রামধন মিত্তির লেন – ১

নবনীতা দেবসেন

।। রামধন মিত্তির লেন।।

সকালবেলা হাঁটতে বেরিয়ে অত তাড়া করেন না, শ্যামস্কোয়ারে আজকাল বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকেন দেবশংকর। কত বদল হয়ে গিয়েছে পাড়াটার। সারা কলকাতা শহরটাই পালটে যাচ্ছে, সব চেনা চিহ্নগুলো মুছে যাচ্ছে, শ্যামপুকুরই বা কতদিন পুরোনো পোশাকে থাকবে? ওপাশে রাসু মল্লিকদের বাড়িটা ভেঙে ফেলেছে রাসুর ছেলেরা—সবটা নয়, সামনের দিকটা। ভেঙেচুরে সেখানে দোতলা দোকানপাট বসেছে, বড় বড় কাচের শোকেস—একটা বড় হলদিরামের ভুজিয়ার দোকান, দুটো শাড়ির, একটা শার্ট—স্যুটের—আরও হয়েছে একটা, এ. টি. এম. ব্যাংক। রামহরির পানের দোকানটা তাই উঠে গেছে, ব্যাংক—কে জায়গা করে দিতে হবে তো? আজকাল লোকে তত পান খায় না বোধহয়, যত গুটখা খায় আর সিগারেট খায়। দেবশংকর চোখ বন্ধ করে রাসু মল্লিকদের আগেকার বাড়িটার চেহারা ভাবতে চেষ্টা করেন। সেই সরুমতন বেলগাছটা, পাঁচিলের গায়ে ঠেকে থাকা টকটকে লাল গুলঞ্চফুলের থোকা—কাঠচাঁপাও বলে বোধহয় ওগুলোকে—রাসু মল্লিক নাকি বাদুড়বাগানে বিদ্যাসাগর মশাইয়ের বাড়ির বাগান থেকে ডালটা ভেঙে এনে পুঁতেছিল। চমৎকার বেড়ে উঠেছিল, ফুল ধরেছিল গাছটায়। রাসু মল্লিক ওই গাছটার জন্যই নিজেকে বিদ্যেসাগরের উত্তরাধিকারী ভাবতে শুরু করে দিয়েছে বলে ওকে ঠাট্টা করতেন দেবশংকর। রাসু আর দেব এক ইশকুলেই পড়তেন। ওই বাড়ি রাসুর ঠাকুর্দার। চারপুরুষের ভিটে ভেঙে ফেললে রাসুর ছেলেরা? বাড়ির পেছনটাও ভাঙা শুরু হবে নাকি, সোম বলছিল সেদিন। প্রোমোটার ছেলেটিকে চেনে সে—ভূপেন দত্তদেরই এক জামাই। রাসুর ছেলেদেরই বা দোষ দেবেন কী করে—ভূপেন দত্তর নাতিরা অমন প্রাসাদের মতো বাড়িখানা বেচে দিলে? অমন বাড়ি এ তল্লাটে একটাও ছিল না। রোশনচৌকি থেকে শুরু করে নাটমন্দির পর্যন্ত কী ছিল না ভূপেন দত্তদের বাড়িতে? মেয়েদের জন্য পুকুর পর্যন্ত কেটেছিলেন ভূপেন দত্তর বাবা ভবানী দত্ত। ওদের তো গন্ধবণিকের ব্যাপার, পারিবারিক ব্যবসাপাতি ভালোই ছিল, সেই সাহেবদের সময় থেকে। শিবশংকর দত্তর এই বাড়ি তো অত পুরোনো নয়, অত বিশালও নয়। ঠাকুর্দা প্রাণশংকর দত্তর তো পৈতৃক জমিদারি ছিল না। সবই তাঁর নিজের উপার্জিত। হ্যাঁ, পৈতৃক ধনসম্পত্তি পেয়েছেন তাঁরা। প্রভুশংকর, ভবশংকর আর দেবশংকর। তাঁরা উচ্চবিত্ত ঘরেই বড় হয়েছেন। শিবশংকর তাঁদের কোনও অভাব রাখেননি। কিন্তু তাঁদের সন্তানেরা কবে উচ্চবিত্ত থেকে মধ্যবিত্তে নেমে এলেন? প্রভুশংকরের অকালমৃত্যুর পরে দেখা গেল ধনসম্পত্তি যা আছে, তাতে সংসারযাত্রা নিয়ে ভাবনার কিছু নেই। যৌথ পরিবার, যৌথ সম্পত্তি, কিন্তু প্রত্যেক পুত্রের জীবিকা আলাদা, তাঁদের উপার্জনও এক ছিল না। কিন্তু পাঁচ সন্তানকে রেখে ভবশংকর যখন তিরোহিত হলেন তখন দৃশ্যপটে বদল হয়েছে দেখা গেল। ভবশংকরের রেস খেলার গোপন অভ্যাসের শিকার হয়েছে গোটা দত্ত পরিবার।

রামধন মিত্তির লেনে দুটি পুরোনো দত্তবাড়ি ছিল। প্রাণশংকর দত্ত আর ভূপেন্দ্রমোহন দত্তের। ভূপেন দত্তের নাতিরা দেবশংকরকে কাকাবাবু বলে ডাকে। চমৎকার ছেলেগুলো। এমনকি তারাও বসতবাড়ি বেচে দিচ্ছে। উপায় নেই।—”সংসারে মানুষের সংখ্যা যত বাড়ছে, প্রয়োজনের বোঝাটাও ততই ভারী হচ্ছে। লোভের আর সীমা—পরিসীমা থাকছে না। আর যত ঝোঁক সব গিয়ে পড়ছে ওই বোবা সাতপুরুষের বাস্তুভিটের ওপরে!” সরমা বলেন। দেবশংকরের চেয়ে দু’ বছরের ছোটো ছেলে হলে কি হবে—বাড়ির বড়গিন্নি তো ঐ সরমাই। আর চিরকুমার দেবশংকর যেন চিরকিশোরই থেকে গেছেন, তাঁর এস্রাজটি কোলে করে।— ”বাস্তুভিটে ভেঙেচুরে গুঁড়িয়ে ফেলে এ সে কী রাজার ঐশ্বর্য সংগ্রহ হচ্ছে বুঝিনে বাবু! এতে ছেলেপুলের অমঙ্গল হয়। আমাদের রামধন মিত্তির লেনের বাড়িতে এতবড় অমঙ্গল ঢুকতে দেব না।”—খুব বড় মুখ করে এতদিন বলতেন সরমা। ইদানীং আর বলছেন না। সোমশংকরকে ‘আদেশ’ করে তার দুই ভাই প্রোমোটার ডেকে এনে বাড়ি দেখিয়েছে। প্রোমোটারও তার যেটুকু কর্তব্য, সেটুকু সম্পন্ন করেছে। অর্থাৎ প্রবল লোভ দেখিয়েছে—এমনই প্রবল সেই লোভনীয় প্রস্তাবটি যে দেবশংকরও স্তব্ধ হয়ে গেছেন।

।। সরমা ।।

এ বাড়িতে বৌ হয়ে এসেছিলুম, সেও প্রায় পঁয়ষট্টি বছর হতে চলল। জীবনের এতগুলো বছর কেটে গেল যেখানে সেই বাড়ি ছেড়ে কি অন্যত্র যেতে পারা সহজ? কিন্তু যতদিন না নতুন করে ফ্ল্যাটবাড়ি তৈরি হচ্ছে ততদিন আমাদের অন্য জায়গায় থাকতে হবে—আলাদা—আলাদা ফ্ল্যাট দিচ্ছে আমাদের থাকবার জন্য ওই কুন্দলিয়া। আলাদা বাসা। কে থাকবে কোথায়? কার সঙ্গে? মেজো তো থাকবে রবির কাছে কেয়াতলায়। রবি অবশ্য আমাদেরও বলেছে। ওর তিনতলায় দুটো ঘর ছেড়ে দেবে। ঠাকুরপোকে আর আমাকে। কিন্তু সোমু—বরুণাকে যেতে হবে ফ্ল্যাটে—তিনজনের গোটা ফ্যামিলিকে ওখানে রাখবার বন্দোবস্ত নেই তার। পদ্ম আর সুব্রতাকেও একখানা ঘর দেবে বলছে তো। ললিতা অবশ্য বলছে, আরেকখানা ঘর হলেই তো কষ্ট করে সোমুরা থাকতে পারবে। গোটা রামধন মিত্তির লেনই যদি কেয়াতলায় উঠে গেল, তাহলে আর রবি—ললিতার আলাদা থাকাটা হবে কেমন করে? ঠাকুরপো এই কথা বলছে আর মুচকি মুচকি হাসছে। সোমু—বরুণা যাবে না। আর আমি যেখানেই যাবো, পদ্মকে আমার সঙ্গে করে নিয়ে যাবো। ও বেচারিকে আলাদা ফ্ল্যাটে থাকতে দেওয়ার প্রশ্ন ওঠে না—সুব্রতা তো এখানে নেই। নিজের দেখাশোনা করবার শক্তি পদ্মের আর নেই। ওকে চব্বিশ ঘণ্টা খেয়াল রাখা দরকার।

পাঁচ পুরুষের বসতবাড়ি, এই রামধন মিত্তির লেনের দত্ত বাড়ি। কী বলে এ বাড়ি ভাঙতে মনস্থ করলে আমাদের ছেলেরা? কী অসুবিধে হচ্ছিল তাদের? এখানে তো তাদের থাকতে হচ্ছে না। আমরা যারা এ বাড়িতে বসবাস করি—এ বাড়ির বাসিন্দা যারা, যেমন ধরো ঠাকুরপো, সোমু—বরুণা সুমন, পদ্ম—সুব্রতা, আমি আর রাধামাধব—আমাদের তো কোনও অসুবিধে হচ্ছিল না? আমাদের বাড়ি—বেচার টাকাও প্রয়োজন নেই—ঠাকুরপোর সামনের হপ্তায় আশি বছর হবে—দু’এক বছর বাদেই আমারও। তারপর মেজোর—আমাদের কোনো দরকারই ছিল না তড়িঘড়ি ভিটেমাটি বেচে দেবার। বলতে নেই, ছেলেরা আমাদের কেউ তো মন্দ নেই—মণির দুবাইতে ব্যবসা বেশ ভালো, দীপের টেকসাসে ডাক্তারি খুবই জমজমাট, ওর বৌটি, জুডিও ডাক্তার। আর এখানে রবির তো কোর্টে বোলবোলাও সবাই দেখতে পাচ্ছে। তবে টাকাটা দরকার ছিল কার? সোমু—বরুণার? ওরা তো কোনো অভিযোগ করেনি—দিব্যি আছে। সুমনদাদা এ বাড়ির একটা মাত্র ছেলে—ওর জ্যাঠারা প্রত্যেকে ওর জন্যে করতে ব্যাকুল। সিনেমার ছবি তোলার কাজ শিখেছে সে, ভালো করে পাশ করেছে, কাজকর্মও পাচ্ছে। তার জ্যাঠা—জেঠি তাই দুবাই থেকে খুব দামি একটা ক্যামেরা এনে দিলে, যাতে সুমনের কাজের সুবিধে হয়। জুডিও আমেরিকা থেকে বরুণাকে একখানা মাইক্রোওয়েভ ওভেন এনে দিয়েছে। ওঃ, আবার ভুল বললুম। ওভেন নয়, আভেন। সুব্রতা আমাকে পাখিপড়া করে শিখিয়েছে—”বড়মা, আভেন, বল? আ—ভেন, ওভেন বলবে না।”

 ফ্ল্যাটে থাকাটা বছর দেড়েক—যতদিন এ বাড়ি তৈরি না হচ্ছে, শুধু ততদিনই। বদলি ঠাঁই। সোমুর আর বরুণার মাইনে মিলে খুব কম নয়। ওদের থাকার জন্যে যে ফ্ল্যাটটা, তার ভাড়া ওই কন্ট্রাকটরই দিয়ে দেবে। শুধু সংসারখরচটুকু নিজের। বরুণা ফ্ল্যাটে যেতে ভয় পাচ্ছে অন্য কারণে। এ বাড়িতে আমরা আর পাঁচজনে একত্তর আছি, সোমুর আজন্মের পাড়াপ্রতিবেশীরা আছে, এখেনে সোমুর সময় কাটানো সহজ। নতুন জায়গায় গিয়ে নতুন পরিবেশে, একা একা ওর আবার না পুরোনো অভ্যেসটা ফিরে আসে। অনেক কষ্টে, অনেক চেষ্টা করে, অভ্যেসটা ছাড়াচ্ছে ওর, বরুণা। এখনই একটা অদলবদল, নাড়াচাড়া ঠিক হবে না। আমি ভাবছি, রবির ওখানে না গিয়ে আমরা বরং একটু বড় একখানা বা পাশাপাশি দু’খানা ফ্ল্যাট নিয়ে সোমুর কাছাকাছিই থাকি। মামণি, ছোটকাকে হাতের কাছে পেলে বরুণাও মনে জোর পাবে। সোমুর স্বভাবটা পালটানো খুব জরুরি। ওর তো রক্তের মধ্যে অনিয়ম আছে। মেজোবাবুর রেসের নেশা ছিল। আমার শ্বশুরমশাইয়েরও স্বভাবের সুনাম ছিল না। সোমুর তো ওসব নেই—শুধু ঐ নেশা—সোমুকে সামলে রাখা আমাদের সকলেরই সমান দায়িত্ব। বরুণার তো একার সমস্যা নয় ওটা। এই সময়ে পরিবারটা ছিঁড়েখুঁড়ে যাক, এটা আমি একদম চাইছি না। যারা এই বন্দোবস্তের মূলে—রবি, দীপ আর আমার ছেলে মণি—তারা কেউই আর এ বাড়িতে বাস করে না। দুজন তো মোটে এদেশেই বাস করে না, আর রবি তো অনেকদিন আগেই বাড়ি ছেড়েছে। ওদের কিসের এত তাড়া, এত তাগিদ ছিল বাড়ি ভাঙবার? রবিই ওদের এইসব ইচ্ছের মূলে—সেই দেশে থাকে। খোঁজখবর রাখে। সে—ই বুদ্ধি জুগিয়েছে ভাইদের। ঠাকুরপোর মত ছিল না, আমারও মত ছিল না। আর বাড়িটা শ্বশুরমশাই নাতিদের দিয়ে যাননি—বাড়ি আমাদের তিনজনের। দুই ছেলের বউ, আর ছোটছেলের। কিন্তু মেজো এই বাড়ি বিক্রির ব্যাপারে নেচে উঠেছে—ঠিক কেন, বুঝতে পারছি না। দুটো করে ফ্ল্যাট, আর থোক কিছু টাকা পাবো আমরা। ফ্ল্যাটের বদলে টাকাও নেওয়া যায়। মেজো বোধহয় সেইটাই চায়—সে আর কতটুকুই বা হবে? মেজো কেবল আমাকে বোঝাচ্ছে, ”তোমরা তো বুড়ো হচ্ছো, কেমন করে থাকবে এত বড় বাড়িতে? বাড়ির মেনটেনান্স এবং মেরামতি, নিত্যিকার দেখাশুনোতেই কত খরচ। চাকরবাকরের পেছনেই কি খরচ কম? তারপর যখন হাঁটুর ব্যথা বাড়বে, আমারই মতন তুমিও আর সিঁড়ি দিয়ে উঠতে পারবে না, তখন কী করবে? লিফট লাগবে? রাধামাধবের পুজোও হবে না, ঠাকুরপোর রেওয়াজও হবে না—তোমরা ছাদে উঠবে কেমন করে? ক’দিন বাদেই তো হাঁটু ধরে যাবে আমারই মতন। ছোট ফ্ল্যাটে বাস করতে ঢের সুবিধে বুড়ো বয়সে। রবি, দীপু, মণি অনেক ভেবেচিন্তেই এটার ব্যবস্থা করেছে। তোমরা আর ‘না’ কোরো না বাপু! সোমুর পক্ষেও ভালো হবে। একটা আলাদা ফ্ল্যাটে গুছিয়ে সংসার করবে—বরুণার তো নিজের মতন করে ঘর—সংসার করাই হল না, শ্বশুর—শাশুড়ির সংসারেই দিন কাটাল বেচারি।” …এদিকে বরুণা কিন্তু উলটো কথাই বলে। বরুণা বলে, এ বাড়িতে আছে বলেই দুজনে আপিসের ভাত খেয়ে দৌড়ে বেরিয়ে যেতে পারে, জানে সুমনের ইশকুল, তার টিফিন, সবই ঠিকঠাক হয়ে যাবে—এ বাড়িতে তাদের ছেলের যত্ন করার লোকের অভাব নেই। মেজোর ক্ষমতা আছে বাবা সব কিছু উলটো দিক থেকে দেখবার।

এ আমার দাদাশ্বশুরের তৈরি বাড়ি। প্রাণশংকর দত্তের ছেলে শিবশংকর আমাদের শ্বশুরমশাই। তাঁর বড়ছেলে প্রভুশংকরের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছিল। মেজো ভবশংকর ছিলে পিঠোপিঠি—আমার চেয়ে অনেকটা বড়। আমি তাই ওঁকে মেজোবাবু বলে ডাকতুম, আপনি—আজ্ঞে করতুম। মেজোবাবুও স্নেহ করে আমাদের ডাকতেন বড়বউ বলে। ঠাকুরপোর সঙ্গে আমাদের বয়সের তফাত বেশি নয়—বছর দুয়েকের। একই সঙ্গে বিয়ে হয়ে এ বাড়িতে এসেছি দুই জায়ে। আমার মণির সঙ্গে ওর রবির বয়সের তফাৎ খুব একটা বেশি নয়। ওরা তখন খুবই ছোট, উনি হঠাৎ চলে গেলেন। মেজোবাবুর আর ছোটবাবুর আদরে অবিশ্যি মণি কখনও বাপের অভাব বুঝতে পারেনি। শাশুড়ি—মা ছেলে হারিয়ে আমাকে তো অপয়া বলে দুষলেনই না, বরং পক্ষিমাতার মতো আমাকে আড়াল করে রইলেন। আমার মাথার চুল ছাঁটতে দিলেন না—গলার হার, হাতে দু’গাছি সোনার চুড়ি রেখে দিলেন। সরুপাড়ের শাড়ি আনালেন তাঁতিকে দিয়ে, থান পরা চলবে না। নিরিমিষ্যি হেঁশেলে আমি খাবো, আর উনি মাছ? এটাও মার সইল না। মা আমার সঙ্গে নিরিমিষ্যি খাওয়া ধরলেন—কেবল এয়োস্ত্রী মানুষ বলে একাদশীর দিনে মাছ—ভাত খেতেন। আমাদের দেখাদেখি ছোটবাবুও এসে নিরিমিষ্যি হেঁশেলে ভর্তি হয়ে গেল—কারুর কোনও কথাই শুনল না। পাগলা ছিল সেই ছোট থেকেই। শ্বশুরমশাই হাজারটা সম্বন্ধ করেও কিছুতেই ছোটছেলের বিয়ে দিতে পারলেন না—বিয়ে—থা না—করে গানবাজনা নিয়ে, আধাসন্নিসি হয়ে জীবনটা কাটিয়ে দিলে। ছোটবৌ এসে পাছে মেজো বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া করে, এই ভয়ে নাকি সে বিয়ে করেনি—বাড়ির শান্তি নষ্ট করে যদি? বাড়ির শান্তি নষ্ট করতে মেজো একলাই যথেষ্ট। ছোটবেলায় এরকম ছিল না, আস্তে আস্তে কেমন যেন বদলে গেল। মেজো সাজতে—গুজতে ভালোবাসতো, গয়নাগাঁটি, কাপড়চোপড়, রূপটান মাখতে ভালোবাসতো। খাটাখাটনি পছন্দ ছিল না, নিজের বাচ্চাকাচ্চাও নিজে মানুষ করেনি সে। গায়ে ফুঁ দিয়ে সেজেগুজে পান মুখে দিয়ে হেসে হেসে বাড়িময় ঘুরতো—কাজ করতে বললেই শুয়ে পড়তো মাথা ধরেছে বলে। আলসে স্বভাবটি ছাড়া তেমন বড় কোনও দোষ ছিল না স্বভাবে। সংসারে তার মোট চারটে কাজ ছিল। পান সাজা, তুলসীতলায় সন্ধে দেওয়া, নিজের ছেলে—মেয়েদের বুকের দুধ দেওয়া আর শ্বশুরমশাইয়ের পা টিপে দেওয়া। তার প্রধান কাজ ছিল সেটাই। রান্নাঘরেই ঢুকত না। কিবা আঁশ, কিবা নিরিমিষ্যি। কেন জানি না, শাশুড়ি—মাও ওকে কিছু বলতেন না। শাশুড়ি আমাকে বলতেন, ”তুই তো আমার বৌ নোস, তুই আমার মেয়ে।” খুব মেয়ের শখ ছিল তাঁর। আমি তাঁর স্নেহের যোগ্য হবার চেষ্টা করে চলেছি সারাজীবন। তাঁর ছেলেদের সামনে চলেছি যথাসাধ্য। এ বাড়িতে সংসারী শুধু ছিলেন মেজোবাবুই। বাবা—মা, পুত্র—কন্যা, বিধবা বউদি, খ্যাপাটে ছোটভাই আর স্ত্রীকে নিয়ে তাঁরই তো ছিল গমগমে ভরন্ত সংসার। অথচ মেজো কোনোদিনই সে—সংসারের গিন্নি হল না, গা করল না, চিরটা কাল কাজ এড়িয়ে, দায়িত্ব এড়িয়ে পালিয়ে বেড়াল। ওর পালানো একরকমের, ছোটবাবুর আরেক । মেজোর জন্যে আমার কষ্ট হত। সধবা মেয়ে। পাঁচ সন্তানের মা! শ্বশুরমশাইয়ের চোখের মণি। তবুও মেজোর সুখ ছিল কি? নইলে নিজের মেয়ের স্বামীসুখে কেউ হিংসে করে? আমার তো মাঝে মাঝে মনে হত মেজো বুঝি পাগলামি করছে। পদ্ম যে তুষারের জন্যে, সূয্যির জন্যে ওকেই দুষী করে—সেটা তো ভুল নয়। চিঠিতে তো তুষার পষ্টাপষ্টি লিখেই গিয়েছিল। ও আর শাশুড়ির এত অত্যেচার, এত অপমান সইতে পারছে না। পদ্ম কি তা ভুলতে পারে? সূয্যি তো বাড়ি থেকে বেরিয়ে চলে গেল! পদ্ম কাঁদছে, মেজো বললে, ”দ্যাখো গে, সে কোন জেলে ঢুকে বসে আছে—যেমন ছেলে হয়েছে তোমার!”—শুনে বিশ্বাস হয় না, দিদিমা বলছে নিজের নাতির সম্বন্ধে! আঠারো বছরের ছেলে, কতটুকুনি ছিল সূয্যি? আস্তে আস্তে মেজোর জিবের ডগায় কোথা থেকে যে অত বিষ এসে জমল! আর সবটুকুই ঢালতো মেয়ে—জামাই আর নাতির ওপর। ছেলেবউদের বেলায় কিন্তু অমন করতে দেখেনি। বৌ—খ্যাদানি শাশুড়ি নয় মোটেই মেজো। ওর যত বিদ্বেষ, যত ক্রোধ ঐ পদ্মা—যমুনা দুটো মেয়ের ওপরে। বংশের প্রথম মেয়ে ওরা, আমার শাশুড়ি খুব আদর করতেন পদ্মকে। পদ্মফুলের মতন দেখতে বলে ওর নাম রাখলেন পদ্মাবতী। বড্ড ফুটফুটে সুন্দর ছিল পদ্মটা। মেজো নিজেও যে ভারি লাবণ্যময়ী, মা দুগ্গার মতন লক্ষ্মীশ্রী, পানপাতার গড়নের মুখখানি, বড় বড় ভাসাভাসা দুটি চোখ, কাটা কাটা ঠোঁট, নাক, চিবুক—রংটিই কেবল একটু চাপা। পদ্ম ওর বাপের রং পেয়েছে। —আমার শ্বশুরবংশের সকলেই ধবধবে ফর্সা—শুধু রবি, দীপু আর যমুনাবতী ওদের মায়ের রং পেয়েছে। তা ছেলেদের গায়ের রং শ্যামলা হলে আমার তো বেশ ভালোই লাগে। পুরুষমানুষ তো? রং দিয়ে করবে কী? মেজোবাবুর জীবনে শান্তি ছিল না—ওদের স্বামী—স্ত্রী দুজনের মধ্যে ঠিক বুঝদারিই হয়নি মনে হয়। মেজোবাবুর মাঝবয়সে হঠাৎ কেন যে অমন ঘোড়ারোগ ধরল—উদ্বেগে উদ্বেগেই একদিন হঠাৎ মারা গেলেন। নেশা ওদের রক্তে।

তখনও শ্বশুরমশাই বেঁচে। শাশুড়িকে তবু মেজো ছেলের মৃত্যু দেখতে হয়নি, পুণ্যবতী স্বামীর কোলে মাথা রেখেই যেতে পেরেছিলেন। সোমু, যমুনা তখনও জন্মায়নি। সোমু বংশের ধারা পেয়ে ধবধবে ফর্সা হল, যমুনা কিন্তু মায়ের রং পেয়েছে। মায়ের লক্ষ্মীশ্রী রূপ—লাবণ্যটি পেয়েছে সে। যমুনাকে রং নিয়ে কম খোঁটা দিয়েছে মেজো? নিজের কালো রং নিয়ে যমুনাকে সেই কচি বয়েস থেকেই মায়ের মুখে অকথা—কুকথা শুনতে হয়েছে। জানি না, নিজে মেয়েমানুষ হয়েও মেজো নিজের পেটের মেয়েদুটোর ওপর এমনধারা খড়্গহস্ত কেন যে? এখন তার চরম রূপ বেরিয়েছে—বাড়ি ভাগাভাগি হচ্ছে, মেজো তিন ছেলেকেই দিতে চায় সম্পত্তির ভাগ, কিন্তু মেয়েদের দেবে না। আমি অবাক হয়ে ভাবছি, রাধামাধবের এ কী লীলা! একটা মানুষের মধ্যে এতগুলো গেরো পাকিয়ে দিয়েছেন কেন? রবি—দীপু—মণি—এদের কোনও অভাব নেই,—আর পদ্মা—যমুনা কারুরই মাথার উপর ছাদ নেই। একজন থাকে তার মা’র বাপের বাড়িতে, আর একজন শ্বশুরের ভাড়া বাড়িতে। বাড়ির দরকারটা আগে ওদেরই। মেজো অনড়। মেয়েদের আবার সম্পত্তি কী? বিয়ে দিয়েছি—সেই শেষ। ছোটবাবু বলেছেন ওঁর ফ্ল্যাট দুটো উনি পদ্মা—যমুনা দুই বোনকে দিয়ে দেবেন। বুড়ো বয়েসে ওঁর আলাদা থেকে কী হবে? এই আমার কাছেই থাকবেন, এখন যেমনটি আছি আমরা দুজনে। আমারটিতে আমরাই থাকব—এখনই তো মণিকে দেব না। বিবির কথাগুলো আমার কানে বাজে—রামধন মিত্তির লেনে থাকা ওর পোষায় না—বড্ড সরু সরু অলিগলি, বড্ড গায়ে গায়ে সব বাড়ি, আর আরো গায়ে—পড়া পাড়ার লোকজন। নিজেদের ফ্ল্যাট—নইলে হোটেলেই ওদের বেশি আরাম। নিজের মতো করে থাকা যায়। এসব কথা বিবিই আমাকে বলে গেছে ওরা শেষ যেবারে এসেছিল, ঐ রবি—ললিতাদের বিবাহ জয়ন্তীতে। বিবি বলেছিল—”ছুটি মানে ছুটিই, শ্বশুরবাড়িতে কর্তব্য করতে যাওয়াকে ছুটি বলে না, মা। আমাদের প্রত্যেক বছর কলকাতায় আসা সম্ভব নয়—এতে আমাদের স্ট্রেন হয়, ছুটি হয় না। সামনের ছুটিতে আমরা ফিজিদ্বীপে হলিডে করতে যাচ্ছি।” না, মণি, কেন বাড়ি বেচে দিয়ে টাকা চাইছে জানি না—বাড়ি বিক্রি হলেও এই ফ্ল্যাট তো মণি এখনই পাবে না। আমি বিদেয় হলে, তবে। বিবি লোভী মেয়ে নয়—ওকে আপনমনে থাকতে দিলেই হল। কারুর সাতে—পাঁচে থাকতে চায় না ও। আমাদের বাড়ির বৌভাগ্যি ভালো, ললিতা চমৎকার মেয়ে—বাড়ির বড়বৌ হবার সব গুণগুলো ওর আছে—ওকে আলাদা বাড়িতে তুলে নিয়ে গেল রবিই—ললিতার শখে যায়নি সে। ওর ও পাড়াতে থাকলে প্র্যাকটিসের নাকি সুবিধে—এই অলিগলির পাড়াটা সত্যি ফ্যাশানেবল নেইকো আর। আমি তো ভালোই আছি এখানে, সোমুকে নিয়ে, বরুণাকে নিয়ে। ছোটবাবু আর পদ্মকে সামলে। সুমনদাদা আর মুন্নুদিদিকে কোলে কাঁখে করে তো ভালোই কেটেছে আমার দিন, রাধামাধবের দয়ায়। কিন্ত এখন একটা বড় অদলবদল আসছে। জানি না সেটা কেমন ধারা হবে।

জীবন তো নানারকম ঢেউ—তরঙ্গের দোলায় দুলিয়েই চলেছে আমাদের। শাশুড়ি—মা বলতেন, ”সমুদ্রের ঢেউ চব্বিশ ঘণ্টাই আছড়ে পড়বে কখনও জোয়ারে, কখনও ভাঁটায়, এটুকু তফাত। যদি ভাবো, আগে তো সমুদ্রের ঢেউ থেমে যাক, তারপরে শান্তিতে চান করতে নামবো—তাহলে এ জীবনে তোমার সমুদ্দুরে চান করা আর হবে না।” জীবনও তাই। সমানেই ধাক্কা আসবে, কখনও বড় কখনও ছোট। যদি ভাবো, বেঁচে থাকবো, কিন্তু ধাক্কা খাবো না—তা হবার নয়। ওটা বেঁচে থাকার অঙ্গ। ওরই মধ্যে মাথা ঠান্ডা রেখে, সাহসে বুক বেঁধে, সবাইকে ভালোবেসে, ক্ষ্যামাঘেন্না করে, সবাইকে নিয়ে পথ চলতে হবে। ”যখন সব কিছু শান্ত হয়ে যাবে, তখনই বাঁচবো”—এটা তো বলা যায় না? সবাই তোমার মনের মতো হয়ে চলবে না। সব কিছু তোমার মঙ্গলময় বলেও মনে হবে না, তবু তোমাকে মানিয়ে নিতে হবে—এখন যেটা মনে হচ্ছে অমঙ্গলের, পরে দেখবে তা থেকেই মঙ্গল উঠে আসছে। ছোটবেলায় বিধবা হয়েছিলুম বলে শাশুড়ি—মা আদর দিয়ে সেই শূন্যতা ভরিয়ে দিতে চেষ্টা করতেন। তাঁদের অকালে পুত্রশোক আমিও ভোলাতে চেষ্টা করতুম, আমার সেবাযত্নে, আমার শ্রদ্ধা ভালোবাসায় তাদের কাছে তো এটুকুই শিখেছি।

কোনোদিনও ভাবিনি এমন করে আমাকে কখনও বিষয়—সম্পত্তির ভাবনা ভাবতে হবে। যে গেট দিয়ে বৌ হয়ে ঢুকেছি, সেই গেটটা দিয়ে খাটে চড়ে রেবুব—এরকমই ধরে নিয়েছিলুম। কপাল—দোষে তা আর হবে না। ঠিকানাটা বদলাবে না বটে, বাসস্থানটা কিন্তু পালটে যাচ্ছে। আমার ঠাকুরঘর, আমার আঁশ—নিরিমিষ হেঁশেল, আমার ভাঁড়ার, আমার উঠোন, খিড়কিবাগান থেকে পুজোর ফুল তোলা—সব মুছে ঘুচে গেছে কাঁচড়াপাড়ার বাপের বাড়ি। আমার এই আঁতুড়ঘরে আমার দিদিশাশুড়িরও আঁতুড় উঠেছিল, আমাদেরও—সেই আঁতুড়ঘরটাকেও ওরা গুঁড়িয়ে দেবে। রাধামাধবের চার—পুরুষের মন্দিরটা গুঁড়িয়ে মাটিতে মিশিয়ে দেবে। অবিশ্যি প্রোমোটার ছোকরা বলেছে ছাদের ওপরে বানিয়ে দেবে নতুন করে রাধামাধবের ঘর। লিফটে করে ওঠা যাবে। আর রবি বলেছে—”এখন কেউ আঁতুড়ঘরে যায় না, যায় নার্সিংহোমে। আঁতুড়ঘর নিয়ে দুঃখু কোরো না, মামণি।” কিন্তু দুঃখুটা কি আসলে ঘরগুলোর জন্যে? কী জানি কিসের জন্যে? এই মার্বেল পাথরের শাদাকালো চৌখুপি ঘরকাটা ভেতরদালানে ভেলভেটের আসন পেতে আমার শ্বশুরমশাই খেতে বসতেন। শাশুড়ি—মা পাখা হাতে সামনে বসতেন। ঘোমটা টেনে আমি পরিবেশন করতুম। ওঁরা তিনভাই যখন বসতেন, তখন শাশুড়ি—মা নিজেই ওঁদের পরিবেশন করতে ভালোবাসতেন। ছেলেদের যত্নআত্তি নিজের হাতে রাখতেন। অতবড় ছাদে আমাদের ভিজে কাপড় শুকোতো। বড়ি—কাঁঠালবিচি শুকোতো। আচার—আমসত্ত্ব শুকোতো। উঠোনে জল দেওয়া হত টিনের ওপর। পুরুষমানুষরা দিনেরবেলা ছাদে উঠতেন না, ছাদটা ছিল শুধু আমাদের মেয়েমহলের জায়গা। এবাড়ি—ওবাড়ির মেয়ে—বউরা সবাই বিকেলবেলায় গা ধুয়ে, চুল বেঁধে, ছাদে উঠে আমরা গল্পগাছা করতুম। সেই ছাদের ওপর আরও চারটে তলা উঠবে। শুনেছি চব্বিশটা ফ্ল্যাট হবে, মস্ত মস্ত। কেমন করে মস্ত হয়? বাড়ি তো একখানি! আজকালকার ছোট—বড়র হিসেব আমার মাথায় ঢোকে না। বিবি বলে, এ বাড়িটাতে ওর দম আটকে আসে। এত বড় বাড়িতে ওর দম আটকে আসে? আর ওই তিন কামরার ফ্ল্যাটে প্রাণ ভরে নিঃশেষ নিতে পারে? পারে নিশ্চয়ই। এব বছর ধরে বড় বাড়ির বউ হয়ে কাটিয়ে শুধু একটা জিনিসই বুঝেছি। আমার শাশুড়ি—মা আমাকে যেটি শিখিয়ে গেছেন। নিজে তিন খুব সুখী মানুষ ছিলেন না।—স্বামী বারমুখো চিরটা কাল। ঘরের মধ্যে অনেক অসৈরণ সয়েছেন, দেখেছেন, জোয়ান ছেলেকে হারিয়েছেন, তবু একটা জিনিস তিনি শেখাতে পেরেছেন আমাকে। মানুষ ভালোবাসার দাস। ধর্ম, অর্থ, কাম কোনোটাই আসলে বড় নয়। শেষপর্যন্ত মানুষ চায় ভালোবাসা। শ্বশুরমশাইও যাবার আগে সেটা পেয়েছিলেন। আমার কেবল মনে হয় মেজো সেই ব্যপারাটাই আজও টের পেলো না। আমিও কি পেরেছি? ঠিকঠাক বুঝতে পেরেছি কি আমিও? কেবল ছোটবাবুকে দেখি, আর ভাবি। ভাবি, এ দেনা কি জন্ম—জন্মান্তরেও মেটাতে পারবো? পঁয়ষট্টি বছর একসঙ্গে, একভাবে কেটে গেল। একটি বারের জন্যেও তার ভুল হলো না। নামে দেব কাজেও দেবতুল্য। আজকাল, একলা বসে জপ করতে করতে হঠাৎ মনে হয়—ভুলটা কি তবে আমিই করলুম? করে চলেছি, জীবনভোর? হে রাধামাধব!

।। সুমন ।।

অনেস্টলি স্পিকিং, দিদিটা যে এসে পড়েছে, এটা মস্ত ব্যাপার। আমি বড্ড মিস করি দিদিকে। বাড়িতে কথা বলবার তেমন কোনও লোকই নেই এখন। অবশ্য দাদুভাই আর বড়মা, দুজনেই বেশ ইন্টারেস্টিং মানুষ—যে যুগের লোক ওরা, সেই তুলনায় দারুণ স্মার্ট কিন্তু। এই যে আমার সিনেমাটোগ্রাফির কাজকর্ম, সেই বিষয়ে—জীবনেও সিনেমা দেখে না যে, সেই বড়মা কিন্তু খুব ইন্টারেস্ট নিয়ে প্রশ্নটশ্ন করে। বুঝতেও পারে। সেদিন বলছে, ”পথের পাঁচালী”—তে দেখেছিল বটে ফটোগ্রাফি। রেলগাড়ি দেখতে যাচ্ছে দুটো বাচ্চা, কাশবন দিয়ে—খুবই ভালো লেগেছিল, আর কি সুন্দর জলের ওপর মিষ্টিওলার বাঁকের ছায়া, বাচ্চাগুলো যাচ্ছে, আবার কুকুরটা চলেছে পিছু পিছু। আমি তো হতভম্ব। আই হ্যাড নো আইডিয়া দ্যাট শি হ্যাভ সাচ আ কীন আই! আমি মাঝে মাঝে আমার ছবি এনে টিভি স্ক্রিনে ওদের দেখাই—খুব খুশি হয়ে দ্যাখে, রেসপন্ডও করে। হঠাৎ দাদুভাই সেদিন বলল, ইলেকট্রিকের তারে ভিজে কাক খুব বস্তাপচা ইমেজ—ওটা বদলানো যায় না? যেমন ধরো কাকভিজে রিকশাওলা গা মুছছে। আই রিয়েলি গেট সারপ্রাইজড বাই দিজ টু! আই মিস মিনদিদি, দো। মা এত গম্ভীর, এত রিজার্ভড, আর বাবা ঠিক উলটো। —ওকে তো পাকড়ানোই যায় না, হি এসকেপস এভরিটাইম—বাবাকে মাঝেমধ্যে আমার মনে হয় আমার চেয়েও ছোট, ইয়াংগেস্ট মেম্বার অফ দা ফ্যামিলি। আর পদ্মমা তো আউট। ঠাম্মু? দ্য লিস্ট সেইড অ্যাবাউট হার দ্য বেটার। ন্যাচরালি আমি খুব দিদিটাকে মিস করি—মাই বেস্ট ফ্রেন্ড ইন আ ওয়ে—দিদি ব্যাঙ্গালোরে চলে গিয়ে আমার ঝামেলা হয়ে গেছে। ওদিকে শ্রীদিদি চলে গেছে বস্টনে। কেবল বোনেরা জিয়া—দিয়া আছে ফ্যামিলির মধ্যে আড্ডা দেবার লোক। একটাও ছেলে নেই! জাস্ট ইম্যাজিন! আর বড়মা বলে, দত্তবাড়ির গর্ব ছিল, এ বাড়িতে মেয়ে—সন্তান জন্মই নিত না—ওনলি মেল চিলড্রেন ওয়্যার বর্ন হিয়ার। পদ্মমাই বংশের প্রথম সারভাইভিং গার্লচাইল্ড আর যমুনামা সেকেন্ড। তারপরেই তো গার্লচাইলডের ছড়াছড়ি শুরু হয়ে গেল। না,—ভুলে গিয়েছি নীল আছে। অবশ্য নীল তো ঠিক আমাদের বংশ নয়, ও জুডির প্রথম পক্ষের ছেলে। জুডির আগের বিয়ের সন্তান। দেবী সেজজেঠুর নিজের মেয়ে। দুবাইতে জেঠু—জেঠির ছেলেপুলে নেই, দে আর স্পিরিটস। মেজজেঠুর দিয়া—জিয়া। সেজজেঠুর দেবী আর নীল, আর এখানে বাবার আছি আমি। দত্তবাড়ির প্রডাক্ট আমরাই। এই কমপ্লিট তালিকা। শ্রীদিদি আর দিদি তো আমাদের দত্ত বংশের নয়, ওরা আমার পিসতুতো বোন—যদিও আমাদের ক্লোজনেসটা আপন ভাইবোনের মতোই। —দিদি আর আমি উই গ্রু আপ টুগেদার ইন দিস হাউস। আর জিয়া—দিয়া—শ্রীদিদিও। আমরা সবাই আপন ভাইবোনের মতোই। নীল আর দেবীকে শুধু একবারই আমরা মিট করেছি, মেজজেঠুদের ওয়েডিং অ্যানির্ভাসারির সময়ে। এবারে সেজজেঠু আর ওদের সঙ্গে আনেনি,—শুধু ঠাম্মাকেই নিয়ে এসেছে। ওদের স্কুল খোলা। সেবার ওই উইক—এন্ড পার্টিটা কেয়াতলায় কিন্তু দারুণ জমেছিল—আমাদের চমৎকার একটা ফ্যামিলি রি—ইউনিয়ান হয়েছিল তখন—গ্লোবালি ছড়িয়ে গেছি তো সকলে। এবছর দাদুভাইয়ের আশি বছরের বার্থডে সেলিব্রেশনেও আবার রি—ইউনিয়ান হবে—কিন্তু এবার এখানেই। এ বাড়িতেই হবে শেষ উৎসব, রি—ইউনিয়ান—কিন্তু অনেকেই আসছে না। মেজজেঠু—জেঠিরাই তো থাকবে না—ওরা গেছে আলাস্কায়। কী একটা চীপ ডিল পেয়ে লোভের চোটে ছাড়তে পারেনি। লোভী সুযোগ ভার্সেস ফ্যামিলি—ডিউটি। —শুধুই কর্তব্য? হৃদয়ের কোনও টান নেই এতে? দাদুভাইয়ের যে—কোনও ব্যাপারই আমাদের পক্ষে খুব জরুরি হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। বাবা—জেঠুদের একমাত্র অভিভাবক তো দাদুভাই—ই। ওরা সারা জীবনটাই ডেডিকেট করেছে কেবল তার দাদাদের ফ্যামিলির দেখভাল করার জন্যে। হি ডিডন্ট হ্যাভ আ ফ্যামিলি অফ হিজ ঔন—কেননা আমার ঠাকুর্দাটি রেস খেলে আর মদ খেয়ে, টাকাপয়সা এবং আয়ু, সব কিছুই উড়িয়ে দিয়েছিল। ঠাম্মা ইজ আ হারপি—ইয়েস, শি ইজ আ হারপি। বড়মা আর দাদুভাই—দে হ্যাভ ব্রট আপ অল হার ফাইভ কিডস—ঠাম্মার ছেলেমেয়েদের তো বড়মাই মানুষ করেছে। —বাবা তাই বলে। বাবা ইজ টোটালি ডেডিকেটেড টু বড়মা অ্যান্ড দাদুভাই—বাবার এই লয়্যালটিটা আমার খুব ভালো লাগে, আমি খুব অ্যাপ্রিশিয়েট করি। আমাদের জেঠুদের মধ্যে তো সেটা দেখি না। দিদিও বলে, বাবা—মা দুজনেই খুব লয়্যাল। দিদির নাকি একটা বয়ফ্রেন্ড হয়েছে এবারে ব্যাঙ্গালোরে—সেটাকেও আনছে সঙ্গে করে—ইনফ্যাক্ট, ছেলেটা কলকাতারই ছেলে। —লুকিং ফরওয়ার্ড টু মিটিং দ্য চ্যাপ। আশা করি আমার দিদির যোগ্য হবে—দিদি ইজ আ ভেরি ভেরি স্পেশ্যাল পার্সন। যেভাবে ও পদ্মমাকে বুকে করে সামলে রেখেছে এতদিন। যেন ওই মা, আর পদ্মমা ওর মেয়ে। দিদি খুব সুখী হোক, আমি চাই।

আমি চাই দিদির বর দিদিকে খুব ভালোবাসুক, খুব প্রোটেক্ট করুক। দিদিই তো সারাজীবন তার মাকে প্রোটেক্ট করে গেল আমার ঠাম্মার পয়জনাস টাং থেকে। এই ছেলেটা দিদিকে ঠিক প্রোপোজ করেছে কিনা, খুলে বলল না দিদিটা—ঠিক আছে, আসুক তো? এলেই বুঝব। হোপ সামথিং ওয়ান্ডারফুল হ্যাফেনস—শ্রীময়ীদিদির বেলায় যেরকম ঘটল সেবারে। বড়মা যে বলে না, ”সবই রাধামাধবের কাজ”—আমার মনে হয় এই একটা কাজ ঠিকই রাধামাধবের কীর্তি—টু ফাইন্ড সিদ্ধার্থদা ফর আস, ফ্রম দি আদার এন্ড অফ দ্য ওয়ার্লড! সিদ্ধার্থদা শ্রীময়ীদিদির পুরো ব্যাপারটাই ড্রিমলাইক।

শ্রীদিদির যখন MS ধরা পড়লো, সেটা শুনেই দুম করে বড়রা সবাই নিবে গেল। দমে গেল। MS, মানে মাল্টিপল সক্লেরোসিস (Multiple Scleroris) আস্তে আস্তে নার্ভগুলো শুকিয়ে আসবে, মাসলগুলো স্টিফ হয়ে যাবে, শেষপর্যন্ত পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে মারা পড়বে—বাট নোবডি নোজ হাউ লং দ্য প্রসেস উইল টেক। অসুখে ধরল, আর মরল, তা তো নয়। মারবে, কিন্তু তিলে তিলে কষ্ট দিয়ে মারবে। শ্রীদিদি সব শুনে ইন্টারনেটে বসে গেল। রিসার্চ করতে লাগল অসুখটার ট্রিটমেন্ট বিষয়ে, বিদেশে কয়েকজন এই রোগে অসুস্থ রুগির সঙ্গে কনট্যাক্টও করে ফেলল। শেষ অবধি চেনা হয়ে গেল সিদ্ধার্থদার সঙ্গেও। সে হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলে এই অসুখটি নিয়েই অ্যাডভান্সড রিসার্চ করছে। সেই থেকে ওদের যোগাযোগ, ই—মেলে, ফোনে এবং সশরীরে উপস্থিত হয়ে কলকাতায় সিদ্ধার্থদা শ্রীদিদিকে প্রোপোজ করল। সেই শীতেই ফিরে এসে বিয়ে করল। এবং বস্টনে নিয়ে চলে গেল। যমুনামাকে সুদ্ধু। যমুনামার যে সাহস হচ্ছিল না শ্রীদিদিকে একা একা অল্পপরিচিত একটি ছেলের সঙ্গে অত দূর বিদেশে ছেড়ে দিতে। তাছাড়া শ্রীদিদি হুইলচেয়ার বাউন্ড, তার তো হেলপ লাগেই। ওদেশে বাড়িতে তো দ্বিতীয় কোনও মানুষ থাকবে না। যমুনামা কলেজের চাকরি থেকে লিয়েন নিয়ে গিয়েছে—কিন্তু শুনছি ছেড়েই দেবে। ছোট পিসে বম্বেতে ট্রান্সফার নিয়ে এ বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে—জেনিকে বিয়েই করবে ঠিক করেছে। এবার জেনি জোরজুলুম শুরু করেছে বোধহয়। ডিভোর্স পেপার্স রেডি করতে বলেছে মেজজেঠুকে। সেদিন দিয়া বলছিল এসব কথা। আমরা ফর্ম্যালি এখনও কোনও ইনফর্মেশন পাইনি কারুর কাছ থেকেই। যমুনামাও বলেনি কিছু, শ্রীময়ীদিদিও না। আর পিসে তো যোগাযোগই রাখে না।

এ বাড়িতে কত কিছু ঘটছে। বড়মা বলে আমরা নাকি পাঁচপুরুষের ভিটেতে আছি। দিদিদের বাচ্চাকাচ্চা হলে, নেক্সট জেনারেশন হবে সিক্সথ পুরুষ—এত পুরোনো, এত ওলড ফ্যাশনড একটা ট্রাডিশনাল জয়েন্ট ফ্যামিলিতে ডিভোর্স হচ্ছে, অ্যাডালটারি কেস হচ্ছে। বাড়ির মেয়েরা Layer হচ্ছে, MBA হচ্ছে।

কীভাবে নতুন দিনের ধাক্কা এসে আছড়ে পড়ছে। ট্রাডিশন অ্যান্ড মডার্নিটি নিয়ে এত কথা শুনি, এত কথা পড়ি, আমাদের নিজেদের সংসারেই যেমন ট্রাডিশন আর মডার্নিটির দ্বন্দ্ব দেখা যায় সেটা প্রায় এক্সেমপ্লারি। উদাহরণস্বরূপ পরিস্থিতি। শ্রীময়ীদিদি—সিদ্ধার্থদার ইন্টারনেটের সম্পর্ক, প্রেম ও বিবাহ একদিকে—অন্যদিকে শ্রীময়ীদিদির বাবার সেক্রেটারির সঙ্গে অ্যাডালটারি অ্যান্ড ডিভোর্স। একদিকে ঠাম্মার ইনক্রেডিবল বিচিং। নিজেরই জামাই, নিজেরই নাতিকে কেউ যে এভাবে খতম করতে পারে, জাস্ট বাই বিচিং হার্ড, এ বাড়ির গল্পটা হাতেকলমে না জানলে, অন্য কেউ আমাকে বললে, আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতুম না। বাট পদ্মমা ইজ নট আ লায়ার। হোয়াট এভার এলস শি মে বি, শি ইজ আ ভিকটিম অফ হার মাদার্স বিচিনেস। দ্যাটস ফর শিওর। বড়মা আর দাদুভাই দুজনে ওকে বুক দিয়ে আগলে রাখে। অ্যাজ ডাজ দিদি—কিন্তু ওর প্রতি যে ইনজাস্টিস হয়েছে, তার কোনও প্রতিকার হয়নি।—প্রতিকার হয় না—কোনও শাস্তি হয়নি কারুর। ওর কথাগুলোকে পাগলের পাগলামি বলে চালিয়ে দেবার চেষ্টা হয়েই চলেছে। বাট এভরিওয়ান নোজ হোয়াট শি সেইজ, ইজ হোয়াট হ্যাপেনড ইন রিয়্যালিটি। দিদির জন্যে ভীষণ কষ্ট হয়, বাবাকে, দাদাকে হারিয়েছি আর মা তো থেকেও নেই। দিদি বলছে পদ্মমাকে ব্যাঙ্গালোরে নিয়ে যাবে, ওখানে নিমহ্যান্স হাসপাতালে চিকিৎসা করাবে। নার্ভের ডিজিজের জন্যে শ্রেষ্ঠ হাসপাতাল। অনেক একদম রিসেন্ট ওষুধপত্র, ট্রিটমেন্ট, ওখানে আছে। তবে পদ্মা গেলে তো? বড়মাকে ছেড়ে যেতে চাইবে না বোধহয়। শি ক্লিংস টু বড়মা ইমোশনালি লাইক আ চাইলড ওদের কাছে মা বলতে তো মামণিই—যা দেখি। আমার বাবাও তাই, যমুনামাও তাই। ইভেন মেজজেঠু—সেজজেঠু। দো দে ইনভাইট ঠাম্মা টু লিভ উইথ দেম—বড়মাকেই ওরা অনেক বেশি রেসপেক্ট করে, অনেক বেশি ট্রাস্ট করে, সেটা আমিও বুঝতে পারি।

দাদুভাই সূয্যিদাদাকে এস্রাজ বাজাতে শিখিয়েছিল, বাঁশি শিখিয়েছিল। আমাকে কিছুই শেখালো না। আমার অভিমান আছে। এদিকে আমাকে দিব্যি ”সাত রাজার ধন এক মানিক”, দত্তবাড়ির ”বংশপ্রদীপ” এই সব টাইটেলে ভূষিত করে। ওদিকে কিছুই শেখায় না। হোয়াই? আমি নিজে নিজেই একটা সিনথেসাইজার নিয়ে গানটান বাজাই—সিনথেসাইজারটা জেঠুই এনে দিয়েছিল দুবাই থেকে। জেঠু কমই আসে, বাট হি ইজ ভেরি জেনারাস, ব্রিংস আ লট অফ থিংস ফর দ্য হাউস। আমাদের জন্যে, মানে মার জন্যে গতবারে আমেরিকা থেকে জুডি একটা মাইক্রোওয়েভ আভেন পাঠিয়েছিল, সেটায় আমিষ রান্না হয় বলে বড়মা—দাদুভাই ইউজ করত না। নেক্সট থিং ইউ নো, জেঠু অ্যারাইভস উইথ আ নিউ মাইক্রোওয়েভ ফর দি নিরিমিষ্যি হেঁশেল। আমার সিনে—ক্যামেরাটাও তো গ্র্যাজুয়েশন গিফট বলে জেঠুই দিয়েছে আমাকে। বাবা ইজ নট ইমপ্রেসড, দো। বাবা বলে, ওরা নিজেরা কাছে থাকে না, মার দেখাশুনো করে না, তাই ‘জিনিস’ দিয়ে দিয়ে শূন্যস্থান পূর্ণ করে—গিলট ফিলিংটা কাটায় ওই করে। সবই ফাঁকা—এম্পটি।

কিছুদিন ধরেই আমি সিনেমাটোগ্রাফি নিয়ে কাজ করতে একটু নিউইয়র্ক ফিল্মস্কুলে যাবার চেষ্টা করছি। ইন্টারনেট থেকে খবর—টবর সবই নিয়েছি—নাউ আই অ্যাম লুকিং ফর দ্য মানি। এখন তো ব্যাংক লোন—টোন কত কী পাওয়া যায়। জিয়াটা এম. বি. এ. পড়ে। ওরা নিশ্চয় এসব ঘাঁতঘোঁত জানবে। অ্যাট লিস্ট ওদের বন্ধুরা কেউ না কেউ জানবেই ও যদি নাও জানে। সিদ্ধার্থদাকেও জিগ্যেস করতে হবে। USEFI থেকে কাগজপত্র নিয়ে এসেছি। নেক্সট ইয়ারেই চেষ্টা করব যেতে।

বাবা বাইরে পড়তে যেতে পারেনি বলে বাবার মনে দুঃখু আছে আমি জানি। মেজজেঠু—সেজজেঠু দুজনেই বিলেতে পড়েছে, ব্যারিস্টার হয়েছে, ডাক্তার হয়েছে। বাবার বেলাতেই ঠাকুর্দার টাকা ফুরিয়ে গেল। ঠাকুর্দার যে রেসের নেশা ছিল, বাড়িতে নাকি কেউ তা জানত না। তারা ভাবতো জাস্ট মদ খাচ্ছে। বড়জোর কিছু দুশ্চরিত্রপনা করছে। কিন্তু ঠাকুর্দা যে পরিবারের সব টাকাকড়ি মাঠে গিয়ে উড়িয়ে দিচ্ছিল, বাড়ির অবস্থা লাটে তুলছিল, সেটা নাকি কল্পনার বাইরে ছিল—ক্ষতির পরিমাণটা আগে থেকে কেউ জানতে পারেনি। বাবাকে তাই চটপট চাকরিতে ঢুকে যেতে হল। বাবার এ নিয়ে খুব ক্ষোভ আছে— বেশি ড্রিংক করা হয়ে গেলেই কমপ্লেন করতে শুরু করে। তাই আমি বাইরে পড়তে যেতে চাই শুনে বাবার দারুণ উৎসাহ হয়েছে। মার তো চাপা স্বভাব, রাগ, দুঃখু, আনন্দ, কিছুই কাউকে তেমন খোলাখুলি বলে না। কিন্তু মাও চেষ্টা করছে। অফিসে খোঁজখবর নিচ্ছে লোন বিষয়ে।

বাবার এই আনফরচুনেট অ্যালকোহলিজমটাই মাকে বেশি বেশি ভিতরমুখী করে দিয়েছে মনে হয়। মা তো খুব চেষ্টা করছে। অ্যালকোহলিক অ্যালনিমাসের মিটিঙে নিয়ে যাচ্ছে ধরে বাবাকে। ইন ফ্যাক্ট এতদিন বাবাকে কিছুতেই রাজি করানো যায়নি, কিন্তু গত বছর হসপিটালাইজেশানের পরে হি হ্যাজ লার্নট হিজ লেসন। এখন নিজেই কোঅপারেট করে—হি ইজ ট্রাইং টু রিড হিমসেল্ফ অফ দা হ্যাবিট। তাড়াতাড়ি ফেরে, বন্ধুদের সঙ্গে ঠেকে যায় না। বইটই পড়ে, চা খায়, বড়মাদের সঙ্গে বসে টিভি দ্যাখে। আমি বাবা—মার জন্য ভালো ভালো ডিভিডি এনে দিই। বাবা—মার বিয়ের পঁচিশ বছরে আমরা ওদের একটা ফিলিপস ডিভিডি প্লেয়ার উপহার দিয়েছিলুম। আই থিংক মা এনজয়েস ইট। বাবা তো পড়ুয়া। কবিতা ভালোবাসে, গান ভালোবাসে, ভালো ভালো ফিল্মও ভালোবাসে। হি নোজ সাচ আ লট অ্যাবাউট ফিল্মস!— মা অফিস থেকে এসে একটু রান্নাবান্না করে, অত বইটই পড়ে না। টিভিটাই দ্যাখে। আমাদের ঘরে বড়মা আর দাদুভাইও বসতে ভালোবাসে। আমার ছবিটবি ওদেরও ডেকে ডেকে দেখাই। পদ্মমা আগে আসতো, ছবি দেখতে পছন্দ করতো। —এখন শি ইজ টোটালি আউট অফ বাউন্ডস। আমাদের সঙ্গে কথাই বলে না। সেদিন মা গিয়ে দাঁড়িয়েছিল পাশে—পদ্মমা তো ঠায় খাটে বসে সূয্যিদাদার চিঠিগুলো ঘাঁটে, মা ওর পিঠে হাত রেখেছে। পদ্মমা সেদিন, হঠাৎ পিছন ফিরে একটা কথা বলেছিল। বলেছিল, ”ভালো কথা—বরুণা, সূয্যি যে আসছে, ওর জন্যে দুটো ইলিশমাছ ভেজে রেখেছিস তো? আমাদের এই নিরিমিষ্যি খিচুড়ি তো ওর মুখে রুচবে না।”

মা তো স্তম্ভিত। কোথায় খিচুড়ি?

পদ্মমা এগেইন ওয়েন্ট ইনটু হার সাইলেন্স। টোটালি উইথড্রন।

পদ্মমাকে ডাক্তার দেখানো খুব জরুরি। দিদি আজকেই এসে পড়েছে।

এই শনিবার জিয়া—দিয়াদের বাড়ি একটা পার্টি আছে—শ্রীদিদি আর সিদ্ধার্থদাও এসে গিয়েছে অলরেডি, এখন ওরা সিদ্ধার্থদার বাড়িতে আছে। দারুণ মজা হবে, ছোটদের রি—ইউনিয়ান—ছোট ঠিক নয়, মানে, আমাদের। ভাইবোনেদের। আমাকে বলেছে ভিডিওক্যাম নিয়ে যেতে। না বললেও নিতুম। গতবারের বিবাহ জয়ন্তী উৎসবের ভিডিওটাও নেবো। সিদ্ধার্থদার ফার্স্ট এন্ট্রি ইনটু দ্য ফ্যামিলি ধরা আছে ওখানে। দারুণ মজার। বড়মা বলেছিল দাদুভাইয়ের আশি বছরের পার্টিটায় অসাধারণ কিছু একটা করতে হবে—যেমনটি আগে কখনও হয়নি। তো, আমাদের একটা দারুণ পার্টির প্ল্যান হয়েছে। দেখা যাক কতদূর কী হয়।

দাদুভাইকেই বাদ দিয়ে প্ল্যানিং হচ্ছে তো, সেটাই প্রবলেম। দাদুভাইয়ের এত ফার্টাইল ইম্যাজিনেশন! সেটাকে ইউজ করা যাচ্ছে না!

 আচ্ছা, ঐ মেয়েটা যে কেন এসেছিল, সকালবেলায় দাদুভাইয়ের খোঁজে—সেটা বোঝা গেল না। বাংলদেশ থেকে এসেছে এটুকুই কেবল বলল। আর কিছুই জানাল না। শুধু বলল—দেবশংকর দত্তের সঙ্গে ওর একটা জরুরি পার্সোনাল প্রয়োজন আছে। তিনিই তো এখনও পরিবারের হেড? বাস এইটুকুই। খুব মিস্টিরিয়াস মেয়ে কিন্তু। বড়মা শুনে অবাক হয়ে বলল, পঁয়ষট্টি বছরের মধ্যে এই প্রথম কোনও মেয়ে দাদুভাইকে খুঁজতে এসেছে। মেয়েটার বয়েস বেশি নয়। এই আমাদের মতন হবে। ফানি হেয়ারডু। বলে গেছে, আবার আসবে—খুব জরুরি কাজ। তখন বোঝা যাবে কী ব্যাপার। যখন দাদুভাইকে বললুম, দাদুভাই তো স্ট্রেট আকাশ থেকে পড়ল। বিন্দুমাত্র আইডিয়া নেই। ঘুণাক্ষরেও জানে না সে মেয়েটা কে বা কেন! বাংলাদেশী কাউকে মনে করতে পারল না দাদুভাই।

অধ্যায় ১ / ৫

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন