সৌরজগৎ

বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন

সৌরজগৎ
প্ৰথম পরিচ্ছেদ

কারসিয়ঙ্গ পৰ্ব্বতের একটি দ্বিতল গৃহে অপরাহ্নে গওহর আলী স্ত্রী ও কন্যাদলে পরিবেষ্টিত হইয়া অগ্নিকুণ্ডের নিকট বসিয়াছেন। তাঁহার নয়টি কন্যা যে ভাবে তাহাকে পরিবেষ্টন করিয়া বসিয়াছে, তাহা দেখিয়া স্বতঃই এ পরিবারটিকে সুখী ও সৌভাগ্যশালী বলিয়া মনে হয়। সৰ্ব্বকনিষ্ঠা দুহিতা মাসুমা তাহার। সৰ্ব্বজ্যেষ্ঠ সহোদরা কওসরের ক্ৰোড়ে, এবং অবশিষ্ট শিশুগুলি পিতামাতার দুই পার্শ্বে ছোট ছোট পাদপীঠে বসিয়াছে।

এইরূপে ভাগ্যবান গহওর আলী তারকাবেষ্টিত সুধাংশুর ন্যায় শোভা পাইতেছেন। কওসর পিতামহের অতি আদরের পৌত্রী। তিনি সাধ করিয়া ইহার নাম “কওসর” রাখিয়াছেন। কাওসর শব্দের অর্থ স্বগীয় জলাশয়, যেমন মন্দাকিনী।১

যে কক্ষে তাহারা উপবেশন করিয়াছেন, সেটি কতক মুসলমানী ও কতক ইংরাজী ধরণে সজ্জিত; নবাবী ও বিলাতী ধরণের সংমিশ্রণে ঘরখানি মানাইয়াছে বেশী। ত্রিপদীর (টিপায়ের) উপর একটি ট্রেতে কিছু জলখাবার এবং চা-দুগ্ধ ইত্যাদি যেন কাহার অপেক্ষায় রাখা হইয়াছে।

গওহর আলীর হন্তে একখানি পুস্তক; তিনি তাহা পাঠ করিয়া সকলকে বুঝাইয়া দিতেছেন। তাঁহাদের আলোচ্য বিষয় ছিল, বায়ু। বায়ুর শৈত্য, উষ্ণতা, লঘুত্ব, গুরুত্ব; বায়ুতে কয় প্রকার গ্যাস আছে; কিরূপে বায়ু ক্ৰমান্বয়ে বাষ্প, মেঘ, সলিল, এবং শীতল তুষারে পরিণত হয়, ইত্যাদি ইত্যাদি। শ্রোতৃবর্গ বেশ মনোযোগসহকারে শ্রবণ করিতেছে; কেবল সপ্তম দুহিতা সুরেয়া নানাপ্রকার প্রশ্ন দ্বারা পিতার ধৈৰ্য্যগুণ পরীক্ষা করিতেছে! কখনও ছবি দেখিবার জন্য পিতার হস্ত হইতে পুস্তক কাড়িয়া লইতেছে! পিতা কিন্তু ইহাতে বিরক্ত না হইয়া বরং আমোদ বোধ করিয়া হাসিতেছেন।

গৃহিনী নূরজাহাঁ একরার ঐ ট্রের দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া বলিলেন, “ভাই এখনও আসিলেন না; চা ত ঠাণ্ড হইতে চলিল।”

গওহর। তোমার ভাই হয়ত পথে লেপচাদরের সঙ্গে খেলা করিতেছেন!

বালিকা। রাবেয়া বলিল, “আমরা তাঁহাকে দ্বিতীয় বেঞ্চের নিকট অতিক্রম করিয়া আসিয়াছি। এইটুকু পথ তিনি এখনও আসিতে পারিলেন না?”

সুরেয়া। বাব্বা! বেন কি অল্প পথ? আমি ত হাঁটিতে না পারিয়া আয়ার কোলে চড়িয়া আসিলাম।

রাবেয়া। ঈশ! আমি একদৌড়ে দ্বিতীয় বেঞ্চ হইতে এখানে আসিতে পারি।

গওহরও কন্যাদের কথোপকথনে যোগ দিয়া বলিলেন, “আগে এক দৌড় আসিতে পারিয়া দেখাও, পরে বড়াই করিও। কোন কাজ করিতে পারার পূৰ্ব্বে পারি’ বলা উচিত নহে!”

কওসর। এখান হইতে দ্বিতীয় বেঞ্চ প্রায় দুই মাইল হইবে, না আব্বা?

গও। কিছু বেশী হইবে। যাহা রউক, রাবু যখন বলিয়াছে, তখন তাহাকে অন্ততঃ একরার একদৌড়ে সে পৰ্যন্ত যাইতেই হইবে!

আখতার। রাবু একদৌড়ে যাইবে, না পথে বিশ্রাম করিবে, তাহা জানিবার উপায় কি?

গও। (বিস্ফারিত নেত্রে) জানিবার উপায়? রাবু যতদূর পর্যন্ত গিয়া ক্লান্তি বোধ করিবে, তথা হইতে ফিরিয়া আসিয়া পরাজয় স্বীকার করিবে। সে নিজেই বলিবে, সে কতদূর গিয়াছিল। আমার কন্যা কি মিথ্যা বলিবে?

রাবু। (সোৎসাহে) না আব্বা! আমি মিথ্যা বলি না—বলিবও না।

আখ। আমি বেশ জানি, তুমি মিথ্যা বল না; তবে যদি মিথ্যা বাহাদুরির লোভে একটি ছোট মিথ্যা বলিয়া ফেলিতে!

রাবু। (সগৰ্ব্বে) মিথ্যা বলার পূৰ্ব্বে মরিয়া যাওয়া ভাল!

গও। ঠিক! তোমরা কেহ একটি মিথ্যা বলিলে আমার মর্ম্মে বড়ই ব্যথা লাগিবে। আশা করি, তোমরা কেহ আমাকে কখন এরূপ কষ্ট দিবে না।

কতিপয় বালিকা সমস্বরে বলিয়া উঠিল,–“আমরা মিথ্যা না,-আমরা কষ্ট না,” অথবা কি বলিল ঠিক শুনা গেল না!

এমন সময় সিঁড়িতে কাহার পদশব্দ শুনা গেল। কওসর ও মাসুমা ব্যতীত অপর বালিকা কয়টি “মাম্মা আসিলেন” বলিয়া পলায়ন তৎপরা হইল। গওহর নয়িমাকে ধরিয়া বলিলেন, “সেজন্য পলাইস কেন মা?”

নায়িমা। ও বাব্বা! আমি না-মাম্মা! (অর্থাৎ আমি থাকিব না-মাম্মা বকিবেন)। ইতঃমধ্যে জাফর আলী গৃহে প্রবেশ করিলেন। পলায়মানা বালিকাদের দেখিয়া গওহরকে সহাস্যে বলিলেন, “Solar system (সৌরজগৎ)টা ভাঙ্গিয়া গেল কেন?”২

গও। তুমি ‘ধূমকেতু আসিলে যে! নূরজাহী লাতার নিমিত্ত চা প্রস্তুত করিতে অগ্রসর হইয়া গওহরকে বলিলেন, “তুমি একটু সর, ভাইকে অগ্নিকুণ্ডের নিকট বসিতে দাও।”

জাফর। না। আমি অগ্নিকুণ্ডের নিকট বসিব না। যে ক্লান্ত হইয়াছি, আমার সর্বাঙ্গ ঘৰ্ম্মাসিক্ত হইয়াছে। আমি এইখানেই বসি।

কওসর জলখাবারের ট্রেটা আনিয়া জাফরের সম্প্ৰমুখে রাখিল, এবং তাঁহার ললাটে ঘৰ্ম্মবিন্দু দেখিয়া স্বীয় বসনাঞ্চলে মুছিয়া দিল।

জাফর এক পেয়ালা চা শেষ করিয়া ভগিনীর হস্তে পেয়ালা দিয়া বলিলেন, “নুরু। আর এক পেয়ালা চা দে!?

গও। তোমার ভুল হইল। পেয়ালাটি লইবার জন্য র্তাহাকে এতদূর আসিতে হইল, ইহা অন্যায়! তুমি উঠিয়া গিয়া তাহাকে পেয়ালা দিতে পারিতে!

নূরজাহাঁ অধোমুখে মৃদুহাস্য করিলেন। কওসরের খুব জোরে হাসি পাইল বলিয়া সে প্ৰস্থান করিল, এবং মাতার সাহায্যের নিমিত্ত বদরকে তথায় পাঠাইয়া দিল।

জাফ। দেখ ভাই! তোমার সাহেবীটা আমার সহ্য হয় না। তুমিই কি একমাত্র বিলাত ফেবতা?

গও। না, তুমিও বিলাত ফেরতা! তোমার গালি শুনিয়া আমোদ হয়, সেইজন্য সাহেবীভূতের দোহাই দিই! সে যাহা হউক, তোমার আসিতে এত বিলম্ব হইল কেন? পথে পাহাড়ীদের সহিত গলপ করিতেছিলে না কি?

জাফ। ভুটিয়াদের সহিত গল্প করিব কি, উহাদের ভাষাই বুঝি না; যে ছাই “কান্‌ছু যানছু” বলে!

বদর তাহার পাহাড়ী ভাষায় অভিজ্ঞতা প্রকাশের জন্য বলিল, “যানছুমানে যাওয়া।” নূরজাহাঁ তাহাকে বলিলেন, “ইহাদের গল্পে যোগ দিয়া তোমার কাজ নাই মা! যাও তুমি কওসরের নিকট।”

গও। তবে কেন বিলম্বব হইল?

জাফ। প্রথম বেঞ্চে বসিয়া বিশ্রাম করিতেছিলাম। তথা হইতে সমস্ত কারসিয়ঙ্গ সহরটা ত বেশ দেখা যায়। বাজার ষ্টেশন, কিছুই বাদ পড়ে না।

নূরজাহী। হাঁ, ঐখানে বসিলে ধরা খানা সরা। তুল্য বোধ হয়!

গও। আর যেদিন ইহারা পদব্রজে “চিমনী সাইড”(৩) পৰ্য্যন্ত আরোহণ ও তথা হইতে অবতরণ করিয়াছিলেন, সেদিন ইহাদের যে আনন্দ হইয়াছিল!-সম্ভবতঃ পোট আর্থার এবং বালটিক ফ্লট জয় করিয়াও জাপানীদের তত উল্লাস হয় নাই!!

নূর। জাপানীরা তত উল্লসিত হইবে কি রূপে? তাহাদের কার্য্য এখনও যে শেষ হয় নাই। আর আমরা ত পদবজে ১২ মাইল ভ্ৰমণের পর গন্তব্য স্থানে পৌঁছিয়ছিলাম!

জাফ। এখন বাকী আছে শ্ৰীমতীদের বেলুন আরোহণ করা!

গও। সময়ে তাহাও বাকী থাকিবে না!

জাফ। তুমি সপরিবারে ইংলণ্ড যাইবে কবে?

গও। যখন সুবিধা যাইবে!

জাফ। হঁ-কন্যাগুলি অক্সফোর্ড বিদ্যালয়ে শিক্ষাপ্রাপ্ত হইয়া এক একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র হইবে! সাধে কি তোমাদের সৌরজগৎ বলি। তোমার দুহিতা কয়টি গ্রহ, আর তুমি সূৰ্য্য! উহাদের নামও ত এক একটি তারকার নাম-মুশতরী, জোহরা, সুরেয়া!(৪) তবে কেবল মঙ্গল, বুধ, শনি এ নামগুলি বাধ দেওয়া হইয়াছে কেন?

নূর। ভাই! তোমরা নিজেরা ঝগড়া করিতে বসিয়া মেয়েদের নাম লইয়া বিদ্রপ কর কেন? আর এ নাম ত আমরা রাখি নাই, স্বয়ং কৰ্ত্তা রাখিয়াছেন। তাঁহার পৌত্রীদের নাম, তিনি যেরূপ ইচ্ছা রাখিবেন, তাহাতে আমাদের কিছু বলিবার অধিকার কি?

জাফরকে আরও অধিক ক্ষেপাইবার জন্য গওহর বলিলেন, “কেবল ইংলণ্ড কেন, আমেরিকা যাইবারও ইচ্ছা আছে,-কাওসর “নায়েগারা ফলস, দেখিতে চাহে।”

জাফ। তোমার এ সাধ অপূর্ণ থাকিবে। কাওসারকে আর ‘নায়েগারা” প্রপাত দেখাইতে হইবে না।

গও। কেন?

জাফ। আগামী বৎসর সে তোমার ক্ষমতার বাহির হইবে। গও। আমার হাতের বাহির হইলেই বা কি, জামাতাসহ যাইব।

জাফ। জামাতা তোমারই মত কাণ্ডজ্ঞানহীন মুর্থ হইলে ত?

গও! তুমি তাঁহাকে অধিক জান, না। আমি?

জাফ! আমি সিদ্দিককে যতদূর জানি, তাহাতে আশা রাখি, তিনি তোমার মত forward (অগ্রগামী) নহেন।

গও। আমিও আশা রাখি তিনি তোমার মত backward (পশ্চাদগামী) নহেন! তিনি নিশ্চয়ই কওসরকে নায়েগারা প্ৰপাত দেখাইবেন!

 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

“মাম্মা আকরার সহিত তজ্জন গজ্জন করিতেছেন, চল আমরা শুনি গিয়া,” এই বলিয়া বদর আখতারকে টানিতে লাগিল।

আখতার। আমরা সেখানে গেলে মাম্মা গজ্জন ছাড়িয়া গোলাবর্ষণ আরম্ভ করিবেন।

বদর। আমরা তাহার সম্প্ৰমুখে যাইব না-পাশ্বের ঘরে লুকাইয়া শুনিব।

কওসর। ছি বদু! লুকাইয়া কিছু শুনা উচিত নহে; সাবধান!

বদর। (ব্যগ্রভাবে।) তবে আমি যে দুই একটি কথা শুনিয়া ফেলিয়াছি, তাহার উপায় কি?

কও। যাহা হইবার হইয়াছে। আর কখন এরূপ দোষ করিও না।

আখ। মাসুমা ত ঘুমাইয়াছে; যাও নায়িমু! তুমিও ঘুমাও গিয়া।

নমিয়া। না, আমি ধুম্‌না।(৫)

আখ। তবে আমি আর তোমায় কোলে রাখিব না!

কও। চল এখন আমরা পড়াশুনা করি গিয়া। যাও ত বোন মুশতরী, তুমি দেখিয়া আইস, আমাদের পড়বার ঘরে অগ্নিকুণ্ডে কয়লা, আগুন —সব ঠিক আছে কি না।

জোহরা। আমরা ডাউহিল স্কুলে পড়তে গেলে খুব ছুটী পাইব, না?

আখ। আরে! আগে যা ত ডাউহিল স্কুলে, তারপর ছুটী লইস।

বদর। আগে পাগলা ঝোরার(৬) জলে ভাল করিয়া মুখখানা ধো!

রাবু। কেন আপা! আমাদের স্কুলে যাওয়া হইবে না কেন? তোমরাই তিনজনে যাইবে না-তোমরা বড় হইয়াছ। আমরা কেন যাইব না?

কও। ওরে, মাম্মা যাইতে দিলে হয়!

রাবু। মাম্মাটা ভাললোক নহেন,-তাহার চক্ষু দেখিলে আমার যে ভয় হয়! এখন তিনি আসিয়াছেন, কেবল আমাদের স্কুলে যাওয়ায় বাধা দিতে!

সুরেয়া। আমি ত স্কুলে যাইবই—

জোহ। হাঁ, তুই একাই যাইবি-তুই বড় সোহাগের মেয়ে কি না!

বদ। রাবু! তোরা পাগলা কোরার নিম্পর্মল জলে বেশ ভাল করিয়া মুখ ধুইস! আমরা তিনজন টেকনিকাল স্কুলে ভর্ত্তী হইব।

রাবু! তোমাদের মাম্মা বাধা দিবেন না?

কও। বাধা দিয়াছিলেন; এখন রাজী হইয়াছেন।

জোহ। আপা! সেখানে কেবল ‘নানা’ আছে, ‘নানা’ নাই?

বদ। না, সে স্কুলে ‘নানা’ নাই—কেবল একদল ‘নানী’ আছেন!

এখানে ‘নানা’ অর্থে নান শব্দের পুংলিঙ্গ বুঝিতে হইবে। দুষ্ট বালিকারা সেন্ট হেলেনাস টেকনিকাল স্কুলের নানুদিগকে ‘নানী’ বলে! তা তাহাদের সূতি খুন মাফ!! এই স্কুলে বালিকাদিগকে রন্ধন, সূচিকম্পর্ম ও নানাপ্রকার বুনন গাঁথনি (যাবতীয় ফ্যানসী ওয়ার্ক) শিক্ষা দেওয়া হয়।

জোহরা সাদরে আখতরের হাত ধরিয়া বলিল, “আপা! তুমি আমার পুতুলের জন্য খুব সুন্দর শাল তৈয়ার করিয়া দিও?”

সুরেয়া কওসরের কণ্ঠবেষ্টন করিয়া বলিল, “আর তুমি অনেক মিঠাই তৈয়ার করিও।”

রাবু। হাঁ, তাহা হইলে তুমি খুব মিঠাই খাও! (সকলের হাস্য)।

মুশতরী আসিয়া জানাইল পাঠগৃহে সব প্রস্তুত। অতঃপর সকলে সেই কক্ষে গেল।

কওসর শিক্ষয়িত্রীর আসন গ্ৰহণ করিয়া গভীর ভাবে সকলকে সম্বোধন করতঃ বলিল, “আব্বা যে সন্ধ্যার সময় আমাদিগকে বায়ুর বিষয় বলিলেন, তাহার কোন কথা তোমরা কে বুঝিতে পার নাই? যে না বুরিয়া থাক, আমাকে জিজ্ঞাসা কর, আমি বুঝাইয়া বলি।”

মুশ। আব্বা হওয়ার কথা বলিয়াছেন। ইন্দ্ৰধনুর বিষয় ত কিছু বলেন নাই। আমি কালি তাহাকে ইন্দ্ৰধনুর কথা জিজ্ঞাসা করিব।

জোহ। আমি আব্বাকে বলিব, আমায় একটা ইন্দ্ৰধনু আনিয়া দিতে।

সুরে। আমিও ইন্দ্ৰধনু লইব।

বয়োজ্যেষ্ঠার হাসিল। মুশতরী বলিল, “ওরে, ইন্দ্ৰধনু কি ধরা যায়?”

রাবু। ইন্দ্ৰধনু ধরা যায় না। সত্য,-কিন্তু যে উপায়ে বায়ু ধরিয়া কাচের নলে বন্ধ করা যায়, পরীক্ষা করা যায়, সেইরূপে ইন্দ্ৰধনুকে ধরাও অসম্ভব নহে।

কও। এ অকাট্য যুক্তি! (সকলের হাস্য)।

রাবু। কেন, মন্দটা কি বলিলাম? আখ। না রাবু! কিছু মন্দ বল নাই। টেলিফোন, গ্রামোফোন-ফনোগ্রাফ ইত্যাদিতে মানুষের কণ্ঠস্বর ধরা গিয়াছে ও ধরা যায়, তবে ইন্দ্ৰধনু ধরা আর শক্তটা কি?

আবার হাসির গররা উঠিল।

কও। চুপ! চুপ! মাম্মা শুনিলে বলিবেন, “এইরূপে বুঝি পড়া হইতেছে?”

মুশ। (কষ্টে হাস্য সম্বরণ) আব্বা তা আমরা হাসিলে কিছু বলেন না?

রাবু। না, বরং তিনিও হাসেন।

বদ। তোরা আর এক কথা শুনিয়াছিস? জাহেদ ভাই ও হুরন বুকে মাম্মা প্রহার করিয়া থাকেন!

জোহ। সত্য নাকি? বাবা! তবে আর আমি মাম্মার বাড়ী যাইব না। যখন নিজের ছেলে মেয়েকে মারেন, তখন আমাদের ত আরও মারিবেন।

সুরে। আব্বা তা আমাদের কখনও মারেন না।

রাবু। আমাদের আকরা ভাল, মাও ভাল, কেবল মাম্মাটি ভাল নহেন।

বদ। দাড়া! আমি মাম্মাকে বলিয়া দিব!

আখ। রাবুতাঁহার মুখের উপর বলিতে ভয় করে কবে?

কওসর। বাস্! এখন চুপ কর!

বদ। বায়ুর বিষয় ভালরূপ বুঝিলাম কি না, সে সম্বন্ধে প্রশ্ন কর না, বড়। আপা?

কও। আমি কাল দিনের বেলায় মেঘমালা দেখিযা ও দেখাইয়া প্রশ্ন করিব। তোমরা এখন

আমাকে প্রশ্ন করিয়া ভাল করিয়া বুঝিয়া লও।

রাবু। আমি কাল পেটাশিয়াম জলে ফেলিয়া তামাসা দেখিব।

মুশ। পেটাশিয়াম জলে ফেলিলে কি তামাসা হইবে?

বদ। কেন তোমার মনে নাই?-উহা জলে ফেলিবামাত্র আগুন জ্বলিয়া উঠিবো!

মুশ। হাঁ, মনে পড়িল। আমি খেলা করিব, সোডিয়াম ও গরমজল লইয়া।

নায়িমা। (নিদ্রাবেশে চক্ষু কচলাইতে কচলাইতে) আল আমি? আমি তি থেলিব?

মাধ। সেহাস্য) তোমার এখন ‘থেলিয়া’ কাজ নাই। চল, তোমায় শয্যায় রাখিয়া আসি।

রাবু। মুশতরী! তোমার আগুন অপেক্ষা আমরা আগুনের রঙ বেশী সুন্দর হইবে!

মুশ্‌। কেন? সোডিয়াম গরম জলে ফেলিলে বেশী সুন্দর হলদে রঙের আগুন বাহির হইবে?

কও। তোমরা ঝগড়া ছাড়া আর কিছু জান না? রাবুই বড় দুষ্ট-ওই ঝগড়া আরম্ভ করে!

রাবু। ক্ষমা কর, বড় আপা। এখন কাজের কথা বলি। আমরা যে কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়ায় তুষার দেখি, উহাও কি পূৰ্ব্ব অবস্থায় বায়ু ছিল?

কও। হঁয়; এবং এখন আবার উপযুক্ত উত্তাপে বাপীভূত হইতে পারে।

রাবু। তবে সূর্যোত্তিাপে গলিয়া যায় না কেন?

কও। গলে বইকি? ঐ বরফ অল্প উত্তাপে স্থানভ্রষ্ট হইয়া নদীর মত বহিয়া যায়; তাহাকে ইংরাজীতে “গ্লেসিয়ার” বলে। আব্বা উহার নাম দিয়াছেন “নীহারনদী”।

রাবু। বাঃ! বরফের নদী ত বড় সুন্দর দেখাইবো! চল আমরা একদিন কাঞ্চনজঙ্ঘার নিকট গিয়া নীহারানদী দেখিয়া আসি।

বদ। বটে? কাঞ্চনজঙ্ঘা বুঝি খুব নিকট?

রাবু। নিকট না হউক, আমরা কি পথ চলিতে ভয় করি? একদিন চিমনী সাইডে উঠিয়াছিলাম–তাহা কি অল্প পথ ছিল? পাচ ছয় মাইল আরোহণ ও অবতরণ কি সামান্য ব্যাপার? আবার সেদিন ডাউহিল ও ঈগলস ক্ৰেগের সন্ধিস্থলে নামিয়াছিলাম।

বদ। ডাউহিলের সন্ধিস্থলে অবতরণ করিয়া কেমন ক্লান্ত হইয়াছিলে, মনে নাই?

কও। রাবুত বলিয়াছিল, আমি আর হাঁটিতে পারি না; আমাকে ফেলিয়া যাও! আমায় ভল্লুকে খায় খাইবে!

রাবু। ডাণ্ডিটা(৭) সময়ে না পাওয়া গেলে আসিতেই পারিতাম না।

কও। আব্বাই ডাণ্ডির বন্দোবস্ত করিয়া গিয়াছিলেন। তিনি জানিতেন, অৰ্দ্ধপথে বন্দু ও রাবুর বীরত্ব প্রকাশ পাইবে!

বদ। আমি ত ভাই রাবুর মত অহঙ্কার করি না যে কাঞ্চনজঙ্ঘা পৰ্যন্ত পদব্ৰজে যাইতে পারিব, একদৌড়ে দ্বিতীয বেঞ্চ অতিক্রম করিব। হাঁ, ভাল কথা! আমি যে সেই ঈগেলস ক্ৰেগের সন্ধিস্থলের বিজন অরণ্য হইতে ফুল আনিয়াছিলাম, তাহা কোথায় রাখিয়াছি? মনে ত পড়ে না।

কও। ফুলগুলি বনে ফিরিয়া গিয়া থাকিবে।

বদ। তবে তুমি তুলিয়া রাখিয়াছ! আর ভাবনা নাই।

কও। তোমার ফুল কিরূপ ছিল? আমার সংগৃহীত কুসুমরাজি হইতে তাহা বাছিয়া লাইতে পার?

বদ। বেশ পারি—সে ফুল বকুল ফুলের মত। গন্ধ ও আকৃতি বকুলের, কেবল বর্ণ পীত।

রাবু। আর কাঞ্চনজঙ্ঘার উপর যে ক্রেপের ওড়নার মত পাতলা মেঘের গাঢ়গোলাপী বেগুনী চাদর দেখিতে পাই, তাহা কোথা হইতে আইসে?

কও। সূৰ্য্যের উত্তাপে ঐ জমাট তুষার হইতে যে বাষ্প উখিত হয়, তাহাই মেঘের ওড়না রূপে কাঞ্চনের চুড়া বেষ্টন করিয়া থাকে।

আখ। আমি ভাবিয়াছিলাম, কাঞ্চনের ওড়নাগুলি বানারস হইতে আইসে!

সুরেয়া ধীরে ধীরে কওসরের নিকট আসিয়া বলিল, “বড়। আপা! আমাকে ইন্দ্ৰধনু দিবে না?”

কও। (সুরেয়ার মুখ চুম্বন করিয়া) আমি কাল তোমায় ইন্দ্ৰধনু দিব।

বদ। সে কি! তুমি ইন্দ্ৰধনু ধরিবে কেমন করিয়া?

কও। ঝাড়ের কলমে (ক্রিকোণ কাঁচ খণ্ডে) ইন্দ্ৰধনু দেখা যায় তা জানিস না?

বদ। তবে ত ইন্দ্ৰধনু ধরিয়া দেওয়া বড় সহজ! হা হা!

আখ। বড় আপা যে “কম্পতরু”! তিনি দিতে না পারেন কি?

কও। “কল্পতরু নহে’,-“কল্পলতা” বলিতে পার!

 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

অপরাহ্নে নূরজাহী চায়ের সরঞ্জাম সাজাইয়া জাফর ও গওহরের জন্য অপেক্ষা করিতেছেন।

মাতার অঞ্চল ধরিয়া মুশতরী বলিল, “কেন মা, আজি এখন কেন আমরা বেড়াইতে বাহির হইব না?”

নূরজাহঁ। সকালে তোদের মাম্মা ভিকাটারীয়া স্কুল দেখিতে গিয়াছিলেন, এখন তিনি বিশ্রাম করিবেন। তাঁহাকে এক রাখিয়া আমরা কিরূপে যাইব?

জোহরা। কেন? মাম্মা একা থাকিতে ভয় করিবেন না কি? তুমি না যাও, আমরা আকরার সঙ্গে যাইব।

কৰ্ত্তা সে কক্ষে প্রবেশ করিবা মাত্র মুশতরী ও জোহরা তাহাদের দরখাস্ত পেশ করিল। গুণাবলিলেন, “বেণ চল— অধিক দূৰ যাইব না, কেবল ঈগেলস, ক্রেগে গিয়া ফিরিয়া আসি।

জোহ। না, আব্ববা। ঈগেলস, ক্রেগ না! সে দিকে বড় জোঁক।

মুশ। না, ও জোঁকের ক্ষেত্রে গিয়া কাজ নাই।

গও। ছি! তোরা জোঁক দেখিয়া ভয় করিস? (জাফরের পদ শব্দ শুনিয়া) আচ্ছা চুপ কর! তোদের মাম্মাকেও লইয়া যাইব। তাঁহাকে অগ্ৰে যাইতে বলিয়া আমরা পশ্চাতে থাকিব।

জোহ। (আনন্দে করতালি দিয়া) সে বেশ হইবে! পথে জোক থাকিলে পূৰ্ব্বে তাঁহাকে ধরিবে।

মুশ। চুপ চুপ! মাম্মা !–

ইতঃমধ্যে জাফর আসিয়া চায়ের টেবলে যোগদান করিলেন।

গও। ভাই! আজ আর একটু বেড়াইবে না?

জাফ। না, আমার পা বড় ব্যথা করিতেছে।

গও। তবু আজ একটু না হীটলে কাল তুমি একেবারে খোড়া হইয়া যাইবে। বেশী নহে— চল এই ঈগেলস, ক্ৰেগ পৰ্য্যন্ত।

জাফ। আমি যে বুট পরিতে পারিব না।

গও। বুট পরিবার দরকার কি, শ্লিপার লইয়াই চল না? সে ত প্রস্তরসঙ্কুল পথ নহে; ঘাসের উপর চলিবে।

রাবু (জনান্তিকে) শ্লিপর পরিয়া গেলে জোক ধরিবার পক্ষে সুবিধা হইবে। (বালিকাদের হাস্য)।

জাফ। (বালিকাদের প্রতি) ছি! হাসিস কেন? তোরা বড় বে-আদব। কেন নূরু, তুই কি একটা ধমক দিতেও পারিস না?

নূর। দোষ বুঝাইয়া না দিলে ওরা ধমক মানে না।

গও। বিনাদোষে বিনাকারণে ধমক মানিবেই না কেন? হাসিলে দোষ কি?

জাফ। বাস। গওহর, তুমিই মেয়েদের মাথায় তুলিয়াছ।

গও। আচ্ছা, এখন তোমার যাওয়া ঠিক হইল ত?

জাফ। না-পথ কি বড় ঢালু? উপরে উঠতে হইবে, না, নীচে যাইতে হইবে?

গও। পথত একটু ঢালু হইবেই-এখানে সমতল স্থান কোথা পাইবে?

জাফ। তবে আমি যাইব না-এ প্ৰকাণ্ড শরীর লইয়া গড়াইতে চাই না!

গও। ছি! তুমি পাথুরে পথকে ভয় কর, ঢালুপথে গড়াইতে চাও না,-ইহা তোমার womanishness (স্ত্রীভাব)।

নূর। “womanish” শব্দে আমি আপত্তি করি। “ভীরুতা’ কাপুরুষতা” বল না কেন?

জাফ। পিপীলিকার পক্ষ হইলে শূন্যে উড়ে। স্ত্রীলোকে শিক্ষা পাইলে পুরুষদের কথার প্রতিবাদ করে,-সমালোচনা করে। তুমি কি গওহরকে ভাষা শিক্ষা দিবে?

গও। স্ত্রীলোকেরা আমাদের অনুপযুক্ত কথার প্রতিবাদ করেন, আমাদের গল্পের অংশ গ্রহণ করেন, ইহা ত অতি সুখের বিষয়।

জাফ। তুমি এখন মুর্থ।–তোমারই পক্ষপাতিত্ব করিয়া নূরুকে ধমক দিলাম, আর তুমি উল্টা আমারই কথার প্রতিবাদ করা?

গও। প্রবলের পক্ষ সমর্থনের আবশ্যকতা নাই। তুমি তোমার ভগিনীর পক্ষপাতিতা করিবে, ইহাই স্বাভাবিক এবং সমুচিত। .

নূর। ভাই আমার মত বা পক্ষ সমর্থন করিবেন কেন? আমি বেচারী তাহার কি কাজে লাগি?-আমি কি তাঁহাকে মোকদ্দমায় সৎ পরামর্শ দিতে পারি? আমি কি তাঁহার জমীদারী দাঙ্গার সময় পাঁচ সাত জন লাঠিয়াল পঠাইয়া সাহায্য করিতে পারি?

গওহর হাসিলেন। জাফর অন্য কথা তুলিলেন;–

“সত্যই নূরু এবার আমার সঙ্গে যাইবে না? আমি ভাবিয়ছিলাম, আগামী বৎসর যাইতে পরিবে না, তখন কাওসরুর বিবাহের ধূমধামে ব্যস্ত থাকিবে। এবার যাইবে না কেন? তুমি গুরুজী এই শিক্ষা দিয়াছ না কি?”

আবার প্রবলবেগে হাসি পাওয়ায় বালিকাদল পলয়ান করিল।

গও। দোহাই তোমার! আমি কিছু শিক্ষা দিই নাই। উনি ত প্রতি বৎসর তীর্থদর্শনের ন্যায় তোমার সহিত পিত্ৰালয়ে যাইতেন। এবার কেন। যাইতে অনিচ্ছুক, উহাকেই জিজ্ঞাসা কর।

জাফ। বল নূরু! কোন যাইবে না?

নূর। আমি রাবুদের ডাউহিল স্কুলে ভৰ্ত্তি করিবার চেষ্টায় আছি।

স্কুল শব্দ শুনিবা মাত্র জাফর বিস্ময়ে চমকাইয়া উঠিলেন,-“কি বলিলে? স্কুলে মেয়ে ভৰ্ত্তি করিবে? এখনও ভারত হইতে মুসলমানের নাম বিলুপ্ত হয় নাই—এখনও মুসলমানসমাজ ধ্বংস হয় নাই! এখনই মেয়েরা স্কুলে পড়বে? এ প্রথম অভিশাপ আমারই ভাগিনেয়ীদের উপর? প্ৰথম অধঃপতন আমাদেরই?”

গও! তুমি ভালরূপে কথাটা না শুনিয়াই বিলাপ আরম্ভ করিলে? ডাউহিল স্কুলে কেবল বালিকারা শিক্ষাপ্রাপ্ত হয়। সেখানে সাত আট জন শিক্ষয়িত্রী নিযুক্ত আছেন। তথায় পুরুষের প্রবেশ নিষেধ। তাদৃশ বিদ্যালয়ে কন্যা পাঠাইলে দোষ কি?

নূর। সে স্কুলে পুরুষ মোটেই নাই। মেথরাণী ও আয়াই স্কুল গৃহের যাবতীয় কাৰ্য্য করে। কেবল বাবৰ্চি ও খানসাম্য পুরুষ। পাচকের সঙ্গে স্কুলগৃহের কোন সম্বন্ধ নাই। কেবল রন্ধনশালা হইতে খানা বহিয়া আনে দুই তিনজন চাকর। প্রধানা শিক্ষয়িত্রীর সহিত আমি কথা ঠিক করিয়াছি যে ঐ খাদ্যদ্রব্য বহিবার জন্য যদি আমি উপযুক্ত চাকরাণী দিতে পারি, তবে তিনি তাহাদিগকেই নিযুক্ত করিয়া পুরুষ কয়টিকে বরখাস্ত করিবেন। উক্ত শিক্ষয়িত্রীটি অতিশয় ভদ্রলোক-তিনি আমাদের পর্দার সম্মান করিয়া থাকেন। সমস্ত স্কুলটি ঘুরিয়া ফিরিয়া দেখিলাম,-কোথাও একটিও চাকর ছিল না।

জাফ। তোমরা বল-আমি শুনি!! আর ঐ স্কুলের পাশ্বেই যে বালকদের স্কুল। ছুঢ়ীর সময় বালক বালিকারা একত্রে খেলা করিবে

গও। বালক স্কুল হইতে বালিকা স্কুলের ব্যবধান এক মাইলেরও অধিক; এমত স্থলে তাহারা একত্ৰে খেলিবে কিরূপে?

জাফ। যদি তোমার চক্ষে কোন পীড়া না হইয়া থাকে। তবে ষ্টেশনের নিকট দাড়াইলেও দেখিবে,-উভয় স্বৰূলের চূড়া পাশাপাশি।

নূরজাহী হাস্য সম্বরণ করিতে পারিলেন না। গওহর সহাস্যে বলিলেন, “তোমার অভিজ্ঞতার বলিহারি যাই! আজি তুমি ভিক্টোরিয়া স্কুল পরিদর্শন করিয়া এই অভিজ্ঞতা অৰ্জ্জন করিয়াছ?”

জাফ। আমি স্কুলের ভিতর যাই নাই।

গও। (সবিস্ময়ে) তবে সকালে তিন ঘণ্টা তমি কোথায় ছিলে?

জাফ। তৃতীয় বেঞ্চে কতকক্ষণ বসিয়াছিলাম। তারপর স্কুল সীমানায় প্রবেশ করিয়া দেখি, পথ আর ফুরায় না। একজন পথিককে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলাম, স্কুল পৌঁছতে আরও ১৫ turn (পেচ) বাকী। (অর্থাৎ পথত সোজা নহে, আঁকাবঁকা; তাই আরও ১৫ বার মুক্সিল স্থা পুঞ্জয়া যাইবে)। তখন আমি ভাবলাম, আজি আর পথ শেষ হইবে না, তাই ফিরিয়া আসিলাম।

নূরনহাঁ আবার হাসিলেন। আর গওহর বলিলেন, “বাস! মোল্লার দৌড় মসজিদ পৰ্য্যন্ত! তুমি প্রায় স্কুলের দ্বারদেশ হইতে ফিরিয়া আসিয়াছ, ভিক্টোরিয়া অথচ ডাউহিল স্কুল সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা প্রকাশ করিতেছ। তুমি কি জান ब्लिन् কোথায়? স্কুলগৃহের যে যুগল চূড়া দেখা যায়, উহা এক ভিক্টোরিয়া স্কুলেরই। স্কুলটি কি তুমি সামান্য গ্রাম্য পাঠশালা মনে করিয়াছ? উহা এক প্রকাণ্ড অট্টালিকা,–এবং উহা অনেকখানি স্থান ব্যাপিয়া দণ্ডায়মান রহিয়াছে। বালকদের জীড়া প্রায়শই ত প্রায় পাঁচ বিঘা জমী!

নূর। এবং ডাউহিল স্কুল উহা অপেক্ষাও প্রকাণ্ড। একটি কক্ষে পঞ্চাশটি বালিকার শয্যা দেখিলাম; এবং প্রত্যেক পর্য্যঙ্ক অপর পর্য্যঙ্ক হইতে দুই হাত ব্যবধানে। এখন আন্দাজ কর ত কক্ষটা কত বড়?

জাফ। অতবড় ঘর এ প্রস্তরসঙ্কুল দেশে নির্ম্মাণ করা কি সহজ না সম্ভব?

নূর। সহজ না হউক সম্ভব তা বড় বড় অট্টালিকা নিৰ্ম্মিত হইয়াছে তা। প্রথমে একটা টেনিস কোর্ট দেখিয়া আমার চক্ষে ধাধা লাগিয়াছিল। কতগুলি কঠিন প্রস্তরের মস্তক চূর্ণ করিয়া ঐ সমতল প্রাঙ্গণখনি নিশ্চির্মত হইয়াছে, তাহা আমরা সহজে ধারণা করিতে পারি না। কেবল প্রস্তর ভাঙ্গিতে হয় নাই, স্থানবিশেষে জোড়া দিয়া ভরাটও করিতে হইয়াছে। অতখানি স্থান যে একেবারে গৰ্ত্তশূন্য ছিল, তাহা হইতে পারে না। একদিকে মহাশিল্পীর পর্বত-রচনা কৌশল, অপর দিকে তাঁহারই প্রদত্ত মানববুদ্ধির পূর্ণ বিকাশ-উভয়ের মিশামিশি বড় চমৎকার বোধ হয়।

গও। ভাই! তুমি দিনকতক এখানে থাক, তাহা হইলে তুমিও কবি হইতে পারিবে! কুবিত্ব-জ্ঞান-রহিত অবলার মরুতুল্য হৃদয়েও যখন কবিত্ব-কুসুম ফুটিয়াছে

জাফ। আমি নুরুর অপেক্ষা কম Prosaic (অকবি) নাহি!! আমরা উভয় ভ্রাতা vefisserfjq Prosaic!

গও! কিন্তু এখানকার জলবায়ুএমন যে—

“বারেক দর্শন পেলে চিরমূক কথা কয়!
… মহামুর্থ কবি হয়!”

জাফ। কিন্তু তাহাতে লাভ কি? কবিত্বটা মস্তিক্ষেকের রোগবিশেষ! আমাদের কুলকামিনীরা পাহাড়ে ময়দানে বেড়াইয়া কবি হয়, ইহা কখনই বাঞ্ছনীয় নহে!

গও। তবে কি বাঞ্ছনীয়?

জাফ। বাঞ্ছনীয় এই—তাহারা সুচারুরূপে গৃহস্থলী করে, রাধে, বাড়ে, খাওয়ায়, খায়, নিয়মিতরূপে রোজা-নমাজ প্ৰতিপালন করে।

গও। নিমজ কাহার উদ্দেশ্যে?

জাফ। (আরক্তলোচনে) কাহার উদ্দেশ্যে?–খোদাতালার উদ্দেশে!

গও। বেশ ভাই ঠিক বলিয়াছ। তুমি অবশ্যই জান, একটা পারস্য বয়েৎ আছে-“চিত্র দেখিয়া চিত্রকরকে স্মরণ কর।“ আর ইনি এখনই মহাশিলপী বলিয়া কাহার প্রশংসা করিলেন?

জাফ। মহাশিল্পী ত ঈশ্বরকে বলা হইয়াছে।

গও। তবে কবিত্ব ধর্ম্মের বিরোধী হইল কিসে? ঈশ্বরের সৃষ্টি যতই অধিক দেখা যায়, ততই ঈশ্বরের প্রতি ভক্তির বৃদ্ধি হয়। চক্ষু কৰ্ণ, যথাবিধি খাটাইয়া সৃষ্টি-জগতের পরিচয় না। লাইলে স্রষ্টাকে ভালমতে চিনিবে কিরূপে? পৰ্ব্বতচূড়ায় দাড়াইলে আপনা হইতেই হৃদয়ে ভক্তি-প্রস্রবণ উচ্ছসিত হয়,-তখন অজ্ঞাতে হৃদয়-তন্ত্রে বাজিয়া উঠে

“সেই অদ্বিতীয় কবি আঁকিয়া এমন ছবি
আপনি অদৃশ্য হয়ে আছেন কোথায়?”

জাফ। আমি ভালমতে বাঙ্গালা বুঝি না।

গও। তবে বল—“জর্মীচমন গুল-”(৮)

জাফ। (বাধা দিয়া) রাখ এখন তোমার কবিতা! কন্যাগুলি নিশ্চয় স্কুলে যাইবে?

গও। নিশ্চয়! কওসর, আখতার ও বন্দুর স্কুলে পড়বার সময় গত হইয়াছে, সেজন্য বড় আক্ষেপ হয়।

জাফ। তবে নূরজাহীকেও ভৰ্ত্তি কর! গও। আমার আপত্তি নাই! ইনি ত বলেন যে “শিং কটাইয়া বাছুর দলে মিশিতে ইচ্ছা হয়”।

জাফ। (সহোদরার প্রতি) মিশিলেই পার! তোমারও একান্ত ইচ্ছা নাকি শ্ৰীমতীদের খ্ৰীষ্টান করা??

নূর। মেয়েরা খ্ৰীষ্টান হইবে কেন? আমি অহঙ্কারের সহিত বলি,-আমার মেয়েরা ধৰ্ম্মভ্ৰষ্ট হইতে পারে না ইহারা খাটি সোনা-অনলে সলিলে ধ্বংস হইবে না।

গও। আমিও সাহঙ্কারে বলি, তোমার স্ত্রীর বিশ্বাস (ইমান) টলিতে পারে, কিন্তু আমার স্ত্রীর বিশ্বাস অটল!

জাফ। আমার স্ত্রীর বিশ্বাস অস্থায়ী হইল কিসে?

গও। যেহেতু তিনি আপনি ধর্ম্মের কোন তত্ত্বই অবগত নহেন। কেবল টিয়া পাখীর মত নমাজ পড়েন, কোন শব্দের অর্থ বুঝেন না। তাহাকে যদি তুমি স্বর্ণপিঞ্জরে আবদ্ধ না রাখ তবে একরার কোন মিশনারী মেমের সহিত দেখা হইলেই তিনি মনে করিবেন, “বাঃ! যিশুর কি মহিমা!” সুতরাং সাবধান! যদি পোর ত লৌহসিন্দুকে বন্ধ রাখিও।

জাফ। আর নুরু বুঝি নমাজে ব্যবহৃত শব্দসমূহের অর্থ জানে?

গও। জানেন কিনা পরীক্ষা কর! তুমি কি মনে কর এই কুড়ি বৎসরের বিবাহিত জীবনেও আমি আমার অর্দ্ধাঙ্গীকে আমার ছায়াতুল্যা সহচরী করিয়া তুলিতে পারি নাই?

জাফ। তবে দেখ নুরু যে স্কুলে পড়ে নাই সে জন্য কি আটকোহয়াছে? তবে মেয়েগুলার মাথা খাও কেন?

গও। আমাদের পূর্বপুরুষেরা রেলপথে ভ্ৰমণ করেন নাই, টেলিগ্রাফে সংবাদ পাঠান নাই, সেজন্য তাঁহাদের কিছু আটকাইয়াছিল কি? তবে আমরা টেলিগ্রাম পাঠাই কেন, রেলগাড়ীতে উঠি কেন?

জাফ। আমাদের তা ওসব আবশ্যক হয়।

গও। যাহা আমাদের জন্য আবশ্যক, তাহা আমাদের মহিলাদের জন্যও প্রয়োজন। তাহারা আমাদের আবশ্যক-অনুযায়ী বস্তুই ত যোগাইয়া থাকেন। গ্রাম্য চাষার স্ত্রীরা জরির কাজ জানে না, আচার মোরব্বা প্ৰস্তুত করিতে জানে না। কারণ চাষীদের তাহা আবশ্যক হয় না। ইউরোপীয়া কামিনীরা পান সাজিতে জানে না, কারণ ইউরোপীয় পুরুষদের তাহা আবশ্যক হয় না। আবার আমাদের কুলবালারা চাষা স্ত্রীদের মত ধান ঝাড়িতে জানেন না, যেহেতু আমাদের তা প্রয়োজন হয় না। ক্রমে আমরা কারি, কাটলেট, পুডিং খাইতে শিখিতেছি আমাদের গৃহিণীরাও তাহা রাধিতে শিখিতেছেন। আমাদের ছাড়া তাঁহাদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব কই? এবং তাঁহাদের ছাড়া আমাদেরও নিরপেক্ষ অস্তিত্ব কই? স্কুল কলেজের শিক্ষা যেমন আমাদের আবশ্যক, তদ্রুপ তাঁহাদেরও প্রয়োজন। তোমার পারিবারিক জীবন অপেক্ষা আমার গাৰ্হস্থ্য জীবন অধিক সুখের, ইহা তুমি অবশ্যই স্বীকার করিবে? তোমার সমস্ত সুখ দুঃখ তোমার স্ত্রী কখনই হৃদয়ঙ্গম করিতে পারেন না।

জাফ। তাহা না পারুন; কিন্তু তিনি আমার মতের বিরুদ্ধে একটি কথাও উচ্চারণ করেন না। আমি যদি দিনকে রাত্রি বলি, তিনিও বলেন,-“হা, দিব্য জ্যোৎস্না।” আবার যদি আমি অমাবস্যা রাত্রিকে দিন বলি, তিনিও বলিবেন,-“হ্যা, রৌদ্র বড় প্রখর।”

গও। সাবাস! (সকলের হাস্য)

জাফ। তা’ না ত কি! স্বামী-স্ত্রীর মত এক না হইলে দিবানিশি রুষ-জাপান যুদ্ধে ব্যাপৃত থাকিতে হয়।

গও। কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর মত এক হইল কই? তুমি যেরূপ বলিলে তাহাতে কেবল তোমারই মত প্ৰকাশ পায়, তাঁহার ত মতামত জানাই যায় না। তিনি কদাচ নিজ মত ব্যক্তি করেন না। এবার যখন কোন পশুশালায় যাইবে অনুগ্রহ করিয়া পশুগুলির সমক্ষে কোন বিশেষ মত প্রকাশ করিও, আর পশুগুলি উত্তর না দিলে বা মাথা নাড়িলে বুঝিয়া লইও, পশুগণ তোমার সহিত একমত হইয়াছে।

জাফ। শুন, আর একটি কাজের কথা বলি; আগামী বৎসর ত কাওসরুর বিবাহ, এখন তাহাকে লইয়া তোমরা পাহাড় পৰ্ব্বতে বেড়াও, বরপক্ষীয় লোকেরা শুনিলে কি বলিবে?

নূর। বরপক্ষের ইহাতে আপত্তি নাই, জানি।

গও। বর ত শিমলাতেই কাজ করেন। আর স্বামীর সহিত স্ত্রী বেড়াইবে, পিতার সহিত কন্যা বেড়াইবে, তাহাতে অন্য লোকের আপত্তি করিবার অধিকার?

জাফ। বেশ, মঙ্গলময় তোমাদের মঙ্গল করুন। বরটিও তোমাদের মনোমত পাইয়োছ। তাহা হইলে দেখিতেছি আমার নির্বাচিত পাত্রের সহিত আখতরের বিবাহ দিবে না।

গাও। না। কওসরের ভাবী দেবরের সহিত আখতরের বিবাহ হইবে।

জাফ। তবে উভয় কন্যার বিবাহ একই সঙ্গে দাও না কেন?

গও। তাহা হইলে ভালই হইত। কিন্তু সে ছেলেটি এখন বিলাতে।

 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

হিমালয়ের ক্রোড়স্থিত টুঙ্গ নামক স্থানে একটি ঝরণার ধারে কয়েক ব্যক্তি বসিয়া বিশ্রাম করিতেছেন। তাঁহাদের মধ্যে যে সৰ্ব্বাপেক্ষা বয়ঃকনিষ্ঠা, সে বলিল,-“মেজ আপা! দেখি ত এই ঝরণা কোথা হইতে আসিয়া ভীমবেগে আবার কোথায় চলিয়াছে! তুমি বলিতে পার শেষে কোথায় গিয়াছে?”

আখতার। না, রাবু! আমি তা জানি না শেষে কোথায় গিয়াছে। আসিয়াছে ঐ পাহাড়ের পাষাণ বক্ষ বিদীর্ণ করিয়া।

রাবু। সামান্য জলধারা পাষাণ বিদীর্ণ করিল কিরূপে? তাহা কি সম্ভব?

কওসর। ঐ জলধারা কেবল পাষাণ বিদীর্ণ করিয়াছে, তাহাঁই নহে; কত প্ৰকাণ্ড প্রস্তর খণ্ড উহার চরণতলে গড়াইতে গড়াইতে ক্ষয়প্রাপ্ত হইয়া বালুককণায় পরিণত হইয়াছে।

প্রকাণ্ড প্রস্তর বালুকায় পরিণত হওয়ার কথাটা রাবু সহজে ধারণা করিতে না পারিয়া পিতাকে জিজ্ঞসা করিল, সত্য আব্বা?

গওহর কথা কহিবার পূৰ্ব্বে জাফর বলিলেন, “হাঁ সত্য। তোরা য়েমন পিতৃক্ৰোড়ে নির্ভয়ে ক্রীড়া করিত, ঐ নির্ঝরগুলি সেইরূপ পাষাণময় পিতৃবক্ষে নৃত্য করিতেছে—পিতা তবু অটল! হিমাদ্রিও ঠিক গওহরেরই মত সহিষ্ণু! আর শোন, ষ্টিমার হইতে যে বিশালকায়া জাহ্নবী দেখিয়াছিস, এইরূপ কোন একটা শিশু নিবন্ধুরই তোহর উৎস।”

রাবু। (আনন্দ ও উৎসাহের সহিত) তবে মাম্মা! বলুন ত ইহার কোনটা গঙ্গার উৎস?

জাফ। গঙ্গার উৎস এখানে নাই।

কও। কি ভাবিতেছ আখতার?

আখ। ভাবিতেছি,-এই ক্ষীণাঙ্গী ঝরণাগুলি হিমালয়ের হৃদয়ে কেমন গভীর হইতে গভীরতম প্ৰণালী কাটিয়া কলকলস্বরে স্রষ্টার স্তবগান গাহিতে গাহিতে চলিয়াছে! বিরাম নাই-বিশ্রাম নাই-আলস্য ঔদাস্য নাই–অনন্ত অবারিত গতিতে চলিয়াছে!

রাবু। মেজ আপা! আমিও একটি নদীর উৎস আবিষ্কার করিলাম!

আখ। বটে?

কও। কি আবিষ্ককার করিয়াছিস বল ত?

রাবু। কারসিয়ঙ্গের পাগলা ঝোরাই পাগলা নদীর উৎস।

আখ। দূর পাগলি!

বদর। রাবু কিন্তু কথাটা একেবারে অসঙ্গত বলে নাই,-ক্রিস্রোতা নদী ত এই দাৰ্জিলিঙ্গের আশপাশেই–

কও। ধন্য তোমাদের গবেষণায়। বদু ত বেশ পণ্ডিত হইয়া উঠিয়াছে!

বদু। যদি গবেষণায় ভুল হইয়া থাকে, তবে ওকথা থাক; আর এক মজার কথা বলি,— বেশ খেয়াল করিয়া দেখ ত, পাহাড়ের বুকের ভিতর দিয়া রেলপথ কেমন আঁকিয়াৰ্যাকিয়া গিয়াছে—একদিকে সুউচ্চ পৰ্ব্বত, অন্যদিকে নিমস্থিত অনুচ্চ পাহাড়ের স্তুপ-একটির পর অপরটি ঢেউয়ের পর ঢেউয়ের মত দেখায়! ইহাকে পৰ্ব্বত-তরঙ্গ বলিলে কেমন হয়?

কও। বেশ ভাল হয়। সমুদ্রের ঢেউয়ের কথা তোমার মনে আছে বোন?

বাদু। না দিদি! মনে ত পড়ে না।

রাবু। মাম্মা! আমি ঐ ঝরণার জল স্পর্শ করি গিয়া?

জাফ। যাবি কিরূপে? অবতরণের পথ যে দুৰ্গম।

রাবু। আপনি অনুমতি দিন,-আমি যেমন করিয়া পারি, যাইব। সেজ। আপা! তুমিও

বাদু। না, তুমি একাই যাও।

জাফর অনুমতি দিলেন। রাবু অতি কষ্টে অগ্রসর হইল; শেষে এক প্রকাণ্ড প্রস্তর তাহার গতিরোধ করিল। সেটি অতিক্রম না করিলে জলস্পর্শ করা হইবে না। উপর হইতে কওসর শাসাইল, “দেখিস কাপড় ভিজে না যেন।” প্রায় হামাগুড়ি দিয়া অতি সাবধানে রাবু সে প্রস্তর অতিক্রম করিল! শীতল জল অঞ্জলি ভরিয়া লইয়া খেলা করিতে লাগিল।

তদর্শনে বন্দুর একটু হিংসা হইল। সে রেলিং-এর ধারে দাড়াইয়া বলিল,-“কিলো রাবু! স্বর্গে পঁহুছিয়াছিস যে? তোর আনন্দের সীমা নাই! তুই তবে থাক ঐখানে,-আমরা bळ्ळि!”

নূরজাহীও ডাকিলেন, “আয় মা! বেলা যায়।” সকলে আরও কতকাদূর অগ্রসর হইলেন। ইহারা টুক্ত হইতে পদব্ৰজে কারসিয়ঙ্গ চলিয়াছেন।

পথে দুই তিনজন পাহাড়ী তাহাদিগকে দেখিয়া পথ ছাড়িয়া দিয়া একদিকে দাড়াইল। গওহর জাফরকে বলিলেন, “দেখিলে ভাই ইহাদের শিভালরী (অবলার প্রতি সম্মান প্রদর্শন)?”

জাফ। ইহা উহাদের অভ্যাস, অনেকে সময় স্ত্রীলোকেরাও আমাকে সুপথ ছাড়িয়া দিয়া পথিপার্শ্বে দাড়ায়।

নূর। যেহেতু তাহারা “নীচেকা আদমি”কে দুর্বল মনে করে। জাফ। আমি কিন্তু স্ত্রীলোকের নিকট দুর্বলতা স্বীকার করি না। গও। যে সবল তাহার নিকট দুর্বলতা স্বীকার করায় দোষ কি? জাফ। যাহাই হউক, স্ত্রীলোককে আমি কায়িক বলের শ্ৰেষ্ঠতা দিব না!

গও। কেন দিবে না? “Give the devil even his due” (শয়তানকেও তাহার প্রাপ্য স্বত্ব দান কর)।

জাফ। কিন্তু আমি রমণীকে তাহার প্রাপ্য স্বত্ব দিতে অক্ষম!

গও। তবে একরার শর্টকাট পথে কোন পাহাড়িনীর সহিত race (বাজী) দৌড়িতে চেষ্টা করা দেখি!

জাফ। শর্টকাটো? তাহা মানুষের অগম্য! নূর। তবে ঐ দুৰ্গম পথে যাহারা পৃষ্ঠে দুই মণ বোঝা সহ অবলীলাক্রমে আরোহণ ও অবরোহণ করে, তাহাদের নিকট দুর্বল বলিয়া পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করা কেন?

এস্থলে পাৰ্ব্বত্য শর্টকাট পথের একটু পরিচয় দেওয়া আবশ্যক। প্রস্তুর সন্ধুল গড়ানিয়া খাড়া সংক্ষিপ্ত পথকে short cut বলে। শর্টকাট পথ বড়ই দুৰ্গম; কোথাও উচ্চ প্রস্তর, কোথাও গৰ্ত্ত, কোথাও এমন ঢালু যে পা রাখা যায় না। পাথর কাটিয়া ভাঙ্গিয়া অশ্বাদি, গাড়ী ও (“নীচেকা”) মানুষের জন্য গবৰ্ণমেন্ট যে অপেক্ষাকৃত সমতল, কিন্তু ক্ৰমোচ্চ সুগম পথ নিম্পর্মাণ করিয়াছেন; তাহাকে স্থানীয় ভাষায় “সরকারী সিটক” বলে। ঐ সরকারী সর্টকগুলি অনেক দূর আঁকিয়াবাকিয়া যায়। সচরাচর গুর্থ ও ভুটিয়াগণ সরকারী ঘুরাও পথে না চলিয়া শর্টকাটে যাতায়াত করে। কারণ যেখানে শর্টকাটে পাঁচ মিনিটে যাওয়া যায়, সেইখানে সরকারী সটীক দিয়া গেলে প্রায় ২০/২৫ মিনিট লাগে এবং সাতবার ঘুরিতে হয়।

নূরজাহাঁ পুনরায় বলিলেন, “এই অশিক্ষিত পাহাড়ীদের শিভালরী। অবশ্য অবশ্য প্ৰশংসনীয়।”

গও। উহাদের নিকট আমাদের ভদ্রতা শিক্ষা করা উচিত। আমরা বৃথা ভদ্রতা ও সভ্যতার বড়াই করি।

নূর। আর একটা বিষয় লক্ষ্য করিয়াছ, ভাই? পাহাড়ী বা ভুটিয়া স্ত্রী পুরুষ-কেহই ভিক্ষা করে না।

জাফ। তাহদের ভিক্ষার প্রয়োজন হয় না বলিয়া।

গাঁও। প্রয়োজন না হওয়াও ত প্ৰশংসনীয়।

এইরূপ কথাবাৰ্ত্তায় তাহারা পথ-ক্লান্তি ভুলিতেছিলেন। কারসিয়ঙ্গ ক্টেশনের নিকটে আসিয়া কওসর বলিল,-“কি রাবু! বড় ক্লান্ত না কি?”

রাবু। না, মোটেই না।

জাফ। আরও এক মাইল যাইতে হইবে, জনিস?

ক্রমে তাহারা একটা বেঞ্চের নিকট আসিলেন। তথায় কয়েকজন গুখা বসিয়াছিল, তাহারা ইহঁদিগকে দেখিয়া সসম্প্রমে আসন ত্যাগ করিল। নূরজাহাঁ বলিলেন, “একটু বসা যাউক”।

জাফ। না, চল আর বেশী দূর নাই।

বাদু। হাঁ মাস্মা! বসুন না! ঐ দেখুন আকাশে আগুন! স্বাক্ষর পশ্চিমে চাহিয়া দেখিলন, সতাই আকাশে আগুন লাগিয়াছে। সবই যেন অগ্নিময়।

আখ। দেখ আপা! কাঞ্চনজঙ্ঘায়ও আগুন লাগিয়াছে!

জাফ। বাস্তবিক বড় চমৎকার দৃশ্য তা! এখান হইতেও কাঞ্চনজঙ্ঘার দুইতিনটি শৃঙ্গ দেখা যায়! অস্তমানরবির সোণালী কিরণে সত্যই সে কাঞ্চনকান্তি লাভ করিয়াছে। বোধ হয় যেন দিনমণি পশ্চিম গগনে আত্মগোপন করিতে যাইতেছে—আর সুকুমার মেঘগুলি তাহার পশ্চাতে ছুটয়াছে। প্রদোষে এমন শোভা হয়, পূৰ্ব্বে লক্ষ্য করি নাই। ওদিকে অলকমালা রাঙ্গাকিরণে স্নান করিয়া স্বর্ণবৰ্ণ লাভ করিতেছে! মৃদুমন্দ সমীরণ যেন তাহাদের সহিত লুকাচুরি খেলিবার ছলে মেঘমালাকে ইতস্ততঃ বিক্ষপ্ত করিতেছে!

গও। সালাম ভাই! তুমিই ত বল কবিত্ব মস্তিষ্কের রোগ রোগ বিশেষ!

জাফ। যে এখানকার জলবায়ুতে ঐ রোগটা আছে। পূর্ববঙ্গের জলবায়ুতে ম্যালেরিয়া, হিমালয়ের জলবায়ুতে কবিত্ব।

গও। কেবল কবিত্ব নহে, বৈরাগ্য-যোগশিক্ষা ইত্যাদিও! এইখানে বসিয়া স্রষ্টার লীলাখেলা দেখ–তোমার সান্ধ্য-উপাসনার ফল প্রাপ্ত হইবে! এখানে নিজের ক্ষুদ্রত্ব বেশ স্পষ্টরূপে উপলব্ধি করা যায়।

নূর। বলিতে কি, অভ্যাসমত উপাসনায় এমন ভাবের আবেগ, ভক্তির উচ্ছাস থাকে না। গও। আর আমরা যে সামাজিক নিয়মের বশবৰ্ত্তী হইয়া স্ত্রীলোকদের এমন উপাসনাঅর্থাৎ স্রষ্টার সৃষ্টিবৈচিত্ৰ্য দর্শন স্বইতে বঞ্চিত রাখি, ইহার জন্য ঈশ্বরের নিকট কি উত্তর দিব? যে চক্ষুর কাৰ্য্য দর্শন করা, তাহাকে চিরঅন্ধ করিয়া রাখি-ধিক আমাদের সভ্যতায়! ইনি না কি এখানে আসিবার পূৰ্ব্বে কখনও উষার প্রথম আলোক ও সূৰ্য্যোদয় দেখেন নাই।

জাফ। সম্ভবতঃ আমিও দেখি নাই-সেজন্য আমি ত একরারও বিলাপ করি না! গও। কিন্তু তুমি মাঠে বাহির হইলেই দেখিতে পাইতে; তোমার গতি ত অবারিত। আর মনে রাখিও, যথাসাধ্য জ্ঞানেন্মেষ ধর্ম্মেরই এক অঙ্গ।

জাফ। জ্ঞান বৃদ্ধি হইলে লোক নাস্তিক হয়, এইজন্য কুলললনাবৃন্দকে জ্ঞান হইতে দূরে রাখা আবশ্যক।

গও। যত অভিশাপ কুলবালার উপর! ইহা তোমার বিষম ভ্ৰম; জ্ঞানের সহিত ধৰ্ম্মের বিরোধ নাই। বরং জ্ঞান ধর্ম্মের এক প্রধান অঙ্গ।

আরও অনেক কথা হইল। এদিকে বালিকার দলও নীরব ছিল না। আখতার মৃদুস্বরে বলিল, “দেখ আপা! ওদিকে দূরে উচ্চ গিরিচূড়ে চায়ের শ্যামল ক্ষেত্রগুলি সান্ধ্য রবিকিরণের তরল স্বর্ণবর্ণে স্নান করিয়া কেমন সুন্দর দেখাইতেছে! আবার কেমন ধীরে ধীরে ঈষৎ ধূমল বর্ণের বাষ্পরূপী ওড়নায় নিজ নিজ স্বর্ণকায় আবৃত করিতেছে!”

কও। ঠিক বলিয়াছ, বোন। আমিও তাঁহাই ভাবিতেছিলাম। সৃষ্টিকৰ্ত্তার কি অপোর মহিমা! তাঁহার শিল্পনৈপুণ্যের বলিহারি যাই!

বাদু। চল এখন বাসায় যাই! আখ। যাওয়ার জন্য এত ব্যস্ততা কেন, দিদি?

বদু। আর এখানে থাকিয়া কি দেখি্বে? ঐ দেখা ক্ৰমে সন্ধ্যা সমাগমে বুঝি শীত বোধ হওয়ায় চা-বাগানগুলি অন্ধকার লেপে শরীর ঢাকিতেছে! আর ত কিছুই দেখা যায় না!

কও। চা-বাগানের শীত বোধ হউক না হউক, বন্দুর শীতবোধ হইতেছে! কারণ বদু ভ্ৰমক্রমে শাল আনে নাই।

সকলে বাসা অভিমুখে চলিলেন।

 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

সন্ধ্যার পর গওহর আলী দুহিতাদিগের পাঠগৃহে বসিয়া তাহাদিগকে পড়াইতেছেন। পাঠ শেষ * হইলে তিনি অৰ্দ্ধঘণ্টাকাল তাহদের সহিত গল্প করেন। গঙ্গাপচ্ছলে তিনি তাহাদিগকে কখন ঐতিহাসিক কখন ভৌগোলিক বিষয়ে শিক্ষা দিয়া থাকেন। অদ্য তাঁহাদের আলোচ্য বিষয় সৌরজগৎ।

মুশতরী। ভাল কথা, আব্বা! মাম্মা কেন আমাদিগকে সীের-চক্ৰ বলেন? আমরাও কি আকাশে ঘুরি?

গও। তিনি বিদ্রাপ করিয়া আমাদের সৌরজগৎ বলেন। কিন্তু আইস আমরা ঐ বিদ্রািপ হইতে একটা ভাল অর্থ বাহির করিয়া লই।

কও। জান না? আঁস্তাকুড়ের আবর্জনার ভিতরও অনেক সময় মূল্যবান বস্তু লুক্কায়িত, থাকে!

গও। হ্যা, অদ্য আমরা ঐ বিদ্রুপ-আবর্জনা হইতে একটা মূল্যবান জিনিষ বাহির করিতে চেষ্টা করি। কওসর! তুমি চেষ্টা করিবে, মা?

কও। আপনিই চেষ্টা করুন।

গওহর আরম্ভ করিলেন, “বলিয়াছি ত প্রত্যেক গ্রহই নিয়মমত সূৰ্য্যকে প্রদক্ষিণ করিয়া থাকে। সূৰ্য্যকে প্ৰদক্ষিণ করা যেমন গ্ৰহগণের কৰ্ত্তব্য, তদ্রুপ তাহাদিগকে আলোক প্রদান ও তাহাদের প্রত্যেকটিকে যথাবিধি আকর্ষণ করা এবং সঙ্গে সঙ্গে নিজের মেরুদণ্ডের উপর ঘোরা সূৰ্য্যের কৰ্ত্তব্য। এই সৃষ্টিজগতের প্রত্যেকে আপনি আপন কৰ্ত্তব্য পালন করিতেছে। কাহারও কৰ্ত্তব্য সাধনে ত্রুটি হইলে সমষ্টির বিশৃঙ্খলা ঘটে।

“মনে কর প্রত্যেক লোকের গৃহই একটি সৌরজগৎ এবং গৃহস্থের আত্মীয় স্বজনেরা ঐ সৌরপরিবারের এক একটি গ্রহ। গ্রহদের কৰ্ত্তব্য গৃহস্থের অবস্থানুসারে তাহারই মনোনীত পথে চলা। এবং গৃহস্থেরও কৰ্ত্তব্য পরিবারস্থ লোকদিগকে স্নেহরশ্মিদ্বারা আকর্ষণ করা, তাহাদের সুখস্বচ্ছন্দতার প্রতি দৃষ্টি রাখা—এমনকি (দারিদ্র্যবশতঃ) খাদ্যের অপ্রতুলতা হইলে, প্রথমে শিশুদের, অতঃপর আশ্ৰিত পোষ্যবৰ্গকে আহার করাইয়া সৰ্ব্বশেষে তাহার ভোজন করা উচিত। যদি এই পরিবারের একটি লোকও স্বীয় কৰ্ত্তব্যপালনে অবহেলা করে, তবে বিশৃঙ্খলা ঘটিয়া পরিবারটি নানা প্রকার অশান্তি ভোগ করবে।

“যেমন কোন গ্রহ যদি আপন কক্ষকে অতিক্রম করিয়া দূরে যায়। তবে সূৰ্য্যের আকর্ষণ বিমুক্ত হইলে, সে অন্য কোন গ্রহের সহিত টক্কর খাইয়া নিজে চূর্ণ হইবে এবং অপর গ্রহকেও বিদপগ্ৰস্ত করিবে। সুতরাং যাহার যে কক্ষ, তাহাকে সেই কক্ষে থাকিয়া স্বীয় কৰ্ত্তব্যবৰ্ত্তে চলিতে হইবে।”

ঠিক এই সময় জাফর আসিয়া বলিলেন, “সালাম ভাই! পথে আসিয়াছ। আমিও ত তাহাই বলি, যাহার জন্য যে সীমা নির্দিষ্ট আছে, সে তাহা অতিক্রম করিলে বিশজখলা ঘটিবে। সমাজরূপ সৌরজগৎ স্ত্রীরূপ গ্রহদের জন্য যে সীমা নির্দিষ্ট করিয়াছে সে সীমা উল্লঙ্ঘন করা স্ত্রীলোকদের উচিত নহে।”

গও। মাফ কর ভাই! আমাকে আগে আমার বক্তব্য বলিতে দাও! তুমি আসন গ্ৰহণ কর।

আখতার। (জনাস্তিকে কওসরকে) মাম্ম কথা বলিবার ভঙ্গীও জানেন না! “সমাজরূপ সৌরজগৎ” আর “স্ত্রীরূপ গ্ৰহ” বলা হইল!

কও। তাই ত! সমাজটু নিজে সৌরজগৎ হইলে গ্রহদের সীমা নির্দিষ্ট করিবার অধিকার কি? ঈশ্বর স্বয়ং সকলের সীমা নির্দেশ করিয়াছেন। আচ্ছা এখন উহাদের কথা শুনি।

জাফর আসন গ্রহণ করিলে পর বালিকারাও আসন গ্ৰহণ করিল। জাফরকে দেখিয়া ইহারা সসম্প্রমে আসন ত্যাগ করিয়াছিল।

গওহর বলিয়া যাইতে লাগিলেন, “কেবল অবলারা সীমা অতিক্ৰম করিলে বিশৃঙ্খলা ঘটে। ইহাই নহে, পুরুষেরাও স্বীয় কক্ষ লঙ্ঘন করিলে বিশৃঙ্খলা ঘটে।”

জাফ। পুরুষদের গন্তব্যপথ ত সীমাবদ্ধ নহে-তাহাদের আর কক্ষচ্যুত হওয়া কি?

গও। পুরুষেরাও স্বেচ্ছাচারী হইতে পারে না। তাহাদেরও কৰ্ত্তব্য আছে। তুমি কি স্ত্রীপুত্রকে অরক্ষিত অবস্থায় ফেলিয়া কোথাও যাইতে পার?

জাফ। না।

গও। তবে কিরূপে বল, তোমার পথ সীমাবদ্ধ নহে?

জাফ। তবু আমার যথেষ্ট স্বাধীনতা আছে।

গও। কৰ্ত্তব্যে অবহেলা করিবার ক্ষমতা নাই।

মুশ। আব্বা! আমরা ত সকলেই নিজ নিজ কৰ্ত্তব্য কাৰ্য্য করি, কিন্তু নয়ীমু ও মাসুমা ত কিছু করে না?

রাবু। তাহারা এত ছোট যে তাহাদের কৰ্ত্তব্য কিছুই নাই।

গও। তাহাদেরও কৰ্ত্তব্য আছে বই কি? নয়ীমুর কৰ্ত্তব্য যথানিয়মে আহার নিদ্রা পালন করা ও খেলা করা। মাসুমার কৰ্ত্তব্য খাওয়া, নিদ্রা যাওয়া, হাসা এবং দৌড়াইতে শিখা।

রাবু। ঈশ! ভারী ত কৰ্ত্তব্য! উহারা ও কাজ না করিলে আমাদের এখানে এমন কি বিশৃঙ্খলা ঘটিবে?

কও। উহারা এখনও তোমাদের মত দুষ্টমী শিখে নাই; তাই উহারা যথানিয়মে স্ব স্ব কৰ্ত্তব্যপালন করে। যদি মাসুমা না হাসে বা নয়ীমা না খায়। তবে বুঝিতে হইবে তাহাদের অসুখ হইয়াছে। তখন তাহাদের শুশ্রুষার জন্য আমাদিগকে ব্যস্ত থাকিতে হইবে।

গও। তাহাদের চিকিৎসার জন্য ব্যস্ত থাকিলে আমাদের দৈনিক কাৰ্য্যে বিশৃঙ্খলা ঘটিবে কি না?

রাবু। ই-বুঝিলাম!

গও। আর এক কথা মনোযোগের সহিত শুন। আমি বলিয়াছি, গ্ৰহমোলা স্ব স্ব কক্ষে থাকিয়া সূৰ্য্যকে প্রদক্ষিণ করে। এই প্ৰদক্ষিণ কাৰ্য্যে গ্রহদের সাদৃশ্য ও একতা আছে—অর্থাৎ সকলেই ঘুরে, এই হইল সাদৃশ্য। কিন্তু তাই বলিয়া যে সকল গ্রহই একই সঙ্গে উঠে, একই সঙ্গে বসে তাহা নহে! (জাফরের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া) তাহাদের আবার ‘ব্যক্তিগত স্বাধীনতা আছে। জাফর ভাই যে বলেন, সৌরপরিবারের অবলারােপ গ্ৰহদের ‘ব্যক্তিগত স্বাধীনতা নাই, ইহা তাঁহার ভ্রম।

জাফ। ভ্ৰম নহে-ঠিক কথা। অবলাকে কোন প্রকার স্বাধীনতা দেওয়া উচিত নহে। তুমি হয়ত মাদ্রাজের Christian Tract Societyর প্রকাশিত Indian Reform সম্বন্ধীয় পুস্তিকাসমূহ হইতে এ স্বাধীনতার ভাব গ্রহণ করিয়াছ! খৃষ্টধৰ্ম্ম প্রচারকগণ যাহা বলেন, তোমার নিকট তাহা অভ্রান্ত সত্যরূপেই পরিগণিত হইয়াছে।

গও। আমি আজি পৰ্য্যন্ত উক্ত পুস্তিকার একখানিও পাঠ করি নাই। খৃষ্টানদের নিকট কিছু শিখিতে যাইব কেন? ঈশ্বর কি আমাকে বুদ্ধি দেন নাই? আর আমি ত এই কারসিয়ঙ্গ, শৈলে আছি, এই সময় তুমি আমার বাড়ী অনুসন্ধান কর গিয়া, যদি আমার বাড়ীতে “Christian Tract Societyর প্রকাশিত পুস্তিকা” একখানিও দেখিতে পাও, তবে আমি তোমাকে হাজার (১০০০) টাকা দিব!

জাফ। হাজার টাকার বাজী?

গও! হাঁ-লাগাও বাজী-এক হাজার নূতন টাকা! আর যদি পুস্তিকা না পাও তবে তুমি দিবে ১০০০ টাকা!

জাফ। না, বাজী এইরূপ হউক যে হারজিত-উভয় অবস্থাতেই তুমি টাকা দিবে! হা! হা-হা!

গও। বাস! ঐ খানেই বীরত্বের অবসান!

এই সময় নূরজাহাঁ আসিয়া কওসরের পার্শ্বে উপবেশন করিলেন।

বদর। আকরা, গ্রহদের “ব্যক্তিগত” স্বাধীনতা কেমন? গও। যেমন সূৰ্য্যের চতুর্দিকে প্রদক্ষিণ করিতে বুধের প্রায় তিন মাস, শুক্রের আট মাস, বৃহস্পতির ১২ বৎসর এবং শনির ৩০ বৎসর লাগে। ইহাই তাঁহাদের ব্যক্তিগত পার্থক্য বা স্বাধীনতা। শনিগ্রহকে কেহ আরক্তনেত্ৰে আদেশ করিতে পারে না যে “তোমাকেও বুধের মত ৩ মাসেই সূৰ্য্যের চতুর্দিকে ঘুরিতে হইবে।”! এবং এতদ্ব্যতীত আরও অনেক বৈষম্য আছে; তাহা তোমরা এখন বুঝিতে পরিবে না।

কও। আর অতি কথা এককালে বলাও ত সম্ভব নহে।

গও। হঁয়, সম্ভবও নহে। এইরূপ মানবের সৌরপরিবারেরও পরস্পরের মধ্যে কতকগুলি সাদৃশ্য আছে এবং কতকগুলি বৈসাদৃশ্যও আছে।

জাফ। যথা গওহর আলীর সহিত আমার চক্ষুকর্ণের similarity (সাদৃশ্য) আছে এবং মতামতের dissimilarity (বৈসাদৃশ্য) আছে! (সকলের হাস্য।)

কও। তরুলতার গঠন প্ৰণালীর প্রতি দৃষ্টি করিলেও আমরা বৈষম্য ও সাদৃশ্য পাশাপাশি বিদ্যমান দেখিতে পাই। বন্দু! সেদিন তোমাকে নানাজাতীয় fernএর (ঢেকি গুলোর) সাধারণ আকৃতিগত সাদৃশ্য এবং পত্রগত সূক্ষ্ম পার্থক্য দেখাইয়াছিলাম মনে আছে ত?

বদু। হাঁ। ঠিক এক রকমের দুইটি পাতা বাহির করিতে পারি নাই।

গও। তাই তা। জাফর ভাই যেমন মনে করেন সংসারে তিনি ছাড়া আর কেহবিশেষতঃ স্ত্রীলোক কথা কহিবে না! তিনি ব্যতীত আর কেহ স্কুলে পড়িবে না ইত্যাদি ইত্যাদি, ইহা প্রকৃতির নিয়ম নহে।

জাফ। আমি কি লোককে কথা বলিতেও নিষেধ করি?

গও। নিষেধ করা না বটে, কিন্তু তুমি এমন ভাবে বলা আরম্ভ কর যে আর কাহারও কথা কহিবার সুবিধা হয় না। ইনি তোমাকে তিন দিন কন্যাদের বালিকা স্কুলে পড়বার কথা বলিতে চেষ্টা করিয়াছেন—তুমি একদিনও ধৈৰ্য্যের সহিত শুন নাই। তুমি যে ভাবে মহিলাদের কথায় বাধা দিয়া নিজের বাগিতা প্রকাশ কর, তাহা তোমার ন্যায় বিলাত ফেরতার পক্ষে কদাচি শোভনীয় নহে।

জাফ। আমি অধিক কথা বলি, তোমরাও বল না কেন?

গও। আমরা অত বকিতে পারি কই? আমি দুইশত টাকা পুরস্কার দিব, যদি কেহ তোমাকে বাগযুদ্ধে পরাস্ত করিতে পারে!

নূর। কেবল বাগযুদ্ধ নহে-বাগাডাকাতিও বটে।

জাফ। নূরু! তুইও বিপক্ষে গেলি? নূর। না, ভাই! ক্ষমা করা,-আমি ত এখন কিছু বলি নাই! গও। টিক,-বাগিতা, বাকচাতুৰ্য্য, বাকচৌৰ্য্য, বাগড়াকাতি এবং বাগযুদ্ধে যে ব্যক্তি আমার জাফর দাদাকে পরাস্ত করিবে, সে ২০০ টাকা পুরস্কার পাইবে!

নূর। সভয়ে আর একটি কথা বলি,—ভাই দুই ঘণ্টা ধরিয়া কথা বলেন, কিন্তু কি যে বলেন, তাহা নির্ণয় করা দুঃসাধ্য!

গও। কেবল বকেন—লক্ষ্য ছাড়িয়া দিয়া কখন দক্ষিণে, কখন বামে, কখন সম্মুখে, কখন পশ্চাতে-ন্যানাস্থানে ঘুরেন! কিন্তু বকেন! অপরের বক্তব্য শুনেন না, কেবল নিজে বকেন! যাহা হউক, ইহা স্বভাবের নিয়ম নহে। জাফর দিনকে রাত্রি বলিলে যে তাঁহার বাড়ীর সকলকেই “দিব্য জ্যোৎস্না” বলিতে হইবে, ইহা ঈশ্বরের অভিপ্রেত নহে। অবলাদেরও চক্ষুকৰ্ণ আছে, চিন্তাশক্তি আছে, উক্ত শক্তিগুলির অনুশীলন যথানিয়মে হওয়া উচিত। তাহাদের বাকশক্তি কেবল আমাদের শিখান বুলি উচ্চারণ করিবার জন্য নহে।

জাফ। উঠ এখন; আজি যথেষ্ট বকিলে।

গও। আর দুই এক কথা বলিতে দাও-তোমার কথা নহে। সৌরচক্রের গ্রহমালা যেমন সূৰ্য্যকে লক্ষ্য করিয়া আপন কক্ষে ভ্ৰমণ করিতেছে, তদ্রুপ আমাদেরও উচিত যে সত্যঅর্থাৎ ঈশ্বরে লক্ষ্য রাখিয়া, তাহার উপর অটল বিশ্বাস সহকারে নির্ভর করিয়া স্ব স্ব কৰ্ত্তব্য পথে চলি। যে কোন অবস্থায় সত্য ত্যাগ করা উচিত নহে-সত্যভ্ৰষ্ট হইলেই অধঃপতন অবশ্যম্ভাবী। সত্যরূপ কেন্দ্রে ধ্রুব লক্ষ্য রাখিতে হইবে।

কও। আমরা সকলেই সৌরপরিবারের এক একটি ক্ষুদ্র তারা, পরমেশ্বর আমাদের সূৰ্য্য।

গও। ঠিক। এবং যাহারা উক্ত সৌরপরিবারের ন্যায় সুখে জীবন অতিবাহিত করে, তাহারা ঈশ্বরের প্রিয়পাত্র।

কও। পরস্পরে একতা থাকাও একান্ত আবশ্যক।

গও। হাঁ, -কিন্তু এই ঐক্য যেন সত্যের উপর স্থাপিত হয়। একতার মূলে একটা মহৎ গুণ থাকা আবশ্যক।

জাফ। আমি বলি, একতার ভিত্তি ন্যায় বা প্ৰেম হইলে আরও ভাল হয়।

গও। ন্যায়পরায়ণতা এবং প্রেমও সদগুণ বটে, কিন্তু উহাদের মাত্ৰাধিক্যে আবার অনিষ্টের সম্ভাবনা। যেমন সময় সময় কঠোর ন্যায় কোমল প্রেমের বিরোধী হয়; আবার প্রেমের আধিক্য ন্যায়কে দলিত করে। বিচারক অত্যন্ত দয়ালু হইলে চলে না, আবার ন্যায়বিচারে প্রকৃত প্রমাণ অভাবে অনেক সময় নিৰ্দোষীর দণ্ড হয়। সত্যের কিন্তু অপর পৃষ্ঠা নাই-উহা স্বচ্ছ সুনিৰ্ম্মল। এই জন্য বলি,—একতার ভিত্তি সত্য হউক। জাফ। বেশ! নমাজের সময় হইল,-চল এখন তোমার কক্ষে!

গও। চল! নমাজে কিন্তু তুমি ইমাম হইবে।

জাফ। না, তুমি ত আমার শ্রেষ্ঠতা স্বীকার কর না,-সুতরাং তুমি ইমাম হইবে।

গও। তবে মনে রাখিও,—সকল বিষয়ে আমি নেতা, তুমি অনুবর্ত্তী।

জাফ। না, তাহা হইবে না!

গও। তবে “ব্যক্তিগত স্বাধীনতা অবলম্ববন কর।

জাফ। তথাস্তু! তুমি তোমার কক্ষে উপাসনা কর,—আমি আমার কক্ষে।

জাফর ও গওহর চলিয়া গেলে পর বদর বলিল, “মাম্মা আমাদিগকে সৌরজগৎ বলিয়া বিদ্রুপ না করিলে এত কথা জানিতে পারিতাম না।”

আখ। ঠিক! অদ্য আব্বা আমাদের জন্য কয়লা হইতে কোহেনুর বাহির করিয়াছেন।

কও। মনে রাখিও—আমরা সকলে সৌরপরিবারের তারা!

————–
১. বালিকাদের নাম ও বয়স জানিয়া বাখিলে পাঠিকার বেশ সুবিধা হইবে। কওসবের ১৮, আখতাবের ১৬, বদরের ১৪, রাবেয়ার ১২. মুশতবীর ১০, জোহরার ৮, সুরেয়ার ৬, নয়িমার ৪, এবং মাসুমার বয়স ২ বৎসর।

২. পুরুষদের কথোপকথনে দুই একটি ইংরাজী শব্দের ব্যবহার পাঠিকারা ক্ষমা করিবেন। ব্রাকেটের ভিতর শব্দগুলির অনুবাদ দেওয়া গেল।

চিমনী সাইড, স্থান বিশেষ; তথায় চায়ের কারখানায় এক প্ৰকাণ্ড চিমনী নির্মিত হইয়াছিল। সাধারণের বিশ্বাস সেই চিমনীর নিকটবৰ্ত্তী স্থানই কারসিয়ঙ্গেব সৰ্ব্বোচ্চ স্থান।

৪. অর্থাৎ বৃহস্পতি, শুক্র ও কৃত্তিকা নক্ষত্র।

৫. তিন চারি বৎসরের শিশুরা প্রায় কবর্গ স্থলে তবর্গ উচ্চারণ করে। গল্পের স্বাভাবিক ভাব রক্ষার্থে আমরাও নয়িমার ভাষায়। তবর্গ ব্যবহার করিলাম।

৬. পাগলা ঝোরা কারসিয়ঙ্গের বৃহত্তম ঝরণা।

৭. ডাণ্ডি, বাহন বিশেষ; ইহা শিবিকাব ন্যায় মানুষের স্কন্ধে বাহিত হয়।

৮. অর্থাৎ “ধারণী কানন ফুল-বাকী অংশত উচ্চারিতই হয় নাই।

অধ্যায় ৩ / ৩

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন