পঁচিশ বছর পর

সায়ক আমান

(Based on an infamous incident that occurred in Poitiers–France– in the year 1901)

রাত ঠিক আড়াইটে নাগাদ শিশির সান্যালের ডেস্কে রাখা ফোনটা বেজে উঠল৷ শিশিরবাবু ঘুমিয়েই পড়েছিলেন, আচমকা শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেল৷ একঝটকায় ঘোর কাটিয়ে রিসিভারটা কানে চেপে ধরলেন, ‘হ্যালো, বিধাননগর থানা৷’

ওপাশ থেকে প্রথমে ফিনফিনে গলা শোনা গেল, চাপা কান্নার আওয়াজ কি? কিছু একটা প্রশ্ন করতে যাচ্ছিলেন শিশিরবাবু, কান্না থেমে গিয়ে প্রথম কথা শোনা গেল, মেয়েলি গলায় কাঁদতে কাঁদতে শব্দগুলো বলে চলেছে কেউ, ‘এ বাড়িতে কিছু একটা আছে… আপনি আমাকে বাঁচান মামাবাবু…’

 মামাবাবু? গলাটা চিনতে পারলেন সান্যাল৷ ঋতু৷ দিন সাতেক আগেই ঋতুকে মল্লিক বাড়িতে কাজে লাগিয়েছেন সান্যাল৷ নিজে সুপারিশ করে বহাল করেছেন৷ বাড়িতে কি তবে গোলমাল হয়েছে কিছু?

—‘কী হয়েছে ঋতু? কাঁদছ কেন তুমি?’ রিসিভারটা কানে রেখেই কোমর সোজা করে উঠে দাঁড়ালেন তিনি৷

‘আপনি যত তাড়াতাড়ি পারেন এখানে চলে আসুন৷ না হলে আমাকে… প্লিজ… প্লিজ… মামাবাবু…’ কান্নার দমকে কথা আটকে যায়৷

—‘কিন্তু কেন? কী আছে ও বাড়িতে?’

—‘যশোদা… যশোদা ফিরে এসেছে… আমি নিজে দেখেছি, কাউকে ছাড়বে না…’

কথাটা শেষ করতে পারে না ঋতু, কান-ফাটানো চিৎকার শোনা যায় ওপাশ থেকে, সঙ্গে একটা মিহি হাসির আওয়াজ৷ ফোন কেটে যায়৷

শিশির সান্যালের বুকের মাঝখানটা গরম হয়ে ওঠে৷ মেয়েটা হয় বিপদে আছে, না হয় কোনও কারণে ওর মাথা খারাপ হয়ে গেছে৷ দ্রুতহাতে কল ব্যাক করেন তিনি৷ ফোন কেটে যায় বার-বার৷

পাশের টেবিলে হাবিলদার সুখলাল বসে ছিল, সান্যালের থমথমে মুখের দিকে চেয়ে সে জিজ্ঞেস করে, ‘কী হয়েছে স্যার? কিছু গোলমাল?’ রিভলভারটা কোমরের খাপে ভরতে ভরতে সান্যাল বলেন, ‘বৃন্দাবনকে ডাক দাও, এখুনি বেরোতে হবে আমাদের৷’

—‘কোথায়?’

—‘৬/এ মল্লিক বাড়ি, কুইক৷ বেশি দেরি করলে মেয়েটার বড় কোনও ক্ষতি হয়ে যেতে পারে৷’

—‘মল্লিক বাড়ি, মানে যেখানে আপনি সেই মেয়েটাকে কাজ দিলেন? কিন্তু কে ক্ষতি করবে ওর?’

—‘যশোদা মল্লিক… সে নাকি ফিরে এসেছে৷’ সান্যাল দরজার দিকে এগোতে এগোতে বলেন৷

—‘ফিরে এসেছে! কোথায় গিয়েছিল?’

সান্যাল ঘুরে দাঁড়ান, থমথমে গলায় বলেন, ‘মল্লিক বাড়ির ছোটমেয়ে যশোদা মল্লিক, আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে মারা গিয়েছে৷’

(দুই)

ব্রিফকেসটা টেবিলের উপরে রেখে মাথা ঘুরিয়ে চারপাশটা দেখে নিল ঋতু৷ বাইরে থেকে বাড়িটাকে দেখেই অদ্ভুত বিষণ্ণতা এসে চেপে ধরেছিল তাকে৷ ভিতরে এসে সেটা বেশ কয়েক ধাপ বেড়ে গেল৷

অন্তত শ-দেড়েক বছর বয়স হবে বাড়িটার৷ তিনতলা৷ ইংরেজ আমলের কায়দায় তৈরি৷ সে সময়ে বিস্তর খরচাপাতি করে বাড়িটা তৈরি হয়েছিল সন্দেহ নেই৷ ইদানীং কিছুটা যত্নের অভাব লক্ষ করা যায়৷ চারদিকের দেওয়ালে কালো ছোপ ধরেছে৷ প্রাচীনত্বের ভূত এসে ভর করেছে বাড়ির উপরে৷ এত বড় একটা বাড়িতে মাত্র দুটো মানুষ থাকে৷ ভাবতেই অবাক লাগে ঋতুর৷

—‘আপনার থাকার ঘরটা একতলাতেই, মায়ের পাশের ঘরটাই৷’ পরিতোষ মল্লিকের গলাটা পাশ থেকে ভেসে আসতে চমক ভাঙে ঋতুর, সে একগাল হাসে, পরিতোষ সিঁড়ির পাশ দিয়ে এগিয়ে যাওয়া প্যাসেজটার দিকে হাত দেখান, ‘এদিকে আসুন৷’

বাগান পেরিয়ে সদর দরজা দিয়ে ঢুকলে একচিলতে বসার ঘরে এসে দাঁড়াতে হয়৷ তার ডানদিকে সিঁড়ি উঠে গিয়েছে৷ সিঁড়ির পাশ দিয়ে সরু প্যাসেজ চলে গিয়েছে৷ সেদিকে কয়েকটা ঘর আছে বোধহয়৷

ঋতু এগোতেই যাচ্ছিল, এমন সময় সিঁড়ির লাগোয়া দেওয়ালে চোখ আটকে যায় ওর, লাইন দিয়ে তিনটে ছবি ঝোলানো আছে সেখানে, ছবিগুলো বেশ পুরোনো, উপরের কাচে ধুলো পড়ে বেশির ভাগটাই আবছা হয়ে গিয়েছে৷ আঙুল দেখিয়ে সে বলে, ‘এরা কি আপনাদের পূর্বপুরুষ?’ পরিতোষ একটু হাসে, প্রথম ছবিটা দেখিয়ে বলে, ‘ইনি আমার বাবা, দুর্গাপ্রসাদ মল্লিক, প্রায় বছর তিরিশেক হল মারা গেছেন… আর এটা…’ পাশের ছবিটার দিকে এগোয় পরিতোষ, ‘আমার বোন, যশোদা৷’ পরিতোষের গলার স্বর উদাস শোনায়৷

—‘উনিও মারা গেছেন?’

—‘হ্যাঁ… নাইন্টিন নাইন্টি ফাইভ… পঁচিশ বছর হতে চলল৷ বোন মারা যাবার পর থেকেই মায়ের শরীরটা খারাপ হতে শুরু করে৷ এত বছর পরেও শোকটা কাটিয়ে উঠতে পারেননি৷’

যশোদা মল্লিকের ছবিটার দিকে ভালো করে তাকায় ঋতু৷ তেইশ কি চব্বিশ বছর বয়স হবে মেয়েটার৷ ডাগর ডাগর হরিণের মতো দুটো চোখ, টকটকে ফরসা গায়ের রং, সেই সঙ্গে একমাথা কোঁচকানো চুল, ঋতুর চোখ আটকে যায়৷ এত সুন্দর একটা মেয়ে আগে দেখেনি সে৷ মনে মনে একটু হিংসাই হয় তার৷

—‘ভারী সুন্দর ছিলেন আপনার বোন, এই বয়সেই মারা যান?’

—‘আজ্ঞে হ্যাঁ৷’

—‘ইশ, কী করে?’

—‘বলছি, আগে ঘরটা দেখিয়ে দিই৷’

জিভ কেটে সামনে এগোতে থাকে ঋতু৷ কৌতূহল ব্যাপারটা তার বরাবরই বেশি৷ এর আগে যে হাসপাতালে কাজ করত, সেখানেও ধমক ধামক খেয়েছে বেশ কয়েকবার৷ অথচ শোধরায়নি৷ ওর নিজের বয়সও প্রায় পঁচিশ হতে চলল, অথচ মনটা এখনও শিশুর মতো৷ হাবভাবেও কৈশোরের ছাপ রয়ে গিয়েছে৷

প্যাসেজ ধরে বেশ কিছুটা এগিয়ে এলে শেষ প্রান্তে দুটো ঘরের দরজা চোখে পড়ে৷ তার মধ্যে একটা এখন বন্ধ৷ অন্যটায় হালকা একটা ঠেলা দিয়ে খুলে ফেলেন পরিতোষ৷ ঘরের ভিতরটা দেখিয়ে বলেন, ‘পাশেরটা মায়ের৷ মা এখন ঘুমোচ্ছেন, উঠলে দেখা করবেন, কেমন?’

লাজুক হাসিটা হেসে ঘরের ভিতরে ঢুকে আসে ঋতু৷ বেশি বড় নয় ঘরটা, দু-দিকের দেওয়াল জুড়ে মোট চারটে জানলা করা আছে৷ মেঝের উপরে হালকা ধুলোর আস্তরণ৷ এককোণে জামাকাপড় ঝোলানোর মতো আলনা, একটা পড়ার টেবিল আর বিছানা ছাড়া অন্য কোনও আসবাব নেই৷

ব্রিফকেসটা টেবিলের উপরে রেখে চেয়ারে বসে পড়ল ঋতু৷ পরিতোষ মল্লিক কিন্তু বসলেন না, সুইচ টিপে পাখাটা চালিয়ে দিয়ে বললেন, ‘বুঝতেই পারছেন, বাড়িতে আমরা দু-জন মাত্র থাকি, ফলে কাজকর্ম সব আপনাকেই বুঝে নিতে হবে৷ প্রথমে একটু অসুবিধা হবে…’

—‘না না, একদম চিন্তা করবেন না৷ আমি এর আগেও…’ ঋতুর কথা শেষ হয় না৷ পাশের ঘর থেকে একটা চাপা গোঙানির শব্দ ভেসে আসে, যেন কাতর কণ্ঠে সাহায্য চাইছেন কোনও মহিলা৷ পরিতোষ ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে বলেন, ‘মা উঠে পড়েছেন, আপনি হাত-মুখ ধুয়ে পাশের ঘরে আসুন একবার৷’

পরিতোষ বেরিয়ে যেতে ঘরের লাগোয়া বাথরুমে ঢুকে মুখ-হাত ধুয়ে নেয় ঋতু৷ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কলটা খুলে দেয়৷ দু-হাত ভরে জল নিয়ে মুখে জলের ঝাপটা দেয়৷ হঠাৎ কী একটা শব্দ কানে আসে তার৷ কান পেতে শোনার চেষ্টা করে কল থেকে জল বেরিয়ে বেসিনের উপরে এসে পড়ছে৷ ছলছল করে শব্দ হচ্ছে তাতে, তার সঙ্গে মিশে খুব ক্ষীণ, অস্পষ্ট অন্য একটা শব্দও শোনা যাচ্ছে৷ যেন জলের ভিতরে একটা ছুরি শান দিচ্ছে কেউ, নাকি মানুষের গলার আওয়াজ?

মনের ভুল ভেবে কলটা বন্ধ করে দেয় সে৷ শব্দ থেমে যায়৷ কী মনে হতে আবার চালিয়ে দেয় কলটা৷ আর কোনও শব্দ নেই৷ একটু হেসে ঋতু বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসে৷

মিসেস মল্লিকের বয়স অন্তত সত্তরের আশপাশে৷ একবার দেখলেই মনে হয়, সশরীরে উঠে প্রায় কোনও কাজই করতে পারেন না মহিলা৷ গোটা মুখে বলিরেখার দাগ৷ শরীরে প্রতিটা ইঞ্চির চামড়া কুঁচকে গিয়েছে৷ কাঠিন্যে ভরা মুখ, বোঝা যায় একসময় যথেষ্ট জাঁদরেল ছিলেন মহিলা৷ ইদানীং হয়তো শরীর সায় দেয় না৷ চাদর দিয়ে গলা অবধি ঢেকে শুয়ে আছেন তিনি৷ ঠিক পায়ের কাছে বসে আছেন পরিতোষ৷

মুখ তুলে একবার ঋতুকে দেখে নিলেন মিসেস মল্লিক, পরিতোষ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘ইদানীং মায়ের শরীরটা একটু বেশি খারাপ করছে৷ তাই আপনাকে আনা, না হলে এ বাড়িতে অন্য কেউ এসে থাকুক, সেটা মা পছন্দ করেন না৷’

ঋতু বুঝতে পারে, মিসেস মল্লিকের ঘোলাটে চোখের দৃষ্টি এখনও এসে পড়ছে ওর মুখে, অস্বস্তি হয় ওর৷

—‘শোনো ছুকরি, এ বাড়িতে তুমি কাজ করছ মানে এই নয় যে বাড়িটা কিনে ফেলেছ…’ ঠান্ডা বরফের মতো কণ্ঠ মহিলার, ‘কোথাও যেতে গেলে বা কিছু সরাতে গেলে আমাকে জিজ্ঞেস করবে আগে৷ আগ বাড়িয়ে কিছু করার দরকার নেই৷’

ঋতু ঘাড় নাড়ায়৷ সঙ্গে সঙ্গে বাজ পড়ার মতো ধমক শোনা যায়, ‘আমি কিছু জিজ্ঞেস করলে মুখে উত্তর দেবে৷ ঘাড় নাড়ানোটা অভদ্রতা৷ কানে গিয়েছে?’

—‘হ্যাঁ৷’ মাথা নামিয়ে বলে ঋতু৷

—‘আমি এই একতলার ঘর থেকে বেশি একটা বেরোই না৷ তুমিও এখানেই থাকবে৷ আমার ছেলে একা থাকে দোতলায়, তিনতলাটা আজ অনেকদিন যাবৎ ফাঁকা পড়ে আছে৷ দিনে একবার দোতলায় গিয়ে ওর খাবার দিয়ে আসবে, বুঝতে পেরেছ?’

—‘হ্যাঁ৷’

—‘বেশ৷ এবার তোমরা যাও৷ আমার শরীর খারাপ নেই এখন৷ দরকার হলে ডাকব৷’

ঘর থেকে বেরিয়ে ঋতু বড়সড় একটা নিশ্বাস ফ্যালে৷ এতক্ষণ যেন একটা দরজা বন্ধ খাঁচার ভিতরে আটকে পড়েছিল৷ নিজের ঘরের চেয়ারে এসে জড়োসড়ো হয়ে বসে পড়ে সে৷

—‘মায়ের আচরণে কিছু মনে করবেন না৷ আমি তো ছোট থেকে দেখে আসছি৷ একটু রাশভারী, তবে মনটা ভারী নরম৷’ উলটোদিকের চেয়ারে বসতে বসতে বলতে থাকেন পরিতোষ, ‘এ এলাকায় যে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই বুঝতে পারবেন৷ দরকারে-অদরকারে মায়ের কাছে এলে কেউ ফাঁকা হাতে ফিরে যায়নি৷ শ্বশুরবাড়িতে মারধর খেয়ে পালিয়ে আসা কত মেয়েকে যে আশ্রয় দিয়েছিলেন…’

—‘তিনতলাটা ফাঁকাই পড়ে আছে? কেউ থাকে না ওখানে?’ প্রসঙ্গটা পালটে ফ্যালে ঋতু৷

—‘আজ্ঞে না৷ চাইলে দেখে আসতে পারেন, তবে যত্ন নেওয়া হয় না বলে মাকড়শার ঝুলে ঢেকে গিয়েছে একদম৷ আমিই মাসে একবার গিয়ে একটু সাফসুতরো করে আসি৷’

—‘কে থাকতেন ওখানে?’

দাড়িতে হাত রাখেন পরিতোষ, ‘এ বাড়িটা আগে দোতলা ছিল, পরে বাবা নিজের কাজকর্ম আর পড়াশোনার জন্যে তিনতলাটা বানান৷ তবে বেশি দিন ওখানে থাকতে পারেননি৷ আমি আর যশোদা থাকতাম দোতলার ঘরে৷ ওর ঘরটাও এত বছর ফাঁকাই পড়ে আছে৷’ যশোদার মুখটা আবার মনে পড়ে যায় ঋতুর৷ কী মায়াভরা চোখ দুটো মেয়েটার৷ নাকের ঠিক পাশে একটা ছোট্ট কালো তিল৷

—উনি কী করে মারা গিয়েছিলেন বলুন তো?’

প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে একটু সময় নেন পরিতোষ৷ আর ঠিক সেই সময়ের মধ্যে আবার সেই পুরোনো শব্দটা কানে আসে ঋতুর৷ আগের থেকে আরও ক্ষীণ, একটা ধারালো ছুরিকে যেন মেঝের উপরে ঠুকছে কেউ৷ পাখার নড়াচড়া থেকে আসছে কি শব্দটা?

—‘যশোদার তখন পঁচিশ বছর বয়স৷ জানি না কেন বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মাথার কিছু গন্ডগোল দেখা দেয় ওর৷ বাড়ি থেকে বেরোতে চাইত না, কারও সঙ্গে কথা বলত না৷ কেউ জোর করে কথা বলতে গেলে তাকে আক্রমণ করে বসত৷ শেষে একদিন…’ থেমে পরের কথাগুলো বলেন পরিতোষ, ‘একদিন ওর ঘর খুলে আমরা দেখি, ওর দেহটা রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে পড়ে৷ ছুরি দিয়ে নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করেছে ও৷’

একটা ঠান্ডা হাওয়া এসে হঠাৎই কাঁপিয়ে দিয়ে যায় ঋতুকে৷ একটু আগেই ছুরির আওয়াজ কানে আসছিল৷ হয়তো মনের ভুলেই….

—‘কিন্তু কেন?’ কোনওরকমে ঢোঁক গিলে বলল৷

—‘জানি না, তদন্ত একটা হয়েছিল, তবে বিশেষ কিছু জানা যায়নি তাতে৷’

কয়েকটা নিস্তব্ধ মুহূর্ত কেটে যায়৷ পরিতোষ উঠতে উঠতে বলেন, ‘আমি এখন আসি বরং৷ আপনি বিশ্রাম করুন৷’

তাঁর দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিতে যাচ্ছিল ঋতু৷ আচমকাই কাঁপা-কাঁপা গলায় দরজার দিকে তাকিয়ে সে চেঁচিয়ে ওঠে, ‘কে… ওখানে কে?’

পরিতোষের চোখ দরজার দিকে ঘুরে যায়, চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলেন, ‘কই কেউ নেই তো, কাকে দেখলেন আপনি?’

—‘একটা ছায়া, দরজা থেকে সরে গেল৷’

দু-জনেই দ্রুত পা চালিয়ে দরজার কাছে সরে আসে৷ পাশের ঘরের দরজা আগের মতোই বন্ধ৷ প্যাসেজ ফাঁকা৷ কোথাও কেউ নেই৷ মায়ের ঘরে একবার উঁকি দেয় পরিতোষ৷ এখনও পাশ ফিরে শুয়ে আছেন৷

—‘উঁহুঁ, ভুল দেখেছেন আপনি৷ ক্লান্ত আছেন, আজকের মতো আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ুন৷’

পরিতোষ বেরিয়ে যেতে দরজা বন্ধ করে ঘরের আলো নিভিয়ে জানলার কাছে সরে আসে ঋতু৷

সন্ধে নামতে শুরু করেছে৷ জানলার ঠিক বাইরে একফালি বাগান করা আছে৷ তার মধ্যে ইতস্তত ছড়ানো ফুলগাছগুলোর উপরেও সন্ধের অন্ধকার নেমেছে৷ একটু একটু করে একটা আলো এসে মিশছে সেই নিকষ অন্ধকারে৷ চাঁদের রূপালি আলো৷

সেদিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঋতুর মনে হয় এ বাড়িটা ঠিক স্বাভাবিক নয়৷ কিছু একটা রহস্য লুকিয়ে আছে এর গভীরে৷ বাড়ির কোনও এক কোনায় এই সন্ধের থেকে বহুগুণ গভীর একটা অন্ধকার জমে আছে৷ অবরুদ্ধ হয়ে আছে কয়েক দশক ধরে৷ বুকটা ছমছম করে ওঠে তার…

(তিন)

৬/এ মল্লিক বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল পুলিশের জিপটা৷ লাফিয়ে জিপ থেকে নেমে এলেন সান্যাল৷ তাঁর ঠিক পিছনে বৃন্দাবন৷ রাত তিনটে বেজেছে এতক্ষণে৷ গোটা পাড়াটা শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে আছে৷ দুটো ভারী বুটের আওয়াজ আর রাস্তার আশপাশ থেকে ভেসে-আসা ঝিঁঝিঁর ডাক ছাড়া অন্য কোনও শব্দ নেই৷

—‘কিন্তু মরা মানুষ কী করে ফিরে আসে স্যার?’ জিপ থেকে নেমে প্রশ্ন করে বৃন্দাবন৷ সুখলাল ড্রাইভ করছিল গাড়িটা, সে বলে, ‘তা-ও আবার যে পঁচিশ বছর আগে মারা গিয়েছে৷’

—‘আমি জানি না, তবে মেয়েটা যে বিপদে আছে, তাতে সন্দেহ নেই৷ বৃন্দাবন, তুমি ফ্রন্ট ডোরটা চেক করো, বন্ধ থাকলে ভেঙে ঢুকতে হবে৷’ সুখলাল গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায়৷ মল্লিক বাড়ির বাইরে গার্ডেন গেটের উপরে টর্চের আলো ফ্যালে৷

সান্যাল খেয়াল করেন, বাড়ির ভিতর থেকে কোনও শব্দ আসছে না৷ কোনও আর্ত চিৎকারও নয়৷ মেয়েটার জন্যে চিন্তা হয় তাঁর৷ হয়তো ঠিক এই মুহূর্তে কিছু একটা ঘটছে বাড়ির ভিতরে৷ ‘যশোদা মল্লিক কীভাবে মারা যায় স্যার?’

—‘শি স্ট্যাবড হারসেল্ফ… ক-দিন আগেই ওর কেস ফাইলটা ঘাঁটছিলাম…’ আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন সান্যাল, প্রসঙ্গটা পালটে বললেন, ‘কিছু একটা গোলমাল আছে ফাইলটায়৷’

—‘কী গোলমাল?’

—‘পরে হবে সেসব, আগে মেয়েটাকে বাঁচানো দরকার, বৃন্দাবন…’ এতক্ষণে গেট পেরিয়ে বাগানের ভিতরে ঢুকেছে বৃন্দাবন৷ ভিতরের দরজাটায় এখন তালা লাগানো৷ পকেট থেকে রিভলভার বের করে সেটার উপর একটা গুলি চালায় সে৷ দরজাটা ভেঙে ভিতরের রাস্তা দেখা যায়….

‘লেট’স গো ইনসাইড…৷’

(চার)

সকালে উঠে মনটা হালকা হয়ে গেল ঋতুর৷ এ বাড়িতে এসে থেকে তিনটে দিন কেটে গেছে৷ এর মধ্যে আর গন্ডগোল কিছু চোখে পড়েনি৷ কাজকর্মের মধ্যে ডুবে গেলে অন্য কিছুর কথা খেয়ালও থাকে না৷ প্রথম দিন সন্ধের সেই ছায়াটার কথা দু-একবার মনে আসেনি তা নয়৷

কিন্তু এ বাড়িটা পুরোনো, বেশির ভাগ দেওয়ালেই কালচে রং ধরেছে৷ তার উপর বেশি আলো জ্বালানো থাকে না৷ চোখের ভুল হওয়া আশ্চর্য না৷

তবে ঋতু খেয়াল করেছে, পাম্প না চললে নৈঃশব্দ্যের সুযোগে বেশ কিছু অবাঞ্ছিত শব্দ কানে আসে তার৷ যেন গোটা বাড়িটাই তাকে কানে কানে কিছু বলতে চাইছে৷ সত্যি কি তেমন কিছু আছে এ বাড়িতে? ভাবনাগুলোকে এড়িয়ে যেতে চায় ঋতু, বারবার৷ সে কাজ করে পয়সা পায়, এসব আজগুবি চিন্তা মনে না-আনাই ভালো৷

এই ক-দিন পরিতোষ মল্লিক বাড়ি ছিলেন না খুব একটা, ফলে দুপুরে খাবার দিতে যেতে হয়নি৷ আজ তিনি বাড়িতে আছেন৷

দুপুর ঠিক একটা বাজতেই একটা প্লেটে পরিতোষের খাবার নিয়ে দোতলায় হাজির হল ঋতু৷ বাড়ির সিঁড়িগুলো সরু-সরু৷ সকাল থেকে পাম্প চলা শুরু হয়েছে৷ তার গনগন আওয়াজ ভেসে আসছে৷ বাড়িটা প্রায় ফাঁকা বলে প্রতিধ্বনিত হয়ে আরও গমগম করছে৷

সিঁড়ি পেরিয়ে দোতলায় উঠলে একটা লম্বা প্যাসেজে এসে দাঁড়াতে হয়৷ সেটা দু-দিকে ভাগ হয়ে গিয়েছে৷ বাঁদিকে গেলে পরিতোষের ঘর৷ সেখানে পৌঁছে টেবিলের উপরে খাবারটা রেখে দেয় ঋতু৷ পরিতোষ ঘুমোচ্ছে৷ মাথার কাছে রাখা রেডিয়োতে পুরাতনী গান বেজে চলেছে৷

বিড়ালের মতো পা টিপে টিপে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে সে৷ নীচে নেমেই যাচ্ছিল, হঠাৎ সেদিন সন্ধ্যায় ছবিতে দেখা যশোদা মল্লিকের চোখটা মনে পড়ে৷ এই তলাতেই তো থাকত সে৷ নিশ্চয়ই প্যাসেজের উলটোদিকের ঘরটা তার ছিল৷ ঘরটা দেখতে ইচ্ছা করছে একবার৷

পায়ে পায়ে হেঁটে প্যাসেজ পেরিয়ে আসে ঋতু৷ এদিকের ঘরগুলোর জানলা বন্ধ৷ ফলে আলো আরও কম৷ তা ছাড়া ধুলো আর মাকড়সার জালের পরিমাণ বেড়ে উঠেছে এদিকটায়৷ মাথার উপরে সাদা সিলিং-এ খয়েরি রঙের ছোপ ধরেছে৷

বুকটা দুরুদুরু করে৷ কে জানে কত বছর কেউ থাকেনি এই ঘরগুলোতে৷

একটা ঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে সে৷ ঘরের দরজাটা এখন খোলা৷ সেই খোলা দরজা দিয়ে তাকাতে ভিতরের দেওয়ালে একটা ছবি ঝুলতে দেখা যাচ্ছে৷ এই ছবিতে একগোছা ফুল হাতে দাঁড়িয়ে আছে যশোদা মল্লিক৷ মাথায় একটা বাঁকানো টুপি৷ কোঁকড়ানো চুলের ঢল কপালের বেশির ভাগটাই ঢেকে ফেলেছে৷ একটা মিহি হাসিও আছে ঠোঁটের পাশে, কালো তিলটার জন্যে আরও মিষ্টি লাগছে হাসিটা৷

এটাই যশোদা মল্লিকের ঘর৷ ঘরে ঢুকে ছবিটার কাছে এগিয়ে আসে ঋতু৷ একদিকের জানলা খুলে দেয়৷ সঙ্গে সঙ্গে একঝাঁক রোদের রেখা মেঝের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে৷ ছবিটা দেওয়াল থেকে খুলে নিয়ে ভালো করে দেখতে থাকে সে৷

যশোদা মল্লিকের মৃত্যুর পর থেকে হয়তো এভাবেই ঝোলানো আছে৷

হলদে রঙের ছাপ পড়েছে ছবির উপর৷ হাত বুলিয়ে সেটা মুছে দেয় ঋতু আর ঠিক সেই সময় মনে হয় ঘরের দরজার কাছ থেকে মৃদু পায়ের আওয়াজ আসছে৷ মুহূর্তে মুখ ফিরে তাকায় সে কেউ নেই৷ দরজা খালি৷ ছবি হাতে ছুটে যায় সে দরজার কাছে৷ নাঃ, প্যাসেজটাও আগের মতোই খালি পড়ে আছে৷

গা-টা ছমছম করে ওঠে৷ বাড়িটা ফাঁকা বলেই কি বারবার মনের ভুল হচ্ছে? দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ করে দেওয়ালে পিঠ রেখে উত্তেজনায় হাঁপাতে থাকে সে৷ পাম্পের শব্দও এতক্ষণে বন্ধ হয়ে গেছে৷ পাশ ফিরে কান রাখে দেওয়ালে, আর সঙ্গে সঙ্গে পুরোনো একটা শব্দ আবার কানে আসে৷ হ্যাঁ… প্রথম দিন সন্ধের সেই ছুরির আওয়াজটা, এবার আগের থেকে আরও জোরে৷ মনের ভুল নয়, সত্যি কিছুর একটা আওয়াজ আসছে দেওয়াল বেয়ে৷ আচমকা একটা শব্দ শুনে সে থরথরিয়ে কেঁপে ওঠে৷ মানুষের গলার আওয়াজ৷ খুব চাপা, প্রায় বুজে-আসা গলায় অস্পষ্ট কিছু শব্দ উচ্চারণ করে চলেছে কেউ৷ ঠিক যেন একটা বন্যপ্রাণী মানুষের স্বর নকল করার চেষ্টা করছে৷

ছিটকে দেওয়াল থেকে সরে আসে ঋতু৷ গায়ের প্রতিটা লোম খাড়া হয়ে উঠেছে ওর৷ মনের ভিতর থেকে কেউ বলে দেয়, একটা ভয়ানক রহস্য লুকিয়ে আছে এ বাড়িতে৷

নীচে তাকায় সে, হাতে ধরা ছবিতে যশোদা মল্লিকের মুখের ঠিক উপরে তার নিজের মুখের প্রতিচ্ছবি এসে পড়েছে৷ মায়াময় চোখ দুটো তুলে একদৃষ্টে ঋতুর দিকে তাকিয়ে আছে যশোদা৷ কিছু কি বলতে চাইছে?

ছবিটা দেওয়ালে তুলে রাখতে গিয়ে থমকে যায় ঋতু৷ ছবিটা যেখানে টাঙানো ছিল সেখানের দেওয়ালে এখন চৌকো রং-ওঠা দেওয়াল বেরিয়ে পড়েছে৷ এতকাল ছবির আড়ালে ঢাকা পড়েছিল জায়গাটা৷

ভালো করে তাকালে বোঝা যায় সেখানে এবড়ো-খেবড়ো সিমেন্টের উপর কয়েকটা ইংরেজি অক্ষর খোদাই করা আছে৷ ধারালো কোনও অস্ত্র দিয়ে কারও নাম খোদাই করে রেখেছে কেউ, অক্ষরগুলো পড়ার চেষ্টা করে ঋতু ‘বি-এ-আর-ইউ…’ পরের অক্ষরটা এম বা এন দুটোই হতে পারে৷ ঋতু আন্দাজ করে নেয় বরুণ৷

কে লিখেছে নামটা? যশোদা? নাকি এই বাড়িতে ‘বরুণ’ নামে কেউ থাকত৷ ঋতুর ভুরু দুটো কুঁচকে যায়, ছবিটা টাঙিয়ে রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে যাচ্ছিল, এমন সময় ছিটকে মাটির উপরে পড়ে সে৷ তিনতলা থেকে একটা শব্দ ভেসে এসেছে এইমাত্র৷ যেন একটা ভারী জিনিসকে মেঝের উপর দিয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে কেউ…

মনস্থির করে নেয় ঋতু৷ এ বাড়ির রহস্য যেভাবেই হোক ভেদ করতে হবে৷ কোনওদিকে না তাকিয়ে সিঁড়ি দিয়ে তিনতলায় উঠতে থাকে৷ কেউ একটা আছে তিনতলায়৷ নিশ্চয়ই আছে৷ এ আওয়াজ মানুষ ছাড়া আর কেউ করতে পারে না৷

সিঁড়ি দিয়ে উঠেই তিনতলার ঘরগুলো চোখে পড়ে৷ দোতলার মতোই ঘরগুলো৷ সব ক-টার দরজা হাট করে খোলা৷ বন্ধ জানলার ফাঁক দিয়ে ক্ষীণ আলো এসে পড়েছে ঘরের ভিতরে৷ দু-একটা পুরোনো ভাঙাচোরা আসবাব রাখা আছে কোনও কোনও ঘরে৷ বাকিটা ফাঁকা৷ কারও পক্ষে সেখানে লুকিয়ে থাকা সম্ভব নয়৷

দৌড়ে দৌড়ে একটার পর একটা ঘরে ঢুকে দেখতে থাকে সে৷ কেউ কোথাও নেই, অস্থির হয়ে ওঠে সে, চাপা গলায় চিৎকার করে ওঠে, ‘কে আছেন এখানে… বেরিয়ে আসুন৷’

ফাঁকা ঘরের ভিতর থেকে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসে শব্দটা৷ কোনও উত্তর আসে না৷ ঋতুর মনে হয়, একটা অদৃশ্য উপস্থিতি যেন তাড়া করছে ওকে৷ কেউ একটানা নজর রাখছে ওর উপরে৷

দৌড়োতে দৌড়োতে সে খেয়াল করে, আবার সেই মানুষের গলার মতো আওয়াজটা শুরু হয়েছে৷ কথা বলার চেষ্টা করছে কেউ৷ দুর্বোধ্য ভাষায় নিজের মনে যেন বিড়বিড় করছে৷

সব ক’টা ঘর দেখে নেয়, সত্যি কোথাও কেউ নেই৷ উত্তেজনায় হাঁপাতে হাঁপাতে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে থাকে৷ আর ঠিক সেই সময় একটা সরু হাতের স্পর্শ এসে পড়ে তার কাঁধে ‘কে…’ কাঁপা গলায় চিৎকার করে মাটিতে বসে পড়ে সে৷

‘আপনি এখানে কী করছেন?’ পরিতোষ মল্লিক দাঁড়িয়ে আছেন৷ ঘুম ভেঙে কোনও এক ফাঁকে উপরে উঠে এসেছেন তিনি৷

ঋতু আমতা আমতা করে, ‘আসলে তিনতলাটা দেখতে ইচ্ছা করছিল…’

—‘দেখতে ইচ্ছা করছিল৷ এখানে দেখার মতো কী আছে?’ পরিতোষের ভুরু কুঁচকে যায়৷

—‘আ… আমার ভুল হয়ে গেছে… আমাকে ক্ষমা করবেন৷’ কথাটা বলে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল ঋতু, হঠাৎ থেমে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘আচ্ছা এ বাড়িতে বরুণ মল্লিক বলে কেউ ছিল?’

পরিতোষের মুখের অভিব্যক্তি কয়েক সেকেন্ডের জন্যে পালটে যায়, একটা চাপা উত্তেজনা মুহূর্তের অসাবধানতায় খোলস ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে৷ পরমুহূর্তে আবার স্বাভাবিক হয়ে যান তিনি, ‘বরুণ… কই না তো৷ কেন বলুন তো?’

—‘কোথায় একটা লেখা আছে দেখলাম যেন৷’

—‘কোথায়?’ পরিতোষ একটু এগিয়ে আসে৷

—‘ঠিক মনে পড়ছে না৷’

—‘আচ্ছা বেশ,’ দীর্ঘশ্বাস ফ্যালে পরিতোষ, ‘মা আপনাকে ডাকছিলেন, কিছু দরকার আছে৷’

সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকে ঋতু৷ বরুণ মল্লিক নামটা উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে পরিতোষের চোখ-মুখ যে বদলে গিয়েছিল সেটা খেয়াল করেছে সে৷ কিছু একটা রহস্য তো অবশ্যই আছে৷ ঋতু মনস্থির করে নেয়, যে রহস্যই থাক, তার সমাধান সে করবেই৷

একতলায় নেমে মিসেস মল্লিকের ঘরে ঢুকতেই ধমক কানে আসে, ‘দরকারের সময় যদি তোমাকে না পাওয়া যায় তাহলে পয়সা দিয়ে রাখা হয়েছে কেন?’

অপরাধীর মতো মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকে সে৷

—‘আমি একটু বাথরুমে যাব, ধরো আমাকে৷’

এগিয়ে গিয়ে মিসেস মল্লিকের একটা হাত কাঁধে তুলে নেয় ঋতু৷ তারপর একটু একটু করে ঘর থেকে বেরিয়ে তাঁকে বাথরুম অবধি পৌঁছে দেয়৷ তিনি ভিতরে ঢুকে যেতে সতর্ক বিড়ালের মতো চারদিকটা দেখে নেয় সে৷ ধীরে ধীরে ল্যান্ড ফোনের কাছে এগিয়ে এসে রিসিভারটা তুলে কানে লাগায়, একটা নম্বর ডায়াল করে৷

ফোনের ওপাশ থেকে শিশির সান্যালের গলা পাওয়া যায়, ঋতু একটু চাপা গলায় বলে, ‘আমি ঋতু বলছি, মামাবাবু৷’

—‘ও, বলো, সব ঠিকঠাক তো?’

‘হ্যাঁ, একটা প্রশ্ন আছে শুধু৷’

—‘এ বাড়িতে বরুণ মল্লিক বলে কেউ ছিলেন কখনও?’

—‘বরুণ? মিস্টার মল্লিকের নাম সম্ভবত ছিল দুর্গাপ্রসাদ, বরুণ বলে কেউ… আচ্ছা দেখছি, দাঁড়াও৷’

ঋতু আর-একবার চারদিকটা দেখে নেয়৷ বাথরুম থেকে জলের আওয়াজ আসছে৷ সম্ভবত স্নান করছেন মহিলা৷ বেরোতে দেরি আছে৷

—‘নাঃ, বরুণ মল্লিক বলে এ অঞ্চলেই কেউ ছিল না কোনওদিন, তবে আমার যতদূর মনে পড়ছে, বরুণ গোস্বামী বলে একজন ল-ইয়ার ছিলেন৷ এই বছর পাঁচেক আগে মারা গেলেন৷ তাঁর সঙ্গে ও বাড়ির যোগাযোগ নেই তো কিছু… কিন্তু তুমি হঠাৎ এসব…’

—‘নাঃ, এমনিই… আপনি ভালো আছেন তো?’

—‘তা আছি৷ কোনও অসুবিধা হলে জানিও৷’

—‘না না, অসুবিধা কীসের, এখন রাখি, মামাবাবু৷’

ফোনটা রেখে আবার বাথরুমের কাছে ফিরে আসে ঋতু৷ এখনও আসছে জল পড়ার শব্দ৷ একটা চাপা উত্তেজনা তার মাথার ভিতরে স্থায়ী জায়গা করে নিচ্ছে৷

যশোদা মল্লিক হঠাৎ অমন নৃশংসভাবে আত্মহত্যা করতে গেল কেন? বরুণ বলে লোকটা কে? তার নামটা শুনে পরিতোষ মল্লিক এমন চমকে উঠলেন কেন? আর তার থেকেও বড় কথা… প্রথম দিন সন্ধের সেই ছায়াটার কথা মনে পড়ে গেল ঋতুর৷

চিন্তাটা মাথা থেকে সরিয়ে মিসেস মল্লিকের ঘরের ভিতরে ঢুকে এল৷ বাথরুম থেকে ঘর অবধি একা আসতে পারবেন না তিনি৷ ঋতুকে ডাক দেবেন৷ ততক্ষণ ফাঁকা পাওয়া যাবে ঘরটা৷

ঘরে ঢুকেই চারদিকটা ভালো করে লক্ষ করল সে৷ ঘরভরতি পুরোনো জিনিস৷ একদিকে কিছু বইপত্র, হিসেবের খাতা ডাঁই করে রাখা আছে৷ দ্রুত সেদিকে সরে এল ঋতু৷ উপরের কয়েকটা খাতা ব্যবসা আর হিসেবপত্র সংক্রান্ত৷ সেগুলো পাশে সরিয়ে রাখল৷ একেবারে তলার দিকে কালো রঙের একটা ডায়েরিতে চোখ আটকে গেল তার৷

ডায়েরির স্পাইনে সাল লেখা আছে, ২০১৩৷ অর্থাৎ ছ-বছর আগের ডায়েরি৷ মিসেস মল্লিকের পারসোনাল ডায়েরি? কী আছে এতে?

ঋতু বাইরেটা আর-একবার দেখে নিয়ে ডায়েরিটা আলোর সামনে মেলে ধরল৷ খুদে অক্ষরে কিছু ঘটনার বিবরণ লেখা আছে কোথাও কোথাও৷ ঋতু শুনেছে, মিসেস মল্লিক নাকি এলাকার মেয়েদের নিয়ে কোনও একটা এনজিও চালাতেন৷

সেই সংস্থার খুঁটিনাটি তথ্য লেখা আছে পাতায় পাতায়৷

হতাশ হয়ে ডায়েরিটা বন্ধ করে দিতে যাবে, এমন সময় একটা পাতায় চোখ আটকে যায় তার৷ কিছু লেখা নেই সেখানে৷ শুধু একটা পুরোনো খবরের কাগজের কাটিং আঠা দিয়ে সাঁটানো আছে৷ আজ থেকে পাঁচ বছর আগের একটা খবর৷

খবরটায় চোখ রাখতেই ঋতুর বুকের ভিতর রক্ত থমকে যায়৷ এই এলাকার এক আইনজীবীর ক্যানসারে ভুগে মৃত্যুর খবর ছাপা হয়েছে সেখানে৷ মৃত আইনজীবীর নাম বরুণ গোস্বামী৷

ডায়েরির ভিতর থেকে আর-একটা কাগজ উড়ে এসে ঋতুর পায়ের কাছে পড়ে৷

(পাঁচ)

ভাঙা দরজার ভিতর দিয়ে ঢুকে এল বৃন্দাবন৷ তার ঠিক পিছন পিছন শিশির সান্যাল৷ দু-দিন আগে ঋতুর কলটা পেয়েই মল্লিক বাড়ির কেস ফাইলটা আবার ঘেঁটে দেখেন তিনি৷ একটা খটকা চোখে পড়ে৷ বরুণ নামটার খোঁজ ঋতু কেন করছিল তা অবশ্য জানতে পারেননি এখনও৷

বন্দুকের আওয়াজে হয়তো এলাকার কিছু লোকের ঘুম ভেঙে গেছে৷ এতক্ষণ নিস্তব্ধ হয়ে ঘুমোচ্ছিল সবাই৷ এবার পাড়ার অন্য বাড়িগুলো থেকে মৃদু গুঞ্জনের শব্দ ভেসে আসতে শুরু করেছে৷

মল্লিক বাড়ির একতলার বসার ঘরে ঢুকে এলেন দু-জনে৷ পিছনে টর্চ হাতে সুখলাল৷ সাদাটে গোল আলো এসে পড়ছে একতলার মেঝের উপরে৷ ডানদিকে সেটা ঘোরাতেই সিঁড়ির ধাপগুলো চোখে পড়ল৷ পাশেই প্যাসেজ ফাঁকা৷ পাম্পের আওয়াজ কানে আসছে৷

—‘আমরা পুলিশ, কেউ সামনে থাকলে হাত তুলবেন…’ চিৎকার করে ওঠেন শিশির সান্যাল৷ অন্ধকারে ডুবে রয়েছে গোটা একতলাটা৷ রিভলভারটা সামনে তুলে ধরে এগিয়ে যান দু-জনে৷

সিঁড়ির ঠিক নীচেই একটা দেওয়ালে ঝোলানো ছবি উলটে পড়ে আছে, ভেঙে গ্যাছে ছবিটা, কাচের টুকরো ছড়িয়ে আছে আশপাশে৷ ছবিটা হাতে তুলে নেন সান্যাল যশোদা মল্লিকের ছবি৷ সেটা নামিয়ে রেখে বৃন্দাবনের দিকে ফেরেন তিনি, ‘আমি একতলাটা দেখছি তুমি উপরে যাও, কিছু গোলমাল দেখলে পায়ে শুট করবে৷ হারি…’

বৃন্দাবন সিঁড়ি দিয়ে উপরে ছুটে যায়, তার পিছন পিছন টর্চ হাতে সুখলাল৷ পকেট থেকে একটা টর্চ বের করে নিজের রিভলভারের উপরে ধরে প্যাসেজের শেষ প্রান্তে এগিয়ে যান সান্যাল৷ পাশাপাশি দুটো ঘর৷ দুটোরই দরজা এই মুহূর্তে খোলা, তিনি আবার চিৎকার করে ওঠেন, ‘ঘরে কেউ থাকলে বেরিয়ে আসুন, ভয়ের কিছু নেই৷’

এক-পা এক-পা করে এগিয়ে যান সান্যাল, অন্ধকারের ভিতরে যেটুকু অংশে সাদা আলো এসে পড়েছে, তাতে দ্যাখা যাচ্ছে, ঘরের এক কোণে দুটো হাঁটুর মাঝে মাথা গুঁজে বসে আছে একটা নারীমূর্তি৷ মৃদু দুলছে যেন তার শরীরটা৷

—‘মিসেস মল্লিক…’

কোনও উত্তর আসে না শরীর থেকে৷ আগের মতোই মুখ ঢেকে দুলছে, বিড়বিড় করে উচ্চারণ করে চলেছে কিছু৷ সান্যাল আরও এগিয়ে যান, একটা হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করতে যান মূর্তির মাথাটা৷ ছিটকে পিছিয়ে আসেন তিনি, মুখ তুলেছেন মিসেস মল্লিক, কিন্তু সে মুখের ডান প্রান্ত থেকে বাঁ প্রান্ত অবধি লম্বা ফালা হয়ে কাটা একটা দাগ, রক্তের ধারা বেরিয়ে আসছে সেই কাটা জায়গাটা থেকে৷ রক্তমাখা মুখেই খলখল করে উন্মাদের মতো হেসে চলেছেন মিসেস মল্লিক, ওঁর বিড়বিড় উচ্চারণ এতক্ষণে ভাষা পেয়েছে —‘বেশ করেছি৷ যা করেছি, বেশ করেছি৷ অবাধ্য মেয়েদের বরদাস্ত করি না আমি, কেউ শাস্তি দিতে পারবে না আমাকে… বেশ করেছি…’ আকাশ বিদীর্ণ করে হাসতে থাকেন তিনি৷

—‘কী করেছেন আপনি?’

প্রশ্নটা করার সঙ্গে সঙ্গে একটা জমাট অন্ধকার আছড়ে পড়ে সান্যালের গায়ে৷ সামলে নিয়ে সেদিকে টর্চ ফেলে চেনা মুখ দেখতে পান তিনি, ঋতু… উদভ্রান্তের মতো চেহারা ওর৷ গায়ে রক্তের ছিটে লেগে আছে৷ হাতে ধরা একটা ধারালো ছুরি৷ সান্যাল পিছিয়ে এলেন… অজান্তেই বন্দুকটা উঠে আসে ঋতুর দিকে৷

—‘আপনি…’ কোনওরকমে উচ্চারণ করে সে, ‘আপনি বাঁচান আমাকে৷ যশোদা ফিরে এসেছে… এই বাড়িতেই৷’

মিসেস মল্লিকের হাসির আওয়াজ আরও বেড়ে ওঠে৷

—‘ইমপসিবল… পঁচিশ বছর আগে মরে যাওয়া মানুষ ফিরে আসতে পারে না… ইমপসিবল…’

—‘তাহলে তিনতলার ঘরে যাকে দেখালাম… আপনি প্লিজ…’ হাত দিয়ে উপরের দিকটা দেখায় ঋতু৷ অব্যক্ত শব্দ মুখে রেখেই তার অবচেতন শরীর মাটির উপরে লুটিয়ে পড়ে৷

(ছয়)

মাঝরাতে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে ঋতু৷ আজ রাতে সে ঘুমোয়নি৷ উত্তেজনায় ঘুম পায়ওনি তেমন৷ ঘরের দরজাটা অল্প একটু খুলে বাইরে মুখ বাড়িয়ে সে দেখে নেয়, একতলায় কেউ আছে কি না৷ কেউ নেই৷

পা টিপে টিপে বাইরে বেরিয়ে আসে৷ মিসেস মল্লিকের ঘরে একবার উঁকি দেয়৷ হ্যাঁ, ঘুমোচ্ছেন, কোনও সন্দেহ নেই৷

ঋতুর একহাতে টর্চ, অন্য হাতে একটা পুরোনো হলদেটে কাগজ৷ আজ সকালে এই কাগজটাই খসে পড়েছিল ডায়েরির ভিতর থেকে৷ একটু কোণের দিকে সরে এসে টর্চ জ্বেলে কাগজটায় কিছু একটা মিলিয়ে নেয় ঋতু৷ তারপর আবার সিঁড়ি দিয়ে উঠতে থাকে৷

ঋতু বুঝতে পারে না, ওর ঠিক পিছনে আরও সতর্ক পায়ে কেউ নজর রাখছে ওর উপর৷ এ বাড়ি এমনিতেই অন্ধকার৷ তার উপরে এখন রাত বলে সমস্ত বাতি নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে৷

দোতলা পেরিয়ে তিনতলায় উঠে আসে সে৷ প্যাসেজের শেষ প্রান্তের জানলার পাল্লা এখন খোলা, সেখান দিয়ে মিহি চাঁদের আলো এসে ঢুকছে এখন৷ প্যাসেজের মেঝের উপর জটিল রুপোলি নকশা কাটা রয়েছে৷ টর্চটা নিভিয়ে দেয়৷ বিশেষ একটা ঘরের দিকে এগিয়ে আসে৷

দীর্ঘদিনের অব্যবহারে এ ঘরের দরজার হুড়কোগুলো অকেজো হয়ে গ্যাছে৷ আর লাগানো যায় না৷ লাগানোর দরকারও পড়ে না৷

দরজার পাল্লাগুলো টেনে দিয়ে ঘরের ভিতরে ঢুকে আসে সে৷ জানলা খুলে হাতের কাগজটা মেলে ধরে মুখের সামনে৷ চাঁদের আলোয় চোখে পড়ে কাগজের উপরে আঁকা নকশাটা৷ এ বাড়ির ঘরগুলোর নকশা৷

তিনতলা জুড়ে সব ক-টা ঘর ছক কেটে দেখানো আছে সেখানে৷ শুধু তিনতলার একেবারে মাঝামাঝি দুটো ঘরের পিছনে একটা আট ফুট বাই আট ফুটের চৌকো অংশ খালি রাখা আছে৷ পরে কেউ লাল রং দিয়ে ভরে দিয়েছে জায়গাটা৷

ঋতু হিসেব করে দেখেছে, আজ সকালে যে ঘরে দাঁড়িয়ে তিনতলার শব্দটা সে শুনেছিল সেটা ওই ফাঁকা অংশটার সোজাসুজি নীচে৷ অর্থাৎ জায়গাটা ফাঁকা নয়৷ কিছু একটা আছে ওখানে৷ উত্তরটা সহজ—একটা লুকোনো ঘর৷ কিন্তু কী রাখা আছে সেখানে?

ঘরের একদিকে এগিয়ে এসে দেওয়ালে একটা টোকা দেয় ঋতু৷ নাঃ, এ জায়গাটা ফাঁপা নয়, পাশে সরে এসে আবার টোকা দেয়, এখানটাও নিরেট৷ হঠাৎ চোখে পড়ে, ঘরের এককোণে একটা পুরোনো জামাকাপড় রাখার আলনা আছে৷ আলনার নীচের দিকে টর্চ ফ্যালে ঋতু৷ সঙ্গে সঙ্গে মাথায় বিদ্যুৎ খেলে যায়৷

আলনার ঠিক নীচে বেশ খানিকটা জায়গায় ধুলো এলোমেলো হয়ে আছে, অর্থাৎ মাঝে মাঝে সরানো হয় আলনাটা৷ মানে গোপন ঘরের দরজা আলনার পিছনেই আছে৷

কসরত করে আলনাটা সরিয়ে ফ্যালে ঋতু৷ তারপর তিনটে আঙুল দিয়ে টোকা দেয় পিছনের দেওয়ালে৷

দেওয়ালের ওপাশ থেকে ফাঁপা আওয়াজ আসছে৷ এখানে দেওয়ালটা সিমেন্টের নয়, কাঠের৷ রং করে সিমেন্টের মতো করে রাখা হয়েছে৷ সিঁড়ির কাছ থেকে খসখস করে শব্দ আসছে একটা৷ কেউ উপরে উঠে আসছে৷ ঋতু ঘাবড়ায় না৷ চাকরি গেলে যাক, তার আগে এই মল্লিক বাড়ির রহস্যের সমাধান সে করবেই৷

জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে থাকে ঋতু, দুটো হাত কাঠের দেওয়ালের উপরে রেখে সজোরে দু-দিকে টানতে থাকে সে৷ সরসর করে আওয়াজ হয় একটা৷ আরও জোর লাগবে, আরও জোর দরকার হাতে৷ পায়ের আওয়াজ ঘরের প্রায় ভিতরে ঢুকে এসেছে৷

একটু একটু করে খুলে যায় পাল্লাটা৷ পিছন থেকে মিসেস মল্লিকের হিমশীতল গলা কানে আসে, ‘এই বয়সের মেয়েদের মরার এত সাধ জাগে কেন বল-তো? তোর মতো বয়সেই আমার মেয়েটাও গেল… আর আজ তুই…’

একবারের জন্যে পিছন ফিরে তাকিয়ে ঋতু দ্যাখে, জ্যোৎস্না মেখে দাঁড়িয়ে আছেন মিসেস মল্লিক৷ তাঁর হাতে একটা ছুরির ফলা চকচক করছে৷ এতটা সিঁড়ি উঠে আসতে কষ্ট হয়েছে মহিলার৷ মুখটা হাঁ করে বড়বড় নিশ্বাস নিচ্ছেন তিনি৷ চেরা হাসি লেগে আছে মুখের একপ্রান্তে৷

ঋতু বুঝল, মিসেস মল্লিক তাকে বেঁচে বেরোতে দেবেন না এখান থেকে৷ কী এমন লুকোনো আছে ঘরের ভিতর? সামনে তাকাল সে৷

কাঠের দরজাটা এখন খুলে গ্যাছে৷ ভিতরের জমাট অন্ধকারের বুক থেকে ভেসে আসছে একটা বুনো জন্তুর কণ্ঠনালি নিঃসৃত কোনও শব্দ৷ সেই সঙ্গে একটা তীব্র অমানুষিক দুর্গন্ধ৷ ঋতুর মনে হল, এখুনি অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়বে সে৷

কাঁপা-কাঁপা হাতে টর্চটা সামনে ধরল সে৷ আর সঙ্গে সঙ্গে তার চলন্ত হৃৎপিণ্ড কয়েক সেকেন্ডের জন্যে বন্ধ হয়ে গেল৷ ঘরের ভিতরে এক পলকের জন্যে যে নারকীয় প্রাণীটাকে চোখে পড়েছে, তার সঙ্গে মানুষের কোনও মিল নেই৷ ঠিক যেন মানুষের কিছু ভাঙা হাড়কে চামড়ার মধ্যে জড়িয়ে তাতে চোখ-মুখ এঁকে দিয়েছে কেউ৷

সেই জড়ানো থলেতে স্পন্দন আছে৷ দুটো হাত সামনে তুলে ধরে আলো থেকে চোখ আড়াল করতে চাইছে সে৷ মুখগহ্বর থেকে বেরিয়ে আসছে অবর্ণনীয় গোঙানির শব্দ৷

আর্ত চিৎকার করে পিছিয়ে আসে ঋতু৷ সঙ্গে সঙ্গে মিসেস মল্লিকের ছুরি তার গলা ছুঁয়ে চলে যায়৷ কোণঠাসা বিড়ালের মতো অমানুষিক শক্তি এসে ভর করে ঋতুর গায়ে৷ সে ঝাঁপিয়ে পড়ে মিসেস মল্লিকের উপর৷ ছুরিটা কেড়ে নিয়ে চালিয়ে দেয় মহিলার মুখ লক্ষ্য করে৷ কাতর চিৎকার করে ওঠেন মিসেস মল্লিক৷ রক্তে ভরে ওঠে ঋতুর হাত৷ তারপর কোনওদিকে না তাকিয়ে ছুটতে থাকে একতলার দিকে৷

একতলায় পৌঁছে ছুরিটা একহাতে ধরেই ফোনের রিসিভারটা তুলে নেয় সে৷ পুলিশের নম্বর ডায়াল করতে থাকে৷

(সাত)

সুখলাল আর বৃন্দাবন এতক্ষণে তিনতলায় উঠে এসেছে৷ দোতলায় পৌঁছে মাটিতে পড়ে-থাকা একটা দেহ দেখতে পেয়েছে দু-জনে৷ পরিতোষ মল্লিক৷ ছুরি দিয়ে আঘাত করা হয়েছে তার পায়ে৷ আঘাত যে ঋতুই করেছে তাতে সন্দেহ নেই৷

ভদ্রলোকের জ্ঞান আছে এখনও৷ উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন তিনি৷

তাঁকে দোতলাতেই রেখে তিনতলায় উঠে এল তিনজন৷ জোরালো টর্চের আলো এখন এসে পড়ছে ঘরগুলোর ভিতরে৷ ঘরটা চিনে নিতে ভুল হল না সান্যালের৷

—‘এদিকে এসো, সামথিং ইজ গোইং অন হিয়ার৷’

গোঙানির আওয়াজটা শুনতে পেয়েছেন সান্যাল৷ একটা বন্যপ্রাণী যেন অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করছে৷ মৃত্যু ঘনিয়ে আসছে তার৷

তিনজনে এসে দাঁড়ালেন কাঠের দরজাটার সামনে৷ সুখলাল পকেট থেকে রুমাল বের করে নাকে চেপে ধরল৷ পেটের ভিতরটা গুলিয়ে উঠছে গন্ধে৷ টর্চের আলো এখন গিয়ে পড়েছে দরজার ভিতরে৷ একটা ছোট আট ফুট বাই আট ফুটের ঘর আলোকিত হয়ে উঠেছে তাতে৷

ঘরের ভিতরে ছড়িয়ে আছে কিছু যন্ত্রপাতি, মলমূত্র আর অভুক্ত খাবারের টুকরো, সেই খাবারের টুকরো খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে একটা মানুষের মতো দেখতে উলঙ্গ প্রাণী৷ ভালো করে লক্ষ করলে বোঝা যায়, তার একটা মুখ আছে, চুল আছে, চোখ আছে, ঠিক যেন একটা ভেঙে-যাওয়া কঙ্কালের গায়ে মানুষের গা থেকে খুলে আনা চামড়া জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে৷

চোখে আলো পড়তে তীব্র বিরক্তি প্রকাশ করে ঘরের এককোণে সরে যায় প্রাণীটা৷ মাটির উপরে উলটে শুয়ে আলো আড়াল করে৷

—‘হোয়াট দ্য হেল ইজ দিস?’ সান্যালের মুখ থেকে অজান্তেই বেরিয়ে আসে শব্দগুলো৷

—‘আমার বোন, যশোদা মল্লিক…’ ওদের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন পরিতোষ মল্লিক, একটা হাত দিয়ে হাঁটু থেকে ঝরে পড়ে রক্ত চাপা দেওয়ার চেষ্টা করছেন কোনওমতে, একসময়ে ডাকসাইটে সুন্দরী ছিল, বিশ্বাস করুন…’

(আট)

—‘কিন্তু এটা তো…’ সান্যাল প্রায় আর্তনাদ করে ওঠেন৷

—‘মানুষ বলে মনে হচ্ছে না, তা-ই তো?’

সান্যাল আবার টর্চ ফেলেন প্রাণীটার গায়ে, একটু আগেই সিঁড়ির কাছে যশোদা মল্লিকের ছবিটা দেখেছেন তিনি, নাঃ, এ অসম্ভব৷

দেওয়ালের একদিকে হেলান দিয়ে বসে পড়েন পরিতোষ মল্লিক, ‘আজ পঁচিশ বছর হল এই ঘর থেকে বেরোতে দেওয়া হয়নি ওকে৷ গোটা পৃথিবীর কাছে আমার বোন মৃত৷ দু-তিনদিনে একবার জল আর খাবার দেওয়া হয়৷ টয়লেট যা করার ওই ঘরেই…’

—‘মাই গড! কিন্তু কেন?’ সান্যাল বিশ্বাস করতে পারছেন না এখনও৷ পরিতোষ মল্লিক হাসেন, ‘কেন? পঁচিশ বছর বয়সে বরুণ গোস্বামী নামে এক লইয়ারের প্রেমে পড়ে আমার বোন৷ তাকে বিয়ে করতে চায়৷ লোকটার পয়সাকড়ি তেমন ছিল না৷ ফলে আমার মায়ের মত ছিল না বিয়েতে৷ বোনও জেদ ধরে বসে৷ অগত্যা মা ওকে ঘরে বন্দি করে দেয়, খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দেয়৷ কিন্তু যশোদা কিছুতেই ভাঙতে চায় না, দু-পক্ষের জেদের মাঝে পঁচিশটা বছর কেটে গ্যাছে৷ আমার বোন মানুষ থেকে কীসে পরিণত হয়েছে, দেখতেই পাচ্ছেন…’

কয়েক সেকেন্ডের থমথমে নিস্তব্ধতা এসে গ্রাস করে ঘরটাকে৷ শুধু খোলা কাঠের পাল্লার ভিতর থেকে বীভৎস কুৎসিত প্রাণীটার মুখ থেকে বেরিয়ে আসা অস্ফুট শব্দ কানে আসছে৷

হাঁটু মুড়ে মাটিতে বসে পড়েন সান্যাল, ‘আপনি যা বলছেন সেটা বিশ্বাস করা অসম্ভব৷ কেবল এই কারণে পঁচিশ বছর নিজের মেয়েকে এভাবে…’

—‘আমার মাঝে মাঝে খারাপ লাগত জানেন, ভাবতাম, মানুষটাকে এভাবে অত্যাচার করার থেকে একেবারে মেরেই ফেলি৷ কিন্তু নিজে হাতে বিষ খাওয়াতে পারিনি কোনওদিন৷ সপ্তাহে দু-দিন দরজার তলার ফাটল দিয়ে ওকে খাবার দিয়ে যেতাম… ভাবতাম, একদিন এসে দেখব, খাবার পড়ে আছে, নিশ্চিত হব, মরে গেছে৷ কিন্তু ও মরেনি… মরেনি… কেন যে এতদিন বেঁচে আছে…’ চোখ ঝাপসা হয়ে আসে মল্লিকের৷

—‘আপনি কোনওদিন বলেননি কাউকে?’

চোখ মুছে মাথা নাড়ান পরিতোষ, ‘আমি মায়ের অবাধ্য হইনি কোনওদিন৷ যশোদা যে আত্মহত্যা করেছে, সে গুজবটা আমার মা-ই ছড়িয়ে দেয় এলাকায়৷ বীভৎস রক্তারক্তির কথা শুনে কেউ বডি দেখতে আসেনি৷ তা ছাড়া এই এলাকায় মায়ের একটা আলাদা সম্মান ছিল৷ পুলিশকেও মা নিজেই ম্যানেজ করে৷’

সান্যাল মাথা নাড়ান, ‘হুম৷ পুলিশ ফাইলসেও যশোদা মল্লিকের ঘটনার তেমন ভিভিড বর্ণনা নেই৷ যেন এই মৃত্যুটা গোটা পুলিশ ডিপার্টমেন্ট স্রেফ এড়িয়ে যেতে চেয়েছে৷ সেটা দেখেই সন্দেহ হয় আমার৷’

—‘কয়েক বছর হল মা-কে বলেছি, এবার ওকে মুক্তি দাও তুমি৷ আর তো মরতে কিছু বাকি নেই ওর৷ মা রাজি হয়নি, ওকে কষ্ট দিয়ে কেন জানি না মনে মনে একটা তৃপ্তি পেত মা৷ মায়ের দেখাশোনার জন্যেই সারাদিনের লোক রাখি আমি৷ মা দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে শুনত যে আমি যশোদার কথা তাকে বলছি কি না…’

দু-হাতে মাথার চুল খামচে ধরেন শিশির সান্যাল৷ গোটা ব্যাপারটা এখনও অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে তাঁর৷ ঘরের ভিতর থেকে সেই প্রাণীটার গোঙানির শব্দ ভেসে আসছে এখনও৷ বুকের ভিতর উত্তেজনাটা প্রতিমুহূর্তে ছলকে উঠছে সেই শব্দে৷ মানুষ এতটা নৃশংসও হতে পারে, সে ধারণা আগে ছিল না ওঁর৷ পায়ের আওয়াজ শুনে দরজার দিকে মুখ ফেরায় সবাই৷ ঋতু উঠে এসেছে সিঁড়ি বেয়ে৷ তার একহাতে ধরা একটা কাচ-ভাঙা ছবি৷ সেটা নিয়ে সে এগিয়ে যায় কাঠের দরজার খোলা পাল্লাটার দিকে৷ টর্চের আলো ভিতরে এসে পড়লে দেখা যায়, কুৎসিত, উলঙ্গ সেই প্রাণীটা সরু সরু হাতে মনের খেয়ালে একটা ধাতব পাতকে ঘষছে মাটির উপরে৷ কখনও ঘষা থামিয়ে পাতটা কামড়ানোর চেষ্টা করছে৷ দাঁতগুলো প্রায় অবশিষ্ট নেই বললেই চলে৷ এত বছরে শক্ত কিছুতে কামড় দিতে গিয়ে ভেঙে গ্যাছে হয়তো৷

তার সামনে এগিয়ে গিয়ে নোংরা মেঝেতেই বসে পড়ে ঋতু৷ অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে হাড় উঁচু হয়ে থাকা ক্ষতবিক্ষত মুখটার দিকে৷ ফোঁসফোঁস করে নিশ্বাস ফেলছে মানুষটা৷

পঁচিশ বছর আগের ডাকসাইটে সুন্দরী যশোদা মল্লিকের ছবিটা তার সামনে তুলে ধরে ঋতু৷ মায়াময় হরিণের মতো দুটো চোখ, নিটোল মখমলের মতো চামড়া আর ঠোঁটের পাশে তিল৷ হলদে হয়ে যাওয়া ছবিতেও ঝরে পড়ছে তার অপরূপ লাবণ্য৷

অবোধ বানরের মতো ছবিটা হাতে নেয় প্রাণীটা৷ কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকে ছবির মানুষটার দিকে৷ আচমকা ছবির একটা কোনা কামড়ানোর চেষ্টা করে, তারপর ছুড়ে ফেলে দেয় মেঝের উপর…

ব্লাঙ্ক মনিয়ের জন্ম হয় ১৮৪৯ সালে, ফ্রান্সে৷ দক্ষ শিল্পীর হাতে তৈরি শ্বেতপাথরের মূর্তির মতো রূপ ছিল তাঁর৷ পঁচিশ বছর বয়সে এক আইনজীবীর প্রেমে আবদ্ধ হন তিনি৷ তাঁর মা এই বিয়েতে মত দেন না ও মা এবং দাদা মিলে জোর করে ব্লাঙ্ককে বাড়ির একটি ছোট ঘরে বন্ধ করে দেন৷ পঁচিশ বছর সেই ঘরের ভিতরেই অর্ধভুক্ত ও রোগগ্রস্ত হয়ে কাটান তিনি৷ এর মধ্যে একবারের জন্যেও এই ঘর থেকে বেরোতে দেওয়া হয়নি৷ নিজের মল, মূত্র, রক্তর উপরেই দিনরাত কাটত তাঁর৷ বেশির ভাগ দিন খাবার ও জল কোনওটাই জুটত না৷ বছরের পর বছর এই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে, অনাহারে বন্দি থাকার ফলে ব্লাঙ্ক কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেন৷ জটিল রোগ এসে বাসা বাঁধে শরীরে৷ পঁচিশ বছর পরে যখন তাকে উদ্ধার করা হয় তখন পঞ্চাশ বছরের ব্লাঙ্কের ওজন ছিল মাত্র ২৩ কেজি৷ চামড়া ও মাংসের বেশির ভাগটাই পোকামাকড়ে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলেছিল৷

ব্লাঙ্ক মনিয়ের মা-কে গ্রেফতার করা হয় ও তাঁর বিচার হয়৷ পনেরো দিন পরে বাড়ির বাইরে জমা হওয়া উন্মত্ত জনতার রোষ দেখে ভয় পেয়ে তিনি মারা যান৷ দাদা মারসেল মনিয়ে বেকসুর খালাস পেয়ে যান৷

উদ্ধারের পর ফ্রান্সের একটি মানসিক হাসপাতালে রাখা হয় ব্লাঙ্ককে, সেখানে ১৯২৩ সালে, চৌষট্টি বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়৷ ব্লাঙ্কের বন্দিদশার খবর পুলিশ পায় একটি উড়োচিঠি মারফত৷ সে চিঠি কে লেখেন তা আজও জানা যায়নি…

সকল অধ্যায়

১. ফাঁদ
২. ফুটোস্কোপ
৩. সিয়াং পাহাড়
৪. লাজারুস
৫. রাত তিনটের পর
৬. উইন্ডচাইম
৭. রাইম
৮. কুয়ো
৯. পঁচিশ বছর পর
১০. কাঠের ঘোড়া
১১. শিশুরা অকারণেই কাঁদে
১২. সুর
১৩. মায়াবৃক্ষ
১৪. ডানাওয়ালা মানুষ
১৫. দেবলীনার আশ্চর্য ক্ষমতা
১৬. ঝম্পো
১৭. বাদাবনের বেকহ্যাম
১৮. দোতলার ঘর
১৯. এখানে কেউ দেবতা নয়
২০. ইশারায়
২১. আমরা কিন্তু হাসছি না
২২. শুকনো গোলাপ
২৩. খেয়া
২৪. স্মাইল
২৫. ভোর হবে
২৬. মিনু আর আমদুসিয়াসের সুর
২৭. মিনুর লাল ঘুড়ি আর লামিয়া
২৮. ঝুমুর
২৯. বিলুপ্ত বিশ্ব
৩০. দেবদূত
৩১. চিজ বার্স্ট
৩২. সে
৩৩. শর্টকাট
৩৪. বিরহিণী
৩৫. চিরকালের গল্প
৩৬. প্রেমাস্পদ গুপ্ত সমিতি
৩৭. যেতে চাইলে যেতে দেব না
৩৮. বৃষ্টি পড়ার দিনে
৩৯. তুমি ঠোঁটে নিও খড়কুটো
৪০. বিকেল রঙের মেয়ে
৪১. শুঁড়
৪২. মিও আমোরে
৪৩. অনিন্দিতা
৪৪. রাঙিয়ে দিয়ে যাও
৪৫. বিজয়া দশমী

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন