ফুলমণি-উপাখ্যান – ৩

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

চন্দনদাকে নিয়ে আর পারা যায় না! সন্ধেবেলা যে মুরগিটা নিয়ে এলো পালক—ফালক ছাড়াবার পরও সেটার ওজন দেড় কিলোর কম নয়। এত বড় একটা মুরগি রান্নার জন্য তেল-মশলা-আলু-পেঁয়াজ জোগাড় করা কি সোজা কথা? তা ছাড়া, এত মাংস খাবে কে?

চন্দনদা বলল, তুই রান্না কর, দেখবি খাওয়ার লোকের অভাব হবে না। হরিলাল, শিবলাল, যাদবলাল কত আছে। দুমকায় আমার দাদু কী বলতেন জানিস? বিরাশি বছর বয়স, তবু রোজ মাছ চাই, মাংস চাই, তিন রকম তরকারি চাই। সব সাজিয়ে দেওয়া হতো, নিজে কিন্তু কিছুই খেতেন না। একটু একটু ছুঁয়ে উঠে পড়তেন। আর বলতেন, আমার টাকা আছে, আমি হুকুম করব সব রান্না হবে, তাতে আমার নাতি-নাতনীরা ভালো করে খেতে পারবে।

আমি বললুম, তা তো বুঝলুম। কিন্তু তোমার বাংলোতে বাবুর্চি আছে, তাকে দিয়ে না রাঁধিয়ে শুধু শুধু আমাকে খাটাচ্ছ। কেন?

চন্দনদা বলল, আরে দুর দুর, বাবুর্চির হাতের রান্না খেয়ে খেয়ে জিভ পচে গেছে। তোর এখানে খেলে বেশ একটা পিকনিক পিকনিক ভাব হয়।

আমি মনে মনে বললুম, দেখাচ্ছি মজা! আজ ভাতের তলা ধরিয়ে দেব, ডালে নুন দেব দু বার, আর মাংসে এমন ঝাল দেব যে কাল সকাল পর্যন্ত হু—হু করে জ্বলবে।

আমার বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়ে চন্দনদা বলল, এক এক সময় মনে হয়, জীবনটা যদি গোড়া থেকে শুরু করা যেত! তোর মতন এই রকম একটা ঘরে থাকতুম, নিজে রান্না করে খেতুম, ইচ্ছে না হলে দু’দিন দাড়ি কামাতুম না। সন্ধের সময় নিজের বাংলোতে থাকি না কেন জানিস? বাড়িতে থাকলেই অন্য অফিসাররা চলে আসে, এসেই অফিসের গল্প শুরু করে। সবসময় অফিসের গল্প। হঠাৎ আবার উঠে বসে বলল, হ্যাঁ, ভালো কথা। মহিমবাবু তোর নামে কী যেন বলছিল! তুই কী করেছিস?

—এই রে। তুমিও তো অফিসের গল্প শুরু করলে!

–না, না, মহিমবাবু তোর নামে অভিযোগ করছিল। তুই নাকি ওয়ার্কারদের লাই দিচ্ছিস, তারা কাজে ফাঁকি দেয়।

-এসব কথা কাল আলোচনা করলে হয় না?

–তোর সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে নাকি, মহিমবাবুর?

–চন্দনদা, তুমি এক সময় গভর্মেন্ট আর্ট কলেজে ভর্তি হয়েছিলে না?

—হ্যাঁ। কে বলল তোকে?

–তোমার প্রাণের বন্ধু তপনদার কাছ থেকে শুনেছি। তুমি বহরমপুর থেকে কলকাতায় পড়তে এসেছিলে। শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে চান্স পেয়েও ভর্তি হয়েছিলে আর্ট কলেজে। তোমার বাবা খবর পেয়ে এসে কান ধরে তোমায় টানতে টানতে শিবপুরে নিয়ে গিয়েছিল।

—কান ধরে টানতে টানতে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা তপনের বানানো, না তুই বানালি? আমার বাবার চোখ রাঙানিটা আমি যথেষ্ট ভয় পেতুম। বাবা দুদে উকিল ছিলেন।

–বাবার ভয়ে তুমি ছবি আঁকা ছেড়েই দিলে? ইঞ্জিনিয়ার হলে বুঝি আর শিল্পী হওয়া যায় না? অনেক ইঞ্জিনিয়ার তো কবিতা লেখেন। কবি যতীন্দ্ৰনাথ সেনগুপ্ত…

—আমার কাজটা যে বড্ড ঝামেলার। চাকরিতে জড়িয়ে পড়ার পর আর চর্চা রাখতে পারিনি।

-নীপা বউদির কাছে তোমার আঁকা কয়েকটা ছবি আমি দেখেছি। নীপা বউদির ইচ্ছে সেগুলো বাঁধিয়ে দেয়ালে টাঙিয়ে রাখবে। কিন্তু তুমি….

—আরে দুর, দূর, সেগুলো খুব কাঁচা ছবি। লোকে দেখলে হাসবে!

-নীপা বউদির একখানা স্কেচ তুমি বেশ ভালোই এঁকেছো। দেখলে চেনা যায়।

-আমি ঠিক পঁয়তিরিশ সেকেন্ডে মানুষের মুখ আঁকতে পারতুম। এক টানে কিন্তু, কিন্তু, তুই কথা ঘোরাচ্ছিস রে, নীলু? মহিমবাবু তোর নামে নালিশটা করেছে, আমি এসেছি তার বিচার করতে—

—মহিমবাবু তোমাকে আসল কথাটাই বলেননি।

—আসল কথাটা কী শুনি?

–আমার ওখানে যারা কাজ করে, তাদের মধ্যে একটা আদিবাসী মেয়ে দেয়ালে একটা ছবি এঁকেছে, তাতে মহিমবাবুর আপত্তি। আমি ভাবলুম, ছবিটা তোমাকে একবার দেখাব।

—ছবি এঁকেছে মানে কী? ফিগার ড্রয়িং আছে?

—হ্যাঁ, একটা ছোট ছেলে, একটা কুকুর।

—রিয়েলিস্টিক? নাকি বাচ্চারা যে-রকম আঁকে, কিংবা মধুবনী স্টাইলের।

—রিয়েলিস্টিক, মানে, ছেলেটাকে ছেলে বলে চেনা যায়, কুকুরটা অবিকল কুকুর।

ব্যস্তভাবে খাট থেকে নেমে চন্দনদা বলল, চল তো, চল তো, আমি এ পর্যন্ত কোনো আদিবাসীর আঁকা রিয়েলিস্টিক ছবি দেখেনি।

—এখন এই রাত্তিরে যাবে নাকি? কাল সকালে…।

—চল দেখে আসি। এমন কিছু রাত হয়নি।

–রান্নাবান্না?

—সেসব পরে হবে! জামাটা পরে নে।

জিপ এনেছে চন্দনদা, ড্রাইভারকে ছুটি দিয়েছে, নিজেই চালাবে। আজ অন্ধকার নেই, ফটফট করছে জ্যোৎস্না। বাতাসে সেই জ্যোৎস্নার সুঘ্রাণ।

এখনো মাদল বাজেনি, আর কোনো শব্দ নেই, জিপের আওয়াজটাকেই মনে হচ্ছে পৃথিবীর একমাত্র আওয়াজ। আকাশ এত পরিষ্কার যে ছায়াপথ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে।

লেবরেটরি বাড়িটায় এখনও বিদ্যুৎ আসেনি। একটা গুদাম ঘরে সিমেণ্ট জমা থাকে, তার জন্য একজন পাহারাদার থাকার কথা, কিন্তু তার পাত্তা পাওয়া পেল না। চন্দনদার হাতে একটা তিন ব্যাটারির লম্বা টর্চ। আমরা উঠে এলুম তোতলায়। দেয়ালটার ঠিক জায়গায় টর্চের আলো পড়তেই চন্দনদা বিস্ময়ে শিস দিয়ে উঠল।

চতুর্দিকে অন্ধকার, টর্চের জোরালো আলোয় ছবিটা স্পষ্ট দেখা গেল, দিনের বেলার চেয়েও ভালো মনে হলো।

চন্দনদা দু’পাশ থেকে ছবিটা দেখে বলল, তুই ঠিক বলছিস নীলু, এটা কোনো আদিবাসী মেয়ের আঁকা?

—হ্যাঁ। মেয়েটা পিকিউলিয়ার। কানে শুনতে পায়, কথা বলে না।

–এ যে পাকা হাতের কাজ। সামথিং ইউনিক। আদিবাসীরা রিয়েলিস্টিক ছবি, যাকে বলে ফটোগ্রাফিক রিয়েলিস্টিক, সে রকম আঁকতে পারে বলে জানা নেই। এখানে দ্যাখ, যে ছেলেটাকে এঁকেছে, তার ফিগারটা পুরোপুরি প্রোপোরশানেট। তার মানে শরীরের সঙ্গে হাত-পা, মুখের সাইজ একেবারে ঠিক ঠিক। খানিকটা ট্রেইনিং না থাকলে তো এরকম আঁকা যায় না।

—মেয়েটাকে দেখে মনে হয়, ও কিছু জানে না।

—তা তো হতে পারে না। ভালো করে দ্যাখ ছবিটা। গাছতলায় একটা ছেলে বসে আছে, একজন রাখাল, হাতে একটা বাঁশি। সাধারণত এই ছবি আঁকা হলে সবাই বাঁশিটা মুখের কাছে দেয়। বাঁশি বাজাচ্ছে তাই বোঝায়। কিন্তু এখানে বাঁশিটা একটু দূরে ধরা, ছেলেটার মুখ দেখলে মনে হয়, সে এখনো বাঁশি বাজানো শুরু করেনি। বাঁশিটা হাতে নিয়ে কিছু একটা ভাবছে। তার মানে, শিল্পী এখানে ট্র্যাডিশানের চেয়ে একটু আলাদা হতে চেয়েছে। এটা বাঁশি হাতে কেষ্টঠাকুর নয়। আর একটা জিনিস দ্যাখ, গাছ আর ছেলেটা ছবির বাঁ দিকে, তাই ব্যালান্স করবার জন্য ডান দিকের কোণে কুকুরটাকে বসিয়েছে। এটা যে কেষ্টঠাকুর নয়, সাধারণ রাখালের ছবি, সেটাও বোঝানো হয়েছে ঐ কুকুরটাকে দিয়ে। কেষ্টঠাকুরের সঙ্গে কুকুরের অনুষঙ্গ নেই, ময়ূর কিংবা হরিণ-টরিণ কিছু থাকত।

–বাবাঃ, তুমি তো অনেক কিছু বলে ফেললে, চন্দনদা। আমি এত সব বুঝি না।

—ভালো করে দেখলেই বোঝা যায়। মহিমবাবুটা একটা পাঁচ নম্বুরি গাড়ল। এই রকম ছবি নিয়ে কেউ নালিশ করে? ক্যামেরাটা আনলুম না, এর একটা ছবি তুলে রাখা উচিত। কয়েকজনকে দেখাতুম।

–কাল সকালে ক্যামেরা নিয়ে এসো।

—কী দিয়ে এঁকেছে বল তো? সরু আর মোটা, দু’রকম রেখাই আছে। কুকুরটাকে মোটা আউট লাইনে এঁকে গায়ে ছোটো ছোট লোমও দিয়েছে। দুরকম তুলির কাজ?

–না, না, চন্দনদা। ও মেয়েটা তুলি-ফুলি কোথায় পাবে? ওর কাছে কিছু থাকে না। টিফিনের সময় কোনো কাঠি দিয়ে আপন খেয়ালে এঁকেছে।

আরও কিছুক্ষণ ধরে ছবিটা দেখার পর টর্চটা নিভিয়ে দিয়ে চন্দনদা বলল, তাহলে তো খুব মুশকিল হলো রে নীলু! যে-মেয়ে এরকম ছবি আঁকে, সে একজন খাঁটি শিল্পী, তাকে দিয়ে আমরা মাথায় ইঁট বওয়াবার কাজ করাব? এটা তো একটা সামাজিক অন্যায়।

আমি বললুম, বেশি বাড়াবাড়ি করো না, চন্দনদা? ছবি তো অনেকেই আঁকে। আমি তো দেখেছি, কলকাতার রাস্তায় অনেক সময় কেউ কেউ ফুটপাথের ওপর রঙিন চক দিয়ে বড় বড় ছবি এঁকে ভিক্ষে করে। তারাও তো শিল্পী!

চন্দনদা জোর দিয়ে বলল, না। সেসব ছবি আমিও দেখেছি। সেগুলো ডাল। নিষ্প্রাণ। যেসব ছবিতে একটা অন্তর্দৃষ্টি থাকে, সেগুলোই আসল ছবি হয়। আমি ছবি চিনি।

—যারা বাউল গান করে, কী চমৎকার গলা। তারাও তো গায়ক। কিন্তু তাদের ট্রেনে ভিক্ষে করতে হয়।

—তুলনা দিবি না, খবর্দার তুলনা দিবি না। ভেরি ব্যাড লজিক। বাউলদের ঠিক মতন কদর হয় না বলে শিল্পীদেরও অনাদর করতে হবে? তা ছাড়া, আজকাল ছবির বাজার ভালো। মধুবনী পেইন্টিংসও তো সাধারণ গ্রামের মেয়েরা আঁকে, ভালো দামে বিক্রি হয়। আমি ছবি চিনি, এটা একটা…।

—একখানা ছবি দেখেই কি কোনো শিল্পীকে চেনা যায়!

—এই এতক্ষণে একটা দামি কথা বলেছিস, নীলু। না, শুধু একটা ছবি দেখলে কিছু বলা যায় না। এই ছবিটা কপি হতে পারে। অন্য কারুর ছবি দেখে যদি এঁকে থাকে, তা হলে অবশ্য কিছুই না। কপি করতে দক্ষতা লাগে বটে, সিনেমার বড় বড় হোর্ডিং যারা আঁকে, তারাও একধরনের আঁকিয়ে, কিন্তু শিল্পী নয়। নিজের মাথা থেকে একটা নতুন বিষয়কে নতুন ভাবে আঁকা আলাদা ব্যাপার! কাল সকালে এসে আমি মেয়েটার সঙ্গে কথা বলব!

সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে চন্দনদা আবার বললেন, ছবিটা দেখে মনটা ভালো হয়ে গেল রে আমার!

পরদিন ন’টার সময় এসে আমি চমকে গেলুম। দোতলার দেয়ালের ছবিটা কেউ মুছে ফেলেছে।

মিস্তিরি-মজুররা জমা হচ্ছে একে একে। সবাইকে জিজ্ঞেস করলুম, কেউ কিছু জানে না। ফুলমণি অন্য দিনের মতনই নিস্তব্ধ। কোনো প্রশ্নেরই উত্তর দেয় না। এক সময় ধৈর্য হারিয়ে আমি অন্য একজন সাঁওতালকে জিজ্ঞেস করলুম, এই মেয়েটা কথা বলতে পারে না?

সে বলল, হ্যাঁ গো বাবু, পারে। কিন্তু বলে না।

খানিক বাদে চন্দনদা এসে খুব রাগারাগি করতে লাগল। ক্যামেরা এনেছে সঙ্গে। ফুলমণিকে জেরা করা হলো অনেক, সে শুধু মাথা নাড়ে। তবু আমার সন্দেহ হলো, ফুলমণিই ছবিটি মুছে ফেলেছে।

চন্দনদা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ঠিক আছে, টিফিনের সময় আমি আবার আসছি।

অন্যদিনের মতনই শুরু হয়ে গেলে কাজ। তিনতলার গাঁথনি শুরু হয়েছে, একতলা থেকে বয়ে নিয়ে যেতে হচ্ছে ইট, বালি, সিমেন্ট। লক্ষ করলুম, ইরফান আলি যেন অন্যদিনের চেয়ে ফুলমণিকে বেশি খাটাচ্ছে। ছবিটা আঁকার জন্য ফুলমণি খানিকটা গুরুত্ব পেয়ে গেছে, সেটা ইরফান আলির পছন্দ হয়নি। যেখানে লাভ-লোকসানের প্রশ্ন নেই সেখানেও মানুষের মনে এক ধরনের ঈর্ষা কাজ করে।

বাঁশের ভারা বেয়ে আমিও উঠে গেলুম দোতলার ছাদে। সিঁড়ি এখনো তৈরি হয়নি। একপাশে কাজ চলেছে, আর এক পাশটা ফাঁকা। এরকম ন্যাড়া ছাদের প্রান্তে এসে নীচের দিকে তাকালে ভয় ভয় করে। খানিকটা দূরেই ছোট ছোট টিলা। বনতুলসীর ঝোপঝাড়টাও দেখা যায় এখান থেকে। ছোট নদীটার ধারে বসে আছে কয়েকটা বক। গোটা চারেক কালো কালো মোষ, এখানে ওদের বলে কাড়া, হেঁটে পার হচ্ছে নদী।

মাঝে মাঝে ফুলমণির দিকে চোখ চলে যাচ্ছে আমার। সে মাথায় করে ইট আনছে ওপরে, আবার নেমে যাচ্ছে, কোনোদিকে আর দৃষ্টি নেই। এত রোগা মেয়েটা একসঙ্গে বারো-চোদ্দটা ইঁট বয়ে আনছে কী করে? পড়ে না যায়। ইরফান আলি মাঝে মাঝে তাকে অকারণ তাড়া দিয়ে বলছে, ইতনা দের কাঁহে হোতা? জলদি করো, জলদি করো!

টিফিনের সময় হোটেল থেকে খেয়ে এসে আমি দেখলাম, চন্দনদা বসে আছে বারান্দায়। পাশে একটা বড় ব্যাগ।

আমাকে দেখে বলল, খেয়ে এসেছিস? গুড! ওদেরও খাওয়া হয়ে এলো। এবার একটা এক্সপেরিমেন্ট করব।

ব্যাগটা থেকে চন্দনদা বার করল ফুলস্কেপ সাইজের অনেকগুলো কাগজ আর অনেকগুলো পেন্সিল, সেগুলোর একদিকে লাল অন্যদিকে নীল শিস।

আঠারো জন মিস্তিরি-মজুরদের সবাইকে ডেকে চন্দনদা একখানা করে সেই কাগজ ও পেন্সিল ধরিয়ে দিল। তারপর বলল, তোমরা সবাই আঁকো যার যা খুশি। যেমন ইচ্ছে আঁকো। তাড়াতাড়ির কিছু নেই।

বাচ্চাদের যেমন সিট অ্যান্ড ড্র প্রতিযোগিতা হয়, সেই রকম ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে গেল আঠারো জন। তিনটি সাঁওতাল মেয়ে শুধু খিলখিলিয়ে হাসে। ফুলমণি সকলের থেকে অনেক দূরে একটা দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসল।

চন্দনদা বলল, এদের কাছাকাছি থাকা ঠিক নয়। তাতে ওরা লজ্জা পাবে।

গাড়ি থেকে একটা আইস বক্স আর গেলাস নামিয়ে চন্দনদা চলে এল একটা কোণের ঘরে। আইস বক্স থেকে বেরুল ঠাণ্ডা বিয়ারের বোতল। একটা বোতলের ছিপি খুলে চন্দনদা বলল, তোকে কিন্তু দিচ্ছি না, নীলু। এখানে তুই আমার কর্মচারী। সব অরডিনেট স্টাফ-এর সঙ্গে কাজের সময় বিয়ার খেলে আমার বদনাম হয়ে যাবে।

একটু পরেই এসে হাজির হলেন মহিমবাবু

ঠোটের এক কোণে হেসে চন্দনদাকে বললেন, স্যার, আপনি নাকি কুলি-কামিনদের দিয়ে ছবি আঁকাচ্ছেন?

চন্দনদা বললেন, হ্যাঁ। আপনাকে কে খবর দিল?

মহিমবাবু বলেন, খবর ঠিক ছড়িয়ে যায়।

চন্দনদা বললেন, আপনি এসেছেন, ভালো করেছেন। বসুন, আপনিও দেখে যাবেন ছবিগুলো।

চেয়ার মাত্র একখানা। জানলা-দরজাও এখনো বসানো হয়নি। মহিমবাবুকে আমারই মতন দাঁড়িয়ে থাকতে হলো।

চন্দনদা মহিমবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, বিয়ার খাবেন? গেলাশ অবশ্য একটাই, আপনাকে বোতল থেকে চুমুক দিতে হবে।

মহিমবাবু জিভ কেটে বললেন, আমার ওসব চলে না। জীবনে কখনো ছুঁইনি। তারপর আমার দিকে চেয়ে তিনি সমর্থন আশা করলেন।

চন্দনদা বললেন, গুড। আপনি বিড়ি-সিগারেট খান না, মদ খান না, কাজে ফাঁকি দেন না, বউয়ের খুব বাধ্য, আপনার তো স্বর্গের টিকিট কাটা হয়েই আছে।

আমি সরে পড়লুম সে ঘর থেকে। মহিমবাবু দাঁড়িয়ে থাকবেন, আমি শুধু শুধু সে শাস্তি পেতে যাই কেন।

মিস্তিরি-মজুররা কেউ একতলার বারান্দায়, কেউ দোতলার সিঁড়িতে বসে ছবি আঁকায় নিমগ্ন। কেউ কেউ এখনো হেসে যাচ্ছে।

ওদের ব্যাঘাত না ঘটিয়ে আমি নেমে গেলুম মাঠে। এদিকে সেদিকে কয়েকটা গাছ পোঁতা হয়েছে মাত্র, পরে বাগান হবে। আজ থেকে তিন-চার বছর বাদে জমজমাট হয়ে যাবে এই জায়গাটা। কত লোক কাজ করবে, কত নোংরা জমা হবে, মানুষের রেষারেষিতে দূষিত হবে বাতাস। নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে বনতুলসীর জঙ্গল। বনতুলসীর প্রতি মায়া করে তো সভ্যতার অগ্রগতি থেমে থাকবে না।

এখানকার সীমানা-পাঁচিলের ওধারেও কিছু বনতুলসী ফুটে আছে। একটা পাতা ছিঁড়ে গন্ধ নিলাম। এই গন্ধটাই স্মৃতিতে থেকে যাবে।

খানিক বাদে একটা ঘণ্টা বাজার ঝনঝন শব্দ হলো। অর্থাৎ টিফিন টাইম শেষ। অন্য দিন ঐ ঘণ্টা আমি বাজাই।

ঘর থেকে বেরিয়ে এসে চন্দনদা বলল, এই নীলু, কাগজগুলো নিয়ে আয়। পরীক্ষার হলের গার্ডের মতন ছাত্রদের কাছ থেকে উত্তরপত্র সংগ্রহ করার মতন আমি ওদের কাছ থেকে ছবিগুলো নিতে লাগলুম। নিতে নিতেই আমার চক্ষু চড়কগাছ। ওরা কি আমাদের সঙ্গে মস্করা করছে নাকি? ফুলমণির কাগজটা নিয়ে আমি কটমট করে তাকালাম তার দিকে। সে মুখ ফিরিয়ে আছে, তার মুখখানা বিষাদ মাখানো।

চন্দনদা বললেন, দেখি দেখি!

একটার পর একটা সব কাগজ উল্টে গিয়ে চন্দনদা হাহাকারের মতন বলে উঠলেন, এ কী? ঐ মেয়েটার কোটা?

কোনো কাগজেই কোনো ছবি নেই। যা আছে তা কহতব্য নয়।

ইরফান আলি এঁকেছে একটা বাড়ির নক্শা। সোজা সোজা দাগে। আর কয়েকজন এঁকেছে কাঠি-কাঠি হাত-পা-ওয়ালা আর গোল মুণ্ডু যেসব মানুষ গুহাচিত্রে আঁকা হয়, সেই রকম কিছু। কেউ এঁকেছে পদ্মফুল, কেউ এঁকেছে পাঁচ ইঞ্চি আমগাছে দেড় ইঞ্চি সাইজের আম ঝুলছে। সাঁওতালরা কেউ কিছু আঁকেনি। সারা কাগজ ভরে কাটাকুটি করেছে। কেউ বা পেন্সিলের চাপে কাগজ ছিঁড়ে ফেলেছে।

প্রত্যেকটা কাগজে আমি নম্বর লিখে দিয়েছিলুম। সুতরাং কে কোন্ কাগজ পেয়েছিল তা আমার আন্দাজ আছে। ফুলমণির কাগজটা এক নম্বর, যে শুধু গোল গোল দাগ দিয়েছে, আর কিছু না।

সেই কাগজটা চন্দনদা উল্টেপাল্টে অনেক ভাবে দেখলেন। তারপর হতাশ ভাবে বললেন, নাঃ কিচ্ছু না! এ কী হলো রে, নীলু?

মহিমবাবু কাগজগুলোকে নিয়ে দ্রুত চোখ বোলালেন। তারপর হ্যা হ্যা করে অট্টহাস্য করে উঠলেন। এরা যে কেউ কোনো ছবি আঁকতে পারেনি, সেটা যেন তাঁরই বিপুল জয়।

চন্দনদা বললেন, সবাই ছবি আঁকতে পারে না ঠিকই, কেউ কেউ একটা সোজা দাগও টানতে পারে না। কিন্তু এতজনেরও মধ্যে একজন অন্তত…কাল দেয়ালে যে ছবিটা দেখলুম।

মহিমবাবু বললেন, বাজে, সব বাজে।

আমি বললুম, চন্দনদা, আমাদের বোধহয় গোড়াতেই একটা ভুল হয়ে গেছে চন্দনদা মুখ তুলে আমার দিকে সরু চোখে তাকাল।

আমি বললুম, আমরা ওদের কাগজ-পেন্সিল দিয়েছি। ওদের মধ্যে অনেকে জীবনে কখনো পেন্সিলই ধরেনি। কলম-পেন্সিল দিয়ে কী করে লিখতে হয়, সেটাও তো শেখা দরকার। হাতেখড়ির সময় বাচ্চাদের কলম ধরতে শেখানো হয় না? এদের হাতেখড়িই হয়নি, এরা আরও শিশু।

চন্দনদা বললেন, এটা একটা পয়েন্ট বটে। এরা পেন্সিল ধরতে জানে না। আমি বললুম, যারা জীবনে কখনো দেশলাই কাঠি জ্বালেনি, তাদের হাতে তুমি একটা দেশলাই দাও জ্বালতে পারবে না। অথচ কাজটা খুব সোজা! মেয়েরা কত সহজে সুই-সুতো দিয়ে শেলাই করে, কিন্তু তুমি আমি চেষ্টা করলে….

মহিমবাবু বললেন, বাদ দিন, এবার এসব কথা বাদ দিন! মিঃ ঘোষাল, আমাদের চার নম্বর প্লটের ঢালাইটা কি কালই হবে? আকাশে মেঘ জমেছে। আজই তা হলে সব ব্যবস্থা করতে হয়।

চন্দনদা মহিমবাবুর মুখের দিকে খানিকক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, আমার মাথায় আর একটা আইডিয়া এসেছে। আজ আর টিফিনের পরে কাজ করতে হবে না। ওদের হাফ-ডে ছুটি।

—এমনি এমনি ছুটি দিয়ে দেবেন?

—এমনি এমনি নয়। ওদের দিয়ে আবার ছবি আঁকাব!

—মিঃ ঘোষাল, কোম্পানি ওদের বিনা কাজে মাইনে দেবে?

—কোম্পানির ব্যাপারটা আমি দেখব। বিনা কাজ মানে কী, ছবি আঁকাটা একটা কাজ নয়?

—আমি অস্বীকার করছি না। কিন্তু সেটা কি কোম্পানির কাজ?

—আলবাৎ! আমরা এখানে কারখানা বানাব, শহর বসাব, কিন্তু তাতে স্থানীয় লোকদের জীবনযাত্রার কোনো ক্ষতি যাতে না হয়, সেটা দেখাও আমাদের কোম্পানির দায়িত্ব। জীবনযাত্রা মানে শুধু খাওয়া-পরা আর চাকরি নয়। কালচারাল অ্যাকটিভিটিও তো আছে। কেউ যদি ভালো ছবি আঁকে কিংবা গান গায় কিংবা খেলাধুলোয় ভালো হয়, তাদেরও এনকারেজ করতে হবে। এখন কে কেমন ছবি আঁকে দেখছি, পরে গানের ব্যাপারটা দেখতে হবে। তারপর খেলাধুলোর প্রতিযোগিতা।

আমার দিকে চেয়ে চন্দনদা বললেন, সবাইকে ডাক।

মিস্তিরি মজুররা এর মধ্যে আবার কাজে লেগে গেছে।

আমি বুঝতে পারি, আমার চাকরিটাই এখানে অবান্তর। এরা এখানে ফাঁকি দিতেই শেখেনি। কেউ দেরি করে আসে না, কত দূরের গ্রাম থেকে আসে, তবু ঠিক সময় আসে, ছুটির আগে কেউ পালাবার ছুতো খোঁজে না। মাইনেটা এদের কাছে নিমক, নিমক খেলে তা ঠিক ঠিক শোধ দিতে হবে। আমার কাজটাই বরং ফাঁকির।

কাজ ছেড়ে চলে আসবার জন্য সবাইকে ডাকতে এরা বেশ অবাক হলো। চন্দনদা হাত তুলে সবাইকে চুপ করার ইঙ্গিত দিয়ে বক্তৃতার ঢঙে বলতে লাগল, শোনো, অন্যদিন তোমরা যা কাজ করো, আজ তোমাদের তা করতে হবে না। রোজ রোজ এক কাজ আর ভালো লাগে? আজ তোমরা সবাই ছবি আঁকো। যে যা পার আঁকো। চেষ্টা করলে কিছু না কিছু পারবেই। গামলায় চুন গুলে নাও, তারপর আঙুল দিয়ে কিংবা কাঠি বা বুরুশ দিয়ে যার যেমন খুশি দেয়ালে আঁকো। যার ছবি আমার পছন্দ হবে, তাকে আমি একশো টাকা প্রাইজ দেব।

ইরফান আলি অপ্রসন্ন ভাবে বলল, আজ তিনতলা গাঁথনি আরম্ভ করেছি, এক ধারটা শেষ হয়ে যেত!

চন্দনদা বলল, কাল হবে, কাল হবে। যাও, যাও, সবাই শুরু করো। মিস্তিরি-মজুররা ছত্রভঙ্গ হবার পর চন্দনদা মহিমবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি আঁকতে পারেন?

মহিমবাবুর বিয়ার খাওয়ার প্রস্তাবে যে রকম প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, সেইরকম ভাবেই প্রায় আঁৎকে উঠে বললেন, ছবি? আমি? না, না, না—

চন্দনদা বলল, তা হলে চলুন, আপনি আর আমি কাজ করতে যাই। চার নম্বর সাইটটা দেখে আসি। এরা আঁকুক। নীলু, তুই চেষ্টা করতে পারিস। এক যাত্রায় আর পৃথক ফল হবে কেন? তোর ছবি ফার্স্ট হলে তুই পাবি একশো টাকা!

চন্দনদার জিপ সশব্দে বেরিয়ে গেল।

এদিকে চুন গোলা শুরু হয়ে গেছে। ছবি আঁকতে পারুক বা না পারুক, চন্দনদার আদেশটাকেও এরা কাজ বলে ধরে নিয়েছে। হতে পারে এটা সাহেবের খেয়াল, কিন্তু এর জন্য তো মাইনে কাটা যাবে না।

ফুলমণি সম্পর্কেই আমার বেশি কৌতূহল। ঐ বোবা মেয়েটা কালকের ছবিটা কেন মুছে দিল আজ সাত সকালে এসে? অত ভালো ছবি আঁকে, ও কি সত্যিই পেন্সিল ধরতে জানে না? কিংবা ও লজ্জা পেয়ে গেছে?

অন্যদের সঙ্গে ফুলমণিও চুন গুলছে।

আমি কিছুক্ষণ বই নিয়ে বসে রইলুম ঘরটার মধ্যে। আধঘণ্টা বাদে অন্যদিনের মতনই বেরিয়ে পড়লুম কাজ ‘পরিদর্শনে। ইরফান আলি ও আর দুজন এক জায়গায় বসে বিড়ি ফুঁকছে। ইরফান আলি হেড মিস্তিরি, চুনের কাজে হাত দিতে বোধহয় তার সম্মানে বাধে।

অন্য অনেকে কিন্তু বিভিন্ন দেয়ালে ছবি আঁকতে শুরু করেছে। কাঠির মাথায় ন্যাকড়া জড়িয়ে তৈরি করেছে বুরুশ। কেউ কেউ আঁকছে শুধু আঙুলে।

ফুলমণি আঁকছে দোতলার একটা দেয়ালে! খুব দ্রুত হাত চালাচ্ছে সে। ঐ দেয়ালে যে রোদ পড়েছে, তার রংটা যেন অন্যরকম। ওঃ হো, উল্টো দিকটা উত্তর, সেদিকটা খোলা। উত্তরের আলো ছবি আঁকার পক্ষে প্রকৃষ্ট, মেয়েটা তা জানল কী করে?

চুনে আঙুল ডুবিয়ে সে লম্বা লম্বা টান দিচ্ছে। কী আঁকছে বোঝাই যাচ্ছে না। মেয়েটার চোখ শুধু আঙুলের ডগায়।

দূর থেকে আমি তার টেকনিকটা লক্ষ করলুম। কখনো আঙুল চ্যাপ্টা করে টানছে মোটা মোটা রেখা, কখনো নখ দিয়ে ফুটিয়ে তুলছে সরু সরু রেখা। তার ডান হাতের একটা নখ বেশ বড়।

ওর মনঃসংযোগের ব্যাঘাত না ঘটিয়ে আমি নেমে গেলুম নীচে। অন্য যে তিনটি সাঁওতাল মেয়ে সব সময় হাসাহাসি করে, তারাও এখন আঁকায় ব্যস্ত, একজন তীর ধুনক হাতে এক বীরপুরুষের রূপ ফুটিয়ে তুলেছে অনেকটা, মন্দ নয় তো ছবিটা!

একা একা একটা সিগারেট ধরিয়ে আমার মনে হলো, চন্দনদাকেই একটা কিছু পুরস্কার দেওয়া উচিত। এমনিতে চন্দনদাকে আমার খুব একটা পছন্দ নয়। নানা রকম হুজুগ তুলে প্রায়ই নিজের সংসারে নানারকম গোলমাল পাকায়। একবার তো নীপা বউদির সঙ্গে ডিভোর্স হয়ে যাচ্ছিল প্রায়। বাবা-মায়ের ঝগড়ায় তিতিবিরক্ত হয়ে ওদের মেয়ে মুমু আত্মহত্যা করতে যাচ্ছিল!

কিন্তু একটা কোম্পানির বড়সাহেব হয়ে, নিজের মিস্তিরি-মজুরদের দিয়ে কাজ করাবার বদলে ছবি আঁকাচ্ছে, এ রকম কী ভূভারতে আর কোথা পাওয়া যাবে? চন্দনদার হুজুগগুলো আলাদা ধরনের।

হঠাৎ গোঁ গোঁ শব্দ করে একটা লরি এসে থামল গেটের সামনে। লরি ভর্তি বালি।

অন্যদিন লরিতে সুরকি, বালি, ইঁট বা সমেন্ট এলে ইরফান আলিই সব কিছু বুঝে নেয়। আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় পাশে, মালিকদের প্রতিনিধি হিসেবে। আমাদের লোকেরাই ওসব নামিয়ে নেয় লরি থেকে।

আজ তো সে প্রশ্নই ওঠে না।

প্রথম কথা, আমাদের মিস্তিরি মজুররা এখন শিল্পী, তাদের শারীরিক পরিশ্রম করার কথা নয়। শিল্পীর আঙুল এখন বালিতে ডুবতেই পারে না।

দ্বিতীয় কথা, লরিওয়ালা তার লোক দিয়ে যদি মালটা নামিয়ে দিতে চায়, তাতেও শব্দ হবে, শিল্পীদের ব্যাঘাত ঘটবে! অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিংবা যামিনী রায় ছবি আঁকছেন। আর কাছেই কিছু লোক হুসহাস শব্দ করে লরি থেকে বালি নামাচ্ছে, এ দৃশ্য কি কল্পনা করা যায়? আমাদের এই নবীন শিল্পীরা কেউ যে অবনী ঠাকুর বা যামিনী রায় হচ্ছে না, তা কে বলতে পারে?

লরি ড্রাইভার নেমে দাঁড়িয়েছে, তাকে আমি বললুম, আজ মাল নামানো হচ্ছে না, ওয়াপস যাও, কাল আও।

বিকেলবেলা জায়গাটা এত নিস্তব্ধ দেখে লরিওয়ালা কিছুটা কৌতূহলী হয়েছে, আমার কথা শুনে আরও অবাক হলো।

সে জিজ্ঞেস করল, কিউ।

আমি বললুম, মিস্তিরি লোক আভি ছবি আঁকতা হ্যায়। তসবির, তসবির, তসবির বানাতে হ্যায়।

সে বলল, কেয়া?

বিস্ময়ে লোকটির চোয়াল ঝুলে গেছে। কিছুই বুঝতে পারছে না। লোককে চমকে অবাক করে দেওয়াটা আমার প্রিয় খেয়াল। আমি ওকে আরও গুলিয়ে দেবার জন্য এক হাতের পাঞ্জায় পেন্সিল বুলোবার ভঙ্গি করে বললুম, ছবি, ছবি! এই সময় ইরফান আলি ছুটতে ছুটতে এলো। এক মুঠো বালি নিয়ে পরীক্ষা করতে করতে বলল, কেইসান বালি লায়া? মোটা দানা। ঠিক হ্যায়, ওহি কোনাসে উতারো।

আমি বললুম, আজ বালি উতারোবে না। কাল আনবে।

ইরফান আলি প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিল, আমি জোর করে বললুম, কাল, কাল একদিন পরে বালি এলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না।

ইরফান আলিকে জব্দ করে এবং হতভম্ব লরি ড্রাইভারকে ফিরিয়ে দিয়ে আমায় বেশ তৃপ্তি হলো। প্রতিদিন তো আর এরকম ঘটনা ঘটে না।

পাঁচটা বাজার একটু পরে আকাশে ঘনিয়ে এল মেঘ। আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে আলো। এরপর আর ছবি আঁকা যাবে না, ইলেকট্রিসিটিও নেই। ওদের মেয়াদ ছটা পর্যন্ত।

আকাশের অবস্থা দেখেই সাত তাড়াতাড়ি চন্দনদা চলে এল মহিমবাবুকে সঙ্গে নিয়ে। ব্যস্ত হয়ে বলল, যতদূর হয়েছে তাই-ই দেখা যাক। আর দেরি করা যাবে না।

শুরু হলো একতলার দেয়াল থেকে

ইরফান আলি কিছুই আঁকে নি। অন্য দু’জন কলের মিস্তিরিও চুন ছোঁয়নি হয়তো তাদের কোনো রকম সংস্কার আছে।

চন্দনদা ইরফান আলিকে জিজ্ঞেস করল, কী আলিসাহেব, আপনি কিছু আঁকলেন না?

ইরফান আলি চাপা বিদ্রূপের সুরে বলল, আমার একশো টাকার ইনাম দরকার নেই, বড়বাবু। ওরা কেউ নিক।

আমি চন্দনদার হাতে মৃদু চাপ দিলুম। যারা কিছু আঁকেনি, তাদের কোনো চাপ না দেওয়াই ভালো।

একতলার দেয়ালগুলো দেখতে দেখতে এগোলুম আমরা। অন্যদের তুলনায় সাঁওতালদের আঁকাই চোখে পড়ার মতন। তারা প্রত্যেকেই কিছু না কিছু এঁকেছে। সাঁওতালদের গ্রামে গিয়েও দেখেছি, তারা বাড়ির সামনে আল্পনা দেয়, মাটির দেয়ালে অনেক কিছু এঁকে রাখে। বাসন্তী নামে একটি মেয়ে, যে সব সময় ফিকফিকিয়ে হাসে আর উঁচু স্কেলে কথা বলে, সে এঁকেছে একটা সম্মিলিত নাচের দৃশ্য। সাত-আটটি নারী পুরুষ কোমর ধরাধরি করে আছে।

চন্দনদা সেই ছবির সামনে দাঁড়িয়ে বলল, বাঃ।

বাসন্তী হেসে উঠে জিজ্ঞেস করল, কেমন গো বাবু?

চন্দনদা আবার বলল, বাঃ!

আমি চন্দনদাকে ওপরে যাবার জন্য তাড়া দিতে লাগলুম।

‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি’। সবাই শিল্পী হয় না, একজন দু’জনই হয়। কোনো সন্দেহ নেই, ফুলমণিই এখানে একমাত্র শিল্পী। অন্যরা দর্শনীয় কিছু কিছু এঁকেছে বটে। কিন্তু খাঁটি অর্থে ছবি বলতে যা বোঝায়, তা এই একখানাই।

ফুলমণি তখনো ছবিটা শেষ করছিল, আমাদের দেখে এক পাশে সরে গেল। বড় দেয়াল জুড়ে ফুলমণি এঁকেছে একটা ল্যান্ডস্কেপ। পাহাড়ের তলা দিয়ে বয়ে যাচ্ছে ছোট নদী, সেই নদী দিয়ে পার হচ্ছে কয়েকটা মোষ, একটা মোষের পিঠে বসে আছে রাখাল, তার মাথার ওপরে উড়ছে কয়েকটা বক। শুধু চুন নয়, খানিকটা কাঠকয়লাও ব্যবহার করা হয়েছে। চুনের ফ্যাটফেটে সাদা ভাবটার মধ্যে খানিকটা কালো মিশিয়ে গভীরতা আনা হয়েছে অনেকখানি।

চন্দনদা অভিভূত ভাবে একবার ছবিটার দিকে, আর একবার ফুলমণির দিকে তাকাতে লাগল। সত্যিই, বিশ্বাস করা যায় না যে, যে-মেয়েটা সারাদিন মাথায় ইঁট বয়ে জীবিকা অর্জন করে, সে কী করে এমন ছবি আঁকে। লেখাপড়া জানে না, দুনিয়াটা চেনে না। ছবির ইতিহাস সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই, অথচ আধুনিক ছবির ধারার সঙ্গে এ ছবির রীতিমত মিল আছে। কোনো রকম শিক্ষা ছাড়া এ রকম ছবি আঁকা যায়?

চন্দনদা ফুলমণির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ও মেঝেন, তোমায় ছবি আঁকা কে শেখাল? তুমি অন্য কোনো ছবি দেখে এটা এঁকেছ?

ফুলমণি কোনো উত্তর দিল না।

আমি বললুম, চন্দনদা, ছাদ থেকে এই নদীটা দেখা যায়। আজ সকালেই আমি দেখেছি!

আমাকে মাথায় করে ইঁট বইতে হয় না, দেয়াল গাঁথতে হয় না, আমি ছাদে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে দূরের দৃশ্যটা উপভোগ করেছিলুম। ফুলমণি সারাক্ষণ কাজে ব্যস্ত ছিল। তার মধ্যেই সে এই দৃশ্যটা দেখল কখন? শুধু দেখেনি, মনে গেঁথে নিয়েছে।

অন্যরা ভিড় করে এই ছবি দেখতে এসেছে। অনেকেই ছবি আঁকতে পারে না, ছবি দেখার চোখও থাকে না। ছবি দেখার অভ্যেস যাদের নেই, তারা রিয়েলিস্টিক ছবি দেখেও বিষয়বস্তু চিনতে পারে না।

আমি ছাদের দৃশ্যটা উল্লেখ করায় ওদের একজন বলল, হ হ, লদী বটে!

অন্য একজন বলল, কালা কালা উগুলান কী, খাঁসী লয়?

বাসন্তী, যে কিছুটা আঁকতে পারে, সে বলল, কানা নাকি তুই, খাঁসী কুথায়, ওগুলান কাড়া, বড় বড় শিং….

চন্দনদা বলল, এই মোষগুলো দ্যাখ, লাইনের কী জোর! একটাও স্ট্যাটিক নয়। প্রত্যেকটার ঘাড় ঘোরানো, পা তোলা আলাদা। কেউ কম জলে, কেউ বেশি জলে। যারা সাধারণ ছবি আঁকে, তারা মোষ আঁকতে গেলে আখাম্বা একটা মোষ এঁকে দেয়। এ ছবি অসাধারণ।

আমি বললাম, পাখিগুলো দ্যাখো। সামান্য একটা করে প্যাচ দিয়েছে, কিন্তু ঠিক বোঝা যায়, ওগুলো কাক কিংবা চিল নয়, উড়ন্ত বক।

চন্দনদা আঙুল তুলে বলল, আমার সবচেয়ে ভালো লাগছে এই মোষটা। এবার আমারও অবাক হবার পালা। চারটে মোষ ঠিক চেনা যাচ্ছে। কিন্তু চন্দনদা যেখানে আঙুল দেখাচ্ছে, সেখানে মোষ কোথায়? প্রথমে মনে হয়েছিল, ছবির মধ্যে এমনি একটা ধ্যাবড়া পড়ে গেছে। ভালো করে দেখে মনে হলো, জলে একটা কিছু ভেসে যাচ্ছে!

আমি বললুম, মোষ কই? ওটা, ওটা যেন জলে ভাসছে একটা তিনকোনা কিছু, অনেকটা যেন মনে হচ্ছে সাইকেলের সিট!

চন্দনদা বিরাট জোরে হা-হা করে হেসে উঠল।

তারপর বলল, তুই যে পিকাসোর ঠিক উলটো বললি! পিকাসোর সেই বিখ্যাত গল্পটা জানিস না?

—কোনটা?

—পিকাসোর বাড়িতে একবার চোর এসেছিল। খুটখাট শব্দে পিকাসোর ঘুম ভেঙে যায়। পিকাসো কে কে বলে চ্যাচাতেই চোরটা বারান্দা দিয়ে লাফিয়ে পালাল। পিকাসো দৌড়ে বারান্দায় এসে এক ঝলক শুধু দেখতে পেলেন গলি দিয়ে সাইকেল চেপে চোরটা দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে! পরদিন সকালে পুলিশ এসে সব খোঁজ খবর নিতে নিতে পিকাসোকে জিজ্ঞেস করল, আপনি চোরটাকে কেমন দেখেছিলেন, একটু বর্ণনা করতে পারবেন? পিকাসো মুখে কিছু না বলে ছবি এঁকে দিলেন। কী আঁকলেন জানিস? একটা মোষের মাথা!

মহিমবাবু এতক্ষণ কোনো কথা বলেননি, এবার বললেন, অ্যাঁ?

চন্দনদা বলল, পিকাসো যা দেখেছিলেন, হুবহু তাই এঁকেছিলেন। একরকম সাইকেল হয়, দুদিকে হ্যান্ডেল উঁচু হয়ে থাকে। রেসিং সাইকেল যাকে বলে। সেই সাইকেলে বসে মাথা নীচু করে কেউ যদি খুব জোরে চালায়, দূর থেকে একটা শিংওয়ালা মোষের মাথাই মনে হবে। এখানে এই ছবিতে, মোষটা সারা শরীর ডুবিয়ে আছে জলে, শুধু মাথার ওপরটা দেখা যাচ্ছে। তাই তোর মনে হচ্ছে সাইকেলের সিট।

মহিমবাবু বললেন, পিকাসো, খুব বড় শিল্পী, না? নাম শুনেছি। দু’একখানা ছবিও দেখেছি। কিছু বোঝা যায় না মাথামুণ্ডু। না বোঝা গেলে সেটা কি করে ভালো ছবি হয় মশাই?

চন্দনদা মহিমবাবুর কাঁধে চাপড় মেরে বললেন, মশাই, এ বিষয়েও পিকাসোর নিজেরই গল্প আছে। প্যারিসে একটা পার্টিতে একটি খুব সাজগোজ করা মহিলা এসে পিকাসোকে ধরেছিল। নাকি সুরে অনুযোগ করে বলেছিল, মিঃ পিকাসো, আপনার ছবি দেখে কিছুই বুঝতে পারি না। উল্টো না সোজা, তা পর্যন্ত বোঝা যায় না। এরকম ছবি আঁকার কি কোনো মানে আছে? পিকাসো উত্তর দিলেন, ম্যাডাম, আপনি কখনো চীনে ভাষা শুনেছেন? তার একটি বর্ণও বোঝেন? তার মানে কি আপনার ধারণা, চীনে ভাষার কোনো মানে নেই? সমস্ত চাইনিজরা মিনিংলেস ভাষায় কথা বলে? শিখলেই চীনে ভাষার ঐশ্বর্য বোঝা যায়। ছবি দেখাও শিখতে হয়। না শিখে কথা বলতে আসে মূর্খরা

চন্দনদা এবার আমার দিকে ফিরে বলল, নীলু, গাড়ি থেকে আমার ক্যামেরাটা নিয়ে আয়। এটা আবার কেউ মুছে ফেলার আগেই একটা ছবি তুলে রাখব। আর হ্যাঁ, আমি একশো টাকা পুরস্কার দেব বলেছিলাম। এই ছবি তার অনেক বেশি পাওয়ার যোগ্য। আমি দুশো টাকা দিচ্ছি।

পকেট থেকে পার্স বার করে চন্দনদা বলল, কোথায় ফুলমণি?

ভিড় ফাঁক হয়ে গেল, সবাই এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। ফুলমণি নেই। কয়েকজন ডাকাডাকি করতে লাগল ওর নাম ধরে। চন্দনদা পিকাসোর লম্বা গল্প ফাদার সময় ফুলমণি সরে পড়েছে।

আমি বারান্দায় গিয়ে দেখলাম, দূরে মাঠের মধ্য দিয়ে ছুটে ছুটে চলে যাচ্ছে ফুলমণি। শেষ বিকেলের ম্লান আলোয় তাকে দেখাচ্ছে ঠিক যেন, কিসের মতন? কিসের মতন? কিসের মতন? নাঃ, আমার তো শিল্পীর চোখ নেই, কোনো উপমাও আমার মনে এল না!

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন