হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত
সোমনাথ বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়াল৷ শীতের দুপুরের নরম রোদ মেখে দাঁড়িয়ে আছে জীর্ণ প্রাসাদোপম দোতলা বাড়িটা৷ তবে সম্প্রতি বাড়িটার একটা অংশ মেরামত করা হয়েছে বোঝা যাচ্ছে৷ সাদা রঙের পোঁচও পড়েছে সেখানে৷ তবে বাড়ির চারপাশের বাগানটা আগাছায় পরিপূর্ণ৷ কিছুটা তফাতে একটা ডানা ভাঙা পরি আনত মুখে দাঁড়িয়ে আছে বাড়িটার অতীত গৌরবের সাক্ষী হয়ে৷ আর কেউ কোথাও নেই৷ ঘড়ি দেখল সোমনাথ৷ বারোটা বাজে৷ দূরে সবুজ পাহাড়ের মাথায় ভেসে বেড়াচ্ছে ধোঁয়ার মতো মেঘ৷ অনেকটা পথ কলকাতা থেকে পেরিয়ে এসেছে সোমনাথ৷ সারা রাত ট্রেন জার্নি করে ভোরবেলা নিউ জলপাইগুড়ি৷ তারপর জিপে চার ঘণ্টারও বেশি সময় লেগেছে ডুয়ার্সের এ জায়গাতে আসতে৷ মোরাম বিছানো রাস্তাটা সোজা গিয়ে থেমেছে বাড়িটার সদর দরজাতে৷ সোমনাথ পায়ে পায়ে গিয়ে দাঁড়াল তার সামনে৷ দরজার গায়ে একটা কলিংবেলের সুইচ৷ দেখেই বোঝা যাচ্ছে সেটাও নতুন বসানো হয়েছে৷ মুহূর্ত খানেক দাঁড়িয়ে থাকার পর সোমনাথ আঙুল ছোঁয়াল সুইচে৷ আওয়াজ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাড়ির ভিতরের কোনো এক জায়গা থেকে আদিত্যনারায়ণের ভরাট গলা ভেসে এল৷ ‘দরজা খোলা আছে৷ প্যাসেজ দিয়ে সোজা চলে এসে ঘরে বসুন…৷’
দরজা খুলে ভিতরে ঢুকল সোমনাথ৷ কিছুটা এগিয়েই একটা ঘর৷ তার দরজা খোলা৷ একটু ইতস্তত করে ঘরের ভিতর পা রাখতেই চমকে গেল সোমনাথ৷ হল ঘরের মতো বিরাট ঘরটাতে একটা মাত্র জানলা খোলা৷ আধো অন্ধকার খেলা করছে ঘরের মধ্যে৷ আর সেই ঘরে এ-কোণ ও-কোণ থেকে সোমনাথের দিকে তাকিয়ে আছে জোড়া জোড়া জ্বলজ্বলে চোখ! অস্পষ্ট সব অবয়ব!
ঘরের ঠিক মাঝখানে কয়েকটা সোফা রাখা৷ তারই একটাতে সোমনাথ গিয়ে বসল৷ তার ঠিক উলটোদিকের সোফার পাশ থেকে আরও এক জোড়া জ্বলজ্বলে চোখ তাকিয়ে আছে তার দিকে৷ যেন সে এখনই ঝাপিয়ে পড়বে তার ওপর৷ একটু অস্বস্তি হল সোমনাথের৷ সে ঘরের চারপাশটা ভালো করে দেখার চেষ্টা করতে লাগল৷ চোখগুলোও আগন্তুকের দিকে তাকিয়ে আছে৷
ঘরে ঢুকলেন আদিত্যনারায়ণ৷ সোমনাথ উঠে দাঁড়াতেই তিনি তাকে ইশারায় বসতে বলে দুটো বড়ো জানলা খুলে দিয়ে মুখোমুখি একটা সোফায় বসলেন৷ জানলা খুলতেই আলোতে ভরে উঠল ঘরটা৷ স্পষ্ট হয়ে উঠল সেই অস্পষ্ট অবয়বগুলো৷ সারা ঘর জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে নানা ধরনের প্রাণী৷ বিরাট শিংওয়ালা হরিণ, ভালুক, হায়না, নেকড়ে, চিতা আরও নানা ধরনের চেনা-অচেনা পশুপাখি৷ ঘরের এক কোণে একটা হাতির বাচচাও দেখতে পেল সে৷ শুঁড় উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ এ প্রাণীগুলোকে হঠাৎ দেখলে যে-কোনো লোক তাদের জীবন্ত ভাববে, এমনই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে স্টাফ করা প্রাণীগুলো৷ বিস্মিত সোমনাথ কিছুক্ষণ ঘরটা দেখার পর তাকাল আদিত্যনারায়ণের দিকে৷
আদিত্যনারায়ণ তাকিয়ে আছেন তার দিকে৷ বেশ লম্বা শক্তপোক্ত ফরসা চেহারা৷ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি৷ ডান গালে একটা আঁচিল৷ ঠোঁটের কোণে আবছা হাসি জেগে আছে৷ তাঁর ডান হাতটা রাখা আছে সোফার গায়েই দাঁড়ানো একটা বিরাট বাঘের মাথার ওপর৷ যার চোখদুটো একটু আগেই অস্বস্তিতে ফেলেছিল সোমনাথকে৷ হয়তো এই বাঘটাই তিনি সোমনাথকে দেবেন কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার জন্য৷
আদিত্যনারায়ণ প্রথম মুখ খুললেন, ‘আপনার এখানে আসতে কোনো অসুবিধা হয়নি তো?’
সোমনাথ জবাব দিল, ‘না, হয়নি৷ নদী-পাহাড়, চা বাগান, জঙ্গল আসার পথে দেখছিলাম৷ এ জায়গাটা খুব সুন্দর৷
আদিত্যনারায়ণ মৃদু হাসলেন৷ তারপর বললেন, ‘হ্যাঁ, সুন্দর জায়গা৷ আপনার ইচ্ছে হলে কয়েকটা দিন এখানে থেকে যেতে পারেন৷ এক সময় আরও সুন্দর ছিল এ জায়গা৷ এখন তো বন কেটে প্রায় সাফ করে ফেলেছে লোকজন৷ কিশোর বয়সে আমি এই বাড়ির ঠিক পিছনেই একটা নেকড়ে মেরেছিলাম৷ প্রায় রাতেই বাঘের ডাক শোনা যেত বাড়ির ভিতরে বসে৷’
তাঁর কথা শুনে সোমনাথ জানতে চাইল, ‘এ-ঘরের প্রাণীগুলো কি আশেপাশের জঙ্গল থেকেই শিকার করা? আপনি এ সব শিকার করেছেন?’
আদিত্যনারায়ণ জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ, আমারই শিকার করা, তবে ঘরের কোণে রাখা ওই হায়নাটা ছাড়া কোনো কিছুই এ-দেশের নয়৷ এই বাঘটাও নেপালের৷ এ দেশে তো শিকার নিষিদ্ধ৷ ষোলো বছর বয়সে আমি জার্মানি চলে যাই৷ সংসার পাতিনি৷ সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়িয়েছি শিকারের নেশায়৷ জার্মানিতেই ট্যাক্সিডার্মি বিদ্যাটা শিখি আমি৷ বলা ভালো তার উপকরণ সংগ্রহর জন্যই বিভিন্ন প্রাণী শিকার করতে হয়েছে আমাকে৷ দেশে ফেরার সময় আমার সারা জীবনের কাজগুলো সঙ্গে করে এনেছি৷ আরও বহু জিনিস বাক্সবন্দি হয়ে পড়ে আছে৷ সব কিছু সাজিয়ে উঠতে পারিনি৷’
এর পর একটু থেমে তিনি বললেন, ‘বাঘ তো নিতে এসেছেন, ট্যাক্সিডার্মি ব্যাপারটা কাকে বলে তো নিশ্চয়ই আপনি জানেন?’
সোমনাথ বলল, ‘এই যে মৃত প্রাণীর চামড়া দিয়ে অবিকল আসল প্রাণী বানিয়েছেন, এ বিদ্যাকেই ‘ট্যাক্সিডার্মি’ বলে, তাই না?’
আদিত্যনারায়ণ যেন একটু খুশি হয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, এখন ট্যাক্সিডার্মি বলতে এটাই বোঝায়৷ তবে এটা অনেক কিছু নিয়ে একটা বড়ো ব্যাপার৷ ‘ট্যাক্সিডার্মি’ শব্দটা গ্রিক ভাষা থেকে এসেছে৷ যার আক্ষরিক মানে হল চামড়া প্রস্তুত বা সংরক্ষণ করা৷ স্টাফ, মাউন্টেড ইত্যাদি নানা শব্দ ব্যবহার করা হয় ব্যাপারটা বোঝাতে৷ চামড়া সংরক্ষণ তো বহু প্রাচীন ব্যাপার৷ কিন্তু সভ্য পৃথিবীতে একে প্রথম শিল্পের রূপ দেন৷ একে জনপ্রিয় করেন ‘জন হ্যানকক’ নামে এক পাখি শিকারি ভদ্রলোক৷ ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে তিনি তাঁর শিকার করা পাখিগুলোকে অবিকল জীবন্তরূপে হাজির করেন লন্ডনের এক প্রদর্শনীতে৷ তা দেখে হইচই পড়ে যায় লন্ডনে৷ এর পরই আর্টের রূপ নেয় ট্যাক্সিডার্মি৷ ইউরোপ থেকে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে এই আর্ট৷ তবে এই কাজের আর্টিস্টকে চামড়া সংরক্ষণ ছাড়াও আরও নানা বিষয় জানতে হয়৷ যেমন পশুপাখিদের অঙ্গসংস্থানগত ব্যাপার-স্যাপার৷ স্কাল্পচার, পেইন্টিং এমনকী ছুতোর মিস্ত্রির কাজ পর্যন্ত৷’
সোমনাথ বাঘটার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল, ‘চামড়া সংরক্ষণ করার ব্যাপারটা তো বুঝলাম৷ কিন্তু এই প্রাণীদের দেহের ভিতরে অংশ, অর্থাৎ মাংস ইত্যাদি সংরক্ষণ কীভাবে করেন? ওটাই কি ট্যাক্সিডার্মির আসল কৌশল?’
ভদ্রলোক তার কথা শুনে এবার স্পষ্টই হেসে ফেলে বললেন, ‘এ ব্যাপারে সাধারণত প্রাণীর স্কাল আর পায়ের হাড় শুধু ব্যবহার করা হয়৷ আসলে চামড়ার নীচে থাকে একটা পুতুল৷ আগে সে পুতুল বানানো হত মাটি বা কাঠ দিয়ে৷ কিন্তু ওসব ব্যবহারে জিনিসগুলো ভারী হত৷ তাই আধুনিক ট্যাক্সিডার্মিস্টরা ওসবের বদলে এখন ব্যবহার করেন, ফাইবার, গ্লাসউল বা স্টিলের তার৷ ওসব দিয়ে প্রাণীর অবয়ব বানিয়ে তার ওপর চামড়া বসানো হয়৷ প্রাণীর চোখ, দাঁত, নখ, ঠোঁট এ সবও কৃত্রিম হয়৷ এই বাঘটাকে একটা বাচচা ছেলেও অনায়াসে মাটি থেকে ওপরে তুলতে পারবে৷ ওই পুতুল বানাবার ওপরেই কিন্তু নির্ভর করে প্রাণীটা কতটা জীবন্ত হবে৷’
তাঁর কথা শোনার পর সোমনাথ ঘরের চারপাশে আরও একবার তাকিয়ে নিয়ে বলল, ‘এ-ঘরের প্রাণীগুলোও অবিকল জীবন্ত প্রাণীর মতো৷ আমার তো বেশ অস্বস্তি হচ্ছিল এ-ঘরে ঢুকে৷’
তিনি বললেন, ‘আরও একধরনের ট্যাক্সিডার্মি আছে৷ সে শিল্প আরও বেশি নিখুঁত ভাবে করতে হয় প্রাণীটাকে জীবন্ত করে তোলার জন্য৷ সে ট্যাক্সিডার্মির নাম ‘রোগ ট্যাক্সিডার্মি৷’
‘রোগ ট্যক্সিডার্মি’ ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে সোমনাথ তাকিয়ে রইল তাঁর দিকে৷
তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, ‘রোগ ট্যাক্সিডার্মি’৷ তার কিছু নমুনাও আছে আমার কাছে৷ আপনি চাইলে এখন আপনি দেখতে পারেন সেগুলো৷ ওই জিনিসুগলো যে-ঘরে রাখা আছে তার পাশের ঘরেই আপনার রাতে থাকার ব্যবস্থার হয়েছে৷ অবশ্য আগে আপনি বিশ্রামও করে নিতে পারেন৷’— এই বলে সোফা ছেড়ে তিনি উঠে দাঁড়ালেন৷ সোমনাথের একটু ক্লান্ত লাগলেও সে কৌতূহলী হয়ে বলল, ‘আমার অসুবিধা হবে না৷ আগে সে জিনিসুগলো দেখি, তারপর নয় বিশ্রাম নেব৷’
সোমনাথকে নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে তিনি এবার চললেন অন্য ঘরের দিকে৷ নিস্তব্ধ বাড়ি৷ অন্য কোনো লোকজনের সাড়া শব্দ নেই৷ যেতে যেতে সোমনাথ তাঁকে জিগ্যেস করল, ‘এতবড়ো বাড়ি৷ কে কে থাকেন এখানে?’
আদিত্যনারায়ণ জবাব দিলেন, ‘আমি একাই থাকি৷’
বেশ কয়েকটা ঘর পেরিয়ে তারা অন্য একটা ঘরে এসে ঢুকল৷ সে ঘরে ঢুকতেই চামড়া, রজন ইত্যাদি জিনিসের পাঁচমিশালি একটা উগ্র গন্ধ এসে লাগল সোমনাথের নাকে৷ ঘরে পা রাখতে রাখতে আদিত্যনারায়ণ বললেন, ‘এ ঘরটা আমার কাজের ঘর বা স্টুডিয়োও বলতে পারেন৷’ সে ঘরে ঢুকেই দরজার এক পাশে একটা বিরাট বড়ো ফ্রিজ বা রেফ্রিজারেটার রাখা আছে৷ আর এর পরই ঘরের ভিতরটা দেখে সত্যিই চমকে গেল সোমনাথ৷ এসব কী প্রাণী! এসব প্রাণী আবার হয় নাকি? কিম্ভূত-কিমাকার সব জীব! যেমন তার সামনেই মাটিতে বসে আছে একটা অদ্ভুত প্রাণী৷ তার দেহটা সিংহর আর মাথাটা ঈগলপাখির৷ কিছু দূরে দাঁড়িয়ে আছে আর একটা প্রাণী, তার দেহটা শিম্পাঞ্জির, মুণ্ডু বাঘের৷ এমনই সব অদ্ভুত অনেক প্রাণী ছড়িয়ে রয়েছে সারা ঘর জুড়ে৷ বিস্মিত সোমনাথের উদ্দেশ্যে আদিত্যনারায়ণ বললেন, ‘‘এগুলো হল ‘রোগ ট্যাক্সিডার্মি’-র নমুনা৷ এই ট্যাক্সিডার্মির মাধ্যমে বিভিন্ন প্রাণীর চামড়া দিয়ে কল্পিত প্রাণী বা পৃথিবী থেকে অবলুপ্ত হয়ে যাওয়া প্রাণী তৈরি করা হয়৷ ধর্মীয় বা অন্যান্য কিছু কারণে অনেকে আবার এ কাজকে অনৈতিক, অবাঞ্ছিত বলে মনে করেন, তাই একে বলা হয় ‘রোগ ট্যাক্সিডার্মি’৷ ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে যখন প্ল্যাটিপাস বা হংসচঞ্চু আবিষ্কার করে তার ছবি লন্ডনে পাঠানো হয়, তখন প্রাথমিক অবস্থায় সবাই ভেবেছিলেন যে রোগ ট্যাক্সিডার্মির সাহায্য নিয়ে ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা চলছে৷’’
বিস্মিত সোমনাথ ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল ঘরটা৷ কত অদ্ভুত বিচিত্র সব প্রাণী৷ এমনকী পক্ষীরাজ ঘোড়ার বাচচা, ড্রাগন ইত্যাদি রূপকথার প্রাণীও আছে৷ হঠাৎ দেওয়ালের এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা একটা মূর্তি দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল সোমনাথ৷ ফাইবার গ্লাসের প্রমাণ সাইজের একটা মানুষের মূর্তি সেখানে দাঁড়িয়ে আছে৷ অসম্পূর্ণ মূর্তি৷ তার গায়ে চামড়া বসানোর কাজ সম্ভবত শুরু হযেছে৷ দুটো হাতে কনুই পর্যন্ত চামড়া বসানো হযেছে শুধু৷ আঙুল থেকে কনুই৷ জিনিসটা দেখে সোমনাথ চমকে উঠে প্রশ্ন করল, ‘এ কি মানুষের চামড়া নাকি?’
আদিত্যনারায়ণ হেসে বললেন, ‘আদি যুগের আধুনিক মানুষ ‘হোমোসেপিয়েন্স’ বানাচ্ছি৷ মানুষের চামড়া নয়৷ মানুষের চামড়া পাবই বা কোথায়? তা ছাড়া স্টাফ করার পক্ষে রোমশ বা একটু মোটা চামড়াই উপযুক্ত৷ মানুষের চামড়া এত পাতলা তা ট্যান করা খুব কঠিন৷ আঁশহীন মাছের পাতলা চামড়া আমি ব্যবহার করছি ওটা বানাবার জন্য৷ ঠিক যেমন সাপের চামড়ার ওপর রং চাপিয়ে আমি ড্রাগনের মূর্তিটা বানিয়েছি৷’
সোমনাথ আশ্বস্ত হল তার কথা শুনে৷
এর পর আরও কিছুক্ষণ ধরে সে-ঘরের বিচিত্র মূর্তিগুলো সোমনাথ দেখার পর অদিত্যবাবু তাকে বললেন, ‘এবার চলুন৷ অনেকটা পথ এসেছেন, এবার বিশ্রাম নেবেন৷ আপনাকে যে বাঘটা দেব বলেছি সেটা একটা প্যাকিং বাক্সর মধ্যে অন্য ঘরে রাখা আছে৷ পরে সেটা দেখাব আপনাকে৷’
সোমনাথ ‘আচ্ছা’ বলে এগোল দরজার দিকে৷ ঘরের বাইরে বেরোবার আগে সে মুহূর্তের জন্য দাঁড়িয়ে পড়ে দরজার কাছে রাখা ডালাবন্ধ রেফ্রিজারেটরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এতবড়ো ফ্রিজ আপনার কী কাজে লাগে?’
ঘর ছেড়ে বেরোতে বেরোতে তিনি জানালেন, ‘আসলে কোনো প্রাণীর ছাল ছাড়াবার আগে তাকে ফ্রিজের মধ্যে রেখে তার দেহটা আরও কঠিন বা শক্ত করে নেওয়া হয়৷ তাতে মাংসর ওপর থেকে ছাল ছাড়ানো সহজ হয়৷ বিশেষত যে সব প্রাণীর চামড়া রোমহীন ও পাতলা তাদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা করা হয়৷’
আদিত্যবাবু এর পর তাকে নিয়ে ঢুকলেন পাশেই একটা ঘরে৷ বেশ বড়ো ছিমছাম একটা ঘর৷ খাট, আলমারি সবই আছে ঘরটাতে৷ দেওয়ালে ঝুলছে শিং সহ বিরাট বড়ো একটা হরিণের মাথা৷ একটা টেবিলের ওপর সম্ভবত খাবার ঢাকা আছে৷ ঘরের লাগোয়া একটা স্নান ঘর৷ আদিত্যবাবু বললেন, ‘স্নান সেরে, খেয়েদেয়ে বিশ্রাম নিন৷ বিকালে বাড়ির বাগানে ঘুরে বেড়াতেও পারেন৷ রাতের আগে আপনার সঙ্গে আর আমার দেখা হবে না৷ একটু বাইরে যাব আমি৷’
সোমনাথ তাঁর উদ্দেশ্যে বলল, ‘বাঘটা নিয়ে যাওয়ার জন্য এগ্রিমেন্ট পেপার, আর টাকাপয়সা আমি সঙ্গে এনেছি৷ সে ব্যাপারগুলো…’
তাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে আদিত্যবাবু বললেন, ‘ওসব কাজ রাতে হবে৷ এখন আপনি আগে স্নান সেরে বিশ্রাম নিন৷ আমি আসছি৷’ এই বলে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে গেলেন আদিত্যনারায়ণ৷
২
তিনি বেরিয়ে যাওয়ার পর দরজা বন্ধ করে চটপট স্নানের জন্য বাইরের পোশাক ছেড়ে তৈরি হয়ে নিল সোমনাথ৷ স্নান ঘরে ঢুকতেই অদ্ভুত সুন্দর একটা গন্ধ নাকে এসে লাগল সোমনাথের৷ ঘরে দুটো বালতিতে জল রাখা আছে স্নানের জন্যে৷ সোমনাথ বুঝতে পারল ওই সুন্দর গন্ধটা আসছে বালতিতে রাখা জলের থেকেই৷ সোমনাথ ছা-পোষা যুবক৷ সে শুনেছে যে পয়সাওয়ালা লোকেরা অনেকে নাকি গোলাপজল মিশিয়ে স্নান করে৷ আদিত্যনারায়ণ ধনী মানুষ৷ বালতির জলে সম্ভবত সেরকম কোনো সুগন্ধী মেশানো আছে তা অনুমান করে নিল সোমনাথ৷
স্নান সেরে ঘরে ঢুকে খাওয়া সেরে বিছানায় শুয়ে পড়ল সে৷ এতটা পথ আসতে বেশ ধকল গেছে শরীরের ওপর৷ বিছানায় শুতেই ঘুম নেমে এল সোমনাথের চোখে৷
তার যখন ঘুম ভাঙল তখন বিকাল৷ বিছানাতে উঠে বসতেই একটা সুন্দর গন্ধ এসে লাগল তার নাকে৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই সোমনাথ বুঝতে পারল গন্ধটা আসলে আসছে শরীর থেকে৷ স্নানের জলে মেশানো সেই সুগন্ধীর গন্ধ৷ চুপচাপ ঘরে বসে থেকে কোনো লাভ নেই৷ খাট ছেড়ে উঠে বাড়ির বাইরে বাগানটাতে ঘুরে আসার জন্য কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল সোমনাথ৷
বাড়ির পিছনে দূরে পাহাড়ের মাথায় সূর্য ঢলতে শুরু করেছে৷ নিস্তব্ধ বাড়িটা আগাছা ঘেরা বাগানের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে৷ বিরাট বড়ো বাড়ি৷ আদিত্যবাবু অবশ্য মিউজিয়ামে সোমনাথের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতে জানিয়েছিলেন যে পূর্বপুরুষরা নাকি এক সময় এ-তল্লাটে বেশ কিছু চা বাগানের মালিক ছিলেন৷ অর্থাৎ বংশানুক্রমিক ভাবেই তাঁরা পয়সাওয়ালা লোক৷ বাগানে কোথাও কোনো লোকজন নেই৷ মাঝে মাঝে শুধু কোথা থেকে যেন কোনো পাখির পিকপিক ডাক শোনা যাচ্ছে৷ বাগানটায় ঘুরে বেড়াতে শুরু করল সোমনাথ৷ কিন্তু এক সময় তার মনে হল বাগানের ঝোপঝাড়ে সাপ-খোপ থাকতে পারে৷ সূর্য ডুবতে চলেছে৷ বাগানে বেশি হাঁটা-চলা ঠিক নয়৷ তার চেয়ে বরং শুকনো ফোয়ারার পরিটার গায়ে যে বেদিটা আছে, সেখানে বসা ভালো৷ বাগানে আর না ঘোরাঘুরি করে সোমনাথ গিয়ে সেখানে শ্বেতপাথরের বেদির ওপর বসল৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই পাহাড়ের মাথায় লাল আবির ছড়িয়ে সূর্য ডুবতে শুরু করল৷ সোমনাথের মাথার ওপর ট্যাঁ ট্যাঁ শব্দ করে ঘরে ফেরার জন্য সবুজ পাহাড়ের দিকে উড়ে চলল টিয়াপাখির ঝাঁক৷ অপূর্ব সুন্দর দৃশ্য৷
তন্ময় ভাবে সে দৃশ্য দেখছিল সোমনাথ৷ হঠাৎ তার কানে এল কে যেন বলল, ‘দাদা কি আদিত্যবাবুর বাড়িতে এসেছেন?’
গলাটা কানে যেতে সোমনাথ পিছন ফিরে দেখল তার কিছুটা তফাতে বৃত্তাকার বেদির ওপাশে আছে একজন প্রৌঢ়৷ অঅপাদমস্তক শাল জড়িয়ে বসে পরিটার আড়াল থেকে উৎসুকভাবে তাকিয়ে আছে সোমনাথের দিকে৷ প্রশ্নকর্তা ও লোকটাই৷
সোমনাথ স্মিত হেসে জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, আদিত্যবাবুর কাছেই এসেছি৷ আপনার পরিচয়টা?’
লোকটা জবাব দিল, ‘আমিও এ-বাড়িতেই থাকি৷ দুঃখিত আমি আগে আপনাকে খেয়াল করিনি৷’ এরপর সে জিগ্যেস করল, ‘আপনি কি আদিত্যবাবুর কোনো আত্মীয় হন? কোথা থেকে এসেছেন?’
সোমনাথ উত্তর দিল ‘না, আত্মীয় নই৷ আমি কলকাতা থেকে আদিত্যবাবুর কাছে একটা কাজে এসেছি৷ আমার নাম সোমনাথ পাত্র৷ তা দাদার পরিচয়টা কী?’
লোকটা প্রশ্ন শুনে মৃদু শুনে মৃদু হেসে বলল, ‘আমার নাম অনিমেষ৷ আমি আদিত্যবাবুর কাছে কাজ শিখতে এসেছি বাইরে থেকে৷’
‘ট্যাক্সিডার্মির কাজ?’
সোমনাথের প্রশ্ন শুনে কয়েক মুহূর্ত তার দিকে তাকিয়ে থেকে সে বললে, ‘হাঁ, সেই কাজ৷ আপনিও কি ট্যাক্সিডার্মি শিখতে এসেছেন নাকি? আদিত্যবাবুর সঙ্গে আপনার যোগাযোগ কী ভাবে? আপত্তি না থাকলে বলবেন?’
সোমনাথ বলল, ‘আমি ট্যাক্সিডার্মি সংক্রান্ত একটা ব্যাপারে এলেও কাজ শিখতে আসিনি৷ আসলে আমার একটা ছোটো ‘সাপ্লায়ার ফার্ম’ আছে৷ বিশেষত সিনেমার সেট সাজাবার জন্য নানা রকম জিনিস সাপ্লাই করি সিনেমার প্রোডাকশন ম্যানেজারদের৷ সম্প্রতি একটা সিনেমার সেটের জন্য একটা স্ফাফ করা বাঘের প্রয়োজন৷ কোনো এক পুরোনো জমিদারবাড়ির দৃশ্যর ছবি তোলার জন্য সেটা কাজে লাগবে৷ অর্ডারটা আমি পেয়েছি৷ কিন্তু মুশকিল হল এ জিনিস তো আর সব জায়গাতে পাওয়া যায় না৷ অনেক খোঁজ করে যখন জিনিসটা পেলাম না, তখন একজন জাদুঘরে যাওয়ার পরামর্শ দিল৷ গেলাম সেখানে৷ কিন্তু কর্তৃপক্ষ আমাকে স্পষ্ট জানিয়ে দিল যে শুটিং-এর কাজের জন্য সরকারি জিনিস কোনো ভাবেই দেওয়া যাবে না৷ ব্যর্থ মনোরথে জাদুঘরের স্টাফ-রুমে একটা বাঘের সামনে দাঁড়িয়ে যখন ভাবছি কী করব, ঠিক তখন একজনের গলা শুনলাম, ‘আপনার কী এরকম একটা বাঘের সত্যি প্রয়োজন?’
তাকিয়ে দেখি এক ভদ্রলোক আমার পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন৷ আমি তাকে বললাম, ‘আপনি কী করে জানলেন? আপনি কী জাদুঘরের লোক?’
তিনি জবাব দিলেন, ‘না যাদুঘরের লোক নই৷ আপনি যখন তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলছিলেন তখন তার কিছুটা আমি দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে শুনেছি৷ আমি একজন ট্যক্সিডার্মিস্ট৷ অর্থাৎ এসব প্রাণীটানি বানাই৷ আমার নাম আদিত্যনারায়ণ চৌধুরী৷’ ব্যস, আমার পরিচয় হয়ে গেল তাঁর সঙ্গে৷ তারপর আমি তাঁকে আমার সমস্যা খুলে বলাতে তিনি স্বাগ্রহে আমাকে একটা বাঘ ভাড়া দেবেন বললেন৷ আর সেই বাঘটা নিতেই কলকাতা থেকে এসেছি আমি৷’ একটানা কথাগুলো বলে থামল সোমনাথ৷
অনিমেষ বলল, ‘এবার ব্যাপারটা বুঝলাম৷ প্রথম দিককার একটা মানুষ অর্থাৎ আদিকালের হোমোসেপিয়েসেন্স একটা মূর্তি বানাচ্ছেন আদিত্যবাবু জাদুঘরের জন্য৷ সে কারণে কিছুদিন ধরে জাদুঘরে কর্তৃপক্ষর সঙ্গে কথাবার্তা বলতে যাচ্ছেন৷ এটা এক ধরনের রোগ ট্যাক্সিডার্মি৷ প্রাচীন মানুষকে ফিরিয়ে আনা৷’
সোমনাথ বলল, ‘আদিত্যবাবুর কাছে হোমোসেপিয়েন্সের ব্যাপারটা শুনলাম৷ মূর্তিটাও দেখলাম৷ চামড়া লাগানো শুরু হয়েচে৷ কনুই পর্যন্ত লাগানো হয়েছে৷ আমি তো মানুষের চামড়া ভেবে একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলাম৷ আদিত্যবাবু জানালেন ওটা নাকি মাছের চামড়া৷’ লোকটা এবার উঠে দাঁড়িয়ে একটু হেসে বলল, ‘হ্যাঁ, মাছের চামড়া৷ আপনার সঙ্গে পরিচয় হয়ে ভালো লাগল৷ এবার যাই৷ তবে যাবার আপনাকে একটা অনুরোধ করছি৷ আমাদের এই সাক্ষাতের ব্যাপারটা আদিত্যবাবুর কাছে গোপন রাখলেই আমার পক্ষে ভালো হয়৷
লোকটার এই অদ্ভুত কথা শুনে সোমনাথ বিস্মিত ভাবে বলল, ‘সে না হয় রাখব৷ কন্তু কেন বলুন তো? আমরা তো কোনো গোপন আলোচনা করিনি৷ বা আদিত্যবাবু সম্পর্কে কোনো বাজে মন্তব্যও করিনি৷ তবে?’
সে বলল, ‘তা করিনি, তবে সাক্ষাতের ব্যাপারটা গোপন রাখতে বললাম অন্য কারণে৷ আমি আদিত্যবাবুর কাছে ট্যাক্সিডার্মি শিখছি নিতান্তই একটা শখের জন্য৷ কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠান ব্যতীত অন্য কোনো জায়গাতে ট্যাক্সিডার্মি শেখানো বেআইনি কাজ৷ সরকার মিউজিয়ামের কর্মী বা বনদপ্তরের কর্মীদেরই একমাত্র এই শিক্ষা দেয় এদেশে৷ চোরা শিকারিরা যাতে বন্যপ্রাণী হত্যা করে তার চামড়া এসব কাজে ব্যবহার না করতে পারে সে জন্য এই সরকারি নীতি গ্রহণ করা হয়েছে৷ আমি আদিত্যবাবুর কাছে যখন ট্যাক্সিডার্মি শেখার ইচ্ছা প্রকাশ করি তখন তিনি আমাকে দুটো শর্ত দেন৷ প্রথমত ব্যাপারটা আমি গোপন রাখব, আর দ্বিতীয়ত আমি বাইরের লোকের সঙ্গে কেনো কথা বলব না৷ কথা বলার লোক পাই না তো৷ হঠাৎ-ই আপনার সঙ্গে কথা বলে ফেললাম, আর সত্যটাও বলে ফেললাম৷ উনি জানলে রেগে যাবেন৷ তাই ব্যাপারটা গোপন রাখতে অনুরোধ করছি৷ ঠিক আছে, আমি এখন যাচ্ছি৷ আপনার সঙ্গে কথা বলে ভালো লাগল৷’
সোমনাথ জবাব দিল, ‘আমারও ভালো লাগল কথা বলে৷’
লোকটা এর পর সোমনাথের থেকে বিদায় নেওয়ার জন্য এগোতে গিয়েও হঠাৎ-ই থমকে দাঁড়াল৷
বাতাসে জোরে জোরে শ্বাস টেনে সোমনাথের দিকে এগিয়ে এসে তাকে একটু অবাক করে দিয়ে বলল, ‘মিষ্টি গন্ধটা কি আপনার গা থেকে আসছে?’
সোমনাথ বলল, ‘হ্যাঁ, আমার গা থেকেই৷ স্নানের জলে কী একটা সুগন্ধী যেন মেশানো ছিল৷’
তার জবাব শুনে লোকটা একটু বিস্মিত ভাবে তাকিয়ে রইল সোমনাথের মুখের দিকে৷
ওভাবে তাকিয়ে তাকতে দেখে সোমনাথের কেমন যেন অস্বস্তিবোধ হল৷ সে বলল, ‘আপনি কি আর কিছু বলবেন আমাকে?’
ঠিক এই সময় একটা গাড়ির শব্দ শোনা গেল৷ শব্দ শুনেই দুজনেই তাকাল সেদিকে৷ একটা জিপ ঢুকছে৷ আদিত্যনারায়ণ বাড়ি ফিরছেন৷ অনিমেষ নামের লোকটা সম্ভবত সোমনাথের কথার উত্তরেই একবার শুধু উচচারণ করল একটা শব্দ— ‘রোগ ট্যাক্সিডার্মি৷’ তারপর নিমেষে মিলিয়ে গেল অন্যদিকে৷
গাড়ি থেকে নেমে বাড়িতে ঢুকে গেলেন আদিত্যবাবু৷ সেই লোকটাও চলে গেছে৷ আর এর পরই হঠাৎ ঝুপ করে অন্ধকার নামতে শুরু করল৷ সোমনাথ আবার বাড়ির ভিতর ঢুকে পড়ল৷
৩
কোনো কাজ নেই সোমনাথের৷ ঘরে ফিরে সে আদিত্যনারাযণের প্রতীক্ষায় বসে রইল৷ সারা সন্ধ্যা দেখা মিলল না তাঁর৷ ধীরে ধীরে রাত নামতে শুরু করল৷ বাইরে যে ঠান্ডা নামছে তা ঘরের ভিতর বসেই অনুভব করতে পারল সোমনাথ৷ সারা বাড়িতে কোনো শব্দ নেই৷ কেমন যেন এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে সারা বাড়ি জুড়ে৷ সময় যেন থেমে আছে এবাড়ির ভিতর৷ কিন্তু ঘড়ির কাটা নিজের নিয়মেই এগিয়ে চলল৷
রাত তখন প্রায় নটা বাজে৷ অধৈর্য হয়ে উঠল সোমনাথ৷ সে ভাবতে লাগল ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আদিত্যবাবুর খোঁজ নেবে কিনা? ঠিক এমন সময় ঘরে ঢুকলেন আদিত্যবাবু৷ তিনি সোমনাথকে বললেন, ‘প্যাকিং বাক্স থেকে আপনার ওই বাঘটা বার করতে গিয়ে আসতে দেরি হয়ে গেল৷’
সোমনাথ বলল, ‘আমি অনেকক্ষণ ধরে আপনার জন্য অপেক্ষা করছি৷ কাগজপত্র সই-সাবুদ করতে হবে৷ তারপর কাল ভোরেই বাড়ি ছেড়ে বেরোতে হবে৷ বেশ রাত হল৷’
আদিত্যবাবু বললেন, ‘চলুন তবে আমার ওই কাজের ঘরটাতে যাই৷ কাগজপত্রও সেখানে নিয়ে চলুন৷ বাঘটা ওখানেই রাখা আছে৷ দেখুন আগে জিনিসটা আপনার পছন্দ হয় কিনা?’
সোমনাথ বলল, ‘তাই চলুন৷’
সোমনাথকে নিয়ে ঘর থেকে বেরোতে গিয়ে চৌকাঠের সামনে একবার থমকে দাঁড়ালেন আদিত্যবাবু৷ পিছন ফিরে সোমনাথকে জিগ্যেস করলেন, ‘এখানে আসার ব্যাপরটা আপনি কাউকে জানাননি তো? ব্যাপারটা আমি আপনাকে গোপন রাখতে বলেছিলাম৷ কারণ এসব মূল্যবান জিনিস কেউ কাউকে দেয় না৷ মিউজিয়ামে আপনার সঙ্গে কথা বলে ভালো লেগেছিল বলে জিনিসটা আপনাকে দিচ্ছি৷ খবরটা জানাজানি হলে অন্যরা আবার এসে এসব চেয়ে বিরক্ত করবে৷’
সোমনাথ উত্তর দিল, ‘না, আপনার এখানে আসার খবর আমি কাউকে জানাইনি, আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন৷’
সোমনাথের কথায় হাসি ফুটে উঠল আদিত্যনারায়ণের ঠোঁটে৷
আদিত্যনারায়ণ সোমনাথকে নিয়ে হাজির হলেন সেই রোগ ট্যাক্সিডার্মির ঘরে৷ উজ্জ্বল আলো জ্বলছে ঘরে৷ একটা চাপা গোঁ গোঁ শব্দ হচ্ছে ঘরটাতে৷ রেফ্রিজারেটারটা মনে হয় চালু করা আছে৷ বিরাট বড়ো একটা কাঠের বাক্স এনে রাখা হযেছে ঘরের এককোণে দেওয়ালের গায়ে৷ দরজার পাশ থেকে পেরেক তোলার শাবলের মতো একটা লোহার দণ্ড তুলে নিয়ে আদিত্যবাবু সোমনাথকে নিয়ে এগোলেন সেই প্যাকিং বাক্সর দিকে৷
শাবলের ফলা দিয়ে চাড় দিয়ে কাঠের প্যাকিং বাক্সর চারপাশের ডালা খুলে ফেলা হল৷ বাক্সর ভিতর দাঁড়িয়ে আছে বিরাট বড়ো একটা বাঘ৷ অপূর্ব সুন্দর দেখতে৷ তার হলুদ কালো ডোরা কাটা চামড়া ঝিলিক দিচ্ছে বিজলি বাতির আলোতে৷ সামনের ডান পায়ের থাবা তুলে সোমনাথের দিকে ঘাড় ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মূর্তিটা৷ দেখে কে বলবে সে প্রাণীটা জীবন্ত নয়!
আদিত্যবাবু সোমনাথের পিছনে সরে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘এটা ট্যাক্সিডার্মির অন্যতম একটা শ্রেষ্ঠ নিদর্শন৷ ভালো করে দেখুন৷ এটা জার্মানিতে একটা কম্পিটিশনে ফার্স্ট প্রাইজ উইনার হয়েছিল৷’
সোমনাথ তন্ময় হয়ে দেখতে লাগল প্রাণীটার মূর্তি৷ কৃত্রিম কাঁচের চোখ প্রাণীটার৷ বড়ো বড়ো গোল চোখ৷ সেই চোখ দেখতে দেখতে হঠাৎ একটা অদ্ভুত প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠল সে চোখে৷ সোমনাথের পিছনে দাঁড়ানো আদিত্যবাবু লোহার শাবলটা যেন তুলে ধরেছেন সোমনাথের মাথার ওপর৷ সামনের দেওয়ালের গায়েও ফুটে উঠেছে একই ছায়াছবি! চমকে উঠে পিছনে ফিরতে গেল সোমনাথ, সেই সময় সোমনাথের ওপর নেমে এল আদিত্যনারায়ণের শাবল৷ সোমনাথ নড়ে যাওয়াতে শাবলটা তার মাথায় না পড়ে কাঁধের ওপর পড়ল৷ প্রচণ্ড আঘাতে কিছুটা তফাতে মেঝেতে ছিটকে পড়ে আতঙ্কিত সোমনাথ চিৎকার করে উঠল, ‘এ কী করছেন আদিত্যবাবু! আমাকে মারছেন কেন?’
আদিত্যনারায়ণের মুখে ফুটে উটেছে একটা পৈশাচিক হাসি৷ তিনি বললেন, ‘কারণ, এখন তো আর বাঘ শিকার করা যায় না, তাই মানুষ শিকার করব৷’
সোমনাথ বলে উঠল, ‘আপনি কি পাগল হয়ে গেছেন? কী বলছেন কী?’
আদিত্যবাবু বললেন, ‘না আমি পাগল হইনি৷ রোগট্যাক্সিডার্মির কাজে, ওই হোমোসেপিয়েন্সের মূর্তিটা বানাবার জন্য আপনার চামড়াটা যে দরকার সোমনাথবাবু৷ মানুষের চামড়া না হলে সেটা আসল মানুষের মতো কী ভাবে দেখাবে? এই বলে অট্টহাস্য করে তার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলেন তিনি৷ উঠে দাঁড়াবার শক্তি নেই সোমনাথের৷
প্রচণ্ড আতঙ্কে ‘না! না!’ বলে চিৎকার করে চোখ বন্ধ করে ফেলল সোমনাথ৷ শাবল উঁচিয়ে সোমনাথের দিকে এগিযে আসছে সাক্ষাৎ শয়তানের চামড়া গায়ে দেওয়া আদিত্যনারায়ণ৷ এবার শেষ আঘাত নেমে আসবে সোমনাথের ওপর৷ ঠিক এই সময় প্রচণ্ড শব্দ করে কেঁপে উঠে রেফ্রিজারেটারটা হঠাৎ থেমে গেল৷ চোখ খুলে সোমনাথ দেখতে পেল থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছেন আদিত্যনারায়ণ৷ তাঁর দৃষ্টি রেফ্রিজারেটারের দিকে নিবদ্ধ৷ চোখে যেন একটা অদ্ভুত বিস্ময়ের ভাব৷ আর রেফ্রিজারেটরের ডালা খুলে তার ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছে একটা লোক৷ আরে, এ যে বিকালের সেই বাগানে দেখা লোকটা!’
ঠান্ডা বাক্স থেকে নেমে মেঝের ওপর দাঁড়াল সে৷ তারপর আদিত্যনারায়ণের উদ্দেশ্যে হেসে উঠে বলল, ‘রোগ ট্যাক্সিডার্মির জন্য হোমোসেপিয়েন্স বানাতে আর ক’টা মানুষ খুন করবে অনিমেষ?’
আদিত্যনারায়ণের মুখের হাসি কিন্তু শুকিয়ে গেছে৷ সোমনাথ দেখল অঅদিত্যনারায়ণের মুখটা সাদা কাগজের মতো লাগছে৷ তার শাবল ধরা হাতটা ধীরে ধীরে ঝুলে পড়ছে নীচের দিকে৷
আগন্তুক এর পর আদিত্যবাবুর উদ্দেশ্যে বললেন, ‘’ও কাজ তোমার দ্বারা হবে না অনিমেষ৷ মানুষের চামড়া তৈরি অত সহজ নয়৷ অনেকে ‘রোগ ট্যাক্সিডার্মি’-কে বলে ‘শয়তানের কাজ৷’ তোমার মতো শয়তানের চামড়াই ওই কাজের জন্য উপযুক্ত৷ এসো অনিমেষ তোমার শয়তানের চামড়টা আমাকে দাও৷’’— এই বলে লোকটা দু-হাত বাড়িয়ে এগোতে লাগল অনিমেষ অথবা আদিত্যনারায়ণের দিকে৷ সোমনাথ স্পষ্ট দেখতে পেল সে লোকটার হাত দুটো কনুই পর্যন্ত টকটকে লাল৷ যেন কেউ লোকটার কনুই পর্যন্ত চামড়া ছাড়িয়ে নিয়েছে!
এগিয়ে যাচ্ছে লোকটা৷ সেই আদিত্যনারায়ণ কিন্তু শাবল দিয়ে তাকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করল না৷ বরং তার শাবলটা হাত থেকে খসে পড়ল মাটিতে৷ আর তারপর আদিত্যনারায়ণ পরিচয় দেয়া লোকটা তীব্র আতঙ্কে আর্তনাদ করে পালাবার জন্য ছুটল দরজার দিকে৷ কিন্তু বাইরে যাওয়া তার হল না৷ একটা প্রাণীর মূর্তিতে হোঁচট খেয়ে সে ছিটকে পড়ল মেঝেতে রাখা তীক্ষ্ণ একটা হরিণের সিং-এর ওপর৷ সিংটা এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিল তার বুক৷ ছটফট করে নিস্তব্ধ হয়ে গেল লোকটার দেহ৷
বিকালের সেই লোকটা সেই দৃশ্যর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ওর চামড়াটা শয়তানের চামড়া৷ রোগ ট্যাক্সিডার্মির পক্ষে একদম উপযুক্ত৷’ তারপর সে সোমনাথের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনি বেঁচে গেছেন৷ কিন্তু এখনই আপনাকে বেরিযে পড়তে হবে এ-বাড়ি থেকে৷ রাত দশটায় কলকাতার একটা বাস আছে, চলুন সেটা আপনাকে ধরিয়ে দেব৷ সোমনাথের মাটি থেকে ওঠার শক্তি ছিল না৷ কাঁধে প্রচণ্ড আঘাত৷ লোকটাই তাকে মাটি থেকে তুলে দাঁড় করাল৷ ওঃ, কী ঠান্ডা তার সেই চামড়া ওঠা হাতের স্পর্শ!
সেই অভিশপ্ত ঘর, বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে জিপে উঠে বসল দুজন৷ চলতে শুরু করল জিপ৷ চালাচ্ছে সেই লোকটা৷ তার পিছনে বসে, বিস্মিত আতঙ্কিত বাকশক্তিরোহিত সোমনাথ৷ যেতে যেতে এক সময় মুখ খুলল লোকটা৷ সে বলল, ‘যাকে আপনি আদিত্যনারায়ণ বলে ভেবেছিলেন সে আসলে আদিত্যনারায়ণ নয়৷ আদিত্যনারায়ণের সহকারী অনিমেষ৷ সম্পত্তির লোভে আদিত্যনারায়ণকে খুন করে নিজে আদিত্যনারায়ণ হয়ে বসে৷ আজ বিকালে আপনার গায়ে গন্ধটা পেয়ে আমি বুঝে যাই কী হতে চলেছে৷ ওটা একটা জৈব রাসায়নিকের গন্ধ৷ চামড়ায় যার প্রলেপ থাকলে চামড়া ছাড়িয়ে নিতে সুবিধা হয়৷ অনেক সময় ট্যাক্সিডার্মি করতে আনা জীবন্ত প্রাণীর দেহে অগেই ওই জিনিস দিয়ে ধোয়ানো হয়৷ আসল আদিত্যনারায়ণের চামড়া দিয়েই সে কাজটা করছিল৷ কিন্তু প্রথমদিন কাজ শেষ হওয়ার পর রেফ্রিজারেটার থেকে উধাও হয়ে যায় আদিত্যনারায়ণের দেহ৷ তাই নতুন চামড়ার দরকার ছিল তার৷ সে জন্যই সে ফাঁদ পেতে আপনাকে টেনে আনে৷ তবে হোমোসেপিয়েন্সের মূর্তিটা ঠিক পেয়ে যাবে জাদুঘরের কর্তৃপক্ষ৷’— এই বলে যেন একটু হাসল লোকটা৷
মাথার ভিতরটা কেমন যেন গুলিয়ে গেছে সোমনাথের৷ কী বলবে বুঝতে পারছে না৷ লোকটা এর পর বলল, ‘আজকের রাতের কথাটা বাইরের পৃথিবীর কাছে গোপন রাখবেন৷ তবে বেশি ভয় পাবেন না৷ এ ঘটনার জন্য কেউ দায়ী হয়ে থাকলে সে আমি৷ কিন্তু অনিমেষের মৃত্যুর জন্য আমাকে ধরার ক্ষমতা আজ আর কোনো পুলিশ, আদালতের নেই৷ এর পর আর কথা না বলে গাড়ি চালাতে লাগল লোকটা৷
বাস রাস্তা এসে গেল একসময়৷ গাড়ি থেকে নামল তারা৷ দূরে দুটো আলোক বিন্দু দেখা যাচ্ছে৷ কলকাতায় যাওয়ার বাস আসছে৷ সোমনাথকে লোকটা বলল, ‘আমি এবার চলি৷ ভালো থাকবেন৷’
সোমনাথ তাকে জড়ানো গলায় জিগ্যেস করল, ‘আপনি কে?’
একটা আবছা হাসি ফুটে উঠল লোকটার ঠোঁটের কোণে৷ সে জবাব দিল, ‘আমিই যে আদিত্যনারায়ণ৷ ট্যাক্সিডার্মিস্ট৷’
এ কথা বলে হতভম্ব সোমনাথের চোখের সামনে থেকে গাড়ি নিয়ে রাতের কুয়াশার আড়ালে হারিয়ে গেলেন ট্যাক্সিডার্মিস্ট আসল আদিত্যনারায়ণ৷ বাসের হর্ন শুনে সোমনাথ বুঝতে পারল বাস এসে পড়েছে৷
পুনশ্চ: কাঁধের হাড়ে একটা ফ্র্যাকচার হয়েছিল সোমনাথের৷ হপ্তাখানেক সময় লাগল তার সেরে উঠতে৷ তারপর সে আবার একদিন হাজির হয়েছে জাদুঘরে৷ সোমনাথের পরিচিত একজন একটা সরকারি সুপারিশপত্র জোগাড় করে দিযেছে জাদুঘর কর্তৃপক্ষকে দেওয়ার জন্য৷ সম্ভবত বাঘটা এবার পেয়ে যাবে সে৷ জাদুঘরের সেই ঘরটাতে ঢুকল সোমনাথ৷ বেশ কিছু নতুন প্রাণী ইত্যাদির মূর্তি ক’দিন হল এসেছে সেখানে৷ একটা কাচের বাক্সে রাখা হযেছে একটা হোমোসেপিয়েন্সের মূর্তি৷ আগ্রহ নিয়ে সোমনাথ দাঁড়াল সেই মূর্তির সামনে৷ ঠিক যেন একটা আসল মানুষ৷ আধুনিক আদি মানুষ৷ তবে তার মুখটা কিছুটা যেন বড়ো, বাঁদরের মতো৷ হঠাৎ সেই মুখে একটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ করল সোমনাথ৷ সেই মানুষটার ডান গালে জেগে আছে বেশ বড়ো একটা আঁচিল৷ হোমোসেপিয়েন্সের গালেও কি আঁচিল থাকত? ব্যাপারটা ঠিক জানা নেই সোমনাথের৷ সোমনাথের পিছনে জাদুঘরের একজন কর্মী এসে দাঁড়িয়েছে৷ সোমনাথের উদ্দেশ্যে সে বলল, ‘আদিত্যনারায়ণ বলে একজন ট্যাক্সিডার্মিস্ট জিনিসটা তৈরি করে পাঠিয়েছেন৷ কী নিখুঁত কাজ! চামড়টা একদম আসল মনে হচ্ছে!’
মুহূর্তের জন্য সোমনাথের চোখে ভেসে উঠল একটা আঁচিলওয়ালা মানুষের মুখ৷ সে বলে উঠল, ‘রোগ ট্যাক্সিডার্মি৷’
লোকটা হেসে বলল, ‘হ্যাঁ, রোগ ট্যাক্সিডার্মি বলে একে৷ আপনি ব্যাপারটা জানেন দেখছি৷ এবার কিউরেটর সাহেবের ঘরে চলুন৷ তিনি ট্যাক্সিডার্মি করা বাঘটা আপনাকে নিতে ডাকছেন৷
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন