মারিয়ানা মারিয়ানা

সৈকত মুখোপাধ্যায়

মারিয়ানা মারিয়ানা

এক

এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে চলে আসা নিষেধ তো একটা ছিলই। তার চেয়েও বেশি ছিল ভয়। আড়াইশো—বছর ধরে ভারতের পশ্চিম সীমান্ত ঘেঁষা এই ইয়েলমিং পার্বত্য এলাকার বহু মানুষ সেই নিষেধ এবং ভয়কে মান্যতা দিয়ে এসেছে।

ইয়েলমিং পাহাড়ের পশ্চিমদিকের ঢালে, বেদিয়ানা—উপজাতিদের সমাধিক্ষেত্রের গায়েই যে এক নিষিদ্ধ বাগান রয়েছে, সে কথা জানত অনেকেই। কিন্তু বেদিয়ানাদের মধ্যে যারা বংশপরম্পরায় গুণীন, তারা ছাড়া আর কেউ কখনো সেই বাগানের ভেতরে পা রাখেনি। বাইরের লোক তো দূরের কথা, বেদিয়ানা উপজাতির কোনো সদস্যও ওই নিষিদ্ধ বাগানের ভেতরে ঢোকার কথা ভাবতে পারত না। কে চায় বেঘোরে প্রাণ হারাতে?

আড়াইশো—বছরের মধ্যে এই প্রথম কোনো বাইরের লোক সেই বাগানের ভেতরে পা ফেলল। সরিয়ে দিল কুখ্যাত ডাইনি আদিসা তিমুরা আর তার মেয়ে মারিয়ানা দিমাগখোরের সমাধিগহ্বরের মুখের পাথর। সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়ে গেল এক নারকীয় ঘটনাক্রম। আড়াইশো—বছর পরে, এই গত এপ্রিল—মে মাসে, ইয়েলমিং—এর গ্রামে গ্রামে, রাস্তায় রাস্তায় এক অবিশ্বাস্য ব্ল্যাক—ম্যাজিকের ছায়া মানুষের প্রাণ নিয়ে ছিনিমিনি খেলা করে বেড়াল।

দু—মাস ধরে পুরো পাহাড়টায় যেন কারফিউ লেগে গিয়েছিল। লোকজন নিতান্ত নাচার না হলে বাড়ি থেকে বেরোচ্ছিল না। খেতের ফসল খেতেই শুকিয়ে যাচ্ছিল। পোষা গোরু—ছাগল আর শুয়োরগুলোকে চরানোর মতন কেউ ছিল না বলে সেগুলো এক—এক করে জঙ্গলের মধ্যে হারিয়ে যেতে শুরু করল। হারানো সেই জন্তুগুলোর মধ্যে সবকটা এখনো গোয়ালে ফেরেনি। ধরেই নেওয়া যায় বাঘ কিংবা বুনো কুকুরের পেটেই গিয়েছে সেগুলো।

কিন্তু কী—ই বা করতে পারত ইয়েলমিং—এর বাসিন্দা সেই বেদিয়ানা এবং অন্যান্য নানান আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষজন? তারা পাহাড়ি—গ্রামের পরিশ্রমী মানুষ। জঙ্গলের মধ্যে সাপের সঙ্গে, বাঘের সঙ্গে লড়াই করে তারা বড় হয়। মৃত্যুকে তারা প্রতিদিন খুব কাছ থেকে দেখে বলেই তাদের মনের মধ্যে মৃত্যুভয় কম। কিন্তু তবু তারা আদিসা তিমুরার মেয়ে মারিয়ানা দিমাগখোরের হাতে মরতে ভয় পেয়েছে। কারণ তারা জানে, সে মরণ বড় বীভৎস মরণ!

আদিসা তিমুরা আর তার মেয়ে মারিয়ানা দিমাগখোরকে নিয়ে অনেক ভয়ের গল্প এখানকার আদিবাসী গাঁওবুড়োদের মুখে মুখে ফেরে। সেসব গল্প থেকে মোদ্দাকথা যা বেরিয়ে আসে তা হল এই—

সতেরোশো—ষাট থেকে সতেরোশো—পঁচাত্তর এই পনেরো বছর ধরে ডাইনিরানি আদিসা তিমুরা ইয়েলমিং পার্বত্য এলাকায় রাজত্ব করেছিল। আদিসা নিজে কিন্তু বেদিয়ানা জাতির মেয়ে ছিল না; ছিল ভালকি নামে অন্য এক উপজাতি গোষ্ঠির সদস্য। সেইজন্যেই আদিসার মৃত্যুর পরে বেদিয়ানাদের মূল সমাধিক্ষেত্রের বাইরে নিষিদ্ধ বাগানে তার আর তার মেয়ের সমাধির ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

ওই সতেরোশো—ষাট কি তার কয়েকবছর আগে, জমির দখল নিয়ে বেদিয়ানাদের সঙ্গে ভালকিদের এক রক্তক্ষয়ী লড়াই হয়। সেই লড়াইয়ে ভালকিরা প্রায় ঝাড়েবংশে শেষ হয়ে যায়। ভালকিদের ছেলে বুড়ো মেয়ে বাচ্চা—বেদিয়ানা সেনাদের সামনে যে পড়েছিল—সেইই কুঠারের কোপে মুন্ডুটা খুইয়েছিল। অল্প যে কয়েকজন পালিয়ে বাঁচতে পেরেছিল, তাদের মধ্যে ছিল ভালকি গুণীনের আঠেরো বছরের মেয়ে আদিসা।

আদিসা কেমন করে বেঁচেছিল, সেও এক অদ্ভুত কাহিনি।

এই যে ইয়েলমিং পাহাড়, সকলেই জানে এই পাহাড়ে বহু অপদেবতার বাস। অপদেবতারা ঠিক দেবতাদের মতন ধরাছোঁয়ার বাইরের জীব নয়। তারা থাকে পাহাড়ের গুহা, গাছের কোটর কিংবা মাটির নীচের গর্তের মতন অন্ধকার দুর্গন্ধময় জায়গায়। অপদেবতারা মানুষকে সহ্য করতে পারে না; তারা মানুষকে নষ্ট করতে চায়। নষ্ট করতে চায় রোগ—বালাই দিয়ে, বন্যা মহামারি দিয়ে, খিদে দিয়ে, যুদ্ধ দিয়ে। তারা বীভৎস, তারা হিংস্র, মহাজাগতিক কালো—শক্তির অধিকারী—তবু তারা রক্তমাংসের জীব। হ্যাঁ, জীব। দেবতাদের মতন অলীক কিছু নয়। সেইজন্যেই বিশেষ কিছু পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়। মানে যেত।

আড়াইশো বছর আগে আদিবাসী গুণীনদের মধ্যে অনেকেই বিশেষ বিশেষ অপদেবতার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারত। এখনকার গুণীদের মধ্যে থেকে সেই বিদ্যেটা হারিয়ে গেছে।

এরকমই এক অপদেবতা ছিল তিমুরা। তিমুরার লোভ ছিল মানুষের মেয়ের প্রতি। সে চাইত কোনো মানুষের মেয়েকে বিয়ে করতে। তাহলে তার মানুষের মতন সন্তান হবে। সেই সন্তান—সন্ততি, তারপর তাদেরও সন্তান—সন্ততি…এইভাবে তিমুরার বংশধরেরা সংখ্যায় বাড়বে। তারা আস্তে আস্তে পৃথিবী থেকে মানুষদের হটিয়ে দিয়ে পৃথিবী দখল করে নেবে। এই ছিল অপদেবতা তিমুরার স্বপ্ন।

যখনকার কথা বলছি তখন অবধি তিমুরার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গিয়েছিল। কোন বাপ—মা চাইবে কালো বেড়ালের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে?

হ্যাঁ, বীভৎস এক চোখ—কানা কালো বেড়ালের মতন দেখতে ছিল অপদেবতা তিমুরাকে। সে ছিল উন্মাদ রোগের অপদেবতা। আদিবাসীদের মধ্যে কেউ পাগল হয়ে গেলে তাকে সারিয়ে তোলার আশায় গুণীনেরা তিমুরার পুজো দিত। তিমুরা খুশি হলে সেই পাগল ভালো হয়ে যেত। না হলে যেমনকার তেমন। এই অপদেবতা তিমুরার খুব কাছের লোক ছিল তখনকার ভালকি—গুণীন, যে ছিল আবার আদিসার বাবা। সেই গুণীন যখন বুঝতে পারল, বিষপিঁপড়ের মতন দল বেঁধে এগিয়ে আসা বেদিয়ানা সৈন্যদের হাত থেকে তাদের কারুর রক্ষা নেই, তখন সে নিজের মেয়ে আদিসাকে তুলে দিল চোখ—কানা কালো বেড়ালের হাতে। ভাবল, বংশের অন্তত একজন তো বাঁচুক।

গুণীন বাপের এই সিদ্ধান্তের ফলে বেদিয়ানা সৈন্যরা সেদিন আদিসাকে ছুঁতেই পারেনি। এখনো ইয়েলমিং পাহাড়ের চুড়োর একটু নীচে রয়েছে কালিপুখরি, যার জলের রং কলমের কালির মতন কালো। সেদিন তিমুরার জাদুতে আদিসা নাকি ওই কালিপুখরির কালো জলের মধ্যে জল হয়ে মিশে গিয়েছিল।

যুদ্ধের দামামা থেমে যেতেই কালিপুখরি থেকে তিমুরার হাত ধরে উঠে এল আদিসা। সে হয়ে গেল আদিসা তিমুরা—তিমুরার স্ত্রী আদিসা—স্বামীর কাছ থেকে যে মেয়ে ডাইনিবিদ্যার সমস্ত মারণ উচাটন বশীকরণের শিক্ষা পেয়েছিল।

অপদেবতা তিমুরা কিন্তু তারপর আদিসার সঙ্গে আর বেশিদিন রইল না। ওদের একটা মেয়ে হওয়ার পরেই তিমুরা ফিরে গেল অজানা কোনো গাছের কোটরে কিংবা পাহাড়ের ফাটলে। একা আদিসা প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যে রয়ে গেল বেদিয়ানা গ্রামের শিয়রে, ওই ইয়েলমিং—এর চূড়ায়। প্রথমে ওই পাহাড়চূড়ায় দুর্গের মতন এক প্রাসাদ বানাল আদিসা। তারপর সেই প্রাসাদের বারান্দা থেকে নীচের বেদিয়ানা—গ্রামে ছড়িয়ে দিল তার বিষের ধোঁয়ার মতন কালা জাদু।

সেই প্রাসাদ বানানো নিয়েও গল্প আছে।

গাঁওবুড়োরা বলে, আজ যেখানে পাহাড়চূড়ায় উঠবার পাকদণ্ডী পাথর—বাঁধানো রাস্তা, আড়াইশো বছর আগে সেখানে ছিল ঘন জঙ্গল, হাঁটু অবধি চিটচিটে কাদা, অজস্র পাগলাঝোরা, চোরাবালি আর ঝাঁকে ঝাঁকে এমন এক বিষাক্ত পোকা যার কামড়ে মানুস অন্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ত।

তাহলে? ওই পথ ধরে একদল সাধারণ মজুরের পক্ষে কি প্রাসাদ বানানোর মালপত্র ওপরে নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল? পাথরের ইঁট, কাঠের বিম, লোহা, কাচ—এত জিনিস ওই দুর্গম পাহাড়চূড়ায় উঠেছিল কেমন করে?

গাঁওবুড়োদের কথা যদি বিশ্বাস করতে হয়, তাহলে বলতে হয়, কোনো জীবন্ত শ্রমিকের হাতে আদিসার ওই প্রাসাদ গড়ে ওঠেনি। যতদিন ধরে আদিসার প্রাসাদ গড়ে উঠেছিল, ততদিন রাত হলেই বেদিয়ানাদের সমাধিক্ষেত্রের কবরগুলোর মুখ যেত খুলে। মৃতেরা কবর ছেড়ে উঠে আসত আর তারাই কাঁধে করে পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছে দিত যাবতীয় ইমারতি মালমশলা। মৃত শ্রমিকদের হাতেই গড়ে উঠেছিল ডাইনিরানি আদিসা তিমুরার প্রাসাদ।

ওই প্রাসাদ থেকেই পরের পনেরো—বছর আদিসা তিমুরা আর তার মেয়ে মারিয়ানা দিমাগখোর তাদের সন্ত্রাসের রাজত্ব চালিয়েছিল।

আড়াইশো বছর আগে ইয়েলমিং পাহাড়ের গ্রামগুলোয় যারা বাস করত, তারা আদিসা আর তার মেয়ের ভয়ে ক্রীতদাসের মতন জীবন কাটাতো। ডাইনির ক্রীতদাস। জঙ্গলের মধ্যে যতটা চাষযোগ্য জমি ছিল, তার বারো আনাই আদিসা তিমুরা হাত করে নিয়েছিল। আদিবাসীরা মারণ—উচাটনের ভয়ে মুখ বুজে তার জমিতে ফসল বুনে দিত, ফসল কেটে দিত। ইয়েলমিং—অরণ্যের শালকাঠ আজও যেমন দামি, তিনশো বছর আগেও সেরকমই মূল্যবান ছিল। ওই কাঠের ব্যবসার সবটাই কবজা করে নিয়েছিল আদিসা তিমুরা। জঙ্গলের গাছ কেটে, নীচে সাহেবদের কাঠের ডিপোয় পৌঁছিয়ে দিয়ে আসার হাড়ভাঙা পরিশ্রমটাও আদিবাসীরা মুখ বুজে করে দিত।

মাঝেমাঝে কি আর দু—একজন মুখ খুলত না? খুলত। অত্যাচার অসহ্য হয়ে উঠলে আদিসার সামনে দাঁড়িয়ে কেউ কেউ বলত, এ সব কাজ আমার দ্বারা আর হবে না। আমি নিজের জমি চষবো কখন? কখনই বা পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাবো?

যারা এমন কিছু বলার বা করার স্পর্ধা দেখাত, তারা অবধারিতভাবে তিন রাত্তিরের মধ্যে নিজেদের ঘরের ভেতরে দেখতে পেত মারিয়ানা দিমাগখোরকে। তারপর এমন বীভৎসভাবে মরত সেই প্রতিবাদী মানুষটি যে, অন্যদের মনের মধ্যে থেকে প্রতিবাদের চিন্তা অনেকদিনের জন্যে হাওয়া হয়ে যেত। নিশ্চিন্তে রাজত্ব চালাত আদিসা তিমুরা।

দুই

এখনো পাহাড়চূড়ায় আদিসার সেই বিশাল কাঠের দুর্গের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়। আর, কয়েকমাস আগেও নিষিদ্ধ বাগানের এক দুর্গম কোণে পৌঁছতে পারলে দেখা যেত পাহাড়ের গায়ে একখণ্ড বিশাল পাথর দিয়ে চেপে বন্ধ করা একটা ছোট গুহা। এখন পাথরটা আর নেই।

সেই পাথরের কপাটের ওপরে সিঁদুর আর কাজল দিয়ে বহু মন্ত্র লেখা ছিল। কপাটের এদিক থেকে ওদিকে টানা দিয়ে বাঁধা ছিল সারিসারি বুনো আদার মালা, বাদুড়ের খুলি আর মন্ত্র লেখা পতাকা। সবকটা আদিবাসী সম্প্রদায়ের গুণীনেরা মিলে বছরের একটা বিশেষ দিনে একবছরের পুরোনো মালাগুলো পালটে দিয়ে, পাথরের কপাটের ওপরে নতুন করে সিঁদুর—কাজলের অক্ষরে মন্ত্র লিখে দিয়ে যেত।

বছরের পর বছর তারা এই কাজটা করে এসেছে—ভক্তিতে নয়, ভয়ে।

আদিসার কাছ থেকে তাদের আর কোনো ভয় ছিল না, কারণ আদিসা মানুষের মেয়ে এবং মৃত। তাকে কেউ বিশেষ ডাইনিমন্ত্র দিয়ে বাঁচিয়ে না তুললে সে আর বাঁচবে না। কিন্তু ওই একই সমাধিগুহায় যে আদিসা আর তিমুরার সন্তান মারিয়ানার দেহও রয়ে গেছে। মারিয়ানা তো পুরোপুরি মানুষ নয়। সে তো অর্ধেক অপদেবতাও বটে।

সকলেই জানত, মুখের ওপর মানুষের ঘৃণার দৃষ্টি পড়লেই মারিয়ানা জেগে উঠবে। কোনো মন্ত্রতন্ত্র কিছুই লাগবে না। সেইজন্যেই এত সাবধানতা। তবু শেষরক্ষা করা গেল না। গত এপ্রিল মাসে একজন বাইরের লোক নিষিদ্ধ বাগানে ঢুকে পাথরের কপাট ঠেলে সরিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল।

এই হঠকারিতা যে করল, সে ইয়েলমিং—এর লোক নয়। একজন শহুরে জালিয়াত। নাম তার কেশব হাজরিকা, বাড়ি গুয়াহাটি। কেশব এর আগে দু—বার অসম পুলিশের হাতে অ্যান্টিক চুরির অভিযোগে ধরা পড়েও যথেষ্ট প্রমাণের অভাবে ছাড়া পেয়ে গিয়েছিল।

এমনিতে বেদিয়ানা উপজাতির লোক ছাড়া অন্য কাউকে ইয়েলমিং পাহাড়ের পশ্চিমদিকটায় যাবার অনুমতিই দেয় না জেলা প্রশাসন। ওদিকে যেতে হলে একমাত্র একটা রাস্তা দিয়েই যাওয়া যায়—হাফলং যাবার পিচ রাস্তা থেকে বেরিয়ে সেই পাথরে বাঁধানো পথটা ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এঁকেবেঁকে কুয়াশায় ঢাকা চূড়ার দিকে উঠে গেছে। সে রাস্তায় গাড়ি চলে না। পায়ে হেঁটে উঠতে হয়। বাইরের লোককে আটকানোর জন্যে সেই রাস্তার মুখেই একটা পুলিশের চেকপোস্ট ছিল।

কিন্তু ওই চেকপোস্টের ভারপ্রাপ্ত অফিসার যখন দেখেছিলেন, ‘গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্বের অধ্যাপক’ কেশব হাজরিকার ইনার—লাইন—পারমিটের ওপরে খোদ ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের সই—ছাপ্পা সমেত পারমিশন জ্বলজ্বল করছে, তখন তিনি আর তাকে আটকানোর সাহস দেখাননি। তবে ছেড়ে দেওয়ার আগে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ কি আর করেননি? করেছিলেন। পরে এনকোয়ারি—কমিশনের সামনে চেকপোস্টের ওই তরুণ অফিসার হলফ করে বলেছিলেন, লোকটা যদি জালিয়াতও হয়, তাহলেও মানতে হবে বেদিয়ানাদের ইতিহাস সে গুলে খেয়ে তবেই কবর চুরি করতে এসেছিল। কারণ, ওই অফিসারের প্রশ্নের উত্তরে কেশব হাজরিকা আদিসা তিমুরার সম্বন্ধে যত গল্পগাথা রয়েছে সবই গড়গড় করে বলে গিয়েছিল।

তদন্তকারী অফিসারদের কোনো সন্দেহ নেই যে, কেশব আসলে আদিসার কবরের মধ্যে পড়ে থাকা বিপুল ঐশ্বর্যের লোভেই ওখানে ঢুকেছিল। যেহেতু বাইরের লোক, তাই কেশবের মনের মধ্যে আদিসা বা তার মেয়ের অলৌকিক ক্ষমতা সম্বন্ধে কোনো বিশ্বাস ছিল না। সে নির্ভয়ে ঢুকে পড়েছিল সমাধিগুহার মধ্যে।

তাকে খেয়েই মারিয়ানা দিমাগখোর তার আড়াইশো বছরের উপোস ভেঙেছিল। তারপর গা ঝাড়া দিয়ে সমাধিগুহা ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল বাইরের দুনিয়ায়—আরো নতুন খাদ্যের সন্ধানে।

মারিয়ানার সেই মুক্তির রাতটা ছিল নিকষ অন্ধকার; তার ওপরে বৃষ্টিও পড়ছিল মুষলধারে। তাই মারিয়ানার জেগে ওঠা আর বেরিয়ে পড়ার ঘটনা কেউ দেখতে পায়নি, এমনকি সমাধিক্ষেত্রের পাহারাদার নিশিত ইয়েলমোও না।

বেদিয়ানা গ্রামের শেষ গুণীনের নাম মহিসোনা টোপ্পো। বয়স পঁচাত্তর বছর। গ্রামের একেবারে উত্তরপ্রান্তে টোপ্পোদের বিশাল বাগানঘেরা বাড়ি। সেই বাড়ির বয়স আর আদিসার দুর্গের বয়স প্রায় কাছাকাছি। তফাৎ শুধু এই যে, টোপ্পোদের বাড়ি কখনো ফাঁকা পড়ে থাকেনি। নিয়মিত সারাই—সোরাই হয়েছে। নতুন নতুন অংশ যোগ হয়েছে, আবার পুরোনো অংশ ভেঙে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। বাড়িটা তাই এখনো বয়সের তুলনায় বেশ ভালো অবস্থাতেই রয়েছে। পাহাড়চূড়ার দুর্গের মতন খণ্ডহর হয়ে যায়নি।

এই যে গুণীন পরিবারের বাড়ি আর ডাইনির দুর্গের বয়স কাছাকাছি—এর পেছনের কারণটা বুঝতে পারা খুব একটা কঠিন নয়। গুণীন আর ডাইনি একই মুদ্রার এপিঠ—ওপিঠ। ডাইনির জন্যেই গুণীনের প্রয়োজন। ডাইনিরা ছিল বলেই গুণীনদের এত প্রতিপত্তি, এত সম্মান, এত সম্পত্তি। অপদেবতাদের সঙ্গে যোগাযোগ যেমন ডাইনিদের ছিল, তেমনই ছিল গুণীনদের। শুধু ডাইনিরা সেই যোগাযোগ কাজে লাগাত মানুষের অনিষ্ট করতে, আর গুণীনরা চাইত মানুষের ভালো। সব মানুষের না হোক, তার নিজের জাতের লোকেদের।

আদিবাসীদের অসুখে—বিসুখে গুণীনরাই ছিল ডাক্তার। তাদের বিয়েচুড়ো শ্রাদ্ধে পুরোহিত। ডাইনির হাত থেকে গুণীনরাই রক্ষা করত তাদের জাতের লোকেদের।

পাঁচ বছর আগে এই টোপ্পো পরিবারে যেন অভিশাপ নেমে আসে। কি এক অজানা অসুখে তাঁর একমাত্র ছেলে আর ছেলের বউ দুজনেই মারা যায়। মহিসোনার স্ত্রী অনেক আগেই মারা গিয়েছিলেন। কাজেই এখন এই বিরাট বাড়িতে থাকে শুধু দুটি প্রাণী—টোপ্পো বংশের শেষ দুই জীবিত সদস্য। একজন মহিসোনা টোপ্পো আর অন্যজন তার নাতি বিকুল।

এপ্রিল মাসের সেই ঝড়বৃষ্টির রাতটায় মহিসোনা একটু সকাল সকালই শুয়ে পড়েছিলেন, কারণ, তাঁর শরীরটা ভালো ছিল না। বাড়ির দোতলায় সার সার ঘরের মধ্যে সবকটাই প্রায় ফাঁকা। শুধু মাঝামাঝি জায়গায় সবচেয়ে বড় ঘরটাকে মহিসোনা রাতে শোবার ঘর হিসেবে ব্যবহার করেন। ওই ঘরের ঠিক পাশের ঘরটায় থাকে মহিসোনার নাতি বিকুল। বিকুলের কথা পরে বলব। এখন সেই রাতটার কথা বলে শেষ করি।

মহিসোনা সেই রাতে অনেকক্ষণ অবধি জেগে ছিলেন। হয়তো ঘন ঘন বিদ্যুতের ঝলসানি আর বাজ পড়ার শব্দেই তাঁর ঘুম আসছিল না। কিন্তু সেটা স্বাভাবিক নয়। ইয়েলমিং পাহাড়ে প্রায় সারাবছরই বৃষ্টি হয়, সারাবছরই বাজ পড়ে। নাহলে বরফ। এখানকার লোকের ঘুম তাই বাজের শব্দে ভাঙে না।

মহিসোনা অন্ধকার ঘরে বিছানায় পাশ ফিরে শুয়ে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়েছিলেন। অনেক দূরে ইয়েলমিং পাহাড়ের চূড়া দেখা যাচ্ছিল। ঘন অন্ধকারের মধ্যে আরো ঘন এক জমাট অন্ধকারের মতন দাঁড়িয়েছিল পাহাড়ের চুড়োটা। বিদ্যুৎ চমকালে এক মুহূর্তের জন্যে পরিষ্কার হয়ে উঠছিল চুড়োটার গায়ে লেপটে থাকা ঘন বনের কালো চাদর। তারপরেই সবকিছু আবার ডুবে যাচ্ছিল অন্ধকারে।

না, সবকিছু নয়। ডাইনির দুর্গটাকে দেখতে পাচ্ছিলেন মহিসোনা। এতদূর থেকে দুর্গটাকে ঠিক একটা পুতুলের বাড়ির মতন দেখতে লাগছিল। ওই দুর্গটাই মহিসোনাকে জাগিয়ে রেখেছিল। তিনি কিছুতেই বুঝতে পারছিলেন না, এই ঘন অন্ধকারের মধ্যেও দুর্গটাকে তিনি কেমন করে দেখতে পাচ্ছেন। কেন দুর্গটা আজ অমন ফসফরাসের মতন হালকা সবুজ আভায় জ্বলছে।

সত্যিই জ্বলছে? নাকি তাঁর মনের ভুল?

নিজের কাছে নিজের মনের চিন্তা লুকিয়ে রাখা যায় না। বৃদ্ধ গুণীন মহিসোনা বুঝতে পারছিলেন, তিনি ভয় পাচ্ছেন। মৃত্যুভয়।

আড়াইশো বছর আগে তাঁরই এক পূর্বপুরুষ শেষ অবধি মারিয়ানা দিমাগখোরকে বশে আনতে পেরেছিলেন। কোনো অপদেবীকে হত্যা তো করা যায় না, বড়জোর তার কালাজাদুকে বিকল করে ফেলা যায়। সেইটুকুই যথেষ্ট ছিল। মারিয়ানা তার ক্ষমতা হারাতেই তার মা আদিসাও অসহায় হয়ে পড়েছিল। তখন গ্রামের লোকেরা দুর্গে আগুন ধরিয়ে আদিসাকে মেরে ফেলেছিল। এখনো টোপ্পোবাড়ির পুঁথিঘরে মহিসোনার সেই পূর্বপুরুষের নিজের হাতে লেখা একটা পুঁথি রয়েছে, যার হলুদ পাতায় লেখা আছে আদিসা—বধের বিবরণ। লেখা রয়েছে কেমন করে, কোন বুদ্ধিতে জব্দ করা গিয়েছিল মারিয়ানা দিমাগখোরকে।

লেখা রয়েছে আরো একটা ভয়ঙ্কর কথা।

মারিয়ানা নিস্তেজ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ার আগে নাকি একটা শপথ করে গিয়েছিল। কোনোদিন যদি সে সমাধিগুহার কবর থেকে আবার মাটির ওপরে উঠে আসতে পারে, তাহলে তার প্রথম কাজ হবে টোপ্পো বংশকে ধ্বংস করা। মহিসোনা জানেন, সেই কাজটা এখন খুব সহজ। মাত্র দুটি প্রাণ কেড়ে নিতে পারলেই হল—তাঁর আর বিকুলের।

মহিসোনার ষষ্ঠেন্দ্রিয় সেই রাতে তাঁকে বলছিল, প্রতিশোধের শপথ রক্ষা করার জন্যে মারিয়ানা বেরিয়ে পড়েছে।

কাঠের জানলার গায়ে নখের আঁচড়ের মতন একটা হালকা শব্দে বিছানায় উঠে বসলেন মহিসোনা। পাশের ঘর থেকেই যেন শব্দটা ভেসে এল। মহিসোনা মাথার কাছে খুলে রাখা শালটা জড়িয়ে খুব সাবধানে বিছানা ছেড়ে দালানে বেরিয়ে এলেন।

সারারাত তুমুল বর্ষণের পরে তখন ভোরের দিকে বৃষ্টিটা একটু ধরেছিল। পুব আকাশে ছানার জলের মতন অল্প একটু আলো ফুটেছিল। বাড়ির সামনের বটগাছটার ডালে বসে ভিজে ডানা থেকে জল ঝাড়তে ঝাড়তে ক্লান্ত গলায় কঃ কঃ শব্দ করে ডাকছিল কয়েকটা কাক। মহিসোনা খুব সাবধানে বিকুলের ঘরের ভেজানো দরজাটা খুলে ঘরে ঢুকেই দেখলেন, বিকুলের বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে মারিয়ানা দিমাগখোর।

মারিয়ানার পিঠটা ছিল দরজার দিকে। বিছানার পায়ের দিকে দাঁড়িয়ে ও একদৃষ্টিতে তাকিয়েছিল ঘুমন্ত বিকুলের মুখের দিকে। মহিসোনা যে ঘরে ঢুকেছেন সেটা মারিয়ানা তখনো বুঝতে পারেনি।

মহিসোনাও চট করে একবার দেখে নিলেন ঘুমন্ত বিকুলকে। বুঝতে পারলেন তার নাতির ঘুম পাতলা হয়ে আসছে। বিকুল গা মোচড়াচ্ছিল। একটা কষ্টের শব্দ করছিল মুখ দিয়ে, দুঃস্বপ্ন দেখলে মানুষ যেমন ঘুমের মধ্যে কাতরে ওঠে, সেইরকম। তাঁর মানে যে কোনো মুহূর্তে বিকুল চোখ খুলতে পারে। চোখ খুললেই ও দেখতে পাবে ঠিক ওর পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা মারিয়ানা দিমাগখোরকে। এবং সেই দেখাই হবে ওর জ্ঞানত শেষ কিছু দেখা। তারপরেই দিমাগখোর ওর ‘দিমাগ’ মানে মগজকে খেয়ে ফেলবে।

টোপ্পো পরিবারের কনিষ্ঠ সদস্যটি অপঘাতে মারা যাবে।

না, সেটা হতে দেওয়া যায় না। মহিসোনা খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন। মুখে কোনো শব্দ না করে হাতের চাপড়ে একটা আলতো আওয়াজ করলেন, যাতে বিকুল না জেগে যায়। সেই আলতো শব্দেই মারিয়ানা দিমাগখোরের মাথার দু—পাশে তিনকোনা কানদুটো খাড়া হয়ে উঠল। বিদ্যুতের মতন নিঃশব্দ ক্ষিপ্রতায় মারিয়ানা ঘুরে দাঁড়াল মহিসোনার মুখোমুখি।

মহিসোনা এই প্রথম নিজের চোখে দেখলেন সেই মেয়েকে, যার ছবিই শুধু তিনি এতকাল দেখেছেন পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া পুঁথির পাতায়। দেখলেন ছবির থেকেও সুন্দর পনেরো—বছরের সেই কিশোরীর শরীর। তিনি বুঝলেন, গত আড়াইশো বছরে কবরের অন্ধকারে মারিয়ানার শরীরে কোনো বদল ঘটেনি।

মেয়েটার মোমের পুতুলের মতন সরু কোমর, লম্বাটে হাত—পা। গায়ে কোনো পোশাক ছিল না। সারা শরীর ঢাকা ছিল ভেলভেটের মতন নরম কালো লোমে।

মহিসোনা দেখলেন, মারিয়ানার শাঁখের মতন খাঁজকাটা সুন্দর গলার ওপরে এক ধূর্ত বেড়ালের মুখ।

হঠাৎই মারিয়ানার হাতের দশ—আঙুলের ডগা থেকে বেরিয়ে এল লুকিয়ে রাখা দশটা লম্বা কালো নখ। বিড়ালিনি মারিয়ানার দু’চোখের মণি সবুজ হয়ে উঠল, যেমন সবুজ আভায় কাল সারারাত জ্বলেছে তার মায়ের ওই দুর্গ।

মহিসোনা প্রাণপণে নিজেকে বোঝাতে শুরু করলেন—ঘৃণা নয়, ঘৃণা নয়। ওই মেয়ের দিকে শান্তভাবে তাকিয়ে থাকো হে গুণীনশ্রেষ্ঠ মহিসোনা। তোমার পূর্বপুরুষ যেমন একদিন তাকিয়েছিলেন ওই বেড়ালমেয়ের দিকে। ভুলো না, বেড়ালে যেমন এঁটোকাঁটা খায়, দিমাগখোর তেমনি খায় মানুষের ঘৃণা। ভালোবাসা খায় না, শ্রদ্ধা খায় না, গান খায় না, কবিতা খায় না। শুধু ঘৃণা খায়, ঘৃণা খেয়ে বেঁচে থাকে। ঘৃণা—মাখা মগজকে চোখ দিয়ে শুষে নেয় ওই মেয়ে। তখন পড়ে থাকে ফাঁকা করোটি।

মহিসোনা সব জেনেও ঘৃণাকে আটকাতে পারলেন না। কেমন করে পারবেন? একটা সুন্দরী মেয়ের শরীরের ওপর থেকে তাকিয়ে আছে এক ধূর্ত নৃশংস বেড়ালের মুখ—এই দৃশ্য কি কেউ শান্ত মনে দেখতে পারে? বিরাট এক ঘৃণার ঢেউ মহিসোনার সমস্ত প্রতিরোধকে গুঁড়িয়ে ফেলে তাঁর দুই চোখের মণিতে উথলে উঠল আর ঠিক তখনই মারিয়ানা দিমাগখোরের ধারালো শ্বদন্তগুলো ঠোঁটের আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে এল। সে ফ্যাঁশ করে একটা শব্দ করল। মনে হল, কালো বেড়ালটা যেন হেসে উঠল দারুণ খুশিতে।

মহিসোনা বুঝতে পারলেন তাঁর দুই চোখের ভেতর দিয়ে মাথার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে বেড়ালের নখের মতো ধারালো কোনো অদৃশ্য আয়ুধ, যেগুলোকে তিনি দু’হাত দিয়ে টেনেও সরাতে পারছেন না। মাথাটা ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে, ক্রমশ ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। তিনি ভুলে যাচ্ছেন সমস্তকিছু। তলিয়ে যাচ্ছেন গভীর ঘুমে।

একদম শেষ মুহূর্তে মহিসোনা চিৎকার করে উঠলেন—বিকুউউল। বাঁচা আমাকে, বাঁচা! তারপরেই মেঝের ওপরে আছড়ে পড়ল বেদিয়ানাদের শেষ গুণীনের প্রাণহীন শরীর।

দাদুর চিৎকারে লাফ মেরে বিছানার ওপর উঠে বসেছিল বিকুল। ঘুমচোখেই সে দেখেছিল, দাদুর নিথর শরীরটা খোলা দরজার সামনে পড়ে রয়েছে আর ঘরের জানলা দিয়ে বাইরে লাফ মেরে পালাচ্ছে একটা কালো বেড়াল।

পুরো ব্যাপারটা বুঝতে বিকুলের আরো অনেকটা সময় লেগেছিল।

তিন

যখন বিকুলের বয়স মাত্র দশ বছর, তখনই তার বাবা—মা দুজনেই মারা গিয়েছিলেন। এখন বিকুলের বয়স পনেরো। তার মানে গত পাঁচ বছর সে বাবা—মাকে ছাড়াই দিন কাটাচ্ছে।

দাদু মহিসোনা ছিলেন ঠিকই। তিনি খুব ভালোও বাসতেন বিকুলকে। কিন্তু তাঁর ছিল নিজস্ব এক জগত। সেই জগতের সঙ্গে বিকুলের পৃথিবীর দূরত্ব ছিল অনেক।

দাদুর ছিল পুঁথিঘর, যেখানে তিনি অনেক রাত অবধি বসে পড়াশোনা করতেন। দাদুর ছিল বাগানের মধ্যে ধ্যানের আসন। একটু বড় হওয়ার পর থেকেই বিকুল পরিষ্কার বুঝতে পারত, দাদু এই আকাশ ছাড়িয়ে অন্য কোনো আকাশ দেখতে পান, এই মাটির নীচে দেখতে পান অন্য কোনো দুনিয়া। দাদুর আশেপাশে যারা হাওয়ার সঙ্গে হাওয়া হয়ে ঘুরে বেড়ায়, দাদু যাদের সঙ্গে আপনমনে কথা বলেন, তারা কেউই মানুষ নয়।

বিকুলের কোনো বন্ধুও ছিল না। গুণীনের বাড়ির ছেলেকে গ্রামের বাকি বাচ্চারা ভয় পেত। তারা বিকুলকে খেলার মাঠের দিকে এগিয়ে আসতে দেখলে খেলা থামিয়ে শ্রদ্ধায় জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকত।

আত্মীয় ছিল না, বন্ধুও না। তাই বিকুল একা—একা খেলা করতে শিখে নিয়েছিল। সে মাঠেঘাটে, নদীর চরে, জঙ্গলের আনাচে—কানাচে ঘুরে বেড়াত। নিস্তব্ধ দুপুরে বনপথ দিয়ে ছুটে চলা ঝরা পাতাদের সঙ্গে সে দিত দৌড়ের পাল্লা। কোনো ঝোপের আড়ালে ফুটে ওঠা ভুঁইচাপার গন্ধ অনুসরণ করে সেই ফুলটাকে খুঁজে বার করাই ছিল তার লুকোচুরি খেলা। নদীর বুকে পড়ে থাকা বোল্ডারের গায়ে যে জলের আঁকিবুঁকি দাগ, তার মধ্যেই বিকুল খুঁজে পেত গুপ্তধনের সঙ্কেতলিপি।

এইভাবে ঘুরতে ঘুরতেই একদিন বিকুল তার ডাক্তারদাদুকে খুঁজে পেয়েছিল।

আগেই বলেছি, ইয়েলমিং পাহাড়টা দুই দেশের সীমানার ওপরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কোথায় যে এক দেশের শেষ আর কোথায় অন্য দেশের শুরু সেটা এখানকার লোকেরা ঠিক বোঝে না। একই গাছের দক্ষিণের ডাল থেকে যদি ভারতের মাটিতে ফুল ঝরে পড়ে, তাহলে উত্তরের ডালের ফুল ঝরে পড়ে অন্য এক প্রাচীন দেশের মাটিতে। একই নদীর জল দুই পাড়ে দুই দেশের মাটি ছুঁয়ে বয়ে যায়।

বিকুল সেদিন ঘুরতে ঘুরতে পাহাড়ের একটা অচেনা শুঁড়িপথ পেরিয়ে অনেকদূরে চলে গিয়েছিল। ওদিকটায় সে আগে কখনো যায়নি। দু’দিকের উঁচু পাহাড়ের দেওয়াল শেষ হতেই বিকুল দেখতে পেল, সে একটা অদ্ভুত জায়গায় পৌঁছিয়ে গেছে। তার পায়ের কাছে ছড়িয়ে থাকা জমি যেন আগুনে পুড়ে ঝামা হয়ে গিয়েছে। এখানে—ওখানে গাছের কিছু গুঁড়ি—সেগুলোও পুড়ে কাঠকয়লা। এরই মধ্যে একসারি কংক্রিটের তৈরি চ্যাপ্টা নিচু ঘর। ঘরগুলোতে ঢুকবার জন্যে দরজা কোথাও থাকতেও পারে, কিন্তু একটা ঘরেও জানলা নেই। জানলার বদলে রয়েছে একটা করে সরু লম্বা ঘুলঘুলি।

কিছুক্ষণের মধ্যেই বিকুল বুঝতে পারল সে ঘুরতে ঘুরতে কোথায় চলে এসেছে। সামনের ওই জমিটা একসময় প্রতিবেশী দেশের সৈন্যরা জবরদখল করে নিয়েছিল। বানিয়ে তুলেছিল একটা মিলিটারি ক্যাম্প। এটা সেই ক্যাম্পেরই ধ্বংসাবশেষ। ওই কংক্রিটের ঘরগুলোকে বলে ‘বাঙ্কার’। বাঙ্কারের মধ্যে থেকে বিদেশি সৈন্যরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বাইরের দিকে নজর রাখত। দেওয়ালের ওই সরু ঘুলঘুলিগুলো ভারতীয় সৈন্যদের দিকে নজর রাখার জন্যেই বানানো। ওই ঘুলঘুলির মধ্যে দিয়েই আগ্নেয়াস্ত্রের নল বার করে গুলিও চালাত ওরা।

বিকুলের মনে পড়ল গ্রামের বয়স্ক মানুষদের মুখে শোনা গল্প। কিছুদিন ওদের মস্তানি সহ্য করার পর ভারতীয় সেনারা এই সীমান্ত—চৌকি ভেঙে গুঁড়িয়ে অনুপ্রবেশকারীদের ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিল তাদের নিজেদের দেশে।

বিকুল তারপর পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়েছিল বাঙ্কারগুলোর দিকে আর তখনই ওর কানে এসেছিল গুনগুন করে ভোমরার ডানার কাঁপুনির মতন একটা শব্দ। শব্দটার দিকে একটু কান পেতে থেকে বিকুল বুঝল, ভোমরার ডানা নয়, মানুষের গলা। এক পরিত্যক্ত বাঙ্কারের ভেতর থেকে ক্ষীণ দুর্বল কিন্তু সুমিষ্ট পুরুষকণ্ঠে কোনো অজানা স্তোত্র অবিরাম ভেসে আসছে। ক্ষীর বলেই সেই শব্দ বেশিদূরে পৌঁছতে পারছে না। আবিরের গুঁড়োর মতন যেখানে উড়ছে সেখানেই ঝরে পড়ছে।

বিকুলের ভয় করল না। সেই মন্ত্রের সুরে এমন কিছু ছিল যা ভয় জাগায় না, অভয় দেয়। যে—বাঙ্কারটার মধ্যে থেকে শব্দটা আসছিল, সেই বাঙ্কারের ঘুলঘুলিতে চোখ লাগিয়ে বিকুল দেখল একজন মানুষ মেঝের ওপরে শুয়ে রয়েছেন। পরনে তাঁর উর্দি নেই, ছেঁড়াখোঁড়া বাসন্তী কাপড় রয়েছে। তার মানে উনি সৈন্য নন, সন্ন্যাসী।

বাঙ্কারের ভেতরে এক সন্ন্যাসী কেন শুয়ে রয়েছেন? উনি ওখানে ঢুকলেন কোথা দিয়ে?

যে কোনো কিশোরের মতন বিকুলও ছিল ভারী কৌতূহলী। সে আর কৌতূহল সামলাতে না পেরে ওই ঘুলঘুলিতে মুখ লাগিয়ে ডাকল—শুনছেন? শুনতে পাচ্ছেন?

মন্ত্র জপ থেমে গেল। সন্ন্যাসী শায়িত অবস্থাতেই এপাশ ফিরলেন। বাঙ্কারের ভেতরে আলোর চেয়ে ছায়াই বেশি। সেই আবছায়াতেও বিকুল দেখতে পেল মানুষটার বয়স বেশি নয়, কিন্তু তিনি ভীষণ রোগা। শরীরের প্রত্যেকটা হাড় যেন গুনে নেওয়া যাচ্ছে। কিছুক্ষণ চোখ কুঁচকে ঘুলঘুলির দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি। যখন বাইরের আলোয় চোখ সয়ে এল আর বিকুলকে পরিষ্কার দেখতে পেলেন, তখন তাঁর মুখে অদ্ভুত সুন্দর এক হাসি ফুটে উঠল।

আপনি এখানে কী করছেন? বিকুল সেদিন জিগ্যেস করেছিল।

ধ্যান করছি। বোধিসত্ত্বের ধ্যান।

এখানে কেন? বাইরে ওই গাছের ছায়াতে বসলেই কি ভালো করতেন না? আপনাকে দেখে তো মনে হচ্ছে আপনি অনেকদিন আলোয় বেরোননি। আপনার চামড়া সাদা হয়ে গেছে।

আমি আর কোনোদিনই বাইরে বেরোতে পারব না। সন্ন্যাসী ইশারায় নিজের পায়ের দিকে দেখালেন। আতঙ্কিত বিকুল দেখল তাঁর বাসন্তী রঙের কাপড়ের নীচ থেকে একটা লোহার শেকল দেখা যাচ্ছে। মেঝেয় গাঁথা দুটো লোহার আংটার সঙ্গে সন্ন্যাসীর পা দুটো শেকল দিয়ে আটকানো রয়েছে। বিকুল আর কোনো কথা না বলে এক দৌড়ে বাঙ্কারটাকে একটা পাক দিয়ে পৌঁছে গেল যেদিকে দরজা, সেইদিকে। যা ভেবেছিল তাই। লোহার দরজাটাও একটা বড় তালা দিয়ে আটকানো। তবে অনেক বছরের রোদে—জলে সস্তার তালাটা মরচে লেগে ঝুরঝুরে হয়ে গিয়েছিল। একটা বড় পাথর তুলে নিয়ে দুটো ঘা মারতেই তালাটা খুলে পড়ে গেল। বিকুল ভেতরে ঢুকে সন্ন্যাসীর পাশে বসল।

বাইরে থেকে বুঝতে পারেনি। কাছে এসে বিকুল অবাক হয়ে দেখল, সন্ন্যাসী এদেশের লোক নন; সম্ভবত ইওরোপিয়। তাঁর ধবধবে সাদা গায়ের চামড়া, সোনালি দাড়িগোঁফ আর মাথার চুল সেই কথাই বলছিল। কিন্তু উনি বিকুলের ভাষাতেই কথা বলছিলেন।

ওনার পায়ের লোহার শেকলটাকে ভাঙার জন্যে বিকুল পাথরটাকে আরেকবার মাথার ওপরে তুলেছিল। উনি হাত তুলে বারণ করলেন। বললেন, থাক। বৃথা পরিশ্রম কোরো না।

বৃথা কেন? বিকুল অবাক হয়ে জিগ্যেস করল। বাইরে বেরোতে চান না?

চাইলেও পারব না। পাঁচ বছর এইভাবে শুয়ে রয়েছি। আমার পা দুটো শুকিয়ে গিয়েছে। আমি আর কোনোদিনই উঠে দাঁড়াতে পারব না। তবে তার জন্যে নয়। আমি এই ধ্যানঘর ছেড়ে বেরোতে চাই না।

ধ্যানঘর কাকে বলছেন? বিকুল অবাক হয়ে তাদের চারদিক দিয়ে ঘিরে থাকা কংক্রিটের ধূসর দেওয়াল আর সিলিং—এর দিকে তাকাল। তারপর আবার সেই সন্ন্যাসীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, এটা তো বাঙ্কার। যুদ্ধের আস্তানা।

হয়তো সেইজন্যেই ওরা বানিয়েছিল। কিন্তু আমি তো গত পাঁচ বছর ধরে এটাকে ধ্যানঘর হিসেবেই ব্যবহার করছি। এই ঘরের মধ্যে গত পাঁচ বছরে আমি ভগবান বোধিসত্ত্বকে যত আপন করে পেয়েছি, তার আগের বিশ বছরের সন্ন্যাসজীবনে তা পাইনি।

বিকুল সেই সন্ন্যাসীকে জিগ্যেস করল, আপনাকে কারা এখানে আটকে রেখে গেছে? ভারতীয় সৈন্য?

না, ওরা। সন্ন্যাসী চোখ দিয়ে সীমান্তের ওপারের দেশটার দিকে দেখালেন। তারপর নিজের মনেই বলে চললেন, আমি তো সেই কবে থেকেই এখানে বাস করছিলাম। তখন এখানে একটা গ্রাম ছিল। সেই গ্রামের লোকেরা আমাকে ভিক্ষা দিয়ে যেত। গুহায় থাকতাম, ধ্যান করতাম। বোধিসত্ত্বের কথা ভাবতাম। হঠাৎই একদিন ওরা এল।

ওরা আসছে বুঝতে পেরে গ্রামের লোকেরা গ্রাম খালি করে, ভারতের আরো ভেতরের দিকে পালাল। আমাকেও গ্রামবাসীরা বলেছিল ওদের সঙ্গে পালিয়ে যেতে। কিন্তু আমি কেন যাবো? আমার কাছে তো কেউ পর নয়। তোমরাও যেমন, ওরাও তেমনি আমার নিজের লোক। ভয় পাব কেন? তাই আমি এখানেই রয়ে গেলাম।

তারপর?

ওরা এল। ট্রেঞ্চ কাটল। বাঙ্কার বানাল। কামান বসাল। আসা—যাওয়ার পথে ওরা আমাকে দেখত। বুঝতে পারতাম, ওরা আমাকে সহ্য করতে পারছে না। আমার ধর্ম সম্বন্ধে ওদের একটা ভারী অদ্ভুত বিতৃষ্ণা আর ক্রোধ দেখেছিলাম। সেটা আশ্চর্য কিছু নয়। পুরো তিব্বত উপত্যকায় তখন ওই সৈন্যদের হাতে বৌদ্ধরা মার খাচ্ছে, মরছে। আমিও তো তাদের চেয়ে আলাদা কিছু ছিলাম না। আমাকেও নিশ্চয় ওরা তখনই মেরে ফেলত। মেরে যে ফেলল না তার কারণ…

সন্ন্যাসী কথা বলতে বলতে হাঁফিয়ে উঠেছিলেন। বিকুলের কাঁধব্যাগের মধ্যে জলের বোতল ছিল। সে সন্ন্যাসীর মুখে বোতল থেকে অল্প অল্প করে জল ঢেলে দিল। আরামে ওনার চোখ দুটো বন্ধ হয়ে এল—যেন কতদিন ওইভাবে জল পান করেননি। তারপর ঠোঁটের কোনদুটো মুছে দিয়ে উনি আবার বলতে শুরু করলেন—

আমাকে মারল না তার কারণ, ওরা এখানে পা দেওয়ার পরেই একটা ঘটনায় জেনে গিয়েছিল যে, আমি একজন ডাক্তার। হ্যাঁ, সত্যিই। সন্ন্যাস নেওয়ার আগে আমি আমার নিজের দেশে ডাক্তারিই করতাম।

ওরা যখন এখানে ক্যাম্প তৈরির কাজ শুরু করল তখন একটা বিশ্রী দুর্ঘটনায় কয়েকজন শ্রমিক আহত হয়েছিল। তাই দেখে আমি চুপ করে বসে থাকতে পারিনি। আমার গার্হস্থ্যজীবনের বিদ্যা কাজে লাগিয়ে আমি তাদের যথাসাধ্য চিকিৎসা করে সারিয়ে তুলেছিলাম। ওরা কৃতজ্ঞ হয়নি, কিন্তু বুঝতে পেরেছিল আমি বেঁচে থাকলে ওদের আরো কাজে লাগব। তাই ওরা আমাকে নজরবন্দি করে বাঁচিয়ে রাখল। ওদের অনুমতি ছাড়া কোথাও যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল আমার।

সত্যিই আমি ওদের কাজে লেগেছিলাম। যুদ্ধ যখন শুরু হল তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রতিদিনই কেউ না কেউ আহত হত। এই দুর্গম জায়গায় ওদের সেনাবাহিনীর চিকিৎসকেরা পৌঁছতে পারতেন না। তাই আমাকেই তাদের চিকিৎসা করতে হত। আমি খুশিমনেই সেই কাজটা করতাম। ভাবতাম বোধিসত্ত্বের করুণাই আমার মধ্যে দিয়ে ওই আহত শ্রমিকদের কাছে পৌঁছচ্ছে।

তারপর?

একদিন বুঝতে পারলাম দূরের যুদ্ধ কাছে এগিয়ে আসছে। এবার আর দূর থেকে ছোঁড়া গুলিগোলা নয়, মুখোমুখি বেয়নেটের লড়াই শুরু হবে। হলও তাই। সেই রক্ত, সেই আর্তনাদ, সেই জয়োল্লাস যদি ভুলতে পারতাম ভালো হত। কিন্তু ভুলতে পারি না।

যাই হোক, আমার কাজ বাড়ল। আমি এই মৃত্যু—উপত্যকায় ঘুরে ঘুরে আহত সৈনিকদের শুশ্রূষা করে বেড়াচ্ছিলাম। উর্দির রং দেখিনি। বিচার করিনি কে আমার বন্ধু, কে শত্রু। বিচার করিনি কে ভারতীয়, কেই বা বিদেশি। ওরা কিন্তু খেয়াল করেছিল যে, আমি ভারতীয় সৈন্যদেরও সেবা করছি। তাই যুদ্ধে হেরে পালিয়ে যাবার আগে ওর আমাকে মেরে ফেলতে গেল।

বাধা দিল ওদের মধ্যেই কয়েকজন সেনা, যাদের আমিই একদিন বাঁচিয়ে তুলেছিলাম। ওদের দলপতি লোকটা ছিল বুদ্ধিমান। সে তখন এমন একটা কৌশল করল, যাতে সেই কৃতজ্ঞ সেনাদের চোখের সামনে না মরে, দু—একদিন বাদে আমি মরি। আমাকে এই বাঙ্কারের মধ্যে শেকল বেঁধে ফেলে রেখে ওরা চলে গেল।

বিকুল বলল, আমাদের সৈন্যরা আপনাকে দেখতে পায়নি?

না। এই জায়গাটার কথা ভারতীয় সৈন্যরা জানতই না। পাহাড়ের আড়ালে এমন সুন্দরভাবে লুকোনো এই জায়গাটা যে, খুব নিচু দিয়ে উড়ে যাওয়া প্লেন থেকেও বোঝা যায় না এখানে একটা ক্যাম্প রয়েছে। তাই এখানে কোনো ভারতীয় সৈন্যের পা পড়েনি।

অনেকক্ষণ থেকেই বিকুলের মনের মধ্যে যে প্রশ্নটা ঘুরপাক খাচ্ছিল, সেটা সে করেই ফেলল—আপনি বেঁচে আছেন কেমন করে? জল পান কোত্থেকে? খাবার?

সন্ন্যাসী বললেন, খুব যে কিছু পেয়েছি তা তো নয়। আমার চেহারা দেখেই নিশ্চয় সে কথা বুঝতে পারছ। তবে বাঙ্কারটা মাটির নীচে তৈরি হওয়ায় একটা সুবিধে হয়েছে। মেঝের ওই ফাটলটা দিয়ে সারাক্ষণ মাটির নীচের জল চুঁইয়ে উঠে আসে। আমি হাত দিয়ে একটা কুণ্ড খুঁড়ে নিয়েছি। পশুর মতন ওই কুণ্ডটায় মুখ ডুবিয়ে জল পান করি। আর খাবার? ওই কুণ্ডের জলেই এক ধরনের শ্যাওলা জন্মায়। সেই শ্যাওলা খেয়েই বেঁচে রয়েছি। ভালোই আছি। যেহেতু কোথাও যাওয়ার নেই, খাওয়াদাওয়ার চিন্তা নেই, তাই সারাদিন সারারাত বোধিসত্ত্বের কথা ভাবতে পেরেছি। এমন জীবনই তো চেয়েছিলাম।

বিকুল সেদিন হতভম্ব হয়ে বহুক্ষণ সেই সন্ন্যাসীর মুখের দিকে তাকিয়ে বসেছিল। সে ঠিক বুঝতে পারছিল না যে, সে স্বপ্ন দেখছে নাকি বাস্তবেই তার সামনে এমন একজন মানুষ রয়েছেন যিনি পাঁচ বছর একটা গুহার পাথুরে মেঝেতে শেকল বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছেন।

এসব মাত্রই কয়েকমাস আগের ঘটনা। তারপর থেকেই বিকুলের সবচেয়ে বড় বন্ধু হয়ে উঠেছেন তার ডাক্তারদাদু। ডাক্তারদাদুরই একান্ত অনুরোধে বিকুল তাঁর কথা কাউকে বলতে পারেনি। এমনকি যখন তার দাদু মহিসোনা বেঁচেছিলেন তখন মহিসোনাকেও সে কিছু বলেনি ডাক্তারদাদুর সম্বন্ধে। ডাক্তারদাদু খালি বলেন, এই তো বেশ ভালো আছি। আর যে ক’দিন বেঁচে আছি এই গুহার মতন বাঙ্কারের মধ্যেই যদি থাকি, ক্ষতি কী? সামনের ওই ঘুলঘুলিটা দিয়ে যতটা দেখা যায় তার মধ্যেই তো আমি পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্য দেখতে পাই।

বিকুল অবাক হয়ে বলে, যাঃ! তাই আবার হয় নাকি? আমরা সবাই যে তাহলে কত দূরে—দূরে আশ্চর্য জিনিস খুঁজতে যাই।

ডাক্তারদাদু তাই শুনে তাঁর হাড়—জিরজিরে হাতটা দিয়ে বিকুলকে জড়িয়ে ধরে বলেন, সব জায়গাই দূরের জায়গা। এই যে তোমাদের ইয়েলমিং পাহাড়, তুমি এখানে থাকো বলে তোমার মনে হয় জায়গাটা বুঝি খুব সাধারণ। কিন্তু আমি যেখানে জন্মেছিলাম সেই জার্মানির একটা ছেলেকে এখানে এনে ছেড়ে দাও তো। দেখবে সে চোখ গোলগোল করে তোমাদের নদী, পাহাড়, পাখি আর গাছপালা দেখছে। হাপুশ—হুপুশ করে তোমাদের বজরার রুটি, লঙ্কার আচার আর ইয়াকের দুধের ছুরপি খাচ্ছে। তুমি যদি একবার বিদেশির চোখ দিয়ে নিজের দেশটাকে দেখতে শিখে যাও বিকুলসোনা, তাহলে দেখবে সেই চেন দেশটার মধ্যেই কত আশ্চর্য জিনিস ছড়িয়ে রয়েছে।

তুমি দেখতে পাও? বিকুল জিগ্যেস করে। ক’দিনের মধ্যেই ডাক্তারদাদুর সঙ্গে তার সম্পর্কটা আপনি থেকে তুমিতে নেমে এসেছে।

পাই বইকি। ডাক্তারদাদু উত্তর দেন। ওই ঘুলঘুলির ফাঁক দিয়ে দেখা সাতফিট বাই তিনফিটের পৃথিবীটা দেখতে গিয়েই তো কোথা দিয়ে পাঁচটা বছর কাটিয়ে ফেললাম, বুঝতেই পারলাম না।

ওই ঘুলঘুলি দিয়ে ঘরের ভেতরে আসা চৌকোনা আলোর ফালিটা যখন লাল হয়ে ওঠে, আমি বুঝতে পারি সূর্য উঠছে। কখনো সোনালি হয়ে উঠলে বুঝি, আজ নিশ্চয় পূর্ণিমার রাত। ওই ঘুলঘুলির মধ্যে দিয়েই ঝড়ের সময়ে একটা—দুটো শুকনো শাল কিংবা সেগুনের পাতা উড়ে এসে বাঙ্কারের মেঝেয় পড়ে। সেই পাতাগুলোর মধ্যে আমি সারা অরণ্যের ছবি দেখতে পাই।

আর কখনো যদি পাতার সঙ্গে একটা ছোট বকুলফুল উড়ে এল তো সেদিন আনন্দে আমার ঘুম আসে না। এই ধ্যানঘরে ওরা যদি আমাকে বন্দি করে রেখে না যেত, তাহলে কি আমি জানতে পারতাম, কি আশ্চর্য নিখুঁত জ্যামিতি ব্যবহার করে একটা বকুলফুলকে তৈরি করা হয়েছে। কি সুন্দর বৃত্তের মতন তার গর্ভকেশর! তাকে ঘিরে কত যত্নে সাজানো ছোট্ট পাপড়িগুলো।

প্রতিবছর বসন্তকালে ওই ঘুলঘুলিতেই বাসা বানায় একজোড়া পাহাড়ি লাফিং—থ্রাশ। দেখি, সামান্য ঘাসপাতা দিয়ে কি সুন্দর পেয়ালার মতন বাসাটি ওরা বানিয়ে তুলছে। সব শেষে আবার বাসার গায়ে মাকড়শার জালের একটা প্রলেপ দিয়ে কাঠিকুটিগুলোকে আঁটসাঁট করে বেঁধে দেয়। এই বকুলফুলের জ্যামিতি আর লাফিং—থ্রাশের ইঞ্জিনিয়ারিং কি আশ্চর্য জিনিস নয়? এইসব দেখার জন্যেই কি একজন্ম চুপ করে বসে থাকা যায় না?

বিকুল আগে কখনো এগুলোকে কোনো গুরুত্ব দেওয়ার মতন জিনিস বলে ভাবেইনি। তবে ডাক্তারদাদুর সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর থেকে তার মনটাও একটু একটু করে বদলে যাচ্ছিল।

দাদু মহিসোনা মারা যাওয়ার পরে বিকুল সবার আগে তাই ডাক্তারদাদুর কাছেই দৌড়ে এসেছিল। বিকুল সেদিন আকুল হয়ে প্রশ্ন করেছিলেন, ডাক্তারদাদু, এই যে আমি একদম একলা হয়ে গেলাম, এই যে মারিয়ানা দিমাগখোর আমাকে খাবে বলে খুঁজে বেড়াচ্ছে, এর মধ্যেও কি তুমি তাহলে কোনো মঙ্গল খুঁজে পাও?

ডাক্তারদাদু ওর মাথাটা বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, ওইদিকে দেখো বিকুল।

কোনদিকে?

ওই যে, বোমার আগুনে পুড়ে যাওয়া রুক্ষ রাস্তাটার দিকে। আমি এখানে বসে বসেই রাস্তাটার একটা টুকরো দেখতে পাই। তুমি যখন রোজ আমার জন্যে বালতি ভরে জল নিয়ে আসো তখন ওই এবড়োখেবড়ো রাস্তার পাথরে হোঁচট খাও। রোজই তোমার কষ্ট করে বয়ে আনা জলের অর্ধেকটা চলকে পড়ে যায় ওই রাস্তার ধুলোয় আর তুমি আমার সামনে জলের বালতিটা নামিয়ে রেখে নষ্ট জলের জন্যে আফসোস করো। কিন্তু আজ একবার তাকিয়ে দেখো তো, সত্যিই কি তোমার বালতি থেকে পড়ে যাওয়া জলটুকু নষ্ট হয়েছে?

বিকুল ডাক্তারদাদুর পাশে বসে, বাঙ্কারের ঘুলঘুলির মধ্যে দিয়ে তাকিয়ে দেখল, সেই রুক্ষ রাস্তার ধুলোর ওপরে যেখানে তার বালতির জল প্রতিদিন চলকে পড়েছিল, সেখানে সেখানে ফুটে উঠেছে নানান রঙের প্রিমুলা। ঘাসফুল। ডাক্তারদাদুর বাঙ্কারের দিকে আসার পুরো রাস্তাটাতেই যেন কেউ রঙিন আসন পেতে রেখে গেছে। পড়ে যাওয়া জলের একটি ফোঁটাও নষ্ট হয়নি।

বিকুলের মনটা শান্ত হয়ে উঠল। মনে হল সকালের সোনালি রোদ্দুরের সঙ্গে এমন একটা শক্তি এই ইয়েলমিং—এর পাহাড়ের আনাচে—কানাচে ছড়িয়ে পড়ছে, যার কাছে মারিয়ানা দিমাগখোরের কালা জাদুও তুচ্ছ।

চার

সেটা ছিল এক সকালবেলার ঘাসফুলে ভরা রাস্তার কথা। রাতের দৃশ্য কিন্তু অন্য। রাতে বেদিয়ানা গ্রামের রাস্তায় আলো জ্বলে না। কয়েকমাস আগেও যে রাস্তায় গভীর রাত অবধি লোক চলাচল ছিল, সেই রাস্তা এখন জনহীন।

না, সম্পূর্ণ জনহীন নয়। মিলিটারির দুটো আর্মার্ড—কার মন্থরগতিতে এ রাস্তা থেকে সে রাস্তায় সারারাত টহল মেরে ঘুরে বেড়ায়। আদিসা তিমুরার সমাধিগুহার দরজা খুলে যাওয়ার পর থেকেই যে আতঙ্ক পাতলা কুয়াশার মতন সারা ইয়েলমিং পাহাড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল, সেই কুয়াশাই মহিসোনার মৃত্যুর পরে কালো মেঘের মতন ঢেকে ফেলেছে এখানকার প্রত্যেকটি মানুষের চেতনা। প্রশাসন থেকে চেষ্টা করা হচ্ছে এই গণ—হিস্টিরিয়ার মোকাবিলা করার। ছোট ছোট মিটিং করা হচ্ছে, যেখানে নেতা—মন্ত্রীরা এসে বোঝাচ্ছেন মহিসোনার মৃত্যু নিতান্তই একটা সমাপতন। ওই মৃত্যুর সঙ্গে আদিসা তিমুরার সমাধিগুহার কোনো সম্পর্ক নেই।

তাহলে কেন প্রশাসন থেকেই আর্মার্ড—কারের টহলের ব্যবস্থা করা হল? মানুষ বোকা নয়। কানাঘুষোয় এই খবরটা ছড়িয়ে পড়তেও দেরি হয়নি যে, মহিসোনার পোস্ট—মর্টেম রিপোর্ট বলছে তার করোটির মধ্যে মগজ বলে কিছু ছিল না।

আর্মার্ড—কার ঘুরে বেড়ায় বড় রাস্তায়। কিন্তু বেদিয়ানার মতন একটা পাহাড়ি গ্রামে বড় রাস্তা আর কতটুকু? বেশিরভাগই তো পাহাড়ের গা বেয়ে ওপরে—নীচে ছড়িয়ে— পড়া শুঁড়িপথ। সেইসব পথের ধারে এখানে—ওখানে ছড়িয়ে—ছিটিয়ে থাকা টিনের চালের বাড়ি, বাঁশের বন, এলাচের ঝোপ। মাঝে মাঝে আকাশের সমস্ত আলো শুষে নিয়ে চৌমাথা অন্ধকার করে দাঁড়িয়ে থাকা একেকটা মহীরুহ।

এই সবের মধ্যেই ঘরের ভেতর থেকে কেউ কেউ দেখে ফেলে সেই মেয়েকে, যার নাম মারিয়ানা দিমাগখোর। চারিদিকের কালো ছায়ার মধ্যে আরো কালো এক ছায়ার মতন এদিক থেকে ওদিকে চলে যায় সেই বেড়াল—মেয়ে। অবিকল বেড়ালের মতোই সরু পাঁচিলের পিঠ বেয়ে চার—হাতে—পায়ে দৌড়য়। চোখে চোখ পড়ে গেলে অবলীলায় ছাদ থেকে লাফ মারে উঠোনের মাঝখানে। একফোঁটা শব্দ হয় না, যেন তারও পায়ের নীচে বেড়ালের থাবার মতন নরম মাংসের প্যাডিং লাগানো রয়েছে। মুহূর্তের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যায় কোনো ঝোপের আড়ালে।

আর্মার্ড—কার সারারাত বড় রাস্তায় টহল মারে। সকালের আলো ফুটলে দেখা যায় বড় রাস্তা থেকে দূরে, কোনো গলিপথে পড়ে আছে একটা লাশ। সেই মৃতদেহের বিস্ফারিত চোখের মণিতে মৃত্যুর পরেও এত ঘৃণা জমে থাকে যে, কারুর সন্দেহ থাকে না সে কার মুখ দেখে মরেছিল।

একলা বিকুল টোপ্পোবাড়ির মাটির নীচের পুঁথিঘরে গুড়িসুড়ি মেরে শুয়ে থাকে। এই ঘরে কোনো জানলা নেই। একটাই দরজা, সেটার পাল্লা ভেতরদিক থেকে মোটা খিল দিয়ে আটকিয়ে বিকুল শুয়ে থাকে। সারারাতের মধ্যে কখনো না কখনো সেই দরজার ওপরে নখের খরখরে আঁচড়ানির শব্দে বিকুলের ঘুম ভেঙে যায়। তারপরে আর ঘুম আসে না।

মৃতের সংখ্যা বাড়তে থাকে। যেন অঘোষিত কারফিউ নেমে আসে ইয়েলমিং পাহাড়ের গ্রামগুলোতে।

প্রতিদিন দুপুরে বিকুল পানীয় জল আর খাবার নিয়ে চলে যায় সেই বাঙ্কারে, যেখানে ডাক্তারদাদু তার জন্যে অপেক্ষা করছে।

সেদিন ডাক্তারদাদুর পাশে বসে বিকুল দেখল ডাক্তারদাদু একটা ক্যালাইডোস্কোপ বানিয়েছে। বোমার স্প্লিন্টারের ঘায়ে বাঙ্কারের চারিদিকে ছড়িয়ে—ছিটিয়ে ছিল ভাঙা কাচের টুকরো। টুকরোগুলো আগুনে পুড়ে কালো হয়ে গিয়েছিল। তাদের একটা দিক পরিষ্কার করে মুছে নিয়েছে ডাক্তারদাদু। অন্যদিকটা ভুষো—কালিতে ঢাকা বলে পরিষ্কার দিকটা ঝকঝকে আয়নার কাজ করছে। ওরকমই তিন টুকরো আয়নাকে দাদু তার সার্জিকাল কিটের অ্যাডহেসিভ টেপ দিয়ে জড়িয়ে বেঁধেছে। তৈরি হয়েছে আয়না— দেওয়ালের ছোট্ট তিনকোনা এক চোঙা।

বিকুল পোঁছতেই দাদু বলল, এসে গেছ? ভালোই হয়েছে। চারদিকে কুচোকাচা যা পড়ে আছে ঢোকাও দেখি ভাই এই চোঙার মধ্যে।

বিকুল মুখ কুঁচকে বলল, ইসস। এইসব কি খেলার জিনিস?

আহা, সবকিছুতেই খেলনা হয়। আমি তো নড়তে পারি না। তুমিই আমাকে ওইগুলো এগিয়ে দাও। দাও ওই ইউনিফর্মের ছেঁড়া বোতাম, ছররা গুলির চকচকে খোল। ওটা কী? ওষুধের প্যাকেটের রাংতা? দাও, ওটাও দাও। আর ওই যে, কারুর গলা থেকে বোধহয় খুলে পড়ে গিয়েছিল রুপোর তাবিজ। ঢুকিয়ে দাও এই চোঙার মধ্যে।

ডাক্তারদাদু যুদ্ধের গন্ধমাখা সমস্ত আবর্জনা একসঙ্গে ধরে ক্যালাডোস্কোপের মধ্যে পুরে, সেটা বিকুলের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, এবারে দেখো।

বিকুল চোঙাটা চোখের সঙ্গে লাগিয়ে মুগ্ধ হয়ে গেল। কোথায় যুদ্ধ? কোথায় মৃত্যু? বুলেটের খোল, ইউনিফর্মের বোতাম, মৃত সৈনিকের গলার তাবিজ—সবকিছুই আয়না থেকে আয়নায় অজস্র সহস্রবার প্রতিফলিত হয়ে বানিয়ে তুলেছে রংবেরঙের ফুল, লতাপাতা আর রঙিন প্রজাপতি। কোনো কিছুকেই আর আলাদা করে চেনা যাচ্ছে না।

বিকুল ক্যালাইডোস্কোপটা চোখ থেকে নামিয়ে ডাকল—ডাক্তারদাদু!

বলো ভাই!

ওই লোকগুলোর ওপরে তোমার রাগ নেই?

কোন লোকগুলোর ওপরে ভাই?

ওই, যারা তোমাকে পা বেঁধে এই বাঙ্কারের মধ্যে ফেলে দিয়ে গিয়েছিল।

দাদু অদ্ভুত সুন্দর হেসে বলল, সে তো ওরা অনেক কিছুই ফেলে দিয়ে গিয়েছিল। বুলেটের খোল, ইউনিফর্মের বোতাম, মৃত সৈনিকের গলার তাবিজ। মনে করো না, আমিও ওরকমই একটা আবর্জনা। আমার জন্যেও অপেক্ষা করছে একটা ক্যালাইডোস্কোপ, যার মধ্যে একবার ঢুকে পড়তে পারলে আমিও সুন্দর হয়ে উঠব। এইসব ভাবলেই আর কারুর ওপরে রাগ করতে পারি না।

বিকুল বলল, মাঝে মাঝে তুমি এমন সব কথা বলো না, কিচ্ছু মানে বুঝতে পারি না। মানুষের মাপের ক্যালাইডোস্কোপ কি হয়?

হয় বইকি। এই পৃথিবীটাই সেই ক্যালাইডোস্কোপ। এখানে অনেকগুলো মানুষ মিলে একটা ফুলের নকশা, একটা পাখির নকশা, একটা প্রজাপতির নকশা তৈরি করে। যে ওপর থেকে দেখে সে বুঝতে পারে। টুকরোগুলো নিজেরা বোঝে না।

বিকুল একটু একটু বুঝতে পারছিল ডাক্তারদাদুর কথাগুলো। আবার অনেকটাই বুঝছিল না।

ইতিমধ্যে কখন যেন ইয়েলমিং—এর চূড়ার সেই ভাঙা দুর্গের ভেতর থেকে একটা বিশ্রী শ্যাওলা রঙের মেঘ মস্ত একটা পোকার মতন গা মোচড়াতে মোচড়াতে আকাশে ভেসে পড়ল। সেই মেঘটা খুব অল্প সময়ের মধ্যে ঢেকে ফেলল নীচের বাড়িঘর, গ্রাম আর বনভূমিকে। ঢেকে ফেলল পরিত্যক্ত বাঙ্কারকে। একটা জোরালো হাওয়ার ধাক্কায় বাঙ্কারের পুরোনো লোহার পাল্লাদুটো ঝনাৎ করে খুলে গেল আর সেই খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে এল কালো লোমে ঢাকা একটা মেয়ে, যার শাঁখের মতন সুন্দর গলার ওপর থেকে তাকিয়ে রয়েছে বেড়ালের মুখ।

বিকুল ভয়ে কঁকিয়ে কেঁদে উঠল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই ডাক্তারদাদুর গলায় যেন মেঘ ডেকে উঠল। তিনি অশক্ত পা দুটোকে যতটা পারেন শরীরের নীচে গুটিয়ে এনে সোজা হয়ে বসলেন। বললেন, বিকুল, তুমি ওর দিকে তাকিও না। তুমি দরজাটা বন্ধ করে এসো। তারপরে চোখে এই ক্যালাইডোস্কোপটা লাগিয়ে ছবি দেখো, ছবি।

বিকুল তাই করল। সে জানে মারিয়ানা ছায়ায় তৈরি জীব। সে যেমন সমাধিগুহার মুখের পাথরও কোনোদিন ঠেলে সরাতে পারেনি, তেমনি এই বাঙ্কারের দরজাও আর নিজে খুলতে পারবে না। তবে হ্যাঁ, ইচ্ছে করলে সে তাদের দুজনের মধ্যে যে কাউকে দিয়ে সম্মোহনের মায়ায় ওই দরজা আবার খুলিয়ে নিতে পারে। কাকে দিয়ে খোলাবে সেটাই প্রশ্ন।

মারিয়ানা…মারিয়ানা…মারিয়ানা!

চোখের ওপরে প্রাণপণে ক্যালাইডোস্কোপটাকে চেপে ধরে বিকুল কান খাড়া করে শুনছিল ওই ডাকটা। ডাক্তারদাদু মারিয়ানাকে ডাকছে। ওই ঘৃণ্য কালো বেড়ালটাকে ডাক্তারদাদু এমন মায়াময় গলায় ডাকছে, যেন সে সত্যিই ডাক্তারদাদুর মেয়ে।

মারিয়ানা, তুমি চাও আমি তোমাকে ঘৃণা করি, তাই তো? যাতে তুমি আমার ঘৃণা মেশানো মগজ তোমার অদৃশ্য নখ দিয়ে বার করে খেয়ে নিতে পারো।

একটা তীব্র ফ্যাঁসস শব্দ হল। সঙ্গে সঙ্গে কংক্রিটের মেঝের ওপরে ধারালো নখের আঁচড়ের গা শিরশিরে আওয়াজ। চিড়িয়াখানায় বাঘের খাঁচার সামনে দাঁড়ালে যে গন্ধটায় গা গুলিয়ে ওঠে সেই গন্ধে ভরে উঠল বাঙ্কারের ভেতরটা। বিকুল বুঝতে পারল, মারিয়ানা ঘৃণার আয়োজনে কোনো ত্রুটি রাখছে না। শুধু একবার ডাক্তারদাদুর মনে সেই ঘৃণা ফুটে উঠলেই দিমাগখোর তার থাবা বাড়িয়ে দেবে।

ডাক্তারদাদুর গলায় কিন্তু কোনো পরিবর্তন নেই। তিনি আগের মতোই শান্তস্বরে বলে চলেছেন—কিন্তু তোমাকে আমি ঘৃণা করব কেন, মারিয়ানা? তুমি কি নিজের ইচ্ছেয় এমন অদ্ভুত চেহারা নিয়ে জন্মেছ? তুমি তো যুদ্ধের সন্তান। মনে নেই, ভালকি আর বেদিয়ানাদের সেই যুদ্ধ? তোমার মায়ের তখন মাত্র আঠেরো—বছর বয়স। একটা আঠেরো—বছরের মেয়ে কি পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে চায় মারিয়ানা? চায় না।

তাই তো সে বিয়ে করল তার পরিত্রাতাকে, অপদেবতা তিমুরাকে। আর তাই তো তুমি এমন অদ্ভুত শরীর নিয়ে জন্মালে মারিয়ানা।

বিকুলের চোখের সামনে তখন বুলেটের খোলগুলো ওষুধের রাংতার সঙ্গে মিলেমিশে ময়ূরপঙ্খী নৌকা হয়ে যাচ্ছিল। তবু তার মধ্যেই সে শুনতে পেল মারিয়ানার ক্রুদ্ধ গর্জন। মারিয়ানা অপেক্ষায় অভ্যস্ত নয়। তাকে দেখলেই মানুষের চোখ থেকে ঘৃণা ঝরে পড়ে। সেই ঘৃণা মাখিয়ে চেটেপুটে দিমাগ খায় দিমাগখোর।

কতক্ষণ সময় পেরোল? বিকুলের মাথার মধ্যে ধাঁধা লেগে যাচ্ছিল। কতক্ষণ সে চোখের ওপরে ক্যালাইডোস্কোপ লাগিয়ে ঘরের কোনার দিকে ফিরে বসে আছে? একঘণ্টা? দু—ঘণ্টা? একরাত? দু—রাত?

কতদিন দরে ডাক্তারদাদুর শান্ত স্বর মারিয়ানাকে দু—হাতের দূরত্বে স্তব্ধ করে রেখেছে? একদিন? দু—দিন?

জানে না, কিছুই জানে না বিকুল। শুধু মাঝে মাঝে চেতনা ফিরে এলে সে শুনতে পাচ্ছে, ডাক্তারদাদু বলে চলেছে—মারিয়ানা, তুমিই প্রথম নও। হয়তো তুমি শেষও নও। তোমারই মতন এমন অনেক কুৎসিত যুদ্ধের সন্তান জন্ম নিয়েছিল জাপানের হিরোসিমা আর নাগাসাকিতে। মিউট্যান্ট বাচ্চা সব।

যখন অ্যাটমবোমা পড়েছিল, তখন ওরা ছিল মায়ের পেটে। যখন জন্মাল, দেখা গেল কারুর হাত নেই, কারুর পা নেই, কারুর দুটো মাথা। তোমার মতন গায়ে লোম নিয়েও নিশ্চয় কেউ কেউ জন্মেছিল। কে বলতে পারে? হিরোসিমা আর নাগাসাকিতেও কি অপদেবতারা ব্ল্যাক—ম্যাজিক দেখিয়েছিল নাকি মারিয়ানা? তাহলে? শুধু তোমাকেই বা আমি কেন ঘৃণা করতে যাব বলো।

এরপরে বিকুলের আর কিছু মনে নেই। হয়তো সে ঘুমিয়েই পড়েছিল। ঘুম ভাঙল ডাক্তারদাদুর ডাকে। বিকুল! বিকুলভাই! উঠে পড়ো। সকাল হয়ে গেছে।

বিকুল ধড়মড় করে উঠে বসে দেখল তার পায়ের কাছে মেঝের ওপরে ঠিক তারই বয়সি একটা মেয়ে কালো স্লিপিং—ব্যাগের মধ্যে গুঁটিসুটি হয়ে ঘুমোচ্ছে। তার মতন অমন সুন্দর মুখ বিকুল আর দেখেছে বলে মনে পড়ল না। ভুট্টার কেশরের মতন সোনালি চুল। ভুট্টার দানার মতন গায়ের রং। আর যখন সেই মেয়ে চোখ খুলল, বিকুল দেখল তার চোখের মণিদুটো গভীর দিঘির মতন সবুজ।

ডাক্তারদাদু বললেন, আলাপ করিয়ে দিই। আমার ভাইঝি, মারিয়ানা। তোমার হাত দিয়ে গতমাসে একটা এয়ারমেল পাঠিয়েছিলাম না? বেটি সেটা পেয়ে একা একাই এতদূরে চলে এসেছে আমাকে নিয়ে যাবে বলে।

মারিয়ানা আড়মোড়া ভেঙে স্লিপিং—ব্যাগের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এল। বিকুল দেখল ওর গা মোমের পুতুলের মতন মসৃণ। বিকুলের দিকে তাকিয়ে মারিয়ানা ভারী মিষ্টি হেসে বলল, গুটেন মার্গেন!

ডাক্তারদাদু বিকুলের ভ্যাবাচাক খাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন, কি বিকুলভাই? মারিয়ানাকে পছন্দ হয়? রেখে দেবে নাকি তোমাদের দেশে?

ভাগ্যিস ডাক্তারদাদু কথাগুলো বিকুলের ভাষাতেই বলেছিলেন। নাহলে বিকুল ভারী লজ্জায় পড়ে যেত।

___

অধ্যায় ৩ / ৩

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন