মহাশ্বেতা দেবী
নিচে দূর্বা আর রণোর ঘর সাজানো হয়ে গেল এক সময়ে।
সরমা আর নাটকু গল্প করছে খাবার ঘরে।
রণো বলল, বাড়ি করেছিল বটে বাবা। এত বড় খাবার ঘর, বসার ঘর, স্টাডি, একটা বেডরুম, দুটা বাথরুম, রান্নাঘর। কাজের লোকের ঘর, সব একতলায়। দোতলায় তিনটে বেডরুম। দুটো বাথরুম, ব্যালকনি, তেতলায় ছাত… সত্যি।
—ঠিকে লোক তো বাড়ি সাফ করতে করতেই…
—কিন্তু কেন?
—”কেন” মানে?
—এত বড় বাড়ি কেন?
—শস্তার দিন ছিল। পৈতৃক বাড়ি বেচে টাকা পেয়েছিল, করেছিল।
—কী হবে এ বাড়ি দিয়ে?
—বাবাই জানে।
—যদি কোনদিন বাবার কিছু হয়…আমি হেম মাকে নিয়ে চলে যাব।
—দাদা! মিলুর ব্যাপারটা কী?
—কিচ্ছু জানি না। ইতু মাসির বাড়িতে সরমাদি থাকে। মিলু ওর মেয়ে…ম্যারেড…তবে হেম মা বলছিল ওর স্বামী বোধ হয় আবার বিয়ে করতে চায়…সামথিং, সামথিং….দেখ. হেম মা ওকে নিয়ে এসেছে দু’মাস আগে। আর কিছু জানি না।
—দাদা, হেম মা ফিরবে তো?
—আজ ভীষণ গম্ভীর ছিল। খুব অন্যরকম লাগছিল…বলে গেল, তোমাদের দুজনকে আজ সব করতে হবে রণো। আমি নিরুপায়।
—হেম মা যে কী করে এত বছর…
—সে কথা বললে জবাব দেয় না।
—তবে নিজের মতো জীবন তো গড়ে নিয়েছে। স্কুলে কাজ করেছে। বন্ধু হয়েছে অনেক। লতু মাসির সঙ্গে এত বছর ধরে কত ঘনিষ্ঠ।
—কোনদিন জানতেই দিল না যে মা নেই।
—আমাকে কতজন বলে, মাকে ”হেম মা” কে বলে?
—তুই কী বলিস?
—বলি, আমি আর দাদা বলি।
—বাবা খুব হতভাগ্য।
—আজকে তেমনই মনে হচ্ছে অবশ্য। কিন্তু ভাব একবার, কী ভয়ঙ্কর লোক।
—লতু মাসি তো সে জন্যেই বলে, বাবারা উনিশ শতকে পড়ে আছে।
—দাদা! হেম মা তো একজনই হয়। আমাদের মা নাকি খুব নরম ছিল। সে কি সহ্য করে গেছে তাই ভাবি।
—মরে গেছে, বেঁচে গেছে। বাবার কোনও কথায় প্রত্যুত্তর না দিয়ে নিজের মত খাটিয়ে আমাদের বড় করতে মা পারত না। হেম মা পেরেছে।
—এত, এত করল হেম মা! আমাদের জন্যে এত করল, অথচ নিজের কী হল, তা জানতে দিল না।
—নিশ্চয় তার কোনও কারণ আছে। হেম মাকে আমি কারণ ছাড়া কিছু করতে দেখিনি।
—এত শিক্ষিত মনটা। এত সিভিলাইজড! সব সময়ে বলেছে নিজের মাকে মনে রেখো। আমার পক্ষে অবশ্য সেটা অসম্ভব। দেখিইনি। মারা গেল একলামপশিয়াতে। সাতাশ বছর আগে তার কোন চিকিৎসা ছিল না?
—নিশ্চয় ছিল।
—কিছু একটা আছে ব্যাপার। লতু মাসি মার নাম করলেই বলে, ওর কথা বোলো না।
—আমাদের কপাল ভাল। হেম মার জন্যে মা আর বাবার পরিবারকে জানতে হয়নি।
—এখন তো আমরা ওদের কাছে…হেম মা! তোর ডিভোর্স! আমার এক উড়েকে বিয়ে!
—মোমো আবার বিয়ে করেছে, জানিস?
—কে বলল রে?
—মেমোই জানিয়েছিল।
—কাকে?
—কোন এক প্যাটেলকে।
—আর শ্রীজয়?
—মার কাছেই থাকুক। বিয়ে ভাঙলে ছেলেমেয়ে নিয়ে মা বাবা টানাটানি করলে ওদের যন্ত্রণা বেশি। আমার ওটা অসম্ভব খারাপ লাগে।
—শ্রীজয় তোকে লেখে?
—বড়দিনে একটা কার্ড। এখনও তো ছোট।
—তুই বিয়ে করে ফেল। হেম মা ভয়ানক দুশ্চিন্তা করে, ভয়ানক।
—পিপুকে তোর কেমন লাগে?
—লতু মাসির ভাইঝি?
—হ্যাঁ।
—কোথায় দেখলি?
—হায়দ্রাবাদে কাজ করছে তো। একটা ইকনমিকস জার্নালে। ওদের পাবলিশিংও আছে।
—পিপুর বয়স কত রে দাদা?
—তোর চেয়ে একটু ছোট।
—আমার কেমন লাগে তা বলে কী হবে? এক কলেজে পড়িওনি। কথায় বার্তায় তো..
—ইয়ং লতু মাসি।
—তার কথা ভাবছিস?
—আমার ওকে ভাল লাগে। খুব খোলামেলা, দারুণ কাজের।
ওখানে মেয়েদের অর্গানাইজেশনেও আছে। নিজের কাজেও খুব ভাল। থাকে তো আমাদের ওখানেই। কৃষ্ণার ফ্ল্যাটটা শেয়ার করে।
—দাদা, ও সব জানে তো?
—স—ব। আর শুধু বলে, ভুলে যাও তো। জীবন আজ থেকে শুরু করো। খুব সোজা, ধারালো মেয়ে।
—দাদা! পিপু নিশ্চয় এখানে এসেছে।
—ধরে ফেলেছিস।
—কদ্দিনের আলাপ?
—তিন বছরের।
—তুই যা চাপা না!
—না রে, আজই মনে হচ্ছে, নিঃসঙ্গ থাকা খুব কঠিন। হেম মা চলে না গেলে…
—শাড়ি পরে?
—কক্ষনো নয়।
—রাঁধে?
—নিজে তো রেঁধেই খায়।
—তুই যে বলিস ঘরোয়া বাঙালি মেয়ে?
—ওয়ার্কিং উইমেন ঘরোয়া হয় না না কি? হেম মা, তুই… এরকম কত!
—আর বাঙালি?
—বাঙালি তো বটেই! তবে তেলুগুও দারুণ বলছে এখন।
—ঠিক করেই এসেছিলি?
—না না। আমরা খুব বন্ধু। আমাদের একটা সার্কলও আছে। ওর বিষয়েই একটু ভরসা পাচ্ছি।
—দাদা! তুই বত্রিশ বছরের বুড়ো। সময় এখন জেট গতিতে চলে। অনেকদিন ভালবাসলাম, তারপর বিয়ে করলাম। অত সময় কোথায়? আমাকে দেখ না। জেট সেট রোমানস, বিয়ে, মেয়ে।
—ওটাই আমাদের প্লাস পয়েন্ট। ভালবাসা নেই, বন্ধুত্ব আছে।
—মোমোকে তো ভালবাসতিস।
—বাসতাম। সে অন্য রণো।
—হেম মা, লতু মাসি, কি খুশি হবে!
—লৌহমানব চেঁচাবেন।
—আজকের পর? কিচ্ছু করবে না।
—পিপু কিন্তু প্রায় আমার মতোই লম্বা। আমি পাঁচ—এগারো, ও পাঁচ—নয়।
—হেম মাকে দরকার, হেম মাকে।
—কোথায় গেল সেই আদ্যিকেলে ব্যাগটা নিয়ে?
—ফিরে এলেই ঝগড়া করব।
—তুই বাবার জন্যে কী এনেছিস?
—নতুন ডিকশনারি। বাবা তো ডিকশনারি পাগল।
—আমি একজোড়া হায়দ্রাবাদি চটি।
—হেম মার জন্যে?
—সেটা দেখতে পাচ্ছিস। নিজেকে এনেছি।
—পিপু কি আজ আসবে?
—আসার কোনও কারণ নেই।
—একদিন আমার ওখানে আয় ওকে নিয়ে। আশ্চর্য, লতু মাসির ভাইঝি। খুব সাঁতার কাটত, খেলত।
—ভাবিস না খুব প্লান প্রোগ্রাম ছিল আমাদের। হায়দ্রাবাদে কৃষ্ণার ঘরে ক’জন খেতে গেছি…হঠাৎ দেখি পিপু। দুজনেই অবাক। তারপর…যেমন হয়…লতু মাসিও ফোনে বলল, একদিন। তোরা এক কমপ্লেকসে আছিস শুনে খুব খুশি হয়েছি। তারপর…আস্তে আস্তে…
—তুই সুখী হলেই ভাল। আমার যা চিন্তা হয় তোর জন্যে। সেই জন্যেই তো চিঠি লিখে গল্প করি।
—সুখ? সুখের কথা ভাবি না দূর্বা। ভাবি শান্তির কথা, স্বস্তির কথা। দুজনে গল্প করি, বন্ধুত্ব আছে। ও খুব যুক্তিবাদী মেয়ে। ঝগড়া হবার কোনও চানস নেই।
—মনে হচ্ছে ভেবে চিন্তেই এসেছিলি।
—না দূর্বা। কিছু ভাবিনি। হেম মা চলে গেল, অনেক কিছু যেন বুঝতে পারছি এখন। তোকে আগে বলিনি, হেম মা এমন আত্মনির্ভর চিরকাল! আমরা তো হেম মার ওপরেই নির্ভর করে এসেছি চিরকাল। ইদানীং…আমাকে যেন বড্ড আঁকড়ে ধরেছে। পরশু যেমন, ব্যালকনিতে চুল শুকোতে শুকোতে হঠাৎ বলল, আমাকে সুখী করতে চাস রণো, তুই একটা মনের মতো মেয়েকে বিয়ে করলে আমি যে সবচেয়ে সুখ পাব, নিশ্চিন্ত হব, সেটা বুঝিস না?
—আমি জানি।
—বললাম, মোমোর মতো যদি হয়? হেসেই বলেছিলাম।
হেম মা বলল, রণো। একেবারে এ—ওর বিপরীত, তেমন বিয়ে হলে সে বিয়ে আঁকড়ে থেকে অসুখী জীবন আগে কাটাত মানুষ। মেয়েরা তো বাধ্যই থাকত। এখনও কাটায়। এখন স্বামীরা ছেড়ে যায়, স্ত্রীরাও ছেড়ে যায়। যা হবার সে তো হয়ে গেছে।
—জানি। আমি বললাম, হেম মা! দাদাকে কি বেশি ভালবাসো? হেম মা বলল, দূর্বা! প্রথমত মেয়েরা অনেক শক্ত হয়। তুমি আমার মতোই। টিকে থাকতে জানো। রণো যে চাপা ছেলে।
—নিজে কি করে এত বছর…
—বললে বলবে, না—পাওয়াটাই দেখলে? পেয়েছিও অনেক। বিমাতা আর দুই সন্তান। সেও সতীনের,—তেমন সম্পর্ক তো হয়নি। তুমি, আমি, রণো তো তিন বন্ধু। এটা কম প্রাপ্তি?
—দূর্বা! চারটে বাজল।
—আগে দুজনে চা খাই। তারপর সেজেগুজে নিই। বাবাকেও তৈরি হতে বলি।
—প্রদীপ কখন আসবে?
—আসবে, আসবে। ব্যস্ত কেন?
—সত্যি। ভাবিইনি প্রদীপ তোকে বিয়ে করবে।
—ও থোড়াই বিয়ে করেছে। আমি যখন ঠিক করলাম যে বিয়ে করলে ওকেই করব, তখনই তো ও ফিনিশ। আমার সঙ্গে পেরে উঠত?
—তুই একটা যা তা!
—যথেষ্ট হয়েছে। এবার ওঠ দাদা।
—শাড়ি পরে তোকে বেশ…
—দূর। হাঁটতেই পারি না। তবে প্রদীপ খুব খুশি হয় দেখলে।
—শাশুড়ি?
—ওঁর ছেলের আইবুড়োত্ব ঘোচাতে পেরেছি বলে এতই খুশি… আর উনি ওসব মাইন্ড করেন না। বলেন, জিনস আর কুর্তা পরলে কত ভাল দেখায় তোমাকে!
—না দূর্বা। হেম মাকে দেখিয়ে দিতে হবে, আমিও টিকে থাকতে জানি। বিয়ে করে ফেলব। আজ বাবাকে দেখে বেশি করে বুঝছি, একলা থাকাটা বুড়ো বয়সে ভয়াবহ।
—হ্যাঁ। কিন্তু পিপুকে বলবি তো!
—বলব, বলব।
—সিধা রেজেস্ট্রি।
—নো রিসেপশান!
—ইয়েস রিসেপশান। আয়রনম্যান এবার নিজেই ব্যবস্থা করবে। ভয় পেয়েছে না?
—চিরকাল…দূরে সরিয়ে রেখেছিল।
—অতীতকে ভুলে যাও রণজয়। সামনে তাকাও নতুন শতাব্দী আসছে। আমি চা করতে গেলাম।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন