দশের মুখ খুদার তবল

সৈয়দ মুজতবা আলী

দশের মুখ খুদার তবল

ইংরেজ খায় জব্বর একখানা ব্রেকফাস্ট! শুধু তাই নয়, অনেক ইংরেজ ঘুম থেকে উঠে বেড-টির সঙ্গে খায় একটি কলা কিংবা আপেল এবং একখানা বিস্কুট।

তার পর ব্রেকফাস্ট। দীর্ঘ সে ভোজন; আমি সংক্ষেপে সারি। যদি সে ইংরেজ ঈষৎ মার্কিন-ঘেঁষা হয়, তবে সে আরম্ভ করবে গ্রেপ ফুট দিয়ে। তার পর খাবে পরিজ কিংবা কর্নফ্লেক, মেশাবে এক জগ দুধের সঙ্গে, কেউ কেউ আবার তার সঙ্গে দেবে চাকতি-চাকতি কলা এবং চিনি। ইতোমধ্যে আরম্ভ হয়ে যাবে তবলা বাদ্য, অর্থাৎ সঙ্গে সঙ্গে টোস্ট-মাখন খাওয়া। শেষ সময় পর্যন্ত এই তবলা বাদ্য বন্ধ হবে না। তার পর ভোজনরসিক খাবেন কিপারস (মাছ) ভাজা– অনেকটা লোনা ইলিশের ফালির মতো— তার পর খাবেন এ্যাব্বড়া এ্যাব্বড়া দুটো আণ্ডা ফ্রাই (আকারে এ-দেশি চারটে ডিমের সাইজ) তৎসহযোগে বেকন আবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, টোস্ট-মাখনের তবলা কখনও বন্ধ হবে না এবং এর পর টেনে আনবে মার্মলেডের বোতল। খাবে নিদেন আরও খানচারেক টোস্ট ওই মার্মলেডসহ। এবং চা কিংবা কফি তো আছেই। বাস!

ফরাসি-জর্মন ব্রেকফাস্টে খায় যৎসামান্য রুটি মাখন আর কফি। খানদানি ফরাসি মাখনও খায় না বলে, ফরাসি রুটির যে আপন উত্তম সোয়াদ আছে সেটা মাখনের স্পর্শে বরবাদ হয়ে যায়।

লাঞ্চের বেলা ইংরেজ খায় যৎকিঞ্চিৎ। ফরাসি-জর্মন করে গুরুভোজন।

রাত্রিবেলা ইংরেজ করে শুরুভোজন। জর্মন খায় অত্যল্প। রুটির সঙ্গে সসিজ, কিংবা চিজ এবং ফিকে পানসে চা। যাসব খাবে সাকুল্যে মালই ঠাণ্ডা, শুধু চা-টাই গরম।

এবারে গিয়ে দেখি হইহই রইরই কাণ্ড ডিনারের বেলায়ও। অবশ্য সবকিছুই ঠাণ্ডা খাওয়ার ঐতিহ্য সে এখনও ছাড়েনি।

এবারে দেখি পাঁচ রকমের সসিজ, তিন রকমের চিজ এবং টুবের খাদ্যের ছড়াছড়ি। আমরা যেরকম টুব থেকে টুথপেস্ট বের করি, এরা তেমনি বের করতে থাকে কোনও টুব থেকে মাস্টার্ড, কোনওটা থেকে টমাটো সস, কোনওটা থেকে মাছের পেস্ট। শুনেছি, দেখিনি, মাংসের পেস্টভর্তি টুবও হয়। কোনও জিনিসের অভাব নেই। দামের পরোয়া করো না, যত পার খাও।

রাস্তায়ও দেখি, আগে যে রাস্তায় ছিল একখানা খাদ্যদ্রব্যের দোকান (লেবেনস মিটেল গেশেফট-কলোনিয়াল ভারেন) এখন সেখানে চারখানা। কারও বাড়িতে যাওয়া মাত্রই সে কোনও কথা না বলেই বের করে উত্তম রাইন মজেল (হক রেনিশ) তাজা বিয়ার ইস্তেক স্কচ হুইস্কি, মার্কিন সিগারেট।

বড় আনন্দ হল এসব দেখে খাক না বেচারীরা প্রাণভরে। এই সে সেভন ডেজ ওয়ান্ডার তিন দিনের ভেল্কিবাজি– এ যে কখন বিনা নোটিসে বন্ধ হয়ে যাবে কে জানে। অতএব খাও-দাও ফুর্তি কর। হেসে নাও, দু দিন বই তো নয়।

এ তত্ত্বটি জর্মনরাও বিলক্ষণ জানে।

হামবুর্গে আমি যে পাড়ায় থাকতুম সেটা শহরতলীতে। অন্যত্র যেমন এখানেও পাড়ার পাবটি ওই অঞ্চলের সামাজিক কেন্দ্রভূমি। দেশের লোকে কী ভাবে, কী বলে, পাবে না গিয়ে জানার উপায় নেই। গুণীজ্ঞানীরা কী ভাবেন, সেটা জানা যায় অনায়াসে–বই, খবরের কাগজ পড়ে। কিন্তু পাবের গাহকরা গুণী-জ্ঞানী নয়; তারা বই লেখে না, লেকচার ঝাড়ে না। অথচ এরাই দেশের মেরুদণ্ড।

এখানে কায়দামাফিক একে অন্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় না। পাশের লোকটির সঙ্গে গালগল্প জুড়ে দিলুম।

বললুম, যুদ্ধের পর ঠিক এই যে প্রথম এলুম তা নয়। বছর দুই পূর্বে এসেছিলুম মাত্র দু দিনের তরে। কোনও একটা পাবে যাবার ফুরসত পর্যন্ত হয়নি। এবারে তার শোধ নেব।

শুধাল, কীরকম লাগছে পরিবর্তনটা?

আমি বললুম, অবিশ্বাস্য! এত ধন-দৌলত যে কোনও জাতের হতে পারে, আমি কল্পনাও করতে পারিনি।

লোকটি হেসে বলল, তা তোমরাও তো এককালে খুব ধনী ছিলে। সেদিন আমি খবরের কাগজে একটা ব্যঙ্গ-চিত্র দেখেছিলুম। তোমাদের তাজমহলের সামনে দাঁড়িয়ে এক মার্কিন ট্যুরিস্ট তার স্ত্রীকে বলছে, ফ্যাসি! এসব জিনিস তারা এমেরিকান এড় ছাড়াই তৈরি করেছিল।

আমি বললুম, রাজরাজড়া ধনী ছিলেন নিশ্চয়ই আজ যে-রকম সউদি আরব, কুয়েত, বাহরেনে শেখরা জলের মতো টাকা ওড়ায়– কিন্তু আর পাঁচজনের সচ্ছলতা কীরকম ছিল অতখানি আমি জানিনে।

আমাদের কথায় বাধা পড়ল। দেখি এক বৃদ্ধ আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। হাতে বিয়ারের গেলাস, পরনে মোটামুটি ভালো স্যুটই, তবে ফিটফাট বলা চলে না। ফিসফিস করে যেভাবে কথা আরম্ভ করল তাতে মনে হল, এখনও বুঝি নাৎসি যুগের গেস্তাপো গোয়েন্দার বিভীষিকা সম্পূর্ণ লোপ পায়নি। নাহ্, আমারই ভুল। হামবুর্গে যখন বেধড়ক বোমা ফেলে তখন কী জানি কী করে তার গলার সুর বদলে যায়। এ তত্ত্বটা জানা হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও তার ফিসফিসানিতে বলা কথাগুলো কেমন যেন উচাটন মন্ত্রে উচ্চারিত নিদারুণ ভবিষ্যদ্বাণী বলে মনে হচ্ছিল।

ডান হাত তুলে ধরে গেলাস দিয়ে জানালার দিকে নির্দেশ করে শুধাল, কী দেখছ?

 আমি বললুম, এন্তের মোটরগাড়ি।

আবার সেই ফিসফিস। বলল, এদের কজন সত্যি সত্যি মোটর পুষতে পারে জানো? শতেকে গোটেক। তোমার দেশের কথা বলছিলে না, রাজরাজড়ারা ধনী ছিল, বাদবাকিদের কথা বলতে পারছ না। এখানেও তাই। এই যে মোটর দাবড়ে বেড়াচ্ছেন বাবুরা, এঁদের ক-জন মোটরের পুরো দাম শোধ করেছেন কেউ বলতে পারবে না। কিন্তু আমি জানি, সব ইস্টমেন্টের ব্যাপার। জি লেবেন য়ুবার ঈরে ফেরহেল্টনিসে– দে আর লিভিং বিঅন্ড দেয়ার মিনস্– আনে সিকি, ওড়ায় টাকা।

আমি বললুম, সেকথা বললে চলবে কেন? কট্টর অবজেকটিভ বিচারেও বলা যায়, তোমাদের ধনদৌলত বিস্তর বেড়েছে।

বুড়ো অসহিষ্ণু হয়ে বলল, কে বলেছে ধনদৌলত বাড়েনি। বেড়েছে নিশ্চয়ই। আলবৎ বেড়েছে। কিন্তু প্রথম কথা, যা বেড়েছে তার তুলনায় খরচ করছে অনেক বেশি। এবং দ্বিতীয় কথা, এ ধনদৌলতের পাকা ভিত নেই। ১৯১২-১৯১৪-এ আমাদের যে ধনদৌলত ছিল তার ছিল পাকা বুনিয়াদ।

আমি বললুম, তাতেই-বা কী ফায়দা হল? ইনফ্লেশন এসে সে পাকা বুনিয়াদও তো ঝুরঝুরে করে দিয়ে চলে গেল।

বুড়ো শুধু মাথা নাড়ে আর বার বার বলে, জি লেবেন যুবার ঈরে ফেরহেল্টনিসে, জি লেবেন য়ুবার ঈরে ফেরহেল্টনিসে– কামায় সিকি, ওড়ায় টাকা।

বুড়ো আমাদের ছেড়ে বারের দিকে এগোলো খালি গেলাস পূর্ণ করার জন্য।

আমি যার সঙ্গে প্রথম কথা আরম্ভ করেছিলুম, সে এতক্ষণ হা-না কিছুই বলেনি। এবারে নিজের গেলাসের দিকে তাকিয়ে বলল, বুড়োর কথা একেবারে উড়িয়ে দেবার মতো নয়। তবে তুমি যে এই ইনফ্লেশনের কথা তুললে না, সেইটেই হচ্ছে আসল ভয়। ইনফ্লেশনের বন্যা এসে একদিন সবকিছু ভাসিয়ে দিয়ে চলে যায়, তারই ভয়ে সবাই টাকা খরচ করছে দু হাতে। এমনকি যে কড়ি এখনও কামানো হয়নি সেটাও ওড়াচ্ছে।

আমি বললুম, যে কড়ি এখনও কামানো হয়নি, সেটা ওড়াবে কী করে? তার পর বললুম, ওহ! বুঝেছি! ধার করে?

বলল, ঠিক ধার করে নয়। কারণ ধার করলে সে পয়সা একদিন না একদিন ফেরত দিতে হয় না দিলে পাওনাদার বাড়ি ক্রোক করে। কিন্তু ইনস্টমেন্টের কেনা জিনিসে সে ভয়ও নেই। বড়জোর যে জিনিসটা কিনেছে সেটা ফেরত নিয়ে যাবে।

ইতোমধ্যেই সেই ফিসফিস-গলা বুড়ো ফিরে এসেছে। বলল, টাকা ধার পর্যন্ত নেওয়া যায়। আমি রোক্কা টাকার কথা বলছি, ইনস্টমেন্টের কথা হচ্ছে না। টাকা শোধ না দিলে যদি ক্রোক করতে আসে, তবে লাটে তুলবে কী? বাড়ির তাবৎ জিনিসই তো ইন্সটলমেন্টে কেনা। সেগুলো তো ক্রোক করা যায় না।

আমি বুড়োকে বললুম, আপনি সব-কিছু বড্ড বেশি কালো চশমার ভিতর দিয়ে দেখছেন।

বুড়ো বলল, আমি কি একা? আমাদের প্রধানমন্ত্রী আডেনাওয়ারও তো ওই পরশু দিন দেশের লোককে সাবধান করে দিয়েছেন, এ সুদিন বেশিদিন থাকবে না। হুশিয়ার, সাবধান! পড়োনি কাগজে?

আমি বললুম, অতশত বুঝিনে। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, সবাই খাসা ফুর্তিতে আছে। ওইটেই হল বড় কথা। তার পর যার সঙ্গে প্রথম কথা বলতে আরম্ভ করেছিলুম, তাকে শুধালুম, তোমাদের শহরের মধ্যিখানে যে হাজারখানেক সেকেন্ডহ্যান্ড কার ফর সেল দেখলুম, সেগুলো কি ইনস্টলমেন্টে কেনা ছিল, আর কিস্তি খেলাপ করেছে বলে বাজেয়াপ্ত হয়ে ওইখানে গিয়ে পৌঁছেছে?

বলল, নিশ্চয়ই তার একটা বড় অংশ। বুড়ো আবার মাথা দোলাতে দোলাতে বলল, তোমাকে বলিনি, জি লেবেন যুবার ঈরে ফেরহেল্টনিসে! কামায় সিকি, ওড়ায় টাকা!

***

সুবুদ্ধিমান পাঠককে সাবধান করে দিচ্ছি, আমি অর্থনীতি জানিনে, এসব মতামতের কতখানি ধাপে টেকে, বলতে পারব না। আমি যা শুনেছি, সেইটেই রিপোর্ট করলুম। এবং আবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, এসব পাবে শুমৃপেটার, কেইনস, শাট আসেন না। আসে যেদো-মেদো। কিন্তু ভুললে চলবে না, কথায় বলে, দশের মুখ খুদার তবল।

সকল অধ্যায়

১. টুনি মেম
২. এক পুরুষ
৩. কবিরাজ চেখফ
৪. দুলালী
৫. দুলালীর সমালোচনা
৬. আন্তন চেখফের ‘বিয়ের প্রস্তাব’
৭. উলটা-রথ
৮. ও ঘাটে যেও না বেউলো
৯. সুখী হবার পন্থা
১০. বিষের বিষ
১১. রাজহংসের মরণগীতি
১২. হিটলার
১৩. নব-হিটলার
১৪. শাঁসালো জর্মনি
১৫. দশের মুখ খুদার তবল
১৬. হাসির অ-আ, ক-খ
১৭. হাসি-কান্না
১৮. রসিকতা
১৯. নানাপ্রশ্ন
২০. জাতীয় সংহতি
২১. ভারতীয় সংহতি
২২. ভাষা
২৩. ভ্যাকিউয়াম
২৪. ধর্ম
২৫. ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাব্যবস্থা
২৬. ধর্ম ও কম্যুনিজম
২৭. এক ঝাণ্ডা
২৮. রাঁধে মেয়ে কি চুল বাঁধে না?
২৯. ওয়ার এম
৩০. দ্য গল
৩১. তলস্তয়
৩২. প্রিন্স গ্রাবিয়েলে দা’ন্নুনদজিয়ো
৩৩. খৈয়ামের নবীন ইরানি সংস্করণ
৩৪. ঢেউ ওঠে পড়ে কাঁদার সম্মুখে ঘন আঁধার

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন