১০. বগদাদের সড়কে রাত্রি

শওকত ওসমান

বগ্‌দাদের সড়কে রাত্রি।

শহরের উপকণ্ঠে নির্জনতার রাজগী অনেক আগে শুরু হয়েছে। কিন্তু সরাইখানার আলো তখনও নেভে নি। আনন্দ-তালাসী পথিকজনের আনাগোনা কৃচিৎ কানে আসে।

আবছা অন্ধকারে দুই ব্যক্তি হাটছিল। হঠাৎ একজন হেসে উঠল। অপর ব্যক্তি আর চুপ থাকতে পারে না। সেও সঙ্গীর পথ অনুসরণ করে।

–আবু নওয়াস।

–কি আবুল আতাহিয়া।

আতাহিয়া : তুমি হাসছো?

নওয়াস : হ্যাঁ, হাসছি।

আতাহিয়া : অবিশ্যি তোমার কবিতা পড়ে মনে হয়, তুমি সত্যি মনে মনে হাসতে পারো। আমাকে দিয়ে তা হয় না।

নওয়াস : তা আমি জানি, তুমি দুনিয়ায় শুধু কেয়ামৎ দ্যাখো।

আতাহিয়া : আর তুমি?

নওয়াস : বেহেশত। এই দুনিয়াই আমার বেহেশত।

আতাহিয়া : শরাব আর সাকী থাকতে, তোমাকে আর আল্লা হেদায়েৎ করবেন না।

নওয়াস : তোমাকে শয়তান পথ দেখায়।

আতাহিয়া : কেন?

নওয়াস : শয়তানের পথ মৃত্যুর পথ। জীবনের সড়ক আলাদা। তুমি শুধু মৃত্যুর কথাই বলো।

আতাহিয়া : তুমি ত মরুভূমির মধ্যে জীবনকে খুঁজেছে।

নওয়াস : মোটেই না। আমার সেই কবিতা পড়ো নি, আতাহিয়া?

আতাহিয়া : কোন্ কবিতা নওয়াস?

নওয়াস : বলছি, শোন।

বেদুইনদের মাঝখানে বৃথা কর আনন্দ-সন্ধান।
কিবা ভোগ করে তারা, যারা ক্ষুধা-তৃষ্ণাতুর লোক?
থাক ওরা ওইখানে, বসে খুব উষ্ট্রদুগ্ধ খাক;
যারা কভু শেখেনিক সূক্ষ্ম প্রাণ-উপভোগ।

আতাহিয়া : একে বুঝি বলে মরুভূমিতে জীবন-সন্ধান?

নওয়াস : তুমি আজকাল আর্বী ভুলে যাচ্ছ, আতাহিয়া। না, আমার কবিতা বুঝতে তোমার কষ্ট হয়?

আতাহিয়া : তার চেয়ে বলো না কেন আমি আমার ওয়ালেদের (বাপ) নাম ভুলে যাচ্ছি।

নওয়াস : তবে ভুল তুমি করো। বুদ্ধি আর বোধি–আক্কেল আর উপভোগ, দুই-ই জীবনে দরকার। কারণ, ইন্দ্রিয়ের পথ আবার বোধির-ও পথ। যে-মুহূর্তে। তুমি একটা বন্ধ করবে, অন্যটা-ও থেমে যাবে। তখন তুমি আর গোটা ইনসান–পূর্ণ মানব নও।

সাকী, পানপাত্র ভরে দাও মদিরা ধারায়
অন্ধকারে কেন? এসো আলোর সভায়।।
বিনা পানে নিরানন্দ ও অভিশপ্ত ক্ষণ।
মাতালের মত টলি–সেই ত অমূল্য জীবন।।

আর আতাহিয়া, সেই জায়গায় তুমি কি লিখছো?

‘জাম’ ঘিরে বসিয়াছে যত্রর্সব মওজী ইনসান,
দুনিয়ার হাত থেকে করে তারা মৃত্যু-মদ্য পান।।

ছোঃ–এটা কি কবির কথা?

আতাহিয়া : শোন, নওয়াস। কবিতা তোমার চেয়ে খারাপ না লিখলেও কথায় পারব না।

নওয়াস : ও কথা ছাড়ো। তুমি মেহদীর বাঁদী উবা-র প্রেমে পড়েছিলে?

আতাহিয়া : পড়েছিলাম।

নওয়াস : কেন?

আতাহিয়া : তা জানি নে।

নওয়াস : তখন তুমি জীবনকে খুঁজেছিলে। প্রেমের পথ, ডোগের পথ, উপভোগের পথ, জীবনের পথ, সব এক জায়গায় বহু সর্পমিথুনের জড়াজড়ির মত। ওকে আলাদা করতে যেয়ো না, বন্ধু।

আতাহিয়া : আজ অনেক খামর (শরাব) টেনেছে মনে হচ্ছে।

নওয়াস : তা ত বটেই। শোনো, তোমাতে আমাতে তফাৎ কি জানো?

আতাহিয়া : কি তফাৎ?

নওয়াস : আমি আঙুর ফল খাই। আর তুমি? তুমি দ্রাক্ষালতা চিবোও। আর মনে মনে বলো, আঙুর যখন এমন মিষ্টি, দেখা যাক ওর আসল মাদ্দা বা উৎসটা কেমন? একটু চিবোই।

আতাহিয়া : নওয়াস, তুমি আজ বিলকুল শরাবী।

নওয়াস : আতাহিয়া, একটা গল্প শোনো।

আতাহিয়া : বলো।

নওয়াস : তখন আমি কুফা শহরে। এক বাঁদীর আশনায়ের জালে ধরা পড়ে গেলাম।

আতাহিয়া : তোমার মত পাকা মৎস্য?

নওয়াস : : কথায় বাধা দিও না। প্রেমে আর খাদে বেশি তফাৎ নেই, পড়ে গেলাম। সব কথা তোমার শুনে দরকার নেই। যা অনেক ঘোরাফেরা কান্নাকাটি আরজী মিনতি অগয়রহের পর আমার মহবুবা (দয়িত) ওলিদা-কে পেলাম। শোনো, ওর সদরিয়া (জামা বিশেষ) খুলে আমি ত বেহুঁশ হওয়ার উপক্রম। এমন সুগঠিত তীক্ষ্ণ বোটা স্তন আমি, খোদার কসম আর জীবনে দেখি নি। ছেলেরা কেতাব পড়ে তিনকা দিয়ে অক্ষরের কাতার ঠিক রাখার জন্যে। এ ঠিক সেই তিনকার মত। ভাবলাম, এটা হাতে থাকলে আমি আর জীবনে কাতারভ্রষ্ট হব না অর্থাৎ গোনার পথে অসৎ পথে পড়ব না। আল্লার মেহেরবানী, এমন তিনকা জুটিয়ে দিয়েছেন, জীবনের কেতাব পড়তে আমার আর ভুল হবে না। আরো শোনো। সেই অবস্থায় আমি কোথায় তিনকা হাতে গ্রহণ করব, তা না, আমার মাথা ঝুঁকে গেল। আমি সীনার ঠিক নীচে নরম ত্বকের উপর ঠোঁট রাখলাম। লোকে পা চুমে, কদম-বুসী করে, আমি করে বসলাম স্তন-বুসী, সীনা-বুসী,–যা বলো।

আতাহিয়া : হাহ্‌ হা, আবু নওয়াস। মরহাবা! ইয়া আবু নওয়াস। আহলান সাহলান, ইয়া নওয়াস। মাইয়োকেলা আজিহিল কালাম ইল্লা আবু নওয়াস–আবু নওয়াস ছাড়া কে আর এমন কথা বলতে পারবে? হাহ্ হা হা হা…।

নওয়াস : আহ্, আমার পিঠে এতো থাপড়াচ্ছো কেন, আতাহিয়া? তোমার হাসি থামাও, নচেৎ এখনই তোমার আঁৎড়ী বেরিয়ে পড়বে। আর এতে হেসো না, এখনই আমিরুল মুমেনীন তা কিনে নেবেন।

আতাহিয়া : আহ, আবু নওয়াস। আর একটু হেসে নিতে দাও। পেটে কুলুপ লেগে গেল।… আমিরুল মুমেনীন আজকাল হাসির সওদাগরি করেন না কি?

নওয়াস : তুমি জানো না?

আতাহিয়া : না।

নওয়াস : হাসির অনেক দাম। লাখ দীরহামের-ও বেশি।

আতাহিয়া : সত্যি?

নওয়াস : কাল তিনি তোমাকে আমার মারফৎ দাওয়া দিয়েছেন। গোলামের হাসি শুনতে যাবো। আবু ইস্‌হাক থাকবে। খানাপিনা গান বাজনা সব আছে।

আতাহিয়া : আলহাম্‌দোলিল্লাহ্।

নওয়াস : চলো, অনেক রাত হয়ে গেছে। সরাইখানা বন্ধ। সড়কে লোজন কম। তার উপর অন্ধকার।

আতাহিয়া : তোমার ভয় কী? তোমার ত তিনকা আছে।

দুই কবি হেসে উঠল জনশূন্য সড়কের উপর। প্রতিধ্বনি দূরে দূরে সহজে অস্তিত্ব হারায় না।

নিদ্রিত মহানগরী বগ্‌দাদ।

তার দুই কবি শুধু জেগে ছিল।

জীবনের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস কবিতা কি কখনও বিশ্রাম নিতে পারে?

সকল অধ্যায়

১. ১. সহধর্মিণী বেগম জুবায়দা ও বাঁদী মেহেরজান
২. ০২. প্রাসাদ-কক্ষে হারুনর রশীদ
৩. ০৩. হারুনর রশীদের কওসুল-আকদার
৪. ০৪. তৃতীয় রাত্রি
৫. ০৫. মশ্‌রুর : জাঁহাপনা
৬. ০৬. রুবাবের কান্না
৭. ০৭. গোলাম-বস্তী
৮. ০৮. অন্দর মহল
৯. ০৯. বাগিচার কক্ষ
১০. ১০. বগদাদের সড়কে রাত্রি
১১. ১১. বেগম জুবায়দা
১২. ১২. তাতারীর বাগিচা
১৩. ১৩. মজকুর জায়গা পরিচিত বাগিচা
১৪. ১৪. সরাহখানায় তারা গজল শুনছিল
১৫. ১৫. বেগম জুবায়দা দাঁড়িয়েছিলেন
১৬. ১৬. মোহাফেজ এবং হারুনর রশীদ
১৭. ১৭. আবু নওয়াস হাঁটছিল
১৮. ১৮. লৌহ গরাদের ওপারে আকাশ
১৯. ১৯. সরাইখানার প্রবেশ-পথ
২০. ২০. আমিরুল মুমেনীনের মহল
২১. ২১. নহরে জুবায়দার তীর
২২. ২২. কারাগারের চত্বর

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন