০২. আমার নবজন্ম হল

শংকর (মণিশংকর মুখোপাধ্যায়)

আমার নবজন্ম হল। কলকাতা হাইকোর্টের শেষ ইংরেজ ব্যারিস্টারের শেষ বাবু আজ থেকে চিরদিনের মতো হারিয়ে গেল। ওল্ড পোস্ট অফিস স্ট্রিটের উপর দাঁড়িয়ে সে আর বাবুদের সঙ্গে গল্প করবে না, চেম্বারে বসে সে বিচার প্রার্থীদের সুখদুঃখের কাহিনি শুনবে না। আইনের সঙ্গে তার সম্পর্ক চিরদিনের মতো শেষ হল। কিন্তু তবু সে এক অপূর্ব আনন্দের অনুভূতি। সাইক্লোনে ক্ষতবিক্ষত জাহাজ মারমুখী সমুদ্রের বুক থেকে যেন আবার বন্দরের নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে ফিরে আসছে।

পরের দিন ভোরে স্নান সেরে, শেষ সম্বল প্যান্ট আর শার্টটা চাপিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিলাম। দূর থেকেই শাজাহান হোটেলের আকাশ চুম্বি হলদে রংয়ের বাড়িটা দেখতে পেলাম।

বাড়ি শব্দটা ব্যবহার করা উচিত হচ্ছে না। প্রাসাদ। তাও ছোট রাজরাজড়াদের নয়। নিজাম বা বরোদা নিঃসংকোচে এই বাড়িতে থাকতে পারেন–রাজন্যকুলে তাতে তাদের ঐশ্বর্যগৌরব সামান্য মাত্র ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।

ওই সকালেই রাস্তার ধারে বেশ কয়েকখানা গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে। নম্বর দেখেই বোঝা যায় যে, সব গাড়ির মালিক এই কলকাতা শহরের স্থায়ী বাসিন্দা নন। বোম্বাই, মাদ্রাজ, দিল্লি থেকে আরম্ভ করে ময়ূরভঞ্জ এবং ঢেঙ্কানল স্টেটের প্রতিনিধিত্ব করছে, ইংল্যান্ড, জার্মানি, ইটালি এবং আমেরিকার কারখানায় তৈরি নানা মডেলের মোটরগাড়ি। ওইসব গাড়ির দিকে তাকিয়ে যে-কোনো পর্যবেক্ষক ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটিয়ে দিতে পারেন। মোটর সোসাইটিতে কাস্ট সিস্টেম বা জাতিভেদ প্রথার যে এখনও প্রবল প্রতাপ, তা একটু লক্ষ্য করলেই বোঝা যায়। গাড়ির আকার অনুযায়ী হোটেলের দারোয়ানজি সেলাম টুকছেন। দারোয়ানজির বিরাট গোঁফ, পরনে মিলিটারি পোশাক। বুকের উপর আট-দশটা বিভিন্ন আকারের মেডেল ঝলমল করছে। এই সাত-সকালে অতোগুলো মেডেল বুকে এঁটে দাঁড়িয়ে থাকার উদ্দেশ্য কী, ভাবতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু তার আগেই দারোয়ানজি যে কায়দায় আমার উদ্দেশে সেলাম ঠুকলেন তার খানিকটা আন্দাজ পেতে পারা যায় এয়ার-ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল বিমান প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনে। দারোয়ানজির সঙ্গে বর্তমানে পৃথিবীবিখ্যাত এয়ারইন্ডিয়া মহারাজার আশ্চর্য সাদৃশ্যের কথা আজও আমাকে বিস্মিত করে। শুনলে আশ্চর্য হব না, শাজাহান হোটেলের এই দারোয়ানজিই হয়তো বিমান প্রতিষ্ঠানের শিল্পীকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন।

সেলামের বহর দেখেই বুঝলাম, দারোয়ানজি ভুল করেছেন। ভেবেছেন, শাজাহান হোটেলের নতুন কোনো আগন্তুক আমি।

গেট পেরিয়ে শাজাহান হোটেলের ভিতর পা দিয়েই মনে হল, যেন নরম মাখনের উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। নিজের চাপে প্রথমে যেন মখমলের বিছানায় তলিয়ে গেলাম, তারপর কোনো স্নেহপরায়ণা এবং কোমলস্বভাবা পরী যেন আলতোভাবে আমাকে একটু উপরে তুলে দিল। পরবর্তী পদক্ষেপে আবার নেমে গেলাম, পরী কিন্তু একটুও বিরক্ত না হয়ে পরম যত্নে আমাকে আবার উপরে তুলে দিল। পৃথিবীর সেরা কার্পেটের যে এই গুণ তা আমার জানা ছিল না; তাই একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল, সেই অদৃশ্য অথচ সুন্দরী পরী আমার দেহটাকে নিয়ে কার্পেটের টেবিলে কোনো বান্ধবীর সঙ্গে পিপঙ খেলছে।

প্রায় নাচতে নাচতে কার্পেটের অন্যপ্রান্তে যেখানে এসে পৌছলাম তার নাম রিসেপশন। সেখানে যিনি দাঁড়িয়ে রয়েছেন তার চোখে সমস্ত রাত্রির ক্লান্তি জমা হয়ে রয়েছে। আমাকে দেখেই তিনি সজাগ হয়ে উঠলেন। ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বললেন-গুড মর্নিং।

একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। সুপ্রভাত ফিরিয়ে না দিয়ে, নিজের পরিচয় দিলাম। এইখানে একটা চাকরি পেয়েছি। গত রাত্রে আপনাদের ম্যানেজার মিস্টার মার্কোপোলোর সঙ্গে দেখা করেছিলাম। তিনি আজ সকাল থেকে আসতে বলেছিলেন। ওঁর সঙ্গে এখন কি দেখা করা সম্ভব?

চকিতে ভদ্রলোকের মুখের ভাব পরিবর্তিত হল। পোশাকি ভদ্রতার পরিবর্তে মুখে হালকা ঘরোয়া হাসি ফুটে উঠল। বললেন, আসুন, আসুন, নমস্কার। Orients oldest hotel welconves its youngest staff! প্রাচ্যের প্রাচীনতম হোটেল তার তরুণতম কর্মচারীকে স্বাগত জানাচ্ছে।

ভয় পেয়ে আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলাম। ভদ্রলোক করমর্দনের জন্যে ডান হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, আমার নাম সত্যসুন্দর বোস—অন্তত আমার বাবা তাই রেখেছিলেন। এখন কপালগুণে স্যাটা বোস হয়েছি।

বোধহয় ওঁর মুখের দিকে অনেকক্ষণ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়েছিলাম। স্নেহমাখানো মৃদু ধাক্কা দিয়ে বললেন, এই পোড়ামুখ দেখে দেখে অরুচি ধরে যাবে। শেষ পর্যন্ত এমন হবে যে আমার নাম শুনলে আপনার গা বমি বমি করবে। হয়তো অ্যাকচুয়ালি বমি করেই ফেলবেন। এখন কাউন্টারের ভিতরে চলে আসুন। শাজাহান হোটেলের নবীন যুবরাজের অভিষেক-কার্য সম্পন্ন করি।

আমি বললাম, মিস্টার মার্কোপোলোর সঙ্গে একবার দেখা করবার…

কিচ্ছু দরকার নেই। সত্যসুন্দরবাবু জবাব দিলেন।গতকাল রাত্রে উনি আমাকে সব বলে রেখেছেন। এখন আপনি স্টার্ট নিন।

মানে?

মানে ফুল ফোর্সে বলতে গেলে গাড়িতে পেট্রল বোঝাই করে যেমনভাবে স্টার্ট নিতে হয়, ঠিক তেমনভাবে স্টার্ট নিন।

সত্যসুন্দরবাবুর কথার ভঙ্গিতে আমি হেসে ফেললাম। উনি গম্ভীরভাবে জিজ্ঞাসা করলেন, এ-এ-বির নাম শুনেছেন?

অটোমোবাইল অ্যাসোসিয়েশন অব বেঙ্গল?

হ্যাঁ হ্যাঁ! ওঁদের দুটো কম্পিটিশন হয়। স্পি কম্পিটিশন-কে কত জোরে গাড়ি চালাতে পারে। আর এনডিওরেন্স টেস্ট-কে কতক্ষণ একনাগাড়ে গাড়ি চালাতে পারে। আমাদের এখানে কিন্তু দুটি মিলিয়ে একটি কম্পিটিশন-স্পিড কাম এনডিওরেন্স টেস্ট। কত তাড়াতাড়ি কত বেশিক্ষণ কাজ করতে পারেন, শাজাহান ম্যানেজমেন্ট তা যাচাই করে দেখতে চান। মিস্টার বোসের পাশের টেলিফোনটা এবার বেজে উঠল। আমার সঙ্গে কথা থামিয়ে, কৃত্রিম অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ভঙ্গিতে সত্যসুন্দর বোস বললেন, গুড মর্নিং। শাজাহান হোটেল রিসেপশন।…জাস্ট-এ-মিনিট…মিস্টার অ্যান্ড মিসেস সাতারাওয়ালা…ইয়েস..রুম নাম্বার টু থার্টি টু…নো মেনসন প্লিজ…

ওঁর টেলিফোন সংলাপ কিছুই বুঝতে পারলাম না। সত্যসুন্দর বোস আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, এখন কান খুলে রেখে শুধু শুনে যান, সময়মতো সব বুঝতে পারবেন, শুধু মরচে পড়া স্মৃতিশক্তিকে ইলেকট্রোপ্লেটিং করে একটু চকচকে রাখবেন। বাকি সবকিছু এমনিতেই ম্যানেজ হয়ে যাবে। যেমন ধরুন রুম নাম্বার। কোন ভিজিটর কোন ঘরে রয়েছে, এটা মুখস্থ থাকলে খুব কাজ দেয়।

রিসেপশন কাউন্টারটা এবার ভালো করে দেখতে লাগলাম। কাউন্টারের ভিতর তিনটে চেয়ার আছে—কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকাটাই রীতি। ভিতরের টেবিলের উপর একটা টাইপরাইটার মেসিনও রয়েছে। পাশে গোটাকয়েক মোটা মোটা খাতা-হোটেল রেজিস্টার। দেওয়ালে একটা পুরনো বড় ঘড়ি অলসভাবে দুলে চলেছে। যেন সবেমাত্র ঘুম থেকে উঠে, ঘড়িটা কোনো উদ্ভট চিন্তায় কুঁদ হয়ে রয়েছে।

সত্যসুন্দর বোস বললেন, ভিতরে চলে আসুন।

আমার মুখের উপর নিশ্চয়ই আমার মনে ছায়া প্রতিফলিত হয়েছিল এবং সেইজন্যই বোধহয় সত্যসুন্দরবাবু বললেন, কী, এরই মধ্যে অবাক হচ্ছেন?

লজ্জা পেয়ে উত্তর দিলাম, কই? না তো। মিস্টার বোস এবার হেসে ফেললেন। চারিদিক একবার সতর্কভাবে তাকিয়ে চাপা গলায় বললেন, এখনও তো শাজাহান হোটেলের ঘুম ভাঙেনি। তখন আরও আশ্চর্য লাগবে।

কোনো উত্তর না দিয়ে কাউন্টারের ভিতরে এসে ঢুকলাম। এমন সময় টেলিফোনটা আবার বেজে উঠল। অভ্যস্ত কায়দায় টেলিফোনটা তুলে নিয়ে, বোস বাঁকা ও চাপা স্বরে বললেন, শাজাহান রিসেপশন। তারপর ওদিককার স্বর শুনেই হেসে বললেন, ইয়েস, স্যাটা হিয়ার! এবার টেলিফোনের অপর প্রান্তের সঙ্গে বোধহয় কোনো রসিকতা বিনিময় হল-মনে হল দুজনেই একসঙ্গে হাসতে আরম্ভ করেছেন।

টেলিফোনটা নামিয়ে রেখে বোস বললেন, স্টুয়ার্ড এখনি আসছেন। ওঁকে একটু বাটার দিয়ে প্লিজ করবার চেষ্টা করবেন।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই একটি বিশাল দেহকে দূর থেকে দেখতে পাওয়া গেল। যেন চলন্ত মৈনাক পর্বত। অন্তত আড়াই মণ ওজন। অথচ হাঁটার কায়দা দেখে মনে হয় যেন একটা পায়রার পালক হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। সায়েবের গায়ের রং পোড়া তামাটে। চোখ দুটো যেন এক জোড়া জ্বলন্ত টিকে।

ভদ্রলোক আমার দিকে গাঁক গাঁক করে তেড়ে এলেন। ও, তাহলে তুমিই সেই ছোকরা যে রোজিকে হটালে!

উত্তর দেবার কোনো সুযোগ না-দিয়ে স্টুয়ার্ড তার বিশাল বাঁ হাতখানা আমার নাকের কাছে এগিয়ে আনলেন। ওঁর হাতঘড়িটার দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে জানালেন যে, আর পনেরো মিনিটের মধ্যেই ব্রেকফাস্ট রেডি হবে। গত রাত্রে ব্রেকফাস্ট কার্ড তৈরি হয়নি; সুতরাং এখনই ও কাজটি সম্পন্ন করতে হবে।

ভদ্রলোক যে ইংরেজ নন, তা কথা থেকেই বোঝা গেল। আধো-আধো কন্টিনেন্টাল ইংরিজিতে চিৎকার করে বললেন, তেক দাউন, তেক দাউন কুইকলি।

একটা শর্টহ্যান্ডের খাতা এগিয়ে দিয়ে মিস্টার বোস চাপা গলায় বললেন, লিখে নিন।

একটুও অপেক্ষা না করে স্টুয়ার্ড হুড় হুড় করে কী সব বলে যেতে লাগলেন। কতকগুলো অদ্ভুত শব্দ, এর পূর্বে কোনোদিন শুনিনি, কানে ঢুকতে লাগল—চিলড পাইনঅ্যাপেল জুইস, রাইস ক্রিসপিজ, এগস-বয়েল্ড, ফ্রায়েড পোন্ড, স্ক্র্যাম্বল্ড…একটা বিরাট ঢোক গিলে স্টুয়ার্ড চিৎকার করে নামতা পড়ার মতো বলে যেতে লাগলেন, ওমলেট–প্রন, চিজ আর টোমাটো। আরও অসংখ্য শব্দ তার মুখ দিয়ে তুবড়ির ফুলঝুরির মতো বেরিয়ে আসতে লাগল। শেষ কথা-কফি।

তারপর আমার দিকে না তাকিয়ে হিন্দিতে বললেন, জলদি, জলদি মাঙতা এবং আমাকে কিছু প্রশ্ন করবার সুযোগ না দিয়েই অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

আমার কাঁদো-কাঁদো অবস্থা। জীবনে কখনও ওইসব অদ্ভুত খাবারের নাম শুনিনি। যতগুলো নাম সায়েব বললেন, তার অর্ধেকও আমি লিখে নিতে পারিনি।

মিস্টার বোস বললেন, পঞ্চাশটা ব্রেকফাস্ট কার্ড এখনই তৈরি করে ফেলতে হবে।

আমার মুখের অবস্থা দেখে, মিস্টার বোস সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করলেন। কিছু মনে করবেন না। ও ব্যাটার স্বভাবই ওরকম। সব সময় বুনো শুয়োরের মতো ঘোঁত ঘোঁত করছে।

আজকের ব্রেকফাস্টের লিস্ট আমি লিখে নিতে পারিনি।আমি কাতর ভাবে ওঁকে জানালাম।

মিস্টার বোস বিনা দ্বিধায় সঙ্গে সঙ্গে বললেন, তার জন্যে চিন্তা করবেন। জিমির ফিরিস্তি আমার মুখস্থ আছে। আপনি আস্তে আস্তে টাইপ করুন, আমি বলে যাচ্ছি। এ-হোটেলে যেদিন থেকে ঢুকেছি, সেদিন থেকেই ওই এক মেনু দেখছি। তবু ব্যাটার বোজ নতুন কার্ড ছাপানো চাই। আগে আমারও ভয় করত, আর এখন মেনু কার্ডের নাম শুনলে হাসি লাগে। কত অদ্ভুত নাম আর উচ্চারণই না শিখে ফেলেছি। দুদিন পরে স্টুয়ার্ডের মুখ দেখে আপনিও বলে দিতে পারবেন, কী মেনু হবে। Salad Italienne হলেই আমাদের ইতালিয় স্টুয়ার্ড যে Consome friod en Tasse আর Potage Albion-এর ব্যবস্থা করবেন, তা আপনার মুখস্থ হয়ে যাবে।

মেনুতে অনভিজ্ঞ আমি টাইপ করতে করতে সেদিন অনেক ভুল করেছিলাম। আমাকে চেয়ার থেকে তুলে দিয়ে সত্যসুন্দর বোস তাই নিজেই টাইপ করতে বসলেন। আর আমি কাউন্টার থেকে বেরিয়ে ঘুরে ঘুরে বাড়িটা দেখতে লাগলাম।

শাজাহান হোটেলে তখনও যেন জীবন শুরু হয়নি। শুধু কিচেন-এর প্যান্ট্রিতে চাপা ব্যস্ততা। বেয়ারারা মিল্কপটে দুধ ঢালছে, কাপ-ডিস সাজাচ্ছে, ঝাড়ন দিয়ে ঘষে ঘষে ছুরি এবং কাঁটাগুলোকে চকচকে করছে।

কাউন্টারে ফিরে এসে দেখলাম, মিস্টার বোস দ্রুতবেগে টাইপ করে যাচ্ছেন। কতই বা বয়স ভদ্রলোকের? বত্রিশ/তেত্রিশের বেশি নয়। এককালে বোধহয় ক্রিকেট কিংবা টেনিস খেলতেন। পেটানো লোহার মতো শরীর, কোথাও একটু বাড়তি মেদ নেই। অমন সুন্দর শরীরে ধবধবে কোট-প্যান্ট এবং ঝকঝকে টাই সুন্দর মানিয়েছে।

আমার টাইপ-করা কার্ডের জন্য অপেক্ষা করলে লাঞ্চের আগে ব্রেকফাস্ট সার্ভ করা সম্ভব হত না। কিন্তু বোসের অভ্যস্ত আঙুলগুলো ফরাসি শব্দের মধ্য দিয়ে যেন দ্রুততালে নাচতে লাগল।

জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি বুঝি ফরাসি জানেন?

মুখ বেঁকিয়ে তিনি বললেন, ফরাসি! পেটে বোমা মারলেও ও-ভাষায় একটি কথা মুখ দিয়ে বেরুবে না। তবে খাবারের নাম জানি। ও-সব নাম, আমাদের হেডকুক, যে টিপ সই দিয়ে মাইনে নেয়, তারও মুখস্থ। কার্ডগুলো সাজাতে সাজাতে বোস বললেন, ইংরেজদের এত বুদ্ধি, কিন্তু রাঁধতে জানে না। একটা ভদ্র খাবারের নামও আপনি জন বুলের ডিক্সনারিতে পাবেন না।

পাশ্চাত্য ভোজনশাস্ত্রে আমার অরিজিন্যাল বিদ্যার দৌড় রিপন কলেজের পাশে কেষ্ট কাফে পর্যন্ত। ওখানে যে দুটি জিনিস ছাত্র-জীবনে প্রিয় ছিল, সেই চপ ও কাটলেটকে ইংরেজ সভ্যতার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলেই জানতাম। তাছাড়া মামলেট নামক আর এক মহার্ঘ ইংরিজি খাদ্যের সঙ্গেও আমাদের পরিচয় ছিল। এখন শুনলাম চপ কাটলেট আবিষ্কারের পিছনে ইংরেজের কোনো দান নেই, এবং মামলেট আসলে ওমলেট এবং য়ুরোপীয় রন্ধনশাস্ত্রে এতরকমের ওমলেট প্রস্তুত প্রণালী আছে যে, ডিক্সনারি অফ ওমলেট নামে সুবিশাল ইংরিজি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।

সায়েবের সঙ্গে যখন কোথাও খেয়েছি, তখন খাবারকেই আক্রমণ করেছি, নাম নিয়ে মাথা ঘামাইনি। সায়েবের কাছেই শুনেছিলাম, এক সৎ এবং অনুসন্ধিৎসু ভদ্রলোক প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, কোনো খাবারের ব্যাকগ্রাউন্ড স্টোরি না-জেনে তিনি সেই খাবার খাবেন না; এবং তার ফলে বেচারাকে যে শেষ পর্যন্ত অনাহারে মারা যেতে হয়েছিল, সে-খবরও খুব গম্ভীর এবং বেদনার্ত কণ্ঠে সায়েব আমাকে জানিয়েছিলেন।

কার্ডগুলো ডাইনিংরুমে পাঠিয়ে দিয়ে মিস্টার স্যাটা বোস বললেন, অষ্টম হেনরির নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই? দাড়িওয়ালা ওই বিশাল মোটা লোকটার ছবি ইতিহাসের বইতে দেখে আমার এমন রাগ হয়েছিল যে, ব্লেড দিয়ে ভদ্রলোককে সোজা কেটে উড়িয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু তখন কি জানতাম যে, ভদ্রলোক আমাদের এইভাবে ড়ুবিয়ে গিয়েছিলেন; তা হলে শুধু ব্লেড দিয়ে কেটে নয়, ছবিটাকে আগুনে পুড়িয়ে শান্তি পেতাম।

কেন? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

শুধু বিয়ে করতে নয়, অষ্টম হেনরি খেতেও খুব ভালোবাসতেন, মিঃ বোস বললেন। একবার উনি এক ডিউকের বাড়িতে নেমন্তন্ন খেতে গিয়েছিলেন। তার সঙ্গে অন্য হোমরা-চোমরা যারা খেতে বসেছিলেন, তারা ডিনার টেবিলে একটা আশ্চর্য জিনিস দেখলেন। অষ্টম হেনরি মাঝে মাঝে তার টেবিলে রাখা একটুকরো কাগজের দিকে নজর দিচ্ছেন, তারপর আবার খাওয়া নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন। লর্ড, ডেপুটি-লর্ড, কাউন্ট, আর্ল এবং পারিষদরা তো মাথায় হাত দিয়ে বসলেন। ওটা কী এমন মূল্যবান দলিল যে, হিজ ম্যাজেস্টিকে খাবার মধ্যেও তা পড়তে হচ্ছে? নিশ্চয়ই কোনো গুরুতর টপ-সিক্রেট সংবাদ দূত মারফত সবেমাত্র এসে পৌঁচেছে। খাওয়া শেষ হলে সম্রাট কিন্তু কাগজটা টেবিলের উপর ফেলে রেখেই ডিউকের ড্রইংরুমে চলে গেলেন। সাঙ্গোপাঙ্গরা সবাই তখন টেবিলের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। কিন্তু হায়! রাজ্যের কোনো গোপন সংবাদ কাগজটাতে নেই—শুধু কতকগুলো খাবারের নাম লেখা। ডিউক ভোজসভার জন্য কী কী খাবারের ব্যবস্থা করেছেন, তা একটা কাগজে লিখে সম্রাটকে দিয়েছিলেন। সবাই তখন বললেন, বাঃ, চমৎকার বুদ্ধি তো। আজে বাজে জিনিসে পেট ভরিয়ে তারপর লোভনীয় কোনো খাদ্য এলে আফসোসের শেষ থাকে না। মেনুর মারফত পূর্বাহ্নে আয়োজনের পূর্বাভাস পেলে, কোনটা খাব, কোনটা খাব না, কোনটা কম খাব, কোনটা বেশি টানব আগে থেকেই ঠিক করে নেওয়া যায়।

মিস্টার বোস একটু হেসে বলতে লাগলেন-সেই থেকেই মেনুকার্ড চালু হল। সম্রাটকে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে আমাদের মতো হোটেল কর্মচারীদের সর্বনাশ করা হল। প্রতিদিন শাজাহান হোটেলের ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ এবং ডিনারের মেনুকার্ড টাইপ করো, টেবিলে টেবিলে সাজিয়ে দেবার ব্যবস্থা করো। খাওয়া শেষ হলে কার্ডগুলো টেবিল থেকে তুলে নিয়ে আবার স্টোররুমে পাঠিয়ে দাও। বান্ডিল-বাঁধা অবস্থায় কার্ডগুলো ধুলোর পাহাড়ে বছরখানেক পড়ে থাকবে। তারপর একদিন স্যালভেশন আর্মির লোকদের খবর দেওয়া হবে। তারা লরি করে এসে পুরনো কাগজপত্তর সব নিয়ে ঘরটাকে খালি করে দিয়ে চলে যাবে।

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সত্যসুন্দরবাবু বললেন, সময়কে এখানে আমরা অন্যভাবে ভাগ করে নিয়েছি, বেড় টি দিয়ে এখানে সময়ের শুরু হয়। তারপর ব্রেকফাস্ট টাইম। বাইরের লোকেরা যাকে দুপুর বলে, আমাদের কাছে সেটা লাঞ্চ টাইম। তারপর আফটারনুন টি টাইম, ডিনার টাইম, এবং সেইখানেই শেষ ভাববেন না। ক্যালেন্ডারের তারিখ পাল্টালেও আমরা পাল্টাই না। সে-সব ক্রমশ বুঝতে পারবেন।

 

দেখলাম, ব্রেকফাস্টের সময় থেকেই হোটেলের কাউন্টারে কাজ বেড়ে যায়। কথা বলবার সময় থকে না। রাত্রের অতিথিরা নিজেদের সুখশয্যা ছেড়ে লাউঞ্জে এসে বসেছেন। কাউন্টারের পাশ দিয়ে যাবার সময়, যন্ত্রচালিতের মতো সুপ্রভাত বিনিময় হচ্ছে। গেস্টরা কাছাকাছি এসে, কাউন্টারের দিকে এক-একটি গুড মর্নিং ছুড়ে দিচ্ছেন, আর মিস্টার বোস, অভিজ্ঞ খেলোয়াড়ের মতো সেটা লুফে নিয়ে, আবার ফিরিয়ে দিচ্ছেন-গুড মর্নিং মিস্টার ক্রেবার—গুড মর্নিং ম্যাডাম, হ্যাড এ নাইস স্লিপ? রাত্রে ঘুম হয়েছিল তো?

এক বৃদ্ধা আমেরিকান মহিলা কাউন্টারের কাছে এগিয়ে এলেন। ঘুম? মাই ডিয়ার বয়, গত আট বছর ধরে ঘুম কাকে বলে আমি জানি না। প্রথম প্রথম পিল খেয়ে ঘুম হত; তারপর ইনজেকশন নিতাম। এখন তাতেও কিছু হয় না। সেইজন্যই ওরিয়েন্টে এসেছি—ম্যাজিক দিয়ে পুরনো দিনে এদেশে

অসাধ্যসাধন হত, যদি তার কিছুটাও এখন সম্ভব হয়।

মিস্টার বোসকে সহানুভূতি প্রকাশ করতে হল। আহা! পৃথিবীতে এত পাজি দুষ্টু এবং বদমাস লোক থাকতে ঈশ্বর তোমার মতো ভালো মানুষের উপর নির্দয় হচ্ছেন কেন? তবে, তুমি চিন্তা করো না, এ-রোগ সহজেই সেরে যায়।

গভীর হতাশা প্রকাশ করে ভদ্রমহিলা বললেন, এই জন্মে আর ঘুমোতে পারব বলে তো মনে হয় না।

কী যে বলেন। বালাই ষাট। আমার পিসিমারও তো ওই রকম হয়েছিল। কিন্তু তিনি তো ভালো হয়ে গেলেন।

কেমন করে? কী ওষুধ খেয়েছিলেন? ভদ্রমহিলা এবার কাউন্টারের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়লেন।

ওষুধ খেয়ে নয়। প্রার্থনা করে—বাই প্রেয়ার। পিসিমার মতে, পেয়ারের মতো শক্তি নেই। প্রেয়ারে তুমি পৰ্বতকে পর্যন্ত নড়াতে পারো।

বৃদ্ধা মহিলা যেন অবাক হয়ে গেলেন। ভ্যানিটি ব্যাগ এবং ক্যামেরাটা কাউন্টারের উপর রেখে মাথায় বাঁধা সিল্কের রুমালটা ঠিক করতে করতে বললেন, তার কি কোনো সুপারন্যাচারাল পাওয়ার আছে?

তাঁর প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগেই আর এক ভদ্রলোক কাউন্টারের সামনে এসে দাঁড়ালেন। ছফুট লম্বা, সুদর্শন বিদেশি। কাঠামোখানা যেন ডরম্যান লং কোম্পানির পেটানো ইস্পাত দিয়ে তৈরি। বোস তার দিকে ঝুঁকে পড়ে বললেন, গুড মর্নিং ডক্টর।

চশমার ভিতর থেকে তির্যক দৃষ্টি হেনে ডাক্তার শুভেচ্ছার প্রত্যুত্তর দিলেন। তারপর গম্ভীরভাবে বললেন, আমি কি দশটা টাকা পেতে পারি?

নিশ্চয়ই, নিশ্চয়। ডানদিকের ক্যাশ বাক্সটা খুলে, এক টাকার দশখানা নোট বার করে বোস ডাক্তার সায়েবের দিকে এগিয়ে দিলেন। একটা ছাপানো ভাউচার বাঁ হাতে খসখস করে সই করে দিয়ে ভদ্রলোক আবার হোটেলের ভিতর চলে গেলেন।

মেমসায়েব ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করলেন, লোকটি কে?

বোস বললেন, ডক্টর সাদারল্যান্ড। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার কাজে এদেশে এসেছেন।

ভদ্রমহিলা এবার একটু অসন্তুষ্ট হলেন। বললেন, তোমাদেরও মাথা খারাপ। তোমরা তোমাদের এনসিয়েন্ট চিকিৎসা বিজ্ঞানের উদ্ধারের জন্য কোনো চেষ্টা করছ না। ইউ পিপল, জানো, এইসব ডাক্তাররা—যাদের তোমরা ডেমি গডের মতো খাতির করে বিদেশে থেকে আনছ, যাদের কমফর্টের জন্য তোমাদের কান্ট্রি লাখ লাখ ডলার খরচ করছে—তারা একজন অর্ডিনারি আমেরিকান সিটিজেনকে ঘুম পাড়াতে পারে না। অথচ এই কান্ট্রির নেকেড ফকিররাও ইচ্ছে করলে একশো বছর, দেড়শো বছর একটানা ঘুমিয়ে থাকতে পারে।

উভয় সঙ্কটে পড়ে বোস চুপ করে রইলেন।

ভদ্রমহিলা তখন বললেন, আমি তোমাদের সাদারল্যান্ডে ইন্টারেস্টেড নই; আমি ইন্টারেস্টেড তোমার পিসিমাতে। আমি সেই গ্রেট লেডির সঙ্গে দেখা করতে চাই। প্রয়োজন হলে, আমি চিঠি লিখে এই গ্রেট লেডির টেলিভিশন প্রোগ্রামের ব্যবস্থা করব। তোমরা জানো না, স্টেটসে তোমার পিসিমার অভিজ্ঞতার কি প্রয়োজন রয়েছে-0. S. A needs her

মিস্টার বোসের চোখ দুটো এবার ছলছল করে উঠল। পকেট থেকে রুমাল বার করে তিনি ঘন ঘন চোখ মুছতে লাগলেন।

ভদ্রমহিলা বিব্রত হয়ে বললেন, কী হল? আমি কি না জেনে তোমাকে কোনো আঘাত দিয়েছি?

চোখ মুছতে মুছতে সত্যসুন্দর বোস বললেন, না, না, তোমার দোষ কী? তুমি কী করে জানবে যে হতভাগ্য আমি মাত্র দু-মাস আগে পিসিমাকে চিরদিনের জন্য হারিয়েছি?

কিছু মনে কোরো না, মিস্টার বোস। আই অ্যাম অফুলি স্যরি। তোমার পিসিমার আত্মা চিরশান্তি লাভ করুক। বলতে বলতে ভদ্রমহিলা ট্যাক্সির খোঁজে বাইরে বেরিয়ে গেলেন।

মিস্টার বোসকে হঠাৎ এইভাবে ভেঙে পড়তে দেখে আমিও অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিলাম। কোনোরকমে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, বোসদা, সংসারে কেউ কিন্তু চিরদিন বেঁচে থাকতে পারেন না। আমার বাবা বলতেন, পৃথিবীতে আমাদের সকলকেই একা থাকবার অভ্যাস করতে হবে।

বোসদা এবার হেসে ফেললেন। ওঁকে হাসতে দেখে আমি আরও ভড়কে গেলাম। উনি তখন বললেন, আমার বাবার কোনো বোনই ছিল না। সব বানানো! পিসিমাকে তাড়াতাড়ি না মেরে ফেললে, বুড়ি আমার আরও একটি ঘণ্টা সময় নষ্ট করত। অথচ অনেক কাজ জমা হয়ে রয়েছে।

আমি অবাক।

সত্যসুন্দরবাবুকে বললাম, সেন্ট জন চার্চের কাছে ওল্ড পোস্ট অফিস স্ট্রিটে যে হাইকোর্ট রয়েছে, সেখানে আপনার যাওয়া উচিত ছিল; এই বুদ্ধি ওখানে খাটালে এতদিনে সহজেই গাড়ি বাড়ি করতে পারতেন।

স্যাটা বোস এবার যেন গম্ভীর হয়ে উঠলেন। নিজের মনেই বললেন, গাড়ি বাড়ি? নাঃ থাক, তুমি নতুন মানুষ, এখন সেসব শুনে কাজ নেই।

হয়তো আরো কথা হত, কিন্তু বেয়ারা এসে খবর দিল, ম্যানেজার সায়েব রান্নাঘর ইন্সপেকশনে নিচেয় নেমেছেন।

বোস বললেন, মার্কোপোলো সায়েবের চাদমুখটা একবার দেখে আসুন। ওঁর সঙ্গেই তো আপনার ঘরসংসার করতে হবে।

ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, লোক কেমন?

আপনার কেমন মনে হয়? উনি উল্টো প্রশ্ন করলেন।

নামটা রোমান্টিক। এমন নাম যে এখনও চালু আছে জানতাম না।

বোস বললেন, হা, রোমান্টিকই বটে। আসল মার্কোপোলোকে শেষ জীবন জেলে কাটাতে হয়েছিল, ইনি কোথায় শেষ করেন দেখুন।

সে রকম কোনো সম্ভাবনা আছে নাকি? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

না না। এমনি বলছি। খুবই কাজের লোক। পাকা ম্যানেজার। জানেন তো ওমর খৈয়াম কী বলে গিয়েছেন? ভালো প্রধানমন্ত্রী পাওয়া যে-কোনো দেশের পক্ষেই কঠিন ব্যাপার; কিন্তু ভালো হোটেল ম্যানেজার পাওয়া আরও কঠিন। দে আর বর্ন অ্যান্ড নট মেড। অপদার্থ মন্ত্রীর হাত থেকে কোনো কোনো দেশকে রেহাই পেতে দেখা গিয়েছে, কিন্তু অপদার্থ ম্যানেজারের মুঠো থেকে কোনো হোটেলকে আজ পর্যন্ত বেরিয়ে আসতে দেখা যায়নি, বোস হাসতে হাসতে বললেন।

স্যাটা আরও বললেন, ভদ্রলোক রেঙ্গুনের সব চেয়ে বড় হোটেলের ম্যানেজার ছিলেন। এখানকার ডবল মাইনে পেতেন। কিন্তু মাথায় কী এক ভূত চাপল। কলকাতায় কাজ করতে এলেন। আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম, হয়তো কোনো গণ্ডগোল বাধিয়ে এসেছেন। কিন্তু ওখানকার স্টুয়ার্ড ফ্রান্সে ফিরে যাবার পথে, আমাদের হোটেলে দুদিন ছিল। সে বললে, রেঙ্গুন হোটেল মার্কোপোলো সায়েবকে এখনও ফিরে যেতে অনুরোধ করছে।

 

মেঝে কেন পরিষ্কার করা হয়নি? ধাপার মাঠ যে এর থেকে পরিষ্কার থাকে, রান্নাঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে ম্যানেজার সায়েব চিৎকার করছিলেন।

দেখলাম, হেড-কুক ও মশালচি ব্যস্ত হয়ে এ-দিক ও-দিক ছোটাছুটি করছে, আর মার্কোপোলো ঘরের সমস্ত কোণ খুঁটিয়ে ময়লা আবিষ্কারের চেষ্টা করছেন।

আমার পায়ের শব্দ পেয়েই সায়েব মুখ তুললেন।হ্যালো, তুমি তাহলে এসে গিয়েছ?

আমি সুপ্রভাত জানালাম।

কাজকর্ম একটু-আধটু দেখতে আরম্ভ করেছ তো? সায়েব জিজ্ঞাসা করলেন।

হেড-কুক নিধনযজ্ঞের এবার বোধহয় বিরতি হল। কারণ সায়েব আমাকে নিয়ে আপিস ঘরের উদ্দেশে পাড়ি দিলেন।

আপিস ঘরটা ছোট্ট। মাত্র খান তিনেক চেয়ার আছে। পাশে একটা টাইপরাইটারও রয়েছে। টেবিলে একরাশ কাগজপত্তর। এক কোণে দুটো লোহার আলমারিও দাঁড়িয়ে আছে। ডান দিকের দেওয়ালে আর একটা দরজা, বোধহয় ওইটা খুলে মার্কোপোলো সোজা নিজের বেডরুমে চলে যেতে পারেন।

নিজের চেয়ারে বসে মার্কোপোলো চুরুট ধরালেন। দীর্ঘ পুরুষালি দেহ। বয়সের তুলনায় শরীরটা একটু ভারী। মাথায় সামান্য টাক। কিন্তু চুলটা ছোট করে ছাঁটা বলে, টাকটা খুব চোখে পড়ে না। চুরুটের গুণে গম্ভীর মুখটা আরও গম্ভীর হয়ে উঠল। থিয়েটারে উইনস্টন চার্চিলের ভূমিকায় ওঁকে সহজেই নামিয়ে দেওয়া যায়।

চিঠি ডিক্টেশন দেবার জন্য প্রস্তুত হয়ে, মার্কোপোলো আমার মুখের দিকে তাকালেন। গভীর দুঃখের সঙ্গে বললেন, সাচ এ গুড় গার্ল। রোজির মতো মেয়ে হয় না। ওর জন্য আমার আপিসের কাজে কোনো চিন্তাই ছিল না। যখনই ডেকেছি, হাসিমুখে চিঠি টাইপ করে দিয়েছে—এমনকি মিডনাইটেও। হোটেলে এমন সব চিঠি আসে যা ফেলে রাখার উপায় নেই, সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিতে হয়।

মার্কোপোলো এবার দু একটা চিঠি ডিক্টেশন দিলেন। ইংরাজি খুব ভালো নয়, কিন্তু বিনয়ের পরাকাষ্ঠা। কোথায় যে কী পানীয় পাওয়া যায় তার পুঙ্খানুপুঙ্খ খবর যে তিনি রাখেন তা বুঝতে পারলাম। সম্প্রতি কয়েকটি মদ ডাইরেক্ট ইমপোর্ট করিয়েছেন। তাই একটা সার্কুলার ডিক্টেশন দিয়ে সগর্বে ঘোষণা করলেন—এই বিশ্ববিখ্যাত পানীয় ভারতবর্ষে একমাত্র আমরাই আমদানি করতে সমর্থ হয়েছি।

ডিক্টেশন শেষ করে ম্যানেজার সায়েব আবার বেরিয়ে পড়লেন। অনেক কাজ বাকি রয়েছে। বড় হোটেল চালানো থেকে একটা ছোটখাটো রাজত্ব চালানো অনেক সহজ। যদি দুশো জন অতিথি এখানে থাকেন, তাহলে প্রতি মিনিটে দুশো সমস্যার উদ্ভব হচ্ছে। এবং সে-সবের সমাধান ম্যানেজারকেই করতে হবে।

চিঠি টাইপ করা আমার নতুন পেশা নয়। সুতরাং ওই কাজে বেশি সময় ব্যয় করতে হল না। সই-এর জন্য চিঠিগুলো সায়েবের ঘরে পাঠিয়ে দিয়ে, আপিসের কাগজপত্তরগুলো গুছোতে আরম্ভ করলাম। হঠাৎ পালিয়ে গিয়ে রোজি আমাকে ড়ুবিয়ে গিয়েছে। কোথায় কী আছে জানি না। কোথায় কোন ফাইল আছে তারও কোনো লিস্টি খুঁজে পেলাম না। কেবল মাত্র একজোড়া চোখ এবং দুটো হাতের উপর ভরসা করে ফাইলের পাহাড় আবার ঢেলে সাজাতে আরম্ভ করলাম।

আমার টেবিলের বাঁদিকে ড্রয়ারগুলো খুলতেই দেখলাম রোজির ব্যক্তিগত মালপত্তর কিছু রয়েছে। একটা নেলপালিশ, নতুন ব্লেড এবং একটা ছোট আয়নাও ওখানে পড়ে রয়েছে। মনটা খারাপ হয়ে গেল। কার জন্য ফাইলগুলো সাজাচ্ছি? আগামী কালই হোটেলে সর্বজনপ্রিয় যুবতী মহিলাটি হয়তো আবার আবির্ভূতা হবেন; তখন আমাকে আবার কার্জন পার্কে ফিরে যেতে হবে। দুদিনের জন্য মায়া বাড়িয়ে লাভ কী?

 

কাজের মধ্য দিয়ে দিনটা যে কোথা দিয়ে কেটে গেল, খেয়াল করিনি। ব্রেকফাস্ট এবং লাঞ্চের ঘর পেরিয়ে ঘড়ির কাটা কখন যে সান্ধ্য চা-এর সময়ও অতিক্রম করে যাচ্ছিল, তা নজরে আসেনি।

বাবুজি, আপনি তো সারাদিনই কাজ করে যাচ্ছেন। একটু চা খাবেন না? মুখ তুলে দেখলাম ম্যানেজার সায়েবের বেয়ারা।

মিষ্টি হাসি দিয়ে সে আমাকে নমস্কার করলে। বয়স হয়েছে ওর! মাথার চুলগুলো সাদা হয়ে এসেছে। কিন্তু পেটা লোহার পাতের মতো চেহারা। ও বললে, আমার নাম মথুরা সিং!

বললাম, মথুরা সিং, তোমার সঙ্গে আলাপ করে খুব খুশি হলাম।

মথুরা সিং বললে, বাবুজি, আপনার জন্য একটু চা নিয়ে আসি।

চা? কোথা থেকে নিয়ে আসবে? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

সে আমি নিয়ে আসছি, বাবুজি। আপনি চিন্তা করবেন না। আপনার সম্বন্ধে এখনও কোনো সিলিপ ইসু হয়নি; অর্ডার হয়ে গেলে তখন আপনার খাওয়াদাওয়ার অসুবিধা হবে না, মথুরা সিং বললে।

আপিস ঘরের মধ্যেই মথুরা চা নিয়ে এল। চা তৈরি করে, কাপটা আমার সামনে এগিয়ে দিয়ে, মথুরা বললে, শেষ পর্যন্ত বাবুজি, আপনি এখানে এলেন?

মথুরা, তুমি কি আমাকে চিনতে? আমি সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করলাম।

আপনি তো ব্যারিস্টার সায়েবের বাবু ছিলেন?মথুরা বললে, কলকাতা শহরে ওই সায়েবকে কে চিনত না বাবু? ওঁর বেয়ারা মোহনের বাড়ি আমাদের গ্রামে।

তুমি তা হলে কুমায়ুনের লোক?

হ্যাঁ, হুজুর। মোহনের সঙ্গে দেখা করতে আমি আপনাদের ওখানে অনেকবার গিয়েছি; আপনাকে কয়েকবার আমি দেখেছি।

বড় আনন্দ হল। অপরিচিতের হাটে এতক্ষণে যেন আপনজন খুঁজে পেলাম। বাংলা দেশ যদি আমার মাতৃভূমি হয়, কুমায়ুন আমার দ্বিতীয় মা। কুমায়ুনের প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য আছে, বিখ্যাতদের পদধূলি লাভ করে ইদানীং সে আরও প্রখ্যাত হয়েছে, তাকে ভালোবাসার লোকের অভাব নেই। কিন্তু কুমায়ুন যদি পৃথিবীর জঘন্যতম স্থান হত, ম্যালেরিয়া, আমাশয় এবং ডেঙ্গুজ্বরের ডিপো হত, তা হলেও আমি তাকে ভালোবাসতাম। এই পোড়া দেশে এখনও যে। এমন জায়গা আছে ভাবতে আশ্চর্য লাগে। ওখানে বাড়ির চারিদিকে কেউ পাঁচিল দেয় না, মনের মধ্যে বিভেদের পাঁচিল তুলতেও ওখানকার লোকেরা আজও শেখেনি।

মথুরা বললে, বাবুজি, এই চাকরিতে আপনি এসেছেন, ভালোই হয়েছে। তবে ঘাবড়ে যাবেন না। এমন অনেক কিছুই হয়তো দেখবেন, যা এর আগে কখনও দেখেননি, হয়তো কানেও শোনেননি। কিন্তু ভয় পাবেন না। এই চল্লিশ বছর ধরে আমিও তো কম দেখলাম না। কিন্তু মাথা উঁচু করে এতদিন তো বেঁচে রইলাম। আপনাদের আশীর্বাদে আমার ছেলেটাও চাকরি পেয়েছে।

কোথায়? এই হোটেলে? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

মাপ করুন, হুজুর। জেনে শুনে এখানে কেউ নিজের ছেলেকে পাঠায়?

আমি বললাম, মথুরা, নিজের কর্মস্থান সম্বন্ধে সকলেরই একটা অবজ্ঞা থাকে। যাকে জিজ্ঞাসা করো সেই বলবে, আমি নিজে ভুগেছি, ছেলেকে আর ভুগতে দেব না।

মথুরা বললে, বাবুজি, ব্যারিস্টার সায়েবের কাছে তো অনেক দেখেছেন! এবার এখানেও দেখুন। শিউ ভগবানের দয়ায় আপনার চোখের পাওয়ার তো কমে যায়নি।

চায়ের পেয়ালা নামিয়ে বললাম, মথুরা, এখানে ছুটি কখন হয়?

বাবুজি, ব্রিটিশ রাজ্যে তবু কোভি কোভি সান-সেট হোয়, কিন্তু হোটেলের আলো কখনও নেভে না। ছুটি এখানে কখনই হয় না। তবে আপনাকে কতক্ষণ কাজ করতে হবে, কিছু বলেনি?

বললাম, না।

আজ প্রথম দিন তাহলে চলে যান। মথুরা বললে।

ম্যানেজার সায়েবের সঙ্গে দেখা করে যাই। আমি বললাম।

ওঁর দেখা তো এখন পাবেন না হুজুর। মথুরা বললে।

কেন? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

আমার এই আকস্মিক প্রশ্নের জন্যে মথুরা যেন প্রস্তুত ছিল না। সে বেশ বিব্রত হয়ে পড়ল। কী উত্তর দেবে সে ঠিক করে উঠতে পারছে না। এখন ওঁর ঘরে কারুর ঢুকবার অর্ডার নেই, মথুরা ফিসফিস করে বললে। আপনি চলে যান, উনি জিজ্ঞাসা করলে, আমি বলে দেব।

আপিস ঘর থেকে বেরিয়ে করিডর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সিঁড়ির সামনে হাজির হলাম। ঘরের ভিতর সব সময় আলো জ্বালা থাকে, তাই বুঝতে পারিনি, সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত্রি এসেছে। শাজাহান হোটেলে আলোগুলো যেন মেছোবাজারের গুন্ডা। ভয় দেখিয়ে, চোখ রাঙিয়ে নিরীহ রাত্রিকে দূরে সরিয়ে রেখেছে, ঘরে ঢুকতে দেয়নি।

সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে দেখলাম কার্পেটের উপর প্রতি পদক্ষেপে হোটেলের নাম লেখা। কাঠের রেলিংটা এত মসৃণ যে ধরতে গিয়ে হাত পিছলে গেল। সিঁড়ির ঠিক বাঁকের মুখে একটা প্রবীণ দাদামশায় ঘড়ি আপন মনে দুলে এই হোটেলের প্রাচীন আভিজাত্যের সংবাদ ঘোষণা করছে।

অতিথিরা লিফটে সাধারণত ওঠা-উঠি করেন। দু-একজন ক্রীড়াচ্ছলে সঙ্গিনীর হাত ধরে নৃত্যের তালে সিঁড়ি দিয়ে দ্রুতবেগে উপরে উঠে যাচ্ছেন। একবার ধাক্কা খেতে খেতে কোনোরকমে বেঁচে গেলাম।

রিসেপশন কাউন্টারে বেশ ভিড়। সত্যসুন্দর বোস তখনও কাজ করছেন। টেলিফোনটা প্রায় প্রতিমুহূর্তেই বেজে উঠছে। লাউঞ্জের সব চেয়ার এবং সোফাগুলো বোঝাই।

আমাকে দেখতে পেয়ে ওরই মধ্যে একটু চাপা গলায় বোস বললেন, সারাদিন ম্যানেজারের আপিসেই পড়ে রইলেন?

বললাম, প্রথম দিন, অনেক কাজ ছিল।

মিস্টার বোস কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু পোর্টারের মাথায় মাল চাপিয়ে একদল নতুন যাত্রী কাউন্টারের সামনে এসে হাজির হলেন।

আচ্ছা, পরে কথা হবে, বলে বিদায় নিলাম।

দরজার সামনে মেডেল-পরা দারোয়ানজি তখন দ্রুতবেগে একের পর এক সেলাম উপটৌকন দিয়ে চলেছেন।

গাড়ি-বারান্দার সামনে একটা সুদৃশ্য বাস দাঁড়িয়ে রয়েছে। হলিউডে তৈরি ইংরিজি ছবিতেই এমন বাস দেখেছি। আমাদের এই বুড়ি কলকাতাতেও যে এমন জিনিস আছে, তা জানা ছিল না। কলকাতার বাসদের মধ্যে কোনোদিন যদি সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা হয়, তাহলে এই বাসটাই যে মিস ক্যালকাটা হবে তা জোর করে বলতে পারি। পোর্টাররা পিছন থেকে মাল নামাচ্ছে। আর বাস-এর সামনের দরজা দিয়ে যাঁরা নেমে আসছেন তারা যে কোনো বিমান প্রতিষ্ঠানের কর্মী, তা দেখলেই বোঝা যায়। মাথার টুপিটা ঠিক করতে করতে পুরুষ এবং মহিলা কর্মীরা ভিতরে ঢুকে যাচ্ছেন। ওঁদের পাশ কাটিয়ে, সেন্ট্রাল এভিন ধরে আমিও হাঁটতে শুরু করলাম।

আমার সামনে চৌরঙ্গী। চৌরঙ্গীর রাত্রি যেন কোনো নৃত্যনিপুণা সুন্দরী। দিন ওখানে রাত্রি। রাত্রি ওখানে দিন। সন্ধ্যার অবগাহন শেষ করে সুসজ্জিতা এবং যৌবনগর্বিতা চৌরঙ্গী এতক্ষণে যেন নাইট ক্লাবের রঙ্গমঞ্চে এসে নামলেন। ওদিকে কার্জন পার্কের অন্ধকারে কারা যেন দেশনায়ক সুরেন্দ্রনাথকে বন্দি করে বেঁধে রেখে গিয়েছে। এই দুষ্টের দল জাতীয়তার জনককে যেন তার প্রিয় কন্যার নির্লজ্জ নগ্নরূপ না দেখিয়ে ছাড়বে না। বৃদ্ধ দেশনায়ক অপমানিত বন্দি দেহটাকে নিয়ে অসহায় ভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ঘৃণায় এবং অবজ্ঞায় আর কিছু না পেরে শুধু মুখটা কোনোরকমে দক্ষিণ দিকের অন্ধকারে ফিরিয়ে নিয়েছেন।

হাঁটতে হাঁটতে কার্জন পার্কের পশ্চিমতম প্রান্তে স্যর হরিরাম গোয়েঙ্কার কাছে এসে দাঁড়ালাম। স্যর হরিরাম এখনও সেই ভাবে রাজভবনের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন। যেন প্রশ্ন করছেন, বণিকের মানদণ্ড কি সত্যই রাজদণ্ড থেকে দুর্বল?

ইতিহাসের এই অভিশপ্ত শহরে শত শত বৎসর ধরে কত বিচিত্র মানুষের পদধূলি পড়েছে। নিঃস্ব হয়ে বিশ্বে এসে তাদের কতজনই তো অফুরন্ত বৈভবের অধিকারী হলেন। তাদের রক্ত বিভিন্ন, ভাষা বিভিন্ন, পোশাক বিভিন্ন কিন্তু লক্ষ্য একই। আর মহাকাল যেন বিশ্বকর্পোরেশনের হেড ঝাড়ুদার, ঝাঁটা দিয়ে খ্যাত-অখ্যাত, ধনী-দরিদ্র, দেশি-বিদেশি সবাইকে মাঝে মাঝে সাফ করে বিস্মৃতির ডাস্টবিনে ফেলে দিচ্ছেন। শুধু দুএকজন সেই ঝটাকে ফাঁকি দিয়ে কোনোরকমে বেঁচে রয়েছেন। এই মৃত্যুমুখর ভাগীরথী-তীরে কয়েকজনের প্রস্তরীভূত দেহ তাই আজও টিকে রয়েছে। সেই মৃত শহরের মৃত নাগরিকদের অন্যতম স্যর হরিরাম গোয়েঙ্কাকে নমস্কার করে বললাম, কাল আপনি আমাকে যে অবস্থায় দেখেছেন, আজ আমার সে অবস্থা নেই। আমি কাজ করছি। শাজাহান হোটেলে। আপনি যখন বেঁচেছিলেন, এই শহরের বাণিজ্য সাম্রাজ্য যখন পরিচালনা করছিলেন, তখনও শাজাহান হোটেলের রাত্তিরটা দিনের মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠত। আপনি নিজেও নিশ্চয় সেখানে অনেকবার গিয়েছিলেন।

হঠাৎ নিজেই হেসে উঠলাম। পাগলের মতো কীসব বকছি? স্যর হরিরাম সম্বন্ধে আমি কতটুকু জানি? হয়তো তিনি গোঁড়া ধর্মভীরু লোক ছিলেন, হোটেলের ধারে কাছেও যেতেন না কখনও। তারপর নিজের ছেলেমানুষিতে নিজে আরও অবাক হয়ে গেলাম। মনে পড়ে গেল, ক্লাইভ স্ট্রিটের এক দারোয়ানজি নিজের অজ্ঞাতে পৃথিবীতে এত লোক থাকতে স্যর হরিরাম গোয়েঙ্কার সঙ্গে আমাকে আত্মীয়তাসূত্রে আবদ্ধ করে দিয়েছেন।

দূরে হোয়াইটওয়ে লাডলোর বাড়ির ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম। রাত্রি অনেক হয়েছে। বাড়ি ফেরা দরকার। বাড়ি ফিরতে এখন আমার সঙ্কোচ কী? আমার বাড়ি আছে, আমার আপনজন আছে এবং সবচেয়ে বড় কথা আমার এখন একটা চাকরি আছে।

সকল অধ্যায়

১. ০১. ওরা বলে এসপ্ল্যানেড, আমরা বলি চৌরঙ্গী
২. ০২. আমার নবজন্ম হল
৩. ০৩. পৃথিবীর এই সরাইখানায়
৪. ০৪. এবার রিসেপশনিস্টের গল্প
৫. ০৫. সাদারল্যান্ড সায়েবের অনুগ্রহে
৬. ০৬. আমার মুখের উপর রোজির দরজা বন্ধ
৭. ০৭. ক্রিকেটে যেমন টেস্ট
৮. ০৮. সম্মানিত অতিথিকে স্বাগত
৯. ০৯. ঘুরতে ঘুরতে যখন আবার হোটেলে
১০. ১০. গন্ধ পাচ্ছি
১১. ১১. ব্যাপারটা যে আর চাপা নেই
১২. ১২. কনি চলে যাওয়ার পর
১৩. ১৩. পুরনো দিনের স্মৃতিরা
১৪. ১৪. নিজেকে খুব স্বার্থপর মনে হয়
১৫. ১৫. ভোর হয়েছে
১৬. ১৬. আজ যদি কেউ আমাকে প্রশ্ন করে
১৭. ১৭. যেদিন প্রভাতে পরম বিস্ময়ে
১৮. ১৮. কোনো কর্মহীন অলস অপরাহ্নে
১৯. ১৯. সান্টাক্রুজ থেকে বোসদার প্রথম চিঠি

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন