দীপান্বিতা রায়
ভূত মানিস তোরা?
সামনে রাখা গরম চায়ের কাপটা তুলে ফুঁ দিচ্ছিল পল্টু৷ সুধন্যদার কথা শুনে চমকে গিয়ে চুমুক দিয়ে জিভ পুড়িয়ে ফেলল৷ মানব মুড়ির গামলাটার ভিতরে হাত চালিয়ে বাদাম আর গাঠিয়ার টুকরো খুঁজতে খুঁজতে বলল, দেখিনি তো কখনও৷ তবে আজ শ্রাবণ মাসের অমাবস্যা৷ তারপর সন্ধে থেকে ঝুপঝুপ করে বৃষ্টি পড়ছে৷ এখন এসব কথা না তোলাই ভালো৷ রাতে তো আর থাকতে দেবে না৷ হেঁটে হেঁটে নিজের বাড়িতে ফিরতে হবে৷ পল্টু হতভাগা তো রায়পাড়া ছাড়িয়েই সুট করে নিজের বাড়িতে ঢুকে পড়বে৷ বাকি পথটা আমাকে একলাই যেতে হবে৷ মাঝে আবার চৌধুরীদের মস্ত বাঁশঝাড়খানা…
পরেশ এতক্ষণ চুপচাপ সকালের বাসি খবরের কাগজখানা উল্টেপাল্টে দেখছিল৷ এবার সেটা একপাশে সরিয়ে রেখে বলল, না মানার তো কোনও কারণ নেই৷ আমি অনেকবার ভূতে ধরতে দেখেছি৷ আমাদের এই জিয়লগাছাতেই কুমোর পাড়ায় একবার একটা বউকে ভূতে ধরেছিল৷ সেকি আছাড়ি-পিছাড়ি চিৎকার৷ বাপরে, এখনও মনে পড়লে গায়ে কাঁটা দেয়৷ আর একবার আমার মামার বাড়ি নিতাইপুরে দেখেছিলাম একজনকে ভূতে ধরতে৷ সে অবশ্য চিৎকার-চেঁচামেচি কিছু করছিল না৷ একপাশে বসে শুধু ফিকফিক করে হাসছিল৷ আমরা দূর থেকে দেখছিলাম৷ ছোট ছিলাম তো কাছে যেতে সাহস হয়নি৷ তবে মনে আছে, একবার লোকটা হাসি থামিয়ে আমাদের দিকে তাকাল, করমচার মতো লাল চোখ৷
দেওয়ালে ঝোলানো ছোট আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছিলেন সুধন্যদা৷ বৃষ্টিটা বেশ জোরেই পড়ছিল৷ ছাতা থাকলেও স্টেশন থেকে বাড়ির পথটুকু আসতেই ভিজে গেছেন ভালোমতো৷ রিকশা পাওয়া যায় এখন৷ তবে হেঁটে আসাই সুধন্যর অভ্যাস৷ কলকাতা থেকে ঘণ্টা দেড়েকের দূরত্ব৷ বছর দশেক আগেও একেবারে ঝিঁঝিঁডাকা গ্রাম ছিল জিয়লগাছা৷ এখন কিছুটা বদলেছে৷ লোকজন বেড়েছে, টোটো আর রিকশাও বেশি চোখে পড়ে৷ তবে গ্রামের গন্ধটা এখনও গা থেকে মোছেনি৷ সেজন্য সারাদিন কলকাতার কলেজে ছাত্র পড়িয়ে সন্ধের মুখে ট্রেনটা যখন জিয়লগাছা স্টেশনে এসে দাঁড়ায়, তখন প্ল্যাটফর্মে পা দিয়েই কেমন যেন গা-টা জুড়িয়ে যায় সুধন্য সরকারের৷ বিয়ে-থা করেননি, মা চলে যাওয়ার পর একলা মানুষ৷ তবে একাকীত্ব বোধ তেমন নেই৷ এই আধাগ্রাম জায়গায় এখনও মানুষ বেশ ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকে৷ একে অপরের খোঁজ-খবর নেয়৷ এই পল্টু-পরেশ আর তাদের দলবল তো রোজ সন্ধে হতেই হাজির হয়৷ বাড়ির চাবি একটা ওদের কাছেও থাকে৷ সুধন্যর বলা আছে৷ তিনি বাড়ি না থাকলেও মুড়ি মেখে চা খেতে কোনও অসুবিধা নেই৷ আজ ফিরতে একটু দেরিই হয়ে গেছে সুধন্যর৷ বাড়ি ফিরে দেখলেন তিন মক্কেলই হাজির৷ সাধন আবার মোড়ের দোকান থেকে গরম আলুর চপও নিয়ে এসেছে৷
চুল আঁচড়েü তক্তাপোশের ওপর আরাম করে গুছিয়ে বসলেন সুধন্য৷ বাইরে বৃষ্টি আরও চেপে এসেছে৷ হু-হা করে আলুর চপে কামড় দিতে দিতে পল্টু বলল, হঠাৎ ভূতের কথা কেন বলোতো? তুমি তো জানতাম ভূত-ভগবান কিছুই মানো না৷ মাসিমা চলে যাওয়া ইস্তক ঘরে একটা ঠাকুরের ক্যালেন্ডার অবধি দেখি না…….
মানি কিনা জানি না৷ তবে ভূত দেখেছি ৷
ভূত দেখেছো তুমি! নিজে দেখেছো!
বিস্ময়ে মুখটা হাঁ হয়ে গেছে পল্টুর৷ সাধন আর পরেশও কম অবাক নয়৷ সুধন্যদার সঙ্গে তাদের ওঠা-বসা নাহক পনেরো বছরের৷ এমন কথা তো কখনও শোনেনি৷ পল্টুটা একটু মাথামোটা৷ কিন্তু বাকি দুজন ব্যাপারটা ইয়ার্কি কিনা বোঝার চেষ্টা করছিল৷ যদিও সুধন্যদার মুখ দেখে সেরকম কিছু মনে হচ্ছে না৷ বরং চা-এর কাপে একটা চুমুক দিয়ে বলল, ভূত দেখেছি বলাটা বোধহয় একটু ভুল হল৷ ভূতে ধরা মানুষের ভৌতিক কাজকর্ম দেখেছি বললে ঠিক হবে….শুনতে চাস তোরা?
খোলা জানলার বাইরে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে সাধনের দিকে একটু সরে এল পল্টু৷ পরেশ বলল, বলো না শুনি৷ আজ তো ভূতের গল্প শোনার মতোই পরিবেশ…..
আলুর চপে একটা কামড় দিয়ে সুধন্যদা শুরু করলেন, তখন আমার বয়স বোধহয় বছর সাত-আট৷ তোরা তো জানিস আমি আদতে নদে জেলার লোক৷ আমাদের বাড়ি ছিল শেতলপাটা গ্রামে৷ অজ গ্রাম৷ কৃষ্ণনগর স্টেশনে নেমে বাসে প্রায় ঘন্টা দুয়েক যাওয়ার পর আবার ভ্যান রিকশায় আধঘণ্টা যেতে হত৷ ইদানীং শুনেছি রাস্তা পাকা হয়েছে৷ গ্রামের মুখ পর্যন্ত বাস যায়৷ তখন সেসব কল্পনাও করা যেত না৷ নদিয়ার মাটি উর্বর৷ তাই চাষ হয় ভালো৷ শেতলপাটাও ছিল চাষি প্রধান গ্রাম৷ ধান, পাট আর শীতকালে সরষে, ডাল, নানারকম সবজির চাষ৷ জমি-জায়গা আমাদের ভালোই ছিল৷ তবে আমি যেসময়ের কথা বলছি, তখন আমার দাদু মারা গেছেন৷ বাবা আর কাকা দুজনেই শহরে চাকরি করেন৷ তাই ভাগের লোক দিয়ে চাষ করানোর ব্যবস্থা৷ চাষবাস কিংবা ঘরের কাজকর্ম সবকিছুরই দায়িত্ব ছিল ঠাকুমার৷ তাঁর তখন পঞ্চাশ পেরিয়েছে৷ টকটকে ফর্সা রঙ, খাড়া নাক, মাথার কাঁচাপাকা চুল টান করে একটা খোঁপায় বাঁধা, পরনে সাদা থান৷ ঠাকুমার এই চেহারাটা আমার চোখের ওপর ভাসে৷ অত্যন্ত শক্ত ধাতের, সোজা কথায় বললে রীতিমত দজ্জাল মহিলা ছিলেন তিনি৷ ঘরে-বাইরে সবাই ভয় পেত৷ খানিকটা সেরকম হওয়া বোধহয় দরকারও ছিল৷ কারণ ঠাকুর্দা যখন মারা যান তখন বাবা এবং কাকা দুজনেই ছেলেমানুষ৷ একাহাতে জমি-জায়গা ঘর-সংসার সব সামলাতে হলে কড়া না হয়ে উপায় ছিল না৷ আমার মাও শাশুড়িকে খুবই ভয় পেতেন৷ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কথা বলার মতো সাহস ছিল না৷
ঠাকুমা এমনিতে বেশ উদ্যমী মানুষ ছিলেন৷ সংসারের রোজগার বাড়ানোর জন্য নিজের সাধ্যমত অনেক কিছু করতেন৷ আমাদের বাড়ির পিছনে মস্ত পুকুর ছিল৷ বাঁধানো ঘাট দেওয়া৷ ঘরের কাজকর্ম সব সেই পুকুরেই হত৷ পুকুরের ধার দিয়ে ছিল নারকেল গাছ৷ সেই গাছের ডাব-নারকেল সব বিক্রি হত৷ পুকুরের জলে মাছ চাষ করত ঠাকুমা৷ সেও কিন্তু বিক্রির জন্যই৷ বাড়ির প্রয়োজনে নিয়মিত মাছ ধরার হুকুম ছিল না৷ নিকোনো উঠোনে মস্ত ধানের গোলা থাকত৷ তোরা জানিস কীনা জানি না, ধানের গোলা সবসময় মাটি থেকে হাত-দুয়েক উঁচুতে হয়৷ গোলার নিচের ফাঁকা জায়গাটা বাঁশের চেঁচারি দিয়ে ঘিরে খাঁচা বানিয়ে সেখানে হাঁস-মুরগি পুষত ঠাকুমা৷ নিয়মিত ডিম দিত তারা৷ সকালে ঘুম থেকে উঠে খেজুরপাতার আঁচড়া দিয়ে, খাঁচা থেকে টেনে টেনে ডিম বার করে গুণে গুণে ঝুড়িতে রাখত ঠাকুমা৷ মুসলমান পাড়ার মীনাবিবি এসে ডিম নিয়ে যেত হাটবারে৷ সন্ধে বেলায় পয়সা বুঝিয়ে দিয়ে যেত৷ বাড়ির মধ্যে একমাত্র আমার সপ্তাহে তিনদিন ডিম খাওয়ার হুকুম ছিল৷ সকালে খুদের জাউ বানিয়ে তার সঙ্গে সেদ্ধ ডিম দিত ঠাকুমা নিজে৷
যেসময়ের কথা বলছি, তার বছরখানেক আগেই আমার কাকার বিয়ে হয়েছে৷ কাকিমা ছিলেন মায়ের মতোই গ্রামের মেয়ে৷ তবে মায়ের থেকেও ছোটখাটো, ভালোমানুষ গোছের৷ বিয়েও হয়েছিল বেশ কমবয়সে৷ তাই ঠাকুমার ভয়ে সর্বদা কাঁটা হয়ে থাকতেন৷ কাকা চাকরি করত মধুপুরে৷ মাস দু-তিন পরপর বাড়ি আসত৷
এখানে আমাদের বাড়ির গড়নটা একটু বলে দিলে তোদের গল্পটা বুঝতে সুবিধা হবে৷ মাটির বাড়ি৷ আমাদের ছিল উঁচুপোতার ঘর৷ মাঝখানে মস্ত নিকোনো উঠোন৷ তার একদিকে দাওয়ার ওপর পর পর চারটে ঘর৷ একটা মা-বাবার, একটা কাকার৷ মাঝের ঘরে ঠাকুমার সঙ্গে আমি শুতাম৷ একদম শেষে ভাঁড়ার ঘর৷ তাতে সম্বচ্ছরের জিনিসপত্র থাকত৷ আর সবসময়ের কাজের লোক মানদামাসিরও সেটাই ছিল শোয়া-বসার জায়গা৷ শোবার ঘর থেকে দুধাপ নেমে পাশে রান্নাঘর৷ তারপাশ দিয়ে পুকুরঘাটে যাওয়ার রাস্তা৷ উল্টোদিকে স্নানের ঘর, ধানের গোলা, তুলসী মঞ্চ৷
তখন শীতের শেষাশেষি হবে৷ গ্রামের দিকে ভালো ঠাণ্ডা৷ একদিন রাতে ঘুম ভেঙে গেছে৷ বাইরে যেতে হবে৷ ওরকম রাত-বিরেতে বাইরে যাওয়ার যদি দরকার হয় তার জন্য দাওয়ার একপাশে ছোট ছেলেপিলেদের জন্য ব্যবস্থা করা থাকত৷ তখন একটু বড় হয়েছি৷ তাই ঠাকুমাকে আর ডাকিনি৷ নিজেই দরজার খিল খুলে বেরিয়ে কাজ সারছি৷ তখনও বেশ রাত আছে৷ চারপাশে সরের মতো ঘন কুয়াশার আস্তরণ৷ হঠাৎ মনে হল ধানের গোলার পাশ থেকে কে যেন আসছে৷ শাড়ি পরা একজন কেউ৷ এতরাতে ওদিকে কে গেছিল দেখার জন্য ভাল করে যেই তাকিয়েছি অমনি যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল৷ আমার তো ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা৷ কোনওরকমে তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে লেপের তলায় ঠাকুমার গা ঘেঁষে শুয়ে পড়লাম৷ পরের দিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে শুনি হৈহৈ কাণ্ড৷ রাতে শেয়াল এসে খাঁচা থেকে হাঁস নিয়ে গেছে৷ ফোঁটা ফোঁটা হাঁসের রক্ত পড়ে আছে খাঁচার পাশে৷ শেয়ালের ভয় ছিল বলে ঠাকুমা নিজে প্রতিরাতে হাঁস-মুরগির খাঁচার দরজা বন্ধ করত৷ সেদিনও নাকি করেছিল৷ কিন্তু তাহলে খাঁচা খুলল কী করে? শেয়াল নাকি আবার আমাদের বেড়ার ধারেই বসে বসে হাঁসটাকে খেয়েছে৷ হাড়গোড়, পালক সব পড়ে আছে সেখানে৷ আমার তো শুনে থেকে বুক ঢিপঢিপ৷ ঠাকুমাকে কিছু বলার সাহস ছিল না৷ কাকিমাকে চুপিচুপি গিয়ে বললাম, ও কাকিমা, শেয়াল নয় হাঁসটাকে আসলে ভূতে খেয়েছে৷ কাল রাত্তিরে গোলার ধারে ভূত এসেছিল, আমি দেখেছি৷
কাকিমা এমনিতেই ভিতু মানুষ৷ তাড়াতাড়ি আমার মুখে হাতচাপা দিয়ে বলল, চুপ চুপ এসব কথা বলতে নেই৷ ঘুমের চোখে কী দেখতে কী দেখেছিস৷ ঠাকুমার বয়স হয়েছে তো৷ নিশ্চয় হাঁসের ঘরের দরজা বন্ধ করতে ভুলে গেছিল৷
ব্যাপারটা সেদিনের মতো চাপা পড়ে গেল ঠিকই, কিন্তু কদিন পরেই সকালে আবার মানদামাসির হাঁউমাঁউ চিৎকার৷ প্রকৃতির ডাকে ভোর রাত্তিরে ঘুম ভেঙে বাইরে এসেছিল, আধা অন্ধকারে দেখে ঘোমটা পরা মেয়েমানুষ রান্নাঘরের পাশ দিয়ে যাচ্ছে পুকুরঘাটের দিকে৷ মানদামাসির সাড়া পেয়ে সে নাকি আবার পিছন ফিরে তাকিয়েছিল৷ মাসি স্পষ্ট দেখেছে তার মুখের জায়গায় একখানা শুধু কঙ্কাল, যার চোখ দিয়ে আগুন ঠিকরে বেরোচ্ছে৷ তারপর কী হয়েছে আর জানা নেই৷ কারণ কোনওরকমে ঘরে ঢুকে দরজায় খিল দেওয়ার পরেই মানদামাসির দাঁতকপাটি লেগে যায়৷ সকালে ঠাকুমা যখন তাকে ডাকাডাকি করছে, তখনও নাকি তার গলা দিয়ে বু-বু আওয়াজ বেরোচ্ছিল৷
বাড়িতে এভাবে হঠাৎ অপদেবতার আনাগোনা শুরু হওয়াতে ঠাকুমা খুবই চিন্তায় পড়ে গেল৷ শেতলপাটার পাশের গ্রাম মহিষরেখায় একজন গুণিন থাকতেন৷ মানদামাসিকে সঙ্গে নিয়ে ঠাকুমা একদিন গেল সেই গুণিনের সঙ্গে দেখা করতে৷ ফিরে এল মুখ গম্ভীর করে৷ গুণিন নাকি বলেছে, লক্ষ্মণ দেখে মনে হচ্ছে অপদেবতা রয়েছে বাড়ির ভিতরেই৷ শুনে তো আমাদের সবার হাত-পা পেটের ভিতর সেঁধিয়ে যাওয়ার দশা৷ ঠাকুমা সব ঘরের দেওয়ালে পিটুলি গোলা দিয়ে হরিনাম লিখে দিল৷ সন্ধের পর আর হাত-মুখ ধুতেও কেউ পুকুরঘাটে যাই না৷ এরকমভাবে কয়েকদিন কাটার পর ঘটল এক সর্বনেশে কাণ্ড৷ কদিন ধরেই বৃষ্টি হচ্ছিল৷ সকালে উঠে মানদামাসি দেখে উঠোনের ভেজা মাটিতে লাল লাল ছোপ৷ হাঁসের ঘরের দরজা খোলা৷ ঠাকুমার আদরের সাদা হাঁসি উধাও৷ শেয়ালে যদি হাঁস ধরেও সে তো আর হাঁস মুখে নিয়ে উঠোনের দিকে আসবে না৷ তাহলে দাওয়ার কাছে লাল ছোপ এল কী করে? আমি লক্ষ্য করলাম রান্নাঘরের ভিতরে বসে মানদামাসি ঠাকুমার কানের কাছে কী যেন গুজগুজ করছে আর ঠাকুমার ফর্সা মুখখানা ক্রমশ আষাঢ়ের মেঘের মতো অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে৷
সেই গুজগুজটা ক্রমশ ঠাকুমা আর মানদামাসি থেকে মায়ের মধ্যেও সংক্রমিত হল৷ বাড়িতে সারাক্ষণ কেমন যেন একটা ভয়ের পরিবেশ৷ মা একমুহূর্তের জন্যও আমাকে কাছছাড়া করছে না৷ ছোট হলেও আমি বুঝতে পারছিলাম বাড়ির সবাই কাকিমাকে একটু যেন এড়িয়ে চলছে৷ একদিন দুপুরবেলা কাকিমা যখন স্নানে গেছে, তখন মানদামাসি কাকিমার ঘরে ঢুকে হাতে করে কতগুলো হাঁসের পালক নিয়ে এসে ঠাকুমাকে কী যেন বলল৷ আমি একটু আশ্চর্যই হয়েছিলাম৷ কারণ কাকিমা যে খেলনা বানাবে বলে নানারঙের হাঁসের পালক জমিয়ে রাখে আমি জানতাম৷
সেদিনই রাতে ঘটল এক সাংঘাতিক ঘটনা৷ মাঝরাতে আমার বাইরে যাওয়ার দরকার হল৷ তখন বাড়ির যা পরিস্থিতি তাতে একা যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না৷ তাই ঠাকুমাকে ডাকলাম৷ দু-চারবার ঠেলা দিতে বাধ্য হয়েই ঠাকুমা উঠল৷ সবে দরজা খুলতে যাবে, হঠাৎ খুট করে শব্দ৷ শব্দটা যে কাকিমার ঘরের খিল খোলার সেটা আমিও বুঝতে পেরেছিলাম৷ ঠাকুমা দরজা না খুলে নিঃশব্দে জানলার পাল্লা ফাঁক করল৷ সেদিন বাইরে ফুটফুটে জ্যোৎস্না৷ স্পষ্ট দেখলাম কাকিমা রান্নাঘরের দিক থেকে এসে গোলাঘরের দিকে গেল৷ মুরগির ঘর থেকে অস্পষ্ট ঝটপটানির আওয়াজও শোনা গেল৷ তারপর বেরিয়ে এসে গোলাঘরের পাশে আমগাছের ঝুপসি ছায়ায় দাঁড়িয়ে কী যেন খেতে লাগল৷ ভয়ে তখন আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেছে৷ মনে হচ্ছে যেন মুরগির হাড় চিবানোর কড়মড় শব্দও পাচ্ছি৷ আমার কাঁধের ওপর ঠাকুমার হাতটা ঠকঠক করে কাঁপছে৷ মুখে অস্ফুট রামনাম৷ বেশ আয়েস করে খাওয়া শেষ করে কাকিমা সম্ভবত আঁচানোর জন্য পুকুরঘাটের দিকে যেতেই ঠাকুমা তাড়াতাড়ি জানলার পাল্লা বন্ধ করে দিয়ে আমাকে আড়কোলা করে তুলে সোজা গিয়ে বিছানায় ঢুকল৷
পরদিন সকালেই খবর দেওয়া হল গুণিনকে৷ কাকিমার ঘরে তার আগেই বাইরে থেকে তালা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল৷ গুণিন এসে তালা খুলে ভিতরে ঢুকল৷ তারপর সেকি সর্ষে পোড়া ছোড়া আর ঝাঁটার বাড়ি মারা৷ কাকিমার আছাড়ি-পিছাড়ি কান্না শুনে মাও চোখের জল ধরে রাখতে পারছিল না৷ কিন্তু ঠাকুমার মুখ পাথরের মতো কঠিন৷ সারাদিন এই কাণ্ড চলল৷ সন্ধের মুখে গুণিন বেরিয়ে এসে জানাল অপদেবতা বিদায় হয়েছে৷ তবে বড্ড জবরদস্ত ভূত৷ তাই বউকে সাবধানে রাখতে হবে৷ আজ সারারাত কিছু খেতে দেওয়া চলবে না৷ এমনকী জলও নয়৷ কাল সকালে মাটির সানকিতে পান্তাভাত দিতে হবে৷ টাকা-পয়সা নিয়ে গুণিন চলে গেল৷ কাকিমার ঘরের দরজা সারারাত বন্ধ রইল৷ পরের দিন সকালে কাকিমাকে দেখে আমি শিউরে উঠলাম৷ গোটা গায়ে ঝাঁটার বাড়ির দাগ৷ মুখ ফুলে গেছে৷ চুল ছেঁড়া, এলোমেলো৷ নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতাও যেন নেই৷ মানদামাসি মাটির সানকিতে পান্তাভাত দিয়েছিল৷ কিন্তু খাওয়ার মতো ক্ষমতাও তখন কাকিমার নেই৷ মাটিতে পড়ে আছে প্রায় বেঁহুশ হয়ে৷
দুপুরের আগেই প্রবল জ্বর এল কাকিমার৷ আর বিকেল নাগাদ, পাড়ার কারুর কাছ থেকে খবর পেয়ে, হঠাৎ আমার কাকা এসে হাজির হল৷ অস্বাভাবিক গম্ভীর মুখ৷ ঠাকুমার সঙ্গে ঘরের দরজা বন্ধ করে কিছুক্ষণ কথা হল৷ তারপর বেরিয়ে গেল কাকা৷ ঘণ্টাখানেক পরে ফিরে এসে কাকিমার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল৷ পরেরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আমরা দেখলাম কাকিমার ঘরের দরজা খোলা৷ কাকা-কাকিমা কেউ নেই৷ বাপের বাড়ি থেকে আনা যে তোরঙ্গে কাকিমার নিজস্ব জিনিসপত্র থাকত সেটাও নেই৷
কথা থামিয়ে একমুঠো মুড়ি তুলে নিয়ে চিবোতে লাগলেন সুধন্যদা৷ পল্টু উদগ্রীব হয়ে বলল, তারপর?
তারপর আর কী? সেই শেষ আমার কাকা-কাকিমাকে দেখা৷ আর কোনওদিন ওদের সঙ্গে আমার দেখা হয়নি৷ কাকা আর কোনওদিন শেতলপাটায় ফেরেনি৷ কোনও সন্ধানই আর পাওয়া যায়নি৷
আর কাকিমা? তারও কোনও খবর পাওনি?
প্রায় ঠান্ডা হয়ে যাওয়া চা-এর তলানিটুকু গলায় ঢেলে নিয়ে একটু চুপ করে থাকেন সুধন্যদা৷ তারপর সামান্য হেসে বলেন, আজ সকাল পর্যন্ত হলে, তোদের প্রশ্নের উত্তর হত হ্যাঁ৷ কিন্তু আজ সকালের পর সবই কেমন যেন গোলমাল হয়ে গেল বুঝলি৷ আমাদের কলেজে এক ছোকরা মাস্টার এসেছে পড়াতে৷ ছোকরা মানে আমার থেকে বছর দশেকের ছোট হবে৷ আগে মালদায় ছিল৷ বদলি হয়েছে৷ আজ স্টাফরুমে বসে গল্প করতে করতে শেতলপাটার কথা উঠেছে৷ তা সে হঠাৎ বলে কীনা, ‘আমারও ঠাকুর্দার বাড়ি শুনেছি ছিল শেতলপাটা গ্রামে৷ আমি অবশ্য কখনও যাইনি৷’ শেতলপাটা নিয়ে আমার তো একটু দুর্বলতা আছেই৷ তাই জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ঠাকুর্দার নাম কী?’ সে ছোকরা বলে কীনা হরিমাধব সরকার৷ শুনে তো আমার বুকের মধ্যে ধড়াস ধড়াস করছে৷ জিজ্ঞাসা করলাম, ‘বাপের নাম কী?’ বলল বেণীমাধব সরকার৷ তারপর আর দেরি করিনি বুঝলি, কোনওরকমে বাকি দুটো ক্লাস সেরে তাকে সঙ্গে নিয়ে সোজা গিয়ে হাজির হলাম তার বাড়িতে…পঞ্চাশ বছর পর দেখা৷ বুড়ো হয়ে গেছে৷ কিন্তু কাকার হাসিটা একইরকম আছে বুঝলি৷ যখন প্রণাম করে সামনে দাঁড়ালাম, প্রথমটায় চিনতে পারেনি৷ নাম বলতে থরথর করে কাঁপতে লাগল….
কাকিমাও ছিল নাকি?
ছিল বৈকি৷ জড়িয়ে ধরে কত কাঁদল৷ মায়ের কথা জিজ্ঞাসা করছিল….
যাক তাহলে আর ভূতে ধরেনি৷ তোমাদের শেতলপাটার ওঝার হাতযশ ভালো বলতে হবে৷
পল্টুর কথাটা শুনে একটা করুণ হাসি ফুটল সুধন্যদার মুখে, ভূতে কোনওদিনই ধরেনি রে৷ কাকিমা ছেলেমানুষ ছিল৷ বাপের বাড়িতে আদরে মানুষ৷ ঘনঘন ক্ষিদে পেত৷ ঠাকুমাকে বলার সাহস ছিল না৷ তাই রাতে সকলে শুয়ে পড়লে চুপিচুপি উঠে হাঁস-মুরগির ঘর থেকে ডিম চুরি করে নিয়ে আসত৷ তাড়াহুড়োতে হয়তো আগড় ঠিকমত লাগায়নি, শেয়ালে টেনে নিয়ে গেছে৷
তাহলে ওই যে বললে রক্তের ছোপ….
আলতা পরেছিল৷ আগের দিন রাতে মা আর কাকিমা দুজনে মিলে আলতা পরেছিল৷ সেই আলতারই ছোপ ছিল মাটিতে৷
আমার কিন্তু বিশ্বাস হচ্ছে না সুধন্যদা৷ তুমি নিজেই বললে, জানলার ফাঁক দিয়ে দেখেছ আমগাছের ছায়ায় বসে কী যেন খাচ্ছে?
খাবেই তো৷ ডিম তো চুরি করেছে খাবে বলেই৷ কিন্তু কাঁচা ডিম তো আর খাওয়া যায় না৷ এদিকে রান্নাঘরে ডিম রান্না করতে গেলে ধরা পড়ে যাবে৷ তাই রাতে সবার খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেলে, ডিমের গায়ে মাটি মাখিয়ে ঢুকিয়ে দিত উনুনের ভিতরে৷ গরমে ডিম সিদ্ধ হয়ে থাকত৷ ভোরবেলা উঠে বার করে খেয়ে নিত৷ ভোররাতে আমি আর ঠাকুমা সেটাই দেখেছিলাম৷ তখন তো ধরেই নিয়েছি কাকিমাকে ভূতে ধরেছে তাই মনে হচ্ছিল যেন হাড় ভাঙার কড়মড় আওয়াজও পাচ্ছি৷ কাকা ঠাকুমাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল৷ কিন্তু গ্রামের মানুষ তো৷ বুঝতে রাজি হননি৷ কাকিমা খুব ভয় পেয়েছিল৷ তাই পরদিন ভোরবেলা কাউকে কিছু না বলে কাকিমাকে নিয়ে চলে যায় কাকা৷ কাকিমা আর শেতলপাটায় ফিরতে রাজি হয়নি৷ এতবছর হয়ে গেছে৷ এখনও সেদিনের কথা বলতে গিয়ে শিউরে উঠছিল৷ আসলে ভূত কোথাও থাকে না রে পল্টু৷ জানলার ওপাশে ওই যে অন্ধকারটা, ওটা আসলে আমাদের মনে ঢুকে বসে আছে, তাই আমরা আমাদের চারপাশেও ওরকম একটা অন্ধকারের জগত ভেবে নিই৷ ছেলেমানুষ মেয়ের ক্ষিদের জ্বালাকে ভূত ভেবে ওঝা ডাকি৷ ভূত আসলে আমাদের মনে৷
—
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন