২৪. উপঢৌকনের বিনিময়ে হেক্টরের মৃতদেহ লাভ

পার্থ সারথী দাস

তুর্বিংশ পর্ব
উপঢৌকনের বিনিময়ে হেক্টরের মৃতদেহ লাভ

ক্রীড়াপ্রতিযোগিতা ও নৈশভোজন সমাপন করে গ্রীকবীরেরা নিদ্রাভিভূত হয়ে পড়লেন আপন আপন জাহাজে গিয়ে। কিন্তু একা অ্যাকেলিস অশান্ত চিত্তে প্যাট্রোক্লাসের কথা ভাবতে থাকায় নিদ্রা যেতে পারলেন না। অতীতে কত সমুদ্র, ভূধর, প্রান্তর ও রণক্ষেত্রে তাকে যে মধুর সান্নিধ্যদানে প্রীত করেছিলেন প্যাট্রোক্লাস, তার কথা ভেবে অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠল তার চোখ। তখন তিনি সমুদ্রতীর গিয়ে তার রথের পিছনে হেক্টরের মৃতদেহটিকে বেঁধে প্যাট্রোক্লাসের সমাধিটিকে তিনবার প্রদক্ষিণ করলেন। কিন্তু অ্যাপোলোর অনুগ্রহবশত বিকৃত হলো না মৃতদেহটি।

এইভাবে হেক্টরের মৃতদেহটিকে আবার অ্যাকেলিস অপমানিত করলে দেবতাদের করুণা হলো। তারা হার্মিসকে গোপনে মৃতদেহটিকে চুরি করে আনার জন্য আদেশ দিলেন। কিন্তু হেরা, পসেডন ও এথেন এ বিষয়ে একমত হতে পারলেন না। বিশেষ করে হেরা ও এথেন অতীতের একটি কথা ভুলতে পারলেন না। একবার হেরা, এথেন ও অ্যাফ্রোদিতে মেষচারণরত আলেকজান্দ্রাসের সামনে এসে উপস্থিত হন। তারা তখন সোনার যে আপেলটিকে নিয়ে খেলা করছিলেন সেটি হঠাৎ আলেকজান্দ্রাসের হাতে এসে পড়ল। তারা তিনজনে তাঁর কাছে এলে তাঁদের মধ্যে অ্যাফ্রোদিতের হাতে আপেলটি দান করে আলেকজান্দ্রাস। অ্যাফ্রোদিতের প্রতি তার পক্ষপাতিত্বের জন্য হেরা ও এথেন সেই থেকে প্রিয়ামনগরী ও প্যারিসের উপর ক্রুদ্ধ হয়ে আছেন। অ্যাফ্রোদিতের আশীর্বাদেই অস্বাভাবিকভাবে নারীদেহালোলুপ হয়ে ওঠে আলেকজান্দ্রাস এবং পর মর্ত্যভূমির সর্বশ্রেষ্ঠ সুন্দরী হেলেনকে লাভ করে।

বারোদিন এইভাবে কেটে গেলে অ্যাপোলো অন্যান্য দেবতাদের বললেন, সে দেবতাবৃন্দ, তোমাদের নিজেদের কাছে নিজেদেরই লজ্জা পাওয়া উচিত। হেক্টর কি কোনদিন নিষ্কলঙ্ক ছাগ বা বকনার উরুদেশের মাংস কেটে তোমাদের উৎসর্গ করেনি? আজ তার পিতামাতা ও স্ত্রী যাতে তার মৃতদেহটি চিতানলে দাহ করে যথাযথভাবে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন করতে পারে তার জন্য তার মৃতদেহটিকে উদ্ধার করে সৎ সাহস তোমাদের নেই। যে অ্যাকেলিসের মত অনমনীয়, দুর্বিনীত এবং অন্যায়পরায়ণ, তোমরা তারই পক্ষ অবলম্বন করছ। সে বিবেক মানুষের অসময়ের বন্ধু সেই বিবেক ও দায়ামায়া সব উদ্ধত সিংহের মত ঝেড়ে ফেলে দিয়েছে অ্যাকেলিস। অ্যাকেলিস যা হারিয়েছে তার থেকে আরো অনেক বেশি প্রিয়জন অর্থাৎ পুত্র ও ভ্রাতাকে হারিয়েও মানুষ তা সহ্য করে। কিন্তু অ্যাকেলিস হেক্টরকে হত্যা করে রথের পিছনে বেঁধে তার সহকর্মীর সমাধির চারপাশে ঘোরাচ্ছে। এটা না করলে সে ভাল করত। তার ক্রোধ প্রকাশের এই জঘন্য রীতিটিকে আমরা দেবতারা ভালভাবে মানতে নাও পারি।

এ কথায় রেগে গেলেন হেরা। তিনি বললেন, হে রজতশুভ্র ধনুর্ধারী দেবতা, যদি তুমি হেক্টর ও অ্যাকেলিসকে একই সম্মানের আসনে বসাতে চাও তাহলে তোমার কথা সব মিথ্যা। কিন্তু মনে রেখো, হেক্টর কোন এক মর্থ্য নারীর স্তনদুগ্ধে লালিত হয়েছে, কিন্তু অ্যাকেলিস এমন এক দেবতার সন্তান আমি নিজে যাকে একদিন লালন পালন করে পরে পেলেউসের সঙ্গে তার বিবাহ দিই। দেবানুগৃহীত সেই পেলেউসের বিবাহোৎসবে তোমরা সকলেই বীণা হস্তে যোগদান করেছিলে।

জিয়াস তখন বললেন, রাগ করো না হেরা, তাদের সম্মান এক হবে না, তবে হেক্টর কোনদিন আমাদের পূজা ও অর্থ দান করতে ভোলেনি বলে সে চিরদিন দেবতাদের প্রিয়। আমাদের প্রাপ্য অঞ্জলি থেকে কখনো সে বঞ্চিত করেনি আমাদের। সুতরাং আমি চাই হেক্টরের মৃতদেহ অপহরণ করে আনা হোক। অবশ্য এক কথা জানতে পারবে অ্যাকেলিস। কারণ তার মাতা দিনরাত বসে আছে তার কাছে। তোমাদের কেউ থেটিসকে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও। আমি তাকে বুঝিয়ে বলব অ্যাকেলিস যেন প্রিয়ামের কাছ থেকে উপঢৌকন নিয়ে হেক্টরের মৃতদেহটিকে দান করে।

জিয়াসের এই আদেশ থেটিসকে দান করার জন্য দ্রুতগামী আইরিস সামস ও ইমব্রেস দ্বীপের মাঝখানে এক জায়গায় সমুদ্রগর্ভে প্রবেশ করলেন। সমুদ্রের শেষ তলপ্রান্তে গিয়ে আইরিস দেখলেন একটি গুহার মধ্যে জলপরীদের নিয়ে শোকে আকুল হয়ে কাঁদছেন থেটিস। কারণ তাঁর পুত্র অ্যাকেলিস স্বদেশ হতে বহু দূরে শীঘ্রই প্রাণত্যাগ করবে। আইরিস তাঁকে বললেন, জিয়াস তোমাকে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার আদেশ দিয়েছেন। থেটিস বললেন, যদিও শোকে দুঃখে অভিভূত হয়ে আমি কোথাও বার হচ্ছি না, তথাপি তিনি যখন ডেকেছেন আমাকে যেতেই হবে, কারণ তাঁদের আদেশ অমোঘ এবং অব্যর্থ।

এই কথা বলে আইরিসের সঙ্গে জল কেটে ঊর্ধ্বে উঠতে লাগলেন থেটিস। সমুদ্রপৃষ্ঠে উঠে তাঁরা উড়ে চললেন অলিম্পাস পর্বতের স্বর্ণশিখরদেশে। থেটিস সেখানে গিয়ে দেখলেন দেবরাজ জিয়াস আগে হতেই দেবতাদের সঙ্গে এক সভায় মিলিত হয়েছেন। তিনি যেতেই হেরা তার হাতে একটি পানপাত্র তুলে দিলেন। থেটিস তার থেকে মদটুকু খেয়ে স্বর্ণপাত্রটি ফিরিয়ে দিলেন হেরার হাতে। তারপর থেটিস একটি আসনে উপবেশন করলে জিয়াস বললেন, হে দেবী, আমি জানি, এক গভীর দুঃখ বিচার করছে তোমার হৃদয়ে। তথাপি যখন অলিম্পাসে এসেছ তখন আমি বলছি কেন তোমায় ডেকেছি। অ্যাকেলিস ও হেক্টরের ব্যাপার নিয়ে আজ নয়দিন যাবৎ দেবতাদের মধ্যে বিবাদ চলছে। দেবতারা চায় হার্মিস গিয়ে হেক্টরের মৃতদেহটিকে অপহরণ করে আনুক। কিন্তু আমি তোমার বন্ধুত্ব চাই বলে তোমার প্রতি শ্রদ্ধাবশত তারা তার করতে পারছে না। এখন শোন, আমি তোমার পুত্রের জন্য যথোচিত সম্মানের ব্যবস্থা করব। এখন তুমি গ্রীক জাহাজে গিয়ে অ্যাকেলিসকে আমার কথা বল। বল সমস্ত দেবতাদের মধ্যে সবচেয়ে আমি বেশি ক্রুদ্ধ হয়েছি তার উপর। কারণ হেক্টরের মৃতদেহটি সে ছাড়ে নি এখনো। সুতরাং আমার ভয়ে সে মৃতদেহটি ছেড়ে দিতে পারে। তবে আমি আইরিসকে প্রিয়ামের কাছে পাঠিয়ে উপযুক্ত উপঢৌকন দান করে অ্যাকেলিসকে সন্তুষ্ট করতে বলব।

কালবিলম্ব না করে শুভ্রচরণকমলা থেটিস অলিম্পাসের পর্বতশিখর হতে চলে গেলেন অ্যাকেলিসের জাহাজে। গিয়ে দেখলেন, তখনো এক তীব্র শোকে আকুল হয়ে হাহাকার করছে অ্যাকেলিস। তার সহকর্মীরা আহারের ব্যবস্থা করলেও সেদিকে তাঁর মন নেই। থেটিস তার পুত্রকে আদর করে বললেন, হে পুত্র, আর কতদিন তুমি এভাবে শোকে আর্তনাদ করে যাবে? তুমি তোমার নিজের অন্তরকে নিজেই আঁচড়ে ছিঁড়েখুঁড়ে দিচ্ছ। তোমার পরমায়ু আর বেশিদিন নেই। মৃত্যুর দিন এগিয়ে আসছে। আসন্ন মৃত্যুর এক করাল পটভূমির মাঝেই ক্ষণায়ু জীবনটিকে সর্বতোভাবে উপভোগ করতে হবে তোমায় আর তার জন্য চাই উত্তম খাদ্য আর নারীসঙ্গ। সুতরাং আমার কথা শোন। জিয়াসের কাছ থেকে আমি আসছি, তিনি ক্রুদ্ধ হয়েছেন তোমার উপর। উপযুক্ত উপঢৌকন নিয়ে হেক্টরের মৃহদেহটিকে তাঁর কথামত ওদের হাতে ছেড়ে দাও।

অ্যাকেলিস তখন বললেন, তবে তাই হোক, অলিম্পাস-অধিপতি জিয়াস যখন বলেছেন তখন তাই হবে, যে উপঢৌকন নিয়ে আসবে সেই মৃতদেহ নিয়ে যাবে।

এইভাবে মাতা ও পুত্রে অনেকক্ষণ ধরে আলোচনা হলো। ইতিমধ্যে জিয়াস রাজা প্রিয়ামের কাছে পাঠিয়ে দিলেন আইরিসকে। তিনি বললেন, ইলিয়াম নগরীতে রাজা প্রিয়ামের কাছে এখনি যাও আইরিস। তাকে বল সে যেন সঙ্গে এমন সব উপঢৌকন নিয়ে যান যাতে সন্তুষ্ট হতে পারে অ্যাকেলিস। কয়েকজন বিশ্বস্ত ভৃত্য ছাড়া আর কেউ সঙ্গে থাকবে তা তার। অ্যাকেলিসের শিবিরে যেতে যে ভয় না করে। কারণ অ্যাকেলিস নির্বোধ বা দুষ্ট প্রকৃতি নয়। সে তার কোন ক্ষতি করবে না।

বাতাসের মত দ্রুতগতিতে প্রিয়াম প্রাসাদে চলে গেলেন আইরিস। গিয়ে দেখলেন, এক তীক্ষ্ণ ক্রন্দনধ্বনিতে নিনাদিত হচ্ছে সমগ্র প্রাসাদ। সর্বক্ষণ মাটিতে মাথা ঠোকার জন ধূলিমলিন হয়ে উঠেছে রাজা প্রিয়ামের পোশাকটি। তাঁর পুত্ররা তার চারদিকে বসে রয়েছে। তাঁর কন্যাগণ ও পুত্রবধূরা সকলে শোকে আকুল হয়ে কাঁদছে। আইরিস তাঁর কাছে গিয়ে ডাকতেই নতুন কোন দুঃসংবাদের ভয়ে ভীত হয়ে উঠলেন তিনি। কিন্তু আইরিস বললেন, ভীত হয়ো না হে দার্দাসপুত্র, শোকোচ্ছাস সংবরণ করো। আমি কোন দুঃসংবাদ বহন করে আনি নি। দেবরাজ জিয়াস তোমার প্রতি সদয় হয়ে আমাকে বলে পাঠিয়েছেন তুমি কয়েকজন ভৃত্যসহ গাড়িতে করে অ্যাকেলিসকে উপযুক্ত উপঢৌকন দান করে হেক্টরের মৃতদেহটি নিয়ে এস। তোমার ভয়ের কোন কারণ নেই, কারন তোমার সঙ্গে হার্মিসকে তিনি পাঠাবেন।

এই কথা বলে চলে গেলেন আইরিস। প্রিয়াম তখন উঠে তাঁর পুত্রদের একটি মালবাহী গাড়ি প্রস্তুত করতে বলে ধনাগারে চলে গেলেন। সেখানে গিয়ে রাণী হেকুবাকে বললেন, অলিম্পাস থেকে এক দেবদূত এসে উপযুক্ত উপঢৌকন দিয়ে অ্যাকেলিসের কাছ থেকে হেক্টরের মৃতদেহটি আমাকে নিজে গিয়ে নিয়ে আসতে বলছেন। এবিষয়ে তুমি কি মনে করো? যদিও গ্রীকদের মাঝখানে যেতে আবার প্রবৃত্তি হচ্ছে না।

রাণী হেকুবা চিৎকার করে বললেন, যে বিচারবুদ্ধির জন্য তুমি একদিন খ্যাতি অর্জন করেছিলে দেশের লোকের কাছে, সে বিচারবুদ্ধি আজ তোমার গেল কোথায়? যে তোমার এতগুলো পুত্রকে হত্যা করেছে কোন সাহসে তুমি একা যেতে চাও তার কাছে। আমার পুত্র হেক্টর কাপুরুষ ছিল না, সে বীরের মত ট্রয়জাতিকে রক্ষা করার জন্য প্রাণ দিয়েছে। তার ভাগ্যে থাকে তো তার দেহ কুকুরে ছিঁড়ে খাক।

কিন্তু প্রিয়াম বললেন, আমি সেখানে যাবই, কুলক্ষণাক্রান্ত পাখির মত আমাকে বাধা দিও না। কোন মানুষ যদি একথা বলত তাহলে তার কথা আমি বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু আমি নিজে দেখেছি একজন দেবী আমাকে একথা বলেছেন। তাছাড়া আমি একবার মৃত পুত্রকে আলিঙ্গন করার পর যদি অ্যাকেলিসের হাতে মৃত্যুবরণ করি তাহলে তাতে আমার কোন দুঃখ থাকবে না।

এই বলে তিনি সিন্দুকের ঢাকনাটি খুলে বারোটি উজ্জ্বল পোশাক, বারোটি দেহবন্ধনী, চারটি গামলা, ছয়টি বাসন, দশটি স্বর্ণমুদ্রা ও একটি সুন্দর পানপাত্র তুলে নিলেন। তারপর প্রাসাদপ্রাঙ্গণে গিয়ে শোকবিলাপরত ট্রয়বাসীদের ভর্ৎসনা করে বললেন, দূর হয়ে যাও তোমরা। আপন আপন বাড়িতে গিয়ে শোক প্রকাশ করো। আর তো হেক্টর নেই। এবার গ্রীকরা এসে তোমাদের সকলকে হত্যা করবে। আর এ নগর ধ্বংস হবার আগেই আমার যেন মৃত্যু হয়। এরপর তিনি তাঁর অবশিষ্ট নয়জন পুত্রকে ডাকলেন। তারা হলো, হেলেনাস, প্যারিস, অ্যাগাথন, পামন, অ্যান্টিলোকাস, পোলাডেস, দীফোবাস, হিপ্লোথোয়াস ও দিয়াস। তিনি চিৎকার করে তাদের বললেন, যতসব অপদার্থের দল। হেক্টরের পরিবর্তে তোমাদের সকলের মৃত্যু হলো না কেন? আমার সব থেকে ভাল তিনজন পুত্র-মেস্টর, ট্রয়লাস আর হেক্টর চলে গেছে। এদের মধ্যে হেক্টর ছিল নরলোকে দেবতার মতো। আর যারা আমার কাছে লজ্জার বস্তু তারা রয়ে গেল জীবিত। এখনো আমার জন্য একটি মালবাহী গাড়ি প্রস্তুত করে তাতে সব উপহারের বস্তাগুলো তোলনি কেন?

প্রিয়ামপুত্ররা তখন ভয়ে ভয়ে তার পিতার আদেশ পালন করল। যে মালবাহী গাড়িটি একদিন মাইসিয়াবাসীরা দান করে রাজা প্রিয়ামকে সেই গাড়িটিতে উপঢৌকনের বস্তুগুলো সাজিয়ে রাখল তারা। তারপর তারা প্রিয়ামের নিজস্ব অশ্বগুলো সংযোজিত করল তার রথে। যাত্রাকালে রাণী হেকুবা একটি পবিত্র পানপাত্র এনে রাজা প্রিয়ামের হাতে দিয়ে জিয়াসের উদ্দেশ্যে মদের অঞ্জলি দিতে বললেন। তারপর বললেন, সর্বদ্রষ্টা জিয়াসের কাছে প্রার্থনা করে বল, তিনি যদি শুভলক্ষণসূচক একটি পাখিকে তোমার ডানদিকে পঠিয়ে না দেন তাহলে তোমাকে আমি যেতে দিব না।

প্রিয়াম বললেন, ঠিক আছে, তাই হবে। এই কথা বলে দাসীদের কাছ থেকে পবিত্র জল দিয়ে প্রথমে হাত ধুলেন প্রিয়াম তারপর পবিত্র পানপাত্রটি হাতে নিয়ে মাটিতে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে হাত তুলে বললেন, হে সর্বশক্তিমান জিয়াস, তোমার কৃপায় আমি যেন গ্রীকজাহাজে সদয় ব্যবহার ও সহানুভূতিসূচক অভ্যর্থনা লাভ করি। আর তুমি শুভ লক্ষণসূচক এক পাখিকে তোমার দূত হিসেবে আমার দক্ষিণ দিকে পাঠিয়ে দাও।

রাজা প্রিয়ামের প্রার্থনা স্বকর্ণে শুনলেন দেবরাজ জিয়াস। সঙ্গে সঙ্গে তিনি বিশাল কৃপক্ষবিশিষ্ট একটি ঈগল পাখিকে পাঠালেন এবং তার দক্ষিণ দিকে তা দেখে আনন্দিত হয়ে রখে আরোহণ করলেন রাজা প্রিয়াম। তার আগে আগে চারটি খচ্চর সেই মালবাহী গাড়িটিকে টেনে নিয়ে যেতে লাগল এবং আইডেউস সে গাড়ি চালনা করতে লাগল।

প্রিয়াম ও আইডেউস রওনা হয়েছেন দেখে জিয়াস হার্মিসকে বললেন, তুমি প্রিয়ামকে সঙ্গে নিয়ে গ্রীকজাহাজে যাও। তিনি অ্যাকেলিসের কাছে যাওয়ার আগে অন্য গ্রীক যেন তাকে দেখতে না পায়।

এই আদেশমত আর্গসহন্তা হার্মিস পায়ে স্বর্ণপাদুকা পরিধান করে আকাশপথে উড়ে চললেন। নিদ্রা ও জাগরণের রহস্যসম্বলিত এক আশ্চর্য জাদুকাঠি ছিল তাঁর হাতে। তিনি যথাসময়ের হেলেসপট উপসাগরের তীরে গ্রীকজাহাজের কাছে উপনীত হলেন। তাঁকে দেখে অভিজাতবংশীয় যৌবনসমৃদ্ধ এক সুন্দর মানবসন্তান বলে প্রতীয়মান হচ্ছিল।

ট্রয়ের রণপ্রান্তরের এক প্রান্তে উপস্থিত ইলাসের সমাধিস্তম্ভের পাশে যখন উপস্থিত হলেন রাজা প্রিয়াম তখন সন্ধ্যা সমাগত প্রায়। পার্শ্ববর্তী নদী হতে জল পান করার মানসে সেখানে গাড়ি থামালেন তাঁরা। কিন্তু মানবরূপ হার্মিসকে তাঁদের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে ভীতি হয়ে আইডেউস বলল, একজন লোক বোধহয় আক্রমণ করবে আমাদের। আমরা কি দ্রুত চলে যাব অথবা ওর কাছে দয়াভিক্ষা করব?

একথা শুনে ভীত হয়ে উঠলেন রাজা প্রিয়াম। তার মাথার চুলগুলো খাড়া হয়ে উঠলো। এমন সময় হার্মিস তাদের দিকে এগিয়ে এসে বলল, হে পিতৃপ্রতিম বৃদ্ধ, এই রাত্রিবেলায় কোথায় চলেছ। তুমি এবং তোমার সহচর দুজনেই বন্ধু। তোমাদের এই সব ধনরত্ন যদি গ্রীকরা দেখে ফেলে তাহলে কে তোমাদের রক্ষা করবে?

প্রিয়াম উত্তর করলেন, নিশ্চয় কোন দেবতা তোমাকে উপযুক্ত সময়ে পাঠিয়ে দিয়েছেন আমার কাছে। তোমার কথা শুনে ও চেহারা দেখে কোন দেবসন্তান বলে মনে হচ্ছে।

হার্মিস তখন বললেন, তোমার অনুমান যথার্থ। কিন্তু তুমি আমাকে বল, তুমি কি তোমার পুত্রের মৃত্যুতে ইলিয়াম নগরী ত্যাগ করে কোন দূরদেশে তোমার সব ধনরত্ন। নিয়ে চলে যাচ্ছ?

প্রিয়াম বললেন, কে তুমি, কেই বা তোমার পিতামাতা? আমার পুত্রের মৃত্যুসংবাদ কেমন করে জানলে তুমি?

হার্মিস উত্তর করলেন, তুমি বলছ হেক্টরের কথা। কতদিন আমি তাকে নিজের চোখে বীরত্বসহকারে যুদ্ধ করতে দেখেছি ট্রয়ের রণপ্রান্তরে। আমি হচ্ছি মার্মিডনদেশীয় এক সৈনিক অ্যাকেলিসের সারথী। আমি আমার পিতা পোলাইতেসের সপ্তম সন্তান। আমি রণপ্রান্তরে আগেই এসেছি। আগামীকাল প্রাতে গ্রীকরা আবার যুদ্ধ শুরু করবে।

প্রিয়াম তখন বললেন, তুমি যদি অ্যাকেলিসের সহচর হও তাহলে বল আমার পুত্রের মৃতদেহটি এখনো অবিকৃত আছে কি না? অ্যাকেলিস কি সে দেহ কেটে খণ্ড খণ্ড করে শিকারি কুকুর দিয়ে খাইয়েছে?

হার্মিস বললেন, গ্রীকজাহাজে শায়িত তোমার পুত্রের মৃতদেহটিকে এখনো পর্যন্ত কুকুর বা শকুনিতে খায় নি। বারোদিন হলো আমার পুত্র নিহত হয়েছে। রোজ একবার করে অ্যাকেলিস সে দেহটি টেনে নিয়ে যায় তার সহকর্মীর সমাধিস্তম্ভের পাশে। তবু সে দেহ আজও বিকৃত হয় নি বা তাতে পচন ধরে নি। দেবতাদের কৃপায় তোমার পুত্রের মৃতদেহ ধৌত করা হয়েছে এবং তার ক্ষতস্থানগুলো বন্ধ হয়ে গেছে আপনা থেকে।

বৃদ্ধ প্রিয়াম বললেন, এটা সম্ভব হয়েছে দেবতাদের উদ্দেশ্যে নিয়মিত পূজা ও অর্ঘ্যদানের ফলে। এ কাজে কোনদিন ভুল হয় নি তার। তাই তার মৃত্যুতেও দেবতারাও তার কথা মনে রেখেছেন। হে যুবক, আমার এই পানপাত্রটি গ্রহণ করে আমাকে গ্রীকজাহাজে পথ দিয়ে নিয়ে চল।

হার্মিস বললেন, আমি বয়সে যুবক হলেও আমাকে কোনকিছুর দ্বারা প্রলুব্ধ করতে পারবে না। তাছাড়া অ্যাকেলিসের বিনা অনুমতিতে আমি কিছু দিতে পারব না। তবে তোমাকে জলপথে বা স্থলপথে যেকোনভাবে নিরাপদে তোমার গন্তব্যস্থলে নিয়ে যাব। কেউ কোন ক্ষতি করতে পারবে না তোমার।

এই কথা বলে হার্মিস রথে চেপে নিজে চাবুক নিয়ে অশ্বচালনা করতে লাগলেন। গ্রীকপ্রাচীর ও পরিখার কাছে গিয়ে হার্মিস প্রহরীদের তাঁর মায়াশক্তির প্রভাবে ঘুম পাড়িয়ে রাখলেন। তারপর নিজের হাতে দ্বারপথ খুলে গ্রীকশিবিরে প্রবেশ করলেন। অ্যাকেলিসের জন্য মার্মিডনরা পাইন কাঠ দিয়ে তৈরি এক খড়ের ছাউনি দিয়ে কুটির নির্মাণ করেছিল। কুটিরের সামনে ছিল চারদিকে ঘেরা এক প্রশস্ত অঙ্গন। তার একদিকে এমন একটি ভারী দরজা ছিল যা তিনজন লোকে খুলত ও বন্ধ করত। হার্মিস নিজে সে দরজা খুলে প্রিয়ামকে সেখানে প্রবেশ করতে বললেন, আমি আর যাব না, তাতে অ্যাকেলিস রেগে যাবে। তুমি তার কাছে গিয়ে তা পা দুটো জড়িয়ে ধরে অনুনয় বিনয় করবে।

এই কথা বলে হার্মিস চলে যেতে রাজা প্রিয়ম আইডেউসকে সেখানে তাঁর রথ ও মালবাহী গাড়ির কাছে দাঁড় করিয়ে রেখে একা চলে গেলে অ্যাকেলিসের ঘরে। তাঁকে কিন্তু কেউ দেখতে পেল না। প্রিয়াম দেখলেন, তখন সবেমাত্র নৈশভোজন শেষ হয়েছে অ্যাকেলিসের। তার অনুচররা তাঁর সেবার কাজে ব্যস্ত। প্রিয়াম সোজা অ্যাকেলিসের কাছে গিয়ে তাঁর পা দুটো জড়িয়ে ধরলেন। কোন পলাতক নরহন্তাকে চোখে দেখে যেমন মানুষ বিস্মিত হয় তেমনি রাজা প্রিয়ামকে একাকী তার ঘরে দেখে বিস্মিত হলেন অ্যাকেলিস। যে হাত দিয়ে অ্যাকেলিস প্রিয়ামের বহু পুত্রকে হত্যা করেছেন সেই হাত দুটি চুম্বন করলেন প্রিয়াম। এবার ঘরের সকলেই দেখতে পেল প্রিয়ামকে।

প্রিয়াম তখন অ্যাকেলিসকে সকাতর অনুনয়ের সুরে বললেন, তুমি একবার তোমার পিতার কথা স্মরণ করো অ্যাকেলিস। আজ তিনিও আমার মতই এক শোচনীয় বার্ধক্যে উপনীত হয়েছেন। আজ তিনি হয়ত দুঃখে কালযাপন করছেন তোমার অভাবে। অথচ তিনি একদিন তোমাকে দেখতে পাবেন ভেবে এখনো আশায় বুক বেঁধে আছেন। কিন্তু আমি হচ্ছি এমনই হতভাগ্য যে আমার বীর পুত্রদের একজনও জীবিত নেই আজ। আমার মোট পঞ্চাশজন পুত্রের মধ্যে উনিশজন আমার একজন মাত্র বিবাহিত স্ত্রীর গর্ভে জাত, আর বাকি সব আমার প্রাসাদের দাসীদের গর্ভজাত। আমার বীর পুত্রগণের মধ্যে একমাত্র হেক্টরই জীবিত ছিল। কিন্তু সম্প্রতি তুমি তাকে হত্যা করেছ। আর আমি তাই উপযুক্ত উপঢৌকন দান করে তার মৃতদেহটি নিয়ে যেতে এসেছি। হে অ্যাকেলিস, দেবতাদের কথা স্মরণ করে আমার উপর দয়া করো। তোমার মত এক পুত্রহন্তার হাত যখন আমার ওষ্ঠাধারে তুলে নিয়েছি তখন কতখানি শক্ত করতে হয়েছে নিজেকে সেকথা ভেবে দেখ।

পিতার কথা ভেবে দুঃখে কাঁদতে লাগলেন অ্যাকেলিস। প্রিয়াম হেক্টরের জন্য আর অ্যাকেলিস তাঁর পিতার জন্য কাঁদতে লাগলেন। তারপর প্রচুর অশ্রুপাতের দ্বারা দুঃখভারাক্রান্ত অন্তরটিকে খালি করে অ্যাকেলিস প্রিয়ামকে জড়িয়ে ধরে বললেন, হে হতভাগ্য, কেমন করে একাকী তোমার এই পুত্ৰহন্তার কাছে এলে? নিশ্চয় তোমার মনোবল লৌহকঠিন। এখন বস এই আসনে। দুঃখ করে কোন লাভ নেই। মানুষ যেদিন জন্মগ্রহণ করে, জিয়াস তাঁর ঘরে সেই দিনই তার ভাগ্য নির্দিষ্ট করে দেন। জিয়াসের ঘরে দুটি পাত্রে মানবজাতির জন্য ভাল ও মন্দ দুটি দানপাত্র আছে। ভাল দান যারা পায় তারাই ভাগ্যবান বলে খ্যাত হয় পৃথিবীতে আর যারা মন্দ দান পায় তারা পৃথিবীর যেখানেই যায় তাদের সঙ্গে যায় দুঃখ আর রিক্ততা, অভাব আর অনটন। দেবতারা একদিন আমার পিতা পেলেউসকে সুখ ঐশ্বর্য সবই দিয়েছিলেন। কোন এক দেবীকে তিনি পান স্ত্রীরূপে। কিন্তু পরে দুর্ভাগ্য নেমে আসে তাঁর জীবনে। আজ আমি ছাড়া আর কোন পুত্র নেই তাঁর আর সেই আমিও বিদেশে। আমি শুনেছি তুমিও সুখী ছিলে হে রাজন। রাজ্য, সম্পদ ও পুত্ৰগৌরবে তোমার সমকক্ষ এ অঞ্চলে আর কেউ ছিল না। কিন্তু পরে যুদ্ধ আর নরহত্যার অভিশাপ নেমে আসে। তোমার রাজ্যে আর তুমি তোমার পুত্রের জন্য যতই শোক করো তাকে ত আর বাঁচাতে পারবে না।

প্রিয়াম বললেন, আমার পুত্র যখন ধূলিশয্যায় শায়িত আছে, আমাকে তখন বসতে বলো না। তার মৃতদেহটিকে আমাকে দাও যাতে আমি তাকে অন্তত চোখে দেখতে পারি। আমি যে উপঢৌকন দেবার জন্য এনেছি তা গ্রহণ করে সুখী হয়ে নিরাপদে স্বদেশে ফিরে যাও।

অ্যাকেলিস কঠোরভাবে তাঁর পানে তাকিয়ে বললেন, উপঢৌকনের কথা বলে আমাকে বিরক্ত করো না। আমি এমনিতেই মৃতদেহ ফিরিয়ে দেবার মনস্থ করেছি। আমার মাতা জলদেবী এসে আমাকে জিয়াসের কথা জানিয়ে যান। তাছাড়া কোন দেবতা তোমার সঙ্গে না থাকলে তুমি এখানে প্রহরীদের দৃষ্টি এড়িয়ে বা আমার বৃহৎ দরজা খুলে আসতে পারতে না।– অ্যাকেলিসের কথা মেনে নিলেন প্রিয়াম। অ্যাকেলিস এবার ঘর থেকে উঠে গিয়ে তাঁর দুজন ঘনিষ্ঠ সহচর অটোডীমন ও অ্যালসিমাসকে সঙ্গে করে প্রিয়ামের মালবাহী গাড়ি হতে হেক্টরের মৃতদেহটিকে আবৃত করার জন্য উপযুক্ত পোমাক নিয়ে এসে সে মৃতদেহটিকে ভাল করে ধৌত করে ও তেল মাখিয়ে একটি শবাধারে করে মালবাহী গাড়িটিতে চাপিয়ে দিলেন।

এবার নিজের ঘরে ফিরে এসে তার আসনে উপবেশন করলেন অ্যাকেলিস। তিনি প্রিয়ামকে বললেন, তোমার কথামত তোমার পুত্রকে শবাধারে করে গাড়িতে চাপিয়ে দিয়েছি। আগামীকাল সকাল হলেই তুমি তাকে দেখতে পাবে। এখন এখানে নৈশভোজন সম্পন্ন করো। মনে রেখো, নিয়োবির বারোটি পুত্রকন্যা নিহত হলেও সে আহার করে। নিয়োবি একবার অহঙ্কার করে বলে তার বারোটি সন্তান আর লিটোর মাত্র দুটি সন্তান। তাই পরে লিটোর সেই দুটি সন্তান অ্যাপোলো ও আর্তেমিস নিয়োবির বারোটি সন্তানকে হত্যা করেন। অ্যাপোলো নিয়োবির ছয়টি পুত্র আর আর্তেমিস তার ছয়টি কন্যাকে হত্যা করেন। নয়দিন ধরে সেই সব নিহত পুত্রকন্যারা রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকে, কারণ তাদের আত্মীয়-স্বজন সব পাথর হয়ে যায় জিয়াসের অভিশাপে। দশদিনের দিন স্বর্গের দেবতারা তাদের সমাহিত করেন এবং তখন নিয়োবি খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ করে। লোকে বলে পিসাইলাস নামক এক জায়গায় কোন পাহাড়ের উপত্যকায় একেনোয়াস নদীর ধারে নিয়োবি এখনো জীবিত আছে এবং আজও সে শোকবিলাপ করে চলেছে তার নিহত পুত্রকন্যাদের জন্য। সুতরাং এখন খাদ্য গ্রহণ করো। তোমার পুত্রকে ইলিয়াম নগরীতে নিয়ে গিয়ে শোকে অশ্রুপাত করার অনেক সময় পাবে।

অ্যাকেলিস নিজে উঠে গিয়ে একটি সাদা ভেড়া বলি দিয়ে তার মাংস অগ্নিদগ্ধ করে রুটি দিয়ে খেতে দিলেন প্রিয়ামকে। তাঁর ভৃত্যরা প্রচুর মদ দিল। তৃপ্তিসহকারে খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ করে প্রিয়াম বললেন, আমি আমার গাড়িতে গিয়ে শুইগে। আমি নয়দিন নয়রাত্রি কোন খাদ্য বা পানীয় গ্রহণ করি নি, আমি নিদ্রাও যাই নি। শুধু আস্তাবলের কাছে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে শোক করে এসেছি। আজ প্রথম খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ করেছি। সুতরাং শীঘ্রই নিদ্রাভিভূত হয়ে পড়ব।

অ্যাকেলিসের দাসীরা বাইরে এক জায়গায় প্রিয়ামের জন্য বিছানা করে দিয়ে এল। অ্যাকেলিস বললেন, এখানে অনেক সেনাপতি আসে রাত্রিতে আমার সঙ্গে আলোচনা করার জন্য। তারা তোমাকে দেখে রাজা অ্যাগামেমননকে বলে দিলে মৃতদেহটি পেতে দেরী হবে। সুতরাং বাইরে তোমার শোবার ব্যবস্থা করেছি। কিন্তু একটা কথা, হেক্টরের শেষকৃত্য সম্পন্ন করতে কতদিন সময় লাগবে?,

প্রিয়াম বললেন, নয়দিন ধরে আমরা জাতীয় লোক পালন করব। দশ দিনের দিন আমরা তাকে সমাহিত করব। সেইদিন তার সম্মানার্থে এক সাধারণ উৎসব ও ভোজসভা অনুষ্ঠিত হবে। একাদশ দিনে আমরা তার স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করব। তারপর প্রয়োজন হলে দ্বাদশদিনে আমরা পুনরায় যুদ্ধ করব। অ্যাকেলিস উত্তর করলেন, তাই হবে রাজা প্রিয়াম। আমরা ততদিন যুদ্ধ বন্ধ রাখব। এই কথা বলে রাজা প্রিয়ামকে অভয় দেবার জন্য তার ডান হাতের কব্জিটি ধরলেন অ্যাকেলিস। প্রিয়াম তখন শয়ন করতে চলে গেলেন আইডেউসকে সঙ্গে নিয়ে। আর অ্যাকেলিস তার ভিতর দিকে একটি কক্ষে সুন্দরী ব্রিসেইসকে নিয়ে শয়ন করতে গেলেন।

রাত্রি গম্ভীর হয়ে উঠলে স্বর্গ ও মর্ত্যের সব দেবতা ও মানব যখন গভীর নিদ্রায় মগ্ন হয়ে পড়ল হার্মিস তখন প্রিয়ামকে নিরাপদে ট্রয়নগরীতে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার কথা ভাবতে লাগলেন। তিনি তখন ঘুমন্ত প্রিয়ামের মাথার কাছে গিয়ে বললেন, অ্যাকেলিস তোমাকে ক্ষমা করেছে, তোমার পুত্রের মৃতদেহ প্রত্যর্পণ করেছে। কিন্তু রাজা অ্যাগামেমনন তোমাকে দেখতে পেলে বন্দি করতে পারে, তখন তোমাদের পুত্রদের এর তিনগুণ উপঢৌকন দিয়ে তোমার মুক্ত করতে হবে।

হার্মিসের কথা শুনে প্রিয়াম আইডেউসকে ও ভৃত্যদেরকে ডেকে রওনা হয়ে পড়লেন সঙ্গে সঙ্গে, হার্মিসও তাদের সঙ্গে রইলেন। ট্রয়ের রণপ্রান্তরে জ্যানথাস নদীর ধারে এসে হার্মিস চলে গেলেন অলিম্পাসের পথে। হেক্টরের মৃতদেহটি মালবাহী গাড়িতে করে প্রিয়াম যখন ট্রয়নগরীর দ্বারপথে উপনীত হলেন তখন পাগ্লামাসের উপর থেকে কেবল তাঁর কন্যা ক্যাসান্ড্রা আর আর কেউ দেখতে পেল না। ক্যাসান্ড্রা তখন ছুটে গিয়ে নগরের সব লোকদের বলে বেড়াতে লাগল, এসে দেখ, তোমাদের দেশের গৌরবচূড়ামণি বীরভ হেক্টরকে। আজ সে যদি যুদ্ধ করে জয় করে ফিরত তাহলে কত আনন্দ করতে তোমরা।

সারা নগর থেকে সমস্ত নারী পুরুষ এসে ভিড় করল দ্বারপথে। প্রথমে হেক্টরের মাতা ও স্ত্রী এসে গাড়িতে শায়িত হেক্টরের মাথায় হাত রাখলেন কাঁদতে কাঁদতে। সমবেত জনতাও কাঁদছিল সেই সঙ্গে। রথের উপর থেকে প্রিয়াম জনতাকে বললেন, এখন গাড়ি যাবার পথ করে দাও, পরে মৃতদেহটিকে প্রাসাদে নিয়ে গেলে তোমরা যত খুশি কাঁদবে।

একথা শুনে জনতা সরে গিয়ে গাড়ি ও রথ যাবার পথ করে দিল। প্রাসাদ মধ্যে হেক্টরের মৃতদেহটি নিয়ে গিয়ে একটি শয্যায় সেদিকে শায়িত করে দেওয়া হলো। চারণকবি বীণা বাজিয়ে শোকসঙ্গীত শুরু করল।

হেক্টরের স্ত্রী অ্যান্ড্রোমে এসে মৃতদেহটি জড়িয়ে ধরে কেঁদে বললেন, হে আমার প্রিয়তম স্বামী, আমাকে বিধবা করে অল্প বয়সে কোথায় চলে গেলে তুমি? আমাদের এই শিশুপুত্রের কী অবস্থা হবে? আজ তুমি নেই। শত্রুরা এ নগর ধ্বংস করে অন্যান্য ট্রয়রমণীদের সঙ্গে আমাকেও তারা বন্দিনী করে নিয়ে যাবে অথবা উপর থেকে আছড়ে ফেলে দিয়ে কারো মৃত্যুর প্রতিশোধ নেবে। হে হেক্টর, তুমি তোমার পিতামাতা ও আমাকে অবর্ণনীয় দুঃখ দান করে গেলে।

রাণী হেকুবা এসে শোকাহত চিত্তে বললেন, হেক্টর, তুমি আমার সকল সন্তানের থেকে প্রিয় ছিলে। দেবতারা তোমাকে এত ভালবাসতেন যে মৃত্যুর পরও তোমাকে তাঁরা ভুলতে পারেন নি। অ্যাকেলিস আমার অন্যান্য সন্তানদের হত্যা করেছে অথবা বিক্রি করে দিয়েছে কোন দূর দ্বীপে। তোমার মৃত দেহ টেনে টেনে সে তার সহকর্মী প্যাট্রোক্লাসের সমাধিটাকে ঘুরিয়েছে। কিন্তু এত করে সে তাকে পুনর্জীবিত করতে পারে নি।

এই কথা বলে অশ্রু বিসর্জন করতে লাগলেন যখন হেকুবা, তখন হেলেন এগিয়ে এসে শোকের সূত্রটি ধরে বললেন, হেক্টর, তুমি আমার স্বামীর অন্যান্য সকল ভাইদের থেকে আমার কাছে প্রিয় ছিলে। আর প্রায় কুড়ি বছর আগে আমি এখানে ঘর ছেড়ে এসেছি। কিন্তু এই দীর্ঘ কুড়ি বছরের মধ্যে একটি দিনের জন্য একটি অপমানের কথা শুনিনি তোমার মুখ থেকে। যদি তোমার কোন ভ্রাতা বা ভগিনী আমাকে কোন রূঢ় কথা বলে ভর্ৎসনা করেছে কখনও, তাহলে তুমি তার ভুল বুঝিয়ে দিয়েছ। আর ট্রয়নগরীর সকলেই আমাকে ঘৃণার চোখে দেখে। আজ তাই তোমার কথা মনে করে আমার চোখে নেমে আসছে অবারিত অশ্রুর ধারা। আজ তোমার অভাবে আমার দুর্ভাগ্যের জন্য বেশি করে দুঃখ হচ্ছে।

ইতিমধ্যে বিরাট এক জনতা প্রাসাদের মধ্যে এসে উচ্ছ্বসিত শোকের আবেগে ফেটে পড়েছে। রাজা পিয়াম ট্রয়বাসীদের বললেন যাও, তোমরা বনে গিয়ে নির্ভয়ে প্রচুর কাঠ কেটে আন। আক্রমণের ভয় করবে না। কারণ অ্যাকেলিস আমায় কথা দিয়েছেন, হেক্টরের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত তারা যুদ্ধ বন্ধ রাখবেন।

রাজা প্রিয়ামের আদেশবাক্য শুনে ট্রয়বাসীরা দূর অঞ্চল হতে প্রচুর কাঠ নিয়ে এল গাড়িতে করে। নয়দিন ধরে চলল ক্রমাগত জাতীয় শোক। দশম দিনের প্রভাতে এক বিরাট চিতা সজ্জিত করে তাদের অগ্নিসংযোগ করে হেক্টরের মৃতদেহটি দগ্ধ করা হলো। তারপর প্রচুর মদের অঞ্জলি দিয়ে সেই চিতানল নির্বাপিত করে তার থেকে তাঁর দেহাস্থিগুলো বেছে নিয়ে সমাহিত করা হলো এক জায়গায়। তারপর এক সমাধিস্তম্ভ নির্মাণ করে তারা চলে গেল এক জাতীয় উৎসবের আয়োজন করতে। বীরচূড়ামণি হেক্টরের সম্মানার্থে এক বিরাট ভোজসভার অনুষ্ঠান শুরু হলো রাজা প্রিয়ামের প্রাসাদে। সে ভোজসভা শুধু রাজপ্রাসাদের মধ্যেই আবদ্ধ হয়ে রইল না। তাকে যোগদান করলেন রাজ্যের শোকসন্তপ্ত প্রজারা।

এইভাবে সারা দেশব্যাপী এক সকরুণ পরিবেশের মধ্যে হেক্টরের শেষকৃত্য সম্পন্ন হলো।

অধ্যায় ২৪ / ২৪

সকল অধ্যায়

১. ০১. মহামারী ॥ অ্যাগামেমনন ও অ্যাকেলিসের মধ্যে কলহ
২. ০২. অ্যাগামেমননের স্বপ্ন ॥ অর্ণবপোতগুচ্ছ
৩. ০৩. পারিস ও মেনেলাসের দ্বৈতযুদ্ধ দুর্গপ্রাকার হতে হেলেন ও প্রিয়ামের গ্রীকসৈন্য অবলোকন
৪. ০৪. সন্ধির শর্তভঙ্গ ॥ অ্যাগামেমনন কর্তৃক সৈন্যবাহিনী পর্যবেক্ষণ
৫. ০৫. ডায়োমেডিস-এর কৃতিত্ব
৬. ০৬. ডায়োমেডিস-এর কৃতিত্ব ॥ হেক্টর ও অ্যান্ড্রোমেকের মিলন
৭. ০৭. হেক্টর ও অ্যাজাক্সের দ্বৈত যুদ্ধ ॥ সন্ধি
৮. ০৮. একদিনের যুদ্ধ ॥ ট্রয়সৈন্যর জয়
৯. ০৯. অ্যাকেলিসের নিকট দৌত্য
১০. ১০. নৈশ অভিযান
১১. ১১. অ্যাগামেমননের কৃতিত্ব ॥ বহু গ্রীকবীর আহত
১২. ১২. গ্রীকপ্রাচীরের উপর আক্রমণ
১৩. ১৩. রণতরীর সন্নিকটে যুদ্ধ
১৪. ১৪. জিয়াস কর্তৃক প্রতারণা
১৫. ১৫. ট্রয়বাসীদের পুনরায় বিজয়গৌরব
১৬. ১৬. প্যাট্রোক্লাসের কৃতিত্ব ও মৃত্যু
১৭. ১৭. প্যাট্রোক্লাসের মৃতদেহের চারপাশে যুদ্ধ
১৮. ১৮. অ্যাকেলিসের অস্ত্রসভার
১৯. ১৯. অ্যাগামেমনন ও অ্যাকেলিসের পুনর্মিলন
২০. ২০. যুদ্ধে দেবতাদের আগমন ॥ অ্যাকেলিসের বীরত্ব প্রদর্শন
২১. ২১. নদীতীরের যুদ্ধ
২২. ২২. হেক্টরের মৃত্যু
২৩. ২৩. প্যাট্রোক্লাসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া
২৪. ২৪. উপঢৌকনের বিনিময়ে হেক্টরের মৃতদেহ লাভ

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন