ধুলোবালির জীবন – ১৩

প্রচেত গুপ্ত

১৩

“মাথায় কী হয়েছে?‌”‌

“পড়ে গিয়েছিলাম। এই জন্য আসতে দেরি হল।”‌

“‌ফোন ধরেন না কেন?‌”‌

“‌যখন পড়ে গিয়েছিলাম, মোবাইলটা ভেঙে গিয়েছে।”‌

“‌নতুন একটা কিনে নিন।”‌

বিধান কিছু না বলে হাসল।

“‌হাসছেন কেন?‌ মোবাইল কেনার পয়সা নেই?‌ এবার হবে। একটা কেন?‌ চারটে মোবাইল কেনার পয়সা হবে। চাকরি ফিরে পাবেন। এতদিনের মাইনে পাবেন, কম্পেনসেশন পাবেন। আর কী চাই?‌”

বিধান বসে আছে তার অফিসের ইউনিয়ন রুমে। সামনে সুফল হালদার। সে অফিস থেকে রিটায়ার করেছে, ইউনিয়ন থেকে করেনি। বিধানকে চিঠি পাঠানোর তিনদিন বাদে সে আসতে পেরেছে। চিঠিতে যদিও তাড়া দেওয়া ছিল…

“‌বিধানবাবু, আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছি না। আপনিও বহুদিন আসেননি। এ কেমন কথা?‌ আপনার চাকরি ফিরিয়ে দেওয়ার দায় কি শুধু আমাদের?‌ আপনার কোনও উদ্যোগ থাকবে না?‌‌ যাক, আপনাকে কথা দিয়েছিলাম, কেসটা দেখব। ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছে। চাকরি আপনি ফিরে পাবেন। আপনি তাড়াতাড়ি এসে আমার সঙ্গে দেখা করুন। ইতি সুফল হালদার।”‌

এই তিনদিন শরীরটা খারাপ হয়েছিল। জ্বর এসেছিল। তিনদিনই শ্রীজিতা কলকাতা থেকে কিশোরীগঞ্জ গিয়েছে। বিধানকে স্নান করিয়ে দিয়েছে, ওষুধ খাইয়ে দিয়েছে, বাড়ি থেকে খাবার এনে খাইয়েছে। বিধান বারবার বারণ করেছে। শ্রীজিতা শোনেনি। তার পক্ষে গোটা বিষয়টা খুব ঝামেলার… অফিস ছুটি নিতে হয়েছে দু’দিন। নতুন দায়িত্ব পাওয়ার পরপরই ছুটি নেওয়ায় সকলেই অবাক হয়েছে। কর্ণ রায় নিজে ফোন করেছিলেন।

“‌এনি প্রবলেম?”‌

শ্রীজিতা একটু ভেবে নিয়ে বলেছে, “‌আমার এক্স হাজ়ব্যান্ডের একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। তাকে দেখার কেউ নেই‌.‌..‌সরি স্যার। আমি জয়েন করে সব কাজ তুলে নেব।”‌

কর্ণ রায় সহানুভূতির গলায় বলেছিলেন, “তোমাকে মোটেই‌ আসতে হবে না। তুমি আগে ওঁকে দেখো। তা ছাড়া তুমি তো ওয়র্ক ফ্রম হোম করছ। যদি কোনও প্রয়োজন হয় অবশ্যই আমাকে জানিয়ো।”‌

দ্বিতীয়দিন যখন বিধান বলেছিল, “‌শ্রী, আমার খুব খারাপ লাগছে। অতদূর থেকে তুমি ছুটে-ছুটে আসছ।”‌

দুম করে রেগে গিয়েছিল শ্রীজিতা, “‌তোমার সমস্যা হচ্ছে?‌ অন্য মেয়ের হাত ধরে গদগদ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে তো সমস্যা হয় না। নাকি আমি এসে পড়ায় সেসব আটকে গিয়েছে? আমিও এখন বাইরের মেয়ে। কিন্তু একটা সময় তো তোমার স্ত্রী ছিলাম। এই মেয়ে তোমার কে?‌ শুধু হাত ধরেনি। রেঁধে খাইয়েওছে। আমি তো বেশিদিন আসব না। তারপর না হয় ওকে আবার ডেকে এনো।”‌

স্তম্ভিত হয়ে চুপ করেছিল বিধান। এ ধরনের কথা শ্রীজিতা কখনও বলেনি তো।‌ রাগের?‌ নাকি অন্যকিছু?‌ সে বলেছিল, “‌তোমাকে তো বলেছি শ্রী, এই মহিলা আমাকে রাস্তা থেকে তুলে এনে হাসপাতালে ভরতি করেছিলেন।”‌

শ্রীজিতা মুখ ঘুরিয়ে নিচু গলায় বলেছিল, “সে তো আমিও তুলে এনেছিলাম। রাস্তাতেই ছিলে একসময়। ছিলে না?‌ তুমি থাকতে পারলে না। আবার রাস্তায় ফিরে গেলে। যাক, চিন্তা কোরো না। আর একটা–‌দু’ দিন দেখে আসা বন্ধ করে দেব।”

বিধান চুপ করে যায়। একসময়ে শ্রীজিতা টেবিলের উপর পড়ে থাকা সুফল হালদারের চিঠিটা হাতে পেয়েছিল। খাম খুলে পড়েছিল।

“‌যাবে না?‌”

বিধান বলে, “কী হবে গিয়ে?‌ চাকরি ফেরত চাই না আর।”‌

শ্রীজিতা বলেছিল, “না, তুমি যাবে। আমার জন্য তোমাকে যেতে হবে। তোমাকে সবাই যখন ‘চোর’ জেনেছিল, তখনও তুমি আমার বর ছিলে। সবাই জেনেছিল, আমি একজন খারাপ মানুষকে বিয়ে করেছি। তুমি চাকরি ফিরে পেলে আমার সেই অপমান, লজ্জা দূর হবে।”‌

বিধান অবাক হয়ে বলেছিল, “‌এখন আর তোমার সঙ্গে এসবের কী সম্পর্ক শ্রী!‌”‌

“তুমি বুঝবে না। কোনওদিন আমার সম্মান-অসম্মানের দিকে ফিরে তাকাওনি। কালই তুমি যাবে। আমি তোমার সঙ্গে থাকব।”‌

শ্রীজিতা অফিসের বাইরে রাস্তায় গাড়ি‌তে অপেক্ষা করছে।

সুফল হালদার ঘর থেকে সবাইকে বের করে দিয়েছে। কথা শোনার মতো কেউ নেই। তারপরে সে গলা নামিয়ে বলল, “যা বলছি চুপ করে শুনে যান। আমরা জেনেছি, আপনাকে সত্যি ফাঁসানো হয়েছে। বাইরে থেকেও ইন‌ফ্লুয়েন্স ছিল। কথাটা বলতে খারাপ লাগলেও বলতে বাধ্য হচ্ছি, অনিমেষ বসু, আপনার এক্স শ্বশুরমশাই না?‌ মারা গিয়েছেন তো?‌ এই ঘটনার পিছনে ওঁর হাত ছিল। এমনিতেই উনি একজন প্রভাবশালী মানুষ ছিলেন, এই অফিসের একটা গ্রুপের সঙ্গে কোনওভাবে যোগাযোগ হয়। তক্কে-তক্কে ছিলেন। আপনাকে ফাঁসানোর জন্য টাকা‌পয়সা খরচ করেছিলেন কি না, জানি না।”‌

বিধান বলেছিল, “একটু জল খাব।”

সুফল হালদার পাশে রাখা জলের গ্লাস এগিয়ে দিয়েছিল।

“‌অনিমেষ বসু যে আপনাকে পছন্দ করতেন না, আপনাদের বিয়ে পছন্দ করেননি, সেটা কানাঘুষোয় শুনেছিলাম। কিন্তু লোকটা যে এতটা ভিনডিক্টিভ, জানতাম না। খুব খারাপ লোক। মনে হয়, আপনাকে প্যাঁচে ফেলে কবজা করতে চেয়েছিলেন। যাক, ওসব ভুলে যান। উনি মরেছেন, আপনারও ওঁর মেয়ের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছে। পারিবারিক কেচ্ছা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি না হওয়াই ভাল। এবার আপনাকে যা করতে হবে, মন দিয়ে শুনুন। এই কেসে আমরা একটা লোককে জড়াব বলে ঠিক করেছি। ওকে জড়িয়ে আপনাকে বের করে আনার ব্যবস্থা করেছি।”

বিধান বলেছিল, “‌কে?‌”‌

সুফল হালদার এদিক-ওদিক দেখে গলা আরও নামাল, “‌বিকাশ পাত্র, অ্যাকাউন্টসে আপনার টেবিলে বসে কাজ করতেন।”’

“‌ও বিকাশদা?‌ ভালমানুষ। উনি আছেন কেমন?‌”‌

সুফল হালদার চাপা গলায় বলেছিল, “‌রাখুন মশাই ভালমানুষ। হারামজাদা… আমাদের বিরুদ্ধে লোক খেপায়। এমনকী আমার পিছনে পর্যন্ত লেগেছিল। আমি নাকি ম্যানেজমেন্টের দালাল! যাক, আমাদের ঘুঁটি সাজানো হয়ে গিয়েছে। উপরে ফিট করেছি। আপনি শুধু কাল–‌পরশু একটা স্টেটমেন্ট দেবেন।”

বিধান উজ্জ্বল মুখে বলেছিল, “‌কী স্টেটমেন্ট!‌”‌

“লিখবেন বিকাশ পাত্র আমার সই জাল করে বিল সই করত। প্রমাণ আমার কাছে আছে।”‌

বিধান বলেছিল, “‌‌আমার কাছে তো প্রমাণ নেই!‌”‌

সুফল হালদার সোজা হয়ে বলেছিল, “‌না মশাই, আপনি সত্যি বোকা। লোকে এমনি বলত না। প্রমাণ আমরা তৈরি করে ফেলেছি। পুরনো বিল জোগাড় করে, বিকাশ হারামজাদার হাতের লেখা নকল করে আপনার সই জাল করা হয়েছে। ফাইলে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে ফের। সব কাজ গুছিয়ে তারপর আপনাকে ডেকেছি। আমাদের বোকা ভাবার কোনও কারণ নেই।”‌

বিধান ঢোঁক গিলল, “‌কোনও গোলমাল হবে না তো?‌”‌

সুফল হালদার চাপা গলায় ধমকের সুরে বলল, “‌আর কী গোলমাল হবে?‌ ভালমানুষ হওয়ার বিপদ এখনও বোঝেননি?‌ অফিসে তামাশা শুনেছেন, নিজের শ্বশুর ডুবিয়ে দিয়ে গিয়েছে, স্ত্রী ছেড়ে চলে গিয়েছে। ফালতু কথা ছাড়ুন। আমরা শুধু-শুধু এত ঝক্কি নিইনি। আপনাকে চক্কর থেকে বের করে আনলে কর্মীরা বুঝবে সুফল হালদার তাদের পাশে থাকে। বিকাশ পাত্রর হাল দেখে ভয়ও পাবে। এরপর আমাদের বিরোধিতা করার আগে দশবার নয়, একশোবার ভাববে। এক ঢিলে দুই পাখি,”‌ কথা থামিয়ে একটু হাসল সুফল হালদার। ফের বলল, “‌আপনাকে নিয়ে বিজয় উৎসব করব। মালা হবে, গান হবে, ভাষণ হবে। চাইলে আপনি সবাইকে মিষ্টি খাওয়াতে পারবেন। এখন বাড়ি যান। কাল এসে চিঠি জমা দেবেন। ‌কাল ফার্স্ট আওয়ারে আসবেন কিন্তু। মনে থাকবে?”‌

অফিসের পিছনের দরজা দিয়ে বেরোতে-বেরোতে বিধান বিকাশ পাত্রর মুখটা মনে করার চেষ্টা করল। পারল না। কেন এমন হচ্ছে?‌ একটা ভালমানুষের মুখ কেন মনে পড়বে না!

গাড়িতে উঠলে শ্রীজিতা বলল, “‌বাড়িতে যাবে?‌ একবার তোয়ার সঙ্গে দেখা করে যাবে?‌”‌

বিধান অন্যমনস্কভাবে বলল, “না, শরীরটা ভাল লাগছে না। বাড়ি যাব। তুমি আমাকে শিয়ালদা স্টেশনে নামিয়ে দাও। ট্রেন ধরব। গাড়ির পিছনে টবে তোয়ার ফুলগাছটা আছে। মনে করে নামিয়ো।”‌

শিয়ালদা স্টেশন পর্যন্ত গাড়িতে কোনও কথা বলল না শ্রীজিতা। অফিসের ড্রাইভার আছে। গাড়ি থেকে নেমে বলল, “‌কী হল?‌”‌

বিধান বলল, “ওরা একজনের ‌নামে মিথ্যে দোষ চাপাতে বলছে।”‌

শ্রীজিতা বলল, “‌তোমার নামেও তো মিথ্যে দোষ চেপে আছে।”’

বিধান শান্তভাবে বলল, “আমি পারব না শ্রী। কিছুতেই পারব না। তার চেয়ে এই ভাল।”‌

শ্রীজিতা বিধানের হাত ধরে অস্থিরভাবে বলল, “মিথ্যে অপরাধে জেলে যাবে?‌”‌‌

বিধান সামান্য হেসে হাত সরিয়ে নিল। বলল, “‌আমি এখন যাই?‌ ট্রেনের টাইম হয়ে গিয়েছে।”

বিকেলের আলো নামছে। সেই আলো মেখে একটু কুঁজো হয়ে এগিয়ে গেল বিধান। শ্রীজিতার মনে হল, ধুলোমাটি মাখা একটা বোকা আর ভাল মানুষ বুক ফুলিয়ে হেঁটে যাচ্ছে।

___

অধ্যায় ১৩ / ১৩

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন