৪০. ধর্মের সমাপ্তি

কাজী মাহবুব হাসান

নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহটি যখন ফিরে আসে, সেই সময়টিকে আমার কুকুর খুবই অপছন্দ করে। যেখানে আমি থাকি তার কাছেই বাগান আর পার্কে মানুষ আতশবাজি ফোঁটায় গভীর রাত অবধি। এই শব্দ শুনে আমার কুকুর ডেইজি ভয়ে কেঁপে ওঠে। আর তাকে আক্রমণ করা এই শত্রুটির কাছ থেকে পালাতে সে আমার স্টাডির কার্পেটে গর্ত খুঁড়তে চেষ্টা করে। অবশ্যই সে কোনো বিপদে নেই, কিন্তু আমি বিষয়টি তাকে বোঝাতে পারব না। তার সেই জিনিসটি আছে যাকে বলা হয়, হাইপারঅ্যাকটিভ এজেন্সি ডিটেকশন ডিভাইস (বা HADD)। সে একটি হুমকি শনাক্ত করছে যার কোনো অস্তিত্ব নেই। এটি আমাদের যে-কারো ক্ষেত্রেই হতে পারে। উপরের ঘরের মেঝেতে হঠাৎ করে কোনো শব্দ হলে আমরা একজন আগন্তুক অনুপ্রবেশকারীকে কল্পনা করি। তারপর আমাদের মস্তিষ্কের যৌক্তিক অংশ সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং আমরা অনুধাবন করি যে, হঠাৎ দমকা হওয়া পুরনো মেঝের কাঠ খানিকটা নাড়িয়ে দিয়ে গেছে। ডেইজি এভাবে যুক্তি ব্যবহার করতে পারে না। আর সে-কারণে নভেম্বর শুরু আর এর বারুদের ঋতু তার জন্যে আসলেই দুঃস্বপ্নের মতো। উচ্চগ্রামের কোনো শব্দ শুনলে তার প্রত্যুত্তরে তাকে পালাতে হবে–এভাবেই তার মস্তিষ্ক বিষয়টি পূর্বনির্ধারণ করে রেখেছে। আমার কাছ থেকে কোনো ধরনের ব্যাখ্যাই তাকে বোঝাতে পারবে না যে, আসলেই কেউ তার ক্ষতি করতে আসছে না।

আর ইতিহাসে ডেইজিই একমাত্র প্রাণী নয় যাদের মস্তিষ্কে এই HADD বিবর্তিত হয়েছে। বহু শতাব্দী ধরেই প্রায় পুরো মানবতাকে এটি প্রভাবিত করেছে। ধর্ম এই পৃথিবীর মানুষকে বলেছে কোনো প্রাকৃতিক সূত্র বা আইন নয় বরং অতিপ্রাকৃত শক্তিগুলো এই পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করছে। আর এই ধারণাকে ব্যাখ্যা করে যে-শব্দটি, সেটি হচ্ছে ‘কুসংস্কার’, সেই বিশ্বাসটি, প্রাকৃতিক কোনো কারণ ছাড়াই জাদুর মাধ্যমে কোনোকিছু ঘটতে পারে। আর এইভাবে চিন্তা করার উপায়টিতে পরিবর্তন আসতে শুরু করেছিল সপ্তদশ শতাব্দীতে একটি পর্বের সময়, যা এখন ‘এনলাইটেনমেন্ট’ নামে পরিচিত, যখন এই পৃথিবীতে যা ঘটছে। সেটি ব্যাখ্যার শ্রেষ্ঠতম উপায় হিসাবে বিজ্ঞান কুসংস্কারকে প্রতিস্থাপিত করেছিল। যা-কিছু ঘটে তার একটি কারণ আছে। এনলাইটেনমেন্ট-পর্বের মূলমন্ত্র ছিল ‘জানতে সাহসী হয়ে উঠুন’। কুসংস্কারের কাছে আত্মসমর্পণ করবেন না। কোনো জিনিসের সত্যিকারের কারণটি জানার মতো সাহস করুন। এনলাইটেনমেন্ট পর্বের একটি পরিণতি ছিল মানুষের মনের ওপর অতিপ্রাকৃতিক কুসংস্কাচ্ছন্ন যে ব্যাখ্যাগুলো দৃঢ়ভাবে তাদের প্রভাব ধরে রেখেছিল, সেটি ক্রমশ শিথিল হতে শুরু করেছিল। মানুষের মস্তিষ্কে আলো প্রবেশ করেছিল এবং তারা নিজেরাই চিন্তা করতে শুরু করেছিলেন।

যদি প্রকৃতি কীভাবে কাজ করে সেটি জানতে চাইবার সাহস এনলাইটেনমেন্ট পর্বের অন্যতম একটি তাড়না হয়ে থাকে, তাহলে আরেকটি ছিল বহু শতাব্দী ধরে অব্যাহত ধর্মীয় সহিংসতার প্রতি ঘৃণা প্রকাশ। কুসংস্কার অবশ্যই যথেষ্ট পরিমাণে খারাপ, কিন্তু তার চেয়েও খারাপ হচ্ছে যুদ্ধ। এনলাইটেনমেন্ট পর্বের চিন্তাবিদরা লক্ষ করেছিলেন, ধর্মগুলো কীভাবে সবসময়ই পরস্পরের বিরোধী একটি অবস্থানে থাকে। প্রতিটি ধর্মই মনে করে, একমাত্র তারাই ঈশ্বর-প্রেরিত সত্যটিকে ধারণ করছে, এবং বাকিরা সব প্রতারণা করছে ভ্রান্ত বিশ্বাস ফেরি করে। যখন ধর্ম কোনো-একটি দেশের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ পায়, এটি এর নির্দেশমতো চলতে নির্বিশেষে সবাইকে বাধ্য করার চেষ্টা করে। এটি যথেষ্ট পরিমাণ খারাপ একটি পরিস্থিতি। কিন্তু পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়, যখন একটি দেশে মাত্র দুটি ধর্ম পরস্পরের সাথে প্রতিযোগিতা করে। প্রায় সারাক্ষণই তারা পরস্পরের সাথে সহিংস বিবাদে লিপ্ত থাকে, ঠিক যেভাবে রিফরমেশন-পর্বের সেই সময় থেকে ইউরোপেও একই পরিস্থিতি বিরাজমান ছিল। কিন্তু যদি সেখানে ত্রিশটি ধর্ম থাকে তাহলে যেন মনে হয় তারা সবাই শান্তিতে বসবাস করছেন।

এনলাইটেনমেন্ট এখান থেকে দুটি উপসংহারে পৌঁছেছিল। প্রথমটি ছিল, যত বেশিসংখ্যক ধর্ম একটি সমাজে থাকবে, সেই সমাজ সবার জন্যে অপেক্ষাকৃত বেশি নিরাপদ হবে। সুতরাং শান্তির জন্যে সবচেয়ে সেরা নিশ্চয়তাটি হচ্ছে সবধরনের বৈষম্যকে অবৈধ ঘোষণা করা এবং সহিষ্ণুতার অনুশীলন করা। দ্বিতীয় উপসংহারটি ছিল, যদিও কোনো একটি সমাজে ধর্মের উপস্থিতি সহ্য করা উচিত, কিন্তু কখনোই এটিকে সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ দেওয়া উচিত হবে না। ধর্মীয় নেতাদের কর্তৃত্ব শুধুমাত্র তাদের ধর্মবিশ্বাসী গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা উচিত।

একসময় শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রে এই মূলনীতিটি কঠোরভাবে আরোপ করা হয়েছিল। আমেরিকার সংবিধানের রচয়িতারা ধর্ম নিয়ে এনলাইটেনমন্ট-পর্বের চিন্তাবিদদের ধারণা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। তারা স্মরণ করেছিলেন কীভাবে আমেরিকার প্রথম বসতিস্থাপনকারীরা ইউরোপের ধর্মীয় নিপীড়ন থেকে পালিয়ে এসেছিলেন। এবং তারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন এমন কিছু যেন তাদের প্রতিশ্রুত দেশে পুনরাবৃত্ত না হয়। আর সে-কারণে টমাস জেফারসন, স্বাধীনতার ঘোষণার অন্যতম স্থপতি এবং তরুণ প্রজাতন্ত্রের তৃতীয় প্রেসিডেন্ট, আমেরিকার জনগণকে উপদেশ দিয়েছিলেন, এমন কোনো আইন প্রণয়ন না করতে, যা কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে শ্রদ্ধা করবে অথবা তাদের বিশ্বাসের স্বাধীন অনুশীলনকে নিষিদ্ধ করবে। তাদের উচিত হবে পার্থক্যের একটি দেয়াল নির্মাণ করা, যা চার্চ আর রাষ্ট্রকে পৃথক রাখবে। আর এটাই যুক্তরাষ্ট্রে ভিত্তিমূলক মূলনীতিগুলোর একটিতে পরিণত হয়েছিল।

ইউরোপে পরিস্থিতি আরো বেশি জটিল ছিল, যেখানে বহু শতাব্দী ধরে রাষ্ট্র আর চার্চ পরস্পর সম্পৃক্ত ছিল। কিন্তু এনলাইটেনমেন্ট-পর্বে মুক্ত হওয়া ধারণাগুলো রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে ধর্মের কর্তৃত্বকে খর্ব করতে শুরু করেছিল। এবং একটি সময়ে রাষ্ট্র এবং চার্চের মধ্যে আরো বৈপ্লবিক একটি বিভাজন অর্জন করা সম্ভব হয়েছিল, যা এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও বেশি ছিল, যেখানে ধর্ম, যদিও এর কোনো আনুষ্ঠানিক অবস্থান নেই, তারপরও এখনো ধর্মের উল্লেখযোগ্য পরিমাণে সামাজিক আর রাজনৈতিক প্রভাব বিদ্যমান।

ইউরোপে যা ঘটেছিল সেটি হচ্ছে এমন একধরনের রাষ্ট্রব্যবস্থার আবির্ভাব হয়েছিল, যাদের এখন আমরা বলি ‘সেকুলার বা লোকায়ত (বা ধর্মনিরপেক্ষ) রাষ্ট্র। সেকুলার শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ ‘সিকুলাম’ থেকে, যার অর্থ সময়ের একটি পর্ব। শব্দটি মূলত অনন্ত সময়ের বিপরীতে একটি সময়কে নির্দেশ করছে; এটি চার্চের বিপরীতে পৃথিবী, ধর্মীয় ঐশী প্রত্যাদেশের বিপরীতে মানবচিন্তা বোঝাতে ব্যবহৃত হতে শুরু হয়েছিল। সেকুলার রাষ্ট্র ধর্ম থেকে উদ্ভূত মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে যারা তাদের জীবন পরিচালনা করছেন, তাদের ব্যাপারে কোনো হস্তক্ষেপ না-করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু এটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, শুধুমাত্র পার্থিব উৎস থেকে উদ্ভূত মূলনীতিগুলোই এর নিজের সিদ্ধান্তগুলোর ভিত্তি হবে। এখানে কিছু উদাহরণ উল্লেখ করলাম যা এখন কীভাবে এটি কাজ করে সেটি বুঝতে সহায়তা করে।

যেমন, আমরা দেখেছি, বহু ধর্মই নারীদের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ করে থাকে। সেই ধর্মগুলোর পবিত্র বইটি বলেছে যে, ঈশ্বর নারীদেরকে পুরুষদের সহায়তাকারী হিসাবে সৃষ্টি করেছেন এবং পুরুষের ওপর কখনোই তারা কর্তৃত্ব অনুশীলন করতে পারবে না। সেকুলার সমাজগুলোয় নারীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করাটিকে একটি নৈতিক ভ্রান্তি হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এবং কিছু ক্ষেত্রে এটিকে অপরাধ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং যার জন্যে আপনাকে আদালতের সামনে হাজির করা হতে পারে। তা সত্ত্বেও, সেকুলার মূলনীতি অনুযায়ী, যা ধর্মকে এর নিজস্ব সহবিশ্বাসীদের সমাজে তার নিজের ইচ্ছামতো কাজ করার স্বাধীনতা দিয়েছে, এবং রাষ্ট্র মাঝে মাঝে ধর্মীয় সমাজগুলোর আচরণের প্রতি অন্ধদৃষ্টি প্রদান করে, যা মূল সমাজে একটি অপরাধ বলেই গণ্য হবে।

অন্য উদাহরণটি সমকামিতা সংক্রান্ত। আবারো, ধর্মের পবিত্র বইগুলো এটি অনুমোদন করেনি। সমকামিতা সবসময়ই পাপ এবং এমন পাপ, যার জন্যে আপনাকে হত্যা করাও হতে পারে। পৃথিবীর বেশকিছু জায়গায় আজও, এটি আপনার মৃত্যুর কারণ হতে পারে। কিন্তু অধিকাংশ আধুনিক সেকুলার সমাজগুলোয় সমকামীদের নিপীড়ন করাই এখন শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বিষমকামীদের মতো সমকামীদের এখন একই অধিকার দেওয়া হয়েছে, এবং কিছু দেশে, তাদের বিয়ে করারও অধিকার আছে। কিন্তু তারপরও সেকুলার-রাষ্ট্র সমকামীদের প্রতি প্রদর্শিত বৈষম্যগুলো দেখেও না-দেখার ভান করে, বহুধর্মবিশ্বাসীদের সমাজে যে-বৈষম্যটি এখনো অনুশীলন করা হচ্ছে।

যদিও সেকুলার-রাষ্ট্র হয়তো ধর্মবিশ্বাসী গোষ্ঠীগুলোর সেক্সিজম বা যৌনবৈষম্যবাদ আর সমকামিতাকে অবজ্ঞা করতে পারে, কিন্তু এর বহু নাগরিকই যথেষ্ট পরিমাণ মনোযোগ দিয়ে বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করেন এবং তারা যা দেখছেন সেটি পছন্দ করেন না। কারণ, সেকুলার রাষ্ট্রের আবির্ভাবের সাথে এনলাইটেনমেন্ট সেকুলার মনেরও জন্ম দিয়েছিল, জীবন সম্বন্ধে ভাবার একটি উপায়, যা কীভাবে এই পৃথিবী সংগঠিত হবে সেই বিষয়ে ঈশ্বর আর তার দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি কোনো তথ্যনির্দেশ করে না। এর নিজের জীবনে ধর্মীয় মূলনীতিগুলোর প্রয়োগ প্রত্যাখ্যান করা ছাড়াও সেকুলার মন আরো কিছু করে। অন্যদের জীবনের ওপর ধর্ম কীভাবে প্রভাব ফেলতে পারে সেটি দেখে এটি বিতৃষ্ণ। সেই প্রান্তিক ব্রোঞ্জ-যুগ থেকে আসা পবিত্র লেখার ওপর ভিত্তি করে যারা নারী এবং সমকামীদের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ করে, এটি তাদের বিরোধিতা করে। পশ্চিমে সেকুলার মনের আবির্ভাবে ধর্মের কর্তৃত্বের ধীর ক্ষয়ের কারণ হয়েছে। পরিণতিতে খ্রিস্টধর্ম, যে-বিশ্বাসটি বহু শতাব্দী ধরে ইউরোপ প্রাধান্য বিস্তার করেছিল, সেটি ক্রমশ দুর্বলতর হতে শুরু করেছিল এবং উত্তরোত্তর শক্তিক্ষয়ের এই প্রক্রিয়াটি থামার খুব সামান্যই ইঙ্গিত দিচ্ছে।

এই শক্তিক্ষয় বহু মানুষকে বিমর্ষ করেছে, এর মধ্যে কিছু মানুষ যারা নিজেরাই ধর্ম অনুশীলন করা বন্ধ করে দিয়েছেন। তারা জানেন ইতিহাসে এর দীর্ঘযাত্রায় বহু অনাচার চার্চের অংশে পরিণত হয়েছিল, কিন্তু এছাড়াও এর কিছু সদগুণও আছে সেই বিষয়টি তারা স্বীকার করেন। এটি মানবতার মিত্র যেমন ছিল তেমনি শত্রুও ছিল; নিরাময়কারী আবার একই সাথে একজন নিপীড়ক। কিন্তু মানবপ্রকৃতি কোনো একটি শূন্যতা ঘৃণা করে। সুতরাং পশ্চিমে ম্লান হয়ে যেতে থাকা খ্রিস্টধর্মের ফেলে-যাওয়া শূন্যস্থানটি ‘সেকুলার হিউম্যানিজম’ নামে একটি নতুন আন্দোলনের সূচনা করতে প্ররোচিত করেছিল। যদিও সেকুলার হিউম্যানিজম বা মানবতাবাদ ধর্মের সংজ্ঞায় উত্তীর্ণ হতে পারবে না, কিন্তু যেহেতু এটি ধর্ম থেকে বেশকিছু সেরা ধারণা ঋণ করেছে, এটি নিয়ে খানিকটা পর্যালোচনা এই ইতিহাস শেষ করার একটি ভালো উপায় হতে পারে।

নামটি যেমন প্রস্তাব করছে, সেকুলার মানবতাবাদীরা মানুষকে একটি সুন্দর জীবন কাটাতে সহায়তা করার চেষ্টা করেন, তবে সেটি ধর্মের আরোপ করা মূলনীতি অনুসারে নয় বরং সেই মূলনীতি অনুযায়ী, যা মানুষ নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিয়ে নির্দিষ্ট করেছে। তারা বিশ্বাস করেন মানবতা প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছে এবং এখন এর নিজের দায়িত্ব নিজেরই নেওয়া উচিত। মানবতার শৈশবে ধর্ম, অথবা ঈশ্বর বলেছিলেন, কী করতে হবে আর কী করা যাবে না, এবং সেখানে হতবাক করে দেবার মতো কিছু নির্দেশাবলি ছিল। দাসত্ব, নারীনিপীড়ন, সমকামীদের পাথর ছুঁড়ে হত্যা করা, বাধ্যতামূলক ধর্মান্তরিতকরণ এবং ভুল ধর্মবিশ্বাস করার কারণে শাস্তি। অবশ্যই এখন তারা এর চেয়ে উত্তম কিছু করতে সক্ষম। আর নিজেরাই যেহেতু মানুষ, মানবতার জন্যে কোটি ভালো সেটি জানার জন্যে তারা শ্রেষ্ঠ একটি অবস্থানে আছেন। সহিষ্ণুতা অবশ্যই উত্তম। নির্যাতন অশুভ এবং বর্জনীয়। দয়া উত্তম এবং নিষ্ঠুরতা অগ্রহণযোগ্য এবং অশুভ। আর এটি বোঝার জন্যে আপনাকে কোনো ঈশ্বরকে বিশ্বাস করতে হবে না। প্রতিবেশীদের ভালোবাসা আর নিজের সাথে যেভাবে আচরণ করা হোক বলে আপনি প্রত্যাশা করেন, সেভাবেই প্রতিবেশীদের সাথে আচরণ করা, এই বিষয়গুলোর ব্যাপারে আপনাকে নির্দেশ দেবার জন্যে কোনো ধর্মেরই প্রয়োজন নেই।

সেকুলার মানবতাবাদীরা যে-কোনো গোষ্ঠীর সাথে কাজ করতে আগ্রহী, যারা এই পৃথিবীকে আরো উত্তম বাসযোগ্য করে তোলার চেষ্টা করছেন, যাদের মধ্যে ধর্মবিশ্বাসীদের গোষ্ঠীও অন্তর্ভুক্ত। তারা এমনকি ধর্মের কিছু পোশাকি রূপও চুরি করতে প্রস্তুত আছেন। মানবতাবাদীরা সচেতন যে, ধর্মের এই ক্ষয়িষ্ণু পরিস্থিতির সাথে সংশ্লিষ্ট বহু ভালো জিনিসই হারিয়ে গেছে, সুতরাং তারা সর্বোচ্চই চেষ্টা করছেন যেন সেগুলো অন্তত কিছু পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয় এবং সেগুলোকে মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্যবহার করা যায়। মানবজীবনের বড় ক্রান্তি লগ্নগুলোকে চিহ্নিতকরণে সহায়তা করতে ধর্ম খুবই দক্ষ। জন্ম, বিয়ে, মৃত্যু, এইসব ঘটনাগুলো উদ্যাপনে ধর্মের নানা অনুষ্ঠান আছে। সমস্যা হচ্ছে এই অনুষ্ঠানগুলোর সাথে সংশ্লিষ্ট আছে স্বর্গীয় জগৎ, যে-জগৎটিকে সেকুলার মানবতাবাদীরা বিশ্বাস করেন না। শিশুদের শরীর থেকে পাপ পরিষ্কার করতে হবে, দম্পতিদের বলতে হবে বিয়ে সারাজীবনের জন্যে, তারা সেটি চান বা না চান। এবং মৃতরা সবাই অন্য একটি জীবনে প্রবেশ করবেন–মানবতাবাদীরা এসব কিছু বিশ্বাস করেন না।

সুতরাং তাদের নিজেদের অনুষ্ঠানের ভাষা তারা নিজেরাই লিখতে শুরু করেছিলেন। এবং আধুনিক সেকুলার-রাষ্ট্র সেটি পরিচালনা করার জন্যে তাদের অনুমতিও দিয়েছে। স্কটল্যান্ডে এখন হিউম্যানিস্ট সেলেব্রান্ট বা মানবতাবাদী অনুষ্ঠান-পরিচালনাকারীরা খ্রিস্টীয় যাজকদের মতোই প্রায় একই সংখ্যক বিয়ের অনুষ্ঠান পরিচালনা করছেন। তারা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া আর শিশুদের নামকরণ-অনুষ্ঠানও পরিচালনা করেন। এই অনুষ্ঠানগুলো যারা অনুরোধ করেছেন তাদের চাহিদামতো সাজাতে, তারা এখন যথেষ্ট পরিমাণ দক্ষতাও অর্জন করেছেন। একজন মানবতাবাদী সেলেব্রান্ট, তাদের নিজস্ব মূল্যবোধ আর পছন্দগুলো সেই অনুষ্ঠানের সাথে যুক্ত করতে সহায়তা করেন। এর সেটি করার মাধ্যমে এই অনুষ্ঠানগুলো একটি ব্যক্তিগত তাৎপর্য লাভ করে। তারা ভিন্নধরনের একটি আধ্যাত্মিকতা জীবনের সেই মুহূর্তগুলোর সাথে যুক্ত করতে পারেন, যা একসময় একচেটিয়াভাবে গতানুগতিক ধর্মগুলোর নিয়ন্ত্রণে ছিল। সেকুলার আধ্যাত্মিকতা এই জীবনেই এর অর্থ আর সৌন্দর্য খুঁজে পায়। এটি একমাত্র জীবন যা আমরা কখনো উপভোগ করতে পারব, সুতরাং এর জন্য আমাদের কৃতজ্ঞতা অনুভব করা উচিত এবং এটি উত্তমভাবে ব্যবহার করা উচিত।

আর ধর্ম থেকে সেকুলার মানবতাবাদীরা শুধু এটাই ঋণ করেননি, যেভাবে বিশ্বাসী মানুষরা একই সাথে উপাসনার জন্যে একত্র হন এবং পরস্পরের সান্নিধ্যে আসার এই অভিজ্ঞতাটিকে তারা গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। কারণ এই অনুষ্ঠানগুলো মানুষদের মধ্যে সংমিশ্রণ করে, পরস্পরকে সহযোগিতা করার সুযোগ সৃষ্টি করে, অন্যথায় যাদের হয়তো কখনোই দেখা হতো না। উপাসনায় সাপ্তাহিক হাজিরা কী-ধরনের জীবন আপনি কাটাচ্ছেন সে-বিষয়ে আন্তরিক হতে এবং গভীরভাবে নিরীক্ষণ করতে, আর হয়তো কিছু পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত নেবার একটি সুযোগ সৃষ্টি করে। সেকুলার মানবতাবাদীরা এটির গুরুত্ব অনুধাবন করেছেন। সুতরাং তারা তাদের নিজস্ব সংস্করণে রোববারের সমাবেশ সৃষ্টি করেছেন। মাঝে মাঝে এটি পরিচিত চার্চ-গোয়িং ফর অ্যাথেইস্ট’ নামে, যেখানে তারা সেকুলার বক্তৃতা আর উপদেশ শোনেন, এবং সমবেতভাবে গান গেয়ে থাকেন। এর সাথে তারা কিছু মুহূর্তের নীরবতা আর ব্যক্তিক আত্মবীক্ষণের সময়ও যুক্ত করেছেন। এটি অতিপ্রাকৃত কোনোকিছু ছাড়াই ধর্ম : মানবধর্ম।

তবে এই ধরনের মানবতাবাদ কি টিকে থাকতে পারবে, আরো বিকশিত হবে, নাকি একসময় ম্লান হয়ে হারিয়ে যাবে? সেই বিষয়ে এখনো ভবিষ্যদ্বাণী করার মতো যথেষ্ট সময় অতিক্রান্ত হয়নি। সেকুলার ধর্ম প্রতিষ্ঠা করার জন্যে এর আগেও চেষ্টা করা হয়েছিল, এবং অল্প কিছুদিনের মধ্যে সেটি হারিয়েও গিয়েছিল। সমালোচকরা সবসময়ই বলেন, এগুলো হচ্ছে অ্যালকোহলমুক্ত বিয়ার কিংবা ক্যাফেইন-বিহীন কফি পান করার মতো। এমন কিছু করারই বা কী অর্থ থাকতে পারে?

এইসব কিছু সেকুলার-মানসিকতাসম্পন্ন মানুষদের জন্য একই সাথে ধর্মের আকর্ষণ এবং এর সমস্যাগুলোর প্রমাণ দিচ্ছে। তারা হয়তো ধর্ম যা-কিছু অর্জন করেছে, তার প্রশংসা করতে পারেন, কিন্তু তারা সেই অতিপ্রাকৃত বিশ্বাসকে আর মেনে নিতে পারেন না, যার ওপর ভিত্তি করে এটি দাঁড়িয়ে আছে। কর্তৃত্বের সেই রূপগুলো নিয়ে তারা সন্দিহান, যা দাবি করে এটি মানব-সংশোধনের ঊর্ধ্বে এবং অভ্রান্ত। তারা লক্ষ করেছেন, মানব-আচরণের ভালো পরিবর্তনগুলোর সাথে খাপ খাইয়ে নেবার ক্ষেত্রে, আর নতুন জ্ঞানের পরিণতিগুলো মেনে নিতে ধর্ম কতটা মন্থর। নতুন কিছু জানার মতো সাহসী হওয়ার বদলে ধর্ম সাধারণত প্রাচীন ধারণাগুলো আঁকড়ে ধরে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।

আমরা যেমন ইতিমধ্যেই লক্ষ করেছি, ধর্ম হচ্ছে সেই কামারের নেহাই, যা বহু হাতুড়িক্ষয়ের কারণ হয়েছে। এটি হয়তো সেকুলার-মানবতাবাদের চেয়ে আরো বেশিদিন টিকে থাকতে পারে। যদিও আজ বহু জায়গায় এটি ক্রমশ হারিয়ে যাবার মুখে, কিন্তু এটি এখনো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রদর্শনী এবং আপনার কাছেই উপাসনা করার কোনো স্থানে এটি এখনো চলমান। তবে সেই অনুষ্ঠানের টিকিট আপনি কাটবেন কিনা সেটি পুরোপুরিভাবে আপনার ওপরেই নির্ভর করবে।

অধ্যায় ৪১ / ৪১

সকল অধ্যায়

১. ০. ভূমিকার পরিবর্তে
২. ০১. উপরে কি কেউ আছেন?
৩. ০২. দরজাগুলো
৪. ০৩. চাকা
৫. ০৪. এক থেকে অনেক
৬. ০৫. রাজকুমার থেকে বুদ্ধ
৭. ০৬. কোনো ক্ষতি কোরো না
৮. ০৭. যাযাবর
৯. ০৮. নলখাগড়ার বনে
১০. ০৯. দশ নির্দেশ
১১. ১০. নবীরা
১২. ১১. সমাপ্তি
১৩. ১২. ভিন্নমতাবলম্বী
১৪. ১৩. শেষ যুদ্ধ
১৫. ১৪. পার্থিব ধর্ম
১৬. ১৫. সবচেয়ে ভালো উপায়
১৭. ১৬. কাদা মন্থন
১৮. ১৭. ধর্ম যখন ব্যক্তিগত হয়ে উঠেছিল
১৯. ১৮. ধর্মান্তরিত
২০. ১৯. মেসাইয়া
২১. ২০. যিশু এলেন রোমে
২২. ২১. চার্চ যখন দায়িত্ব নিয়েছিল
২৩. ২২. শেষ নবী
২৪. ২৩. সমর্পণ
২৫. ২৪. সংগ্রাম
২৬. ২৫. নরক
২৭. ২৬. খ্রিস্টের প্রতিনিধি
২৮. ২৭. প্রতিবাদ
২৯. ২৮. মহাবিভাজন
৩০. ২৯. নানকের সংস্কার
৩১. ৩০. মধ্যম পথ
৩২. ৩১. পশুর শিরশ্চেদ
৩৩. ৩২. বন্ধুরা
৩৪. ৩৩. আমেরিকায় তৈরি
৩৫. ৩৪. আমেরিকায় জন্ম
৩৬. ৩৫. মহা-হতাশা
৩৭. ৩৬. অতীন্দ্রিয়বাদী এবং চলচ্চিত্র তারকা
৩৮. ৩৭. দরজা উন্মুক্ত করা
৩৯. ৩৮. ক্রুদ্ধ ধর্ম
৪০. ৩৯. পবিত্র যুদ্ধগুলো
৪১. ৪০. ধর্মের সমাপ্তি

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন