় না মিষ্টার মোহনচাঁদ?”

মোহনচাঁদ গম্ভীর হয়ে বলে—”কথাটা ঠিক! কিন্তু উপায় নেই বলেই তোমাকে আনতে হয়েছে। তোমার বাবা দৌলতরামজী আমাকে গ্রেপ্তার করবার জন্যে অনেক দিন থেকে উঠে পড়ে লেগেছেন। তোমার ভাইটিও বড় কম যান না। আজ আমি যদি বলি, আমার সর্ব্বস্ব নিয়ে তোমার দাদা এত বড় কারবার ফেঁদেছে, সে কথা বিশ্বাস করবে তুমি?”

রুবি অবিশ্বাসের হাসি হাসে, বলে—”ডাকাতি, রাহাজানি, খুন, চুরি, গুম করা যার পেশা, তার সর্ব্বস্ব নিয়ে আমার ভাই ব্যবসা ফেঁদেছেন, এ—কথা আমি বিশ্বাস করি না।”

মোহনচাঁদ শান্তকণ্ঠে বলে—”কিন্তু একদিন বিশ্বাস করবে রুবি! এ ভুলকে সত্য বলে তুমি খুশী থাকতে পার—কিন্তু জেন, আমার পাওনা যতদিন না মিটবে, ততদিন আমি তোমায় ছেড়ে দেব না; আর তোমার বাবাকেও ঠিক ওই অবস্থায় দিন কাটাতে হবে।”

তীক্ষ্ন কণ্ঠে রুবি বলে—”আমাকে আটকে রেখে ভয় দেখাতে এসেছেন!”

মোহনচাঁদ উত্তর দেয়—”ভয় দেখাচ্ছি না। শীঘ্রই তুমি বুঝবে, কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা!…এখন কিছু বলব না—তোমার ভুল নিয়ে তুমি থাক। তবে জেনে রাখ, তোমার বাপ—ভাই যতদিন না আমার পাওনা মিটোবেন, ততদিন তোমায় এমনই ভাবে বন্দিনী হয়ে থাকতে হবে।”

মোহনচাঁদ বেরিয়ে যায়।

সঙ্গে সঙ্গে বাইরে থেকে ঝনাৎ করে দরজা বন্ধ হয়ে গেল।

রুবি কতকটা নিশ্চিন্ত হয় মোহনচাঁদের কথায়।

মোহনচাঁদকে সে আর একবার দেখেছিল, তখন জয়নারায়ণ বিলাতে যাবার উদ্যোগ করছে, তার সাথী হয়েছিল মোহনচাঁদ।

সেদিন দৌলতরাম ছিলেন দারোগা—সামান্য বেতন পেতেন। রুবি তখন কলকাতায় স্কুলে পড়ে, হোষ্টেলে থাকে। মোহনচাঁদের পরিচয় পেয়েছিল, বিহারের এক সমৃদ্ধ ঘরের ছেলে সে, প্রচুর অর্থসম্পদ তার! রুবি ভাবে—সেই মোহনচাঁদ, আজ দুর্দ্দান্ত দস্যু—দলপতি। এর আদেশে খুন, লুঠ, ডাকাতি, রাহাজানি সব কিছু হছে, যুক্তপ্রদেশে, বিহারে তার পরিচয় কে না জানে? বাংলাও তার নাম জানে, কাজের পরিচয় পেয়েছে। তবে এতকাল বাংলায় তার আসবার প্রয়োজন ছিল না—এবার সে বাংলায় নিজের লীলাক্ষেত্র গড়ে তুলেছে।

তবু কতক স্বস্তি পায় রুবি,—এখানে বন্দী থাকতে কেউ তার উপর কোন অত্যাচার করতে পারবে না!

নিশ্চিন্ত হয়ে শুয়ে পড়ে সে।

আট – পরিচয়

শিখার সময় নেই মোটে।

পুলিশ—কমিশনার বলেন—”জাল নোটে বাজার ছেয়ে গেল মিস্ রায়। কিছুদিন আগে এমনই জাল নোট বাজারে এত বেশী চালু হয়েছিল যে সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে লেন—দেনের ব্যাপারে নোট মোটে নিতেই চাইত না,—দলশুদ্ধ জালিয়াতদের ধরায় সেবার তোমার অদ্ভুত বাহাদুরি দেখেছি, অপূর্ব্ব! কিন্তু এবারকার ব্যাপার দেখছি আরও সঙ্গীন। দৌলতরাম জখম হবার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মেয়ে গায়েব হলো—আর অমনি এই জাল নোটের আমদানি। আমার বিশ্বাস, এ—সব ঐ মোহনচাঁদের কীর্ত্তি! দিল্লী—পুলিশ আমাদের ওয়ার্নিং—নোট দিয়েছে—আমরা যেন খুব বেশী রকম হুঁশিয়ার হই। মোহনচাঁদ কোথায় গা ঢেকে আছে, কখন কোথায় কি মূর্ত্তিতে তার আবির্ভাব হবে—দেবতারাও বোধ হয় আগে থাকতে তা জানতে পারেন না! দিল্লী—পুলিশের ধারণা, মোহনচাঁদ এখানে এসেছে। ওখানকার নামজাদা ডিটেকটিভ অফিসার লাল সিং এখানে আসছেন আমাদের সাহায্য করবার জন্যে। কিন্তু আমি তাঁর সাহায্য চাই না মিস্ রায়। আমাদের বাংলাদেশের পুলিশ—ডিপার্টমেণ্টের তাতে কলঙ্ক—দুর্নাম হবে। আমি জানি, কটা কেসে তুমি খুব কৃতিত্ব দেখিয়েছ—বিচক্ষণ পুলিশ—অফিসাররাও তেমন পারেন না! তুমি পুলিশ না হলেও তোমার যা বুদ্ধি—চাতুর্য্য আর ধৈর্য্য—সে—রকম অনেকেরই নেই! তাই আমি তোমাকে ডেকেছি, অনুরোধ করছি তুমি এ ভার নাও। আমাদের ডিটেকটিভ—ডিপার্টমেণ্টের সবচেয়ে পাকা অফিসার পরশুরাম থাকবেন তোমার সঙ্গে। তাছাড়া তোমার জানা যতীনবাবুও থাকবেন। এছাড়া আর যে—অফিসারকে তুমি চাও—পাবে। আমি তোমাকে এর জন্য চিঠি দিচ্ছি—লেটার—অফ—অথরিটি; সেই সঙ্গে স্পেশাল পাওয়ার। এতে তুমি ‘না’ বললে আমরা শুনবো না। আমি হোম—ডিপার্টমেণ্টের সঙ্গে এ—সম্বন্ধে কথা কয়ে ব্যবস্থা পাকা করে ফেলেছি মিস্ রায়।”

কমিশনার মিষ্টার গুপ্তর এমন অনুরোধ, শিখা এতে না বলতে পারে না। বিশেষ অনেক সময় শিখাকে তাঁর সাহায্য নিতে হয়। অন্য প্রভিন্সের ডিটেকটিভ বাংলায় এসে কেরামতি দেখিয়ে যাবে—বাঙ্গালীর মুখ তাতে কালো হবে, শিখারও তা সহ্য হবে না। বাংলায় নিপুণ ডিটেকটিভ অফিসার অনেক আছেন, যে—কোন বাঙ্গালী এ—কাজের ভার পেলে কথা ছিল না! কিন্তু দিল্লীওয়ালাকে সে এ—প্রশংসা অর্জ্জন করতে দেবে না।

মোহনচাঁদের একখানা ফটো আর তার পরিচয় সে চায়।

গুপ্ত তাকে ফটো দেন। পরিচয় শিখা যা পায়, তাতে সত্যই আশ্চর্য্য হয়ে যায়।

অতুল ঐশ্বর্য্যের অধীশ্বর মোহনচাঁদ। পাটনায় তার বাড়ী। যে—মন্দিরের বিগ্রহের অলঙ্কারপত্র চুরি হয়েছে এবং যেজন্য মন্দিরের বর্ত্তমান মালিক গিরিধারীলাল পুলিশ চেয়েছিলেন, সেই বিখ্যাত বিগ্রহ একদিন ছিল মোহনচাঁদের বংশগত সম্পত্তি। গিরিধারীলাল দৌলতরামের সম্বন্ধী। কি করে এই বিপুল সম্পত্তি তাঁর হস্তগত হয়, তা কেউ জানে না, এমন কি মোহনচাঁদ নিজেও জানতো না। মোহনচাঁদের বাবা নাকি তাঁর সম্পত্তি গিরিধারীলালের কাছে বন্ধক রেখেছিলেন এবং সেই সূত্রে গিরিধারীলাল মালিক হয়েছেন। এজন্য মোহনচাঁদ যে মর্ম্মাহত হবে, জানা কথা! এরপর মোহনচাঁদ তার মায়ের অলঙ্কারপত্র আর নগদ প্রায় লক্ষ টাকা নিয়ে বিলাতে চলে যায় এবং সেখানে নাকি তার খুব দামী এক ছড়া মুক্তার মালা চুরি যায়! যে ব্যাঙ্কে টাকা জমা রেখেছিল তার পাশ—বই, চেক—বই, আর কাগজপত্রও চুরি যায়, এবং ব্যাঙ্কে তার যে টাকাকড়ি ছিল—তার সই—করা চেকে নাকি তুলে নেওয়া হয়! মোহনচাঁদ বলে—চেক জাল। তার সই নয়।

মোহনচাঁদ বহুকাল য়ুরোপ ছিল—তারপর যখন খুন আর লুঠের কেসে আর্থার মূর ধরা পড়ল, তার দলের ক’জনও ধরা পড়ল, বিচারে আর্থার মূরের আর দলের ক’জনের হলো ফাঁসি—তখন নাকি মোহনচাঁদ ভারতে ফেরে; একা নয়, তার সঙ্গে দলের ক’জন ভারতীয় অনুচরও আসে। এসেই বোম্বাই প্রেসিডেন্সিতে তাঁর কীর্ত্তিকলাপ শুরু হয়। বোম্বাই পুলিশ আর ধনীর দল মোহনচাঁদের জন্য একেবারে তটস্থ! তারপর বোম্বাই ছেড়ে তার আবির্ভাব হয় যুক্তপ্রদেশে। মোহনচাঁদ আসবার সঙ্গে সঙ্গে গিরিধারীলাল নাকি কোথায় নিরুদ্দেশ হন। সেই ফাঁকে তাঁর বিগ্রহের অনেক টাকা আর দামী অলঙ্কারপত্র—হীরার অলঙ্কার, পান্না—মণি চুনি—মুক্তার অলঙ্কার চুরি! পুলিশ—অফিসার দৌলতরাম সেই থেকে মোহনচাঁদকে গ্রেফতার করবার জন্য কি চেষ্টাই না করছেন! দৌলতরাম কতকগুলো চিঠি পান—মোহনচাঁদের নিজের হাতে লেখা ঐ—সব চিঠিতে দৌলতরামকে রীতিমত শাসানো হয়েছিল, তাঁকে নাকি সগোষ্ঠী সাবাড় করবে মোহনচাঁদ!

কমিশনার গুপ্ত রেকর্ড খুলে দেখান শিখাকে—ভারতে এসে অবধি মোহনচাঁদ যেখানে যা—যা করেছে, তার বিস্তারিত বিবরণ। অথচ সব চেয়ে আশ্চর্য্যের কথা—সব প্রভিন্সেই জবরদস্ত অফিসাররা বহু চেষ্টা করেও মোহনচাঁদের কোন পাত্তা পাননি! খুন, লুঠ, রাহাজানি সমানে হচ্ছে—অথচ মানুষটার সন্ধান মেলে না! সব যেন ভূতে করছে! কোন প্রভিন্সেই খুব বেশী দিন নয়—হঠাৎ আবির্ভাব, হঠাৎ অন্তর্দ্ধান! সম্প্রতি ছ’মাস আগে পুলিশের সঙ্গে মোহনচাঁদের দলের ছোট—খাট একটা লড়াই হয়ে গেছে বিহারের চাম্পারণ জেলায়। চাম্পারণ—পুলিশের গুলিতে মোহনচাঁদ বেশ সঙ্গীন রকম জখম হয়েছিল—তবু ধরা পড়েনি। দলের লোক তাকে এমন ভাবে সরিয়ে দেয় যে, আজ পর্য্যন্ত তার সন্ধান মেলেনি! তার কয়েকজন অনুচর গ্রেপ্তার হয়। ফাঁসিকাঠে প্রাণ দেবে তবু মোহনচাঁদের সম্বন্ধে তাদের মুখে একটি কথা বেরুবে না! তাদের কত লোভ দেখানো হয়েছিল, শুধু মার্জ্জনা নয়—বেশ মোটা টাকা রিওয়ার্ড—তবু না!

লোকগুলোর অদ্ভুত ভক্তি! এই মোহনচাঁদের ব্যাপারে কমিশনার এখন নির্ভর করছেন শিখার উপর। এ বয়সে তার যে রকম সাহস আর বুদ্ধি—

সব কথা শুনে শিখা বাড়ী ফিরে আসে; ফটো আর রেকর্ডগুলো সঙ্গে নিয়ে আসে। এনে সেগুলো নিজের ঘরে বেশ সাবধানে রাখে; রতনকে বলে দেয়—আমার হুকুম ছাড়া এ—ঘরে কেউ আসবে না; তুমিও না!

রেকর্ডগুলো ড্রয়ারে রেখে শিখা বসল মোহনচাঁদের ফটো নিয়ে—চেহারাখানা ভালো করে দেখে প্রত্যেকটি খুঁটিনাটি ভাবভঙ্গী নিজের মনে এঁকে রাখে শিখা।

বয়স বেশী নয়। তরুণ যুবা—দেখতে চমৎকার—সুপুরুষ—বড় বড় দুটি চোখে বুদ্ধির দীপ্তি। চেহারা দেখলেই বোঝা যায়, বেশ বনেদী ঘরের মানুষ। বিপুল সম্পত্তি ছিল! শিখার মনে হ’ল, এমন চেহারা, এমন মুখ—মুখে পাপ বা অনাচারের এতটুকু ছায়া পাওয়া যায় না! এ মানুষ এমন কাজ করতে পারে—মন যেন সায় দিতে চায় না!

রুবির কথা মনে পড়ে।

তার চিঠি পেয়ে শিখা এলাহাবাদে গিয়েছিল—রুবি তখন এর পরিচয় দিয়েছিল। সে কতটুকু! রুবি হয়তো সব কথা জানে না। বাপ আর দাদার কাছে যেটুকু রুবি শুনেছে—ততটুকুই বলেছে শিখাকে।

জয়নারায়ণের কথা সে জানতে চেয়েছিল। কমিশনার গুপ্ত কিছু বলতে পারলেন না। বললেন, সন্ধান নিয়ে জানাবেন।

মা এসে বললেন—”তোর কি আহার—নিদ্রা ঘুচে গেল শিখা? সেই কোন সকালে দুটো ভাত মুখে দিয়েছিস আর তো কিছু খাসনি! আয়, খাবি আয়।”

রতন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল; হেসে বললে—”খাবেন কখন? ডিটেকটিভ—পুলিশের কাজ করলে কি খাওয়ার সময় পাওয়া যায়, মা?”

শিখা ধমক দেয়—”তুই থাম!”

নয় – অভাবনীয়

পরের দিন সকাল বেলা।

খবরের কাগজে শিখা পড়ছে ডাকাতির খবর—

কলিকাতার বড়বাজারে ভীষণ ডাকাতি

বিশাল সহর কলকাতার পথে প্রধান ব্যবসাকেন্দ্র বড়বাজারে ধনী ব্যবসায়ী ঝুনঝুনলালের গদীতে ডাকাত পড়ে চক্ষের নিমেষে প্রায় তিন লক্ষ টাকা নিয়ে বোমা ছুঁড়তে ছুঁড়তে সরে পড়েছে। বোমার ভয়ে কেউ অগ্রসর হতে সাহস করেনি। দু—একজন এগিয়ে গিয়েছিল, তাদের মধ্যে কেউ হয়েছে আহত, কেউ নিহত।

শিখার ললাট কুঞ্চিত হয়। কাগজখানা সে টেবিলে রাখে।

কাল সন্ধ্যায় নিজের চোখে যে ঘটনা দেখেছে, তাতে সব কিছু সম্ভব বলে মনে হচ্ছে।

যতীন্দ্রনাথের সঙ্গে কাল মধ্যমগ্রামের দিকে সে গিয়েছিল। যে—বাড়ীতে তাকে বন্ধ করে রাখা হয়েছিল, সে—বাড়ী যে ঐ অঞ্চলে তাতে তার সন্দেহ নেই।

মোটরে ছিল একজন পুলিশ কনষ্টেবল আর ছিল ড্রাইভার।

দমদম থেকে আসতে সন্ধ্যা হয়। পথ জনশূন্য। দু—দিকে গাছপালা—এ সময় পথে প্রায় লোক থাকে না। তার উপর আকাশে ছিল মেঘ। খানিক আগে বেশ এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। বৃষ্টি তখনও থামেনি, টিপটিপ করে পড়ছিল।

হঠাৎ গুড়ুম করে একটা শব্দ! শব্দ হবার সঙ্গে সঙ্গে মোটরখানা লাফিয়ে উঠে থেমে যায়। ছুটন্ত মোটরের চাকার টায়ারে গুলি করেছে—মোটর অচল করা ছিল উদ্দেশ্য।

গাড়ী থেকে নামবার সঙ্গে সঙ্গে পাশের গাছগুলো থেকে আট—দশজন লোক ছুটে এল—তাদের হাতে লম্বা ধারালো ছোরা।

মোটরের উপর তাদের হানা। রীতিমত ধস্তাধস্তি সুরু হলো।

ছোরা নেমে আসছিল যতীন্দ্রনাথের উপর। যতীন্দ্রনাথ তার হাতখানা চেপে ধরলেন—একজন কনষ্টেবলও তার বাঁ হাত ধরেছে চেপে। শিখা রিভলভার বের করে একজনের হাঁটু তাক করে গুলি ছোঁড়ে। এই সময় দস্যুদের মধ্যে একজন পিছন থেকে যতীন্দ্রনাথের মাথায় সজোরে লাঠি দিয়ে আঘাত করে। আঘাত খেয়ে তিনি মাটিতে বসে পড়েন।

এমন সময় বাসের শব্দ—যাত্রীবাহী বাস আসছে দমদম থেকে।

দস্যুরা চকিতে উধাও হয়ে যায়। তাদের যে দুজন সঙ্গী শিখার গুলিতে জখম হয়েছিল, তাদের তুলে নিয়ে চোখের পলক পড়তে না পড়তে কোথায় ঝোপ—ঝাড়ের মধ্যে ঢুকে উধাও হয়ে গেল—বহু সন্ধানেও আর তাদের চিহ্ন পাওয়া গেল না।

অচেতন কনষ্টেবল, আহত যতীন্দ্রনাথ আর ড্রাইভার; শিখার বাঁ—হাতে ছোরার চোট লেগে অজস্র রক্ত পড়ছে—রুমাল দিয়ে সেখানটা শিখা সবলে চেপে আছে।

বাস থামল। আরোহীরা সবাই নেমে পড়ল।

ব্যবস্থা হল তখনই। বাসের পিছনে একখানা লরি আসছিল—আহদের সেই লরিতে তুলে আর—জি—কর হাসপাতালে আনা হলো।

হাসপাতালে পৌঁছুবার আগে কনষ্টেবল বেচারী লরীতেই মারা গেল। যতীন্দ্রনাথ এবং ড্রাইভারের চোট ভারী রকম—তাঁদের হাসপাতালে থাকতে হলো। শিখাকে ফার্ষ্ট এড দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হলো।

বাড়ী ফিরলে মেয়ের অবস্থা দেখে মা কেঁদে অস্থির! রতনও কাঁদে আর কি!

রাত্রিটা কাল বেশ উদ্বেগে কেটেছে।

আজ সকালে সে খবর তেমন ফলাওভাবে কাগজে কাগজে ছাপা হয়নি—খুব সংক্ষেপে একটুখানি খবর ছাপা হয়েছে—সেই সঙ্গে বাংলাদেশের পুলিশের উপর টিপ্পনী কাটা হয়েছে প্রচুর।

শিখার বাঁ হাত ব্যাণ্ডেজ—করা, গলার সঙ্গে বাঁধা—হাত যাতে বেশী নড়া—চড়া না করে।

রতন এসে খবর দেয়—”এক ভদ্রলোক এসেছেন দিদিমণি। সাহেবদের মত চেহারা। এই কার্ড দিয়েছেন।”

কার্ডখানা সে শিখার সামনে ধরে।

বিরক্ত হয়ে শিখা বলে—”বল গিয়ে, আমি অসুস্থ। এখন দেখা হবে না!”

রতন বলে—”সে কথা বলে তাঁকে বিদেয় করবার চেষ্টা করিনি কি? তিনি নাকি হাসপাতাল থেকে আসছেন—কে, দাশগুপ্ত ডাক্তার তাঁকে পাঠিয়েছেন? ইনি নিজেও ডাক্তার,—কি যেন নাম বললেন।”

শিখা কার্ডখানা দেখে—নাম লেখা, ডক্টর কুঞ্জলাল পণ্ডিত, আর, এম, ও, আর—জি—কর হসপিটাল।

যতীন্দ্রনাথের কোন খবর এনেছেন নাকি?

উৎকণ্ঠিত হয়ে শিখা বলে—”আচ্ছা, তাঁকে নিয়ে এস।”

রতন চলে যায়।

একটু পরে পর্দ্দা সরিয়ে প্রবেশ করেন ডাক্তার পণ্ডিত। অভিবাদন করে স্মিত হাস্যে তিনি বলেন—”না, না, আপনাকে উঠতে হবে না মিস্ রায়—আতুরে নিয়ম নাস্তি।”

শিখা হেসে অভিবাদন জানিয়ে বলে—”বসুন, ডক্টর পণ্ডিত। আপনি আর—জি—কর হাসপাতাল থেকে আসছেন?”

পণ্ডিত বললেন—”হ্যাঁ, কাল আমার ডিউটি ছিল না, আমি ছিলাম না হসপিটালে। অনেক রাত্রে ফিরে ঘটনার কথা শুনে আশ্চর্য্য হয়ে গেছি! রাত্রেই যতীনবাবুকে দেখে এসেছি। তিনি বেশ ঘুমোচ্ছেন। আজ বেলা চারটে নাগাদ তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হবে। তবে ড্রাইভারকে কিছুদিন এখনও থাকতে হবে। তার কাঁধে ছোরা বিঁধেছিল মন্দ না। আপনি গেল রাত্রে কেমন ছিলেন, আমি খোঁজ নিতে এসেছি।”

শিখা বললে—”ধন্যবাদ, আমি ভালই আছি। সামান্য চোট—দু—একদিনের মধ্যে ভালো হয়ে যাবে। যতীনবাবুর জন্যই ভাবছি, তাঁর স্ত্রী ভারি অধীর হয়ে উঠেছেন।”

ডাক্তার বললেন—”কিন্তু আপনি ওদিকে গিয়েছিলেন কেন?”

শিখা বললে—”একটা বাড়ীর খোঁজে গিয়েছিলুম।”

ডাক্তার ভ্রূ—কুঞ্চিত করে বলেন—”বাড়ী! ভাড়া নেবেন?”

পরক্ষণেই হেসে বলেন—”ও বুঝেছি, কোন আসামীর সন্ধানে? আপনাদের ওই কাজ তো!”

শিখা বললে—”ঠিক তাই। আপনি ডাক্তার, খবরের কাগজে পড়েছেন কি না জানি না—কিছুদিন ধরে কলকাতায় ভয়ানক ভয়ানক সব ব্যাপার ঘটছে। নোট—জালের কারখানা তৈরী হয়েছে আর আমার মত কত অভাগা—অভাগীকে ধরে নিয়ে গিয়ে এরা আটকে রেখেছে, খবর পেয়েছি কি না, তাই খুঁজে বেড়াচ্ছি।”

ডাক্তার বললেন—”কিন্তু আমি যতদূর জানি, মিস্ রায়—আর—কাকেও ওরা আটক করে রাখেনি!”

বিস্ময়ে শিখা ডাক্তারের পানে তাকায়, বলে—”আপনি কি করে জানলেন? আপনি ডাক্তার। এদের খবর—”

বলতে বলতে শিখা থেমে যায়।

ডাক্তার হাসলেন—”আমাকে ওদের দলের লোক বলে আপনার সন্দেহ হচ্ছে নাকি? এ—রকম সন্দেহ হওয়া কিছু আশ্চর্য্য নয়। মানে, মোহনচাঁদকে আমি চিনি। এদের কাজ দেখে মোহনচাঁদকে আপনি ভুল বুঝবেন না। শুনেছি, মোহনচাঁদ অনেক আগেই আপনাকে চিঠি দিয়েছিলেন—আপনাকে দৌলতরামের ব্যাপারে হাত না দিতে অনুরোধ করে। তা সত্ত্বেও আপনি এ—কেস হাতে নিয়েছেন। একটা কথা মনে রাখবেন মিস্ রায়, মেয়েরা যত শিক্ষিতাই হোক, যত বুদ্ধিমতীই হোক, তবু মেয়ে ছাড়া তারা আর কিছু নয়! তাদের সাধ্যের একটা সীমা আছে!”

রুক্ষ—কণ্ঠে শিখা বলে উঠল—”আপনি কি আবোল—তাবোল বলছেন, ডক্টর পণ্ডিত! আপনি ডাক্তার, রোগের চিকিৎসা করা আপনার কাজ—এ—সব ব্যাপারে—”

শান্ত কণ্ঠে ডাক্তার বললেন—”আমি যদি বলি, আমি আপনাকে মিথ্যা পরিচয় দিয়েছি?”

শিখা একটু হাসে, বলে—”আপনি বলবার আগেই আমি বুঝেছি। কারণ, আর—জি—কর হাসপাতালে আপনার নামের কোন ডাক্তার নেই। তা ছাড়া—”

বলতে বলতে ড্রয়ার খুলে একখানা ফটো বের করে সে টেবিলের উপরে রাখে। বলে—”আপনার ফটো দেখতে দেখতে আপনার চেহারা আমার মনে এমন…মানে, অনেকের মধ্যে থাকলেও আপনাকে দেখে আমি ঠিক চিনে নেব মিষ্টার মোহনচাঁদ।”

শিখার মুখের ওপর মোহনচাঁদের অপলক দৃষ্টি—চকিতের জন্য। তারপর সে হেসে উঠল।

দশ – মিঃ দৌলতরাম

অদ্ভুত লোক বটে!

সেদিন থেকে শিখা তাই ভাবে।

মোহচাঁদ বলেছিল—”আমি এখানে বসে রইলুম মিস্ রায়, ইচ্ছা করলে আপনি পুলিশে ফোন করতে পারেন। আমাকে ধরিয়ে দিতে পারলে সেন্ট্রাল গভর্ণমেণ্টের দশ—হাজার টাকা পুরস্কারই শুধু পাবেন না, খ্যাতি—প্রতিপত্তি হবে প্রচুর! জগৎ জুড়ে আপনার জয়—গান উঠবে।”

শিখা হেসেছিল মোহনচাঁদের কথা শুনে। বলেছিল—”তুচ্ছ দশ—হাজার টাকা আর ঐ খ্যাতিতে আমার কোন লোভ নেই। আপনি ভাবছেন, চিরকাল আমি এই লাইনে কাজ করব? আজ ভাল লাগছে—এ—কাজে আনন্দ পাচ্ছি, তাই করছি। দু—দিন পরে হয়তো ভাল লাগবে না, অরুচি হবে, তখন আর এ—কাজ নয়। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, ফোন আমি করব না।”

মোহনচাঁদের কাছে শিখা যা শুনল, তাতে সত্যই সে আশ্চর্য্য হলো।

দস্যু মোহনচাঁদকে বন্ধু বলে স্বীকার না করলেও তাঁর মহত্ত্বের পরিচয় পেয়ে শিখা মুগ্ধ হয়।

দৌলতরাম কিছুটা সুস্থ হয়েছেন এখন। হাসপাতাল থেকে সেদিন তিনি ফিরেছেন তাঁর শ্যালকের বাড়ী কটন ষ্ট্রীটে।

খবর পেয়ে শিখা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেল।

এর আগে সে কোনদিন দৌলতরামকে দেখেনি। রুবি এখানে হোষ্টেলে থেকে পড়াশুনা করেছে, কোন আত্মীয়ের বাড়ী সে থাকেনি। হোষ্টেলে দৌলতরাম দু—একবার এলেও শিখা তাঁকে দেখেনি।

এই প্রথম তাঁকে সে দেখল।

দৌলতরাম এখনও তেমন চলাফেরা করতে পারেন না। ডাক্তার তাঁকে সতর্ক করে তবে ছেড়ে দিয়েছেন। একটা গুলি বাঁ দিককার পাঁজরা ঘেঁষে বেরিয়ে গেছে, আর একটা বিঁধেছিল ঊরুতে।

রুবির কথা তাঁকে এ পর্য্যন্ত কিছু জানানো হয়নি। তাঁকে বলা হয়েছে, রুবি দিল্লীতে আছে, ভালোই আছে, তাকে সেখানে পাঠানো হয়েছে।

শিখার পরিচয় পেয়ে রুবির মাতুল শ্যামলাল আগরওয়ালা এসে খবর দিলেন তাঁকে।

শিখার নাম দৌলতরাম জানতেন, তাই তাকে সাদরে অভ্যর্থনা করে সামনের চেয়ারে বসালেন।

একখানা কৌচে অর্দ্ধশায়িত ভাবে তিনি বসে ছিলেন, বললেন—”তুমি আমার রুবির বন্ধু, তোমায় আমি তার মতই মনে করি। হঠাৎ এমন বিপদ! দেড়মাস হাসপাতালে কাটাতে হবে, আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি! শুনলাম, তুমি হাসপাতালে গিয়েছিল। ডাক্তাররা কারো সঙ্গে কথা বলতে দেননি, তাই চিনেও চিনিনি। আজও এমন অবস্থা—উঠে তোমায় খাতির—যত্ন করব, তার উপায় নেই!”

শিখা বললে—”কোন দরকার নেই। রুবির বাবা আপনি, তাই আমি আপনাকে দেখতে এসেছি! আশা করি, এখন একটু সুস্থ আছেন। কোন কথা যদি জিজ্ঞাসা করি, জবাব দিতে পারবেন?”

বলতে বলতে কমিশনারের সেই অথরিটি—লেটারখানা ব্যাগ থেকে বের করে সে দৌলতরামের হাতে দেয়।

সেখানা দেখে দৌলতরাম ফিরিয়ে দেন। উৎফুল্ল কণ্ঠে বলেন—”এখানকার পুলিশ—কমিশনার তোমার সাহায্য চেয়েছেন, এ ব্যাপারের ভার তোমায় দিয়েছেন, এতে আমি ভারী খুশী হয়েছি মিস্ রায়। আমার এ দুর্গতি—সেই মোহনচাঁদের কাজ! উঃ, একবার তাকে যদি পেতাম!”

তিনি দাঁতের উপর দাঁত ঘষেন।

শিখা শান্ত কণ্ঠে বলে—”তাঁর সম্বন্ধেই আমি কিছু খবর জানতে চাই। মোহনচাঁদের বাড়ীতে খোঁজ পাব না। বহুকাল তিনি বাড়ী ছাড়া।”

বিরক্তিভরা কণ্ঠে দৌলতরাম বলেন—”একটা বদমায়েস, শয়তান, ডাকু!—তাকে আর ‘তিনি’ ‘মশায়’ এমন করে বলো না, মিস্ রায়। সে অতি ইতর ছোটলোক। খুন, লুঠ, চুরি, ডাকাতি এই সবই তার পেশা!”

শিখা বলে—”আপনি উত্তেজিত হবেন না দৌলতরামবাবু। উত্তেজনায় আপনার স্বাস্থ্যের ক্ষতি হতে পারে। আমি শুধু দু—চারটে কথা জানতে চাই। মোহনচাঁদের বাপ খুব বড় জমিদার ছিলেন কি? বহু লক্ষ টাকা, মস্ত বাড়ী, বিরাট ঠাকুর—বাড়ী—এ—সব কি সত্যিই তাঁর ছিল?”

মুখখানা বিকৃত করে দৌলতরাম বলেন—”তা ছিল, অনেক—কিছুই তাঁর ছিল। কিন্তু দেনাও ছিল বিস্তর। দেনার দায়ে এ—সব তিনি বন্ধক দিয়েছিলেন পাটনার এক মস্তবড় ব্যবসায়ী গিরিধারীলালের কাছে। গিরিধারীকে ঐ শয়তানই খুন করেছে! জানো?”

শিখা বলে—”বিগ্রহের যে সব অলঙ্কার চুরি গেছে, সে—সব কি মোহনচাঁদের পৈতৃক সম্পত্তি?”

তিক্ত কণ্ঠে দৌলতরাম বলেন—”এনকোয়ারিতে অনেক কিছু তুমি জেনেছ, দেখছি। কিন্তু যাক, আমি এখন যা বলি, শোন। ঐ মন্দির মোহনচাঁদ ফিরে পেতে চেয়েছিল। তার জন্যে বিলেত থেকে ফিরেই সে গিরিধারীলালকে চিঠি দেয়। কিন্তু গিরিধারীলাল তাতে রাজী হয়নি। মোহনচাঁদের বাবা উদয়চাঁদ সমস্ত সম্পত্তি মায় বিগ্রহ পর্য্যন্ত বন্ধক রেখেছিল গিরিধারীলালের কাছে। ভয় দেখালেই বা সে তা দেবে কেন? আইন—অনুসারে সব সম্পত্তি গিরিধারীলালের। তাই সে ডিষ্ট্রিক্ট ম্যাজিষ্ট্রেটের কাছে নালিশ করে সব জানায়। আমার উপর তদন্তের হুকুম হয়। আমি তখন সেখানে যাই। অলঙ্কার—পত্র কিছুই পাওয়া যায়নি। মোহনচাঁদও তখন থেকেই ফেরার। চুরি যে সে—ই করেছে, তার প্রমাণ প্রচুর। সম্ভব হ’লে বিগ্রহ পর্য্যন্ত মোহনচাঁদ চুরি করে নিয়ে যেত, কিন্তু তা আর পারেনি! আর এই রাগেই মোহনচাঁদ শেষে গিরিধারীলালকে খুন করে।”

একটু থেমে তিনি আবার বলেন—”সেই থেকে আমার উপর তার জাতক্রোধ! আমাকে আর আমার ছেলে জয়নারায়ণকে কপর্দ্দকহীন করবার চেষ্টা করছে সে। দুবার দুখানা ত্রিশূলাঙ্কিত চিঠি পাঠিয়েছে—একখানা আমাকে, আর একখানা জয়নারায়ণকে। তার প্রাপ্য হিসাবে সে যা চেয়েছিল, তা পায়নি বলে জয়নারায়ণকে সে খুন করবার চেষ্টা করে। আমার টাকা যখন ব্যাঙ্কে যাচ্ছিল, তখন সে—টাকা মোহনচাঁদ লুঠ করে। তার ফলে কারবার বন্ধ করে জয়নারায়ণ ইউরোপে চলে গেছে। আমি মাস—খানেকের ছুটি নিয়ে রুবিকে সঙ্গে করে কলকাতায় আসছিলাম। রুবি তোমার কাছে থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু দ্যাখ না, হঠাৎ কি কাণ্ড হয়ে গেল! এখানে বদলির ব্যবস্থাও করছিলাম।”

তিনি একটা নিশ্বাস ফেলে মুখ ফেরালেন।

শিখা কুণ্ঠিতভাবে বলে—”মাপ করবেন দৌলতরামবাবু, আর একাট কথা—আপনার ছেলে আর মোহনচাঁদ লণ্ডনে এক বোর্ডিং—এ ছিলেন, তখন নাকি মোহনচাঁদের ব্যাঙ্কে তাঁর ক্রেডিট—ব্যালান্সে যে টাকা—কড়ি ছিল, ব্যাঙ্ক থেকে তার সব তুলে নেওয়া হয়—জাল চেকের সাহায্যে সে টাকা কে তুলেছিল, মোহনচাঁদবাবু সে খবরও পেয়েছিলেন?”

দৌলতরাম সোজা হয়ে উঠে বসেন। সিখা লক্ষ্য করে তাঁর চোখ লাল হয়ে উঠেছে!

তিনি বলেন—”এ—সব কথা আমার কাছে বলবার মানে বুঝি না, মিস্ রায়। বরং মোহনচাঁদকে জিজ্ঞাসা করো, তাহলেই এর জবাব পাবে।”

শিখা হেসে বলে—”হ্যাঁ, তাঁকে জিজ্ঞেস করলে সঠিক জবাব পাব, এ—আশা আমি রাখি বৈকি। তবে আপনাকে জানিয়ে যাচ্ছি, আমি অনেকখানি এগিয়েছি—শীঘ্রই এ—কেসের সুরাহা করতে পারব, আসল আসামীকেও ধরতে পারব, মনে হয়!”

ঈষৎ হাসি মুখে দৌলতরাম বলেন—”আসল আসামী আমি নই, নিশ্চয়?”

হেসে ওঠে শিখা। বলে—”রাম রাম, কি যে আপনি বলেন। আপনি একজন বড় পুলিশ—অফিসার, সেনট্রাল গভর্ণমেণ্ট আপনার তারিফ করে। এ—সব আসামীর সন্ধান করাই হ’ল আপনার কাজ, তা না হয়ে আপনি হবেন আসামী! স্বচক্ষে দেখলেও যে বিশ্বাস করব না! হ্যাঁ, একটা কথা, মোহনচাঁদের চিঠি আপনার বা আপনার ছেলের নামে যা পেয়েছেন, তার একখানা আমায় দিতে পারবেন? পেলে আমার এনকোয়ারির বিশেষ সুবিধা হয়।”

মাথায় হাত বুলান দৌলতরাম। বিকৃত মুখে বলেন—”না, সে—চিঠি কোথায় ফেলেছি, কোথায় রেখেছি, কতকাল আগেকার কথা, সে কি আর পাব, মিস্ রায়? মনে হয় না। তবে খুঁজে যদি পাই কখনো, দেব। নিশ্চয় দেব সে চিঠি।”

শিখা হতাশ হয়। কিন্তু সে ভাব প্রকাশ করে না। বলে—”আপনাকে অত্যন্ত বিরক্ত করলাম—অনেক বকিয়েছি, হয়তো ডাক্তার শুনে রাগ করবেন। উপায় নেই বলেই আপনার কাছে আসা। যাই হোক, আজ আমি আসি! এরপর মাঝে মাঝে হয়তো আসব, ততদিনে আপনি নিশ্চয় সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবেন।”

দৌলতরাম ব্যগ্রকণ্ঠে বলেন—”হ্যাঁ, হ্যাঁ, মাঝে মাঝে এসো, তদন্তের খবরগুলো আমায় জানিয়ে যেয়ো। নিজের যদি চলাফেরার ক্ষমতা থাকত, তোমার সঙ্গে যেতে পারতাম, সঙ্গে সঙ্গে সব খবরও জানতে পারতাম! মেয়েটা দিল্লীতে রইল, চিঠি দিয়েছিল নাকি তার মামার কাছে, সে চিঠি আমায় শুনিয়েছে। দেখি, তাকে একখানা চিঠি দিতে বলি শ্যামলালকে।”

শিখা বলে—”রুবি তার মাসির বাড়ীতে আছে না? টালিগঞ্জে রিজেণ্ট পার্কে?”

দৌলতরাম বলেন—”তাই ছিল—কিন্তু শ্যামলাল তাকে দিল্লীতে পাঠিয়ে দিয়েছেন।”

শিখার বিশ্বাস হয় না, এ কথা। কিন্তু বিশ্বাস না হলেও সে ও—সম্বন্ধে কোন কথাই তোলে না দৌলতরামের কাছে। রুবি টালিগঞ্জে নেই শুনেই তার মনে নানা সন্দেহ উঁকি মারতে থাকে। সে তখন আর দেরী না করে উঠে দাঁড়ায়, অভিবাদন করে বিদায় নেয়।

ঘরের বাইরে দরজার পাশে দাঁড়িয়েছিল বাড়ীর এক ভৃত্য।

শিখা তার পানে তাকাতেই তার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। সে চটপট সরে যায়।

শিখা নিশ্চিন্ত হয়। ভৃত্য—বেশে পরেশ দত্ত শিখার নির্দ্দেশ যথাযথ পালন করে যাচ্ছে, শিখা বুঝতে পারে।

এগারো – অভিযান

বিরাটীতে এক মোড়ের মাথায় মোটর থেকে নামে শিখা। তার সঙ্গে ক্যালকাটা—পুলিশের ডিটেকটিভ ডিপার্টমেণ্টের অ্যাসিষ্ট্যাণ্ট কমিশনার বসন্ত গুপ্ত এবং চব্বিশ—পরগণা পুলিশের সি. আই. ডি. ইনস্পেক্টর মণীশ চৌধুরী।

সন্ধ্যা হয়ে গেছে, গ্রামের অন্ধকার ছড়িয়ে পড়েছে। পথের ধারে গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে অসংখ্য জোনাকি ঝিকমিক করছে।

সন্তর্পণে পথ চলে শিখা, পাশে চলেন বসন্ত গুপ্ত। মণীশ চৌধুরী পিছনে আসেন।

একটু আগে একটা লরিতে এসেছে কুড়িজন সশস্ত্র কনষ্টেবল। তারা রেললাইনের ধার পর্য্যন্ত এদিকে—ওদিকে ছড়িয়ে আছে।

পুলিশ সুপারিণ্টেণ্ডেণ্টকেও খবর দিয়েছিল বিরাটীর অবিনাশ গুহ। তাই তিনি কলকাতার পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে পরামর্শ করে এই মিলিত—অভিযানের ব্যবস্থা করেছেন।

অবিনাশ গুহ মাঝে মাঝে পুলিশের কাছে অনেক খবর দেয়। ক’বছর আগে এখানে চোরের বড় উপদ্রব হয়েছিল, সেই চোরকে অবিনাশ অসীম সাহসে বন্দী করে এবং তার জন্য গভর্ণমেণ্ট তাকে একশ টাকা পুরস্কার দিয়েছিলেন।

আশে—পাশে চারদিকে শিখা পরিচিত লোকদের পাহারাদারীর ভার দিয়েছে। কিছু প্রাপ্তির আশাও দিয়েছে। সেই আশায় বে—সরকারী লোকজনও অনেক জায়গায় খবর সংগ্রহ করেছে।

অবিনাশের সঙ্গে শিখার আগে থেকেই পরিচয় ছিল। শিখার কথায় ক’দিনের জন্য অবিনাশ পশ্চিমে গিয়েছিল, সেখান থেকে অনেক খবর সংগ্রহ করে খাতায় লিখে এনে শিখার হাতে দিয়েছে। দিন—দশেক আগে, শিখা বিরাটীতে এসেছিল।

শিখাকে সে খবর দিয়েছে, গ্রামের একেবারে শেষ প্রান্তে একটা বাড়ীতে প্রতি রাত্রে নানা রকম অদ্ভুত শব্দ হয়। বাড়ীতে প্রত্যহ বহু লোকের সমাগম হয়। দরজা—জানালা সব বন্ধ থাকলেও ফাঁক দিয়ে আলো এসে বাইরে পড়ে। আশে—পাশে যে ক’ঘর লোকের ঘর—বাড়ী আছে, তারা নিতান্ত দরিদ্র। তাদের জিজ্ঞাসা করলে কোন খবরই পাওয়া যায় না। মনে হয়, ও বাড়ীর লোকদের কাছ থেকে এরা টাকা—কড়ি পায়।

বাড়ীটি পূর্ব্বে কোন ধনীর বাড়ী ছিল। এক মাসের মধ্যে তাঁর পুত্র—কন্যা—স্ত্রী মারা যাওয়ায় তিনি বাড়ীখানা ছেড়ে দিয়ে জয়পুরে তাঁব ভগ্নীর বাড়ীতে গিয়ে বাস করছেন। বর্ত্তমানে এক ধনী ব্যবসায়ী এ—বাড়ী ভাড়া নিয়েছেন। ভাড়াটে এদেশী নয়।

শিখা বুঝেছে, এই বাড়ীতেই তাকে আটকে রাখা হয়েছিল—আর রুবিকেও এই বাড়ীতে আটক করে রেখেছে! যে দু—তিন দিন শিখা ছিল, প্রতি রাত্রে লোকজনের কথাবার্ত্তা, মেসিন চলার নানারকম শব্দ সে শুনতে পেত। দিনের বেলা বেশী লোক সেখানে থাকত না, মেসিনও চলত না।

জায়গা ঠিক ঠাহর করতে পারেনি, তার চোখ বেঁধে পথে এনে মোটরে তোলা হয়েছিল; নামিয়ে দিয়েছিল শ্যামবাজারের মোড়ে।

সে কত খুঁজেছে, কোথায় সে—বাড়ী—সন্ধান পায়নি।

আজ দুপুরে অবিনাশের বাড়ী বেড়াতে আসার নাম করে সে দূর থেকে বাড়ীটা দেখে চিনে গিয়েছে। কলকাতায় ফিরে কমিশনারকে জানাতেই তিনি বসন্ত গুপ্তকে দিয়েছেন শিখার সঙ্গে।

রাত্রে ছাড়া এ দলকে ধরা যাবে না, শিখা তা জানে। সেই জন্যই সন্ধ্যার পর এসেছে।

পথ ছেড়ে শিখা মাঠে নামে।

বসন্ত গুপ্ত চুপি চুপি বলেন—”মাঠ দিয়ে না গিয়ে যদি পথ থাকে, সেই পথ ধরে চলুন, মিস্ রায়। একে অন্ধকার, তার উপর ধানের ক্ষেত—সাপখোপ থাকা বিচিত্র নয়!”

শিখা উত্তর দেয়—”পথ এদিকে নেই মিষ্টার গুপ্ত। এই মাঠের মধ্যে দিয়েই আমাদের যেতে হবে।”

বসন্ত গুপ্ত অনিচ্ছায় মাঠে নামেন। অনভ্যস্ত পথে চলতে গিয়ে দু—তিনবার হুমড়ি খেয়ে পড়েন। বলেন—”টর্চটা জ্বালব?”

শিখা হাসে, বলে—”যাচ্ছেন চোর ধরতে, আলো জ্বাললে তাদের পালাবার সুযোগই দেওয়া হবে।”

বসন্ত গুপ্তর রাগ হয়। তিনি চুপ করে থাকেন, ভাবেন, মেয়েটা ভারী জ্যাঠা! এইটুকু একটা মেয়ের হুকুমে তাঁকে চলতে হচ্ছে—রাগ তো তাঁর হবেই! তিনি বহুকালের অভিজ্ঞ অফিসার! কিন্তু কোন উপায় নেই, কমিশনারের আদেশ!

কিছুদূর অগ্রসর হয়ে এক জায়গায় দাঁড়ায় শিখা। মস্ত বাগানের মাঝখানে একটা বড় বাড়ী। বাগানের মধ্যে বড় বড় গাছপালা। তার জন্য এদিকটাতে বেশ নিবিড় অন্ধকার।

দুজন তিনজন করে কনষ্টেবল কাছে আসে। এরা শিখার নির্দ্দেশে এই বাগানে অন্ধকারে অপেক্ষা করছে, নিঃশব্দে মশার কামড় সইছে।

হাতের ঘড়ির পানে তাকিয়ে দেখা গেল, দশটা বাজে।

অবিনাশ আসে, এসে সে বলে—”আজ কারো সাড়া—শব্দ নেই, মিস্ রায়। তাই ভাবছি, নিশ্চয় ওরা জেনেছে, আমরা আজ এখানে আসছি। একটা লোককেও দেখতে পাচ্ছি না! কোন ঘরে আলোও জ্বলেনি!”

নিষ্ফল ক্রোধে বসন্ত গুপ্ত সগর্জ্জনে বলে ওঠেন,—”যত সব বাজে খবর তোমার, অবিনাশ। আমাদের হয়রান করলে তোমায় আমি দেখে নেব কিন্তু!”

শিখা চুপ করে থাকে।

মোহনচাঁদ সত্যই অদ্ভুত কর্ম্মী! দুপুরে শিখা অবগুণ্ঠন টেনে গ্রাম্য বধূর মত এসেছিল, মোহনচাঁদ নিশ্চয় সে—খবর পেয়েছে এবং সেই জন্যই সে সতর্ক হয়েছে!

বার বার শিখার পরাজয়! শিখা মনে মনে পণ করে, যেমন করে হোক, মোহনচাঁদের সব চেষ্টা সে ব্যর্থ করে দেবে! তার কাছে পরাজয় সে মানবে না!

বসন্ত গুপ্তর নির্দ্দেশে সব কটা টর্চ জ্বলে ওঠে! সদরের তালা ভেঙ্গে পুলিশ সদলে ভিতরে ঢোকে।

কিন্তু বাড়ীতে কেউ নেই! জনপ্রাণীর চিহ্ন না! ঘরদোর দেখলে মনে হয় না, এখানে কেউ বাস করে!

বসন্ত গুপ্ত গর্জ্জন করে ওঠেন—”ধাপ্পাবাজ! লোফার!”

সকলে ফিরলেন। সদরের বাহিরে পা দিয়েছেন, অমনি একটা পৈশাচিক অট্টহাসি উঠল আকাশ—বাতাস চিরে—হা—হা—হা—হা—হা!

কে? কে হাসে?

বুক কেঁপে উঠল! তবু বসন্ত গুপ্ত আবার ফিরলেন।

কুড়িটা রাইফেল গর্জ্জন করে উঠলো—গ্রামের লোক সে—শব্দে চমকে ওঠে! সকলে বোঝে, ভূতের বাড়ীতে বেশ কিছু একটা হচ্ছে! সব ভূতের কাণ্ড! তা ছাড়া আর কি!

ভয়ে কাঠ হয়ে যায় গ্রামের লোকেরা।

বারো – আসামী গ্রেফতার

দৌলতরাম দিল্লী ফেরবার উদ্যোগ করছেন। তিনি বেশ সেরে উঠেছেন, গিয়ে সেখানে কাজে জয়েন করবেন। বদলি হতে চান না।

যাবার আয়োজন সম্পূর্ণ। একটু পরে ষ্টেশনে যাবেন, হঠাৎ কটন ষ্ট্রীটে শ্যামলালের বাড়ীর সামনে এসে দাঁড়াল পুলিশের একখানা ট্রাক, তার পিছনে একখানা জিপ। জিপ থেকে নামলেন স্বয়ং কমিশনার—তাঁর সঙ্গে বসন্ত গুপ্ত আর শিখা!

তাঁদের দেখে দৌলতরাম অবাক! তিনি আর শ্যামলাল দুজনে সম্বর্দ্ধনা করলেন! শ্যামলাল কৃতাঞ্জলিপুটে বললেন—”বহুৎ মেহেরবানি, গরীবের এখানে আপনারা পায়ের ধুলো দিয়েছেন।”

দৌলতরাম বললেন—”কতদূর কি হলো? আমি চলে যাচ্ছি।”

”কোথায়?”

দৌলতরাম বললেন—”ষ্টেশনে। আজ দিল্লী যাচ্ছি।”

শিখা বললে—”বটে! তবে যে শুনেছিলাম, এখানে মাসখানেক আরো থাকবেন! এখানে বদলির ব্যবস্থা। আর হঠাৎ আজ?”

দৌলতরাম বললেন—”আরাম হয়েছি, মিথ্যা কেন আর এখানে থাকা! তাছাড়া বদলি হতে চাই না। যেখানে চিরদিন কাজ করছি—”

শ্যামলাল সকলকে এনে বসায় তার সুসজ্জিত ঘরে।

কমিশনার বললেন—”কিন্তু আপনাকে তো যেতে দিতে পারছি না দৌলতরামবাবু। আজ তো নয়ই। ক’দিন আপনাকে আরো থাকতে হবে যে!”

দৌলতরাম মাথা নাড়লেন, বললেন—”তা হয় না মশায়। আমার মেয়ে দিল্লীতে একা, তার জন্যই বিশেষ করে যাওয়া। ছেলেটা বিলাতে, তারা কোন খবর পাইনি বহুকাল। পৌঁছে শুধু একটা কেবল করেছিল, তারপর আর কোন খবর নয়! সেজন্যে ভাবনা! মানে, জানেন তো, তাকে শাসিয়ে কি রকম চিঠি ছেড়েছে ঐ মোহনচাঁদ! তার অসাধ্য কাজ নেই!”

শিখা বললে—”কিন্তু রুবি তো এখানে, এই কলকাতায়! আপনি বলছেন, দিল্লী!”

”রুবি এখানে!” দৌলতরাম হাসলেন। অবিশ্বাসের হাসি। তিনি বললেন—”আপনি ভুল করছেন মিস্ রায়! শ্যামলাল তার চিঠি পড়িয়ে শুনিয়েছে আমাকে, দিল্লী থেকে রুবি চিঠি লিখেছে।”

শিখা বললে—”না! আপনি অসুস্থ বলে আপনাকে তাই বলা হয়েছে, ডাক্তারের পরামর্শে! মানে, রুবির খুব বিপদ গেছে। হাসপাতাল থেকে তাকে ভুলিয়ে নিয়ে গিয়ে দেড় মাস আটক করে রেখেছিল! আজ সকালে রুবিকে আমরা সেখান থেকে উদ্ধার করে এনেছি। রুবি সব কথা বলেছে।”

দৌলতরাম যেন আকাশ থেকে পড়েন। তিনি বলেন—”সে কি কথা! তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে আটক করে রেখেছিল! নিশ্চয় সেই মোহনচাঁদের কাজ! তাকে গুলি করে মারলেও—”

বলতে বলতে তিনি উত্তেজনায় চঞ্চল হয়ে ওঠেন!

কমিশনার বলেন—”মোহনচাঁদকে ধরতে গিয়েছিলুম। কিন্তু লোকটা ভয়ানক ওস্তাদ! পালিয়েছে! একা নয়, দলকে দল! তবে ভাগ্য ভালো, আপনার মেয়েকে আমরা উদ্ধার করতে পেরেছি। আপনাদের কর্ম্মফল আপনার বেচারী মেয়েটিকে ভোগ করতে হলো!”

এ পর্য্যন্ত বলে তিনি তাকালেন দরজার সামনে যে কনষ্টেবল মোতায়েন রয়েছে, তার দিকে। বললেন—”বাবাকো লাও!”

”কে? রুবি!” বলে দৌলতরাম দরজার দিকে অগ্রসর হন।

কমিশনার বাধা দেন, বলেন—”না, ঘর থেকে বেরুবেন না। আপনার মেয়েকে আনা হচ্ছে এখনি! দেখতে পাবেন।”

দৌলতরাম অপ্রতিভ ভাবে দাঁড়ালেন। কনেষ্টেবলের সঙ্গে ঘরে এলো রুবি। নির্ব্বাক মলিন মূর্ত্তি!

”রুবি! মা!” দু—হাত বাড়িয়ে দৌলতরাম তাকে বুকে টানেন।

”বাবা!” বলে বাপের বুকে মাথা রাখে রুবি। তার দু—চোখে জল।

বড় করুণ, বড় মর্ম্মস্পর্শী দৃশ্য! সকলে চুপ করে থাকেন।

মেয়েকে বাহুপাশ থেকে মুক্ত করে দৌলতরাম বলেন—”আর ভাবিসনে মা, আজই আমরা দিল্লী যাবো। চ, এখানে আর একদিনও নয়! এখনই আমরা বেরুব।”

কমিশনার বললেন—”কিন্তু আজ আপনার যাওয়া হতে পারে না, দৌলতরামবাবু! বাই নো মীন্স।”

দৌলতরামের দু—চোখ বিস্ফারিত। তিনি বলেন—”কেন?”

কমিশনার বলেন—’কারণ, আপনাকে এ্যারেষ্ট করতে এসেছি!”

”এ্যারেষ্ট!” দৌলতরামের চোখের সামনে আলো যেন নিভে গেল!

রাশি রাশি অন্ধকার! কোনমতে নিজেকে সম্বরণ করে বিচলিত—কণ্ঠে তিনি বললেন—”ওয়ারেণ্ট?”

কমিশনার বললেন—”বিনা ওয়ারেণ্টেই আপনাকে এ্যারেষ্ট করছি। আপনি জানেন দৌলতরামবাবু এতকাল পুলিশে কাজ করছেন, কারো নামে যদি নালিশ হয়, কগনিজেবল অপরাধ করেছে, তাহলে সে—লোককে পুলিশ বিনা ওয়ারেণ্টে এ্যারেষ্ট করতে পারে। ভেবে দেখুন, খেয়াল হবে নিশ্চয়, আপনার কি অপরাধ!”

দৌলতরামের মুখ চকিতে কাগজের মত সাদা হয়ে যায়। তিনি কাঁপতে কাঁপতে পড়ে যাচ্ছিলেন, বসন্ত গুপ্ত তাঁকে ধরে ফেললেন।

”বাবা!” রুবি আর্ত্তকণ্ঠে চীৎকার করে ওঠে।

দৌলতরামকে একখানা চেয়ারে বসানো হলো! গোলমালের মধ্যে শ্যামলাল নিঃশব্দে সরে পড়ছিল—শিখা কনষ্টেবলকে ইঙ্গিত করল—”কাকেও ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে দেবে না, রাম সিং।”

সঙ্গে সঙ্গে কমিশনার হুকুম দিলেন—”গ্রেফতার করো ঐ—লোকটাকে।”

রামসিং জমাদার শ্যামলালের হাতখানা চেপে ধরল।

বাঘের মত হুঙ্কার ছাড়ে শ্যামলাল—”খবর্দ্দার!”

কমিশনার বললেন—”আপনাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে, গিরিধারীলালবাবু। সব খবর ফাঁস হয়ে গেছে। আপনি তো শ্যামলাল আগরওয়ালা নন—আপনি গিরিধারীলাল। চলুন, আপনাদের লালবাজারে যেতে হবে। দু’জনে মিলে যা করেছেন, অপূর্ব্ব!”

তেরো – ঐশ্বর্য্যের অভিশাপ

দিল্লী যাবার জন্য শিখা তৈরী। দৌলতরামকে গ্রেফতার করে তাকে পাঠানো হয়েছে দিল্লীতে। তদন্তে সেখানে যে—সব ব্যাপার প্রকাশ পেল, সে যেন এক উপন্যাস! শিখা তার যে পরিচয় পেয়েছিল মোহনচাঁদের মুখে, পুলিশ—কমিশনারকে সে—কথা জানায়। তখন কমিশনার নিজে থেকে বলেন—”মোহনচাঁদ যত বড় শয়তানই হোক, এমন জাল—জালিয়াতি…এর তদন্ত দরকার। বিশেষ দৌলতরাম যখন একজন বড় সরকারী অফিসার! এই সব লোকের জন্য সরকারী ডিপার্টমেণ্টের দুর্নাম হয়!”

নিজে থেকে দায়িত্ব নিয়ে দৌলতরাম আর শ্যামলালকে গ্রেফতার করে তিনি দিল্লী পুলিশে পাঠান এ ব্যাপারের আগাগোড়া তদন্তের জন্য।

আর এ—তদন্তের ব্যাপারেই শিখাকে যেতে হলো দিল্লী।

তদন্তে দৌতলরামের যে পরিচয় পাওয়া গেল, অদ্ভুত!

দৌলতরামের পিতা ছিলেন মোহনচাঁদের পিতামহের বাড়ীতে দরোয়ান। দৌলতরামকে মোহানচাঁদের পিতা রাজা—বাহাদুর ছেলের মত দেখতেন এবং তাকে লেখাপড়া শেখান। কিন্তু দৌলতরাম তিন—তিনবার চেষ্টা করেও ম্যাট্রিক পাশ করতে পারেননি। রাজা—বাহাদুরের সুপারিশে পুলিশে তিনি পান রাইটার—কনষ্টেবলের চাকরি। ভাগ্য, রাইটার—কনষ্টেবল থেকে আজ তিনি হয়েছেন পুলিশের ডিষ্ট্রিক্ট সুপারিণ্টেণ্ডেণ্ট। দৌলতরামের পুত্র জয়নারায়ণ আর মোহনচাঁদ—দুজনকে মোহনচাঁদের পিতা সমান দেখতেন। দুজনের খেলাধূলা, লেখা—পড়া একসঙ্গে। তারপর কিশোর বয়সে মোহনচাঁদ বিলাত যান লেখা—পড়া শেখবার জন্য। সে সময় তাঁর অর্থে, তাঁর সঙ্গে জয়নারায়ণও যান বিলাতে—দুজনে ব্যারিষ্টার হয়ে ফিরবেন।

পুত্রের বিলাত যাবার আগেই মোহনচাঁদের পিতা মারা যান। কর্ম্মচারীদের উপর সম্পত্তি দেখাশুনার ভার থাকে। দৌলতরাম রাখতেন কর্ম্মচারীদের উপর নজর। মোহনচাঁদের এতটুকু সন্দেহ বা অবিশ্বাস ছিল না। ক্রমে মিথ্যা দেনার দায়ে মোহনচাঁদের বিষয়—সম্পত্তি নিলামে বিক্রী হয় এবং নিলামে সে সম্পত্তি কিনে নেয় গিরিধারীলাল—তার টাকা জোগান দৌলতরাম—মোহনচাঁদের তহবিল থেকেই।

পাটনায় এবং বিহারের নানা জায়গায় জোর তদন্ত চলল স্পেশাল অফিসার দিয়ে; তার সঙ্গে রইল শিখা। মোহনচাঁদের কাছে শিখা যে—সব বৃত্তান্ত জেনেছে, সঙ্গে সঙ্গে নোট করে রেখেছিল। সেই নোট ধরে পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত হলো।

গিরিধারীলাল খুন হয়নি, শ্যামলাল আগরওয়ালা পরিচয়ে কলকাতায় এসে ব্যবসা ফেঁদে বসে। অর্থাৎ, সে একেবারে ভোল বদলে ফেলেছে!

এঁরাই মোহনচাঁদকে করেছেন কপর্দ্দকহীন! তাতেও খুশী নন, মোহনচাঁদের নামে নানা মিথ্যা অপরাধের দায় চাপিয়ে তাঁকে সমাজের কলঙ্করূপে দাঁড় করিয়েছেন।

যে বন্ধকী—খতের দায়ে নালিশ করে মোহনচাঁদের অনুপস্থিতিতে ডিক্রী করে সম্পত্তি নিলামে বিক্রয় হয়, কোর্টে সে মকদ্দমার নথিপত্র সার্চ করে দেখা গেল, বন্ধকী—খৎ জাল। সে—জাল প্রমাণ হলো মোহনচাঁদের এষ্টেটের পুরাতন আমলাদের মারফৎ। শমন চেপে একতরফা ডিক্রী হয়েছিল।

এমন জালিয়াতীর ব্যাপার সহজে দেখা যায় না!

বিগ্রহের চুরি—করা অলঙ্কারও পাওয়া গেল—কতক গিরিধারীলালের বড়বাজারের বাড়ী সার্চ করে, বাকী মোহনচাঁদ নিজে থেকে বার করে দিলেন। আর সেই মুক্তার মালা, মোহনচাঁদের মায়ের গলার মালা—সে—মালা মোহনচাঁদ সঙ্গে নিয়ে যান বিলাত যাবার সময় এবং বিলাত থেকে ফিরে আসবার পর সে—মালা চুরি যায় মোহনচাঁদের এলাহাবাদের বাড়ী থেকে। জয়নারায়ণের কীর্ত্তি!

দৌলতরামের ভয় ছিল, একদিন হয়তো সব কথা প্রকাশ হবে। তাই মোহনচাঁদকে সরাবার মতলবে সে একটি দল গড়ে তুলেছিল। সে—দলের সাহায্যে নানা শয়তানী করিয়ে তার দায় মোহনচাঁদের ঘাড়ে চাপানো হয়।

এমনি নানাভাবে বিব্রত হয়ে মোহনচাঁদ শেষে দুর্জ্জন—দমনে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। টাকা কোথায় পাবেন? জাল নোটের আশ্রয় গ্রহণ করেন…কিন্তু সে স্বতন্ত্র কথা।

তিনমাস পরে কেস কোর্টে চালান হলো। পাটনার হাইকোর্টে দায়রার বিচার।

একমাস ধরে বিচার চলল, দিনের পর দিন সাক্ষী তলব। কত খাতা, কত দলিল পেশ হলো। দৌলতরাম উকিল দেননি, ব্যারিষ্টার দেননি—লজ্জায় তিনি মাথা নীচু করে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন; তাঁর পাশে গিরিধারীলাল আর কজন অনুচর—এ—পাপে যারা ছিল তাঁর সহচর।

আসামীরা অপরাধ স্বীকার করল এবং তাদের সাজা হলো। দৌলতরামকে রীতিমত অনুতপ্ত দেখে জজ—সাহেব তাঁকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিলেন; গিরিধারীলালের হলো সাত বছরের কারাদণ্ড; দলের অন্য লোকদের কারো দু’বছর, কারো এক বছর।

দণ্ডাদেশের পর জজের অনুমতি নিয়ে দৌলতরাম দেখা করলেন শিখার সঙ্গে, রুবির সঙ্গে।

রুবিকে বললেন—”কেঁদ না মা, যে বিষ মনে জমেছিল, তার ছোঁয়া লেগে তোমার জীবন বিষিয়ে উঠতো! আশীর্ব্বাদ করি, তোমার জীবন নির্বিষ হোক, সুখের হোক।”

তারপর শিখার হাত ধরে দৌলতরাম বললেন—”তোমার উপর আমার কোন অভিমান নেই মা, তুমি আমায় জ্ঞান দিয়েছ। আরামে থাকব, সুখে থাকব বলে যে কাণ্ড করে ঐশ্বর্য্য—সে ঐশ্বর্য্য পেয়ে একটুও আরাম, একটুও শান্তি ছিল না আমার! পাপের অর্থে শান্তি বা আরাম মেলে না। তুমি আমাকে কি অশান্তি থেকে যে মুক্ত করেছ—তুমি হয়তো বুঝবে না। তোমার হাতে আমার রুবিকে দিয়ে গেলাম। রুবিকে তোমার বোন মনে করে তোমার বোনের মতই তাকে গড়ে তুলো। যদি বেঁচে ফিরতে পারি, যে—মহাপাপ করেছি তার যথাসাধ্য প্রায়শ্চিত্ত…”

দৌলতরাম আর বলতে পারলেন না। অশ্রুর বাষ্পে কণ্ঠ রুদ্ধ হলো।

চৌদ্দ – তার পর

রুবিকে নিয়ে শিখা নিজের বাসায় এল। তারপর কলকাতায় ফেরবার উদ্যোগ।

প্লেনে দুটো বার্থ রিজার্ভ। যেদিন পাটনা ত্যাগ করে কলকাতায় আসবে রুবিকে নিয়ে, তার আগের দিন সন্ধ্যার পর বাঙলোয় ফিরে শিখা দেখে, এক ভদ্রলোক এসে বসে আছেন। তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। শিখা একা এল ভদ্রলোকের কাছে। সম্ভাষণ করে শিখা বললে—”আপনি?”

ভদ্রলোক যেন অত্যন্ত ক্লান্ত, বললেন—”চিনতে পারলেন না? আমি মোহনচাঁদ!”

শিখার চোখ উজ্জ্বল হলো। শিখা বললে—”আপনি! আপনাকে দেখে কি আনন্দ হচ্ছে আমার! আপনার কথা এক মিনিট ভুলতে পারছি না! কি ভাবে আপনার উপর নির্যাতন—”

মুখে মলিন হাসি, মোহনচাঁদ বললেন—”তার জন্য আমার কোন দুঃখ নেই, মিস্ রায়! আমি এসেছি আপনাকে আমার অন্তরের কৃতজ্ঞতা জানাতে। আমার কলঙ্ক আপনি মোচন করেছেন, এ—উপকার যতদিন বাঁচব, ভুলব না। কাল আমি চলে যাচ্ছি। প্লেনে বার্থ নিয়েছি। ভারতবর্ষ ছেড়ে আমি যাচ্ছি য়ুরোপে। যাবার আগে আমার কৃতজ্ঞতার সামান্য নিবেদন—”

শিখা বলল—”কিন্তু মোহনচাঁদবাবু—”

পকেট থেকে মোহনচাঁদ বের করলেন চমৎকার একটি আইভরির কৌটা। কৌটা খুলে তার ভিতর থেকে মুক্তার একছড়া মালা বের করে শিখার হাতে দিলেন! বললেন—”এ মালা ছিল আমার মার। আমার কাছে এ শুধু দামী মুক্তার মালা নয়, আমার মার স্নেহের, পুণ্যের স্মৃতি! এ মালা অমূল্য। এ—মালা নিয়ে কোথায় ঘুরবো? আমার মার মালা আপনার হাতে দিয়ে যাচ্ছি। আপনি ব্যবহার করবেন। আমার মার আশীর্ব্বাদে আপনি সুখী হবেন।”

শিখা বললে—”না, না, আমি পুরস্কারের লোভে এ কাজ করিনি মোহনচাঁদবাবু। আপনার এ অহেতুক কলঙ্ক…আমার দুঃখ হয়…”

বাধা দিয়ে মোহনচাঁদ বললেন—”ও—সব কথা থাক। এ—মালা আপনাকে নিতেই হবে, আমার মিনতি। না নিলে—”

মোহনচাঁদের দু—চোখে করুণ মিনতি! শিখা আর কোন কথা বলতে পারল না।

মোহনচাঁদ বললেন—”রুবিকে বলবেন, তার জন্য আমি কিছু ব্যবস্থা করে যাচ্ছি। আমার এষ্টেট থেকে সে খরচ পাবে। তার সঙ্গে আর দেখা করব না। আমার জন্যই তার বাবা আজ—”

শিখা বললে—”কিন্তু এখন তো আপনার কলঙ্ক মোচন হয়েছে। নোট—জালের অপরাধ সরকার মাপ করেছে। এখন এখানে থাকতে বাধা কি, মোহনচাঁদবাবু?”

মোহনচাঁদ হাসলেন, বললেন—”না, অনেক পাপ করেছি! হয়তো আর কখনো ভারতবর্ষে আসবো না। যেখানেই থাকি, আপনার কথা মনে থাকবে। আমার বোন থাকলে সে যেমন করে আমাকে বুঝত, বুঝে যে স্নেহ……আপনি ঠিক……কিন্তু না, থাক! শুধু ভগবানের কাছে আমার জন্য প্রার্থনা জানাবেন, আমার জীবনে যেন কলঙ্ক আর না স্পর্শ করে।”

অভিবাদন করে মোহনচাঁদ উঠে দাঁড়ান। কণ্ঠ গাঢ়, শিখা বলে—”ভগবান আপনার মঙ্গল করবেন মোহনচাঁদবাবু। মানুষ যতই ভুল বুঝুক আপনাকে, ভগবান ভুল বুঝবেন না!”

মোহনচাঁদ বিদায় নিয়ে যান। শিখা নিস্পন্দ দাঁড়িয়ে থাকে টেবিলের সামনে। টেবিলের উপর মোহনচাঁদের দেওয়া মুক্তার মালা।

শিখার দু—চোখ জলে ভরে আসে।

***

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন