নীলকান্তমণি উধাও – হীরেন চট্টোপাধ্যায়

পৌলোমী সেনগুপ্ত

নীলকান্তমণি উধাও – হীরেন চট্টোপাধ্যায়

যাব বলে লাফাচ্ছিলাম দিনসাতেক আগে থেকেই, সকালে বাবা যখন মা আর আমাকে পৌঁছে দিয়ে অফিস চলে গেলেন, আনন্দে তখনও টগবগ করে ফুটছি আমি। কিন্তু দুপুরের এই ছোট ব্যাপারটাই কেমন যেন খিঁচড়ে দিয়ে গেল মনটা। সন্ধের জমজমাট অনুষ্ঠানের কথা ভেবেও মন ঠান্ডা করতে পারছিলাম না।

ব্যাপারটাকে অবশ্য ছোট্টই বলতে হবে, অন্তত আমার মনখারাপ হওয়ার মতো ব্যাপার সেটা মোটেই নয়। সকালে আসার সঙ্গে সঙ্গে বড়মামা আমাকে জড়িয়ে ধরেছেন, “আরে, এসো, এসো, আমার চ্যাম্পিয়ান ভাগনে।” তারপর আমায় ভেতরের ঘরে নিয়ে গিয়ে দারুণ একটা পেন আর ক্যালকুলেটর দিয়ে বলেছেন, “এই নে, তোর চ্যাম্পিয়ান হওয়ার পুরস্কার।”

একটা ক্যালকুলেটরের শখ আমার অনেক দিন থেকে। বাবাকে বলতে পারিনি খানিকটা ভয়েই, বলবেন, “এখন থেকেই তোর ক্যালকুলেটর দরকার?” বলতেই পারেন, কারণ খুব ভাল ছেলে যাকে বলে, তা তো আর আমি নই। গাদাগুচ্ছের সাবজেক্ট পড়তেই যে আমার ভাল লাগে না মোটে, ক্লাসে ফার্স্ট হয়ে আর আমি উঠব কী করে! আমার ভাল লাগে অঙ্ক। এটা আমার বরাবরই বেশ প্রিয়। আমাদের ফার্স্ট বয় অরিত্র এই ক্লাস নাইন পর্যন্ত একবারও অঙ্কে আমার সমান নম্বর পায়নি। সাররা সকলেই জেনে গেছেন, একটা নম্বর কম পেলেই খাতা নিয়ে আমি সোজা চলে যাব হেডসারের কাছে।

এটা অবশ্য ঠিকই যে, ক্লাস নাইনের অঙ্ক করতে ক্যালকুলেটর লাগে না, কিন্তু আমি তো শুধু আমার ক্লাসের অঙ্কই করি না, উঁচু ক্লাসের অঙ্ক করতেও তো আমার ভাল লাগে। আর অঙ্কের আসল মজাটাই তো হল— সেটা কেমন করে করতে হবে তা বের করা— ঘাড়-মুখ গুঁজে বড় বড় গুণ ভাগ করতে কি আর ভাল লাগে। অবশ্য বড়মামা যে আমায় চ্যাম্পিয়ান বললেন, সেটা একটা অন্য ব্যাপার। মাসখানেক আগে জুনিয়ার কুইজ কনটেস্টে আমি চ্যাম্পিয়ান হয়েছি। অন্যসব স্টেটের বাঘা বাঘা ছেলে ছিল বেশ কিছু, তাদের হারিয়ে চ্যাম্পিয়ান হওয়াটা খুব একেবারে মুখের কথা ছিল না। বেশ একটা রোমাঞ্চ অনুভব করছিলাম, মাইকে যখন নামটা অ্যানাউন্স করছিল।

বড়মামিমা অবশ্য অতসব বোঝেন না, তাড়াতাড়ি এক প্লেট ছানার জিলিপি নিয়ে এসে বলেছিলেন, “খেয়ে ফেল দেখি এগুলো। অর্ডার দিয়ে কিছু ভাজিয়ে রেখেছি তুই আসবি বলে।” না, না, তার মানেই যে আমি ভিআইপি গোছের কিছু হয়ে গিয়েছি, সেসব কিছু নয়। ছেলেবেলায় আমি তো মামার বাড়িতে এসেই থাকতাম বেশিরভাগ সময়, গরমের ছুটিফুটি হলে তো আর কথাই নেই। আর বড়মামিমাও আমায় খুব ভালবাসেন, তাই এসব জানেন আর কী!

মামার বাড়ি আসতে এখনও আমার খুব ভাল লাগে, তার ওপর এইরকম একটা অনুষ্ঠান হলে তো আর কথাই নেই। না, অনুষ্ঠানটার ওপর যে আমার খুব একটা লোভ ছিল তা নয়, আসল আকর্ষণ হচ্ছে ওই নীলকান্তমণিটা। বড়মামা একজন জহুরি। কোনও একটা ভাল মণি পেলেই বাড়ি নিয়ে আসতেন, বড়মামিমাকে দেখাতেন। ছেলেবেলায় নানারকম মণিমুক্তো দেখেছি আমি মামার বাড়িতে। একরকম ঝুটো মুক্তো আমার খুব ভাল লাগত। তার নামটাও ছিল ভারী মজার, মিকিমতো মুক্তো। ওই নামের এক জাপানি ভদ্রলোক নাকি ওই মুক্তো তৈরি করার রহস্যটা বের করেছেন। এই নীলকান্তমণি পাওয়ার পর বড়মামা মাকে একটা চিঠিতে জানিয়েছিলেন, “একটা দুর্লভ নীলকান্তমণি পেয়েছি। জ্যোতিষী আমাকে অনেকদিন থেকে এই মণি ব্যবহার করতে বলছে, ভাবছি এটা রেখেই দেব। তবে, ব্যবহার করতে হলে আগে শোধন করতে হয়। তাই আগামী শনিবার গুরুদেবকে খবর দিয়েছি আসবার জন্য। সত্যনারায়ণ হবে, আমার রত্নও শোধন হবে। তোরা সকালবেলাতেই সব চলে আয়।”

ভেবেছিলাম অনেকেই আসবে, খুব মজা হবে। তা কিন্তু হয়নি। বাবা তো অফিসের কাজে ধানবাদ চলেই গেলেন আমাদের পোঁছে দিয়ে। মায়েরা তিন ভাই-বোন। ছোটমামা কাজ করেন অম্বরনাথে, রাইফেল ফ্যাক্টরিতে। জানিয়েছেন, এখন ছুটিছাটা পাওয়া একেবারে অসম্ভব। বড়মামার মেয়ে তুলিদির বিয়ে হয়েছে কাছেই, আসানসোলো—তারও নাকি বাড়িতে কার অসুখ। আসার মধ্যে এসেছেন গুরুদেব আর নালুমামা। নালুমামা বোধহয় আমার নিজের মামা নন, কিংবা হতে পারে কিছু ঘুরিয়েটুরিয়ে। কিন্তু নালুমামাকে আমি দেখছি এ-বাড়িতে, জ্ঞান হওয়া অবধি। দোকানেই বসতোটসতেন বেশি। ভুলুদা, মানে নালুমামার ছেলে বাজারটাজার করে দিত আর ভুলুদার মা রান্নাবান্নায় সাহায্য করতেন। গত বছরই কী একটা গন্ডগোল হয়েছিল যেন। তারপরই নালুমামারা উঠে গিয়েছিলেন কাছেই, একটা অন্য বাড়িতে।

নালুমামাদের অবস্থা ভাল নয়, সেটা আমি বেশ বুঝতে পারি। বাইরে বেরোবার সময়ও নালুমামার জামাকাপড় আমি কোনওদিন ফর্সা দেখিনি। তার ওপর আবার বাবার মতো ওই নস্যি নেওয়ার অভ্যেস। পকেট থেকে কালচিটে একটা রুমাল যখন বের করেন, অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে আসার জোগাড়। তবে মানুষটাকে কিন্তু বেশ ভালই লাগে আমার। রুমালে পয়সা লুকিয়ে অদৃশ্য করা, দড়ি কেটে জোড়া দেওয়া—এইসব টুকটাক ম্যাজিক যে আমায় কত দেখিয়েছেন, তার শেষ নেই।

না, নালুমামাকে নিয়ে কিছু হয়নি দুপুরবেলা, হয়েছিল ছোট্টুদাকে নিয়ে। আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড় হলেও ছোট্টুদা তুলিদির চেয়ে ছোট। ছেলেবেলা থেকেই এমন গোঁয়ার আর একরোখা যে, এ-বাড়িতে এলে পারতপক্ষে ওকে এড়িয়েই চলতাম আমি।

সত্যি বলতে কী, ছোট্টুদাকে আমি দু’চোখে দেখতে পারি না। বড়মামাও তাই। লেখাপড়ায় ছোট্টুদা অষ্টরম্ভা। বারকয়েক মাধ্যমিক পরীক্ষায় হোঁচট খেয়ে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে। তারপর কী করছেটরছে আমি জানি না, কিন্তু আজ যেমন করে বড়মামার সঙ্গে কথা বলছিল, সে তো সাংঘাতিক! বড়মামাকেও অত রাগতে আমি কখনও দেখিনি, চিৎকার করে বলেছিলেন, “পারব না! তোর পেছনে টাকা খরচ করা মানে ভস্মে ঘি ঢালা! পঁচিশ হাজার টাকা কি মুখের কথা নাকি?”

ছোট্টুদা থামেনি, বলেছিল, “বন্ধুর বাবারা সবাই দিয়েছেন। না দিলে বিজনেসটা হবে কী করে শুনি!”

“ব্যাবসা করবি তুই!” বড়মামা সেইরকম গলা চড়িয়েই বলেছিলেন, “তোকে আমি চিনি না? টাকাগুলো সব নয়ছয় করে ফেলবি!”

“তা হোক!” ছোট্টুদার কী সাহস, সমানে তর্ক করে বলেছিল, “টাকাটা তোমাকে দিতেই হবে, নইলে আমি মুখ দেখাতে পারব না!”

“ও-মুখ আর দেখাতে হবে না,”—বড়মামা রাগে গজগজ করছিলেন, “সরে যা তুই আমার সামনে থেকে।”

“ঠিক আছে, দেখব তুমি দাও কি না-দাও,” ছোট্টুদা ফোঁস ফোঁস করতে করতে সরে গিয়েছিল সামনে থেকে।

তা গিয়েছিল, কিন্তু ঘটনাটা আমি ভুলতে পারছিলাম না বিকেলেও। গন্ডগোল মিটতে আপনমনে চলে আসার সময় আর-এক কাণ্ড। ফিসফিস গলার আওয়াজ শুনে দেখি গুরুদেবের শাগরেদ বিষ্টুচরণ কী যেন বলছে গুরুদেবকে।

ওর নাম যে বিষ্টুচরণ, সেটা সকালে আসার পরই টের পেয়েছি আমি। গুরুদেবের ওই বিশাল দশাসই চেহারা, পেল্লায় ভুঁড়ি, ভাটার মতো গোল গোল লাল চোখ, আর ইয়া ঝাঁকড়া চুল! তার পাশে বিষ্টুচরণ যেন চামচিকে। গুরুদেব মাঝে মাঝেই হাঁক ছাড়ছেন, “বিষ্টুচরণ!” আর বিষ্টু অমনই ধনুকের মতো বেঁকে দাড়াচ্ছে সামনে, বুক-পিঠ একেবারে এক হয়ে যাচ্ছে তখন।

আমি অবশ্য দাঁড়াইনি, কিন্তু যেতে যেতে যেটুকু কথা কানে এসেছিল, তাতেই আমার লোকটার ওপর রাগ ধরে যাচ্ছিল। বিষ্টুচরণ বলছিল, “কত দাম হবে জানেন মণিটার? রাজার ঐশ্বয্যি—একবার যদি কোনওরকমে…”

ছি ছি ছি, এই কিনা গুরুদেবের চেলা! কথাটা আমি বলিনি বড়মামাকে, কিন্তু মনটন খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল আমার।

অনুষ্ঠানটা যখন শুরু হল তখন অবশ্য আর মনখারাপ লাগাটাগা ছিল না। পুজোর ব্যাপারটা তো ভাল বটেই, গুরুদেবের শোধন করবার কায়দাকানুনও খুব ভাল লাগছিল। অনুষ্ঠান শেষ হলে প্রসাদ খেয়ে আমরা সব জড়ো হয়েছিলাম বড়মামার বৈঠকখানায়। গুরুদেব জাঁকিয়ে বসে ছিলেন ডিভানে তাকিয়া ঠেস দিয়ে, পায়ের কাছে বিষ্টুচরণ। ওদিকের সোফায় আমি, মা আর বড়মামিমা। আর একটা সোফায় ভুলুদা আর ভুলুদার মা। ছোট্টুদা টিভি আর টেলিফোনের মাঝখানে আপেল-মোড়ায়। সেন্টারটেবিলে মুখোমুখি বড়মামা আর নালুমামা।

ঘটনাটা ঘটে গেল বড়মামা নীলকান্তমণির সুন্দর ছোট্ট বাক্সটা টেবিলে রাখবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে।

হঠাৎ বাড়ির আলোগুলো সব নিভে গেল।

বড়মামা বললেন, “দেখেছ কাণ্ড। লোডশেডিং হওয়ার আর সময় পেলে না।”

আমিই হঠাৎ লক্ষ করেছি পাশের বাড়ির আলো এসে পড়েছে রাস্তার ওপর। সে-কথা বলবার আগেই বড়মামা ফিসফিস করে বলেছেন, “আরে, লোডশেডিং তো নয়, এই বাড়িতেই তো গেছে দেখছি!” তারপরই গলা চড়িয়ে বলেছেন, “রামু, টর্চ নিয়ে ফিউজটা একবার দ্যাখ তো!”

রামুদা এ-বাড়িতে কাজ করছে বহুদিন। শুনেছি তুলিদিরও জন্মের আগে থেকে। ইলেকট্রিকের কাজকর্ম একটু-আধটু জানে রামুদা, টুকটাক কিছু করতে হলে বাইরে যাওয়ার দরকার হয় না। বড়মামার কথা শেষ হওয়ার পরেই ওদিকে লণ্ঠনের আলো দেখা গেছে। মেন সুইচের ফিউজ খুলে ঠিক করতে বোধহয় একটা মিনিটও সময় লাগেনি। কিন্তু যা হওয়ার, সেটা তার মধ্যেই হয়ে গেছে।

অদ্ভুত! অবিশ্বাস্য! অকল্পনীয়!

যে যেমন ছিল ঠিক তেমনই আছে, টিভির পাশে ছোট্টুদা, এদিকে আমরা, ওদিকে ভুলুদা-রা। টেবিলের ওপর নালুমামার নস্যির কৌটোটা পর্যন্ত ঠিক তেমনই রাখা রয়েছে, একটু আগে যেমনটি ছিল। কেবল আসল জিনিসটা লোপাট। নীলকান্তমণি। শূন্য বাক্সটার ডালা ওপরদিকে তোলা রয়েছে শুধু।

নিজের চোখকেও যেন বিশ্বাস করতে পারছি না। দু’চোখ কচলে ভাল করে তাকালাম। না, কোনও ভুল নেই, নীলকান্তমণি উধাও হয়েছে।

বড়মামার দিকে চাইলাম। ভুরু কুঁচকে গেছে, মুখচোখ থমথম করছে। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে যেন নিজের মনেই বললেন, “আশ্চর্য! এরকম যে হবে,” তারপর গুরুদেবের দিকে চেয়ে বললেন, “কেন এমন হল গুরুদেব?”

“বুঝতে পারছি না বাবা,” গুরুদেব বিষণ্ণ মুখে বললেন, “অনুষ্ঠানে তো কোনও ত্রুটি হয়নি! তবু যে কেন এরকম অমঙ্গল ঘটে গেল!”

“না, না, একে অমঙ্গল বলবেন না!” বড়মামার চোয়াল শক্ত হয়ে উঠছিল।

“কথাটা খুব লজ্জার হলেও সত্যি যে, এখানে আমার একেবারে নিজের লোকেরাই আছে, আর তাদের মধ্যেই কেউ নিয়েছে মণিটা। তবে এটাও ঠিক যে, সেটা এখনও এই ঘরের বাইরে যায়নি। যে-ই লোভে পড়ে করে থাক, আমি চাই বাইরের লোক জানাজানি হওয়ার আগে যেন সেটা ফেরত দেয়। এতে আমি কিছুই মনে করব না, কিন্তু যদি তা না হয়, তবে কেলেঙ্কারি অনেকদূর গড়াবে।”

কথা শেষ করে বড়মামা সকলের দিকে একবার করে তাকালেন। ঘরে তখন একটা ছূঁচ পড়লে শব্দ শোনা যায়। মিনিটখানেক সময়কেই মনে হচ্ছিল যেন পুরো এক ঘণ্টা। ছোটুদা বিরক্ত মুখে একবার টিভির গায়ে হাত বোলাল। নালুমামা হতাশ একটা ভঙ্গি করে ঘাড় নাড়লেন। বিষ্টুচরণ একবার এর মুখ একবার ওর মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে। শেষপর্যন্ত হাতজোড় করে গুরুদেবের পায়ের কাছে বসে পড়ল।

“এভাবে তা হলে ব্যাপারটা মিটিয়ে নেওয়া গেল না। ঠিক আছে,” বড়মামা উঠে ফোনের দিকে এগিয়ে গেলেন, “বাধ্য হয়েই পুলিশকে জানাতে হচ্ছে ব্যাপারটা। ওরাই এসে সার্চ করবে। এজন্য পরে কেউ আমাকে দোষ দিয়ো না।”

“সে কী কথা।” বড়মামিমা বললেন, “পুলিশ এসে আমাদের সার্চ করবে?”

“উপায় কী! মেয়ে-পুলিশও আনতে বলছি।”

বড়মামিমা রাগ রাগ মুখ করে চুপ করে গেলেন। বড়মামা ফোনে লোকাল থানার সঙ্গে কথাবার্তা বলে জায়গায় ফিরে এসে বললেন, “ওরা এখনই এসে পড়বে, তবে আসার আগে ঘর থেকে কাউকে বেরোতে বারণ করল।”

“তার মানে?” ছোট্টুদা সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়েছে, “আর মিনিট পনেরো পরে বন্ধুদের সঙ্গে আমাকে দেখা করতে হবে। এখানে বসে থাকলে চলবে?”

“নির্দেশটা তো আমার নয়, পুলিশ অফিসারের।”

“তাই বলে তুমি কি জোর করে আটকাবে নাকি?”

“তা আটকাব না, তবে পুলিশ যদি মণিটা খুঁজে না পায়, তা হলে কিন্তু—”

“তা হলে? কী হবে তা হলে? তার মানে, তুমি আমাকেও সন্দেহ কর!” ছোট্টুদারাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল, “বেশ তো, আমায় সার্চ করে নাও।”

‘সার্চ করা আমার কাজ নয়”—বড়মামা বললেন, “সেজন্য পুলিশ আছে।”

“তাই বলে আমায় এখানে চুপ করে বসে থাকতে হবে। বুঝতে পেরেছি—দুপুরে যা বললাম, তুমি তার শোধ তুলছ। ঠিক আছে—”

উসখুস করছিলেন গুরুদেবও, বললেন, “আমাকেও তো এবার উঠতে হয় বাবা, আহ্নিকে বসতে হবে।”

“আজকের মতো একটু দেরি করুন গুরুদেব, পুলিশ না এলে…”

“বলো কী! আমাকেও তা হলে তুমি, জয় কালী!”

বড়মামিমা জিভ কেটে কী বলতে যাচ্ছিলেন, থামিয়ে দিয়ে বড়মামা বললেন, “আমাকে ভুল বুঝবেন না গুরুদেব। এ-ঘরে যারা আছে তাদের কাউকেই আমি সন্দেহ করতে পারি না, সবাই আমার আপনজন। কিন্তু সন্দেহ যদি করতেই হয় তবে তার জন্য বাছাবাছি করাটা কি ঠিক হবে?”

“উত্তম, আমি পরেই যাব। পাপ যদি লাগে সে তোমাকেই লাগবে।”

আমার খুব জলতেষ্টা পাচ্ছিল। কী জানি কেন, হয়তো সিন্নিটা একটু বেশি খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। দরজার ওপাশে রামুদাকে দেখতে পেয়ে ইশারায় একটু জল দিতে বললাম।

নালুমামা একটু হাই তুলে নস্যির কৌটোটা অন্যমনস্কভাবে টেনে নিলেন। আস্তে আস্তে ঢাকা খুলে বললেন, “মরেছে! আমার নেশার জিনিসটা ফুরিয়ে গেছে যে! বাইরে তো আবার যাওয়া চলবে না!”

প্রশ্নটা ঠিক কাকে করা হল, বোঝা গেল না, তবে কথা শেষ করে নালুমামা এবার বড়মামার দিকে চেয়ে বললেন, “রামুকে দিয়ে আনানো চলবে তো?”

“ওরকম করে বলছ কেন!” বড়মামার গলায় বিষাদের সুর, “ব্যাপারটা বড় লজ্জার নলিনাক্ষ, এ নিয়ে ঠাট্টা কোরো না। রামুকে বলো, এনে দেবে।”

রামুদা জল নিয়ে এসেছিল। পকেট থেকে একটা আধুলি বের করে কৌটোটা ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে নালুমামা বললেন, “চট করে একটু নস্যি এনে দে তো বাবা। কতক্ষণ বসে থাকতে হবে, সে তো জানি না!”

নস্যির কৌটো নিয়ে রামুদা সবে দরজা পর্যন্ত গেছে, মাথার মধ্যে একটা সম্ভাবনা কেমন যেন বিদ্যুতের মতো খেলে গেল আমার। দু’-এক সেকেন্ডের দ্বিধা, তারপরই গ্লাসটা নামিয়ে রেখে আমি উঠে দাঁড়িয়েছি, বলেছি, “দাঁড়াও রামুদা, যেয়ো না।”

রামুদা থমকে দাঁড়িয়েছে। নালুমামা অবাক হয়ে বললেন, “মানে? রামু যাবে না কেন? ও তো আর এই ঘরে ছিল না।”

“না, কিন্তু নস্যির কৌটোটা তো ছিল।”

নালুমামার মুখটা কি একটু ফ্যাকাশে হয়ে গেল! হলেও, সঙ্গে সঙ্গে সামলে নিয়ে বললেন, “বাবা, এ যে দেখছি বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড়। নে বাবা, রামু, কৌটোটা খুলে ভাল করে পরীক্ষা করে নে। মণিটনি যদি থাকে।”

“খোকন।” বড়মামা একটা হালকা ধমক দিলেন আমাকে, “ওসব কথা বলছিস কেন?”

“কেন বলছি, কৌটোটা হাতে নিলেই তুমি বুঝতে পারবে।”

“মানে?”

“রামুদা।” অকস্মাৎ তীব্র চিৎকার করে উঠেছি আমি, কারণ, ও তখন সুযোগ বুঝে কৌটো নিয়ে দরজার বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। চিৎকার শুনে থতমত খেয়ে ফিরে দাঁড়াল। আমি সেইভাবেই বললাম, “কৌটোটা তুমি বড়মামার হাতে দাও।”

রামুদার মুখ কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই রক্তহীন হয়ে গেল। পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছিল, বড়মামার কাছাকাছি এসেই তাঁর পায়ের ওপর সটান আছড়ে পড়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল, “বাবু, আপনার পায়ে পড়ি বাবু, এবারকার মতো আমারে মাপ করি দ্যান বাবু—”

এরকম কিছু যে হবে, বড়মামা নিজেও তা ভাবতে পারেননি বোধহয়। কোনওরকমে পা সরিয়ে নিয়ে বললেন, “কী হয়েছে কী, সেটা বলবি তো!”

“অভাবে স্বভাব নষ্ট বাবু। মেয়েটার জোর অসুখ, দেশ থেকে চিঠি পেইছি—ডাক্তার নাকি বলছে অপরেশন করতি হবে। দু’হাজার টাকা খরচ। মাথাখারাপ হয়ে গেল বাবু, অত টাকা তো আর আপনারে বললি আপনি দেবেন না। নালুবাবু কথাটা জানতি চাইলেন। বললাম। তা বললেন, আমারে একটা ছোট্ট কাজ করে দে—দেবোনে দু’হাজার ট্যাকা। লোভ সামলাতে পারলাম না বাবু। তাই—”

“তা তুমি মেন সুইচ বন্ধ করে নালুমামাকে হাত সাফাইয়ের সুযোগ দিলে?” আমি বললাম, “আর এখন যাচ্ছিলে সেটা সরিয়ে রাখতে। তাই না?”

“দাঁড়া, দাঁড়া,” বড়মামা তাড়াতাড়ি কৌটোর ঢাকনি খুলে সেটা টেবিলের ওপর উপুড় করলেন। একরাশ নস্যির মধ্য থেকে ঠক করে মণিটা পড়ল টেবিলে। সঙ্গে সঙ্গে রুমাল দিয়ে মুছে সেটা হাতের তালুতে রাখলেন বড়মামা।

আঃ। নীলকান্তমণি তো নীলকান্তমণি, নীল আভায় ঘর একেবারে ঝকঝক করছে।

বড়মামা সাবধানে সেটা বাক্সে ভরতে ভরতে বললেন, “কিন্তু এতসব ব্যাপার তুই বুঝলি কেমন করে?”

“আগে কিছুই বুঝিনি বড়মামা,” আমি বললাম, “নস্যি আনার কথা শুনেই হঠাৎ আমার মনে পড়ে গেল নালুমামা তো সকালে কৌটো ভরতি করে নস্যি আনিয়েছেন রামুদাকে দিয়ে—আমি দেখেছি। বাবা তো খুব নস্যি নেন, কিন্তু যেদিন আনি সেদিন তো ফুরোয় না, অন্তত দু’দিন চলে। মনে হল, ওর মধ্যেই নেই তো মণিটা। সঙ্গে সঙ্গে আরও অনেক কথা খেলে গেল মাথায়। হাত-সাফাইয়ের খেলা নালুমামা খুব ভাল জানেন। আলোটা ঠিক ওই সময়েই বা নিভল কেন! ফিউজ কেটে গেছে? এত তাড়াতাড়ি কি ফিউজ পালটানো সম্ভব। এ-ঘরে আমরা সবাই বসে রয়েছি, গুরুদেবও রয়েছেন, ফিউজ পালটাবার আগে রামুদা একটা আলো তো অন্তত দিয়ে যাবে এই ঘরে! সমস্ত মিলিয়ে এ যোগসাজশের ব্যাপারটা এমন স্পষ্ট হয়ে গেল যে, আমি..”

বড়মামা মুগ্ধ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন দেখে লজ্জায় আমি কথা শেষ করতে পারলাম না। বড়মামা মণির বাক্সটার গায়ে আর-একবার হাত বুলিয়ে বললেন, “নাঃ, চালটা নলিনাক্ষ ভালই চেলেছিল! নস্যির কৌটোটা টেবিল থেকে তোলেনি পর্যন্ত পাছে সন্দেহ হয়। অথচ তোর চোখকে ফাঁকি দিতে পারল না রে খোকন! জিতা রহো ভাগনে, আসল চ্যাম্পিয়ান তুই এবারই হলি। ক্যালকুলেটরে আর কুলোবে না, এবার তোক একটা…”

খেয়াল করিনি, নালুমামা উঠে দাঁড়িয়েছেন। দরজার বাইরে বেরিয়ে পড়েছেন দেখেই বড়মামা চিৎকার করে উঠেছেন।

আমরা সকলেই উঠে পড়েছিলাম। কিন্তু…

কিন্তু তার আর দরকার ছিল না। বাইরের দরজায় ঠিক তখনই একটা জিপ এসে দাড়াবার শব্দ পাওয়া গেছে।

২৩ ডিসেম্বর ১৯৯২

অলংকরণ : কৃষ্ণেন্দু চাকী

সকল অধ্যায়

১. নাম-না-জানা বন্ধু – এণাক্ষী চট্টোপাধ্যায়
২. চুরির তদন্ত – প্রতিভা বসু
৩. জ্বরের ঘোরে শোনা – সমরেশ বসু
৪. গোয়েন্দার নাম গোগো – গৌরাঙ্গপ্রসাদ বসু
৫. গ্রহ থেকে – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
৬. খুনি – সমরেশ মজুমদার
৭. ব্যাঙ্ক ডাকাত কুপোকাত – সমরেশ মজুমদার
৮. সর্বেশ্বরের কেরামতি – সুভদ্রকুমার সেন
৯. অভ্রর গোয়েন্দাগিরি – রঞ্জিত চট্টোপাধ্যায়
১০. মতিলালের মুশকিল – সুভদ্রকুমার সেন
১১. শুভ্রদীপের বুদ্ধি – রঞ্জিত চট্টোপাধ্যায়
১২. জটাধরের জট – আনন্দ বাগচী
১৩. কালো কুকুর – সৈয়দ মুজতবা সিরাজ
১৪. নীলশার্ট, লালগেঞ্জি – অশোক বসু
১৫. গোয়েন্দা-লেখক গুপ্তসভা – বিমল কর
১৬. একটি জলবৎ রহস্য – সিদ্ধার্থ ঘোষ
১৭. চোর-পুলিশ – প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত
১৮. লোটেশ্বরের সাধু – দিব্যেন্দু পালিত
১৯. মিশরীয় জাহাজের রহস্য – অদ্রীশ বর্ধন
২০. অম্বর তদন্ত – ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়
২১. পোড়োবাড়ির রহস্য – নলিনী দাশ
২২. মাত্র একখানা থান ইট – আশাপূর্ণা দেবী
২৩. কঠিন শাস্তি – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
২৪. আমিই গোয়েন্দা – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
২৫. নীলকান্তমণি উধাও – হীরেন চট্টোপাধ্যায়
২৬. ফটিকের কেরামতি – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
২৭. লাখ টাকার পাথর – সমরেশ মজুমদার
২৮. জুহু বিচে তদন্ত – ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়
২৯. পটলবাবুর বিপদ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
৩০. অর্জুন হতভম্ব – সমরেশ মজুমদার
৩১. কিস্তিমাত – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
৩২. রহস্য রজনীগন্ধার – ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়
৩৩. কৃষ্ণধাম কথা – বিমল কর
৩৪. আমি অর্জুন – সমরেশ মজুমদার
৩৫. মহারাজের হিরের আংটি – রূপক সাহা
৩৬. আজব গোয়েন্দার দেশে – আবুল বাশার
৩৭. চারুহাসিনীর দেওয়াল-সিন্দুক – সুচিত্রা ভট্টাচার্য
৩৮. দক্ষিণাবর্ত শঙ্খ – ঋতা বসু
৩৯. শিরকুণ্ডা মন্দিরের সাধু – ঋতা বসু
৪০. রানি ভিক্টোরিয়ার টাকা – অনিল ভৌমিক
৪১. দেবতার হাত – অনির্বাণ বসু
৪২. মধুরা নিরুদ্দেশ – সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
৪৩. আর-একটু হলে – সুকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়
৪৪. দ্যুতির গোয়েন্দাগিরি – রাজেশ বসু
৪৫. অভিনেত্রীর হার – অনন্যা দাশ
৪৬. গুপ্তধনের ঠিকানা – শ্যামল দত্তচৌধুরী
৪৭. হার চোর – চঞ্চলকুমার ঘোষ

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন