২.১০ রেড়ির তেলের আলো

বিমল মিত্র

চারি সমাজের পতি কৃষ্ণচন্দ্র মহামতি
ভূমিপতি ভূমিসুরপতি।
তার রাজ্যে শ্রেষ্ঠ ধাম সমাজপূজিত গ্রাম
শ্রীকান্ত সাগরে নিবসতি ॥
শ্রীউদ্ধব দাস নাম, হরিভক্তি লাভ কাম
উপনাম শ্রীশ্রীহরিদাস।
পয়ারে রচিয়া ছন্দ, লিখিতং গীতবন্ধ–
শ্রীবেগম মেরী বিশ্বাস ।

রেড়ির তেলের আলোর তলায় বসে বসে উদ্ধব দাস লিখত আর সুর করে করে পড়ত। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের কথা, তার দেওয়ান কালীকৃষ্ণ সিংহের কথা, গোপাল ভাঁড় মশাই, রায়গুণাকর, রামরুদ্র বিদ্যানিধির কাহিনীও লিখত।

সেদিন উদ্ধব দাস বাবুমশাইয়ের সঙ্গে বাগবাজারের বাগানে এসে দেখে ছাউনিতে কেউ নেই, ফাঁকা। লটবহর নিয়ে সবাই রওনা দিয়েছে চন্দননগরের দিকে। ছোটমশাই আর সেদিন অপেক্ষা করেননি সেখানে, সোজা চলে গিয়েছিলেন কৃষ্ণনগরে।

কৃষ্ণচন্দ্র এমনিতে পণ্ডিতদের নিয়ে দিন কাটাতেন বটে, কিন্তু নজর রাখতেন সব দিকে। তার লোক ছিল দিল্লিতে বাদশার দরবারে। তেমনি আবার অন্য লোক ছিল মুর্শিদাবাদে কাছারির কাজ করবার জন্যে। নতুন নবাব হবার পর থেকেই বড় ঝঞ্জাট চলছিল। আগেও ঝাট ছিল। কিন্তু নবাব আলিবর্দি খাঁ ছিল রসিক মানুষ। বয়েস হয়েছিল। অনেক ঠেকে, অনেক শিখে, অনেক দেখে জীবন সম্বন্ধে একটা জ্ঞান হয়েছিল। বাকি খাজনার জন্যে যেমন রাজা-জমিদারদের জমি বাজেয়াপ্ত করেছিল নবাব, তেমনি খালাসও দিয়েছিল অনেককে।

রামরুদ্র বিদ্যানিধিকে মহারাজ বরাবর সঙ্গে নিয়ে দরবারে যেতেন।

দরবারে একবার নবাব জিজ্ঞেস করলেন–আচ্ছা মহারাজ, আজ তিথি কী?

নবাব কৃষ্ণচন্দ্রকে মহারাজ বলে ডাকতেন।

মহারাজ রামরুদ্র বিদ্যানিধির দিকে চাইতেই বিদ্যানিধি বললেন–আজ পূর্ণিমা

নবাব জানতেন পণ্ডিতরা অনেক সময় ঠিকে ভুল করে। জিজ্ঞেস করলেন–আজ কি তা হলে সমস্ত রাতই জ্যোৎস্না থাকবে?

বিদ্যানিধি বললেন–হঁ জাঁহাপনা, আজ সমস্ত রাতই জ্যোৎস্না থাকবে

 আলিবর্দি হেসে ফেললেন। বললেন–পণ্ডিত, আপনি কিন্তু মিছে কথা বলছেন

সমস্ত দরবারসুদ্ধ আমির-ওমরাহরা পণ্ডিতের মুখের দিকে তাকালেন। রামরুদ্র বিদ্যানিধিকে সবাই চিনতেন। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রকেও সবাই চিনতেন। রামরুদ্র বিদ্যানিধিকে মিথ্যেবাদী বলা মানে মহারাজকেও মিথ্যেবাদী বলা।

কিন্তু আপনার এই পঞ্জিকাতেই তো আপনি লিখেছেন আজ চন্দ্রগ্রহণ?

মহারাজের মাথায় বজ্রাঘাত হল। বিদ্যানিধি মশাই কি তাকে লজ্জায় ফেলবেন নবাবের সামনে!

 কিন্তু বিদ্যানিধি মশাই বললেন–না খোদাবন্দ, আজ চন্দ্রগ্রহণ বটে, কিন্তু সে-চন্দ্রগ্রহণ হিন্দুস্থানে অদৃশ্য, তাই সারারাতই আকাশ জ্যোৎস্নাময় থাকবে দেখে নেবেন–

কথাটা বিদ্যানিধি বললেন বটে, কিন্তু মহারাজের ভয় গেল না। দরবার থেকে ফিরে বিদ্যানিধির কাছে এসে মহারাজ বললেন–কী সর্বনাশে ফেললেন বলুন তো পণ্ডিতমশাই, এখন কী করে আমার মুখরক্ষে হবে?

সে অনেক কাল আগের কথা। সত্যি-মিথ্যে, বাস্তব কল্পনা, সবকিছু মিশিয়ে সেই নবাবি আমল। উদ্ধব দাস নিজে দেখেনি। বেগম মেরী বিশ্বাসও দেখেনি। শুধু চেহেল সুতুনের ভেতরে বেগমমহলের কাছ থেকে গল্প শুনেছে। নানিজি নিজে বলেছে মরালীকে। নবাব রাত্রে চেহেল্‌-সুতুনে এসে নানিবেগমকে বলেছিলেন–আজ কৃষ্ণনগরের পণ্ডিতকে জব্দ করব

নানিবেগম জিজ্ঞেস করেছিল–কেন গো, কীসে জব্দ করবে—

আজ পণ্ডিত বিদ্যানিধি বললে, চন্দ্রগ্রহণ হিন্দুস্থানে দেখা যাবে না তাই দেখব মিনারে উঠে

ওদিকে মহারাজেরও ভাবনার অন্ত নেই। কী করে মুখরক্ষে হবে মহারাজের তাই নিয়েই ভাবনা।

 নবাব বলেছিলেন–যদি চন্দ্রগ্রহণ দেখা যায়, তা হলে কী হবে পণ্ডিতমশাই?

তা হলে আপনার যা অভিরুচি, তাই-ই করবেন!

 তা মহারাজের ভাবনা দেখে রামরুদ্র বিদ্যানিধি বললেন–মহারাজ চিন্তা করবেন না, গ্রহণ হবে না—

মহারাজ বললেন কিন্তু এ আপনি কী বলছেন পণ্ডিতমশাই, সর্বগ্রাস চন্দ্রগ্রহণ কখনও না হয়ে যায়? আপনি প্রলাপ বকছেন নাকি? এক বছর মাথা ঘামিয়ে যা গণনা করে বার করেছেন, এক দিনের কথায় তা আজ রদ হয়ে যাবে? আপনি বলছেন কী?

বিদ্যানিধি বললেন আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন মহারাজ, স্নানাদি করতে যান, আজকে আমার সঙ্গে দিবারাত্রির মধ্যে আর দেখা করতে আসবেন না

বুঝেছি, আপনি পালিয়ে যাবেন। কিন্তু নবাবের মুল্লুক ছেড়ে কোথায় পালাবেন?

বিদ্যানিধি বললেন–মহারাজ, প্রাণের মায়া কি আমার এত বড় যে বিপদের সময়ে মহারাজকেও ত্যাগ করব? আমি তেমন লোক নই

সেই দিনই বিদ্যানিধি ভাগীরথী পাড়ে গিয়ে পুজো আরম্ভ করলেন। একটা তামার কলসি আগেই জোগাড় করেছিলেন। আর জোগাড় করেছিলেন একশো আটটা লোহিতবর্ণ জবাফুল। সামনে পেছনে কেউ কোথাও নেই। মহারাজের সাঙ্গোপাঙ্গরা সেই পুজোর জিনিসপত্র নিয়ে গিয়ে ভাগীরথীর নির্জন একটা বাঁকে তুলে দিয়ে এল। বিদ্যানিধি মশাই সেই একশো আটটা জবাফুল দিয়ে যথাবিধি নিজের উপাস্যদেব সহস্রাংশুর পুজো করতে লাগলেন। তারপর সন্ধে হবার সময়েই তামার কলসিটা পুজোর বেদিতে রেখে মন্ত্রবলে রাহুকে আকর্ষণ করে কলসির মধ্যে পুরে ফেললেন। তার ওপরে একখানা তামার থালা ঢাকা দিয়ে পাঁচটি শিবলিঙ্গ স্থাপন করে একমনে উপাস্য দেবতার জপ শুরু করলেন।

নবাব মিনারের ওপর চাঁদোয়া খাঁটিয়ে চন্দ্রগ্রহণ দেখবেন বলে তখন আসর আঁকিয়ে বসেছেন। গল্প করতে করতে বললেন–মহারাজের পণ্ডিতটা একটা বুজরুক হে! মৌলবি সাহেবও আমাকে বলেছিল যে, দিল্লির পঞ্জিকাতেও নাকি লেখা আছে রাত চার দণ্ডের সময় গ্রহণ লাগবে আর দ্বিতীয় প্রহরে ছাড়বে, আর পূর্ণগ্রাস হবে

কিন্তু না, সবাই দেখলে গ্রহণ হল না।

নবাব তখন নিজের মহলে ঘুমোতে গেলেন। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের কিন্তু আর ঘুম এল না। তিনি বিদ্যানিধি মশাইয়ের খোঁজে বেরোলেন। বিদ্যানিধি মশাইয়ের তখন বাহ্যজ্ঞান নেই। সেই জনমানবহীন গঙ্গাগর্ভে মাঘ মাসের দুঃসহ ঠান্ডার মধ্যেও একলা নাগ্রে দৃষ্টিস্থাপন করে সহস্রাংশুর নাম জপ করে চলেছেন। শেষে যখন রাত শেষ হয়ে এল, তখন চাঁদ নিষ্প্রভ হয়ে গেছে। বিদ্যানিধি মশাইও গাত্রোত্থান করে শিব পাঁচটি গঙ্গাগর্ভে বিসর্জন দিলেন। তারপর তামার থালাটি তুলতেই সমস্ত পৃথিবী ঝাপসা হয়ে এল। নবাব ঘুম থেকে উঠে দেখলেন, অস্তগামী চাঁদ আকাশপটে মিলিয়ে যাচ্ছে

মহারাজ বিদ্যানিধির ঘরে এসে পণ্ডিতকে একেবারে জড়িয়ে ধরলেন।

বললেন–আপনি আমার মুখ রক্ষে করেছেন পণ্ডিতমশাই, আজকে আমি যথার্থ নবদ্বীপের মহারাজা–

তারপর সকালবেলাইনবাব আলিবর্দি খা দরবারে এলেন। এসেই বিদ্যানিধি মশাইকে জ্যোতিষশাস্ত্র সম্বন্ধে অনেক প্রশ্ন করলেন। শেষে বললেন–কী খেলাত পেলে আপনি খুশি হবেন পণ্ডিত?

বিদ্যানিধি পঁড়িয়ে উঠে কুর্নিশ করে বললেন–মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের অভীষ্টই আমার অভীষ্ট জাঁহাপনা!

বিদ্যানিধির সেই কথাতেই নবাব আলিবর্দি সেবার মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের বকেয়া খাজনা সমস্ত মকুব করে দিয়েছিলেন।

উদ্ধব দাসই লিখে গেছে এসব কাহিনী আদিকালের। আদিযুগের মানুষগুলোর সঙ্গেই ওইসব কাহিনী হারিয়ে গিয়ে নিঃশেষ হয়েছে। সেই আলিবর্দি খাঁ-ও নেই, সেই রামরুদ্র বিদ্যানিধিও নেই। শুধু আছেন মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র আর বিদ্যানিধি মশাইয়ের পঞ্জিকা। সেই পঞ্জিকা নিয়েই তিনি নাড়াচাড়া করছিলেন সেদিন।

হঠাৎ খবর এল দেউড়িতে হাতিয়াগড়ের ছোটমশাই এসেছেন সাক্ষাৎ করতে।

বড় অসময়ে ফিরে আসা দেখে সন্দেহ হল মহারাজের। ক্লাইভ সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে বলে দিয়েছিলেন তাকে। এত তাড়াতাড়ি তো ফেরবার কথা নয়। দেওয়ানজিকে ডাকতেই তিনি এলেন। কালীকৃষ্ণ সিংহ মশাই।

মহারাজ জিজ্ঞেস করলেন-হঠাৎ এত তাড়াতাড়ি হাতিয়াগড়ের রাজা ফিরে এলেন কেন?

কালীকৃষ্ণ সিংহ মশাই তার আগেই সব আলোচনা করেছেন ছোটমশাইয়ের সঙ্গে। জলাঙ্গীর ঘাটে তার বজরা রাখা আছে। চেহারা শুকিয়ে গেছে ক’দিনের মধ্যেই। এই কিছুদিন আগেই দেওয়ানমশাই তাকে তার নিজের বজরায় তুলে দিয়ে এসেছেন। তখনও দেখেছেন, আবার এখনও দেখছেন।

বললেন–আপনার শরীর খুব খারাপ হয়ে গেছে এই ক’দিনেই

ছোটমশাই বললেন–এ ক’দিনে বিশ্রামও হয়নি, কোনও কাজও হয়নি! শরীরের আর অপরাধ কী দেওয়ানমশাই, সেই সব কথাই মহারাজ বাহাদুরকে বলতে এসেছি

কিন্তু ক্লাইভ সাহেব কী বললেন?

ছোটমশাই বললেন–মুশকিল হল কী, আমিও যেই গেলাম অমনি নবাবও গিয়ে পড়লেন ওখানে। যদি জানতুম ঠিক এই সময়েই নবাব ওখানে যাবেন তো আমি আর যেতাম না।

নবাবের কী হাল দেখলেন?

 খুবই খারাপ হাল দেওয়ানমশাই, খুবই খারাপ! কালীকৃষ্ণ সিংহ মশাই বললেন–আমি আপনি আসার ক’দিন আগেই মুর্শিদাবাদ থেকে ফিরেছি। সেখানেই এইসব খবর পেয়েছিলাম।

কার কাছ থেকে সব খবর পেলেন?

কেন, আমাদের জগৎশেঠজির কাছ থেকে! আমিই তো জগৎশেঠজিকে বললাম রায়মশাইকে কলকাতায় পাঠাতে।

রায়মশাই কে?

আজ্ঞে, জগৎশেঠজির দেওয়ান। রায়মশাই তো সবই জানেন।

আমার স্ত্রীর ব্যাপারটাও জানেন নাকি?

তা আর জানেন না? আর কেই বা না জানে? নাটোরের রানি ভবানীর পর্যন্ত কানে গিয়েছে। প্রথমে ভয় পেয়েছিলেন তিনি। নবাবের চরের তো শেষ নেই। ওই যে মনসুর আলি মেহের মুহুরি আছে, ও বেটা এদিকে আমাদের দলেও আছে, আবার নবাবের দলেও আছে। আমাদের খুব সাবধানে কাজ করতে হচ্ছে কিনা। বশির মিঞার নাম শুনেছেন তো?

ছোটমশাই বললেন—হ্যাঁ হ্যাঁ, শুনেছি বটে, আমার অতিথিশালাতেও একবার গিয়েছিল, কী একটা হিন্দুর নাম নিয়ে উঠেছিল–

সে বেটা এখন মুর্শিদাবাদে রয়েছে।

 কেন?

আজ্ঞে, নবাব যখন দলবল নিয়ে কলকাতায় লড়াই করতে গেছে, তখন রাজধানীটা ফাঁকা পড়ে থাকবে, সেটা দেখবার জন্যেই রয়েছে। সেই জন্যেই তো আমি রাত্তিরে গিয়ে উঠেছিলাম শেঠজির। বাড়িতে। সেই পাঠান পাহারাদার আছে শেঠজির, ভিখু শেখ, চেনেন তো? ভারী বিশ্বাসী লোক, তাকে বললাম একটু দেখিস বাবা, আমি যে এখানে এসেছি তা যেন কেউ না জানতে পারে, বলে তার হাতেও একটা মোহর গুঁজে দিলাম। বলা তো যায় না, আজকাল দিনকাল তো বদলে গেছে সব, সেই আলিবর্দি খাঁ’র আমল হলে আর এমন ভাবতাম না। মনে আছে তো সেই রামরুদ্র বিদ্যানিধির ব্যাপারটা?

ছোটমশাই বললেন–হ্যাঁ, কর্তাবাবার কাছে শুনেছিলাম।

দেখুন, সেই দু’লাখ টাকার বকেয়া বাকি খাজনা, এককথায় খুশি হয়ে মকুব করে দিলেন। তিনি ছিলেন জহুরি, গুণের কদর করতে জানতেন। সেসব দিন কোথায় চলে গেল! .

তা জগৎশেঠজি কী বললেন? রাজি হলেন রায়মশাইকে পাঠাতে?

রাজি কি আর হন? রাজি করালাম। মহারাজার চিঠি নিয়ে গিয়েছিলাম, এসব কাজ তো আর নায়েব-গোমস্তা দিয়ে হয় না। বললাম আপনার কথাও বললাম। বললাম, মহারাজ হাতিয়াগড়ের রাজামশাইকে পাঠিয়েছেন ক্লাইভ সাহেবের কাছে আর আপনার কাছে পাঠিয়েছেন আমাকে

তা জগৎশেঠজি বললেন–রায়মশাইকে নবাবের কাছে পাঠিয়ে কী ফায়দা হবে?

আমি বললাম–নবাবকে অন্তত বুঝিয়েসুঝিয়ে কিছুদিন থামিয়ে তো রাখা চলবে।

 তা জগৎশেঠজি আবার জিজ্ঞেস করলেন–থামিয়ে রেখে লাভ কী?

আমি সব বুঝিয়ে বললাম–এখন ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে লড়াই হলে ফিরিঙ্গিরাই হেরে যাবে, তাতে আমাদের ক্ষতি। আর কিছুদিন পরে লড়াই হলে ভাল

জগৎশেঠজি জিজ্ঞাসা করলেন–কেন?

আজ্ঞে শেঠজি, ইংরেজদের আরও দু-তিনটে জাহাজ আসার কথা আছে, তারা আগে আসুক, তবে তো ইংরেজরা হারাতে পারবে নবাবকে।

কিন্তু ওদিক থেকে আহমদ শা আবদালি যদি এসে পড়ে?

সে এলে তখন দেখা যাবে!

তা ছাড়া যদি জেনারেল বুশি এসে পড়ে কর্ণাট থেকে, তখন কী হবে? তার আগেই তো সবফয়সালা হয়ে যাওয়া ভাল।

আমি বুঝিয়ে বললাম জগৎশেঠজি, তারা কেউ না-ও তো আসতে পারে। তারা এসে পড়লে তখন না-হয় অন্য পথ খুঁজে বার করা যাবে। আমার কথায় রায়মশাই সায় দিলেন। তিনিও বললেন এখন লড়াইটা না হতে দেওয়াই ভাল! ইংরেজরা আগে ভাল করে তৈরি হয়ে নিক! মানে, যদি কোনওরকমে একটা মিটমাট করিয়ে দেওয়া যায় দু’পক্ষে, সেইটেই আমাদের পক্ষে ভাল।

ছোটমশাই হঠাৎ বললেন–মহারাজ কখন আসবেন নীচেয়?

এই এলেন বলে, খবর পাঠিয়ে দিয়েছি। আজকে আবার একজন মস্ত কুস্তিগির আসছেন কুস্তি লড়তে–

কুস্তি লড়তে? ছোটমশাই অবাক হয়ে গেলেন কথাটা শুনে! মহারাজ আবার কুস্তি দেখতে ভালবাসেন নাকি?

কালীকৃষ্ণ মশাই বললেন–মহারাজের তো ওই খেয়াল। গোপাল ভাড় মশাইয়ের ভাঁড়ামিও শুনতে ভালবাসেন, রায়গুণাকরের কাব্য শুনতেও ভালবাসেন, আবার শিবরাম বাচস্পতির ষড়দর্শনের ব্যাখ্যাও শুনতে ভালবাসেন, সঙ্গে সঙ্গে আবার মুজাফর হুসেনের কুস্তি দেখতে ভালবাসেন–আজ দিল্লি থেকে এক কুস্তিগির আসছে যে

তা হলে তো মহারাজ ব্যস্ত খুব!

তার আগে কুস্তি হয় কি না তাই দেখুন!

কেন?

কালীকৃষ্ণ মশাই বললেন–সেই জন্যেই তো তিনি পঞ্জিকা দেখছেন, তর্কালঙ্কার মশাইকে ডেকে পাঠিয়েছেন–মল্লক্রীড়ার জন্যে আজ প্রশস্ত সময় কিনা জানতে

হঠাৎ ভেতর থেকে ডাক এল। মহারাজার খাসচাকর এসে খবর দিলে, ডাক পড়েছে মহারাজার কামরায়।

মহারাজ যাদের সঙ্গে গোপনে দেখা করেন, তাদের ভেতরে খাসকামরায় ডাক পড়ে। কালীকৃষ্ণ সিংহ মশাই উঠলেন। বললেন–চলুন, নীচে যখন এলেন না, তখন আপনার সঙ্গে নিরিবিলিতে কথা বলতে চান, চলুন

কৃষ্ণনগরের রাজবাড়ির ভেতরে কখনও যাননি ছোটমশাই। ভেতরেও সদরমহল আছে। শিবমন্দির, পুকুর, অতিথিশালা, চণ্ডীমণ্ডপ, কুস্তির আখড়া, বিরাট কাণ্ডকারখানা। কাছারিবাড়ি পেরিয়ে একেবারে পুব দিকে গিয়ে মহারাজার খাসকামরা। বিরাট রাজবাড়ি। প্রকাণ্ড রাজবাড়ির পেছনে রাজবাড়ির অন্দরমহল।

ছোটমশাই গিয়ে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলেন।

আসুন

তারপর কালীকৃষ্ণের দিকে চেয়ে বললেন–আপনি এখন নিজের কাজে যান দেওয়ানমশাই, আমি পরে ডেকে পাঠাব, ভেতরে খবর দিয়ে দেবেন ছোটমশাইয়ের কথা, ইনি আজকে থাকবেন এখানে

কালীকৃষ্ণ চলে যেতেই মহারাজ ছোটমশাইয়ের দিকে চেয়ে বললেন–এত তাড়াতাড়ি চলে এলেন যে?

ছোটমশাই বললেন না এসে উপায় কী বলুন, কোনও কাজই হল না যে–

আমাদের কালীকৃষ্ণকে সব বলেছেন নাকি?

হ্যাঁ, সব বলেছি।

রণজিৎ রায় মশাইয়ের সঙ্গে দেখা করেছেন?

কী করে দেখা করব, আমি তো নবাবের ছাউনিতে যাইনি।

যাননি ভালই করেছেন। ক্লাইভ সাহেব কী বললে?

ছোটমশাই বললেন যেতে না-যেতেই যুদ্ধ বেধে গেল, তাই বেশিক্ষণ কথা হল না। তারপর ত্রিবেণীতে গিয়ে বজরা বাঁধলাম। সেখানে আমার স্ত্রীর সাক্ষাৎ পেলাম।

সেকী? আপনার স্ত্রী?

আজ্ঞে হ্যাঁ, মরিয়ম বেগম। আপনি তো জানেন সব বৃত্তান্ত!

তারপর?

ছোটমশাই বললেন আমার সঙ্গে পথে এক পাগল জুটেছিল। সেই পাগলটার সঙ্গে দেখলুম ক্লাইভ সাহেবের খুব ভাব।

আপনার স্ত্রী আপনাকে চিনতে পারলেন? কথা হল তাঁর সঙ্গে?

কথা হবে কী করে? তবে সেই পাগলটার সাহস খুব, সে গিয়ে সরাসরি বেগমসাহেবাকে আমার কথা বললে।

আপনিও দেখলেন আপনার স্ত্রীকে?

 ছোটমশাই বললেন–স্পষ্ট দেখতে পেলাম না, বোরখায় সর্বাঙ্গ ঢাকা ছিল, সঙ্গে আর একজন বেগমসাহেবা ছিল

মহারাজ বললেন–নানিবেগমসাহেবা

ছোটমশাই অবাক হয়ে গেলেন।

আপনি কী করে জানলেন?

 মহারাজ হাসলেন। বললেন–তারপর আপনার সহধর্মিণী ক্লাইভ সাহেবের ছাউনির বাগানে গিয়ে সাহেবের সঙ্গে দেখা করেছেন

আরও অবাক হয়ে গেলেন ছোটমশাই। বললেন–আপনি এসব জানলেন কী করে? কে খবর দিলে আপনাকে?

তারপর যখন আপনি ক্লাইভ সাহেবের ছাউনিতে গেলেন তখন ক্লাইভ সাহেবও সেখানে নেই, তাদের ফৌজও নেই। আপনার সহধর্মিণী কি নানিবেগম সাহেবা, কেউই নেই। বাগান ফাঁকা

ছোটমশাই স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে উঠলেন। আর বসে থাকতে পারলেন না।

তখন ক্লাইভ সাহেব ফৌজিসেপাই দলবল লশকর-গোলোজ সব নিয়ে ফরাসি চন্দননগর দখল করতে ভাগীরথীর ওপারে চলে গেছে।

হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন। সব ঠিক। কিন্তু আপনি কেষ্টনগরে বসে জানলেন কী করে? দেওয়ান মশাই কলকাতায় গিয়েছিলেন নাকি? আমাদের সঙ্গে তো দেখা হয়নি। আমাকে তো কিছুই বললেন না।

মহারাজ বললেন–না, কালীকৃষ্ণ এসব কিছুই জানে না, সেই জন্যেই তো কালীকৃষ্ণকে এঘর থেকে সরিয়ে দিলাম।

ছোটমশাই উদগ্রীব হয়ে শুনছিলেন। জিজ্ঞেস করলেন-তারপর?

তারপর আপনি সাহেবের দেখা না পেয়ে এখানে চলে এলেন।

হ্যাঁ, কিন্তু ওদিকে আমার স্ত্রী? আমার স্ত্রীর কী হল? নবাব তো গোবিন্দ মিত্তির মশাইয়ের বাগানবাড়ি থেকে শুনলাম ছাউনি তুলে নিয়ে ত্রিবেণীর দিকে আসছেন, মুর্শিদাবাদে ফিরে আসবার জন্যে

মহারাজ বললেন না, তিনি পথে শুনলেন নানিবেগম আর মরিয়ম বেগমসাহেবা নবাবের সঙ্গে দেখা করবার জন্যে ত্রিবেণী থেকে তাঞ্জামে করে আসছেন, তাই শুনে আবার একটা বাগানে ছাউনি গাড়লেন

তারপর? আপনার কাছে এত তাড়াতাড়ি এ-খবর কী করে এল?

তারপর খবর পেলেন বেগমসাহেবারা তার ছাউনিতে আসতে আসতে পেরিন সাহেবের বাগানে কর্নেল ক্লাইভ সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে গেছে!

সে-খবরও নবাবের কানে গেছে নাকি? তা হলে তো নবাব খুব রেগে গিয়েছেন মরিয়ম বেগমের ওপর? তা হলে কী হবে? তা হলে ক্লাইভ সাহেবের কাছ থেকে ওরা কি আবার নবাবের ছাউনিতে গেছে?

মহারাজ বলতে লাগলেন-হ্যাঁ, আর তারপর নবাব দুই বেগমসাহেবাকে নিয়ে অগ্রদ্বীপে গেছেন। সেখানে গিয়ে শুনেছেন ইংরেজরা চন্দননগর দখল করবার জন্যে সৈন্য-সামন্ত নিয়ে ভাগীরথী পেরিয়ে ওপারে গেছে

ছোটমশাই এতক্ষণ সব শুনছিলেন। শুনে অবাক হয়ে যাচ্ছিলেন।

আপনি এত খবর কোথা থেকে পান? কে দিলে আপনাকে এত খবর?

 মহারাজ সে কথার উত্তর না দিয়ে বললেন–আমি ভেবেছিলাম আপনি এখানে ফিরে না এসে ক্লাইভের সঙ্গে চন্দননগরে যাবেন। কারণ আপনার গৃহিণী অগ্রদ্বীপে নবাবের সঙ্গেই আছেন। আমার কাছে খবর এসেছিল আপনি আপনার নৌকো নিয়ে ত্রিবেণী ছাড়িয়ে পশ্চিম দিকে গেছেন। এত তাড়াতাড়িতে তো আপনার আসার কথা নয় এখানে।

ছোটমশাই বললেন আমি এসব কথা কিছুই জানতাম না—

মহারাজ বললেন–আমি এখানে বসে সব টের পাচ্ছি আর আপনি নিজে সেখানে গিয়েও সব খবর পেলেন না। ওদিকে নবাবের ছাউনিতেও যে গোলমাল বেধেছে

কেন?

আপনার স্ত্রীকে নিয়ে!

আমার স্ত্রী? মরিয়ম বেগম?

হ্যাঁ, মরিয়ম বেগম কর্নেল ক্লাইভ সাহেবের বাগানে গিয়েছিল বলে উমিচাঁদ সাহেব ভীষণ রেগে গেছে। আমার কাছে শেষ যে-খবর এসেছে তাতে মনে হচ্ছে আপনার স্ত্রীর ভীষণ বিপদ। তাকে খুন করবার চেষ্টা চলছে! আপনার পক্ষে যদি সম্ভব হয় এখনই আপনার সেখানে চলে যাওয়া উচিত

কিন্তু খুন করবে কেন?

মহারাজ হাসলেন। বললেন–দেখুন, আপনি তো গোড়া থেকেই সব দেখছেন, আপনার চেয়ে আমি বয়েসে আরও বড়, আমি সুজাউদ্দিনের আমল দেখেছি, সরফরাজের আমলও দেখেছি, আবার এই আমাদের সিরাজউদ্দৌলার আমলও দেখছি। বাকি খাজনার দায়ে মুর্শিদকুলি খাঁর আমলে বৈকুণ্ঠের মধ্যে নরকযন্ত্রণাও সহ্য করেছে জমিদাররা, বগিদের হামলার সময়েও লোকেরা অকথ্য অত্যাচার সহ্য করেছে, কিন্তু এই আমলেই প্রথম দেখছি আমার প্রজারা খেতে না পেয়ে গলায় দড়ি দিয়েছে। এ-ঘটনা আগে কখনও হয়েছে?

মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের মুখে ছোটমশাই আগে কখনও এমন কথা শোনেননি।

আমি নবদ্বীপে গিয়ে এবার নিজের চোখে এই ঘটনা দেখে এসেছি। এর পরেও কি আমি চুপ করে থাকতে পারি?

ছোটমশাই বললেন–সে তো আমিও হাতিয়াগড়ে দেখেছি, কিন্তু এর প্রতিকার কোথায়?

প্রতিকারের কথা শুধু মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র কেন, সবাই ভেবেছে। অষ্টাদশ শতাব্দীর জমিদার, রাজা মহারাজা, তালুকদার সবাই ভুক্তভোগী। গুণের আদর কোথায় আছে আপনিই বলুন? আমার টোলের পণ্ডিতদের কে আদর করে? তাদের আদর করে লাভ নেই বলেই কেউ আদর করে না। তার চেয়ে সরকারি আমলা-আমির-ওমরাহদের খাতির করলে লাভ বেশি। এই দেখুন না, আমার এক প্রজা সুতোর ব্যবসা করে, তাকে নিজামতে সরকারি মাশুল দিতে হয় শতকরা কুড়ি টাকা, আর বেভারিজ সাহেব কলকাতায় সোরার কারবার করত, সে বছরে তিন হাজার টাকা এককালীন নজরানা দিয়ে লাখ লাখ টাকা মুনাফা করে, তার বেলায় কোনও বিচার নেই–

একটু থেমে মহারাজ বললেন–আপনি কিছু ভাববেন না ঘোমশাই, আপনি হয়তো সামান্য রাজা, আমি হয়তো মহারাজ, এখানে আপনাতে আমাতে কোনও প্রভেদ নেই। আমরা সবাই ভুক্তভোগী। গীতাতেও দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন করবার কথা আছে। রাজা যদি অন্যায় করে তো তারও শাস্তি দেবার বিধাম আমাদের ধর্মে আছে, সেটা অন্যায় কর্ম নয়। স্বয়ং মহাত্মা ব্যাসদেব মহাভারতে অশ্বমেধ পর্বের তৃতীয় অধ্যায়ে যুধিষ্ঠিরকে উপদেশ দিয়েছেন, মানুষ সমস্ত কর্মই ঈশ্বর প্রেরণায় করে থাকে, তাতে ব্যক্তিবিশেষের কোনও অপরাধ হয় না

নহি কশ্চিৎ স্বয়ং মর্ত্যঃ স্ববশঃ কুরুতে ক্রিয়াং।
ঈশ্বরেণ চ যুক্তোহয়ং সাধ্বসাধুচ মানবঃ
করোতি পুরুষঃ কর্ম তত্র কা পরিবেদনা ॥

কথা বলতে বলতে হঠাৎ দেউড়ির ঘণ্টা বেজে উঠল। মহারাজা উঠলেন। কাঁধের চাদরটা তুলে নিয়ে বললেন–আজকে আবার আমার আখড়ায় কুস্তি হবে, দিল্লি থেকে একজন কুস্তিগির এসেছে–পাঁজি দেখে সময়টা ঠিক করছিলুমপণ্ডিত মশাইকে আবার ডেকে পাঠিয়েছে কিনা

ছোটমশাই বললেন আমার কুস্তি দেখতে ভাল লাগে না

মহারাজ বললেন–আরে ভাল কি আমারই লাগে ছোটমশাই? কিন্তু তবু এত বড় রাজত্ব চালাতে হয়, ও গোপাল ভাঁড়কেও যেমন ঘাড়ে নিয়েছি, তেমনি রায়গুণাকরকেও ঘাড়ে নিয়েছি ইচ্ছে না। থাকলেও ঘাড়ে নিতে হয়। শুধু নিজের বউটি আর আমিটি নিয়ে থাকলে তো বনে গিয়ে বাস করলেই

কিন্তু ওদিকের কী হবে?

কোন দিকের? আপনার স্ত্রীর ব্যাপারটা?

হ্যাঁ।

সে আমার লোক আছে। আমি তো বলেছিলুম আপনাকে যে, আমার কাছে সব খবরই আসে। আপনি এসে বলবার আগেই আমার কাছে সব খবর এসে গেছে।

কে সে?

সে আপনার জেনে দরকার নেই। নবাবের ফৌজের দলে যখন সেপাই নিচ্ছিল, তখন সে-ও সেপাইয়ের দলে নাম লিখিয়ে দিয়ে ফৌজের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। তাকে কেউ চেনে না। সে একটা বাঙালি হিন্দু সেপাই, সে-ই সব খবর দেয়–

তারপর একটু থেমে বললেন–আপনি এখন বিশ্রাম করুন, আহারাদি করুন, তারপর যেমন-যেমন খবর আসে আপনাকে জানাব, আপনি সেইমতো কাজ করবেন।

ছোটমশাইও উঠে নীচে নেমে এলেন।

*

শীত বেশ আঁকালো হয়ে পড়েছে অগ্রদ্বীপে। নবাবের ছাউনিতে অনেক রাত পর্যন্ত সলাপরামর্শ চলেছে। শেষরাত্রের দিকে সবাই ঘুমোতে গেছে। উমিচাঁদ আর ওয়াটস্ দু’জন ছাড়া আর সবাই ছিল নবাবের সামনে। এতদিনের সব আয়োজন, সব আলোচনা, সমস্ত যেন ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। নিজের হাতে সে-সন্ধিতে সই করে গেছে ক্লাইভ, নিজেই আবার যেন সেই কাগজটা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে।

মিরজাফরকে দেখে বললেন–আপনিই তো এদের সঙ্গে ফয়সালা করতে বললেন আমাকে? এখন এর পরেও এদের বিশ্বাস করতে বলেন? ফরাসিরা আমার দোস্ত, তাদের সঙ্গে শত্রুতা করা মানে তো আমার সঙ্গেও শত্রুতা করা

মিরজাফর সাহেব মাথা ঠান্ডা রেখে বললে–জাঁহাপনা তো হুগলির ফৌজদার নন্দকুমারকে ডেকে পাঠিয়েছেন

শুধু নন্দকুমারকে কেন, উমিচাঁদকেও ডেকে পাঠিয়েছি। আমি নন্দকুমারকে বারবার বলেছি, ইংরেজরা যেন ফৌজ নিয়ে চন্দননগরের দিকে না যেতে পারে। তার পরেও কেন উমিচাঁদের কথায় সে কোনও বাধা দিলে না?

মিরজাফর কোনও উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইল।

তা হলে আমি যে খবর পেয়েছি, তা কি সত্যি?

 জাঁহাপনা তো মিথ্যে খবরও পেতে পারেন। ফৌজদারের তো শত্রুর অভাব নেই

 মিথ্যে খবর? মিথ্যে খবর আপনারই বারবার দিয়ে আমাকে বিভ্রান্ত করেছে। আমি আপনাদের কথা শুনেই কাফেরদের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করেছি। এখন বলুন, আমি ঠিক করেছি না ভুল করেছি

না জাঁহাপনা, আমরা এখনও বলছি, আপনি ঠিকই করেছেন। ইংরেজরা কখনও মিথ্যে কথা বলে না। তারা কখনও সন্ধি ভাঙে না। ইংরেজদের দেশে যদি কেউ মিথ্যে কথা বলে তাকে সবাই একঘরে করে দেয়, তার ছোঁওয়া পানি পর্যন্ত কেউ খায় না

নবাব বললেন–তা হলে ক্লাইভ উমিচাঁদকে চিঠি লেখেনি?

সে-চিঠি কি জাঁহাপনা দেখেছেন?

সব জিনিস দেখা যায় না। আপনাদের ক্লাইভ তত বোকা নয়, উমিচাঁদও তত বোকা নয় যে, সে চিঠি অন্য কেউ দেখতে পাবে। কিন্তু উমিচাঁদ নন্দকুমারকে গিয়ে বারো হাজার টাকা দেয়নি বলতে চান?

ইয়ার-লুৎফ খাঁ পাশ থেকে বললে–সঁহার মনে সন্দেহ জাগাবার জন্যেই এ-খবর কেউ দিয়েছে হয়তো

তা হলে বলব কে এ-খবর দিয়েছে? আপনারা শুনতে চান?

শুনলে আমরা সবাই খুশি হব জাঁহাপনা!

মরিয়ম বেগম!

.

পাশের ঘরে কথাটা নানিবেগমসাহেবার কানে গেল। মরালীর কানেও গেল। কিন্তু তার পরে আর কারও মুখ দিয়ে কোনও কথা বেরোল না। শুধু শোনা গেল, উমিচাঁদ সাহেব আর নন্দকুমার এলে সব অভিযোগ প্রমাণ হবে। ততক্ষণ পর্যন্ত অগ্রদ্বীপে থাকাই স্থির হয়ে গেল। চারদিকে হুহু করে হাওয়া দিচ্ছে। ঠান্ডায় হিম হয়ে আসে হাত-পা। কিন্তু বাংলার ইতিহাস সেই ঠান্ডায় বুঝি সেদিন হিম হয়ে থাকেনি। হলে অন্য রকম হত। সে-ইতিহাসের বুকে আগে অনেক ঝড় বয়ে গেছে। ভাস্কো-ডা-গামা যেদিন হিন্দুস্থানের উদ্দেশে পাড়ি দিয়েছিল, সেদিনও এমনি হাড় কাঁপানো শীতের হাওয়া বয়েছে। ১৫৯৯ সালে যেদিন এক অল্ডারম্যানের বাড়িতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রাণ-প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, সেদিনও এমনি হাত-পা হিম হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু হাত-পা হিম হয়ে গেলে ইতিহাসের চলে না। তাকে অনাদি অতীতকাল থেকে এগিয়ে চলতে হয় সামনের দিকে এগিয়ে চলাই তার ধর্ম। মহম্মদ বখতিয়ার খিলজিই আসুক আর সুলতান মুঘিস-উদ্দিন উজবুকই আসুক, একদিন সকলকেই যথাস্থানে ফিরে যেতে হবে। কিন্তু যে ফিরবে না, সে এই ইতিহাস। উদ্ধব দাস সেই ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে তাই লিখে গেছে এই বেগম মেরী বিশ্বাস।

রাত যখন গম্ভীর হল, তখন সামান্য একটু শব্দ হতেই মরালী বিছানা ছেড়ে উঠে পরদা ঠেলে বাইরে এল। কান্ত দাঁড়িয়ে ছিল।

মরালী বললে–সেটা পেয়েছ?

কান্ত চাদরের ভেতর থেকে বার করে একটা ছোরা মরালীর দিকে বাড়িয়ে দিলে। মরালী সেটা নিয়ে নিজের বোরখার মধ্যে পুরে ফেললে। তারপর আবার পরদা সরিয়ে ভেতরে চলে যাচ্ছিল–

কান্ত ডাকলে–শোনো।

মরালী ফিরল। বললে–কী?

কোথায় পেলুম জানো? নবাবের ঘরের গোসলখানার পথে। কেউ বোধহয় সরিয়ে রেখেছিল। তুমি যখন কাল নবাবের সঙ্গে কথা বলে উঠে এলে, তখন বোধহয় কেউ উঁকি মেরে দেখেছিল। কিন্তু আর একটু দাঁড়াও, আর-একটা জরুরি কথা আছে

মরালী দাঁড়াল! বললে–বলল, শিগগির বলল, কেউ দেখে ফেলবে

তুমি একটু সাবধানে থেকো মরালী।

আমাকে ভয় পাওয়াচ্ছ?

না, ভয় পাওয়াচ্ছি না। ওদের কথা শুনে তোমার জন্যে আমার ভয় হচ্ছে।

কেন? কারা?

তুমি তো চেনো সকলকে। নবাব তোমার নাম করাতে ওরা খুব চটে গেছে। আমি দেখলুম, ওরা তিনজনে চুপি চুপি কী সব পরামর্শ করছে। শশীর নাম শুনেছ তো? আমার বন্ধু? শশীকে খবর রাখতে বলেছিলাম। সে আমাকে বললে।

কী বললে?

ওই যে উমিচাঁদ সাহেব কাশিমবাজার যাবার পথে হুগলির ফৌজদার নন্দকুমার সাহেবের সঙ্গে কথা বলে বারো হাজার টাকা ঘুষ দেবার কথা বলেছে, ওইটে জানাজানি হওয়াতে এখন সবাই তোমার ওপর রেগে গেছে।

মরালী বললে–তা আমার ওপর রেগে কী করবে? খুন করে ফেলবে আমাকে?

 যদি তাই করে?

 তা খুন করলে না-হয় খুনই হব। আমার বেঁচে থাকায় তো কারও কোনও লাভ-লোকসান নেই

কান্ত আরও কাছে এগিয়ে গেছে। বললে–ছি, কেন ওসব কথা যে বলো তুমি বারবার। তোমার মুখে কিছু আটকায় না দেখছি

মরালী সেকথার উত্তর না দিয়ে বললে–ক্লাইভসাহেবের সঙ্গে দেখা করার পর থেকেই তো ওরা চটে গেছে, এখন না-হয় আরও একটু বেশি করেই চটল। আমি কি কারও পরোয়া করি? দেখি না কাল নন্দকুমার আর উমিচাঁদ সাহেব এসে কী জবাবদহি করে–

বলে মরালী পরদা সরিয়ে নিঃশব্দে ভেতরে চলে গেল। কান্তর উত্তর শোনবার জন্যে আর দাঁড়াল না।

*

এক-একজন মানুষ সংসারে থাকে যারা নিঃশব্দে নিজের কার্যসিদ্ধি করে যায়। তারা আড়ালে থাকতেই ভালবাসে। তারা আড়াল থেকেই সব লক্ষ করে। উচ্চাকাঙ্ক্ষা তাদের থাকে বটে, কিন্তু সে-উচ্চাকাঙ্ক্ষা অন্যের ক্ষতি করে না। সে-উচ্চাকাঙ্ক্ষা শুধুই কেবল স্বার্থসিদ্ধির জন্যে, অন্যের সর্বনাশ করবার জন্যে নয়। অন্যে যদি বড় হয় তো হোক, তার সঙ্গে আমার বড় হওয়াটা বাধা না-পেলেই আমি নিশ্চিন্ত!

অষ্টাদশ শতাব্দীর যারা শীর্ষস্থানীয় আমির ওমরাহ, তারা নিজের উন্নতি চাইত তো বটেই। কিন্তু উন্নতি তো কোনওদিন কারও চিরস্থায়ী হয়ে থাকবার জিনিস নয়। আজ বড় হলাম, কিন্তু কাল তো আবার ছোট হয়ে যেতে পারি। কাকে কখন ধরলে আমার বড় হওয়াটা অব্যাহত থাকবে সেটা যে-লোক বিচার-বিবেচনা করে চলতে পারে, সেই এ-সংসারে আজীবন বড় হয়ে থাকে।

আজ নাহয় মির্জা মহম্মদ সিরাজ-উ-দ্দৌলা বাংলা বিহার উড়িষ্যার নবাব, কিন্তু কাল নবাব না থাকতেও পারে, পতনের সঙ্গে সঙ্গে নিজের পতন যেন না হয়, তাই নজর রাখতে হয়, কে ভাবী নবাব! এখন থেকে সেই ভাবী নবাবেরও প্রিয়পাত্র হয়ে থাকি।

যে-দূরদৃষ্টি থাকলে এই বিচার খাঁটি বিচার হয়, সেই দূরদৃষ্টি সকলের ছিল না। ছিল দু’জন লোকের। প্রথম নন্দকুমার, দ্বিতীয় মুনশি নবকৃষ্ণ। অষ্টাদশ শতাব্দীর দু’জন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন পুরুষ। উদ্ধব দাস নবকৃষ্ণের কথা আগে লিখেছে। এবারে লিখছে নন্দকুমারের কথা।

হুগলির ফৌজদার নন্দকুমার। ব্রাহ্মণ বংশাবতংস। আহ্নিক করে, জপ করে, গায়ত্ৰীনা আউড়ে জল গ্রহণ করে না। কিন্তু চোখ আর মন পড়ে থাকে মুর্শিদাবাদে। রাজধানী থেকে দূরে থাকতে হয় বলে অসুবিধে যা হবার তা হয়। কিন্তু উদ্যোগী পুরুষের কাছে কোনও কাজই অসাধ্য হতে পারে না।

ফৌজদারের কাছে যারাই আসে তাকেই জিজ্ঞেস করে-মুর্শিদাবাদের খবর কী?

যারা আসে ফৌজদারের কাছে তারা জানে মুর্শিদাবাদের খবর মানে নবাবের হাঁড়ির খবর। নবাবের প্রিয়পাত্র কে,নবাব এখন কার কথায় ওঠে বসে, নবাবের মেজাজ এখন কেমন, জগৎশেঠজি এখন কার দলে, মিরজাফর সাহেবের সঙ্গে নবাবের এখন কীরকম সম্পর্ক ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক জানবার এবং জানাবার মতো কথা। কোন আমলার এখন নসিব খুলল, নবাব এখন হিন্দুদের দিকে ঝুঁকেছে, না মুসলমানদের দিকে, এইসব। মোহনলাল, মিরমদন যখন হিন্দু আর তারা যখন নবাবের নেকনজরে পড়েছে, তখন নন্দকুমারের ওপরেও একদিন নবাবের নেকনজর পড়তে পারে।

ফৌজদারের কাছে ফিরিঙ্গিরাও আসে। সোনার দেশ ছেড়ে এই মশা, মাছি, জ্বর, গরম, হিংসে, খুনখারাবি আর খোশামোদের দেশে এসে দুটো পয়সার লোভে পড়ে আছে তারা। কিন্তু শুধু কারবার করলে চলে না। কারবার করতে গেলে ট্যাক্সো দিতে হয় নিজামতে। তাই নিজামতের খবর নিতে আসে ফৌজদারের কাছে।

কেউ বলে–শুনছি, এখন নবাবের সবচেয়ে পেয়ারের লোক মরিয়ম বেগম

মরিয়ম বেগম? সে আবার কে জনাব?

একজন বললে–হাতিয়াগড়ের রাজার ছোট তরফের বউ–তারই কথায় যে নবাব ওঠে বসে—

সেকী? কী করে হল? এখন বুঝি পেশমন বেগমসাহেবের রাহুর দশা যাচ্ছে?

এসব গুজব সব সুবাতেই আস্তে আস্তে ছড়িয়ে গিয়েছিল, এককালে নবাবের ওপর ফৈজি বেগমের যে ক্ষমতা ছিল এখন নাকি মরিয়ম বেগমের সেই ক্ষমতা হয়েছে। এখন নাকি নবাব কারও সঙ্গে লড়াই করবে কি না তা নিয়ে পরামর্শ করে মরিয়ম বেগমের সঙ্গে। আবার মরিয়ম বেগমও নাকি চেহেল-সূতুনের আদবকায়দা নিয়মকানুন কিছুই মানে না। যখন খুশি তখনই হারেম থেকে বাইরে যায়।

কেউ বলে–আহা, অত কথা কী ফৌজদার সাহেব, আমি শুনেছি মরিয়ম বেগমসাহেবা নাকি আবার সুরত বদলে মর্দানার কাপড়ে পরে আন্ধেরি রাতে মুর্শিদাবাদে ঘুরে বেড়ায়–

নন্দকুমার সাহেব জিজ্ঞেস করে রাত্রে শহরে ঘুরে বেড়ায়? কেন?

কেন আবার? নবাবের দুশমনদের ধরবার জন্যে! কে নবাবের দুশমন আর কে দোস্ত তা জানতে কোশিস করে–

যারা শোনে তারা হতবাক হয় বেগমসাহেবাদের আক্কেল শুনে। বলে–ইয়ে বড়ি তাজ্জব বাত জনাব–

একজন শ্রোতা বলে-নবাবকা দোস্ত কঁহা! সবহি তো দুশমন হ্যায়।

খবরটা ওলন্দাজ কুঠিতেও যায়। চন্দননগরের ফরাসিকুঠিতেও যায়। হুগলির ইংরেজ কুঠিতেও যায়। নবাবের সঙ্গে ইংরেজদের লড়াইয়ের খবর যখন আসত তখন সেক’দিন খুব গরম হয়ে থাকত ফৌজদারের দফতর! কখন কী হয়, কখন কী হুকুম আসে, তারই জন্যে সবাই উন্মুখ হয়ে থাকত। শুধু যে ইংরেজের সঙ্গে লড়াই, তা তো নয়, কাল হয়তো ওলন্দাজের সঙ্গেও লড়াই হতে পারে, কিংবা ফরাসিদের সঙ্গেও হতে পারে। হিন্দুস্থানে কেউ বলতে পারে না কাল তার কপালে কী লেখা আছে। নবাবি-নিজামতে কাউকে বিশ্বাস করে কথা বলার নিয়ম নেই। কে কখন কোন ফাঁকে গিয়ে নিজামতে কথাটা লাগাবে, আর নিজামত থেকে ডাক আসবে সঙ্গে সঙ্গে। আর তখনই নোকরি খতম। শুধু নোকরি নয়, জানও খতম। তারপর যদি একবার মরিয়ম বেগমসাহেবার কানে যায় তো একদম ফরসা। তা ছাড়া মেহেদি নেসার সাহেব আছে, ইয়ারজান সাহেব আছে, মনসুর আলি মেহের মোহরার সাহেব আছে, এমনকী খুদে জাসুস বশির মিঞা আছে–

তারপরে একদিন খবর এল নবাবের ফৌজ ইংরেজ ফৌজের কাছে লড়াইতে হেরে গেছে। লড়াইতে হেরে গিয়ে তাবাকুফে দস্তখতও করেছে। ওয়াটস্ ফিরিঙ্গি আর উমিচাঁদ সাহেবের ওপর মুর্শিদাবাদের দরবারে যাবার হুকুমত হয়েছে। দু’জনে রওয়ানা দিয়েছে কলকাতা থেকে।

তখনও ফৌজদার সাহেব রোজ জপ করতে করতে মনে মনে বলছে–হে মা, হে কালী, হে জগদম্বা, নবাব যেন ভালয় ভালয় মুর্শিদাবাদে ফিরে যায় মা, হুগলিতে যেন না আসে  

নবাব হুগলিতে এলেই যত ঝঞ্জাট। আসবার আগে থেকে তোড়জোড়, থাকার সময় ঝামেলা, চলে যাবার পরেও ভাবনা দূর হয় না। নবাব যখন আসে তখন তো আর একলা আসে না, সঙ্গে করে ভূত-পিশাচদেরও নিয়ে আসে। নবাবের চেয়ে ভূত-পিশাচরাই নবাবিআনায় বেশি দড়। তাদের খাই মেটানোই বেশি শক্ত। কোথায় মদ, কোথায় মেয়েমানুষ, কোথায় টাকা, কোথায় কী, সব জুগিয়েও সুনাম পাওয়ার আশা নেই। নবাবের ভূত-পিশাচদের খুশি করতে করতেই ফৌজদারদের প্রাণান্ত!

শেষকালে হঠাৎ কলকাতা থেকে নবাবের কাছারির একটা খত্ এল।

নবাব লিখে পাঠিয়েছে ইংরাজেরা আমার সন্ধি অগ্রাহ্য করিয়া মদীয় দোস্ত চন্দননগরে ফরাসিদের নগরী ও কেল্লা দখল করিতে অগ্রসর হইলে হুগলির ফৌজদারসাহেব জনাব নন্দকুমারের উপর ফৌজ লইয়া বাধাপ্রধান করিবার হুকুম হইল। ইহার অন্যথা না হয়।

চিঠিটা পড়ে ফৌজদার প্রথমে হতবাক হয়ে গেল। আবার যুদ্ধ! আবার লড়াই। খবরটা প্রথমে চাপাই ছিল। ফৌজদার সাহেব বার দুই চিঠিটা পড়লে। তারপর লোকটার দিকে চেয়ে দেখলে।

বললে–টাকা? টাকা কই?

কীসের টাকা?

কেন, লাখ টাকার কথা লেখা রয়েছে যে!

চিঠির সঙ্গে আর একটা চিঠি। সে চিঠিতে লেখা আছে–এই পত্রবাহকের হাতে এক লাখ টাকা পাঠাইলাম। এই টাকা ফরাসি সরকারকে দিবে। তাহাদের নিকট হইতে নবাব সরকার দুই লাখ টাকা লইয়াছিল। এই টাকার সাহায্যে তাহারা ইংরাজকে শায়েস্তা করুক, ইহাই আমি চাহি।

এই থলেটার ভেতর কী আছে জানি না হুজুর, এইটেও আপনাকেও দেবার হুকুম হয়েছে।

ফৌজদার সাহেব থলিটা নিয়ে মুখের বাঁধনটা খুলে ফেললে। বেটা বদমায়েস লোক। টাকাটা বাজেয়াপ্ত করতে চেয়েছিল। তারপর টাকাটা নিজের সিন্দুকের মধ্যে পুরে বললে–যা, এখন যা–

একটা চিঠি দেবেন না, হুজুর?

 আবার কীসের চিঠি?

চিঠি পেলেন, টাকা পেলেন, তার রসিদ দেবেন না?

লোকটা হুঁশিয়ার বটে। বললে–যা, আমার দফতরে, রসিদ দেবে আমার খাস মুনশি

ফৌজদারের দফতরও বড় দফতর। হুগলির ফৌজদারের মাইনেও কম নয়। সামান্য ব্রাহ্মণসন্তানের পক্ষে বাৎসরিক তিন লাখ টাকার চাকরি বড় ছোট চাকরি নয়। কিন্তু তবু টাকাকে তো বিশ্বাস নেই, টাকা আজ আছে, কাল নেই। তা ছাড়া নবাবের চাকরির কোনও ঠিকঠিকানাও নেই। অনেক তদবির করে চাকরিটা পাকা করে নিয়েছে ফৌজদার সাহেব। কিন্তু দিনকাল যা পড়েছে তাতে কোন দিন কে এসে লাথি মেরে তাড়িয়ে দেবে গদি থেকে। বলবে–ভাগো

তারপর আবার ছোকরা নবাব। মেয়েমানুষের কথায় ওঠে বসে। ওদের কাছে চাকরি করাও যা, ওদের মুখের থুতু খাওয়াও তাই। সবসময়ে মুর্শিদাবাদের নিজামতের দিকে হা করে থাকতে হয়।

কিন্তু দুদিন যেতে না যেতেই হঠাৎ একদিন উমিচাঁদ সাহেব এসে হাজির। দেখে ফৌজদার সাহেবের একেবারে একগাল হাসি।

আপনি?

উমিচাঁদ সাহেব কিন্তু হাসল না। বললে–আশেপাশে কেউ নেই তো? থাকলে এখন ঘরে ঢুকতে বারণ করে দিন–গোটাকতক জরুরি কথা আছে। কিছু টাকা মবলক উপায় করতে চান?

টাকা! বলে কি পাঞ্জাবিটা! টাকা আবার সংসারে কে না উপায় করতে চায়! টাকাই তো কলিযুগের মোক্ষ, উমিচাঁদ সাহেব! নবাবি আমলে আমাদের হরিনাম টুরিনাম তো সব ফকিকারি, টাকাই তো একমাত্র সত্য।

কিন্তু হঠাৎ আপনার কাছ থেকে টাকা নিতে যাবই বা কেন? আমি কী এমন পুণ্য করেছি? আমি তো মন্তর-দেওয়া বামুন নয়।

বলি, কলকাতার কিছু খবর রাখেন? কলকাতার হালচালের?

নন্দকুমার বললে–কলকাতার খবর না রাখলে কি আর ফৌজদারি চালাতে পারি? শুনছি তো এখন আর নবাবের আমল নয়, এখন মরিয়ম বেগমের আমল। শেষকালে নাকি আলিবর্দি খাঁ’র সনদ চালাচ্ছে একজন মেয়েমানুষ!

উমিচাঁদ সাহেব বললে–আরে ওই ত। মেহেদি নেসারটার কাণ্ড! লোকটা নিজে ম তাল, নবাবের সঙ্গে অত দহরমমহরম, কিন্তু আখেরের কাজ গুছিয়েই নিতে পারলে না। কোথা থেকে কোন হাতিয়াগড়ের বউটাকে এনে হারেমে পুরে দিয়েছিল, সে মাগিও তেমনি জাঁহাবাজ, এখন েেহদি নেসারের পেছনে কাঠি দিচ্ছে।

কী রকম?

আর কী রকম! আমাদের আর পাত্তাই দিতে চায় না নবাব। সকলকে বাতিল করে দিতে শুরু করেছে। ওর দাদামশাই বুড়ো নবাব আমাকে বিশ্বাস করত, আমাকে বিশ্বাস করে মনের কথা বলত, এবার দেখি একেবারে উলটো! আমাকে মানতেই চায় না। আমরা কারবার করে খাই। আমাকে বলে কিনা, আমি নবাবকে খুন করবার মতলব করেছি। বলে কিনা, আমার হাতের লেখা চিঠি পেয়েছে সফিউল্লার কাছে। সফিউল্লা সাহেব খুন হয়ে গেছে, শুনেছেন তো?

তাই তো শুনলুম!

ওই মরিয়ম বেগমই তাকে খুন করে সাবাড় করে দিলে। আমি খুন করলে আমার তো গর্দান চলে যেত, আর মরিয়ম বেগমের বেলায় উলটো হল। একেবারে নবাবের নেকনজর পেয়ে গেল। নেকনজর পেয়ে এখন আমাদের ওপর চোখ রাঙায় আবার!

দেখতে খুব উমদা নাকি?

আরে টাকার চেয়ে তো আর দুনিয়ায় উমদা চিজ কিছু নেই, তবে? নাকি কিছু অন্যায় কথা বলেছি আমি, বলুন?

তা তো বটেই!

উমিচাঁদ সাহেব বললে–সেই জন্যেই তো আপনার কাছে এলাম ফৌজদারসাহেব, আপনি নবাবের কাছ থেকে কিছু নির্দেশ পেয়েছেন?

পেয়েছি!

 তাই বলুন! আমাকে ক্লাইভসাহেব লিখেছে যে! ক্লাইভসাহেবকে চেনেন তো?

 খুব চিনি।

উমিচাঁদ সাহেব বললে–তা হলে একটা কাজ করতে হবে দাদা, আপনিই করতে পারেন, আপনি ছাড়া আর কারও করবার ক্ষমতা নেই! টাকা যা চান তা দেওয়া যাবে।

টাকা! নন্দকুমার সাহেবের মুখ দিয়ে ফস করে কথাটা বেরিয়ে গেল। কে টাকা দেবে?

কেন, ফিরিঙ্গি কোম্পানি দেবে!

 কত টাকা দেবে?

যা চান আপনি!

ফৌজদার সাহেব বললে–কী করতে হবে আমাকে?

আপনাকে এমন কিছু কঠিন কাজ করতে হবে না। ইংরেজরা ফৌজ নিয়ে চন্দননগর দখল করতে যাবে, আপনি মোট কথা বাধা দেবেন না, ফৌজ দিয়েও বাধা দেবেন না

ফৌজদার সাহেব কথাটা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল।

উমিচাঁদ সাহেব বললে–আরে মশাই, এতে ভাবার কিছু নেই। এমন হাতিঘোড়া কাজ কিছু নয়। এটা, আসলে তো আপনার নবাবও যা, ও ক্লাইভসাহেবও তাই।

সে কী রকম?

উমিচাঁদ সাহেব বললে–আরে মশাই, চারদিকের হালচাল দেখছেন না? ওদিক থেকে পাঠান

আহমদ শা আবদালি তো এসে পড়ল বলে। এই তো এবার কলকাতা থেকে ফিরেই নবাবকে যেতে হবে আজিমাবাদের দিকে, শুনেছেন তো?

শুনেছি, পথে পাঠানদের আটকাবার জন্যে।

আটকাতে কি পারবে নাকি ভেবেছেন? এই ধরুন আপনিই যদি ফৌজ নিয়ে যান তো আপনিই কি লড়াই করতে পারবেন মন খুলে? বলুন না, পারবেন? আপনার দফতরের লোকেরা, আপনার ফৌজের সেপাইরা নিয়ম করে মাইনে পায়? আপনিই কি মাইনেফাইনে পান মাসের পয়লা তারিখে?

নন্দকুমার বললেন–অনেক লিখে লিখে তবে আদায় হয়–

আদায় হয় শেষপর্যন্ত?

ওই ন’মাসে মাসে আসে কোনওরকমে। তা-ও মাইনে বাড়াবার জন্যে তাগিদ দিচ্ছি মশাই, তারও কোনও জবাব নেই। জিনিসপত্তরের দাম বাড়ছে

আপনার মাইনে?

নন্দকুমার বললেন–নিয়ম করে মাইনে পেলে আর কী ভাবনা, উমিচাঁদসাহেব! তা পেলে তো পায়ের ওপর পা দিয়ে…

উমিচাঁদ সাহেব বললে–তা আমি জানি। ও দেখবেন, এনবাবি টিকবে না আর। যে ক’টা দিন আছেন, কাজ গুছিয়ে নিন, আখেরের কাজ গুছিয়ে নিন–নইলে পরে পস্তাতে হবে! তাই তো বলছিলাম, বড় গাছে নৌকো বাঁধুন। এরা সব বনেদি মানুষ, এই ইংরেজরা। এদের কারবারের। কায়দাকানুনই আলাদা। আমিও তো কারবার করি, আর ও-বেটাদের কারবারও দেখছি। কথার খেলাপ করে না মশাই, যার যা পাওনা-গণ্ডা, তাকে তা আগে মিটিয়ে দিলে তবে ওদের ভাত হজম হয়। আমিও তো কারবার করি তাদের সঙ্গে, আমার একটা কড়াক্রান্তির হিসেব পর্যন্ত না মিটিয়ে দিলে ওদের ঘুম হয় না, তা জানেন?

তা কী করতে হবে আমাকে, বলুন?

ওই যে আপনাকে বললুম! ক্লাইভসাহেবের সঙ্গে আমার কথা হয়ে গেছে সব। আপনি যত টাকা চাইবেন ও-বেটারা দেবে! দু’হাজার চান দু’হাজার, চার হাজার চান চার হাজার! ও-বেটাদের মশাই হকের টাকা, কিছু দুয়ে নিন না–

তা কত নিই বলুন তো ঠিক ঠিক?

যা আপনার খুশি!

পাঁচ হাজার চাইলে দেবে?

তা দেবে না কেন, পাঁচ হাজার চাইলে পাঁচ হাজারই দেবে!

নন্দকুমার বললে–তা হলে ছ’হাজারই চাই, কী বলেন!

তা চান!

নন্দকুমার বললে–দাঁড়ান, ছ’হাজারই বা কেন, যখন মাগনা পাওয়া যাচ্ছে, তখন আট হাজারই চাই। আট হাজারই হলেই আমার ভাল হত। আমার তো অনেক ঝুঁকি–

উমিচাঁদ বললে–ঝুঁকির কথা যদি বলেন তো আট কেন, দশ হাজারই চান না পুরোপুরি।

 নন্দকুমার আর পারলে না। বললে–দাঁড়ান, আমি একবার ঠাকুরঘর থেকে আসি

ঠাকুরঘর?

আজ্ঞে হ্যাঁ, ঠাকুরকে জিজ্ঞেস না করে আমি কিছু করিনে কিনা, বড় জাগ্রত ঠাকুর আমার–কালী মূর্তি

বলে চলে গেল ভেতরে। আর তার একটু পরেই হাসতে হাসতে বাইরে এল।

বললে–কিন্তু উমিচাঁদসাহেব, ঠাকুর বলছেন–তুই বারো হাজার টাকা নে–

উমিচাঁদ বললে–আপনার ঠাকুর নিজের মুখে বলেছে? তা হলে বারো হাজারের এক দামড়ি কম নেবেন না–বারো হাজারই নিয়ে নিন

দেবে তো?

 নিশ্চয়ই দেবে। আপনি টাকা না দিলে কাজ করবেন না। মিছিমিছি কাজ করতে যাবেন কেন? কাচ্চাবাচ্চা নিয়ে আমরা ঘর করি, টাকা না পেলে কাজ করব কেন? আপনি এক কাজ করুন। আপনি আমার কথার ওপর বিশ্বাস করবেন না। আমি সোজাসুজি লোক পাঠাচ্ছি ক্লাইভসাহেবের কাছে। ক্লাইভসাহেব যদি উত্তরে লিখে পাঠায় গোলাপ ফুল’তা হলে বুঝে নেবেন সাহেব আপনার কথায় রাজি, আর যদি কিছু উত্তর না আসে বুঝতে হবে গররাজি

আমাকে তা হলে কী করতে হবে?

আপনাকে কিছুই করতে হবে না। ফরাসিদের কাছে নবাবের দেওয়া টাকাটা পাঠাতেও হবে না, ইংরেজরা যখন চন্দননগর হামলা করতে যাবে তখন শুধু আপনি আপনার ফৌজ নিয়ে হুগলিতে ঠুটো জগন্নাথ হয়ে বসে থাকবেন, বুঝলেন? তা হলে আমি চলি?

উমিচাঁদ সাহেব চলে গেল।

বারো হাজার টাকা! বারো হাজার টাকা মবলক পাওয়া গেল। ঘরের মধ্যে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল নন্দকুমার ফৌজদার সাহেব। ব্রাহ্মণ বংশে জন্মে এমন চাকরি হবে, এত টাকা হবে, বাপ-মা কি ভাবতে পেরেছিল! হঠাৎ বাইরে আবার ঘোড়ার খুরের শব্দ হল। এই ঘোড়ার খুরের শব্দটাকেই ফৌজদার সাহেবের যত ভয়। কখন হঠাৎ ডাক আসে মুর্শিদাবাদের দরবারে, কখন উজির-এ-আজম আসে, সেই ভয়েই ওষ্ঠাগত হতে হয়। নইলে বেশ চাকরি। তখত-এ-তাউসে বসে ঘুমোলেও কেউ কিছু বলবার নেই। বেশ চায়েন, বেশ আরাম।

হুজুর! কৌন? ফিরিঙ্গি কোঠি থেকে হরকরা এসেছে। দিশি হরকরা। কুর্তা-কামিজ পরা। এসেই ফৌজদার সাহেবকে মাটি পর্যন্ত মাথা নিচু করে সেলাম করলে। তারপর একটা লেফাফা এগিয়ে দিলে। দিয়ে আবার চলে গেল কুর্নিশ করে। হুকুমবরদারও চলে গেল।

ফাঁকা ঘরের মধ্যে নন্দকুমার লেফাফাখানার মুখ ছিঁড়ে ফেললে। ভেতরে একটা সাদা কাগজ শুধু। তার ওপর ফারসিতে বড় বড় হরফে লেখা–গুলাব কে ফুল।

কে লিখছে, কেন লিখছে, কোথা থেকে লিখছে, কিছুই লেখা নেই তাতে। না থাক, ফৌজদার সাহেব লেফাফাখানা নিয়ে মাথায় ঠেকালে। জয় মা কালী, জয় মা জগদম্বা, ভাগ্যিস তুমি বুদ্ধি দিয়েছিলে। নইলে তো চার হাজার টাকা লোকসান হয়ে যেত! জয় মা বগলামুখি, আজ তোমায় সোনার রেকাবিতে সিন্নি চড়াব। হিরের চামর দিয়ে তোমায় বাতাস করব, গঙ্গাজলের বদলে আজ খাঁটি গোরুর দুধ দিয়ে তোমার চরণামৃত বানিয়ে দেব! জয়, জয় করালবদনি। জয় হোক তোমার

*

অনেক কাজের ভিড়ে যেন শান্তি ছিল না ক্লাইভ সাহেবের। শুধু নবাবের ভাবনাই নয়। সেই আর্কট থেকে যে ভাবনার শুরু হয়েছে, সেই ভাবনাটাই বেড়ে বেড়ে এখন যেন সমস্ত মানুষটাকেই গ্রাস করেছে। এমনি মাঝে মাঝে হয় ক্লাইভ সাহেবের। মনে হয় কোথাও গিয়ে একটু বিশ্রাম নিলে ভাল হত। কিন্তু কে দেবে রেস্ট? কে আছে এখানে ক্লাইভ সাহেবের? নিজের পার্সোনাল আর্দালি ছিল একটা, হরিচরণ, তাকেও দিয়ে দিয়েছে ওদের কাছে।

অনেকদিন আগে মাদ্রাজে থাকার সময় এইরকম হয়েছিল। মনটা কেবল নিজের হোমে ফিরে যেতে চাইত। এই ব্যথাটা যখন হত তখনই বাড়ির কথা মনে পড়ত।

বাইরের দিকে চেয়ে দেখলে ক্লাইভ সাহেব। ফৌজ রেডি রয়েছে। তারও ওদিকে নবাবের সেপাইরা তাঞ্জামটা নিয়ে চলে যাচ্ছে। একটা পেটি বেগম, তারও তেজ কত! এতগুলো বেগম একজন নবাবকে কী করে ভালবাসতে পারে! ইন্ডিয়াতে না এলে এটাও তো দেখা হত না। সবাই বলেছে ওরা নাকি স্লেভস। হরিচরণকে জিজ্ঞেসও করেছে কতবার।

হরিচরণ বলেছে–আজ্ঞে হুজুর, আমি তো কখনও বেগমদের দেখিনি-ওরা সব বাঁদির মতন

বাঁদি মানে?

বাঁদি মানে চাকরানি, হুজুর। হারেমের বাইরে বেরোতে পারে না বেগমসাহেবারা।

কারও সঙ্গে কথা বলতে পারে না?

না হুজুর, বাইরে বেরোলে বোরখা পরতে হয়।

তা হলে কোনও পুরুষমানুষ নেই সেখানে?

না হুজুর, শুধু খোজারা আছে

সাহেব বুঝেছিল ইউনাক! স্ট্রেঞ্জ! স্ট্রেঞ্জ এই ইন্ডিয়া আর স্ট্রেঞ্জ এই ইন্ডিয়ার নবাব। বহুদিন পরে বাবাকে একটা চিঠি লিখেছিল রবার্ট। সেই তার ওয়ার্থলেস ছেলে রবার্ট! লিখেছিল–এখানে সবই অদ্ভুত বাবা। এখানকার নবাব অনেকগুলো বিয়ে করে। একটা অ্যাপার্টমেন্ট থাকে, তাকে ওরা বলে জেনানা হারেম। সেখানে এরা এদের মিস্ট্রেসদের পুরে রাখে। এখানে পলিগেমি খুব চলছে। একটা লোক এখানে একশো-দুশো ওয়াইফ রাখতে পারে! কেউ নিন্দে করে না সে-জন্যে। মেয়েদের এরা স্লেভ করে রাখে। কিন্তু আজ একটা বেগমের সঙ্গে দেখা হল, দেখলাম, সে ইনটেলিজেন্ট। আমার ধারণা ছিল, যারা অনেক বিয়ে করে, তাদের ওয়াইফরা তাদের হেট করে। তা নয়। এ-বেগমটা তার হাজব্যান্ডকে বেশ রেসপেক্ট করে দেখলাম। খুব ভাল মেয়ে বলে মনে হল। ইন্ডিয়ান মেয়েদের সম্বন্ধে ক্রমেই আমার ধারণা বদলে যাচ্ছে। যে-হিন্দু বউটাকে আমার এখানে শেলটার দিয়েছি, সে-ও খুব রেসপেক্টেবল লেডি। কিন্তু আশ্চর্য, তার বিয়ে হয়েছিল একজন পোয়েটের সঙ্গে। পোয়েটটা খুব ভাল লোক। বেশ ব্রড আউটলুক। সে মানুষকেই গড মনে করে পুজো করে। তার কাছে মানুষই গড। তার কাছে বেশ নতুন লাইট পেলাম। কয়েকদিন আগে সিলেক্ট কমিটির কাছে খবর এসেছিল যে, ফ্রান্সের সঙ্গে আমাদের ওয়ার বেধে গেছে। আমার ওপর কাউন্সিলের অর্ডার হয়েছে, এখানকার ফ্রেঞ্চ টেরিটোরি চন্দননগর অ্যাটাক করবার জন্যে। আমি তাই নিয়ে খুব ব্যস্ত আছি। আমি বেঙ্গলের মিলিটারি অ্যাফেয়ার্সটা সেটেল করতে পারলেই আর একবার ওখানে যাব। ভাই-বোন আর মা’কে আমার ভালবাসা দিয়ো। তুমি আমার বেস্ট রিগার্ডস নিয়ো–আই অ্যাম ইয়োরস

চিঠিটা শেষ করে ক্লাইভ চিঠির মুখটা বন্ধ করতে যাচ্ছিল। তাড়াতাড়ি চিঠিটা হোমের ডাকে না দিলে আবার যাবে না। আর এই জাহাজে যদি না যায় তো আবার কবে যাবে, তার কোনও ঠিক নেই। এই চিঠিটাই পৌঁছোতে সাত মাসও লাগতে পারে, আট মাসও লাগতে পারে–

তুমি আছ নাকি সাহেব?

হ্যাঁ দিদি, কী হল?

দুর্গা বাইরে থেকে ভেতরে ঢুকল–তুমি তো বাবা আমাদের বলোনি, হরিচরণ বললে, তাই জানতে পারলুম!

কার কথা বলছ দিদি? আমি তো ঠিক বুঝতে পারছি না?

তোমরা নাকি লড়াই করতে যাচ্ছ আবার! তা হলে আমরা কোথায় থাকব?

কেন দিদি, তোমরা এখানেই থাকবে! তোমাদের সমস্ত ব্যবস্থা তো আমি করে দিচ্ছি।

তা তুমি থাকবে না এখানে, তা হলে আমরা কী করে থাকব? কার ভরসায় থাকব?

ক্লাইভ বললে–বাঃ, আমি কি বরাবরের মতো চলে যাচ্ছি? তোমাদের পাহারা দেবার জন্যে আমি তো তোক রেখে যাচ্ছি–

তা নবাবের সঙ্গে তোমাদের লড়াই যখন মিটে গেছে, এবার আমাদের বাড়ি পাঠিয়ে দাও না বাবা, আর কদ্দিন এরকম করে ছন্নছাড়া হয়ে থাকি? আমাদের বাড়ি পাঠাবার একটা ব্যবস্থা করে দাও না আমরা যে আর পারিনে বাবা

ক্লাইভ বললে–তোমাদের কষ্ট যে হচ্ছে, তা কি আর বুঝতে পারছি না? কিন্তু নবাবের সঙ্গে মিটমাট হয়েছে, কে বললে–তোমায়? নবাব এখনও যে আমার পেছনে লেগে রয়েছে। এই দেখো না, আমাদের সঙ্গে নবাবের যে কথা হয়েছে, সেকথার আবার খেলাপ করতে চাইছে।

তা তোমরা এত সব বড় বড় বীর রয়েছ, নবাবকে মেরে ফেলতে পারছ না? অমন হতচ্ছাড়া নবাব থেকে লাভটা কীসের? বউ-ঝি যে-দেশে ঘরে নিশ্চিন্তে থাকতে পারবে না, সে-দেশের নবাবের মুখে ঝাটা মারি।

দাঁড়াও না দিদি, আর দুটো দিন সবুর করো, তোমাদের নিশ্চিন্তে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে তবে আমি দেশ ছেড়ে যাব!

দেশ ছেড়ে যাবে মানে!

ক্লাইভ হাসতে লাগল বা রে, আমার নিজেরই বুঝি ঘরবাড়ি নেই? আমার নিজের বুঝি বাপ-মা’কে দেখতে ইচ্ছে করে না? আমার বউ ছেলেমেয়ে বুঝি নেই ভেবেছ?

ওমা, তাই নাকি? তোমার মা বেঁচে আছে?

কেন, বেঁচে থাকবে না কেন? আমি এখানে এসে যুদ্ধ করে বেড়াই বলে আমার বাবা-মা থাকবে না?

দুর্গা কপালে হাত দিলে।

ও আমার কপাল! তবে যে হরিচরণ বললে, তোমার মা মারা গেছে বলে তুমি নাকি আড়ালে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদো?

হরিচরণ বলেছে তোমাদের ওই কথা? আরে, আমার মা বেঁচে আছে কি না, তা আমার আর্ডালি জানবে কী করে?

বলে ডাকতে লাগল আর্ডালি, আর্ডালি—

দুর্গা বললে–না বাবা, ওকে আর তুমি বোকো না। ও হয়তো বুঝতে পারেনি। কী বুঝতে কী বুঝে ফেলেছে। যাক গে, শুনে মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল বাবা। সত্যিই তো, তুমি এমন ভাল লোক, তোমার মা কেন মারা যাবে। আহা, তোমার মা বেঁচেবর্তে থাক। আশীর্বাদ করি, এবার যুদ্ধটুদ্ধ ছেড়ে দেশে ফিরে গিয়ে মায়ের কোল-জোড়া হয়ে থাকো। যাই বলো, তোমাদের চাকরি কিন্তু বড় বিচ্ছিরি চাকরি বাবা। এমন চাকরি আর কক্ষনও নিয়ো না। তোমার ছেলেমেয়ে বউ–তাদের ছেড়ে বা আছ কী করে বাবা এই এত দূরে? তাদের জন্যে তোমার মন কেমন করে না?

ক্লাইভ সেই রকমই হাসতে লাগল।

বললে–মন কেমন করলে কি চলে দিদি? তোমাদের দেশের মতো আমাদের দেশে এমন আরাম তো নেই। সে ঠান্ডার দেশ, তোমাদের দেশ থেকে মালমশলা গেলে তবে আমরা খেতে পাই, তা জানো? বউ-ছেলেমেয়ে-পরিবার ছেড়ে না-এলে চলবে কেন? দেশের লোক খাবে কী?

দুর্গা বললে–তা ভাল, তুমি কাজকম্ম তো যথেষ্ট করলে, এখন আমাদের একটা হিল্লে করে দিয়ে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাও, বাপ-মা’র প্রাণটা জুড়োক

তা তোমাদের ভাবতে হবে না দিদি, আমি যেখানেই যাই না কেন, তোমাদের একটা ব্যবস্থা করে দেবই–

কিন্তু তুমি চলে গেলে যদি আবার সেই পাগলা বাউন্ডুলেটা আসে?

কে? সেই পোয়েট?

পোয়েট ফোয়েট বুঝিনে বাবা, তাকে এখানে ঢুকতে দিলে আমি একশা কাণ্ড করে বসব, তা বলে রাখছি।

হঠাৎ বাইরে থেকে একজন সেপাই একটা চিঠি নিয়ে এল। ক্লাইভ সাহেবের মুখখানা কেমন যেন গম্ভীর হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে।

বললে–তুমি একটু বসো দিদি, আমি আসছি—

বলে বাইরে বারান্দায় এসে খামটা খুলে চিঠিটা পড়তে লাগল। দিয়েছে হুগলি থেকে উমিচাঁদ।

লিখেছে–সাহেব, আমি তোমার কথামতো হুগলির ফৌজদার নন্দকুমারের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি। লোকটা বামুন হলে কী হবে, এক নম্বরের ফেরেব্বাজ। টাকার জন্যে লোকটা সব করতে পারে। আমি তাকে টাকার লোভ দেখাব, যাতে তোমাদের বিরুদ্ধে ফৌজ না পাঠায়। তোমরা চন্দননগরে হামলা করলেও সে চুপ করে থাকবে হাত-পা গুটিয়ে, এই শর্তে তাকে আমি দশ-বারো হাজার টাকা ঘুষ দেবার কথা বলব। তুমি এই লোকের মারফত শুধু একটা কথা লিখে নন্দকুমারের কাছে পাঠিয়ে দাও–’গুলাব কে ফুল’। আমি যেই ফৌজদারের দফতর থেকে বেরিয়ে আসব, তখনই যেন সে সেই চিঠিটা নিয়ে গিয়ে ফৌজদারকে দেয়। তোমার যে টাকা দেবার অমত নেই, সেইটেই কথাটার মানে, তা । আমি তাকে বুঝিয়ে বলব। চিঠিটা খুব সাবধানে নিয়ে যেতে বলবে সাহেব। চারদিকে নবাবের চর পিলপিল করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি আর ওয়াটসাহেব মুর্শিদাবাদ যাচ্ছি। নবাব এখন অগ্রদ্বীপেছাউনি করেছে। এই সঙ্গে আর-একটা কথা তোমাকে জানিয়ে রাখি–নবাবের এক বেগম মুর্শিদাবাদ থেকে এসেছে। সঙ্গে নানিবেগমসাহেবা আছে। নবাবের দিদিমা। বড় জাহাবাজ মেয়েমানুষ ওই মরিয়ম বেগমসাহেবা। আমাদের সব খবরদারি করবার জন্যে চর লাগিয়েছে। আমাদের ইয়ার সফিউল্লা সাহেবকে ওই মাগিটাই খুন করেছে। খুব সাবধান। ও-মাগিটার কাছে পেট কাপড়ে সব সময় ছোরা থাকে। বলা যায় না, ওই বেগম হয়তো অন্য কোনও ছুত করে তোমাদের বাগানেও যেতে পারে। মেয়েমানুষ বলে যেন রূপ দেখে গলে যেয়ো না। তোমার তো আবার মেয়েমানুষের ওপর দুর্বলতা আছে। ও মাগি সব পারে খুব সাবধান। এদিকে আমার দ্বারা তোমাদের যা উপকার করা সম্ভব, তা করছি। ভবিষ্যতেও আরও করব। আশা করি, আমার কথা তোমরা ভুলে যাবেনা। সুদিন এলে আমাকে নিশ্চয়ই তোমরা মনে রাখবে আশা করি।

নীচেয় কারও নাম নেই। না থাক, বুঝতে কষ্ট হয় না উমিচাঁদের লেখা

একখানা কাগজে ক্লাইভ লিখলে–গুলাব-কেফুল। তারপরে খামের মুখটা আঠা দিয়ে এঁটে সেপাইটার হাতে দিয়ে বললে–এই নাও–সোজা হুগলির ফৌজদার সাহেবের বাড়ি দিয়ে আসবে, কিছু বলতে হবে না

দুর্গা সাহেবের মুখখানার দিকে চেয়ে অবাক হয়ে গেল। এই এতক্ষণ বেশ হেসে হেসে কথা বলছিল তার সঙ্গে, আর এখনই মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল কেন?

হ্যাঁ বাবা, একটা কথা বলব?

 কী দিদি, বলো?

তোমার মুখটা মাঝে মাঝে অমন গম্ভীর হয়ে যায় কেন বলো দিকিনি বাবা! বেশ হাসিখুশি আছ, আর হঠাৎ কী হয়? কার কথা ভাবো?

ক্লাইভ বললে–কিছু মনে কোরো না দিদি, আমার একটা রোগ আছে—

রোগ? সেকী?

হ্যাঁ দিদি, রোগ! ওই একটাই আমার রোগ। আমার নার্ভ মাঝে মাঝে অসাড় হয়ে যায়, তখন কিছু ভাল লাগে না। মাঝে মাঝে আমার এত ব্যথা হয় যে, আমি অজ্ঞান হয়ে যাই

দুর্গা বললে–অজ্ঞান হয়ে যাও?

হ্যাঁ দিদি, অজ্ঞান হয়ে যাই, ছোটবেলা থেকে রোগটা আমার আছে, এই রোগের যন্ত্রণায় এক-একবার আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করে, ভীষণ ব্যথা হয়

আহা গো, তা কবিরাজ দেখাও না কেন? হাকিম দেখালেও তো পারো! রোগ পুষে রাখা তত ভাল নয় বাছা, বিদেশ-বিভূঁইয়ে এসে শেষে কি বেঘোরে প্রাণটা দেবে?

ক্লাইভ বললে–আমার নিজেরও তাই ভয় হয় মাঝে মাঝে

তবে বাবা তুমি একটু শুয়ে পড়ো, আমি যাই, একটু গড়িয়ে নাও। খাওয়াদাওয়ার সময়ের ঠিক নেই, ঘুমেরও ঠিক নেই, পিত্তি তো পড়বেই! এক কাজ করতে পারো না, ভোরবেলা উঠে খালিপেটে ছোলা ভিজোনো জল খেতে পারো না? ও পিত্তির ব্যথা, আমারও আগে হত, এখন সেরে গেছে

ক্লাইভ সাহেব কিছু উত্তর দিলে না দেখে দুর্গা ভেতর দিকে চলে গেল। বললে–আমি চললুম, তুমি একটু গড়িয়ে নাও

হায় রে, গড়িয়ে নিলেই যেন চলবে! খবরটা অ্যাডমিরাল ওয়াটসনকে দিতে হবে। দুর্গা চলে যেতেই বাইরের পাহারাদারকে ডাকলে–আর্ডালি

অগ্রদ্বীপে নবাবের ছাউনির ভেতরে সমস্ত আবহাওয়া যেন তখন থমথম করছে। কাল রাত থেকেই নবাব খুব মেজাজ গরম করেছে। মিরবকশি থেকে শুরু করে ছোটখাটো চৌকিদারটা পর্যন্ত ভয়ে তটস্থ হয়ে আছে। উমিচাঁদ সাহেব আর হুগলির ফৌজদার নন্দকুমার সাহেবকে জরুরি তলব দিতে ডেকে পাঠানো হয়েছে।

.

পাশের ছাউনি থেকে হঠাৎ মরিয়ম বেগমসাহেবার ডাক এল কান্তর কাছে।

মরিয়ম বেগমসাহেবা কান্তবাবুকে এত্তেলা দিয়েছে।

 যাচ্ছি–

বলে কান্ত পাশের কামরায় গেল। কামরার পরদা তুলে দেখলে মরালীর একেবারে অন্য চেহারা। একখানা লাল ওড়নি মাথায় ঢেকে দাঁড়িয়ে আছে।

আমাকে আবার এসময়ে ডাকলে কেন? নবাব খুব বের হয়ে রয়েছে; যদি জানতে পারে?

মরালী বললে–একটা জরুরি কথা, পরদার ফাঁক দিয়ে দেখছিলাম কদিন ধরে একটা লোকের সঙ্গে ফিসফিস করে কথা বলছ, ও লোকটা কে?

রোগা লম্বা মতন ছেলেটা? ওরই নাম তো শশী। ওর কথাই তো তোমাকে লিখেছিলুম।

 ওর সঙ্গে তোমার কীসের এত কথা?

কান্ত মরালীর মুখের দিকে চেয়ে যেন ভয় পেয়ে গেল।

ও কেবল জিজ্ঞেস করে ভেতরের খবরাখবর।

কীসের খবর?

কান্ত বললে–এই যুদ্ধ বন্ধ হলে ওর চাকরি চলে যাবে ফৌজ থেকে, তাই খুব ভয় ওর। ও জানতে চায় যুদ্ধ হবে কি হবে না–ছেলেটা ভাল, খুব নিরীহ গোবেচারি মানুষ!

মরালী গম্ভীর গলায় বললে–তা হোক, ওর সঙ্গে এত কথা বলতে হবে না, ও-লোকটা ভাল নয়।

না না, আমি বলছি, খারাপ লোক নয় তেমন!

তা যোক ভাল লোক, তবু ওর সঙ্গে কথা বোলো না। ও কারও চর নিশ্চয়ই

বা রে, তুমি কী করে জানলে? 

আমি যা বলছি শোনো, ওর সঙ্গে এত কথা বলতে হবে না, আমি গোঁফ দেখলে লোক চিনতে পারি, ও নিশ্চয়ই কারও চর, ওর ছায়া মাড়াবে না।

হঠাৎ বাইরে কীসের শব্দ হল। তারপর বোঝা গেল, ঘোড়া ছুটিয়ে কারা আসছে এদিকে

মরালী বললে–যাও, এবার চলে যাও, উমিচাঁদ আর নন্দকুমার এসে গেছে, নবাবের ঠিক পাশে পাশে থাকবে তুমি, সব দিকে নজর থাকে যেন, যাও

*

অষ্টাদশ শতাব্দীর মানুষ বুঝি অস্থায়ী যুগের মানুষ। সুখ, ঐশ্বর্য, দুঃখ, জী, সমস্তই তখন অস্থায়ী। তবু বোধহয় অস্থায়ী জিনিসের ওপর মানুষের কোনওদিনই আস্থা নেই। তাই সেই ক্ষণস্থায়ীকে স্থায়ী করবার জন্যে হুগলির ফৌজদার নন্দকুমার অত ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল। নইলে তিন লাখ যার বার্ষিক খেলাত তার পক্ষে মাত্র বারো হাজার টাকায় নবাবের এত বড় ক্ষতি করা সম্ভব হত না।

নবাবের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে, নবাব যখন জবাবদিহি চাইলে তখন সেই যুক্তিই দিলে ফৌজদার সাহেব।

বললে–জাঁহাপনা কী করে ভাবতে পারলেন যে, আমিনবাবের দুশমনদের কাছ থেকে টাকা নেব? নবাব তো আমার কোনও ক্ষতি করেননি যে, আমি নবাবের ক্ষতি করব?

নবাবের গলা বড় গম্ভীর। কিন্তু কান্তর মনে হল নবাব যেন নন্দকুমারের সামনে করজোড় প্রার্থনা জানাচ্ছে। মনে মনে বড় কষ্ট হতে লাগল কান্তর। নবাবের সামনে দাঁড়িয়ে যে-লোক এমন করে মিছে কথা বলতে পারে তাকে তো কেটে ফেলা উচিত। কোতল করা উচিত। এরা কি বোঝে না যে নবাবের ক্ষতি মানে সকলের ক্ষতি? নবাব বাঁচলেই তো সবাই বাঁচবে। নবাবের পর যদি আহমদ শা আবদালি এই বাংলাদেশে আসে, সে কি আর আমাদের এমন করে বাঁচাবে! সে তো লুটপাট করে দেশ-গাঁ উজাড় করে সবাইকে ভিটে-মাটি ছাড়া করবে! আর এই যে মরালী নবাবকে না বলে সাহেবের সঙ্গে দেখা করে এল, অন্য নবাব হলে কি এত বড় গুণাহ বরদাস্ত করবে!

মরালী ফিরে আসতেই কান্ত জিজ্ঞেস করেছিল–তুমি কোন সাহসে গেলে মরালী?

 মরালী বলেছিল–কেন, আমি তো নবাবের ভালর জন্যেই গিয়েছিলাম

সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে তোমার ভয় করল না?

মরালী বলেছিল চেহেল্‌-সুতুনে আসতেই যখন ভয় করেনি তখন পেরিন সাহেবের বাগানে যেতেই বা ভয় করবে কেন?

কান্ত বলেছিল কিন্তু কেন তুমি চেহেল্‌-সুতুন ছেড়ে এখানে এলে? কেমন করে এলে? সঙ্গে একটা বাঁদি নাওনি, খোঁজা নাওনি, তোমার ভয় করল না?

মরালী বললে–ভয় হয়েছিল প্রথমে

তা হলে? তা হলে কী করে ভয় কাটল?

আর একজনের কথা ভেবেই ভয় কেটে গেল!

কান্ত জিজ্ঞেস করলে কার কথা ভেবে? নবাবের কথা?

মরালী বললে–প্রথমে নবাবের কথা ভেবেই কলকাতায় এসেছিলুম, কিন্তু আর একজনের কথা ভেবে ক্লাইভসাহেবের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলুম

কার কথা?

সেকথা এখন তোমায় বলব না। নবাবকেও বলিনি। আমার এত কষ্ট করা সব বোধহয় মিথ্যে হয়ে গেল। নিজেও সুখ পেলুম না, অন্যকেও সুখী করতে পারলুম না।

বলতে বলতে মরালীর মুখখানা কেমন ছলছল করে উঠেছিল সেদিন।

সত্যিই তখন কি মরালী জানত যে, যাকে নবাবের হাত থেকে বাঁচাবার জন্যে রানিবিবির ছদ্মবেশ পরে চেহেল সুতুনে এসেছিল, সেই হাতিয়াগড়ের ছোট বউরানিই আবার কোন ঘটনাচক্রে পড়ে ক্লাইভ সাহেবের ছাউনিতে গিয়ে উঠবে! তা হলে তার এত কাণ্ড করার দরকার কী ছিল।

কান্ত বলেছিল–চলো না মরালী, আমরা কোথাও চলে যাই

কোথায়?

কান্ত বলেছিল–এসব যুদ্ধ-লড়াইয়ের মধ্যে কেন থাকি আমরা। যারা নবাবের আশেপাশে রয়েছে দেখছি, তারা সবাই স্বার্থপর। কেবল নিজের নিজের সুবিধে আদায় করে নেবার জন্যে ঘুরঘুর করছে। আমি যত দেখছি ততই মনটা বিষিয়ে উঠছে মরালী–আমার আর ভাল লাগছে না–

মরালী বললে–আমার কি ভাল লাগছে বলতে চাও?

তোমার যদি ভাল না লাগে তো কেন এখানে এলে? চলো না, কোথাও চলে যাই–চলোনা, এখান থেকে গেলে কেউ জানতে পারবে না, কেউ ধরতে পারবে না।

মরালী বললে–গেলে তো যাওয়া যায়। আগে হলে হয়তো যেতে পারতুম, কিন্তু এখন যে আটকে গেছি, এখন যে বাঁধা পড়ে গেছি একেবারে

কীসের বাধা তোমার? কে তোমার আছে এখানে?

কী বলল তুমি? কেউ নেই? আমি যদি যাই তো হাতিয়াগড়ের ছোট বউরানির কী হবে? তখন তো তাকে নিয়েই টানাটানি পড়বে। আর তা ছাড়া তুমি তো জানো না,নবাবকে ছেড়ে আর যেতে পারব না।

যে তোমার সব দুঃখ-কষ্টের মূলে তার জন্যে তোমার এত দরদ?

আমার কষ্টের জন্যে কি নবাব দায়ী? যদি দায়ী হত তো আমি এখনই নবাবকে লাথি মেরে পালিয়ে যেতাম।

তা হলে কে দায়ী?

তবু তুমি তা শুনতে চাও? তুমি যদি দেরি করে সেদিন বিয়ে করতে না আসতে, তা হলে আমিই কি ছোটমশাইয়ের বাড়িতে বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে যেতাম, না রানিবিবি সেজে চেহেল্‌-সুতুনেই আসতে হত?

কান্ত বললে–একটা অপরাধ করে ফেলেছি বলে তার গুণোগার তো এতদিন ধরেই দিচ্ছি। আর কত গুণাগার দেব বলো?

সে কথা এখন আর ভেবে কী হবে!

গুণোগারেরও তো একটা শেষ আছে! সেই জন্যেই তো মুর্শিদাবাদে একবার গণতকারকে নিজের হাতটা দেখিয়েছিলুম।

মরালী বলেছিল ওসব কথা অনেকবার শুনেছি, যা হবার নয় তা নিয়ে কথা বলতে ভাল লাগে না। যখন চেহেলসূতুনেই চিরকাল থাকতে হবে তখন চেহেসতুনের কী করে ভাল হয় সেই কথা ভাবাই ভাল। আমি কেবল ভুলতে চেষ্টা করি যে আমি মরালী

কিন্তু সেই উদ্ধব দাস? সে কী করল? তার কী অপরাধ!

অপরাধ তার নয়, অপরাধ আমার কপালের, আর যে-মুখপোড়া আমাকে তৈরি করেছিল সেই ভগবানের! তোমার পায়ে পড়ি, এসব কথা আর তুলো না আমার সামনে। আমার ওসব কথা ভাবতেও ভাল লাগে না। নইলে যেদিন ওরা আমার সিথির সিঁদুর তেল দিয়ে ঘষে ঘষে মুছে দিয়েছে, সেই দিনই আমার নাম মরিয়ম বেগম হয়ে গেছে। ধরে নাও আমি মরে গেছি।

ছি।

বলেই কান্ত মরালীর মুখখানা নিজের হাত দিয়ে চাপা দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু মরালী তার আগেই নিজের ঘরের ভেতর চলে গিয়েছিল। যাবার সময় বলে গিয়েছিল–আমি নবাবের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি, দেখো কেউ যেন এ সময়ে ওখানে না ঢোকে–

তারপর নানিবেগমসাহেবা আর মরিয়ম বেগম নবাবের সঙ্গে দেখা করেছিল। ইতিহাসের সে এক সন্ধিক্ষণ। নবাব তখন নিঃসহায় সর্বস্বান্তের মতো চুপ করে অপেক্ষা করছিল। নানিবেগম আর মরিয়ম বেগম ঘরে যেতেই চমকে উঠল।

বললে–তোমরা কেন এসেছ?

নানিবেগম আগে উত্তর দিলে। বললে–তোর জন্যেই ভেবে ভেবে এখানে চলে এলুম মির্জা, তোর জন্যে আমাদের বড় ভাবা হয়েছিল রে, তুই একলা আছিস

নবাব বললে–কে বললে–একলা আছি, এখানে আমার সবাই আছে, জগৎশেঠজি নিজের দেওয়ানকে পাঠিয়ে দিয়েছে, ইরাজ খাঁ সাহেব আছেন, কে নেই আমার? তুমি কি ভাবো তোমার মির্জা সেই ছেলেমানুষই আছে আগেকার মতন? মির্জা মসনদ চালাতে পারে না?

না না, সে কথা বলব কেন? কিন্তু মরিয়ম মেয়ে যে বললে–তোর খুব বিপদ

কীসের বিপদ? নবাব এতক্ষণে মরিয়ম বেগমের দিকে চেয়ে দেখলে!

 মরিয়ম বেগম বললে–আমি জানি আপনার বিপদ জাঁহাপনা

তুমি চেহেল্‌-সুতুনে বসে কী করে জানলে আমার বিপদ?

মরিয়ম বেগম বললে–আমি চেহেল্-সুতুনে বসেই তো জানতে পেরেছিলুম জাঁহাপনা যে, সফিউল্লাসাহেব আপনার সর্বনাশ করতে চাইছে, আমি তো সেই দিনই জাঁহাপনাকে সাবধান করে দিয়েছিলম। তবে আজ কেন আমাকে একথা জিজ্ঞেস করছেন? আপনি উমিচাঁদ সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেই সব টের পেতেন। আপনি জিজ্ঞেস করেছিলেন তাকে?

দেখো…

নবাব চারদিকে অসহায়ের মতো চাইল। তারপর বললে–জীবনে যা চাওয়া যায় সব কি পাওয়া যায়? সবাই কি বন্ধু পায়? আমি শত্রু পেয়েছি, দুশমন পেয়েছি, আমাকে তাদের নিয়েই কাজ চালাতে হবে।

কিন্তু আপনি তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন না কেন, সে-চিঠি তিনি লিখেছেন কি না? কিংবা সে-চিঠির মানে কী?

নবাব কী বলবে যেন বুঝতে পারলে না। তারপর বললে–আমাকে যখন ওদের নিয়েই চালাতে হবে তখন ওদের কথাই আমাকে শুনতে হবে।

কেন, ওরা ছাড়া কি আর কোনও ভাল লোক নেই? ওদের সকলকে ছাড়িয়ে দিয়ে অন্য লোক রাখুন না!

অত সোজা নয় বেগমসাহেবা! নবাব হলে তুমিও বুঝতে পারতে অত সহজে কাউকে ছাড়ানোও যায় না, অত সহজে কাউকে বহাল করাও যায় না।

মরিয়ম বেগম বললে–সেকী? কেউ দোষ করলেও তাকে বরখাস্ত করা যাবেনা? তা হলে আপনি কীসের নবাব জাঁহাপনা?

লোকে বাইরে থেকে তাই-ই জানে বটে! লোকে জানে আমি সকলের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। আমি ইচ্ছে করলে যাকে যা-খুশি তাই-ই করতে পারি, নবাব হয়েও আমি যা-খুশি তাই-ই করেছি। এই নানিজি সমস্ত জানে। আমি ঘসেটি বেগমকে এখনও নজরবন্দি করে রেখেছি। আমি মিরজাফর খাঁর জায়গায় মিরমদনকে বসিয়েছি। আমার নিজের দেওয়ান মোহনলালকে আমি দেওয়ান-ই-আলা, মোদার-উল-মহান করেছি, গোলাম হোসেন খাঁ-কে মুলুক থেকে তাড়িয়েছি। কিন্তু তাতে ফল ভাল হয়নি বেগমসাহেবা, তাতে আমার বদনামই হয়েছে! আর তা ছাড়া দেখো না, আমি তো তোমাকেও তোমার খসমের কাছ থেকে নিয়ে এসে চেহেলসতুনে পুরে রেখে দিয়েছি।

মরিময় বেগম বললে–কেমন চেহেল্‌-সুতুনে পুরে রেখেছেন তা তো দেখতেই পাচ্ছি, তাই তো আপনার অনুমতি না নিয়েই আমি ক্লাইভসাহেবের সঙ্গে গিয়ে দেখা করে এলুম —

নবাব বললে–তা জানি—

কিন্তু কই, আমি আপনার শত্রুর কাছে গিয়েছিলুম বলে আমাকে তো জিজ্ঞেস করলেন না, কেন সেখানে গিয়েছিলুম!

নবাব নানিবেগমসাহেবার দিকে তাকালে। বললে–নানিজি, বলতে পারো যাদের আমি শাস্তি দিই তারা কী জন্যে আমাকে এত ভালবাসে? আর যাদের আমি কোনও ক্ষতি করি না তারা কেন আমার শত্রুতা করে? এই ইংরেজরা, এদের সবকিছু শর্তে আমি তো রাজি হয়ে ওদের তাবাকুফে দস্তখত করে দিয়েছি, তবু কেন ওরা শর্ত ভাঙতে চাইছে এখন?

নানিবেগম বললে–কিন্তু কেন তুই ওদের বিশ্বাস করতে গেলি মির্জা?

 বিশ্বাস করলুম কি সাধে! ওদিকে আহমদ শা আবদালি পাঠানটা যে দিল্লি হয়ে আমার মুলুকে আসছে! দুদিকে দুটো শত্রু নিয়ে আমি কেমন করে সামলাব!

মরিয়ম বেগম কথার মাঝখানে বাধা দিলে।

বললে–জাঁহাপনা, নবাব কখনও দেখিনি জীবনে, আর হয়তো কখনও পরে দেখবও না। কিন্তু একটা কথা আপনাকে বলে যাই জাঁহাপনা, আপনার নবাবি যদি না টেকে তো সে আপনার নিজের জন্যে

আমি বড় বেশি অত্যাচারী, তাই না?

 মরিয়ম বেগম বললে–না, আপনার বড় বেশি সহ্যক্ষমতা!

লোকে কিন্তু অন্য কথা বলে। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র থেকে শুরু করে জগৎশেঠজি পর্যন্ত বাই বলে, আমি নাকি বড় অত্যাচারী, বড় অহংকারী, বড় বদমিজাজি! বলে, আমার অহংকার নাকি নবাবি পাবার পর আকাশ ছুঁয়ে গেছে

মরিয়ম বেগম বললে–লোকে যা-ই বলুক, আমি নিজে যা জানি তা-ই বললুম; এত সহ্যক্ষমতা ভাল নয়! ক্লাইভসাহেবের ছাউনিতে যাবার জন্যে আমাকে আপনার শাস্তি দেওয়া উচিত ছিল।

নবাব বললে–শাস্তি দিতে গেলে তো আমার নিজের মাকেই আগে বেশি শাস্তি দিতে হয় বেগমসাহেবা। কিন্তু কী শাস্তি তুমি চাও বলল, শাস্তি দেবার ক্ষমতাটা এখনও আমার হাতেই আছে!

কিন্তু আমি কী অপরাধ করেছি তা তো শুনতে চাইলেন না আমার কাছে?

তুমি নিজেই বলো তুমি কী অপরাধ করেছ?

আমি যদি নিজে নিজের অপরাধ স্বীকার না করি তো আপনি তা জোর করে আদায় করে নিতে পারবেন না?

নবাব বললে–তুমি হাসালে বেগমসাহেবা। এককালে তাও করেছি। লোকের কাছ থেকে জোর করে অপরাধ স্বীকার করিয়ে নিয়েছি। লোকে আমার নামে ভয়ে থরথর করে কেঁপেছে। হয়তো এখনও কাঁপে। নবাব-বাদশাদের ভয়ে লোকে না কাপলে মসনদ চালানোই হয়তো যায় না। কিন্তু এতদিন পরে ভাবছি এবার না-হয় ভয় না করে আমাকে একটু ভালই বাসুক! তাতেও যদি একটু শান্তি পাই।

তাতে আপনি না-হয় বাঁচলেন, কিন্তু আপনার মসনদ? আপনার মসনদের জন্যেই তো মুর্শিদাবাদ থেকে আপনি এতদূরে এসেছিলেন ইংরেজদের সঙ্গে লড়াই করতে আপনার মসনদের জন্যেই আপনার মাসিকে নজরবন্দি করে রেখেছেন, শওকত জঙকে খুন করেছেন, হোসেনকুলির নাম পর্যন্ত মুছে ফেলেছেন। এতদিন যা-কিছু করেছেন সব তো নিজের মসনদের জন্যেই করে এসেছেন! আপনি আর আপনার মসনদ কি আলাদা?

নবাব কী যেন ভাবলে কিছুক্ষণ। তারপর বললে–কিন্তু তখন যে ভেবেছিলাম মসনদ পেলেই আমি সুখ পাব, শান্তি পাব, আনন্দ পাব–

আর এখন?

এখন ভাবছি সেই দিনগুলোই যেন বেশি ভাল ছিল, যখন মসনদ পাইনি।

কিন্তু সত্যিই কি জাঁহাপনা সেই দিনগুলো ফিরে পেতে চান? মসনদ পাবার আগেকার দিন?

সে কি আর পাওয়া সম্ভব?

মরিয়ম বেগম বললে–সবই সম্ভব জাঁহাপনা, সম্ভব সবই।

কী করে তা সম্ভব বলে দাও

আপনি সকলকে একসঙ্গে বরখাস্ত করে দিন। আমি যাদের যাদের নাম করব তাদের সকলকে বরখাস্ত করে দিন।

নবাব বললে–এখন ফরাসিদের সঙ্গে ইংরেজদের লড়াই বেধেছে, ওদিকে আহমদ শা আবদালি বাংলা মুলুকের দিকে আসছে, এই সময়ে সকলকে বরখাস্ত করব কী করে?

তা হলে আপনি হুগলির ফৌজদারকে অন্তত বরখাস্ত করে দিন।

কে? নন্দকুমার? ও তো বিশ্বাসী লোক বেগমসাহেবা!

 মরালী বললে–না

কী করে জানলে তুমি?

ফৌজদারসাহেব উমিচাঁদসাহেবের হাত দিয়ে বারো হাজার টাকা ঘুষ নেবার কড়ার করেছে

। কেন? আমি তো তাকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে ফৌজ পাঠাবার হুকুম দিয়েছি।

আপনার হুকুম যাতে না মানে ফৌজদারসাহেব, তাই এই কড়ার।

কিন্তু একথা তুমি কী করে জানলে?

এখানে ডেকে আনুন তাকে!

কিন্তু তুমি কী করে জানলে আগে তাই বলো?

মরিয়ম বেগমসাহেবা বললে–তা আমি বলব না জাঁহাপনা, নিজামতের যেমন চর থাকে, বেগমসাহেবারাও তেমনি চর পোষে, তা জানেন তো!

তুমিও কি চর পুষেছ?

আমার চর পুষতে হয়নি জাঁহাপনা, নিজামতে আমারও পেয়ারের লোক আছে, আর আমাকে খবর জোগায়, নবাবের ভালর জন্যেই মুফত খাটে।

কে সে? নাম কী তার?

 আপনি নাম জিজ্ঞেস করবেন না জাঁহাপনা, সে আপনার এখানেই আছে এখন

নবাব মাথা উঁচু করে সোজাসুজি মরালীর দিকে চাইলে।

জিজ্ঞেস করলে–সত্যি বলছ?

আগে ফৌজদারসাহেবকে এখানে ডাকুন—

কান্ত এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব শুনছিল। এবার চমকে উঠল। কার কথা বলছে মরালী! সত্যি না মিথ্যে কে জানে! যদি মরালী প্রমাণ না করতে পারে, যদি প্রমাণ হয় যে মরালীর কথা মিথ্যে! সমস্ত সাজানো কথা! বাইরে যেন কার পায়ের শব্দ হল। হুকুম হয়েছিল যতক্ষণনবাব বেগমসাহেবাদের সঙ্গে কথা বলবে ততক্ষণ কেউ নবাবের ছাউনির পাশে যেতে পারবেনা। সমস্ত বাগানবাড়িটাতে সবাই সন্ত্রস্ত হয়ে আছে। এতদিন চলছিল একরকম। সন্ধি হয়ে গেছে ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে। এখন আর কোনও গোলমাল নেই। সবাই গা এলিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু বেগমসাহেবারা আসার পর থেকেই আবার সব চৰ্মন্ করে উঠেছে।

কান্ত পরদার কাছ থেকে সরে এসে দেখলে, শশী।

তুমি এখানে?

শশীর মুখটা গম্ভীর, তার মনটা কয়েকদিন থেকেই খারাপ হয়ে গিয়েছিল। লড়াই থেমে গেলেই চাকরি চলে যাবে বলে সারাদিন মনমরা হয়ে থাকে।

তোমার সঙ্গেই দেখা করতে এসেছিলাম ভাই, কী খবর?

কান্ত বললে–খবর কিছু নেই

 তবু শশী নড়ল না। একটু থেমে বললে–বেগমসাহেবা কী জন্যে এখানে এসেছে ভাই?

কান্ত বললে–তা আমি জানি না

আমার কাছে তুমি লুকোচ্ছ ভাই, নিশ্চয়ই তুমি সব জানো। তুমি তো সবসময় নবাবের পাশে পাশে থাকো, আমি দেখেছি।

তা আমার কাজই তো নবাবের জুলুস দেখা, নবাবের পাহারাদারি করা।

শশী বললে–কিন্তু আমি যে দেখেছি তুমি বেগমসাহেবার সঙ্গে কথা বলছিলে?

আমি? কখন দেখলে তুমি?

শশী বললে–না, আমি দেখেছি। তুমি যে পরদা তুলে বেগমসাহেবার ঘরের ভেতর ঢুকলে! তোমার সঙ্গে বেগমসাহেবার বুঝি জানাশোনা আছে? বলল না, আমার কাছে কেন মিছিমিছি লুকোচ্ছ, আর আমি তো কারও কাছে বলতে যাচ্ছি না। আমি আমার নিজের চাকরি নিয়েই ভাবছি কেবল, আমার অন্য কোনও চিন্তাই নেই

শেষপর্যন্ত শশী নাছোড়বান্দা। কিছুতেই যাবে না। শেষে কান্তই চলে গিয়েছিল। কেমন যেন সন্দেহ হয়েছিল কান্তর মনে। লোকটা চরটর নয় তো কারও! বলেছিল-আমার এখন কাজ আছে ভাই, আমি চলি–

তারপর যখন রাত্রে সব নিরিবিলি হয়ে গেল, নবাবের খানা খাওয়া হয়ে গেছে, তখন ছটফট করতে লাগল কান্ত। ছাউনিও পাতলা হয়ে গেছে সেদিন। উমিচাঁদ সাহেব আর ওয়াটস্ সাহেব দুজনেই কাশিমবাজার কুঠির দিকে চলে গেছে। ইরাজ খা-ও আর বেশি সময় নষ্ট না করে সোজা মুর্শিদাবাদের দিকে রওনা দিয়েছে। দেওয়ান রণজিৎ রায়ও আর বেশি দিন থাকবার লোক নয়। তাকেও সব খবরাখবর দিতে হবে জগৎশেঠজিকে। .

কান্ত বাইরে শব্দ করতেই পরদার ভেতর থেকে খসখস শব্দ হল।

আবার কী? তোমার কি একটা কাণ্ডজ্ঞান পর্যন্ত নেই?

গলা নিচু করে মরালী সামনে এসে কান্তকে পরদার ভেতরে নিয়ে গেল।

কান্ত বললে–আমার বড় ভয় করছে মরালী

কী হয়েছে? ভয় করছে তো আমার কাছে কেন? ফৌজের লোকজনদের কাছে যাও না, ওদের কাছে কামান আছে, বন্দুক আছে

না, সে জন্যে নয়। তুমি নবাবের সঙ্গে যা-যা কথা বলেছিলে আমি সব লুকিয়ে লুকিয়ে শুনেছি। এখন কী হবে?

কীসের কী হবে?

তুমি প্রমাণ করতে পারবে?

কীসের প্রমাণ?

ওই যে হুগলির ফৌজদার ঘুষ নিয়েছে ক্লাইভসাহেবের কাছ থেকে! যদি প্রমাণ হয় যে তুমি মিছে কথা বলেছ, তখন? উমিচাঁদসাহেব কি তোমার রক্ষে রাখবে ভেবেছ? ও যে সর্বনেশে লোক, তুমি ওকে চেনো না!

কে তোমাকে বললে–আমি চিনি না?

 কিন্তু তুমি তো দেখোনি ওকে। ও বড় জাহাবাজ লোক! ও-লোকটার দাড়ি দেখলেই আমার ভয় করে। তোমার কাছে ছোরাটা সবসময়ে রেখে দিয়ে, কালকের মতন আবার যেন ফেলে এসো না কোথাও

ঠিক আছে, রাত হয়েছে, তুমি এবার ঘুমোও গে, যাও

বলে কান্তকে ঠেলে বাইরে বার করে দিয়ে মরালী পরদাটা এঁটে দিলে ভেতর থেকে।

*

শেষরাত্রের দিকেই তোড়জোড় শুরু হয়ে গিয়েছিল পেরিন সাহেবের বাগানে। অ্যাডমিরাল ওয়াটসন এসেছিল রাত থাকতে। সেপাইরা সেজেগুজে নিয়েছে। ওয়াটসন আসতেই ক্লাইভ একেবারে তাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরেছে।

হোয়াটস আপ রবার্ট? কী হল তোমার?

রবার্ট ক্লাইভ আনন্দে অধীর হয়ে গেছে একেবারে। ছাড়তেই চায়না ওয়াটসনকে। এতদিনের ঝগড়া দু’জনের, তা যেন রবার্ট ভুলেই গিয়েছে এক মুহূর্তে।

ওয়াটসন, এখনি দ্যাট স্কাউড্রেল অব এ বিস্ট চিঠি দিয়েছে। নন্দ কুমার রাজি।

রাজি মানে? এগ্রিড?

হ্যাঁ, বারো হাজার টাকা তাকে ব্রাইব দিতে হবে। তা হলে সে আর আমাদের এগেনস্টে আর্মি পাঠাবে না। আজকেই আমরা চন্দননগর অ্যাটাক করব! বি রেডি। নাউ অর নেভার।

কই, চিঠি দেখি!

ক্লাইভ সাহেব টেবিলের ওপর থেকে উমিচাঁদের চিঠিখানা নিয়ে দেখাতে গেল। অনেক কাগজপত্রের ভিড় তার ওপর। ইংলভের সিলেক্ট কমিটিকে যে-চিঠি লিখেছে, বাবাকে যে চিঠি লিখেছে, বাবার কাছ থেকে যে-চিঠি এসেছে তাও রয়েছে।

এই যে, এই নাও!

গুলাব-কে ফুলের কথা লেখা যে-চিঠিটা উমিচাঁদ লিখেছিল সেটা নিয়ে ক্লাইভ ওয়াটসনকে দেখালে।

ওয়াটসন চিঠিটা পড়ে বললে–আমাকে তো তোমার এ-প্ল্যান আগে বলেনি।

না, আগে বলিনি, এখন সাকসেসফুল হয়েছি বলে বলছি।

তুমি কী লিখেছিলে?

আমার এই হল ফার্স্ট লেটার, এই লেটার পেয়ে উমিচাঁদ আমাকে সব লিখলে—

উমিচাঁদের চিঠিটা কোথায়? দেখি

 ক্লাইভ উমিচাঁদের চিঠিটা খুঁজতে লাগল। কোথায় গেল সে চিঠিটা। হোয়ার ইজ দ্যাট লেটার? ক্লাইভের মুখটা শুকিয়ে গেল! সে-চিঠিটা কোথায়?

কেউ চুরি করেনি তো?

কে আবার চুরি করবে? আমার ঘরে তো কেউ আসেনি!

কেন, সেই যে নবাবের বেগম এসে বসেছিল তোমার ঘরে, সে নিয়ে যায়নি তো?

কিন্তু..

কিন্তু হঠাৎ ক্লাইভের মনে পড়ল। বেগমসাহেবাকে একলা ঘরে বসিয়ে ক্লাইভ বাইরে ওয়াটসনের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিল, সেই সময়ে বেগমসাহেবা চিঠিটা নিয়ে যায়নি তো! সর্বনাশ! গড সেভ মাই সোল! সত্যিই কি চিঠিটা নিয়ে ব্ল্যাকমেল করবে নাকি! কথাটা ভাবতেই রবার্ট ক্লাইভের বুকটা ধড়াস করে উঠল। তা হলে কী হবে!

*

অ্যাডমিরাল ওয়াটসন দেখছিল এতক্ষণ। রবার্টকে যতদিন ধরে দেখছে ততদিনই কেমন অবাক লাগছে। রবার্ট শুধু এখানে যেন যুদ্ধ করতে আসেনি, একান্ট্রিটাকে জানতেও এসেছে। সেই ম্যাড্রাস থেকেই দেখেছে ওয়াটসন। ছেলেটা কখন কী করে, কখন কী মতলব আঁটে, তা কারও জানবার উপায় নেই। হয়তো নিজেই জানে না। কিন্তু যার হাতে এতগুলো লোকের জীবন নির্ভর করছে, যার ওপর কোম্পানির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে, তার পক্ষে কি এত খেয়ালি হলে চলে!হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই, এখানকার ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে গল্প করতে বসে যায়। ভিলেজের লোকরা রাস্তায় হুঁকো নিয়ে তামাক খেতে খেতে চলেছে, রবার্ট দেখতে পেয়েই দাঁড়িয়ে যায়। বলে হোয়াট ইজ দিস? এটা কী?

নেটিভরাও ভয় পেয়ে যায় প্রথমে। তারপর বলে–এ হুঁকো

হুঁকো?

বলে নিজেই সেটা নিয়ে তামাক খেতে যায়।

নেটিভরা আপত্তি করে। বলে-না হুজুর, নিয়ো না

রবার্ট বলে–দেখি না, আমি স্মোক করতে পারি কিনা–

একটা হুঁকোয় অন্য জাতের লোক মুখ দিলে তাতে যে জাত চলে যায় তা রবার্ট বোঝে না। হুঁকোয়। মুখ দিলে জাত চলে যাবে কেন তা তার কাছে দুর্বোধ্য। শেষকালে আবার হরিচরণকে দিয়ে একটা হুঁকো কিনিয়ে আনে। হরিচরণকে দিয়ে তামাক সাজায়, টিকে ধরায়, ধোঁয়া টানে। তারপর মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে মহা খুশি। হো হো করে হাসে।

ওদিকে আবার মেয়েদের দেখলে তাদের সঙ্গে কথা বলতে যায়। নেটিভ মেয়েরা গঙ্গায় স্নান করতে আসে, মাটির কলসিতে জল নিয়ে বাড়ি যায়, পুকুরে কাপড় কাঁচতে আসে, রবার্ট সেই দিকে হাঁ করে চেয়ে দেখে।

ওয়াটসন বলত ওদের দিকে চেয়ো না অমন করে, ওরা আমাদের ভয় পাবে।

কেন, ভয় পাবে কেন, আমি কি ওদের খেয়ে ফেলব?

না, ওরা ভাববে তুমি ওদের রেপ করবে!

 রবার্ট বলত–হোয়াই? ওরা বিউটিফুল, তাই ওদের দিকে চেয়ে দেখছি–ইংলিশ লেডিদের মতন নয়, ওরা পুরুষদের স্লেভ

ইজ ইট?

হ্যাঁ, দেখোনা, নেটিভরা ওদের মেয়েদের বাইরে বেরোতে দেয় না, নেটিভরা কতগুলো বিয়ে করে, ওরা স্লেভস

রবার্ট বলত–কিন্তু ওরা কত বিউটিফুল তা জানে না ওরা?

পরে বুঝেছিল রবার্ট–নেটিভ মেয়েরা অত বিউটিফুল বলেই নেটিভরা অমন করে তাদের ঘরের মধ্যে লুকিয়ে রাখে। পাছে তাদের বিউটিফুল চেহারা দেখে কেউ রেপ করে, কেউ তাদের কিডন্যাপ করে, তাই তারা মাথায় ঘোমটা দিয়ে মুখ ঢেকে রাখতে বলে। হোয়াট এ স্ট্রেঞ্জ পিপল, হোয়াট এ স্ট্রেঞ্জ ল্যান্ড!

অথচ রবার্ট বিয়ে করেছে, ছেলে-মেয়ে হয়েছে তার। বউকে চিঠি লেখে, বাবাকে চিঠি লেখে। তাদের চিঠি না পেলে রবার্টের মন খুব খারাপ হয় আবার।

বলে–এখনও মেল এল না কেন ওয়াটসন–সাত মাস হয়ে গেল, নো লেটার ফ্রম পেগি!

পেগির কাছ থেকে কোনও চিঠি না-এলেই রবার্ট ভাবতে বসে। এক মেলেই দু’খানা তিনখানা চিঠি লিখে দেয়। সব কথা লিখতে মনে থাকে না। বাকি কথাগুলো মনে পড়ে গেলেই আবার আর একখানা চিঠি লিখতে বসে। তোমরা কেমন আছ? এখানে মেয়েরা মাথায় ঘোমটা দেয়। তাদের বিউটিফুল মুখ দেখে পাছে কেউ তাদের কিন্ন্যাপ করে নিয়ে যায় তাই তারা বাড়ির মধ্যে দিনরাত থাকে, রাস্তায় বেরোয় না। শুধু গঙ্গায় স্নান করবার সময় তাদের দেখতে পাই। দে আর ভেরি বিউটিফুল। আর একটা ভারী মজার ব্যাপার করেছি আজ পেগি। আজ আমি হুঁকো খেয়েছি। একটা কোকোনাটের খোলের ওপর নল লাগিয়ে তার ওপর একটা মাটির পটে আগুন দেয়, তারপর কোকোনাটের মুখের গর্ততে দুটো ঠোঁট দিয়ে হাওয়া টানে। তখন মুখ দিয়ে ধোঁয়া বেরোয়। ভেরি প্লেজান্ট। আমাদের সিগারের চেয়ে তা মিষ্টি, ভেরি সুইট। মাই ডারলিং, যখন দেশে ফিরে যাব তখন এখানকার আরও কুইয়ার স্টোরি বলব তোমাকে। এখানে গ্রীষ্মকালের গরমে আমি গায়ে জামা রাখতে পারি না। কিন্তু এখন খুব ঠান্ডা। খুব শীত। আমরা এবার চন্দননগর অ্যাটাক করতে যাচ্ছি। একদিন ফ্রেঞ্চদের সঙ্গে আমি ফাইট করেছি, আবার শুরু হবে ফাইট। ডুপ্লের কথা তো তুমি জানো। ভেরি শ্রুড ম্যান। এবারে হয়তো খবর পেয়ে আবার এই বেঙ্গলে আসবে। আবার মুখোমুখি ফাইট দিতে হবে। লাভ টু চিলড্রেন। থাউজ্যান্ড কিসেস টু ইউ, মাই ডারলিং!

আবার এদিকে দু’জন নেটিভ উওম্যানকে নিজের কাছে রেখে দিয়েছে। ওয়াইফকে ভালবাসে, আবার এদেরও ছাড়তে পারে না। আজকাল ড্রিঙ্কও করে না। বিফ খাওয়াও ছেড়ে দিয়েছে।

ওয়াটসন একবার বলেছিল–তা ওদের রেখেছ কেন এখানে? ওদের ছেড়ে দাও না!

 রবার্ট রেগে গিয়েছিল কথা শুনে। বলেছিল–কেন, ওরা এখানে থাকলে তোমার কী ক্ষতি হচ্ছে? আর কোম্পানিরই বা কী লোকসান হচ্ছে? ওরা তো আমার টাকায় খাচ্ছে–

তোমার টাকায় খাচ্ছে?

রবার্ট বলেছিলা, তোমরা কি মনে করেছ আমি কোম্পানির অ্যাকাউন্টে ওদের খরচ দেখাচ্ছি? আমি আমার নিজের মাইনের টাকা খরচ করে যাকে ইচ্ছে খাওয়াতে পারি, তাতে কারও কিছু বলবার নেই। আর তা ছাড়া, ওরা কতটুকু খায়? কতটুকু খেতে পারে দু’জনে।

ওয়াটসন বলেছিল-না, আমি তা বলছি না

না, ওদের মধ্যে আবার একজন তো উইডো। ইন্ডিয়ার উইডোরা কিছুই খায় না। ফিশ খায় না, বিফ খায় না, মটন খায় না, এমনকী পেঁয়াজ পর্যন্ত খায় না, তা জানো?

ওয়াটসন বলেছিল–না, আমি তার জন্য বলিনি, আমি বলছিলুম আমার রেশনের জন্যে, রেশন তো আগে প্লেন্টি পাওয়া যেত না

তা এখন তো পাওয়া যাচ্ছে। এখন তো যত চাও তত পাওয়া যাচ্ছে। এখন তো উমিচাঁদ যত কিনবে তত সাপ্লাই করবে! এখন তো আমাদের মাথায় হাত বুলিয়ে ওই বাস্টার্ড মেকিং হিউজ মানি

তারপর থেমে আবার বললে–আর তা ছাড়া, তুমি যদি চাও তো আমি নাহয় নিজে না-খেয়ে আমার রেশন থেকে ওদের খাওয়াতে পারি!

না না, আমি তা বলিনি! কিন্তু এক-একবার ভাবি ওই উওম্যানদের কেন তুমি রেখেছ এখানে? হোয়াট ফর?

কেন রেখেছি তা তুমি জানো না? তোমাকে বলিনি?

 ওদের সেফ শেলটার দেবার জন্যে! ওদের নিরাপদ করার জন্যে!

ইয়েস, একজ্যাক্টলি সো! তুমি শুনলে অবাক হয়ে যাবে ওয়াটসন, ক’দিন আগে আমার কাছে হাতিয়াগড়ের রাজা এসেছিল–

কেন? কী বলতে?

মহারাজ কিষণচন্দর তাকে পাঠিয়েছিল আমার কাছে, টু হেলপ হিম!  

হাউ? কী ভাবে?

তার ওয়াইফকে বেঙ্গলের নবাব কিডন্যান করে নিজের হারেমে রেখে দিয়েছে।

সে তো তারা এমন করেই! দ্যাট ইজ এ কাস্টম হিয়ার!

কিন্তু তার ওয়াইফকে নবাব কনভার্ট করেছে, হিন্দুকে মহমেডান করেছে, নাম চেঞ্জ করে মরিয়াম বেগম নাম দিয়েছে।

তারপর?

তারপর তার হাজব্যান্ড এখন তার ওয়াইফকে কী করে ফিরিয়ে নেওয়া যায়, সেই পরামর্শ করতে এসেছিল আমার কাছে। বলছিল, নবাবকে ওভার-থ্রো করতে চেষ্টা করলে তারা সবাই আমাদের সঙ্গে কো-অপারেট করবে। আমাদের টাকা দিয়ে, মানুষ দিয়ে সব রকমে হেলপ করবে। অল দি জমিন্দারস আমাদের সাইডে আসবে!

সে তো আমরা জানি!

না, শুধু জগৎশেঠ নয়, মিরজাফর আলি নয়, এমনকী পেটি জমিনদারসরাও উইল হেলপ আস।

 দ্যাটস গুড! কিন্তু নবাবকে ওভার-থ্রো করলে কে নিউ নবাব হবে? হু?

রবার্ট বলেছিল–সে পরের কথা। নবাব হবার জন্যে লোকে ইগার হয়ে বসে আছে। সবাই নবাব হতে চায়! সেসব কথা এখন ভাবব না। আগে ফ্রেঞ্চদের এই এরিয়া থেকে তাড়াতে হবে। তা না হলে দে মে জয়েন দি নবাব!

তুমি কী বললে–হাতিয়াগড়ের রাজাকে?

আমি কিছু কমিট করিনি। পুরো কথা হয়নি আমার সঙ্গে। তার আগেই নবাবের আর্মি আমাদের ক্যাম্পে কামান ছুঁড়তে লাগল আর সঙ্গে সঙ্গে এখান থেকে চলে গেল। আই থিঙ্ক, আবার একবার আসবে আমার কাছে। আর সেই জন্যেই আমি এই লেডিদের ছাড়ছি না। লেট দেম রিমেন হিয়ার! নইলে রাস্তায় নবাবের নিজামতের লোক কেউ দেখে ফেললেই, ওদের কিডন্যাপ করে নবাবের হারেমে পুরে দেবে! তুমি নিজে দেখেছ তো, কী রকম বিউটিফুল লেডি? বিউটিফুল নয়?

আমি তো কোনও বিউটি দেখতে পাইনা! যাক গে, আমার বিউটি দেখবার অত সময় নেই তোমার মতো!

আমার সময় কোথায় বিউটি দেখবার?

দেখতে তো পাচ্ছি তোমার সময় রয়েছে। তুমি ওদের সঙ্গে গল্প করো, ওদের সঙ্গে তুমি জোক্‌ করো!

নো!

ক্লাইভের নীল চোখ দুটো হঠাৎ কথাটা শুনে লাল হয়ে উঠতে যাচ্ছিল, কিন্তু আবার সামলে নিলে। রবার্ট। এদের ওপর রাগ করে কোনও লাভ নেই। ওরা তো ইন্ডিয়াকে আমার চোখ দিয়ে দেখছে না। ওরা তো ইন্ডিয়ানদের মানুষ বলে মনে করে না। এরা এসেছে এ কান্ট্রি কার করতে। আমিও। এসেছি, কিন্তু কান্ট্রি কঙ্কার করতে হলে আগে যে কান্ট্রির লোকেদের হার্ট কস্কার করতে হয় তা এরা। জানে না।

রবার্ট বললেও নিয়ে আমি তোমার সঙ্গে ডিসকাস করতে চাই না। তারপর আমি ভেবেছিলুম হাতিয়াগড়ের রাজাকে ডাকিয়ে আনব আমার কাছে। তার ওয়াইফকে নবাবের হারেম থেকে উদ্ধার করবার চেষ্টা করব। যাতে নবাবকে বলে তাকে রাজার কাছে ফেরত দেয় সেই চেষ্টা করব! কিন্তু না, এখন আর চেষ্টা করব না ঠিক করলাম

না না, তুমি ওর মধ্যে যেয়ো না রবার্ট! নবাবের ফ্যামিলি-অ্যাফেয়ার্স নিয়ে মাথা ঘামাবার দরকার নেই আমাদের। আমরা এখানে এসেছি বিজনেস করতে, টাকা কামাতে। নবাবের মর্যালিটি নিয়ে আমাদের কারবার নয়। লেট হিম ডু হোয়াট এভার হি লাইকস! কোন রাজার বউকে নিয়ে নবাব কী অ্যাডালট্রি করছে, দ্যাটস নট আওয়ার লুক-আউট!

রবার্ট বলেছিল কিন্তু আমিও তো ম্যান! ম্যান হিসেবে আমারও তো একটা মর‍্যাল ডিউটি আছে!

তা হলে তুমি প্রিচার হলেই পারতে! মিশনারি ফাদার হলেই পারতে!

রবার্ট বললে–না, তাও আমি করতুম। কিন্তু সেই হাতিয়াগড়ের রাজার ওয়াইফ আমার কাছে এসেছিল–

হুঁ? সেই হাতিয়াগড়ের রাজার ওয়াইফ? তোমার কাছে? কখন?

রবার্ট কললে-তুমি তাকে দেখেছ।

আমি? আমি কখন দেখলুম?

হ্যাঁ, তুমি দেখেছ। তুমি সেদিন এসে দেখলে আমার ঘরে একজন লেডি রয়েছে, বোরখা-পরা লেডি, সেই লেডিই হল হাতিয়াগড়ের রাজার ওয়াইফ।

কিন্তু সে তো বেঙ্গলের নবাবের বেগম।

তারই নাম মরিয়ম বেগম! দ্যাট ইজ দি ওয়াইফ অব হাতিয়াগড়ের রাজা! এখন নবাবের বেগম হয়েছে। আগে রাজার কথা শুনে তার ওয়াইফের ওপর সিমপ্যাথি হয়েছিল, কিন্তু এখন আর আমার কোনও সিমপ্যাথি নেই। খুব ধড়িবাজ। তখন বুঝতে পারিনি কী উদ্দেশ্য নিয়ে আমার কাছে এসেছিল। ভেবেছিলাম হারেম থেকে কী করে পালিয়ে যাওয়া যায় সেই পরামর্শই করতে এসেছে পারহ্যাপস। কিংবা হয়তো হাজব্যান্ডের কাছে খবর পাঠাবার কথা বলতে এসেছে

ওয়াটসন উদগ্রীব হয়ে উঠেছে।

তা হলে কী জন্যে এসেছিল?

খুব ধড়িবাজ মেয়ে। আমাকে বোকা বানিয়ে দিয়ে চলে গেল ওয়াটসন। আমি বিফুলড হয়ে গেলাম। এখন বুঝছি সে আমাকে ধাগা দিতে এসেছিল

ওয়াটসন বললে–তা হলে সেই বেগমসাহেবাই তোমার চিঠি চুরি করে নিয়ে গেছে?

 ইয়েস!

 তা হলে উমিচাঁদ খুব বিপদে পড়বে। উমিচাঁদ উইল বি কট!

হ্যাঙ আওয়ার উমিচাঁদ। উমিচাঁদের জন্যে আমার মাথাব্যথা নেই। উমিচাঁদ মে গো টু হেল। নবাব আমাদের অ্যাটাক করতে পারে!

বেগমসাহেবা তোমার এখান থেকে কোথায় গেল, জানো?

নিশ্চয় নবাবের কাছে। আমাকে বলে গেল সেনবাবের পরামর্শ না নিয়েই এসেছে। আমার মনে হয় ওটা মিথ্যে কথা। নবাব আমাদের চিঠি পেয়েছে, চিঠি পেয়েই বেগমকে এখানে পাঠিয়েছে। আমাদের ক্যাম্পের সব খবরাখবর জানবার জন্যে।

কিন্তু সে-ই যে মরিয়ম বেগম তা তুমি জানলে কী করে? মে বি সামডি এল! অন্য কেউ তো হতে পারে! হয়তো মরিয়ম বেগমের নাম করে কোনও পুরুষমানুষ এসেছিল। তুমি কি তার চেহারা দেখেছ?

কী করে দেখব? বোরখা পরা ছিল যে!

বোরখা খুলে দেখলে না কেন?

কিন্তু আমি তো তাকে সন্দেহ করিনি!

সেইটেই তো তোমার উইকনেস রবার্ট! আমি কতদিন থেকে বলেছি মেয়েদের বিশ্বাস কোরো না। এই যে তুমি এখানে নেটিভ উওম্যানদের ক্যাম্পের ভেতরে রেখেছ, ওরাও তো পাই হতে পারে। নবাবের শাই হতে পারে। হতে পারে আমাদের সমস্ত মুভমেন্টের খবর নেবার জন্যে নবাব ওদের পাঠিয়ে দিয়েছে।

ক্লাইভ কী যেন ভাবলে খানিকক্ষণ। তারপর বললে–কিন্তু তা কী করে হতে পারে? দে আর সো গুড!

স্পাইরা তো সব সময়েই ভাল হয়।

কিন্তু আমি যে ওর হাজব্যান্ডকে চিনি। হি ইজ এ পোয়েট! পোয়েটটা খুব ভাল লোক।

পোয়েট তোমাকে কি বলেছে যে, ও ওর ওয়াইফ?

 হ্যাঁ বলেছে। কিন্তু ওয়াইফ যেতে চায় না হাজব্যান্ডের কাছে! হয়তো পছন্দ হয়নি হাজব্যান্ডকে।

কোথায় যেতে চায়?

ওর ফাদারের কাছে!

তা ওরা একলা বোটে করে কোথায় যাচ্ছিল?

 ওরা বলছে তীর্থ করতে। হিন্দু লেডি তো। খুব ধার্মিক। জানো ওয়াটসন, ওরা বিফ খায় না, ড্রিঙ্ক করে না। ওরা কী করে স্পাই হবে?

ওয়াটসন বললে–তবু, তুমি উমিচাঁদকে চিঠি লেখো

 কী জন্যে!

 লিখে দাও যে তার একটা চিঠি, এখানে তোমার টেবল থেকে চুরি হয়ে গেছে। মরিয়ম বেগমসাহেবা চুরি করে নিয়ে গেছে।

বাইরে একটা শব্দ হতেই ক্লাইভ চেয়ে দেখলে। আর্মির লোক। মেসেঞ্জার।

কী খবর ফ্লেচার?

ফ্লেচার ঘরে ঢুকল।

আমি এখনই আসছি হুগলির ফৌজদারসাহেবের কাছ থেকে।

সেই লেটারটা ডেলিভারি দিয়েছ?

ইয়েস স্যার। কিন্তু শুনলাম নবাব ফৌজদারসাহেবকে নিজের ক্যাম্পে ডেকে পাঠিয়েছে।

হোয়াট ফর? কী জন্যে?

তা জানি না। কিন্তু খুব আর্জেন্ট কল! ফৌজদারসাহেব এখানেই আসছে।

 এখানে?

না, এখানে নয়। নবাবের ক্যাম্পে! নবাবের সঙ্গে দেখা করতে!

অলরাইট! তুমি ওয়াচ রাখো, যাও

ফ্লেচার চলে যেতেই অ্যাডমিরাল ক্লাইভের দিকে চাইলে। বললে–এখন কী করতে চাও বলল, হোয়াট নেক্সট?

ক্লাইভ হঠাৎ এক মুহূর্তে আবার সেন্ট ডেভিড ফোর্টের কমান্ডার হয়ে উঠল।

বললে–এই সুযোগ! দিস ইজ দি অপারচুনিটি ওয়াটসন! নাউ অর নেভার! আমি চন্দননগর অ্যাটাক করব!

*

হুগলির ফৌজদার সাহেব তখন নবাবের ছাউনির দরবারে নবাবের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। পাশে উমিচাঁদ।

নবাবের সামনে দাঁড়িয়ে হুগলির ফৌজদারও ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। মা জগদম্বার ভক্ত ছেলেকে যেন পাঁঠার মতো বলির জন্যে দেবীর সম্মুখে আনা হয়েছে। শুধু ফৌজদার কেন, মহা-মহা রথী-মহারথীদেরও কতবার লাঞ্ছিত হয়ে ফিরে যেতে হয়েছে নবাবের দরবার থেকে। দশ পুরুষের জমিদারকেও বকেয়া খাজনার দায়ে নবাবের কয়েদখানায় আটক থাকতে হয়েছে। নবাবের কাছে এলে জগৎশেঠের মতো কোটিপতির বুকটা দুরদুর করে কাঁপে। কুর্নিশ করতে সামান্য ত্রুটি হলেও ধমক খেতে হয় তাদের সকলকে। অষ্টাদশ শতাব্দীর মানুষের কাছে দিল্লিশ্বর যা, বঙ্গেশ্বর যা, জগদীশ্বরও তাই। তুমি নবাব, তুমিই দেবতা। তোমার পাপ বলে কোনও কিছু থাকতে নেই। তুমি নিষ্পাপ নির্দোষ। তোমার মেহেরবানিতেই আমরা বেঁচে আছি। তোমার মর্জি হলে তুমি আমাকে বাঁচিয়ে রাখতেও পারো, খুনও করতে পারো। তোমার হুকুমের ওপরে আপিল নেই। তুমি খোদাতালা, তুমি আল্লাতালা আর আমি কীটানুকীট দাসানুদাস বশংবদ। তুমি আমাকে রাখলে রাখতে পারো, মারলেও মারতে পারো। সব দোষ আমার, সব গুণাহ আমার, সব অপরাধ আমার।

যে আমির ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে রোজ ইষ্টদেবতাকে স্মরণ করে, সে প্রথমেই বলে হে মা কালী, হেমা জগদম্বা, আমাকে দেখো মা, নবাবের বিষনজরে যেন না পড়ি। নবাব যেন খুশি হয়ে থাকে আমার ওপর।

যে-জমিদার ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে রোজ ইষ্টদেবতাকে স্মরণ করে, সে প্রথমেই বলে হে মা কালী, হে মা জগদম্বা, আমাকে দেখো মা, নবাবের বিষনজরে যেন না পড়ি। নবাব যেন খুশি থাকে আমার ওপর।

শুধু আমির-ওমরাহ নয়, শুধু জমিদার-তালুকদারই নয়, তামাম হিন্দুস্থানের মানুষের ওই আর্জি। আজ না-হয় সকাল হল, আজ না-হয় বেঁচে আছি। কিন্তু কাল সকাল পর্যন্ত বেঁচে না-থাকতেও পারি। কাল পর্যন্ত তুমি আমাকে দেখো। কাল যদি বেঁচে থাকি তো তখন পরশুর কথা পরশু বলব। ১৭০৭ সালে বাদশা আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর থেকেই জীবন ঐশ্বর্য আশা আস্থা সবকিছুই যেন মানুষের মনে ক্ষণস্থায়ী হয়ে গিয়েছিল। এই যে আজ খেত থেকে ধান কেটে নিয়ে এসে আমার মরাইতে রাখলুম, কাল সকালবেলা ডিহিদার এসে তা কেড়ে নিয়ে যেতে পারে। এই যে আজ অনুষ্টুপ ছন্দে মন্ত্র পড়ে আমার স্ত্রীকে ঘরে নিয়ে এলুম, কাল নবাবের লোক এসে পরোয়ানা দেখিয়ে তাকে তুলে নিয়ে যেতে পারে। খোদাতালার রাজ্যে তবু দু’দণ্ড সবুর করা চলে। কবিরাজ কি হেকিম ডেকে মানুষের মৃত্যুকে তবুদু’দিন ঠেকিয়ে রাখাও যায়, কিন্তু নবাবের হুকুমে সবুর সয় না। নিজামতের পরোয়ানার আর নড়চড় নেই। সে বিধাতার বিধানের চেয়েও অমোঘ। নিজামতের বিধানে আজ না হয় হুগলির ফৌজদার হয়ে আছি, কিন্তু সেই নিজামতের বিধানেই হয়তো কাল আবার নিজামতের কয়েদখানায় থাকতে পারি। কে বলতে পারে?

কিন্তু উমিচাঁদের যাবার কথা কাশিমবাজারে, কাশিমবাজারে না গিয়ে সে তোমার দফতরে গেল কেন?

উমিচাঁদ পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল।

বললে–নন্দকুমারজি আমার বন্ধু জাঁহাপনা। তাই তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলুম

কিন্তু দেখা করবার আর সময় পেলে না? ঠিক যে সময়ে ফিরিঙ্গিরা চন্দননগরে হামলা করতে যাবার মতলব করছে, সেই সময়ে?

ফিরিঙ্গিরা চন্দননগরে হামলা করবার মতলব করেছে? কই, আমি তো কিছু জানি না জাঁহাপনা!

উমিচাঁদ যেন হঠাৎ আকাশ থেকে পড়েছে।

উমিচাঁদ।

এবার নবাবের গলার আওয়াজ আর এক পরদা চড়ে উঠল। পাশে কান্ত পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে ছিল শুরু থেকে। কান্তর মনে হল নবাব আরও জোরে চেঁচিয়ে ওঠে না কেন? নবাবের হাতে কি ক্ষমতা নেই? নবাব কি বাংলামুলুকের ভাগ্যবিধাতা নয়! তবে এত নরম হয়ে আছে কেন? জেলখানায় পুরতে পারে না আগেকার মতো? কোতল করতে পারে না যেমন করেছিল হোসেনকুলি খাঁ’র বেলায়? নবাবের মুখের দিকে চেয়ে দেখল কান্ত। সমস্ত মুখখানা যেন শুকিয়ে গেছে। সেই যেদিন থেকে নবাবের সঙ্গে কলকাতায় এসেছে সেই দিন থেকেই নবাবের পাশে পাশে থেকে দেখেছে। এই মানুষটার ওপরেই বুড়ো সারাফত আলির এত রাগ; এই মানুষটাকেই লোকে ঠকায়। এই মানুষটারই এত নিচ্ছে। অথচ দেখে কিছুই বোঝা যায় না। সারাদিন বাব চুপ করে ঘরের মধ্যে বসে থাকে, কারও সঙ্গে কথা বলে না। মেহেদি নেসার, ইয়ারজান সাহেবরা এত বন্ধু ছিল আগে, তারাও কাছে থাকে না। কাছে থাকতে দেয় না তাদের। কেউ দেখা করতে এলে নামধাম-পরিচয় জিজ্ঞেস করে নিয়ে তবে দেখা করে। সকলের কথা শোনে। মন দিয়ে শোনে। তারপর একটা কি দুটো কথা বলে। তাও আস্তে আস্তে। ইংরেজদের সঙ্গে মিটমাট হয়ে যাবার পর থেকেই কেমন যেন গম্ভীর হয়ে গেছে আরও। আশ্চর্য, ছাউনির ভেতরে মদের ফোয়ারা চলে। মেহেদি নেসার সাহেব খায়, ইয়ারজান সাহেব খায়, মিরজাফর আলি সাহেবও খায়। আমির-ওমরাওরা কেউই বাদ যায় না। কিন্তু নবাবকে কোনওদিন মদ খেতে দেখলে না কান্ত। দরকার হলে শুধু জল কিংবা শরবত আসে খানাঘর থেকে। তাও প্রথম-প্রথম গরম মশলা দিয়ে মোগলাই খানা রান্না হত। ভারী লোভ লাগত কান্তর। মিষ্টি গন্ধ। চারদিক একেবারে গন্ধে ভুরভুর করত। কিন্তু হালসিবাগানের ব্যাপারটার পর থেকেই খুব মনমরা হয়ে গিয়েছিল। থালায় সব খাবার পড়ে থাকত। কেউ খেতে বলবারও লোক নেই। রাত্রে ঘুমও কমে গিয়েছিল। কান্ত ঘুম থেকে উঠে এসে দেখত তার আসার অনেক আগেই নবাব উঠে পড়েছে। উঠে ঘরের কোণের অলিন্দ দিয়ে বাইরের দিকে চেয়ে রয়েছে। তখনও সূর্য ওঠেনি। অনেক দূরের ধানখেত খাঁ খাঁ করছে, এই লড়াইয়ের জন্যে চাষারা গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছে, কেউ চাষ করতে পারেনি। তার ওপাশে গঙ্গা, তার ওপাশে ঝাপসা ঝাপসা দেখা যায় গাছের সার। এক ঝাঁক পাখি উড়ে আসছে আকাশ চিরে। তার ওপাশে একেবারে অন্ধকার, ওদিকের আকাশটাতে তখনও পুবের আলো পৌঁছোত পারেনি। সেই দিকে চেয়ে নবাব কী ভাবে কে জানে। কান্ত ভেবেছিল আবার বাইরে ফিরে যাবে, কিন্তু যায়নি। বেশ লাগত নবাবকে দেখতে, নবাবের কাছে কাছে থাকতে।

কে?

যেদিন নানিবেগম মরালীর সঙ্গে প্রথম ছাউনিতে এল সেদিন তার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল পড়তে দেখেছে কান্ত!

তুই কত রোগা হয়ে গেছিস মির্জা? তুই কত শুকিয়ে গেছিস? খাওয়াদাওয়া করিস না বুঝি ঠিকমতো?

নবাব হেসেছিল শুধু নানিবেগমের কথা শুনে। যেন ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করলেই শরীর ভাল হয়। আশ্চর্য, কান্ত যদি এই চাকরিতে না আসত তো জানতেই পারত না যে, নবাব বাদশাদেরও দুঃখ থাকতে পারে। জানতেও পারত না যে, বাইরে যাদের সবাই হিংসে করে, যাদের অর্থ, নাম, ঐশ্বর্য লোককে লোভ দেখায়, তাদেরও খিধে থাকে না, তারাও রাত্রে ভাবনায় ঘুমোত পারে না। বুঝতেও পারত না যে, তাদেরও কষ্ট আছে, তারাও আমাদের গরিব লোকদের মতো যন্ত্রণায় ছটফট করে। সত্যিই সেদিন বাংলা মুলুকের নবাবকে অত কাছাকাছি থেকে দেখেছিল বলেই আর কোনওদিন তার মনের মধ্যে লোভ এল না। টাকার লোভ, নামের লোভশান্তির লোভ, সুখের লোভ। অনেকে কান্তকে পাগল বলেছে। বলেছে, তুই নবাবের অত কাছাকাছি ছিলিনবাবের কাছ থেকে কিছু বাগিয়ে নিতে পারলি না? ওরা জানে না যে, দেবার মালিক নবাব নয়, দেবার মালিক বাদশাও নয়। নিতে গেলে আগে নেবার যোগ্য হতে হয়। সবাই কি নিতে পারে? আলিবর্দি খাঁ তো মসনদ দিয়ে গিয়েছিল নবাব মির্জা মহম্মদকে, নবাব কি রাখতে পারলে? চাইতেই যদি হয়, তো চাইব এমন কিছু যা রাখা যায়, যা হারায় না, যা থাকে! যা পেয়ে হারাবার ভয়ে কাতর হব না, যা পেয়ে বলতে পারব–এ আমার, এ আমার চিরকালের ধন। এ পাওয়া আমার কেউ কেড়ে নিতে পারবে না, এই পাওয়াই আমার সত্যিকারের প্রাপ্তি।

যাক এসব কথা!

সেদিন নবাবের চেহারা কিন্তু অন্য রকম হয়ে গিয়েছিল। সেই নন্দকুমার, যাকে আলিবর্দি খাঁ এত ভালবাসত, যাকে খুশি হয়ে হুগলির ফৌজদার করে দিয়েছিল, সেই নন্দকুমার এমন করে বিশ্বাসঘাতকতা করবে। অথচ বাইরে পুরোপুরি হিন্দু ব্রাহ্মণ। নিয়ম করে পুজো করে, আহ্নিক করে, জপ করে, তপ করে, সেই নন্দকুমার?

আমার কথায় বিশ্বাস করুন জাঁহাপনা, আপনার কাছে ভুল খবর দিয়েছে কেউ!

কিন্তু উমিচাঁদের হাতের লেখাও ভুল?

উমিচাঁদ পাশ থেকে বললে–আমার হাতের লেখা আগেও একবার জাল হয়েছিল জাঁহাপনা, এবারও জাল হবে না তার কী প্রমাণ?

এ যদি জাল হয় তো তুমিও জাল উমিচাঁদ! আর, আমিও জাল। এই বাংলা মুলুক, যে মুলুকের নবাব আমি, তাও জাল! তোমরা কি বলতে চাও বাংলা মুলুকের নবাব বলে কেউ নেই? ফরাসিরা বাংলা মুলুকের নবাব হয়ে গেছে? তোমরা কি বলতে চাও দিল্লির বাদশা তোমাদের সনদ দিয়েছে? তোমরা কি বলতে চাও আমি মসনদ ছেড়ে কান্দাহার পালিয়ে গেছি পাঠানদের ভয়ে? আমার নিজের নামে আমার সনদ বরবাদ করে দিয়েছে দিল্লির বাদশা? বলতে চাও দিল্লির বাদশা আহমদ-শা-আবদালি?

দরবারের মধ্যে থমথম করছে সমস্ত আবহাওয়াটা। যেনবাব ভাল করে খায় না, ভাল করে ঘুমোয় না, বাইরের নিঃশব্দ নিঝুম আকাশটার দিকে চেয়ে চুপ করে থাকে, তার গলায় যেন বাজ ভেঙে পড়ল। যারা আশেপাশে ছিল, সবাই চমকে উঠল গলার শব্দে।

ছাউনির ভেতরে সমস্ত কথাই কানে যাচ্ছিল মরালীর। নানিবেগমের কানেও যাচ্ছিল। মরালী আর থাকতে পারল না।

বললে–আমি যাই নানিজি!

নানিবেগম বললেওমা, তুই কোথায় যাবি? দরবারের মধ্যে যাবি নাকি?

হা নানিজি, ওরা তোমার মির্জাকে বিশ্বাস করছে না। শুনছ না?

তা তুই দরবারের ভেতরে গেলেই কি বিশ্বাস করবে ওরা?

হা, আমি ওদের বিশ্বাস করিয়ে দেব ওরা সবাই জোচ্চোর, ওরা সবাই ঠগ।

তা তুই কী করে বিশ্বাস করাবি ওদের?

তার তরিখা আমি জানি! তাতেও যদি ওরা বিশ্বাস না করে, আমি ওদের মুখের ওপর সাত জুতো মারব, তখন ওরা বাপ বাপ বলে স্বীকার করবে।

কিন্তু বেগম হয়ে দরবারের মধ্যে যাবি কী করে? মির্জা কী বলবে?

মরালী বললে–কেন, আমি তো ক্লাইভ সাহেবের ছাউনিতে গিয়েছিলাম, তোমার মির্জা কিছু বলেছে?

বলে আর দাঁড়াল না। তাড়াতাড়ি বোরখাটা পরে নিলে। তারপর ছাউনির পরদাটা ফাঁক করে দরবারের ভেতর ঢুকল।

*

কোথায় কবে কখন কেমন করে কার ভাগ্যোদয় হয় কে বলতে পারে। যেদিন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সমুদ্রের ওপর কাঠের পালতোলা জাহাজ ভাসিয়ে বাংলা মুলুকে এসে নামল তখন সে ছেলেটা জন্মায়নি। সেই নবকৃষ্ণ। একদিন বড় হয়ে যখন চোখ ফুটল, তখন দেখলে দিল্লির বাদশার ফার্মানের কোনও দামই নেই। কোথা থেকে কোন ম্লেচ্ছ জাতের লোকেরা এসে কলকাতায় বেশ আসর জাকিয়ে বসেছে। নয়ানঠাদ মল্লিকের ভাড়াটে বাড়িতে গোরা সাহেবরা থাকত। সেখানে নবাবের আমির-ওমরাওরা আসত পালকি চড়ে। অনেক রাত পর্যন্ত খানাপিনা চলত, হইহুল্লোড়ের শব্দ কানে আসত। কটা আর লোক তখন শহরে। মিউনিসিপ্যালিটি করেছে, হলওয়েলসাহেব তখন ছিল তার বড়কর্তা। তখন থেকেই ছেলেটা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখত সেদিকে। গঙ্গার ধারে গিয়ে জাহাজের মাল ওঠানামা দেখত।

ছোট চাকরি নবকৃষ্ণের। পোস্তার রাজার দাদামশাইয়ের বাড়িতে সামান্য মুনশির চাকরি। লক্ষ্মীকান্ত ধর মশাইকে লোকে বলত নকু ধর। নকু ধর মশাইয়ের কারবার ইংরেজ কোম্পানির সঙ্গে। কোম্পানিকে টাকা দিতে হত। মাল বন্ধক রেখে টাকার সুদ আদায় করতে হত। জাহাজঘাটায় কোম্পানির সাহেবদের সঙ্গে দেখা করতে কে যাবে?

নবকৃষ্ণ বলত–আমি যাব কর্তা!

ফুটফুটে ছেলেটা। বেশ বিনয়ী। নম্র ভদ্র গরিব। নকু ধর মশাই বেশ পছন্দ করতেন।

বলতেন–মুহুরিমশাই, ওইনবকেই পাঠাও

সে-সব অনেক দিন আগেকার কথা। কোম্পানির ঘাটে তখন কোম্পানির মাল ছাড়া আরও অনেকের মাল ওঠানামা করত। হুজুরিমল, বৈষ্ণবচরণ শেঠ, বেভারিজ সাহেব, পোস্তার রাজবাড়ির বাবুদের মালও নামত ওখানে। ছেলেটার চোখের সামনে সব ঘটেছে। একদিন কোম্পানির ঘাট ভেসে গেল জোয়ারের জলে। তখন নতুন ঘাট তৈরি করতে হল। সাহেবরা নিয়ম করে দিলে, যে-মহাজন কোম্পানির ঘাটে মাল ওঠাবে-নামাবে তাকে মাশুল দিতে হবে। নকু ধর মশাই বললেন–তা হলে আমরা নিজের ঘাট তৈরি করব।

তা তা-ই হল। একে একে নতুন ঘাট তৈরি হতে লাগল গঙ্গার ধারে ধারে। দপাল ঘাট, কাশীনাথ ঘাট, ব্যাবেটোর ঘাট, জ্যাকসন ঘাট, কোর সানস ঘাট, ব্লইথার ঘাট, হুজুরিমল ঘাট। তারপর হল বাজার। শোভাবাজার, চার্লস বাজার, হাটখোলার বাজার, ঘাসটোলার বাজার।

ছেলেটার চোখের সামনে যেন আরব্য-উপন্যাস ঘটে যেতে লাগল। কেবল মনে হত জীবনটা নষ্ট হয়ে যেতে বসেছে নকু ধরের সেরেস্তার চারটে মধ্যে। কেবল ছটফট করত বাইরে বেরিয়ে যাবার জন্যে। যদি একটা চাকরি মেলে সাহেবদের দফতরে, তা হলে যেন জীবনটা ধন্য হয়ে যায়।

জাহাজঘাটায় কোম্পানির জাহাজ এসে নামত আর সাহেব দেখলেই মাথা নিচু করে সেলাম করত।

বলত সেলাম সাহেব

একটু একটু ইংরেজি বলতেও শিখেছিল শেষের দিকে। তখন বলত–গুড মর্নিং স্যার–

সত্যিই, কোথায় কবে কখন কেমন করে কার ভাগ্যোদয় হয়, কে বলতে পারে! রাজা রাজবল্লভ যখন কলকাতায় এসেছিল, তখন নবকৃষ্ণ নিজের দুঃখের কথা শুনিয়েছিল। বলেছিল–আপনার তো সাহেবদের সঙ্গে খুব দোস্তি আছে দেওয়ানমশাই, আমাকে একটা চাকরি করে দিন-না দফতরে–

রাজা রাজবল্লভের বোধহয় দয়া হয়েছিল। বললে–কী কাজ জানো তুমি?

নবকৃষ্ণ বলেছিল–আজ্ঞে সব কাজ জানি

ফিরিঙ্গিরা গোরু খায়, জানো তো?

আজ্ঞে খুব জানি, সে তো মুসলমানরাও খায়। তাতে আর আমার কী? দফতর থেকে কাজ করে এসে গঙ্গায় চান করে নিলেই হল!

লেখাপড়া জানো?

আজ্ঞে শুভঙ্করী জানি।

আর ফারসি?

ফারসি লিখতে পারি, পড়তে পারি

কথাটা মনে ছিল দেওয়ানজির। উমিচাঁদের সঙ্গে যখন রাজা রাজবল্লভের কথা হল তখন ইংরেজরা ফারসি-জানা লোক খুঁজছে। মুনশি কাজিউদ্দিন আছে বটে, কিন্তু সে তো মুসলমান। দেওয়ান রামচাঁদও আছে। কিন্তু মুর্শিদাবাদের হিন্দু তামির-ওমরাওরা, হিন্দু জমিদাররা যেনবাবের উচ্ছেদ চায়, তারা যে ইংরেজদের মদত দেবে, সে-চিঠি যাকে-তাকে দিয়ে তর্জমা করানো যায় না। বেশ বিশ্বাসী মুনশি চাই।

ক্লাইভ জিজ্ঞাসা করেছিল–তেমন বিশ্বাসী হিন্দু মুনশি কোথায় পাব?

উমিচাঁদ বলেছিল–আমি তোমাদের দেব সাহেব।

 কী নাম তার?

 নবকৃষ্ণ!

তাই উদ্ধব দাসও লিখেছে তার কাব্যে কোথায় কবে কখন কেমন করে কার ভাগ্যোদয় হয় কে বলতে পারে। নবকৃষ্ণ ছিল নকু ধরের সেরেস্তার কর্মচারী, একেবারে সেই দিন থেকে হয়ে গেল ইংরেজ দফতরের মুনশি! তারপর থেকে যত চিঠি উমিচাঁদ লিখেছে, মিরজাফর লিখেছে; সব তর্জমা করে দিয়েছে নবকৃষ্ণ। রামচাঁদের তখন আর ডাক পড়ে না। সব কাজে ডাক পড়ে নবকৃষ্ণের।

সেদিন আবার নবকৃষ্ণের ডাক পড়ল পেরিন সাহেবের বাগানে। নবকৃষ্ণ গিয়ে আভূমি সেলাম করে দাঁড়াল।

মুনশি, আমি ভীষণ বিপদে পড়েছি, তোমাকে বাঁচাতে হবে। ক্যান ইউ সেভ মি?

মুনশি বললে–আমি তো তুজবের নিমক খেয়েছি সাহেব, হুজুর যা হুকুম করবেন তা-ই করব–

আমার একটা ইস্পট্যান্ট লেটার চুরি হয়ে গেছে।

কে চুরি করেছে হুজুর? আমাকে নাম বলে দিন, আমি তার গলায় গামছা দিয়ে হুজুরের সামনে ধরে নিয়ে আসব।

না, তা নয়, শোনো

 ভগবান বুদ্ধি দিয়েছিল মুনশি নবকৃষ্ণকে অকারণে নয়। কিংবা হয়তো ইতিহাসের প্রয়োজনেই নবকৃষ্ণের আবির্ভাব অনিবার্য হয়েছিল। নইলে নকু ধরের সেরেস্তায় পড়ে থাকলে বুদ্ধির খেলা দেখাবার সুযোগই মিলত না তার জীবনে।

সব শুনে মুনশি বললে–ঠিক আছে হুজুর, আমি এখুনি যাচ্ছি—

কিন্তু হুগলির ফৌজদার সেখানে হাজির রয়েছে, উমিচাঁদও হাজির রয়েছে, সেটা যেন মনে থাকে–আর মরিয়ম বেগমও সেখানেই আছে, সেটাও যেন মনে থাকে–

মুনশি বললে–হাজার হোক হুজুর, মরিয়ম বেগমসাহেবা তো মেয়েমানুষ বই আর কিছু নয় মেয়েমানুষের বুদ্ধির কাছে মুনশি নবকৃষ্ণ হেরে যাবে না, এটা নিশ্চয় জানবেন!

না না মুনশি, তুমি মরিয়ম বেগমকে চেনো না। ভারী ক্লেভার, ভেরি শুড গার্ল–খুব সাবধানে কথা বলবে তুমি।

মুনশি বললে–আমি হুজুরের নুন খেয়েছি, আমাকে সেকথা বলতে হবে না দরকার হলে আমি বেগমের পা জড়িয়ে ধরব

সেকী? তুমি মুসলমান মেয়ের পা জড়িয়ে ধরবে?

কেন হুজুর? আপনি আমাকে এক্ষুনি হুকুম করুন, পা জড়িয়ে ধরা দূরের কথা, আমি মরিয়ম বেগমের পা চেটে আসব। হুজুরদের জন্যে যদি তা করতে হয় তো তাও করব

তা হলে তুমি এক্ষুনি চলে যাও মুনশি, তোমার ওপর আমার কোম্পানির একজিস্টেনস নির্ভর করছে। যদি এই কাজটা তুমি করতে পারো মুনশি তো ইংলন্ডের প্রাইম মিনিস্টার মিস্টার পিটকে তোমার কথা লিখে দেব, তোমাকে আমি রিওয়ার্ড দেব আর বাক্যব্যয় না করে মুনশি বেরিয়ে গেল।

এতক্ষণ ওয়াটসন কিছু বলেনি। এবার ক্লাইভের দিকে চেয়ে হেসে বললে–এরাই হল রিয়্যাল ইন্ডিয়ান, রবার্ট, এরা টাকার জন্যে সব করতে পারে। বেগমের পা পর্যন্ত চাটতে পারে। আমরা রাইট-ম্যান পেয়েছি, উমিচাঁদ আমাদের রাইট-ম্যান দিয়েছে, দি স্কাউড্রেল!

*

১৭৩৯ সালে নাদির শা দিল্লির সিংহাসনে মাত্র আটান্ন দিন রাজত্ব করে চার কোটি টাকা নিয়ে নিজের দেশে ফিরে গিয়েছিল। মহীশুরের রাজার শ্বশুর জামাইয়ের সব ইয়ার বন্ধুদের নাক কেটে দিয়ে সকলের সামনে তাদের অপমান করেছিল। হিন্দুস্থানের আসল মালিক কে তারই ঠিক নেই তখন! মালিক দিল্লির বাদশা না হায়দার আলি না জেনারেল বুশি না নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলা–তারও কোনও হিসেব-নিকেশ হয়নি! সুতরাং কোম্পানির কদরদান খিদমদগার যদি হতে চাও তো নবাবের পা চাটো, নবাবের বেগমের পা-ও চাটো, দরকার হলে অ্যাডমিরাল ওয়াটসন, রবার্ট ক্লাইভের পা-ও চাটো। তাতে হিন্দুস্থানের ভাল না হোক তোমার নিজের তত ভাল হবে। হিন্দুস্থানের ভালর কথা ভাবার দরকার নেই, সে খোদাতালাহু ভাবুক। তুমি তোমার নিজের ভালর কথা আগে ভাবো। যে হিন্দুস্থানের মালিক হবে সে তোমাকে বাংলা মুলুকের মালিক বানিয়ে দেবে। তারই ভজনা করো।

মুনশি নবকৃষ্ণ যখন নবাবের ছাউনিতে পৌঁছোল তখন চারদিকে বেশ উত্তেজনার ফেনা ছড়িয়ে গেছে। এমনিতে মুনশি নবকৃষ্ণ আগে কখনও নবাবের দরবারে যায়নি। দরবারি কায়দা কানুন জেনেছে, শিখেছে নকু ধর মশাইয়ের সেরেস্তায় কাজকর্ম করবার সময়, অনেকবার নিজামতের আমির-ওমরাওদের সঙ্গে মুলাকাত করতে হয়েছে, সেরেস্তার কাজে বাৰুদের হয়ে কথাবার্তা চালিয়েছে। কিন্তু নিজেকে বড় ছোট মনে হয়েছে। মনে হয়েছে, সকলে যেন বড় নিচু নজরে দেখছে। তাকে। তারপর সুতানুটি গোবিন্দপুর কত বড় হয়েছে, সাহেবরা আস্তে আস্তে শহরে আঁকিয়ে বসেছে। কিন্তু নবকৃষ্ণ যে-কে-সেই রয়ে গেছে। সেই খাতাবগলে সেরেস্তায় যাওয়া আর আসা।

কিন্তু এতদিন পরে কোম্পানির চাকরি পাওয়াতে চোখের সামনে আবার একটু আশার আলো ফুটে উঠেছে।

বাবু শুনে খুশিই হয়েছিল। বলেছিল–ধর্মটা বজায় রেখে কাজ কোরো নবকৃষ্ণ, তা হলে ধর্মও থাকবে, ওদিকে টাকাও হাতে আসবে–

তা ধর্ম রাখতে কায়স্থ বংশের ছেলে নবকৃষ্ণ জানে। ধরমশাইরা সুবর্ণ বণিক। কতদিন চাকরি করেছে সেখানে, কিন্তু কেউ বলতে পারে না নবকৃষ্ণ কোনওদিন ধর্ম খুইয়ে চাকরি বজায় রেখেছে। রোজ চটিজোড়া বাইরে রেখে কাছারিতে ঢুকেছে, আবার কাছারি থেকে ফেরবার সময় চটিজোড়া পরে বাড়িতে এসেছে। বেনের ছোঁওয়া এক ফোঁটা জল পর্যন্ত খায়নি সেখানে। আবার এখানেও তাই। এখানেও কোম্পানির সেরেস্তা। কোম্পানির মুসলমান মুনশি কাজিউদ্দিন সাহেব একটু একটু বিষনজরে দেখতে আরম্ভ করেছিল নবকৃষ্ণকে। কিন্ত নবকৃষ্ণর জানা আছে, পরের কাছে নিজেকে ছোট করার মধ্যে অসুবিধে যতই থাক, সুবিধেটাই বেশি। না হয় ছোটই হলুম তোমার চোখে, কিন্তু আসলে তো ছোট হলুম না। নিজের কাজ গুছিয়ে নেবার পর তখন তুমি যতই ছোট করবার চেষ্টা করো না কেন, তখন আর আমাকে ছোট করতে পারবে না।

সেদিন সিংহবাহিনীর মূর্তির সামনে অনেকক্ষণ ধরে নবকৃষ্ণ চোখ বুজে সেই প্রার্থনাই করেছিল।

বলেছি–হে মা, তোমার কাছে আর কিছু চাইনে আমি। আমাকে শুধু অগাধ টাকা দিয়ে। টাকার জন্যে এতদিন অনেকের পায়ে ধরনা দিয়েছি, আর পারছিনে ধরনা দিতে। এমন সুযোগ জীবনে আসবে না আর। ওদিকে নবাবের বিপদ, এদিকে কোম্পানিরও বিপদ। এমন বিপদের দিনেই তো সুযোগ আসে মানুষের জীবনে। বিপদ আছে বলেই তো কোম্পানির ফিরিঙ্গিরা আমার মুঠোর মধ্যে এসেছে। বিপদ চলে গেলে কি আর আমাকে পুঁছবে, মা? আমাকে তখন লাথি মেরে তাড়িয়ে দেবে কুকুর বেড়ালের মতো। তাই বলছি, ওদের বিপদ থাকতে থাকতে আমার একটা কিছু হিল্লে করে দাও মা আমি তোমার মাথায় হিরের মুকুট, নাকে সোনার নথ করে দেব

কথাটা মা শুনেছিল কি না কে জানে। কিন্তু সেরেস্তায় আসতেই সাহেবের ডাক পড়েছিল। আর তার পরেই এই সুযোগ।

বিরাট ছাউনি নবাবের। দূর থেকে দেখা যায় ছাউনির চূড়া। সার সার ঘোড়া বাঁধা রয়েছে সদরে। মাথার ওপর নিজামতের নিশেন উড়ছে। যেখানে যেখানে নবাব যায়, সঙ্গে যায় সেপাই বরকন্দাজের দল। কাছারির লোকজন থাকে সঙ্গে। বাইজি-বেগমদের তাঁবুও পড়ে। বাবুর্চি, মশালচি, নৌকর, খিদমদগার, সবাই থাকে।

কিন্তু সেদিন যে মুনশি নবকৃষ্ণ সোজা নবাবের দরবারে ঢুকতে পেরেছিল সে চাকরির খাতিরে নয়, সে শুধু উদগ্র উন্নতির কামনায়। যেমন করে হোক, টাকা করতেই হবে। টাকা না হলে কিছুই হবে না জীবনে। টাকা চাই-ই চাই। হুগলির ফৌজদারের টাকা হয়েছে, লক্ষ্মীকান্ত ধরের টাকা হয়েছে, বৈষ্ণবচরণ শেঠের টাকা হয়েছে, নবকৃষ্ণ শেঠেরও টাকা হওয়া চাই। অগাধ টাকা!

নবাবের দরবারে এত্তেলা দিয়ে ঢুকতে হয়।

নবকৃষ্ণ এত্তেলা দিয়ে ঢুকতে যাচ্ছিল, হঠাৎ বোরখা-পরা বেগমসাহেবা এসে দাঁড়াল।

নবকৃষ্ণ পড়ি-কি-মরি করে একেবারে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে কুর্নিশ করে ফেললে। বেগমসাহেবা যে-ই হোক, নবাবের বেগমসাহেবাকে কুর্নিশ করা মানে নবাবকেই কুর্নিশ করা।

মরালী জিজ্ঞেস করলে–তুমি কে?

 নবকৃষ্ণ বললে–বেগমসাহেবা, আমি দাসানুদাস মুনশি নবকৃষ্ণ!

হিন্দু? কাফের?

হা বেগমসাহেবা। অধ। কাফেয়। পেটের দায়ে ফিরিঙ্গি সাহেবের সেরেস্তায় কাজ করি। কিন্তু নবাবের নুন খাই।

নবাবের নুন খাই মানে?

 আজ্ঞে, নবাবের নুন কে না খায়? তামাম হিন্দুস্থানের লোক তো নবাবের নুন খেয়েই বেঁচে আছে।

তুমি এখানে কী করতে এসেছ?

নবকৃষ্ণ বুঝেছিল–এই-ই নিশ্চয় মরিয়ম বেগম। এই মরিয়ম বেগম সম্বন্ধেই সাহেব খুব সাবধান করে দিয়েছিল। কিন্তু এমন করে এত সহজে বেগমসাহেবার সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে ভাবতে পারেনি।

আপনিই কি মরিয়ম বেগমসাহেব হুজুর?

 তুমি আমাকে চেনো?

আপনাকে কে না চেনে বেগমসাহেবা? আমার মনিব ক্লাইভসাহেব আপনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ একেবারে। আমাকে আসবার সময় বলে দিয়েছেন, বেগমসাহেবাকে দেখলেই কুর্নিশ করবে।

তুমি কি ক্লাইভসাহেবের কাছ থেকে আসছ?

হ্যাঁ বেগমসাহেবা। নইলে আর কার কাছ থেকে আসব?

এখানে তোমাকে কী করতে পাঠিয়েছে তোমার সাহেব?

 নবকৃষ্ণ বললে–আপনার সঙ্গে দেখা করতেই পাঠিয়েছে বেগমসাহেবা। বলে পাঠিয়েছে বেগমসাহেবা সাহেবের দফতরে এসেছিলেন কিন্তু কোনও নজরানা দিতে পারেননি। খুব আফশোস করছিলেন। তাই আমাকে এখানে পাঠিয়ে দিলেন সাহেব!

আমি চলে আসার পর কেউ এসেছিল সাহেবের দফতরে?

 কে আবার আসবে বেগমসাহেবা? আমিই এসেছি। আমিই তো সাহেবের খাস মুনশি এখন। আপনি হবের কোনও অপরাধ নেবেন না বেগমসাহেবা। সাহেবের বড় ভুলো মন। আপনি সাহেবের কাছ থেকে তাড়াতাড়ি চলে এলেন তাই নজরানার কথা সাহেব একেবারে ভুলে গেছেন!

পাশ দিয়ে নবাবের চোপদার যাচ্ছিল। মরালী বললে–নৌসের আলি–

নৌসের আলি কুর্নিশ করে সামনে এসে দাঁড়াল।

মরালী বললে–একে ধরো তো-হাত-পা বেঁধে নবাবের সামনে নিয়ে যাও

আজ্ঞে বেগমসাহেবা, আমি তো কিছু করিনি

নৌসের আলি কিন্তু ততক্ষণে বেগমসাহেবার হুকুম তামিল করে ফেলেছে। তারপর আর বেশি কথা না বলে একেবারে দরবারের ভেতরে নিয়ে গেছে।

নবাবের সামনে তখন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে উমিচাঁদ আর নন্দকুমার।

দরজার দিকে চোখ পড়তেই হঠাৎ নবাব দেখলে আর-একজনকে ধরে নিয়ে আসছে নৌসের আলি।

একী?

উত্তরটা আর নৌসের আলিকে দিতে হল না। উত্তর দিলে মরালী।

মরালী বললে–আমিই একে বাঁধবার হুকুম দিয়েছি জাঁহাপনা, এ ফিরিঙ্গিদের চর

এখানে কী করতে এল?

নবকৃষ্ণ একবার উমিচাঁদের দিকে চাইলে, তারপর নন্দকুমারের দিকে। তারপরনবাবের দিকে চেয়ে কেঁদে ফেললে। বললে–আমি চর নই জাঁহাপনা, আমি ক্লাইভসাহেবের মুনশি।

এখানে কী করতে এসেছ?

আমাকে ক্লাইভসাহেব জাঁহাপনার বেগমসাহেবার কাছে মাফ চাইতে পাঠিয়েছিল।

 কীসের মাফ? কী কসুর?

 নবকৃষ্ণ বললে–বেগমসাহেবা মেহেরবানি করে সাহেবের দফতরে গিয়েছিলেন, কিন্তু আমার সাহেব নজরানা দিতে ভুলে গিয়েছিলেন।

মরালী বলে উঠল বাস খতম—

সমস্ত দরবারটা যেন হঠাৎ মরিয়ম বেগমের আবির্ভাবে দপ করে জ্বলে উঠেছিল।

মরালী বললে–চারদিকে সবাই একসঙ্গে জাল পেতেছে জাঁহাপনা, এ-মুনশিও আর এক জাল। ক্লাইভসাহেবের কাছে খবর গেছে যে জাঁহাপনা হুগলির ফৌজদার আর উমিচাঁদকে ডেকে পাঠিয়েছেন, তাই এখানে নিজের মুনশিকে পাঠিয়েছে সবকিছু দেখবার জন্যে।

নবাব কী করবে বুঝতে পারলে না।

মরালী বললে–নানিবেগমসাহেবা বলছেন এখানে এখন দরবার বন্ধ থাক, মুর্শিদাবাদে মতিঝিলে গিয়ে দরবার করবেন জাঁহাপনা। এদের তিনজনকে বনি করে মুর্শিদাবাদে নিয়ে যাওয়াই ঠিক হবে!

ক’দিন ধরে নবাবেরও বিশ্রাম হচ্ছিল না। অগ্রদ্বীপের ঠান্ডায় সমস্ত শরীর-মন যেন জমে গিয়েছিল। বাংলা বিহার ওড়িষ্যার নবাবের সমস্ত দায়িত্ব যেন পাথরের মতো মাথায় বোঝা হয়ে বসেছিল এত সহজে সবকিছুর সমাধান হবার কথা নয়। হয়তো সেই ভাল।

নবাব দরবার ছেড়ে উঠে পড়ল। মরালী আগেই চলে গিয়েছিল। নবাব তার পেছন পেছন পাশের তাঁবুর ভেতর গিয়ে দাঁড়াল।

মরালী তখন বোরখার মুখের ঢাকা খুলে ফেলেছে। একেবারে নবাবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললে–জাঁহাপনা, এখান থেকে তাড়াতাড়ি করে চলুন–নইলে আবার এক ষড়যন্ত্রের মধ্যে জড়িয়ে পড়ব আমরা

নানিবেগমসাহেবাও এতক্ষণ সব শুনেছে ভেতর থেকে।

বললে–চল মির্জা, এখান থেকে চলে যাই আমরা

কিন্তু কেন চলে যাব নানিজি! এ-ও তো আমার তালুক, এ-ও তো আমার মুলুক! আমিই তো এই মুলুকের নবাব!

মরালী বললে–এরা সবাই জাঁহাপনার দুশমন, এদের কাছে ফিরিঙ্গিদের আড্ডা। নন্দকুমার, উমিচাঁদ, নবকৃষ্ণ এই তিন শয়তানকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলে আর কোনও ভয় নেই জাঁহাপনার–

কিন্তু আমি আজই নন্দকুমারকে বরখাস্ত করে দিতে চাই!

এখন বরখাস্ত করে দিলে ফল ভাল হবে না জাঁহাপনা। ও খোলাখুলি ক্লাইভের দলে গিয়ে জুটবে। তার চেয়ে ওদের সকলকে কোতোয়ালিতে জমা করে দিন। সব ঠান্ডা হয়ে যাবে!

কিন্তু এই মুনশিটি?

মরালী বললে–আমি ক্লাইভসাহেবের দফতর থেকে যে-চিঠি চুরি করে এনেছি সেইটে নিতে এসেছে ও

এতদূর সাহস হবে ক্লাইভের?

 আপনি কি ক্লাইভকে এখনও চেনেননি জাঁহাপনা?

কিন্তু মিরজাফর যে অন্য কথা বলেছে! ওরা নাকি খুব ইমানদার জাত!

মিরজাফর আলি সাহেবকেও তো জাঁহাপনা ভাল করে চিনেছেন! ওদের তিনজনকেই হাতে হাতকড়া দিয়ে বেঁধে মুর্শিদাবাদে ধরে নিয়ে চলুন। ওদের ধরলে ক্লাইভসাহেব ভয় পেয়ে যাবে, চন্দননগরে হামলা করতে আর এগোবে না–আমি বলছি, আপনি নিয়ে চলুন জাঁহাপনা

কিন্তু এ-সময়ে ওদের চটানো কি ভাল হবে, তাই ভাবছি!

মরালী বললে–কিন্তু জীবনে কখনও কি ভাল সময় পেয়েছেন আপনি জাঁহাপনা? জীবনে ধীরে সুস্থে নিশ্চিন্তে কাজ করবার মতো সময়? আপনার দাদামশাই-ই কি পেয়েছেন তেমন সময়? জীবনে কেউ কি তা পায়? দিল্লির বাদশাও কি কখনও তা পেয়েছে?

নানিবেগম কথাগুলো চুপ করে শুনছিল।

নবাব মরিয়ম বেগমের কে অবাক হয়ে চেয়ে রইল।

বললে–জীবন সম্বন্ধে তুমি এত কথা জানলে কী করে বেগমসাহেবা? কে তোমাকে এত কথা শেখাল? কত বছর বয়সে তোমার বিয়ে হয়েছিল?

সে-সব কথা থাক আলি জাঁহা!

না, বলো তুমি, আমার অন্য বেগমরা তো এমন করে কখনও বলেনি! তারা তো এসব কথা জানে না, এসব কথা ভাবেও না!

মরালী বললে–এত নরম হবেন না আলি জাঁহা, এত নরম হলে মসনদ চালাতে পারবেন না

কেবল মসনদ আর মসনদ! আর মসনদের কথা ভাবতে ভাল লাগে না আমার। এখন শুধু বাঁচতে ইচ্ছে করে–

কিন্তু আপনার ওকথা বলা সাজে না জাঁহাপনা! হিন্দুস্থানের লাখ লাখ মানুষ যে আপনার মুখের দিকে চেয়ে আছে!

নবাব আরও অবাক হয়ে গেল। বললে–সত্যি বলো না, কোত্থেকে এসব কথা শিখলে তুমি? কে শেখালে তোমাকে?

মরালী বললে–আমার কথা থাক আলি জাঁহা, আমি সামান্য মেয়ে, আমি কিছুই নই—

না না, বলো তুমি। তোমাকে বলতেই হবে!

মরালী বললে–ওদিকে দরবারে ওরা সব আপনার হুকুমের জন্যে অপেক্ষা করছে যে—

করুক অপেক্ষা। ওদের অপেক্ষা করা অভ্যেস আছে! তুমি বলো!

আলি জাঁহা কি এসব কথা আগে কারও কাছে শোনেননি?

না, এমন করে কেউ বলেনি।

সেকী! আপনার কত মৌলবি রয়েছে, কত পণ্ডিত আছে, আপনার কাছ থেকে তখা পেয়ে কত লোক কোরান নকল করছে, গীতা নকল করছে…

নবাব বললে–সে তাদের পেশা বেগমসাহেবা, তাই করেই তারা রুজি-রোজগার করে—

আলি জাঁহা কি কখনও সে-সব পড়েও দেখেননি? মৌলবিদের ডেকে সে-সব কথাও শোনেননি?

নবাব বললে–ছোটবেলা থেকে আমি বখে গিয়েছিলাম বেগমসাহেবা, আমি ভাল ভাল গজল শুনেছি, ঠুংরি শুনেছি, ভাল ভাল নাচ দেখেছি, ভাল ভাল ভোয়াইফ আনিয়েছি দিল্লি থেকে, তাদের সঙ্গে এক বিছানায় রাত কাটিয়েছি, আর কিছু জানবার সময় পাইনি, জিন্দগির যে আরও একটা অন্য দিক আছে তা কখনও ভাবিনি–

কিন্তু কোরান? কোরানও কখনও পড়েননি?

 নবাব বললে–না

নানিবেগম শুনছিল। বললে–আমি কতবার পড়িয়ে শুনিয়েছি মির্জাকে, ও শুনতে চায়নি কেবল দুষ্টুমি করে বেড়িয়েছে রে–

আমার যে তখন কিছুই ভাল লাগত না নানিজি।

মরালী বললে–কিন্তু এখন কেন ভাল লাগছে আলি জাঁহা?

তা জানি না বেগমসাহেবা। ওই যে তুমি বললে, জীবনে ভাল সময় বলে কিছু নেই, কথাটা ভাল লাগল

মরালী বললে–সমুদ্রে যেমন ঢেউ থাকাটাই নিয়ম, জীবনেও তেমনই বিপদ থাকাটাই যে নিয়ম। ঢেউ থামলে তবে স্নান করব যারা বলে, তাদের স্নান করা যে আর হয় না এ-জীবনে!

সত্যি বলো না বেগমসাহেবা, এত কথা কে শেখালে তোমাকে? হাতিয়াগড়ের রাজা? তোমার খসম?

না।

 তবে? মৌলবিসাহেব? তোমাদের পুরোহিত?

 না আলি জাঁহা!

তবে কে?

মরালী বললে–আমার এক পিসি ছিল, তার নাম নয়ানপিসি, আমাকে রামায়ণ-মহাভারত পড়ে শোনাত, তার কাছেই সব শিখেছি

আমাকে একবার শোনাতে পারো বেগমসাহেৰা? তাকে একবার নিয়ে আসতে পারো আমার চেহেলসূতুনে?

মরালী হাসল। বললেনা আলি জাঁহা, আমি নাহয় জাত দিয়েছি, কিন্তু সবাই জাত দেবে কেন?

কিন্তু আমার চেহেল্‌-সুতুনে এলেই তার জাত যাবে? 

যাবে। আমাদের হিন্দুদের জাত বড় ঠুনকো জিনিস আলি জাঁহা, বড় সহজে জাত চলে যায়।

তারপর একটু থেমে বললে–কিন্তু আর একজনের কাছে আমি অনেক শিখেছি আলি জাঁহা

 কে সে?

সে একজন কবি, আলি জাঁহা। গান লেখে!

 হাফিজ?

না।

তবে? কবীর? কবীরের দোঁহা?

মরালী বললে–না, এর তত নাম নেই। এ রাস্তায় রাস্তায় বাউন্ডুলের মতো ঘুরে বেড়ায়, এর ঘর নেই, বাড়ি নেই, জাত নেই, ধর্মও নেই।

কোথায় থাকে সে?

মরালী বললেতারও কোনও ঠিক নেই। সবাই তাকে পাগল বলে জানে। কিন্তু তার গান শুনে আমি অনেক শিখেছি আলি জাঁহা, আমি যা-কিছু বলছি সবই তার গান শুনে?

তা হলে তাকে ডেকে আনো একদিন।

মরালী বললে–যদি কোনওদিন সুযোগ হয় আলি জাঁহা তো ডাকব তাকে, ডেকে আপনাকেও তার গান শোনাব–শুনলে আপনিও শান্তি পাবেন আমার মতো!

তার নাম কী?

মরালী বললে–সে নিজে বলে সে হরির দাস–ভক্ত হরিদাস

কান্ত এতক্ষণ আড়ালে দাঁড়িয়ে সব শুনছিল। উদ্ধব দাসের কথাটা উঠতেই শিউরে উঠল। মরালী উদ্ধব দাসের কথা তা হলে মনে রেখেছে! এত শ্রদ্ধা করে মরালী উদ্ধব দাসকে? মরালীকে যেন নতুন দৃষ্টি দিয়ে দেখতে পেলে কান্ত! এমন তো ভাবেনি সে।

ঘর ছেড়ে নবাব পাশের ঘরে যেতেই কান্ত সচেতন হয়ে সরে এসেছে। নৌসের আলি তখনও দরবারঘরে মুনশি নবকৃষ্ণকে ধরে রেখেছে। ভেতর থেকে নবাব হুকুম দিয়ে দিয়েছিল, উমিচাঁদ আর নন্দকুমারকেও বন্দি করে মুর্শিদাবাদে নিয়ে যেতে হবে। সেখানেই বিচার হবে তিনজনের।

উমিচাঁদের দাড়ির ভেতরেও দাতে দাঁত চাপার শব্দ হল। হুগলির ফৌজদার সাহেব নন্দকুমার অসহায়ের মতো চাইলে উমিচাঁদের দিকে।

চুপি চুপি বললে–কী হবে উমিচাঁদসাহেব? আপনার চিঠি মরিয়ম বেগমসাহেবার হাতে কী করে পড়ল?

মুনশি নবকৃষ্ণের কানে কথাটা গেল।

 বললে–আমাদের কোতল করবে নাকি উমিচাঁদসাহেব? আমি কী করেছি?

উমিচাঁদের মুখে কোনও ভাষা নেই বটে, কিন্তু চোখ দেখে বোঝা গেল অপমানে সমস্ত বুকটা যেন পুড়ে যাচ্ছে। যেন মরিয়ম বেগমসাহেবাকে সামনে পেলে দাঁত দিয়ে কামড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে।

নবাব দরবারে ঢুকতেই সবাই স্থির হয়ে দাঁড়াল।

নবাব বললে–আমরা আজই মুর্শিদাবাদে রওনা দিচ্ছি উমিচাঁদসাহেব, আপনাদের তিনজনকেও হাতকড়া বাঁধা অবস্থায় যেতে হবে আমার সঙ্গে

বলেই নবাব আবার চলে যাচ্ছিল। উমিচাঁদসাহেব হঠাৎ পেছন থেকে বললে–তা হলে কি বুঝব আমরা জাঁহাপনার বন্দি?

আমার কথার সেই মানেই তো দাঁড়ায়।

বলে আর দাঁড়াল না সেখানে নবাব। তাড়াতাড়ি পাশের তাঁবুতে গিয়ে ঢুকল। আর তার একটু পরেই ছাউনির মধ্যে চারদিকে সাজ সাজ রব পড়ে গেল। আবার ছুটোছুটি, আবার হাঁকডাক, আবার নাকাড়া বাজিয়ে সকলকে হুঁশিয়ার করে দেওয়া হল। ওঠো ওঠো, তল্পি গুটোও। হাতি ঘোড়া সাজাও। মির্জা মহম্মদ হায়াৎ খাঁ সিরাজ-উ-দ্দৌলা আলমগির বাহাদুর কী ফতে! জিগিরে জিগিরে আকাশ ফেটে চৌচির হয়ে গেল।

একটু নিরিবিলি পেতেই উমিচাঁদ বললে–অনেকদিন সহ্য করা হয়েছে নন্দকুমার, এবার আর দেরি করা নয়, এবার ওকে খতম করতে হবে

নন্দকুমার চুপি চুপি জিজ্ঞেস করলে–কাকে উমিচাঁদসাহেব?

মরিয়ম বেগমসাহেবাকে!

 মুনশি নবকৃষ্ণ চমকে উঠল নামটা শুনে। তার মাথার লম্বা টিকিটাও সঙ্গে সঙ্গে কেঁপে উঠেছে।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন