রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কই গো প্রকৃতি রানী , দেখি দেখি মুখখানি ,
 কেন গো বিষাদছায়া রয়েছে অধর ছুঁয়ে
 মুখখানি মলিন কেন গো ?
 এই যে মুহূর্ত আগে হাসিতে ছিলে গো দেখি
 পলক না পালটিতে সহসা নেহারি এ কি—
 মরনে বিলীন যেন গো !
 কেন তনুখানি ঢাকা শুভ্র কুহেলিকা বাসে
 মৃদু বিষাদের ভারে সুধীরে মুদিয়া আসে
 নয়ন – নলিন হেন গো ? 
ওই দেখো চেয়ে দেখো—একবার চেয়ে দেখো—
 চাঁদের অধর দুটি হাসিতে ভাসিয়া যায়।
 নিশীথের প্রাণে গিয়া সে হাসি মিশিয়া যায়।
 সে হাসির কোলে বসি কানন – গোলাপগুলি
 আধো আধো কথা কহে সোহাগেতে দুলি দুলি।
 সে – হাসির পায়ে পড়ি নদীর লহরীগন
 যার যত কথা আছে বলিতে আকুল মন।
 সে হাসির শিশুদুটি লতিকামন্ডপে গিয়া
 আঁধারে ভাবিয়া সারা বাহিরিবে কোথা দিয়ে
 সে – হাসি অলসে ঢলি দিগন্তে পড়িয়া নুয়ে ,
 মেঘের অধরপ্রান্ত একটু রয়েছে ছুঁয়ে।
 বলো তুমি কেন তবে
 এমন মলিন রবে ?
 বিষাদ – স্বপন দেখে হাসির কোলেতে শুয়ে। 
ঘোমটাটি খোলো খোলো
 মুখখানি তোলো তোলো
 চাঁদের মুখের পানে চাও একবার।
 বলো দেখি কারে হেরি এত হাসি তার !
 নিলাজ বসন্ত যবে কুসুমে কুসুমময়
 মাতিয়া নিজের রূপে হাসিয়া আকুল হয় ,
 মলয় মরমে মরি ,
 ফিরে হাহাকার করি—
 বনের হৃদয় হতে সৌরভ – উচ্ছাস বয় !
 তারে হেরি হয় না সে এমন হরষে ভোর ;
 কী চোখে দেখেছে চাঁদ ওই মুখখানি তোর !
 তুই তবু কেন কেন
 দারুন বিরাগে যেন
 চাস নে চা চাঁদের হাসি চাঁদের আদর !
 নাই তোর ফুলবাস
 নাইক প্রেমের হাস ,
 পাপিয়া আড়ালে বসি শুনায় না প্রেম গান !
 কী দুখেতে উদাসীনি
 যৌবনেতে সন্ন্যাসিনী !
 কাহার ধেয়ানে মগ্ন শুভ্র বস্ত্র পরিধান ? 
এক – কালে ছিল তোর কুসুমিত মধুমাস—
 হৃদয়ে ফুটিত তোর অজস্র ফুলের রাশ ;
 যৌবন – উচ্ছাসে ভোর
 প্রাণের সুরভি তোর
 পথিক সমীরে সব দিলি তুই বিলাইয়া !
 শেষে গ্রীষ্মতাপে জ্বলি
 শুকাইল ফুল – কলি ,
 সর্বস্ব যাহারে দিলি সেও গেল পলাইয়া !
 চেতনা পাইয়া শেষে হইয়া সর্বস্ব – হারা
 সারাটি বরষা তুই কাঁদিয়া হইলি সারা !
 এত দিন পরে বুঝি শুকাইল অশ্রুধারা !
 আজ বুঝি মনে মনে করিলি দারুন পণ
 যোগিনী হইবি তুই পাষাণে বাঁধিয়া মন !
 বসন্তের ছেলেখেলা ভালো নাহি লাগে আর—
 চপল চঞ্চল হাসি ফুলময় অলংকার !
 এখন যে হাসি হাসো আজি বিরাগের দিন ,
 শুভ্র শান্ত সুবিমল বাসনা – লালসাহীন।
 এত করিলি পণ
 তবুও তো ক্ষণে ক্ষণ
 সে দিনের স্মৃতিছায়া হৃদয়ে বেড়ায় ভাসি।
 প্রশান্ত মুখের ‘ পরে
 কুহেলিকা ছায়া পড়ে—
 ভাবনায় মেঘ উঠে সহসা আলোক নাশি—
 মুহূর্তে কিসের লাগি
 আবার উঠিস জাগি
 আবার অধরে ফুটে সেই সে পুরানো হাসি ! 
ঘুমায়ে পড়িস যবে বিহ্বল রজনীশেষে ,
 অতি মৃদু পা টিপিয়া উষা আসে হেসে হেসে ,
 অতিশয় সাবধানে দুইটি আঙুল দিয়া
 কুয়াশা – ঘোমটা তোর দেয় ধীরে সরাইয়া।
 অমনি তরুণ রবি পাশে আসি মৃদুগতি
 মুদিত নয়ন তোর চুমে ধীরে ধীরে অতি !
 শিহরিয়া কাঁপি উঠি
 মেলিস নয়ন দুটি ,
 রাঙা হয়ে ওঠে তোর কপোল – কুসুমদল
 শরমে আকুল ঝরে শিশির – নয়নজল ! 
সুদুর আলয় হতে তাড়াতাড়ি খেলা ভুলি
 মাঝে মাঝে ছুটে আসে দুদন্ডের মেঘগুলি।
 চমকি দাঁড়ায়ে থাকে , ওই মুখপানে চায় ,
 কাঁদিয়া কাঁদিয়া শেষে কাঁদিয়া মরিয়া যায় !
 কিসের বিরাগ এত , কী তপে আছিস ভোর !
 এত করে সেধে সেধে
 এত করে কেঁদে কেঁদে
 যোগিনী , কিছুতে তবু ভাঙিবে না পণ তোর ?
 যোগিনী , কিছুতে কি রে ফিরিবে না মন তোর ?
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন